টনি ম্যাকার্নহাস, মেজর ফারুক আর মেজর রশিদের সংক্ষিপ্ত জীবন বৃত্তান্ত
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের দাফনের করুণ কাহিনী এবং নিষ্ঠুর হত্যাকাণ্ডের মর্মান্তিক বিবরণের পর স্বাভাবিকভাবেই একটা বিরাট প্রশ্ন থেকে যায়। কেন এই পৈশাচিক হত্যাকাণ্ড? আর পর্দার অন্তরাল থেকে কারা এসবের ফায়দা পেলাে—এতােসব জানতে হলে আবার লন্ডনের বৈদেশিক রাজনৈতিক মঞ্চে ফিরে যেতে হবে। ১৯৭৬ সালের ২রা আগস্টের কথা। ইনডিপেনডেন্ট টেলিভিশন থেকে এ মর্মে বেশ কয়েকবার অগ্রিম ঘােষণা দেয়া হলাে যে, বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে সরাসরিভাবে জড়িত দুজন প্রাক্তন জুনিয়র সামরিক অফিসার যথাক্রমে লে. কর্নেল ফারুক রহমান এবং আব্দুর রশিদের সাক্ষাঙ্কার প্রচারিত হবে ‘ওয়ান্ড ইন্ অ্যাকশন অনুষ্ঠানে। সাক্ষাৎকার গ্রহণ করবেন লন্ডনের সানডে টাইমস’ পত্রিকার এ্যান্থনি ম্যাসকার্নহাস ওরফে টনি ম্যাসকানহাস। সমগ্র ব্রিটেনে তুমুল উত্তেজনা। এই চাঞ্চল্যকর সাক্ষাৎকারের অংশ বিশেষ উপস্থাপনের প্রাক্কালে তিনজনের সংক্ষিপ্ত পরিচয় প্রদান বাঞ্ছনীয় হবে। প্রথমেই এ্যান্থনী ম্যাসকার্নহাস ওরফে টনির পরিচয় : ভদ্রলােকের আদি নিবাস ভারতের পশ্চিম উপকূলে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাক্ষেত্র গােয়া শহরে। এজন্যই স্থানীয় অধিবাসীদের গােয়নিজ নামে আখ্যায়িত করা হয়। কিন্তু এঁদের ধমনীতে প্রবাহিত পর্তুগিজ রক্ত।
এঁরা কট্টর রক্ষণশীল রােমান ক্যাথলিক ধর্মাবলম্বী এবং পরিবার পরিকল্পনায় বিশ্বাসী নয়। ১৯৪৭ সালে ভারত উপমহাদেশ বিভক্ত হলে এ্যান্থনি ম্যাসকার্নহাস-এর পরিবার গােয়া থেকে পাকিস্তানের তৎকালীন রাজধানী করাচীতে ভাগ্যের অন্বেষণে পাড়ি জমায়। টনি ম্যাসকার্নহাসের তখন পূর্ণ যৌবন এবং করাচী মহানগরীতে সাংবাদিকতাকে পেশা হিসাবে গ্রহণ করে এখানেই তিনি যৌবনের শ্রেষ্ঠ বছরগুলাে অতিবাহিত করেন। সাংবাদিক হিসাবে তিনি পরিচিত হন পাকিস্তানের উভয় অংশের রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ এবং উঠতি শিল্পপতি ও ব্যবসায়ীদের সঙ্গে। তাঁর চোখে উদ্ভাসিত হয় এক নতুন দিগন্তের এবং স্বাভাবিকভাবেই তিনি কিছুটা উচ্চাভিলাষী হন। শিল্পপতি ও ব্যবসায়ীদের মধ্যে তাঁর সখ্যতা সৃষ্টি হয় মাদ্রাজ, থেকে আগত শিল্পপতি এম.ই. খান (ঢাকার মেহার ইন্ডাস্ট্রিজ-এর আদি মালিক) এবং বােম্বাইর পার্শি ব্যবসায়ী ও বাসমতী চাল রফতানিকারক ফারুক মার্চেন্টের (তেজগাঁও-এর ফাররােখ ইন্ডাস্ট্রিজ-এর মূল মালিক) সঙ্গে। রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের মধ্যে তিনি সবচেয়ে বেশি আকৃষ্ট হন হােসেন শহীদ সােহরাওয়ার্দীর ব্যক্তিত্বের প্রতি। এই করাচীতেই শহীদ সােহরাওয়ার্দী একদিন স্বীয় চেম্বারে টনিকে পরিচয় করিয়ে দেন পূর্ব বাংলার উদীয়মান বাঙালি নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে। প্রথম পরিচয়ের দিনেই শেখ মুজিব নাসিকা কুঞ্চিত করেছিলেন। কেননা, এ্যান্থনি ম্যাসকার্নহাস বরাবরই হচ্ছেন পূর্ব বাংলার স্বার্থবিরােধী ইংরেজি দৈনিক মর্নিং নিউজ পত্রিকার করাচী সংস্করণের অন্যতম সহকারী সম্পাদক এবং সিটি এডিটর। তবুও পরবর্তী বছরগুলােতে দুজনের ব্যক্তিগত সম্পর্ক অব্যাহত ছিল।
হােসেন শহীদ সােহরাওয়ার্দীর মৃত্যুর পর ষাট দশকে শেখ মুজিবের নেতৃত্বে পূর্ব বাংলার ভয়াবহ ছ’দফা আন্দোলন, তথাকথিত আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা, আইয়ুব বিরােধী অভ্যুত্থান ও ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহার, রাওয়ালপিন্ডির ব্যর্থ গােল টেবিল বৈঠক ও আইয়ুবের পদত্যাগ এবং ইয়াহিয়ার সামরিক বাহিনীর প্রহরায় সত্তরের নির্বাচনে শেখ মুজিবের অভূতপূর্ব সাফল্য এ্যান্টনি ম্যাসকার্নহাস-এর মনে দারুণভাবে প্রভাব বিস্তার করে এবং তিনি পূর্ব বাংলার ব্যাপারে আরাে বেশি কৌতূহলী হয়ে উঠেন।
এরপর ১৯৭১ সালের কথা। অবিভক্ত পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগের ঐতিহাসিক বিজয়ের পর ফৌজি প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান সেদিন ভুট্টোর পরামর্শে ক্ষমতা হস্তান্তরের পরিবর্তে পূর্ব বাংলার গণহত্যার নির্দেশ প্রদান করে। এটাই হচ্ছে ‘অপারেশন সার্চ লাইট’। এই গণহত্যার মােকাবেলায় বঙ্গবন্ধুর প্রদর্শিত পথে শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধ। বাংলাদেশের বাঙালি জাতি তখন এক ও অভিন্ন। পাল্টা আঘাত হানার লক্ষ্যে সৈয়দ নজরুল ও তাজউদ্দিনের নেতৃত্বে গঠিত প্রবাসী মুজিবনগর সরকারের তত্ত্বাবধানে তখন সীমান্ত এলাকায় সবেমাত্র মুক্তিযােদ্ধাদের প্রশিক্ষণ শুরু হয়েছে। এ সময় বিশ্বের পত্র-পত্রিকায় প্রতিনিয়ত ফলাও করে প্রকাশিত হচ্ছে। হানাদার বাহিনীর বেপরােয়া ধর্ষণ, লুণ্ঠন, অগ্নিসংযােগ আর পৈশাচিক হত্যা কাণ্ডের কাহিনী। পাকিস্তানের তৎকালীন সামরিক জান্তা এসবের পাল্টা প্রচারণার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করল। বিশ্ববাসীকে এ মর্মে জানাতে হবে যে, মার্চের শেষ সপ্তাহে সামান্য গােলযােগ-এর পর এখন পূর্ববঙ্গে পরিস্থিতি সম্পূর্ণ স্বাভাবিক। এই সিদ্ধান্তের জের হিসাবেই করাচী, লাহাের ও রাওয়ালপিন্ডির জনাকয়েক প্রবীণ সাংবাদিককে বিশেষ ব্যবস্থাধীনে পূর্ব বাংলা সফরে আনা হয়। ইংরেজি দৈনিক মর্নিং নিউজ-এর সহযােগী সম্পাদক এ্যান্থনি ম্যাসকার্নহাস ছিলেন আলােচ্য প্রতিনিধিদলের অন্যতম সদস্য।
কথা ছিল সফরান্তে এরা কর্মস্থলে ফিরে যেয়ে স্ব স্ব পত্রিকায় প্রত্যক্ষদর্শীর বিবরণ লিখবেন। অবশ্য প্রতিবেদনগুলাে হবে স্বাভাবিকভাবেই সামরিক জান্তার পক্ষে। হানাদার পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর সরাসরি তত্ত্বাবধানে এই সাংবাদিক প্রতিনিধি দলকে তৎকালীন পূর্ব বাংলার দখলীকৃত এলাকা সফর করানাে হলাে। এদের থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা হয়েছিলাে সামরিক বাহিনীর অফিসার্স মেসে। কুমিল্লার ময়নামতি ক্যান্টনমেন্টের অফিসার্স মেসের ডাইনিং রুমে একদিন কিছু পাকিস্তানি আর্মি অফিসারদের সঙ্গে নৈশ ভােজের সময় এদের কথাবার্তা এবং বাঙালি নিধনের আলােচনা থেকে সাংবাদিক ম্যাসকার্নহাস-এর জ্ঞান চক্ষুর উন্মােচন হলাে। এতগুলাে বছরের সাংবাদিকতার অভিজ্ঞতাকে তিনি কাজে লাগালেন। স্বীয় প্রচেষ্টায় অত্যন্ত সন্তর্পণে তিনি সগ্রহ করলেন গণহত্যা, লুণ্ঠন, অগ্নিসংযােগ আর ধর্ষণের লােমহর্ষক তথ্য। অত্যন্ত চাতুর্যের সঙ্গে নিজের নােট বই-এ লিপিবদ্ধ করলেন খুনী অফিসারদের সদম্ভ স্বীকারােক্তি। ম্যাসকার্নহাস হিসাব করে দেখলেন যে, পূর্ব বাংলার এসব লােমহর্ষক কাহিনী বিশ্বের পত্র-পত্রিকায় অচিরেই প্রকাশিত করতে সক্ষম হলে, তিনি চিহ্নিত হবেন উপমহাদেশের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সাংবাদিক হিসাবে। কিন্তু সেক্ষেত্রে নিজের এবং পরিবারের সদস্যদের নিরাপত্তার গ্যারান্টি কোথায়? করাচীতে প্রত্যাবর্তনের পর ভদ্রলােক তার স্ত্রীর সঙ্গে সবকিছু খােলাখুলিভাবে আলােচনা করলেন। এবার সিদ্ধান্ত হচ্ছে সপরিবারে লন্ডনে পাড়ি জমাতে হবে। অত্যন্ত গােপনে ম্যাসকার্নহাস। পরিবার স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি বিক্রি করে কিছু নগদ অর্থের ব্যবস্থা করলাে আর ব্যাংকে গচ্ছিত টাকাও উঠিয়ে ফেলল। এরপর দেশ ভ্রমণের অছিলায় পাঁচ পুত্র কন্যাসহ মিসেস ম্যাসকার্নহাস চলে গেলেন লন্ডনে।
এদিকে করাচী মর্নিং নিউজ পত্রিকায় ইতিমধ্যেই এ্যান্থনী ম্যাসকার্নহাস-এর লেখা দুই কিস্তি প্রতিবেদন প্রকাশিত হওয়ায় গােয়েন্দা বিভাগের কেউই কোনাে সন্দেহ পর্যন্ত করল না। পূর্ব বাংলা সফরের বিবরণ সম্বলিত এসব প্রতিবেদনে জেনারেল ইয়াহিয়ার সামরিক সরকারের কঠোর ও তাৎক্ষণিক পদক্ষেপের | যৌক্তিকতায় ভরপুর। এ্যান্থনী মাসকার্নহাস আরও দুই কিস্তি প্রতিবেদন মর্নিং নিউজ পত্রিকার প্রধান সম্পাদক মহসিন আলীর হাতে দিয়ে হপ্তা দুয়েকের ছুটি মঞ্জুর করালেন। আনুষঙ্গিক অন্যান্য সব কাজ আগেই সম্পূর্ণ করা ছিল। মাত্র ৪০ ঘণ্টার ব্যবধানে তিনি লন্ডনে যেয়ে মিলিত হলেন পরিবারের সঙ্গে।
ম্যাসকানহাস এখন মুক্ত বিহঙ্গ। এখানে উল্লেখ্য যে, পাকিস্তানে অবস্থানকালে ম্যাসকার্নহাস করাচী মর্নিং নিউজ-এর সার্বক্ষণিক সহযােগী সম্পাদক ছাড়াও লন্ডনের সানডে টাইম’ পত্রিকার করাচীস্থ খণ্ডকালীন সংবাদদাতা হিসাবে কাজ করতেন। কিন্তু পূর্ব বাংলায় প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার সামরিক বাহিনীর ‘অ্যাকশন’ শুরু হওয়ার পর পাকিস্তানে পূর্ণ সেন্সরশিপ জারি থাকায় কোনাে রিপাের্টই তিনি। পাঠাতে পারেননি। তাই লন্ডনে পৌছেই তিনি দৌড়ালেন উদারপন্থী সানডে টাইমস পত্রিকার প্রধান সম্পাদকের সঙ্গে সাক্ষাতের জন্য। দুজনে একান্তে অনেক আলােচনা হলাে। ম্যাসকার্নহাস প্রধান সম্পাদকের কাছ থেকে গ্রিন সিগন্যাল লাভ করলেন।
পরের রােববার সমগ্র পাশ্চাত্য জগতে নতুন করে শুরু হলাে দারুণ হৈ চৈ আর উত্তেজনা। কারণ একটাই। লন্ডনের প্রখ্যাত সানডে টাইমস্ পত্রিকায় পাকিস্তান থেকে সপরিবারে পালিয়ে আসা অবাঙালি সাংবাদিক এ্যান্থনী ম্যাসকার্নহাস-এর চাঞ্চল্যকর প্রতিবেদনের প্রথম কিস্তি। ১৬ কলামব্যাপী এই প্রতিবেদনে ম্যাসকার্নহাস অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে পূর্ব বাংলার প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার সামরিক বাহিনীর নজীরবিহীন গণহত্যা, লুণ্ঠন, অগ্নিসংযােগ আর ধর্ষণের ঘটনা উপস্থাপন করেছেন। প্রতিবেদনের অন্যতম আকর্ষণ হচ্ছে মানবতা বিরােধী এসব কর্মকাণ্ডে লিপ্ত পাকিস্তানি সামরিক অফিসারের পূর্ণ পরিচিতিসহ সাক্ষাৎকার। এসব সাক্ষাৎকারে আলােচ্য অফিসারদের লুণ্ঠন, হত্যা আর ধর্ষণ সংক্রান্ত সদম্ভ স্বীকৃতি এবং পৈশাচিক বিবরণ। এছাড়া গােপনে সংগৃহীত অধিকৃত এলাকার বহু সংখ্যক বাঙালির বর্ণিত করুণ কাহিনী। ‘সানডে টাইমস’ পত্রিকায় প্রকাশিত এসব প্রতিবেদন অচিরেই লন্ডন থেকে পুস্তক আকারে প্রকাশিত হলাে। নাম ‘দি রেপ অব বাংলাদেশ’। এ্যান্থনী ম্যাসকার্নহাস পাশ্চাত্য জগতের একজন পেশাদার সাংবাদিক হিসাবে প্রতিষ্ঠা লাভ করলেন। তিনি ‘সানডে টাইমস’ পত্রিকায় সার্বক্ষণিক স্টাফ হিসাবে যােগ দিলেন আর ব্রিটিশ সরকার সপরিবারে এ্যান্থনী মাসকানহাসকে ‘রাজনৈতিক আশ্রয় মঞ্জুর করলাে।
এ্যান্থনী ম্যাসকার্নহাস-এর জীবন কথার চাঞ্চল্যকর অধ্যায় এখানেই সমাপ্ত হওয়া বাঞ্ছনীয় ছিল। কিন্তু তা হয়নি। এরপর তার জীবনের আরও চাঞ্চল্যকর অথচ বিতর্কিত অধ্যায় রয়েছে। ১৯৭১ সালের ১৬ই ডিসেম্বর বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর এ্যান্থনী ম্যাসকার্নহাস-এর মনে স্বাভাবিকভাবেই উদগ্র বাসনা বাংলাদেশ সফরের। কিন্তু কীভাবে? উপমহাদেশে তখন নাটকীয়ভাবে একের পর এক ঘটনা সংঘটিত হচ্ছে। মিত্র বাহিনীর কাছে কাপুরুষের মতাে ৯১ হাজার পাকিস্তানি সৈন্য আত্মসমর্পণ করল, ভারতের ইন্দিরা সরকার ১৮ই ডিসেম্বর নাগাদ একক সিদ্ধান্তে পশ্চিম রণাঙ্গণে যুদ্ধবিরতি ঘােষণা এবং পশ্চিম পাকিস্তানের দখলীকৃত বিরাট এলাকা থেকে সৈন্য প্রত্যাহার করল। যুদ্ধে পরাজিত ও অপদস্থ পাকিস্তানের ফৌজি প্রেসিডেন্ট খণ্ডিত পাকিস্তানের ক্ষমতা অর্পণ করলেন পিপলস পার্টির নেতা জুলফিকার আলী ভুট্টোর কাছে। এরপর আরও নাটকীয়ভাবে ফাঁসির হুকুম প্রাপ্ত আসামী শেখ মুজিবুর রহমান পশ্চিম পাকিস্তানের মিয়ানওয়ালী জেল থেকে মুক্তি লাভের পর ব্রিটিশ এয়ারওয়েজের একটি চার্টার্ড প্লেনে ১৯৭২ সালের ৯ই জানুয়ারি হাজির হলেন লন্ডনের হিথরাে বিমানবন্দরে। সঙ্গে সফরসঙ্গী সে আমলের বিতর্কিত আওয়ামী লীগ নেতা ড. কামাল হােসেন। স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশের স্রষ্টা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অস্থায় আস্তানা হলাে লন্ডনের ক্লারিজ হােটেলে। এখানেই শত শত লােকের ভিড় ঠেলে এ্যান্থনী মাসকার্নহাস দেখা করলেন মুজিবের সঙ্গে। হাতে তার সুদৃশ্য ফাইলে সযত্নে রক্ষিত ‘সানডে টাইমস’ পত্রিকায় প্রকাশিত আলােড়ন সৃষ্টিকারী রিপাের্টএর কাটিং। পরিশ্রান্ত ও রুগ্ন শেখ মুজিব কৌতূহলী হয়ে রিপাের্ট উল্টিয়ে দেখলেন এবং কয়েকটি অংশ অত্যন্ত আগ্রহের সঙ্গে পড়লেন। বাংলাদেশের হানাদার বাহিনীর বীভৎস নির্যাতনের করুণ কাহিনী পড়ে তার কণ্ঠস্বর হলাে বাষ্পরুদ্ধ। আর একারণেই নীরবে কয়েক ফোটা অশ্রু ঝরে পড়ল।
এহনী ম্যাসকার্নহাস সুযােগের সদ্ব্যবহার করলেন। অত্যন্ত বিনয়ের সঙ্গে সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশ সফরের ইচ্ছা জানালেন। শেখ মুজিব সানন্দে রাজি হয়ে পাশে উপবিষ্ট বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীকে প্রয়ােজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ দিলেন। বললেন, সাংবাদিক টনি সরকারের একজন সম্মানিত অতিথি হিসাবে বাংলাদেশ সফর করবে। বাহাত্তর সালের একেবারে গোড়ার দিকে এ্যন্থনী মাসকার্নহাস এসে হাজির হলেন ঢাকায়। সরকারি খরচে তার থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা হলাে তৎকালীন হােটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তখন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী। সরকারের তথ্য বিভাগের মহাপরিচালক হিসাবে আমার উপর দায়িত্ব অর্পিত হলাে ম্যাসকার্নহাস-এর দেখাশােনার। ভদ্রলোক আমার পূর্ব পরিচিত। ১৯৬০-৬১ সালে আমি দৈনিক আজাদের করাচীস্থ ব্যুরাে চিফ হিসাবে কাজ করার সময় প্রথম পরিচয় এবং সে সময়েই আমাদের পারিবারিক সম্পর্ক গড়ে ওঠে। দুজনের মধ্যে ‘তুমি’ সম্পর্ক। এতগুলাে বছর পরে নানা ঘটনা প্রবাহে ম্যাসকার্নহাস এখন লন্ডন প্রবাসী আর আমি প্রায় দুই যুগ সাংবাদিকতার পর সরকারি কর্মচারী। ( যথারীতি ম্যাসকার্নহাসকে সঙ্গে করে রায়েরবাজারে বাঙালি বুদ্ধিজীবীদের বধ্যভূমি থেকে শুরু করে মীরপুরের কাঁটাবনের গণকবর ইত্যাদি দেখানাে ছাড়াও বেশ কিছু বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গের সঙ্গে সাক্ষাৎকারের ব্যবস্থা করলাম। কিন্তু আমার মনে তখন একটা সন্দেহের উদ্রেক হয়েছে।
আমাকে গোপন করে ম্যাসকার্নহাস এর মধ্যেই কাটা তার দিয়ে ঘেরা মােহাম্মদপুরে অবস্থানরত পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর দোসর বিহারী নেতৃবৃন্দের সাক্ষাৎকার গ্রহণ করেছে। খবরটা পেয়েছিলাম মিত্রবাহিনীর পক্ষ থেকে মােহাম্মদপুরের ভারপ্রাপ্ত আর্মি কমান্ডার লে. কর্নেল চুনীর কাছ থেকে। কিন্তু কেন এই গােপনীয়তা? লন্ডনে প্রত্যাবর্তনের প্রাক্কালে এ্যান্থনি ম্যাসকার্নহাস দ্বিতীয় দফা বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে সাক্ষাৎপ্রার্থী হলে তারও ব্যবস্থা করলাম। পুরনাে গণভবনের পিছনের বারান্দায় অনুষ্ঠিত এবারের সাক্ষাৎকারে টনির প্রশ্নের সুর ও ধরন বেশ কিছুটা ভিন্নতর মনে হলাে। বার বার জেনেভা ক্যাম্পের বিহারিদের প্রশ্ন উত্থাপন করল। বঙ্গবন্ধুও বার বার একই উত্তর। ওরা পাকিস্তানি নাগরিক। সুতরাং দায়িত্ব পাকিস্তানের। খাওয়া-দাওয়া আর চিকিৎসা আন্তর্জাতিক রেডক্রস-এর। মানবতার খাতিরে আমরা যথার্থভাবেই আশ্রয় এবং নিরাপত্তার ব্যবস্থা করেছি। প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবের এ ধরনের জবাবে মনে পড়লাে দিন কয়েক আগে এই গণভবনেই অনুষ্ঠিত এক ঘটনার কথা। এ সময় তিনজন মার্কিনী সাংবাদিক এলেন বাংলাদেশ সফরে। উদ্দেশ্য হচ্ছে, যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশ সম্পর্কে রিপাের্ট সংগ্রহের পর প্রধানমন্ত্রীকে ইন্টারভিউ করা। কিন্তু দু’দিন ধরে চেষ্টা করেও মার্কিনী সাংবাদিকরা প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে পারলেন না। শেষ পর্যন্ত স্থানীয় জনৈক সাংবাদিক এ মর্মে পরামর্শ দিলেন যে, দুপুরে সামান্য বিশ্রামের পর প্রতিদিন বিকাল সাড়ে ৪টা নাগাদ প্রধানমন্ত্রী পুরনাে গণভবনে অফিসের জরুরি ফাইল দেখা এবং রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের জন্য আগমন করে থাকেন। তাই আগে থেকে গণভবনের গাড়ি বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকলে প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবের সঙ্গে কথাবার্তা হতে পারে।
এই পরামর্শেই কাজ হলাে। তিনজন মার্কিনী সাংবাদিক সেদিন বিকাল ৪টা থেকে পুরনাে গণভবনের গাড়ি বারান্দায় পায়চারী করতে লাগল। ঠিক বিকাল সাড়ে চারটা শীতের পড়ন্ত রােদে একটা পতাকাবাহী গাড়িতে প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান এসে হাজির হলেন। গাড়ি থেকে নামার মুহূর্তে সাদা চামড়ার সাংবাদিকদের দেখে তার ভ্রু দুটো কুঁচকে উঠল। ইন্টারভিউ দেয়ার আর শেষ নেই নাকি? তাই গাড়ি থেকে নেমেই তিনি বারান্দা দিয়ে হন হন করে গণভবনের পিছনের দিকে রওনা হলেন। সাংবাদিকরাও নাছােড়বান্দা। তারাও দ্রুত প্রধানমন্ত্রীর পিছু নিলেন। এরপর বারান্দায় দাঁড়িয়ে কথােপকথন ছিল নিম্নরূপ : ১ম সাংবাদিক ; মি, প্রাইম মিনিস্টার, আমরা আপনাকে ইন্টারভিউ করতে চাই। কিন্তু আমরা সে সুযােগ পাচ্ছি না কেন? আপনি কি বিদেশী সাংবাদিকদের ভয় পান? শেখ মুজিব ! প্রথমেই আমি আপনাদের একটা পালটা প্রশ্ন করতে চাই। আপনারা কোনােরকম এপয়েন্টমেন্ট ছাড়া আমার সঙ্গে কথা বলছেন; আমাদের বাংলাদেশের কোনাে সাংবাদিক কি এভাবে মার্কিন প্রেসিডেন্ট নিক্সন-এর সঙ্গে কথা বলা কিংবা প্রশ্ন জিজ্ঞেস করার সুযােগ পাবে। আর ভয়ের কথা বলছেন? শেখ মুজিব তার যৌবনের প্রায় আর্ধেকটাই কাটিয়েছে কারাগার অভ্যন্তরে। আর জীবনে দু’দুবার রাষ্ট্রদ্রোহীতার মিথ্যা ষড়যন্ত্র মামলায় ফাঁসির আসামী ছিল। তাই শেখের ডিকশনারিতে ভয় বলে কোনাে শব্দ নেই।
আপনারা আমাকে যেকোনাে প্রশ্ন জিজ্ঞেস করতে পারেন। ২য় সাংবাদিক মি, প্রাইম মিনিস্টার, আপনি কি অস্বীকার করতে পারেন যে, বর্তমানে বাংলাদেশের আইন ও শৃঙ্খলাজনিত পরিস্থিতি খুবই খারাপ? এর উন্নতির জন্য আপনার সরকার কী ধরনের ব্যবস্থা নিয়েছে? পরিস্থিতির উন্নতি হওয়ার আদৌ কোনাে সম্ভাবনা আছে কি? শেখ মুজিব :. আমি এতক্ষণ এ ধরনের একটা প্রশ্ন আশা করছিলাম। আসুন, আমরা পরিস্থিতি সঠিকভাবে বুঝবার জন্য একটা পরীক্ষা করি। আপনারা নিশ্চয়ই হােটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালএ উঠেছেন? তাহলে আজ গভীর রাতে ধরুন ১১টা কিংবা ১২টা নাগাদ কোনােরকম গার্ড ছাড়াই আপনারা একাকী পায়ে হেঁটে এই গণভবন থেকে হােটেলে যাবেন। আমি দেখতে চাই, আপনাদের কেউ ছিনতাই কিংবা স্পর্শ করে কিনা? ২য় সাংবাদিক : এটা আবার কী ধরনের পরীক্ষা? শেখ মুজিব শােনেন সাহেবরা। আইন-শৃঙ্খলার কথাই যখন ওঠালেন, তখন আমি আপনাদের ছােট্ট একটা প্রশ্ন করতে চাই। দুনিয়ার সবচেয়ে সভ্য দেশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। এই দেশের সবচেয়ে বড় দুটো মহানগরী হচ্ছে, নিউইয়র্ক আর শিকাগাে সিটি। তাহলে আমাকে বলতে পারেন এ দুটো মহানগরীতে কোনাে মহিলা তাে দূরের কথা, কোনাে ভদ্রলােকের পক্ষে সন্ধ্যার পর ফুটপাথ দিয়ে হেঁটে যাওয়া কি সম্ভব?
৩য় সাংবাদিক : মি. প্রাইম মিনিস্টার, আপনি তাে আমার প্রশ্নগুলাে এড়িয়ে যাচ্ছেন? শেখ মুজিব : আমি কোথায় প্রশ্ন এড়ালাম? পরিস্থিতি ভালাে করে বােঝাবার জন্য আমি তাে শুধুমাত্র আপনাদের সুসভ্য দেশের সঙ্গে আমাদের দেশের আইন-শৃঙ্খলাজনিত পরিস্থিতির তুলনা করলাম মাত্র। ৩য় সাংবাদিক : এবার আমি আপনাকে একটা গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন করতে চাই। শেখ মুজিব : আমি সানন্দে প্রশ্নের জবাব দিব। কিন্তু এটাই হবে আপনাদের শেষ প্রশ্ন। আমার জরুরি কাজ রয়েছে। ৩য় সাংবাদিক : মি, প্রাইম মিনিস্টার, আপনি “বিহারীদের ব্যাপারে কী পদক্ষেপ নিয়েছেন? বাংলাদেশের বিভিন্ন ক্যাম্পগুলােতে কয়েক লাখ ‘বিহারী পরিবার এখন যে নারকীয় অবস্থায় জীবন যাপন করছে, তা স্বচক্ষে দেখার জন্য আপনি ফুরসৎ পেয়েছেন কি? শেখ মুজিব : আপনি আমাকে একই সঙ্গে দুটো প্রশ্ন করেছেন। প্রথমটার উত্তর সােজা। এসব ‘বিহারিরা একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে হানাদার পাকিস্তানি বাহিনীর দোসর হিসাবে নির্বিচারে হত্যা, নারী ধর্ষণ, লুণ্ঠন এবং অগ্নিসংযােগের মতাে মানবতা বিরােধী কাজে লিপ্ত ছিল। তবুও স্বাধীন বাংলাদেশে এরা প্রাণে রক্ষা পেয়েছে। উপরন্তু এরা আন্তর্জাতিক রেডক্রশ-এর মাধ্যমে নিজেদের পাকিস্তানি নাগরিক হিসাবে দাবি জানিয়েছে। স্বাভাবিকভাবে এদের পুরাে দায়িত্বই হচ্ছে পাকিস্তান সরকারের। এখন সবার উচিত হবে, পাকিস্তান সরকারের উপর চাপ প্রয়ােগ করে বিহারীদের পাকিস্তানে ফেরৎ নেয়ার ব্যবস্থা করা।
দ্বিতীয়ত আপনি এদের ক্যাম্প জীবনের অবস্থা সম্পর্কে প্রশ্ন করেছেন। আমার তাে মনে হয়, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক হওয়া সত্ত্বেও নিগ্রোরা সেদেশের বস্তিগুলােতে যেভাবে জীবন যাপন করছে, সে তুলনায় বাংলাদেশে বিহারীরা অনেক ভালাে আছে। কেমন কিনা? (মুচকি হেসে) আপনাদের সংবাদপত্রে আমার জবাবগুলাে হুবহু ছাপালে আমি খুশিই হব। ধন্যবাদ। মাত্র দিন কয়েকের ব্যবধানে আলােচ্য মার্কিনী সাংবাদিকদের প্রশ্নের বিষয় থেকে শুরু করে প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করার স্টাইল ও ধরনের সঙ্গে এ্যান্থনী ম্যাসকার্নহাস-এর প্রশ্ন ও স্টাইল-এর হুবহু মিল দেখে চমকে উঠলাম। তাহলে কি এসব সাম্প্রতিক ঘটনাবলীর মধ্যে একটা গােপন যােগসূত্র রয়েছে? সাংবাদিক সাক্ষাৎকারের একেবারে শেষ পর্যায়ে এসে হঠাৎ করে ম্যাসকার্নহাসের চেহারার মধ্যে পরিবর্তন হলাে। মুহূর্তে বিলীন হলাে রাগান্বিত ভাব। চেহারায় উদ্ভাসিত হলাে এক অমায়িক হাসি। এবার কথােপকথন হচ্ছে নিম্নরূপ : ম্যাসকার্নহাস : মি. প্রাইম মিনিস্টার, আমি আপনাকে আর বিরক্ত করবাে না। আপনার সঙ্গে আমার মাত্র দু’মিনিটের একটা গােপন কথা রয়েছে। ঘর খালি হলে বলতে পারি। শেখ মুজিব : তথ্য দফতরের মহাপরিচালক এম. আর. আখতার মুকুল-এর সামনে আপনি নিশ্চিন্তে কথা বলতে পারেন। ওতাে আপনার পূর্ব পরিচিত; কেমন কিনা? আমাদের খুব বিশ্বাসী অফিসার। ম্যাসকার্নহাস : মুজিব ভাই, আপনি তাে জানেন গত বছর আমি বাংলাদেশের জন্য কী দুঃসাহসিক কাজ করেছি লন্ডনের সানডে টাইমস পত্রিকায় প্রকাশিত আমার এসব চাঞ্চল্যকর রিপাের্টের দরুন বিশ্ব জনমত বাংলাদেশের পক্ষে সােচ্চার হয়েছে। শেখ মুজিব : আমরা তাে আপনার এই অবদানের স্বীকৃতি বার বার করে যাচ্ছি। এখন বলুন, আপনার আসল বক্তব্য কী?
ম্যাসকার্নহাস : আপনি তাে জানেন, শুধুমাত্র এই একটি রিপাের্ট ছাপাবার উদ্দেশে আমাকে এতগুলাে ছেলেমেয়ে নিয়ে দেশত্যাগ করতে হয়েছে। আমি এখন বাস্তুহারা এবং ব্রিটেনে শরণার্থী। শেখ মুজিব : ১৯৪৭ সালে প্রথমবার ভারতের গােয়া থেকে করাচীতে এসেছেন। দ্বিতীয়বার ১৯৭১-এ করাচী থেকে লন্ডনে পাড়ি জমিয়েছেন। এখন বলুন আপনি আমার কাছে কী চান? ম্যাসকার্নহাস : সম্প্রতি পশ্চিম লন্ডনের শেফার্ড বুশ-এর কাছে একটা বাড়ি কেনার চেষ্টা করছি। এজন্য বহু অর্থের প্রয়ােজন। মুজিব ভাই, আমি আপনার কাছে হাজার বিশেক পাউন্ড চাচ্ছি। কথা দিচ্ছি এরপর কোনােদিনই আর আপনাকে বিরক্ত করবাে না। শেখ মুজিব : বলেন কী? বিশ হাজার পাউন্ড? মানে আমাদের প্রায় আট লাখ টাকা? আমি হচ্ছি একটা গরিব দেশের প্রধানমন্ত্রী? এখানকার অফিসারদের সর্বোচ্চ বেতন হচ্ছে মাত্র এক হাজার টাকা। আমি এতাে টাকা বৈদেশিক মুদ্রায় পাবাে কোথেকে? না, টনি আমার দ্বারা সম্ভব হবে না। আমাকে মাফ করতে হবে। ম্যাসকার্নহাস : বলছিলাম কি, গভর্নমেন্ট-এর তাে অনেক সিক্রেট ফান্ড থাকে। সেসব কোনাে ফান্ড…।। শেখ মুজিব : টনি, আমি দুঃখিত। গভর্নমেন্টের কোনাে ফান্ড থেকে এভাবে নগদ ২০ হাজার পাউন্ড দিতে পারব না। তবে ইংল্যান্ডের সিলেটীদের বিশেষ করে সেখানকার আওয়ামী লীগ সভাপতি গাউস খানকে অনুরােধ করতে পারি আপনাকে সাহায্য করার। ম্যাসকার্নহাস : মি, প্রাইম মিনিস্টার, লন্ডনে অন্তত এলাহাবাদ রেস্টুরেন্ট-এর মালিক গাউস খানের সাহায্যের দরকার হবে না। আপনাকে এভাবে বিরক্ত করার জন্য আমি দুঃখিত ধন্যবাদ।
এর মাত্র বছর তিনেক পরের কথা। ১৯৭৫ সালের জানুয়ারিতে আমি লন্ডনে বাংলাদেশ হাইকমিশনে সবে মাত্র প্রেস কাউন্সিলর-এর দায়িত্বে। এটা এমন এক সময় যখন বাংলাদেশে রুশ সমর্থকদের পরামর্শে সৃষ্ট ‘গণ ঐক্য জোট’-এর ব্যর্থতার পর এক দলীয় বাকশাল গঠনের তােড়জোড় শুরু হয়েছে। হাইকমিশনে যােগদানের পর স্থানীয় পরিস্থিতি সম্পর্কে ব্রিফিং নেয়ার সময় একটা গােপনীয় ফাইল থেকে জানতে পারলাম যে, “দি রেপ অব বাংলাদেশ’-এর লেখক এবং বিশিষ্ট সাংবাদিক এ্যান্থনী মাসকার্নহাসকে তার সাম্প্রতিক কর্মকাণ্ডের জন্য ‘অবাঞ্ছিত ব্যক্তিদের তালিকাভুক্ত করা হয়েছে। অর্থাৎ ঢাকার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পূর্ব অনুমতি ছাড়া দূতাবাস থেকে ভিসা ইস্যু করা যাবে না এবং রাষ্ট্রীয় কোনাে অনুষ্ঠানে ম্যাসকার্নহাসকে আমন্ত্রণ করা হবে না। দূতাবাস থেকেই জানতে পারলাম যে, বাংলাদেশের সরকার বিরোধী মহল ছাড়াও সম্প্রতি এ্যান্থনি ম্যাসকার্নহাস-এর নিবিড় সম্পর্ক সৃষ্টি হয়েছে পাকিস্তানি লবির সঙ্গে। সত্যি কথা বলতে কি, মনটা আমার বিষন্নতায় ভরে উঠল। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময় যে এ্যান্থনি ম্যাসকার্নহাস একদিন নিজের ও পরিবারের জীবন বিপন্ন করে গণহত্যার রিপোের্ট সংগ্রহের পর বিশ্বের পত্র-পত্রিকায় প্রকাশের মাধ্যমে দুঃসাহসিকতার নজীর স্থাপন করেছিলেন; সেই ম্যাসকার্নহাস তার প্রার্থিত বিশ হাজার পাউন্ড থেকে বঞ্চিত হয়ে ১৯৭৫-এ আবার গোপনে পাকিস্তানি এজেন্সির সঙ্গে যােগসূত্র স্থাপন করে বসে আছেন।
পাকিস্তানিদের কাছে ম্যাসকার্নহাস-এর মূল্য এখন অনেক বেশি। এখানেই শেষ নয়। ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্ট ভাের রাতে ঢাকায় যারা সপরিবারে বঙ্গবন্ধু হত্যার সঙ্গে জড়িত এবং পরবর্তীকালে নানা ঘটনা প্রবাহে যাদের পরিবার লন্ডনে রয়েছে, এ্যান্থনী মাসকানহাস এ সময় হচ্ছেন তাদের স্থানীয় গার্ডিয়ান। এহেন এ্যান্থনি ম্যাসকার্নহাস ১৯৭৬ সালের আগস্ট মাসের প্রথম সপ্তাহে। লন্ডনের ইনডিপেনডেন্ট টেলিভিশন’-এর ‘ওয়ার্ল্ড এন অ্যাকশন’ অনুষ্ঠানে ফারুক রশিদের চাঞ্চল্যকর সাক্ষাৎকার গ্রহণ করলেন। কিন্তু কথা হচ্ছে, মুজিব হত্যার। মাত্র বছর খানেক সময়ের মধ্যে এভাবে হত্যার স্বীকৃতি দেয়া ছাড়াও ফারুকরশিদ কেন বললেন যে, হত্যাকাণ্ডের প্রস্তুতিকালীন অবস্থা সম্পর্কে জিয়াউর রহমান অবহিত ছিলেন। পরবর্তী সময়ের ঘটনা প্রবাহের মূল্যায়ন থেকে একথা বলা যায় যে, ১৯৭৬ সালের আগস্ট মাস নাগাদ আরও একটি অ্যুথান সম্পর্কিত প্রাথমিক কর্মকাণ্ড শুরু হয়েছিল এবং সবার দৃষ্টি অন্যত্র ব্যস্ত রাখার লক্ষ্যেই বহু ঢাকঢােল পিটিয়ে আলােচ্য টিভি সাক্ষাৎকারের ব্যবস্থা হয়েছিল। এবার সৈয়দ ফারুক রহমান-এর কথা। এর আদি নিবাস উত্তরাঞ্চলের রাজশাহীতে। পিতা মেজর সৈয়দ আতাউর রহমান ছিলেন পাকিস্তান সেনা বাহিনীর ডাক্তার। অবিভক্ত ভারতে ইংরেজ রাজত্বের অন্তিম সময়ে যখন সমগ্র উপমহাদেশ সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় রক্তাপুত; সেই ১৯৪৬ সালে ফারুকের জন্ম। পিতার সম্মতিক্রমে তিনি ১৯৬৫ সালে সামরিক বাহিনীতে যােগদান করেন এবং পাকিস্তানের রিসালপুর মিলিটারি একাডেমিতে তার প্রশিক্ষণ সমাপ্ত হয়। এ সময় তার শিক্ষকদের অন্যতম ছিলেন দুজন বাঙালি অফিসার যথাক্রমে মেজর জিয়াউর রহমান এবং মেজর খালেদ মােশাররফ।
১৯৭০ সাল নাগাদ শিয়ালকোটে ৩১তম ক্যাভেলরি-তে থাকাকালীন সৈয়দ ফারুক ক্যাপ্টেন পদে প্রমােশন লাভ করেন। এ বছরের অক্টোবর মাসে যখন তৎকালীন পূর্ব বাংলায় নির্বাচনী হৈচৈ শুরু হয়ে গেছে, তখন পাকিস্তানের। সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে তাকে সেকেন্ডমেন্ট’-এ পাঠানাে হয় আবুধাবিতে ‘আর্মার্ড। রেজিমেন্ট-এর অন্যতম কমান্ডার হিসাবে। সৈয়দ ফারুক রহমানের মাতুলালয় হচ্ছে বৃহত্তর ময়মনসিংহ জেলার জামালপুরে। মায়ের দিক দিয়ে ফারুক মুজিবনগর সরকারের এককালীন সংস্থাপন সচিব নুরুল কাদের ঝিলু এবং স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে মুজিব মন্ত্রীসভা থেকে তাজউদ্দিনের পদত্যাগের পর নয়া অর্থমন্ত্রী ডক্টর আজিজুর রহমান মল্লিকের নিকটআত্মীয়। আবুধাবিতে থাকাকালীন অবস্থায় ১৯৭১ সালের অক্টোবর মাসে হঠাৎ করে ফারুকের নামে কোলকাতা থেকে একটা চিঠি এসে হাজির। চিঠি লিখেছেন তার নিকটআত্মীয় ও নির্বাসিত মুজিবনগর সরকারের সংস্থাপন সচিব নুরুল কাদের খান ঝিলু। বিষয়বস্তু হচ্ছে, পূর্ব বাংলায় পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ভয়াবহ গণহত্যা এবং | নির্বাসিত মুজিবনগর সরকারের সার্বিক তত্ত্বাবধানে সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের বিবরণ। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের তখন সমাপ্তি পর্যায়ে। ১৯৭১ সালের ১২ই নভেম্বর ক্যাপ্টেন সৈয়দ ফারুক রহমান বিমান যােগে বৈরুত হয়ে চলে গেলেন লন্ডনে। এখানেই তার পরিচয় হলাে বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীর মাধ্যমে সানডে টাইমস পত্রিকার প্রখ্যাত সাংবাদিক এ্যান্থনী ম্যাসকার্নহাস-এর সঙ্গে। ১৯৭৬ সালের আগস্ট মাসে ‘আইটিভি’র ওয়ার্ল্ড ইন অ্যাকশন অনুষ্ঠানে সাক্ষাৎদানকালে রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যার আর এক দাবিদার হচ্ছে মেজর আব্দুর রশিদ। পুরাে নাম খন্দকার আব্দুর রশিদ।
জন্ম ১৯৪৬ সালে কুমিল্লার দাউদকান্দি উপজেলার ছয়ফরিয়া গ্রামে। পিতা ছিলেন। প্রাথমিক স্কুলের শিক্ষক এবং গ্রামীণ গৃহস্থ। মায়ের দিক দিয়ে খন্দকার রশিদ হচ্ছেন একই দাউদকান্দি উপজেলার সন্তান ও বিশিষ্ট রাজনীতিবিদ খন্দকার মােশতাক আহম্মদের দূর সম্পর্কে আত্মীয়। তরুণ রশিদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নকালে শিক্ষা অসমাপ্ত রেখেই ১৯৬৫ সালে পাকিস্তান সামরিক বাহিনীতে যােগদান করেন। পাঞ্জাবের রিসালপুর মিলিটারি অ্যাকাডেমিতে ট্রেনিং-এর সময় তার পরিচয় হয় এক ব্যাচ সিনিয়র ক্যাডেট ফারুকের সঙ্গে। অচিরেই দুজনের মধ্যে গড়ে উঠে নিবিড় সখ্যতা। ট্রেনিং সমাপ্তির পর ফারুকের পােস্টিং হয় শিয়ালকোটে ল্যানসার্স রেজিমেন্ট-এ। আর ছ’মাসের ব্যবধানে রশিদের পােস্টিং সীমান্ত প্রদেশের বানুতে অবস্থানরত সেকেন্ড ফিল্ড আর্টিলারিতে। ১৯৬৮ সালের কথা। খন্দকার রশিদ তখন সবেমাত্র সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট থেকে ক্যাপ্টেন হিসাবে প্রমােশন পেয়েছেন। বাৎসরিক ছুটিতে দেশে এলেন। উদ্দেশ্য বিবাহ। ঢাকা ও কুমিল্লাতে বেড়াবার পর রশিদ যখন বন্দরনগরী চট্টগ্রামে তখন তার বিয়ের কথাবার্তা হলাে বিশিষ্ট শিল্পপতি এস.এইচ.খানের জ্যেষ্ঠ কন্যা টিংকুর সঙ্গে। অচিরেই বিবাহ সম্পন্ন হলে ক্যাপ্টেন রশিদ সস্ত্রীক চলে যান। কর্মস্থল বানুতে।
এস,এইচ,খানের বড় ভ্রাতা হচ্ছেন প্রখ্যাত শিল্পপতি এ. কে. খান। এই আবুল কাসেম খান ছিলেন এককালে পাকিস্তানের ফৌজি প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান মন্ত্রীসভার শিল্পমন্ত্রী। আবার এ. কে. খান-এর জামাই হচ্ছেন চট্টগ্রামের শিল্পপতি ও আওয়ামী লীগের দক্ষিণপন্থী উপদলীয় অন্যতম নেতা এম, আর, সিদ্দিকী। এখানে উল্লেখ্য যে, বঙ্গবন্ধু হত্যার পরও জনাব সিদ্দিকী আরও বছর কয়েক পর্যন্ত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে রাষ্ট্রদূত ছিলেন। খন্দকার মােশতাক আহম্মদের দূর সম্পর্কে আত্মীয় খন্দকার রশিদের বৈবাহিক সূত্রে এভাবেই সৃষ্টি হলাে ‘হাই কানেকশন।’ ১৯৭১ সালের অক্টোবর মাসের প্রথম সপ্তাহে খন্দকার রশিদ ছুটিতে সপরিবারে এলেন যুদ্ধ বিধ্বস্ত পূর্ব বাংলায়। একদিকে হানাদার বাহিনীর হামলা আর অন্যদিকে মুক্তিযােদ্ধাদের পাল্টা আক্রমণে জনজীবন দারুণভাবে বিপর্যস্ত। দাউদকান্দির ছােট্ট ছয়ফরিয়া গ্রামে থাকা একেবারে অসম্ভব। তাই খন্দকার রশিদ সপরিবারে হাজির হলেন চট্টগ্রামে বিত্তশালী শ্বশুর বাড়িতে। তার ভায়রা এম, আর, সিদ্দিকী এপ্রিল মাস থেকে মুজিবনগরে। স্ত্রী ও দুই কন্যাকে চট্টগ্রামে কিছুটা নিরাপদ হেফাজতে রেখে ক্যাপ্টেন খন্দকার রশিদ পাড়ি জমালেন ভারতের আগরতলায়। সেদিনের তারিখটি হচ্ছে ১৯৭১ সালের ২৯শে অক্টোবর। | তখন মুক্তিযুদ্ধের শেষ পর্যায় এবং মুজিবনগর সরকারের তত্ত্বাবধানে ১১টি সেক্টর ছাড়াও জিয়াউর রহমানের কমান্ডে ‘জেড’ ফোর্স, শফিউল্লাহর কমান্ডে “এস” ফোর্স এবং খালেদ মােশাররফ-এর কমান্ডে “কে” ফোর্স-এর জন্ম হয়েছে। এছাড়াও স্থানীয়ভাবে গঠিত টাঙ্গাইলে কাদেরিয়া বাহিনী, গফরগাও-এ আফসান বাহিনী, মানিকগঞ্জে হালিম বাহিনী, গােপালগঞ্জে ‘হেমায়েত বাহিনী’র মতাে বহু সংখ্যক বাহিনী দারুণভাবে তৎপর হয়ে উঠেছে।
এদিকে স্বাভাবিকভাবেই সীমান্তের ওধারে ভারতীয় সহযােগিতায় ক্যাপ্টেন রশিদ যােগ দিলেন তৎকালীন লে. কর্নেল জিয়াউর রহমানের “জেড” ফোর্সে। সপ্তাহ কয়েক প্রয়ােজনীয় প্রশিক্ষণ ইত্যাদির পর ক্যাপ্টেন রশিদ যখন তার সর্ব প্রথম অ্যাকশন-এর জন্য সিলেট সীমান্ত দিয়ে রণাঙ্গনে প্রবেশ করে, তখন ১৯৭১ সালের ডিসেম্বর মাসের প্রথম সপ্তাহ। তবে এ সময় জেড ফোর্সের যে ব্যাটারির সঙ্গে রশিদ যুক্ত ছিল সেটাই স্বাধীনতা পরবর্তীকালে দ্বিতীয় ফিল্ড আর্টিলারি রেজিমেন্ট-এ উন্নীত হয় এবং প্রমােশন লাভের পর মেজর খন্দকার আব্দুর রশিদ হলেন সেই রেজিমেন্টের কমান্ডিং অফিসার। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭২ সালের প্রথমার্ধে ঢাকায় আবার দুই বন্ধু ফারুক আর রশিদের দেখা হলাে। সামরিক বাহিনীর চাকুরিতে ফারুক এক বছরের সিনিয়র সত্ত্বেও তখন পর্যন্ত অবিবাহিত। অথচ রশিদের বিবাহিত জীবন হচ্ছে ১৯৬৮ সাল থেকে। শেষ পর্যন্ত খন্দকার রশিদের প্রচেষ্টায় ১৯৭২ সালের আগস্ট মাস নাগাদ স্বীয় শ্যালিকার সঙ্গে ফারুকের বিবাহ সম্পন্ন হলাে। এভাবে দুই বন্ধু পরিণত হলেন দুই ভায়রা ভাই-এ।