You dont have javascript enabled! Please enable it!
বটগাছ পইড়া গেলে হাওয়ার দাপট টের পাইবেন—বঙ্গবন্ধু
আলজিয়ার্স-এ জোট নিরপেক্ষ শীর্ষ সম্মেলনে যােগদানের পর বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সবেমাত্র দেশে ফিরে এসেছেন। এর মধ্যেই দক্ষিণ আমেরিকার চিলি থেকে বিশ্বের পত্র-পত্রিকা, সংবাদ সংস্থা এবং বেতার-টিভির মাধ্যমে পাক্কা খবর এসে পৌছল। সান্টিয়াগােতে ব্যাপক রক্তপাতের মাঝ দিয়ে সামরিক অভ্যুত্থান সফল হয়েছে। নির্বাচনে বিজয়ী। সমাজতন্ত্র মতাদর্শের কমরেড আলেন্দের সরকারকে উৎখাত করা হয়েছে। চিলির বিমান বাহিনী ও ট্যাঙ্ক বাহিনীর সম্মিলিত আক্রমণে প্রেসিডেন্টের প্যালেস এখন ধূলিস্যাৎ। বর্ষীয়ান প্রেসিডেন্ট আলেন্দে এবং তার বহু সহকর্মী নিহত। পাশ্চাত্য পত্র-পত্রিকার রিপাের্ট অনুসারে চিলিতে শুরু হয়েছে গণহত্যা। রাজধানী সান্টিয়াগাের ফুটবল খেলার স্টেডিয়ামে এখন প্রতিদিন শত শত বামপন্থী সমর্থকদের ফায়ারিং স্কোয়াডের সামনে দাঁড় করিয়ে হত্যা করা হচ্ছে। হাজার হাজার লেখক, সাংবাদিক, সাহিত্যিক, শিক্ষক, ডাক্তার, প্রকৌশলী, অভিনেতা, গায়ক এবং চিত্রশিল্পী হয় পলাতক আর না হয় স্বেচ্ছায় নির্বাসিতের জীবন বরণ করে নিয়েছে। চিলির সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় জীবনে মহা-দুর্যোগ। চিলির ক্ষমতা এখন সামরিক জান্তার কজায়। স্বঘােষিত নতুন ফৌজী প্রেসিডেন্ট হলেন জেনারেল পিনােচেট। সেদিন দুপুরে খাওয়ার পর দৈনিক জনপদ সম্পাদক আব্দুল গাফফার চৌধুরী। আর আমি যেয়ে হাজির হলাম গণভবনে। তখন ঘড়িতে বেলা প্রায় সাড়ে তিনটা। বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে একান্তে আলাপের এটাই হচ্ছে প্রকৃষ্ট সময়। দলীয় নেতৃবৃন্দ, সচিবালয়ের উর্ধ্বতন কর্মচারী এবং তােষামােদকারীদের সবাই এ সময় মােটামুটিভাবে অনুপস্থিত। প্রধানমন্ত্রীর পার্সোন্যাল স্টাফের জনাকয়েক পাশের কামরায় দিবা-নিদ্রায় মগ্ন কেবলমাত্র সাদা পােশাকে গােয়েন্দা বিভাগের দুজন ঘরের বাইরে দোতলার বারান্দায় পায়চারী করছে।
আর অদূরে নিচের তলায় ও গেটে ডিউটিরত আর্ম গার্ড। এখানে উল্লেখ করা প্রয়ােজন যে, মাত্র কিছুদিন আগে পর্যন্তও দুপুরের খাওয়ার পর আব্দুল গাফফার চৌধুরী নিয়মিতভাবে বঙ্গবন্ধুর আত্মজীবনীর ডিকটেশন নিচ্ছিলেন। কিন্তু আকস্মিকভাবে চৌধুরী সাহেবের স্ত্রীর ‘অবসাদজনিত অসুখের জন্য ডিকটেশন নেয়া অনিয়মিত হয়েছে। ঘটনা পরম্পরায় শেষ অবধি বঙ্গবন্ধুর আত্মজীবনী লেখার কাজটি অসম্পূর্ণ রয়ে যায়। তবুও বাঙালি জাতির ইতিহাসের এই অমূল্য সম্পদ বঙ্গবন্ধুর ডিকটেশন দেয়া স্বীয় আত্মজীবনীর ষাট দশক পর্যন্ত প্রথমাংশের টেপ ও গাফফার চৌধুরীর হাতে লেখা পাণ্ডুলিপি এখন কোথায় আছে এবং কীভাবে আছে তা অজ্ঞাতই রয়ে গেল। এ তাে শুধু আত্মজীবনী নয়, এটা হচ্ছে অসংখ্য অজানা ও চাঞ্চল্যকর তথ্যে ভরপুর প্রায় ৩০ বছরের রাজনৈতিক উত্থান-পতনের ইতিহাস। অবশ্য বঙ্গবন্ধুর আত্মজীবনীর ডিকটেশন কে গ্রহণ করবে এই প্রশ্নও এ সময় পর্দার অন্তরালে এক তাৎপর্যপূর্ণ বাদানুবাদ হয়েছিল।
তৎকালীন তথ্য প্রতিমন্ত্রী জনাব তাহেরউদ্দিন ঠাকুর বঙ্গবন্ধুর কাছে এ মর্মে সুপারিশ করলেন যে, পাকিস্তান প্রত্যাগত ঝানু অফিসার সৈয়দ নাজেমউদ্দিন হাশেম ডিকটেশন গ্রহণের দায়িত্ব যথাযথভাবে পালনে সক্ষম হবেন কিন্তু তথ্য মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম-সচিব বাহাউদ্দিন চৌধুরী এবং বাংলাদেশ বেতারের মহাপরিচালক হিসাবে আমার সুপারিশ ছিল ভিন্নতর শ্রদ্ধাভাজন জনাব নাজেমউদ্দিন হাশেমের পরিবর্তে এই দায়িত্ব দৈনিক জনপদ সম্পাদক জনাব আব্দুল গাফফার চৌধুরীকে দেয়া বাঞ্ছনীয় হবে কারণ হিসাবে বঙ্গবন্ধুকে বললাম, আমাদের জানামতে ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্যে সুপণ্ডিত হলেও হাশেম সাহেব ইসলামাবাদে থাকাকালীন সময়ে তৎকালীন প্রভাবশালী তথ্য সচিব আলতাফ গহরের সুপারিশে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ফিল্ড মার্শাল (স্বঘােষিত) আইয়ুব খানের বিতর্কমূলক আত্মজীবনী ‘প্রভু নয়, বন্ধু’র ডিকটেশন গ্রহণ করেছিলেন। তাই একই ব্যক্তিকে এ ধরনের দায়িত্ব দেয়া বুদ্ধিমত্তার পরিচয়। হবে না। সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে বঙ্গবন্ধুর আত্মজীবনী তাে লেখা হবে বাংলায়-ইংরেজিতে নয়। সাংবাদিকতায় বহুদিনের অভিজ্ঞতার কথা ছেড়ে দিলে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে আব্দুল গাফফার চৌধুরীর দখল প্রশ্নাতীত। এতেই কাজ হলাে। গণভবনের দোতলায় প্রধানমন্ত্রীর বেডরুমের ভেজানাে দরজা ঠেলে দিতেই খুলে গেল সব কটা জানালায় টেনে দেয়া ভারি পর্দা। ঘরের ভিতর আধাে অন্ধকার বিছানায় বঙ্গবন্ধু একটা বালিশে মাথা গুঁজে উপুড় হয়ে। মাঝে মধ্যে ফুপিয়ে কান্নার শব্দ।  হ্যা, বঙ্গবন্ধু তখন গােপনে ক্রন্দন করছিলেন। কিন্তু কিসের জন্য এই ক্রন্দন? আমরা দুজনা নিঃশব্দে ঘরের মাঝখানে এসে হতভম্বের মতাে দাঁড়ালাম। সঙ্গে সঙ্গে গুরুগম্ভীর স্বরে প্রশ্ন কে? কেডা? পরিচয় দিতেই তিনি বললেন, “লাইট জ্বালাইয়া দে আর চেয়ার টাইন্যা বয়। তােগাে লগে কথা আছে।”
এর মধ্যেই শেখ মুজিব নিজেকে সামলিয়ে বিছানায় উঠে বসেছেন। সাইড টেবিল থেকে পাইপটা নিয়ে ধরিয়েই বললেন, “তােরা বােধ হয় শুনছাে যে চিলিতে হেরা আলেন্দেরে শ্যাষ করছে। এবার কার পালা?” এরপর কিছুক্ষণ আলাপ হলাে আলজিয়ার্স জোট-নিরপেক্ষ সম্মেলনে ফেদেল  ক্যাস্ট্রোর দেয়া হুঁশিয়ারির কথা। হঠাৎ করে বঙ্গবন্ধু বললেন, “আর পারি না। সব বেটাই চোর। যাকেই দায়িত্ব দিতাছি সেই-ই চুরি করছে। এবার ভাবতাছি, ফ্রান্সের দ্য গল-এর মতাে ‘রিটায়ার করুম। পাবলিক মিটিং-এ বলুম এবার আপনারা নতুন নেতা দেখেন। আমি গামছা কাঁদে মনপুরায় (ভােলার অন্তর্গত) চললাম।” কথা ক’টা বলেই বঙ্গবন্ধু নিভে যাওয়া পাইপটা আবার জ্বালিয়ে গাফফার চৌধুরীর দিকে তাকালেন উত্তরের আশায়। গাফফার সাহেব হাত কচলিয়ে জবাব দিলেন, মুজিৰ ভাই, যদি বেআদপী না নেন তাে বলি। দেশ শাসনের ব্যাপারটা বাঘের পিঠে চড়ার মতাে। একবার যখন বাঘের পিঠে সওয়ার হয়েছেন, তখন নামা এতাে সহজ নয়। হয় আপনি চাবকিয়ে বাঘকে বশে আনবেন না হয় বাঘই আপনাকে খেয়ে ফেলবে। এখানে আপােষের কোনাে প্রশ্নই নাই।”
বঙ্গবন্ধু মুহূর্ত কয়েক ঠোট কামড়িয়ে আবার প্রশ্ন করলেন, “আচ্ছা বলেন তাে, আমার এ্যাডমিনিস্ট্রেশনের কী কী দোষ আছে?” গাফফার চৌধুরী তুরিৎ উত্তর দিলেন, “অভয় দিলে বলতে পারি, আপনি শেরে বাংলা ফজলুল হকের মতাে মাদার্স হার্ট—মানে কিনা মায়ের ক্ষমাসুন্দর হৃদয় নিয়ে দেশ শাসন করছেন। তাই সমস্যা অনেক বেশি মনে হচ্ছে। এ্যাডমিনিস্ট্রেশন চালাবার সময় আপনার হৃদয় সম্রাট আওরঙ্গজেবের মতাে নির্দয় হলে, এতদিনে অনেক এগুতে পারতেন।” একজন পদস্থ সরকারি কর্মচারী হওয়া সত্ত্বেও আমি হঠাৎ করে বলে উঠলাম, “স্যার, মুক্তিযুদ্ধের সময় আপনি তাে ছিলেন পাঞ্জাবের মিয়ানওয়ালী জেলে। আপনি জানেন না, কাদের ক্ষমা করেছেন? অথচ মুজিবনগর সরকারের প্রকাশ্য ঘােষণা ছিল যে, কেউ নিজের হাতে বিচার তুলে নেবেন না। কেবলমাত্র সুই বিচারের পর দোষী ব্যক্তিদের শাস্তি দেয়া হবে। তাহলে আমাদের ওয়াদার ইজ্জত রইলাে কই?”  বঙ্গবন্ধু কী যেন চিন্তা করে হঠাৎ বিকটভাবে চিৎকার করে উঠলেন, “তােমরাই তাে আমার এই সর্বনাশ করেছ। কেন আমাকে জাতির পিতা বানাইলা? পিতা তাে ক্ষমা করবেই?”

জবাবটা দিলাে গাফফার চৌধুরী, “আপনি হচ্ছেন স্বাধীন বাংলাদেশের স্রষ্টা তাই আমরা সবাই মিলে আপনাকে জাতির পিতা বানিয়েছি। কিন্তু সেদিন পর্যন্ত যারা এ ব্যাপারে কথায় কথায় বাড়াবাড়ি করছিল, তাদের অধিকাংশই এখন জাসদ করছে। বাকিরা খুব লীগে রয়েছে।” এবার নিভে যাওয়া পাইপটা টেবিলের উপর রেখে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নিচু গলায় বললেন,  “শােনেন সাহেবরা। চিলিতে তাে আলেন্দেরে শ্যাষ করছে। কিন্তু আমারে এমতে কাইত করতে পারবাে না। যখন কারবার করবাে, তখন তিন বাহিনীর তিন চীফ আইস্যা আমারে স্যালুট দিয়া কইবাে, স্যার অনেক দিন গভরমেন্ট চালাইলেন। আপনি এখন টায়ার্ড হইয়া পড়ছেন। এই কাগজের মধ্যে দস্তখত কইর্যা এখন রেস্ট নেন। আপনি জাতির পিতা ঠিকই থাকবেন। এই না কইয়া আমার কাছ থাইক্যা দস্তখত আদায় করবাে। আমিও দস্তখত দিয়া যামুগা মনপুরায়। এরপর বুঝতেই তাে পারতাছেন, ক্যুনিস্টরা যাইবাে আন্ডার গ্রাউন্ডে। তখন আপনাগাে মতাে ন্যাশনালিস্টগে এরা তক্তা বানাইবাে।” ঘরের মধ্যে তখন এক অসহনীয় পরিবেশ। অজানা আশঙ্কায় মনটা কেপে উঠল। বঙ্গবন্ধু আবার কথা বললেন, “আমি যখন থাকুম না, তখন আমার দাম বুঝবেন। বটগাছ পইড়া গেলে হাওয়ার দাপট টের পাইবেন।” কথা ক’টা বলেই তিনি আবার পাইপ ধরালেন। . আমরা দুজন হতভম্বের মতাে তাকিয়ে রইলাম।

সূত্রঃ মুজিবের রক্ত লাল – এম আর আখতার মুকুল

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!