লন্ডনে মুজিব হত্যার সংবাদ কীভাবে পৌছাল
সিংহ রাশিতে জন্ম আমার। তাই সমগ্র জীবনটাই হচ্ছে শুধু উত্থান-পতন। কখনােই এক নাগাড়ে বেশিদিন সুখ আমার সহ্য হয় না। এই লন্ডন মহানগরীতেও এর ব্যতিক্রম হলাে না। মাত্র বছর খানেক আগেও আমি ছিলাম বাংলাদেশ। হাইকমিশনের একজন কূটনীতিবিদ। তখন আমার বাসা ছিল লন্ডনের সবচেয়ে অভিজাত এলাকা ‘হ্যামস্টেড’-এ। কার্যোপলক্ষে প্রতিনিয়তই আমার যাতায়াত ছিল ব্রিটিশ ফরেন অফিস, কমনওয়েলথ সচিবালয়, বুশ হাউস-এর বি বি সি, আর ফ্লিট স্ট্রিট-এর সংবাদপত্র অফিসগুলােতে। সন্ধ্যার পর পার্টি ও নৈশভােজের আমন্ত্রণ না থাকলে প্লে-বয় কিংবা ভিক্টোরিয়া ক্লাবে আমার যাতায়াত ছিল নিয়মিত। মাঝে-মধ্যে নাটক দেখার বাতিক ছিল। প্রায় প্রতি সপ্তাহেই ‘উইক এন্ড’ কাটাবার জন্য সপরিবারে গাড়িতে চলে যেতাম লন্ডনের বাইরে। হঠাৎ করেই আমার জীবনে ছন্দ পতন হলাে। স্বল্পকালের ব্যবধানে এখন আমি পূর্ব লন্ডনের সর্ড-উইচ হাই স্ট্রিট-এর এক বিরাট চামড়ার কারখানার একজন সাধারণ শ্রমিক। ফ্যাক্টরির নাম ‘একেজি ফ্যাশনস’। মালিক হচ্ছেন সিলেটের জনৈক বঙ্গ সন্তান। এখানে আমার কাজ প্রতিদিন সকালে পাঁচ তলা থেকে কাঁধে করে চামড়ার গাট্টি চার তলায় নামিয়ে সেগুলােকে অর্ডার মােতাবেক কাটিং করা। কখনও ‘বােমা জ্যাকেট, কখনও বা মেয়েদের ওভারকোট। কাজে কোনাে ফাকি দিলে নিজেরই আর্থিক ক্ষতি। কারণ এখানে কাজ হচ্ছে পিসরেটেড ওয়ার্ক পদ্ধতিতে। অর্থাৎ যে শ্রমিক যত বেশি কাজ করবে, তার তত বেশি কামাই হবে। এক কথায় বলতে গেলে ‘নাে ওয়ার্ক নাে পে’। তাহলে তাে গােড়া থেকেই কথাগুলাে গুছিয়ে বলতে হয়। সেদিনের তারিখটা ছিল ১৯৭৫ সালের ১৪ই আগস্ট। আমি তখন লন্ডনের বাংলাদেশ হাইকমিশনে প্রেস কাউন্সিলরের দায়িত্বে। সকালে গার্ডিয়ান কাগজে একটি ডবল কলাম বিজ্ঞাপন দেখে চমকে উঠলাম। বিজ্ঞাপনের শিরােনাম ছিল, ‘বাংলাদেশের মিনি ডিকটেটরকে সরিয়ে (‘রিমুভ’) ফেলতে সাহায্য করুন। বিজ্ঞাপনদাতা হিসাবে যে সংস্থার নাম ছাপা হয়েছে, সেই নামের কোনাে সংস্থার অস্তিত্ব পর্যন্ত নেই।
সকাল থেকেই মনটা খুব অস্থির হয়ে রইল। কিন্তু হাইকমিশনে কারাে সঙ্গে আলাপ পর্যন্ত করতে সাহস হলাে না। প্রথমেই হাইকমিশনার শ্রদ্ধেয় সৈয়দ আব্দুস সুলতানের কথা। এ সময় স্থানীয়| বিখ্যাত ‘রিভেন্ট পার্কে’ মূলত সৌদি সরকারের টাকায় একটি মসজিদ তৈরি হচ্ছিল। লন্ডনে মুসলিম দেশগুলাের সকল রাষ্ট্রদূত ও হাইকমিশনাররা এই মসজিদ কমিটির সদস্য ছিলেন। সেই সুবাদে আমাদের হাইকমিশনারও এই কমিটিতে ছিলেন একজন সিনিয়র মেম্বার। কিন্তু কিছুদিনের মধ্যে অন্যান্যদের মতাে তারও উৎসাহের ভাটা পড়ল। ফলে তার প্রতিনিধি হিসাবে আমাকেই মসজিদ কমিটির পরবর্তী বৈঠকগুলােতে যােগ দিতে হলাে। কিন্তু প্রথম দিনের বৈঠকে যাওয়ার আগে মাননীয় হাইকমিশনার আমাকে এ মর্মে ব্রিফিং দিলেন যে, “বেশি কিছু মাতবেন না। পাকিস্তানি রাষ্ট্রদূত মিয়া মমতাজ দৌলতানা যে লাইনে কথা বলবেন, আপনিও সেই মােতাবেক কথা বলবেন এবং ভােট দিবেন।” আমি কিন্তু এ ধরনের ব্রিফিং-এ হতবাক হইনি। মুহূর্তে আমার মনে পড়লাে অখণ্ড পাকিস্তানি জামানার কথা। দুর্দান্ত প্রতাপশালী স্বঘােষিত ফিল্ড মার্শাল (অব:) প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান সামরিক শাসন থেকে গণতন্ত্রে উত্তরণের সময় মরহুম আবুল হাশিমের পরামর্শে একটি নতুন রাজনৈতিক দল গঠনের ধকল এড়িয়ে পুরনাে মুসলিম লীগ দলটাকেই হাইজ্যাক করে বসেন। পদ্ধতিটা ছিল খুবই অভিনব। পশ্চিম পাকিস্তানের হােমড়া-চোমড়া মুসলিম লীগাররা ছাড়াও চট্টগ্রামের ফজলুল কাদের চৌধুরী, ময়মনসিংহের মােনম খাঁ, রংপুরের আবুল কাশেম, খুলনার খান এ সবুর প্রমুখের মতাে পাকিস্তানের যেসব মুসলিম লীগ নেতৃবৃন্দ সামরিক জান্তাকে সহযােগিতার হস্ত সম্প্রসারণ করেছিল, আইয়ুব খান তাদের দিয়ে করাচীর ক্লিফটন বিচ-এ মুসলিম লীগের এক বিরাট কনভেনশন আহ্বান করিয়ে নিজেই পার্টি দখল করে বসলেন। এ থেকেই আইয়ুব খানের মুসলিম লীগের নামকরণ হলাে ‘কনভেনশন মুসলিম লীগ’।
পাকিস্তান মুসলিম লীগের অন্যান্য নেতৃবৃন্দ অনতিবিলম্বে পার্টির কাউন্সিল অধিবেশন আহ্বান করে দলকে পুনর্গঠিত করলেন। সংবাদপত্রের ভাষায় এই পুনর্গঠিত উপ-দলের নামকরণ হলাে কাউন্সিল মুসলিম লীগ’। এই কাউন্সিল মুসলিম লীগের সভাপতি নির্বাচিত হলেন কট্টর প্রতিক্রিয়াশীল পাঞ্জাবী নেতা মিয়া মমতাজ দৌলতানা আর অন্যতম ভাইস-প্রেসিডেন্ট পদে ময়মনসিংহের সৈয়দ আব্দুস সুলতান। সৈয়দ সাহেব আইয়ুব-বিরােধী গণঅভ্যুত্থানের সময় মুসলিম লীগ থেকে পদত্যাগ করে আওয়ামী লীগের ছত্রছায়ায় আশ্রয় নিলেন। সত্তরের সাধারণ নির্বাচনে তিনি আওয়ামী লীগের টিকিটে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার প্রস্তাবিত গণপরিষদের সদস্য নির্বাচিত হলেন। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি সীমান্ত অতিক্রম করলেন। কিন্তু বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পর ভদ্রলােক আওয়ামী লীগের আভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে খুব একটা সুবিধা করতে পারলেন না। বৃহত্তর ময়মনসিংহ জেলার আওয়ামী লীগের দলীয় রাজনীতিতে সৈয়দ সাহেবের স্থান হলাে না। সর্বজনাব সৈয়দ নজরুল ইসলাম, মনােরঞ্জন ধর, জিল্লুর রহমান, রফিকউদ্দিন ভূইয়া, ড. আজিজুর রহমান মল্লিক এবং আব্দুল মােমেন প্রমুখের পর ‘নব আওয়ামী লীগার’ সৈয়দ আব্দুস সুলতানকে ময়মনসিংহ জেলার (সদর, নেত্রকোণা ও কিশােরগঞ্জ) কোটায় মন্ত্রী হিসাবে বিবেচনা করার প্রশ্নই উঠল না। হচ্ছিল। লন্ডনে মুসলিম দেশগুলাের সকল রাষ্ট্রদূত ও হাইকমিশনাররা এই মসজিদ কমিটির সদস্য ছিলেন। সেই সুবাদে আমাদের হাইকমিশনারও এই। কমিটিতে ছিলেন একজন সিনিয়র মেম্বার। কিন্তু কিছুদিনের মধ্যে অন্যান্যদের মতাে তারও উৎসাহের ভাটা পড়ল। ফলে তাঁর প্রতিনিধি হিসাবে আমাকেই মসজিদ কমিটির পরবর্তী বৈঠকগুলােতে যােগ দিতে হলাে। কিন্তু প্রথম দিনের বৈঠকে যাওয়ার আগে মাননীয় হাইকমিশনার আমাকে এ মর্মে ব্রিফিং দিলেন যে, “বেশি কিছু মাতবেন না। পাকিস্তানি রাষ্ট্রদূত মিয়া মমতাজ দৌলতানা যে লাইনে কথা বলবেন, আপনিও সেই মােতাবেক কথা বলবেন এবং ভােট দিবেন।
আমি কিন্তু এ ধরনের ব্রিফিং-এ হতবাক হইনি। মুহূর্তে আমার মনে পড়লাে অখণ্ড পাকিস্তানি জামানার কথা। দুর্দান্ত প্রতাপশালী স্বঘােষিত ফিল্ড মার্শাল (অব:) প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান সামরিক শাসন থেকে গণতন্ত্রে উত্তরণের সময় মরহুম আবুল হাশিমের পরামর্শে একটি নতুন রাজনৈতিক দল গঠনের ধকল এড়িয়ে পুরনাে মুসলিম লীগ দলটাকেই হাইজ্যাক করে বসেন। পদ্ধতিটা ছিল খুবই অভিনব। পশ্চিম পাকিস্তানের হােমড়া-চোমড়া মুসলিম লীগাররা ছাড়াও চট্টগ্রামের ফজলুল কাদের চৌধুরী, ময়মনসিংহের মােনেম খাঁ, রংপুরের আবুল কাশেম, খুলনার খান এ সবুর প্রমুখের মতাে পাকিস্তানের যেসব মুসলিম লীগ নেতৃবৃন্দ সামরিক জান্তাকে সহযােগিতার হস্ত সম্প্রসারণ করেছিল, আইয়ুব খান তাদের দিয়ে করাচীর ক্লিফটন বিচ-এ মুসলিম লীগের এক বিরাট কনভেনশন আহ্বান করিয়ে নিজেই পার্টি দখল করে বসলেন। এ থেকেই আইয়ুব খানের মুসলিম লীগের নামকরণ হলাে ‘কনভেনশন মুসলিম লীগ’। পাকিস্তান মুসলিম লীগের অন্যান্য নেতৃবৃন্দ অনতিবিলম্বে পার্টির কাউন্সিল অধিবেশন আহ্বান করে দলকে পুনর্গঠিত করলেন। সংবাদপত্রের ভাষায় এই পুনর্গঠিত উপ-দলের নামকরণ হলাে ‘কাউন্সিল মুসলিম লীগ’। এই কাউন্সিল মুসলিম লীগের সভাপতি নির্বাচিত হলেন কট্টর প্রতিক্রিয়াশীল পাঞ্জাবী নেতা মিয়া মমতাজ দৌলতানা আর অন্যতম ভাইস-প্রেসিডেন্ট পদে ময়মনসিংহের সৈয়দ আব্দুস সুলতান। সৈয়দ সাহেব আইয়ুব-বিরােধী গণঅভ্যুত্থানের সময় মুসলিম লীগ থেকে পদত্যাগ করে আওয়ামী লীগের ছত্রছায়ায় আশ্রয় নিলেন। সত্তরের সাধারণ নির্বাচনে তিনি আওয়ামী লীগের টিকিটে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার প্রস্তাবিত গণপরিষদের সদস্য নির্বাচিত হলেন। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি সীমান্ত অতিক্রম করলেন। কিন্তু বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পর ভদ্রলােক আওয়ামী লীগের আভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে খুব একটা সুবিধা করতে পারলেন না।
বৃহত্তর ময়মনসিংহ জেলার আওয়ামী লীগের দলীয় রাজনীতিতে সৈয়দ সাহেবের স্থান হলাে না। সর্বজনাব সৈয়দ নজরুল ইসলাম, মনােরঞ্জন ধর, জিল্লুর রহমান, রফিকউদ্দিন ভূইয়া, ড. আজিজুর রহমান মল্লিক এবং আব্দুল মােমেন প্রমুখের পর ‘নব আওয়ামী লীগার’ সৈয়দ আব্দুস সুলতানকে ময়মনসিংহ জেলার (সদর, নেত্রকোণা ও কিশােরগঞ্জ) কোটায় মন্ত্রী হিসাবে বিবেচনা করার প্রশ্নই উঠল না। নিয়তির পরিহাসই বলতে হয়। আলােচ্য ঘটনা প্রবাহের জের হিসাবে লন্ডনে স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশের প্রথম হাইকমিশনার হলেন সৈয়দ আব্দুস সুলতান। আবার কিছুদিনের ব্যবধানে খণ্ডিত পাকিস্তানের রাষ্ট্রদূত নিযুক্ত হলেন সেই-ই মিয়া মমতাজ দৌলতানা। এখন দু’জন হচ্ছেন দুই দেশের নাগরিক। কিন্তু পারস্পরিক সম্পর্ক? | তাই গার্ডিয়ান পত্রিকায় প্রকাশিত বিজ্ঞাপনের ব্যাপারে মাননীয় হাইকমিশনারের সঙ্গে কোনাে আলাপই করলাম না। এরপর ডেপুটি হাইকমিশনার জনাব ফারুক চৌধুরীর কথা : সিলেটের এক খান্দানী বংশের সন্তান ফারুক সাহেব উচ্চ শিক্ষিত ও মার্জিত রুচিসম্পন্ন ব্যক্তিত্ব। যদিও ১৯৭২ সালে লন্ডনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পেটে অপারেশনের সময় এই চৌধুরী সাহেব জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর কষ্টের কথা চিন্তা করে হাসপাতালের করিডােরে নিজেই অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলেন। তবুও একথা উল্লেখ করতেই হয় যে, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময় ভদ্রলােক ঢাকায় পাকিস্তানি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধি হিসাবে বহাল তবিয়তেই কাজ করে গেছেন। তাই বলতে বাধা নেই যে, আমি জনাব ফারুক চৌধুরীকে একজন সহকর্মীরূপে পছন্দ করলেও কোনাে সময় একান্ত আপনজন হিসাবে গ্রহণ করতে পারিনি। সবশেষে হাইকমিশনের গােয়েন্দা প্রধান জনাব নূরুল মােমেন খান মিহির। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর আমি যখন বাংলাদেশ বেতারের মহাপরিচালক, তখন জনাব খান জাতীয় নিরাপত্তা সংস্থার (এনএসআই) প্রথম মহাপরিচালক হিসাবে অক্লান্ত পরিশ্রম করে নেতৃবৃন্দের আস্থাভাজন হয়েছিলেন। আবার দু’জনে একই সঙ্গে লন্ডনের বাংলাদেশ হাইকমিশনে। তখন আমাদের মধ্যে চমৎকার সমঝােতা। সপ্তাহের প্রতি সন্ধ্যায় অবসর মুহূর্তে আমরা দু’জনা একই সঙ্গে। একেবারে মানিকজোড়।
সমস্ত রাত্রির প্রাইভেট পার্টি থেকে শুরু করে ম্যাকলিয়ড রােডের ভিক্টোরিয়া ক্লাব পর্যন্ত দু’জনার একই সঙ্গে যাতায়াত। খান সাহেবের নতুন জার্মান গাড়ি ‘অডি-৮০’ আর আমার নতুন জাপানি ‘ডাটসুন-১৬০০’ নিয়ে আমরা দু’জনে সমস্ত লন্ডন একেবারে চষে ফেললাম। কখনও উত্তর লন্ডনে ফিনচলে এলাকায় শেফিক-তালেয়ার বাসায় আড্ডায়। কখনও কর্পোরেশনের সীমানা ছাড়িয়ে মেথুয়েন রােডে গাফফার চৌধুরীর বাড়িতে; আবার কখনও বা পশ্চিম লন্ডনের শেফার্ড বুথ-এ গাউশ খানের ‘এলাহাবাদ রেস্টুরেন্টে’। এসবের পরেও একটা ‘কিন্তু’ থেকে গেল। ১৯৭৫ সালের মাঝামাঝি সময়ে বাংলাদেশে ‘বাকশাল গঠনের প্রাক্কালে দুজনের চিন্তারাজ্যে বেশ কিছুটা ফারাক হয়ে গেল। ‘বাকশাল’ গঠনের ব্যাপারে আমার মনে তখন নানা প্রশ্ন। মানসিক দ্বন্দ্বে আমি জর্জরিত। বাকশালের বিপক্ষে কিছু না বললেও, প্রকাশ্যে বাকশাল’কে সমর্থনের জন্য স্বেচ্ছায় এগিয়ে আসতে ব্যর্থ হলাম। তাই, সত্যি কথা বলতে হলে ১৪ই আগস্ট সকালে অফিসে যেয়েও গার্ডিয়ান পত্রিকায় আলােচ্য বিজ্ঞাপনের ব্যাপারে নূরুল মােমেন খান-এর সঙ্গে কোনাে আলাপই করলাম না।
একমাত্র হাইকমিশনের প্রতিষ্ঠাতা-সদস্য ও হিসাবরক্ষণ বিভাগের প্রধান এবং আমার একান্ত সুহৃদ লুৎফুল মতিন-এর সঙ্গে এ ব্যাপারে আলােচনায় আগ্রহী হলাম। ভদ্রলােক একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের শুরুতেই পাকিস্তানি মিশন থেকে ‘ডিফেক্ট’ করে বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীর সঙ্গে অমানুষিক পরিশ্রম করেছিলেন। এ সময় তাঁর সহকর্মী ছিলেন পিআইএ-র ইস্তাম্বুল অফিস থেকে ‘ডিফেক্ট’ করা জনসংযােগ অফিসার মহিউদ্দিন আহম্মদ চৌধুরী। সে যাই হােক ১৪ই আগস্ট সকালে লুৎফুল মতিনকে তার অফিসে পেলাম। কার্যোপলক্ষে তিনি জেনেভার বাইরে গিয়েছিলেন। তাই আর আলাপআলােচনা হলাে না। দুপুরে আমরা হাইকমিশন থেকে দল বেঁধে কাছেই একটা পাব’-এ লাঞ্চ করতে গেলাম। দলের সদস্যরা হচ্ছেন ডেপুটি হাইকমিশনার ফারুক চৌধুরী, অবসরপ্রাপ্ত মেজর ডালিমের শ্বশুর আর আই চৌধুরী, ঢাকা থেকে আগত শিল্পপতি ব্যবসায়ী জিয়াউল হক টুলু, সাংবাদিক আব্দুল গাফফার চৌধুরী, জুলফিকার আলী ভুট্টোর এককালীন প্রাইভেট সেক্রেটারি ও প্রাক্তন কূটনীতিবিদ কায়সার রশীদ চৌধুরী, কায়সার-তনয়া জিনাত, নুরুল মােমেন খান এবং আমি। খেতে বসে অনেক আলাপ হলাে। কিন্তু আলােচনার মূল বিষয়বস্তু হচ্ছে বাংলাদেশের রাজনীতি এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। কথায় কথায় একজন সরাসরি একটা প্রশ্ন জিজ্ঞেস করে বসলেন, “আচ্ছা আপনারা কেউ বলতে পারেন বঙ্গবন্ধু আর কতদিন ক্ষমতায় থাকতে পারবেন?” হঠাৎ করে জবাবটা দিলেন জিয়াউল হক টুলু। বঙ্গবন্ধুর নীতির জন্য আমরা ব্যবসায়ী সম্প্রদায় মােটামুটি সন্তুষ্ট। আমার তাে মনে হয় বঙ্গবন্ধু সরকার আরও বছর দশের জন্য ক্ষমতায় থাকবে।
এবার গাফফার চৌধুরী ঠোট কাটা কথা বললেন, “এভাবে বাংলাদেশ চলতে পারে না। শেখ মণি শক্তিশালী হলে আগামী বছরের মাঝামাঝি পর্যন্ত বঙ্গবন্ধুর সরকার টিকতে পারে কিনা সন্দেহ।” গাফফারের এ ধরনের জবাবে বুকটা আমার ধক্ করে উঠল। তাহলে কি ‘সাম থিং রং সাম হয়্যার?’ এবার সবাই আমাকে ধরে বসল। আমার মুখ থেকে কিছু একটা জবাব বের করবেই। এরকম এক সমাবেশে কোনাে কথা না বলাটাই বুদ্ধিমানের কাজ। কিন্তু এঁদের চাপাচাপিতে আকস্মিকভাবে একটা হেঁয়ালী ধরনের জবাব দিলাম। ‘তা’হলে শােনেন। প্রায় ৭ হাজার মাইল দূরে বসে আমার জবাব সঠিক হবে : কিনা জানি না। সঠিক না হলেই খুশি হবাে। আমার তাে মনে হয়, “তােমারে বধিবে যে গােকুলে বাড়িছে সে”। প্রাসঙ্গিক বিধায় এখানে গাফফার সম্পর্কিত একটি ঘটনার কথা উল্লেখ করতেই হচ্ছে। লন্ডনে পরিচিত মহলে তখন একথা প্রায় সবারই জানা ছিল যে, বেকার অবস্থায় অসুস্থ স্ত্রীকে নিয়ে বেশ কিছুদিন থেকে চৌধুরী সাহেবের আর্থিক অবস্থা খুবই শােচনীয় হয়ে দাঁড়িয়েছিল। তাই ঢাকার সরকারি মালিকানাধীন পত্রিকাগুলাের লন্ডনস্থ সংবাদদাতার চাকুরির জন্য গাফফার চৌধুরী প্রার্থী হলেন। এ ব্যাপারে সুরাহার লক্ষ্যে সপ্তাহ কয়েক আগে বাংলাদেশ বিমানে একটা ফ্রি রিটার্ন টিকিটের ব্যবস্থা করে আমিই চৌধুরী সাহেবকে ঢাকায় পাঠিয়েছিলাম। বঙ্গবন্ধু এ প্রস্তাবে রাজিও হয়েছিলেন। কিন্তু হিসাবে একটু ভুল ছিল। গাফফার চৌধুরীর মতে শেখ মণির মাধ্যমে চাকুরির সুপারিশ না হওয়ায় শেষ মুহূর্তে বিপত্তির সৃষ্টি হলাে। চাকুরিটা হয়েও হলাে না। গাফফার চৌধুরীও তাঁর বরিশাইল্যা জেদ’ ছাড়লেন না। ঢাকায় স্বল্পকালীন অবস্থানকালে একটা চাকুরির জন্য শেখ মণির সঙ্গে দেখা তাে দূরের কথা, যােগাযােগ পর্যন্ত করলেন না। দুঃখ ভারাক্রান্ত হৃদয়ে আবার তিনি লন্ডনের পথে রওনা হলেন। আসার দিনে আওয়ামী লীগের মুখপত্র দৈনিক জনপদ-এর প্রথম পাতায় বঙ্গবন্ধুর উদ্দেশে বাকশাল’কে নিয়ে লেখা গাফফার চৌধুরীর সেই বিখ্যাত সম্পাদকীয় প্রকাশিত হলাে; ক্লান্তি আমার ক্ষমা কর প্রভু”। লন্ডনে ফিরে আসার পর স্বাভাবিকভাবেই গাফফার চৌধুরী বাংলাদেশ সরকারের সমালােচনায় নতুন বক্তব্য উপস্থাপন করলেন। তিনি বললেন, বাংলাদেশে এক শ্রেণীর রাজনীতিবিদ ও বুরােক্রেটদের কারসাজিতে গােপনে আরও একটা বিপ্লব’ হয়ে গেছে। এজন্যই ‘কোলাবরেটর’ আর রাজাকাররা এখন শুধু ক্ষমাপ্রাপ্তই নয়, সমাজ জীবনে সুপ্রতিষ্ঠিত। অবশ্য গাফফার-এর বক্তৃতায় বিরােধিতা ছাড়াওঁ আফসােস্-এর সুর দারুণভাবে বিদ্যমান।
লন্ডনে ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্ট শুক্রবার ভােররাত সাড়ে ৩টা। চারদিক নীরব-নিঝুম। বাংলাদেশের ঘড়িতে এখন সকাল সাড়ে ৯টা। লন্ডনে এর মধ্যেই শীতের আমেজ শুরু হয়ে গেছে। টয়লেট থেকে বেরিয়ে আবার বিছানায় শােবার সুযােগ পেলাম না। বিশ্রী শব্দ করে টেলিফোনটা বেজে উঠল। ওপাশ থেকে গলার আওয়াজ ভেসে এল: “হ্যালাে, হ্যালাে। কে? মুকুল সাহেব? আমি কায়সার বলছি। কায়সার রশিদ। চৌধুরী।” “তা কায়সার ভাই এতাে রাতে? সকালে ফোন করলেও তাে পারতেন? কোনাে জরুরি খবর আছে নাকি?” “হ্যা খুবই জরুরি কথা। আর ঘুমাতে যাবেন না। আমি এক্ষুণি আসছি।” হ্যালাে, হ্যালাে. ফোনের লাইনটা খুট করে কেটে গেল। আমি একাকী বসে আকাশ-পাতাল ভাবতে লাগলাম। মিনিট দশেক পরেই কলিং বেল বেজে উঠল। দরজা খুলতেই কায়সার ভাই হুড়মুড় করে ঘরে ঢুকলেন।
“মুকুল সাহেব, এখন মাথা ঠাণ্ডা করে কাজ করার সময়। ঢাকার খবর ভালাে ।” “কায়সার ভাই, যা জানেন সবকিছুই খুলে বলুন। কসম খােদার বলছি, আমি খুব একটা উত্তেজিত হবে না। বাংলাদেশে কি মিলিটারি কু হয়েছে? বঙ্গবন্ধু বেঁচে আছেন তাে।” “মুকুল সাহেব, গতকাল দুপুরে ‘পাব’-এ লাঞ্চ খাওয়ার সময় আপনি আর গাফফার যা ভবিষ্যৎ বাণী উচ্চারণ করেছিলেন, সেটাই হয়েছে। ব্রিটিশ ফরেন অফিসে খবর হচ্ছে বঙ্গবন্ধুকে ‘ওরা’ হত্যা করেছে। তবে মিলিটারি কু হয়েছে। কিনা জানি না।” আমি পাথরের মতাে নিচুপ হয়ে রইলাম। শুধু চোখের সামনে বারবার করে ভেসে উঠল। পাঞ্জাবি পরিহিত সৌম্য চেহারার মুজিব ভাই-এর সেই অমায়িক হাসিমাখা মুখখানা। মনে পড়লাে লন্ডনে পােস্টিং হওয়ার পর ১৯৭৪ সালের ৩০শে ডিসেম্বর দুপুরে ঢাকার ধানমন্ডিতে বত্রিশ নম্বরের দোতলায় বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আমার একান্তে শেষ সাক্ষাৎকারের কথা। সেদিন দরজা বন্ধ করে | শেখ হাসিনার ঘরে দু’জনের মাঝে অনেক কথা হলাে। “তাহলে শেষ পর্যন্ত তুই-ও আমারে ছাইড়া চইল্যা যাইতাছস্?” “মুজিব ভাই, আমি দেশে থাকতে পারলাম না বইল্যা মাফ কইরা দিয়েন। বেয়াদবী নিবেন না। আসলে আপনি কিন্তু আবার বাস মিস্ করছেন। আমার তাে আর ধানমন্ডি গুলশানে বাড়ি নাই। ব্যাংক ব্যালেন্সও নাই। আমি হইতাছি ছাপােষা মানুষ। আমি বাঁচতে চাই।” একটা পশমী আলােয়ান গায়ে বঙ্গবন্ধু বিছানায় কাত হয়ে শুয়েছিলেন। আমাকে ডেকে মাথার কাছে বসালেন। এরপর তার হাতের আঙুলগুলাে ফুটিয়ে দিতে বললেন। সবে মাত্র গােটা দুয়েক আঙ্গুল ফুটিয়েছি, এমন সময় বলে উঠলেন, “আমার হাজার হাজার রাজনৈতিক নেতা, কর্মী আর অফিসারদের মধ্যে একমাত্র তুই-ই এ ধরনের কথাবার্তা সাহস কইরা বলছস। আমি কিন্তু সবকিছুই আন্দাজ করতে পারি। শুধু মুখ ফুইট্যা বলি না।” মিনিট খানিক দু’জনে চুপচাপ। এর পরে বঙ্গবন্ধু হঠাৎ করে আমার হাতটা টেনে গেঞ্জির নিচে তার বুকের উপর নিয়ে গেলেন। বললেন, “বলতে পারােস, কয়টা গুলি আমার এই বুকটা ছেদা কইরা ফেলাইবাে? ভালাে কইরা বুকটা একটু হাতাইয়্যা দে।’ এরপর দুজনেই ফুপিয়ে কেঁদে উঠলাম। আবার ঘরে কবরের নিস্তব্ধতা। একটু পরেই মুজিব ভাই উঠে তার পাইপ ধরিয়ে নিজেকে সামলে নিলেন। বললেন, “বউ পােলাপান সব সঙ্গে লইয়া লন্ডন যাইবি। তাের পরিবারের কেউ যেনাে বাংলাদেশে না থাকে বুঝছস। ফরেন অফিসেও তাের শত্রু রইছে।”
বিদায়ের সময় মুজিব ভাইকে কদমবুচি শেষ করার সঙ্গে সঙ্গে আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরে বললেন, “বাংলাদেশে যখন ফেরত আইবি, তখন আমারে আর পাইবি না। আমার কবর যেখানেই থাকবাে জিয়ারত কইরা একটা সাদা ফুল দিয়া আসি।”“তবে তােরে আইজ আরও একটা কথা কইয়া দেই। তুই তাে ১৯৪৬ সাল। থাইক্যা আমারে দেখতাছস। ‘সেই-ই ক্যালকাটা পলিটিকস। আমি আছিলাম শহীদ সােহরাওয়ার্দীর শিষ্য। ছাত্র রাজনীতিতে দিনাজপুর জেলা থাইক্যা দবিরুল ইসলাম আর তুই ছিলি আমাগাে অন্ধ সাপোর্টার। হেই জন্য নুরুল আমীনের টাইম-এ দিনাজপুরে জেলও খাটছস এক বছর। পঞ্চাশ সালের রায়ট-এর বছর ঢাকায় আইলি ইউনিভার্সিটিতে পড়ার জন্য। তারপর মানিক ভাই-এর ইত্তেফাকের জন্মের টাইম থ্যাইক্যা তুই হইলি ফুল টাইম সাংবাদিক। পাকিস্তানের চব্বিশটা। বছরই তুই আমার রাজনীতির সবকিছুই দেখছােস। এরপর একাত্তর থাইক্যা তুই হইলি আমার বাংলাদেশ সরকারের অফিসার। যা আইজ তােরে একটা ভবিষ্যৎ বাণী কইয়া দিলাম। আমি যখন এই দুনিয়ায় থাকুম না, তুই তখন আমার সম্বন্ধে বই লিখবি। বুঝছােস্, এইসব বই বেইচ্যা তাের হইবাে রুজি-রােজগার। বউ পােলাপান খাওইয়াতে পারবি।” দরজার ছিটকিনি খুলে বেরিয়ে আসার মুহূর্তে আবার পিছনে ডাক এল। মুখে তার স্নেহমাখা হাসি। বললেন, “আমার মুকুল তুই আর ফুটলি না। আর একটা কথা শুইন্যা রাখি। আমার ফ্যামিলির সঙ্গে তাের স্পেশাল সম্পর্কের কথা কিন্তু ভুলিস না। এই বাড়ির তিন তিনটা জেনারেশনের লগে তাের হইতাছে ভাই’-এর সম্পর্ক। ১৯৪৬ সাল থাইক্যা তুই আমারে চিনিস। আমি তাের মুজিব ভাই আর রেণু তাের ভাবী। আবার কামাল জামাল-রাসেল আর হাসিনা-রেহানাও তােরে মুকুল ভাই কইয়া ডাকে।” “সব চাইতে বড় ডাক্টা তুই শােনচোস? আমার নাতি মানে হাসিনার পােলা জয়’ও কিন্তু তোরে ‘মুকুল ভাই কইয়া ডাকে। এই জন্যই তুই হইতাছাে এই বাড়ির হগলের ভাই।” কথাটা বলেই মুজিব ভাই তার স্বভাবসুলভ শিশুর মতাে সৰল অট্টহাস্যে ফেটে পড়লেন। আমি তখন দরজার কাছে থমকে দাঁড়ানাে। তিনি এবার নিভে যাওয়া পাইপটা আবার ধরিয়ে একগাদা ধূয়া ছেড়ে হঠাৎ গুরু গম্ভীর গলায় বললেন, “করি কী? মনে হইতাছে, মস্কো আমারে এখনও ঠিকমতাে বিশ্বাস করে না। আবার লাহােরের ইসলামী সম্মেলনে গেছিলাম বইল্যা দিল্লী ‘সাউথ ব্লক’ গোস্বা। আর নিন্মন-কিসিঞ্জারের আমলে ওয়াশিংটনের পলিসি তাে বুঝতেই পারতাছােস। একেবারে এক ঠ্যাং-এ আঁড়া। আমাগাে মতাে ‘ন্যাশনালিস্ট’ গাে বিপদ তাে এখানেই।
আমি ঠিকই বুঝতে পারতাছি। চিলির পর বাংলাদেশ। আলেন্দের পর। এবার আমার পালা। আমিও শ্যাষ দেইখ্যা ছাড়ম। পারুম কিনা জানি না।” আমি পাথরের মতাে দাঁড়িয়ে রইলাম। মনটা আমার কোন সে সুদূরে চলে গেল। হঠাৎ নেতার কথায় সম্বিত ফিরে এল। তিনি ধরা গলায় বললেন, “আমি যখন থাকুম না, যদি সম্ভব হয় ভাই হিসাবে এগাে একটু খােজ খবর নিস।” সপরিবারে প্রেসিডেন্ট মুজিবকে হত্যার স্বল্প দিনের ব্যবধানে ঢাকা থেকে আমার জনৈক সাংবাদিক বন্ধু কার্যোপলক্ষে লন্ডনে এসে হাজির হলেন। বিবিসি এক্সটার্নাল সার্ভিসেস-এর বাংলা বিভাগে দেখা। খন্দকার মােশতাক তখন ক্ষমতায় টলটলায়মান। স্বাভাবিকভাবেই বাংলাদেশে রাজনৈতিক পরিস্থিতি জানার জন্য অস্থির হয়ে উঠলাম। বিবিসি’র নূরুল ইসলাম-এর সঙ্গে আমরাও বিকালের নাস্তা খাওয়ার জন্য বেসমেন্ট-এর রেস্টুরেন্টে গেলাম। তিনজনে অনেক আলাপ হলাে। একটু পরে রেকর্ডিং-এর জন্য নূরুল ইসলাম উঠে গেলেও আমাদের কথাবার্তা অব্যাহত রইল। কথায় কথায় নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সাংবাদিক বন্ধু গোপালগঞ্জের টুঙ্গীপাড়ার গােরস্থানে বঙ্গবন্ধুর লাশ দাফনের সংগৃহীত কাহিনী বললেন।
১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্ট সকাল থেকেই কারফিউ। বিকাল নাগাদ টুঙ্গীপাড়ার আকাশে বঙ্গবন্ধুর লাশ নিয়ে হেলিকপ্টার এল। এর আগেও অনেকবার টুঙ্গীপাড়ার লােকজন হেলিকপ্টার নামতে দেখেছে। প্রতিবারই হাজার হাজার লােক টুঙ্গীপাড়ার কৃতীসন্তান শেখ মুজিবকে এক নজর দেখার জন্য দৌড়ে গেছে। কিন্তু এবার? কারফিউ-এর ভয়ে কেউই আর ঘর থেকে বেরুতে সাহসী হলাে না। বাংলাদেশ বেতারে তখন পাকিস্তানি উর্দু সিনেমার গান আর মাঝে মাঝে সরকারি নির্দেশ ঘােষণা হচ্ছে। হেলিকপ্টার থেকে ধীরে ধীরে বাংলার অগ্নিপুরুষ ও বর্তমান বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ রাজনৈতিক নেতাকে তার জন্মভূমিতে নামানাে হলাে। কিন্তু তিনি আর জীবিত নেই। এবার টুঙ্গীপাড়ায় নামলাে একটা বস্তাবন্দি লাশ। হেলিকপ্টারে লাশের সঙ্গে যেসব সিপাহী এসেছিল তাদেরই দু’জন বেরিয়ে গেল মওলবীর খোঁজ করতে। আর উন্মুক্ত আকাশের নিচে বস্তাবন্দি বঙ্গবন্ধুর লাশ থেকে চুইয়ে চুইয়ে রক্ত পড়ে সবুজ ঘাস ভিজে উঠল। বাতাসের মর্মর ধ্বনিতে, মনে হলাে বজ্রকণ্ঠের সেই প্রতিধ্বনি, “রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরাে দেবাে…. এদেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়বাে, ইনশাল্লাহ।” ।
সিপাহীরা টুঙ্গীপাড়া মসজিদের ইমাম সাহেবকে হাজির করলে মেজর সাহেব নির্দেশ করলেন মিনিট দশ-পনেরাের মধ্যে গােরস্থানে লাশটা দাফনের ব্যবস্থা সম্পূর্ণ করতে হবে। কিন্তু সময়ের স্বল্পতার কথা উল্লেখ করে ইমাম সাহেব স্বীয় অপরাগতা জানালেন। বিনীতভাবে বললেন, মুসলমানের লাশ গােসল ও কাফনের পর জানাজা নামাজ ছাড়া দাফন করা সম্ভব নয় বলে ক্ষমাপ্রার্থী। এরপর মেজর সাহেবের সম্মতি পেয়ে ইমাম সাহেব স্থানীয় মাদ্রাসার কয়েকজন তালেবেলেম ডেকে আনলেন। রক্তাক্ত লাশটা গােসল করিয়ে কাফন পরানাের পর ছােট্ট অথচ ঐতিহাসিক জানাজার নামাজ অনুষ্ঠিত হলাে। ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্ট বিকেলের পড়ন্ত রােদে টুঙ্গীপাড়ায় দাফন হলাে বাংলার নয়নমণি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের। লােকালয়ের কল-কোলাহল থেকে বহু দূরে নদীমাতৃক গ্রাম বাংলার এক নিভৃত কোণে এই টুঙ্গীপাড়া গ্রাম। পাশ দিয়ে প্রবাহিত মধুমতির ছােট শাখানদী বাঘিয়া। মাত্র মাইল ছয়েক দূরে মূল মধুমতি নদী। এটাই হচ্ছে জেলার শেষ সীমানা। ওপারে খুলনা। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরপুর এই টুঙ্গীপাড়া গ্রামে বাংলা ১৩২৭ সালের ভরা বসন্তে ৩রা চৈত্র (১৯২০ সালের ১৭ই মার্চ) মঙ্গলবার দিবাগত রাত ৮টায় যে শিশুর জন্ম হয় এবং যিনি পরবর্তীকালে স্বীয় কর্মদক্ষতায় স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশের স্রষ্টা ও জাতির পিতা হিসাবে বিশ্বব্যাপী স্বীকৃতি লাভ করেছিলেন, মাত্র সাড়ে ৫৫ বছর বয়সে (৫৫ বছর ৫ মাস ২৮ দিন) তার দাফন হলাে সেই টুঙ্গীপাড়াতেই। তিনি রইলেন চিরনিদ্রায় শায়িত। সপরিবারে রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যার সময় বাংলাদেশে ছিলাম না। তাই সুদূর লন্ডনের বিবিসি রেস্টুরেন্টে বসে সেদিন তন্ময় হয়ে শুনলাম এই মহান নেতার দাফনের করুণ কাহিনী।
সূত্রঃ মুজিবের রক্ত লাল – এম আর আখতার মুকুল