অর্থনীতির দৃষ্টিকোণে বাংলাদেশ
বাংলাদেশের আয়তন হচ্ছে ৫৫,১২৬ বর্গমাইল। লােকসংখ্যা বর্তমানের সাড়ে সাত কোটি। অর্থাৎ শতকরা প্রায় ৫৬ ভাগ পাকিস্তানের মােট জনসংখ্যার। দেশের শতকরা ৮২ ভাগ লােক চাষের কাজে লিপ্ত। মােট জমির শতকরা ৬৪ ভাগে (প্রায় ২১-৫০ মিলিয়ন একর) চাষাবাদ হয়।
ধান পাট প্রধান ফসল। পৃথিবীর ৮০ ভাগ পাট এখানে উৎপন্ন হয়। এছাড়া পার্বত্য অঞ্চলে চা ও অন্যান্য জায়গায় তুলাে, তামাক, আখ, গম, ডাল ও অন্যান্য ফসলও ফলে। পাট, চা ইত্যাদি থেকে মূল্যবান বৈদেশিক মুদ্রা রােজগার হয়। একমাত্র পাট ও পাটজাত দ্রব্য রপ্তানী করেই ‘৬৭-৬৮ সালে ১৩৬ কোটি ১০ লক্ষ টাকা (রপ্তানী বাণিজ্যের শতকরা ৪৫ ভাগ) পাওয়া গেছে। গােটা পাকিস্তানের মাত্র ১৫ ভাগ, উর্বর এই নদীমাতৃক ভূখণ্ডের লােকের জীবনযাত্রা মূলত কৃষি ও সংশ্লিষ্ট অন্যান্য বৃত্তির ওপরই নির্ভরশীল। অথচ তুলনায় অনেক কম উর্বর ও লােকসংখ্যা কম থাকা সত্ত্বেও পশ্চিম পাকিস্তান অবাধে দীর্ঘদিন ধরে এই অঞ্চলকে নানাভাবে শােষণ করে চলেছে।
বিগত দু’দশকে রজস্বখাতে বাংলাদেশে খরচ হয়েছে ১৫০০ কোটি টাকা, পশ্চিম পাকিস্তানে ৫০০০ কোটি টাকা। ২৫ শে মার্চের পর থেকে বাংলাদেশের মাঠে মাঠে যে ফসল ইতিমধ্যেই ফলেছে পাকবাহিনী সেসব নষ্ট করছে। চাবাগানগুলিরও রেহাই নেই। তাছাড়া উপযুক্ত সময়ে ঐসব ফসল ঘরে তােলার অভাবে নষ্ট হয়ে গেছে মাঠেই। এছাড়া ব্যাপক হারে দেশত্যাগের ফলে চাষের কাজে অসুবিধাও দেখা দিতে পারে।
এমনকি চাষের অভাবে জমি পড়ে থাকাও বিচিত্র নয়। ফলে আগামী দিনগুলিতে প্রচণ্ড মাদ্যাভাবেরও • সম্ভাবনা রয়েছে। নবগঠিত রাষ্ট্রের সামনে যা যথেষ্ট উদ্বেগের কারণ হতে বাধ্য। যুদ্ধ দীর্ঘস্থায়ী হলে
রাষ্ট্রপ্রধানদের দেখতে হবে যাতে ক্ষেতে, বাগানে ফসল ফলে। কারণ, খালি পেটে যুদ্ধ চলে না এটা নিষ্ঠুর সত্য। এ ক্ষেত্রে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনকারী ফসল ফলানাের জন্য নড়াইকে স্থান বিশেষে সীমাবদ্ধ করার কথাও ভাবতে হতে পারে। এছাড়া খাদ্যাভ্যাস পাল্টানাের কথাও চিন্তা করার দরকার।
এতাে গেল অর্থনীতিতে কৃষির অবস্থা। এবার শিল্প-কারখানার, ব্যবসার অবস্থা দেখা যাক। যুদ্ধের আগে পর্যন্ত বাংলাদেশে উন্নয়নখাতে ব্যয় হয়েছে মােট ব্যয়িত অর্থের ১/৩ ভাগ, মাত্র ৩০৬০ কোটি টাকা। অথচ একমাত্র রাজস্ব মূলধন খাতেই ৪৭-৪৮ থেকে ৬৮-৬৯ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ যুগিয়েছে প্রায় ২৯৭৮ কোটি টাকা। পশ্চিম পাকিস্তান পেয়েছে ৬,০০০ কোটি টাকা। পশ্চিমের মাত্র ২৪টি ব্যবসায়ী পরিবার গােটা পাকিস্তানের ৬০ ভাগেরও বেশী শিল্প কারখানা, শতকরা ৮০ ভাগে ব্যাংক ব্যবস্থা, শতকরা ৭৫ ভাগ বীমা সম্পত্তি নিয়ন্ত্রণ করে। ব্যাংক মােট শতকরা তিন ভাগ অ্যাকাউন্টসে (টাকা) ৮২ ভাগ লগ্নী করেছে। অর্থাৎ দেশের ব্যবসা-বাণিজ্যে পূবের অংশ নেই বললেই চলে। অথচ পূবের বাজারই দেশের ব্যবসার প্রধান অংশ, শােষণের সূত্র। পাট ও পাটজাত দ্রব্যের রপ্তানী মােট রপ্তানীর শতকরা ৪৫ ভাগ। অথচ মােট বৈদেশিক দ্রব্য আমদানীর শতকরা মাত্র ২৫ ভাগ পূবের বরাতে। গােটা পাকিস্তানে কল-কারখানা, শিল্প মূলতঃ বিদেশী সাহায্যে, সহযােগিতায় যা কিছু তৈরী হয়েছে বা হতে চলেছে তার মাত্র শতকরা ২০ ভাগ জুটেছে বাংলাদেশের বরাতে। বাকী ৮০ ভাগ ইসলামাবাদের খপ্পরে। অথচ জনসংখ্যার হিসেবে পূবের ভাগেই বেশী বরাদ্দ হওয়ার কথা। দেশভাগের সময় বাংলাদেশে ছিল মাত্র ১০টি কাপড়ের কল, ৫টি চিনিকল আর এধার ওধারে ছােটখাটো কিছু শিল্প কারখানা। একটাও পাটকল ছিল না। এবার সরকারি উদ্যোগে কি হয়েছে। দেখলেই বােঝা যাবে বঞ্চনা কতদূর। ১৯৫২ সালে পি আই ডি সি দশ বছর পর ই পি আই ডি সি (৬২ সালে) গঠিত হওয়ার পর দুটি সংস্থায় মিলে বাংলাদেশের মাটিতে কল-কারখানা গড়েছে যথাক্রমে ২১টি ও ৪৭টি মােট ৬৮ টি। এজন্যে দশ বছরে খরচ করেছে মাত্র ৮৩ কোটি ২০ লক্ষ টাকা ও আট বছরে ১৫৫ কোটি টাকা। মােট ২৩৮ কোটি ২০ লক্ষ টাকা। যেখানে এতদিন ধরে পূবদেশ রপ্তানী বাণিজ্যে এনেছে কয়েক হাজার কোটি টাকা। এক বছরেই (৬৭-৬৮ সালে) ১৩৬ কোটি ১০ লক্ষ টাকা। ঐসব সরকারি শিল্পোদ্যোগে কাজ পেয়েছে ৭৫ হাজার লােক। আর শমজীবীদের সংখ্যার মােট ভাগের মধ্যে শতকরা ৫৭ ভাগ বাংলাদেশের লােক। তাদের মধ্যে ৯০ লক্ষ লােক বেকার। এই সংখ্যাও দ্রুতহারে বাড়ছে। বাংলাদেশের এ যাবত উন্নতির চমৎকার নমুনা এটি।
এই সবই হচ্ছে ২৫শে মার্চ পর্যন্তের হিসেব। এরপর থেকে যা কিছু চোখে পড়েছে নির্বিচারে পাক বাহিনী তা কামানের গােলা, বিমান থেকে বােমা ফেলে ও অন্যভাবে নষ্ট, ধ্বংস করেছে নিছক প্রতিহিংসার বশবর্তী হয়েই। এই পরিস্থিতিতে বাংলাদেশে প্রকৃতপক্ষে অটুট অক্ষত অবস্থায় কটা কল-কারখানা এখনও আছে অথবা আদৌ চালু হওয়ার মত অবস্থায় আছে কিনা সন্দেহ। অর্থাৎ আক্ষরিক অর্থেই ধরতে হবে যে, এ পর্যন্ত যা কিছু কল-কারখানা ইত্যাদির অস্তিত্ব ছিল তার বেশীর ভাগই ধ্বংসপ্রাপ্ত অথবা বিকল হয়ে গেছে। অল্প যে কয়টি এখনও টিকে আছে তাদেরও অবস্থা সঙ্গীন। মানে শিল্প বলতে বিশেষ কিছুর চিহ্নই নেই, ধ্বংসস্তুপ ছাড়া অর্থাৎ জন্মরুপন বাংলাদেশের শিল্প কারখানা বড় রকম আঘাত পেয়েছে। অর্থনৈতিক অবস্থার কথা ভেবে যুদ্ধনীতিতে বাংলাদেশের সামান্য পরিবর্তন আনার দরকার হতে পারে। এখনও যেসব কল-কারখানা মুক্তিফৌজের দখলীকৃত এলাকার মধ্যে রয়েছে এবং অবিলম্বে চালু করা যেতে পারে সেসবগুলিকে চালু করার চেষ্টা করতে হবে। এছাড়া পাকবাহিনীর কাছ থেকে যতদূর সম্ভব অক্ষত অবস্থায় কল-কারখানা দখলের কথাও ভাবা দরকার। আজকের দিনে বিদ্যুৎশক্তি মেশিন চালু রাখার অন্যতম প্রধান উৎস। ইতিমধ্যেই ধ্বংসপ্রাপ্ত বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্রগুলির কথা বাদ দিলে অল্প ক্ষতিগ্রস্ত বা চালু করা যেতে পারে এমন কেন্দ্রগুলি দৃঢ়তার সঙ্গে রক্ষা করতে হবে। যাতে বিদ্যুৎ সরবরাহ চালু রাখা যায়। লড়াই যেহারে ছড়িয়ে যাচ্ছে তাতে উপরােক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ কতদূর সম্ভব সন্দেহ আছে। তাছাড়া ব্যাপক গণহত্যা ও দেশত্যাগের ফলে অনেক দক্ষ শিল্পকর্মী হয় মারা গেছেন না হয় অন্যত্র চলে গেছেন। ফলে কল-কারখানা চালু করাও সমস্যা বলা যায়। তবে নিত্য প্রয়ােজনীয় জিনিষপত্রের কল-কারখানায় উৎপাদনের ওপর অনুন্নত বা উন্নয়নশীল দেশের বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলের লােকেরা কম নির্ভরশীল হওয়ায় ও জীবনযাত্রায় শহুরে ছাপ না থাকায় যে কোন অবস্থা বিপাকে তারা দিশাহারা বা একেবারে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে না। এই বিশেষত্বের জন্যেই বােধহয় এশিয়ার বিভিন্ন অঞ্চলে দীর্ঘকাল ধরে প্রচণ্ড প্রতিকূলতার মধ্যেও যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়া সম্ভব হয়েছে ও হচ্ছে।
নবগঠিত রাষ্ট্রের সরকারি কর্মীরা মানেই পেয়েছেন খবরটা কাগজে বেরিয়েছে। এর ফলে বােঝা যাচ্ছে যে বাংলাদেশের সরকার কোষাগারে জমা থাকা বা পরে জমা পড়া টাকা ব্যবহার করছেন। নগদ ৩০ কোটি টাকা বাংলাদেশের সরকারি কোষাগারে জমা পড়েছে। আরও কয়েক কোটি টাকা ও সােনারূপাে সীমান্তের এপারে ভারতের সরকারি ট্রেজারী ও ব্যাংকে জমা হয়েছে। এছাড়া প্রবাসী বাংলা দেশবাসীরা চাঁদা তুলেও বেশ কয়েক লক্ষ পাউন্ড জোগাড় করেছেন। এ সবই বাংলাদেশ সরকারের উপস্থিত কাজে লাগছে নানা প্রয়ােজনে। কিন্তু এইসব সঞ্চিত অর্থেরও একটা সীমা আছে। সীমান্ত অঞ্চলের অধিবাসীরা না হয় বিনিময়ের মাধ্যমে প্রয়ােজনীয় জিনিসপত্র যােগার করছেন ভারত থেকে। সেই সঙ্গে পাক নােট ও মুদ্রাও অবাধে ব্যবহার হচ্ছে। যদিও এর আন্তর্জাতিক মূল্য শতকরা ত্রিশ পঁয়ত্রিশ ভাগ কমে গেছে। বাংলাদেশের সরকারি ট্রেজারী, ব্যাঙ্ক থেকে পাক বাহিনী কোটি কোটি নগদ টাকা সােনারূপাে লুঠ করেছে। জনসাধারণের সঞ্চিত অর্থ সােনাদানাও লুঠ করেছে। জাহাজ বিমানযােগে সেসব পশ্চিম পাকিস্তানে চালান হয়েছে সুযােগমত এখনও পাচার হচ্ছে। ফলে সঞ্চিত সম্পদের হিসেবে বাংলাদেশ এখন প্রায় রিক্তই বলা চলে। যেহেতু বাংলাদেশ স্বাধীন, সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে সেইজন্যে যুদ্ধের মধ্যেই তার নিজস্ব মুদ্রার ব্যবস্থা করার কথা ভাবতে হবে। ইসলামাবাদ থেকে টাকা আর আসবে না। আন্তর্জাতিক অর্থ ভান্ডারের নিয়মানুযায়ী নবগঠিত রাষ্ট্রের টাকার সমমূল্যের সােনা সঞ্চয়ের দরকার হবে। এজন্যে ইতিমধ্যেই জমা সােনা ও স্বেচ্ছাদান হিসেউের সােনা সংগ্রহের কথা ভাবা যেতে পারে। এছাড়া রপ্তানী বাণিজ্যের ফলে বাংলাদেশের প্রতি সহানুভূতিশীল রাষ্ট্রগুলির কাছে যদি কোন অর্থ পাওনা থাকে তার মধ্যে জনসংখ্যার ভিত্তিতে বাংলাদেশ তার ভাগের অর্থ দাবী করলে কেমন হয়? আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে অসম্ভব বলে কিছু নেই। রাজনীতি অর্থনীতি এখানে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত।
সূত্র: দৈনিক যুগান্তর, ১৭ মে ১৯৭১