You dont have javascript enabled! Please enable it!

বাংলার বাণী
ঢাকা : ৭ই অক্টোবর, সোমবার, ১৯৭৪, ২০শে আশ্বিন, ১৩৮১ বঙ্গাব্দ

বাংলাদেশ শান্তি ও সম্প্রীতির নীতিতে বিশ্বাসী

স্বাধীনতা যুদ্ধের মাধ্যমে আমরা রাজনৈতিক ও সামাজিক ক্ষেত্রে যে নতুন জাগরণ ও মূল্যবোধের বিকাশ ঘটাতে সক্ষম হয়েছিলাম তা আজ অনেকটা বিলুপ্তির পথে। তবু মুক্তিযুদ্ধকে বাস্তব সমর্থনের কারণে বিশ্বের যে সকল দেশ আমাদের পরীক্ষিত বন্ধু হিসেবে পরিগণিত হয়েছিল তাদের মাঝে আজও বাংলাদেশ সম্পর্কে আগ্রহ কমেনি। বৈদেশিক নীতির সুস্পষ্টতায় বাংলাদেশের প্রতি বিশ্বের আরো অনেক দেশই পরবর্তীকালে আগ্রহ দেখিয়েছে, সমর্থন যুগিয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের কালে বিশ্বের কয়েকটি দেশ সরাসরি আমাদের বাস্তব সাহায্য করেছে। তাদের সমর্থন ও বাস্তব সহযোগিতা না পেলে তৎকালীন উদ্ভূত নানা সমস্যারই সমাধান বাংলাদেশের পক্ষে অসম্ভব হয়ে পড়তো। স্বাধীনতা লাভের পর বাংলাদেশ সেই সকল পরীক্ষিত বন্ধুদের সঙ্গে উদার বন্ধুত্বমূলক সম্পর্ক স্থাপন করেছে। মুক্তিযুদ্ধের সময় ভারত আমাদের সরাসরি সাহায্য ও সহযোগিতা করেছিল। যুদ্ধের শেষ পর্বে এসে তাদের সৈন্যবাহিনী আমাদের মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে একাত্ম হয়ে যুদ্ধ করে দখলদার পাকিস্তান বাহিনীকে পরাজিত করেছিল। এছাড়া রাজনৈতিক আশ্রয়, শরণার্থীদের আশ্রয় ও রক্ষণাবেক্ষণ রাজনৈতিক আশ্রয় প্রাপ্ত মুজিবনগর সরকারকে সকল প্রকার সহযোগিতা, বৈদেশিক সাহায্য ও সমর্থনের প্রশ্নে ভারত সরকারের আন্তরিক সহযোগিতা প্রভৃতির মাধ্যমে ভারত সরকার ও তার জনগণ সেদিন যে উদাহরণ সৃষ্টি করেছিল তা নজিরবিহীন। যারা মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিল তারা সে অবদানের কথা কোনোদিন ভুলবেনা। মহান বন্ধুরাষ্ট্র সোভিয়েত ইউনিয়নের অবদানের কথাও কারো বিস্মৃত হবার নয়। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের প্রশ্নে আমেরিকা ও চীনের আচরণের বিরুদ্ধে সেদিন সোভিয়েত ইউনিয়ন যে ভূমিকা গ্রহণ করেছিল বাংলাদেশের ইতিহাসে সে কথা নিঃসন্দেহে লিপিবদ্ধ থাকবে। জনগণও কোনোদিন সে অবদানের কথা ভুলবে না।
স্বাধীনতা লাভের পর থেকে দেশের ভেতরে এবং বাইরের পৃথিবীতে অনেক পরিবর্তন সূচিত হয়েছে। বিশেষ করে বাংলাদেশের বাস্তবতা ক্রমান্বয়ে সবাই একদিন মেনে নিয়েছে। একমাত্র চীন ছাড়া বিশ্বের প্রায় সকল জাতিসংঘভুক্ত দেশগুলোই আজ বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিয়েছে। সম্প্রতি জাতিসংঘে বাংলাদেশের অন্তর্ভুক্তির কাজ সম্পন্ন হয়ে যাওয়ায় একটি দেশ হিসেবে বিশ্বের যতগুলো সংস্থার স্বীকৃতি আবশ্যক বাংলাদেশ তা অর্জন করেছে। আজ বিশ্ব মানচিত্রে একটি পরিপূর্ণ স্বাধীন সার্বভৌম দেশ হিসেবে সে আজ স্বীকৃত। বাংলাদেশ তার জন্মের পর থেকেই জোটনিরপেক্ষ পররাষ্ট্র নীতির কথা সুস্পষ্টভাবে ঘোষণা করেছে। এবং সেই নীতির ভিত্তিতেই পারস্পরিক সৌহার্দ্য প্রতিষ্ঠার জন্য উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। উপমহাদেশের রাজনীতিতে সহযোগিতা ও সম্প্রীতি গড়ে তোলার জন্য বাংলাদেশ জন্মের পর থেকেই হাত বাড়িয়েছে। বিশেষ করে পাকিস্তানের সঙ্গে সকল বিরোধ মিটিয়ে ফেলার জন্য বাংলাদেশই প্রথম আগ্রহ প্রকাশ করেছে। ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে সিমলা চুক্তি এবং পরবর্তীকালে দিল্লী চুক্তি বাস্তবায়নের জন্য বাংলাদেশ সরাসরি তার মনোভাব ব্যক্ত করেছে। পাকিস্তান যখন বাংলাদেশকে একটি স্বাধীন দেশ হিসেবে স্বীকৃতি জানালো তখন থেকেই বাংলাদেশ অন্যান্য সমস্যার সমাধানের জন্য আগ্রহ প্রকাশ করেছে এবং উদ্যোগও নিয়েছে। বস্তুতঃ বাংলাদেশ শান্তি, মৈত্রী ও প্রগতিতে বিশ্বাসী বলে পূর্বাপর সে উপমহাদেশীয় বিশেষ করে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর মাঝে একটি সহযোগিতামূলক সম্পর্ক গড়ে তোলার জন্য আগ্রহ প্রকাশ করে এসেছে। কিন্তু চীনের মনোভাব সরাসরি উপলব্ধি করা অনেক ক্ষেত্রেই সম্ভব হয়নি। বিশেষ করে জাতিসংঘে বাংলাদেশের অন্তর্ভুক্তির প্রশ্নে প্রথমবারে দেওয়া তার ভেটো নীতির কারণে স্বাভাবিকভাবেই আমাদের উদ্যোগে আঘাত এসেছিল। পরে অবশ্য চীনের নীতি কিছুটা পরিবর্তিত বলে প্রতীয়মান হয়েছে। চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের যোগাযোগ ও কূটনৈতিক কথাবার্তা শুরু হয়েছে বলেও সরকারীভাবে ঘোষণা করা হয়েছে। অন্যদিকে জাতিসংঘে বাংলাদেশের অন্তর্ভুক্তির কারণে এবং আমেরিকার যুক্তরাষ্ট্রে বঙ্গবন্ধুর সফরের মাধ্যমে সম্পর্কের একটি নতুন দ্বার উন্মোচিত হয়েছে বলেও সরকারীভাবে জানানো হয়েছে। বাংলাদেশের মানুষ নতুন বন্ধুদের যেমন স্বাগত জানাতে প্রস্তুত তেমনি মুক্তিযুদ্ধের পুরনো পরীক্ষিত বন্ধুদের কথা কৃতজ্ঞচিত্তে স্মরণ করতেও বদ্ধপরিকর। সরকার তার পররাষ্ট্রনীতির ঐতিহ্যকে সামনে রেখে অতীত ও বর্তমানের বন্ধুদের সঙ্গে সম্পর্কের মানদন্ড নির্ণয় করবেন বলে আমাদের বিশ্বাস।

আজ বিশ্বশিশু দিবস

আজ বিশ্বশিশু দিবস। বছর পরিক্রমায় প্রতি বছরই এই বিশেষ দিনটি একবার করে ঘুরে আসে। এবং জাতিসংঘের আহ্বানে প্রতি বছর এ দিবসটি সারা বিশ্বে বিপুল উৎসাহ-উদ্দীপনা, মানবিক সুপারিশ ও কল্যাণমুখী কার্যক্রমের মধ্য দিয়ে পালিত হয়। এবারেও তার ব্যতিক্রম হবে না। বিশ্বের সকল দেশের নিষ্পাপ শিশুকে রক্ষা করা ও লালনের মাধ্যমে বিকশিত করে তোলার প্রেরণা ও সহযোগিতা জোগানোই বিশ্বশিশু দিবসের প্রধান উদ্দেশ্য।
আমোদের বাংলাদেশে এবারের বিশ্বশিশু দিবস এসেছে বন্যাবিধ্বস্ত গৃহহীন, ক্ষুধার্ত ও পুষ্টিহীন জীবন্মৃত কোটি কোটি শিশুদের হতাশা কান্নার মাঝে। শিশুখাদ্যের অভাবে প্রাণ ধারণের মৌলিক চাহিদাটুকু আজ এদের বিপন্ন। এমন কি প্রচন্ড শিশুখাদ্যের অভাবে অসহায় প্রায় দু’কোটি শিশুর জন্য নেই বিকল্প খাদ্য বা চিকিৎসার ব্যবস্থা। অথচ অনাহার আর অপুষ্টিতে রুগ্ন ঐ দেহগুলোই যে ভবিষ্যত বাংলাদেশের উত্তরাধিকারী—এত বড় সত্যকে অস্বীকার করার উপায়ও নেই। জাতিকে গড়ে তুলতে হলে এবং কোনো জাতির জন্য সুন্দর একটা ভবিষ্যত তৈরী করার অন্যতম হাতিয়ারই যে শিশু—এও সর্বজন স্বীকৃত সত্য।
বিশ্বশিশু দিবসের স্মরণে বাংলাদেশের শিশু সংস্থাগুলো কিছু কিছু কার্যসূচী হাতে নিয়েছে। শিশু-কিশোর সংগঠন, কেন্দ্রীয় খেলাঘর আসর এ উপলক্ষে কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে আলোচনা সভার আয়োজন করেছে। এবং এই সংগঠন এবার শ্লোগান করেছে—‘ক্ষুধার্ত শিশুকে বাঁচতে দাও।’ বাংলাদেশ শিশু কল্যাণ পরিষদও বাংলাদেশ পরিষদ মিলনায়তনে শিশুদের একটি আলোচনা সভার আয়োজন করেছে। এদের আলোচ্যসূচী হলো—‘প্রত্যেক শিশুর জন্য উজ্জ্বল ভবিষ্যত চাই।’
এ কথা সত্য যে, শুধুমাত্র বিশেষ দিনের বিশেষ আয়োজনে কিছু আলোচনা বা শ্লোগানসর্বস্ব কার্যসূচী হাতে নিলেই বিশ্বশিশু দিবসের উদ্দেশ্য সিদ্ধ হবে না। যে জন্য দীর্ঘমেয়াদী কার্যকরী পরিকল্পনার ভিত্তিতে বাস্তব কর্মসূচী প্রণয়ন করতে হবে। মূলগতভাবে একটি শিশুকে বিকশিত করে তোলার জন্য খাদ্য-বস্ত্র-শিক্ষা-ঠাঁই এর নিরাপত্তা বিধান করা যায় কিভাবে সে চিন্তা রাখতে হবে।
উন্নয়নশীল দেশগুলোর সামনে বিশেষভাবে নানা সমস্যার মাঝে শিশু পালন ও লালনই আজ অন্যতম প্রধান সমস্যা। উন্নয়ন পরিকল্পনা, উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের তাগিদ এবং নানাবিধ প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের মোকাবেলা করেও শিশুদের জন্য একটা নিরাপদ ও সুন্দর ভবিষ্যতের কথা তাদের চিন্তা করতে হবে। এই সমস্যায় আমরাও আক্রান্ত। এদেশের প্রায় সোয়া কোটি দম্পতি প্রতিদিন এদেশকে প্রায় দশ হাজারের মতো যে শিশুগুচ্ছ উপহার দিচ্ছে তাদের কথা সবাইকে ভাবতে হচ্ছে। কি নিদারুণ অথচ সত্য!
শুধু উন্নয়নশীল দেশের কথাই বা কেন—উন্নত দেশগুলোও আজ শিশুদের নিরাপদ ভবিষ্যত ও সুস্থ জীবনের ব্যাপারে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছেন। ইউরোপীয় অভিন্ন বাজারের সাবেক প্রেসিডেন্ট মিঃ সিসকো ম্যান্সহোল্ট সম্প্রতি বন-এ একদল আন্তর্জাতিক খাদ্য ও কৃষি বিশেষজ্ঞের কাছে বলেছেন যে, শুধুমাত্র প্রোটিনের অভাবেই সারা বিশ্বে বর্তমানে ১৮ কোটি শিশুর কোনো না কোনোভাবে মানসিক বিকাশ ব্যাহত হচ্ছে। এই পরিস্থিতিকে তিনি এক বিরাট সংকট ও মহাবিপর্যয় বলে উল্লেখ করেন।
উন্নয়নশীল দেশের শিশু প্রসঙ্গে আবার বলতে হয় যে, খাদ্য ঘাটতি সমস্যাকে সামনে রেখে শিশুর প্রোটিন জোগানোর গুরুদায়িত্ব আজ এককভাবে কোনো দেশই হয়তো পালন করতে পারবেনা। এ কথা অনস্বীকার্য যে, আধুনিক বিশ্বে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক যতই সম্প্রসারিত ও পারস্পরিক সমঝোতাভিত্তিক হচ্ছে—ততই উন্নয়নশীল দেশগুলো উন্নত দেশের সাহায্য ও সহযোগিতার আশ্বাস পাচ্ছে। আমাদের দৃঢ়বিশ্বাস এই আশ্বাস মৌখিক নয় বা আনুষ্ঠানিক নয়। তবে এ কথাও ঠিক যে, শুধু নির্ভরশীলতা নয়—নিজেদের উদ্যোগও সেই সঙ্গে রাখতে হবে। আমাদের দেশে শিশু কল্যাণ সমিতি ও সংস্থার সংখ্যা আরও বাড়াতে হবে এবং বহুমুখী কার্যক্রমে তাকে করে তুলতে হবে প্রাণবন্ত ও কার্যকরী। আর সমাজ সেবা প্রতিষ্ঠানগুলোর দায়িত্বও এ ব্যাপারে অপরিসীম।
তাই আজ বিশ্বশিশু দিবসের আন্তর্জাতিক আবেদন ও উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে বিশ্বের যাবতীয় নিষ্পাপ শিশুদেরকে ভবিষ্যত পৃথিবীর যোগ্য নাগরিকরূপে গড়ে তোলার শর্তহীন শপথ নিতে হবে দায়িত্বশীল ও সচেতন বিশ্ববাসীকে। কারণ সাম্রাজ্যবাদী শক্তি, সমাজবিরোধী ও দুষ্কৃতিকারীদের কুচক্র এবং সকল প্রকার অন্যায়-অত্যাচার ও নিষ্ঠুর শোষণের হাত থেকে কুসুমপেলব শিশু জীবনগুলোকে রক্ষা করতে না পারলে এই দিবসের মর্যাদা ক্ষুন্ন হবে এবং অপমানিত হবে মানবরা ও মানুষের শুভবুদ্ধি। বিশ্বমানব সমাজের পক্ষে যা গৌরবের নয়।

কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক

পত্রিকার মূল কপি পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!