ষড়যন্ত্রের কথা জানতে হলে সবচেয়ে প্রথমেই আওয়ামী লীগের জন্মকথা
পুরাে ষড়যন্ত্রের কাহিনী জানতে হলে প্রথমেই আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরের উপদলীয় রাজনীতির গােড়ার কথা ছাড়াও মুজিবনগরের গােপন কর্মকাণ্ড সম্পর্কে কিছুটা আলােকপাত করা অপরিহার্য বলে মনে হয়। এতে আমাদের নতুন বংশধরদের পক্ষে সিদ্ধান্ত গ্রহণ অনেক সহজতর হবে। ১৯৪৯ সালে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগের জন্ম হলে মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী প্রেসিডেন্ট এবং টাঙ্গাইলের যুবনেতা শামসুল হক সেক্রেটারি নির্বাচিত হন। এছাড়া শেখ মুজিবুর রহমান এবং খন্দকার মােশতাক আহম্মদ যুগ্ম-সম্পাদক নিযুক্ত হন। কিছুদিনের মধ্যে শামসুল হকের মস্তিষ্ক বিকৃতি ঘটলে মওলানা সাহেব দুজন যুগ্ম-সম্পাদকের মধ্যে শেখ। মুজিবকে অস্থায়ী সম্পাদক হিসাবে দায়িত্ব পালনের নির্দেশ দেন। দিনাজপুর ও রাজশাহীতে ছাত্র বিক্ষোভ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে নিম্নতম কর্মচারী ধর্মঘট এবং আটচল্লিশের প্রথম ভাষা আন্দোলনের উপর্যুপরি কারাবরণ ছাড়াও শেখ মুজিবের সাংগঠনিক ক্ষমতা দেখে আসাম থেকে আগত মওলানা সাহেব এই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। এটাই হচ্ছে মুজিব-মােশতাক বিরােধের প্রথম সূত্রপাত। শেখ মুজিব আওয়ামী লীগের সম্পাদক হওয়ায় খন্দকার মােশতাক মনঃক্ষুণ হন। কিন্তু নবগঠিত আওয়ামী লীগে মুজিবের প্রভাব দ্রুত বৃদ্ধি পাওয়ায় নিশ্রুপ থাকেন এবং সযত্নে একটার পর একটা আন্দোলন থেকে দূরে সরে যান। ১৯৫৪ সালে পূর্ববঙ্গের সাধারণ নির্বাচনের পর ক্ষমতার লােভে খন্দকার মােশতাক আওয়ামী লীগ ত্যাগ করে শেরে বাংলার কৃষক শ্রমিক পার্টিতে যােগদান করেন। মােশতাক কৃষক শ্রমিক পার্লামেন্টারি পার্টির চিক হুইপ নিযুক্ত হয়ে আতাউর রহমানের আওয়ামী লীগ মন্ত্রিসভার পতন ঘটান। প্রায় দশ বছর পর ১৯৬৪ সালে খন্দকার মােশতাক আবার আওয়ামী লীগে। যােগদানের ইচ্ছা প্রকাশ করলে শেখ সাহেব তাকে ক্ষমা করে পার্টিতে গ্রহণ। করেন। কিন্তু এর মধ্যে বুড়িগঙ্গার অনেক পানি বঙ্গোপসাগরে গিয়ে পড়েছে।
আটান্ন সালে জেনারেল আইয়ুব পাকিস্তানে ক্ষমতায় এসেছে এবং ১৯৬২ সালে একটা গণ-বিরােধী শাসনতন্ত্র প্রবর্তন করেছে। এদিকে ১৯৫৭ সালে মওলানা ভাসানী তার দলবলসহ আওয়ামী লীগ ত্যাগ করে ন্যাপ গঠন করেছেন। অন্যদিকে শেখ মুজিব আওয়ামী লীগের প্রেসিডেন্ট, তাজউদ্দিন আহমদ সেক্রেটারি এবং সৈয়দ নজরুল সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছেন। এছাড়া উত্তরবঙ্গ থেকে এম মনসুর আলী, কামরুজ্জামান ও অধ্যাপক ইউসুফ আলী আওয়ামী লীগের নেতৃস্থানীয় হিসাবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন। তবুও শেখ মুজিব অ্যাডভােকেট সালাম খান, খন্দকার মােশতাক এবং জহীরউদ্দিনের মতাে দলত্যাগীদের আবার পার্টিতে গ্রহণ করলেন। এর সঙ্গে এসে আওয়ামী লীগে ঢুকলেন মুসলিম লীগ নেতা শাহ মােহাম্মদ আজিজুর রহমান। মুজিব ঘুণাক্ষরে বুঝলেন না যে, একটা বিশেষ মহল থেকে এসব দক্ষিণপন্থী নেতাদের আওয়ামী লীগে অনুপ্রবেশ করানাে হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের সময় জহীরউদ্দিন পাকিস্তানের সামরিক সরকারের দালালী করায় পুরস্কৃত (বঙ্গবন্ধু হত্যার পর) হয়েছেন। আলহাজ্ব জহীরউদ্দিন হলেন বাংলাদেশের সামরিক সরকারের ইসলামাবাদে প্রথম রাষ্ট্রদূত। আর খন্দকার মোশতাক মুক্তিযুদ্ধের সময় বিশ্বাসঘাতকতার চেষ্টা করার পর স্বাধীন বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধু-হত্যার ষড়যন্ত্রে জড়িত হলেন। শেখ মুজিব থেকে খন্দকার মােশতাক ছিলেন বয়সে বড় এবং আওয়ামী মুসলিম লীগের জন্মের সময় দুজনে একই সঙ্গে যুগ্ম সম্পাদক ছিলেন।
উপরন্তু নিজে অ্যাডভােকেট বলে মােশতাকের ধারণা তিনি সব সময়েই শেখ মুজিব থেকে বড় নেতা এবং রাষ্ট্র পরিচালনায় সক্ষম। কিন্তু দুঃসাহসী শেখ মুজিবের প্রবল জনপ্রিয়তা ও সাংগঠনিক ক্ষমতা দেখে খন্দকার সাহেব বাহ্যত নিশ্ৰুপ থাকলেও মনে মনে গুমরে মরছিলেন। খন্দকার মােশতাক আওয়ামী লীগে পুনরায় যােগদানের পর শেখ মুজিব তার এই পুরনাে সহকর্মীকে সৈয়দ নজরুল, তাজউদ্দিন ও মনসুর আলীর উপরে স্থান দিতে পারলেন না। পাটি লাইন-আপ-এ মােশতাকের স্থান হলাে পাঁচ নম্বরে। অর্থাৎ কিনা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান, সৈয়দ নজরুল, তাজউদ্দিন এবং মনসুর আলীর পরে। তাই প্রায় দশ বছরের জন্য দলত্যাগ ও ১৯৫৪ সালের বিশ্বাসঘাতকতার কাফফরা” হিসাবে মােশতাককে আপাতত জুনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসাবে সন্তুষ্ট থাকতে হলাে। কিন্তু মনে মনে তিনি প্রতিহিংসার আগুনে জ্বলতে লাগলেন আর ষড়যন্ত্রের জাল বুনতে শুরু করলেন। কিছুদিনের মধ্যেই মােশতাক বুঝতে পারলেন যে, আওয়ামী লীগের কাদের সঙ্গে তিনি উপদল সৃষ্টি করবেন। মহল বিশেষের মতে এ সময় ঢাকার আগামসি লেনের অভিযান প্রেসের উপর তলায় রাতের অন্ধকারে বৈঠক শুরু হলাে। এসব বৈঠকে এসে হাজির হলেন মুন্সীগঞ্জের শাহ মােয়াজ্জেম, ফরিদপুরের কে এম ওবায়েদ, কুমিল্লার জহিরুল কাইয়ুম, কুষ্টিয়ার শাহ আজিজুর রহমান, ঢাকার জহীরউদ্দিন প্রমুখ। এর আগেই মোশতাকের সঙ্গে ইত্তেফাকের রিপাের্টার ব্রাহ্মণবাড়িয়ার তাহেরউদ্দিন ঠাকুরের সম্পর্ক স্থাপিত হয়েছে। আইয়ুব-বিরােধী আন্দোলনের সময় মােশতাকের উপদল এক ভয়ংকর খেলায় মেতে উঠে। আন্দোলন চরম আকার ধারণ করলে গণঅভুথানের ভয়ে ভীত আইয়ুব খান তথাকথিত আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় অভিযুক্ত শেখ মুজিবসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দের সঙ্গে গােল টেবিল বৈঠকের প্রস্তাব করে। আইয়ুব খান বললেন, আলােচনার জন্য মুজিবকে প্যারােলে মুক্ত করা হবে। এই প্রশ্নে আওয়ামী লীগের মধ্যে দ্বিমতের সৃষ্টি হলাে।
মােশতাকের উপদল আইয়ুবের প্রস্তাব মতাে শেখ মুজিবকে ‘প্যারােলে মুক্ত হয়ে বৈঠকে যােগদানের জন্য চাপ দিলাে। দৈনিক ইত্তেফাকের সম্পাদক মরহুম মানিক মিয়াও এদের সমর্থন করলেন। তার মতে, আইয়ুব খানের মতাে লােক যখন মুজিবকে ‘প্যারােলে মুক্ত করে আলােচনায় রাজি হয়েছে, তখন এই সুযােগ গ্রহণ না করাটা বােকামীর পরিচয়। কিন্তু তাজউদ্দিন এর ঘাের বিরােধীতা করলেন। তিনি বললেন, গণআন্দোলনের জোয়ারে আইয়ুব সরকার এখন টলটলয়মান। তাই তথাকথিত আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহার করে আইয়ুব খানকে মুজিব ভাইয়ের সঙ্গে আলাপ করতে হবে। না হলে এই রক্তাক্ত আন্দোলন অব্যাহত থাকবে। অন্যদিকে বেগম মুজিৰ কুর্মিটোলায় স্বামীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করে বললেন, “প্যারােলে মুক্ত হয়ে খুনী আয়ুবের সঙ্গে আলােচনায় রাজি হলে আমি আত্মঘাতী হবাে।
মােশতাক উপদলের চাপ অগ্রাহ্য করে শেষ পর্যন্ত মুজিব ঘােষণা করলেন, ‘মুক্ত মানুষ হিসাবে আইয়ুবের সঙ্গে আলােচনায় রাজি আছি। তাই আলোচনার প্রথম শর্ত হিসাবে তথাকথিত ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহার করতে হবে।’ তৎকালীন বাংলাদেশের রাজনৈতিক সন্ধিক্ষণে শেখ মুজিব যে এ সময় সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছিলেন, ইতিহাস তা সাক্ষ্য দিবে। কিন্তু কিছুদিন চুপ থেকে সত্তরের সাধারণ নির্বাচনের প্রাক্কালে খন্দকার মােশতাক আবার সক্রিয় হয়ে উঠলেন। অত্যন্ত সন্তর্পণে নিজের উপদলের প্রার্থীদের নমিনেশনের ব্যবস্থা করলেন। জীবনে ছাত্রলীগ ও আওয়ামী লীগ সদস্য থাকা সত্ত্বেও ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সরাইল কেন্দ্র থেকে সাংবাদিক অছিলায় তাহেরউদ্দিন ঠাকুর নমিনেশন পেলাে। তাজউদ্দিন-সমর্থকদের মতে, বাংলার রাজনৈতিক ভাগ্যাকাশে আর এক অকভ নক্ষত্রের জন্ম হলাে। সিলেট থেকে অবসরপ্রাপ্ত ওসমানীকে আওয়ামী লীগে এনে মােশতাক সাহেব শুধু যে তার নমিনেশনের ব্যবস্থা করলেন তাই-ই নয়, রাতারাতি কর্নেল সাহেবকে আওয়ামী লীগের নেতা বানিয়ে দিলেন। সিলেট জেলা আওয়ামী লীগে আবদুস সামাদের বিরুদ্ধে নিজের উপদল সৃষ্টির উদ্দেশে মােশতাক এই নতুন চাল চাললেন। ধীরে ধীরে সবার অলক্ষে প্রায় প্রতিটি জেলায় আওয়ামী লীগের মধ্যে দক্ষিণপন্থী উপদল সৃষ্টি হলাে। অবশ্য শেখ মুজিব স্বীয় ব্যক্তিত্ব দিয়ে এসব উপদলীয় কোন্দল আপাতত চাপা দিয়ে রাখতে সক্ষম হলেন।
এদিকে নানা ঘটনা প্রবাহের মধ্যে সাধারণ নির্বাচনের রায়কে বানচাল করে। জেনারেল ইয়াহিয়ার সৈন্য বাহিনী একাত্তরের ২৫শে মার্চ বাংলাদেশে গণহত্যায় মেতে উঠলাে। শুরু হলাে বাঙালিদের মুক্তিযুদ্ধ। ১৭ই এপ্রিল তারিখে মুজিবনগরের অম্রিকুঞ্জে (মেহেরপুর মহকুমার) ঘােষণা হলাে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের অস্তিত্ব। পাকিস্তানের কারাগারে বন্দি থাকা সত্ত্বেও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নির্বাচিত হলেন বাংলাদেশের প্রথম প্রেসিডেন্ট। সৈয়দ নজরুল হলেন অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি ও সামরিক বাহিনীর সর্বাধিনায়ক। আর তাজউদ্দিন আহম্মদের নেতৃত্বে গঠিত হলাে চার সদস্যের মন্ত্রিসভা। মনসুর আলী অর্থ মন্ত্রণালয়, খন্দকার মােশতাক বিদেশ মন্ত্রণালয় এবং কামরুজ্জামান পেলেন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব। তাজউদ্দিন প্রধানমন্ত্রী হওয়ায় খন্দকার মােশতাক ক্ষুব্ধ হলেও প্রকাশ্যে কিছুই বলতে সাহসী। হলেন না। অন্যদিকে তাজউদ্দিন বিদেশ মন্ত্রণালয়ের উপর রাখলেন শ্যেনদৃষ্টি। এ সময় পাকিস্তানের ডেপুটি হাইকমিশনার হােসেন আলী এবং তার অফিসের সমস্ত বাঙালি কর্মচারীরা মুজিবনগর সরকারের প্রতি আনুগত্য ঘোষণা করলে বিরাট চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়। নিম্নপদস্থ বাঙালি কর্মচারীরা দেশপ্রেমের জন্য এই আনুগত্য প্রকাশ করলেও হােসেন আলীর সিদ্ধান্তের কারণ এতদিন পর্যন্ত রহস্যের অন্তরালেই রাখা হয়েছিল। বাংলাদেশে গণহত্যার প্রতিবাদে সর্বপ্রথম পাকিস্তান হাইকমিশনের দিল্লী অফিস থেকে আমজাদুল হকসহ দুজন কর্মচারী ‘ডিফেক্ট” করলে, তাজউদ্দিন কোলকাতার বাঙালি ডেপুটি হাইকমিশনের হােসেন আলীর কাছে অনুরােধ বার্তা দিয়ে দূত পাঠান।
কিন্তু হােসেন আলী সেই বার্তা অগ্রাহ্য করে হেসে উড়িয়ে দিলেন। এর দিন কয়েক পরের কথা। সেদিন ছিল শনিবার। সকালে ‘ডিপ্লোমেটিক ব্যাগ খুলে হােসেন আলী দেখলেন, তাকে রাওয়ালপিন্ডিতে বদলীর অর্ডার এসেছে। তিনি বিপদের গন্ধ পেলেন। বুঝলেন এ যাত্রা রক্ষা পাওয়া যাবে না। সমস্ত কাজকর্ম ফেলে দ্রলােক সদ্য ঘােষিত মুজিবনগর সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিনের সঙ্গে গােপনে সাক্ষাৎ প্রার্থনা করে লােক পাঠালেন। হাইকমিশনের অবাঙালি অফিসারদের অজ্ঞাতে সন্ধ্যার পরে এই সাক্ষাতের ব্যবস্থা হলাে। তাজউদ্দিন পরিষ্কারভাবে আশ্বাস দিলেন, হােসেন আলী এবং মিশনের অন্যান্য বাঙালি কর্মচারীরা মুজিবনগর সরকারের প্রতি আনুগত্য ঘােষণা করলে বেতন ছাড়াও অন্যান্য সমস্ত রকমের সুযােগ ও সুবিধা দেয়া হবে। পিন্ডিতে বদলীর অর্ডার হােসেন আলীর জন্য শাপে বর হলাে। তাজউদ্দিনের আশ্বাসের ফলে হােসেন আলী বিবৃতিতে দস্তখত করলেন। শনিবার রাতেই কোলকাতার পাকিস্তান মিশনের ৭৩ জন বাঙালি কর্মচারী ৭২ জন গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আনুগত্য ঘােষণা করে মিশন দখল করে বসলাে। কেবল একজন ফার্স্ট সেক্রেটারি পুলিশ সার্ভিসের আর আই চৌধুরী (মেজর ডালিমের শ্বশুর) মনস্থির করার জন্য সময় চাইলেন। অবশ্য পরে ইনিও আনুগত্য প্রকাশ করেন। রােববার সকালে কোলকাতার ডেপুটি হাইকমিশনে রক্ত বলয় খচিত ও বাংলাদেশের ম্যাপ অঙ্কিত স্বাধীন বাংলার পতাকা উড়লাে আর চাঁদতারা মার্কা। ছেড়া পাকিস্তানি পতাকা নামানাে হলাে। হায়রে রাজনীতি! হােসেন আলীর জন্য চারদিকে ধন্য ধন্য রব উঠলাে। অভিনন্দনের জোয়ারে তিনি অভিভূত হয়ে পড়লেন। বিদেশী সাংবাদিকদের কাছে তিনি অসংখ্য ইন্টারভিউ দিলেন।
বিশ্বের পত্র-পত্রিকায় তার ফটো ছাপা হলাে এবং, টিভিতে তার কার্যকলাপ দেখানাে হলে হােসেন আলী খাঁটি দেশপ্রেমিক হিসাবে চিহ্নিত হলেন। আর স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু দেশে ফিরেই তাকে ডবল প্রমােশন দিয়ে একেবারে তথ্য সেক্রেটারি বানালেন। কিন্তু হােসেন আলীর বদলীর কাহিনী আর নেপথ্যে তাজউদ্দিনের প্রচেষ্টার কথা গােপনই থেকে গেল। এসব কথা শুনলে আজ অনেকেই আশ্চর্য হয়ে যাবেন যে, পাকিস্তানি মিশনগুলােতে চাকুরিরত বাঙালি অফিসারদের বিদেশী মুদ্রায় পুর বেতন, বাড়ি ভাড়া, অন্যান্য ভাতা এবং সুযােগ-সুবিধার গ্যারান্টি দেয়ার পর, কেবলমাত্র এদের একাংশ মুজিবনগর সরকারের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করেছিল। বাকিদের মধ্যে এমন অনেকে রয়েছেন, যারা স্বাধীনতার এক থেকে দেড় বছর পর বাংলাদেশের প্রতি আনুগত্য (পাকিস্তানি মুরুব্বীদের ইঙ্গিতে) ঘােষণা করে এখন জিয়ার সামরিক শাসনের আমলে দিব্যি প্রমােশন পাচ্ছেন। অথচ মুক্তিযুদ্ধের সময় মুজিবনগরে প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণীর গেজেটেড অফিসারদের সর্বোচ্চ যথাক্রমে মাত্র পাঁচশ এবং সাড়ে তিনশ টাকা বেতন দেয়া হয়েছিল। স্বাধীনতার পর নানা বাহানায় এদের বকেয়া বেতন থেকেও বঞ্চিত করা হয়। ১৯৭১ সাল। বাংলার দুলাল ও অগ্নিসাধক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্ত েিনর অন্ধকার কারাকক্ষে মৃত্যুর প্রতীক্ষায়; ইয়াহিয়া খানের দখলদার সেনাবাহিন বাংলাদেশে শুরু করেছে হত্যার তাণ্ডব লীলা। তারা গ্রামের পর গ্রাম জ্বালিয়ে লােকালয়গুলােকে নিশ্চিহ্ন করছে। আগুনের লেলিহান শিখায় বাংলার আকাশ লাল হয়ে উঠেছে। বারুদের গন্ধে বাতাস ভরপুর। নিরাপরাধ মানুষ, আর্ত নারী আর মাসুম বাচ্চার ফরিয়াদে খােদার আরশ পর্যন্ত কেঁপে উঠেছে। এই গণহত্যার খবরে সমস্ত সভ্য জগৎ স্তম্ভিত।
অস্ত্রের ঝনঝনানীকে অস্ত্র দিয়েই রুখতে হবে। তাই বাংলাদেশে লাখাে লাখাে দামাল ছেলের দল স্বাধীনতার রক্তাক্ত যুদ্ধে ঝাপিয়ে পড়েছে। চারিদিকে আওয়াজ উঠেছে “ওরা মানুষ হত্যা করেছে, আসুন আমরা পশু হত্যা করি।” এদিকে বিবেকসম্পন্ন সাংবাদিক, সাহিত্যিক, শিল্পী, অধ্যাপক ও বুদ্ধিজীবীরাও এই মুক্তিযুদ্ধে শরিক হয়েছে। আমরা তখন মুজিবনগরে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে অনুষ্ঠান প্রচার শুরু করেছি। মুক্তিফৌজ ও জনসাধারণকে দ্বিগুণ উৎসাহে শত্রুর উপর পাল্টা আঘাত হানার জন্য বেতারে আহ্বান জানাচ্ছি। এ সময় জনৈক প্রখ্যাত গায়িকার এক ভাই (সিনেমা শিল্পের সঙ্গে জড়িত) তখন আমাদের সঙ্গেই ছিলেন। অক্টোবর মাসের শেষের দিকে হঠাৎ করে একদিন বেতার কেন্দ্রে অনলাম, গায়িকা শাহনাজের ভাইকে পাওয়া যাচ্ছে না। বহু খোজাখুঁজির পর ব্যাপারটা দিবালােকের মতাে স্পষ্ট হয়ে উঠলাে। ভদ্রলােক মুজিবনগর থেকে কী একটা গােপন বার্তা নিয়ে কাঠমুণ্ডু হয়ে পাকিস্তানে চলে গেছেন। সাংবাদিকের কৌতূহল দমন করতে না পেরে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুলের বাসায় গেলাম। সৈয়দ সাহেব পুরাে ব্যাপারটা না বললেও শুধু জানালেন, “সাংবাদিক হিসাবে এটুকু জেনে রাখুন, আমাদের বিরুদ্ধে সরকারের মধ্যে থেকেই জনাকয়েক বিরাট ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়েছে”। বহু চেষ্টা করেও তার কাছ থেকে আর কথা বের করতে পারলাম না। পুরা ব্যাপারটা জানার জন্য আমি অস্থির হয়ে উঠলাম। এখন ডাইরিতে লিখে রাখলে ভবিষ্যতে কাজে লাগতে পারে। তাই মুজিবনগর সেক্রেটারিয়েট থেকে বিদেশ মন্ত্রণালয় আর সেখান থেকে ‘জয় বাংলা পত্রিকা অফিস ও স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র-সব চষে ফেললাম। কিন্তু কোনাে কিনারাই করতে পারলাম না। শেষে প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিনের সঙ্গে দেখা করতে মনস্থ করলাম। স্বাভাবিকভাবেই ব্যস্ত মানুষ। তবুও দুপুরে খাবার সময় দেখার অনুমতি দিলেন। ছােট্ট একটা অফিস।
তারই পিছনের কামরায় থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা। এরমধ্যে মেস থেকে। দুজনের আন্দাজ খাবার এসেছে। খেতে খেতে অনেক আলাপ হলাে। মুক্তিযুদ্ধের অবস্থা, বঙ্গবন্ধুর মামলা, বেতারকেন্দ্রের প্রােগ্রাম, ঢাকার সর্বশেষ খবর ইত্যাদি। হঠাৎ করে জিজেস করলাম, সেদিন ঢাকা থেকে যে নামজাদা সাংবাদিক পালিয়ে এসেছে তাকে ইন্টারভিউ দিতে অস্বীকার করলেন কেন? জবাবে বললেন, ‘তােমরা কিসের সাংবাদিকতা করাে? ও তাে পাকিস্তানি পাসপাের্টে এখানে এসেছে? দেখছে না, দিব্যি আমাদের ফরেন অফিসে জায়গা নিয়েছে?” ‘ফরেন অফিসের কথা উঠতেই আমি পরিষ্কারভাবে ষড়যন্ত্রের কথা জানতে চাইলাম। সেকেন্ড কয়েক চুপ করে থেকে বললেন, ‘দাঁড়াও হাত ধুয়ে আসি। তােমাকে ফাইলটা দেখাচ্ছি।’ লােহার আলমারি থেকে অত্যন্ত গােপনীয় মার্কা মারা একটা লাল রং-এর। ফাইল বের করলেন। একবার চোখ বুলিয়ে বললেন, ‘তুমি এখানে বসে ফাইলটা থেকে নােট করে নিতে পারাে। কিন্তু ব্যাপারটা আপাতত গােপন রাখার চেষ্টা করবে। আমি একটু বাইরের অফিস ঘরে যাচ্ছি। জহুর আহম্মদ চৌধুরীর কাছ থেকে খবর নিয়ে লােক এসেছে। • এক মনে ফাইলটা পড়তে শুরু করলাম। ধীরে ধীরে ষড়যন্ত্র আর রহস্যের জাল আমার কাছে উদঘাটিত হলাে। মুজিবনগর সরকারের অজান্তে পররাষ্ট্র সেক্রেটারি মাহবুবুল আলম চাষী পাকিস্তানের সঙ্গে যুদ্ধ বিরতি ও আপােষের যে প্রস্তাব পাঠিয়েছেন তার কপি পর্যন্ত ফাইলে রয়েছে।
বার দুয়েক প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদের দস্তখত করা নােট পড়লাম। তিনি এ মর্মে নােট লিখেছেন, যেসব রাজনৈতিক নেতা এই ষড়যন্ত্রে জড়িত রয়েছেন তাদের ব্যবস্থা রাজনৈতিকভাবে আওয়ামী লীগ পাটির পক্ষে গ্রহণ করা বাঞ্ছনীয়। তবে সরকারি কর্মচারী হয়ে মাহবুবুল আলম চাষী এই জঘন্য ষড়যন্ত্রে জড়িত থাকায় আমি তাকে এই মুহূর্তে দায়িত্বভার থেকে অব্যাহতি দিলাম। এটা হচ্ছে ১৯৭১ সালেন নভেম্বর মাসের ঘটনা। বাংলাদেশের পথে-প্রান্তরে তখন একদিকে মুক্তিফৌজ এবং আরেক দিকে বাঘা সিদ্দিকীর কাদেরিয়া বাহিনী প্রচণ্ড পাল্টা হামলায় দখলদার পাকিস্তানি সৈন্যদের প্রাণ ওষ্ঠাগত করে তুলেছে। জেনারেল নিয়াজীর নির্দেশে পাকিস্তানি সৈন্যরা ক্যাম্প থেকে সন্ধ্যার পর বেরুনাে বন্ধ করে দিয়েছে। প্রতিদিন কয়েক শ’ করে সৈন্য ও রাজাকার নিহত হচ্ছে। বরিশাল-খুলনা সেক্টরে মেজর জলিল, কসবা-আখাউড়া সেক্টরে মেজর খালেদ মােশাররফ, যশাের সেক্টরে মেজর মঞ্জুর ও হুদা এবং টাঙ্গাইল-ময়মনসিংহ সেক্টরে টাইগার সিদ্দিকী একটার পর একটা এলাকা মুক্ত করে চলেছে। এছাড়া রাজশাহীর ভােলারহাট, দিনাজপুরের তেঁতুলিয়া, পচাগড়, রুহিয়া ও ঘােড়াঘাট এবং রংপুরের পাটগ্রাম, রৌমারী ও চিলমারী প্রভৃতি এলাকায় মুজিবনগর সরকারের প্রশাসন চালু হয়েছে। আর সমগ্র বাংলাদেশ এক বিরাট রণাঙ্গনে পরিণত হয়েছে। ঢাকা ও চট্টগ্রামে শুরু হয়েছে গেরিলাদের অতর্কিত হামলা। ঠিক এমনি সময়ে ২৭শে নভেম্বর তারিখে প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিনের নির্দেশে পররাষ্ট্র সেক্রেটারি মাহবুবুল আলম চাষী চাকুরি থেকে বরখাস্ত হলেন। বিদেশ মন্ত্রী খন্দকার মােশতাক বহু চেষ্টা করেও তার প্রিয়ভাজন চাষীর চাকুরি রক্ষা করতে পারলেন না। মুজিবনগর সরকারের সেক্রেটারিয়েট, স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্র, জয় বাংলা পত্রিকা অফিস আর আওয়ামী লীগ মহলের প্রায় সবাই এ নির্দেশে হতবাক হয়ে পড়লাে। প্রাক্তন রাষ্ট্রদূত আবদুল মােমেন নতুন পররাষ্ট্র সেক্রেটারি নিযুক্ত হলেন। * ধীরে ধীরে এই জঘন্য ষড়যন্ত্রের কথা প্রকাশ পেলাে।
বাংলাদেশের স্বাধীনতার যুদ্ধ যখন চরম পর্যায়ে উপনীত হয়েছে, তখন এই মুক্তিযুদ্ধকে বানচালের উদ্দেশ্যে সবার অগােচরে একটা বিদেশী দূতাবাসের সহযোগিতায় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে এই ষড়যন্ত্রের সূচনা হয়। প্রকাশ, এই ব্যাপারে খন্দকার মােশতাক, তাহেরউদ্দিন ঠাকুর এবং চাষী মাহবুবের সঙ্গে আরও যেসব নাম গুজবের আকারে জড়িত হলাে সেগুলাে হচ্ছে- মুক্তিবাহিনীর প্রধান কর্নেল (পরে জেনারেল) ওসমানী, কোলকাতার ডেপুটি হাই কমিশনার হােসেন আলী, ফরিদপুরের ওবায়দুর রহমান, মুন্সিগঞ্জের শাহ মােয়াজ্জেম, কুমিল্লার জহিরুল কাইয়ুম, ডাক্তার টি হােসেন এবং চট্টগ্রামের দৈনিক আজাদী’র সম্পাদক মােহাম্মদ খালেদ অন্যতম। তখন সত্য-মিথ্যার যাচাই করা মুস্কিল। যখন বাংলাদেশের আপামর জনসাধারণ এক রক্তাক্ত যুদ্ধে মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ছে, তখন এই হচ্ছে গোপন ঘটনা প্রবাহ। ধীরে ধীরে মােশতাকের উপপল একটা অঘােষিত পাল্টা সরকার গঠন করে বসলাে। এমন কি বিদেশমন্ত্রী খন্দকার মােশতাক মন্ত্রিসভার বৈঠকে পর্যন্ত অনুপস্থিত থাকতে শুরু করলেন। প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন বিপদের গন্ধ পেয়ে জাতিসংঘে প্রেরিত প্রতিনিধি দলের নেতা হিসাবে খন্দকার সাহেবকে যেতে দিলেন না। প্রকাশ, এ সময় তার পাসপাের্ট (ভারতীয়) পর্যন্ত ‘সিজ’ করার ব্যবস্থা হয়। এজন্যই শেষ মুহূর্তে জাতিসংঘে প্রেরিত বাংলাদেশের প্রতিনিধি দলের নেতৃত্ব থেকে খন্দকার সাহেবকে সরিয়ে আকস্মিকভাবে বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীকে নেতা নিযুক্ত করা হয়।
ফলে এই কোন্দল চরম আকার ধারণ করলাে। পরে নভেম্বরের ষড়যন্ত্রের কথা প্রকাশ হলে মােশতাক বেশ কিছুটা স্তিমিত হয়ে পড়েন। এদিকে মাস কয়েক আগে স্বাধীন বাংলা বেতারের কর্মীরা জনাব তাহেরউদ্দিন ঠাকুরকে তার দলবলসহ বেতারকেন্দ্র থেকে একরকম বহিষ্কার করেছে। তিনি কিছুদিন আগে কসবা-আখাউড়া সেক্টরে একটা এক কিলােওয়াট ট্রান্সমিটারের দায়িত্বে ছিলেন। এ সময় উপযুক্ত কর্তৃপক্ষের কোনােরকম অনুমােদন ছাড়াই এমন একটা নির্দেশ ঘােষণা করেছিলেন, যাতে ওই এলাকার মুক্তিবাহিনীর মধ্যে বেশ বিভ্রান্তির সৃষ্টি হয়েছিল। তাই মেজর খালেদ মােশাররফের ভয়ে ঠাকুর সাহেব দলবল নিয়ে মুজিবনগরে এসে স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্রে আশ্রয় নেন। স্বাধীন বাংলা বেতার থেকে বেরিয়ে এরা খন্দকার মােশতাকের আশ্রয়পুষ্ট হয়। প্রকাশ শেষ পর্যন্ত এ মর্মে গোপন সিদ্ধান্ত হয়েছিল যে, মুজিবনগর সরকারের অজান্তে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে একটা পশ্চিমা লবির মাধ্যমে জেনারেল ইয়াহিয়া সামরিক জান্তার সঙ্গে যােগাযােগ করতে হবে। তাদের জানাতে হবে, একটা মাত্র উপায়ে পাকিস্তানের অখণ্ডতা রক্ষা করা সম্ভব। বঙ্গবন্ধুর মুক্তি এবং বাংলাদেশের পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন স্বীকার করে পাকিস্তানকে কনফেডারেশনে পরিণত করতে হবে। এই শর্তের ভিত্তিতে অবিলম্বে যুদ্ধ বন্ধ করে বৈঠকের ব্যবস্থা করা অপরিহার্য। মহল বিশেষের মতে ইরানের শাহেন শাহর তত্ত্বাবধানে এই বৈঠক তেহরানে অনুষ্ঠিত হওয়ার প্রস্তাব করা হয়েছিল। পরবর্তীকালে যুগােশ্লাভিয়ার প্রেসিডেন্ট মার্শাল টিটোও এক টিভি সাক্ষাৎকারে এই প্রস্তাবিত বৈঠকের উল্লেখ করেছেন।
সিদ্ধান্ত অনুসারে পররাষ্ট্র সেক্রেটারি মাহবুবুল আলম চাষী গােপন বার্তা পাঠিয়ে দিলেন। প্রকাশ, তিনি আরও জানালেন, জেনারেল ইয়াহিয়া সম্মত থাকলে প্রস্তাবিত বৈঠকে বিদেশ মন্ত্রী খন্দকার মােশতাক বাঙালি প্রতিনিধি দলের নেতৃত্ব দিবেন এবং অন্যতম প্রতিনিধি হিসাবে কর্নেল (অব.) ওসমানী দলের অন্তর্ভুক্ত থাকবেন। প্রতিনিধিদের মধ্যে সরলমনা কর্নেল ওসমানী থাকায় স্বাধীনতা সংগ্রামীদের দ্বিধা বিভক্ত করা ছাড়াও সমগ্র দেশে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করা সহজ হবে। এছাড়া সাধারণ মানুষকে এ কথা বলতে হবে যে, বঙ্গবন্ধুর প্রাণ রক্ষা করে পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্ত করার জন্যই এ ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। আর বঙ্গবন্ধু ফিরে এলে প্রধানমন্ত্রীর গদি ছেড়ে দিতে হবে বলে তাজউদ্দিন এ ধরনের কোনাে চেষ্টা করছেন না। তাহলে এক ঢিলে দুই পাখি মারা সম্ভব হবে। | এর মধ্যে কোনাে একটি মহল থেকে একটা প্রচারপত্র ছাপিয়ে মুক্তিবাহিনীর শিবিরে শিবিরে বিতরণ করলাে। “স্বাধীনতা আগে না বঙ্গবন্ধুর মুক্তি আগে?”… এ ধরনের একটা হেডিং দিয়ে প্রচারপত্রে বলা হলাে যে, বঙ্গবন্ধুকে যেকোনাে শর্তে মুক্ত করা হলে ভবিষ্যতে পূর্ণ স্বাধীনতার যুদ্ধে তিনিই নেতৃত্ব দিতে পারবেন। তাই এখন বঙ্গবন্ধুর জীবন রক্ষার জন্য মুক্তিযুদ্ধকে প্রয়ােজন মতাে বন্ধ করতে হবে। এতে করে মুক্তিফৌজের মধ্যে দারুণ বিভ্রান্তি সৃষ্টি হলাে।
জাতির এই সংকট মুহূর্তে স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্র তার বলিষ্ঠ ভূমিকা অব্যাহত রাখে। প্রতিটি অনুষ্ঠানেই ঘােষিত হলাে, আঘাতের পর আঘাত হেনে শক্রকে বিপর্যস্ত করার আহ্বান। উপরন্ত সৈয়দ নজরল এবং তাজউদ্দিন দুজনেই স্বাধীন বাংলা বেতার থেকে জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণ দিলেন। এঁরা স্পষ্টভাবে সবাইকে পূর্ণ স্বাধীনতা না হওয়া পর্যন্ত লড়াই চালিয়ে যেতে বললেন। এভাবে সেদিন মােশতাক উপদলের আর একটা চাল ব্যর্থ হলাে। একটার পর একটা ঘটনা জোড়াতালি দিয়ে ষড়যন্ত্রের আসল চেহারা দেখে আমার কেবলই পলাশীর যুদ্ধের কথা মনে পড়লাে।
হায়রে দুর্ভাগা বাংলাদেশ!
সূত্রঃ মুজিবের রক্ত লাল – এম আর আখতার মুকুল