You dont have javascript enabled! Please enable it!
প্রেসিডেন্ট মুজিব হত্যা লন্ডন টিভিতে ফারুক-রশিদের প্রকাশ্যে স্বীকারােক্তি
[বাংলাদেশের নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্ট ভাের রাতে সপরিবারে হত্যার পর অভিযুক্ত হত্যাকারী মেজরদের নিয়ন্ত্রিত ট্যাঙ্ক দিয়ে পরিবেষ্টিত বঙ্গভবনে ক্ষমতাসীন হলেন স্বঘােষিত প্রেসিডেন্ট খন্দকার মােশতাক আহমদ। মাত্র ৮৩ দিনের মাথায় আর এক সামরিক অভ্যুত্থানে ক্ষমতাসীন হলেন খালেদ মােশাররফ এবং তিনি কথিত খুনী মেজরদের বাংলাদেশ থেকে বহিষ্কার করলেন। এমনি এক নাজুক পরিস্থিতিতে প্রকাশ পেলাে যে, ইতিমধ্যেই মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বদানকারী চার জাতীয় নেতাকে ঢাকার কেন্দ্রীয় কারাগারের অভ্যন্তরে নৃশংসভাবে হত্যাকাণ্ড সমাধা হয়ে গেছে। এর মাত্র ৯৬ ঘণ্টার ব্যবধানে তৃতীয় সামরিক অভ্যুত্থানে এবং জাসদ-এর সমর্থনে খালেদ মােশাররফ-হুদাকে হত্যার মাধ্যমে ক্ষমতায় এলেন জিয়াউর রহমান। এসব কর্মকাণ্ডের মাত্র নয় মাস পরে ১৯৭৬ সালের আগস্ট মাসের প্রথম সপ্তাহে লন্ডনে ইনডিপেনডেন্ট টেলিভিশনে আলােচ্য মেজরদের নেতা ফারুক ও রশিদ এক চাঞ্চল্যকর সাক্ষাৎকার প্রদান করেন। এই সাক্ষাৎকার গ্রহণ করলেন উপমহাদেশের বিতর্কিত সাংবাদিক এ্যান্থনী ম্যাসকার্নহাস। এক প্রশ্নের জবাবে ফারুক-রশিদ সপরিবারে প্রেসিডেন্ট মুজিব হত্যার কথা স্বীকার করলেন এবং বললেন যে, জেনারেল জিয়াউর রহমান ষড়যন্ত্রের কথা অবহিত ছিলেন।

১৯৭৬ সালের আগস্ট মাসের প্রথম সপ্তাহে বিতর্কিত সাংবাদিক এ্যান্থনী ম্যাসকার্নহাস সপরিবারে প্রেসিডেন্টকে কীভাবে হত্যা করা হয়েছে, সে সম্পর্কে অবসরপ্রাপ্ত কর্নেল ফারুক ও কর্নেল রশিদের যে চাঞ্চল্যকর সাক্ষাৎকার গ্রহণ করেছেন, তারই অংশ বিশেষ এখানে উপস্থাপিত করা হলাে ।-লেখক) এ্যান্থনি : এ সময়ে সামরিক বাহিনী কি একটা বিশেষ ধরনের অপারেশনে লিপ্ত ছিল? ফারুক : হ্যা। আমরা এ সময় চোরাচালান বিরােধী এবং দুর্নীতি ও খাদ্যশস্য স্থানান্তর বিরােধী অভিযানে লিপ্ত হয়েছিলাম। এটা এমন একটা সময় ছিল, যখন প্রত্যন্ত অঞ্চলে প্রতিনিয়ত গুলিবর্ষণ ও হত্যাকাণ্ডে উদ্ভূত পরিস্থিতিতে দেশের সাধারণ স্থায়িত্ব পর্যন্ত নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছিল।

এ্যান্থনি : তাহলে মুজিবের অফিস থেকে এ মর্মে নির্দেশ ছিল যে, এ ধরনের কার্যকলাপের অভিযােগে কেবলমাত্র বিরােধী দলীয় সদস্যরা ছাড়া
কোনাে আওয়ামী লীগারকে গ্রেফতার করা যাবে না। রশিদ : হ্যা। ফারুক : বাস্তবে অবস্থা এমন এক পর্যায়ে যেয়ে দাঁড়িয়েছিল, যেখানে মনে
হচ্ছিল যে, আমরা একটা ক্রিমিন্যাল সংগঠনের নিয়ন্ত্রণে ছিলাম।
উদাহরণ হিসাবে বলা যায় যে, মাফিয়া’র নিয়ন্ত্রণে-আমেরিকা। রশিদ: তিনি সবাইকেই দুর্নীতিপরায়ণ হবার সুযােগ দিয়েছিলেন। তিনি
মানবতা বিরােধী আর অসহনীয় কার্যকলাপের অভিযােগের জন্য নিজের দলীয় সদস্য এবং অন্য কারাে বিরুদ্ধে কোনাে ব্যবস্থাই গ্রহণ।
করেননি। এ্যান্থনি : তাহলে এটা কি সত্য যে, যখনই নিজের রাজনৈতিক দলের কেউ দুনীতির অভিযােগ অথবা আইনকে অগ্রাহ্য করার অপরাধে আটক হয়েছে তখনই মুজিব তাদের রক্ষা করেছেন? রশিদ : হ্যা। এ্যান্থনি : আপনারা কি মুজিবকে এ কথাটা জানাবার চেষ্টা করেছিলেন যে, এই প্রক্রিয়ার পরিবর্তন দরকার? রশিদ : না, তা করা হয়নি। আমি ব্যক্তিগতভাবে এ ধরনের কোনাে প্রচেষ্টা করতে পারি না। কেননা আমি তাে সামরিক বাহিনীর একজন জুনিয়র অফিসার। আমার এমন কোনাে সুযোেগই ছিল না যে, আমি তাকে শােধরাবার কথা বলতে পারি। এ্যান্থনি : এ ধরনের এক প্রেক্ষাপটে আপনারা কি তাকে (মুজিবকে) জোর করে পদত্যাগের কথা বলতে পারতেন? নাকি তাকে হত্যা করাটা প্রয়ােজনীয় হয়ে পড়েছিল? রশিদ : আমি এ ব্যাপারে আগেই বলেছি ।  কিন্তু তিনি তাে একজন সফল প্রশাসক নন। তার চরিত্রে একটি অপরূপ গুণ রয়েছে এবং তা হচ্ছে তিনি সাধারণ মানুষকে ক্ষেপিয়ে তুলতে পারদর্শী। তাই তাঁকে যদি বাঁচিয়ে রাখা হতাে, তাহলে পরিস্থিতি সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ করা আমাদের সম্ভব ছিল না। রাজনৈতিক দিক থেকে তিনি ছিলেন অনেক বেশি অভিজ্ঞ। তাই শুধুমাত্র ক্ষমতায় থাকার জন্য তিনি যে কোনাে ধরনের দুরভিসন্ধিমূলক কাজ করতে সক্ষম ছিলেন—এমনকি দেশের স্বার্থের বিনিময়। এ্যান্থনি : তাহলে আপনাদের বক্তব্য হচ্ছে, মুজিব বেঁচে থাকলে পরিস্থিতি আপনাদের সম্পূর্ণ বিরুদ্ধে ঘুরে যেত? রশিদ : হ্যা। এটাই হতাে তাঁর প্রথম পদক্ষেপ। এ্যান্থনি : এজন্যই তাকে হত্যা করতে হয়েছে?
রশিদ: হ্যা, আমাকে তা করতে হয়েছে। ফারুক : আমি সিদ্ধান্ত নেই যে, তাকে এই ধরাধাম থেকে বিদায় নিতে হবে।
কিন্তু এ সময় ১৯৭৪ সালের মার্চে আমি ছিলাম পুরােপুরিভাবে। একজন পেশাদার সৈনিক। আমার কোনাে রাজনৈতিক বােঝাপড়া ছিল না। কিন্তু একটা বিষয় বুঝতাম যে, তাকে সরাবার পর কী। ধরনের অবস্থার সৃষ্টি হবে এবং প্রতিক্রিয়া কী হবে। তাই আমি নানা জনের সঙ্গে আলাপ আরম্ভ করলাম এবং অর্থনীতিসহ বিভিন্ন বিষয়ে দারুণভাবে পড়াশােনা করে ওয়াকেফহাল হলাম। কেননা, তখনও পর্যন্ত অনেকের মতে অর্থনৈতিক দিক থেকে বাংলাদেশ টিকে থাকতে পারে না। তাই আমার নিজেরই একটা এ মর্মে সিদ্ধান্তের প্রয়ােজন। ছিল যে, আসলেই অর্থনৈতিক দিক দিয়ে বাংলাদেশ টিকে থাকতে
পারে না; নাকি শেখ মুজিবের জন্যই বাংলাদেশ টিকতে পারে না। এ্যান্থনি : মুজিবকে সরাবার প্রক্রিয়া একবার শুরু হলে, তার স্থলাভিষিক্ত কাকে করা হবে সেই ব্যক্তিত্বকেও কর্নেলদের খুঁজে বের করতে হয়। এদের পছন্দ নিশ্চয়ই নিজেদের পেশার একজন সামরিক ব্যক্তিত্বকে।
এজন্যই তারা মেজর জেনারেল জিয়াকে প্রস্তাব করেছিল? রশিদ : আমাদের প্রথম পছন্দ ছিল জেনারেল জিয়া, কেননা অন্ততপক্ষে তার চরিত্র বিবর্ণ হয়নি। এজন্য অনেক প্রচেষ্টার পর ১৯৭৫ সালের ২০শে মার্চ সন্ধ্যায় আমি তার সঙ্গে সাক্ষাতের ব্যবস্থা করতে সক্ষম হই। জেনারেল জিয়া বললেন, “আমি একজন সিনিয়র অফিসার। এ ধরনের কর্মকাণ্ডে আমি জড়িত হতে পারি না। কিন্তু তােমরা, জুনিয়র অফিসাররা আগ্রহী হলে, এগিয়ে যেতে পারাে।” এ্যান্থনি : আপনি কি এ কথা জেনারেল জিয়াকে পরিষ্কারভাবে বলেছিলেন যে, আপনারা শেখ মুজিবুর রহমানকে হটাবার পরিকল্পনা করেছেন? রশিদ : আপনার মনে রাখা দরকার যে, আমি সামরিক বাহিনীর উপ-প্রধান একজন মেজর জেনারেলের সঙ্গে কথা বলেছিলাম। যদি আমি ভোঁতাভাবে তাকে বলতাম যে, আমি দেশের প্রেসিডেন্টকে সরাতে চাই; সেক্ষেত্রে তাঁর নিজের গার্ডদের দিয়ে সেখানেই আমাকে গ্রেফতার করে সরাসরি জেলে পাঠিয়ে দেয়ার সম্ভাবনা ছিল। তাই আমাকে কিছুটা ঘুরিয়ে ফিরিয়ে কথাটা উত্থাপন করতে হয়েছে। আলােচনার আসল জায়গায় আসার সময় বলেছিলাম যে, ব্যাপকভাবে দুর্নীতি চলছে এবং কিছুই ঠিকভাবে চলছে না; সেজন্য একটা পরিবর্তন দরকার। এসব শুনে জেনারেল জিয়া বললেন, হ্যা, হা। চলাে আমরা বাইরের লন-এ যেয়ে বসে আলাপ করি। এ্যান্থনি : জিয়া কি আপনাকে এভাবে বলেছিল? রশিদ : হ্যা। এরপর আমরা লন-এ গেলাম। আমি তাকে বললাম, আমরা
হচ্ছি পেশাদার সৈনিক। আমরা দেশের সেবা করি; কোনাে ব্যক্তি বিশেষকে নয়। সশস্ত্র বাহিনী, সিভিল সার্ভিস, সরকার—সব কিছুই রসাতলে যাচ্ছে। আমাদের এ অবস্থার পরিবর্তন ঘটাতে হবে।
আমরা জুনিয়র অফিসাররা এর মধ্যেই এ ব্যাপারে পরিকল্পনা করেছি। আমরা আপনার সমর্থন ও নেতৃত্ব কামনা করছি। তিনি (জিয়া) বললেন, আমি দুঃখিত এবং আমি এ ধরনের কিছুর মধ্যে জড়াতে চাই না। যদি তােমরা কিছু করতে চাও, সেক্ষেত্রে জুনিয়র অফিসারদের নিজেদের তা করা উচিত। এ্যান্থনি : তাহলে আপনার এ ধরনের একটা পরামর্শের কথা তিনি
প্রেসিডেন্টকে জানাননি? রশিদ : না। তবে তিনি নিজের এডিসি’কে এ মর্মে নির্দেশ দিয়েছিলেন যে, আমাকে আর কোনাে সাক্ষাৎকার দেয়া হবে না…অথবা আমি কোনাে সময়ে ইন্টারভিউ চাইলে তা যেনাে অগ্রাহ্য করা হয়। এ্যান্থনি : সেক্ষেত্রে কথা হচ্ছে যে, আপনাদের সঙ্গে সাক্ষাৎকারের পর, উনি (জিয়া) আপনাকে জানিয়ে দেন যে, আপনার সঙ্গে উনি আর দেখা সাক্ষাৎ করতে চান না? তাহলে দেখা যাচ্ছে যে, সামরিক বাহিনী (একটি উপদল) থেকে প্রথম যাকে প্রস্তাব করা হলাে, তিনি পিছিয়ে গেলেন। কিন্তু জেনারেল জিয়া অপেক্ষা করলেন এবং পরিস্থিতি নজরে রাখলেন। এ সময়ের মধ্যে জুনিয়র অফিসাররা মুজিবের পতনের ষড়যন্ত্র করল। মাত্র আট মাস সময়ের মধ্যে তিনি এর ফল লাভ করলেন। জেনারেল জিয়া দেশ শাসনের সুযােগ পেলেন। সামরিক বাহিনীর নেতৃত্ব লাভে বঞ্চিত হয়ে কর্নেলরা একজন বেসামরিক ব্যক্তিত্ব ও রাজনীতিবিদ-এর সন্ধান করলেন। ইনিই হচ্ছেন খন্দকার মােশতাক আহম্মদ। কর্নেল রশিদ, মুজিবের মৃত্যুর পর আপনি এবং কর্নেল ফারুক মিলে জনাব মােশতাককে দেশের প্রেসিডেন্ট বানালেন। এর আগে কি।
তাকে সামনের কাতারে এনেছিলেন? রশিদ : হ্যা। আগস্টের প্রথম সপ্তাহে তার সঙ্গে আমার আলােচনা হয় এবং এরপর আমি ১২ই, ১৩ই ও ১৪ই আগস্ট তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করি। এ্যান্থনি : আপনি কি মুজিব হত্যা সম্পর্কে তার সঙ্গে আলােচনা করেছেন? রশিদ : ঠিক হত্যার কথা বলিনি। তবে তাকে এমনভাবে বলা হয়েছে যে, ক্ষমতা থেকে ওদের (মুজিব সরকার) বল প্রয়ােগে হটানাে হবে এবং এ কাজ করতে যেয়ে শেখ মুজিবের হত্যা হতে পারে। এ্যান্থনি : কী ধরনের আলােচনা হয়েছিল, আপনি কি সে সম্পর্কে আমাকে ধারণা দিতে পারেন?
রশিদ : হ্যা। আলােচনার পর আমি তাকে দুটো বিশেষ প্রশ্ন করলাম। যেহেতু তার মতে তিনি শেখের খুব ঘনিষ্ঠ, সেক্ষেত্রে তিনি কি মনে করেন যে, শেখের নেতৃত্বে দেশের অগ্রগতির সম্ভাবনা রয়েছে? তার উত্তর ছিল, না কোনাে সম্ভাবনা নেই। তখন আমি প্রশ্ন করলাম, যখন অন্যান্য রাজনীতিবিদদের মতাে আপনিও মনে করেন যে, দেশের অগ্রগতির কোনাে সম্ভাবনা নেই; তখন আপনি কেন তাকে (মুজিবকে) সংশােধনের পরামর্শ দিচ্ছেন না? তিনি বললেন, আমাদের পক্ষে এটা খুবই দুষ্কর। এ্যান্থনি : আপনি কোনটা বােঝাতে চাচ্ছেন? সরিয়ে ফেলা নাকি পরামর্শ দেয়া? রশিদ: সরিয়ে ফেলা এবং পরামর্শ দেয়া দুটোই ছিল দুষ্কর। এ্যান্থনি : আপনারা কী করতে যাচ্ছেন, এ সম্পর্কে আপনি কি তাকে (মােশতাককে) কোনােরকম ইঙ্গিত দিয়েছিলেন? রশিদ। তিনি বললেন, এ ধরনের কাজ করার জন্য যদি কারও সাহস ও কর্মতৎপরতা থাকে; তাহলে আপনারা ভবিষ্যতে যে নেতৃত্বকে পছন্দ করতে যাচ্ছেন তার জন্য মঙ্গলজনক হবে।… এরপর শুধু জানতে চাইলাম যে, আপাতত তার দেশের বাইরে যাওয়ার কোনাে সম্ভাবনা রয়েছে কি না। এ্যান্থনি : পরবর্তী কয়েক দিনের মধ্যে আপনাকে যােগাযােগের জন্য পাওয়া যাবে কিনা, তিনি কি আপনাকে এ ধরনের সুনির্দিষ্ট প্রশ্ন করেছিলেন? রশিদ : হ্যা। এ্যান্থনি : তাহলে এসব আপনি জিজ্ঞেস করেছিলেন? ১৩ই আগস্ট সেখানে যাওয়ার এই-ই ছিল আপনার উদ্দেশ্য। রশিদ : হ্যা। এ্যান্থনি : আপনি কি সামরিক অভ্যুত্থানের তারিখ সম্পর্কে তাকে কোনাে ধারণা  দিয়েছিলেন? রশিদ; না।… আমি কেমন করে বিশ্বাস করতে পারি? তিনিও তাে এসব শেখকে বলে দিতে পারেন এবং তার দক্ষিণ হস্তে পরিণত হতে পারেন? এ্যান্থনি : আপনার কি এ ধরনের ধারণা হয়েছিল যে উনি (মােশতাক) আপনাদের পক্ষে রয়েছেন? রশিদ : হ্যা। এ্যান্থনি : তাহলে দেখা যাচ্ছে, এই-ই হচ্ছে আর এক ব্যক্তিত্ব এবং যিনি হচ্ছেন মুজিবের অন্যতম মন্ত্রী। যেহেতু তার জানা ছিল যে, তাঁর নেতার মৃত্যু হবে, সেহেতু তিনিও সেই মহা মুহূর্তের জন্য প্রতীক্ষা এবং পর্যবেক্ষণ করছিলেন। সামরিক অভ্যুত্থানের লক্ষ্যে ঢাকায় কর্নেল ফারুক এবং রশিদের অবস্থান ছিল চমকপ্রদ। রশিদ ছিলেন রাজধানীর সুবিধাজনক স্থানে অবস্থানকারী ২য় ফিল্ড আর্টিলারির কমান্ডে এবং ফারুক ছিলেন বাংলাদেশের একমাত্র ট্যাঙ্ক রেজিমেন্টের নেতৃত্বে। প্রেসিডেন্ট মুজিবকে সরিয়ে ফেলার জন্য যে পরিমাণ ‘ফায়ার পাওয়ার প্রয়ােজন। ছিল এ সময় এদের দুজনের কাছে তার চেয়েও বেশি ফায়ার পাওয়ার ছিল। এ্যান্থনি : কোনাে নির্দিষ্ট দিনের কথা মনে মনে স্থির করেছিলেন? ফারুক : তখন আমি চিন্তা করতে শুরু করলাম কখন কাজটা সুবিধাজনক হবে।
অবশ্য এ সময় আমাদের লােকদের জন্য লাগাতার ট্রেনিং এবং ইউনিট ট্রেনিং-এর ব্যবস্থা করি। এই ‘ইউনিট ট্রেনিং’ হচ্ছে প্রতি মাসে দুবার করে রাত্রিকালীন ট্রেনিং। এ্যান্থনি : আপনি কি বেঙ্গল ল্যান্সার্স-এর কথা বলছেন? ফারুক : হ্যা, বেঙ্গল ল্যাসার্স এবং ২য় ফিল্ড রেজিমেন্ট। এ্যান্থনি : কিন্তু এসব তাে হচ্ছে স্বাভাবিক ধরনের ট্রেনিং এক্সারসাইজ”। যখন এসব শুরু হয়েছিল তখন মুজিব হত্যার সঙ্গে এর কি সম্পর্ক থাকতে পারে? ফারুক : না। অপারেশনের কথা চিন্তা করেই এই বিশেষ ট্রেনিং-এর কর্মসূচি প্রণয়ন করা হয়েছিল। কেননা, রাতের অসময়ে অপ্রয়ােজনীয় এবং অঘােষিতভাবে ইউনিট-এর চলাচল নজরে পড়তে বাধ্য। এজন্যই প্রণীত কর্মসূচি অনুযায়ী মার্চ থেকে প্রতি মাসে দুবার করে ‘রাত্রিকালীন ট্রেনিং শুরু করলাম। এ্যান্থনি : ট্যাঙ্ক রেজিমেন্ট … বেঙ্গল ল্যাসার্স-এর ‘রাত্রিকালীন ট্রেনিং’ তাহলে শুরু করলেন? ফারুক : এর সঙ্গে ২য় ফিল্ড রেজিমেন্ট-এরও। এ্যান্থনি : ২য় ফিল্ড আর্টিলারি রেজিমেন্ট হচ্ছে কর্নেল রশিদ-এর রেজিমেন্ট? ফারুক : এর আগেই রশিদ ভারত (ট্রেনিং সমাপ্তির পর থেকে ফিরে এসেছে।
এবং আমিই তাকে এ ধরনের ট্রেনিং-এর কথা বলেছি। এতে বিশেষ দিনে এবং বিশেষ স্থানে আমাদের আলােচনার সুবিধা হলাে। অথচ সবার কাছে ব্যাপারটা স্বাভাবিক মনে হবে। | এ্যান্থনি : মুজিবকে হত্যার জন্য কেন আপনি ১৯৭৫-এর ১৫ই আগস্ট
দিনটিকে বেছে নিলেন? ফারুক : প্রথমত, এটা হচ্ছে রাত্রিকালীন ট্রেনিং। ১৪/১৫ আগস্ট-এর রাত হচ্ছে রাত্রিকালীন ট্রেনিং-এর পূর্ব নির্ধারিত একটি তারিখ । দ্বিতীয়ত, বর্ষাকাল। বর্ষাকালে বাংলাদেশ আক্রমণ করা খুবই দুরূহ। এ সত্ত্বেও যদি ভারত তা করে, তাহলে নিদেনপক্ষে ভারতকে ৬ থেকে ৮ ডিভিশন সৈন্য এনে জড়াে করতে হবে।
এ্যান্থনি : তাহলে আপনি এভাবে চিন্তা করেছিলেন যে, ভরা বর্ষায় ১৫ই  আগস্টে মুজিবকে সরিয়ে ফেললে, ভারত প্রয়ােজনীয় ত্বরিৎ প্রতিক্রিয়া দেখাতে পারবে না। ফারুক : হ্যা। এ্যান্থনি : ভারতের কথা আপনার চিন্তায় এসেছিল কেন? আপনি কি ভারতের
দিক থেকে কোনােরকম অসুবিধা আঁচ করছিলেন? ফারুক : হ্যা। কেননা, শেখ মুজিব ভারতের সঙ্গে যতগুলাে চুক্তি দস্তখত
করেছেন, তার একটিতে এ মর্মে শর্ত রয়েছে যে, দেশে কোনাে গণ্ডগােল হলে উনি ভারতীয় সৈন্য ডেকে পাঠাতে সক্ষম। (বাংলাদেশ-ভারত ২৫ বছরের অনাক্রমণ চুক্তির জন্য অত্র গ্রন্থের পরিশিষ্ট দ্রষ্টব্য] এ্যান্থনি : তাহলে আপনি চিন্তা করেছিলেন, শেখ মুজিব নিজেকে রক্ষার জন্য  মৃত্যুর পূর্বে ভারতীয় সৈন্য তলব করতেও পারতেন?… রশিদ: আমি আর ফারুক হচ্ছি অভিন্ন হৃদয়ের বন্ধু… সে আমার শ্যালিকাকে বিয়ে করেছে; তাই আমরা হচ্ছি ‘ভায়রা ভাই’। এ্যান্থনি : আপনারা দুজনে দুবােনকে বিয়ে করেছেন?…. রশিদ: হ্যা। সেজন্য আমরা পরস্পরকে নির্দ্বিধায় বিশ্বাস করি এবং আমরা দুজনা আমাদের মধ্যে সব কিছুই আলাপ করে থাকি। আমরা যখন ঢাকায় ছিলাম, ফারুক ছিল ল্যানসার্স রেজিমেন্টের কমান্ডে আর আমার কমান্ড ছিল আর্টিলারী রেজিমেন্ট-এর। এ্যান্থনি : ল্যানসার্স-এর ট্যাঙ্ক ছিল… রশিদ : হ্যা। এ্যান্থনি : বাংলাদেশের যতগুলাে ট্যাঙ্ক ছিল সবগুলােই কি ল্যানসার্স-এর? রশিদ : হ্যা। এ্যান্থনি : কতগুলাে ট্যাঙ্ক হবে? রশিদ : ২০/৩০ টার মতাে ট্যাঙ্ক।
এ্যান্থনি : ৩০টা ট্যাঙ্ক-এ কতজন লােক ছিল? রশিদ: ৭০০ জনের মতাে। এ্যান্থনি : ৭০০ জোয়ান, ৩০টা ট্যাঙ্ক। তাহলে কতগুলাে কামান? রশিদ : আমার কাছে ছিল প্রায় ১৮টা কামান। এ্যান্থনি : এসব কী ধরনের কামান? রশিদ : ১০৫ এম এম। এ্যান্থনি : মুজিবকে সরাবার জন্য আপনাদের পরিকল্পনা অনুসারে ছিল ২৮টা ট্যাঙ্ক, ১৮টা ১০৫ এম এম কামান আর ৭০০ লােকবল। রশিদ: হ্যা। ফারুক : এটা রশিদ-এর চিন্তায় এল যে, ব্যক্তিগত আক্রোশ রয়েছে এ ধরনের কিছু অফিসার এর ভিতরে জড়ানাে মঙ্গলজনক হবে। তাই ১৪ই আগস্ট তারিখের রাতের জন্য আমরা এ ধরনের কিছু অফিসার সংগ্রহ করলাম—যারা আগেই বাহিনী থেকে স্থায়ীভাবে অবসর গ্রহণ করেছে। এ্যান্থনি : তাহলে মুজিব হত্যার মাত্র ঘণ্টা কয়েক আগে ১৪ই আগস্ট রাতে আপনারা এদের নিয়ে আসলেন? ফারুক : হ্যা। এদের এ মর্মে বলা হয়েছিল যে, আমরা কোনাে একটা ব্যাপারে পরিকল্পনা করছি—তােমরা নতুন এয়ারপাের্টে আসবে। এ্যান্থনি : ১৫ই আগস্ট ভাের রাতে ৫টা থেকে সাড়ে ৫টার মধ্যে আপনার পূর্ব নির্ধারিত নির্দিষ্ট টার্গেট-এর জন্য দলগুলােকে পাঠিয়ে দিলেন। আপনি কী করলেন? আপনি নিজের জন্য কী দায়িত্ব নিলেন? ফারুক : আমার মূল দায়িত্ব ছিল যে কোনাে ধরনের বিরােধিতাকে নিরপেক্ষ করে দেয়া। এ্যান্থনি : ষড়যন্ত্রকারীরা আশঙ্কা করেছিল যে, বিরােধিতা আসবে রক্ষীবাহিনীর কাছ থেকে; এরাই ছিল শেখ মুজিবের ব্যক্তিগত বডিগার্ড? এ সময় এই আধা সামরিক বাহিনীর ৩,০০০ লােকবল ঢাকায় অবস্থান করছিল। কিন্তু এদের কাছে হালকা ধরনের অস্ত্র ।
এজন্যই ফারুক যে পরিকল্পনা নিয়েছিল তা ছিল সাধারণ ধরনের। ফারুক : আমার ৯৯ ভাগ বিশ্বাস ছিল যে, শেখ মুজিব, সেরনিয়াবাত এবং শেখ মণির হত্যা কার্যকরী হবে। কিন্তু আমি পরবর্তী ঘটনা প্রবাহের ব্যাপারে খুব একটা নিশ্চিত ছিলাম না। এজন্য ‘সাইকোলজিক্যাল ভীতি দেখাবার লক্ষ্যে আমি ট্যাঙ্ক-এর ব্যবহার করেছিলাম। এ্যান্থনি : আপনার কাছে কতগুলাে ট্যাঙ্ক ছিল? ফারুক : এদিন রাস্তায় আমাদের ২৮টা মধ্যম ধরনের ট্যাঙ্ক ছিলাে। এ্যান্থনি : আপনাদের কাছে কী ধরনের গােলাবারুদ ছিল? ফারুক : আমাদের জন্য গােলাবারুদ ইস্যু করা হয়নি। এ্যান্থনি : আপনি কি বলতে চান যে, ট্যাঙ্কগুলােতে কোনাে সমরাস্ত্র ছিল না? ফারুক : হ্যা। এ্যান্থনি : আসলে কি কোনাে অস্ত্রই ছিল না? ফারুক : না। এ্যান্থনি : … তাহলে আপনারা কেন এগুলাে বের করলেন? ফারুক : আমাদের যে গােলাবারুদ নেই, এ কথা সবাই (ইউনিট-এর) জেনে ফেলবে বলে চিন্তাই করিনি। আমার ধারণা ছিল শুধুমাত্র জনাকয়েক নেতৃস্থানীয়রা জানতে পারবে যে, ট্যাঙ্কগুলােতে গােলাবারুদ নেই।…
আমি বুঝাতে চাচ্ছি যে, এটা ছিল ধোঁকাবাজি। এ্যান্থনি : কর্নেল ফারুক-এর ট্যাঙ্কগুলােতে গােলাবারুদ না থাকতে পারে, কিন্তু

কর্নেল রশিদের ফিল্ড গান গুলাের জন্য যথেষ্ট গােলাবারুদ সরবরাহ ছিল। তার কামানগুলাে মুজিবের বাসার উপর দিয়ে গােলা মারতে শুরু করল,..। রক্ষী বাহিনী যাতে ভীত হয়ে পড়ে এবং মুজিবের সাহায্যে এগিয়ে আসতে না পারে সেটাই ছিল এর উদ্দেশ্য। এ্যান্থনী : তাহলে আপনি ৩০টা ট্যাঙ্ক নিয়ে রক্ষী বাহিনীর হেড কোয়ার্টার-এর দিকে রওনা হলেন। ফারুক : আমি ২৮টা ট্যাঙ্ক নিয়ে গ্যারেজ থেকে বেরিয়েছিলাম। কিন্তু যখন আমি এয়ারপাের্ট এবং সেকেন্ড ক্যাপিটাল এলাকা অতিক্রম

করছিলাম, তখন আমার পিছে একটা মাত্র ট্যাঙ্ক অনুসরণ করছে।
এ্যান্থনি : আপনি কি ২৭টা হারিয়ে ফেললেন? ফারুক মনে হয় ওগুলাে ক্যান্টনমেন্ট অথবা এয়ারপাের্টের কোথাও আটকে
পড়েছে। এ্যান্থনি : এরপর আপনি কী করলেন? ফারুক : আমি বিশেষ কিছু করিনি। এয়ারপাের্টের বাউন্ডারি ওয়াল ভেঙে রাস্তায়
গােটা কয়েক গাছ উপড়িয়ে ফেলে কিছুদূর এগিয়ে যেতেই দেখতে পেলাম এক এক লাইনে ৬ জন করে ৩,০০০ রক্ষী বাহিনীর একটি ” ব্রিগেড দাঁড়িয়ে। এদের মাথায় হেলমেট এবং এরা পূর্ণ যুদ্ধ পােশাক পরিহিত। আর এদের সব কিছু রয়েছে।… ড্রাইভার জিজ্ঞেস করল, এখন কী করব। জবাবে বললাম, ওদের নাকের ডগায় ৬ ইঞ্চি পাশ দিয়ে ট্যাঙ্ক চালিয়ে যাও। ট্যাঙ্ক-এর গানারকে বললাম কামান ওদের দিকে তাক করে প্রস্তুত থাক। বাকিদের সাহসিকতাপূর্ণ চেহারায় তাকিয়ে থাকার নির্দেশ দিলাম। আমার পরিকল্পনা মতােই কাজ হলাে। ওরা আমাদের দিকে তাকিয়ে রইলাে এবং আমাদের দৃষ্টিও ওদের উপর। আমি ড্রাইভারকে বললাম, যদি ওরা কিছু শুরু করে,
তখনই ট্যাংকের মাথা ডান দিকে ঘুরিয়ে… এ্যান্থনি : তাহলে কোনােরকম বাধা এলেই আপনারা ওদের উপর দিয়েই ট্যাঙ্ক
চালিয়ে দিতেন? ফারুক : তখন এছাড়া আমাদের করণীয় কিছুই ছিল না। এ্যান্থনি । বাস্তবে আপনি একটি মাত্র অস্ত্রহীন (?) ট্যাঙ্ক নিয়ে ৩,০০০ লােকবল
সম্পন্ন শেখ মুজিবের প্রাইভেট এলিট ফোর্সকে (?) ‘রিডিউস’ করে
দিলেন? ফারুক : যখন কোনাে বাহিনী স্বাভাবিকভাবে প্রতিক্রিয়া করে না, তখন আর

এক দফায় প্রতিক্রিয়া করতে কিছুটা সময়ের প্রয়ােজন। আমার ব্যাপারে মানসিক দিক থেকে আমি নিশ্চিত ছিলাম যে, ওরা এখন আর তাৎক্ষণিকভাবে প্রতিক্রিয়া করবে না। আপনি সম্ভবত জানেন যে, ওরা এখন উদ্ভূত পরিস্থিতির পরীক্ষা ও পর্যালােচনা করবে। আর

একবার কেউ পরিস্থিতির পর্যালােচনা শুরু করলে, ত্বরিভাবে তারা।
কোনাে এ্যাকশন গ্রহণ করে না। এ্যান্থনি : এবার আপনি অন্য টার্গেটগুলাের দিকে এগিয়ে গেলেন? ফারুক : এরপর আমি শেখ মুজিবের বাসার দিকে রওনা হই। শেখ মুজিবের
বাসায় আমাদের লােক আমাকে থামিয়ে বলল, সব কিছু ঠিক আছে। এ্যান্থনি : সব কিছু ঠিক আছে অর্থ কি মুজিবকে হত্যা করা হয়েছে? ফারুক : হ্যা। এ্যান্থনি : এ সময় মুজিবের বাসায় কী ঘটনা ঘটলাে? কেন তার পরিবারের
সমস্ত সদস্যদের হত্যা করা হলাে? ফারুক : শেখকে বলা হয়েছিল আত্মসমর্পণ করার জন্য এবং নিচে নেমে
আসার জন্য। এরপর হলাে কী, তিনি ঘরের মধ্যে চলে গেলেন এবং আর্মি হেড কোয়ার্টারে ফোন করলেন। তাঁর সাহায্যে এগিয়ে আসার জন্য তিনি জেনারেল শফিউল্লাহ এবং মিলিটারি সেক্রেটারি কর্নেল জামিলকে বললেন। এমনকি রক্ষী বাহিনীর হেড কোয়ার্টারেও ফোন করলেন। সবাই তাঁকে জানাল যে, তারা শীঘই হাজির হবেন। মনে হয় এতেই তিনি সাহস পেলেন এবং ছেলেমেয়েদের বললেন প্রতিহত করার জন্য। এ্যান্থনি : তাই মুজিব বুঝতে পেরেছিল যে, সাহায্য আসছে এবং আপনাকে
আর আর্মিকে প্রতিহত করতে শুরু করবে। ফারুক : হ্যা, ওরা গুলি শুরু করে। ওরাই প্রথমে গুলি আরম্ভ করে। আমাদের
সৈন্যদের পক্ষে প্রথম হতাহতের ঘটনা। একজন ঘটনাস্থলেই মারা গেল আর বুলেটে গুরুতরভাবে আহত হলাে চার জন। তাই ঘটনা যখন ঘটেই গেল, তখন আর সময় নষ্ট করা সম্ভব নয়। আমরা কেবলমাত্র তাকে (বাসার বাইরে) আসতে বললাম। তারা গুলি করলাে এবং আমরাও ঘরের মধ্যে গ্রেনেড নিক্ষেপ করলাম। কেননা, সবাই মিলে এই ঘর থেকেই গুলি করছিল। যেহেতু কামরা বন্ধ ছিল এবং সবাই এই ঘরেই ছিল… তাই পরিবারের মহিলা সদস্য এবং শিশুরাও এখানেই ছিল। তাই অ্যাকশন-এর দরুন এরাও হত্যা হয়েছে। এটা খুবই দুঃখজনক। কিন্তু যেহেতু সৈন্য মারা গেছে, সেজন্য এরা আর কোনাে সুযােগ দেয়নি এবং অপেক্ষা করেনি। এ্যান্থনি : আপনি কি আশা করেছিলেন মুজিব বেরিয়ে আসবে এবং আত্মসমর্পণ
করবে? ফারুক। যদি তিনি তা করতেন, তাহলে এ ধরনের ঘটনা হতাে না; সম্ভবত
তার পরিবারের সদস্যরা বেঁচে যেতেন। এ্যান্থনি : কিন্তু আপনি কেমন করে আশা করতে পারলেন যে, মুজিব তা
করবে, মানে কিনা মুজিব বেরিয়ে আসবে…।
ফারুক : … আপনিই দেখুন, যখন আমি তাকে ঘেরাও করে ফেলেছে এবং
তারা আত্মসমর্পণ করতে বলছে, তখন তাঁর উচিত ছিল আত্মসমর্পণ
করা। এ্যান্থনি : তাহলে উনি আত্মসমর্পণ করেননি…তাকে জোর করেই…। ফারুক : এখান থেকে আমি গেলাম রেডিও স্টেশন চেক করতে, রেডিও ভবন।
“সিজ’ করা হয়েছে কিনা। আমি দেখলাম রেডিও স্টেশন নিরাপদে। রয়েছে। এবং এই রেডিও স্টেশন থেকেই খন্দকার মােশতাক আহম্মদ নিজেকে প্রেসিডেন্ট ঘােষণা করেছেন এবং কয়েকটি ঘােষণা
দিয়েছেন। এ্যান্থনি : তাহলে অভ্যুত্থানের আগে আপনারা যাকে পছন্দ করেছিলেন, সেই
জনাব মােশতাক আহম্মদ নিজেকে প্রেসিডেন্ট ঘােষণা করলেন? ফারুক : এখানে তার সঙ্গে আমাকে পরিচয় করানাে হলাে। এই প্রথমবারের
মতাে আমি তার সঙ্গে পরিচিত হলাম। তিনি আমাকে বসতে অনুরােধ করলেন … কিন্তু আমি তখনও অনিশ্চিত বােধ করছিলাম। … আমার কিছু পুনর্বিন্যাস সম্পর্কিত কাজ রয়েছে। যে কোনাে মিলিটারি অপারেশনের পর কিছু পুনর্বিন্যাসের কাজ সম্পন্ন করতে
হয়। এ্যান্থনি : এ কথা বলতেই হচ্ছে যে প্রথম ভদ্রলােক এতদিন পর্যন্ত সীমারেখায়
নিপভাবে দাঁড়িয়ে ছিলেন, সেই মােশতাক আহম্মদ প্রেসিডেন্ট হলেন। ১৫ই আগস্ট শেখ মুজিবের উত্তরসূরী হিসাবে আপনি খন্দকার মােশতাক আহম্মদকে নয়া প্রেসিডেন্টের গদিতে বসালেন। ক্ষমতায় ছিলেন তিনি ৮৩ দিন। আপনার আকাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যগুলাে কি
তিনি পূর্ণ করতে সক্ষম হয়েছিলেন? ফারুক : না। তিনি করেননি। এ্যান্থনি : তিনি কি মুজিবের নীতিই অনুসরণ করেছিলেন? নাকি তিনি।
নীতিগতভাবে পরিবর্তন এনেছিলেন? ফারুক : তিনি বলেছিলেন (পরিবর্তন) করবেন, কিন্তু সে সময় তিনি করেননি। এ্যান্থনি : গত বছর (১৯৭৫) ৩রা নভেম্বর ব্রিগেডিয়ার খালেদ মােশাররফ এসে

খন্দকার মােশতাককে অপসারণ করেন এবং অনতিবিলম্বে নিজেকে জেনারেল হিসাবে প্রমােশন দেন। মাত্র চারদিনের মধ্যে আর একটি সামরিক অভ্যুত্থানে এই ব্রিগেডিয়ার (মেজর জেনারেল) নিহত হন। এরপর দ্বিতীয় ব্যক্তিত্ব যিনি এতদিন পর্যন্ত প্রতীক্ষা করছিলেন সেই জেনারেল জিয়াকে ক্ষমতায় আনা হলাে। কেবলমাত্র এ সময় স্বীয় নিরাপত্তার জন্য তিনি ফারুক এবং রশিদকে অপসারণ করলেন। এসবই হচ্ছে জঙ্গল-এর আইন-কানুন। এদের নির্বাসনে রাখা হলাে এবং স্বল্প দিনের ইতিহাসে বাংলাদেশ সামরিক অভ্যুত্থানের মাঝে

বেঁচে থাকতে অভ্যস্ত হলাে।
১৯৭৫ সালের নভেম্বরে মােশতাককে সরাবার পর যখন জেনারেল জিয়া তার সমস্ত উদ্দেশ্য ও লক্ষ্যের পথে সরকার পরিচালনা করছেন, তিনি কি কোনােভাবে মােশতাকের নীতি পরিবর্তন করছেন? ফারুক: জেনারেল জিয়া কিছুই করেননি এবং তিনি কিছু করতে সক্ষম নন। এ্যান্থনি : দেশ শাসনের ক্ষেত্রে তিনি কি মুজিবের মতােই খারাপ (প্রশাসক)? ফারুক : তিনি শেখ মুজিবের নীতিই অনুসরণ করে যাচ্ছেন। টেলিভিশনের ধারা ভাষ্যকার : মুজিবকে হত্যা করে বাংলাদেশ কি ফায়দা উঠাতে সক্ষম হয়েছে? এ্যান্থনি : গত ১২ মাসের (১৭৫-৭৬) ঘটনাবলী পর্যবেক্ষণ করে বলা যায় যে, খুবই কম ক্ষেত্রেই পরিবর্তন হয়েছে। কিন্তু সেখানে কোনাে গণতন্ত্র নেই। এখন পর্যন্ত জনগণের কাছে এ ধরনের কোনাে সুযােগ আসেনি। সেখানে দারুণ বঞ্চনা। নিশ্চিতভাবে সেখানে কিছু পরিমাণ দুর্নীতি রয়েছে। পুলিশী হয়রানি এবং অনিশ্চিত পরিবেশ…। এ ধরনের এক প্রেক্ষাপটে যে কোনাে লােক সব সময়ের জন্য একটা প্রশ্নই শুনতে পারে, তাহলে মুজিবকে কেন মরতে হয়েছে?… [কোনাে কোনাে গবেষকের মতে ঘটনার এক বছর পর অত্র সাক্ষাৎকারের বর্ণনা হিসাবে এবং ফারুকের জবানবন্দি অনুসারে সপরিবারে মুজিব হত্যার সময় ফারুক ছিলেন রক্ষী বাহিনীর হেড কোয়ার্টারে। এজন্য ঠিক কীভাবে সপরিবারে বঙ্গবন্ধু নিহত হলেন সে সম্পর্কে ফারুকের বক্তব্যের পরেও সুষ্ঠু ও পরিচ্ছন্ন রিসার্চ অপরিহার্য।-লেখক

সূত্রঃ মুজিবের রক্ত লাল – এম আর আখতার মুকুল

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!