মুজিবের হত্যাকারী মেজর নূর-ম্যাকানহাস বঙ্গবন্ধুর ঘাতক সুবেদার মােসলেমউদ্দিন-
লিজ
সপরিবারে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার মাত্র তিন সপ্তাহ পর সাপ্তাহিক ‘ফার ইস্টার্ন ইকনমিক রিভিউ’ পত্রিকায় ৫ই সেপ্টেম্বরে প্রকাশিত সংখ্যায় এতদসম্পর্কিত বেশ কিছু তথ্য প্রকাশিত হয়। তখন খন্দকার মােশতাক আহম্মদ ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত এবং বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি বেশ নাজুক। পত্রিকাটিতে বলা হয় যে, পুরাে ব্যাপারটার জন্য একটা ‘ব্লু-প্রিন্ট’ তৈরি করা হয়েছিল এবং বিভিন্ন উপদলের মধ্যে যােগাযােগ স্থাপনের দায়িত্ব অর্পিত হয়েছিল জনৈক ক্ষমতাশালী স্টেট মন্ত্রীর উপর। পত্রিকাটিতে আরও বলা হয় যে, কথিত ষড়যন্ত্রকারীদের সংখ্যা ছিল সাতচল্লিশ জনের মতাে এবং ৭ই আগস্ট তারিখে অনুষ্ঠিত এদের দ্বিতীয় বৈঠকে সিভিলিয়নদের মধ্যে একমাত্র আলােচ্য স্টেট মন্ত্রী মহােদয় উপস্থিত ছিলেন। কারাে কারাে মতে এসব বৈঠকে শেখ মুজিবকে হত্যার কথা বলা হয়নি। শুধুমাত্র এ মর্মে জানানাে হয়েছিল যে, প্রেসিডেন্ট মুজিবকে ক্ষমতা থেকে হটিয়ে দেয়ার জন্য পদত্যাগ করতে বলা হবে। তিনি অস্বীকার করলে তাকে জোর করে সরিয়ে দেয়া হবে। সাপ্তাহিক ‘ফার ইস্টার্ন ইকনমিক রিভিউ’ পত্রিকার এই প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে যে, সামরিক যে কজন সদস্য এই ঘটনার সঙ্গে জড়িত হয়েছিল তাদের অধিকাংশই জানত না যে, আসলে কী হতে যাচ্ছে। বেঙ্গল ল্যানসার্স এবং ৫৩৫ ইনফ্যানট্রি রেজিমেন্টের এসব সদস্যরা উপরের অফিসারদের অর্ডার পালন করেছে মাত্র। প্রকাশ ১১ই থেকে ১৪ই আগস্টের মধ্যে কয়েক দফায় অনুষ্ঠিত বৈঠকে রু-প্রিন্টের চূড়ান্তকরণ করা হয়। পরবর্তীকালে লন্ডনে প্রদত্ত এক টেলিভিশন সাক্ষাৎকারে কর্নেল ফারুক এ মর্মে তথ্য প্রকাশ করেছেন যে, মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান ঘটনার সঙ্গে জড়িত না থাকা সত্ত্বেও আলােচ্য বৈঠকগুলাের অগ্রগতি সম্পর্কে তাঁকে জানানাে হতাে এবং তিনি পক্ষে বা বিপক্ষে কোনাে মতামতই দেননি।
কোনাে কোনাে মহলের মতে সংশ্লিষ্ট এজেন্সিগুলাে সঠিক সংবাদ সরবরাহে ব্যর্থ হলেও এ সময় ব্রিগেডিয়ার খালেদ মােশাররফ স্বীয় সন্দেহের কথা উল্লেখ করে প্রেসিডেন্ট মুজিবকে হুঁশিয়ার করেছিলেন। কিন্তু মহল বিশেষের পরামর্শে এই হুঁশিয়ারির প্রতি তেমন গুরুত্ব আরােপ করা হয়নি। তাঁকে এ মর্মে বুঝানাে হয় যে, চাকুরিতে আকাক্ষিত আরও একধাপ প্রমােশন না পাওয়ায় খালেদ মােশাররফ এ ধরনের অহেতুক সন্দেহ প্রকাশ করেছেন। তথাপিও বঙ্গবন্ধু এ সময় আকস্মিকভাবে পাকিস্তান প্রত্যাগত বিশ্বাসী সামরিক অফিসার কর্নেল জামিলকে সামরিক গােয়েন্দা বিভাগের প্রধান হিসাবে নিয়ােগ করেন। কিন্তু কর্নেল জামিল নতুন দায়িত্বে যােগদানের পূর্বেই মুজিব হত্যার ষড়যন্ত্র বাস্তবায়িত হয়। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় যে, শেষ মুহূর্তে বঙ্গবন্ধুর টেলিফোন পেয়ে এই কর্নেল। জামিল নিজেই প্রাইভেট গাড়ি চালিয়ে ১৫ই আগস্ট ভাের রাতে বত্রিশ নম্বরের পথে মাত্র আধা ফার্লং দূরে সােবহানবাগ কলােনি পর্যন্ত এসেছিলেন এবং আত্মাহুতি দিয়েছিলেন।‘ফার ইস্টার্ন ইকনমিক রিভিউ’ পত্রিকায় মুজিব হত্যার বিস্তারিত তথ্য দিয়ে আরাে বলা হয় যে, অনুষ্ঠিত একটি প্রস্তুতি বৈঠকে আলােচ্য ট্যাঙ্কগুলাে সম্পর্কিত প্রশ্ন উত্থাপিত হয়। এ মর্মে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল যে, নির্ধারিত দিনে রাজধানী ঢাকা নগরীর রাস্তায় ট্যাঙ্ক বের করার কী যৌক্তিকতা দেখানাে যাবে।
তখন এদের বােঝানাে হয় যে, সাধারণত প্রতি সপ্তাহের বৃহস্পতিবার রাতে আর্মার্ড রেজিমেন্ট মহড়ার জন্য রাস্তায় বের হয়, তাই বৃহস্পতিবার দিবাগত রাতে অর্থাৎ শুক্রবার ভাের রাতে ‘অ্যাকশন’ হলে রাস্তায় ট্যাঙ্ক বের হওয়ার ব্যাপারে কেউই আর সন্দেহ করতে পারবে না। এই ধরনের এক প্রেক্ষিতেই ‘অ্যাকশন’-এর সময় নির্ধারণ করা হয়। এদিকে ঘটনা পরম্পরায় আর একটি সুযােগের সৃষ্টি হয়। বাকশাল গঠনের পর ১৫ই আগস্ট শুক্রবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রেসিডেন্ট মুজিবের বক্তৃতা দেয়ার কথা এবং সে মােতাবেক আয়ােজনও সম্পূর্ণ করা হয়। কিন্তু আগের দিন। অর্থাৎ ১৪ই আগস্ট বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় একটি হাত বােমা বিস্ফোরিত হলে প্রেসিডেন্ট মুজিবের নিরাপত্তা ব্যবস্থা আরাে কঠোর করার লক্ষ্যে সেনাবাহিনীর সাহায্যের প্রয়ােজনীয়তা দেখা দেয়। কোনাে কোনাে মহলের মতে বাংলাদেশে এসব ট্যাঙ্ক আমদানির প্রাথমিক ব্যবস্থাদি সম্পর্কে প্রেসিডেন্ট মুজিব বিশেষ ওয়াকেফহাল ছিলেন না। মিসরইসরাইল যুদ্ধে সিনাই মরুভূমিতে ব্যবহৃত রুশ (যুগােশ্লাভিয়ার) নির্মিত এই ২৯টি ট্যাঙ্ক বন্ধুত্বের নিদর্শন স্বরূপ মিসর উপহার দিতে আগ্রহী হলে বাংলাদেশের পক্ষে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সম্মতি জ্ঞাপন করে এবং জাহাজযোেগে এগুলাে চট্টগ্রামের পথে রওনা হয়ে যায়। প্রকাশ, পরে পররাষ্ট্র মন্ত্রী ড. কামাল বিষয়টি চূড়ান্ত অনুমােদনের জন্য উপস্থাপিত করলে প্রেসিডেন্ট মুজিব দারুণভাবে স্বীয় উম্মা জানিয়েছিলেন এবং ভবিষ্যতে কেবলমাত্র নিজেদের উদ্যোগে এ ধরনের কোনাে কাজ না করার জন্য লিখিতভাবে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে নির্দেশ দিয়েছিলেন। উল্লেখ্য যে, ১৯৭৩ সালের ১৬ই ডিসেম্বর স্বাধীনতা দিবসে শেরে বাংলা নগরে অনুষ্ঠিত মার্চ পাস্টে শেখ মুজিবুর রহমান এসব ট্যাঙ্কের স্যালুট গ্রহণ করেন।
আসলে কীভাবে ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্ট ভােররাতে বঙ্গবন্ধু ও অন্যান্যদের হত্যাকাণ্ড সমাধা হয়েছিল তার প্রকৃত তথ্য রহস্যের অন্তরালেই থাকার কথা। কেবলমাত্র বিদেশী সাংবাদিকদের প্রতিবেদন এবং অভিযুক্ত ব্যক্তিদের প্রদত্ত সাক্ষাৎকার ও বিবৃতির ভিত্তিতে যেটুকু দাঁড় করানাে সম্ভব, আপাতত সেটুকুই গ্রহণ করতে হচ্ছে। অবশ্য সব কিছুই ভবিষ্যতে রিসার্চ এবং সত্যতার যাচাই সাপেক্ষের ব্যাপার। বিদেশী সাংবাদিক টনি ম্যাসকার্নহাস-এর রচিত বিতর্কিত এ লিগাসি অব ব্লাড গ্রন্থে হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে কিছু তথ্য বর্ণিত হয়েছে। টনির বর্ণনা ছাড়াও অপর এক বিদেশী সাংবাদিক লিফসুজ-এর মতে ১৪ই আগস্ট দিবাগত রাতে কুর্মিটোলার নির্মীয়মান নতুন এয়ারপাের্টে প্রস্তাবিত অ্যাকশনে অংশগ্রহণকারীদের একত্রিত করা হয় এবং কর্নেল ফারুক ও মেজর রশিদ এদের উদ্দেশে নাতিদীর্ঘ বক্তৃতা প্রদান করেন। পত্রিকাটির মতে, এসব বক্তৃতায় মুজিব সরকারের কার্যকলাপের তীব্র সমালােচনা করা হয়। বলা হয় যে, এই সরকার সামরিক বাহিনীকে অবহেলা করে ‘রক্ষী বাহিনীকে ব্যাপকভাবে শক্তিশালী করে তুলছে। বক্তৃতায় এ মর্মে অভিযােগ করা হয় যে, মুজিব সরকারের নীতি হচ্ছে সামরিক বাহিনীকে ছাঁটাই করা এবং বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব রক্ষী বাহিনী’র উপর ছেড়ে দেয়া। উপরন্তু বাংলাদেশকে ভারতের কাছে ছেড়ে দেয়ার জন্য মুজিব সরকার একটি চুক্তিপত্রে দস্তখত করেছে। তাই এই সরকারকে উৎখাত করতেই হবে এবং তা আজ রাতেই।
বিদেশী সাংবাদিকদের বর্ণিত তথ্যে আরও উল্লেখ করা হয়েছে যে, পূর্ব পরিকল্পনা অনুসারে ‘অপারেশন শুরু হয় রাত সাড়ে বারােটায়। প্রথমেই মেজর রশিদ এবং লেফটেন্যান্ট রফিক হাসানকে একদল সৈন্যসহ পাঠানাে হলাে তেজগাঁও এয়ারপাের্ট-এ ‘পজিশন নেয়ার জন্য। এরপর রাতের নিশ্ৰুপ অন্ধকারে ট্যাঙ্ক ও আর্মার্ড গাড়িগুলাে চারটি গ্রুপে বিভক্ত হয়ে রওনা হলাে। প্রথম গ্রুপ ধানমন্ডির বত্রিশ নম্বর রােডে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের বাড়ির দিকে; হাবিলদার মােসলেহ উদ্দিনের নেতৃত্বে দ্বিতীয় গ্রুপ বাকশাল-এর ক্ষমতাশালী নেতা শেখ মণির খোজে। মেজর শাহরিয়ার ও ক্যাপ্টেন হুদার নেতৃত্বে তৃতীয় গ্রুপ গেল শেখ পরিবারের আত্মীয় ও মন্ত্রী আব্দুর রব সেরনিয়াবাত-এর সরকারি বাসভবনের দিকে। সবচেয়ে শক্তিশালী চতুর্থ গ্রুপ রওনা হলাে সাভার অভিমুখে। রক্ষী বাহিনীর সম্ভাব্য যেকোনাে প্রতি আক্রমণ নিশ্চিহ্ন করাই ছিল এদের মূল দায়িত্ব। এছাড়া শাহবাগে অবস্থিত ঢাকা বেতার কেন্দ্রের কর্তৃত্ব গ্রহণের দায়িত্ব অর্পিত হলাে পদচ্যুত মেজর শরিফুল ইসলাম ডালিম-এর উপর।
ধানমন্ডির বত্রিশ নম্বর রাস্তাটা যেখানটায় এসে মীরপুর রােডে মিশেছে, তার উল্টাদিকে সােবহানবাগ বরাবর বড় রাস্তায় এবং বত্রিশ নম্বর রােড থেকে ধানমন্ডি লেক অতিক্রম করে পুলিশ ফাড়িতে যাওয়ার পথে যে ছােট্ট পুল রয়েছে, এই দুটো জায়গায় সৈন্যরা ‘পজিশন নিল। বাকিরা অত্যন্ত সন্তর্পণে এগিয়ে গেল বঙ্গবন্ধুর বাসভবন ঘেরাও করতে। এর পরের ঘটনা প্রবাহ সম্পর্কে যেসব তথ্য পাওয়া যায় তা অনেক ক্ষেত্রেই পরস্পরবিরােধী। কারাে কারাে মতে এক ঝাঁক গুলি হওয়া সত্ত্বেও প্রেসিডেন্ট মুজিবের বাসভবনে প্রহরারত আর্মি পাটুন থেকে কোনােই প্রতিরােধ হয়নি। বরং বেশ কয়েকজন সামরিক অফিসারকে একত্রে দেখে সেদিন এরা স্যালুট প্রদান করেছিল। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময় মুজিবনগর প্রথম ব্যাচ-এ কমিশনপ্রাপ্ত এবং প্রধান সেনাপতি এম, এ, জি ওসমানীর অন্যতম এডিসি শেখ কামাল প্রথম গুলির শব্দেই তেতলা থেকে নেমে এক তলায় রিশেপসনে এসে কাকে যেন ফোনে। যােগাযােগের চেষ্টা করছিল। সম্ভবত তার ধারণা ছিল যে চরম বামপন্থীরা বাড়ি আক্রমণ করেছে। তাই সৈন্যদের হাতে উদ্যত স্টেনগান দেখেও নিজের পরিচয় দিয়ে কিছু একটা বলতে চেয়েছিল। কিন্তু কথা শেষ হওয়ার আগেই শেখ কামালের দেহটা গুলিতে ঝাঁঝরা হয়ে গেল। লাশটা মুখ থুবড়ে মেঝেতে পড়ে রইল। মাত্র মিনিট কয়েকের মধ্যে নিচ তলায় বঙ্গবন্ধুর কনিষ্ঠ ভ্রাতা শেখ নাসেরসহ আরও কয়েকজনকে হত্যা করা হলাে। এদিকে গুলি এবং হৈচৈ-এর শব্দে প্রেসিডেন্ট মুজিব ঘুম থেকে উঠে দোতলার সিঁড়ির মাথা পর্যন্ত এগিয়ে এসেছিলেন। তার পরণে ছিল লুঙ্গি এবং গায়ে গেঞ্জী। তিনি আক্রমণকারীদের সিঁড়ির গােড়ায় দেখতে পান এবং এদের নেতৃস্থানীয়রা তার পূর্ব পরিচিত। অবস্থাদৃষ্টে একথা বিশ্বাস করার যথেষ্ট কারণ রয়েছে যে, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে এদের দুদফায় কথােপকথনও হয়েছিল। সম্ভবত প্রথম দফা কথাবার্তায় বঙ্গবন্ধুকে আক্রমণকারীদের সঙ্গে যাওয়ার প্রস্তাব দেয়া হয়েছিল এবং তিনি প্রস্তাবে সম্মত হয়ে পাঞ্জাবি পরার জন্য এবং পাইপ আনার অছিলায় বেড রুমে ফিরে যাওয়ার সুযােগ পেয়েছিলেন। এ সময় তিনি কাদের সঙ্গে ফোনে আলাপ করছিলেন, তা সঠিকভাবে বলা সম্ভব নয়।
তিনি কি সেনাবাহিনীর তৎকালীন মেজর জেনারেল শফিউল্লাহকে যােগাযােগ করেছিলেন? ফোনে যােগাযােগ হয়ে থাকলে কী কথা হয়েছিল? জেনারেল শফিউল্লাহকে ফোন না করে থাকলে কেন করেন নি? এতগুলাে বছর পর এতাে সব কেন-র জবাব সংগ্রহ করা আর সম্ভবপর নয়। তবে একথা সঠিক যে, জীবনের এই অন্তিম মুহূর্তে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব তার বিশ্বাসভাজন কর্নেল জামিলকে সাহায্যের জন্য ফোনে ডেকে পাঠিয়েছিলেন এবং কর্নেল জামিল সেই নির্দেশ পালনের জন্য একাকী এগিয়ে এসেছিলেন। বঙ্গবন্ধুর প্রতি কর্তব্য নিষ্ঠর জ্বলন্ত স্বাক্ষর হিসাবে সেদিন কর্নেল জামিল নির্মম মৃত্যুকে বরণ করলেন। আগেই উল্লেখ করেছি যে, বঙ্গবন্ধুকে হত্যার কোনাে প্রত্যক্ষদর্শীর বস্তুনিষ্ঠ বিবরণ সংগ্রহ করা সম্ভবপর নয়। কেননা হত্যাকারীরা পঁচাত্তরের ১৫ই আগস্ট ভাের রাতে ধানমন্ডির বত্রিশ নম্বর রােডের বাড়িতে অবস্থানকারী সবাইকে হত্যা করেছিল। এদের মধ্যে বেগম মুজিব, শেখ নাসের, সস্ত্রীক শেখ কামাল, সস্ত্রীক শেখ জামাল এবং বালক রাসেল অন্যতম।
তবে ঘটনা পরম্পরাকে ভিত্তি করে কোনাে কোনাে মহলের মতে পাঞ্জাবি পরে পাইপ হাতে প্রস্তুত হয়ে বঙ্গবন্ধু দোতলার সিঁড়ির মাথায় দাঁড়ালে দ্বিতীয় দফা কথাবার্তা হয়। মুজিব তখনও জানতেন না যে, নিচে শেখ কামালের লাশ পড়ে রয়েছে। কথাবার্তার এক পর্যায়ে তিনি এ মর্মে শর্ত প্রদান করলেন যে, জ্যেষ্ঠপুত্র শেখ কামালকে সঙ্গে করে আক্রমণকারীদের সঙ্গে যেতে রাজি আছেন। স্বাভাবিকভাবেই আক্রমণকারীরা এ ধরনের শর্তে অসম্মতি জ্ঞাপন করে। সম্ভবত এজন্যই তাৎক্ষণিকভাবে প্রেসিডেন্ট মুজিবকে চোখ বেঁধে নিয়ে যাওয়ার কথা বলা হলে তিনি চিৎকার করে অস্বীকৃতি জানান। এর মধ্যেই সস্ত্রীক শেখ মণিকে হত্যাকারী গ্রুপটিও এসে হাজির হয়। এর পরের মর্মান্তিক ঘটনার কিছু বর্ণনা রয়েছে সাংবাদিক টনি মাসকার্নহাসএর লেখনীতে। কর্নেল ফারুকের বরাত দিয়ে তিনি উল্লেখ করেছেন যে, চরম মুহূর্তে মেজর মহিউদ্দিন ব্যর্থ হলে প্রাক্তন মেজর নূর তার স্টেনগান থেকে বঙ্গবন্ধুকে লক্ষ করে গুলিবর্ষণ করে। কিন্তু ফার ইস্টার্ন ইকনমিক রিভিউ” পত্রিকার সংবাদদাতা বাংলাদেশ : দি আনফিনিশড রেজুলিউশন’ গ্রন্থের রচয়িতা লরেন্স লিফসুজ এবং উপমহাদেশের বিশিষ্ট সাংবাদিক মরহুম এ এল খতিব-এর বক্তব্য বেশ ভিন্নতর।
জনাব খতিৰ জন্মসূত্রে শ্রীলংকার নাগরিক এবং সাংবাদিকতাকে পেশা হিসাবে গ্রহণের পর যৌবন ও প্রৌঢ়ত্বের শ্রেষ্ঠ বছরগুলাে বােম্বাই-করাচী-ঢাকাসিগ্নাতে অতিবাহিত করেন। আট দশকের শুরু থেকে প্রায় এক যুগের বেশি সময় ধরে জনাব খতিবের কর্মক্ষেত্রে ছিল এই ঢাকাতেই। এ সময় তিনি অত্যন্ত অন্তরঙ্গ আলােকে এদেশীয় রাজনীতি অবলােকন করেন। শুধু তাই-ই নয়; সাংবাদিক অতিৰ অন্যান্য রাজনীতিবিদরা ছাড়াও বিশেষ করে ব্যক্তিগতভাবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ ছিলেন। জীবন সায়াহ্নে এসে ভদ্রলোক ঢাকার বাংলাদেশ অবজারভার পত্রিকার দিল্লীস্থ সংবাদদাতা হিসাবে কাজ করার সময় রচনা করলেন চাঞ্চল্যকর গ্রন্থ ‘হু কিল্ড মুজিব’। তিনি লিখেছেন,… যতদূর জানা যায়, সুবেদার মােসলেমউদ্দিন শেখ মণিকে খুন করে এসে এই অবস্থা দেখে সাথে সাথেই বঙ্গবন্ধুকে লক্ষ করে গুলি ছোড়ে। বঙ্গবন্ধু থমকে দাঁড়ান। তারপর পড়ে যান সিড়ির উপর। তখন সময় সকাল ৫-৪০ মিনিট। পড়ে যাওয়া পুরাে দেহটার উপর চলে ব্রাশ ফায়ার। তারপর মেইন সুইচ অফ করে নৃশংস হত্যাকাণ্ড। দুই কন্যা (বিদেশে অবস্থানরত) ব্যতীত সপরিবারে সবাই নিহত হন। মােসলেমউদ্দিন মৃত্যুর পূর্বে তার জবানবন্দিতে স্বীকার করেছে যে, সে-ই শেখ মুজিবকে প্রথম গুলি করে। মােসলেমউদ্দিন ১৯৭৩ সনের পাকিস্তান প্রত্যাগত সুবেদার। ১৯৭৫ সনের ২রা নভেম্বর খালেদ মােশাররফ ক্ষমতা দখল করলে সুবেদার মােসলেম দেশ ত্যাগ করে। পরবর্তীকালে জিয়াউর রহমান তাকে তৃতীয় সচিবের (বিদেশে বাংলাদেশ দূতাবাসে) মর্যাদা দেয় এবং অনারারী ক্যাপ্টেন পদে উন্নীত করে।
কিন্তু এতেও মােসলেমউদ্দিন সন্তুষ্ট হয়নি এবং ১৯৭৭ সালের ২রা অক্টোবরের জিয়া বিরােধী প্রস্তাবিত সামরিক অভ্যুত্থানে জড়িয়ে পড়ে। অভ্যুত্থান ব্যর্থ হলে মােসলেম ধরা পড়ে। বিশেষ সামরিক আদালতের রায়ে মােসলেমউদ্দিনের ফাঁসি হয়। মৃত্যুর পূর্বে মােসলেমউদ্দিন তার জবানবন্দিতে কোর্টকে জানায় যে, শেখ মুজিবকে হত্যার জন্যই আজ তার ফাসি হচ্ছে। কিন্তু ১৯৯৯ সালে এসে অসমর্থিত খবর হচ্ছে, মােসলেমউদ্দিন এখনাে জীবিত এবং জলাতঙ্কগ্রস্ত। বিভিন্ন সূত্রে প্রাপ্ত তথ্যের উপর ভিত্তি করে লন্ডনের রাজনৈতিক মহলের মতে সস্ত্রীক শেখ মণিকে হত্যার পর সুবেদার মােসলেমউদ্দিন বত্রিশ নম্বরের ঐতিহাসিক বাড়িতে উপস্থিত হয়ে প্রেসিডেন্ট মুজিবকে তখনও পর্যন্ত জীবিত রয়েছেন দেখে দারুণভাবে উত্তেজিত হয়ে পড়ে। উর্দু ভাষায় অশ্রাব্য গালাগালির পর হাবিলদার মােসলেমউদ্দিনের স্টেনগানটা গর্জন করে উঠল। বর্ষিত হলাে উপর্যুপরি কয়েকটি গুলি। শেখ মুজিবের রক্তাক্ত দেহটা হুড়মুড় করে সিড়িতেই পড়ল। আর তার সাদা পাঞ্জাবি তাজা খুনে লাল হয়ে উঠল। ফিনকি দিয়ে বেরিয়ে আসা রক্তে সিড়িটা ভিজে গেল। মুহূর্ত কয়েক সময়ের ব্যবধানে স্বাধীন বাংলাদেশের স্রষ্টা ও জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বীয় বাসভবনের সিঁড়িতে ইন্তেকাল (ইন্না লিল্লাহে … রাজিউন) করলেন। তখনও তার ডান হাতে শক্ত করে ধরা পাইপ। নিয়তির পরিহাসই বলতে হয়। যেখানে ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্ট তাের রাতে পাকিস্তান প্রত্যাগত কর্নেল জামিল প্রেসিডেন্ট মুজিবের প্রাণ রক্ষার জন্য নিজের জীবন আত্মাহুতি দিলেন; সেখানে আর এক পাকিস্তান প্রত্যাগত সুবেদার হালিবদার মােসলেমউদ্দিন মাত্র মিনিট বিশেকের ব্যবধানে নৃশংসভাবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যা করল।
অথচ ইতিহাসে একথা সুস্পষ্টভাবে লিখিত থাকবে যে, বাংলাদেশের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানই হচ্ছেন পাকিস্তানে আটকে পড়া বাঙালিদের ত্রাণকর্তা। শুধুমাত্র তাঁরই প্রচেষ্টায় এসব বাঙালির দেশে প্রত্যাবর্তন এবং চাকুরির ধারাবাহিকতা ও জ্যেষ্ঠতাসহ পুনর্বাসন সম্ভব হয়েছিল। সপরিবারে বাংলাদেশে প্রত্যাবর্তনকালে এসব বাঙালিদের অসুবিধার কথা চিন্তা করে বঙ্গবন্ধু সরকার এ সময় কাবুল, দিল্লী এবং ঢাকা বিমানবন্দরে লিয়াজো অফিস পর্যন্ত স্থাপন করেছিল। এখানেই শেষ নয়। পাকিস্তান প্রত্যাগত সামরিক ও বেসামরিক কর্মচারীদের আর্থিক সংকট মােচনের লক্ষ্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবের নির্দেশে এ সময় তেজগাঁও বিমানবন্দরে অ্যাকাউন্ট্যান্ট জেনারেল-এর ক্যাম্প অফিস বসিয়ে এক মাসের অগ্রিম বেতনের চেক দেয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছিল, শুধু তাই-ই নয় ত্বরিৎ এসব চেক ভাঙাবার জন্য বিমানবন্দরেই অস্থায়ীভাবে খােলা হয়েছিল সােনালী ব্যাংকের শাখা। অথচ ১৯৭২ সালের ১০ই জানুয়ারি বঙ্গবন্ধুর দেশে ফেরার আগেই ব্যুরােক্রেসির পরামর্শে মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ী মুক্তিবাহিনীকে ডিসব্যান্ড’ করা হয়েছিল। ইতিহাসে আরও লিপিবদ্ধ থাকবে যে, পাকিস্তানে আটকে পড়া কয়েক লাখ বাঙালির নিরাপদে দেশে প্রত্যাবর্তনের জন্য সদ্য স্বাধীন বাঙালি জাতিকে সেদিন বিরাট মূল্য দিতে হলাে। মার্কিনী চাপ এবং পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পরামর্শে ১৯১ জন যুদ্ধাপরাধীসহ প্রায় ৯১ হাজার পাকিস্তানি যুদ্ধবন্দিকে ছেড়ে দিতে হয়েছিল। মানবতা-বিরােধী সুস্পষ্ট অভিযােগ থাকা সত্ত্বেও আমরা এসব যুদ্ধাপরাধীদের বিচার পর্যন্ত করতে পারিনি। বিপুল সংখ্যক ধর্ষিতা নারী (নতুন নামকরণে বীরাঙ্গনা) এসব কর্মকাণ্ডকে কপালের লিখন’ হিসাবে মেনে নিলেও স্বীয় বিবেককে সান্ত্বনা দিতে ব্যর্থ হলাে। শুধু দীর্ঘ নিশ্বাসে ফরিয়াদ জানালাে পরম করুণাময়ের দরবারে। আর যুদ্ধাপরাধীদের প্রত্যাশিত বিচারে বঞ্চিত কয়েক লাখ শহীদ পরিবারের প্রিয়জনদের নিঃশব্দ ক্রন্দনে খােদার আরশ পর্যন্ত কেঁপে উঠল। আমরা নিঃশব্দে সবই মেনে নিয়েছিলাম শুধুমাত্র দেশ ও জাতির বৃহত্তর স্বার্থে।
সূত্রঃ মুজিবের রক্ত লাল – এম আর আখতার মুকুল