বাংলার বাণী
ঢাকা: ২৫শে সেপ্টেম্বর, বুধবার, ৮ই আশ্বিন, ১৩৮১
রেল পরিবহনের নৈরাজ্য!
খামখেয়ালীপনা বললে ঠিক হয়না-পাগলের কারখানাও বলা যেতে পারে রেল জগতের দুর্নীতি ও নৈরাজ্যকে। সংবাদপত্রের বিশেষ প্রতিবেদন প্রকাশিত নির্দিষ্ট একটি ঘটনাকে কেন্দ্র করে একজন সুস্থ স্বাভাবিক ও সচেতন নাগরিক অন্তত সে কথা মনে করতে পারেন। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে যে, ঢাকা থেকে আখাউড়া রেল ভ্রমণের টিকিটে স্টেশন দুটির মধ্যে দূরত্ব ও ভাড়ার যে মূল্য ছাপা থাকে তা তিন-চার রকমের। বিভ্রান্ত যাত্রীসাধারণ দূরত্ব নিয়ে মাথা না ঘামালেও কেউ কেউ ঢাকা আখাউড়া ভাড়ার তারতম্য দেখে অধিকতর বিভ্রান্ত হয়েছেন।
জৈনিক যাত্রীর অভিজ্ঞতা সূত্র থেকে প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে যে ১৯শে জুলাই যাত্রীটি ঢাকা আখাউড়া যাওয়ার সময় একটা দ্বিতীয় শ্রেণীর টিকিট ১০.১০ টাকা মূল্যের বিনিময়ে সংগ্রহ করে। কিন্তু ওই টিকিটের উপরে ৬.৯৫ টাকার ভাড়া অংক ছাপা ছিল। এ ব্যাপারে অনুসন্ধান করলে টিকিট টিকিটের প্রকৃত মূল্য ৯.৮৫ টাকা বলে জানান। এবং বাকি ২৫ পয়সা অতিরিক্ত কিছু দূরত্বের (অ্যাডিশনাল মাইলেজ) জন্য ধার্য করা হয়েছে বলে জানান। এসব কথার পর টিকিট বদলে দেয়া হয় এবং তার দাম ধরা হয় ১০.০০ টাকা। তারপরে এক জায়গায় একটি টিকিট চার্টে দেখা যায় যে, ঢাকা আখাউড়ার দ্বিতীয় শ্রেণির ট্রেনের টিকিট ভাড়া ৯.৮৫ টাকা। একই যাত্রী সূত্রে প্রাপ্ত অভিযোগের বিবরণ দিয়ে ওই প্রতিবেদনে জানানো হয় যে, আগস্টে তিনি ঢাকা আখাউড়ার একটি দ্বিতীয় শ্রেণীর টিকিট ৯.০০ টাকায় সংগ্রহ করেন। বর্তমানে ওই দূরত্বের জন্য টিকিটে ৮.৩৫ টাকা দাম ছাপা আছে। টিকেট সংগ্রহের ব্যাপারে এই বিভ্রান্তিকর অবস্থায় পড়ে যাত্রীটি একটি লিখিত নালিশ পেশ করেন নালিশ বই-এ। সেই নালিশ বইটি আত্ম পর রহস্যজনকভাবে চুরি হয়ে যায় বলে প্রতিবেদন সূত্রে জানানো হয়।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে একই দূরত্বের জন্য একাধিক মূল্য মানে টিকিট বিক্রি কি করে হয়? টিকিটের ছাপা থাকে একরকম আর দাম নেয়া হয় অন্যরকম এই বা হয় কেমন করে। শুধু তাই নয়, এক্সট্রা মাইলেজের জন্য বাড়তি পয়সা সংগ্রহের অধিকারই বা টিকিট দাতারা কোথা থেকে পেল? শুধু তাই নয়, টিকিটে ঢাকা আখাউড়ার দূরত্ব ৮৮ মাইল লেখা থাকলেও যেহেতু ৮৯ মাইলের ভাড়া আদায় করা হয় সেহেতু যাত্রীসাধারণের জিজ্ঞাসা জাগতে পারে প্রকৃতপক্ষে ঢাকা হাওড়া দূরত্ব কত খানি।
টিকিটের এই ব্যাপারটি খুব মারাত্মক একটা কিছু না বললেও অবহেলা করা যায় না কখনই। কারণ প্রতিদিন প্রায় হাজার হাজার রেলযাত্রী ওই একই দুর্ভোগ তথা টিকেট সংগ্রহের ঝক্কি ও বিভ্রান্তিতে পড়েন-এটা সুখের বা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ জন্য গৌরবের কথা নয়। একথা অস্বীকার করা যায় না যে একটা দেশের সার্বিক চলমানরত পরিবহন ব্যবস্থার উপর অনেকাংশে নির্ভরশীল। আবার স্থল, বিমান ও নৌ পরিবহন এর মধ্যে আমরা বেশি নির্ভর করি স্থল পরিবহনের উপরই। স্থল পরিবহন প্রধানত রেল সড়ক ও যানবাহন সড়ক কেন্দ্রিক। এর মধ্যে রেল পরিবহন অধিকাংশ সাধারণ যাত্রী বহন করে থাকে। এসব যাত্রীরা প্রতিদিন গ্রাম ও শহরের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করেন। তাদের দুর্ভোগ বাড়লে আর যাই হোক দেশের শান্তি বাড়বে না।
রেল নৈরাজ্য শুধু কি একরকম? ট্রেনের কামরা গুলোতে আলো পাখা প্রায়ই থাকেনা। প্রথম শ্রেণীর কামড়াতে বসলো প্রায় পেটের খাদ্য উগলে আসার জো হয়। কামরা সংলগ্ন বাথরুমগুলো দুরবস্থা ভাষায় বর্ণনা করা সম্ভবই নয়। প্রথম শ্রেণীর কামরা সম্বন্ধে এমন অভিযোগ একজনের নয়-বহুজনের। অতএব তার একটা ভিত্তি তো নিশ্চয়ই আছে এবং প্রথম শ্রেণীর এই অবস্থার প্রেক্ষিতে তৃতীয় শ্রেণীর অবস্থা সহজেই অনুমেয়। তার ওপর আছে যাত্রীসাধারণের সুবিধামতো চেন টেনে ট্রেন থামিয়ে বাড়ির কাছে নেমে যাবার বেপরোয়া আচরণ। যেখানে সেখানে লোকাল ট্রেন তো বটেই মেল ট্রেনও তারা অনায়াসে থামাচ্ছে চেন টেনে। তারপর মাল পড়ে ধুপ-ধাপ; মানুষ লাফ দেয় ঝুপ-ঝাপ। এগুলো যে সত্যিই নিয়ন্ত্রণ করা যায় না-এ কথা বিশ্বাস করা কষ্টসাধ্য নাকি রেল কর্তৃপক্ষ পাগলামি দেখে ওরাও পাগল হতে চলেছে।
বড় কথায় কাজ নেই। আমরা চাই সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা। টিকিট সরবরাহের মতো সহজ কাজে এত নৈরাজ্য, গাফিলতি বরদাস্ত করা যায় না। আবার এসব নিয়ে নালিশ করলে সেই নালিশ সহ বইও হারিয়ে যায়। এই উদ্দেশ্যপ্রণোদিত কাজেরও ক্ষমা আমাদের চোখে নেই। অসংখ্য যাত্রী সাধারণের অভাব-অনটনক্লিষ্ট জীবনে এহেন দুর্গতি ও ভোগান্তি ডেকে এনে কিছু কর্মচারী নির্বিকার থাকতে পারলেও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ যেন চুপ করে না থাকেন এই আমাদের ঐকান্তিক আবেদন। সুষ্ঠু ও নৈরাজ্যের আবর্তে পড়ে অবশেষে আমরা সবাই অপ্রকৃতস্থ হয়ে যাবো-এ হতে পারে না।
উন্নয়নশীল রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক সমস্যা
একটি-দুটি নয় সবগুলো উন্নয়নশীল দেশের প্রায় এক অবস্থা। সততা এবং আন্তরিকতা যদি এসব দেশের সরকার ও প্রশাসনযন্ত্রের সাধারণ গুণাবলী হিসেবে ধরে নেয়া যায় তবে যে সমস্যাগুলো এসব দেশ মোকাবিলা করছে তার চরিত্রেও মৌলিক সাদৃশ্য পরিলক্ষিত হবে। সম্প্রতি প্রকাশিত রিপোর্টে উন্নয়নশীল দেশের অর্থনৈতিক সমস্যার গুরুত্ব এবং তাদের সাদৃশ্য সম্পর্কে বাস্তব চিত্র তুলে ধরা হয়েছে।
বলা হয়েছে শুধু চুয়াত্তর সালে উন্নয়নশীল দেশগুলোর উন্নত রাষ্ট্রসমূহের নিকট থেকে দীর্ঘমেয়াদী ঋণ হিসেবে দু’শো ষাট কোটি ডলারের প্রয়োজন হবে। পচাত্তর সালে তা বেড়ে দাঁড়াবে ন’হাজার ছয়শো আশী কোটি ডলারে। এই টাকা তাদের শুধু বাণিজ্যিক লেনদেন এর ঘাটতি পূরণের জন্যই প্রয়োজন হবেনা। বরং নয়া বিনিয়োগ এবং সার-খাদ্যশস্য ক্রয়ের জন্য এই টাকা তাদের দরকার. এছাড়া রয়েছে নিত্যপ্রয়োজনীয় ব্যবহারিক সামগ্রী আমদানি খাতে ব্যয়। উন্নত এবং সম্পদশালী রাষ্ট্রগুলো যদি এদের সাহায্যে এগিয়ে না আসে তবে তা উন্নয়নশীল রাষ্ট্র গুলোর অর্থনৈতিক অবস্থার উপর মারাত্মক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করবে। বর্তমান যেসকল রাষ্ট্রকে উন্নয়নশীল বলে আখ্যায়িত করা হয় তাদের উন্নয়নের পথে যাত্রা খুব বেশিদিনের নয়। দীর্ঘদিনের উপনিবেশিক শাসন থেকে মুক্ত হবার পর তারা অর্থনৈতিক স্বয়ম্ভরতা অর্জনে প্রচেষ্টা শুরু করে পঞ্চাশের দশকে। কিন্তু রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রে ব্যাপক জনস্বার্থের অনগ্রসরতা, অর্থনীতির ওপর সাম্রাজ্যবাদী প্রভাব প্রভৃতি পঞ্চাশের দশকে উন্নয়নশীল দেশগুলোর অর্থনৈতিক অগ্রগতির পথে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে। পশ্চাত্য অর্থনীতিবিদরা তাই সত্তর দশকে উন্নয়নশীল দেশগুলোর অর্থনৈতিক উন্নয়নের দ্বিতীয় দশক হিসেবে চিহ্নিত করতেই আগ্রহী। বিশ্বব্যাংকের রিপোর্টে উন্নয়নশীল দেশগুলোর অর্থনৈতিক অগ্রগতিতে সম্পদশালী বিশ্বের সাহায্যের ওপর গুরুত্ব দিতে গিয়ে বলা হয়েছে এই সকল দেশ তাদের উন্নয়নের দ্বিতীয় দশকে জাতীয় উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্য বা নির্ধারিত করেছিলেন আন্তর্জাতিক সাহায্য ব্যতিরেকে তা অর্জন করা সম্ভব নয়। এমনকি সেই রিপোর্টে উন্নয়নশীল দেশের অগ্রগতি বৃথা হয়ে যাওয়ার আশঙ্কাও প্রকাশ করা হয়েছে।
চল্লিশের দশকের শেষাশেষি স্বাধীনতা লাভের পর ভারত যে স্বাভাবিকতা নিয়ে অর্থনৈতিক অগ্রগতি সাধন এর তৎপর হয়েছিল পাকিস্তানের অংশ হিসেবে তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানের পক্ষে তা সম্ভব হয়নি। ভারত বিভক্তি পূর্ব পাকিস্তানের শাসন চরিত্রে তেমন কোনো গুণগত পরিবর্তন আনতে সক্ষম হয়নি। এই অঞ্চলের ওপর পাকিস্তানের শাসন ছিল উপনিবেশিক প্রকৃতির। স্বাভাবিক ভাবেই স্বাধীন অর্থনৈতিক বিকাশের পর এখানে কোনদিনই উন্মুক্ত হতে পারেনি।
অর্থনৈতিক অগ্রগতি অর্জনের স্বাধীন নীতি প্রণয়নের অধিকার পেতে আমাদের বহুদিন সংগ্রাম করতে হয়েছে। সর্বশেষ এই দশকের গোড়ার দিকে রাজনৈতিক স্বাধীনতা এবং সেই সঙ্গে স্বাধীন অর্থনীতি গড়ে তোলার অধিকার স্বীকৃত হয়েছে এই অঞ্চলের। বাংলাদেশ স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। একটা উপনিবেশিক কাঠামোর ডেকে স্বাধীন অবনতি গড়ে তোলার প্রচেষ্টা এই প্রথম।
একই সঙ্গে সারা বিশ্ব অর্থনৈতিক সংকট জটিলতার হয়ে উঠেছে। বিশেষ করে তৈরি সংকট এই অর্থনৈতিক জটিলতা আরো কয়েকগুণ বাড়িয়ে তুলেছে। শিল্পোন্নত দেশ সমূহ তাদের উৎপাদনের বাড়তি খরচটি আদায় করে নিচ্ছেন অনুন্নত এবং উন্নয়নশীল আমদানিকারক রাষ্ট্রসমূহের কাছ থেকে।
বিশ্বব্যাংকের রিপোর্টে প্রকাশিত অর্থনৈতিক সমস্যার চিত্রটির তাই আমাদের অতি পরিচিত। যেমন অতি প্রয়োজনীয় ব্যবহারী জিনিস আমদানী করতে তেমন শিল্পায়ন এবং কৃষি আধুনিকরণের মাধ্যমে স্বনির্ভরতা অর্জনের জন্যও আমাদের বৈদেশিক মুদ্রা দরকার। আর এই প্রয়োজনীয় বৈদেশিক মুদ্রা যেহেতু একমাত্র উৎপাদনকারী রাষ্ট্রগুলির ছাড়া অন্য কোনো দেশের পক্ষে অর্জন করা সম্ভব নয় সেইহেতু বৈদেশিক সাহায্য এবং সহযোগিতা একান্ত আবশ্যক। গোটা বিশ্ব অর্থনৈতিক দিক থেকে বিভক্ত হয়ে পড়েছে। কাঁচামাল রপ্তানিকারক উন্নয়নশীল রাষ্ট্র আর উৎপাদিত পণ্যের রপ্তানি কারক শিল্পসমৃদ্ধ দেশ। এ দুয়ের সহযোগিতা পারস্পরিক স্বার্থেই প্রয়োজন। বিশ্বব্যাংক রিপোর্টের গুরুত্ব উন্নত রাষ্ট্রসমূহ নিশ্চয়ই উপলব্ধি করতে পারবেন এবং সারা দুনিয়ায় আশঙ্কিত একটা অর্থনৈতিক বিপর্যয় রোধে এবং দায়িত্বশীল পদক্ষেপ গ্রহণ করবেন বলে আমাদের বিশ্বাস।
কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক