এরপর ঘটনা-প্রবাহের দ্রুত পরিবর্তন ঘটলাে। ভুট্টোর সফরের পরেও বাংলাদেশ সরকার হুশিয়ার হতে পারলাে না। ক্ষমতাসীন দল তখন নানা উপদলে বিভক্ত। সরকারের নীতি সংশোধন করার কোনাে প্রচেষ্টাই হলাে না। এরমধ্যে পাকিস্তান থেকে প্রত্যাগত কর্মচারীদের নিয়ে একটা বিরাট হৈ চৈ পড়ে গেল। ঢাকার সেক্রেটারিয়েটে তাে স্বাভাবিক কাজকর্ম একরকম বন্ধ হয়ে রইলাে। প্রাক্তন সিএসপি’র দল প্রকাশ্যেই বলতে শুরু করলেন যে, এবার আর চিন্তা নেই। পাকিস্তান থেকে অভিজ্ঞ অফিসাররা ফিরে এলে প্রশাসন আরও জোরদার হবে। অথচ এ কথাটা কেউই বলল না, এঁরা মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেয়া তাে দূরের কথা, এরা স্বাধীনতার যুদ্ধ পর্যন্ত দেখেনি—এঁরা একটা পরাজিত প্রশাসনের অংশ বিশেষ। এদের অভিজ্ঞতা স্বাধীন বাংলাদেশের প্রশাসন পরিচালনায় বিশেষ কোনাে কাজে আসবে না। প্রকাশ, সংস্থাপন বিভাগের জনৈক রাতারাতি প্রমােশন প্রাপ্ত জয়েন্ট সেক্রেটারি ফাইলে এ মর্মে নােট দিয়েছিলেন যে, পাকিস্তান থেকে প্রত্যাগত অফিসারদের মধ্যে কয়েকটা ক্ষেত্রে বাছাই-এর প্রয়ােজন রয়েছে। কেননা এদের মধ্যে জনাকয়েক কট্টর পাকিস্তানি মনােভাবাপন্ন। উপরন্তু ভুট্টো এদের হৃদয় জয় । করার জন্য আসার সময় সমস্ত মালপত্র এমনকি সােনা-দানা ও মােটর গাড়ি পন্তি সঙ্গে আনার অনুমতি দিয়েছেন। এ ব্যাপারে কিছু তদন্ত হওয়ার দরকার। অবশ্য বিষয়টির সত্যতা যাচাই সম্ভব হয়নি। বিরাট ডামাডােল আর হৈ চৈ এর মধ্যে এসব নােটে কোনাে কাজই হলাে । রক্তাক্ত যুদ্ধের মধ্য দিয়ে স্বাধীনতাপ্রাপ্ত দেশগুলাের কোথাও এভাবে পরাজিত প্রশাসনের অফিসারদের প্রমােশন দিয়ে গ্রহণ করার নজীর নেই। কিউবা, মােজাম্বিক, ভিয়েতনাম, ক্যাম্বােডিয়া এমনকি অ্যাংগােলা তার জ্বলন্ত নীর। অথচ বাংলাদেশে পাকিস্তান থেকে প্রত্যাগত অফিসারদের অসুবিধার কথা চিন্তা করে তেজগাঁও বিমানবন্দরে চেকে টাকা দেয়া ছাড়াও পােস্টিং না হওয়া পর্যন্ত বেতনের ব্যবস্থা করা হলাে। এমনকি চেক ভাঙ্গানাের সুবিধার্থে বিমান বন্দরেই সােনালী ব্যাংকের শাখা পর্যন্ত খােলা হলাে।
নিয়তির পরিহাস। স্বাধীনতার সংগ্রামে বিজয়ী মুক্তিবাহিনীর দামাল ছেলেরা। নিজ নিজ জেলায় ফেরার পর কিন্তু এর কোনােটাই করা হয়নি। বরং স্বাধীনতার পর ঢাকা থেকে নির্দেশ দিয়ে রেশন বন্ধ করে মুক্তিবাহিনী ‘ডিসব্যান্ড’ করা হয়েছিল। জালেম শােষক আর বর্বর হত্যাকারীদের হাত থেকে দেশকে মুক্ত করাই বােধ হয় এদের অপরাধ ছিল। শেষ অবধি মুজিব-ভুট্টো সাক্ষাৎ ব্যর্থ হলাে বলা যায়। প্রেসিডেন্ট মুজিব দুটো প্রশ্নে খুব চাপ দিলেন। প্রথমত, একাত্তর সাল পর্যন্ত ইসলামাবাদের কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে বাংলাদেশের পাওনা টাকা এবং পিআইএ ও শিপিং কর্পোরেশন ইত্যাদি সংস্থার সম্পত্তির ন্যায্য ভাগ দিতে হবে। দ্বিতীয়ত, বাংলাদেশের বিভিন্ন ক্যাম্পে অবস্থানরত যেসব বিহারী নিজেদের পাকিস্তানি হিসাবে ঘােষণা করেছে, তাদের ফিরিয়ে নিতে হবে। ভুট্টো সাহেব একটাতেও রাজি হলেন না। তাই বাংলাদেশের মতে আলােচনা ব্যর্থ হয়েছে। বিদেশ মন্ত্রী ডক্টর কামাল। হােসেন সাংবাদিক সম্মেলনে এ কথাটা স্পষ্টভাবেই ঘােষণা করলেন। কিন্তু ভুয়ো সাহেব লাহােরে ফিরেই সাংবাদিকদের বললেন, তার বাংলাদেশ সফর সফল হয়েছে। এ কথাটা তখন বিশেষ তলিয়ে দেখেনি। পরে বুঝতে পেরেছিলাম, ঠিকই তাে পাকিস্তানের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে ভুট্টোর এ সফর সফলই হয়েছে। কেননা প্রায় দেড় বছর পর ঢাকার বিমানবন্দরে ভুট্টোর সম্বর্ধনার মাধ্যমে পাকিস্তানি এজেন্টদের মনােবল বৃদ্ধি করা ছাড়াও এদের সঙ্গে সরাসরি যােগাযােগ। সম্ভব হয়েছে। এরা এখন দ্বিগুণ উৎসাহে কাজ করবে এবং ভবিষ্যতে এদের সময় মতােই ব্যবহার করা যাবে। এছাড়াও বাংলাদেশের প্রশাসনে নিজেদের লােকগুলােকে বহাল তবিয়তে দেখতে পেয়ে খুশি মনেই ভুয়ো লাহাের ফিরে গেলেন।
প্রেসিডেন্ট মুজিবের দাবিগুলাে তিনি গ্রাহ্যই করলেন না। কিছুদিনের মধ্যেই বঙ্গবন্ধুর সরকার একটার পর একটা সমস্যার জালে আটকা পড়লাে। ঘুণে ধরা প্রশাসন নিয়ে তিনি বিশেষ এগুতে পারলেন না। দেশের মৌলিক সমস্যাগুলাের সমাধানের জন্য আওয়ামী লীগ, ন্যাপ মুজাফফর, সিপিবি এবং যুবলীগ কোনাে সুষ্ঠু পরিকল্পনা কিংবা পরামর্শ দিতে ব্যর্থ হলাে। একদিকে দেখা দিলাে উপর্যুপরি বন্যা, ঝড় ও প্রাকৃতিক দুর্যোগে গ্রাম-বাংলায় দারিদ্র্যের হাহাকার আর অন্যদিকে শহরগুলােতে শুরু হলো শান-শওকত ও জৌলুসের জীবন। প্রসঙ্গত বাঙালি মুসলিম মধ্যবিত্তদের সম্পর্কে এখানে একটা মন্তব্য না করে পারছি না। বিংশ শতাব্দীর চল্লিশ দশকের মধ্যভাগ নাগাদ যখন ব্রিটিশদের এদেশ থেকে চলে যাওয়ার দাবি জোরদার হলাে এবং পাকিস্তান অর্জিত হলাে ব্রিটিশদের সঙ্গে সঙ্গে গাঙ্গেয় ব-দ্বীপ এলাকা থেকে বিশেষ করে বিত্তশালী উচ্চ বর্ণের হিন্দুরাও চলে গেল। রাতারাতি নিজেদের অবস্থার উন্নতির উদগ্র বাসনায় পাকিস্তান। নামে একটা উদ্ভট রাষ্ট্র (কেননা দু’অংশের মধ্যে প্রায় দেড় হাজার মাইলের ব্যবধান) সৃষ্টি হবে জেনেও আমরা তা সমর্থন করেছিলাম। অর্থনৈতিক মুক্তি ও ধর্মের নামে জিগির তুলে গ্রামের গরিব মুসলমানদের ভােট আদায় করেছিলাম। আবার মাত্র ২৩ বছরের মাথায় আমরা বাঙালি মুসলিম মধ্যবিত্তরা প্রথমে বঙ্গবন্ধুর আন্দোলনের প্রতি নাক সিটকালেও যে মুহূর্তে বুঝতে পারলাম এতে আমাদের অবস্থার রাতারাতি আরও উন্নতি হবে এবং বিত্তশালী অবাঙালিদের হটিয়ে বাংলাদেশে আমরাই হবে সর্বেসর্বা, সেই মুহূর্তেই আমরা সবাই জয় বাংলা’ স্লোগান দিয়ে উঠলাম। গ্রাম-বাংলার দামাল ছেলেগুলােকে রক্তাক্ত যুদ্ধের মধ্যে ঠেলে দিয়ে আমরা সযত্নে দূর থেকে সম্পূরক ভূমিকা পালন করলাম। আবার দেশ মুক্ত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে নিজেদের স্বাধীনতা সংগ্রামী হিসাবে চিহ্নিত করে বাড়ি-গাড়ি আর বিরাট বিরাট সম্পত্তির মালিক হয়ে বসলাম। ধানমন্ডি, ইস্কাটন, গুলশান ও বনানীর শূন্য বাড়িগুলাে আমাদের কজায় এল।
উচ্চ শিক্ষার জন্য নিজেদের ছেলেমেয়েকে বিদেশে পাঠিয়ে আমরা দেশে কেরানী তৈরি করার শিক্ষার পদ্ধতি চালু রাখলাম। ঢাকা-চট্টগ্রাম ও খুলনা-রাজশাহীর রাস্তাগুলাে দেখতে দেখতে নতুন চকচকে গাড়িতে ভরে উঠলাে। আলাদীনের আশ্চর্য প্রদীপে আমরাই হলাম বাংলাদেশের নতুন বুর্জোয়া। কিন্তু মুখে আমাদের রয়েছে সমাজতন্ত্রের গালভরা বুলি। আর গ্রাম-বাংলা যে তিমিরে সে তিমিরেই রয়ে গেল। অনাহার, অবিচার আর দারিদ্র তাদের নিত্য সহচর হলাে। মাসুম বাচ্চার ক্রন্দন ও অবলা নারীর বুক ফাটা নিশ্বাসে বাতাস ভরে উঠলাে। স্বাধীন বাংলাদেশে গণঐক্য জোটের নিত্য-নতুন স্লোগান, ব্যুরােক্রেসির পাকিস্তানি অভিজ্ঞতার বড়াই, প্ল্যানিং কমিশনের বিদেশী ডিগ্রির গর্ব, কাগজেকলমে কোটি কোটি ডলারের পাশ্চাত্য সাহায্যের প্রচারণা আর সংবাদপত্রগুলাের নীতি কথার ফুলঝুরির মাঝ দিয়েও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব দেখতে পেলেন দুর্ভিক্ষের পদধ্বনি। প্রশাসনকে জোরদার এবং ত্বরিৎ কিছু ব্যবস্থা নেয়ার উদ্দেশে তিনি সংবিধান সংশােধন করে বিতর্কিত প্রেসিডেন্সিয়াল পদ্ধতি চালু করলেন কিন্তু অবস্থার বিশেষ পরিবর্তন হলাে না। চুয়াত্তরের শেষভাগে বাংলাদেশে দুর্ভিক্ষ দেখা দিলাে। যে দুর্ভিক্ষ বাহাত্তর সালে হবার কথা ছিল, ভারতের প্রায় আট লাখ টন খাদ্য সরবরাহে তা ঠেকানাে গেলেও এবার তাে অবস্থা বেগতিক। ভারত নিজেই খাদ্য সমস্যার সম্মুখীন। এর উপর বিরােধী প্রচারণা এখন তুঙ্গে। এরই পাশাপাশি বাংলাদেশ বাস্তবক্ষেত্রে সমাজতান্ত্রিক নীতি কার্যকরী না করায় এবং দ্রুত ডান দিকে হেলে মার্কিনী-ঘেষার প্রচেষ্টা করায়, সােভিয়েট রাশিয়া সাহায্য করা তাে দূরের কথা, আগের ধার দেয়া দুলাখ টন খাদ্য ফেরত চেয়ে বসলাে। বঙ্গবন্ধুর দ্বিতীয়বার মস্কো সফরেও কাজ হলাে না।
আর ওয়াশিংটনে মহারথীর খাদ্য সাহায্যের ব্যাপারে ‘দেই দিচ্ছি’ করে বাংলাদেশকে ঝুলিয়ে রাখল। এমনি এক সময়ে প্রেসিডেন্ট মুজিব অটোয়ায় কমনওয়েলথ সম্মেলন শেষে একটা বােঝাপড়ার জন্য ওয়াশিংটন রওনা হলেন। যেভাবেই হােক খাদ্য এনে বাংলার মানুষকে দুর্ভিক্ষের হাত থেকে বাঁচাতেই হবে। মার্কিন প্রেসিডেন্টের সঙ্গে বৈঠকের প্রাক্কালে মার্কিনীদের পরামর্শে ‘পি এল ৪৮০’ প্রােগ্রামে খাদ্য সাহায্য পাবার আশায় বাংলাদেশ তার অন্যতম বন্ধু রাষ্ট্র কিউবার সঙ্গে বাণিজ্য বন্ধ করে দিলাে। এর পরেও হেনরি কিসিঞ্জার বললেন, ‘বাংলাদেশ তাে একটা তলাহীন ভাঙ্গা ঝুড়ির মতাে। বঙ্গবন্ধু এ অপমান সহ্য করেও খাদ্য চাইলেন।’ | শেষ পর্যন্ত মার্কিনী খাদ্য এল বটে কিন্তু অনেক বিলম্বে। জাহাজ এসে চট্টগ্রাম বন্দরে পৌছানাের আগেই দুর্ভিক্ষে গ্রাম-বাংলার হাজার হাজার বাঙালি আত্মাহুতি দিলাে। বাংলাদেশের প্রত্যেকটি দুর্ভিক্ষ প্রপীড়িত থানায় লঙরখানা খুলেও বঙ্গবন্ধু দুর্ভিক্ষকে ঠেকাতে পারলেন না। রাতের পর রাত না ঘুমিয়ে পাইপ হাতে বত্রিশ নম্বরের বাসার ব্যালকনিতে পায়চারী করে চিন্তার কোনাে কিনারাই করতে পারলেন না। শুনেছি, চুয়াত্তর সালের শেষের দিকে দুর্ভিক্ষকে ঠেকাতে না পেরে তিনি একবার আত্মহত্যার কথা পর্যন্ত ভেবেছিলেন। কিন্তু তা হবে ভীরুতার পরিচয়; মুসলমান হিসাবে তিনি হবেন গুনাহগার। খাদ্যমন্ত্রী আবদুল মােমিনকে ডেকে বঙ্গবন্ধু বললেন, ‘কিছুই লুকাবে না। দুর্ভিক্ষে মৃত্যুর সংখ্যা প্রকাশ্যে জানিয়ে দাও।’ পার্লামেন্টে দাঁড়িয়ে খাদ্যমন্ত্রী মােমিন সাহেব বললেন যে, “এৰারের দুর্ভিক্ষে অনাহারে মৃত্যুর সংখ্যা সাতাশ হাজারের মতাে।
এর মধ্যে রংপুরের অবস্থা সবচেয়ে শােচনীয়।” উপমহাদেশের ইতিহাসে অনাহারে মৃত্যুর কথা আর কোনাে সরকার এভাবে স্বীকার করার সৎ সাহস দেখাতে পারেনি। ব্যুরােক্রেসির কারসাজি, আওয়ামী লীগের উপদলীয় কোন্দল, পারিবারিক চাপ এবং পাশ্চাত্য শক্তির কূটনৈতিক চাল আর নানা ঘটনা প্রবাহে ১৯৭৪ সালের শেষভাগে কানাডা ও যুক্তরাষ্ট্র সফরান্তে দেশে ফিরেই প্রেসিডেন্ট মুজিব তার অর্থমন্ত্রী এবং প্রায় দুই দশকের রাজনৈতিক সহকর্মী তাজউদ্দিন আহমেদকে পদত্যাগের নির্দেশ দিলেন। ১৯৭১-এর নির্বাসিত মুজিবনগর সরকারের সফল প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিনের বিদায়ের ফলে দক্ষিণপন্থী ও চরম বামপন্থী মহলে আনন্দের জোয়ার বইলাে। প্রগতিশীল ও ধর্মনিরপেক্ষতার দাবিদার বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবী মহল, ন্যাপ-মুজাফফর এবং কম্যুনিস্ট পার্টি মােটামুটিভাবে নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করল।
সেদিনের কথা এখনও স্পষ্ট মনে আছে। চুয়াত্তর সালের নভেম্বর মাসের গােড়ার দিকে হঠাৎ করে নতুন গণভবনে খবরের কাগজের সম্পাদক আর সিনিয়র রিপাের্টারদের ডাক পড়ল। প্রেসিডেন্ট মুজিব সাংবাদিকদের কাছে এক গুরুত্বপূর্ণ। ঘােষণা করবেন। আমরা সবাই প্রেস ক্লাব থেকে হুড়মুড় করে দৌড়ালাম। কেন জানি না, গণভবন আজ থমথম করছে। ক্যাবিনেট সেক্রেটারি তৌফিক ইমাম এবং গুটিকয়েক অফিসার ফাইল হাতে ঘুরঘুর করছে। গণসংযােগ অফিসার তােয়াৰ সাংবাদিকদের নিয়ে বসালেন। এমন সময় প্রেসিডেন্ট মুজিব এলেন। তিনি যেয়ে নিজের রুমে বসলেন। আমি রেডিও ডি. জি, সেই রুমে দাঁড়িয়ে রইলাম। পুলিশের গােয়েন্দা প্রধান তার কাছে এগিয়ে গেলেন। প্রেসিডেন্টকে বললেন, ‘তাজউদ্দিন সাহেব তাঁর কিছু সমর্থক নিয়ে শলা-পরামর্শে বসেছেন আর পদত্যাগপত্রে দস্তখত করতে গড়িমসি করছেন।’ বঙ্গবন্ধু বিকট একটা হুংকার দিয়ে বললেন, ‘আপনারা জেনে রাখুন, আমি তাজউদ্দিনকে স্বেচ্ছায় পদত্যাগপত্রে দস্তখত করতে বলেছি। যদি না করে, তাহলে তাজউদ্দিনকে এখনই মন্ত্রিসভা থেকে বরখাস্ত করবাে।’ কথা ক’টা বলে তিনি পাইপ ধরিয়ে দরজার দিকে তাকিয়ে দেখেন বেশ কিছুক্ষণ হলাে ক্যাবিনেট সেক্রেটারি ফাইল হাতে দাঁড়িয়ে রয়েছেন। জিজ্ঞেস করলেন, “তুমি এখানে দাড়িয়ে কেনাে? হাতে ওটা কিসের ফাইল?’ স্বল্পভাষী ইমাম সাহেব জবাবে বললেন, ‘স্যার আমি অর্থমন্ত্রীর বাসায় যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে উনি পদত্যাগপত্রে দস্তখত করে দিয়েছেন। সেটা আপনাকে দেখাবার জন্য এতক্ষণ দাঁড়িয়ে আছি।
আমরা সবাই হতভম্ব হয়ে মুখ চাওয়া-চাওয়ি করতে লাগলাম। গােয়েন্দা প্রধানের রিপাের্ট হচ্ছে, তাজউদ্দিনের স্বীয় পদত্যাগ পত্রে দস্তখত করেননি। আর এদিকে ক্যাবিনেট সেক্রেটারি দস্তখত করা পদত্যাগ পত্র হাতে বঙ্গবন্ধুর সামনে। দাঁড়িয়ে। মনে পড়লাে বাহাত্তর সালের জানুয়ারি মাসের কথা। পাকিস্তানের কারাগার থেকে বঙ্গবন্ধু দেশে ফিরে এসেছেন। বঙ্গ ভবনে শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠান। আজ থেকে বঙ্গবন্ধু দেশের প্রধানমন্ত্রী হতে চলেছেন। স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন এ অনুষ্ঠানে সপরিবারে এসেছেন। তিনি সবার সঙ্গে প্রাণ খােলা হাসি দিয়ে কথা বলছেন। আমরা সবাই অবাক হয়ে তাঁকে লক্ষ করছি। শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানের পর তিনি সাংবাদিকদের বললেন, “আজ আমার জীবনের সবচেয়ে আনন্দের দিন। নেতার অনুপস্থিতিতে মুজিবনগর সরকারের প্রধানমন্ত্রী হিসাবে মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব দিয়ে দেশকে স্বাধীন করেছি। আবার নেতাকে মুক্ত করে তারই হাতে প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্বভার উঠিয়ে দিয়ে আমি নিজেকে ধন্য মনে করছি। অন্তত ইতিহাসের পাতায় এক কোনায় আমার নামটা লেখা থাকবে।” | মাত্র বছর তিনেকের ব্যবধান। বিশেষ বিশেষ মহলের কারসাজিতে বঙ্গবন্ধু ও তাজউদ্দিন এই দুই অভিন্ন হৃদয়ের মধ্যে অবিশ্বাস ও সন্দেহের সূচনা হলাে। সৃষ্টি হলাে দুজনের মধ্যে মতানৈক্য। মন্ত্রিসভা থেকে তাজউদ্দিনের বিদায়ে সবার অজান্তেই বাংলাদেশে জাতীয়তাবাদী শক্তি দারুণভাবে দুর্বল হয়ে পড়লাে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সফর শেষ করে বঙ্গবন্ধুর দেশে ফেরার পর এবং বাংলাদেশে মার্কিনী বিদেশ মন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জারের আগমনের প্রাক্কালে মন্ত্রিসভা থেকে তাজউদ্দিনের অপসারণ কি একটা ভয়াবহ ষড়যন্ত্রের ইঙ্গিত বহন করছে? মনের গহনে একটা বিরাট খটকা লেগে রইল। আমার কাছে শুধু মনে হলাে বঙ্গবন্ধুর কোমর থেকে কারা যেন শাণিত তরবারিটা সরিয়ে নিলাে। শুধু পড়ে রইলাে শূন্য খাপ। আগের কথায় ফিরে আসা যাক। সাংবাদিক সম্মেলনে প্রেসিডেন্ট মুজিব দেশের বিপর্যস্ত অর্থনৈতিক অবস্থার মােকাবেলায় তার সরকারের নতুন ব্যবস্থা সম্পর্কে জানালেন। এরপর গম্ভীর মুখে সবাইকে আপাতত বিদায় দিলেন। এ সময় পাশের দরজা দিয়ে শেখ মণি, তােফায়েল আহাম্মদ, কে এম ওবায়েদ, তাহেরউদ্দিন ঠাকুর আর সবার শেষে বাণিজ্যমন্ত্রী খন্দকার মােশতাক এসে ঢুকলেন। এরা সবাই বঙ্গবন্ধুকে অভিনন্দন জানালেন। পরদিন সকালে ঢাকার খবরের কাগজে তাজউদ্দিনের বিরুদ্ধে বিষোদগার। হলাে। ব্যারিস্টার মইনুল হােসেন ও আনােয়ার হােসেন মঞ্জুর ইত্তেফাক, শেখ মণির বাংলার বাণী ও বাংলাদেশ টাইমস পত্রিকায় তাজউদ্দিনের বিরুদ্ধে সমালােচনার জোয়ার বইলাে। সমস্ত পত্র-পত্রিকাগুলাে দেশের অর্থনৈতিক দুরবস্থার জন্য তাজউদ্দিনকে দায়ী করলাে। শুধু দেখলাম ঢাকার প্রেস ক্লাবে জনাকয়েক রিপাের্টার পুরাে ব্যাপারটা নিয়ে হাসাহাসি করছে। তাদের যুক্তি হচ্ছে, সংবিধানের রীতি অনুসারে মন্ত্রিসভা থেকে যেসব নীতি ঠিক করে দেয়া হয়, তার উপর ভিত্তি করেই বাজেট প্রণীত হয় এবং প্রতিটি স্তরেই মন্ত্রিসভা থেকে তা অনুমােদন করা হয়। এছাড়া অর্থমন্ত্রীকে বাজেটের মৌলিক নীতির ক্ষেত্রে পার্লামেন্টারি পার্টির মােকাবেলা করতে হয়। উপরন্ত মন্ত্রিসভা থেকে অর্থমন্ত্রীর প্রস্তাবিত বাজেট বক্তৃতার প্রতিটা লাইন পরীক্ষা করে দেখা হয়। তাই বাজেট কিংবা সরকারের ফিসক্যাল পলিসির জন্য মন্ত্রিসভাকে যৌথভাবে এবং ক্ষমতাসীন দলকে এককভাবে দায়িত্ব গ্রহণ করতে হয়। এটাই হচ্ছে পার্লামেন্টারি গণতন্ত্রের নীতি। কিন্তু বাংলাদেশে কে কার যুক্তি শােনে? মুজিবনগরের দক্ষিণপন্থী শিবির, চাকুরিচ্যুতির হাত থেকে রক্ষাপ্রাপ্ত কোলাবরেটর অফিসারবৃন্দ, আর ঢাকার সংবাদপত্রগুলাে বাঙালি জাতীয়তাবাদী শক্তিকে নিশ্চিহ্ন করার প্রচেষ্টায় উন্মাদ হয়ে উঠলাে। মন্ত্রিসভা থেকে তাজউদ্দিনের বিদায়ে বাংলাদেশের ইতিহাসের একটা অধ্যায়ের পরিসমাপ্তি হলাে। পরবর্তী অধ্যায়ে শুরু হলাে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের বিরুদ্ধে সামপ্রতিক ইতিহাসের জঘন্যতম ষড়যন্ত্র ।
সূত্রঃ মুজিবের রক্ত লাল – এম আর আখতার মুকুল