You dont have javascript enabled! Please enable it!

সিংহল, চৌ-এন-লাই ও বাঙালি বুদ্ধিজীবী
মােদাব্বর আলী নুকুই

সিংহলে জনতা বিমুক্তি পেরামুনা (জাতীয় মুক্তি ফ্রন্ট) সশস্ত্র অভ্যুত্থানের দ্বারা ক্ষমতা দখলের একটা পরিকল্পনা ছকেছিল। তারা স্থির করেছিল, মার্চ মাসের শেষ সপ্তাহে একটা নির্দিষ্ট তারিখে এক সঙ্গে সিংহলের সমস্ত থানা দখল করবে এবং প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী বন্দরনায়ককে বন্দি করে নিজেরা রাষ্ট্র ক্ষমতা দখল করে নেবে। এই অভ্যুত্থানের জন্য তারা অস্ত্রশস্ত্র বােমা বন্দুক নিয়ে রীতিমত তৈরি হয়েই ছিল। কিন্তু তাদের মধ্যে একটি গােষ্ঠী নির্দিষ্ট তারিখের আগেই কয়েকটি থানা আক্রমণ করায় তাদের পরিকল্পনা ফাঁস হয়ে যায়। শ্রীমতী বন্দরনায়কের গভর্নমেন্ট দেশে জরুরি অবস্থা ঘােষণা করে তাদের দমন করার প্রয়াস পান। তখন দেখা যায় সিংহলী সেনাবাহিনীতে সৈন্যের সংখ্যা ২২ হাজার, অপরদিকে সন্ত্রাসবাদীর সংখ্যা ২৫-৩০ হাজারের মতাে। দ্বিতীয়ত সিংহলী সৈন্যদের যুদ্ধবিগ্রহের বিশেষ কোনাে অভিজ্ঞতাও নেই। শ্ৰীমতী বন্দরনায়ক তখন আশেপাশের কয়েকটি দেশের কাছে সাহায্য প্রার্থনা করেন। ভারত সহ কয়েকটি দেশ সেই প্রার্থনায় সাড়া দিয়ে সিংহল গভর্নমেন্টকে সাহায্য করতে এগিয়ে যায়।
সিংহলের বন্দরনায়ক সরকার একটি বামপন্থী কোয়ালিশন সরকার। কমিউনিস্ট পার্টি এবং ট্রটস্কিপন্থীরাও তার অংশীদার। এই গভর্নমেন্ট কালাে টাকা ধরবার জন্য পুরােনাে নােট বাতিল করে ফাটকাবাজ ও চোরাকারবাদের বিরাগভাজন হন। অতঃপর তারা দেশের জন্য নতুন এবং প্রগতিশীল সংবিধান রচনার কাজে আত্মনিয়ােগ করেন। সিংহলের রক্ষণশীল দক্ষিণপন্থীরা তাতেও বিশেষ ক্ষুব্ধ হন। সাম্রাজ্যবাদী রাষ্ট্রগুলােও সিংহলকে ‘টাইট” দেবার কথা চিন্তা করছিল।
এই সমস্ত ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে সিংহলে সশস্ত্র অভ্যুত্থান দেখে ঘরে বাইরে যথেষ্ট বিভ্রান্তির সৃষ্টি হয়। সিংহল সরকার সন্ত্রাসবাদীদের “চে-গুয়েভারাপন্থী” বলে আখ্যাদেন। কিন্তু সাম্রাজ্যবাদী দুনিয়ার সংবাদপত্রগুলাে রটাতে থাকে, এই অভ্যুত্থানের পেছনে চীন, পূর্ব জার্মানি এবং উত্তর কোরিয়ার হাত আছে। বােম্বাইয়ের “কারেন্ট” পত্রিকা এর মধ্যে সােভিয়েতের “চক্রান্ত” ও আবিষ্কার করেছিল। সিংহল সরকার স্থানীয় উত্তর কোরিয় দূতাবাসের কর্মচারীদের সিংহল থেকে বহিস্কার করায় লােকের মনে এই ধারণার সৃষ্টি হয় যে উত্তর কোরিয়া বােধহয় এই বিদ্রোহের উস্কানিদাতা। পরে জানা গেছে, দূতাবাসের একজন প্রাক্তন সিংহলী কর্মচারী এই অভ্যুত্থানের অন্যতম নায়ক হলেও সরকারিভাবে দূতাবাসের সঙ্গে এই বিদ্রোহের কোন সম্পর্ক নেই।
সিংহলের প্রতিক্রিয়াশীল দক্ষিণপন্থী মহল ভেবেছিল, এই অভ্যুত্থানের ফলে বন্দরনায়ক গভর্নমেন্টের পতন ঘটবে এবং সমস্ত বামপন্থী পার্টিগুলাে জনপ্রিয়তা হারাবে। আর সেই সুযােগে তারা ক্ষমতায় অধিষ্ঠত হবে। তাই তারা বন্দরনায়কের সমর্থক সমাজতান্ত্রিক দেশগুলােকে এই সশস্ত্র অভ্যুত্থানের উস্কানিদাতা বলে প্রচার শুরু করে। সিংহলের সাধারণ নাগরিকদের মনে বিদ্বেষভাব জাগাবার চেষ্টা করেছিল।
যাই হােক, সিংহল সরকার বর্তমান দেশের পরিস্থিতি মােটামুটি আয়ত্তে আনেত সক্ষম হয়েছেন।
সিংহলের অর্থনৈতিক অবস্থা মােটেই ভালাে নয়। তার উপর সে দেশে শিক্ষিত অশিক্ষিত বেকারের সংখ্যাও অনেক। তাই সে দেশের যুবসম্প্রদায়ের মধ্যে গুরুতর হতাশার সৃষ্টি হওয়াই স্বাভাবিক। সেই সর্বব্যাপী হতাশার সুযােগ নিয়ে একদল রােমান্টিক হঠকারী তাদের সশস্ত্র অভ্যুত্থানের মন্ত্রে দীক্ষা দেয়। নেতারা নিজেদের মার্কসবাদী বলে দাবি করলেও অন্য কোন দেশের মার্কসবাদী পার্টির সঙ্গে তাদের কোন যােগসূত্র ছিল বলে শােনা যায়নি।
চীনের সঙ্গে সিংহলের বন্দরনায়ক সরকারের সদ্ভাবের কথা কারও অজানা থাকবার কথা নয়। সিংহল প্রতি বছর চীনের কাছ থেকে প্রচুর চাল কিনে থাকে। বন্দরনায়ক সরকার অর্থনৈতিক সংকটে পড়েছে দেখে চীন সেই চালের দাম কমিয়ে (বিদ্রোহের মাত্র কয়েকদিন আগে) তাকে যথেষ্ট সাহায্য করে এবং অন্যান্য অনেক সাহায্যের প্রতিশ্রুতি দেয়। এটা সাম্রাজ্যবাদী এবং তাদের সিংহলস্থ দালালরা কোন সময়ই সুনজরে দেখেনি। তাই তারা রটাতে আরম্ভ করে যে সিংহলের বিদ্রোহের পেছনে আসলে চীনের উস্কানি দিচ্ছে।
কলকাতার কয়েকজন বামপন্থী বুদ্ধিজীবীকে অতি অনায়াসে এই টোপ গিলতে দেখে আমরা দস্তুরমত অবাক হয়ে গেছি। সাম্রাজ্যবাদী প্রচারকদের মিথ্যাচার গলাধঃকরণ করে কলকাতার একটি ইংরাজি এবং একটি বাঙলা সাপ্তাহিক পত্রিকা ধরে নিয়েছিলেন যে সত্যিই বােধহয় সিংহলের বিদ্রোহের পেছনে চীনের সহানুভূতি ও সমর্থন আছে। তাই তারা এই সশস্ত্র অভ্যুত্থানকে “জাতীয় মুক্তিসংগ্রাম” বলে চালাবার চেষ্টা করেন এবং ভারতসহ যেসব দেশ এই বিদ্রোহ দমনে সিংহলকে সাহায্য করেছে, তাদের আদ্যশ্রাদ্ধ করে ছাড়েন।
কিন্তু সিংহলের বিদ্রোহ সম্পর্কে গােড়ায় নীরব হয়ে থাকলেও গত ২৬ এপ্রিল চীনের প্রধানমন্ত্রী চৌ এন লাই শ্ৰীমতী বন্দরনায়কের কাছে প্রেরিত এক বাণীতে বলেছেন, “স্বদেশের এবং বিদেশের প্রতিক্রিয়া-পন্থীরাই সিংহলে বিদ্রোহের ষড়যন্ত্র করেছিল।” সঙ্গে সঙ্গে তিনি একথাও ঘােষণা করেছেন যে, চীন-সিংহল মৈত্রীবন্ধন ছিন্ন করার ক্ষমতা কারও নেই। প্রধানমন্ত্রী চৌ সিংহলকে বিনা সুদে ১৫ কোটি টাকার দীর্ঘমেয়াদী ঋণ দিতে চেয়েছেন এবং সিংহল এই মাসেই সেই ঋণের প্রথম কিস্তির টাকা পেয়ে যেতে পারে।
চৌ তাঁর বাণীতে আরও বলেছেন, “মুষ্টিমেয় লােক (যাদের মধ্যে বহু বিদেশি গুপ্তচর ঢুকে পড়েছিল) যে অরাজক অবস্থার সৃষ্টি করেছিল, তা আয়ত্তে এসেছে জেনে তিনি সুখী হয়েছেন।
“উহু বামপন্থা” এবং “সুবিধাবাদী দক্ষিণপন্থার বিরুদ্ধে আক্রমণ অব্যাহত রাখবার যে শিক্ষা চেয়ারম্যান মওয়ের কাছ থেকে পাওয়া গেছে, তা উদ্ধৃত করে চীনা প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, সিংহলের এই বিদ্রোহ ব্যর্থ হতে বাধ্য।
চৌ এন-লাইয়ের এই বক্তব্য খুবই পরিষ্কার। সিংহলে বিদেশি গুপ্তচররা “উগ্র বামপন্থীদের ভিড়ে “অরাজক অবস্থার সৃষ্টি করতে চেয়েছিল। কাজেই এই বিদ্রোহের সঙ্গে “জাতীয় মুক্তি” অথবা “সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের কোন সম্পর্ক থাকা সম্ভব নয়। এই বিদ্রোহের মধ্য দিয়ে দক্ষিণপন্থীদের ক্ষমতা লাভের পথই প্রশস্ত হতাে। অরাজকতা আর বিপ্লব এক জিনিস নয়। অরাজকতার মধ্যে দিয়ে বিপ্লবের পরিবর্তে ফ্যাসিবাদের আবির্ভাবের সম্ভাবনাই বেশি।
সিংহলের বিদ্রোহের পেছনে চীনের সমর্থন আছে অনুমান করে কলকাতার যেসব বামপন্থী বুদ্ধিজীবী সেই বিদ্রোহ সমর্থন করছিলেন, তারা এবার নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন যে, এতদিন তারা সাম্রাজ্যবাদের তত্ত্বযােদ্ধার ভূমিকাই গ্রহণ করেছিলেন। সাম্রাজ্যবাদের তত্ত্ববাগীশরা মার্কসবাদের সঙ্গে প্রকাশ্য লড়াইয়ে বহুকাল আগেই পিছু হঠে গেছেন। এখন তারা গেরিলা যুদ্ধের নীতি অবলম্বন করেছেন। সেই গেরিলা যুদ্ধের রণধ্বনি হচ্ছে “অপারেশন কনফিউশন।” অর্থাৎ মার্কসবাদীদের মধ্যে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করে ভিত্তি থেকে তাদের ঘায়েল করাে। আমাদের দেশের বামপন্থি বুদ্ধিজীবীদের একাংশও নিজেদের অজ্ঞাতে সেই গেরিলা সৈনিকবৃত্তি অবলম্বন করেননি তাে? যেখানে গােলমাল এবং যেখানে অরাজকতা, সেখানেই “বিপ্লব” আবিষ্কার করা সুস্থ বুদ্ধির লক্ষণ কি?

সূত্র: সপ্তাহ, ৪ জুন ১৯৭১

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!