You dont have javascript enabled! Please enable it! লন্ডন ষড়যন্ত্র মােশতাক এবং চীনপন্থীদের মিশন আক্রমণ - সংগ্রামের নোটবুক
লন্ডন ষড়যন্ত্র মােশতাক এবং চীনপন্থীদের মিশন আক্রমণ
আবার ১৯৭৫-এর লন্ডন নগরীর ঘটনাবলীর কথা । ১৫ই আগস্ট সকালে এই লন্ডনে আরও সব চাঞ্চল্যকর ঘটনা সংঘটিত হলাে। এ সময় আমি কূটনৈতিক দায়িত্বে ছিলাম লন্ডনস্থ বাংলাদেশ হাইকমিশনে। তাই আলােচ্য ঘটনাবলীর প্রায় সবটাই আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকেই লিখতে হচ্ছে। আগেই বলেছি, পাকিস্তানি জামানার ঝানু ডিপ্লোম্যাট এবং জুলফিকার আলী ভুট্টোর বন্ধু স্থানীয় কায়সার রশীদ চৌধুরীর কাছ থেকে আমি ১৫ই আগস্ট ভাের রাতে সর্বপ্রথম বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রাথমিক রিপাের্ট পেয়েছিলাম। তিনি নিজেই গাড়ি চালিয়ে আমার বাসায় এলেন। এক্ষণে কায়সার রশীদ চৌধুরীর আরও কিছু পরিচয়ের উল্লেখ অপরিহার্য। ষাট দশকের প্রথমার্ধে ভদ্রলােক শুধু যে পাকিস্তান পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অন্যতম পরিচালক। ছিলেন, তাই-ই নয়—তিনি ছিলেন প্রেসিডেন্ট আইয়ুবের এককালীন পররাষ্ট্র মন্ত্রী জুলফিকার আলী ভুট্টোর ব্যক্তিগত সচিব। রাজনৈতিক কারণে ভুট্টোর পদত্যাগের পর অত্যন্ত মার্জিত রুচিসম্পন্ন কায়সার রশীদ চৌধুরীও সরকারি চাকরি পরিত্যাগ করেন। পরবর্তীকালে ১৯৭১-এর ২৫শে মার্চ দিবাগত রাতে ঢাকায় পাকিস্তানি সৈন্য বাহিনী বঙ্গবন্ধুর বত্রিশ নম্বরের বাসায় হামলা করার সময় শেখ কামাল পলাতক হলে, সেই ভয়ঙ্কর দিনগুলােতে আশ্রয় লাভ করেন ধানমন্ডির দুই নম্বর রােডে এই কায়সার সাহেবের বাসায়। এখান থেকেই শেখ কামাল মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেয়ার জন্য মুজিবনগরে পাড়ি জমিয়েছিলেন। বছর কয়েক পরের কথা। খণ্ডিত পাকিস্তানে জুলফিকার আলী ভুট্টো আর স্বাধীন বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ক্ষমতায় । ভুট্টোর ঢাকা সফরের প্রাক্কালে সুইডিশ দূতাবাসের মাধ্যমে প্রেরিত পাকিস্তান পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একটা গােপন টেলেক্স বার্তা দেখে হতবাক হয়েছিলাম। আমি তখন বাংলাদেশ বেতারের মহাপরিচালক। বার্তায় ছােট্ট একটা অনুরােধ।
ভুট্টোর সম্মানে আয়ােজিত রাষ্ট্রীয় ভােজসভায় যেন কায়সার রশিদ চৌধুরী আর জামিল গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজ-এর চিরকুমার ডিরেক্টর মােস্তফা ভাইকে (মাজু ভাই) আমন্ত্রণ জানানাে হয়। বঙ্গবন্ধু এই অনুরােধ রক্ষা করেছিলেন। দুজনই তার পূর্ব পরিচিত। এহেন কায়সার ভাই-এর কাছ থেকে সপরিবারে বঙ্গবন্ধু হত্যার খবরে আমি। কিংকর্তব্যবিমূঢ় না হলেও হতভম্ব হয়েছিলাম। বারবার আমার মন কোন সে সুদূর অতীতের পানে ধেয়ে চললাে। এই এক মহান ব্যক্তিত্বকে ঘিরে কত কথা, কত গান, কত স্মৃতি আর ইতিহাসের কত দুর্লভ মুহূর্ত। সব কিছু ছাপিয়ে বার বার শুধু বঙ্গবন্ধুর একটা কথাই মনে হচ্ছিল। ১৯৭৩ এর শেষভাগে এক সামরিক অভ্যুত্থানে চিলির নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট আলেন্দে তখন নিহত। প্রতিক্রিয়ায় বঙ্গবন্ধু এ মর্মে বলেছিলেন, “আমাকে মারতে চাস মার। কিন্তু তােরা কোনােদিন শান্তি পাইবি না।” কায়সার রশীদের কথায় চিন্তার খেই হারিয়ে ফেললাম। বললাম, “কায়সার  ভাই, বঙ্গবন্ধু হত্যার নিউজটা কনফার্ম করতে চাই।” দুজনে বসে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে অবস্থিত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূতদের ফোন নম্বর নিয়ে গােটা কয়েক ইমিডিয়েট’ কল করলাম। প্রথমেই পেলাম তেহরান। রাষ্ট্রদূত দোহা গম্ভীর গলায় বললেন, “হ্যা, আপনারা ঠিকই খবর পেয়েছেন। আজ ভাের রাতে ধানমন্ডির বত্রিশ নম্বরে সপরিবারে প্রেসিডেন্ট শেখ মুজিবকে হত্যা করা হয়েছে। এর বেশি জানি না। এর পরেই সুদূর ওয়াশিংটন থেকে টেলিফোনে প্রেস কাউন্সিলার সৈয়দ  নূরুদ্দীনের গলা। “মুকুল কিছুই তাে বুঝতে পারছি না। ঢাকার খবর খুবই খারাপ। বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করা হয়েছে। ‘ভয়েস অব আমেরিকায় একটু পরেই খবর শুনতে পাবে।” ফোন রেখে তাড়াতাড়ি তৈরি হলাম। ঠিক করলাম, আমি আর কায়সার ভাই  দুজনেই যাবাে লন্ডন-এর কিলবার্ন এলাকায়। মাত্র দিন কয়েক আগে ঢাকা থেকে সপরিবারে খােকাভাই বেড়াতে এসেছেন। উঠেছেন কিলবার্ন-এর এক বাসায়। খােকা হচ্ছে বঙ্গবন্ধুর ফুপাতাে ভাই এবং পাকিস্তানি আমলে দুর্দিনের সাথী। কায়সার ভাই-এর গাড়িতেই গেলাম। তখন লন্ডনের ঘড়িতে ভাের সাড়ে চারটা।
গাড়ির ছােট্ট ট্রানজিস্টার রেডিওতে পাক্কা খবর পেলাম। সেট অন করতেই ‘ওয়ান নাইন ফোর’ বেতার থেকে তাদের নিয়মিত প্রভাতী গানের অনুষ্ঠানের মধ্যে বিশেষ ঘােষণা হচ্ছে সপরিবারে প্রেসিডেন্ট শেখ মুজিব হত্যার কথা। সকাল সাতটা নাগাদ কায়সার ভাই আমাকে নামিয়ে দিলেন। বাসায় আমার বছর। উনিশের বড় ছেলে আর একজন বাঙালি বাবুর্চি ছাড়া আর কেউই নেই। স্ত্রী এবং দু’মেয়েই তখন ভারতের শান্তি নিকেতনে। পাশ্চাত্যের জীবনধারা ওদের মােটেই পছন্দ হয়নি। তাই মেয়ে দুটোকে আবার শান্তি নিকেতনের ‘পাঠভবনে ভর্তির ব্যবস্থা করেছি। কথা ছিল ওদের দুজনকেই শান্তি নিকেতনে পৌছে দিয়ে আমার স্ত্রী সােজা। ঢাকায় ফিরে যাবে ১৫ই আগস্টে এবং তার পুরনাে কর্মস্থল বাংলা একাডেমিতে কাজে যােগ দিবে। কিন্তু আকস্মিকভাবে বঙ্গবন্ধু হত্যা হওয়ায় আমার সবকিছু পরিকল্পনা ওলট-পালট হয়ে গেল। আশঙ্কায় মনটা ভরে উঠলাে, এখন উপায়? ইতােমধ্যে বিশ্বের বিভিন্ন বেতার থেকে এ মর্মে সংবাদ প্রচারিত হয়েছে যে, বাংলাদেশের সঙ্গে বিশ্বের সমস্ত দেশের সব রকম যােগাযােগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে।
তাই ছেলের সঙ্গে মিনিট কয়েক আলাপ করেই একটা সিদ্ধান্তে এলাম। তাহলে আমার সহধর্মিনী এখনও পর্যন্ত কোলকাতায় আটকে রয়েছে—ঢাকায় যেতে পারেনি। সে ক্ষেত্রে যেভাবেই হােক কোলকাতায় যােগাযােগ করে তাকে আবার লন্ডনে ফিরিয়ে আনতে হবে। ডিপ্লোম্যাট হিসাবে কোলকাতায় একটা ইমিডিয়েট’ ট্রাংককল বুক করলাম। পিপি হচ্ছেন কোলকাতায় বাংলাদেশের ডেপুটি হাইকমিশনার। একটু পরেই লাইন পেয়ে গেলাম। ডেপুটি হাইকমিশনার জানালেন যে, একটু আগে মিসেস রেবা দমদম এয়ারপাের্ট থেকে মিশনেই ফিরে এসেছেন। ঢাকার সমস্ত ফ্লাইট বাতিল হয়ে গেছে। ভদ্রমহিলা এখন তার টেবিলের সামনে বসে রয়েছেন। সঙ্গে সঙ্গে ডেপুটি হাইকমিশনারকে একটা বিশেষ অনুরােধ করলাম। যেভাবেই হােক লন্ডনের একটা টিকিটের ব্যবস্থা করে আমার স্ত্রীকে যেন প্লেনে উঠিয়ে দেন। নচেৎ উনি ঢাকায় ফিরে গেলে পরিবারের সবার জন্য তা বিপদের কারণ হয়ে দাঁড়াবে। ভদ্রলােক রাজি হলেন এবং লন্ডনের লয়েডস ব্যাংক-এর একটা একাউন্ট নম্বর। দিয়ে বললেন, টিকিটের দামের সমপরিমাণ পাউন্ড যেন আমি সেই একাউন্ট-এ জমা করে দেই। এরপর ফোনে স্ত্রীকে সব বুঝিয়ে বলে নিশ্চিত হলাম।
এদিকে রিসিভারটা রাখতেই শুধু ফোনের পর ফোন। সবাই ঢাকার বিস্তারিত সংবাদ জানতে আগ্রহী। একমাত্র গাফফার চৌধুরীর সঙ্গে ফোনে অনেকক্ষণ আলাপ করে মনকে প্রবােধ দিতে সক্ষম হলাম।
আবার বিশ্রী শব্দ করে ফোনটা বেজে উঠলাে। এবার স্বয়ং হাইকমিশনার সৈয়দ আবদুস সুলতানের গলা। “মুকুল সাহেব, ঠিক ন’টার মধ্যে অফিসে আসবেন। এটা আমার নির্দেশ হিসেবে গ্রহণ করলে খুশি হবাে।” ফোনটা রাখতেই আমার সহকর্মী ও সুহৃদ মিহির সাহেবের উত্তেজিত কণ্ঠস্বর। বললেন, “মুকুল সাহেব, আপনাকে কি হাইকমিশনার সাহেব ফোন করেছিল? আমাকে তাে ঠিক সকাল ন’টার মধ্যে অফিসে যেতে হুকুম করলাে। এখন করি কী, বলেন তাে? মনে হচ্ছে মিশনে একটা গণ্ডগােল হবে। তবুও আমি ঠিক করেছি, অফিসে যাবই। খালি ভয় আমার নতুন গাড়ি নিয়ে তাই আজ আমাকে উঠিয়ে নিয়ে যাবেন। এটা আমার বিশেষ অনুরোধ।” জবাবে বললাম, “এখন মাথা ঠাণ্ডা করে কাজ করার সময়। গার্ডিয়ান কাগজে বিজ্ঞাপন দেখার পর আমার মনে হচ্ছে আপনার কথাই ঠিক। আজ হাইকমিশনে কিছু একটা গণ্ডগােল হতে পারে। বােঝা যাচ্ছে, সব কিছুই বিরাট ষড়যন্ত্রের অংশ। তাই ফড়যন্ত্রকারীরা বৃটিশ পত্র-পত্রিকা আর বেতার-টিভিতে পাবলিসিটি নেয়ার জন্য আজ আমাদের অফিসে কিছু একটা করবেই। এরা বােঝাতে চাইবে যে, প্রবাসী। বাঙালিরা আর বঙ্গবন্ধুকে সমর্থন করে না।”
উত্তেজিত অবস্থায় দ্রলােক আমার কথাই শুনতে রাজি নন। বারবার একই অনুরােধ, তাকে বাসা থেকে উঠিয়ে নিয়ে যেতে হবে। উপায়ন্তবিহীন অবস্থায় বললাম, “আপনি হচ্ছেন গোয়েন্দা বিভাগের লোক এবং লন্ডনে বেশ কিছুদিন ধরে রয়েছেন। তাই মনে হয় চীনপন্থীরা ছাড়াও জাসদ’ আর ‘জনমত’-ওয়ালারা আপনার উপর খাপ্পা হয়ে আছে। তাই একটা ক্যাজুয়াল লীভ’-এর দরখাস্ত
পাঠিয়ে বাসায় বসে সবকিছু ওয়াচ’ করুন। সেটা সবচেয়ে ভালাে বুদ্ধি।” আমি বােঝাতে ব্যর্থ হলাম। শেষ অবধি মিহির সাহেবকে বাসা থেকে উঠিয়ে অফিসে রওয়ানা হলাম। যখন কুইনস্ গেট-এর অফিসে যেয়ে পৌছলাম তখন সকাল ন’টা বাজার মিনিট কয়েক বাকি। লক্ষ করলাম আমাদের হাইকমিশনের ভবন অসংখ্য লন্ডন পুলিশ ঘেরাও করে রেখেছে। আর ঠিক গেটের সামনে ওঁত পেতে বেশ কটা টিভির ক্যামেরা। একটু দূরে গাড়ি পার্ক করে অফিসে ঢুকে এক অবর্ণনীয় অবস্থা দেখলাম। টেবিল-চেয়ার, শেলফ-এর বই এমনকি দেয়ালে টানানাে নিহত প্রেসিডেন্ট মুজিব-এর ফটো—সবকিছু ভেঙে একাকার হয়ে রয়েছে। একেবারে লণ্ডভণ্ড অবস্থা দেখলাম। মিশনের নিরাপত্তা প্রহরীর কাছ থেকে ঘটনার বিস্তারিত শুনলাম। সকাল আটটা নাগাদ প্রায় একশ’ জনের এক উত্তেজিত জনতা (প্রবাসী সিলেটী বাঙালি অনুপস্থিত) বাংলাদেশ হাইকমিশন অফিস আক্রমণ করায় এই লংকাকাণ্ড। উল্লেখ্য যে, আনুষ্ঠানিকভাবে হাইকমিশনার কর্তৃক আহ্বান না করা অবধি বিধিমতাে মিশন ভবনে পুলিশের প্রবেশাধিকার নেই বলেই এ অবস্থা। এজন্যই আক্রমণকারীরা মিশনের ভিতরে ঢােকার পর ইচ্ছামতাে ভাংচুর করতে সক্ষম হয়েছে।  এ ধরনের এক অবস্থায় অফিসের সবরকম কাজকর্ম বন্ধ। চারপাশে ছােট ছােট জটলা।

একজন সহকর্মীর রুমে রেডিওর নিউজ শুনতে গেলাম। প্রতি অর্ধ ঘণ্টা পর পর প্রচারিত আন্তর্জাতিক সংবাদে বাংলাদেশ সম্পর্কে ফলাও করে শুধুমাত্র সপরিবারে প্রেসিডেন্ট মুজিব নিহত এবং এই দেশটির সঙ্গে বহির্বিশ্বের সমস্ত রকম যােগাযোগ বিচ্ছিন্ন, এটুকু ছাড়া বিস্তারিত কিছুই নেই। তবে প্রতিক্রিয়া জানাতে গিয়ে বারবার লন্ডনস্থ বাংলাদেশ হাইকমিশনের ডেপুটি হাইকমিশনার জনাব ফারুক চৌধুরীর মন্তব্য উল্লেখ করছে। জনাব চৌধুরী এ মর্মে মন্তব্য করেছেন যে, প্রেসিডেন্ট মুজিব হত্যার ফলে বাংলাদেশ একনায়কত্বের হাত থেকে রক্ষা পেয়েছে।  দারুণভাবে বিস্মিত হলাম। কারণ, মাত্র বছর আড়াই আগে এই লন্ডনের এক হাসপাতালে বঙ্গবন্ধুর পেটের বিসিস’ অপারেশনের প্রাক্কালে আলােচ্য কূটনীতিবিদ হাসপাতালের করিডােরেই অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলেন। ওয়াকেফহাল মহলের মতে, জাতির পিতার পেটে কীভাবে অস্ত্রোপচার হবে সেটা চিন্তা করেই নাকি জনাব চৌধুরী অজ্ঞান হয়েছিলেন। আর এখন? একটু পরেই হাইকমিশনার-এর কামরায় ডাক পড়লো। এককালের প্রবীণ এই রাজনীতিবিদ-এর কথা হচ্ছে, তিনি থাকতে তার অধীনস্থ কর্মচারীর ইন্টারভিউ ব্রিটিশ রেডিও-টিভিতে প্রচারিত হচ্ছে কীভাবে?

প্রেস কাউন্সিলার হিসাবে তাকে অনেক করে বুঝালাম। এখন ঢাকার সঙ্গে। বহির্বিশ্বের কোনাে যােগাযােগই নেই। ফলে বাংলাদেশে কী হচ্ছে তা বােঝা সম্ভব নয়। এমতাবস্থায় কোনােরকম মন্তব্য করা বুদ্ধিমত্তার পরিচায়ক হবে না।
কিন্তু শ্রদ্ধাভাজন সৈয়দ সাহেব ব্রিটিশ প্রেস-এ ইন্টারভিউ দেয়ার আগ্রহ প্রকাশ করলেন। নিচের ফুটপাতেই তখন রিপাের্টাররা ঘােরাঘুরি করছিল। দুপুরের পর থেকে রেডিও-টিভিতে বাংলাদেশ হাইকমিশনারের মন্তব্য প্রচারিত হতে শুরু করল। ভাষাটা একটু তফাৎ হলেও দুজনের মোদ্দা কথাটা একই। উনসত্তরের আইয়ুব-বিরােধী গণঅভুথানের সময় প্রবীণ রাজনীতিবিদ সৈয়দ আবদুস সুলতান কাউন্সিল মুসলিম লীগ থেকে পদত্যাগ করলে বঙ্গবন্ধু তাকে আওয়ামী লীগে স্থান দিয়ে সত্তরের নির্বাচনে কেন্দ্রীয় পার্লামেন্টে আওয়ামী লীগের টিকিটে জয়যুক্ত করিয়েছিলেন। আবার বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ব্রিটেনের। মতাে জায়গায় হাইকমিশনার হিসাবে সৈয়দ সাহেবকে পাঠিয়েছেন—সম্ভবত এটা। ছিল বঙ্গবন্ধুর অন্যতম ‘অপরাধ’। এতে করেও ভদ্রলােক তার চুক্তিভিত্তিক চাকুরির মেয়াদ বাড়াতে পারেননি। এটা হচ্ছে নিয়তির পরিহাস!  সেদিন দুপুরের লাঞ্চ-এর আগেই লন্ডনস্থ বাংলাদেশ হাইকমিশনে আরও ২টি নাটকীয় ঘটনা সংঘটিত হলাে। সকালে যারা মিশন আক্রমণ করেছিল, তাদের ৫/৬ জন নেতা এল ডেপুটি হাইকমিশনার জনাব ফারুক চৌধুরীর সঙ্গে দেখা করার জন্য। এদের প্রথম দাবি হচ্ছে, সকালে মিশন আক্রমণের সময় বিবিসি এবং আইটিভির ক্যামেরাম্যানরা ছবি নিতে পারেনি। তাই মিশনের ভিতরে আরেক দফা ভাংচুর করা হবে এবং ছবি নেয়ার জন্য টিভি ক্যামেরাম্যানদের এবং প্রেস ফটোগ্রাফারদের এলাউ করতে হবে। স্বল্পকালীন আলােচনার পর মিশনের কর্তৃপক্ষ অফিসের ভিতরে আরেক দফা ভাংচুর-এর অনুমতি প্রদান করলেন। সে এক চরম লজ্জাস্কর আর অকল্পনীয় ব্যাপার। নিহত প্রেসিডেন্টের ফ্রেমওয়ালা ভাংগা আর ভালাে অনেক ক’টা বড় ফটো এনে ডেপুটি হাইকমিশনারের বিরাট কামরার চারটা দেয়ালে টানানাে হলাে। টিভি ক্যামেরাম্যান আর প্রেস ফটোগ্রাফাররা ঘরের এক কোণায় পজিশন’ নেয়ার পর আকস্মিকভাবে। শুরু হলাে এক পৈশাচিক ব্যাপার। মরহুম প্রেসিডেন্ট মুজিবের ফটো ভাঙা এবং পা দিয়ে ফটোগুলাে সবার সামনে ‘দলিত-মথিত’ করল।
এদিকে আক্রমণকারীরা হাইকমিশন-এর একজন ঊর্ধ্বতন অফিসার কুটনীতিবিদকে মিশন থেকে বহিষ্কারের দাবি জানালে আশ্চর্যজনকভাবে মিশন কর্তৃপক্ষ এতে সম্মত হয় এবং অনতিবিলম্বে উক্ত অফিসারকে (জনাব এন এম খান মিহির) অফিস থেকে বেরিয়ে যেতে হয়। বিকেল ৩টা নাগাদ বাংলাদেশ হাইকমিশনে সংঘটিত এসব ঘটনা প্রদর্শিত হলাে বিবিসি ও আইটিভি টেলিভিশনে। বাঙালি জাতির ইতিহাসে এই ঘটনা আর। এক কলঙ্কজনক অধ্যায়। সাম্রাজ্যবাদী শক্তির ইন্ধন আর বাঙালি মীরজাফরদের এতাে প্রচেষ্টা সত্ত্বেও বিদেশে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ইমেজ’ বিনষ্ট করা সম্ভব হলাে না। জীবনের এক দুর্লভ অভিজ্ঞতার মাঝ দিয়ে তা উপলব্ধি করলাম। তখন বাংলাদেশে এক অনিশ্চিত পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে স্বঘােষিত প্রেসিডেন্ট খন্দকার মােশতাকের আমল। ১৯৭১-এর প্রবাসী মুজিবনগর সরকারের কর্ণধার এবং মুক্তিযুদ্ধের চার মহান নেতা যথাক্রমে সর্বজনাব সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দিন আহমদ, মনসুর আলী এবং কামরুজ্জামানসহ বিপুল সংখ্যক মুক্তিযােদ্ধা ও আওয়ামী লীগ কর্মী কারাগারে নিক্ষিপ্ত। এমনি এক নাজুক সময়ে লন্ডন থেকে ঢাকায় বদলীর নির্দেশ এল।  কারণ একটাই। আমি হচ্ছি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বাঙালি জাতীয়তাবাদের আদর্শে অনুপ্রাণিত। উপরন্তু মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্রের সবচেয়ে জনপ্রিয় ‘চরমপত্র’ অনুষ্ঠানের রচয়িতা ও পাঠক। এ ধরনের এক ব্যক্তিত্বকে এভাবে বিদেশের মাটিতে রাখা বুদ্ধিমত্তার পরিচায়ক হবে না। অতএব মাত্র নয় মাসের মাথায় আমার প্রতি ঢাকায় ফিরে যাওয়ার নির্দেশ। ঢাকার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে বারংবার একই ধরনের টেলেক্স বার্তা।  শেষ অবধি স্থির সিদ্ধান্তে এলাম। এ সময় দেশে ফিরে যাব না। লন্ডনের ‘পস’ এলাকা ‘হ্যামস্টেড’ থেকে বাসা বদলিয়ে একেবারে চলে এলাম পূর্ব। লন্ডনের শ্রমিক এলাকা ‘ইস্ট হ্যাম’-এ একটা দেড় কামরার বাসায়। স্ত্রী অসুস্থ। হয়ে হাসপাতালে, কন্যাদ্বয় সুদূর শান্তিনিকেতনে, একমাত্র পুত্র ‘গালফ অয়েল’এর গ্যারেজে চাকুরিরত আর বিশাল লন্ডন নগরীতে আমি হলাম বেকার।
১৯৭৫-এর এই দিনটির কথা আমি জীবনে ভুলতে পারব না। কিসের এক ছুটির দিন। আমি বাসায় একা। দুপুরে রান্না করে খাওয়ার পর ভাবলাম বিবিসিতে যেয়ে আড্ডা মেরে আসি। ওখানে গেলে বাংলাদেশেরও কিছু খবর অন্তত পাওয়া যাবে। বাস টার্মিনালে যেয়ে একটা খালি বাসের দোতলায় বসে সিগারেট ধরালাম। ভর দুপুরে উপরের তলায় আমি শুধু একাই বসে। মিনিট কয়েক পরেই বাসটা সেন্ট্রাল লন্ডনের দিকে রওনা হবে। এমনি সময়ে বিরাটদেহী এক জ্যামাইকান—ব্রিটিশ বাসের উপরের তলায় এসে বসল। হাতে তার জ্বলন্ত সিগারেট। মনে মনে একটু বিরক্ত হলেও বুঝতে পারলাম ভদ্রলােক আমার সঙ্গে কিছু গল্প করে সময় কাটাতে চায়। এরপর দুজনের মধ্যে কথাবার্তা নিম্নরূপ : জ্যামাইকান : বেআদবী মাফ করবেন। আমি কালাে হলেও এদেশেই আমার জন্ম। আমার পূর্ব পুরুষদের জোর করে ক্রীতদাস হিসেবে এদেশে নিয়ে এসেছিল। এখন আমরা ব্রিটিশ নাগরিক। আপনি কোন দেশের? উত্তর : আপনি আন্দাজ করুন আমি কোন দেশের লােক হতে পারি। জ্যামাইকান : দেখুন আমার আন্দাজ সঠিক কিনা। আপনি নিশ্চয়ই আফ্রিকার ঘানা থেকে এসেছেন। কেমন কিনা? উত্তর : আপনার জবাব সঠিক হয়নি। আবার চেষ্টা করুন।
জ্যামাইকান  (বিকট শব্দে হেসে) আমি একটা আহম্মক নাকি? আপনি তাে পিরামিডের দেশের লােক? ‘ইজিপসিয়ান। উত্তর : এবারও ঠিক হলাে না। আবার চেষ্টা করুন। আমার দেশ আরও পূর্বে। জ্যামাইকান  (একটা সিগারেট অফার’ করে নিজেও একটা ধরিয়ে) আমি একটা আস্ত গর্দভ। আপনি হচ্ছেন গান্ধীর দেশের ইন্ডিয়ান এবার ঠিক হয়েছে তাে? উত্তর : আপনি আবারাে ভুল করছেন। আমি ‘ইন্ডিয়ান নই। তবে “ইন্ডিয়া আমাদের প্রতিবেশী  এবার বলুন আমি কোন দেশের? জ্যামাইকান ; স্যরি, আমি পারলাম না বলতে। তাহলে এবার আপনি নিজের দেশের পরিচয় দিন। উত্তর : এতবার চেষ্টা করেও পারলেন না? আমি হচ্ছি বাংলাদেশের লােক। বাঙালি। এই জবাব দেয়ার সঙ্গে সঙ্গে কিছু বােঝবার আগেই বাসের মধ্যে এক অকল্পনীয় ব্যাপার ঘটে গেল। সঠিকভাবে বর্ণনা দেয়া মুস্কিল। মুহূর্তে জ্যামাইকান দ্রলােকের চেহারা থেকে কপূরের মতাে সব হাসি উবে গেল। তিনি তখন রাগে অগ্নিশর্মা। সিট ছেড়ে দাঁড়িয়ে চিৎকার করে বললেন, “ইউ আর ফ্রম বাংলাদেশ? (আপনি বাংলাদেশের লােক) ইউ হ্যাভ টালি কিলড শেখ মুজিব? (আপনারাই শেখ মুজিবকে নৃশংসভাবে হত্যা করেছেন?) আই হেইট টু টক উইথ ইউ। (আমি আপনার সঙ্গে কথা বলতে ঘৃণা বােধ করি) থুঃ থুঃ । থুঃ থুঃ থুঃ।
ভদ্রলােকের চেহারার দিকে তাকিয়ে দেখলাম তার চোখ দুটো থেকে কী নিদারুণ ঘৃণা বেরিয়ে এসেছে। আমি হতভম্বের মতো শুধু ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে রইলাম। আমি তাকে বলতেই পারলাম না; বঙ্গবন্ধুকে ভালােবাসি বলেই এখন ৪৪ বছর বয়সে আমার দুর্বিষহ নির্বাসিত জীবন আর অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ। তবুও নিজের বিবেকের কাছে আমার কোনাে দংশন নেই।  বঙ্গবন্ধুকে ভালােবাসা যদি “অপরাধ” হয়ে থাকে সে “অপরাধ” আমার মাথায় মুকুট হয়ে থাক  হুড়মুড় করে জ্যামাইকান ভদ্রলােক একেবারে বাস থেকেই নেমে গেলেন। শুধু প্রমাণ করে গেলেন সমগ্র বিশ্বব্যাপী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পর্বত প্রমাণ ‘ইমেজ’ অটুট আর অক্ষুণ রয়েছে। এরপরেও কথার পিঠে কথা থেকে যায়। নির্বাসিত জীবনে নিজের অস্তিত্ব রক্ষার জন্য অচিরেই পূর্ব লন্ডনের একটা চামড়াজাত ফ্যাক্টরিতে সাধারণ শ্রমিক হিসাবে প্রায় আড়াই বছরের ভয়ংকর জীবনযাত্রী। তবুও এক মুহূর্তের জন্য বঙ্গবন্ধুকে ভুলিনি—ভুলতেও পারব না। মুজিবের লাল রক্তে সিঞ্চিত বাংলাদেশের ইতিহাসে মুজিব অমরত্ব লাভ করেছেন। এজনাই ‘মুজিবের রক্ত লাল।

সূত্রঃ মুজিবের রক্ত লাল – এম আর আখতার মুকুল