You dont have javascript enabled! Please enable it!

বাংলা বাণী
ঢাকাঃ ৯ই আগস্ট, শুক্রবার, ২৩শে শ্রাবণ, ১৩৮১

“মানুষের প্রতি বিশ্বাস হারানো পাপ”

আশ্চর্য নীরবতার মধ্য দিয়ে এবারের বাইশে শ্রাবণ এসেছিল। প্রতি বছর এই দিনে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মৃত্যু বার্ষিকী উদযাপনের একটা আয়োজন ও সাড়া পরিলক্ষিত হয়। কারণ বাঙালি জাতির সাহিত্য ও সংস্কৃতির সঙ্গে কবিগুরুর সমগ্র জীবন ও কর্ম অঙ্গীভূত। আমাদের মুখের ভাষা আন্তর্জাতিক গৌরবে গৌরবান্বিত হয়েছে তারই প্রতিভা বলে। শুধুমাত্র তারই সযত্ন পরিচর্যার উপযুক্ত লালনে বাংলা ভাষার লেখ্য ভঙ্গিতে এসেছে অভূতপূর্ব বৈচিত্র্য ও নৈপূণ্য। এবং বাংলা সাহিত্যের সকল শাখা হয়েছিল পূর্ণতর।
কাল ছিল তারই মৃত্যুবার্ষিকী। তার সৃষ্টিকর্মের মধ্যে দিয়ে তাঁকে স্মরণ করার এমন সময়ে এলো যখন প্রাকৃতিক তান্ডব লীলায় সমগ্র দেশ বিপর্যস্ত। সর্বগ্রাসী বন্যায় দেশের প্রায় অর্ধেক এরও বেশী স্থলভাগ জলে নিমজ্জিত সোয়া দুই কোটির জনজীবন বন্যাকবলিত, লক্ষ লক্ষ একর ফসলি জমি সলিল শয্যায় বন্ধ্যা জননীর মতো নিথর, কোটি কোটি টাকার ফসলসহ বিবিধ মালামাল ধুয়ে গেছে। বাংলাদেশের আকাশ-বাতাস মুখরিত হয়েছে কোটি কোটি মানুষের আহাজারিতে। পত্র পত্রিকার পাতায় বিপন্ন মানবতার মর্মান্তিক ছবি। এক কণা খাদ্যদ্রব্য, একটুকরো পরিধেয় বস্ত্র, একবিন্দু মাটির আশ্রয়ের জন্য মানুষ আজ অধীর। নদীমেখলা শস্য-শ্যামলা বাংলার মাটিতে ভালোবাসা মাথা ঠেকানো বা পরমাত্মীয়ের শেষশয্যা রচনা করারও যো নেই কোথাও। পানি-সর্বত্র পানি। চোখের আর বন্যার পানি।
এরই মধ্যে বাইশে শ্রাবণ চলে গেল। বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে ত্রাণশিবির গড়া হয়েছে। ক্ষুদার্ত ও সর্বহারা দলের জন্য আশ্রয় শিবির গড়ে তোলা হয়েছে। অপর্যাপ্ত ত্রাণসামগ্রীর জন্য অগণিত মানুষ, শকুন, সুযোগসন্ধানী ও নরমাংসলোভীর দল একই সঙ্গে শিবিরগুলোর আশেপাশে ঘুরঘুর করছে। বিপন্ন মানবতার মধ্যে ততোধিক বিপন্ন জীবনের অসহায়ত্বের সুযোগ নিতে সচেষ্ট রয়েছে আদিম কামনার ধারকরা। ব্যস্ত-সবাই ব্যস্ত।
আমাদের স্বদেশভূমি আজ ক্রন্দসী। এই প্রসঙ্গে একটা প্রশ্ন জাগছে-বাংলাদেশ কি স্বদেশভূমি বা আমার দেশ বলা যায়? রবীন্দ্রনাথ এই প্রসঙ্গে বলেছেন ‘দেশে জন্মগ্রহণ করেছি বলেই দেশ আমার এ হচ্ছে সেইসব প্রাণীর কথা যারা বিশ্বের ব্যাপারে পরাসক্ত।’ আজকে আমরা যা করছি-তা কি এর চেয়ে কোনো অংশে উত্তম? এ দেশে জন্মেছি বলেই এদেশ আমার বলে দাবি করছি। এদেশের সম্পর্কে দ্ব্যর্থহীনভাবে জবরদস্তির অংশীদারিত্ব করছি। মানুষের ধর্ম ও এ নয়। সে সম্বন্ধে রবীন্দ্রনাথ বলেছেন- ‘মানুষের যথার্থ স্বরূপ হচ্ছে তার আত্মশক্তি সম্পন্ন অন্তর প্রকৃতি; এই জন্য যে দেশকে মানুষ আপনার জ্ঞানে বুদ্ধিতে প্রেমে কর্মে সৃষ্টি করে তোলে সে দেশেই তার।’’
এরই প্রেক্ষিতে যদি আত্মজিজ্ঞাসা করি- আমাদের অন্তর প্রকৃতি এবং দেশকে আপনার জ্ঞান বুদ্ধি প্রেম ও কর্ম দ্বারা সৃষ্টি করে তুলতে চেয়েছি কিনা-তাহলে উত্তর যোগাবেনা। স্বাধীনতা সংগ্রামের নয়টি মাসে সে সাধনা বাঙালি শুরু করেছিল। দেশ গড়ার স্বপ্ন ধ্যান-জ্ঞান, কর্ম, নিষ্ঠা ও কর্তব্য চেতনার তিল তিল উপকারের নৈবেদ্য দান শুরু হয়েছিল মাত্র। কিন্তু তার পরের চেহারা বড় করুন-বড় লজ্জার! বড় মর্মান্তিক!
রবীন্দ্রনাথ আরো বলেছেন-‘মানুষের দেশ মানুষের চিত্তের সৃষ্টি, এজন্যই দেশের মধ্যে মানুষের আত্মার ব্যাপ্তি, আত্মার প্রকাশ’ এই বাংলাদেশে যদি আমাদের চিত্তের সৃষ্টি হয়, যদি এই নৈরাজ্য ও দুর্নীতির মধ্যে আত্মার ব্যাপ্তি প্রকাশিত হয় এবং বিপর্যয়কে সামনে রেখেও সুযোগ সন্ধানের মানসিকতায় আত্মার প্রকাশ ভাসমান হয়-তাহলে তার ব্যাখ্যা কি দাঁড়ায় তা ভাবতেই শিউরে উঠতে হয়।
তবু রবীন্দ্রনাথ একদা আশা পোষণ করেছিলেন যে, পূর্ব দিগন্ত থেকে মুক্তির দূত আসবে। তাদের পদধ্বনিও তিনি শুনতে পেয়েছিলাম যেন। তাই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের মহা বিধ্বংসী তাণ্ডবের পর মানব ইতিহাসের কল্যাণী নেয়েকে ভেসে আসছে দেখেছিলেন। এবং পূর্ণ আশ্বাসে বলেছিলেন-‘মানুষের প্রতি বিশ্বাস হারানো পাপ।’
যদিও দেশে এবং সমগ্র বিশ্বে আজ সভ্যতার সংকট, মূল্যবোধের বিপর্যয় এবং নীতিবোধ ও সামাজিক বিধি-নীতির আমূল পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে-তবু তারই মধ্যে দিয়েই একদিন মুক্তিদূত আসবে এই বিশ্বাস আমরাও করছি। অমৃতের সন্তান মানুষের প্রতি অগাধ বিশ্বাস রেখেই কামনা করছি আমাদের চিত্তের সৃষ্টি হিসেবে এই বাংলা একদিন সত্যিই এই সোনার বাংলায় রূপান্তরিত হবে। ভালো-মন্দ মিলিয়ে মানুষ। মান আর হুশ এর সমন্বয় মানুষ। বাংলাদেশের সত্যিকারের সৎ বিবেকবান ও মানবিক মূল্যবোধে বিশ্বাসী মানুষের অভাব আছে-এটা আমরা বিশ্বাস করি না। আর বিশ্বাস করি না বলেই আজকের এই বন্যার তাণ্ডবলীলার মধ্যেও দেশবাসী তাকিয়ে আছেন, কখন, কোথায় ও কোন সময় মানবিক মূল্যবোধ নিয়ে সোনার দেশ গড়ার জন্য সোনার মানুষগুলো এগিয়ে আসবেন।

কবরস্থানে স্থানাভাব

কবরস্থানে ঠাঁই নেই, নগরীতে দাফন সমস্যাঃ এই শিরোনামায় গতকাল একটি পত্রিকায় দীর্ঘ রিপোর্ট প্রকাশিত হয়েছে। তাতে বলা হয়েছে আজিমপুর নতুন ও পুরাতন গোরস্থানে স্থান সংকুলানের অভাবে সব রকম জায়গায় সংরক্ষণ গত জুলাই মাস থেকে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। আজিমপুর পুরাতন ও নতুন দুটি কবরস্থানের জায়গা হল যথাক্রমে ২০ ও ৩ একর। এখানে গড়ে প্রতিদিন ত্রিশটি করে লাশ দাফনের জন্য আসে। পুরাতন কবরস্থানটি দুটি অংশে বিভক্ত। প্রতিবছরেই একাংশের লাশ দাফন বন্ধ থাকে এবং অপর অংশে দাফন করা হয়। পরের বছর বন্ধ করা অংশে লাশ দাফন শুরু হয়। এই নিয়মে এতদিন ধরে চলে আসছে। নতুন কবরস্থানটি হলো সংরক্ষিত এবং আগে দেড় হাজার টাকার বিনিময়ে এখানে নাগরিকরা জায়গা পেতেন কিন্ত পরে সেই হার চার হাজার টাকায় বৃদ্ধি করলেও গত মাস থেকে আজিমপুর গোরস্থানে জায়গা সংরক্ষণ সম্পূর্ণ বন্ধ করে দেয়া হয়। বনানীতে জন্নতুন কবরস্থানটি চলতি মাস থেকে চালু হচ্ছে তাতে গুলশান পৌর এলাকার লোকেরা বিশেষ সুযোগ-সুবিধা পাবেন। তাদের জন্য চলতি স্থান সংরক্ষণে ১হাজার এবং অগ্রিম স্থানের জন্য ২ হাজার দিতে হবে। বাইরের লোক এলে তাদেরকে এই পরিমাণ এর দ্বিগুণ দিতে হবে। জুরাইন কবরস্থানের মোট ৩০ একর জমিতেও জায়গা সংরক্ষণের ব্যবস্থা আছে এবং সেখানে প্রতি কবরের জায়গার জন্য দিতে হচ্ছে গত জুলাই মাস থেকে তিন হাজার টাকা করে, এর আগে দিতে হতো ওই জায়গার জন্য সাতশ’ টাকা।
গত আদমশুমারি অনুযায়ী ঢাকা শহরের লোকসংখ্যা হলো বর্তমানে তের লাখের ওপর এবং গত বছর একমাত্র আজিমপুরেই লাশ দাফন হয়েছে ১৩ হাজার ৯শ’ ৬৭টি। আজিমপুরের তিন একরের সংরক্ষিত জায়গায় এ পর্যন্ত একই কবরে একাধিক লাশ দাফন করা হয়নি এবং বনানীর নতুন কবরস্থান ও জুরাইনে সংগ্রহের ব্যবস্থা যতদিন থাকবে ততদিন ওইসব এলাকার গুলোতেও কোনদিন একাধিক লাশ দাফন করা হবে না। রাজধানী ঢাকা নগরীর লোকসংখ্যা উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং সংরক্ষিত কবরের ব্যবস্থা যতদিন থাকবে ততদিন দাফন সমস্যা সমাধানের পথও খুঁজে বের করা যাবে না। আজিমপুরের শতবর্ষের পুরাতন কবরস্থান জায়গার পরিমাণ হলো মাত্র ২০ একর সেই কবরস্থান এতদিন ধরে লক্ষ লক্ষ লোকের জায়গা করে দিয়েছে। সুতরাং আমরা মনে করি আজিমপুরের পুরাতন কবরস্থান এর দৃষ্টান্ত অনুসরণ করে এ সম্পর্কে কোন প্রকার জায়গা সংরক্ষণের প্রথাকে বন্ধ করা উচিত। এছাড়া আমাদের মনে হয় না যে, ইসলাম ধর্মতেও এইভাবে কবরের জায়গা আটকে রাখার বিধান চালু আছে। কারণ জায়গায় আটকে রাখার প্রথা জমিকে নষ্ট করে দেয় এবং এই প্রথা পুরুষানুক্রমে চালু থাকলে পৃথিবীর বিশাল অংশ একদিন গোরস্থানের পরিণত হতে পারে। হয়তো এজন্যই পবিত্র ইসলাম ধর্মে এ প্রথা চালু নেই। এছাড়া প্রতি কবরের জায়গা মূল্য বর্তমান হার অপেক্ষা দশ গুণ বৃদ্ধি করলেও বিত্তবানেরা তাদের পরিবারের লোকদের জন্য সেই অধিকহারে জমি কিনতে কৃপণতা করবে না। আমাদের লক্ষ্য রাখতে হবে ৫৪ হাজার বর্গমাইলের এই দেশটি লোকসংখ্যা বর্তমানে সাড়ে সাত কোটি এবং দিন দিন আমরা বাসস্থান সমস্যায় জর্জরিত হচ্ছি। সুতরাং মৃত ব্যক্তির কবরের জন্য জায়গা আটকে রাখার প্রবণতা রোধ করার ব্যাপারে প্রতিটি নাগরিকেরই দৃষ্টি রাখা প্রয়োজন।

কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক

পত্রিকার মূল কপি পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!