You dont have javascript enabled! Please enable it!

ম্যাসকানহাস-এর লেখনীতে সপরিবারে প্রেসিডেন্ট মুজিব হত্যার বীভৎস কাহিনী

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নৃশংস হত্যাকাণ্ডের প্রস্তুতি এবং শেষ পরিণাম সম্পর্কে ব্রিটেনে বসবাসকারী প্রাক্তন পাকিস্তানি সাংবাদিক এ্যান্থনী ম্যাসকার্নহাস (সপ্রতি পরলােকগত)-এর বরাতে কিছু তথ্য এখানে উপস্থাপন করা সমীচীন হবে। ১৯৭৬ সালে লন্ডনের ইন্ডিপেনডেন্ট টেলিভিশনের (আইটিভি) পর্দায় সাংবাদিক ম্যাসকার্নহাস প্রায় এক ঘণ্টাকাল কর্নেল ফারুক ও কর্নেল রশিদের। সাক্ষাৎকার গ্রহণ করেছিলেন। এই চাঞ্চল্যকর সাক্ষাৎকার অনুষ্ঠানে ফারুক ও রশিদ প্রকাশ্যে মুজিব হত্যার স্বীকৃতি দেয়া ছাড়াও নৃশংস হত্যাকাণ্ডের বিবরণ ও নিজেদের বক্তব্য পেশ করেন। অনুষ্ঠান চলাকালে এই প্রথমবারের মতাে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের রক্তাক্ত লাশের স্থির আলােকচিত্র প্রদর্শিত হয়। তাহলে প্রশ্ন থেকে যায় কেন এমনটি হয়েছিল? পরবর্তীকালে অনেকে এ মর্মে মত প্রকাশ করেছেন যে, আসলে এ সময়টা ছিল ৭৭-এর সামরিক অভ্যুত্থানের (ব্যথ) প্রস্তুতি পর্ব। প্রকাশ, লন্ডন, বেনগাজী এবং ব্যাংকক-এ অফিস খুলে এদের কর্মকাণ্ড এ সময় পুরােদমে শুরু হয়েছিল। তাই সবার দৃষ্টি অন্যত্র সরিয়ে আনাই ছিল আলােচ্য টিভি সাক্ষাৎকারের অন্যতম উদ্দেশ্য এবং স্বাভাবিকভাবেই ম্যাসকার্নহাস এসব ব্যাপারে মােটামুটি অবহিত ছিলেন। | সে যা-ই হােক। এ্যান্থনী ম্যাসকাহাস পরবর্তীকালে তাঁর রচিত বিতর্কিত “এ লিগাসি অব ব্লাড’ গ্রন্থে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের যে বিবরণ দিয়েছেন তারই অংশ বিশেষ এখানে উপস্থাপন করা হলাে। সময় : রাত ১০টা। তারিখ : ১৪ই আগস্ট ১৯৭৫ স্থান : ঢাকার নতুন বিমানবন্দর.। নিয়ম মাফিক ফাস্ট বেঙ্গল ল্যান্সার ও দ্বিতীয় ফিল্ড আর্টিলারি যুক্ত মহড়া ১৪ই আগস্ট রাত দশটায় শুরু হলাে। দুই ইউনিটের প্রায় ৬০০ সৈন্য ক্যান্টনমেন্টের পিছনে নির্মীয়মান নতুন এয়ারপাের্টের কাছে অংশ নিতে গিয়েও তাদের কমান্ডারদের মনে কী আছে তা একটুও টের পায়নি।

সমস্ত স্বাভাবিক ও গতানুগতিক কাজের মধ্যে একটি মাত্র কাজ ছিল অস্বাভাবিক। একটা আর্টিলারি রেজিমেন্টের তিন কোম্পানির ব্যাটারিকে বেরিয়ে এনে শুধুমাত্র রাইফেল নিয়ে সজ্জিত হতে বলা হলাে। এদের প্রতি নির্দেশ ১২টি ট্রাক ভর্তি হয়ে মহড়ায় যাওয়ার। এই শেষ নির্দেশটি কারও মনে কোনাে সন্দেহের উদ্রেক করতে পারেনি। কেননা মেজর রশিদ রেজিমেন্টের দায়িত্ব নেয়ার পর ইতিপূর্বেও ট্রেনিং-এর সময় রুটিন-এ এ ধরনের রদবদল করেছে। মেজর হুদা মিলিটারি গােয়েন্দা বিভাগের একজন অফিসার এবং ডালিমের ঘনিষ্ঠ বন্ধু। তারা একই সঙ্গে আর্টিলারিতে কাজ করেছে। এদিকে রশিদ তার দল এবং ১২টি ট্রাক বােঝাই সৈন্য নিয়ে ট্যাঙ্ক গ্যারেজে এসে ফারুকের সঙ্গে যােগ দিল। এখানেই মধ্যরাতে প্রথমবারের মতাে সবাইকে অপারেশনের পুরাে বিবরণ জানানাে হলাে। ফারুক অপারেশনের সর্বময় নেতৃত্ব ছিল। শেখ মুজিবকে হত্যা করার কারণ এবং প্রয়ােজনীয়তা ব্যাখ্যা করে, পরিকল্পনায় যােগ দিতে রাজি আছে কিনা ফারুক জানতে চাইলে সকলেই সম্মতি জানায়। তারপরই তারা কাজের কথায় ফিরে আসে।  ফারুক তখন ঢাকা শহরের একটি সুপরিকল্পিত ট্যুরিস্ট ম্যাপ স্কোয়াড্রন অফিস টেবিলে রাখে। যে সকল জায়গায় ব্লক স্থাপন করতে হবে, সে সমস্ত । জায়গায় সে দাগ কেটে দেয়। পরিকল্পনা মােতাবেক একটা ট্যাঙ্ক বিমান বন্দরের রানওয়ে আটকাবে আর। সৈন্যরা মিরপুর ব্রিজ নিয়ন্ত্রণ করবে। অন্য দগুলােকে পাঠানাে হবে রেডিও স্টেশন, বঙ্গভবন আর নিউ মার্কেটের কাছে পিলখানায় (পিলখানা ব্যারাক বাংলাদেশ রাইফেলস্-এর সদর দপ্তর)। ৭৫ থেকে ১৫০ জন সৈন্যের বড় বড় তিনটি দল সাজানাে হলাে। ঐ সুসজ্জিত তিনটি দলকে তিনটি প্রধান প্রধান টার্গেট–শেখ মুজিব, আবদুর রব।

সেরনিয়াবাত এবং শেখ ফজলুল হক মণি’র বাড়িতে চূড়ান্ত আঘাতের দায়িত্ব দেয়া হলাে। শেখ মুজিবের বাড়িতে আক্রমণের জন্য ডালিমকে বলা হলে, ডালিম রাজি হলাে না। প্রেসিডেন্ট পরিবারের সঙ্গে তার পরিবারের একটা ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বিদ্যমান ছিল। সম্ভবত সে কারণে ডালিম খােদ শেখ মুজিবের উপর আক্রমণ। চালাতে ব্যক্তিগতভাবে নারাজ হলাে। তৎপরিবর্তে সে সেরনিয়াবাতের বাড়িতে সর্বাত্মক হামলা চালানাের দায়িত্ব নিলাে। আর শেখ মুজিবকে দুনিয়া থেকে সরিয়ে দেয়ার ভয়ংকর দায়িত্বটি নিলাে প্রাক্তন মেজর নূর এবং মেজর মহিউদ্দিন। তারা সঙ্গে নিলাে এক কোম্পানি ল্যান্সার। ম্যাসকার্নহাস আরও লিখেছেন, ফারুকের অত্যন্ত আস্থাভাজন এনসিও (নন কমিশন্ড অফিসার) রিসালদার মুসলেহউদ্দিন ওরফে মুসলিমকে দেয়া হলাে শেখ মণির বাড়িতে আক্রমণের দায়িত্ব। তাদের উপর নির্দেশ ছিল—শেখ মুজিব, সেরনিয়াবাত আর শেখ মণিকে হত্যা করার। এবং মুজিবের দুই পুত্র শেখ কামাল আর শেখ জামালকে বন্দি করার। আর কাউকে কিছু করা বারণ ছিল। তবে, পরিকল্পনায় বাধা সৃষ্টি করতে পারে, এমন যে কাউকে প্রয়ােজনবােধে নিশ্চিহ্ন করে দেয়ার নির্দেশ রইল। আসলে এই নির্দেশটিই হত্যাযজ্ঞের পরিধি প্রশস্ত করার পথ খুলে দিল। ফারুকের মতে, রশিদের দায়িত্ব ছিল রাজনৈতিক খুঁটিগুলাে সঠিকভাবে চালনা করা। অভিযান শুরু হবার সঙ্গে সঙ্গেই রশিদ স্কোয়ার্ডন লিডার লিয়াকতের কাছে যাবে, যাতে করে সে তার মিগ জঙ্গী বিমান নিয়ে প্রস্তুত থাকে। ঢাকার বাইরে থেকে কোনাে সেনা ইউনিট ঢাকায় আসার চেষ্টা করলে, সে তা ঠেকিয়ে দেবে।

এছাড়া রশিদের উপর আরও দুটি গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব বর্তায়। তার একটা ছিল, খন্দকার মােশতাক আহম্মদকে রেডিও স্টেশনে নিয়ে আসা। রেডিও স্টেশনে পৌঁছে মুজিব হত্যার ঘােষণা দেয়, আর দেশের পরবর্তী প্রেসিডেন্ট হিসেবে খন্দকার মােশতাক আহম্মদের নাম ঘােষণা করা। অন্য দায়িত্বটি ছিল, মুজিব হত্যার পর বিশ্লেড হেড কোয়ার্টারের উচ্চপদস্থ সামরিক অফিসারদের সমর্থন আদায়ের চেষ্টা চালানাে। সে (ফারুক) নিজে নিলাে অভিযানের সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ আর বিপদসংকুল কাজটি এবং তা ছিল দুর্ধর্ষ রক্ষী বাহিনীকে সামলানাের কাজ। সাধারণ অবস্থায়, অতর্কিতে আক্রমণ চালানাে হলে, ২৮টি ট্যাঙ্ক দিয়ে একত্রে জমাট-বাঁধা ৩০০০ রক্ষী বাহিনীর একটি দলকে অকেজো করে দেয়া তেমন কোনাে কঠিন কাজ নয়। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে ফারুকের ট্যাঙ্কগুলাে ছিল একেবারে শূন্যকোনাে গােলা বারুদই ছিল না এতে। এমনকি ট্যাঙ্কের মেশিনগানগুলােতেও কোনাে গুলি ছিল না। ঐ অবস্থায় কেউ তাকে সত্যিকারভাবে প্রতিরােধ করতে চাইলে তার কিছুই করার থাকত না। ভাের ৪টা ৪০ মিনিট নাগাদ ফারুকের বাহিনী আঘাতের লক্ষ্যে সংগঠিত হয়ে যার যার জায়গামতাে পৌছার জন্য প্রস্তুত হলাে। রশিদের আর্টিলারি বাহিনী তাদের কামান নিয়ে নতুন এয়ারপাের্ট-এর প্রান্তে দাঁড়িয়ে। ল্যান্সার গ্যারেজে সারিবদ্ধভাবে ২৮টি ট্যাঙ্ক, ১২টি ট্রাক, ৩টি জিপ আর ১০৫ মি:মি: হাউইটজার। তৈরি। এগুলাের সঙ্গে রণসাজে সজ্জিত ৬০০ সৈন্যের একটি শক্তিশালী দল। আধা ঘণ্টার মধ্যেই ফারুক তার সুসজ্জিত বাহিনী নিয়ে যাত্রা শুরু করল। ফারুক ছিল একেবারে সামনের ট্যাঙ্ক-এ … বনানীর রাস্তা ধরে, ডানদিকে মােড় নিয়ে ক্যান্টনমেন্টের চেক পয়েন্টের দিকে ফারুকের ট্যাঙ্কবহর ধীরে ধীরে ছুটে চলল।

অত্যন্ত আশ্চর্যের ব্যাপার এই যে, ট্যাঙ্কের এতােবড় বহরকে তাদের নিজস্ব প্রশিক্ষণ এলাকা ছাড়িয়ে বাইরে যেতে দেখেও কারাে মনে কোনাে সন্দেহ। হলাে না।. ক্যান্টনমেন্ট এলাকা থেকে বের হয়েই ট্যাঙ্কগুলাে দ্রুতগতিতে এগিয়ে চলল। দেয়াল ভেঙে ঢুকে পড়ল এয়ারপাের্ট (নতুন) এলাকায়। একটা ট্যাঙ্ক পূর্বের নির্দেশ মতাে সারি থেকে বেরিয়ে এসে রানওয়ে অবরােধ করে বসল। আর একটা গেল হেলিপ্যাডের দিকে। সেখানে আধ ডজন হেলিকপ্টার পার্ক করা ছিল। বাকি সব ট্যাঙ্ক প্ল্যান্ট প্রােটেকশন সেন্টারকে (উদ্ভিদ সংরক্ষণ কেন্দ্র) পাশ কাটিয়ে ছুটে চললাে রক্ষী বাহিনীর হেড কোয়ার্টারের দিকে ফারুক তখন ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখে সকাল ৫টা ১৫ মিনিট হয়ে গেছে। এতক্ষণে ঘাতক দলগুলাে স্ব স্ব গন্তব্যস্থলে পৌঁছে গেছে নিশ্চয়ই। | এয়ারপাের্টের দেয়ালের কাছাকাছি এসে ফারুক তাকিয়ে দেখে মাত্র একটি ট্যাঙ্ক তাকে অনুসরণ করছে। বাকি ২৪টা ট্যাঙ্ক একেবারে লাপাত্তা। কিন্তু ফারুক দমে যাবার পাত্র নয়। কম্পাউন্ডের বাউন্ডারি ওয়াল আর দুটি গাছ উপড়ে ফেলে তার ট্যাঙ্ক এগিয়ে চলল । কিন্তু রক্ষী বাহিনীর ব্যারাকের কাছে পৌছে সে যা দেখল, তাতে তার দম বন্ধ হবার উপক্রম হলাে। তার ভাষায়। হঠাৎ আমি তাকিয়ে দেখি ৩০০০ রক্ষী বাহিনীর পুরাে ব্রিগেডটি ৬টি সারিতে সারিবদ্ধ হয়ে ব্যারাকের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। তারা ছিল যুদ্ধের সাজে সজ্জিত। মাথায় তাদের স্টিলের হেলমেট, হাতে রাইফেল, কাঁধে প্রয়ােজনীয় জিনিসের বান্ডিল আরও কত কি। এরপর পিছু হটার, আর কোনাে পথই খােলা ছিল না। আমরা যখন ওদের পাশ দিয়ে যাচ্ছিলাম তখন রক্ষী বাহিনীর লােকেরা অবাক হয়ে আমাদের দিকে তাকিয়ে দেখছিল। আমরা তাদের দিকে তীক্ষভাবে তাকিয়ে ছিলাম। সে ছিল এক ভয়ঙ্কর অবস্থা। আমি ড্রাইভারকে বললাম, যদি ওরা কিছু করতে শুরু করে অমনি আর দেরি না করে তাদের উপরেই ট্যাঙ্ক চালিয়ে দেবে।

তার আর দরকার হয়নি। দূর থেকে ভেসে আসা গুলির আওয়াজ তাদের। কানে বাজতে লাগলাে। … রক্ষী বাহিনীর পক্ষ থেকে কোনাে প্রতিক্রিয়া না দেখে ফারুক নিশ্চিত হলাে যে, তার বিপদের সম্ভাবনা কেটে গেছে।  ধানমন্ডির ৩২ নম্বর বাড়ির অবস্থা তখন গােলযােগপূর্ণ। ভাের সােয়া পাঁচটার মধ্যেই মেজর মহিউদ্দিন, নূর আর হুদার নেতৃত্বে পরিচালিত প্রধান ঘাতক দলটি শেখ মুজিবের বাড়িতে পৌঁছে গিয়েছিল। তাদের সঙ্গে পাঁচ ট্রাক ভর্তি ১২০ জন সৈন্য আর একটি হাউইটজার ছিল। মিরপুর রােডে লেকের পাড়ে হাউইটজারটি শেখ মুজিবের বাড়ির মুখােমুখি বসানাে হলাে। আরও কিছু ট্রাকে করে সৈন্য এসে পুরাে বাড়িটার চতুর্দিক ঘিরে ফেলে। তারপরই মেজরবৃন্দ আর তাদের লােকেরা ভেতরে ঢুকে পড়ে। বাড়ির এলাকার বাইরে প্রহরারত সশস্ত্র পুলিশ কালাে উর্দিপরা ভারি অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত সৈন্য দেখে ভড়কে যায় এবং কোনাে প্রকার বাদানুবাদ ছাড়াই আত্মসমর্পণ করে। গেটে প্রহরারত ল্যান্সার প্রহরীরা ষড়যন্ত্রের সঙ্গে জড়িত ছিল। ঠিকই, কিন্তু যখন তারা তাদেরই সহকর্মী আর তাদেরই কিছু অফিসারকে দেখতে পেলাে, তখন তারা ঐ কালাে উর্দি পরিহিত লােকদেরকে ভেতরে আসার সুবিধে করে গেট ছেড়ে দিলাে। ঐ সময় শেখ মুজিবের ব্যক্তিগত প্রহরীরা বারান্দায় ঘুমন্ত ছিল। আনাগােনার শব্দ শুনে ওরা জেগে ওঠে। গেট দিয়ে অচেনা লােকদেরকে অস্ত্র নিয়ে ঢুকতে দেখে, তারা তাদের স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র থেকে গুলি চালায়। আর্টিলারির শামছুল আলমের মাথায় গুলি লেগে সঙ্গে সঙ্গেই মারা যায়। ল্যান্সার বাহিনীর আর একজন সৈন্য গুরুতরভাবে আহত হয়। সঙ্গীদের ঢলে পড়তে দেখে আর বাড়ির ভেতর থেকে প্রচণ্ড প্রতিরােধের কারণে সৈন্যরা তাদের সর্বশক্তি নিয়ােগ করে শত্রুর উপর ঝাপিয়ে পড়ে।

কয়েক মিনিটের মধ্যেই শেখ মুজিবের দেহরক্ষীদের খতম করে দিয়ে তারা বাড়ির ভেতরে ঢুকে পড়ে। প্রথমেই তারা নীচতলার প্রতিটি রুম পালাক্রমে তল্লাশী করে দেখে। ইতিমধ্যে প্রচণ্ড গুলি বিনিময়ের শব্দে হাউইটজার কুরা ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে পড়ে। প্রবল প্রতিরােধের আশঙ্কায় তারা তাদের হাউইটজার থেকে রকেট নিক্ষেপ করতে শুরু করে। রকেটের প্রথম দু’টিই ধানমন্ডির লেকের দু’পাশে গিয়ে পড়ে। তারপর তারা তাদের কামান উচিয়ে আরও ছয় রাউন্ড রকেট নিক্ষেপ করে। একটিও লক্ষ্যভেদ করতে সক্ষম হলাে না। কামান থেকে এত বেশি জোরে রকেটগুলাে নিক্ষিপ্ত হয়েছিল যে এর একটা প্রায় চার মাইল দূরে মােহাম্মদপুরে এক বিহারীর বাড়িতে গিয়ে পড়ে। ঐ রকেটের আচমকা আঘাতে দু’ব্যক্তি নিহত ও অনেক লােক আহত হয়। এ্যান্থনি ম্যাসকার্নহাস-এর প্রদত্ত তথ্য অনুসারে শেখ মুজিবের ছেলে শেখ কামাল আর শেখ জামাল সঙ্গে সঙ্গে তাদের স্টেনগান হাতে নিয়ে শত্রুর বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত হয়ে পড়ে। কিন্তু বেশিক্ষণ টিকতে পারেনি কামাল। সিড়ির গােড়ার দিকেই গুলিবিদ্ধ হয়ে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে সে। অবশ্য নিহত হবার আগে সে আরও দুজন সৈন্যকে আহত করতে পেরেছিল। শেখ মুজিব নিজেও খুব তাড়াতাড়ি কিছু প্রয়ােজনীয় পদক্ষেপ নিয়ে আক্রমণ ঠেকানাের চেষ্টা চালান। প্রথমেই তিনি টেলিফোন করে রক্ষী বাহিনী সদর দফতরে। সেদিন রক্ষী বাহিনীর কমান্ডিং অফিসার বিগ্রেডিয়ার নুরুজ্জামান আর কর্নেল সাবিহউদ্দিন দেশে ছিল না। তিনি বহু চেষ্টা করে অন্য কোনাে সিনিয়র অফিসারকেও মিলাতে পারলেন না। উপায় না পেয়ে তিনি সেনাবাহিনী স্টাফ প্রধান, জেনারেল শফিউল্লাহকে ফোন করেন এবং তার মিলিটারি সেক্রেটারি ব্রিগেডিয়ার মাশহুরুল হককে ফোন করে অবিলম্বে সাহায্য পাঠাবার নির্দেশ দেন। সর্বশেষ ফোনটি করেন সামরিক গােয়েন্দা বিভাগের ডাইরেক্টর, কর্নেল জামিলকে।

মাত্র পক্ষকাল আগে শেখ মুজিব কর্নেল জামিলকে ঐ পদের জন্য  বিশেষভাবে নির্বাচন করেন। জামিল একটুও দেরি করল না। পােশাক পরিধানের | সময় না পেয়ে তার পায়জামার উপরে ড্রেসিং গাউনটি চড়িয়ে দিয়ে লাল ভােক্স ওয়াগন গাড়িতে করে সে প্রেসিডেন্টের সাহায্যে ছুটে চলল। প্রচণ্ড বেগে গাড়ি হাঁকিয়ে এসে পৌছলাে প্রেসিডেন্টের বাড়ির দ্বারপ্রান্তে। কিন্তু ধানমন্ডির ৩২ নম্বর সড়কের বাড়িটি তখন কারবালায় পরিণত হয়ে গেছে। জামিল তার গাড়ি নিয়ে বাড়ির ভেতরে ঢুকতে চেয়ে ব্যর্থ হলাে। গেটের বাইরেই তাকে থামিয়ে দিলাে সৈন্যরা। অত্যন্ত কড়া ভাষায় বাক্য বিনিময়ের সঙ্গে সঙ্গেই জামিল তার গাড়ি । থেকে বেরিয়ে এল। গাড়ি ফেলে সৈন্যদের পাশ দিয়ে বাড়ির ভেতরে ঢুকে পড়তে চাইলেই সৈন্যরা গুলি চালিয়ে দেয় জামিলের বুকে আর মাথায়। টলতে টলতে প্রেসিডেন্টের বাড়ির গেটের গােড়ায় মৃত্যুর হিমশীতল কোলে ঢলে পড়ে জামিল। জীবনের বিনিময়েও সে শেখ মুজিবের কোনাে কাজে লাগতে পারল না।  এরই মধ্যে বাড়ির সর্বত্র ওরা ছড়িয়ে পড়েছে। মেজর মহিউদ্দিন, হুদা আর নূর বাড়ির প্রতিটি কামরা মুজিবের খোঁজে তন্ন তন্ন করে চষে বেড়াচ্ছে। হঠাৎ অপ্রত্যাশিতভাবে মহিউদ্দিন মুজিবকে পেয়ে গেল। সে দোতলায় উঠতে সিঁড়ির গােড়ায় পা ফেলতেই শেখ মুজিবকে দাঁড়ানাে অবস্থায় দেখতে পায়। তাদের মধ্যে দূরত্ব ২০ ফুটের বেশি হবে না। শেখ মুজিবের পরনে তখন একটি ধূসর বর্ণের চেক লুঙ্গি আর সাদা পাঞ্জাবি। ডান হাতে ছিল তার ধুমপানের পাইপটি। | শেখ মুজিবকে হত্যা করার দৃঢ় মনােবল নিয়ে এ অভিযানে বেরুলেও মহিউদ্দিন শেখ-এর সামনা সামনি দাঁড়িয়ে পুরােপুরিভাবে মনােবল হারিয়ে ফেলে। মহিউদ্দিন আমতা আমতা করে তাকে বলছিল স্যার আপনি আসুন।

“তােমরা কী চাও?” মুজিব অত্যন্ত কর্কশ ভাষায় জিজ্ঞেস করল। “তােমরা কি আমাকে খুন করতে চাও? ভুলে যাও। পাকিস্তানি সেনাবাহিনী তা করতে পারেনি। তােমরা কি মনে করাে, তা করতে পারবে?” মুজিব স্পষ্টতই সময় কাটাতে চাচ্ছিলেন। তিনি তাে আগেই বেশ কয়েক জায়গায় ফোন করে রেখেছেন। ইতিমধ্যে নিশ্চয়ই লােকজন তাঁর সাহায্যে ছুটে আসছে। সেই সময়ে তিনি অত্যন্ত সাহসের পরিচয় দিচ্ছিলেন। পরে ঘটনার বিস্তারিত বিবরণ দিতে গিয়ে ফারুক আমাকে বলেছিল, ‘শেখ মুজিবের ব্যক্তিত্ব ছিল অত্যন্ত প্রবল। মহিউদ্দিন তাঁর ব্যক্তিত্বের কাছে একেবারে নতজানু হয়ে পড়েছিল। ঐ মুহূর্তে নূর চলে না আসলে কী যে ঘটতাে তা আমার আন্দাজের বাইরে।” মহিউদ্দিন তখন ঐ একই কথা বলে চলছিল, ‘স্যার, আপনি আসুন।” আর অন্যদিকে শেখ মুজিব তাকে অত্যন্ত কড়া ভাষায় ধমক দিয়ে যাচ্ছিলেন। এমন সময় নূর এসে পড়ে। তার হাতে স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র। সে বুঝে ফেলে, মুজিব সময় কাটাতে চাইছেন। মহিউদ্দিনকে একপাশে সরিয়ে দিয়ে নূর চিৎকার করে আবােল-তাবােল বকতে বকতে তার স্টেগান থেকে মুজিবের প্রতি ব্রাশ ফায়ার’ করে। শেখ মুজিব তাকে কিছু বলার আর সুযােগ পেলেন না। স্টেনগানের গুলি তার বুকের ডান দিকে একটা বিরাট ছিদ্র করে বেরিয়ে গেল। গুলির আঘাতে তার দেহ কিছুটা পিছিয়ে গেল। তারপর নিস্তেজ হয়ে তার দেহ মুখথুবড়ে সিড়ির মাথায় পড়ে গেল। বাঙালি জাতীয়তাবাদের মহান নেতার প্রাণহীন দেহ সিড়ি দিয়ে কিছুদূর গড়িয়ে গিয়ে থেমে রইল। তাঁর ধুমপানের প্রিয় পাইপটি তখনও তিনি শক্তভাবে ডান হাত দিয়ে ধরে রেখেছিলেন। সময় তখন সকাল ৫টা ৪০ মিনিট। বাঙালি জাতির সঙ্গে শেখ মুজিবের প্রচণ্ড ভালােবাসার চিরতরে (?) অবসান ঘটলাে।
গুলির শব্দ শুনে বেগম মুজিব তার স্বামীর অনুসরণ করতে চাইলে তার বেডরুমের দরজার সামনেই তাকে আর এক দফা ব্রাশ ফায়ার করে হত্যা করা হলাে। তারপর হত্যাযজ্ঞ চলতে লাগল। অফিসার আর সৈন্যরা গুলি করে দরজার বােল্ট উড়িয়ে দিয়ে একের পর এক রুমের দরজা খুলে ফেলল। তারপর ব্রাশ ফায়ার করে রুমগুলােকে ঝাঝরা করে দেয়া হলাে যেন একটা প্রাণীও এর ভেতরে বেঁচে থাকতে না পারে। শেখ মুজিবের দ্বিতীয় ছেলে জামাল। কেবলই স্যান্ডহাস্ট থেকে প্রশিক্ষণ শেষ করে সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট হিসাবে সেনাবাহিনীতে কাজ করছিল। অবস্থা দেখে বাড়ির বাকি সদস্যদের বাচানাের জন্যে সে তাদেরকে মেইন বেড রুমে এনে জমায়েত করে। এবার এল তার মরার পালা। একজন অফিসার অত্যন্ত কাছ থেকে তাকে গুলি করলে, পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের সামনে শেখ জামাল মেঝেতে গড়িয়ে পড়ে শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করে।   মুজিবের দুই যুবতী পুত্রবধূ, কামাল আর জামালের সদ্য বিবাহিতা স্ত্রীদ্বয়, রাসেলের গলা জড়িয়ে ধরে বিছানায় গড়াগড়ি যাচ্ছিল। রাসেল শেখ মুজিবের দশ বছর বয়স্ক সর্বকনিষ্ঠ ছেলে। দুই পুত্রবধূকে জঘন্যভাবে টেনে আলাদা করে অত্যন্ত কাছ থেকে গুলি করে নির্দয়ভাবে হত্যা করা হয়। রাসেল তখন ঘরের আলনা কিংবা অন্যান্য আসবাবপত্রের আড়ালে পালিয়ে জীবন বাঁচানাের সকরুণ ব্যর্থ প্রচেষ্টা চালাচ্ছিল। কিন্তু এই নিস্পাপ শিশুটিকেও ঠিক একইভাবে সজোরে টেনে বের করে অত্যন্ত জঘন্যভাবে স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রের গুলিতে ছিন্ন-ভিন্ন করে ফেলা হলাে। শেখ মুজিবের ছােট ভাই শেখ নাসের, স্বাধীনতার পর প্রচুর ধন-সম্পদের মালিক হয়। সে পাশের একটা বাথরুমে পালিয়েছিল। সেখানেই তাকে গুলি করে হত্যা করা হয়। শেখ মুজিবের দুই কন্যার মধ্যে শেখ হাসিনা বয়সে বড়। ওরা দুজনই দেশের বাইরে থাকায় সেই ভয়ংকর হত্যাযজ্ঞ থেকে প্রাণে বাঁচে।… হত্যাকারীরা এরপর পুরাে বাড়িটা এক এক করে তল্লাসী চালায় এবং মূল্যবান সব কিছু লুটে নেয়। প্রতিটি আলমারি, ড্রয়ার ও অন্যান্য আসবাব ভেঙে খােলা হয়।
এবং মূল্যবান জিনিসপত্র ছাড়া সব কিছুই ছড়িয়ে ছিটিয়ে ফেলা হয়। বাড়ির প্রতিটা কামরাই যে এক একটা কসাইখানা আর সমস্ত বাড়িটা জুড়ে যেন মৃত্যুর গন্ধ, দর্শনার্থীদের ব্যাকুল করে তুলছিল।  মৃত্যুর পরেও শেখ মুজিবকে আর এক দফায় অবমাননা করা হলাে। ফারুক জানিয়েছিল, হত্যাকারীদের একজন জীবদ্দশায় শেখ মুজিবকে খুব কাছ থেকে দেখার সুযােগ পায়নি। সুতরাং খুব কাছে থেকে বঙ্গবন্ধুকে দেখার জন্যে সে তার পায়ের বুট মুজিবদেহের নিচে দিয়ে ঢুকিয়ে দেয়। তারপর অত্যন্ত বর্বরােচিতভাবে বুটের হেঁচকা টানে প্রাণহীন মরদেহটি উল্টিয়ে দিয়ে মনের সুখে বঙ্গবন্ধুর হাসিমাখা মুখখানি দেখার সাধ মিটায়। এর প্রায় চার ঘণ্টা পর সরকারি তথ্য  দফতর থেকে আগত একজন বিশেষ ফটোগ্রাফার ঐ অবস্থায় বঙ্গবন্ধুর ছবি উঠায়। ভাের ৫টা ১৫ মিনিটে ডালিমের দল আবদুর রব সেরনিয়াবাতের বাড়িতে পৌছে। … পরবর্তীকালে হাসনাত (সেরনিয়াবাতের জ্যেষ্ঠ পুত্র) স্মৃতিচারণ করে বলল, বাবা বঙ্গবন্ধুকে বললেন, আমাদের বাড়ি দুষ্কৃতিকারী কর্তৃক আক্রান্ত। বাবা তাকে সাহায্য পাঠাতে অনুরােধ জানালেন। টেলিফোনের অন্যপ্রান্ত থেকে কেউ খুব চিৎকার করে কথা বলছিল, আমি শুনতে পাচ্ছিলাম। বাবাও শুনছিলেন। অন্য প্রান্তের কথা শুনে বাবা একেবারে ভেঙে পড়লেন। আমার ধারণা বাবাকে বলা হয়েছিল যে, ‘বঙ্গবন্ধুর বাড়িও আক্রান্ত হয়েছে। বাবা আর একটি কথাও বললেন। তিনি ফোন নামিয়ে বিছানার উপর বসে পড়লেন। তারপর কোনাে কথা না। বলে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে রইলেন আমার দিকে…।  ২০ মিনিট ধরে হাসনাত থেমে থেমে গুলির আওয়াজ আর চিৎকার শুনতে পাচ্ছিল। কিছুক্ষণ পরেই সব নিস্তব্ধ হয়ে গেল আর সৈন্যদের বুটের আওয়াজ দূরে রাস্তায় মিলিয়ে গেল।
বাড়ির সবকিছু থেমে যাওয়া পর্যন্ত সে অপেক্ষা করছিল। তারপর অনেক সন্তর্পণে নেমে এল নিচতলায়। ড্রইং রুমে এসে দেখে তা এক কসাইখানায় পরিণত হয়ে গেছে। চতুর্দিকে কেবল রক্ত, মৃত দেহের তূপ আর ভাঙা চোরা আসবাবপত্র। তার স্ত্রী, মা আর বিশ বছরের একটি বােন গুরুতরভাবে আহত। তার দুই কন্যা অক্ষত অবস্থায় সােফার পেছনে পালিয়ে থেকে ভয়ে কাঁপছিল আর তার পাঁচ বছরের ছেলে, দশ ও পনের বছরের দুটি বােন, ১১ বছর বয়সী তার ছােট ভাই, আয়া, কাজের ছেলে আর তার চাচাতাে ভাই শহীদুল ইসলাম, সেরনিয়াবাত-এর লাশ ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে আছে। শহীদুল ইসলামের বড় বড় গোঁফ ছিল এবং দেখতে অনেকটা হাসনাতের মতাে ছিল। সেই কারণেই হয়তাে হত্যাকারীরা হাসনাত ভেবে শহীদুল ইসলামকে ভুল করে হত্যা করে গেছে। শেখ মুজিবের ভাগ্নির বিয়ে উপলক্ষে হাসনাতের যে দশজন বন্ধু বরিশাল থেকে এসেছিল তাদের মধ্যে একজন নিহত আর পাঁচজন আহত হয় শেখ মণির বাড়িতে আক্রমণটি অত্যন্ত সংক্ষিপ্ত হলেও রীতিমতাে প্রলয়ংকরী গােছের। শেখ মণি ঘুমে অত্যন্ত পাতলা বলে প্রতীয়মান হয়। রিসালদার মােসলেহউদ্দিন দুই ট্রাক ভর্তি তার লােকজন নিয়ে মণির বাড়ির দিকে এলেই সে ঘুম থেকে লাফ দিয়ে উঠে একেবারে বিছানায় বসে পড়ে। সৈন্যদেরকে দেখে সে জিজ্ঞেস করল, তারা তার বাড়ি পাহারা দেবার জন্য এসেছে কিনা। মােসলেহউদ্দিন তাকে নিচে নেমে আসতে অনুরােধ করলে মণি নিচে চলে আসে, সঙ্গে সঙ্গে মােসলেহউদ্দিন গ্রেফতারের চেষ্টা করলে শেখ মণির সাত মাসের অন্তঃস্বত্তা স্ত্রী স্বামীকে বাঁচানাের জন্য লাফ দিয়ে আড়াল করে দাঁড়ায়। আর মুহূর্তে স্টেনগানের গুলিতে দুজনকেই হত্যা করা হলাে।… মােসলেহউদ্দিন নির্দিষ্ট মিশন শেষ করে গাড়ি চালিয়ে শেখ মুজিবের বাড়ির দিকে চলে গেল।
 

সূত্রঃ মুজিবের রক্ত লাল – এম আর আখতার মুকুল

 
error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!