এক শ্রেণীর সাংবাদিকের অর্থবহ ভূমিকা লিফসুজের লেখনীতে ষড়যন্ত্রের কথাবার্তা
সত্তর দশকের মাঝামাঝি সময়ে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার অন্যতম প্রভাবশালী ইংরেজি সাপ্তাহিক ‘ফার ইস্টার্ন ইকনমিক রিভিউ’ পত্রিকার ভ্রাম্যমাণ প্রতিনিধি হিসাবে কর্মরত ছিলেন পাশ্চাত্য দেশীয় সাংবাদিক লরেন্স লিফসুজ। স্বল্প দিনের মধ্যেই ভদ্রলােক বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি সম্পর্কে ওয়াকেফহাল হলেন এবং সে মােতাবেক ‘রিভিউ’ পত্রিকায় ‘মুজিব হত্যা’ সংক্রান্ত বেশ ক’টি প্রতিবেদন পাঠালেন। ফার ইস্টার্ন ইকনমিক রিভিউ’ পত্রিকায় এ সময়ে প্রকাশিত রিপাের্টগুলাে বাংলাদেশের বিশেষ বিশেষ মহলের কর্মকাণ্ডের জন্য বেশ সহায়ক হলাে। অথচ সে আমলে লিফসুজ-এর ধারণা ছিল যে, তিনি বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিকতা করছেন। কিন্তু এই ধারণা ছিল ভ্রমাত্মক এবং রিপাের্টগুলাে একতরফা। পরবর্তীকালে লিফসুজ নিজেই এই ভুল ‘আবিষ্কার’ও ‘অনুধাবন করতে সক্ষম হন। এ সময় তিনি প্রণয়ন করেন তার চাঞ্চল্যকর গবেষণামূলক গ্রন্থ “বাংলাদেশ : দি আনফিনিশড রেভলিউশন”। বইটিতে তিনি ঢাকার জনাকয়েক বাঙালি সাংবাদিকের উল্লেখ করে লিখেছেন যে, “এরাই তাকে ১৯৭৫ সালে ঢাকায় ভুল ব্রিফিং দিয়েছিল”। তাহলে প্রথমেই দেখা যাক, স্বাধীনতা উত্তর যুগে ঢাকার সংবাদপত্রগুলাে কাদের কুক্ষিগত ছিল। হিসাব করলে দেখা যাবে যে, বিশ্বের অনুন্নত দেশগুলােতে ষড়যন্ত্র করে আইনসম্মত সরকারের পতন ঘটানাে এবং প্রতিটি ভয়াবহ রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে সেই দেশের শক্তিশালী সংবাদপত্রের ও সাংবাদিকের প্রত্যক্ষ অথবা পরােক্ষ যােগাযােগ রয়েছে। বাংলাদেশেও এর ব্যতিক্রম হয়নি।
একাত্তরে ঢাকায় গণহত্যার সময় পাকিস্তানের সামরিক বাহিনী দৈনিক ইত্তেফাকের অফিস ধ্বংস করে দিয়েছিল। প্রকাশ, মাস কয়েক পর ইয়াহিয়ার সামরিক সরকার নিজেদের এই ‘বােকামি’ বুঝতে পেরে ধৈনিক ইত্তেফাককে আবার চালু করার জন্য দশ লক্ষাধিক টাকা ক্ষতিপূরণ দেয়। মরহুম মানিক মিয়ার জ্যেষ্ঠ পুত্র ব্যারিস্টার মঈনুল হােসেন অফসেট রােটারি মেশিন কেনার উদ্দেশ্যে এ সময় পিশ্চম জামানি ও ব্রিটেন সফর করেন। দেশে ফিরে তিনি দৈনিক পাকিস্তানের প্রেস থেকে ইত্তেফাক পুনঃ প্রকাশের ব্যবস্থা করেন। তখন বাংলাদেশের মাটি রক্তাক্ত মুক্তিযুদ্ধ। মহল বিশেষের মতে, মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানের সামরিক বাহিনী ইত্তেফাকের সম্পাদক জনাব আনােয়ার হােসেন মঞ্জু এবং সাপ্তাহিক ‘হলিডে’ পত্রিকার জনাব এনায়েতউল্লাহকে গ্রেফতার করলেও তাদের বেশিদিন আটকে রাখতে পারেনি। প্রকাশ, পশ্চিমা শক্তিবর্গের ঢাকাস্থ লবি থেকে হস্তক্ষেপ করায় এঁদের ছেড়ে দেওয়া হয়। এঁরা আবার ঢাকার বিভিন্ন মহলে যথারীতি ঘােরাঘুরি করতে লাগলেন। স্বাধীনতার পর ‘ইত্তেফাকের মালিক গােষ্ঠী বিপদ থেকে উদ্ধার পাওয়ার জন্য আওয়ামী লীগের মহিমা কীর্তন শুরু করল। কিছুদিনের মধ্যেই এরা একাত্তর সালের বাকি পড়া সাড়ে তিন লাখ টাকার বিজ্ঞাপনের বকেয়া বিলের ব্যবস্থা করল। উপরন্তু রােটারি মেশিন আমদানির জন্য ১৭ লাখ টাকার ক্যাশ লাইসেন্স পেল। লন্ডনস্থ সাপ্তাহিক নতুন দিন পত্রিকায় ১৯৮৮ সালের ১৭-২৩ জুন সংখ্যায় বিশিষ্ট লেখক-সাংবাদিক আব্দুল গাফফার চৌধুরী দৈনিক ইত্তেফাক’-এর ভূমিকা সম্পর্কে লিখেছেন :“…কিছুকাল আগে মানিক ভাইয়ের এক ছেলে (এখন মন্ত্রী) নিজের কার্যকলাপের সাফাই গাইতে গিয়ে আমাকে বলেছেন, তার বাবাও মাঝে মাঝে দুর্বলতা দেখাতেন। পাকিস্তান আমলে ‘ইত্তেফাক পত্রিকা যখন সরকার বাজেয়াপ্ত করে দেয়, তখন মাঝে মাঝে মানিক মিয়া দুর্বল হয়ে পড়তেন, আপােষ করতে চাইতেন। “আমি তাকে একবার বলতে চেয়েছিলাম, মানিক মিয়া বিপ্লবী ছিলেন না, তার চরিত্রে দুর্বলতা ও সরলতা ছিল (বিপ্লবীদের চরিত্রেও দুর্বলতা ও আপােষবাদিতা থাকে)।
তবে এই দুর্বলতা তিনি সব সময় কাটিয়ে উঠেছেন। কখনাে আপােষবাদিতাকে তিনি আত্মসমর্পণ বা আত্মবিক্রয়ে রূপান্তরিত হতে দেননি। এই কথাটা শেষ পর্যন্ত মন্ত্রী মহােদয়কে আমার বলা হয়নি। “কারণ, মানিক মিয়ার যে ছেলে গর্ব করে বলতে পারে, মানিক মিয়ার ইত্তেফাক’ ১৯৭১ সালের মার্চ মাসে পাকিস্তানের সৈন্য বাহিনীর হাতে ভস্মীভূত হয়ে গেছে, তারপর নিজের চেষ্টায় ও পরিশ্রমে এই ‘ইত্তেফাক গড়ে উঠেছে এবং এই ইত্তেফাক’ মানিক মিয়ার ইত্তেফাকের মতাে ব্যক্তিনির্ভর রাজনৈতিক মতবাদের সংবাদপত্র নয়; স্বনির্ভর স্বতন্ত্র সংবাদপত্র; তাকে যুক্তিতর্ক দিয়ে কিছু বােঝাতে যাওয়া নিরর্থক মনে হয়েছে। মানিক মিয়ার সেই ভস্মীভূত ‘ইত্তেফাকের ছাইয়ের গাঁদার উপর দাঁড়িয়েই যে তার পুত্ররত্নেরা’ এখন সেই ছাই শুধু মুখে নয়, সারা দেহে মাখছে; একথা তাদের কে বােঝাবে? | “তবে একটা কথা মানিক মিয়ার মৃত্যুর ১৯ বছর পর নিজের কাছেই বড় কঠিন সত্য বলে মনে হচ্ছে। এই কথাটা হলাে, বর্তমানের ‘দৈনিক ইত্তেফাক মানিক মিয়ার প্রতিষ্ঠিত দৈনিক ইত্তেফাক নয়। মানিক মিয়ার ইত্তেফাক পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর হাতে ১৯৭১ সালের মার্চ মাসে ভস্মীভূত নয়, শহীদ হয়েছে। শহীদ হয়েছেন মানিক মিয়ার উত্তরসূরী কার্যনির্বাহী সম্পাদক সিরাজুদ্দীন হােসেন। এখন যে ‘ইত্তেফাক’ তা ভস্ম থেকে জেগে ওঠা ‘ইত্তেফাকের প্রেতাত্মা। এই প্রেতাত্মা বাংলার জনগণের কণ্ঠ নয়; এই পত্রিকা স্বৈরাচারীর ও গণশত্রুদের সেবাদাস, পদ ও অর্থের ক্রীতদাস। জনগণের বন্ধু নয়, শত্রু।
কবরে শুয়ে মানিক মিয়া আজ হয়তাে একটাই সান্ত্বনা পাচ্ছেন, তার হাতে গড়া ‘ইত্তেফাক’ (যদিও জন্মলগ্নে ১৯৫৩ সালের ২৫শে ডিসেম্বর ইত্তেফাকের প্রতিষ্ঠাতা মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী এবং মুদ্রাক্ষর ও প্রকাশক ঢাকার কারকুন বাড়ি লেনের ইয়ার মােহাম্মদ খান এবং সম্পাদক তফাজ্জল হােসেন মানিক মিয়া) বাংলার মানুষের সঙ্গে, জনগণের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেনি; বরং ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর হাতে সম্মান ও মর্যাদার সঙ্গে শহীদ হয়েছে।” সাপ্তাহিক ‘হলিডে’ পত্রিকার ইতিহাস এক বিচিত্র ইতিহাস। আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে রুশ-চীন বিরােধের প্রাক্কালে আইয়ুব আমলে এই পত্রিকার জন্ম। রুশ ‘সম্প্রসারণবাদীদের’ সমালােচনা করার নামে মার্কসবাদী দৃষ্টি থেকে মহাচীনকে সমর্থন দানের অজুহাতে এঁরা অত্যন্ত সঙ্গোপনে মার্কিনী লবিকে সাহায্য করতে শুরু করে। আবার সেই পাকিস্তানি জামানায় আভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রে শেখ মুজিবের ছয় দফার পিছনে মার্কিনী সমর্থন রয়েছে বলে জিগির তুলে বাংলাদেশে জুলফিকার আলী ভুট্টোর ‘ইমেজ’ গড়ার ব্যর্থ প্রচেষ্টা চালায়। প্রগতিশীল বুলি কপচিয়ে চীনের নয়া বন্ধু মার্কিনীদের যে পরােক্ষভাবে সমর্থন দেয়া যায়, বাংলাদেশের সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে এ কৃতিত্ব হলিডে পত্রিকার । পাকিস্তানে ভুট্টোর পিপলস পার্টির জন্ম হওয়ার সময় আসলাম নামে জনৈক উর্দুভাষী সাংবাদিক সাপ্তাহিক হলিডে পত্রিকার কার্যনির্বাহী সম্পাদক হিসাবে যােগ দিয়েছিলেন। ভদ্রলােক উর্দুভাষী হলেও বাংলায় তার বেশ দখল।
কিছুদিনের মধ্যে তিনি নিজেকে একজন প্রগতিশীল সাংবাদিক হিসাবে পরিচয় দিয়ে বিভিন্ন মহলে যাতায়াত শুরু করেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় এর ভূমিকা রহস্যজনক থাকলেও স্বাধীনতার পর ভুট্টোর বাংলাদেশ সফরসূচি চূড়ান্ত হবার পর ইনি হঠাৎ করে একদিন উধাও হয়ে যান। | তকালীন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী মুনসুর আলী এক প্রশ্নের উত্তরে জাতীয় পরিষদে জানালেন, বাংলাদেশ সরকারের পাসপাের্টে আলােচ্য আসলাম লন্ডন হয়ে পাকিস্তানে চলে গেছে। গােয়েন্দা রিপাের্টে প্রকাশ পেলাে, স্বাধীনতার পর পাকিস্তানের সঙ্গে বাংলাদেশের যােগাযােগ সম্পূর্ণভাবে বিছিন্ন হওয়ায় যে ক’জন ভুট্টোর এজেন্ট গােপনে কাজ করছিলেন, আসলাম তাদের অন্যতম। ছিটকে পড়া পাকিস্তানি এজেন্টদের সমাজ জীবনে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করে পাকিস্তানি গােয়েন্দা বিভাগের সঙ্গে এদের আবার যােগাযােগ করে দেওয়াই তার কাজ ছিল। তাই ভুট্টোর সফরের প্রাক্কালে দায়িত্ব শেষ হওয়ায় ইনি পাকিস্তানে ফিরে গেছেন। অবশ্য এক শ্রেণীর অফিসারদের কারসাজিতে এজন্য ‘হলিডে’ পত্রিকাকে কোনাে ঝামেলাই পােহাতে হলাে না।
অনেকের মতে স্বাধীনতার পর একটা বিশেষ মহলের ইঙ্গিতে এই হলিডে পত্রিকায় বাঙালিদের মধ্যে ভাঙন ধরাবার জন্য লেখা হলাে, তাহলে আমরা দু’কোটি লােক কি কোলাবরেটর?” এতে দুটো জিনিস বুঝানাে হলো। প্রথমত, মুজিবনগরে যে এক কোটি বাঙালি চলে গিয়েছিল তারা এবং যে ছ’কোটি এপারে থেকে গিয়েছিল এরা একান্ত নয়। সুতরাং মুজিবনগরীদের ছলে বলে ও কৌশলে একঘরে করে ফেলতে হবে। দ্বিতীয়ত, এই শ্লোগান দিয়ে কোলাবরেটার অফিসার, রাজাকার, আলবদর এবং মুসলিম লীগ ও জামাত কর্মীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ থেকে বাংলাদেশ সরকারকে বিরত থাকতে বলা হয়েছে। এপারের ছ’কোটির মধ্যে এদের ব্রাকেট করা হয়েছে বলে কোনাে ব্যবস্থা নিতে হলে এই ছ’কোটি লােকের বিরুদ্ধেই তা করতে হবে। | যেখানে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে অবস্থানকারী বাঙালি এবং মুজিবনগরের স্বাধীনতা সংগ্রামীরা একযােগে পাকিস্তানি সৈন্যদের বিরুদ্ধে রক্তাক্ত যুদ্ধ করেছে, সেখানে স্বাধীনতার পর এক অদ্ভুত উপায়ে বাঙালি জাতিকে দ্বিধা বিভক্ত করা হলাে। ওয়াকেফহাল মহলের মতে মুক্তিযুদ্ধের সময় শত্রু পক্ষের দালালি করায় যারা নেতিয়ে পড়েছিল তারা আবার গা-ঝাড়া দিয়ে একত্র হতে লাগল। এর সঙ্গে এসে জুটলাে উঠতি বাঙালি শিল্পপতির দল। আর নৈতিক সমর্থন দিলাে মুজিবনগরের দক্ষিণপন্থী শিবির। তেহাত্তর সালে “হলিডে সম্পাদক জনাব এনায়েতউল্লাহ ঢাকা শহর থেকে “প্রদীপ’ মার্কা বাক্স নিয়ে সাধারণ নির্বাচনে অবতীর্ণ হলেন। নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীর লক্ষাধিক ভােটের মােকাবেলায় তিনি পেলেন সাড়ে পাঁচ হাজারের মতাে ভােট। তার জামানত পর্যন্ত বাজেয়াপ্ত হলাে। জনতার দরবারে জনপ্রিয়তার করুণ অবস্থা! এনায়েতউল্লাহ খান মাত্র মাস কয়েক চুপ রইলেন। তিনি এবার শেখ। মুজিবের সমালােচনা কিছুদিনের জন্য বন্ধ রাখলেন।
‘হলিডের পাতায় তখন এ মর্মে প্রতিবেদন হচ্ছে, দেশের অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের জন্য অর্থমন্ত্রী তাজউদ্দীন দায়ী। সরকারকে সমালােচনা না করে একজন মন্ত্রীর ঘাড়ে সব দোষ চাপিয়ে জনাব এনায়েতউল্লাহ গণভবনের সঙ্গে একটা যোগাযােগ স্থাপন করলেন। প্রেস ক্লাবে বসে মুখে শেখ মুজিবের সমালােচনা করলেও গােপনে তার সঙ্গে দেখা সাক্ষাৎ অব্যাহত রইল। ফলে অভিযুক্ত পাকিস্তানি এজেন্ট আসলামের ব্যাপারকে কেন্দ্র করে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে হলিডে সম্পাদকের যে পাসপাের্ট ‘সিজ’ করা হয়েছিল, তা আবার ফেরত দেয়া হলাে। এদিকে ঘটনা পরম্পরায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের আটোয়া, নিউ ইয়র্ক ও ওয়াশিংটন সফরের পর কিসিঞ্জারের উপমহাদেশ সফরের প্রাক্কালে মন্ত্রিসভা থেকে তাজউদ্দিন বিদায় নিতে বাধ্য হলেন। এতে একাত্তরের রাজাকার ও কোলাবরেটর এবং ধর্মান্ধ মহল ছাড়াও মুজিবনগরের দক্ষিণপন্থী নেতৃবৃন্দ আর চীন-সমর্থক গােষ্ঠী দ্বিগুণভাবে উৎসাহিত হলাে। ১৯৭৫ সালের শুরুতেই প্রেসিডেন্ট মুজিব প্রস্তাবিত একদলীয় বাকশাল শাসন ব্যবস্থার পরিপূরক হিসাবে সংবাদপত্রের সংখ্যা কমিয়ে নিয়মণ করতে আগ্রহী হলে ‘হলিডে’ পত্রিকার সম্পাদক জনাব এনায়েতউল্লাহ খসড়া-নীতি প্রণয়নের জন্য স্বেচ্ছায় এগিয়ে আসেন। কিছুদিনের জন্য তিনি গণভবনেই দফতর বসালেন। কিন্তু অল্প সময়ের মধ্যে বিধবাম হলাে। হঠাৎ করে একটা গােয়েন্দা রিপাের্ট প্রকাশ পেলাে যে, জনাব এনায়েতউল্লাহর গতিবিধি বেশ সন্দেহজনক। তিনি নিরাপত্তা আইনে গ্রেফতার হলেন। গ্রেফতারের প্রকৃত কারণ অজ্ঞতই রয়ে গেল।
মাস কয়েক পর তিনি মুক্তি লাভ করেন প্রভাবশালী মহলের তদ্বিরে। স্বাধীনতার পর ধীরে ধীরে প্রতিক্রিয়াশীল সাংবাদিকরাই ঢাকার পত্রপত্রিকাগুলাে দখল করে বসল। মােনেম খানের সমর্থক এবং আইয়ুব আমলে মুসলিম লীগের টিকিটে বুনিয়াদী গণতন্ত্রীদের ভােটে নির্বাচিত ও একাত্তরের কোলাবরেটর হিসাবে অভিযুক্ত খােন্দকার আবদুল হামিদ বঙ্গবন্ধুর মহানুভবতায় জেল থেকে ছাড়া পেয়ে এসে যােগ দিলেন দৈনিক ইত্তেফাক-এ। তখন এই পত্রিকার কার্যনির্বাহী সম্পাদক আসাফোদৌল্লা রেজা। বাংলাদেশ টাইম্স পত্রিকায় সহকারী সম্পাদক হিসাবে নিযুক্ত হলেন। মাহবুবুল আলম। শেখ মুজিবের বিরুদ্ধে ইয়াহিয়া খানের তথাকথিত ষড়যন্ত্র মামলায় জনাব আলম ছিলেন অন্যতম রাজসাক্ষী। মুক্তিযুদ্ধের সময় ইনি করাচীর “ডন” পত্রিকার ঢাকাস্থ প্রতিনিধি ছিলেন এবং ঢাকা বেতারকেন্দ্র থেকে নিয়মিতভাবে বঙ্গবন্ধু ও স্বাধীনতা সংগ্রামীদের বিরুদ্ধে প্রচার করেছিলেন। শেখ মুজিব প্রধানমন্ত্রী থাকাকালীন ইনি কিছুদিনের জন্য প্রেস সেক্রেটারি ছিলেন। পরে দালালী সংক্রান্ত রিপাের্ট প্রকাশ পাওয়ায় বঙ্গবন্ধু তাকে পদত্যাগে বাধ্য করেন। কিন্তু ক্ষমা প্রদর্শন করে বাংলাদেশ টাইম্স-এ যােগদানের অনুমতি দেন। সরকার নিয়ন্ত্রিত বাংলাদেশ অবজারভার পত্রিকায় এককালীন সম্পাদক ওবায়দুল হক সাহেব মুক্তিযুদ্ধের সময় ঢাকা বেতার ও টেলিভিশন থেকে বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিফৌজের বিরুদ্ধে প্রচারণা করেছেন। দেশ স্বাধীন হবার পর জনাব হক অবজারভার পত্রিকায় একটা বিশেষ কলামে নিয়মিতভাবে বঙ্গবন্ধুর বন্দনা শুরু করেন (ভয়েস অব থান্ডার)। এমনকি বঙ্গবন্ধুর প্রশস্তি গেয়ে বিরাট একটা ইংরেজি কবিতা পর্যন্ত লিখে ফেলেন। এখানেই শেষ নয়। সেই কবিতা আর্টিস্ট দিয়ে বড় বড় অক্ষরে লিখে ফ্রেমে বাঁধিয়ে এই ভদ্রলােক তা নিজ হাতে গণভবনের দেয়ালে টানিয়ে দিয়ে আসেন। প্রকাশ, আবার বঙ্গবন্ধু হত্যার পর ইনি বিশেষ সম্পাদকীয় লিখলেন, “দেশ এখন রাহুমুক্ত হলাে। একাত্তর সালে জেনারেল ইয়াহিয়া কারাগারে শেখ মুজিবকে আটক রেখে। রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযােগের যে মিথ্যা মামলা শুরু করেছিল, সে মামলার বাঙালি রাজসাক্ষীদের বঙ্গবন্ধু ক্ষমা প্রদর্শন করলেন। এদের মধ্যে জনাকয়েক হচ্ছেন সাংবাদিক।
আর এক সাংবাদিক হচ্ছেন জনাব আতিকুল আলম। ভারত-পাকিস্তান সিমলা-চুক্তির সময় বিশেষ কারণে বাংলাদেশ সরকার সাংবাদিকদের সিমলায় যেতে নিষেধ করে। প্রকাশ, জনাব আলম সরকারি অনুরােধ অগ্রাহ্য করে সিমলায় হাজির হন। পরে গােয়েন্দা রিপাের্ট-এর দরুন বাংলাদেশ সরকার তাকে গ্রেফতার করতে বাধ্য হয়। কিছুদিন পর বঙ্গবন্ধু তাকে দ্বিতীয় বারের মতাে ক্ষমা করে মুক্তির নির্দেশ দেন। কিছুদিন ইনি একটি বিদেশী সংবাদ সংস্থার ঢাকার ব্যুরাে চিফ এবং সংবাদদাতা হিসাবে কাজ করছেন। এসব বিবরণ থেকেই বােঝা যায় যে, বাংলাদেশের সংবাদপত্র, বেতার, টেলিভিশন, তথ্য মন্ত্রণালয় থেকে শুরু করে বিদেশ মন্ত্রণালয় পর্যন্ত সর্বত্র একই চেহারা বিরাজমান এবং জাতীয়তাবাদী সাংবাদিক গােষ্ঠীর কোণঠাসা অবস্থা। এ সময় একমাত্র দৈনিক জনপদ সম্পাদক আব্দুল গাফফার চৌধুরী বঙ্গবন্ধুর প্রস্তাবিত একদলীয় শাসন এবং সংবাদপত্র নিয়ন্ত্রণ নীতির সঙ্গে ভিন্ন মত হয়ে “ক্ষমা করাে প্রভু” সম্পাদকীয় লিখে আবার লন্ডনে পাড়ি জমালেন। তাই উদারমনা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের মহানুভবতার সুযােগে সমাজের প্রতিটি ক্ষেত্রে প্রতিক্রিয়াশীলদের একটার পর একটা ঘাটি তৈরি হলো। মুজিব হত্যার বছর কয়েক পরের কথা। ফার ইস্টার্ন ইকনমিক রিভিউ পত্রিকার সেই সাংবাদিক লরেন্স লিফসুজ বাংলাদেশের খড়যন্ত্রের রাজনীতি সম্পর্কে নিরলস গবেষণা করতে যেয়ে হতবাক হলেন। শেষ পর্যন্ত তিনি সাংবাদিকতা পেশাকেই বর্জন করলেন। রচনা করলেন সাড়া জাগানাে গ্রন্থ “বাংলাদেশ : দি আনফিনিশড রেভলিউশন”। বিপুল সংখ্যক ডি-ক্লাসিফাইড সি.আই.এ-দলিল এবং চাঞ্চল্যকর সাক্ষাৎকারের বিবরণে ভরপুর এই গ্রন্থে প্রকাশ পেলাে বহু গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির নাম আর অজানা তথ্য।
লিফসুজ লিখেছেন, “…মােশতাকের বেসরকারি নিয়ােগ-বদলীর মধ্যে আরেকটি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ নিয়ােগ হচ্ছে সরকার পরিচালিত ইংরেজি দৈনিক বাংলাদেশ টাইমস-এর সম্পাদক পদে এনায়েতউল্লাহ খানের নিয়ােগ। বাইরে বাহ্যতঃ নিয়ােগটা একটু অদ্ভুত। এনায়েতউল্লাহ খান প্রচণ্ড মুজিববিরােধী ছদ্ম বামপন্থী রবিবাসরীয় পত্রিকা ‘হলিডে’র সম্পাদক ছিলেন। এ সময় খানকে আদর্শগতভাবে মােহাম্মদ তােয়াহার পূর্ব বাংলা কমুনিস্ট পার্টির ঘনিষ্ঠ বলে গণ্য করা হতাে। “খান-এর আদর্শগত মত ছিল যে, মুজিবের আওয়ামী লীগ এবং তার সর্বশেষ সংস্করণ “বাকশাল ভারতের ছত্রছায়ায় লালিত। ভারত আবার সােভিয়েত ছত্রছায়ায় প্রতিপালিত। এজন্য প্রতিটি বাঙালি প্রগতিশীল ব্যক্তির দায়িত্ব হচ্ছে, আধিপত্যবাদ (সােভিয়েট ইউনিয়ন) এবং সম্প্রসারণবাদ (ভারত)এর প্রতি মুজিবের নতজানু অবস্থান-এর বিরােধিতা করা। “খন্দকার মােশতাক এই বিশ্লেষণের সাথে সম্পূর্ণ একমত ছিলেন। স্বয়ং কট্টর কম্যুনিস্ট বিরােধী হলে কী হবে, তার ডানপন্থী অভ্যুত্থানকে বামপন্থী হিসাবে ঘােষণাকারী ব্যক্তিরা সমর্থন করলে আপত্তির কারণ নেই।
“মােদ্দা কথায় মােশতাকের উদ্দেশ্য ছিল ফিল্ড মার্শাল আইয়ুব খার পুরনাে কায়দায় পশ্চিমা ঘেঁষা বুর্জোয়া আর পিকিংপন্থীদের মধ্যে ‘আঁতাত গড়ে তােলা। “১৯৬২-র পর থেকেই পিকিংপন্থীরা দক্ষিণ এশিয়ার ভারতের ক্ষমতাসীন গােষ্ঠীর বিরােধিতা করাই তাদের মূল দায়িত্ব হিসাবে গণ্য করেছে। শুধু তাই-ই নয়, এই বিরােধিতাকে এরা নিজের দেশের শাসক শ্রেণীর উৎখাতের চেয়েও বেশি গুরুত্ব প্রদান করেছে। শুধু তােয়াহার খাস লােক হিসাবেই নয়, যাট দশকের শেষের দিকে ভুট্টোর ঘনিষ্ঠ সহচর এনায়েতউল্লাহ খান ঠিক এ ধরনের ব্যক্তিত্ব।”… “অভূত্থানের (১৯৭৫-এর আগস্ট) সব চাইতে দৃষ্টিকটু পরস্পর বিরােধী ব্যাপারগুলােরও কোনাে সুচিন্তিত বিশ্লেষণের প্রচেষ্টা হলাে না। এখানে লক্ষণীয়, অভুথানের আগে দু’বছর ধরে দেশের বামপন্থী দলগুলাে যেমন জাসদ, ন্যাপ (ভাসানী), নিষিদ্ধ ঘােষিত সর্বহারা পার্টি মুজিব মানসের বিরুদ্ধে তীব্র জনমত গড়ে তুলেছিল। কিন্তু যখন এক সংকটজনক মুহূর্তে মুজিবের পতন ঘনিয়ে এল, তখন কোনাে বামপন্থী আন্দোলনের মাধ্যমে নয়, বরং একটা সংকীর্ণ ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত ডানপন্থী চক্রান্তের মাধ্যমেই মুজিব ক্ষমতাচ্যুত হলেন। “মুজিব সরকারের বিরুদ্ধে বামপন্থী দলগুলাে যে চ্যালেঞ্জ গড়ে তুলেছিল, আগস্টের (১৯৭৫) ঘটনাবলী সেসব পুরােপুরি ধামাচাপা দিয়ে দিলাে। মুজিবের নিজের দল, নিজের মন্ত্রী পরিষদ, দেশীয় সচিবালয় এবং দেশীয় গোয়েন্দা সংস্থাগুলাের ডানপন্থী মহল যখন উপলব্ধি করলাে যে, মুজিবের পক্ষে আর তাদের স্বার্থ সংরক্ষণ সম্ভব নয়, তখন তারা নিজেরা ভিতর থেকে চক্রান্ত করে এই অভ্যুত্থান ঘটাল।”
পাশ্চাত্য সাংবাদিক লিফসুজ-এর বিশ্লেষণ আর যৌক্তিকতার ভিত্তিতে একথা বলা যায় যে, প্রথমে খন্দকার মােশতাক এবং এর অব্যবহিত পরেই খালেদ মােশাররফ আর শেষ অবধি জিয়ার ক্ষমতা দখলের চাঞ্চল্যকর কর্মকাণ্ডের দিনগুলােতে বাংলাদেশের চীন-সমর্থক বামপন্থীরা কেবলমাত্র লেজুড় বৃত্তির ভূমিকা। পালন করে গেছে। ‘পজেটিভি’ কিছুই করতে পারেনি। অনেকের মতে এর পিছনে দুটো কারণ বিদ্যমান ছিল। প্রথমত, প্রচণ্ড রকমের রুশ-ভারত বিদ্বেষ এবং দ্বিতীয়ত, মুক্তিযুদ্ধের সময় এদের অনেকের বিতর্কমূলক ভূমিকা। এ ধরনের এক প্রেক্ষাপটে সমসাময়িক কালে ইংরেজি সাপ্তাহিক হলিডের পদাঙ্ক অনুসরণকারী সরকারি মালিকানার বাংলা সাপ্তাহিক বিচিত্রার কর্মকাণ্ড বিশেষভাবে লক্ষণীয়। এটা এমন একটা সময় যখন সপরিবারে মুজিব হত্যার পর খন্দকার মােশতাকের ৮৩ দিনের রাজত্বের অন্তিম অবস্থা। তখন এই সাপ্তাহিক পত্রিকার বেশ ক’জন সাংবাদিক হচ্ছেন খালেদ মােশাররফ-এর সমর্থক এবং এদের ব্যক্তিগত যােগাযােগ পর্যন্ত অক্ষুন্ন ছিল। কিন্তু ঘটনা পরম্পরায় ৭ই নভেম্বর খালেদ মােশাররফ-এর পতন ও হত্যা হবার পর বাংলাদেশ টাইমস এবং হলিডের মতাে সাপ্তাহিক বিচিত্রাও রাতারাতি জিয়া-সায়েম সরকারের প্রতি সমর্থনের হস্ত সম্প্রসারিত করল এবং পরােক্ষভাবে মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সন্তান খালেদ মােশাররফকে “হিন্দুস্থানী জাসুস’ (ভারতীয় গুপ্তচর) হিসাবে চিহ্নিত করলাে। অচিরেই সাপ্তাহিক বিচিত্রা জিয়া সরকারের আশির্বাদপুষ্ট হলো। ঘটনাপ্রবাহ সাক্ষ্য দেয় যে, এ সময় বিচিত্রা সম্পাদকের সঙ্গে জিয়ার তথ্য উপদেষ্টা জনাৰ আকবর কবীরের মতানৈক্যের সৃষ্টি হলে এই তথ্য উপদেষ্টাকেই পদত্যাগ করতে হয়। জিয়ার সামরিক সরকারের প্রতি মাত্রাতিরিক্ত “আনুগত্য” প্রদর্শনের উদগ্র বাসনায় ১৯৭৬ সালে সাপ্তাহিক বিচিত্রায় কল্পিত কাহিনী ভিত্তিক একটি প্রচ্ছদ প্রতিবেদন হচ্ছে, নির্বাসিত সম্পাদক আব্দুল গাফফার চৌধুরীর বিরুদ্ধে “লন্ডন ষড়যন্ত্র”।
এটাই ছিল সাপ্তাহিক বিচিত্রার ক্ষণস্থায়ী যৌবনকাল। তখন ছিল বিচিত্রার অঙ্গুলি হেলনের সময়। কিন্তু “সে রামও নেই, অযােধ্যাও নেই।” অনেকের মতে নানা ঘটনা প্রবাহে আশি দশকের শুরু থেকেই সাপ্তাহিক হলিডের মতাে বিচিত্রার প্রভাব দ্রুত হ্রাস পেতে শুরু করে এবং সম্প্রতি তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। এখন তাে বহু অনুরােধ-উপরােধ করে শেখ হাসিনার সাক্ষাৎকারও ছাপাতে হয়। এজন্যই পরিচ্ছদের শুরুতেই বলেছি যে, তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলােতে আইনসম্মত সরকারের পরিবর্তনকালে এক শ্রেণীর পত্র-পত্রিকার ভূমিকা বিশেষভাবে লক্ষণীয় বাংলাদেশও তার ব্যতিক্রম হয়নি। এ ধরনের প্রেক্ষাপটে ১৯৭৯ সালের ১৫ই আগস্ট শেখ মুজিবুর রহমানের চতুর্থ মৃত্যু বার্ষিকীতে ব্রিটেনের গার্ডিয়ান পত্রিকায় প্রকাশিত হলাে লিফসুজ-এর চাঞ্চল্যকর প্রতিবেদন ।
‘মুজিবকে যে সামরিক অভ্যুত্থানে সরানাে হয়েছিল তার পিছনের ষড়যন্ত্র -লরেন্স লিফসুজ “আমাদের এই সংসারে ঘটনা বলা হয়ে থাকে; আবার কখনও বা সাংবাদিকদের বদৌলতে পত্র-পত্রিকাতেও এসব ঘটনা প্রকাশিত হয়। কিন্তু এমন সব ঘটনা সংঘটিত হচ্ছে, যেসব ক্ষেত্রে বিদেশী সংবাদদাতারা প্রথম প্রচেষ্টায় সত্য উদ্ঘাটনে ব্যর্থ হয়ে থাকে। কেননা এসব ষড়যন্ত্রমূলক ঘটনাপ্রবাহ অনুধাবন করা খুবই জটিল এবং দুরূহ। এসবই হচ্ছে স্বীয় পদ্ধতিতে চালাকির হত্যাকাণ্ড আর বিশ্বাসঘাতকতায় ভরপুর। নানা দেশে আকস্মিক সংকটের মুহূর্তে যেসব সামরিক অভ্যুত্থান অথবা মধ্যরাত্রির হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হচ্ছে, ঠিক সে সময়ে পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত এতদসম্পর্কিত সংবাদগুলাে খুব কম ক্ষেত্রেই বস্তুনিষ্ঠ এবং বাস্তবভিত্তিক হয়ে থাকে। একবার স্বীয় পত্রিকার প্রথম পাতায় ফলাও (লরেন্স লিফসুজ: ফার ইস্টার্ন ইকনিমক রিভিউ’-এর দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার প্রাক্তন সংবাদদাতা) করে এসব খবর প্রকাশিত হওয়ায় খুব কম সাংবাদিকই রয়েছেন যাঁরা পরবর্তীকালে এসব রিপোর্ট যাচাই করে থাকেন এবং অনুধাবন করতে সক্ষম হন যে, আসল ঘটনা বেশ ভিন্নতর। “চার বছর আগে ১৯৭৫ সালের ১৪ই আগস্ট দিবাগত রাতে এ ধরনের এক ঘটনা ঘটেছিল। এ সময় বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা জাতীয়তাবাদী নেতা শেখ মুজিবুর রহমান এক সামরিক অভ্যুত্থানে নিহত হন। ‘দি গার্ডিয়ান’ (লন্ডন) পত্রিকার জন্য আমি আর মার্টিন ওলাকট এ সময় ঘটনা প্রবাহের বিস্তারিত রিপাের্ট পাঠিয়েছিলাম। ১৯৭৫ সালের ২৩শে আগস্ট ‘দি গার্ডিয়ান’-এর এটাই ছিল প্রধান শিরােনামের সংবাদ। এখন পিছনে তাকিয়ে দেখতে পাই যে, সে সময় অনেক কিছুই আমাদের নজর এড়িয়ে গেছে। কিন্তু আমাদের জানা ঘটনাবলী ছাড়াও আসলে সেখানে কী ঘটেছিল?
“প্রতি বছর গরমের সময় এ অঞ্চলে বঙ্গোপসাগর থেকে আর্দ্রতাপূর্ণ। বর্ষাকালীন আবহাওয়া প্রবাহিত হয়ে থাকে, আর বছরের ঠিক এমনি এক সময়ে এক গভীর রাতে এখানে সামরিক অভ্যুত্থান হলাে। সে দিনের সন্ধ্যা ছিল সম্পূর্ণ শান্ত। ঢাকার বিভিন্ন চায়ের স্টলে রাজনৈতিক আলােচনার বিষয়বস্তু ছিল একটাই এবং তা হচ্ছে পরদিন সকালে বিশ্ববিদ্যালয়ে মুজিবের প্রস্তাবিত বক্তৃতা সম্পর্কিত। এ সময় বাংলাদেশের জীবনযাত্রা মন্দ থেকে খারাপের দিকে এবং অনেকের চিন্তা ছিল যে, পরদিন হয়তাে বা কোনাে গােপন বামপন্থী দল বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুষ্ঠানে গোলমাল সৃষ্টি করবে। এছাড়া সেদিনের রাতটা ছিল গরমকালের অন্যান্য রাতের মতােই। | “তবুও আগস্টের সন্ধ্যারাত থেকে ঢাকার জীবনে আকস্মিকভাবে পরিবর্তন এল। ঠিক মধ্যরাত্রির পর রাজধানীর উপকণ্ঠে অর্ধ-সমাপ্ত দ্বিতীয় বিমানবন্দরের রানওয়ের দিকে মন্থর গতিতে এগিয়ে গেল বেঙ্গল ল্যানসার্স আর বাংলাদেশ আর্মার্ড কোর। প্রধান রানওয়েতে সারিবদ্ধভাবে দাঁড়ানাের পর এদের কমান্ডিং অফিসার মেজর ফারুক একটা ট্যাঙ্ক-এর উপর দাঁড়িয়ে বলল, আজ রাতেই মুজিব প্রশাসনকে হটাতে হবে। এটা ছিল একটা অনলবর্ষী বক্তৃতা এবং ফারুকের বক্তৃতা শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সবাই প্রস্তুত। এরা তিনটি কলামে বিভক্ত হয়ে বেরিয়ে পড়ল। ঘণ্টা তিনেকের মধ্যে মুজিব এবং তার পরিবারের প্রায় চল্লিশজন সদস্য হলেন নিহত। | “এ সময় ঘটনা সম্পর্কে প্রদত্ত বিভিন্ন বক্তব্য থেকে এটুকু জানা যায় যে, মাত্র দু’জন অফিসার তাদের কমান্ডের তিন শ’ জোয়ান নিয়ে মুজিবকে সরানাের কাজে লিপ্ত হয়েছিল। কিছু সংখ্যক অফিসার এবং তাদের সহযােগীদের ব্যক্তিগত আক্রোশের প্রতিশােধ গ্রহণই ছিল এই অ্যুত্থানের উদ্দেশ্য। এর সঙ্গে অবশ্য এ সময়ে মুজিব প্রশাসনের বিরুদ্ধে দুর্নীতি সম্পর্কে যে ব্যাপক রটনা হয়েছিল, তার পরিপ্রেক্ষিতে নৈরাশ্যজনক মনমানসিকতাও কাজ করেছিল।”
“এই সামরিক অভ্যুথানের প্রতিবেদন প্রকাশের সময় স্থানীয় কোনাে বাংলা সংবাদপত্র কিংবা বিদেশী পত্র-পত্রিকাগুলাে অতিরঞ্জিত কথাবার্তা ছাড়া প্রকৃত ঘটনার সন্ধান করল না। আলােচ্য অফিসাররা আগস্ট-এর আগে কাদের সঙ্গে এবং কোন কোন রাজনীতিবিদদের সঙ্গে যােগাযােগ স্থাপন করেছিল; এসবই সাংবাদিকরা অবজ্ঞা করল। ফলে কোনােরকম পূর্ব প্রণীত রাজনৈতিক পরিকল্পনা ছাড়াই শুধুমাত্র অফিসাররা নিজেরাই এ ধরনের কর্মকাণ্ড সংঘটিত করেছে বলে যেটুকু ভাষ্য রটেছিল সেটাই প্রতিষ্ঠিত হলাে। অথচ এটা ছিল ভ্রমাত্মক ও কল্পনা প্রসূত। “যেদিন ভােরে শেখ মুজিব সপরিবারে হত্যা হলাে, সেদিন তরুণ মেজররা যাকে প্রেসিডেন্ট হিসাবে ঘােষণা করলেন, তিনিই হচ্ছেন খন্দকার মােশতাক আহম্মদ। সাধারণভাবে একে আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরে দক্ষিণপন্থীদের প্রতিনিধি হিসাবে চিহ্নিত করা হয়ে থাকে। মুজিবের পতনের লক্ষ্য যে ভূমিকাই পালন করে থাকুন না কেন, অ্যুত্থানের পর মােশতাক সে ব্যাপারে গােপনীয়তা রক্ষার জন্য খুবই হুঁশিয়ার হলেন। ঘটনার সঙ্গে তার পূর্ব যােগাযােগ সম্পর্কে তিনি স্বীকার কিংবা অস্বীকার কোনােটাই করলেন না। তিনি এ বিষয়ের প্রকাশ্য আলােচনা একেবারেই পরিহার করলেন এবং স্বীয়। প্রশাসনের ভিত্তি সুদৃঢ় করতে সচেষ্ট হলেন। সামরিক অভ্যুথানের এক বছর পর, অর্থাৎ যখন তিনি নিজেই ক্ষমতাচ্যুত এবং দুর্নীতির অভিযােগে গ্রেফতার হবার আগে মােশতাক আমার কাছে বলেছেন যে, আগস্টের অভ্যুথান সম্পর্কে তিনি। কিছুই জানতেন না এবং যেসব মেজররা এ অত্যুত্থান করেছিল তাদের সঙ্গে তার। কোনাে পূর্ব সাক্ষাৎ হয়নি। কিন্তু মেজররা আমার কাছে যেসব কথাবার্তা বলেছে, তা সম্পূর্ণ ভিন্নতর।
“মেজররা নিশ্চিত করে বলেছে যে, মােশতাক ও তার সহযােগীদের সঙ্গে। মেজরদের আগে থেকেই যােগাযােগ ছিল এবং অভ্যুত্থানের পূর্বে বৈঠক হয়েছে। বাঙালি ওয়াকেফহাল মহল এবং স্থানীয় বিদেশী কূটনীতিক সূত্রগুলাে এখন এ মর্মে দাবি করছে যে, মুজিবকে ক্ষমতাচ্যুত করার লক্ষ্যে এক বছরের বেশি সময় থেকে মােশতাক এবং তার রাজনৈতিক বন্ধুরা এসব কর্মকাণ্ডে জড়িত ছিলেন। স্থানীয় বাঙালি সূত্র এবং ঢাকাস্থ মার্কিন দূতাবাসের উচ্চ পদস্থ কর্মচারীদের কাছ থেকে প্রাপ্ত তথ্যে দেখা যায় যে, মুজিবকে হত্যার অ্যুথান সম্পর্কে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র পূর্ব থেকে অবহিত ছিল। এমনকি মুজিব হত্যার ছ’মাস আগে মার্কিনী দূতাবাসের কর্মচারীরা ষড়যন্ত্রে লিপ্ত ব্যক্তিদের সঙ্গে আলােচনা পর্যন্ত করেছেন। মার্কিন দূতাবাসের জনৈক উর্ধ্বতন কূটনীতিবিদ-এর মতে শেখ মুজিবকে উৎখাতের ব্যাপারে আগ্রহী বাঙালি ব্যক্তিবর্গ ঢাকার মার্কিন দূতাবাসের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সঙ্গে যােগাযােগ অব্যাহত রেখেছিল। ১৯৭৪ সালের নভেম্বর থেকে শুরু করে ১৯৭৫ সালের জানুয়ারি মাস পর্যন্ত সংশ্লিষ্ট এসব লােকদের সঙ্গে দূতাবাসের কর্মকর্তাদের বেশ কিছু বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। এসব বৈঠকের উদ্দেশ্য ছিল—যদি বাংলাদেশে বাস্তবেই অভ্যুত্থানের মাধ্যমে একটি রাজনৈতিক পট : পরিবর্তন ঘটে যায়, সেক্ষেত্রে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সরকারের মনােভাব কী হবে সেটা অনুধাবন করা। “যখন ওয়াশিংটনে বসে চার্চ ও পাইক-এর কংগ্রেসীয় কমিটি সিআইএ পরিকল্পিত বিদেশী নেতৃবৃন্দের হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে শুনানী গ্রহণ করছিল, ঠিক তখনই ষড়যন্ত্রকারীদের সঙ্গে যােগাযােগ (ঢাকায় মার্কিন দূতাবাস কর্মচারী ও ষড়যন্ত্রে লিপ্ত ব্যক্তিদের) স্থাপিত হয়। আলোচ্য কমিটির শুনানী মার্কিনী কূটনীতিবিদ এবং গােয়েন্দা-ব্যুরােক্রেটদের উপর প্রভাব বিস্তার করেছিল।
এতে করে দারুণ উৎকণ্ঠা ও অস্থিরতার সৃষ্টি হয়। মার্কিন সংবাদপত্রগুলাে এ মর্মে ভবিষ্যদ্বাণী করছিল যে, চিলি এবং অনান্য জায়গায় বেআইনী ও গুপ্ত কর্মকাণ্ডের জন্য আমেরিকান গোয়েন্দা অফিসারদের জেলের মুখােমুখি হতে হবে। “সিনেটের শুনানীর দরুন উদ্ভূত পরিস্থিতিতে ১৯৭৫ সালের জানুয়ারি মাসে ঢাকায় মার্কিন দূতাবাসে একটি সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। জনৈক উচ্চপদস্থ কর্মচারীর মতে । “আমরা দূতাবাসের কর্মীরা নিজেদের মধ্যে এ মর্মে এক সমঝোতায় উপনীত হই যে, আমরা এ ধরনের কর্মকাণ্ডের সঙ্গে আর জড়িত থাকব না এবং ওই সব লােকদের সঙ্গে সম্পর্কচ্ছেদ করব।” “যদিও মার্কিন দূতাবাসে উচ্চ পর্যায়ে এ মর্মে সিদ্ধান্ত হয় যে, তারা কোনােভাবেই মুজিব বিরােধীদের সঙ্গে কোনাে রকম যােগাযােগ রক্ষা করবে না’ তবুও পরবর্তীকালে মার্কিনী কর্মকর্তাদের সাক্ষাৎকারে প্রকাশ পায় যে, এদের মধ্যেই এ প্রশ্নে বিতর্কের সূচনা হয়। দূতাবাসের যারা আগের বৈঠকগুলাে সম্পর্কে অবহিত ছিলেন, তাদের এখনকার বক্তব্য হচ্ছে যে, তারা ১৯৭৫ সালের গোড়ার দিকের বৈঠক ও ঘটনাবলী ছাড়া আর কিছুই জানেন না। অন্যান্যদের বক্তব্য কিছু ভিন্নতর। এদের কথা হচ্ছে, যারা “নিষ্কলুষ” থাকতে আগ্রহী তাদের কূটনৈতিক পর্যায়ে যােগাযােগ ছিন্ন হলেও মার্কিনী দূতাবাসের সিআইএ প্রধান ফিলিপস চেরি এবং অন্যান্য স্টেশন এজেন্টদের সঙ্গে চক্রান্তকারীদের যােগাযোগ সুষ্ঠুভাবেই কাজ করছিল। “আমার সঙ্গে সাক্ষাৎ করে চেরি তার বিরুদ্ধে আনীত অভিযােগ পরিষ্কারভাবে অস্বীকার করেন। তার কথা হচ্ছে, “বাঙালিরা নিজেরাই এসব করছিলাে।” ফিলিপস আরও বলল, এটা ধারণা করা বােকামী যে, কোনাে বিদেশী সরকার জড়িত থাকলেই কেবল একটা অভূত্থান ঘটাতে পারে। প্রায় সব অদ্যুথানের পিছনেই নিজেদের স্থানীয় লােক সক্রিয়ভাবে কাজ করে থাকে। বাংলাদেশেও এর ব্যতিক্রম হয়নি। বাঙালিরা নিজেরাই তা করেছিল। “মােশতাকের সঙ্গে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের যােগসাজশ বা আঁতাত সম্পর্কে চেরিকে প্রশ্ন করলে তিনি জবাবে বললেন, “কিছু রাজনীতিবিদ এমনিতেই বিদেশী – দূতাবাসে খুব বেশি যাতায়াত করে থাকে। সম্ভবত সেখানে তাদের যােগাযোগের ব্যাপারও থাকতে পারে। তারা মনে করে থাকে যে, তাদের যােগাযােগ রয়েছে।
তাই বলে কোনাে অভুথানের ব্যাপারে কোনাে দূতাবাসের সহযােগিতার জন্য জড়িত হবে এমনটি মনে করা সঠিক হবে না।” “খন্দকার মােশতাকের যােগাযােগ ছিল, এ ধরনের চিন্তা করার পিছনে খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভিত্তি রয়েছে। পাকিস্তানের গৃহযুদ্ধের ঘটনাবলী সম্পর্কে যারা অবহিত রয়েছেন, তাদের মধ্যে বছরের পর বছর ধরে এ ধরনের গল্প-কাহিনী চালু ছিল যে, ১৯৭১ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যােগাযােগ স্থাপন করেছিল। যা হােক, এই যােগাযােগের অস্তিত্বের সঠিকতা সম্পর্কে নিশ্চিত কোনাে খবরই ছিল না। কিন্তু ওয়াশিংটন ভিত্তিক অন্যতম মার্কিন পররাষ্ট্র নীতি সম্পর্কিত গবেষণা প্রতিষ্ঠান “কার্নেগী এন্ডাওমেন্ট ফর ইন্টারন্যাশনাল পিস’-এর স্টাডি কমিশন-এর অপ্রকাশিত দলিলে দেখা যায় যে, নিশ্চিতভাবে এ ধরনের যােগাযােগ (মুজিবনগরে মােশতাক উপদল এবং কোলকাতায় মার্কিনী দূতাবাস) স্থাপিত হয়েছিল। “১৯৭১ সালে বাংলাদেশ সংকটের সময় কোন প্রেক্ষাপটে এবং প্রক্রিয়ার মাধ্যমে মার্কিনী নীতি গণহত্যার পরিস্থিতি সৃষ্টিকারী পাকিস্তানের দিকে হেলে পড়লো, তা মূল্যায়ন করার লক্ষ্যে ১৯৭৩ সালে কার্নেগী এন্ডাওমেন্ট’-কে দায়িত্ব দেয়া হলাে। কিন্তু কার্নেগীর অভ্যন্তরীণ মতবিরােধের দরুন নয় মাস পর্যন্ত কাজ হবার পরও এই ‘স্টাডি’ (রিপাের্ট) সম্পূর্ণ হলাে না। অথচ ইতিমধ্যে স্টেট ডিপার্টমেন্ট থেকে শুরু করে সিআইএ পর্যন্ত ১৫০ জনের বেশি উচ্চপদস্থ কর্মচারীর বিস্তারিত সাক্ষাৎকার নেয়া হয়েছিল। ‘কার্নেগী দলিলগুলােতে একটি বিষয় নিশ্চিত করে বলা হয়েছে যে, ১৯৭১ সালে কোলকাতায় বাংলাদেশ অস্থায়ী সরকার-এর একটি উপদলের সঙ্গে গােপনে যােগাযােগ স্থাপন করা হয়েছিল। এদের আশা ছিল, স্বাধীনতা আন্দোলনকে দ্বিধাবিভক্ত করে পূর্ণ স্বাধীনতার চেয়ে কিছুটা কমের মাত্রায় পাকিস্তানের সঙ্গে মীমাংসা করিয়ে দেয়া। মার্কিনীরা কোলকাতায় আওয়ামী লীগের মােশতাক উপদলের সঙ্গে যােগাযােগ স্থাপন করেছিল এবং বিষয়টি ছিল খুবই স্পর্শকাতর ও নাজুক ধরনের।
কেননা, এরা তখন অস্থায়ী সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদকে ডিঙিয়ে এগিয়ে গেছে। “প্রকৃতপক্ষে তাজউদ্দিন এবং সমগ্র বাঙালি নেতৃত্বই পূর্ণ স্বাধীনতার জন্য অটল ছিল। পাকিস্তানি কর্তৃপক্ষের ১৯৭১-এর মার্চ মাসের নির্বাচনী ফলাফল (এতে মুজিব হতাে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী) গ্রহণে অস্বীকৃতি এবং নৃশংস ও ভয়াবহ দমন নীতির ফলে অস্থায়ী সরকারের নীতি ছিল পরিষ্কার ও শর্তহীন । বাংলাদেশের পূর্ণ স্বাধীনতা ছাড়া কোনাে আলােচনাই হইবে না। “নির্বাসিত বাঙালি নেতৃবৃন্দের মধ্যে একমাত্র ব্যতিক্রম হচ্ছেন খন্দকার মােশতাক আহম্মদ। এ সময়ে হেনরি কিসিঞ্জার (মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রী) পাকিস্তানি সামরিক জান্তার যােগসাজশে একই সঙ্গে দুটি কাজ করছিল। তিনি পাকিস্তানি চ্যানেল-এর মাধ্যমে তার রাজনৈতিক জীবনের সবচেয়ে নাজুক যােগাযােগ অর্থাৎ চীনের সঙ্গে কথাবার্তা শুরু করছিলেন এবং স্বাধীনতার প্রশ্নে নির্বাসিত আওয়ামী লীগ সরকারকে দ্বিধাবিভক্ত করার কর্মকাণ্ডে লিপ্ত হয়েছিলেন। সম্পূর্ণ সতর্কতা এবং গােপনীয়তা রক্ষাই ছিল বাঙালি নেতৃবৃন্দকে দ্বিধাবিভক্ত করার মূল চাবিকাঠি। উপরন্তু আলােচ্য কর্মকাণ্ডের লক্ষ্য ছিল, যে বিশেষ উপদল পূর্ণ স্বাধীনতার দাবি না করে পাকিস্তানের সঙ্গে সমঝােতায় সম্মত রয়েছে সেই উপদলকে সমর্থন করা। “যা হােক, ১৯৭১-এর অক্টোবরে মােশতাকের এই গােপন যােগসাজশ আবিস্কৃত হয় এবং কোলকাতায় তাঁকে কার্যত গৃহবন্দি করে রাখা হয়। “১৯৭১ সালে স্বাধীনতার পর মুজিব স্বীয় অসতর্কতার দরুন মােশতাককে ক্ষমা প্রদর্শন করলেন। কিন্তু স্বাধীনতা উত্তর যুগে তাকে গুরুত্বহীন পদের দায়িত্ব দিলেন না। তবুও চার বছর পরে তার কোলকাতার যােগসাজশ-এর দিনগুলাের দুজন নেতৃস্থানীয় আশ্রিত ব্যক্তিত্ব যথাক্রমে মাহবুব আলম চাষী এবং তাহেরউদ্দিন ঠাকুরকে নিয়ে এক অভ্যুত্থানের নেতৃত্ব প্রদান করলেন আর এই অ্যুত্থানে মুজিব নিহত হলেন।
অভ্যুত্থানের অব্যবহিত পরে মােশতাক ব্যুরােক্রেসি এবং জাতীয় গােয়েন্দা সংস্থার গুরুত্বপূর্ণ পদগুলােতে এমন সব লােকদের নিয়ােগ করলেন যারা ১৯৭১ সালে ছিলেন বাঙালি ‘ভিচি’ (ফ্রান্সের সেই ভয়াবহ ‘ভিচি’ শাসনামল)। ১৯৭১-এর মার্চে ঢাকায় পাকিস্তানের হামলা শুরু হলে বাঙালি জনসংখ্যার যে ক্ষুদ্র ভগ্নাংশ পাকিস্তানি সৈন্যদের সঙ্গে রীতিমতাে সহযােগিতা করেছিল, এরা হচ্ছেন তারাই। “এদের মধ্যে জাতীয় নিরাপত্তা গােয়েন্দা সংস্থার মহাপরিচালক এ বি এস সফদার এবং গৃহযুদ্ধের সময় পূর্ব পাকিস্তান সরকারের প্রাক্তন চিফ সেক্রেটারি শফিউল আজম অন্যতম। পাকিস্তানি জামানায় যে সুসংগঠিত দক্ষিণপন্থী রাজনৈতিক ও বুদ্ধিজীবী মহলের অভ্যুদয় হয়েছিল এবং ১৯৭১ সালে স্বাধীনতার পর মুজিব যাদের সরিয়ে দিয়েছিলেন, তারা শেষ অবধি মুজিবের নিজস্ব পার্টির একটি উপদলের সহযােগিতায় ১৯৭৫-এর আগস্ট মাসে সংঘটিত অভ্যুত্থানের মাধ্যমে নিজেদের ক্ষমতায় পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করলেন। “১৯৭৫ সালের আগস্টে বাংলাদেশে অনুষ্ঠিত ঘটনাবলীকে যতটুকু সহজভাবে উপস্থাপিত করা হয়েছে, বাস্তবে কোনাে অবস্থাতেই সেগুলাে তত সহজ ছিল না। এ সময় বাঙালি এবং বিদেশী পত্র-পত্রিকাগুলাে একটি সহজ ভাষ্য গ্রহণ করেছিল।
“মুজিবের প্রশাসন বিপদে পতিত হয়েছিল। এটা এমন এক সময় ছিল, যখন এ দেশটি সবেমাত্র একটি দুর্ভিক্ষের মােকাবেলা করেছে। আলােচ্য দুর্ভিক্ষে প্রায় ৫০,০০০ কৃষকের মৃত্যুর জন্য সরকারি ব্যর্থতা আর দুর্নীতিকে দায়ী করা হলাে। এ সময় কর্তৃপক্ষীয় নির্দেশে ক্রমাগতভাবে গণতান্ত্রিক অধিকার হ্রাস করা হচ্ছিল। এরা মুজিব বিরােধীদের সরিয়ে ফেলার লক্ষ্যে পত্র-পত্রিকাগুলাে বন্ধ করে দিচ্ছিল। বেসামরিক ক্ষেত্রে অসন্তোষ এবং গ্রামাঞ্চলে সশস্ত্র বিদ্রোহ ক্রমবর্ধমান সমস্যার সৃষ্টি করেছিল। এ ধরনের এক প্রেক্ষাপটে যে ভাষ্য সাংবাদিকদের কাছে উপস্থাপিত করা হলাে, তা হচ্ছে-ছ’জন তরুণ মেজর তাদের কমান্ডে ৩০০ লােকবল নিয়ে নিজেদের উদ্যোগেই একটি অ্যুথান সংঘটিত করেছে। এর পিছনে ছিল ব্যক্তিগত আক্রোশ থেকে শুরু করে ইসলামি ‘বােনােপার্টিজম’-এর সংমিশ্রিত নিজস্ব ভ্রমাত্মক ‘মােটিভ। “আলােচ্য ভায্যে এ মর্মে একটি বিষয়ে বিশেষ জোর দেয়া হলাে যে, এরা (মেজররা) নিজেরাই একক সিদ্ধান্তে কাজ করেছে। মুজিব হত্যার পর এরা হঠাৎ করেই খন্দকার মােশতাককে উঠিয়ে এনে প্রেসিডেন্টের গদিতে স্থলাভিষিক্ত করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। মােশতাকের অবস্থা এমনভাবে বর্ণনা করা হয়। যেন বেচারা হচ্ছে ঘটনাচক্রের শিকার। কিন্তু ঘটনার প্রায় এক বছর পরেও একথা সঠিকভাবে পরীক্ষা করে দেখা হয়নি যে, মােশতাক নানা যােগসূত্রের মাধ্যমে এ ধরনের একটি জটিল পরিকল্পনায় অংশ গ্রহণ করেছিলেন কিনা।
অবস্থাদৃষ্টে এটুকু মনে হয়, যেসব সামরিক ব্যক্তিত্ব প্রকৃতপক্ষে মুজিবকে হতী করেছে, তাদের মোশতাক-চক্রের প্রণীত পরিকল্পনায় মাচের শেষের দিকে কিংবা এপ্রিল মাসে (১৯৭৫) নিশ্চিতভাবে জড়িত করা হয়। অবশ্য এর আগে থেকেই মেজরদের নিজস্ব চিন্তাধারা ছিল। কিন্তু এসবের পশ্চাতে রাজনৈতিক সমর্থনের অভাব ছিল বিদ্যমান। এ সময় মােশতাক এবং তার নিজস্ব রাজনৈতিক চক্র নিজেদের কৌশলের সঙ্গে সমন্বয় সাধনের লক্ষ্যে অত্যন্ত সর্তকতা অবলম্বন করে সামরিক যােগসূত্রগুলাে পরীক্ষার প্রক্রিয়া অব্যাহত রেখেছিল। যখন একজন মেজর ছিল মােস্তাকেরই আত্মীয়, তখন প্রাথমিক পর্যায়ে মােস্তাকের গ্রুপের লক্ষ্য ছিল সিনিয়র সামরিক অফিসার দিয়ে অ্যুত্থান ঘটানাে। “এসব ঘটনা প্রবাহ সম্পর্কে যথেষ্ট ওয়াকিফহাল, বাংলাদেশের এ ধরনের সামরিক সূত্রের মতে তৎকালীন সামরিক বাহিনীর উপ-প্রধান মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানকে (জিয়া) প্রস্তাব করা হয়েছিল। বর্তমানে (১৯৭৯) জিয়াউর রহমান রাষ্ট্র প্রধান। সামরিক সূত্রের আরও কথা হচ্ছে, ১৯৭১ সালে কোলকাতায় মােশতাকের বিশ্বস্ত সহকারী এবং তৎকালে মার্কিনীদের সঙ্গে প্রধান যােগাযােগ রক্ষাকারী মাহবুব আলম চাষী এবার জিয়ার সঙ্গে যােগাযােগ স্থাপন করেন। “এসব সূত্রের মতে প্রস্তাবিত অভুথানের ব্যাপারে জেনারেল জিয়া আগ্রহ দেখালেও প্রয়ােজনীয় সামরিক ব্যবস্থা গ্রহণের নেতৃত্বদানে অনীহা প্রকাশ করেন। পরবর্তীকালে মেজর রশিদ ও ফারুক ১৯৭৫ সালের ২০শে মার্চ জিয়াকে আবার প্রস্তাব করেন। রশিদ এ মর্মে জিয়াকে অবহিত করেন যে, জুনিয়র অফিসাররা ইতিমধ্যেই প্ল্যান করে ফেলেছে এবং তারা জিয়ার কাছ থেকে শুধুমাত্র সমর্থন ও নেতৃত্ব কামনা করছে। রশিদের মতে এ সময় জিয়া তাদের বলেছিল যে, একজন সিনিয়র অফিসার হিসাবে তাঁর পক্ষে সরাসরি এ ব্যাপারে জড়িত হওয়া সম্ভব নয়। কিন্তু জুনিয়র অফিসাররা তৈরি হয়ে থাকলে তাদের এগিয়ে যাওয়া বাঞ্ছনীয়।
“প্রস্তাবিত অখানের নেতৃত্ব দানের প্রশ্নে সিনিয়র অফিসারদের কাছ থেকে ব্যর্থ হয়ে মােশতাক এপ জুনিয়র অফিসারদের ষড়যন্ত্রে অগ্রসর হলাে। যদিও এরা একজন সিনিয়র অফিসারের নেতৃত্বের অভ্যুথানে আগ্রহী ছিল, তবুও দ্বিতীয় বিকল্পকেই বেছে নিতে হলাে। জিয়ার নিরপেক্ষতা কিংবা পরােক্ষ সমর্থন থেকে এটুকু পরিষ্কার হলাে যে, সামরিক অভ্যুত্থানের পর জিয়া অন্তত স্বীয় ফোর্স দিয়ে এদের হটিয়ে দিবে না। “আলােচ্য পরিকল্পনা এপ্রিল মাস থেকে এগিয়ে চললাে পূর্ণতার দিকে। আগস্ট অভূত্থানের তিন মাস পরে নতুন ধরনের উত্থান-পতনের মাঝ দিয়ে একজন সামরিক লৌহ-মানব হিসাবে জিয়াই দেশের ক্ষমতা দখল করল এবং শেষ অবধি মােশতাককে গ্রেফতার করে নিক্ষেপ করল কারাগারে। মােশতাক এখনও (১৯৭৯) কারাগারেই রয়েছেন। সামরিক অভ্যুত্থানের পর থেকে উল্লিখিত সময়ের বিদ্যমান পরস্পর বিরােধী উপসর্গগুলাে সম্পর্কে খুব কমই মূল্যায়ন করা হয়েছে। অভূত্থানের দুবছর আগে থেকেই এসবের পাশাপাশি পুরােদস্তুরভাবে অবস্থানকারী বিষয়গুলাে লক্ষই করা হয়নি। এসব হচ্ছে, শক্তি সঞ্চয়কারী জাসদ (জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল), ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ভাসানী) এবং সর্বহারা পার্টির মতাে গােপন দলগুলাে। এরা মুজিব প্রশাসনের বিরুদ্ধে জনমত সংগঠনে লিপ্ত ছিল। তবুও মুজিবের অন্তিম সময়ের সংকটজনক মুহূর্তে বামপন্থী গণ-অভুথানের অনাকাক্ষিত “বিপ্লব” সংঘটিত হলো না।
কিন্তু যা বাস্তবায়িত হলাে তা হচেছ, স্বল্প সমর্থন-ভিত্তিক দক্ষিণপন্থী ষড়যন্ত্র। “উদ্ভূত পরিস্থিতির মােকাবেলায় গােড়া জাতীয়তাবাদী শক্তিগুলাে যে চ্যালেঞ্জের প্রস্তুতি নিয়েছিল, আগস্ট-এর পরবর্তী ঘটনা প্রবাহে সেসব বিলীন হয়ে গেল। মুজিবের নিজস্ব পার্টির দক্ষিণপন্থী উপদল, তার মন্ত্রিসভা, তার সচিবালয় এবং তার নিজস্ব জাতীয় গােয়েন্দা সার্ভিস থেকে এই অ্যুথানের মদদ জোগানাে হয়েছে। এদের বক্তব্য হচ্ছে যে, মুজিবের নেতৃত্বে উগ্র বামপন্থী চ্যালেঞ্চের মােকাবেলা সম্ভব নয়। অথচ এখানেই এদের আসল শ্রেণী স্বার্থ জড়িত রয়েছে। “মার্কিন কংগ্রেসের জারিকৃত যে পরােয়ানায় হাজিরা বাধ্যতামূলক, এ ধরনের সমন ইস্যু করে সংশ্লিষ্ট সিআইএ কর্মচারীদের এনে জবানবন্দি লিপিবদ্ধ করা প্রয়ােজন। অতঃপর স্টেট ডিপার্টমেন্টের তথ্যাদি সন্নিবেশিত করে স্থির সিদ্ধান্তে না আসা পর্যন্ত একথা বলা যাবে না যে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এসব পরিকল্পনা সম্পর্কে পূর্ব থেকে অবহিত ছিলাে। কিন্তু সন্দেহাতীতভাবে একথা বলা যায় যে, সামরিক অভ্যুত্থানের রাজনৈতিক এবং গােয়েন্দা বিভাগীয় নেতৃত্বের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ পূর্ব সম্পর্ক বজায় ছিল। “বাংলাদেশে মুজিবুর রহমানের বিদায় এবং চার বছর পর পাকিস্তান থেকে ভূয়োর বিদায় বিশেষভাবে লক্ষণীয়। অনুন্নত এবং মারাত্মকভাবে পিছিয়ে পড়া সমাজ ব্যবস্থায় উদ্ভূত পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে যে সামাজিক গণতন্ত্রের লক্ষ্যকে জনগণের আশা-নিরাশা বলয় সৃষ্টি করে রেখেছিল, সেই যুগের অবসান হলাে। একটা পুরনাে ও দুষ্ট ক্যানসার ব্যাধির মতাে সামরিক ও ব্যুরােক্রেটিক একনায়কত্ব বাংলাদেশ ও পাকিস্তান এই দুই দেশের সমাজ ব্যবস্থায় প্রত্যাবর্তন করে জেঁকে বসল।
“১৯৬০-এর দশকে মুজিবুর রহমানের মতাে গণতন্ত্রমনা ব্যক্তিত্বসহ বহু সংখ্যক গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্রের সমর্থকদের স্থান হয়েছিল কারাগারে। “কেবলমাত্র যখন দেশের জনগােষ্ঠী রাজনৈতিকভাবে সচেতন হয়ে উঠলাে, তখন জনগণের রাজনীতির জোয়ারে সামরিক একনায়কত্ব ব্যারাকে প্রত্যাবর্তন করল। এখন এই দুটি সমাজ ব্যবস্থাতেই আবার এদের পক্ষে চাকা ঘুরতে শুরু করেছে। তবে একথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, সামরিক কর্তৃত্বে অনুষ্ঠিত নির্বাচন হচ্ছে জেনারেলদের নিয়ম মাফিক প্রক্রিয়া। এ ধরনের এক বিরাজমান প্রেক্ষাপটে জনপ্রিয় “নিউ ডেমােক্রেসি”-র (জনগণের নির্বাচন) বাস্তবায়ন সম্ভবপর নয় এবং এই মােহও কারাে থাকা উচিত নয়। এ “বাংলাদেশের ক্ষেত্রে কিসিঞ্জার-এর “নিরাপত্তার দূরদৃষ্টি এবং মার্কিনী শক্তির হস্তক্ষেপে এদেশের অতীতের একনায়কত্বমূলক পদ্ধতিকে ফিরিয়ে এনেছে কিনা সে ব্যাপারে শেষ পর্যায়ে বিস্তারিতভাবে পরীক্ষান্তে প্রকৃত সত্যের উন্মােচন করতে হবে। অবশ্য যতদিন পর্যন্ত মাত্র অর্ধযুগ আগে সংঘটিত ইতিহাসের ঘটনাবলীর প্রকৃত তথ্য উদ্ঘাটিত না হয়, ইত্যবসরে ততদিন পর্যন্ত বাংলাদেশে “সামরিক গণতন্ত্রের সুদীর্ঘ অমানিশা অব্যাহত থাকবে।” (১৯৭৯ সালের ১৫ই আগস্ট-এ ‘দি গার্ডিয়ান পত্রিকায় প্রকাশিত সাংবাদিক লরেন্স লিফসুজ-এর স্বনামে লিখিত নিবন্ধের বাংলা ভাবানুবাদ। ফার ইস্টার্ন ইকনমিক রিভিউ’ পত্রিকায় প্রাক্তন দক্ষিণ-পূর্ব এশীয় সংবাদদাতা লিফসুজ-এর আলােচ্য নিবন্ধের শিরােনাম, শেখ মুজিবকে যে সামরিক অভ্যুত্থানে সরানাে হয়েছিল তার পিছনের ষড়যন্ত্র। পরবর্তীকালে লিফসুজ আলােচ্য নিবন্ধের ভিত্তিতে রচনা করেন বাংলাদেশ সম্পর্কিত তার চাঞ্চল্যকর গ্রন্থ “বাংলাদেশ : দি আনফিনিশড রেভলিউশন”। সাংবাদিক লিফসুজ-এর বর্ণিত ষড়যন্ত্রে মার্কিনী যােগসাজশ সম্পর্কিত অতিরিক্ত তথ্যাদি অত্র পুস্তকের পরিশিষ্টে সংযােজিত হয়েছে।-লেখক
সূত্রঃ মুজিবের রক্ত লাল – এম আর আখতার মুকুল