You dont have javascript enabled! Please enable it!
বাকশালের জন্ম আওয়ামী লীগের মতাে ক্যুনিস্ট পার্টিরও বিলুপ্তি
এরপরেই মার্কিনি পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জার উপমহাদেশ সফর উপলক্ষে মাত্র ২২ ঘণ্টার জন্য ঢাকায় এলেন। তিনি গণভবনে সাংবাদিক সম্মেলনে বঙ্গবন্ধুর পক্ষে কিছু প্রশস্তিমূলক কথা ছাড়া বিশেষ কিছুই বললেন না। তাজউদ্দিনের বিদায় ও কিসিঞ্জারের মুখে শেখ মুজিবের প্রশংসায় অনেকেই বিশেষ অর্থ খুঁজে পেলাে। বঙ্গবন্ধু বুঝতে পারলেন, দুর্ভিক্ষে তার জনপ্রিয়তা নষ্ট করে সাইজ মতাে কেটে মার্কিনী মহল তাকে ক্রীড়নক বানাতে চাচ্ছে। নীরবে সহ্য করা ছাড়া তিনি কিছুই করতে পারলেন না। চোখের সামনে হাজার হাজার মানুষ অনাহারে মৃত্যুবরণ করলাে; তবুও তারা বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে কোনাে প্রতিবাদ পর্যন্ত করলাে বঙ্গবন্ধু রংপুরে যেয়ে কংকালসার মানুষগুলােকে জড়িয়ে ধরে কাদলেন আর লঙরখানা পরিদর্শন করলেন। এর মধ্যে পশ্চিমা সংবাদপত্রগুলাের একদল রিপাের্টার আবার বাংলাদেশে এসে হাজির হলাে। এদের পাঠানাে রিপাের্টগুলাে বিদেশী পত্র-পত্রিকায় ফলাও  করে বেরুলাে সব রিপাের্টেরই এক সুর। শেখ মুজিবের শাসন ব্যর্থ হয়েছে। বাংলাদেশে কোটি কোটি ডলারের বিদেশী সাহায্য দুর্নীতির জন্য দুর্ভিক্ষে হাজার হাজার লােক মারা গেছে।  উদ্দেশ্য একটাই  বিদেশে শেখ মুজিবের ‘ইমেজ নষ্ট করা। কিন্তু একজন রিপাের্টারও এ কথাটা লিখলাে না যে, স্বাধীনতার পর বাংলাদেশকে যে বিপুল পরিমাণে পণ্য সাহায্য দেয়া হয়েছে, তার প্রায় শতকরা ৩৮ ভাগ জাহাজ ভাড়া ছাড়াও বিদেশী স্বেচ্ছাসেবক ও কর্মচারীদের বেতন, থাকা-খাওয়া এবং যাতায়াতের খরচ হিসাবে দাতাদেশগুলাে ফেরত নিয়ে গেছে। বাকি পণ্যের শতকরা প্রায় পনের ভাগ বাঙালিদের ব্যবহারের অযােগ্য। বাংলাদেশের গ্রামের মেয়েরা তাে আর গাউন-স্কার্ট কিংবা বিকিনী পরবে না! বাংলাদেশ নিজের পায়ে দাঁড়াক—এটা অনেকেরই কাম্য নয়। তাই ১৯৭২/৭৩ সালে বিদেশ থেকে যত সাহায্য এসেছে, তা দেশের ভবিষ্যৎ উৎপাদন বাড়ানাের জন্য দেয়া হয়নি। এসব সাহায্য দিয়ে কোনাে দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনায় হাত দেয়া যায়নি। কৃষি উৎপাদন বাড়ানাের জন্য সার তৈরি কিংবা পাওয়ার পাম্প বসানাের ক্ষেত্রে এ সময় কোনাে সাহায্যই আসেনি।
এতােসব ঘটনার মধ্যে বঙ্গবন্ধু উপলব্ধি করলেন, ভবিষ্যতে পৌনঃপুনিক দুর্ভিক্ষের হাত থেকে বাংলাদেশকে বাঁচানাের জন্য ব্যাপকভাবে উৎপাদন। বাড়াতেই হবে। তাই তিনি তিনটা পন্থা গ্রহণ করলেন। প্রথমত, সম্পর্কের উন্নতি করে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলাে থেকে নগদ সাহায্য নিতে হবে। দ্বিতীয়ত, দেশবিদেশ থেকে খাদ্য সংগ্রহ করে কিছু স্টক করতে হবে। আর তৃতীয়ত, দ্রুত উৎপাদন বৃদ্ধির উদ্দেশে নানা প্রতিবন্ধকতার হাত থেকে সরকারকে রক্ষা করা এবং প্রশাসনকে জোরদার করার জন্য দেশে জরুরি অবস্থার ঘােষণা করতে হবে। ১লা জানুয়ারি জরুরি অবস্থা ঘােষণা করায় সমাজ জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে কিছুটা সাফল্য দেখা গেল। সবাই শিল্প ও কৃষি ক্ষেত্রে উৎপাদন বাড়ানাের জন্য মনযােগী হলাে। কিন্তু শিক্ষিত মধ্যবিত্ত ও উচ্চ মধ্যবিত্তের অনেকেই সমালােচনা মুখর হয়ে উঠলাে। পঁচাত্তর সালের ঘটনাবলী বাংলাদেশের ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে থাকবে। দেশের মানুষকে অনাহার আর দুর্ভিক্ষের হাত থেকে বাঁচানাের জন্য বঙ্গবন্ধু তাঁর জীবনের সাধনাকে জলাঞ্জলি দিলেন। যে গণতন্ত্রের মর্যাদা রক্ষার মহান ব্রতে তিনি বছরের পর বছর ধরে দুঃসহ কারাযন্ত্রণা ভােগ করেছেন—এমনকি ফাসির | আসামী পর্যন্ত হয়েছেন, দুঃখী বাঙালির দুমুঠো ভাতের ব্যবস্থার জন্য তিনি সেই গণতন্ত্রকে ঠাণ্ডা ঘরে রেখে বামপন্থী আদর্শের দাবিদার গােষ্ঠীর পরামর্শে পরিস্থিতির মােকাবেলায় একদলীয় শাসন ব্যবস্থা প্রবর্তনের উদ্দেশে সংবিধান সংশােধন করলেন। অবশ্য সময় সংকীর্ণ বলেই হােক আর ভুল পরামর্শেই হােক, এ ব্যাপারে জনমত গঠনের কোনাে প্রচেষ্টাই করা হলাে না। 
সুদীর্ঘ ২৮ বছর সংগ্রাম করে বঙ্গবন্ধু যে আওয়ামী লীগ পার্টি তৈরি। করেছিলেন এবং নানা ঘাত-প্রতিঘাতের মাঝ দিয়ে যে আওয়ামী লীগ তার সংগ্রামী। ঐতিহ্য ছাড়াও বাংলাদেশের গ্রাম পর্যায়ে হাজার হাজার নেতা ও কর্মী তৈরি করতে সক্ষম হয়েছিল, যে আওয়ামী লীগ মুক্তি সংগ্রামে সাফল্যজনক নেতৃত্ব দিয়ে দেশকে স্বাধীন ও সার্বভৌম করতে পেরেছিল, বৃহত্তর স্বার্থে কলমের এক খোঁচায় সেই আওয়ামী লীগের অস্তিত্ব বিলীন হয়ে গেল। এমনকি রুশ সমর্থক কম্যুনিস্ট পার্টিও স্বীয় দলের বিলুপ্তি ঘােষণা করল।  তৈরি হলাে ‘বাকশাল। আওয়ামী লীগ, ন্যাপ মুজাফফর, কম্যুনিস্ট পার্টি, যুব লীগ, শ্রমিক লীগ, কৃষক লীগ এমনকি ছাত্রলীগ ও ছাত্র ইউনিয়ন থেকে শুরু করে সরকারি কর্মচারী ও সামরিক অফিসারেরা পর্যন্ত এই বাকশালের সদস্য হলেন। টাঙ্গাইলের সন্তোষে প্রস্তাবিত ইসলামিক বিশ্ববিদ্যালয়ে সরকারি সাহায্যের শর্তে মওলানা ভাসানী নয়া পার্টিকে অভিনন্দিত করলেন। প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী আতাউর রহমান খান এক সাংবাদিক সম্মেলনে ‘বাকশালে যােগদানের কথা ঘােষণা করলেন। ঢাকার সংবাদপত্রগুলাে অতিরিক্ত ফলাও করে সব খবর ছাপালাে। একদিনে প্রায় সাড়ে তিনশ’ সাংবাদিকের একটা দল গণভবনে যেয়ে বাকশালের সদস্য হলেন। সংবাদপত্রের সম্পাদকরাও দল বেঁধে পদাঙ্ক অনুসরণ করলেন। পার্লামেন্টের সমস্ত সদস্য বাকশালের মে দস্তখত করল। (জেনারেল অব. ওসমানী এবং ব্যারিস্টার মইনুল হােসেন অর্থবহ কারণে ব্যতিক্রম)। আর মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান তাে বাকশাল-এর অন্যান্য সদস্যদের টেলিগ্রাম করে অভিনন্দন জানালেন।
ঢাকা শহরের চেহারাটাই পাল্টে গেল। বাংলাদেশ বিমান, ঢাকা বেতার কেন্দ্র এবং ডাক ও তার বিভাগ থেকে শুরু করে বিভিন্ন সরকারি ও আধাসরকারি অফিসের কর্মচারীরা দফায় দফায় শােভা যাত্রা করে ‘বাকশালে যােগদান করলাে। কেবলমাত্র মুজিবনগর সরকারের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী ও বাংলাদেশ সংবিধানের অন্যতম প্রণেতা তাজউদ্দিন নিশ্ৰুপ রইলেন। আর সংবিধানের আর এক প্রণেতা বিদেশ মন্ত্রী ডক্টর কামাল হােসেন দ্বিধা-দ্বন্দ্বের মধ্যে অক্সফোর্ডে যেয়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের ইতিহাস'(?) লিখতে শুরু করলেন। অন্যদিকে সমস্ত সংবাদপত্রের সম্পাদকরা ‘বাকশালে যােগদান করলেও অধুনালুপ্ত দৈনিক জনপদের সম্পাদক এবং বাংলাদেশ সংবাদপত্র সম্পাদকমণ্ডলীর সভাপতি আবদুল গাফফার চৌধুরী একমত হতে না পেরে ক্লান্তি আমায় ক্ষমা কর প্রভু’ সম্পাদকীয় লিখে লন্ডনের পথে পাড়ি জমালেন। বন্ধু-বান্ধবের কাছে চৌধুরী সাহেব বললেন, “স্বাধীনতার পর পরই ১৯৭২ সালে এক দলীয় শাসনের মাধ্যমে বিপ্লবী কর্মসূচি নিলে আজ ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু দেশকে একটা গণতান্ত্রিক সংবিধান দিতে পারতেন। অথচ সমস্ত ব্যাপারটাই উল্টো মনে হচ্ছে। সাড়ে তিন বছর পর এক দলীয় শাসন চালু করায় একটা বিরাট ‘ভ্যাকুয়াম সৃষ্টি হতে চলেছে। এতে সব কিছুই আপাতত অনিশ্চিত হয়ে পড়লাে।” যা হােক, এর মধ্যেই শতাধিক ব্যক্তির কেন্দ্রীয় কমিটি ছাড়াও ১৫ জন সদস্য বিশিষ্ট সর্বময় ক্ষমতা সম্পন্ন ‘বাকশালের পলিট ব্যুরাে ঘােষণা করা হলাে। কার্যত এই পলিট ব্যুরােই হলাে ‘সুপার ক্যাবিনেট’ এবং সর্বোচ্চ নীতি নির্ধারণী সংস্থা।
এর সমস্ত সদস্যই পূর্ণ মন্ত্রীর পদমর্যাদা পেলাে। বাংলাদেশের রাজনৈতিক মহল বুঝতে পারলাে, পলিট ব্যুরাের অছিলায় জনা কয়েক ব্যক্তিত্ব পিছনের দরজা দিয়ে ঢুকে নিজেদের ক্ষমতা সুপ্রতিষ্ঠিত করতে চলেছে। এদের অনেকে আওয়ামী লীগ পার্টির মাধ্যমে আগে উপমন্ত্রী পর্যন্ত হতে পারেনি। কিন্তু এখন এরা সুপারমন্ত্রী হলেন। পলিট ব্যুরাে তৈরি হবার পর মন্ত্রিসভা প্রকৃতপক্ষে ক্ষমতাহীন হয়ে পড়লাে। কেননা এখন পলিট ব্যুরােই হচ্ছে নীতি নির্ধারণী সর্বময় কর্তৃপক্ষ। প্রকাশ্যে কিছু বললেও বাংলাদেশের বিভিন্ন মহলে চাপা সমালােচনা শুরু হলাে। শােনা যায়, এই পলিট ব্যুরাের সদস্য মনােনয়নে শেখ ফজলুল হক মণির প্রভাব ছিল সবচেয়ে বেশি।
আর অন্যদিকে বঙ্গবন্ধুকে নিশ্চিহ্ন করার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত ব্যক্তিরা মণিকে বাহবা দিয়ে দল পাকিয়ে তুলল। এদিকে একদলীয় শাসন প্রবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে প্রেসিডেন্ট মুজিব প্রশাসনের আমূল পরিবর্তনের কথা ঘােষণা করলেন। বাংলাদেশকে ৬১টি জেলায় ভাগ করে। গভর্নর নিয়ােগ ও ট্রেনিং-এর ব্যবস্থা হলাে। পার্লামেন্টের সদস্য, সামরিক ও বেসামরিক অফিসার এবং লব্ধপ্রতিষ্ঠ আইনজীবীদের মাঝ থেকে এসব গভর্নর পদে নিযুক্ত হলেন (৩৩ জন সংসদ সদস্য এবং তেরােজন ব্যুরােক্রেটসহ ২৮জন অরাজনীতিবিদ)। জেলায় জেলায় গভর্নর নিয়ােগের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু প্রশাসনিক ক্ষমতার দুশ বছরের চেইন ভেঙে অন্যভাবে তৈরি করলেন। মনােনীত গভর্নররা হলেন বিপুল ক্ষমতার অধিকারী। জেলার উন্নয়ন পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন, প্রশাসন ও বিচার ব্যবস্থা—এমনকি আইন শৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্বও গভর্নরদের উপর অর্পিত হলাে। প্রতিটি জেলা সদরের সঙ্গে সরাসরি রেডিও-টেলিফোনে যােগাযোগ স্থাপিত হলাে প্রেসিডেন্ট ভবনের সঙ্গে (পলিট ব্যুরাে, কেন্দ্রীয় কমিটি এবং জেলা গভর্নরদের পূর্ণ তালিকার জন্য পরিশিষ্ট দেখুন)।  এ ব্যবস্থায় দুটো জিনিস প্রকট হয়ে উঠলাে। প্রথমত, ঢাকায় কেন্দ্রীয় সেক্রেটারিয়েট কার্যত ক্ষমতাহীন হয়ে পড়লাে। দ্বিতীয়ত, যে বঙ্গবন্ধু সরকার এতদিন পর্যন্ত শহর ভিত্তিক ক্ষমতার উপর বসে ছিল, রাতারাতি সেই ক্ষমতার উৎসকে সরিয়ে গ্রাম-বাংলায় নিয়ে যাওয়া হলাে। বঙ্গবন্ধু বুঝতে পেরেছিলেন, সরকারের বিভিন্ন নীতি ও কার্যকলাপের মাঝ দিয়ে শহরে শিক্ষিত মধ্যবিত্তদের আরাম-আয়েশের ব্যবস্থা এবং উন্নয়নের যত। সুযােগই দেয়া হােক না কেন, এরা কোনাে দিনই সন্তুষ্ট হবে না এবং এদের চাহিদারও শেষ নেই। উপরন্তু এতে দেশের সর্বাঙ্গীন উন্নতি কোনােদিনই সম্ভব নয়। তাই তিনি গ্রাম-বাংলার অর্থনৈতিক উন্নয়নের উদ্দেশে অত্যন্ত দ্রুত ক্ষমতার উৎসকে শহর থেকে মফস্বলে সরিয়ে নেয়ার প্রাক্কালে ঢাকায় এক জনসভায় প্রদত্ত বক্তৃতায় শহুরে শিক্ষিত মধ্যবিত্তদের ঢালাওভাবে কঠোর সমালােচনা করলেন।
সবার অজান্তেই বঙ্গবন্ধু তৈরি করলেন নতুন নতুন শত্রু ক্ষমতা হ্রাস পাওয়ায় পার্লামেন্টের সদস্যরা ক্ষুব্ধ হলেন। দেশ শাসনের ক্ষেত্রে কার্যত ‘ব্যুরােক্রেসি’র কোনাে ভূমিকা থাকবে না এবং মফস্বলের কর্মচারীরা ঢাকা সেক্রেটারিয়েটের চেয়ে গভর্নরদের নির্দেশ বেশি জরুরি মনে করবে বলে অফিসার মহল রাগান্বিত হলেন। এ ধরনের এক প্রেক্ষিতে ব্যুরােক্রেসিকে সন্তুষ্ট করতে প্রাক্তন সিএসপিসহ মােট ১৩ জন উচ্চ পদস্থ অফিসারকে গভর্নর হিসাবে নিয়ােগ করেও বঙ্গবন্ধু বিপদ এড়াতে পারলেন না। এরই পাশাপাশি বিডিআর, পুলিশ, রক্ষীবাহিনী ও অন্যান্য শান্তি রক্ষাকারী সংস্থাগুলাের কেন্দ্রীয় কর্তৃপক্ষ জেলায় অবস্থানকারী বাহিনীর উপর কর্তৃত্ব বিনষ্ট হবার আশঙ্কায় আতঙ্কগ্রস্ত হলেন। উপরন্ত শিক্ষিত মধ্যবিত্ত মহল বুঝতে পারলাে যে, এতদিন পর্যন্ত ক্ষমতাসীন প্রতিটি সরকার সমর্থনের জন্য তাদের যেভাবে তােয়াজ করেছে, নয়া পদ্ধতির দরুন ভবিষ্যতে আর তা অব্যাহত থাকবে না। শ্রেণী হিসাবে শহুরে মধ্যবিত্তরা তাদের আরাম-আয়েশ ও সুযােগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত হবে। তাই ভিতরে ভিতরে এরাও সমালােচনামুখর হয়ে উঠলাে এবং বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে নানা কথিত দুর্নীতির কথা প্রচারে লিপ্ত হলাে। অনেকের মতে পলিট ব্যুরােতে বঙ্গবন্ধুর দুজন আত্মীয় ছাড়াও জনাকয়েক জনপ্রিয়হীন ব্যক্তি থাকায় এসব প্রচারণা জোরদার হলাে। অন্যদিকে যেসব মন্ত্রী পলিট ব্যুরাের সদস্য হতে পারলেন না এবং নিজের জেলায় উপদলীয় নেতাকে গভর্নর হিসাবে দেখতে পেলেন, তারাও ক্ষমতাহীন অবস্থায় ভিতরে ভিতরে গুমরে উঠলেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কিংবা তার পরামর্শদাতারা আন্দাজই করতে পারলেন না, তারা ভীমরুলের চাকে হাত দিয়েছেন।
সৈন্যবাহিনী দিয়ে পার্লামেন্ট ভবন ঘেরাও করে সংবিধান সংশােধন থেকে শুরু করে গভর্নর নিয়ােগ পর্যন্ত সমস্ত ব্যাপারগুলাে কোনােরকম গণ্ডগােল ছাড়াই সমাধা হওয়ায় তারা আসন্ন দুর্যোগের হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার কোনাে ব্যবস্থাই করলেন না। তারা বুঝতেই পারলেন , সর্বোচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন পলিট ব্যুরাে নিযুক্ত হওয়ায় মন্ত্রিসভায় বেশ কিছু সদস্যসহ আওয়ামী লীগের একটা বিরাট মহল নিরপেক্ষ ভূমিকায় চলে গেছে। আর বঙ্গবন্ধু সরকারকে নিশ্চিহ্ন করার উদ্দেশে বিদেশী ইংগিতে স্বার্থান্বেষী মহলগুলো যড়যন্ত্রের জন্য ঘন ঘন মিলিত হচ্ছে। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে বানচাল করার লক্ষ্যে মার্কিনীদের যােগসাজশে মুজিবনগরে যে ষড়যন্ত্র হয়েছিল এবং পরবর্তীকালে বিদেশী সাংবাদিক লরেনস লিফসুজ যার তথ্য উদঘাটন (বাংলাদেশ : দি আনফিনিশড রেভলিউশন গ্রন্থ) করেছেন; তার বরাতে এক্ষণে এটুকু বলা যায় যে, স্বাধীনতার পর খন্দকার মােশতাকের উপদল যখন দেখতে পেল যে, ‘মুজিবনগরের যড়যন্ত্রের বিচার করে শাস্তি দেয়া তাে দূরের কথা ডামাডােলের মধ্যে পুরাে ব্যাপারটাই চাপা পড়ে গেছে এবং বিশেষ জানাজানি হয়নি; তখন তারা আবার ঢাকার আগামসি লেনে মিলিত হতে শুরু করলেন। মুজিবনগরে প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদ কর্তৃক পদচ্যুত পররাষ্ট্র সচিব মাহবুবুল আলম চাষী আবার বঙ্গবন্ধুর মহানুভবতায় চাকুরি ফিরে পাওয়ায় এরা দ্বিগুণভাবে উৎসাহিত হলেন। এসব বৈঠকগুলােতে পুরনাে রাজনৈতিক সাথীরা ছাড়াও মাঝে মধ্যে নতুন মুখের আমদানি হলাে। এদের মধ্যে আলহাজ্ব জহিরউদ্দিন, খােন্দকার আবদুল হামিদ, আসাফোদ্দৌলা রেজা এবং ইত্তেফাকের হােসেন ভ্রাতৃদ্বয় অন্যতম।
এসবের বিস্তারিত তথ্য বিদেশী সাংবাদিক লরেনস লিফসুজ এবং এ্যন্থনী মাসকার্নহাসএর বরাতে অত্র পুস্তকে উপস্থাপিত করা হয়েছে। এরই পাশাপাশি নব্য গঠিত ‘গণ ঐক্য জোট’-এর মােকাবেলায় আওয়ামী লীগের দক্ষিণপন্থী উপদলের অন্যতম নেতা ব্যরিস্টার মইনুল হােসেনের কাকরাইলস্থ বাস ভবনে অনুষ্ঠিত হলাে বেশ ক’টি অঘােষিত বৈঠক। প্রকাশ, এ ধরনের এক বৈঠকে ব্যারিস্টার মইনুল স্বয়ং একটি পৃথক ‘সােহরাওয়াদী আওয়ামী লীগ’ গঠনের প্রস্তাব দিলেন। এমনকি ব্যারিস্টার সাহেব প্রস্তাবিত পার্টির একটা খসড়া মেনিফেস্টো পর্যন্ত পেশ করলেন। অনেক তর্ক-বিতর্কের পর উপস্থিত অনেকেই এ মর্মে মত প্রকাশ করলেন যে, স্বেচ্ছায় আওয়ামী লীগ থেকে বেরিয়ে আসা বুদ্ধিমানের কাজ হবে। লা। তাই ওয়াকেফহাল মহলের মতে আপাতত সিদ্ধান্ত হচ্ছে, পার্লামেন্টারি। গণতন্ত্রের কথা বলে বঙ্গবন্ধু সরকারকে বিপ্লবী কর্মসূচি গ্রহণ থেকে বিরত রাখতে হবে এবং কিছুতেই বাংলাদেশের প্রকৃত ইতিহাস প্রণয়ন এবং বাঙালি জাতির সঠিক ঐতিহ্য নির্ণয় করতে দেয়া হবে না। বিশ্বের এই সর্ববৃহৎ গাঙ্গেয় ব-দ্বীপ। এলাকায় স্থানিক বাঙালি কালচার-এর সঙ্গে পবিত্র ধর্মের যে অপূর্ব সমন্বয় হয়েছে, এই মৌলিক সত্যকে কোনাে অবস্থাতেই উপস্থাপিত করা বুদ্ধিমত্তার পরিচায়ক। হবে না এবং ইসলামের ভিন্নতর ব্যাখ্যা দিয়ে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করতে হবে। নিজেদের চিন্তাধারার স্বপক্ষে জনমত গঠনের দায়িত্ব হবে দৈনিক ইত্তেফাক-এর। এ ধরনের এক প্রেক্ষাপটে যে ব্যক্তিত্ব একদিন পাকিস্তানের অস্থায়ী প্রধানমন্ত্রী হিসাবে দিল্লী সফরকালে ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী পণ্ডিত জহরলাল নেহরুর জন্য এক পাতিল সুন্দরবনের মধু নিয়ে হাজির হয়েছিলেন এবং নেহরুকে ‘বড়ভাই’ হিসাবে সম্বােধন করেছিলেন, সেই সাংবাদিক-রাজনীতিবিদ আবুল মনসুর আহম্মদ বার্ধক্যের দ্বারপ্রান্তে এসে আবার লেখনী ধরলেন।
কিন্তু বক্তব্য ভিন্নধর্মী। দৈনিক ইত্তেফাকে তিনি লিখলেন, বিপ্লব নয়, পার্লামেন্টারি গণতন্ত্র; ‘বাঙালি জাতীয়তাবাদ নয়, বাঙালি মুসলিম জাতীয়তাবাদ’ ইত্যাদি। অথচ বাংলাদেশের। নয়া সংবিধানে তখন দেশে ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল গঠন পর্যন্ত বেআইনী। অন্যদিকে এক শ্রেণীর উঠতি বাঙালি শিল্পপতি অবাঙালিদের পরিত্যক্ত শিল্প দখলে ব্যর্থ হয়ে এবং শিল্প জাতীয়করণের নীতির ঘাের বিরােধিতার লক্ষ্যে বঙ্গবন্ধুর মহানুভবতায় ক্ষমতাপ্রাপ্ত দক্ষিণপন্থী নেতৃবৃন্দের মদদ জোগাতে শুরু করলাে। ঢাকা-লন্ডন বিশেষ মহলের মধ্যে একটা নিবিড় যােগসূত্রের সৃষ্টি হলাে। ক্ষমাপ্রাপ্ত কোলাবরেটর আর বাংলাদেশের অস্তিত্বে অবিশ্বাসী নেতৃবৃন্দ ঘন ঘন। লন্ডন-জেদ্দা ও করাচী-লন্ডন যাতায়াত শুরু করল। প্রকাশ, পাকিস্তানি লবীর। সক্রিয় সমর্থনে লন্ডনে বেশ কয়েক দফা বৈঠকের পর ঢাকার কথিত ষড়যন্ত্রকারীদের সম্ভাব্য সাহায্যের আশ্বাস দেয়া হলো।  শােনা যায়, মূল পরিকল্পনা অনুসারে চট্টগ্রামের বেতবুনিয়াতে যখন প্রেসিডেন্ট মুজিব উপগ্রহ কেন্দ্র উদ্বোধন করতে গিয়েছিলেন, তখনই তাঁকে হত্যা করার কথা। কিন্তু ট্যাঙ্ক বাহিনীকে সেখানে নেয়া সম্ভব নয় বলে হত্যাকাণ্ডের দিন পরিবর্তন করা হয়।
ষড়যন্ত্রকারীরা যেভাবে হত্যার দিন ঠিক করেছিল, তা চিন্তা করলে অবাক লাগে। কেননা এ সময় রক্ষীবাহিনীর প্রধান বিগ্রেডিয়ার নুরুজ্জামান দেশের বাইরে এবং সামরিক গােয়েন্দা বিভাগের নয়া ডিরেক্টর জেনারেল কর্নেল জামিল তখনও দায়িত্বভার গ্রহণ করেননি।  এটা এমন একটা সময় যখন বঙ্গবন্ধুর সরকারের প্রতি বন্ধু দেশগুলাের মনােভাব কিছুটা ঝাপসা এবং সন্দেহের বীজ বপন হয়েছে। কেননা বঙ্গবন্ধুর কথা হচ্ছে ‘বশ্যতা নয়; বন্ধুত্ব। অন্যদিকে বাকশালের পলিট ব্যুরাে গঠনে আওয়ামী লীগের বিরাট মহল নিরপেক্ষ হওয়ার প্রেক্ষিতে জাতীয়তাবাদী শক্তি অনেকটা ছত্রভঙ্গ আর শিক্ষিত মহল বিভ্রান্ত। মুজিব-বিরােধীরা বুঝতে পেরেছিলেন, যা কিছু করার তা পহেলা সেপ্টেম্বর থেকে জেলায় জেলায় গভরশীপ পদ্ধতির প্রশাসনের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুর নতুন ক্ষমতার উৎস সৃষ্টির আগেই করতে হবে। চরম আঘাত হানার জন্য ষড়যন্ত্রকারীরা এমন একটা সময় বেছে নিলাে, যখন জেলায় জেলায় গভর্নরের ক্ষমতা গ্রহণের আর মাত্র সপ্তাহ দুয়েক বাকি আছে। একবার গভর্নররা গদিতে বসতে পারলে সরকারের শক্তির উৎস প্রচুর। পরিমাণে জেলাগুলােতে স্থানান্তরিত হওয়ার প্রেক্ষিতে বঙ্গবন্ধুর আগামী সরকারকে নিশ্চিহ্ন করা মুস্কিল হবে। সেক্ষেত্রে জেলাগুলো থেকেই সংঘবদ্ধভাবে প্রতিরােধ আসতে বাধ্য।

এজন্য পহেলা সেপ্টেম্বরের আগেই বঙ্গবন্ধু হত্যার ষড়যন্ত্রকে বাস্তবায়িত করতেই হবে। তাই যারা একথা বলেন যে, সপরিবারে বঙ্গবন্ধু হত্যা একটা বিচ্ছিন্ন ঘটনা। মাত্র, তারা সত্যের অপলাপ করছেন। আসলে অত্যন্ত সন্তর্পণে এক সুদূরপ্রসারী ষড়যন্ত্রের জের হিসাবেই এ নৃশংস হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়েছে। ষড়যন্ত্রকারীরা নানা অছিলায় সবার দৃষ্টি শুধুমাত্র সংশ্লিষ্ট মেজরদের উপর নিবন্ধ রাখার জন্য। তখনও প্রচেষ্টা চালাচ্ছিল। তাই মূল পরিকল্পনা হিসাবে পরােক্ষভাবে জিয়ার ‘ইমেজ তৈরি ও রাস্তা সুগম। করার উদ্দেশে কাজ শেষ হবার সঙ্গে সঙ্গে খন্দকার মোশতাক, জেনারেল। ওসমানী, খালেদ মােশাররফ, কর্নেল তাহের, মেজর ফারুক-রশীদের দল, বিচারপতি সায়েম এবং এয়ার ভাইস মার্শাল তাওয়াব-একে একে সবাইকে উচ্ছিষ্টের মতাে নর্মায় ফেলে দেয়া হলাে। অবস্থা দৃষ্টে মনে হয় যে, বঙ্গবন্ধুকে বেআইনীভাবে ক্ষমতাচ্যুত করার ষড়যন্ত্রের কথা মােটামুটিভাবে সব কটি উপদলের জানা থাকলেও, পাক-মার্কিন বিশেষ মহলের সমর্থনে নানা ঘাত-প্রতিঘাতের মাঝ দিয়ে শেষ পর্যন্ত জেনারেল জিয়াকে যে ক্রীড়নক হিসাবে ক্ষমতায় বসানাে হবে—এই ষড়যন্ত্রের কথাটা অনেকের অজানা ছিল।

সূত্রঃ মুজিবের রক্ত লাল – এম আর আখতার মুকুল

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!