এক্সেলেন্সি মুজিব আপনি কিন্তু নিশ্চিহ্ন হতে যাচ্ছেন -ক্যাস্ট্রো
সবশেষে মুজিব-ক্যাস্ট্রো বৈঠকের কথা। তখন সম্মেলন একেবারে শেষ পর্যায়ে। এই বৈঠকের কথা তাে কোনােদিনই ভুলবার নয়। জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত এর প্রতিটি কথা আমার স্মৃতিতে জাগরুক থাকবে। এটা এমন একটা সময় যখন দক্ষিণ আমেরিকার চিলিতে শুরু হয়েছে। বিদেশী অর্থপুষ্ট ও ষড়যন্ত্রে ভয়াবহ গৃহযুদ্ধ। একদিকে জনগণের ভােটে নির্বাচিত সমাজতন্ত্র মতাদর্শের আলেন্দে সরকার এবং অন্যদিকে মার্কিনী প্রশাসন আর, সিআইএ-র পৃষ্ঠপােষকতায় চিলির সামরিক জেনারেলবৃন্দের একাংশ। এজন্যই শেষ মুহূর্তে প্রেসিডেন্ট আলেন্দে আলজিয়ার্স সম্মেলনে যােগদানে স্বীয় অপারগতার কথা জানিয়েছিলেন। সেদিন দুপুর নাগাদ আলজিয়ার্স-এ-মর্মে সংবাদ এসে পৌছলাে যে, দেশব্যাপী অব্যাহত ট্রাক ধর্মঘটে খাদ্য সরবরাহ দারুণভাবে বিঘ্নিত হওয়ার জের হিসাবে সমগ্র চিলিতে শুরু হয়েছে ভয়াবহ খাদ্য-দাঙ্গা আর লুটতরাজ। বামপন্থী। রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ কিংকর্তব্যবিমূঢ়। এমনি এক নাজুক পরিস্থিতিতে রাজধানী। সান্টিয়াগােতে নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট আলেন্দের বাসভবন ঘেরাও করে রয়েছে এক বিরাট ট্যাঙ্ক বহর। আকাশে বিমানবাহিনীর জঙ্গী বিমান। যেকোনাে মুহূর্তে পতন নিশ্চিত। তাই ভ্রাতৃপ্রতিম প্রেসিডেন্ট আলেন্দের সর্বশেষ সংবাদে ফেদেল ক্যাস্ট্রোর মন দারুণভাবে বিক্ষুব্ধ। বিপুল সংখ্যক নিরাপত্তারক্ষী পরিবেষ্টিত হয়ে কিউবার বিপ্লবী নেতা ফেদেল – ক্যাস্ট্রো এলেন আর এক অবিস্মরণীয় নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎকারের জন্য।
তখন ভূমধ্য সাগরের সমুদ্র-সৈকতে বিকেলের পড়ন্ত রােদ আর দূর থেকে ভেসে আসছে অসংখ্য গাংচিল-এর আওয়াজ। এদিকে কটেজ-এর গাড়ি বারান্দায় সাদা পাজামা-পাঞ্জাবী আর কালাে মুজিব কোট পরে অভ্যর্থনার জন্য দাঁড়িয়ে স্বয়ং বঙ্গবন্ধু। হাতে তার জ্বলন্ত পাইপ। বিশেষভাবে নির্মিত বুলেট প্রুফ যে লিমােজিন গাড়িতে ক্যাস্ট্রো এসে হাজির হলেন, তাতে জনা আটেক দেহরক্ষীর বসার ব্যবস্থা। ড্রাইভারের পাশে দুজন এবং একেবারে পিছনের সিট-এ চারজন। আর মধ্যে যেখানে কমরেড ক্যাস্ট্রো বসে তারও দু’পাশে দু’জন। এ ছাড়াও সামনে এবং পিছনের অন্য গাড়িতে রয়েছে বিশেষ কমান্ডাে প্লাটুন।
গাল ভর্তি চাপ-দাড়ি, মাথায় গেরিলা টুপি আর পরনে জলপাই রঙ-এর আধা সামরিক পােশাক। প্রায় ছ’ফুট লম্বাদেহী ফেদেল ক্যাস্ট্রো যখন চুরুট হাতে (পরবর্তীতে ধূমপান ছেড়ে দিয়েছেন) গাড়ি থেকে নেমেই দেখলেন সহাস্য বদনে স্বয়ং বঙ্গবন্ধু দাড়িয়ে, তখন তারও মুখে উদ্ভাসিত হলাে এক অমায়িক হাসি। এরপর পরস্পর উষ্ণ আলিঙ্গন আর চুম্বন। দুই গােলার্ধের দুই নেতার মহামিলনের এক বিরল মুহূর্ত।
ইংরেজি ভাষায় ক্যাস্ট্রোর বিশেষ দখল নেই বললেই চলে। তার কিছুটা ভাঙা ভাঙা ইংরেজি উচ্চারণে ফরাসি স্পেনীয় প্রভাব দারুণভাবে বিদ্যমান। আর শেখ মুজিবের ইংরেজি উচ্চারণে স্বাভাবিকভাবেই উপমহাদেশীয় প্রভাব। কোনাে দোভাষী ছাড়াই শুরু হলাে দুই নেতার সরাসরি আলােচনা। দুজনে একই সােফায় বসলেন। উল্টো দিকের সােফায় উপবিষ্ট দুদেশের উপদেষ্টা আর প্রতিনিধিবৃন্দ। এরপর শুরু হলাে দুই নেতার কথাবার্তা। এই আলােচনার ঐতিহাসিক গুরুত্ব অপরিসীম। তাই সুদীর্ঘ ১৫ বছর পর শুধুমাত্র কয়েক লাইনের নােট আর স্মরণশক্তির উপর নির্ভর করে এই আলােচনার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশবিশেষ পাঠকদের সমীপে উপস্থাপন করলাম।
ক্যাস্ট্রো : এক্সেলেন্সি, আপনি বােধ হয় চিলির বিপ্লবী প্রেসিডেন্ট আলেন্দের সর্বশেষ অবস্থার কথা অবগত আছেন। বিদেশী ষড়যন্ত্রে তাঁর সরকারের পতন এখন যে কোনাে মুহূর্তে হতে পারে। এর অর্থ হচ্ছে এই মহান ব্যক্তিত্বকে ধরাধাম থেকে নিশ্চিহ্ন করে দেয়া হবে। এক্সেলেন্সি, এ ধরনের এক প্রেক্ষাপটে আপনাকে অত্যন্ত আপনজন মনে করেই আজ কয়েকটা কথা বলব। এজন্য আগে ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি।
মুজিব : এক্সেলেন্সি, আপনি নির্ভয়ে এবং সরল মনেই কথা বলতে পারেন। আমি জানি যে, আপনি হচ্ছেন আমাদের অকৃত্রিম শুভাকাঙ্ক্ষী এবং বন্ধু।
ক্যাস্ট্রো : বাংলাদেশ এবং ভারত থেকে আমরা যেসব খবর পাচ্ছি, তাতে এ দুটো দেশের অবস্থা খুব একটা সুবিধার মনে হচ্ছে না। এ দুটো দেশেই সাম্রাজ্যবাদী এজেন্টরা খুব তৎপর।
মুজিব : এক্সেলেন্সি, এতাে ভূমিকা না করে আসল কথা বললে আমি খুশিই হবাে, বেয়াদবী নেবাে না।
ক্যাস্ট্রো ; এক্সেলেন্সি, তাহলে শুনুন। চিলির প্রেসিডেন্ট আলেন্দের মতাে আমরা বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী মুজিবকেও খরচের খাতায় রেখে দিয়েছি। ইউ আর ফিনিশ এক্সেলেন্সি (আপনিও শেষ এক্সেলেন্সি)।
মুজিব : কমরেড, হঠাৎ করে এ ধরনের কথাবার্তা বলছেন কেন? একটু গুছিয়ে বলবেন কি?
ক্যাস্ট্রো : বিকজ, ইউ হ্যাভ লিগালাইজড দ্য ডিফিটেড এ্যাডমিনিস্ট্রেশন ইন্ বাংলাদেশ। ইউ আর ফিনিশ এক্সেলেন্সি। (কেননা আপনি বাংলাদেশের একটা পরাজিত প্রশাসনকে আইন সঙ্গত করেছেন। এক্সেলেন্সি, আপনি কিন্তু নিশ্চিহ্ন হতে যাচ্ছেন)।
মুজিব : এক্সেলেন্সি, আপনি জানেন যে, আমাদের বাংলাদেশ আয়তনে একটা ক্ষুদ্র দেশ এবং একাত্তরের যুদ্ধে ভয়ঙ্করভাবে ক্ষতিগ্রস্ত। তাই বাংলাদেশকে পুনর্গঠনের জন্য আমাদের অভিজ্ঞতা সম্পন্ন ঝানু বুরােক্রেটদের প্রয়ােজন। এজন্যই আমি পাকিস্তানি আমলের অভিজ্ঞ অফিসারদের চাকুরির ধারাবাহিকতা দিয়ে বাংলাদেশের প্রশাসনে বসিয়েছি।
ক্যাস্ট্রো : বেয়াদপী নিবেন না এক্সেলেন্সি। এঁদের প্রশাসনিক অভিজ্ঞতার কথা বলছেন? ফুঃ? হােয়াট এক্সপিরিয়েন্স দে হ্যাভ গট? উইথ দেয়ার এক্সপিরিয়েন্স এ্যান্ড এ্যাডভাইস মাইতি পাকিস্তান লস্ট ইন দ্য ওয়ার। ইয়াের মুক্তি বয়েজ? নাে এক্সপিরিয়েন্স। ফাইটিং ফাইটিং এন্ড ফাইটিং—গট ভিকতিরি। (ফুঃ তাদের কি অভিজ্ঞতা রয়েছে। এসব অভিজ্ঞতা এবং পরামর্শের জন্যই তাে যুদ্ধে মহাপরাক্রমশালী পাকিস্তানের পরাজয় হয়েছে। আপনার মুক্তিবাহিনীর ছেলেরা? কোনােই অভিজ্ঞতা নেই। লড়াই, লড়াই আর লড়াই—বিজয়কে এঁরা ছিনিয়ে আনলাে)।
মুজিব : তাহলে আমরা যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশে পুনর্গঠনের কাজ করবাে কীভাবে?
ক্যাস্ট্রো : ব্ৰিংগ লইয়ার্স, ব্ৰিংগ জার্নালিস্টস, ব্ৰিংগ বিজনেস এক্সিকিউটিভস, ব্রিংগ ডক্টরস, ব্ৰিংগ ইঞ্জিনিয়ার্স, ব্ৰিংগ প্রােফেসার্স এ্যান্ড পুত্ দেম অন্ টপ অব এ্যাডমিনিস্ট্রেশন। দে উইল ডু মিসটেক, মিসটেক এ্যান্ড লার্ন-বাত নট কনসপিরেসী। ফর গড় সেক। প্লিজ গিভ মাের রেছপনছিবিলিটি টু ইয়াের মুক্তি বয়েজ। এ্যান্ড ফুললি ত্ৰাসত দেম। আদারওয়াইজ, ইউ আর ফিনিশ এক্সেলেন্সি (আইনজীবী, সাংবাদিক, ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা, ডাক্তার, প্রকৌশলী, শিক্ষাবিদ—এসব পেশার নেতৃস্থানীয়দের এনে সরকারি প্রশাসনে গুরুত্বপূর্ণ পদে বসিয়ে দিন। এঁরা ভুলের পর ভুল করে সঠিক শিক্ষা লাভ করবে—কিন্তু এরা ষড়যন্ত্র করবে না। পরম করুণাময়ের দোহাই দিয়ে বলছি আপনার মুক্তিযােদ্ধা ছেলেদের আরও বেশি করে দায়িত্ব দিন এবং সম্পূর্ণভাবে ওদের বিশ্বাস করুন। অন্যথায় আপনি কিন্তু নিশ্চিহ্ন হতে যাচ্ছেন এক্সেলেন্সি।
মুজিব : কমরেড সত্যি কথা বলতে কি, গুটি কয়েক আঙুলে গুণা কোলাবরেটর অফিসার ডিশমিশ করে বাকি অভিজ্ঞ অফিসারদের সিনিয়রিটি দিয়ে আমি দায়িত্বপূর্ণ পদে বসিয়েছি। আমার তাে এতােদিনের ধারণা যে, এঁদের অভিজ্ঞতা কাজে লাগবে। কিন্তু আপনার কথাবার্তায় আমি বেশ চিন্তিত হয়ে পড়লাম।
ক্যাস্ট্রো : এক্সেলেন্সি, দুনিয়ার কোথাও যুদ্ধে পরাজিত প্রশাসনের উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তাদের নতুন প্রশাসনে আর দায়িত্ব দেয়া হয় না, বাংলাদেশে আপনার মহানুভবতায় ওরা প্রাণে রক্ষা পেয়েছে এই-ই তাে যথেষ্ট, যুদ্ধোত্তর দেশে তাে এ ধরনের অফিসার পুনর্বাসনের প্রশ্নই উঠতে পারে না। দেখুন না সাম্রাজ্যবাদী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেও প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ক্ষমতাসীন দলের পরাজয় হলে, মার্কিন প্রশাসনের উচ্চ পদস্থ কর্মচারী এমন কি রাষ্ট্রদূতদের পর্যন্ত বিদায় নিতে হয়।
মুজিব : এক্সেলেন্সি, প্রেসিডেন্ট ক্যাস্ট্রো, আমার তাে এখন একমাত্র চিন্তা যে, বিধ্বস্ত বাংলাদেশকে কীভাবে দ্রুত পুনর্গঠন করা সম্ভব।
ক্যাস্ট্রো : এক্সেলেন্সি, তাহলে কিউবার দৃষ্টান্ত দিয়েই বলছি। মহান বিপ্লবের অব্যবহিত পর কমরেড চে গুয়েভারা স্বয়ং কিউবার পরাজিত প্রশাসনকে নিশ্চিহ্ন করে একেবারে নতুন করে ঢেলে সাজিয়ে দিয়েছেন। আজকের দিনে কিউবার মাটিতে অন্তত প্রাক্তন বাতিস্তা সরকারের কোনাে বুরােক্রেট-এর চিহ্ন মাত্র খুঁজে পাবেন না। এজন্যই কিউবার ঠিক ঘাড়ের উপরে মহাপরাক্রমশালী মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের অবস্থান হওয়া সত্ত্বেও আমার বিরুদ্ধে কোনাে ষড়যন্ত্রই সফল হচ্ছে না। পশ্চিম গােলার্ধের মানচিত্রের দিকে তাকিয়ে দেখুন এক্সেলেন্সি। যুক্তরাষ্ট্রের মায়ামী বিচ থেকে কিউবার দূরত্ব মাত্র ৯০ মাইলের মতাে। অথচ কিউবা সগর্বে তার অস্তিত্ব বজায় রেখেছে। এই যে দেখছেন, আমার কমরেড দেহরক্ষীদের। কেউই এঁদের কাউকে আমার বিরুদ্ধে দলে ভিড়াতে পারবে না—কোনাে দামে I এঁদের কেনা সম্ভব নয়।
মুজিব : এক্সেলেন্সি আপনি দয়া করে থামবেন না। আপনার কাছ থেকে আরও শুনতে চাই। আমার জ্ঞান চক্ষুর উন্মোচন হচ্ছে।
ক্যাস্ট্রো : (অদূরে দণ্ডায়মান দেহরক্ষীদের প্রতি অঙ্গুলিনির্দেশ করে বললেন) প্লিজ ত্রাই তু বাই দেম। অফার দেম হানদ্রেদ থাউজেন ডলার-তু। হানদ্রেদ থাউজেনহা এ মিলিয়ন। অল রাইট, অফার দেম ওয়ান মিলিয়ন ডলার, নাে ইউ কানত বাই দেম। দিওরিং লং ওয়ার এ্যাগেইনসত ডিকতের বাতিস্তা, উই ফত তুগেদার ফ্রম দ্য সেম বাংকার। উই শেয়ার ফুড-বেড এ্যান্ড এভরিথিং। ইউ কানত ইমাজিন হাউ মাচ দে লাভ মী। আই স্মােক সিগার। মাই বয়েজ তেসত ইত ফাস্ট। তু অফ দেম দায়েইদ। বিকজ সিআই পয়জনিং। এক্সেলেন্সি ইন বাংলাদেশ হুম আর ইউ ‘ত্রাসতিং? লাইক কমরেড আলেন্দে, ইউ আর অলছাে গােয়িং টু বি ফিনিশ কমরেড মুজিব (দয়া করে এদের কেনার চেষ্টা করুন। এঁদের অফার করুন এক লাখ ডলার-দুলাখ—অর্ধ মিলিয়ন ডলার। আচ্ছা ঠিক আছে, এঁদের এক মিলিয়ন ডলার অফার করুন। না, আপনি কিছুতেই এঁদের কিনতে পারবেন না। ডিক্টেটর বাতিস্তার বিরুদ্ধে দীর্ঘ দিনের লড়াই-এর সময় আমরা একই বাংকারে থেকে যুদ্ধ করেছি। এ সময় আমরা খাওয়াদাওয়া, বিছানা-সবকিছু একই সঙ্গে ভাগ করেছি। আপনি ধারণাও করতে পারবেন না এরা আমাকে কী পরিমাণ ভালােবাসে। আমার চুরুট খাওয়ার অভ্যাস রয়েছে। তাই আমার ছেলেরা প্রথমেই প্রতিটি প্যাকেট থেকে চুরুট টেস্ট করে দেখে দুজন তাে মরেই গেল। কারণ সিআইএ-র এজেন্টরা বিষ মিশিয়েছিল। এক্সেলেন্সি, বাংলাদেশে আপনি কাদের বিশ্বাস করেছেন? কমরেড আলেন্দের মতাে আপনিও নিশ্চিহ্ন হতে যাচ্ছেন কমরেড মুজিব।)
সবার চোখ তখন অশ্রু সজল। এবার বিদায়ের পালা। হাতের অর্ধদগ্ধ চুরুটটা এ্যাশট্রেতে রেখে ধীর পদক্ষেপে ফেদে ক্যাস্ট্রো এগিয়ে এলেন বঙ্গবন্ধুর কাছে। এরপর ক্যাস্ট্রো-মুজিব উষ্ণ আলিঙ্গন আর পরস্পর চুম্বন। আলিঙ্গনের শেষ মুহূর্তে মুজিবের কাধে মাথা রেখে অকস্মাৎ ঘরের নিস্তব্ধতা ভঙ্গ করে ক্যাস্ট্রো বলে উঠলেন, ‘কমরেড মুজিব, আই লাভ ইউ আই লাভ ইউ। আই লাভ বাংলাদেশ।’ (অর্থাৎ কমরেড মুজিব, আমি তােমায় ভালােবাসি-আমি তােমায় ভালােবাসি। আমি বাংলাদেশকে ভালােবাসি)। গাড়ি বারান্দার স্টার্ট দিয়ে রাখা বিরাট ‘লিমােজিন’-এ উঠতে যেয়ে হঠাৎ মাথাটা একটু তেরছা করে ঘুরিয়ে ক্যাস্ট্রো চীকার করে স্লোগান দিলেন ‘জয় বাংলা’।
আমরা কিছু বােঝার আগেই ঝড়ের বেগে সব কটা গাড়ি বেরিয়ে গেল। সবাই আমরা নিঃশব্দে এসে ড্রইং রুমে ঢুকলাম। বঙ্গবন্ধুর হাতের পাইপটা বেশ কিছুক্ষণ আগেই নিভে গেছে। এতক্ষণ জ্বালার ফুসরৎ পাননি। হঠাৎ চেয়ে দেখলাম ড্রইং রুমের একটা টি-পয়ের বিরাট এ্যাশট্রেতে ক্যাস্ট্রোর রেখে যাওয়া চুরুটের বাকি অংশ তখনও জ্বলছে—সর্পিল রেখার মতাে ধুয়া বেরুচ্ছে, মনে হলাে ঘরের মধ্যে ক্যাস্ট্রোর শেষ কথাগুলাে তখনও প্রতিধ্বনিত হচ্ছে, “এক্সেলেন্সি, বাংলাদেশে আপনি কাদের বিশ্বাস করেছেন? লাইক কমরেড আলেন্দে, ইউ আর অলছাে গােয়িং টু বি ফিনিশ কমরেড মুজিব।” (কমরেড আলেন্দের মততা, আপনিও কিন্তু নিশ্চিহ্ন হতে যাচ্ছেন কমরেড মুজিব)।
সূত্রঃ মুজিবের রক্ত লাল – এম আর আখতার মুকুল