বাংলার বাণী
২০শে আগস্ট, সোমবার, ১৯৭৩, ৩রা ভাদ্র, ১৩৮০ বঙ্গাব্দ
ঔষধ নিয়ে ছিনিমিনি খেলা বন্ধ করুন
ঔষধ কেউ সখ করে সেবন করে না জীবন ধারণের জন্যেও এর তেমন প্রয়োজন পড়ে না কিন্তু জীবন বাঁচানোর জন্যে এর প্রয়োজন যে কত অধিক সে কথা বলাই বাহুল্য। তাই জরারোগ ব্যাধি থেকে আত্মীয় পরিজনকে বাঁচানোর জন্যে প্রয়োজনীয় ঔষধের নিমিত্তে প্রিয়জনেরা শেষ সম্বলটুকু উজাড় করে দিতেও কুণ্ঠিত হয় না। অথচ সেই জীবনরক্ষাকারী ঔষধ নিয়েও ছিনিমিনি খেলা শুরু করেছে বলে পত্রিকান্তরে প্রকাশ। অবশ্য, খবরটি নতুন নয়, মাস দু’তিন আগে এমনিতর খবর আরেকবার প্রকাশ পেয়েছিলো। আশার কথা, প্রকাশিত সে খবরের প্রেক্ষিতে সরকার ঔষধের কালোবাজারী বন্ধ ও বিদেশ থেকে বৈদেশিক মুদ্রা খরচ করে আনীত ঔষধ ন্যায্যমূল্যের ঔষধের দোকানের মাধ্যমে বিক্রির ব্যবস্থা করলে বেশ কিছুদিন জীবনরক্ষাকারী ঔষধ সহ অন্যান্য ঔষধপত্র মোটামুটি সুষ্ঠুভাবে জনগণের হাতে পৌঁছেছিলো। কিন্তু দুঃখের বিষয় এই অবস্থা বেশীদিন স্থিতিশীল থাকতে পারেনি। থাকতে পারেনি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের নিষ্ক্রিয়তা অথবা অবহেলার জন্যে। প্রকাশিত খবর অনুসারেও সে কথা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।
নিত্যপ্রয়োজনীয় অন্যান্য দ্রব্যের কিছুসংখ্যক ব্যবসায়ীদের ন্যায় ঔষধ ব্যবসায়ে লিপ্ত বেশ কিছুসংখ্যক অসাধু ব্যবসায়ী জনগণের বর্তমান অর্থনৈতিক সংকটের সুযোগে অধিক মুনাফা লাভের বাসনায় দোকানে ঔষধ থাকা সত্ত্বেও ‘নেই’ বলে জবাব দেন। কিন্তু সেই দোকানেই উক্ত ঔষুধের অধিক মূল্য দিলে পরে পাওয়া যায়। উক্ত অসাধু ঔষধ বিক্রেতাদের এহেন জঘন্য মনোবৃত্তি ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পেয়ে চলেছে। ফলে বাজারে সরকার কর্তৃক আনীত ঔষধ থাকা সত্ত্বেও জনগণ সেই সব দুষ্কৃতিপরায়ণ ঔষধ বিক্রেতাদের কাছ থেকে অধিক মূল্যে ঔষধপত্র কিনতে বাধ্য হচ্ছেন। আর এর ফলে যেখানে অর্থের অভাবে দু’বেলা আহার সংগ্রহ করা সম্ভব হয়ে উঠছে না সেখানে অধিকমূল্যে ঔষধ ক্রয় করা দুঃসাধ্য হয়ে পড়ছে। পরিণতিতে বিনা চিকিৎসায় অকালে মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যেতে হচ্ছে বহু রোগীকে।
আমাদের বিশ্বাস, ঔষধের কালোবাজারীদের কার্যকলাপ বন্ধ করা খুব বেশী একটা কঠিন কাজ নয়। ইতিপূর্বে বিদেশ থেকে আমদানীকৃত ঔষধ বিনামূল্যে বিক্রির ব্যবস্থা গ্রহণের পর অদ্যাবধি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কেউ উক্ত ব্যবসায়ীরা ঠিকমতো ঔষধ বিক্রি করেছে কি না তা পরীক্ষা করে দেখেননি। এবং সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের এই উদাসিনতার সুযোগে উক্ত ব্যবসায়ীরা ভুয়া রসিদের মাধ্যমে বিদেশ থেকে আমদানী করা ঔষধ বিক্রি না করেই তা লুকিয়ে রেখে বিক্রি হয়ে গেছে বলে ক্রেতাদের জানান। কিন্তু উক্ত ঔষধের বেশী দাম দিতে চাইলেই আবার তা পেতে কষ্ট হয় না।
অন্যান্য দ্রব্যের ন্যায় জীবনরক্ষাকারী ঔষধ নিয়ে যারা ছিনিমিনি খেলছে তাদের এই মানবতাহীন কার্যকলাপকে অবশ্যই দমন করতে হবে। এজন্যে সরকারকে অবশ্যই সতর্কতা অবলম্বন করে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের মতো ঔষধের প্রয়োজন না হলেও মৃত্যুর মুখোমুখি হয়ে কিংবা রোগের যাতনা থেকে মুক্তি পাবার জন্যে শেষ অবলম্বন জীবনরক্ষাকারী ঔষধও যদি জনগণের হাতে ঠিকমতো না পৌঁছে তাহলে এর চেয়ে বেদনাদায়ক ও লজ্জার আর কিছু থাকবে না।
প্রসঙ্গতঃ বলা প্রয়োজন যে, ইতিমধ্যে বন্যায় প্লাবিত বিভিন্ন এলাকা থেকে পানি সরে যেতে শুরু করেছে। পানি সরে যাবার পর পরই সেসব জায়গায় বিভিন্ন অসুখ মহামারী আকারে দেখা দিয়ে থাকে। ইতিমধ্যে বিভিন্ন স্থান থেকে মহামারী আকারে অসুখ-বিসুখের খবর আসতে শুরু করেছে। এ সব এলাকায় যেমন প্রয়োজনীয় ঔষধপত্র পাঠানো দরকার তেমনি সঙ্গে সঙ্গে লক্ষ্য রাখতে হবে সে সব ঔষধ যেন কালোবাজারী বা অসাধু ব্যবসায়ীদের হাতে না পড়ে। অতীতে রিলিফ হিসেবে বিদেশ থেকে প্রেরিত বিভিন্ন ত্রাণ সংস্থার মাধ্যমে পাওয়া ঔষধপত্রের কালোবাজারীর খবরও আমরা পেয়েছি। সুতরাং সেদিকেও সতর্ক নজর রাখতে হবে। মনে রাখতে হবে, যেকোন মূল্যে জীবনরক্ষাকারী ঔষধের ছিনিমিনি খেলা অবশ্যই বন্ধ করতে হবে।
সেই রামও নেই, সেই অযোধ্যাও নেই
বিশ্বাস করুন আর না-ই করুন, মফস্বল এলাকার পোস্ট মাস্টাররা নাকি এখনো মাত্র পঁচিশ টাকা বেতনে চাকুরী করে যাচ্ছেন। তথ্যটা অনেকের কাছেই বিশ্বাসযোগ্য নাও হতে পারে। কারণ বর্তমানের দুর্মূল্যের বাজারে দেশের কোন পরিবারের পঁচিশ টাকা মাইনে দিয়ে জীবিকা নির্বাহ হয় কিনা তা একটি গগণচুম্বী প্রশ্ন বটে। কারণ, চালের মণ যেখানে একশত টাকা সেখানে শুধুমাত্র পঁচিশটি টাকা একটি মাসের বেতন হিসেবে নিতান্তই নগণ্য। পত্রিকান্তরে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে জানা গেছে, পোস্ট মাস্টারদের পঁচিশ টাকা প্রদানের আইন ১৮৮৬ সালে প্রণীত হয়েছিলো যখন ইংরেজ বেনিয়া কোম্পানীর গোলামীর জিঞ্জিরে আমরা শৃঙ্খলিত ছিলাম। বৃটিশের শাসনের গৌরব রবি আজ অস্তমিত হয়েছে। পাকিস্তানী ঔপনিবেসিকতা থেকেও আমরা আজ মুক্ত, স্বাধীন। সমাজতান্ত্রিক লক্ষ্য অর্জনের জন্যে আমরা আজ সম্মুখপানে অগ্রসরমান। প্রকাশিত খবরে জানা গেছে যে, বাংলাদেশ পোস্টাল ই, ডি কর্মচারী সমিতি এই অভিশপ্ত আইনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ মুখর হয়ে উঠেছে। তাঁরা সরকারের কাছে তাঁদের দুঃখ দুর্দশা লাঘবের জন্যে আবেদন জানিয়েছেন। আয়োজন করেছেন বিক্ষোভ মিছিলের। এই বিক্ষোভ মিছিলে দূর-দূরান্তের গ্রাম থেকে প্রায় শতাধিক পোস্টাল ই,ডি কর্মচারী অংশ গ্রহণ করেছিলেন। জানা যায়, আগেকার দিনে নাকি জমিদাররা তাঁদের পোষ্য পোস্ট মাস্টারদের খাওয়া পরা বাবদ ঔ পঁচিশ টাকা মাসোহারার ব্যবস্থা করেছিলেন। এবং পরবর্তীকালে ইংরেজ সরকার জমিদারদের দেয় ভাতাই আইন করে পোস্ট মাস্টারদের জন্যে মাইনে নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছিলো। কিন্তু রামও নেই, সেই অযোধ্যাও নেই। বেচারী মফস্বল পোস্ট মাস্টারদের কপাল মন্দ। তাই দেশ স্বাধীনতা প্রাপ্তির পরও তাদের সেই সনাতন যুগের অবসান, দুঃখ কষ্ট লাঘব তো সুদূরপরাহত। পঁচিশ টাকা মাইনেতে কেউ কোন কাজ করে, এ যুগেও তা বিশ্বাস করা নিতান্তই কষ্টসাধ্য ব্যাপার। কাজেই আমরা সরকার সমীপে আবেদন করি যে, মফস্বল এলাকার পোস্ট মাস্টারদের চতুর্থশ্রেণীর সরকারী কর্মচারীদের সমতুল্য বেতন প্রদানের ব্যবস্থা করা হোক। নইলে এই ঘোরতর দুর্দিনের বাজারে ঐসব হতভাগ্য পোস্টমাস্টারদের বেঁচে থাকার কোন পথ নেই।
কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক