বাংলাদেশের মাটি থেকে ভারতীয় সৈন্য প্রত্যাহারের কৃতিত্ব শেখ মুজিবের
কিন্তু অনেকের মতে একাত্তরে যা সম্ভব হয়নি, ১৯৭৫-এ এসে সে ধরনের একটি ভয়াবহ ঘটনা সংঘটিত হলাে। বাঙালি জাতিকে এক ও অভিন্ন করার মহান লক্ষ্যে এবং দেশ ও জাতির বৃহত্তর স্বার্থে ‘ক্ষমা ও মহানুভবতার ভিত্তিতে এতােসব করা সত্ত্বেও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নিজেই অব্যাহতি পেলেন না। ক্ষমাপ্রাপ্ত ‘কোলাবরেটর’ আর ‘বিশ্বাসঘাতকদের কারসাজিতে তাঁকে দিতে হলাে চরম মূল্য। প্রায় ৩৫ বছরের সংগ্রামবহুল রাজনৈতিক ঘটনা প্রবাহ যে মহানায়কের অভ্যুদয়ে হয়েছিল বাংলাদেশের বাঙালি জাতি চিরতরে সেই মহানায়ককে হারালাে একাত্তরে বাঙালি জাতির মহাদুর্যোগের সময় শেখ মুজিবুর রহমান। উদাত্ত কণ্ঠে আহ্বান জানিয়েছিলেন,ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তােলাে। রক্ত যখন দিয়েছি, আরও রক্ত দেবাে; তবুও দেশকে মুক্ত করে ছাড়বাে ইন্শাল্লাহ্”। তার এই অমর বাণী অক্ষরে অক্ষরে বাস্তবায়িত হয়েছে। তাইতাে এক সাগর রক্তের বিনিময়ে বিশ্বের মানচিত্রে স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসাবে বাংলাদেশ তার স্থান করে নিলাে। আর একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে শাহাদত বরণকারীদের পথ ধরে দুঃখী। বাঙালির অর্থনৈতিক মুক্তির সংগ্রামে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব পরবর্তীকালে আত্মাহুতি দিলেন। এজন্যই তার স্থান হলাে প্রতিটি বাঙালির হৃদয়ের অন্তঃস্থলে বাংলাদেশ।
স্বাধীন ও সার্বভৌম করার অব্যবহিত পরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আরও যে একটি ঐতিহাসিক দায়িত্ব পালন করেছেন, এখানে তার উল্লেখ না করলে বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে মূল্যায়ন অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। একথা ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে যে, হাজার হাজার বছর ধরে আমাদের এই গাঙ্গেয় ব-দ্বীপ এলাকার নিপীড়িত ও শােষিত জনগােষ্ঠীকে বাঙালিত্বের জাতিসত্তা প্রদান ছাড়াও পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর কবজা থেকে রক্তাক্ত লড়াই-এর মাঝ দিয়ে একটি নির্দিষ্ট ভৌগােলিক সীমারেখায় বাংলাদেশ। স্বাধীন সার্বভৌম করার কৃতিত্ব হচ্ছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের সফল নেতৃত্বের। এরই পাশাপাশি শুধুমাত্র আলােচনার মাধ্যমে এদেশের মাটি থেকে মিত্র বাহিনীর ভারতীয় সৈন্যদের প্রত্যাহারের ব্যবস্থা করার একক কৃতিতুও হচ্ছে শেখ মুজিবের। অবশ্য এক্ষেত্রে তৎকালীন ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর আন্তরিক সহযােগিতা ছিল তুলনাহীন।
আমার স্থির বিশ্বাস বাংলাদেশের অন্য কোনাে রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের পক্ষে এই ঐতিহাসিক দায়িত্ব পালন অসম্ভব ছিল। স্বাধীনতার ঠিক ৯০ দিনের মাথায় কীভাবে বাংলাদেশের মাটি থেকে ভারতীয় সৈন্য প্রত্যাহার করার ব্যবস্থা হয়েছিল, সে আমলের একজন পদস্থ সরকারি কর্মচারী হিসাবে আমি নিজেই তার অন্যতম সাক্ষী। এখন সেই দুর্লভ মুহূর্তের প্রতিবেদন। দুপুরে খাওয়ার পর কোলকাতার রাজভবনে আমরা জনাকয়েক শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে একান্তে আলাপ করছিলাম। তারিখটা ছিল ১৯৭২ সালের ৪ঠা ফেব্রুয়ারি। আমি তখন বাংলাদেশ সরকারের তথ্য দফতরের মহাপরিচালক (পরবর্তীকালে এই পদের বিলুপ্তি ঘটে)। দিন দুই আগে ঢাকা থেকে ৩৫ জন সাংবাদিককে নিয়ে কোলকাতায় এসেছি। এসব সাংবাদিকরা কোলকাতায় এসেছেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান-এর প্রথম বিদেশ সফর সংক্রান্ত সংবাদ সংগ্রহের জন্য। এদের থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে কোলকাতার বিখ্যাত গ্রেট ইস্টার্ন হােটেলে। আমার মনে তখন দারুণ কৌতূহল। বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আলাপ প্রসঙ্গে বুকে সাহস সঞ্চয় করে বললাম, “স্যার, বাংলাদেশের ও ভারতের দুই প্রধানমন্ত্রীর মধ্যে যে আলােচনা হতে যাচ্ছে, তাতে কোনাে এজেন্ডা তাে দেখলাম না? তাহলে আপনারা কী কী বিষয়। আলােচনা করবেন?”
বঙ্গবন্ধু তাঁর পাইপটাতে ঠিকমতাে আগুন ধরিয়ে এরিনমাের তামাকের গন্ধওয়ালা এক গাদা ধোয়া ছেড়ে কথা বলতে শুরু করলেন : “পাকিস্তানের কারাগার থেকে ছাড়া পেয়ে লন্ডনে গেলাম। সেখান থেকে ঢাকায় আসার পথে দিল্লী বিমানবন্দরে জীবনে প্রথম এই মহিলাকে (ইন্দিরা গান্ধী) দেখলাম। এর আগে তাে এর সঙ্গে আমার কোনাে পরিচয় ছিল না।” সঙ্গে সঙ্গে বললাম, “স্যার, মিসেস ইন্দিরা গান্ধী বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে দারুণভাবে সাহায্য করা ছাড়াও আপনার জীবন বাঁচাবার জন্য পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের দরজায় দরজায় ঘুরেছেন।” বঙ্গবন্ধু মুচকি হেসে আবার কথা শুরু করলেন। “তােদের বন্ধু-বান্ধবরা তাে আমাকে অর্ধশিক্ষিত বলে। তাহলে ইতিহাস। থেকে একটা কথার জবাব দে, আজ পর্যন্ত সাম্রাজ্যবাদ কিংবা ক্যুনিস্ট কিংবা অন্য কেউ, যারাই অন্যদেশে সৈন্য পাঠিয়েছে, তারা কি স্বেচ্ছায় সৈন্য প্রত্যাহার করেছে? তােরা কি দেখাতে পারিস যে, এমন কোনাে দেশ আছে।”
হঠাৎ করে আলােচনার পরিবেশ খুবই গুরু গম্ভীর হয়ে উঠলাে। আমরা সবাই মুখ চাওয়া-চাওয়ি করতে লাগলাম। উনি পাইপে পরপর কয়েকটা টান দিয়ে হালকা মেজাজে কথা আরম্ভ করলেন। “কানের মাঝ থাইক্যা সাদা-কাচা চুল বাইরাইয়া আছে ভারতে এমন সব ঝানু পুরানাে আইসিএস অফিসার দেখছাে? এরা সব ইন্দিরা গান্ধীরে বুদ্ধি দেওনের আগেই আজ আলােচনার সময় মাদামের হাত ধইর্যা কথা লমু। জানাে কী কথা? কথাটা হইতাছে, মাদাম তুমি বাংলাদেশ থাইক্যা কবে ইন্ডিয়ান। সােলজার ফেরত আনবা?” বঙ্গবন্ধু তার দেয়া প্রতিশ্রুতি রেখেছিলেন। কোলকাতার রাজভবনে ফার্স্ট রাউন্ড আলােচনার শুরুতে দুজনে পরস্পরের কুশলাদি বিনিময় করলেন। এরপর বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয়ভাবে সাহায্য করার জন্য ভারতের জনগণ, ভারত সরকার এবং প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীকে ধন্যবাদ জানিয়ে বঙ্গবন্ধু হঠাৎ করে আসল কথাটা উত্থাপন করলেন। শেখ মুজিব : মাদাম, আপনে কবে নাগাদ বাংলাদেশ থেকে ভারতীয় সৈন্য প্রত্যাহার করবেন? ইন্দিরা গান্ধী : বাংলাদেশে আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতি তাে এখনও পর্যন্ত নাজুক
পর্যায়ে রয়েছে।
পুরা ‘সিচুয়েশন বাংলাদেশ সরকারের কন্ট্রোলে আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করাটা কি বাঞ্ছনীয় নয়? অবশ্য আপনি যেভাবে বলবেন সেটাই করা হবে। শেখ মুজিব : মুক্তিযুদ্ধে আমাদের প্রায় ৩০ লাখ লােক আত্মাহুতি দিয়েছে। স্বাধীন বাংলাদেশে আইন ও শৃঙ্খলাজনিত পরিস্থিতির জন্য। আরও যদি লাখ দশেক লােকের মৃত্যু হয়, আমি সে অবস্থাটা বরদাশত করতে রাজি আছি। কিন্তু আপনারা অকৃত্রিম বন্ধু বলেই বলছি, বৃহত্তর স্বার্থে বাংলাদেশ থেকে ভারতীয় সৈন্য প্রত্যাহার করলে আমরা কৃতজ্ঞ থাকব। ইন্দিরা গান্ধী : এক্সেলেন্সি, কারণটা আর একটু ব্যাখ্যা করলে খুশি হবাে। শেখ মুজিব : এখন হচ্ছে বাংলাদেশ পুনর্গঠনের সময়। তাই এই মুহূর্তে দেশে শক্তিশালী রাজনৈতিক বিরােধিতা আমাদের কাম্য নয়। কিন্তু ভারতীয় সৈন্যের উপস্থিতিকে অছিলা করে আমাদের বিরােধী পক্ষ দ্রুত সংগঠিত হতে সক্ষম হবে বলে মনে হয়। মাদাম, আপনেও বােধ হয় এই অবস্থা চাইতে পারেন না। তাহলে কবে নাগাদ ভারতীয় সৈন্য প্রত্যাহার করছেন? ইন্দিরা গান্ধী : (ঘরের সিলিং-এর দিকে তাকিয়ে একটু চিন্তা করলেন) এক্সেলেন্সি, আমার সিদ্ধান্ত হচ্ছে, আগামী ১৭ই মার্চ বাংলাদেশের মাটি থেকে ভারতীয় সৈন্য প্রত্যাহার করা হবে।
এক্সেলেন্সি প্রাইম মিনিস্টার, ১৭ই মার্চ হচ্ছে আপনার জন্মদিন। এই বিশেষ দিনের মধ্যে আমাদের সৈন্যরা বাংলাদেশ থেকে ভারতে ফিরে আসবে। ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী তার দেয়া প্রতিশ্রুতি রক্ষা করেছিলেন। ভারত সরকারের ব্যুরােক্রেসি এবং দক্ষিণপন্থী রাজনৈতিক মহলের বিরােধিতা অগ্রাহ্য করে ইন্দিরা গান্ধীর সুস্পষ্ট নির্দেশে যেদিন ভারতীয় সৈন্যদের শেষ দলটি বাংলার মাটি ত্যাগ করলাে, সেদিনের তারিখটি হচ্ছে ১৯৭২ সালের ১৭ই মার্চ। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের জন্মদিন। ইতিহাসের নির্মম পরিহাসই বলতে হয় উপমহাদেশের শান্তি স্থাপনের জন্য নিবেদিত এই দুই মহান নেতাই পরবর্তীকালে আততায়ীর হস্তে নিহত হন। এরপরেও কথার পিঠে কথা থেকে যায়। আমাদের ভবিষ্যৎ বংশধরেরা যখন প্রশ্ন করবে বাংলাদেশের ভৌগােলিক সীমারেখায় প্রকৃত বাঙালি জাতীয়তাবাদ দর্শনের প্রবক্তা এবং দিশারী বঙ্গবন্ধুর ‘অপরাধ’ কী ছিল? তখন প্রতিক্রিয়াশীল মহল থেকে ত্বরিৎ জবাব হবে, শেখ মুজিবুর রহমান ‘পাকিস্তান ভেঙে স্বাধীন বাংলাদেশের স্রষ্টা এবং তিনি মনে প্রাণে অগণিত দুঃখী বাঙালিকে ভালােবেসেছিলেন…এটাই তাঁর ‘অপরাধ’।
যখন বিংশ শতাব্দীর নব্বই দশকের নতুন প্রজন্ম প্রশ্ন করবে, আমরা প্রকৃত সত্যকে উদঘাটিত করতে চাই, তাই বলতে হবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ‘মহা অপরাধ’ কোনটি? তখন ধর্মান্ধদের মুহূর্তে জবাব হবে, শেখ মুজিবের মাথার চুল থেকে পায়ের নখ পর্যন্ত সব কিছুই ছিল বাঙালিত্বে ভরা। তাঁর আচার ব্যবহার আর কথাবার্তায় ছিল গ্রাম-বাংলার মাটির সোঁদা গন্ধ এবং তাঁর ধমনীতে প্রবাহিত গ্রাম-বাংলার রক্ত। এসবই হচ্ছে শেখ মুজিবের ‘মহা অপরাধ। প্রায় তিন যুগের বেশি সময় ধরে শত নির্যাতন ও উৎপীড়নের মাঝ দিয়ে যে মহান নেতার সৃষ্টি হয়েছিল, বছরের পর বছর ধরে নির্জন কারাগারের দুঃসহ যন্ত্রণা সহ্য করে যে রাজনৈতিক মহাপুরুষের অভ্যুদয় হয়েছিল, আর শত প্রলােভন ও ভয়-ভীতির মুখে যে বিশাল ব্যক্তিত্ব এবং সৌম্য চেহারার সিংহপুরুষ বিরাট মহীরুহের মতাে দাঁড়িয়ে ছিল; এক ভয়াবহ চক্রান্তের শিকার হয়ে বাংলার নয়নমণি সেই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্ট সােবে সাদেক-এর প্রাক্কালে এই ধরাধাম থেকে চিরবিদায় গ্রহণ করলেন। বাংলাদেশের ঘড়িতে তখন ভাের ৫-৪০ মিনিট। দূর থেকে ভেসে আসছে মােয়াজ্জেন-এর আজানের ধ্বনি … আসসালাতু খায়রুম মিনান নউম।
সূত্রঃ মুজিবের রক্ত লাল – এম আর আখতার মুকুল