বাংলার বাণী
ঢাকাঃ ৪ঠা ডিসেম্বর, বুধবার, ১৮ই অগ্রহায়ণ, ১৩৮১
খাদ্য সংগ্রহ অভিযানের মন্থর গতি
খাদ্য সংগ্রহ অভিযান শুরু হবার পর দুই সপ্তাহেরও বেশি সময় চলে গেছে। সংসদ অধিবেশন মুলতবি রেখে সংসদ সদস্যদের পাঠানো হয়েছে নিজ নিজ এলাকায়, বঙ্গবন্ধুর কড়া নির্দেশ এবারের খাদ্য সংগ্রহ অভিযান অবশ্যই সফল করে তুলতে হবে। সরকারি দল আওয়ামী লীগ এমনকি গণ ঐক্য জোটের নেতৃবৃন্দ বৈঠক করে সর্বশক্তি নিয়ে খাদ্য সংগ্রহ অভিযান সফল করে তোলার ঘোষণা করেছেন। অথচ অভিযান এগোচ্ছে মন্থর গতিতে। বাধ্যতামূলক সংগ্রহ আজ পর্যন্ত স্বেচ্ছা লেভীর পর্যায়েই রয়েছে। নিজে থেকে যারা সংগ্রহ কেন্দ্রের নিজেদের উদ্ধৃত চাল জমা দিচ্ছে তাদের ছাড়া খাদ্য সংগ্রহের কোন পরিকল্পনা উদ্যোগ আজ পর্যন্ত গৃহীত হয়নি।
সরকারি সূত্রের উদ্ধৃতি দিয়ে বার্তা সংস্থা খবর দিয়েছে আগামী দশ তারিখ থেকে নাকি সংগ্রহ অভিযান জোরদার করে তোলা হবে। তাদের মতে ওই সময় যত ফসল কাটার মৌসুম পুরোদমে শুরু হবে সেহেতু তখনই লেভী সংগ্রহের মোক্ষম সময়। ওই সূত্রের মতে দশই ডিসেম্বর থেকে দু মাস সংগ্রহ অভিযান চলবে।
অভিযানের দুই সপ্তাহের খতিয়ান যা প্রকাশ পেয়েছে তাতে সংগ্ৰহের পরিমাণ প্রায় ৩৩ হাজার মণ। এর মধ্যে ধান ২৫ হাজার এবং চাল প্রায় আট হাজার মণ। অথচ শতকরা প্রায় ২০-২৫ ভাগ ধান ইতিমধ্যে কাটা হয়ে গেছে।
আসলে অভিযানের শুরুটা খুব সুখপ্রদ নয়। বাধ্যতামূলক লেভীর জন্য প্রয়োজনীয় কাগজপত্র এখনো তৈরি হয়নি। কার উপর কত লেভী ধার্য করা হবে তাও আজ পর্যন্ত নির্ধারিত হয়নি। সরকারের গোচরে যাই আনা হোক না কেন ইউনিয়ন পর্যায়ের এ্যাসেসমেন্ট কমিটি গঠনেই এখন পর্যন্ত সম্ভব হয়নি। সংসদ সদস্যরা সবাই নিজ নিজ এলাকায় গিয়ে পৌঁছতে পারেননি। ঢাকা থেকে ফিরে গিয়ে জেলা মহাকুমা শহরগুলোতে অবস্থান করছেন অনেকেই। কেউ কেউ ইউনিয়ন চেয়ারম্যানেদের ডেকে নানাবিধ পরামর্শ দিয়েই নিজেদের দায়িত্ব সারতে চাচ্ছেন।
সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ যা তা হল খাদ্য সংগ্রহ অভিযান এর স্বপক্ষে কোন প্রকার রাজনৈতিক তৎপরতা শুরু হয়নি। ঢাকার বৈঠকি আশ্বাস কার্যে পরিণত হয়নি। পক্ষান্তরে স্বার্থন্বেষী মহল এমনকি কোনো কোনো রাজনৈতিক দল সংগ্রহ অভিযানের বিরুদ্ধে জনগণকে বিভ্রান্ত করে চলেছে। ক’দিন আগের দুর্ভিক্ষের করুণ চিত্র জনগণের মন থেকে মুছে যায়নি। এই সংগ্রহ অভিযান যে ভবিষ্যতে খাদ্য সংকট প্রতিরোধের সহায়ক হতে পারে এমন কোনো ধারণা কৃষকদের মধ্যে সৃষ্টি করার ব্যাপারে দায়িত্বশীল রাজনৈতিক মহলে কোনো তৎপরতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে না। ফলে স্বার্থান্বেষীদের অপপ্রচার কৃষকদের মনে দানা বাঁধছে। আর সেই সুযোগে মজুমদার ও চাল ব্যবসায়ীরা হাতিয়ে নিয়েছে কৃষকদের গোলার ধান। এই অবস্থা আর কিছুদিন চলতে থাকলে অভিযান জোরদার করেও সংগ্রহ করার মতো চাল পাওয়া যাবেনা। কালো পথে তা পাড়ি জমাবে মজুতদার আর ব্যবসায়ীদের কালো থলিতে।
আমরা সংসদ সদস্য এবং প্রগতিশীল রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের কাছে পুর্নবার আহবান জানাচ্ছি, বাকসর্বস্ব প্রগতিশীলতায় কাজ হবে না। ঢাকায় বুক ফুলিয়ে নিজেদের হিম্মত জাহির করেও ফল হবে না। বঙ্গবন্ধুর সবার কার্যক্ষমতা যাচাইয়ের সুযোগ দিয়েছেন। এটাই হয়তো তাদের শেষ সুযোগ। খাদ্য সংগ্রহ অভিযানের ব্যর্থতা দেশের অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক অবস্থার উপর কি মারাত্মক প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করতে পারে তা নিশ্চয়ই নতুন করে বলার অপেক্ষা রাখে না। ভুলে গেলে চলবেনা খাদ্য সংগ্রহ অভিযান সফল করার মাধ্যমে আমরা হাজার হাজার মানুষকে অনাহারে মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা করতে পারি। এটি তাই সকল দায়িত্বশীল মানুষের কর্তব্য। জনগণের সার্বিক সহযোগিতার মাধ্যমে খাদ্য সংগ্রহ অভিযানকে সফল করে তোলার সময় এবং সুযোগ এখনও শেষ হয়ে যায়নি। রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ এবং সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ অভিযানের গুরুত্ব উপলব্ধি করে সমস্ত শক্তি নিয়োজিত করতে কুণ্ঠাবোধ করবেন না বলে আমাদের বিশ্বাস।
ইথিওপিয়ায় গৃহযুদ্ধের পদধ্বনি
দিনদিন ইথিওপিয়ায় সংকট ঘনীভূত হচ্ছে। সামরিক বাহিনীর হাতে ইথিওপিয়ার সমস্ত ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত হবার পর রাজতন্ত্রের সমর্থকরা ক্ষমতাসীন সরকারের প্রতি বৈরী হয়ে ওঠে। নভেম্বরের শেষের দিকে প্রাক্তন সম্রাট হাইলে সেলাসির পৌত্র এবং দুজন প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী সহ ৬২ জন প্রাক্তন পদস্থ সামরিক এবং বেসামরিক কর্মকর্তাকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়। মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্তদের মধ্যে ক্ষমতাসীন সামরিক পরিষদের চেয়ারম্যান জেনারেল আমান আন্দমও ছিলেন। তিন হাজার বছরের সমাজতন্ত্রের অবসান ঘটানোর জন্য সামরিক বাহিনী এই ৬২ ব্যক্তিকে বিনা বিচারে হত্যা করেছেন এবং সামরিক শাসক গোষ্ঠীর মৃত্যুদণ্ডের ‘ন্যায়বিচার’ বলেই অভিহিত করেছেন। যারা দেশের মধ্যে দুর্নীতি, কুশাসন এবং সামরিক বাহিনীর মধ্যে বিভেদের আগুন ছাড়া ছিলেন তাদের ভাগ্যে জুটেছে এই মৃত্যুদণ্ড। এরপর সামরিক শাসক গোষ্ঠী আরো ১৪০ জনকে বন্দী করেছেন, সামরিক আদালতে এদেরও বিচার করা হবে। প্রাক্তন সম্রাট হাইলে সেলাসি অন্তরীণা বদ্ধ হয়েছেন। তিনি সুইস ব্যাংকের সঞ্চিত তার সমুদয় সম্পত্তি জনগণের কল্যাণে দেশের খরাপীড়িত দের জন্য ব্যয় করতে সম্মত হয়েছেন এবং সামরিক শাসক গোষ্ঠীর কাছে একটি দলিলে স্বাক্ষর দিয়েছেন। এ ঘটনার পরেই ইথিওপিয়ার রাজধানী আদ্দিস আবাবায় বেশ কয়েকটি বোমা বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটেছে। সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনাটি ঘটিয়েছেন ইথিওপিয়ার ক্ষমতাচ্যুত রাজশাসনের সাবেক নেতা ইজাজ ম্যাচ আঝুলা বেকেলে। তিনি সামরিক শাসকদের কাছে আত্মসমর্পণ করতে অস্বীকৃতি জ্ঞাপন করেন। শুধু আত্মসমর্পণে অস্বীকৃতি নয়, সেনাবাহিনীর সঙ্গে প্রকাশ্যে সংঘর্ষেও লিপ্ত হন। সংঘর্ষ তার মৃত্যু হয়েছে কি তিনি বেঁচে আছেন, সে সংবাদ এখনো আমাদের অজ্ঞাত। তবে গোলাগুলির আগেই সামরিক শাসক গোষ্ঠীর রাজধানীতে কড়া নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহণ করেছেন। রাজধানী আদ্দিস আবাবায় এখন সেনাবাহিনী টহল দিয়ে বেড়াচ্ছে।
ইথিওপিয়ায় কতিপয় ব্যক্তি শাসনের নামে শোষণ ও বঞ্চনার রাজত্ব কায়েম করেছিলেন। প্রাক্তন সম্রাট হাইলে সেলাসির চারপাশে যেসব রাজতন্ত্রের সমর্থক ছিলেন তারা সবসময়ই চাটু বৃত্তিতে ছিলেন মগ্ন। ফলে, হাইলে সেলাসী জনগণের দুর্দশা সম্পর্কে ছিলেন সম্পূর্ণ অন্ধকারে। একমাত্র এ কারণে ইথিওপিয়া ভয়াবহ দুর্ভিক্ষের কবলে পড়েছিল। রাজতন্ত্রের যুগের মানুষ রাতারাতি ফুলে ঢোল হয়েছিলেন, আর দেশের বেশিরভাগ মানুষই ছিলেন অর্থনৈতিক দিক দিয়ে পঙ্গু, পর্যুদস্ত। কিন্তু সামরিক বাহিনী সম্রাটের রাজপ্রাসাদ দখল করে যখন তাকে ‘জনগণের সম্পত্তিতে’ পরিণত করেন তখন থেকে ইথিওপিয়ার রাজতন্ত্রের প্রকাশ্যে উচ্ছেদ ঘোষণা সূচিত হয়। সামরিক শাসক গোষ্ঠী ইথিওপিয়াকে জনগণের দেশে পরিণত করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। কিন্তু রাজতন্ত্রের অবসান এর সঙ্গে সঙ্গে জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষা মূর্ত হয়ে উঠবে, এমন মনে করার কারণ নেই। ইথিওপীয় সেনাবাহিনীর মধ্যে বিভেদ আছে। সামরিক বাহিনীর মধ্যে দুটি ভিন্ন ধর্মী শিবির রয়েছে তাদের একটি চায় দ্রুত পরিবর্তন সাধিত করে দেশে বৈপ্লবিক কর্মকাণ্ড সূচিত করা হোক। অপর দল ধীরে ধীরে সমস্ত সমস্যার সমাধান কামনা করেন। এতদিন দুটি দলের ঐক্যবদ্ধভাবে সমন্বিত কর্মসূচি অবলম্বন করে এগিয়েছেন। কিন্তু বর্তমানের সামরিক বাহিনীর এই দুটি শিবিরের মধ্যে অসহিষ্ণুতা প্রকট হয়ে উঠেছে। যারা রাজতন্ত্রের সমর্থক, তাদের প্রতি ক্ষমতাসীন সামরিক সরকার কড়া নীতি অবলম্বন করেছেন। ক্ষমতাসীন সামরিক সরকার ইরিত্রিয় মুক্তিসংগ্রামের প্রতি কি মনোভাব পোষণ করেন, তা এখনও স্পষ্ট হয়ে ওঠেনি। ইথিওপিয়ার সাম্প্রতিককালে যে লক্ষণগুলো দেখা যাচ্ছে, তাতে এ কথাই মনে হওয়া স্বাভাবিক যে, সেখানে একটি গৃহযুদ্ধের পদধ্বনি শোনা যাচ্ছে। কারণ ৬২ জনের মৃত্যুদণ্ডকে কেন্দ্র করে বিদেশী সমালোচকরা সমালোচনা করেছেন, তার জবাবে ইথিওপীয় পত্র-পত্রিকাগুলো সোচ্চার মন্তব্য প্রকাশ করতে কার্পণ্য করেনি। পত্র পত্রিকা গুলোর অভিমত হচ্ছে, জনগণের কল্যাণের জন্য সেনাবাহিনীর যেসব ব্যবস্থা গ্রহণ করেছেন, সেগুলোর হেরফের ঘটাতে সামরিক পরিষদ রাজি নন। ক্ষমতাসীন সামরিক সরকার জনগণের কল্যাণের জন্য যেসব ব্যবস্থা অবলম্বন করেছেন, তা থেকে কোনরকম বিচ্যুতি ঘটবে না। বাইরের সমালোচকরা যাই বলুক না কেন, সামরিক শাসক গোষ্ঠী তাদের সিদ্ধান্তে অটল থাকবেন। এ থেকে সুস্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হচ্ছে যে, রাজতন্ত্রের পূজারীদের সঙ্গে ক্ষমতাসীন সামরিক সরকারের একটি বোঝাপড়া হতে আর দেরি নেই। ক্ষমতাসীন সামরিক শাসক গোষ্ঠী ইথিওপিয়াকে জনগণের কল্যাণের স্বার্থে কিভাবে এগিয়ে নিয়ে যাবেন, সেটাই এখন পর্যবেক্ষণের বিষয়। শুধু ক্ষমতা হস্তান্তরিত হলেই জনগণের মুক্তি আসেনা। জনগণের মুক্তি বাস্তব কর্মপন্থার মধ্যে নিহিত।
কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক