You dont have javascript enabled! Please enable it! 1975.08.15 | বাংলাদেশের ব্যুরােক্রেসি ও বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড - সংগ্রামের নোটবুক
মুখে সমাজতন্ত্রের বুলি আওড়ালেও ব্যুরােক্রেসির মারপ্যাচ
পৃথিবীর দরিদ্রতম দেশগুলাের মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। ব্রিটেনের দু’শ’ বছর এবং পাকিস্তানের ২৩ বছরের শাসন ও শােষণ এর জন্য দায়ী। কিন্তু স্বাধীন বাংলাদেশে এতাে সুযােগ থাকা সত্ত্বেও অর্থনৈতিক অবস্থার উন্নতি হওয়া তাে দূরের কথা, দিন দিন অবনতি হচ্ছে কেন? এই প্রশ্নের জবাবে নিঃসন্দেহে বলা চলে যে, বাংলাদেশের ব্যুরােক্রেসিই এর জন্য মূলত দায়ী। স্বাধীনতার পর পরই যেদিন অফিসারদের চাকুরি অব্যাহত রেখে পাকিস্তানি যুগ থেকে সিনিয়রিটি দেয়ার সিদ্ধান্ত হলাে সেদিনই মুক্তিযুদ্ধের আদর্শকে বানচাল করে বঙ্গবন্ধুকে নিশ্চিহ্ন করার বীজ বপন করা হলাে। বিশ্বের ইতিহাসে আজ পর্যন্ত কোনাে দেশেই রক্তাক্ত মুক্তিযুদ্ধের পর পরাজিত প্রশাসনের কর্মচারীদের চাকুরি সম্মানের সঙ্গে বজায় রাখা এবং পরাজিত প্রশাসনের রুলস-রেগুলেশন হুবহু অব্যাহত রাখার নজির নেই। কিউবার ফিদেল ক্যাস্ট্রো কিংবা মহাচীনে মাও সে তুং; সবাই দেশ স্বাধীন হবার পর পূর্ববর্তী সরকারের সমস্ত অফিসারকে নিশ্চিহ্ন করেছে আর দেশের স্বার্থে নতুন নতুন সরকারি বিধি প্রণয়ন করেছে। তাই তাে, এরা একটার পর একটা বিদেশী ষড়যন্ত্র বানচাল করতে সক্ষম হয়েছে। সম্প্রতি ক্যাম্পুচিয়ার বিপ্লবী সরকার পাঁচ হাজার দালাল অফিসারকে নিশ্চিহ্ন করেছে বলে খবর বেরিয়েছে। ভবিষ্যতে ক্যাম্পুচিয়ার মাটিতে যাতে করে বিদেশী শক্তি ষড়যন্ত্র না করতে পারে তার জন্যই এ ব্যবস্থা নিতে হয়েছে। 
কিন্তু বিচিত্র দেশ এই বাংলাদেশ। পাকিস্তানের তৈরি প্রশাসনের পরাজিত অফিসাররা যখন নিজেদের অতীত অপরাধের জন্য প্রাণ ভয়ে প্রকাশ্যে বাইরে আসতে সাহসী নন, তখন স্থানীয় নেতৃস্থানীয় কয়েকটি সংবাদপত্র আর বিশেষ মহল থেকে প্রশাসনে অনভিজ্ঞ নেতৃবৃন্দের উপর চাপ সৃষ্টি করা হলাে। বুঝানাে হলাে, দেশকে পুনর্গঠনের সময় অভিজ্ঞ অফিসারের প্রয়োজন বলে এদের শুধু প্রাণে রক্ষা করতে হবে, তাই-ই নয়, নতুন প্রশাসনে এদের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব দিতে হবে। মুজিবনগর সরকারের প্রাক্তন সি,এস,পি অফিসাররা ছাড়াও খন্দকার মােশতাকের উপদল এ ব্যাপারে প্রকাশ্যেই ওকালতি করল। অথচ এ কথাটা কেউই বলল না যে, এদের অভিজ্ঞতা হচ্ছে পরাজিত প্রশাসনের অভিজ্ঞতা। এদের অভিজ্ঞতার জন্যই দখলীকৃত এলাকায় আইনশৃঙ্খলার লেশমাত্র ছিল না। এদের অভিজ্ঞতা হচ্ছে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর “লেজুড়’ হিসাবে কাজ করার অভিজ্ঞতা এবং এদের অভিজ্ঞতা হচ্ছে রাজাকার ও আলবদর সৃষ্টি করে হত্যা, লুণ্ঠন আর নারী ধর্ষণের ইন্ধন জোগানের অভিজ্ঞতা। পাকিস্তানের কারাগার থেকে বঙ্গবন্ধুর ফিরে আসা পর্যন্ত আর তার সহ্য হলাে গােষ্ঠী স্বার্থে মুজিবনগরের সি.এস.পি অফিসারদের সুপারিশে বাহাত্তরের জানুয়ারি মাসের প্রথম সপ্তাহে ঢাকা থেকে সরকারি নির্দেশ জারি হলাে। প্রকাশ্যে অতিরিক্ত দালালীর অভিযােগে অভিযুক্ত গুটি কয়েক অফিসার ছাড়া বাকি সবারই চাকুরি , অব্যাহত থাকলাে। শুধু তাই-ই নয়, প্রমােশনের ক্ষেত্রে এদের “সিনিয়রিটি’ গণ্য করা হবে বলে আশ্বাস দেয়া হলাে। বাংলাদেশের প্রতি আনুগত্য প্রকাশের একটা বন্ডে দস্ত খত করে এসব কোলাবরেটর অফিসাররা রাতারাতি দেশপ্রেমিক হলেন।
ঢাকার ইডেন বিল্ডিংস-এর সেক্রেটারিয়েট আবার সেই পরিচিত মুখগুলােয় ভরে উঠলাে। ধীরে ধীরে তারা আসর জাকিয়ে বসলেন। এদের প্রথম কাজ হলাে মুক্তিবাহিনীকে ‘ডিসব্যান্ড’ করা। এরা রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ ও মন্ত্রীদের বুঝালাে, ‘মুক্তিবাহিনীর ছেলেদের কন্ট্রোল করা খুবই মুস্কিল হয়ে উঠেছে। এখন সাহস করে ব্যবস্থা না নিলে আপনাদেরই অসুবিধা হবে। ভবিষ্যতে এরা কিন্তু বিরাট বিপদ হয়ে দেখা দিবে। বন্ধু দেশগুলাের সক্রিয় সমর্থন ছাড়া যে শক্তির বলে বলীয়ান হয়ে নেতৃবৃন্দ বাংলাদেশকে স্বাধীন করতে সক্ষম হয়েছিলেন এবং যে শক্তির উপর নির্ভর করে পাকিস্তানের শােষক গােষ্ঠীর সামরিক বাহিনীকে আত্মসমর্পণ করানাে সম্ভব হয়েছিল, সেই শক্তিকে বিনষ্ট করার ষড়যন্ত্র হলাে। মুক্তিবাহিনীর রেশন সরবরাহ বন্ধ করে ‘ডিসব্যান্ড করার জন্য ঢাকার সেক্রেটারিয়েট থেকে নির্দেশ জারি হলাে।  অ্যাংগােলা, মােজাম্বিক, কিউবা কিংবা মহাচীনের মতাে মুক্তিবাহিনীকে শৃঙ্খলার মধ্যে এনে দেশ গড়ার কাজে লাগানাে হলাে না। গ্রাম-বাংলার লাখ লাখ দামাল ছেলে এতাে বড় একটা মুক্তিযুদ্ধ করার পর স্বাধীন বাংলাদেশে বেকারত্বের অভিশাপকে মাথায় নিয়ে দারিদ্র আর বুভুক্ষার মধ্যে ফিরে গেল। এরপরেই জারি হলাে আর একটা সরকারি নির্দেশ। স্বাধীনতার যুদ্ধের বিজয়ী মুজিবনগর সরকারের কর্মচারীদের বাংলাদেশ সরকারের কর্মচারী হিসাবে গ্রহণের ব্যাপারটা বিলম্বিত করার উদ্দেশে সংস্থাপন বিভাগে একটা বিশেষ সেল গঠন করা হলাে।
এসব কর্মচারীদের নতুন করে পােস্টিং-এর জন্য কাগজপত্র পরীক্ষা করতে হবে। সরকারের এই অদ্ভুত নির্দেশে আমরা ঢাকার প্রেস ক্লাবে বসে হাসাহাসি করতে লাগলাম। কোথায় মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ী মুজিবনগর সরকার, পরাজিত প্রশাসনের কর্মচারীদের ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করবে আর কোথায় উল্টা ‘কোলাবরেটর’ অফিসাররাই এখন বাস্তবে পরীক্ষা করে দেখছে যে, মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী কর্মচারীদের চাকুরি দেয়া হবে কিনা? এতে সমাজের প্রতিটি ক্ষেত্রে বিভ্রান্তি দেখা দিলাে। এটাই হচ্ছে। সমসাময়িককালে বিরাজমান পরিস্থিতিতে সবচেয়ে নির্মম পরিহাস। এখানে একটা ঘটনার কথা উল্লেখ করলে, স্বাধীনতার পর বাংলাদেশের আসল চেহারাটা কী রকম দাঁড়িয়েছিল, তার কিছুটা আঁচ করা যাবে। বাহাত্তর সালের শেষের দিকে কী একটা খবর জোগাড়ের জন্য জনাকয়েক বন্ধু সাংবাদিকের সঙ্গে আমিও একজন প্রাক্তন সাংবাদিক হিসাবে ঢাকার রমনা থানায় গিয়েছি। ওসি ভদ্রলােক আমাদের পূর্ব পরিচিত। হেসে সবাইকে বসতে বললেন। তাড়াতাড়ি টেবিলের কাগজপত্র গুছিয়ে থানার ডাইরি থেকে খবরটা পড়ে শােনালেন। এরপর ওসি সাহেব বললেন, আপনারা তাে সাংবাদিক, মানুষের পেটের খবর রাখেন। তাই আজ আরও একটা খবর দিবাে। কিন্তু আপনাদের বলতে হবে এর মাজুমাটা কী?
আমরা নতুন খবরটা শােনবার জন্য সবাই উদগ্রীব হয়ে উঠেছি। এমন সময় ভাঙা কয়েকটা পেয়ালায় চা এল। আর ওসি সাহেব খবরটা বলতে শুরু করলেন। “গত কিছুদিন থেকেই দেখছি, আমার এলাকার পলাতক রাজাকার, আলবদর আর কোলাবরেটারদের যাকেই ধরে আনি না কেন কোট-এ চালান দেয়ার আগেই জানাজানি হয়ে যায়। কিছুক্ষণের মধ্যেই প্রভাবশালী মহল থেকে ফোন আসে। তার পরপরই উকিল, মােক্তার নিয়ে লােক এসে হাজির হয়। ফোনটা কিসের জন্য আসে তা বােধ হয় বলে দিতে হবে না। তাই বদলী আর হয়রানির ভয়ে ফাইন্যাল রিপাের্ট দিয়ে এসব আসামীদের ছেড়ে দিতে হয়। এখানেই শেষ নয়। এ ব্যাটাগুলাে থানা থেকে যাবার সময় এক রকম ধরতে গেলে মুখ ভেংচি দিয়ে হাসতে হাসতে চলে যায়।  তাই এক বেটা রাজাকারকে ধরে আনার পর আজ এক কাজ করে বসেছি। প্রথমেই বেটার মাথার লম্বা চুল থেকে কাঁচি দিয়ে এক গাছি কেটে কাগজে মুড়ে ড্রয়ারে রেখে এখন বিশেষ ফোনের জন্য বসে রয়েছি। আমরা সবাই হাে হাে করে হেসে উঠলাম।
ওসি ভদ্রলােক আমাদের সঙ্গে হাসিতে যােগ না দিয়ে ড্রয়ার খুলল। কাগজের মােড়কের মধ্যে সযত্নে রাখা একগাছি চুল দেখিয়ে বললেন, “কেন এটা রেখেছি জানেন? বেটা যেন খালাস হয়ে যাবার সময় বলতে না পারে, ‘স্যার এক গাছি চুলও তাে রাখতে পারলেন না? এখন বলেন এর মাজুমাটা কী? বাংলাদেশের কেইসটা আপনারা কেমন বুঝতাছেন? এবার আর আমরা হাসতে পারলাম না। সবাই এক রকম মাথা নিচু করে উঠে গেলাম। চোখের সামনে দেখতে পেলাম একাত্তরের রক্তাক্ত মুক্তিযুদ্ধ আর বাহাত্তরের স্বাধীন বাংলাদেশের কী সাংঘাতিক পরস্পর বিরােধী ছবি। কোনােভাবেই হিসাব মিলাতে পারলাম না। তবে কি সবার অজান্তেই ডান দিক থেকে বাংলাদেশে একটা প্রতি-বিপ্লব হয়ে গেছে? পঁচিশে মার্চ রাতে বঙ্গবন্ধু কেন ধরা দিলেন আর কাদের ইশারায় বা বাংলাদেশে কোলাবরেটরদের নিশ্চিহ্ন করার আগেই পাকিস্তানি কারাগার থেকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে ছেড়ে দেয়া হলাে? আর তার সঙ্গে কীভাবে ড. কামাল। ফিরে এলেন? এ তিনটা প্রশ্নের জবাব তাে ইতিহাসের পাতায় খুঁজে পাচ্ছি না। স্বাধীনতার অব্যবহিত পরে পাকিস্তানি প্রশাসনের ধারাবাহিকতায় পুনর্গঠিত বাংলাদেশের প্রতিক্রিয়াশীল ব্যুরােক্রেসি ও পুলিশ বাহিনী, আত্মঘাতী বাণিজ্যনীতি, আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরীণ কোন্দল, ব্যাপক দুর্নীতি ও চোরাচালান স্বাভাবিকভাবেই দ্রুত ক্ষমতাসীন দলকে জনসাধারণের কাছ থেকে দূরে সরিয়ে নিলাে। এরই ফল হিসাবে সরকারের মৌলিক নীতিগুলাে শুধুমাত্র মধ্যবিত্ত এবং নব্য ধনীদের স্বার্থে প্রণীত হলাে। এক শ্রেণীর লােক রাতারাতি বিপুল ধন-সম্পত্তির ও অর্থের মালিক হলেন। মাত্র দুই বছরের মাথায় স্বাধীন বাংলাদেশ থেকে পালিয়ে যাওয়া বিত্তশালী অবাঙালিদের শূন্যস্থান পূরণ হলাে।
সৃষ্টি হলো নতুন বাঙালি বুর্জোয়া শ্রেণীর। হিসাব করলে দেখা যায় যে, স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম তিন বছরে যেখানে কৃষি উন্নয়নের জন্য মাত্র পনেরাে হাজার পাওয়ার পাম্পের ব্যবস্থা করা যায়নি, সেখানে প্রায় বিশ হাজার নতুন মােটরগাড়ি আমদানি হয়েছে। যেখানে বেকার যুবকদের কর্মসংস্থানের উদ্দেশে ব্যাপক কারিগরী শিক্ষার ব্যবস্থা করা যায়নি, সেখানে মাদ্রাসা শিক্ষার জন্য পাকিস্তানি আমলের বার্ষিক ৩৫ লাখ টাকার জায়গায় বার্ষিক ৭২ লাখ টাকার ব্যবস্থা করা হয়েছে। যেখানে ছােট ছােট শিল্পগুলােকে বাঁচাবার জন্য খুচরাে যন্ত্রপাতি আমদানি করা যায়নি, সেখানে টিসিবি মারফত লাখ লাখ টাকার ৫৫৫ সিগারেট ও ব্লেড আর কয়েক কোটি টাকার বেবি ফুড (বিত্তশালী প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য) আমদানি করা হয়েছে। যেখানে কয়েক লাখ টাকার সাহায্য দিয়ে গ্রামীণ সংস্কৃতিকে পুনরুজ্জীবিত করা যায়নি, সেখানে মাত্র বিশ হাজার টিভি সেটের মালিককে সন্তুষ্ট করার উদ্দেশে টেলিভিশন সংস্থাকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য বছরে গড়ে দু’কোটি করে টাকা খরচ করা হয়েছে। তাই দেখতে দেখতে শহরের বড় বড় দোকানপাটগুলাে বিদেশী সৌখিন দ্রব্যে ভরে উঠলাে। আর টাকার অভাবে একটার পর একটা উন্নয়ন পরিকল্পনা বন্ধ হয়ে গেল। গ্রাম-বাংলা যে তিমিরে সেই তিমিরেই রয়ে গেল। অনাহার, অনটন আর দারিদ্র্যের কশাঘাতে সাধারণ মানুষের জীবন হলাে জর্জরিত। অন্যদিকে বিদেশ থেকে খাদ্য, তেল আর রক ফসফেট আমদানির ফাইল নিয়ে । সেক্রেটারিয়েটে শুরু হলাে দৌড়াদৌড়ি। সবাই কমিশন নিয়ে ব্যস্ত। বিমান মন্ত্রী জেনারেল ওসমানী তাে ফকার ও বােয়িং বিমান কেনার ব্যাপারে সরকারি রুলস্-এর বাগড়া তােলায় মুজিবনগরের এক অফিসারকে রাতারাতি বদলী করালেন।
প্রকাশ, জেনারেল ওসমানী প্রধানমন্ত্রীকে বলেছিলেন যে, এই অফিসারকে বদলী করা না হলে তিনি পদত্যাগ করবেন। এরপর জেনারেল সাহেব বিমান কেনা আর এজেন্সি দেয়ার ব্যাপারগুলাে নিজের তত্ত্বাবধানে সমাধা করলেন। অথচ বাইরে এরা সবাই বঙ্গবন্ধুর চরিত্রে কলঙ্ক দিতে শুরু করলেন। অত্যন্ত সন্তর্পণে শেখ মুজিব সম্পর্কে কথিত দুর্নীতির কথা চালু করা হলাে। কানাডার অটোয়ায় কমনওয়েলথ প্রধানমন্ত্রী সম্মেলনে যােগদানের সময় বিদেশী খাদ্যে অনভ্যস্ত শেখ সাহেবের জন্য ঢাকা থেকে এক হাড়ি জীবন্ত মাগুর মাছ পাঠানাে হলে ঢাকায় একটা ইংরেজি সাপ্তাহিক পত্রিকায় ছাপা হলাে, টন দুয়েক (প্রায় ৫৫ মণ) খাবার নিয়ে যাওয়া হয়েছে। দ্বিতীয় পুত্র শেখ জামালকে স্যান্ডহার্সের ট্রেনিং-এর জন্য পাঠানাে হলে রটনা করা হলাে যে, শেখ মুজিব লন্ডনে একটা বিরাট বাড়ি কিনেছেন এবং বিদেশী ব্যাংকে কয়েক কোটি টাকা পাচার করেছেন। নিয়তির নিষ্ঠুর পরিহাস! বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর প্রথমে মােশতাক সরকার এবং পরে সায়েম-জিয়া সরকার, কথিত দুর্নীতির ঘটনা বের করার কত চেষ্টাই না করলেন! ঢাকার বত্রিশ নম্বরের পুরনাে বাড়িটা ছাড়া ঢাকা-লন্ডনের কোথাও বঙ্গবন্ধুর একটা বাড়ি পর্যন্ত পাওয়া গেল না। বিদেশের কোথাও একটা ব্যাংক একাউন্টের অস্তিত্ব পর্যন্ত মিললাে না। বহু তদন্তের পর প্রকাশ পেলাে যে, প্রায় সাড়ে তিন বছর গদিতে থাকার পর বঙ্গবন্ধু পরিবারের সমস্ত আত্মীয়-স্বজনের বাইশটা একাউন্ট-এ মাত্র কয়েক লাখ টাকা রয়েছে। বঙ্গবন্ধুর নিজস্ব একাউন্ট-এ লাখ খানেক টাকাও নেই। অবস্থা বেগতিক দেখে সামরিক সরকার বঙ্গবন্ধুর দুর্নীতির কথা প্রচারে আর সাহসী হলাে না।
এদিকে স্বাধীনতার অল্প কিছুদিনের মধ্যেই ব্যুরােক্রেসির কারসাজিতে ও মুজিবনগরের দক্ষিণপন্থী মহলের চাপে বাংলাদেশের চেহারাটাই পাল্টে গেল। ঘুণে ধরা পুলিশ বাহিনীর ব্যর্থতার জন্য খুন-জখমের সংখ্যা ব্যাপক বৃদ্ধি পাওয়ায় দিনের অধিকাংশ সময়ে বঙ্গবন্ধু আইন ও শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। এর মধ্যে শুরু হলাে রাজনৈতিক কোন্দল।  সত্যি কথা বলতে কী, মুখে সমাজতন্ত্রের বুলি আওড়ালেও ব্যুরােক্রেসির মারপ্যাচে সরকারের কার্যক্রম মােটেই সমাজতান্ত্রিক পথে অগ্রসর হলাে না। প্রয়ােজনীয় ব্যবস্থা ও প্রস্তুতি না নিয়ে কলমের এক খোচায় বৃহৎ শিল্প। জাতীয়করণের অর্থই হচ্ছে—শিল্প ব্যবস্থাপনায় অনভিজ্ঞ লােক দিয়ে এমন এক দুর্নীতিমূলক অবস্থার সৃষ্টি করা, যাতে ভবিষ্যতে সাধারণ মানুষ জাতীয়করণের নামে আতংকগ্রস্ত হয়। রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনা অর্থাৎ টিসিবির মাধ্যমে আমদানির ক্ষেত্রে এমন দুর্নীতির সৃষ্টি হলাে, যাতে অফিসাররা টাকার পাহাড় বানালেও জবাবদিহির দায়িত্ব হলাে ক্ষমতাসীন দলের। বাংলাদেশের সংবাদপত্র থেকে শুরু করে রাজনৈতিক দলগুলাের কেউই একথাটা বলল না যে, খন্দকার মােশতাক আহম্মদ-এর অধীনে টিসিবি, ভােগ্যপণ্য আর বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ই হচ্ছে দুর্নীতির আখড়া। এ সময় বাংলাদেশের ঘােষিত বাণিজ্যনীতিকে ‘আত্মঘাতী’ হিসাবে আখ্যায়িত করা যায়। এই নীতির ফলে সৃষ্টি হলো ‘ওয়েজ আর্নিং স্কিম। কলকারখানার খুচরা যন্ত্রপাতি ও অতি প্রয়ােজনীয় কেমিক্যালস কিংবা পাওয়ার পাম্প ও টিলারের বদলে আমদানি হলাে। বিদেশী গাড়ি, ফ্রিজ, টিভি সেট, সিগারেট, সৌখিন কাপড় আর প্রসাধন দ্রব্য। উপর্যুপরি একই ধরনের বাণিজ্যনীতির ফলে গ্রাম-বাংলার সাধারণ মানুষের কোনাে উপকারই হলাে না। এছাড়া একদিকে সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার অভাব এবং অন্যদিকে অপরিপক্ক ট্রেড ইউনিয়নগুলাের আন্দোলনের বদলে ‘হামলা’র ফলে কলকারখানায় আশঙ্কাজনকভাবে উৎপাদন হ্রাস পেলাে। ফলে একটার পর একটা নিত্যব্যবহার্য দ্রব্যের অভাব হলাে প্রকট।
এ কথা ভাবলে আশ্চর্য লাগে যে, বঙ্গবন্ধুর ক্ষমা ও মহানুভবতায় বাংলাদেশে এমন এক প্রশাসনের সৃষ্টি হয়েছিল, যারা দেশে যথেষ্ট লবণ থাকা সত্ত্বেও লবণের দুর্ভিক্ষ ঠেকাতে পারেনি। এরা কিছুসংখ্যক রেলওয়ে ওয়াগন আর বার্জ জোগাড় করে চট্টগ্রাম থেকে লবণ পর্যন্ত সুষ্ঠুভাবে সরবরাহ করতে ব্যর্থ হয়েছিল। শেষে সমস্ত জরুরি কাজ বন্ধ রেখে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিব স্বয়ং লবণ সমস্যার সমাধানে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। আর হােমরা-চোমরা অফিসারেরা। ফাইল হাতে গণভবনে দৌড়াদৌড়ি করে নিরাপত্তা আইনে লবণ ব্যবসায়ীদের গ্রেফতারের পরামর্শ দিলেন। হায়রে, পাকিস্তানি প্রশাসনের অভিজ্তা!  এবার আরও কিছু প্রাসঙ্গিক কথা। ১৯৭৩ সালের গােড়ার দিকের কথা। আমরা কজনা কী একটা ব্যাপারে পুরনাে গণভবনে গেছি। আমাদের দলের প্রায় সবাই সাংবাদিক। বঙ্গবন্ধু আমাদের ডেকে নিলেন পিছনের বারান্দায়। চমৎকার সবুজ মাঠটার উপর বিকেলের পড়ন্ত রােদ এসে পড়েছে। হঠাৎ করে বঙ্গবন্ধু তার সাম্প্রতিক যশাের সফরের কথা বলতে শুরু করলেন। যশােরের মিটিং শেষ করে সার্কিট হাউসে ফিরে এসেছি। গাড়ি থেকে নামতেই দেখি এক বিরাট জনতা লাইন করে দাঁড়িয়ে আমাকে সালাম জানিয়ে ‘জয় বাংলা’ আর ‘বঙ্গবন্ধু জিন্দাবাদ’ স্লোগান দিচ্ছে। ‘একটু এগিয়ে যেতেই দেখলাম এক ভদ্রলােক সালামের বদলে স্যালুট করলাে। চেহারাটা চেনা চেনা। হাতের ঈশারায় ডেকে বললাম, ‘তুমি নির্মল না? তুমি আমার সঙ্গে এসাে।’ তেত্রিশ বছর আগেকার স্মৃতি মনে পড়লাে। আমরা তখন গােপালগঞ্জে মিশন স্কুলে পড়ি। এই নির্মল ছিল আমাদের স্কুলের ফুটবল টিমের সেন্টার হাফ । ফাইনালে খেলতে এসেছি এই যশােরেই। দারুণ খেলা হলাে। বলতে কি, শুধুমাত্র নির্মলের জন্যই আমরা সেদিন জিতেছিলাম।
এবার সেই যশােরেই নির্মলকে সে কথা মনে করিয়ে দিয়ে হা হা করে হেসে জিজ্ঞেস করলাম, “তা তুমি এখন কী করছে? মুখটা কাচুমাচু করে উত্তর দিলাে, ‘স্যার আমি দারােগা ছিলাম। ভগবানের কৃপায় এখন রিটায়ার্ড করেছি।’ মনে সন্দেহ হলাে। জিজ্ঞেস করলাম, “তােমার তাে রিটায়ার্ড করার বয়স হয়নি?” নির্মল ঃ ‘স্যার, একাত্তরের অসহযােগ আন্দোলনের সময় আমি এই জেলার এক, থানায় সেকেন্ড অফিসার ছিলাম। বড় দারোগা সাহেব ছিলেন ‘জামাত সমথক। আমার উপর তার খুব রাগ। তলে তলে অামার চাকুরি খাওয়ার জন্য রিপাের্ট তৈরি করলেন। উনিশে কী বিশে মার্চ টঙ্গী-জয়দেবপুরে গণ্ডগােলের খবর পেয়ে আমি সপরিবারে জন্মভূমি থেকেই জেগে পড়লাম। যুদ্ধের নয় মাস আমি। মুজিবনগরেই ছিলাম। স্বাধীন হওয়ার পর দেশে ফিরে চাকুরি পেলাম ঠিকই। কিন্তু পােস্টিং-এর পর দেখলাম, আবার সেই দারােগা সাহেবের অধীনেই আমার চাকুরি। কেন জানি না, এবার আর সাহস পেলাম না। জানটা বাঁচাবার জন্য । দরখাস্ত করে পেনশন নিয়েছি।’
এরপর বঙ্গবন্ধু আরও বললেন, আমি তখনই খুলনা রেঞ্জের ডিআইজিকে ডেকে নির্মলকে বড় দারােগা বানিয়ে পােস্টিং দিতে বললাম। ততক্ষণে নির্মল হুড়মুড় করে আমার পা জড়িয়ে ধরেছে। বলল। স্যার আমার প্রমােশনে কাজ নেই। এই দারােগা সাহেবকে আমি বড় ডরাই। অন্য জেলায় ট্রান্সফার করলে আপনার হুকুম মতাে চাকুরি করতে পারি। পাইপটা আবার ধরিয়ে বঙ্গবন্ধু বললেন, ‘আমি নির্মলকে বরিশাল জেলায় ট্রান্সফারের অর্ডার দিয়েছি। এই একটা ঘটনার মধ্যে দিয়ে অফিসারদের কারসাজির ফলে স্বাধীন বাংলাদেশের চেহারাটা আমাদের চোখের সামনে ভেসে উঠলাে। অনেকের মতে মুজিবনগর সরকারের যে পাঁচজন সেক্রেটারি অন্যান্য নিম্নপদস্থ কর্মচারীদের স্বার্থকে বিসর্জন দিয়ে ঢাকায় পরাজিত ব্যুরােক্রেসিকে আইন সঙ্গত করে হাত মিলিয়ে নিজেদের পদ ঠিক রেখেছিল, ধীরে ধীরে তাদের উপরেও আঘাত নেমে এল। অর্থ সচিব খন্দকার আসাদুজ্জামানকে সরিয়ে জুট বাের্ডে এবং তথ্য সচিব। আনােয়ারুল হক খানকে প্রথমে ওএসডি এবং পরে টেরিফ বাের্ডে দেয়া হলাে। সংস্থাপন সচিব নুরুল কাদের খান শেষ পর্যন্ত পদত্যাগ করলেন। ক্যাবিনেট সেক্রেটারি তৌফিক ইমাম ও যােগাযােগ সচিব আবদুস সামাদ আপাতত কোনােক্রমে পদ রক্ষা করলেন। কেবল খন্দকার মােশতাকের নমিনি ডেপুটি হাইকমিশনার হােসেন আলী রাতারাতি ডবল প্রমােশন পেয়ে তথ্য সচিবের পদে এবং ডাক্তার টি, হােসেন স্বাস্থ্য সচিবের পদে বহাল রইলেন। কিন্তু জিয়া-সায়েম সরকার এর মধ্যেই ১৯৭৫-৭৬ সালে সেক্রেটারির পদ থেকে মুজিবনগরের সমস্ত অফিসারকে সরিয়ে দিয়েছে। খন্দকার আসাদুজ্জামান, তৌফিক ইমাম ও নুরুদ্দীনকে সামরিক আইনে গ্রেফতার করা হয়েছে। যােগাযােগ সচিব আবদুস সামাদকে ওএসডি এবং ডাক্তার টি. হােসেনকে পদচ্যুত করা হয়েছে।
প্রিন্সিপ্যাল সেক্রেটারি রুহুল কুদ্স আগেভাগেই লন্ডনে সপরিবারে চলে গেছেন। মাত্র চার বছরের মধ্যে বাংলাদেশে এমন এক প্রশাসন কায়েম হয়েছে, যেখানে গুরুত্বপূর্ণ পদে স্বাধীনতা-সংগ্রামী অফিসারদের চিহ্নমাত্র আর নেই বললেই চলে। অবস্থাদৃষ্টে একথা বলা যায় যে, আইয়ুব খান আমলের গােয়েন্দা প্রধান ও পরে মন্ত্রী কাজী আনােয়ারুল হক এবং একাত্তরের খুনী গভরি টিক্কা খানের চিফ সেক্রেটারি শফিউল আজমের পরামর্শে জিয়া-সায়েম সরকার এখন প্রশাসন থেকে জাতীয়তাবাদীদের নিশ্চিহ্ন করেছে। যাক যা বলছিলাম। বাহাত্তর সালের মাঝামাঝি সময়। প্রতিদিনের মতাে। আমরা গণভবনে গিয়েছি। অল্পক্ষণের মধ্যেই বঙ্গবন্ধুর সাক্ষাৎ পেলাম, তিনি পাইপ ধরিয়ে বললেন, সমস্ত রাজাকার, আলবদর আর কোলাবরেটরদের গ্রেফতারের অর্ডার দিয়েছি। আমাদের মধ্যে থেকে একজন বলে উঠলাে, ‘স্যার কোলাবরেটর অফিসাররা চাকুরি ফিরে পেয়েই আপনাকে ভুল বুঝিয়েছে?
বঙ্গবন্ধু ঠোট কামড়িয়ে বললেন, ‘কেন?” সাংবাদিক ভদ্রলােক অনেক কষ্টে ঢােক গিলে বললেন, স্যার বেয়াদবী নিবেন না। আপনার এই হুকুম যেসব দারােগা তামিল করবে তাদের অনেকেই তাে কোলাবরেটর। সত্যি কথা বলতে কী, দেশপ্রেমিক অফিসাররা তাে পাকিস্তানি আর্মির সঙ্গে লড়াই করে মরে গেছে। যারা বেঁচে আছে তাদের অনেকেই তাে মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানিদের সঙ্গে ইচ্ছায় হােক আর অনিচ্ছায় হােক হাত মিলিয়ে মুক্তিবাহিনীর ছেলেদের গ্রেফতার করেছে। এরাই তাে ১৯৭১-এ মুক্তিযুদ্ধের সময় গ্রামে গ্রামে রাজাকার ‘রিকুট’ করেছিল।”  কথা কটা শুনে বঙ্গবন্ধুর মুখ গম্ভীর হয়ে গেল। তিনি উত্তর দেয়ার আগেই মুজিবনগর সরকারের অন্যতম প্রবীণ এবং দক্ষিণপন্থী উপদলীয় নেতা এসে ঢুকলেন।
পুরাে ব্যাপারটা শুনে বললেন, ‘আরে থানায় থানায় আমাদের পাটি আছে না? আমাদের ওয়ার্কাররাই এদের ধরিয়ে দিবে।’ বুঝলাম আওয়ামী লীগের দক্ষিণপন্থী মহল আর স্বরাষ্ট্র সচিব তসলিম সাহেবের মতাে কোলাবরেটর অফিসারদের পরামর্শে এই নির্দেশ জারি করা হয়েছে। এতে বাইরে থেকে নির্দেশটা বলিষ্ঠ মনে হলেও আসলে কার্যকরী হবে । ফলে সাধারণ মানুষের মনে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করা সহজ হবে। এর মাস কয়েক পরে কাকে যেন বিদায় জানাতে ঢাকা এয়ারপাের্টে গেছি। ফেরার সময় বিরাট লাউঞ্জে’ দেখলাম নেড়ে মাথায় একদল হজ্বযাত্রী বসে রয়েছে। সৌদী আরব বাংলাদেশকে স্বীকৃতি না দিলেও বঙ্গবন্ধুর প্রচেষ্টায় এসব ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের হজ্বের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা (বিদেশী পাসপাের্টে) করা হয়েছে।  পরিচিত কেউ হজ্বে যাচ্ছে কি না খুঁজতে লাগলাম। হঠাৎ করে একজন আমার হাত চেপে ধরলাে। হাজীর পােশাকে কুষ্টিয়ার এক উকিল বন্ধুকে দেখলাম। অবাক হয়ে কিছুক্ষণ তার দিকে তাকিয়ে রইলাম। বললাম, ‘দোস্ত এই বয়সেই তুমি হজ্বে যাচ্ছাে?  উত্তরে বলল, ‘ভাই সে এক বিরাট কাহিনী। তােমার হাতে সময় থাকলে বলতে পারি। তােমার বােধ হয় মনে আছে, বাংলাদেশ হওয়ার পর কুষ্টিয়াতেই আসামী চিকন আলীর বিরুদ্ধে কয়েকটা নরহত্যা ছাড়াও লুণ্ঠন ও নারী ধর্ষণের অভিযােগ ছিল। মামলায় চিকন আলীর ফাসি হয়ে গেছে।  এরপর বাকি মামলাগুলাের ব্যাপারে শুরু হলাে গড়িমসি। কেন জানি না ডিসি সাহেব খালি নানা টালবাহানা করে আর মামলাগুলাের লম্বা লম্বা তারিখ পড়ে। সেশন কোর্টে একটা মামলায় এমন কাণ্ড হলাে যে, আমি তাজ্জব বনে গেলাম। সাক্ষী-সাবুদ শেষ হবার পর জজ সাহেব আসামীকে জিজ্ঞেস করলাে, “তুমি দোষী নির্দোষী।’ কাঠগড়ায় আসামী চুপ করে দাঁড়িয়ে খালি হাত কচলায় আর হাকিমের দিকে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে। বার কয়েক জিজ্ঞেস করার পরও আসামী কোনাে জবাব দিলাে না।
জনাকয়েক উকিল-মােক্তার জোরে বলে উঠলাে, বল বেটা, তুই নির্দোষী। এবার আসামী হাত কচলিয়ে বলল, ‘স্যার আমি ভাবতাছি।’ আসামী পক্ষের উকিল : কী ভাবতাছােস? জজের দিকে আঙ্গুল দেখিয়ে আসামী স্পষ্টভাবে বললাে, ‘আমি ভাবতাছি, হাকিমের চেয়ারে বইস্যা আছে, যুদ্ধের সময় হেই সাবেই তাে আমারে এই রাস্তায় আনছে? তা হইলে সাৰ প্রমােশন পাইয়া হাকিম হইলাে, আর আমি কীর লাইগা এই কাঠগড়ায় আইলাম? আর হেই সাবেই বা আমার বিচার কেমতে কইরা করতাছে? মুহুর্তে বুঝতে পারলাম ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় এই জজ সাহেব ছিলেন কুষ্টিয়ার এডিসি ইনচার্জ অব রাজাকার রিক্রুটমেন্ট। এখন স্বাধীন বাংলাদেশে চাকুরির ধারাবাহিকতার বদৌলতে প্রমােশন পেয়ে হয়েছেন অতিরিক্ত জেলা জজ। কাহিনীটা বলে উকিল বন্ধু একটা নিশ্বাস ফেললেন। বললেন, দোস্ত, এখন বুঝছাে তাে, আমি কেন হজে যাচ্ছি?
বন্ধুর শুভ কামনা করে বিদায় দিয়ে বাসায় ফিরে এলাম। চিন্তা করতে লাগলাম, বাংলাদেশ যে পথে চলেছে তার শেষ কোথায়?
সপরিবারে বঙ্গবন্ধুকে নৃশংসভাবে হত্যা আর চারজন জাতীয়তাবাদী নেতাকে জঘন্যভাবে কারাগারে খুন করার প্রায় ন’ মাস পরে এখন একটার পর একটা। ঘটনা চোখের সামনে ভেসে উঠছে। সমস্ত ঘটনাগুলাের মধ্যে একটা যােগসূত্র রয়েছে। এর কোনােটাই বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। ষড়যন্ত্রকারীরা মুজিবনগরের দিনগুলাে। থেকে শুরু করে প্রতিটা কাজ পরিকল্পনামতাে করে চলেছে। তাই তাে স্বাধীনতার পর প্রথমেই দেখতে পেলাম প্রাক্তন সিএসপি জনাব রফিকুল্লাহ চৌধুরী হয়েছেন প্রধানমন্ত্রীর সেক্রেটারি। একাত্তরে ঢাকাস্থ এ.পি.পি। অফিসের জেনারেল ম্যানেজার আবুল হাশিম নিযুক্ত হয়েছেন প্রধানমন্ত্রীর জনসংযােগ অফিসার পদে আর বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে ইয়াহিয়া খানের তৈরি ভুয়া মামলায় সরকার পক্ষের অন্যতম সাক্ষী ও করাচীর ‘ডন’ পত্রিকার ঢাকাস্থ সংবাদদাতা মাহবুবুল আলম হলেন প্রেস সেক্রেটারি। এখানেই শেষ নয়। খুনী জেনারেল টিক্কা খান ও প্রাক্তন গভর্নর ডাক্তার মালেকের এককালীন প্রাইভেট সেক্রেটারি অনু ইসলাম এবং স্টেনােগ্রাফার রােজারিওকে গণভবনে নিয়ােগ করা হলাে। এমনকি শেষ পর্যন্ত কুখ্যাত গভর্নর মােনেম খানের এডিসি ব্রিগেডিয়ার মােশরুল পঁচাত্তর সালে বঙ্গবন্ধুর এডিসি পদে বহাল হলেন। স্বাধীনতার পর অর্থমন্ত্রী জনাব তাজউদ্দিনের উপর নজর রাখার জন্য ৩০৩’এর পদচ্যুত সিএসপি মতিউল ইসলামকে অর্থ সচিব পদে নিয়ােগ করা হলাে। সংস্থাপন বিভাগ থেকে মুজিবনগর সরকারের নুরুল কাদের খানকে সরিয়ে এম, এম, জামানকে সেক্রেটারি পদে বসানাে হলাে। পাকিস্তান থেকে ফিরে আসার সঙ্গে সঙ্গে মুজিবুল হক পেলাে দেশরক্ষা দফতরের দায়িত্ব আর কফিলউদ্দিন মাহমুদ হলেন রাজস্ব বাের্ডের চেয়ারম্যান। পররাষ্ট্র দফতর তাে পরিণত হলাে ‘কোলাবরেটরদের দফতরে’।
আমরা প্রেস ক্লাবে ঠাট্টা করে এই দফতরের নামকরণ করেছিলাম ‘ক্যাম্প অফিস অর্থাৎ কিনা পাকিস্তান পররাষ্ট্র দফতরের ঢাকার ক্যাম্প অফিস। মুক্তিযুদ্ধের সময় দিল্লীর পাকিস্তানস্থ হাইকমিশনের সমস্ত বাঙালি কর্মচারী “ডিফের করলেও দুজন মাত্র বাঙালি অফিসার এই কাজ অস্বীকার করেছিলেন। তার একজন বাংলাদেশ স্বাধীন হবার প্রায় বছর দেড়েক পর (হামিদুল হক চৌধুরীর জামাই রিয়াজ রহমান) দিব্যি এসে আবার ফরেন অফিসে ধাপে ধাপে প্রমােশন পেলাে।  পুলিশ বিভাগের কথা বলতে গেলে তাে একটা বিরাট কেতাৰ লিখতে হয়। দেশপ্রেমিক পুলিশ অফিসার বলতে বাংলাদেশে যা ছিল, তাদের অধিকাংশই একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে শহীদ হয়েছেন। অন্যদিকে যারা অতি উৎসাহে পাকিস্তানি আর্মিকে সহযােগিতা ও মদদ জুগিয়েছিল, স্বাধীনতার পর তাদেরই পোয়াবারাে। পাকিস্তানি আমলের পুরা কোলাবরেটর পুলিশ বিভাগকে কলমের এক খোঁচায় অফিসিয়াল করা হলাে। ১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চ তারিখে পাকিস্তানি সৈন্যদের হামলা ও ধ্বংস লীলার সময় ঢাকার সিটি এসপি হিসাবে যিনি চাকুরিরত ছিলেন, মাত্র এক বছরের মধ্যে সেই-ই এ চৌধুরী স্বাধীন বাংলাদেশ পুলিশের ডিআইজি হলেন এবং গােয়েন্দা বিভাগের প্রধান হিসাবে দায়িত্ব পেলেন। তথাকথিত আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় যে পুলিশ অফিসার এ বি এস সফদর সমস্ত মিথ্যা সাক্ষী তৈরি করেছিলেন, ষােলই ডিসেম্বরের পর তাকে কিছুদিন জেলে রাখা সত্ত্বেও বিশেষ মহলের তদ্বিরে তাকে যে শুধু মুক্ত করা হলাে তা-ই নয়, তাকে এনে প্রধানমন্ত্রীর অনুসন্ধানী কমিটির প্রধান হিসাবে নিয়ােগ করা হলাে।
অবশ্য বঙ্গবন্ধুর হত্যার পর ইনি বাংলাদেশের গােয়েন্দা প্রধান হিসাবে বহাল হলেন। অত্যন্ত অল্প সময়ের মধ্যে সবার অগােচরে বাংলাদেশের প্রশাসনে ‘ব্যুরােক্রেসি’ই প্রকৃত শক্তির উৎস হয়ে দাঁড়ালাে। নানা অজুহাতে এবং “ডিসিপ্লিনের নামে এরা এমন সব সরকারি বিধি জারি করালেন, যাতে প্রশাসন ক্ষেত্রে মন্ত্রীদের ক্ষমতা হ্রাস পেলাে। বঙ্গবন্ধু ধীরে ধীরে কার্যত ‘ব্যুরােক্রেসি’র উপর নির্ভরশীল হতে শুরু করলেন। এরপর ‘ব্যুরােক্রেসি’র কাজ হলো, বাইরের কোনাে শিক্ষিত ব্যক্তি যেন দায়িত্বপূর্ণ সরকারি পদে নিযুক্ত না হয়। উদাহরণস্বরূপ বলা যায় যে, শিক্ষা সচিব হিসাবে অধ্যাপক কবীর চৌধুরীর মতাে লােককে বেশিদিন টিকতে দেয়া হলাে না। বেচারা চৌধুরী সাহেব অল্পদিনের মধ্যেই ব্যাপার বুঝতে পেরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিরে গেলেন। আবার শিক্ষা সচিবের পদটা প্রাক্তন সিএসপি’দের দখলে এল। এদিকে ‘ব্যুরােক্রেসি” বেশ চতুরতার সঙ্গে প্ল্যানিং কমিশনের বিরুদ্ধে খেলতে শুরু করলাে। কেননা এই কমিশনের পুরােটাই মােটামুটিভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের দিয়ে গঠিত। উপরন্ত কমিশনের ক্ষমতা খুব বেশি এবং ভাইস চেয়ারম্যান ও কমিশনের সদস্যদের সরাসরি বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে যােগাযোগের সুবিধা  রয়েছে। তাই গােড়া থেকেই অফিসাররা প্ল্যানিং কমিশনের কাজকর্মের সমালােচনা শুরু করলাে। এ ব্যাপারে তারা দৈনিক ইত্তেফাকে ও সাপ্তাহিক হলিডে পত্রিকার সহযােগিতা পেলাে। গােপনে সেক্রেটারিয়েট থেকে পাওয়া তথ্যের উপর ভিত্তি করে এ দুটো পত্রিকায় প্ল্যানিং কমিশনের বিরুদ্ধে বেশ ক’টি নিবন্ধ ছাপা হলাে। দৈনিক ইত্তেফাকের কথা হচ্ছে বঙ্গবন্ধুর প্ল্যানিং কমিশনের উপর অতিরিক্ত নির্ভর করায় বিপদ দেখা দিয়েছে এবং কমিশনের সদস্যরা সমস্যার মােকাবেলায় বিশেষ পারদর্শী বলে মনে হয় না।
অবিরাম প্রচারণার ফলে রাজনৈতিক মহলে প্ল্যানিং কমিশনের সদস্যদের কর্মদক্ষতা সম্পর্কে কিছুটা সন্দেহের সৃষ্টি হলাে। এছাড়া ব্যুরােক্রেসির তৈরি প্রতিবন্ধকতা তাে রয়েছেই। এক কথায় বাংলাদেশের ব্যুরােক্রেসি ও প্ল্যানিং কমিশনের মধ্যে একটা অঘােষিত সংঘর্ষ দেখা দিলাে। অফিসাররা প্রকাশ্যেই মন্ত্রীদের বুঝাতে লাগলেন যে, অভিজ্ঞ সিএসপিদের বসালে প্ল্যানিং কমিশনের কাজ আরও সুষ্ঠুভাবে পরিচালিত হতাে। এ ধরনের এক নাজুক পরিস্থিতি দেখে বাংলার কৃতি সন্তানরা ‘অভিমান” আর কিছুটা অপমানের হাত থেকে বাঁচবার জন্য এক এক করে কমিশনের সদস্য পদ ত্যাগ করতে শুরু করলেন। প্ল্যানিং কমিশনের ভাইস চেয়ারম্যান সুদূর অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে আশ্রয় নিলেন। ধীরে ধীরে এক অদ্ভুত উপায়ে প্ল্যানিং কমিশনে অফিসারদের অনুপ্রবেশ ঘটলাে। বাংলাদেশের ব্যুরােক্রেসি’ নিজেদের গােষ্ঠী স্বার্থে এবার বঙ্গবন্ধু ও তার মন্ত্রীসভার সদস্যদের রাজনৈতিক ইস্যুর দিকে ব্যস্ত রাখায় সচেষ্ট হলাে। কেননা, এতে করে প্রশাসন ক্ষেত্রে স্বাভাবিকভাবেই ‘ব্যুরােক্রেসি’র ক্ষমতা বৃদ্ধি পেতে বাধ্য। তাই ১৯৭৩-এর সাধারণ নির্বাচনে এককভাবে আওয়ামী লীগের বিজয়ে এরা খুশি হতে পারলাে না।
বাংলাদেশে লবণ দুর্ভিক্ষের আগে পর্দার অন্তরালে আরও একটা ঘটনা সংঘটিত হয়। মহল বিশেষের মতে এই ঘটনার মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব এবং পুনর্গঠিত সামরিক বাহিনীর মধ্যে কিছুটা অবিশ্বাসের সৃষ্টি হয়। আলােচ্য মহলের ধারণায় এক্ষেত্রে খন্দকার মােশতাক আহম্মদ এবং মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানের ভূমিকা কিছুটা অর্থবহ ও রহস্যজনক বৈকি! | এ সময় দুর্বল পুলিশ, বিডিআর এবং জোড়াতালি দেয়া প্রশাসনের ব্যর্থতার। দরুন দেশে কালােবাজারী ও চোরাকারবারী চরম আকার ধারণ করে। সংবাদপত্র। এবং বুদ্ধিজীবী মহলের একাংশ এজন্য প্রশাসনকে দায়ী না করে সমস্ত দোষ সযত্নে প্রতিবেশী রাষ্ট্রের উপর চাপিয়ে দেয়। এমন কি বিরােধী রাজনৈতিক দলগুলাে পর্যন্ত একই অভিযােগ উত্থাপন করে জনপ্রিয়তা অর্জনের চেষ্টা করে। অথচ ক্ষমতাসীন সরকার এবং প্রশাসন এজন্য দায়ী—এই কথাটা পরিস্কারভাবে বলার কেউ সাহস দেখাল না। অন্যদিকে পাকিস্তানি আমলের অফিসার দিয়ে তৈরি। পুলিশ বাহিনীর নৈতিক বল দারুণভাবে হ্রাস পাওয়ায় অনেকগুলাে থানায় সশস্ত্র পুলিশদের রক্ষার জন্য রক্ষী বাহিনীর পাহারা বসলাে।
সে এক অদ্ভুত ব্যাপার! থানার মধ্যে পুলিশবাহিনীর সশস্ত্র অবস্থায় থাকা সত্ত্বেও তাদের প্রাণ রক্ষার জন্য রক্ষীবাহিনীর ক্যাম্প বসলাে। তবুও ব্যুরােক্রেসির কথা হচ্ছে, এই দুর্বল পুলিশ বাহিনী দিয়েই কাজ চালাতে হবে। এরকম এক অবস্থায় স্বাভাবিকভাবেই পরিস্থিতির কোনাে উন্নতি হলাে না। তখন এই প্রতিক্রিয়াশীল প্রশাসনের সুপারিশে বঙ্গবন্ধুর ‘যৌথ সামরিক অপারেশনের নির্দেশ দিলেন। কালােবাজারী ও চোরাচালান বন্ধের জন্য সীমান্ত এলাকায় সেনাবাহিনী মােতায়েন হলাে। বাংলাদেশের নবগঠিত সামরিক বাহিনী। দেশ শাসনের ‘এন্ট্রি পেলাে। খন্দকার মােশতাকের ইশারায় তথ্য মন্ত্রণালয়ের স্টেট মন্ত্রী তাহেরউদ্দিন ঠাকুর প্রচার মাধ্যমগুলােকে নতুন নির্দেশ দিলেন। সংবাদপত্র, বেতার ও টেলিভিশনে সামরিক বাহিনীর কার্যকলাপ ফলাও করে প্রচার শুরু হলাে। এমনকি বেতারে সামরিক বাহিনীর মনােরঞ্জনের উদ্দেশ্যে নিয়মিতভাবে বিশেষ অনুষ্ঠান প্রচারের ব্যবস্থা হলাে। | এদিকে আওয়ামী লীগের দক্ষিণপন্থী উপদল তখন খুবই তৎপর। সামরিক বাহিনীর হাতে ব্যাপক ধর-পাড় শুরু হলে জনৈক প্রভাবশালী নেতা (খন্দকার মােশতাক) কুমিল্লার একদল এমপিকে নিয়ে গণভবনে হাজির হলেন। তিনি বঙ্গবন্ধুকে বললেন, অবিলম্বে সামরিক বাহিনীর যৌথ অপারেশন বন্ধ না হলে মফস্বল এলাকায় আওয়ামী লীগ নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে। মিলিটারি অফিসাররা কুমিল্লায় বাড়াবাড়ি করছে। ফলে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের নির্দেশে মেজর জেনারেল জিয়া হেলিকপ্টারে কুমিল্লায় যেয়ে তদন্ত করে এলেন। | শেষ পর্যন্ত রাজনৈতিক চাপে ‘যৌথ সামরিক অপারেশন প্রত্যাহারের নির্দেশ জারি হলাে। সৈন্যরা আবার ফিরে চললাে ব্যারাকে। অনেকের মতে এই অপারেশনের অজুহাতে সামান্য দিনের জন্য হলেও এরা দেশের প্রশাসন পরিচালনায় যে আস্বাদ পেলাে তা পরবর্তীকালে অর্থবহ প্রমাণিত হয়েছে।
সবার অলক্ষ্যে বাংলাদেশের রাজনৈতিক মহল এবং ব্যুরােক্রেসির পাশাপাশি এটাই হচ্ছে তৃতীয় শক্তির অভ্যুদয়ের সূচনাকাল। এরা সবাই এদেশেরই সন্তান এবং এদের একাংশ হচ্ছেন স্বাধীনতা সংগ্রামী মুক্তিযোেদ্ধা। এদিকে রাজনৈতিক নেতৃত্বের সঙ্গে ভুল বােঝাবুঝি সৃষ্টির লক্ষ্যে কট্টর মুসলিম লীগ সমর্থক কলামিস্ট খন্দকার আবদুল হামিদ দৈনিক ইত্তেফাক-এর কলামে ইনিয়ে-বিনিয়ে একথাটাই লিখলেন যে, দায়িত্ব সম্পূর্ণ হওয়ার পূর্বেই ‘যৌথ সামরিক অপারেশন প্রত্যাহার হচ্ছে মুজিব সরকারের ভ্রমাত্মক পদক্ষেপ। পাকিস্তানি যুদ্ধবন্দি এবং ১৯১ জন যুদ্ধাপরাধীকে বিনা শর্তে মুক্তি দেয়ার ব্যাপারে বাংলাদেশের ব্যুরােক্রেসি’র ক্ষমতা ব্যবহার করলাে। পাকিস্তান সরকার, ভারতের দক্ষিণপন্থী মহল, মন্ত্রিসভার উপদল ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের চাপ ছাড়াও বাংলাদেশের ব্যুরােক্রেসি’র সুপারিশে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ৯১ হাজার যুদ্ধবন্দি  এবং ১৯১ জন যুদ্ধাপরাধীকে ছেড়ে দেয়ার সিদ্ধান্ত ঘােষণা করলেন। অফিসারদের পরামর্শে এ ব্যাপারে জনসাধারণের কাছ থেকে কিংবা আওয়ামী লীগ কাউন্সিল থেকে কোনাে মতামত নেয়া হলাে না।
শুনেছি মন্ত্রীদের মধ্যে কেবল মাত্র তাজউদ্দিন বলেছিলেন, গণহত্যা, ধর্ষণ ও লুণ্ঠনের ক্ষেত্রে সুনির্দিষ্ট অভিযোেগ থাকায় ১৯১ জন পাকিস্তানি আর্মি অফিসারের বিচার হওয়া দরকার। বিচারে শাস্তি হবার পর জাতির পিতা হিসাবে বঙ্গবন্ধু তাদের ক্ষমা করে ছেড়ে দিতে পারেন এবং পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্কের উন্নতি করতে পারেন। তাহলে অন্তত ইতিহাসে একথাটা লেখা থাকবে যে, এরা ১৯৭১ সালে বাংলাদেশে মানবতা-বিরােধী অপরাধ করেছিল। অন্যদিকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কোলাবরেটর অফিসাররা এ মর্মে যুক্তি প্রদর্শন করলেন যে, পাকিস্তানি যুদ্ধবন্দিরা প্রায় ১৮ মাস ধরে ভারতে বন্দি রয়েছে। এটাই তাে বিরাট শাস্তি। উপরন্তু এদের ছেড়ে দিয়ে যদি পাকিস্তানে আটক বাঙালিদের ফিরে পাওয়া যায় এবং পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্কের উন্নতি হয়। তবে আপত্তিটা কী? কারাে কারাে মতে, ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে অনুষ্ঠিত ‘সিমলা চুক্তিতেই যুদ্ধাপরাধীদের ভবিষ্যৎ অনেকটা নির্ধারিত হয়েছিল। পাকিস্তানি প্রধানমন্ত্রী ভুট্টো এদের বিনাশর্তে মুক্তির ব্যবস্থার জন্য ভারতকে বিশেষ অনুরােধ করেছিলেন এবং এ মর্মে সমঝােতায় এসেছিলেন যে, এরপর কাশ্মীর প্রশ্নে পাকিস্তান আর খুব একটা হৈ চৈ করবে না। উপরন্তু ‘আজাদ কাশ্মীর’ এলাকার বিশেষ মর্যাদা প্রত্যাহার করে প্রদেশের মর্যাদায় পরিণত করা হবে। অন্য দিকে ভারতীয় এলাকার অন্তর্ভুক্ত কাশ্মীরের ‘স্পেশাল স্ট্যাটাস’ বিলুপ্ত করে অন্যান্য রাজ্যের মর্যাদায় নামিয়ে আনতে হবে। তাই পরবর্তীকালে ভুট্টোর আমলে কাশ্মীর নিয়ে পাকিস্তানের পক্ষ থেকে বিশেষ কোনাে হৈ চৈ করা হলাে না। এ ধরনের এক অবস্থা আন্দাজ করেই বাংলাদেশের ব্যুরােক্রেসি’ নানা বাহানায় যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের তদন্ত বিলম্ব করতে থাকে। অথচ কুর্মিটোলায় যুদ্ধাপরাধীদের রাখার জন্য বিশেষ কারাগার এবং বিচার কক্ষ নির্মাণ পর্যন্ত সমাপ্ত হয়েছিল। বঙ্গবন্ধু স্বয়ং এসব পরিদর্শন করেছিলেন। 
বিশ্বের ইতিহাসে বিনা শর্তে যুদ্ধ অপরাধীদের এভাবে ছেড়ে দেয়া এক নজীরবিহীন ঘটনা। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের জার্মান ও জাপানি যুদ্ধাপরাধীদের অনেকে এখনও পর্যন্ত কারান্তরালে রয়েছে। ইসরাইলীরা পলাতক আইকম্যানকে যুদ্ধ শেষ হওয়ার প্রায় কুড়ি বছর পর দক্ষিণ আমেরিকা থেকে জোরপূর্বক ধরে এনে বিচার করে ফাঁসি দিয়েছে।  কিন্তু বাংলাদেশে গণহত্যা ও ধর্ষণের অপরাধে ধৃত পাকিস্তানিদের বিচার না করে ছেড়ে দেয়া হলাে। ধর্ষিতা নারী আর এতিম বাচ্চাদের ফরিয়াদে খােদার আরশ পর্যন্ত কেঁপে উঠলাে। এখানে উপমহাদেশের রাজনীতির ঘটনা প্রবাহ বিশেষভাবে লক্ষণীয়। অনেকের মতে এ ব্যাপারে উপমহাদেশের এক শ্রেণীর পশ্চিমাঘেঁষা শিল্পপতি ও সংবাদপত্র একটা বিশেষ ভূমিকা পালন করেছে। এক শ্রেণীর রাজনীতিবিদের সহযােগিতায় এবং বিদেশী সমর্থনে এরা এতদূর উৎসাহিত হয়েছিলেন যে, ১৯৭৫ সালে এরা মিসেস ইন্দিরা গান্ধীকে পর্যন্ত ক্ষমতা থেকে সরাবার ষড়যন্ত্র করেছিল। এরই ফল হিসাবে জয় প্রকাশ নারায়ণের নেতৃত্বে দক্ষিণপন্থী দলগুলাে ভারতে গণঅভ্যুত্থান ও হিংসাত্মক কাজের জোয়ার বইয়ে দিয়েছিল। একটার পর একটা ধর্মঘট ও গুপ্ত হত্যার পর যখন জয় প্রকাশের সমর্থকরা সামরিক বাহিনীকে বিদ্রোহ করার আহ্বান জানিয়েছিল, তখন ইন্দিরা সরকার জরুরি অবস্থা ঘােষণা করে এদের কঠোর হস্তে দমন করতে বাধ্য হয়েছিলেন।
কিন্তু উপ-মহাদেশীয় রাজনীতির প্রতিটি সংকটজনক মুহূর্তে বাংলাদেশ, ভারত ও পাকিস্তানে অবস্থিত পশ্চিমা সমর্থক লবিগুলাের মধ্যে এক অদ্ভুত যােগাযােগ দেখা যায়। বাংলাদেশের নাজুক পরিস্থিতির সময় এর ব্যতিক্রম হয়নি। তাহলে একথা বলা যায় যে, বাংলাদেশ ও ভারত এই দুটো দেশে উগ্র দক্ষিণপন্থী কর্মকাণ্ডের মােকাবেলায় শেষ অবধি বাংলাদেশে এক দলীয় বাকশাল’ ও ভারতে ‘এমার্জেন্সি’ জারি করতে হয়েছিল। অথচ দুটো পদ্ধতিই ছিল বিতর্কিত। এক্ষণে ভারতের দক্ষিণপন্থী (সরকারের ভিতরে ও বাইরে) মহলের কর্মকাণ্ডের কিছু কথাবার্তা। অনেকের মতে ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের চরম পর্যায়ে যখন লড়াই বন্ধ করার লক্ষ্যে মার্কিনী সিআইএ এবং প্রবাসী সরকারের দক্ষিণপন্থী উপদলের মধ্যে গােপনে যােগসূত্র স্থাপিত হয়েছিল, তখন সবার অলক্ষ্যে ভারতের দক্ষিণপন্থী মহল এই ষড়যন্ত্রে সক্রিয়ভাবে মদদ জুগিয়ে যাচ্ছিল। এ সময় মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জার-এর গােপন নির্দেশে ভারতে কর্মরত সিআইএ কর্মকর্তা ফিলিপস্ চেরি ইরানের শাহেন শাহ-এর মধ্যস্থতায় তেহরানে পাকিস্তানের সামরিক জান্তা এবং মুজিবনগর সরকারের দক্ষিণপন্থী মােশতাক উপদলের সঙ্গে বৈঠকের আয়ােজন প্রায় সম্পূর্ণ করে এনেছিল। উদ্দেশ্য একটাই এবং তা হচ্ছে অবিলম্বে মুক্তিযুদ্ধ বন্ধ করে পাকিস্তানের অখণ্ডতা রক্ষা করতে হবে। বিনিময়ে শেখ মুজিবের মুক্তি এবং ৬ দফার ভিত্তিতে পাকিস্তানে কনফেডারেশন সৃষ্টি।  এতসব গােপন কর্মকাণ্ডের জন্য স্থানীয় ভারতীয় লবির সমর্থন তখন ছিল অপরিহার্য এবং সেই সক্রিয় সহযােগিতা দিয়েছিল চীনা সমর্থক মার্কসিস্টদের পরিবর্তে ভারতের একটি বিশেষ দক্ষিণপন্থী মহল। ব্যবসায়ী, শিল্পপতি, রাজনীতিবিদ, বিদেশী মার্কিন সংবাদ সংস্থায় কর্মরত সাংবাদিক, সংবাদপত্র শিল্পের মালিক, বীমা কোম্পানির এজেন্ট, এমনকি প্রাক্তন সন্ত্রাসবাদী পর্যন্ত এই মহলের অন্তর্ভুক্ত ছিল। উপরন্তু ভারতীয় মুসলমানদের অধিকাংশের চিন্তাধারায় এদের সঙ্গে পরােক্ষভাবে একাত্মতার সুর ছিল বিদ্যমান। 
অবশ্য সে আমলে ভারতীয় গােয়েন্দা বাহিনীর শ্যেনদৃষ্টি থেকে কিছুই। এড়াতে পারেনি। এজন্যেই ১৯৭১ সালে কোলকাতায় বেশ কিছু ধরপাকড় এবং তল্লাশী পর্যন্ত হয়েছিল। এ সময় বাংলাদেশের দক্ষিণপন্থী রাজনীতিবিদ রাজিয়া ফয়েজের পিতা সৈয়দ বদরুদ্দোজাকে গ্রেফতার এবং পুলিশ আনন্দবাজার পত্রিকার সম্পাদক অভীক সরকারের বাসগৃহ সার্চ করে। মুজিবনগর সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদকে এ ব্যাপারে ওয়াকেফহাল করানাে হয়।  এখন পর্যালােচনা করে দেখা যাক যে, ১৯৭১ সালে আলােচ্য ভারতীয় দক্ষিণ মহলের কর্মকাণ্ড কেন এমনটি হয়েছিল? (ক) ভারতের সমর্থনে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ সফল হলে উপমহাদেশে পাকিস্তান নামক রাষ্ট্র দ্বিখণ্ডিত হওয়ার প্রেক্ষিতে ভারতীয় প্রজাতন্ত্রে বিচ্ছিন্নতাবাদ আন্দোলন অচিরেই উগ্র থেকে উতর হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। (খ) রক্তাক্ত মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশ স্বাধীন হলে, ক্ষমতাসীন কংগ্রেস দলের এবং বিশেষ করে প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর ‘ইমেজ’ ভারতে দারুণভাবে বৃদ্ধি পাবে এবং সেক্ষেত্রে পরবর্তী সাধারণ নির্বাচনে ইন্দিরা নেতৃত্বাধীন কংগ্রেসকে হটানাে আর সম্ভব হবে না। (গ) ১৯৭১ সালে পশ্চিম বাংলায় ভয়াবহ নকশাল আন্দোলনের প্রেক্ষাপসে
আন্তর্জাতিক সীমানার ওধারে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর সেখানকার ক্ষমতাসীন জাতীয়তাবাদী শক্তির পক্ষে ক্ষমতায় বেশিদিন আঁকড়ে থাকা কি সম্ভব হবে? যদি না হয়, তবে কি রক্তাক্ত সংঘর্ষে উগ্র চীনপন্থীর অভ্যুদয় হবে? (ঘ) আন্তর্জাতিক রাজনীতির খেলাধুলায় একদিকে রুশ-ভারত সখ্যতা এবং অন্যদিকে চীন-মার্কিন মিত্রতা—এ দুটোর মধ্যে কোনটা গ্রহণযােগ্য? ভারতের দক্ষিণপন্থী মহলের কাছে শ্ৰেণীস্বার্থে স্বাভাবিকভাবেই চীন মার্কিন মিত্রতা অনেক বেশি কাম্য।
সবশেষে ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের অভ্যুদয় হওয়ার পর থেকে ভারতের আলােচ্য দক্ষিণপন্থী মহলের কর্মকাণ্ডগুলাে কীভাবে নিম্নে বর্ণিত ঘটনাবলীতে প্রভাবান্বিত হয়েছিল তা বিশেষভাবে লক্ষ্যণীয় : (ক) ১৯৭২ সালে বাংলাদেশের বৃহত্তর স্বার্থে চীনের সঙ্গে বন্ধুত্ব স্থাপনের লক্ষ্যে বঙ্গবন্ধু স্বয়ং উদ্যোগ গ্রহণ করে গোপনে কিছু পরিমাণ পাটি চীনে রফতানি করলে ভারতের দক্ষিণপন্থী মহল এবং ভারত সরকার স্তম্ভিত হয়ে পড়ে। এটা ছিল ঘােড়া ডিঙিয়ে ঘাস খাওয়ার মতাে। নব্য স্বাধীন বাংলাদেশের এ ধরনের পদক্ষেপের দরুন শেখ মুজিবের নেতৃত্বের প্রতি ভারতীয় দক্ষিণপন্থী মহল এবং নয়াদিল্লীর নীতি-নির্ধারক ব্যক্তিবর্গের ধারণা ঝাপসা হতে শুরু করে। এদের কথা হচ্ছে, দারুণ জনপ্রিয় এবং ব্যক্তিত্বসম্পন্ন বাঙালি জাতীয়তাবাদী নেতা শেখ মুজিবের নেতৃত্ব ভবিষ্যতে আরও চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়াবে। উল্লেখ্য যে, বিশিষ্ট বাঙালি কূটনীতিবিদ ও রাষ্ট্রদূত খাজা কায়সার পিকিং (বেজিং) থেকে দেশে প্রত্যাবর্তনের পথে কোলকাতায় জনৈক ভারতীয় সাংবাদিকের কাছে চীনে পাট রফতানির তথ্য প্রকাশ করায় ভারতীয় সংবাদপত্রে শুরু হয় তুমুল হৈ চৈ। আরাে উল্লেখ্য যে, ১৯৭১ সালে ঢাকার সন্তান খাজা কায়সার ছিলেন মহাচীনে পাকিস্তানি রাষ্ট্রদূত। এরই কূটনৈতিক তৎপরতা এবং প্রচেষ্টায় পাকিস্তানের মধ্যস্থতায় গোপনে মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রী কিসিঞ্জারের চীন সফর হয়েছিল।
এর পরেই হচ্ছে প্রেসিডেন্ট নিক্সনের চীন সফর এবং সাম্রাজ্যবাদী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আর কমুনিস্ট চীনের মধ্যে সৃষ্ট নয়া “অশুভ আঁতাত। (খ) ১৯৭৩ সালে বাংলাদেশ মন্ত্রিসভার সিদ্ধান্ত হচ্ছে পাকিস্তান কর্তৃক বাংলাদেশকে স্বীকৃতি না দেয়ার প্রেক্ষিতে লাহােরে প্রস্তাবিত ইসলামী শীর্ষ সম্মেলন বয়কট। ঢাকাস্থ ভারতীয় হাইকমিশনার ও প্রাক্তন আইসিএস সুবিমল দত্ত সেই মােতাবেকই নয়াদিল্লীর সাউথ ব্লকে (পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অফিস) রিপাের্ট পাঠিয়ে দিলেন। কিন্তু এরপর বিনামেঘে বজ্রপাত। নয়াদিল্লীর বিমানবন্দরের কন্ট্রোল টাওয়ার আকস্মিকভাবে একটি উড্ডীয়মান চার্টার্ড ফ্লাইট-এর প্লেন থেকে প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর কাছে প্রেরিত শুভেচ্ছা বাণী রিসিভ করলাে। প্রেরক হচ্ছেন বাংলাদেশের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান। শেষ মুহূর্তে তিনি একক সিদ্ধান্তে লাহােরের প্রস্তাবিত ইসলামী শীর্ষ সম্মেলনে যােগ দিতে যাচ্ছেন। অথচ পাকিস্তান তখনও পর্যন্ত বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়নি। এ সময় ভারত সরকারের তীব্র সমালােচনা করে ভারতীয় একটি সংবাদপত্রের সম্পাদকীয় হচ্ছে, ‘ধিক, নতজানু ভারতীয় কূটনীতি।’ এরই পাশাপাশি ভারতীয় দক্ষিণপন্থী মহল আর সাউথ ব্লকের কর্মকর্তাদের দ্রু-যুগল কুঞ্চিত হলাে। কারণ একটাই এবং তা হচ্ছে স্বাধীনচেতা ও জনপ্রিয় নেতা বাংলাদেশের শেখ মুজিবকে কন্ট্রোলে রাখা সম্ভব হবে কি? (গ) ভারতীয় দক্ষিণপন্থী মহল এবং নয়াদিল্লীর পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা আর কট্টরপন্থীদের কথা হচ্ছে, ঠিক মতাে কিছু বুঝে উঠার আগে এই শেখ মুজিবই বাংলাদেশের মাটি থেকে ভারতীয় সৈন্য প্রত্যাহার করিয়ে দিয়েছেন। আবার অত্যন্ত চাতুর্যের সঙ্গে গঙ্গার পানি বণ্টনে বাংলাদেশের হিস্যায় ৪৪ হাজার কিউসেক-এর চুক্তিতে দস্তখত করিয়ে নিয়েছেন। বহু ঢাক-ঢােল পিটিয়ে ভারত-বাংলাদেশ বাণিজ্য চুক্তি দস্তখত হলেও মুজিব আমলে তার ভগ্নাংশও কার্যকরী হয়নি।
এ ধরনের এক সামগ্রিক প্রেক্ষাপটে শেখ মুজিবুর রহমানের জাতীয়তাবাদী সরকারের প্রতি ভারতীয় কট্টরপন্থীরা ছাড়াও দক্ষিণপন্থী মহল (সরকারের ভিতরে ও বাইরে) এবং নয়াদিল্লীর পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের প্রভাবশালী অংশের। চিন্তাধারার রূপান্তর ঘটলাে এবং তখন সূচনা হলাে দ্বিতীয় চিন্তার । অচিরেই এর পূর্ব থেকে পশ্চিমে ঘড়ি ফিরালাে এবং পাকিস্তানি বাজার দখলের উদগ্র বাসনায় পাক-ভারত সম্পর্কের দ্রুত উন্নতির লক্ষ্যে সচেষ্ট হলাে। ভারতীয় শিল্পপতিদের পরিচালিত প্রভাবশালী স্টেটসম্যান, টাইমস অব ইন্ডিয়া, দি হিন্দু, ইলাস্ট্রেটেড উইকলি অব ইন্ডিয়া প্রভৃতি পত্র-পত্রিকায় একটার পর একটা এ মর্মে প্রতিবেদন। প্রকাশিত হলাে-পাকিস্তানের হৃদয় জয় করার জন্য বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে আত্মসমর্পণকারী (ভারতের বন্দি শিবিরে অবস্থানরত) ৯১ হাজার যুদ্ধবন্দিকে ছেড়ে দেয়া হােক এবং ১৯১ জন যুদ্ধাপরাধীকে বিচারের সময় পর্যন্ত কালক্ষেপণ করা বাঞ্ছনীয় হবে না। ১৯৭১-এর যুদ্ধে উভয় রণাঙ্গনে পাকিস্তানের শােচনীয় পরাজয়ের পর মার্কিনী কারসাজিতে নয়াদিল্লীতে ক্ষমতার কেন্দ্র বিন্দু থেকে ধর-হাকসার-কাউল পরামর্শক গােষ্ঠীর বিদায়ের পর ইন্দিরা সরকারের উপর দক্ষিণপন্থী মহলের এ ধরনের ব্যাপক প্রভাবের সংবাদে বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের পাশ্চাত্য শিক্ষিত দক্ষিণপন্থী মহলে তখন চাপা অসন্তোষ। সবার অলক্ষ্যে সৃষ্টি হলাে বাংলাদেশ, ভারত ও পাকিস্তানের দক্ষিণপন্থী মহলের নিবিড় সম্পর্ক। পরােক্ষভাবে মদদ দিতে এগিয়ে এলাে চীনা-সমর্থক আর ধর্মান্ধ গোষ্ঠী।  ঠিক এমনি এক সময়ে স্বাক্ষরিত হলাে বিতর্কিত সিমলা চুক্তি।

ওয়াকেফহাল মহলের মতে, বার্টার পদ্ধতিতে পণ্য বিনিময় চুক্তির মতাে কাশ্মীর প্রশ্নের সুরাহার (বিভক্ত কাশ্মীরের অঘােষিত স্বীকৃতি) সঙ্গে পাকিস্তানি যুদ্ধবন্দিদের বিনাশর্তে মুক্তির ব্যবস্থা হলাে। বাংলাদেশের স্বার্থ বলি দিয়ে সিমলা চুক্তিতে সৃষ্টি হলাে পাক-ভারত উষ্ণ সম্পর্ক। উপমহাদেশের দক্ষিণপন্থী শিবিরে তখন গোপন আনন্দের হিল্লোল। এজন্যই পরবর্তীকালে দেখা যায় যে, প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর বিরাগভাজন হওয়ার ঝুঁকি নিয়েও দক্ষিণপন্থী মহলের সমর্থক ভারতীয় হাইকমিশনার সমর সেন বেতার মারফত ঘােষিত নয়া প্রেসিডেন্ট খন্দকার মোশতাক আহমদকে সর্বপ্রথমে অভিনন্দন [অত্র পুস্তকে মোশতাক-সমর কোলাকুলির আলােচ্য চিত্র দ্রষ্টব্য] জ্ঞাপন করেন। অথচ ঢাকায় বঙ্গবন্ধু হত্যার দিন (১৫ই আগস্ট) সমর সেন ছিলেন। নয়াদিল্লীতে। বেতার মারফত এবং পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে এই সংবাদ পেয়েই তিনি প্লেনে সেদিন সন্ধ্যায় এসে পেীছিলেন কোলকাতায়। পরদিন সকালে গাড়িতে একেবারে বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তে। এরপর নয়া বাংলাদেশ সরকারের স্পেশাল পারমিশনের বদৌলতে বেনাপােল বর্ডার দিয়ে মােটরযোগে সােজা। রাজধানী ঢাকা (তখন কারফিউ বলবৎ ছিল) এবং তারপরেই মােশতাক সকাশে। 

সূত্রঃ মুজিবের রক্ত লাল – এম আর আখতার মুকুল