বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী মুজিবের জন্যও নির্দিষ্ট হয়েছিল এই ধরনের একটি সুদৃশ্য কটেজ’। নিরাপত্তার খাতিরে এই বিশেষ এলাকায় সম্মেলন চলাকালীন সময়ে টুরিস্ট কিংবা স্থানীয় জনসাধারণের জন্য সমুদ্রে গােসল ছিল সম্পূর্ণ বেআইনী। মাত্র ৩৬ ঘণ্টার নােটিশে প্রায় লক্ষাধিক টুরিস্টকে আলজিয়ার্স পরিত্যাগে বাধ্য করা হয়েছিল। অভ্যাস মতাে খুব ভােরে একজনমাত্র সিকিউরিটি গার্ড আর দোভাষী মহিলাকে নিয়ে প্রধানমন্ত্রী মুজিব সবে মাত্র তাঁর প্রাতঃভ্রমণ শেষ করে নির্দিষ্ট ‘কটেজ’-এ ফিরে এসেছেন। এমন সময় দেখলেন, বিরাট আকারের এক মােটর ভ্যান তার কটেজ’-এর সামনে দাঁড়িয়ে। বুকে নিরাপত্তার ব্যাজ লাগানাে দুজন লােক তালিকা মিলিয়ে নানা ধরনের খাবার-দাবার, টিন ফুড, মাছ মাংস—এমনকি টাটকা শাক-সবজি আর ফল-মূল পর্যন্ত নামিয়ে রাখছে। শেষ আইটেম ছিল কয়েক ‘ক্রেট’ পানীয়। ক্রেটগুলাে নামাবার সঙ্গে সঙ্গে বঙ্গবন্ধু খুবই চঞ্চল হয়ে উঠলেন। বিকট এক চীৎকার দিয়ে দোভাষী মহিলাকে তর্জনী তুলে বললেন স্বীয় ইচ্ছার কথা। এই কটেজ-এ একমাত্র ‘কোকাকোলা’-সেভেন আপ ছাড়া বিয়ারহুইস্কি-ভােদকা-জিন-রাম-রেডওয়াইন কিছুই ডেলিভারি হবে না। অবাক বিস্ময়ে দোভাষী মহিলার চোখ জোড়া একেবারে ছানাবড়া। জীবনে বহু ভিআইপি’র সঙ্গে দোভাষীর কাজ করা সত্ত্বেও এ ধরনের অভিজ্ঞতা এই প্রথম। কী আশ্চর্য, প্রধানমন্ত্রী মুজিবের গালে শত্রু আর মাথায় টুপি-কোনােটাই নেই। অথচ ইসলামী শরিয়ত মােতাবেক মদিরার প্রশ্নে কী ভয়ংকর নীতিবােধ!
শেখ সাহেবের রাগের বহিঃপ্রকাশে দোভাষী মহিলা আমতা আমতা করে বার কয়েক ঢােক গিলল। এরপর স্থানীয় দেহাতী ভাষায় লােক দুজনকে বুঝিয়ে বললাে মদের ‘ক্রেট’গুলাে ফেরত নেয়ার জন্য। লােক দুজন ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে হুকুম তামিল করল। জোট নিরপেক্ষ সম্মেলনের প্রতিদিনকার অধিবেশনের পর সবচেয়ে উল্লেখযােগ্য বিষয় হচ্ছে বিভিন্ন বিশ্ব-নেতৃবৃন্দের মধ্যে সৌজন্য সাক্ষাৎকার আর একান্ত বৈঠক। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব বিপুল সংখ্যক রাষ্ট্রনায়কের সঙ্গে মােলাকাত ও কুশলাদি বিনিময় করলেন। প্রথমেই এক মজার ব্যাপার হয়ে গেল। প্রথম দিন সম্মেলন কক্ষের সঙ্গে – লাগা লবিতে এক সােফায় পাইপ মুখে শেখ মুজিব আপন মনে চিন্তা করছিলেন। মাঝে-মধ্যে লবিতে নানান দেশের নেতৃবৃন্দের আনাগােনা ছিল অব্যাহত।
এমন সময় তিনি দেখতে পেলেন বুকে মেডেল এবং পূর্ণ সামরিক পােশাকে বছর সাতেকের এক কৃষ্ণাঙ্গ শিশু লবিতে ঘুরে বেড়াচ্ছে। কড়া নিষেধাজ্ঞার দরুন শিশুর দুজন গার্ড লবির বাইরে দাঁড়িয়ে। এদিকে শেখ মুজিব ইশারা-ইংগিতে শিশুটির সঙ্গে করলেন নানা ধরনের কৌতুক। হঠাৎ দেখতে পেলেন বিশাল কৃষ্ণাঙ্গ দেহী প্রায় সাড়ে ছ’ফুটের এক মানব সন্তান ফিল্ড মার্শালের সামরিক পােশাকে ঘরের মধ্যে যমদূতের মতাে দাড়িয়ে। বুকে অসংখ্য মেডেল। এই দানব-সদৃশ ভদ্রলােক তখন ধধবে সাদা দাঁত বের করে হেসেই চলেছেন। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর মনে হলাে সম্মুখে তার আজরাইল দাড়িয়ে। পাকিস্তানের প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে কোথায় যেন চমৎকার মিল রয়েছে। ইনিই হচ্ছেন আফ্রিকার অন্যতম দুর্ভাগা দেশ উগান্ডার প্রধান সামরিক অধিকর্তা এবং স্বঘােষিত প্রেসিডেন্ট ইদি আমীন। একটি সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে সেনাধ্যক্ষ ইদি আমীন তখন উগান্ডায় ক্ষমতাসীন। কিন্তু উগান্ডাকে বুঝতে হলে এর পূর্বের ইতিহাস জানতে হবে। বহু যুগ ধরে ইংরেজ রাজত্বে উগান্ডায় সাম্রাজ্যবাদী শােষণের রূপ ছিল নগ্ন ও ভয়ঙ্কর প্রকৃতির। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় যে, ইউরােপীয় শ্বেতাঙ্গ সাম্রাজ্যবাদীদের আফ্রিকান কলােনি সম্পর্কিত নীতি ছিল সব সময়েই অভিন্ন। এরই জের হিসাবে ইংরেজ শাসকগােষ্ঠী উগান্ডাতে কোনাে সময়েই স্থানীয় নেটিভদের জন্য পাশ্চাত্য শিক্ষা ব্যবস্থা পর্যন্ত করেনি। ফলে স্বাধীনতা লাভের অব্যবহিত পরে উগান্ডার প্রশাসন পরিচালনাই এক বিরাট সমস্যার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। উপরন্তু পরস্পর কলহরত নানা উপজাতির আবাসস্থল উগান্ডায় সংহতির ভিত ছিল খুবই দুর্বল।
অন্যদিকে রাজধানী কাম্পালা থেকে উগান্ডার প্রতিটি শহরের দোকান-পাট ও ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রায় পুরােটাই হচ্ছে বহিরাগত ভারতীয় ও পাকিস্তানি ব্যবসায়ীদের কব্জায়। এঁদের মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে একটাই এবং তা হচ্ছে মুনাফা-শুধু মুনাফা। এরা সবাই ব্রিটিশ পাসপাের্ট হােল্ডার এবং প্রতিনিয়তই এঁদের লাভের টাকা পাউন্ডের আকারে পাচার হচ্ছে ব্রিটেনের ব্যাংকগুলােতে। পরিবার-পরিজনসহ এসব হাজার হাজার গুজরাটি, সিন্ধী আর আগাখানী ব্যবসায়ী পুরুষানুক্রমে শতাধিক বছর ধরে উগান্ডায় বসবাস করা সত্ত্বেও কোনােদিনই সুষ্ঠুভাবে স্থানীয় সােহেলী ভাষা রপ্ত করেনি কিংবা কালা আদমীদের সঙ্গে বৈবাহিক সম্পর্ক পর্যন্ত স্থাপন করেনি। এঁদের ছেলেমেয়েরা এশীয়দের উদ্যোগে স্থাপিত বিদ্যালয়ে গুজরাটি-হিন্দী-ইংরেজি ভাষার মাধ্যমে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষা লাভে অভ্যস্ত। কলেজ পর্যায় এবং উচ্চ শিক্ষার প্রয়ােজনে এরা। দিব্বি ইংল্যান্ডে পাড়ি জমায়। প্রাসঙ্গিক বিধায় একটি কথার উল্লেখ করতেই হয় যে, অনেকের মতে এ বিশ্বে চার শ্রেণীর জাতি রয়েছে। এরা হচ্ছে উন্নত ললাটের শ্বেতাঙ্গ, চাপা নাসিকা ও ক্ষুদ্রাকৃতি চক্ষু বিশিষ্ট হলুদ মঙ্গোলীয়, মােটা নাক ও কোঁকড়া চুলের কালাে আদমি ও বাদামী গাত্র বর্ণের এশীয়। এদের মধ্যে শেষােক্ত দুই শ্রেণীর বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপনের ঘটনা বিরল বলা যায়। আমার জানা মতে আজও পর্যন্ত ভারতীয় উপমহাদেশীয় কোনাে বাদামী গাত্র বর্ণের যুবকের (আসামের প্রখ্যাত গায়ক ভুপেন হাজারিকা ব্যতিক্রম) সঙ্গে কোনাে আফ্রিকান কিংবা জ্যামাইকান কালাে যুবতীর বিবাহ হয়নি। এমনকি প্রেম নিবেদনও নয়। সত্য ভাষণ করলে বলতে হয় যে, শ্বেতাঙ্গরা সামগ্রিকভাবে আমাদের যে পরিমাণ ঘৃণা করে থাকে; তুলনামূলকভাবে কালাে মানুষের প্রতি সবার অজান্তে আমাদের ঘৃণার পরিমাণ অনেক বেশি। এটা এমন একটা সময় যখন এশীয় ব্যবসায়ীদের জানিয়ে দেয়া হয়েছে, পরবর্তী ছ’মাসের মধ্যে তাদের এ মর্মে ঘােষণা দিতে হবে যে, তারা উগান্ডার নাগরিক না ‘ব্রিটিশ সিটিজেন’। যদি ব্রিটেনের নাগরিকত্ব পছন্দ হয়, তাহলে অবিলম্বে ব্যবসাপত্র গুটিয়ে সপরিবারে দেশ ত্যাগ করতে হবে। এই নীতির জের হিসাবেই সামরিক প্রেসিডেন্ট ইদি আমীনকে সাম্রাজ্যবাদ বিরােধী ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে হয়েছে। এটাই তার বিপত্তির অন্যতম কারণ।
অবশ্য এটুকু হচ্ছে ঘটনা পরম্পরায় তার প্লাস পয়েন্টের কথা। এরপরেও বিরাট ‘কিন্তু রয়ে গেছে। প্রথমেই হচ্ছে উগান্ডার সমাজ জীবনে ব্যাপক ও অচিন্তনীয় দুর্নীতি। আর দ্বিতীয়টি আরও নাজুক। অনেকগুলাে উপজাতির আবাসস্থল উগান্ডায় ইদি আমীন হচ্ছেন একটা সংখ্যালঘু মুসলিম উপজাতির নেতা। এটাই হচ্ছে তার আসল বিপদ। সরকারের গুরুত্বপূর্ণ পদগুলােতে তিনি ভিন্ন উপজাতির সামরিক কর্মচারীদের দায়িত্বে বসিয়ে খুব একটা ভরসা পান না। সামরিক প্রেসিডেন্ট আমীন উদার মনমানসিকতার মাধ্যমে জাতিধর্ম নির্বিশেষে দেশবাসীর হৃদয় জয়ের পরিবর্তে বীভৎস ও নারকীয় হত্যার ভ্রমাত্মক পথ বেছে নিলেন। ছলে-বলে-কৌশলে তিনি বিরােধী দলগুলােকে নিশ্চিহ্ন করার প্রক্রিয়ায় মেতে উঠলেন। ফলে পাশ্চাত্য পত্র-পত্রিকাগুলাে ইদি আমীনকে একজন অপ্রকৃতিস্থ প্রেসিডেন্ট হিসাবে প্রমাণ করার লক্ষ্যে সব ধরনের সংবাদ ফলাও করে ছাপতে শুরু করলাে। এ হেন সামরিক প্রেসিডেন্ট ইদি আমীন আলজিয়ার্স-এ মুজিবের সঙ্গে একান্ত বৈঠকের প্রস্তাব করলে তা নাকচ করা হলাে। কিন্তু যেসব নেতৃবৃন্দের সঙ্গে তিনি একান্ত বৈঠকে মিলিত হলেন, তা বিশেষভাবে লক্ষণীয়। এসব বৈঠকের অধিকাংশই হচ্ছে ভ্রাতৃপ্রতিম দেশগুলাের নেতৃবৃন্দ। কিন্তু অন্যান্য বৈরী ভাবাপন্ন দেশগুলাের নেতৃবৃন্দের সঙ্গে বৈঠকগুলাের মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ছিল মুজিব-গাদ্দাফী এবং মুজিব-ফয়সাল বৈঠক। কেননা তখনও পর্যন্ত পাকিস্তান ও চীনের পাশাপাশি মধ্যপ্রাচ্যের দু’টি দেশ সৌদি আরব এবং লিবিয়া আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়নি।
আলজিয়ার্স-এ পৌছেই বঙ্গবন্ধু এ মর্মে ইচ্ছা প্রকাশ করলেন যে, তিনি কর্নেল গাদ্দাফী এবং বাদশাহ ফয়সাল-এর সঙ্গে একান্তে কথাবার্তা বলতে ইচ্ছুক। তিনি পরিষ্কার বুঝতে চান, কেন বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম মুসলিম জনসংখ্যা অধ্যুষিত বাংলাদেশের প্রতি সৌদি আরব আর লিবিয়ার এ ধরনের ‘শত্রুতামূলক আচরণ? কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, কীভাবে এ দুটো বৈঠকের ব্যবস্থা সম্ভব হবে? আর কে-ই বা এর দায়িত্ব নেবেন? শেষ পর্যন্ত আওয়ামী লীগের এক উদীয়মান নেতা অসম্ভবকে সম্ভব করলেন। ভদ্রলােক উচ্চ শিক্ষার জন্য বেশ কয়েক বছর লন্ডনে বসবাস করছেন। এ সময় আইন ক্লাসে জনাকয়েক সৌদি ছাত্রের সঙ্গে তার সখ্যতা গড়ে উঠেছিল। এতগুলাে বছর পরে এঁদের একজনকে তিনি দেখতে পেলেন সৌদি প্রতিনিধি দলের অন্যতম প্রভাবশালী সদস্য হিসাবে। এরই মাধ্যমে সেদিন আলজিয়ার্স-এ মুজিব-ফয়সাল বৈঠকের আয়ােজন সম্পূর্ণ হলাে। পর্দার অন্তরালে আওয়ামী লীগের যে তরুণ নেতার অক্লান্ত পরিশ্রমে এই বৈঠক সম্ভব হয়েছিল, তিনিই হচ্ছেন কুষ্টিয়ার আওয়ামী লীগ নেতা ব্যারিস্টার আমিরুল ইসলাম। কিন্তু সবচেয়ে প্রথমেই অনুষ্ঠিত হলাে মুজিব-সিহানুক বৈঠক।
এবার ক্যাম্পুচিয়ার ক্ষমতাচ্যুত সেই শাসনকর্তা প্রিন্স নরােদম সিহানুক-এর কথা। বছর কয়েক আগেকার ঘটনা। তখন দেশের নাম ক্যাম্বােডিয়া আর ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত ছিলেন ম্রাট তনয় এই প্রিন্স নরােদম সিহানুক। এ সময় কম্বােডিয়ায় সামন্ত প্রথার বদৌলতে জমিদারদের লাগামহীন শােষণে লাখ লাখ কৃষক দিশেহারা। ভূমিহীন কৃষকের সংখ্যা শতকরা ৭৫ ভাগ ছাড়িয়ে গেছে। অন্যদিকে নব্যশিল্পপতিদের মুনাফার মাত্রা নিয়ন্ত্রণ প্রায় অসম্ভব। সর্বত্র শ্রমিক অসন্তোষ তখন চরমে। এক কথায় বলতে গেলে, ব্যাপক দুর্নীতি এবং অর্থনৈতিক বিপর্যয়ে ক্যাম্বােডিয়ার সামগ্রিক পরিস্থিতি ভয়াবহ পর্যায়ে পৌছে গেছে। এরই পাশাপাশি গােপন কম্যুনিস্ট পার্টি তখন দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে ক্রমাগতভাবে শক্তি সঞ্চয়ের পর সরকারের সঙ্গে সংঘর্ষে লিপ্ত হয়েছে। এমনি এক নাজুক পরিস্থিতিতে জাতীয়তাবাদী আদর্শে বিশ্বাসী প্রিন্স নরােদম সিহানুক গােটা কয়েক সংস্কারপন্থী পদক্ষেপ গ্রহণ করলেন। প্রথমত, ভূমিহীন কৃষকদের মধ্যে বিনামূল্যে খাস জমি। বিতরণ ও আধিয়ার কৃষকদের স্বার্থ সংরক্ষণ এবং গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি বৃহৎ শিল্প জাতীয়করণ। এতেই কাল হলাে। দোর্দণ্ড প্রতাপশালী জমিদার ও শিল্পপতিরা দাতা দেশগুলাের অন্যতম মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রশাসনকে এ মর্মে বুঝাতে সক্ষম হলাে। যে, প্রিন্স নরােদম সিহানুক রাতারাতি কমুনিস্ট প্রভাবান্বিত হয়ে গেছেন। ফলে অচিরেই এর মােকাবেলায় ক্যাম্বােডিয়ার ভবিষ্যৎ সম্পর্কে গােপনে ফয়সালা হয়ে গেল।
একদিন ভাের রাতে ক্যাম্বোডিয়ায় সংঘটিত হলাে সামরিক অত্যুথান। রাজধানী নমপে’র রাজপথে সামরিক ট্যাঙ্ক আর সাঁজোয়া গাড়ির টহল। রাজপ্রাসাদ হলাে ঘেরাও। কিন্তু পাখি উড়ে গেছে। প্রিন্স নরােদম পলাতক এবং দেশের বাইরে চলে যেতে সক্ষম হলেন। মার্কিন সমর্থনপুষ্ট হয়ে ১৯৭৩ সালে সামরিক বাহিনীর যে ব্যক্তিত্ব ক্ষমতাসীন হলেন, তার নাম জেনারেল নললন। এর পরের ঘটনা অত্যন্ত সংক্ষিপ্ত। দেশের বিভিন্ন স্থানে সামরিক সরকারের সঙ্গে গােপনে কমুনিস্টদের প্রথমে সংঘর্ষ এবং পরে শুরু হলাে সশস্ত্র লড়াই। একদিকে চরম প্রতিক্রিয়াশীল সেনাবাহিনী ও মৌলবাপী এবং অন্যদিকে কমুনিস্ট। মধ্যপন্থী জাতীয়তাবাদী শক্তির আর কোনাে অবস্থানই রইল না। মাত্র দু’বছরের মধ্যে পরাশক্তি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তাদের ভ্রমাত্মক নীতির দরুন। ক্যাম্বােডিয়ায় মারাত্মক কাফফারা দিল। শত চেষ্টা করেও জেনারেল নললন-এর সামরিক জান্তাকে আর রক্ষা করা গেল না। ১৯৭৫ সাল নাগাদ কমুনিস্ট খেমারুজ গেরিলাৱা রাজধানী নমপেহ দখল করলে মার্কিন মদদপুষ্ট জেনারেল নললন-এর সেনাবাহিনী নিশ্চিহ্ন হয়ে গেল। কম্যুনিস্ট বিপ্লবী সরকার প্রথমেই দেশের নাম পরিবর্তন করল। কয়েক শতাব্দীর পর স্থানীয় জনগােষ্ঠী তাদের আবাসভূমির আদি নাম ফিরে পেল ‘ক্যাম্পুচিয়া । কিন্তু অচিরেই বিশ্ববাসী জানতে পারল নয়া সরকারের স্বরূপ। ক্যুনিস্ট দু’টি উপদলের সমন্বয়ে গঠিত সরকারের নামসর্বস্ব রাষ্ট্রপতি নিযুক্ত হলেন নির্বাসিত প্রিন্স নরােদম সিহানুক। কিন্তু অর্থবহ কারণে তিনি আর দেশেই প্রত্যাবর্তন করলেন না। তখন সর্বোচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন প্রধানমন্ত্রীর পদে অধিষ্ঠিত চীন সমর্থক খেমারুজ নেতা কমরেড পলপট। রুশ সমর্থক কমরেড হের শের। মীনও তাঁর দলবল নিয়ে আপাতত সরকারের সঙ্গেই রইলেন। এরপর ক্যাম্পুচিয়ায় সংঘটিত হলাে মানব জাতির ইতিহাসে আর এক কলংকজনক অধ্যায়। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় ইউরােপের অধিকৃত দেশগুলােতে নাজী জার্মানি যেভাবে ইহুদি নিধন যজ্ঞ করেছিল এবং ১৯৭১ সালে তৎকালীন পাকিস্তানি সৈন্যরা যেভাবে অধিকৃত বাংলাদেশে গণহত্যা করেছিল; ক্যাম্পুচিয়ার হত্যাযজ্ঞকে কেবলমাত্র এসবের সঙ্গে তুলনা করা যায়।
কমুনিস্ট খেমারুজদের আদি ইতিহাস খুব চাঞ্চল্যকর। মার্কিনী সমর্থনপুষ্ট স্বৈরাচারী জেনারেল নললন-এর সামরিক সরকারের আমলে বিরােধী রাজনৈতিক দলগুলাের কর্মকাণ্ড একেবারে স্তব্ধ হয়ে যাওয়ার প্রাক্কালে দেশের ১০১ জন বামপন্থী মনোভাবাপন্ন বুদ্ধিজীবী অত্যন্ত গোপনে এই খেমারুজ’ দল গঠন করে। পরিস্থিতির মােকাবেলায় দ্রুত গড়ে উঠল খেমারুজ’দের সশস্ত্র অঙ্গদল। শেষ অবধি এরাই দলের প্রকৃত চালিকা শক্তি হয়ে দাঁড়াল। আর মধ্যবিত্ত শ্রেণীর অধিকাংশ বুদ্ধিজীবী একে একে বিদায় গ্রহণ করল। ফলে কমরেড পলপটই হয়ে দাঁড়ালেন ‘খেমারুজ’দের সর্বক্ষমতাসম্পন্ন নেতা। নয়া প্রধানমন্ত্রী কমরেড পলপট-এর থিসিস হচ্ছে সংবাদপত্রের কণ্ঠরােধ করা ছাড়াও বুদ্ধিজীবী এবং শহরবাসীদের এই ধরাধাম থেকে নিশ্চিহ্ন করে দিতে হবে। তাহলেই প্রতিবাদের কণ্ঠস্বর আর থাকবে না এবং নতুন সমাজ গড়ে তােলা সহজতর হবে। বিশেষজ্ঞদের মতে প্যারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র থাকাকালীন সময়ে পলপট এই থিসিস প্রণয়ন করেছিলেন। খেমারুজদের এই নিধন পর্বের ছিটে-ফোটা সংবাদে সভ্য জগৎ হলাে হতভম্ব। ১৯৭৫-৭৮ মধ্যবর্তী সময়ে ক্যাম্পুচিয়ায় নিহতের সংখ্যা দাঁড়ালাে প্রায় দুই থেকে তিন মিলিয়নের মতাে। ক্যাম্পুচিয়ায় যখন এ ধরনের এক ভয়ঙ্কর পরিস্থিতি বিরাজমান এবং যখন পাশ্চাত্য দেশগুলাের পত্র-পত্রিকায় প্রতিনিয়তই গণহত্যার নৃশংস ও মর্মস্পর্শী সংবাদ প্রকাশিত আর বেতার ও টেলিভিশনে পরিবেশিত হয়েছিল, ঠিক এমনি। এক সময়ে এখানে সংঘটিত হলাে আর এক সুদূর প্রসারী ঐতিহাসিক ঘটনা। ক্যাম্পুচিয়ায় রুশ সমর্থক কম্যুনিস্ট নেতা কমরেড হের শের মীন বিদ্রোহ করলেন চীন সমর্থক কমরেড পলপট সরকারের বিরুদ্ধে। অচিরেই ঘােষণা করলেন নয়া সরকার গঠনের কথা। বছরটা হচ্ছে ১৯৭৮। ক্যাম্পুচিয়ায় শুরু হলাে গৃহযুদ্ধের আর এক পর্যায়।
মহাচীন এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রশাসন সামগ্রিকভাবে ঘটনাপ্রবাহ বুঝে উঠার আগেই অত্যন্ত দ্রুত ক্যাম্পুচিয়ায় পট পরিবর্তন হলাে। সােভিয়েত রাশিয়ার সম্মতিক্রমে নিকট প্রতিবেশী কম্যুনিস্ট রাষ্ট্র ভিয়েতনাম সক্রিয়ভাবে সহযােগিতার হস্ত সম্প্রসারণ করল কমরেড হের শের মীন-এর সদ্য ঘােষিত সরকারের প্রতি। প্রায় লক্ষাধিক ভিয়েতনামী কমুনিস্ট সৈন্য সীমান্ত অতিক্রম করে হুড়মুড় করে হাজির হলাে ক্যাম্পুচিয়ার মাটিতে। এরপর ভিয়েতনামী সৈন্যের সমর্থনপুষ্ট হয়ে কমরেড হেরশের মিন-এর সৈন্যরা কমরেড পলপট-এর খেমারুজ বাহিনীকে একেবারে ছিন্নবিচ্ছিন্ন করে দিল। চীনের দেয়া পুরানাে মডেলের সমরাস্ত্র নিয়ে খেমারুজরা কিছুই করতে পারল না। রাজধানী নমপেহর পতন হলাে। রাজপথে খেমারুজদের অসংখ্য লাশ। কমরেড পলপট-এর ললাটে তখন পরাজয়ের গ্লানিমা। অতি কষ্টে তিনি হতাবশিষ্ট খেমারুজদের নিয়ে আশ্রয় নিলেন সীমান্তের ওপারে থাইল্যান্ডে। আর ক্যাম্পুচিয়ার নামকাওয়াস্তে রাষ্ট্রপ্রধান প্রিন্স নরােদম সিহানুক তখনও পর্যন্ত চীনের মাটিতে স্বেচ্ছাকৃত’ নির্বাসিতের জীবন যাপন করছেন। নিয়তির পরিহাসই বলতে হয়। যে মার্কিন প্রশাসন একদিন সিহানুককে ক্ষমতাচ্যুত করেছিল, তারাই এবার সিহানুকের দ্বারস্থ হলেন। উপায়ন্তবিহীন অবস্থায় মার্কিনীদের পৃষ্ঠপােষকতায় এবার থাই-ক্যাম্পুচিয়ার সীমান্তে গঠিত হলাে এক নির্বাসিত ত্রিদলীয় কোয়ালিশন সরকার। এর নামে-মাত্র রাষ্ট্রপ্রধান প্রিন্স নরােদম সিহানুক। প্রধান অঙ্গদল হচ্ছে চীন-সমর্থিত কমরেড পলপট-এর সেই-ই খেমারুজ। এঁদের প্রধান ঘাঁটি থাইল্যান্ডের মাটিতে।
মার্কিনী ও চীনাদের সরবরাহকৃত নগদ অর্থ ও সমরাস্ত্রের সাপ্লাই অব্যাহত রাখার স্বার্থে বছরের পর বছর ধরে এঁদের কর্মকাণ্ড জিইয়ে রইল শুধুমাত্র সীমান্তবর্তী এলাকায়। গণতন্ত্রমনা প্রিন্স নরােদম সিহানুক না ঘরকা, না ঘাটকা অবস্থায় চীনেই থেকে গেলেন। এ অবস্থায় কেটে গেল প্রায় ১০ বছর সময়। ১৯৭৮ থেকে ১৯৮৮ পর্যন্ত। এক্ষণে গত দেড় যুগের বেশি সময় ধরে ক্যাম্পুচিয়ায় বিরাজমান জটিল পরিস্থিতি সঠিকভাবে অনুধাবন করার লক্ষ্যে পুনরাবৃত্তি হওয়া স্বত্ত্বেও সংঘটিত ঘটনাগুলাের একটা সারাংশ উপস্থাপনা করা বাঞ্ছনীয় হবে। প্রথমবার ১৯৭৩ সাল নাগাদ মার্কিনী মদদপুষ্ট জেনারেল নললন একটা সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতাসীন জাতীয়তাবাদী মনােভাবাপন্ন নরােদম সিহানুককে হটিয়ে ক্ষমতা দখল করলে প্রিন্স সিহানুক হলেন পলাতক। এ ধরনের একটা স্বৈরাচারী সামরিক সরকারের মােকাবেলায় আত্মগােপনকারী কমুনিস্ট খেমারুজ গেরিলারা রাজনৈতিক প্রজ্ঞা প্রদর্শনে সক্ষম হলাে। এঁরা সিহানুককে গােপন সরকারের প্রধান হিসাবে ঘােষণা দিলেন। অবশ্য প্রিন্স সিহানুক বরাবরের জন্য চীনে নির্বাসিত জীবনটাকেই বেছে নিলেন। দ্বিতীয়বার মাত্র বছর দুয়েক সময়ের মধ্যে ক্ষমতার হাত পরিবর্তন হলাে। রক্তাক্ত লড়াই-এর মাঝ দিয়ে বিজয় কেতন উড়িয়ে এবার ক্ষমতায় এলাে চীনসমর্থক কমরেড পলপট-এর খেমারুজ বাহিনী। এঁরা আনুষ্ঠানিকভাবে প্রিন্স নরােদম সিহানুককেই নাম সর্বস্ব রাষ্ট্রপ্রধান হিসাবে ঘােষণা দিলেন। আর অর্থবহ কারণে রাষ্ট্রপতি সিহানুক চীনে তার নির্বাসিত জীবনকেই আঁকড়ে রইলেন। এখানেই শেষ নয়। তৃতীয়বারের চাঞ্চল্যকর কথা। ১৯৭৮ সাল নাগাদ ক্যাম্পুচিয়ায় ক্ষমতার পট পরিবর্তন হলেও সিহানুকের রাজনৈতিক অবস্থানের কোনাে পরিবর্তন হলাে না। এবার কমরেড পলপট-এর নৃশংস খেমারুজ বাহিনীকে হটিয়ে ক্ষমতা কজা করলাে রুশ সমর্থক কমরেড হের শের মীন-এর গেরিলা বাহিনী।
এঁদের রক্ষাকবচ হিসাবে তখন থেকে লক্ষাধিক ভিয়েতনামী বাহিনী ক্যাম্পুচিয়ার মাটিতে তাঁবু গাড়ল। কিন্তু চীনা-মার্কিনী পৃষ্ঠপােষকতায় কমরেড পলপট-এর খেমারুজ গেরিলারা সহজে হটবার পাত্র নয়। এঁরা সীমান্ত বরাবর থাইল্যান্ডের মাটিতে গঠন করলাে এক নির্বাসিত ত্রিদলীয় কোয়ালিশন সরকার। রাষ্ট্রপ্রধান হিসাবে আবার ঘােষিত হলাে প্রিন্স নরােদম সিহানুক-এর নাম।
এ সময় সবচেয়ে অর্থবহ ঘটনা হচ্ছে, স্বেচ্ছায় নির্বাসিত প্রিন্স নরােদম সিহানুক-এর আস্তানার পরিবর্তন। ভদ্রলােক চীন থেকে চলে এলেন একেবারে সুদূর ফ্রান্সের এক নিভৃত পল্লীতে। পর্দার অন্তরালে এখানেই অনুষ্ঠিত হলাে সিহানুক-এর সঙ্গে কমুনিস্ট এবং পাশ্চাত্যের নানা লবীর আলােচনা। ফলাফল একেবারে ‘টপ সিক্রেট’ অর্থাৎ ‘অত্যন্ত গােপনীয়’। কিন্তু হঠাৎ করেই প্রকাশ পেল ১০ বছর ধরে নির্বাসিত ‘খেমারুজ’ কোয়ালিশন সরকারের প্রধানের পদ থেকে রাষ্ট্রপতি নরােদম সিহানুক পদত্যাগ করেছেন। আন্ত
র্জাতিক রাজনৈতিক মহল এ ঘটনার প্রতি খুব একটা গুরুত্ব প্রদান করল না। কিন্তু যখন ‘ওয়াশিংটন পােস্ট’ পত্রিকায় এ ব্যাপারে চীন-এর নতুন চিন্তাধারা সম্পর্কে কমরেড দেং জিয়াও পিঙ-এর মন্তব্য প্রকাশিত হলাে, তখন অনেকের টনক নড়ল। কমরেড দেং এ মর্মে মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রী জর্জ শুলজকে জানালেন যে, চীনের মূল দাবি হচ্ছে ক্যাম্পুচিয়া থেকে ভিয়েতনামী সৈন্য প্রত্যাহার। যতদিন ক্যাম্পুচিয়ার মাটিতে ভিয়েতনামী সৈন্য থাকবে, ততদিন পর্যন্ত চীনের পক্ষে অপারগ অবস্থায় নির্বাসিত ‘খেমারুজ’ অস্থায়ী সরকারকে সমর্থন দেয়া ছাড়া আর কোনাে পথ নেই। খেমারুজদের ক্যাম্পুচিয়ার ক্ষমতায় বসাতেই হবে, এমন কোনাে নীতি চীনের নেই। এদিকে বিভিন্ন সূত্র থেকে এ মর্মে খবর প্রকাশিত হয়েছে যে, ক্যাম্পুচিয়ায় রুশ-সমর্থক কমরেড হের শের মিন-এর সরকার দেশের বৃহত্তর স্বার্থে প্রিন্স সিহানুকের সঙ্গে কোয়ালিশন সরকার গঠনে সম্মত হয়েছে। এর শর্ত হিসাবে ক্যাম্পুচিয়ার মাটি থেকে এক লাখ বিশ হাজার ভিয়েতনামী সৈন্য স্বদেশে প্রত্যাবর্তন করবে এবং অন্যদিকে চীন ‘খেমারুজদের প্রতি সমর্থন প্রত্যাহার করবে। একমাত্র খেমারুজ’ বাহিনী ছাড়া একদিকে চীন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং অন্যদিকে রাশিয়া ও কমরেড হের শের মিন-এর সরকার; সবাই আলােচ্য ফর্মুলা মেনে নিতে সম্মত হয়েছে। মস্কোতে ১৯৮৮ সালের ডিসেম্বর কিংবা ১৯৮৯ সালের জানুয়ারিতে দেং-গর্বাচভ আসন্ন শীর্ষ বৈঠকে এর চূড়ান্তকরণ হবার কথা।
‘ধান ভানতে শিবের গীত’। ১৯৮৮-তে বসে ১৯৭৩-এর কথা লিখতে যেয়ে স্বাভাবিকভাবেই পাঠকদের সমীপে ১৯৮৮ পর্যন্ত ক্যাম্পুচিয়ার ঘটনাপ্রবাহ এবং রাজনৈতিক উত্থান-পতনের কথা উপস্থাপন করতেই হয়েছে। আবার প্রসঙ্গে ফিরে আসা যাক। আলজিয়ার্স-এ যখন মুজিব-সিহানুক বৈঠক হলাে, তখন প্রিন্স নরােদম সিহানুক ক্যাম্পুচিয়ায় সবেমাত্র ক্ষমতাচ্যুত। আগেই উল্লেখ করেছি যে, মার্কিনী মদদপুষ্ট হয়ে একটা সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে যিনি ক্ষমতা দখল করেছেন তিনি হচ্ছেন জেনারেল নললন। প্রিন্সের আমলে ছিলেন সেনাবাহিনীর প্রধান। প্রিন্স নরােদম সিহানুকের দেহের উচ্চতা সাড়ে পাঁচ ফুটের মতাে এবং শরীরের গড়ন দোহারা। অমায়িক ব্যবহার ও মার্জিত রুচিসম্পন্ন সিহানুক হচ্ছেন। বলিষ্ঠ ব্যক্তিত্বের অধিকারী এবং পােশাক-পরিচ্ছদে অত্যন্ত কেতাদূরস্ত। অনেক ক্ষেত্রেই মুজিব ও সিহানুক-এর চিন্তাধারায় মিল। দুজনেই জাতীয়তাবাদী আদর্শে বিশ্বাসী এবং জনসমক্ষে দুজনের ইমেজ তুলনাহীন। সবচেয়ে মজার ব্যাপার, দুজনেই অকম্যুনিস্ট হওয়া সত্ত্বেও মার্কিনী প্রশাসন এঁদের। উপর কোনাে সময়েই আস্থাভাজন হয়নি। কারণ একটাই, এদের বিশাল ব্যক্তিত্ব ও দারুণ জনপ্রিয়তা মার্কিনীদের মােটেই পছন্দ নয়। সেদিনের কথা আমার আজও স্পষ্ট মনে রয়েছে। আলজিয়ার্স-এর জোটনিরপেক্ষ সম্মেলন চলাকালীন সময়ে মুজিব-সিহানুক বৈঠকের আয়ােজন করা হয়েছে। পূর্ব নির্ধারিত সময়ে কড়া নিরাপত্তায় পাশ্চাত্য পােশাক পরিহিত অবস্থায় প্রিন্স নরােদম সিহানুক এসে হাজির হলেন মহানগরীর উপকণ্ঠে ভূমধ্য সাগরের সমুদ্র সৈকতে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর জন্য নির্দিষ্ট কটেজ’-এ। গাড়ি বারান্দায় দাঁড়িয়ে উষ্ণ করমর্দনে মুজিব অভ্যর্থনা জানালেন প্রিন্স সিহানুককে।
এরপর ড্রইংরুমের সােফায় দুজনের মধ্যে বেশ কিছুক্ষণ নিভৃতে কথাবার্তা হলাে। আমরা বিস্তারিত কিছুই জানতে পারলাম না। শুধুমাত্র আন্দাজ করলাম। আমরা যখন ভিতরে প্রবেশের অনুমতি পেলাম, তখনও দুজনের মধ্যে আলােচনা অব্যাহত রয়েছে। একই সঙ্গে দু’বাহু উঁচু করে প্রিন্স বললেন, দেখুন এক্সেলেন্সি, আমি হচ্ছি একজন সম্রাটের পুত্র। আমার পিতার দাপটে এক সময় সমগ্র ক্যাম্পুচিয়া ছিল ভীত-সন্ত্রস্ত্র । আমার ধমনীতে রাজরক্ত প্রবাহিত। আমার শার্টের কাফ-লিংক’ আর ‘টাই-পিন’ পর্যন্ত সােনার তৈরি। হীরা বসানাে হাতের আংটি। আমি হচ্ছি একজন সংস্কারপন্থী বুর্জোয়া। অথচ মার্কিনীদের ধারণা আমি নাকি কমুনিস্টদের কট্টর সমর্থক। “আহাম্মক” আর কাকে বলে? ওরা একবারও বুঝতে চেষ্টা করল না, আমার আসল চিন্তাধারা কোন খাতে প্রবাহিত হচ্ছে। বল্গাহীন শােষণে ক্যাম্পুচিয়ার বিপর্যস্ত অর্থনৈতিক পরিস্থিতির সুযােগে যাতে করে গ্রামাঞ্চলে কম্যুনিস্টরা দ্রুত শক্তি সঞ্চয় করতে না পারে আমি তারই পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিলাম। ক্যাম্পুচিয়ার সমাজ ব্যবস্থাকে আরও কিছুদিন সুষ্ঠুভাবে বাঁচিয়ে রাখার লক্ষ্যে কিছু সংস্কারমূলক নীতি বাস্তবায়নের উদ্যোগ নিয়েছিলাম—এসবের মধ্যে ছিল ভূমিহীনদের মধ্যে বিনামূল্যে খাস জমি বিতরণ এবং কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ শিল্প জাতীয়করণ। কিন্তু ক্যাম্পুচিয়ার বুর্জোয়া শ্রেণী আর ‘মার্কিনী প্রভুদের এসব সহ্য হলাে না। তাই মার্কিনী মদদ-এ সামরিক অভ্যুত্থান। কিন্তু এখন? এখন অবস্থা কোন পথে? সর্বত্রই খেমারুজ কমুনিস্টদের সঙ্গে সরকারি বাহিনীর মুখােমুখি লড়াই এবং স্বাভাবিকভাবেই গণসমর্থনহীন সরকার পক্ষের পরাজয়ের পালা।
বঙ্গবন্ধু এ সময় প্রশ্ন করলেন, এক্সেলেন্সি আপনার অসুবিধাটা কোথায়? আপনিই তাে হচ্ছেন বিপ্লবী খেমারুজ’ সরকারের প্রধান—তাই-ই না?” একটা কাষ্ঠহাসি দিয়ে প্রিন্স সিহানুক জবাব দিলেন, “এক্সেলেন্সি, আপনি ঠিকই প্রশ্ন করেছেন। তাহলে কথাগুলাে আরও পরিষ্কার করে বলতে হচ্ছে। এক্সেলেন্সি, ক্যাম্পুচিয়ায় আমাদের অর্থাৎ জাতীয়তাবাদীদের এখন আর কোনাে অবস্থান নেই। সবই নিশ্চিহ্নের পথে। কেবলমাত্র দেশ-বিদেশে এই সরকারের আসল চরিত্র সম্পর্কে কিছুটা অস্পষ্টতা বজায় রাখার জন্যই খেমারুজ কমুনিস্টরা সরকার প্রধান হিসাবে আমার নাম ব্যবহার করছে। এই বিপ্লবী সরকারের সিদ্ধান্ত গ্রহণে আমার কোনাে ভূমিকাই নেই। আমি তাে হচ্ছি নাম-কা-ওয়াস্তে সরকার প্রধান। ক্যাম্পুচিয়ার ভবিষ্যৎ এর মধ্যেই মােটামুটি নির্ধারিত হয়ে গেছে। দেশটা পুরােপুরিভাবে লাল হয়ে যেতে বাধ্য। আহাম্মক’ মার্কিনীদের ভুলের খেশারত দিতেই হবে।” বহুদিন পর প্রাণ খুলে কথা বলে প্রিন্স নরােদম সিহানুক হাসিমুখেই বিদায় নিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের কাছ থেকে।
সূত্রঃ মুজিবের রক্ত লাল – এম আর আখতার মুকুল