You dont have javascript enabled! Please enable it! পাকিস্তানের জন্মমৃত্যু দর্শন – যতীন সরকার - সংগ্রামের নোটবুক

Reference: পাকিস্তানের জন্মমৃত্যু-দর্শন – যতীন সরকার

 

বায়ান্নর একুশে ফেব্রুয়ারি ও গ্রামবাংলার মানুষ
পবিত্রদা অর্থাৎ পবিত্র দাস—উনিশোে পঞ্চাশে আশুজিয়া হাইস্কুলে মাস্টারি নিয়েছিলেন। আর আমি বেখৈরহাটি স্কুল ছেড়ে আশুজিয়া হাইস্কুলে ভর্তি হই একান্ন সালে, ক্লাস নাইনে। কিন্তু এর কয়েকদিন পরই পবিত্রদা কলকাতায় গেলেন কী একটা কাজে, সেখানে গিয়েই বসন্ত রােগে আক্রান্ত হলেন এবং সে রােগেই অকালে প্রাণ হারালেন।
পবিত্ৰদার অকাল মৃত্যুতে তার সকল পরিচিত জন হাহাকার করে উঠলাে। হেকিম ভাই খুবই ভেঙে পড়লেন। তার এই বন্ধুটিকে তিনিই আশুজিয়া হাইস্কুলের মাস্টার হতে উদ্বুদ্ধ করেছিলেন। পবিত্র দাস মাস্টার হওয়াতে এলাকার সকল মানুষই খুশি হয়েছিলাে। পবিত্রদার কম্যুনিস্ট মতবাদকে অপছন্দ করতেন অনেকেই, কিন্তু তার ব্যক্তিত্বকে পছন্দ করতেন সকলেই। এই তরুণটি যে অত্যন্ত মেধাবী, উদ্যমী, সৎ ও সব দিক দিয়েই তুখােড়—এ কথা সবাই মানতেন। এ-রকম একজন তুখােড় যুবককে মাস্টার হিসেবে পাওয়া গেছে যখন, তখন
১৮৩
এ-স্কুলে ছেলেদের পাঠিয়ে তাদের পড়াশােনা সম্পর্কে নিশ্চিন্ত থাকা যাবে, আশুজিয়া স্কুল তার আগেকার গৌরব ফিরে পাবে—গাঁয়ের লােকদের মুখে এই রকম আশাবাদী কথাবার্তা শােনা গিয়েছিলাে। কিন্তু এই তরতাজা মানুষটির আকস্মিক মৃত্যুসংবাদ তাদের আশার বাতিটিকে ফুঁ দিয়ে নিভিয়ে দিলাে।
সে সময়কার গ্রামাঞ্চলের অন্যসব স্কুলের মতােই আশুজিয়া হাইস্কুলেরও ছিলাে নিতান্ত করুণ দশা। এ স্কুলের শিক্ষক বলতে একমাত্র জয়চন্দ্র রায়। দু’তিন জন ম্যাট্রিক পাস শিক্ষক নিচের ক্লাসগুলােতে পড়ান। আর ক্লাস নাইন টেনের প্রায় সব সাবজেক্টই বলতে গেলে একা জয়চন্দ্র বাবুকেই পড়াতে হয়। একজন প্রবীন মৌলবী সাহেব আরবি পড়াতেন, সংস্কৃত পড়াতেন পণ্ডিত কৃষ্ণধন গােস্বামী। সংস্কৃতের পণ্ডিতকেই নিতে হতাে বাংলা ব্যাকরণের ক্লাসও। হেডমাস্টার ক্ষিতীশ চক্রবর্তী ছাড়া আর কোনাে গ্রাজুয়েট শিক্ষক ছিলেন না। জয়চন্দ্র রায় নিজেও আন্ডার গ্রাজুয়েট । আশপাশের গায়ের যে কোনাে যুবক ইন্টারমিডিয়েট পাস করে বা বিএ পরীক্ষা দিয়ে বাড়ি এলেই জয়চন্দ্র বাবু তাকে ধরে নিয়ে এসে স্কুলে মাস্টারির কাজে লাগিয়ে দিতেন। এভাবেই আমরা কিছুদিনের জন্যে অঙ্কের শিক্ষক হিসেবে পেয়েছিলাম বলাইশিমুল গ্রামের আইএ পাস তরুণ ফজলুল হক সাহেবকে। এরপর তিনি বিএ পড়তে ময়মনসিংহ চলে গেলে আমাদের অঙ্কের ক্লাসে কোনােদিন যেতেন হেডমাস্টার ক্ষিতীশ বাবু, কোনােদিন জয়চন্দ্র বাবু। ক্ষিতীশ বাবু প্রায়শই অসুস্থ থাকতেন। তার পক্ষে নিয়মিত ক্লাস নেয়া মােটেই সম্ভব হতাে না। বিএ পরীক্ষা দিয়ে এসে কচন্দরা গ্রামের ফজর আলী সাহেবও আমাদের কয়েকদিন ইংরেজি পড়িয়েছিলেন। তারপর তিনিও চলে যান। এরকম আরাে কয়েকজন শিক্ষক এসেছেন ও চলে গেছেন। এতাে দ্রুত তাদের আগমণ-নির্গমণ ঘটেছে যে, এই শিক্ষকদের কারাে নাম বা চেহারাই আমার স্মৃতিপটে গেঁথে যেতে পারেনি। আমাদের স্কুলটিতে তখন পড়াশােনার হাল যে কেমন ছিলাে তা শিক্ষকদের এ-রকম আগমণ-নির্গমণ থেকেই বােঝা যায় ।
একান্ন সালের শেষের দিকে স্কুলে এসে যােগ দিলেন একজন প্রবীণ গ্রাজুয়েট শিক্ষক কুমুদ ভট্টাচার্য। তিনিও ফজলুল হক, ফজর আলী বা অন্যান্য স্বল্পকালীন শিক্ষকদের মতােই জয়চন্দ্র রায় তথা আশুজিয়া হাইস্কুলের প্রাক্তন ছাত্র। তবে শিক্ষক রূপে আশুজিয়া হাইস্কুলে তার অবস্থান এতাে স্বল্পকালীন হয়নি। বছর পাঁচেক তিনি এই স্কুলে ছিলেন। তিনি আসার পর থেকেই স্কুলটিতে অ্যাকাডেমিক পরিবেশ অনেক পরিমাণে ফিরে এসেছিলাে, জয়চন্দ্র বাবুর খাটুনিরও অনেকখানি লাঘব হয়েছিলাে। আশুজিয়ার মতােই আরেক ব্রাহ্মণ-প্রধান গ্রাম কাটিহালির বাসিন্দা এই কুমুদ ভট্টাচার্য ছিলেন একজন বিদগ্ধ শিক্ষক। ছাত্রদের মনে সাহিত্য ও ইতিহাস সম্পর্কে কৌতূহল সৃষ্টি করতে তিনি সব সময়ই চেষ্টা করতেন, পাঠ্যবিষয়ের সূত্র ধরেই পাঠ্যসূচি বহির্ভূত নানা বিষয়ের এলাকায় তাদের নিয়ে যেতেন। পাঠ্য বইয়ের বক্তব্যও তার আলােচনায় অন্যরকম মাত্রা পেয়ে যেতাে। আমাদের ইংরেজি বইয়ে একটি প্রবন্ধ ছিলাে—‘ডায়ালােগ উইথ অ্যা জায়েন্ট। এটি বিভার্লি নিকলসের ভার্ডিক্ট অন ইন্ডিয়া’ বইয়ের একটি নির্বাচিত অংশ। ব্রিটিশ সাংবাদিক নিকলস সাহেব ছিলেন জিন্নাহ সাহেবের একান্ত অনুরাগী, জিন্নাহর ব্যক্তিত্বের ছটায় মুগ্ধ। কুমুদ বাবু আমাদের ক্লাসে নিকলস সাহেবের অনুসরণেই জিন্নাহর ব্যক্তিত্বটি অত্যন্ত চমৎকারভাবে ফুটিয়ে তুলেছিলেন। কিন্তু সেই সঙ্গে তার বক্তব্যের ফাক ও ফাকিগুলােও চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছিলেন। পাকিস্তানের সেই
১৮৪
রমরমার দিনে, ক্লাসের ছাত্রদের সামনে, পাকিস্তানী ভাবাদর্শের বিরােধী বক্তব্য তুলে ধরতেও তিনি ইতস্তত করতেন না। আবার ইসলামের ইতিহাস সম্পর্কে তার অনুরাগের বিষয়টিও তার পাঠদানের মধ্যে ধরা পড়তাে। আমীর আলীর ‘দ্য স্পিরিট অব ইসলাম আর ‘হিস্ট্রি অব দ্য সারাসেনস’-এর অনেক কথা তিনি নানা প্রসঙ্গে ক্লাসের পাঠ্যবই পড়াবার ফাঁকে ফাঁকে উল্লেখ করতেন। মুসলমান ছাত্ররাও ইসলাম সম্পর্কে তার জ্ঞানের পরিচয় পেয়ে মুগ্ধ হয়ে যেতাে। কোনাে কোনাে দিন ইংরেজি ‘অমৃতবাজার পত্রিকা হাতে নিয়ে ক্লাসে ঢুকেই তিনি হাঁক ছাড়তেন—ট্রান্সলেট ইন টু বেঙ্গলি। এরপর গড়গড় করে পত্রিকার প্রতিবেদনের কিছু অংশ পড়ে যেতেন, আমরা তা শুনে শুনে খাতায় লিখে নিতাম। আমাদের অনুবাদের ভুল-ত্রুটি নির্দেশের সঙ্গে সঙ্গে মূল প্রতিবেদনটিও তিনি ব্যাখ্যা করে বােঝাতেন। সেই সূত্রেই এসে যেতাে রাজনীতির নানা প্রসঙ্গ।
আসলে কুমুদ বাবু আমাদের চোখ-কান খুলে দিতে চাইতেন, আমাদের ভেতর স্বাধীন চিন্তার উন্মেষ ঘটাতে চাইতেন, পাঠ্যসূচির গণ্ডি ভেঙে আমাদের ভাবনার জগতকে অনেক দূর পর্যন্ত প্রসারিত করে দিতে চাইতেন।
যদিও আমি একান্তভাবে পাঠ্যপুস্তক-বিরূপ ও নিতান্ত সাধারণ মানের ছাত্র, তবু আমার জীবনে স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক শিক্ষকেরই অনেক ধরনের প্রভাব পড়েছে; কিন্তু কোনাে শিক্ষকের প্রভাবই সম্ভবত কুমুদবাবুর চেয়ে গভীরতর হয়নি। ক্লাসের বাইরেও তার স্নেহসান্নিধ্য লাভের সুযােগ আমার হয়েছে। সেই সান্নিধ্যই আমার মনােজগতকে নানাভাবে আলােড়িত করেছে। অনেক বিষয়েই অনেক নতুন নতুন ভাবনার উপকরণ আমি তার কাছ থেকে পেয়েছি।
উনিশোে বায়ান্ন সালের ফেব্রুয়ারি মাসে (সম্ভবত তেইশ তারিখে) একদিন কিন্তু আমাদের এই একান্ত শ্রদ্ধেয় কুমুদ বাবুর ক্লাস থেকেই আমরা একযােগে বেরিয়ে গিয়েছিলাম। তিনি আমাদের ভালােমন্দ কিছু বলেননি, বাধাও দেননি। বিষন্ন মুখে তিনিও আস্তে আস্তে ক্লাস ছেড়ে চলে এসেছিলেন। এভাবেই বােধহয় আমাদের সঙ্গে সঙ্গে আমাদের শ্রদ্ধেয় শিক্ষক কুমুদ ভট্টাচার্যও মাতৃভাষার জন্যে প্রাণােৎসর্গকারী শহীদদের প্রতি নীরবে শ্রদ্ধাজ্ঞাপন করেছিলেন।
একুশ ফেব্রুয়ারিতে ঢাকার রাজপথ রক্তাক্ত হওয়ার খবরটি গাঁয়ে এসে পৌছা মাত্র আমাদের মধ্যে দেখা দিলাে ক্ষোভ ও চাঞ্চল্য। আমাদের সেই ক্ষোভ ও চাঞ্চল্যে উপযুক্ত ভাষা জোগালেন খান মােহাম্মদ আবদুল হাকিম। রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’-এর সঙ্গে সঙ্গে আমাদের মুখে স্লোগান উঠলাে—‘ছাত্রহত্যার বিচার চাই’, নূরুল আমিনের রক্ত চাই।
আটচল্লিশ সালের ভাষা আন্দোলনের সময় আমি ছিলাম নেত্রকোনা শহরের চন্দ্রনাথ হাইস্কুলে ক্লাস সিক্সের ছাত্র। সে সময় ক্লাস নাইন-টেনের ছাত্রদের নেতা মেনে অন্য সবার সঙ্গে ক্লাস থেকে বেরিয়ে এসে মিছিলে যােগ দিয়েছিলাম, নেতাদের দেয়া স্লোগানে কণ্ঠ মিলিয়েছিলাম। কিন্তু এবার, উনিশোে বায়ান্ন সালে, গায়ের স্কুলে ক্লাস টেনের ছাত্র আমি । আমাকেই হয়ে যেতে হলাে ‘নেতাদের একজন। আমাদের ক্লাসেরই খালেক, সাত্তার, মনফর এবং ক্লাস নাইনের আরাে ক’জন ছাত্র মিলে আমরা সব ক্লাসে গিয়ে ছাত্রদের বের করে নিয়ে এলাম। মুখে টিনের চোঙা লাগিয়ে স্লোগান দিতে দিতে চলে গেলাম আমাদের স্কুল থেকে মাইলখানেক দূরে বসুর বাজারে। বাজারে ঢােকার রাস্তাটিতেই আমাদের মিছিল দাঁড়িয়ে গেলাে।
১৮৫
সেদিন ছিলাে হাটবার। সবেমাত্র হাটুরেরা আসতে শুরু করেছে। চোঙায় মুখ লাগিয়েই উঁচু গলায় আমরা তাদের কাছে ঢাকার ছাত্রহত্যার বর্ণনা দিয়ে চললাম। বর্ণনার মধ্যে অবশ্যই বেশ কিছু কল্পনার মিশেল ছিলাে, অতিরঞ্জন ছিলাে। আর ছিলাে প্রচণ্ড আন্তরিক আবেগ। আমাদের সেই আবেগের তােড়ে হাটের মানুষদের অনেককেই ভেসে যেতে দেখলাম। অনেকেই ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলেন। শত্রুর বিরুদ্ধে ক্রোধ ও ঘৃণার বাচনিক প্রকাশ ঘটালেন অনেকে। আমাদের আবেদনে সেদিন সেই হাটে হরতাল পালিত হলাে। কেউ কোনাে কিছু কেনাবেচা করলেন না। আমাদের সঙ্গে মিছিলে যােগ দিয়ে তারাও বাজার-পরিক্রমা করলেন, স্লোগানে স্লোগানে ছাত্রহত্যাকারীদের বিরুদ্ধে ঘৃণার প্রকাশ ঘটালেন।
এরপরের কয়েকদিন ধরে আশপাশের অন্যান্য বাজারগুলােতেও আমরা এমনিভাবে হরতাল পালন করিয়েছিলাম। গায়ের কোনাে কোনাে মানুষ শব্দটির সঙ্গে হয়তাে আগে থেকেই পরিচিত ছিলাে, নানা উপলক্ষে শহরে হরতাল হওয়ার কথা তারা শুনেছে। কিন্তু বসুরবাজার কিংবা রামপুর, বীরগঞ্জ, বেখৈরহাটির মতাে গ্রাম্য বাজারে নিজেরাই হরতাল করে বসলাে বােধহয় এই প্রথম। প্রত্যেকটি হাটে হরতালের সময় গ্রামীণ মানুষদের মধ্যে শােক, ঘৃণা, ক্রোধ ও প্রতিবাদের প্লাবন বয়ে গিয়েছিলাে।
‘আমরার পােলাপানরারে শহরে পাঠাই ল্যাহাপড়া শিহনের লাইগ্যা। আর গুলি চালাইয়া তারারে মাইরা ফালায় যারা হ্যারা ….।
এই হ্যারা’ (তারা) সম্পর্কে যে বিশেষণগুলাে প্রয়ােগ করেছিলাে সেদিনকার সেই ক্ষুব্ধ গ্রামীণ মানুষেরা, সেগুলােকে কলমবন্দি করার সাহস আমার নেই। কারণ আমি তাে তথাকথিত দ্রলােক। দ্রলােকের বিচারে তাে এসব শব্দ অশ্লীল, অশালীন, অনুচ্চার্য, অলেখ্য। তবে ভদ্রলােকদের তৈরি বাংলা অভিধানে যেসব শব্দ ঠাই পায় না, সেসব শব্দ ছাড়া যে গণশত্রুদের যথার্থ পরিচয় দেয়া সম্ভব নয়—সে কথা আমাকে স্বীকার করতেই হবে।
হেকিম ভাই তখন তমদ্দুন মজলিস করেন। তমদ্দুন মজলিসের মুখপত্র সাপ্তাহিক ‘সৈনিক’-এর তিনি গ্রাহক ও লেখক। প্রায় নিয়মিত তিনি এ পত্রিকায় আমাদের এলাকার রিপোের্ট পাঠান। তার বাড়ির গােলঘরে বসেই আমি ‘সৈনিক পড়ি। সৈনিকেই একুশের ঘটনার বিস্তারিত বিবরণ পড়ে রাগে-দুঃখে হতবাক হয়ে গিয়েছিলাম। একুশে ফেব্রুয়ারির পরে আমরা যে নেত্রকোনার কেন্দুয়া থানার কয়েকটি অজ পাড়াগাঁয়ে ভাষা আন্দোলন গড়ে তুলেছিলাম তার মূল প্রেরণাটি পেয়েছিলাম ‘সৈনিক’ থেকেই। আর ‘সৈনিক’-এর গ্রাহক ও লেখক খান মােহাম্মদ আবদুল হাকিম হয়েছিলেন আমাদের জীবন্ত প্রেরণাদাতা। হেকিম ভাইয়ের একটা নতুন উদ্যমী ও সংগঠনকুশলী রূপ তখন প্রত্যক্ষ করেছিলাম। কদিন ধরে চরকির মতাে তিনি এ গাঁয়ে ও গায়ে ঘুরলেন। গাঁয়ের মানুষদের ছােট ছােট বৈঠকে একুশে ফেব্রুয়ারির ঘটনার তাৎপর্য তুলে ধরলেন। বাংলা রাষ্ট্রভাষা না হলে যে আমাদের পশ্চিমাদের গােলাম হয়ে যেতে হবে—সে কথাই সকলকে বােঝাতে চাইলেন। মােল্লা-মৌলবী কিসিমের কিছু কিছু লােক যখন হেকিম ভাইয়ের কথার প্রতিবাদ জানালাে, উর্দু আর ইসলামকে এক ও অভিন্ন বলে মত প্রকাশ করলাে, রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনকে হিন্দু ও হিন্দুস্থানের চক্রান্ত বলে চিহ্নিত করতে চাইলাে, তখন হেকিম ভাই রেগে একেবারে আগুন হয়ে গেলেন। ইটাউতা গ্রামের একজন ছাত্র (যতদূর মনে পড়ে তার নাম মঞ্জুর) এসে একটি মাদ্রাসার খবর জানালাে। সে মাদ্রাসার শিক্ষক ও ছাত্ররা
১৮৬
নাকি রাষ্ট্রভাষা উর্দুর সপক্ষে মিছিল করার প্রস্তুতি নিচ্ছে। শুনে মহা উত্তেজিত হয়ে হেকিম ভাই বললেন, এই কাঠমােল্লাদের মাথা ফাটিয়ে দিতে হবে। তােমরা প্রস্তুত হয়ে যাও।’ কারাে মাথা ফাটানাের অবিশ্যি প্রয়ােজন পড়েনি, কারণ কেউই শেষ পর্যন্ত উর্দুর পক্ষে মিছিল বের করার মতাে সাহস পায়নি।
হেকিম ভাইয়ের এক সম্বন্ধী, অবশ্যই আমাদের চেয়ে অনেক বেশি বয়স্ক, আবদুল আউয়াল বায়ান্ন সালে আশুজিয়া হাইস্কুলে ক্লাস টেনে আমাদের সহপাঠি হয়েছিলেন। এর বেশ কয়েক বছর আগে ক্লাস টেন পর্যন্ত পড়েই তিনি ইস্কুল ছেড়ে দিয়েছিলেন। এরপর কী মনে করে বলতে গেলে প্রায় প্রবীণ বয়সে, আবার তিনি ছাত্রের খাতায় নাম লেখালেন। এই প্রবীণ সহপাঠিটিকে আমরা খুবই সমীহ করে চলতাম। একুশে ফেব্রুয়ারির পরে কোনাে একদিন (তারিখটা মনে করতে পারছি না) আমাদের স্কুল সংলগ্ন ইউনিয়ন বাের্ড অফিস প্রাঙ্গণে খুব ঘটা করে একটি ছাত্রসভার আয়ােজন করেছিলাম। সে সভার সভাপতি বানিয়েছিলাম আউয়াল ভাইকে। আমিই হয়েছিলাম প্রধান বক্তা’! ছয় বছর আগে, ছেচল্লিশ সালের সাধারণ নির্বাচনের আগে ও পরে, আমাদের পাড়ার বালক শ্রোতাদের সামনে অনেক জ্বালাময়ী বক্তৃতা দিয়েছি! সেই থেকেই আমি বক্তা! কিন্তু সত্যিকারের কোনাে সভায় বক্তৃতা দিতে দাঁড়ালাম এই প্রথম। একুশের শহীদদের শ্রদ্ধা জানাতে গিয়ে অনর্গল অনেক কথা বলে ফেলেছিলাম। বক্তৃতা শুরু করেছিলাম নানান দেশের নানান ভাষা, বিনা স্বদেশী ভাষা মিটে কি আশা নিধু বাবুর সেই বিখ্যাত পংক্তিটির উদ্ধৃতি দিয়ে। শ্রোতাদের কাছে কেমন লেগেছিলাে জানি না, তবে সেই ‘মেইডেন স্পীচ দিয়ে আমি নিজেই যে অবাক হয়ে গিয়েছিলাম—সে কথা মনে করে আজো শিহরিত হয়ে উঠি!
পাকিস্তানের জন্মদাতা বলে কথিত জিন্নাহ সাহেব নিজেই যদি আটচল্লিশ সালে উর্দুকে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার ঘােষণা দিয়ে পাকিস্তানের মৃত্যুবীজ রােপণ করে থাকেন, তবে এ কথাও বলতে হবে যে, সেই মৃত্যুবীজকে ফলবান মহীরুহে পরিণত করেছিলেন তারই উত্তরসুরিরা বায়ান্নতে বাংলাভাষাপ্রেমিক ছাত্রদের বুকের রক্ত ঝরিয়ে। বায়ান্নর একুশে ফেব্রুয়ারিরই অনিবার্য পরিণতি একাত্তরের ছাব্বিশে মার্চ বা ষােলই ডিসেম্বর—এমন কথাও আমরা হরহামেশা বলি বটে। কিন্তু একুশের ঘটনার পরপরই গ্রামবাংলায় তার কী-ধরনের প্রতিক্রিয়া হয়েছিলাে, অজ পাড়াগাঁয়ে পর্যন্ত কীভাবে ভাষা আন্দোলনের বিস্তৃতি ঘটেছিলাে, বিভিন্ন স্থানের গ্রামীণ এলিটদের প্রণােদনায় সাধারণ কৃষকরা পর্যন্ত সে আন্দোলনের সঙ্গে কেমন করে সম্পৃক্ত হয়ে পড়েছিলাে—সে সবের খুব বেশি খোঁজখবর আমাদের জানা নেই, জানার আগ্রহ বা উদ্যোগও তেমন নেই। ঢাকার বাইরের ভাষা আন্দোলন সম্পর্কে বলতে গিয়ে আমরা বড়জোর সেকালের জেলা সদর পর্যন্ত গিয়েই থেমে যাই। কোনাে কোনাে মহকুমা বা থানা সদরের নাম উল্লেখের চেয়ে বেশি কিছু করা প্রয়ােজন মনে করি না।
আমাদের এ-রকম আচরণ কি সঙ্গত? এভাবেই কি আমরা ইতিহাসকে খণ্ডিত করে ফেলি ? খণ্ডিত ইতিহাসের সঙ্গে বিকৃত ইতিহাসের কি খুব বেশি পার্থক্য আছে?

বায়ান্ন-পরবর্তী রাজনীতিতে নতুন হাওয়া
বায়ান্নর ফেব্রুয়ারি-মার্চে হেকিম ভাইয়ের সহযােগী রূপে ভাষা আন্দোলনে আমিও বেশ সক্রিয় হয়ে পড়েছিলাম। আমার সক্রিয়তা অবিশ্যি তেমন জোরালাে কিছু নয়। হেকিম ভাইয়ের
১৮৭
পাশাপাশি থাকা, ‘সৈনিক পত্রিকা পড়া, বাংলাভাষার পক্ষে কিছু তর্ক-বিতর্ক করা, অনানুষ্ঠানিক গ্রাম বৈঠকগুলােতে বক্তৃতা দেয়া বা বক্তৃতার ঢঙে কিছু কথা বলা। এই পর্যন্তই। গ্রাম এলাকায় এরচেয়ে বেশি কিছু করার সুযােগও অবশ্যই ছিলাে না। তাছাড়া, আমি তাে আর হেকিম ভাইয়ের তমদ্দুন মজলিসের সদস্য বা কর্মি ছিলাম না। হেকিম ভাইও কোনােদিন আমাকে তমদ্দুন মজলিসে যােগ দিতে বলেননি। অমুসলমানদের পক্ষে তমদ্দুন মজলিসের সদস্য হতে কোনাে বাধা ছিলাে কিনা জানি না। বাধা না থাকলেও এবং হেকিম ভাই বললেও, আমি কিছুতেই তমদুনী’ হতে পারতাম না। সৈনিক’-এর রিপাের্টগুলাে পড়ে ভাষা আন্দোলনের খোঁজ-খবর পাচ্ছিলাম বটে, কিন্তু এই সৈনিকের পাতাতেই তমদ্দুন মজলিসের ভাবাদর্শের যে পরিচয় পেতাম তাতে বুঝতে অসুবিধা হয়নি যে, এটি হচ্ছে একটি ইসলামী পুনর্জাগরণবাদী সংগঠন। এ সংগঠনের একজন হওয়া তাে তাই জন্মগত কারণেই আমার পক্ষে ছিলাে অসম্ভব। তার ওপর কৈশােরেই আমার ভেতর শেকড় গেড়ে বসেছিলাে সেকুলার ভাবনাচিন্তা। তমদ্দুন মজলিস সুস্থ ও সুন্দর’ তমদ্দুন গড়ে তােলার জন্যে কুসংস্কার, গতানুগতিকতা ও প্রতিক্রিয়াশীলতা দূর করার কথা বলতাে। কিন্তু এই শব্দগুলাের তাৎপর্য তমদুনীদের কাছে খুব স্পষ্ট ছিলাে বলে মনে হয় না। কিংবা এই শব্দগুলাের ওপর তারা এমন অর্থ আরােপ করেছিলেন যা হয়ে গিয়েছিলাে এগুলাের আসল অর্থের সম্পূর্ণ বিপরীত। যুক্তিবাদের ওপর প্রতিষ্ঠিত সর্বাঙ্গ সুন্দর ধর্মভিত্তিক সাম্যবাদের দিকে মানব সমাজকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়াকে তার উদ্দেশ্য বলে তমদ্দুন মজলিস ঘােষণা করেছিলাে। তমদুনীদের এই ‘যুক্তিবাদের পেছনে যুক্তি কতােখানি ছিলাে বলা মুশকিল। আবার ‘ধর্ম’ বলতে তারা আসলে ইসলামকেই বুঝতেন এবং ইসলামেরও যে খুব একটা সাহসী র্যাডিকেল ব্যাখ্যা হাজির করেছিলেন—তাও নয়। দ্বিজাতিতত্ত্বকেও তারা প্রত্যাখ্যান করেননি। বরং দ্বিজাতিতত্ত্বকে প্রতিষ্ঠিত ও পােক্ত করাই ছিলাে তাদের লক্ষ্য। মূলত তমদ্দুন মজলিস একটি সাম্প্রদায়িক সংগঠনই ছিলাে। মার্কসবাদ তথা কম্যুনিজমের প্রতি তার ছিলাে বিজাতীয় বিদ্বেষ। মার্কসবাদ ও বস্তুবাদের বিরােধিতা করতে গিয়ে তমদ্দুন মজলিস চূড়ান্ত অবৈজ্ঞানিক ও যুক্তিহীন যুক্তিজাল বিস্তার করেছিলাে। প্রতিক্রিয়াশীলতা দূর করার কথা বললেও স্বরূপত এ সংগঠনটি ছিলাে প্রতিক্রিয়াশীলই।
তবু, এসব সত্ত্বেও, বাংলা ভাষার পক্ষে তমদ্দুন মজলিসের ভূমিকা ছিলাে একান্তভাবেই প্রগতিশীল। সে সময়কার পূর্ব পাকিস্তানে দৈনিক পত্রিকার সংখ্যা ছিলাে অঙ্গুলিমেয়। এদের কোনােটাই বাংলা ভাষার জন্যে আন্দোলনকারীদের পক্ষ সমর্থন করেনি। বায়ান্নর একুশ ফেব্রুয়ারির ঘটনার প্রতিবাদে আজাদ সম্পাদক আবুল কালাম শামসুদ্দীন যে পূর্ব পাকিস্তান আইনসভার সদস্য পদে ইস্তফা দিয়েছিলেন সেটি ছিলাে তার একান্ত ব্যক্তিগত বিবেকী সিদ্ধান্ত, এর সঙ্গে পত্রিকার নীতিমালার কোনাে সম্পর্ক ছিলাে না। রাজধানী থেকে প্রকাশিত পত্রপত্রিকার মধ্যে তমদ্দুন মজলিসের মুখপত্র সৈনিক’ই কেবল ভাষা আন্দোলনের প্রতি বলিষ্ঠ সমর্থন জানিয়েছিলাে এবং মফস্বলবাসী আমরাও এই পত্রিকাটির কল্যাণেই ভাষা আন্দোলনের সঙ্গে নিজেদের যুক্ত রাখতে পেরেছিলাম। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের পুরাে কৃতিত্ব অবশ্যই তমদ্দুন মজলিসের ছিলাে না। তবু মজলিসের কৃতিত্বকে অস্বীকার করা বা তার ভূমিকাকে খাটো করে দেখাও হবে নিতান্ত অনুচিত আচরণ।।
আবার অন্যদিকে, তমদ্দুন মজলিস তথা ইসলামপন্থীদের কেউ কেউ খেদের সঙ্গে বলেন যে, সেকুলারপন্থী ও মার্কসপন্থীরা ভাষা আন্দোলনের কৃতিত্বকে ইসলামপন্থীদের কাছ থেকে
১৮৮
হাইজ্যাক করে নিয়ে গেছে। ঠিক এই ভাষাটিই সবাই প্রয়ােগ করেন না, তবে তাদের কথার ভাবার্থ এ রকমই দাঁড়ায়। অন্তত একুশে ফেব্রুয়ারি এলেই, আশি ও নব্বইয়ের দশকেও, এদের মুখপত্রগুলােতে এরা ইনিয়ে বিনিয়ে এমন কথাই বলে থাকেন। এ রকম কথা বলে তারা বাঙালির ভাষা সংগ্রামের পুরাে ইতিহাসটাকেই খণ্ডিত ও বিকৃত করে তুলতে চান। তারা যে এদেশের অসাম্প্রদায়িক পণ্ডিতবর্গ, সেকুলার রাজনীতিকবৃন্দ ও প্রগতি-চেতন ছাত্রসমাজের অবদানকে হাইজ্যাক করে নিতে পারলেন না, তাদের ক্ষোভটা বােধহয় সে কারণেই। পাকিস্তানের জন্মের সঙ্গে সঙ্গেই যে ভাষাচার্য মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, মুক্তবুদ্ধির সাধক কাজী মােতাহার হােসেন, গবেষক ও শিক্ষাবিদ মুহম্মদ এনামুল হক, বহুভাষাবিদ ও রস সাহিত্যিক সৈয়দ মুজতবা আলী প্রমুখ সুধী রাষ্ট্রভাষা বাংলার পক্ষে কলম ধরেছিলেন তা ইসলামিক বা ধর্মীয় বিবেচনা থেকে নয়। ভাষাতাত্ত্বিক ও রাষ্ট্রনৈতিক নিয়মনীতিই ছিলাে তাদের বিবেচ্য। বায়ান্নর অনেক আগেই হুমায়ুন কবীর সম্পাদিত ‘চতুরঙ্গ সাহিত্যপত্রে বেরিয়েছিলাে সৈয়দ মুজতবা আলীর দীর্ঘ রচনা পূর্ব পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা’। সে সময়েই, বই আকারে প্রকাশের আগেই, এ রচনাটি পড়ার সৌভাগ্য আমার হয়েছিলাে। হেকিম ভাইয়ের সংগ্রহেই চতুরঙ্গের সেই সংখ্যাটি আমি পেয়েছিলাম। সৈয়দ মুজতবা আলীর মতাে লেখক-বুদ্ধিজীবীরা যেমন, তেমনি ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের মতাে সেকুলার জাতীয়তাবাদী রাজনীতিকরাও রাষ্ট্রভাষা রূপে বাংলার যৌক্তিকতার কথা জোরালাে ভাষায় তুলে ধরেছিলেন। আর জিন্নাহর মুখের ওপর না, না’ ধ্বনি তুলে প্রতিবাদে সােচ্চার হয়েছিলেন যে সচেতন ছাত্রনেতৃবৃন্দ তাদেরও কোনাে ধর্মীয় বা সাম্প্রদায়িক বিবেচনা ছিলাে না। আসলে ভাষা ব্যাপারটাই ধর্মনিরপেক্ষ, কোনাে ভাষাই কোনাে বিশেষ ধর্মীয় সম্প্রদায়ের নিজস্ব সম্পত্তি নয়। এবং ভাষা শ্রেণী-নিরপেক্ষও। শােষকশােষিত নির্বিশেষে একটি জনগােষ্ঠীর সকল শ্রেণীর মানুষই একটি ভাষার ছত্রচ্ছায়ায় এসে সম্মিলিত হয়ে থাকে। আর এভাবে একটি সাধারণ ভাষাই হয় একটি জনগােষ্ঠীর জাতিতে পরিণত হওয়ার মূল উপাদান। বাংলা ভাষার আশ্রয়ে যে জনগােষ্ঠীটি একটি বিশাল ভূখণ্ডে শত শত বছরে তিল তিল করে একটি অর্থনৈতিক কাঠামাে ও অজস্র বৈচিত্র্যেভরা অভিন্ন সংস্কৃতি গড়ে তুলেছিলাে, সেই জনগােষ্ঠীটিই ধর্ম সম্প্রদায় ও শ্রেণী নির্বিশেষে একটি জাতি—বাঙালি জাতি। ধর্মভিত্তিক ভুয়া দ্বিজাতিতত্ত্ব ভাষাভিত্তিক এই আসল জাতি পরিচয়কে অস্বীকার করে পাকিস্তান নামক কৃত্রিম রাষ্ট্রটির জন্ম দিয়েছিলাে। কিন্তু দ্বিজাতিতত্ত্বের হােতারা যখন বাঙালির ভাষার ওপর আঘাত হানলাে, তখন সেই আঘাতটি গিয়ে পড়লাে সেই ভুয়া জাতিতত্ত্বটির ওপরই। সেই আঘাতেই দ্বিজাতিতত্ত্বের কৃত্রিম পর্দা ছিড়ে বেরিয়ে এলাে বাঙালির আদি ও অকৃত্রিম জাতীয় চেতনা। এই আসল জাতীয় চেতনাই একদিন কৃত্রিম চেতনাজাত কৃত্রিম রাষ্ট্র পাকিস্তানের মৃত্যু ঘটিয়ে জন্ম দিলাে বাংলাদেশ নামক স্বাধীন জাতিরাষ্ট্রের। অর্থাৎ বাঙালির ভাষার ওপর আঘাতই পাকিস্তানের মৃত্যু ও বাংলাদেশের জন্মের প্রক্রিয়াটির সূচনা করে দিয়েছিলাে। এবং এই প্রক্রিয়ায় যে কেবল সচেতন জাতীয়তাবাদী সেকুলার মানুষদেরই অবদান ছিলাে, তা নয়। ধর্মভিত্তিক দ্বিজাতিতত্ত্বে বিশ্বাসী ইসলামপন্থীদের অনেকে ব্যক্তিগতভাবে বা সাংগঠনিকভাবে বাঙালির মাতৃভাষার সপক্ষে ও তার শত্রুদের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছিলেন। বাঙালির ভাষার শত্রুদের বিরুদ্ধে (অর্থাৎ প্রতিক্রিয়াশীল পাকিস্তান রাষ্ট্রের কর্তৃত্বশীল শক্তির বিরুদ্ধে) দাঁড়ানাে তাে আসলে পাকিস্তানের বিরুদ্ধেই দাঁড়ানাে। অনেকে অসচেতনভাবেও এমনটি করেছিলেন। তমদ্দুন মজলিসের মতাে পাকিস্তানপ্রেমী
১৮৯
ইসলামপন্থী সংগঠনটিও তাই করেছিলাে। এর ধ্যান-ধারণা যতাে অস্বচ্ছ, অবৈজ্ঞানিক ও প্রতিক্রিয়াশীলই হােক, নিজের অজান্তে বা অনিচ্ছায় হলেও ভাষা-আন্দোলনে তমদ্দুন মজলিসের ভূমিকাটি ছিলাে একান্ত স্পষ্ট, বৈজ্ঞানিক ও প্রগতিশীল। এ থেকেও প্রমাণিত হয় যে, অনেক প্রতিক্রিয়াশীল গােষ্ঠীও ইতিহাসের বাঁকে বাঁকে কখনাে কখনাে কোনাে না কোনােভাবে প্রগতিশীল ভূমিকায় মঞ্চাবতরণ করে থাকে। কিন্তু তাই বলে তাদের প্রতিক্রিয়াশীল চরিত্র মুছে যায় না। প্রগতির পক্ষে যতােটুকু অবদান তারা রাখে সেটুকু স্বাভাবিকভাবে প্রগতিশীল শক্তির ভাণ্ডারে গিয়েই জমা হয়। এ নিয়ে যে যতাে আফসােস ও আহাজারিই করুক, ইতিহাসের দ্বান্দ্বিক নিয়ম তাতে পাল্টে যাবে না। গােলাম আযমও ভাষা আন্দোলনে যােগ দিয়েছিলেন বলে তার অনুসারীরা গৌরব প্রকাশ করে থাকে। কিন্তু একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময় সেই গােলাম আযমকেই নাকি বলতে শােনা গেছে যে, বাংলা ভাষার পক্ষে আন্দোলন করে তারা ভুল করেছিলেন। এ রকম বােধে উপনীত হওয়াই গােলাম আযমদের জন্যে স্বাভাবিক। কারণ ভাষা-আন্দোলনের মতাে একটি প্রগতিশীল আন্দোলনের ফসল তাে কোনােমতেই ওদের মতাে প্রতিক্রিয়াশীলদের ঘরে গিয়ে উঠতে পারে না, সে ফসলে নিরঙ্কুশ অধিকার জন্মে প্রগতিকামী মানুষের ও বঞ্চিত জনগণের। বাঙালির ভাষা আন্দোলনের পরিণতিই তাে স্বাধীনতা আন্দোলন, সশস্ত্র মুক্তিসংগ্রাম, স্বাধীন বাংলাদেশের জন্ম ও এ অঞ্চলে পাকিস্তানের মৃত্যু এবং এ রকম কোনাে পরিণতিই গােলাম আযমের মতাে প্রতিক্রিয়াশীল মানুষদের বা তাদের নানা গণবিরােধী সংগঠনের কাম্য ছিলাে না, কাম্য হতে পারে না।
হেকিম ভাই তমদ্দুন মজলিসের প্রেরণায় ভাষা আন্দোলনের সঙ্গে তাে নিজেকে অত্যন্ত উৎসাহের সঙ্গে যুক্ত করেছিলেনই, মজলিসের আরেকটি দাবিরও ছিলেন তিনি সােচ্চার প্রচারক। সেটি হচ্ছে : বিনা ক্ষতিপূরণে জমিদারি উচ্ছেদ। তার বন্ধু পবিত্র দাসের সঙ্গে তিনি ক্যুনিজম নিয়ে তর্ক করতেন। ইসলামী রাষ্ট্র কায়েম হলে যে ক্যুনিজমের কোনাে প্রয়ােজন হবে না, তমদ্দুন মজলিসের ম্যানিফেস্টো দিয়েই তিনি তা প্রমাণ করতে চাইতেন। খােলাফায়ে রাশেদীনের দিনগুলােকে ফিরিয়ে আনতে পারলেই প্রতিষ্ঠিত হবে ধনতন্ত্রেরও বিকল্প, ক্যুনিজমেরও বিকল্প। দ্বিতীয় খলিফা হযরত ওমরের সময়ের একটি ঘটনাকে দৃষ্টান্ত হিসেবে উল্লেখ করে তমদ্দুন মজলিস মত প্রকাশ করেছিলাে যে, জনগণের স্বার্থে জমিদারদের ক্ষতিপূরণ না দিয়েই তাদের জমি অধিগ্রহণ করা ন্যায়সঙ্গত এবং এটিই ইসলামের রাষ্ট্রীয় বিধান।
কিন্তু ক্যুনিস্ট-বিরােধী তমদ্দুন মজলিসের এ রকম ইসলাম-সম্মত দাবি ও বক্তব্যও সেসময়কার পাকিস্তানের দৃষ্টিতে হয়ে গেলাে ইসলাম-বিরােধী ও কম্যুনিস্টপন্থী। পূর্ববাংলার অর্থমন্ত্রী হামিদুল হক চৌধুরী আটচল্লিশ সালের বিশ আগস্ট রাজশাহীতে এক জনসভায় বলেছিলেন যে, ক্ষতিপূরণ না দিয়ে জমিদারি উচ্ছেদ করা হবে একান্ত অন্যায় ও মানুষের ব্যক্তিগত সম্পত্তিতে হস্তক্ষেপ। এ রকম হস্তক্ষেপ হবে অরাজকতা সৃষ্টিকারী। এ রকম অরাজকতা সৃষ্টি করতে চায় যারা তারাই ক্যুনিজমের অনুসারী। কম্যুনিজমের সঙ্গে ইসলামের কোনােরূপ সমঝােতা হতে পারে না, কমুনিস্টদের সম্পর্কে পাকিস্তানের সকলকে অবশ্যই সতর্ক থাকতে হবে।
পাকিস্তানের জন্মের আগে কিন্তু পাকিস্তান আন্দোলনকারীদের ভেতর এমন উগ্র কম্যুনিজম-বিরােধিতা দেখা যায়নি। তখনকার কমুনিস্ট পার্টি পাকিস্তান আন্দোলনকে
১৯০
‘সংখ্যালঘুদের আত্মনিয়ন্ত্রণের জাতীয় আন্দোলন’ রূপে চিত্রিত করায় তরুণ মুসলমানদের অনেকে বরং কম্যুনিস্টদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠেছিলেন। প্রস্তাবিত পাকিস্তানই হবে কম্যুনিজম প্রতিষ্ঠার উর্বর ক্ষেত্র—অনেকে এ-রকমও ভাবতেন। কিন্তু সত্যি সত্যিই যখন পাকিস্তান কায়েম হয়ে গেল তখন কায়েমী স্বার্থবাদীরাই এ রাষ্ট্রের সবকিছুতে অধিকার বিস্তার করে বসলাে। ক্যুনিজম কিংবা বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র তাে দূরের কথা, সমাজতন্ত্রের সঙ্গে যারা ইসলামকে মিলিয়ে দেখতে চাইতাে বা ‘ইসলামিক সমাজতন্ত্রের কথা বলতাে, পাকিস্তানের শাসকদের দৃষ্টিতে তারাও হয়ে গেল ইসলাম-বিরােধী ও পাকিস্তান-বিরােধী। ইসলামের বৈপ্লবিক অন্তঃসার বলে এতােকাল যা কথিত হয়ে আসছিলাে, তাকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে পাকিস্তানের গণবিরােধী শাসকগােষ্ঠী ও তাদের সহযােগীরা ব্যক্তিগত সম্পত্তির অধিকারকেই ইসলামের মূল মর্মরূপে উপস্থাপন করলাে। বিভিন্ন লেখায় ও বক্তৃতায় তারা বােঝাতে চাইলাে: এক আল্লাহর অস্তিত্ব, হযরত মুহম্মদের রেসালাত, কোরানের বিধানের অভ্রান্ততা ইত্যাদির প্রতি বিশ্বাস ও আনুগত্য কিছুতেই সম্পূর্ণ হতে পারে না ব্যক্তিগত সম্পত্তির অধিকারকে পবিত্র ও অলংঘনীয় ইসলামী বিধান বলে মেনে না নিলে।
এ-রকম তত্ত্বীয় ধূম্রজালের মধ্যে পড়ে বায়ান্ন সালেই হেকিম ভাইকে খুব বিব্রত, ক্ষুব্ধ ও ব্যতিব্যস্ত হতে দেখলাম। তখন তার ক্যুনিস্ট বন্ধু প্রয়াত পবিত্র দাসের কথা মাঝেমধ্যেই স্মরণ করতেন ‘পবিত্রটা যদি এখন বেঁচে থাকতাে!’ দীর্ঘশ্বাস ফেলে এমন কথাও বলতেন।
বায়ান্নর মে মাস থেকে পরবর্তী সাত/আট মাস হেকিম ভাইয়ের সঙ্গে আমার বড়াে একটা দেখাসাক্ষাৎ হয়নি। মে মাসেই আমি গুরুতর পেটের পীড়ায় আক্রান্ত হয়ে পড়ি। প্রথম মাস দুই চললাে প্রচণ্ড ডিসপেপসিয়া, কোনাে খাবারই হজম হয় না। এরপর শুরু হলাে অসহ্য বুক জ্বালা । সারাক্ষণ বুক জ্বালা। কিছু খাবার খেলে অল্প সময়ের জন্যে জ্বালার উপশম হলেও একটু পর আবার পূর্ববৎ। হােমিওপ্যাথি ও এলােপ্যাথি চিকিৎসায় দীর্ঘদিনেও কোনাে ফল পাওয়া গেলাে না। এরপর কুলনন্দ আয়ুর্বেদ ভবনের কবিরাজ জগদীশ নাগ আমার চিকিৎসার দায়িত্ব নিলেন। তিনি অনেক দামি বটিকা ও অরিস্ট আমাকে সেবন করালেন। কিন্তু ফল না পেয়ে যখন প্রায় হাল ছেড়ে দিয়েই বসেছিলেন, তখন তারই কম্পাউন্ডার হেমেন্দ্র নাগ বই দেখে একটি পাঁচনের প্রতি তাঁর দৃষ্টি আকর্ষণ করলেন। হেমেন্দ্রদার পরামর্শটি কবিরাজ মহাশয় মেনে নিলেন। তারই নির্দেশে ‘চন্দনাদি পাঁচন’ খেলাম। এবং কী আশ্চর্য, দু’সপ্তাহেই আমার পীড়ার উপশম হয়ে গেলাে। যদিও পেটের পীড়া আমার সারা জীবনের সঙ্গী হয়ে আছে, তবুও বায়ান্ন সালে এর প্রচণ্ড দাপট থেকে কবিরাজী চন্দনাদি পাঁচনই আমাকে রক্ষা করেছিলাে। কিন্তু নষ্ট হলাে একটি বছর। তেপ্পান্ন সালের ফেব্রুয়ারিতে আশুজিয়া হাইস্কুলে ক্লাস টেনের বেঞ্চিতে আবার গিয়ে বসলাম।
তেপ্পান্ন সালের গােড়া থেকেই রাজনীতিতে অন্যরকম হাওয়া বইতে শুরু হয়েছিলাে। নেত্রকোনাে শহরের মােক্তারপাড়া মাঠে আওয়ামী মুসলিম লীগের উদ্যোগে এক বিরাট জনসভা হলাে। বিশ/পঁচিশ মাইল দূর থেকে পায়ে হেঁটে হাজার হাজার লােক সভায় উপস্থিত হয়েছিলাে। আমিও গিয়েছিলাম। সেই সভাতেই বক্তৃতা শুনলাম মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী, হােসেন শহীদ সােহরাওয়ার্দী, হাশিম উদ্দিন ও শেখ মুজিবুর রহমানের। এই প্রথম এই নেতাদের আমি দেখলাম। ভাসানী ও সােহরাওয়ার্দী পূর্ব থেকে পরিচিত নাম। কিন্তু হাশিম উদ্দিন ও মুজিবুর সম্পূর্ণ নতুন। হাশিম উদ্দিন সাহেব ময়মনসিংহের ঈশ্বরগঞ্জের সন্তান।
১৯১
আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃতী ছাত্র। মুন্সেফের চাকরি ছেড়ে রাজনীতিতে যােগ দিয়েছেন। জনসভার শ্রোতারা অবাক বিস্ময়ে তার বক্তৃতা শুনলাে। শ্রোতাদের সবচেয়ে বেশি মুগ্ধ করলেন শেখ মুজিবুর রহমান। এই তরুণের বক্তৃতায় যেনাে আগুন ঝরে। লােকের মুখে মুখে কেবল তারই কথা।
আগের মতােই যথারীতি প্রায় রােজই হেকিম ভাইয়ের সঙ্গে সাক্ষাত, আলাপ ও তর্কবিতর্ক চলতে লাগলাে। দেখলাম : তার রাজনীতি ভাবনায় বেশ পরিবর্তন ঘটে যাচ্ছে, তমদ্দুন মজলিসের প্রতি আগের সেই আকর্ষণ আর নেই।

তেপ্পান্ন সালের গণমানুষের ভাবনা
বায়ান্নর মে থেকে তেপ্পান্নর জানুয়ারি—এই কয় মাস অসুস্থতার দরুন প্রায় গৃহবন্দি হয়েই ছিলাম। নিয়মিত পত্রিকা পড়া হয়নি, দেশের কোনাে খোঁজখবরও রাখা হয়নি। কিন্তু আট/ নয় মাস পরে, তেপ্পান্নর ফেব্রুয়ারিতেই, লক্ষ করলাম মানুষের কথাবার্তার ধরনধারণ যেনাে বদলে যাচ্ছে। একান্ন সালেও যাদের মুখে হরহামেশা ‘শিশু রাষ্ট্র পাকিস্তানের লালন-পালনের কথা শােনা যেতাে, সরকারের মৃদু সমালােচনার মধ্যেও যারা পাকিস্তানের দুশমনদের চক্রান্ত দেখতাে, তাদের কণ্ঠই এখন কঠোর ও বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছে। আওয়ামী মুসলিম লীগ নামক রাজনৈতিক দলটির জন্ম যদিও ঘটেছে বছর চারেক আগেই, তবু আমাদের গ্রামাঞ্চলে তখন এ দলের কোনাে প্রকাশ্য অনুসারীর দেখা পেয়েছি বলে মনে পড়ে না। অথচ তেপ্পান্ন সালের গােড়াতেই অবস্থা অন্যরকম।
আমাদের রামপুর বাজারটির অবস্থান হচ্ছে চার সড়কের মাথায়। উত্তরে দক্ষিণে প্রলম্বিত কেন্দুয়া-নেত্রকোনা সড়ক ও পূর্ব-পশ্চিমে তেলিগাতি ময়মনসিংহ সড়কের সম্মিলন-স্থলটিতেই রামপুর বাজার। মানুষ দীর্ঘ পথও অতিক্রম করে পায়ে হেঁটে অথবা সাইকেলে। উত্তর-দক্ষিণ পূর্ব-পশ্চিম যে দিক থেকেই যে কোনাে পথিকই আসুক, তাকে কিছুক্ষণের জন্যে হলেও রামপুর বাজারে মথুর নন্দী কিংবা যােগেন্দ্র ঘােষের মুদি দোকানের সামনে বসে বিশ্রাম নিতে হয়। স্থানীয় লােকদেরও অনেকেরই অলস সময় যাপনের স্থান এ মুদি দোকান দুটি। অর্থাৎ এখানে আড্ডা জমে থাকে সারাদিন। সুন্দরী বিড়ি’তে সুখটান দিতে দিতে আর পান চিবােতে চিবােতে কতাে কথাই না বলে যায় আড্ডাধারীরা। নেত্রকোনা বা ময়মনসিংহ থেকে কোনাে লােক এলেই তার কাছে সবাই শহরের খবর জানতে চায়। শহরের খবরে রাজনীতির কথাই থাকে বেশি।
দুপুরে বসে খবরের কাগজ সামনে নিয়ে পােস্ট অফিসের সেই ঐতিহ্যবাহী আড্ডা। রামপুর বাজারের মুদি দোকানের আড্ডা আর পােস্ট অফিসের আড্ডায় পাওয়া খবরগুলাে একত্র হয়ে তৈরি হয় যে তথ্যপ্রবাহ তাই শাখা-প্রশাখা বিস্তার করে দেয় আশপাশের গ্রামগুলােতে। তখনাে ট্রানজিস্টারের প্রচলন হয়নি, টেলিভিশন তাে কল্পনার বিষয়। খবরের কাগজের প্রচারও গ্রামাঞ্চলে, সে সময়েও, একান্ত সীমিত। তাই আড্ডা থেকে প্রাপ্ত খবরই এক মুখ থেকে আরেক মুখে ছড়িয়ে ছড়িয়ে যেতাে। শুধু খবর নয়, খবরের ভাষ্যও। ভাষ্যই বরং বেশি। এবং সে ভাষ্যে থাকতাে কল্পনার অবাধ বিস্তার, ইচ্ছাপূরণের বিচিত্র উপাদান। এভাবেই
১৯২
তেপ্পান্নর গােড়াতেই দেখলাম, লােকের মুখে মুখে চালু হয়ে গেছে যে, এদেশে এখন দুটো লীগ—একটি আওয়ামী লীগ, আরেকটি পকেট লীগ। কথাটা পঞ্চাশ সাল থেকেই শােনা যাচ্ছিলাে, কিন্তু তখন তার এমন ব্যাপক প্রচার ঘটেনি। কেউ কেউ ফিসফিস করে আড়ালে আবডালে বলতাে, শিশুরাষ্ট্রের গার্জেনদের ভয়ে প্রকাশ্যে মুখ খুলতে সাহস পেতাে না। বায়ান্নর সেই রক্তাক্ত একুশে মানুষের সব ভয় ও আড়াল ঘুচিয়ে দিলাে। একুশে মানুষকে যেমন ক্ষুব্ধ করেছিলাে, তেমনি করে তুলেছিলাে সাহসী ও বেপরােয়া। লােকে প্রকাশ্যেই বলতে লাগলাে : যে মুসলিম লীগ পাকিস্তান এনেছে সে এখন কতিপয়ের পকেটে বন্দি, নিজের স্বার্থ ছাড়া এরা আর কিছু বােঝে না, সারাটা দেশকে লুটেপুটে খাচ্ছে এরা, এদেরকে গদিছাড়া করতে না পারলে দেশের আর কোনাে ভবিষ্যত নেই। কায়েদে আজম’ নেই, কায়েদে মিল্লাত’ নেই, মুসলিম লীগ আর পাকিস্তান চলে গেছে কতকগুলাে বাটপারের দখলে। এই বাটপারদের হাত থেকে দেশটাকে উদ্ধার করতে হলে পকেট লীগের বদলে নতুন লীগ চাই। সেই নতুন লীগেরই নাম আওয়ামী লীগ। আসল নাম যদিও আওয়ামী মুসলিম লীগ এবং তা থেকে মুসলিম’ শব্দটি খসেছে অনেক পরে, তবু গােড়া থেকেই মানুষের মুখে মুখে সংগঠনটির নাম আওয়ামী লীগই হয়ে গিয়েছিলাে। এই আওয়ামী লীগই, অনেক লােকের বিবেচনায়, পকেট লীগ বা মুসলিম লীগের বিকল্প হয়ে উঠেছিলাে। শিশু রাষ্ট্র পাকিস্তানে বিরােধী দল বলতে ছিলাে দুটো কংগ্রেস ও ক্যুনিস্ট। কংগ্রেসের কাজকর্ম সীমাবদ্ধ ছিলাে পূর্ববঙ্গ আইনসভা আর পাকিস্তান গণপরিষদের অভ্যন্তরে। ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত, বসন্তকুমার দাস, রাজকুমার চক্রবর্তী, শ্রীশ চট্টোপাধ্যায়, মনােরঞ্জন ধর এবং এরকম আরাে কয়েকজন কংগ্রেসীর নাম পাওয়া যেতাে খবরের কাগজের পাতায়। এরা সরকারের নানা গণবিরােধী কাজের প্রতিবাদ জানিয়ে গণপরিষদ ও আইনসভায় বক্তৃতা দিতেন। আর সরকারি দলের নেতারা এদেরকে চিহ্নিত করতেন ভারতের দালাল তথা পাকিস্তানের দুশমন রূপে। মূলত হিন্দু অধ্যুষিত ‘পাকিস্তান জাতীয় কংগ্রেস’ নামক এ সংগঠনটির পক্ষে কার্যকর বিরােধী দল রূপে জনসাধারণের মধ্যে ছড়িয়ে পড়া কোনাে মতেই সম্ভব ছিলাে না। আর কনিষ্ট? ওরা তাে খােদাদ্রোহী, ধর্মদ্রোহী! পাকিস্তানের মতাে পবিত্র ইসলামী রাষ্ট্রে ওদের ঠাই হয় কী করে? পাকিস্তান রাষ্ট্রের সকল নেতা আর পাতিনেতা সর্বক্ষণই কম্যুনিস্টদের মুণ্ডুপাত করে চলেছেন। দেশের জনগণকে সবসময় তারা কম্যুনিস্টদের সম্পর্কে হুঁশিয়ার করে দিচ্ছেন, আশেপাশে ডাইনে-বাঁয়ে সর্বত্র তারা কমুনিস্টের ভূত দেখছেন। আঠারােশাে আটচল্লিশ সালে মার্কস-এঙ্গেলস তাদের রচিত কম্যুনিস্ট ম্যানিফেস্টোতাে বলেছিলেন—ইউরােপ ভূত দেখছে, কম্যুনিজমের ভূত। তারই একশাে বছর পরে, উনিশোে আটচল্লিশ সাল থেকে, কমুনিজমের সবগুলাে ভূত যেন পাকিস্তানে এসে জড়াে হয়ে গিয়েছিলাে! তাই পাকিস্তানের কর্তাব্যক্তিরা দিনরাত বিরামহীনভাবে সেই ভূত তাড়ানাের মন্ত্র জপ করে যাচ্ছিলেন!
সকল রকম জেল-জুলুম-নির্যাতন সহ্য করেও কম্যুনিস্টরাই যে পাকিস্তানের জনগণের ন্যায্য অধিকার রক্ষার জন্যে এখানে ওখানে নানা সংগঠন গড়ে তুলছেন, কৃষক-শ্রমিকমধ্যবিত্তদের জন্যে সগ্রাম করে চলছেন, কোথাও কোথাও সে সংগ্রাম রক্তক্ষয়ী রূপ ধারণ করছে—সে সব খবর জনগণের কাছে খুব কমই পৌঁছতে পেরেছিলাে। পৌছলেও তার রূপ হয়ে গিয়েছিলাে একান্ত বিকৃত। আমাদেরই নেত্রকোনার সুসং দুর্গাপুর আর কলমাকান্দা,
১৯৩
জামালপুরের শেরপুর-নালিতাবাড়ি এবং সুনামগঞ্জের কিছু এলাকা জুড়ে যে কম্যুনিস্ট নেতা মনি সিংহের নেতৃত্বে হাজং কৃষকদের বীরত্বপূর্ণ টংক আন্দোলন চলছিলাে, তারও সঠিক খবরটি আমাদের কাছে পৌঁছায়নি। লােকমুখে কেবল শুনেছি যে, কলমাকান্দা ও সুসং দুর্গাপুরের গারাে-হাজংরা পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছে, তারা আদিস্থান’ কায়েম করতে চায়। এই আদিস্থানের যুদ্ধটি চালাচ্ছে পাকিস্তানের জানী দুশমন কম্যুনিস্টরা। মনি সিংহ হচ্ছে তাদের নেতা। অথচ কথাগুলাে ছিলাে ডাহা মিথ্যা। মনি সিংহের আন্দোলনের সঙ্গে গারােদের ‘আদিস্থানের কোনাে সম্পর্ক ছিলাে না। এমনকি মনি সিংহের নেতৃত্বে পরিচালিত কৃষক আন্দোলনে কোনাে গারােই যােগ দেয়নি। এ এন্দোলনে হাজংরা ছিলাে কুশীলব। আদিস্থানের মতাে কোনাে পৃথক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ তাদের ছিলাে না। তারা শুধু টংক নামক একটি জঘন্য সামন্ততান্ত্রিক শােষণের হাত থেকে মুক্তি চেয়েছিলাে। হাজংদের মতােই সাঁওতাল কৃষকদের বীরত্বপূর্ণ সংগ্রামের খবরও আমরা জানতে পারিনি। কৃষকনেত্রী ইলা মিত্রের ওপর সেই বর্বর নির্যাতন, রাজশাহী জেলের খাপড়া ওয়ার্ডে সাতজন কৃষক ও বামপন্থী নেতার নির্মমভাবে নিহত হওয়া, দেশের বিভিন্ন জেলখানায় কম্যুনিস্ট ও অন্যান্য বামপন্থী বন্দিদের প্রতি অমানবিক আচরণ—এ সব কোনাে খবরই সাধারণ মানুষ পায়নি। রামপুর পােস্ট অফিসে পত্রিকা পাঠের আসরে এ সব প্রসঙ্গে কোনাে কথা কোনাে দিনই শুনিনি। কম্যুনিস্টদের অভ্যন্তরীণ সব খবরাখবর—আটচল্লিশে ভারতীয় কম্যুনিস্ট পার্টির দ্বিতীয় কংগ্রেস, সে কংগ্রেসের ভেতর থেকেই পাকিস্তানের পৃথক ক্যুনিস্ট পার্টির জন্ম, রণদিভে থিসিস, বামবিচ্যুতি ও সগ্রামের হঠকারী লাইন, বামবিচ্যুতির সংশােধন—কোনাে কিছুর সম্পর্কেই আমাদের তেমন অবহিতি ছিলাে না। কম্যুনিস্ট ও বামপন্থীদের প্রত্যক্ষ ও পরােক্ষ উদ্যোগেই যে নানা দমন-পীড়নের মধ্যেও যুবলীগের মতাে সংগঠন গড়ে উঠেছিলাে—মফস্বলের সাধারণ মানুষ তাে দূরের কথা, রাজনীতি-সচেতন মানুষ ও পত্রপত্রিকার নিয়মিত পাঠকদের কাছেও সে খবর খুব একটা গুরুত্ব পায়নি। মুসলিম লীগের বিরুদ্ধে বামপন্থী চেতনাশ্রয়ী রাজনৈতিক সংগঠন হিসেবে কেবল ‘গণতন্ত্রী দলটির কথা সে সময় শুনেছি বলে আবছা আবছা মনে পড়ে। এর অনেক পরে কলেজে পড়তে যখন শহরে গিয়েছি, তখনই কেবল পাকিস্তানের প্রাথমিক দিনগুলােতে সকল প্রতিকূলতার মুখেও কম্যুনিস্টরা এদেশে কীভাবে গণসংগ্রামের ভিত গড়ে তুলেছিলাে তার কিছু কিছু খবর জানতে পেরেছি।
তেপ্পান্ন সালে গ্রামাঞ্চলের মানুষদের মধ্যে মুসলিম লীগের প্রতি যে ক্ষোভের প্রকাশ দেখেছি তা অবশ্যই কমুনিস্টদের প্রত্যক্ষ প্রেরণাজাত নয়। তবে এ-ও লক্ষ করেছি যে, কম্যুনিস্ট জুজুর ভয় দেখিয়ে তখন আর মানুষকে আগের মতাে তাতানাে যাচ্ছে না। সকলের মুখে মুখে আওয়ামী লীগের কথা। আওয়ামী লীগের ভেতরেও কম্যুনিস্টরা ঢুকে গেছে, আওয়ামী লীগের নামে কম্যুনিস্টরাই আমাদের সকলের সাধের স্বাধীন পাকিস্তানকে ধ্বংস করার ষড়যন্ত্র করছে—সরকারি লীগপন্থীদের এ ধরনের কথার জবাব খুবই কড়া ভাষায় দিতে এখন আর অনেকেই পিছপা হয় না। আমার কখনাে কখনাে মনে হয়েছে যে, অদৃশ্য ক্যুনিস্ট ভূতের বিরুদ্ধে গদা ঘুরিয়ে পাকিস্তানের লীগ শাসকরা কম্যুনিস্টদের অপকারের বদলে উপকারই করেছেন। কারণ যারাই জনগণের যে কোনাে ন্যায্য অধিকার বা প্রাপ্য আদায়ের জন্যে দাবি তুলেছে তাদেরই বলা হয়েছে কম্যুনিস্ট। শাসক শ্রেণীর অন্যায় আচরণের বিরুদ্ধে যারা কথা বলেছে তারাই হয়ে গেছে কমুনিস্ট। শাসক দলের এ রকম প্রচারের ফল দাঁড়ালাে এই: যারা
১৯৪
কম্যুনিজম বা কমুনিস্টের মাথামুণ্ডু কিছুই জানতাে না বা বুঝতাে না তাদেরও মনে হতে লাগলাে যে, ক্যুনিজম বিষয়টা খারাপ কিছু নয়, কম্যুনিস্টরাও খারাপ মানুষ নয় ।
তেপ্পান্ন সালে শুরুতেই দেখলাম: বাহাগু গ্রামের আবদুস শাহিদ আমাদের এলাকায় আওয়ামী লীগের আদর্শ ও উদ্দেশ্যের প্রচারে কোমর বেঁধে লেগে গেছে। শাহিদ ছিলাে বেখৈরহাটি হাইস্কুলে আমার সহপাঠি। ক্লাস সেভেনে পড়ার সময়েই দেখেছি যে, শাহিদ রাজনীতির ব্যাপারে ভীষণ উৎসাহী। সেই রাজনীতি পাকিস্তান ও মুসলিম লীগের। শিশুরাষ্ট্র পাকিস্তান ও তার দুশমনদের সম্পর্কে মুসলিম লীগ নেতাদের কথাগুলােই সে তােতা পাখির মতাে আওড়াতাে। হিন্দুরা পাকিস্তানের দুশমন—এই মহাসত্যটি সে সময়ে অসময়ে উচ্চকণ্ঠে ঘােষণা করতাে। হিন্দুস্থানের সঙ্গে যুদ্ধ বাধলে পাকিস্তানের বীর সৈন্যরা কীভাবে চোখের পলকে হিন্দুস্থানের রাজধানী দিল্লী দখল করে নেবে তার নিখুঁত বর্ণনা সে করে যেতে পাকভারতের মানচিত্র সামনে রেখে।
সেই শাহিদের মুখেই এখন শুনলাম যে, বদমাশ মুসলিম লিগাররা পাকিস্তানের সর্বনাশ করে চলেছে, এদের হাত থেকে যে করেই হােক দেশটাকে রক্ষা করতে হবে। সব সময় একটা কৃত্রিম ভারত-বিরােধিতার ভাব এরা জিইয়ে রাখতে চায়। উদ্দেশ্য: আসল সমস্যা থেকে জনগণের দৃষ্টি ভিন্ন দিকে ঘুরিয়ে দিয়ে নিজেদের গদিকে নিরাপদ রাখা। মুসলমানদের মনে হিন্দু বিদ্বেষকেও এরা স্থায়ী করে রাখতে চায় একই উদ্দেশ্যে। কাজেই, গদি থেকে এদের টেনে নামাতেই হবে।
শাহিদের মুখে এমন ধরনের কথা শুনে, মাত্র চার/পাঁচ বছরের ব্যবধানে তার এমন বৈপ্লবিক পরিবর্তন দেখে, আমি একেবারে অবাক হয়ে গেলাম। শাহিদই আশপাশের গ্রামের যুবকদের নিয়ে এখানে আওয়ামী লীগের সংগঠন দাঁড় করিয়ে ফেললাে। নেত্রকোনা মহকুমার আওয়ামী লীগ নেতাদের নিয়ে এসে সে বেখৈরহাটি বাজারে, রামপুর বাজারে ও তার পাশের গ্রামগুলােতে ছােট ছােট সভার অনুষ্ঠান করতে লাগলাে। সে সব সভায় বক্তারা মুসলিম লীগ সরকারের সকল দুর্নীতি ও কুকীর্তির খতিয়ান তুলে ধরলেন। পাকিস্তানের জন্মের প্রায় পর থেকেই যে দেশে দুর্ভিক্ষ বিরাজ করছে, নূরুল আমিন সরকারই যে আমাদের ষােল টাকা সের দরে লবণ কিনতে বাধ্য করেছে, আমাদের মুখের ভাষা কেড়ে নিতে চেয়েছে, মাতৃভাষার অধিকার দাবি করার অপরাধে (?) বন্দুকের গুলিতে ছাত্রদের বুক ঝাঝরা করে দিয়েছে—এ সবই ছিলাে বক্তাদের প্রচণ্ড আবেগপূর্ণ বক্তৃতার বিষয়বস্তু। বক্তৃতার প্রধান অংশ জুড়ে থাকতাে পূর্ববাংলার প্রধানমন্ত্রী নূরুল আমিন ও অন্যান্য মন্ত্রীদের দুর্নীতি ও লুটপাটের কথা। মুসলিম লীগ-বিরােধী বক্তাদের কথাগুলাে সবচেয়ে বর্ণময় হয়ে উঠতাে মন্ত্রীদের দুর্নীতির বর্ণনায় । নূরুল আমিন একটি শ্বেতপাথরের বাড়ি বানিয়েছে। বাড়ি তাে নয়, সম্রাটের প্রাসাদ! সেই প্রাসাদের বর্ণনা শুনতে শুনতে রূপকথা শুনে অভ্যস্ত গ্রামীণ শ্রোতাদের চোখ চকচক করে উঠতাে। তখনই বক্তারা কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে বলে উঠতেন, নূরুল আমিনরা এই রাজপ্রাসাদ এই আমিরি বালাখানা বানিয়েছে আমার-আপনারই গায়ের রক্তজল করা ট্যাক্সের পয়সা চুরি করে। আমাদের প্রত্যেকটি পাই-পয়সার হিসেবে তাদের দিতে হবে। আমরা তাদের এই প্রাসাদের একটি একটি করে পাথর খসিয়ে আনবাে। জনতার আদালতে তাদের বিচার হবে। … ভাইসব, কিছুদিন পরই দেশে ইলেকশন হবে, ভােট হবে। ওরাও আপনাদের কাছে ভােট চাইতে আসবে। তখন আপনারা…।’
১৯৫
ভােটের বক্তৃতা শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে শ্রোতাদের চোখমুখের রঙ অন্যরকম হয়ে যায় । ভােটের অস্ত্র দিয়েই তারা কীভাবে নূরুল আমিনদের ছারখার করে দেবে, সেই কল্পনায় তারা উত্তেজিত ও উদ্বেলিত হয়ে ওঠে। কেউ কেউ প্রাকৃত বুলি উচ্চারণ করে নূরুল আমিন আর তার মন্ত্রী মিনিস্টারসহ সকল মুসলিম লিগারের নামে খিস্তি করতে থাকে। ষােল ট্যাহা সেরের লবণ খাওয়াইয়া তারা আবার ভােট চাইতে আইবাে কোন লাজে? …. আমরার পােলাপানরে যারা গুলি কইর্যা মারছে, ভােট দেওনের বদলে তারার কপালে ঝাটা মারবাম।…’
ইলেকশানের সময় যতাে এগিয়ে আসতে থাকে উত্তেজনা তততা বাড়তে থাকে। আট বছর আগে, ছেচল্লিশ সালে, ভোেট হয়েছিলাে। সেই ভােটের ফলেই জন্ম নিয়েছিলাে পাকিস্তান। শাসকদের অনেক টালবাহানার শেষে, পাকিস্তানের জন্মের সাত বছর পরে, চুয়ান্ন সালে, আবার ভােট হতে যাচ্ছে। ছেচল্লিশের ভােটারদের মুখের জিগির ছিলাে—পাকিস্তান জিন্দাবাদ, মুসলিম লীগ জিন্দাবাদ। সেবারের জিন্দাবাদটা ছিলাে অজাত পাকিস্তানের জন্যে, পাকিস্তানের ধাত্রী শক্তি মুসলিম লীগের জন্যে। আর এবারের ভােটাররা বাস্তবের পাকিস্তানের জন্যে জিন্দাবাদ দেবে বটে, কিন্তু মুসলিম লীগের জিন্দাবাদ দেবে কয়জন?

ভােট দেবেন কিসে? নৌকা মার্কা বাক্সে
চুয়ান্ন সালের শুরুতে, তখনকার পূর্ববঙ্গ আইন সভার (লেজিসলেটিভ এ্যাসেম্বলি) নির্বাচনের দিন যতােই এগিয়ে আসতে লাগলাে ততােই স্পষ্ট হয়ে উঠলাে যে, ভাড়াটিয়া লােক ছাড়া মুসলিম লীগ জিন্দাবাদ’ বলার মতাে লােকের সংখ্যা একেবারেই কমে এসেছে। মুসলিম লীগের পয়সা খেয়ে যারা বাজারে বাজারে গিয়ে লীগের হারিকেন মার্কায় ভােট দেবার জন্য ক্যানভাস করেছে, তাদেরও অনেককেই দেখা গেছে নিজের পাড়া-পড়শির কাছে যুক্তফ্রন্টের নৌকায় ভােট দেয়ার জন্য আবেদন জানাতে। প্রথম কাজটি করেছে পয়সার খাতিরে, দ্বিতীয়টি মনের তাগিদে। এ ব্যাপারটিতে গাঁয়ের মানুষদের অভিনব রসবােধের পরিচয়ও ধরা পড়েছে। দেখা গেছে: ভােটের দিনেও গাঁয়ের অনেক ভােটার আগে গেছে মুসলিম লীগের ক্যাম্পে। সেখানে গিয়ে বেশ মৌজ করে মুসলিম লিগারদের পান-সিগারেট খেয়েছে। কেউ যদি জিজ্ঞেস করেছে যে, কী ব্যাপার, তােমাকে তাে যুক্তফ্রন্টের সমর্থক বলে জানতাম, তবে তুমি মুসলিম লীগের ক্যাম্প থেকে পান-সিগারেট খাচ্ছ কেন? তাহলে একগাল হেসে সেই ভােটারটি জবাব দিয়েছে, মুসলিম লীগের কিছু ক্ষতি করে গেলাম।
‘মুসলিম লীগের ক্ষতি করা’—বাংলাভাষায় এই কথাগুলাে একটি নতুন ইডিয়ম বা বাগধারা হিসেবে চালু হয়ে গিয়েছিলাে সেই চুয়ান্নর নির্বাচনের সময় থেকেই। এভাবেই নানা সামাজিক বা রাজনৈতিক ঘটনা ভাষায় নানা বাগধারার জন্ম দেয়। কোনাে কোনােটি ভাষার ভেতর চিরস্থায়ী শিকড় গেড়ে বসে, কোনােটির আয়ু হয় স্বল্পস্থায়ী। চুয়ান্নর নির্বাচনের সময়কার এই বাগধারাটি স্বল্পায়ুই হয়েছিলাে। এখন আর কারাে মুখে এটি শুনতে পাই না। আমার সমবয়সীদের মধ্যে কেউ কেউ হঠাৎ এটি ব্যবহার করে ফেললেও অন্যদের কাছে এর তাৎপর্য ধরা পড়ে না। অর্থাৎ সময়ের ব্যবধানে এর ভাবানুষঙ্গটি হারিয়ে গেছে। তবু আমার মনে আছে, চুয়ান্ন সনের পরেও অনেককাল ধরে আমরা নিজেদের মধ্যে এই ইডিয়মটি ব্যবহার করে পুলক অনুভব করেছি।
১৯৬
তবে চুয়ান্ন সনে এদেশের মানুষ মুসলিম লীগের কিছু ক্ষতি নয় শুধু, একেবারে ভরাডুবি ঘটিয়ে ছেড়েছিলাে। পূর্ববঙ্গ প্রাদেশিক আইন সভার নির্বাচনে যুক্তফ্রন্টেরই হয়েছিলাে জয়জয়কার। দুশাে সাঁইত্রিশটি মুসলিম আসনের মধ্যে যুক্তফ্রন্ট পেয়েছিলাে দু’শাে সাতাশটি।
ভােটের বছর খানেক আগে থেকে আমাদের এলাকার মানুষ মেতেছিলাে আওয়ামী লীগের নামে। ভােটের আগে আগে পরিচিতি পেয়ে গেলাে যুক্তফ্রন্ট’ নামটা। কারণ, আওয়ামী লীগ তখন জোটবদ্ধ হয়েছে মুসলিম লীগ-বিরােধী আরাে কয়েকটি দলের সঙ্গে। কৃষক শ্রমিক পার্টি, নেজামে ইসলাম, গণতন্ত্রী পার্টি, খিলাফতে রাব্বানী আর আওয়ামী লীগ মিলেই হলাে যুক্তফ্রন্ট। তবে, শতকরা নম্বই ভাগ মানুষের চেতনাতেই আওয়ামী লীগ বা যুক্তফ্রন্ট কোনাে নামই তেমন কোনাে তাৎপর্যবহ ছিলাে না, তারা চিনেছিলাে ‘নৌকা। তখনাে পৃথক নির্বাচন প্রথা বহাল ছিলাে। আমাদের নির্বাচনী এলাকায় (কেন্দুয়া থানায়) আইন সভার মুসলিম আসনের জন্য প্রার্থী ছিলেন তিনজন—মুসলিম লীগের আহছান আলী মােক্তার, আওয়ামী মুসলিম লীগ তথা যুক্তফ্রন্টের ইনসান ভূইয়া উকিল, আর নির্দলীয় শমসের আলী। মুসলিম লীগের হারিকেন, যুক্তফ্রন্টের নৌকা আর নির্দলীয়ের ছাতা ছিলাে নির্বাচনী প্রতীক। ভােটের দিন যতােই এগিয়ে আসে, মানুষ (অন্তত গাঁয়ের মানুষ) ততােই দল বা প্রার্থীর কথা ভুলে যেতে থাকে। প্রতীকটাই তখন তার কাছে প্রধান হয়ে ওঠে। না, ‘প্রতীক’-এর মতাে একটি গম্ভীর তৎসম শব্দও নয়। বাঙালি প্রাকৃতজন এর জন্য বৈদেশিক উৎসজাত একটি শব্দ ব্যবহার করতেই একান্ত স্বাচ্ছন্দ্য বােধ করে। সেটি হচ্ছে মার্কা। ভােট দেবেন কিসে? অমুক মার্কা বাক্সে। উনিশ শো চুয়ান্ন সন পর্যন্ত এই ছিলাে বাঙালির নির্বাচন যুদ্ধের প্রধান রণধ্বনি। সত্তর সাল থেকে প্রার্থীদের জন্য পৃথক পৃথক মার্কা দেয়া বাক্সের বদলে একই ব্যালট পেপারে সকল প্রার্থীর প্রতীক মুদ্রিত হতে থাকে, প্রত্যেক ভােটার তার নির্বাচিত প্রার্থীর প্রতীকে সিল মেরে একই বাক্সে তা ফেলে দিয়ে আসে। তখন থেকেই অমুক মার্কা বাক্সে’ কথাটা অপ্রচলিত হয়ে পড়ে। তবে ‘প্রতীক’ বা ‘মার্কা’ যে শব্দই ব্যবহার করুক, আসলে প্রাকৃতজন এই প্রতীককে ঘিরেই তার চিন্তা ও কল্পনার জাল বিস্তার করে। কখনাে কখনাে নির্বাচনের কোনাে কোনাে প্রতীক গণমনে দীর্ঘস্থায়ী সংস্কার বা কুসংস্কারেরও জন্ম দিয়ে ফেলে, এবং গণমনের এই সংস্কারটিকে ধূর্ত রাজনীতিকরা নানাভাবে তাদের নিজেদের কাজে লাগায়; জনগণকে প্রয়ােজন মতাে বিভ্রান্ত, উত্তেজিত বা মােহগ্রস্ত করে। চুয়ান্নর নির্বাচনে যুক্তফ্রন্টের সমর্থকদের তৈরি একটি ছড়া বেশ জনপ্রিয় হয়েছিলাে। ছাতা মাথে হারিকেন হাতে, ভােট দিবেন ভাই নৌকাতে। আরেকটি ছড়া-হারিকেনে তেল নাই, মুসলিম লীগের ভােট নাই। যুক্তফ্রন্টের সমর্থকরা গায়ের মানুষজনের কাছে নৌকার মাহাত্ম্য বর্ণনা করতাে নানান কায়দায়। খাল-বিলনদীনালা পরিবেষ্টিত বাংলার মানুষের যে নৌকা ছাড়া গতি নেই, আমাদের মুর্শিদি গানেও যে। আছে মুর্শিদ পার করাে আমারে’-র আকুতি, নৌকা দিয়ে নদী পারাপারের ভাবানুষঙ্গেই যে লৌকিক ধর্মানুসারী গণমানুষ পরলােক যাত্রার কথাও ভাবে—গণমনস্তত্ত্বের এইসব উপাদানকেই নিপুণ কৌশলে ব্যবহার করা হয়েছিলাে নৌকামার্কা বাক্সে ভােট আকর্ষণের জন্যে।
আবার অন্যদিকে, মুসলিম লিগাররা মানুষের মনকে নৌকার প্রতি বিরূপ ও বীতশ্রদ্ধ করে তােলার চেষ্টায় একেবারে মরীয়া হয়ে লেগে গিয়েছিলাে। তারা বারবার ভাঙা নৌকার কথা বলে বলে মানুষকে ভয় দেখাতে লাগলাে ‘আগে জানলে তাের ভাঙা নৌকায় চড়তাম না’
১৯৭
গানের এই কলিটির জুৎসই ব্যবহারের চেষ্টা চালালাে। আমাদের এলাকার জনপ্রিয় বাউল গায়ক মজিদ মিঞাকে দিয়ে নৌকা বিরােধী গান রচনা করালাে ম্যাড়া মান্দার শিমুল কাঠে, বিচিত্র এক নৌকা বটে’-এ-রকম ধূয়াযুক্ত একটি লম্বাগান গেয়ে মজিদ মিয়া বাজারে বাজারে নৌকা-বিরােধী তথা যুক্তফ্রন্ট-বিরােধী প্রচারণা চালালেন। ম্যাড়া, মান্দার আর শিমুল হলাে খুবই পচা কাঠ। এ-সকল কাঠেরই তৈরি যুক্তফ্রন্টের নৌকা। এ-নৌকার মাঝিমাল্লা হচ্ছেন মৌলানা ভাসানী, ফজলুল হক ও সােহরাওয়ার্দী। নৌকা ফুটো হয়ে গেছে, পানিতে ভরে গেছে, এর ডুবুডুবু অবস্থা। এ-নৌকায় যে-ই চড়বে, সে-ই ডুবে মরবে। মজিদ মিঞার পুরাে গানটায় ছিলাে এ-রকমের সব কথাবার্তা।
অথচ মজিদ মিঞা চল্লিশের দশক থেকেই জনপ্রিয় হয়েছিলেন তাঁর গণ-অধিকার সম্পন্ন গানগুলাের জন্যে, তার যেমন ছিলাে অসাধারণ সুরেলা কণ্ঠ, তেমনি তার গানের কথাগুলােতেও এক সময়ে গণমানুষের আশা ও আবেগ ধ্বনিত প্রতিধ্বনিত হতাে। দেহতত্ত্ব, মারফতি আর মুর্শিদি গানের গতানুগতিক ধারার ভেতরেই সমাজ-চেতনার প্রাণপ্রবাহ সঞ্চার করে দিয়ে তিনি একদিন গ্রামীণ জনগণের হৃদয় জয় করে নিয়েছিলেন, নিবারণ পণ্ডিত আর অখিল ঠাকুরের মতাে বিপ্লবী গণসংগীতকারদের পাশে তিনিও সম্মানজনক ঠাই পেয়েছিলেন, পঁয়তাল্লিশ সালের সারা ভারত কৃষক সম্মেলনে তাঁর গান দিয়ে তিনি বঞ্চিত কৃষকদেরকে অধিকার-চেতনায় উদ্বুদ্ধ করেছিলেন। আর আজ উনিশ শো চুয়ান্ন সালে, সেই মজিদ মিঞা হয়ে গেলেন গণ অধিকার-অপহরণকারী মুসলিম লীগ চক্রের ভাড়াটে গায়ক। হাটেবাজারে গিয়ে গান গেয়ে লােক জড়াে করেন তারপর মুসলিম লীগ নেতাদের শিখিয়ে দেয়া বস্তাপচা কথাগুলাে গেলাতে চেষ্টা করেন। বলেন: নৌকায় ভােট দিলে দেশটা হিন্দুদের দখলে চলে যাবে, যে সব হিন্দু জমিদার তালুকদার মহাজন হিন্দুস্থানে চলে গেছে তারা আবার এদেশে ফিরে আসবে, মুসলমান প্রজাদের সঙ্গে তারা কুকুর বেড়ালের মতাে ব্যবহার করবে, জুতা পায়ে বা ছাতা মাথায় তাদের বাড়ির সামনের রাস্তা দিয়ে মুসলমানদের হাঁটতে দেবে না, পাকিস্তান হওয়ার পর গায়ের মুসলমানরা যে জমি জিরাতের মালিক হয়েছে সবই ওই হিন্দুরা কেড়ে নেবে।
মজিদ মিঞার এ-সব কথা অধিকাংশ শ্ৰোতাই বিশ্বাস করেনি, করলে তারা এতাে বিপুল সংখ্যায় নৌকা মার্কা বাক্সে ভােট দিতাে না। কিন্তু আমি ভাবতাম: মজিদ মিঞার এমন পরিণতি কী করে হলাে? একজন গণকবি রাতারাতি গণবিরােধী হয়ে যান কী করে?
মজিদ মিঞাকে আমি সরাসরি কোনােদিন এ প্রশ্ন করিনি। করলে তিনি অবশ্যই ব্ৰিত হতেন। তবে তার সঙ্গে আলাপচারিতার বুঝে নিয়েছি যে অনেক প্রতিভাবান লােককবিই যে প্রক্রিয়ায় এস্টাব্লিশমেন্টের কাছে বিক্রিত হয়ে যান ও নিজের সৃষ্টিকে বিকৃত করে ফেলেন, মজিদ মিঞাও সেই প্রক্রিয়াটির অধীন হয়ে গেছেন। সমাজ ও রাষ্ট্রের কর্তৃত্বশীল মানুষদের অনুগ্রহে তিনি সরকারি অনুষ্ঠানে যােগ দেয়ার সুযােগ পেয়েছেন, পাকিস্তান রেডিওর সংগীতশিল্পী হয়েছেন, দু’টি পয়সার মুখ দেখেছেন। সেই অনুগ্রহের বলয় থেকে বেরিয়ে আসা। তাঁর পক্ষে ছিলাে কঠিন।
কঠিন তাে হয় অনেকের পক্ষেই। ক্ষমতাবানের অনুগ্রহের বলয় ভেঙে বেরিয়ে আসার পথে প্রধান বাধা দু’টো। লােভ আর ভয়। অনুগ্রহকে গ্রহণ করার মধ্যে প্রাপ্তির লােভ যেমন থাকে, তেমনি তাকে প্রত্যাখ্যান করলে থাকে নিগ্রহের ভয়। ক’জন মানুষ পারে লােভ আর
১৯৮
ভয়কে জয় করতে? পারে না বলেই লােককবি তথা গ্রামীণ এলিট মজিদ মিঞার মতাে শহর নগরের অনেক বাঘা বুদ্ধিজীবীও এস্টাব্লিশমেন্টের সেবাদাস হয়ে যায়।
সে যাই হােক, চুয়ান্ন সালে পূর্ববঙ্গের মুসলিম ভােটাররা মজিদ মিঞা কিংবা মুসলিম লীগের কথায় বিশ্বাস করেনি, হিন্দু জুজুর ভয়ে ভীত হয়নি, এবং মুসলিম লীগকে ভােট দেয়নি। তার মানে কিন্তু এ নয় যে সে-সময়েই দেশে সাম্প্রদায়িক রাজনীতির অবসান ঘটে গিয়েছিলাে। যুক্তফ্রন্ট যে একুশ দফা প্রণয়ন করেছিলাে তার কোনাে একটি দফাতেও। অসাম্প্রদায়িকতা বা ধর্মনিরপেক্ষতার কোনাে কথা ছিল না। বরং ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতার লালন ও পােষণেরই নিশ্চয়তা দেয়া হয়েছিলাে। নীতিটি ছিলাে—‘কোরান ও সুন্নার মৌলিক নীতির খেলাফ কোনাে আইন প্রণয়ন করা হইবে না এবং ইসলামের সাম্য ও ভ্রাতৃত্বের ভিত্তিতে নাগরিকগণের জীবন ধারণের ব্যবস্থা করা হইবে।’
অর্থাৎ ইসলাম ধর্মের অনুসারী যারা নয়, যুক্তফ্রন্টের মূলনীতিতে তাদের জন্য কিছুই বলা হয়নি। না বলা কথা থেকে বড়াে জোর এ-রকম সিদ্ধান্ত করা যেতে পারে যে, ইসলামের সাম্য ও ভ্রাতৃত্বের নামে যুক্তফ্রন্টও মুসলিম লীগের মতােই ধর্মীয় সংখ্যালঘুদেরকে পবিত্র আমানত রূপে গ্রহণ করার পক্ষে। যুক্তফ্রন্টের অন্তর্ভুক্ত সবচেয়ে বড়াে দল আওয়ামী মুসলিম লীগ’ থেকেও তখনাে মুসলিম’ শব্দটাকে বাদ দেয়া হয়নি। তাই ধরে নেয়া যেতে পারে যে, অনেক প্রগতিশীল কর্মসূচী সত্ত্বেও তখনাে এ-দলটি ছিলাে সাম্প্রদায়িকই। তা ছাড়া যুক্তফ্রন্টে ছিলাে মৌলানা আতহার আলীর ‘নেজামে ইসলাম। এ দলের ঘােষিত লক্ষই তাে ছিলাে পাকিস্তানে ইসলামি হুকুমাত কায়েম করা। যুক্তফ্রন্টের নির্বাচনী সভাগুলােতে এমন একটি গান শুনতাম, যে গানের ধ্রুবপদ ছিলাে—‘আল্লা তুমি কায়েম করাে নেজামে ইসলাম/ হায় হায় নেজামে ইসলাম।
এসব কারণেই ইসলাম বিপন্নের ধুয়া তুলে বা কম্যুনিস্ট ও হিন্দু জুজুর ভয় দেখিয়ে মুসলিম লিগাররা চুয়ান্নর নির্বাচনে ভােটারদের ভজাতে পারিনি। যুক্তফ্রন্টের একুশ দফার সব দফা নিয়ে গাঁয়ের কৃষক জনতার মাথাব্যথা ছিলাে না। তারা পাটের ন্যায্য দাম পাবে, খাজনা ট্যাক্স কমে যাবে, সার্টিফিকেট যােগে খাজনা আদায়ের জুলুম থাকবে না, এখানে সেখানে ঘুষ দিতে হবে না, লবণের দাম শস্তা হবে, শস্তায় কাপড় কেনা যাবে, ছেলে-মেয়েদের বিনা খরচে লেখাপড়া শেখাতে পারবে, লেখাপড়া শেখানাের জন্য ছেলেদের শহরে পাঠালে সেখানে গুলি খেয়ে মরতে হবে না—নৌকা মার্কা বাক্সে ভােট দেয়ার পক্ষে এ-সবই ছিলাে তাদের বিবেচনা। শিক্ষিত প্রগতি-চেতন মানুষদের দৃষ্টিতে অবিশ্যি একুশ দফার আরাে গভীরতর তাৎপর্য ধরা পড়েছিলাে। যদিও একুশ দফায় অসাম্প্রদায়িক ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রগঠনের প্রত্যয় ব্যক্ত হওয়ার বদলে ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্রনীতির কথাই বলা হয়েছে, তবু তাঁরা এতে গণতন্ত্রের চর্চা, বাংলাভাষার অধিকার আর পূর্ববঙ্গের স্বায়ত্তশাসন অর্জনের সম্ভাবনা দেখতে পেয়েছিলেন। তাঁরা এ-ও বুঝে নিয়েছিলেন যে, বাংলা ভাষার অধিকার আর পূর্ববঙ্গে স্বায়ত্তশাসন মানে বাঙালি জাতীয়তাবাদের প্রতিষ্ঠা। মানে আখেরে পাকিস্তানের মৃত্যুঘণ্টা বেজে যাওয়া। যারা সুদূর প্রসারী চিন্তা করতে পারেন তাঁরা ঠিকই বুঝতে পেরেছিলেন যে, নীতি হিসেবে একুশ দফার শীর্ষে যতাে বড়াে করেই ধর্মের কথা লেখা থাকুক না কেন, একুশ দফার বিজয় মানে আস্তে আস্তে সেকুলারিজমের পথ খুলে যাওয়া, পাকিস্তানের মৃত্যুর বীজতলা তৈরি হওয়া। তাই নিরক্ষর কৃষক-মজুরের সঙ্গে সাক্ষর মধ্যবিত্ত সমান জোরের সঙ্গেই স্লোগান তুলেছিলাে- ‘ভােট দেবেন কিসে? নৌকা মার্কা বাক্সে।
১৯৯
গাঁয়ের কৃষকদের এই নৌকা মার্কা বাক্সের প্রতি প্রচণ্ড আকর্ষণের আরাে একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান ছিলাে। সেটি হচ্ছে যুক্তফ্রন্টের অন্যতম নেতা রূপে হক সাহেবের অবস্থান। শেরে বাংলা ফজলুল হক ছেচল্লিশের নির্বাচনে পাকিস্তানি জোয়ারের মুখে মুসলিম লীগের কাছে হেরে গিয়েছিলেন। কৃষকরা সে সময়ে তাকে শুধু প্রত্যাখ্যানই করেনি, নেত্রকোনায় এসে তিনি লাঞ্ছিতও হয়েছিলেন। অথচ এর আগে তিনিই তাে ছিলেন বাংলার কৃষকের নয়নমণি। তাঁকে নিয়ে রচিত হয়েছিলাে অনেক গল্পগাথা আর কিংবদন্তী। সাতচল্লিশের পরে বেশ কয়েক বছর ধরে তার অবস্থান একান্ত গুরুত্বহীন হয়ে গেলেও, সে সময়েও, তাঁর কথা নিয়ে কিছু কিছু সত্যমিথ্যা গল্প এখানে ওখানে শােনা গেছে। এরকমই একটি গল্প ভােজনরসিক শেরে বাংলা নাকি একদিন বাজারে খাঁটি দুধ পাওয়া যায় না বলে খুব দুঃখ করছিলেন। তখন তাঁর একজন ভক্ত বললেন, “হুজুর, আপনার বাসায় তাে অনেক জায়গা আছে, কাজের লােকজনও আছে। আপনি অনায়াসে গােরু পােষার ব্যবস্থা করতে পারেন। তা হলে আর বাজারের দুধের ওপর নির্ভর করতে হবে না।’
শেরে বাংলা চোখ কপালে তুলে বললেন, ‘গরু। গরু কোথায় পাবাে। দেশের সব গরুইতাে পাকিস্তান হওয়ার পর মন্ত্রী হয়ে গেছে?’
পাকিস্তানের শাসকগােষ্ঠী সম্পর্ক এ রকম ব্যঙ্গপ্রবণ শেরে বাংলা যখন তাঁর কৃষক শ্রমিক পার্টি নিয়ে যুক্তফ্রন্টে এসে যােগ দিলেন, তখন বাংলার কৃষক তাঁর প্রতি পুরনাে দিনের সেই আবেগ ও আকর্ষণ নতুন করে অনুভব করলাে। তখন শেরে বাংলা যেখানেই সভা করতে যেতেন সেখানেই জনসমুদ্রের সৃষ্টি হতাে। তিনি যখন নৌকা মার্কায় ভােট দেয়ার কথা বলছেন, তখন বাংলার কোন্ কৃষক সে-কথা অমান্য করবে?
সম্প্রদায়-ভিত্তিক পৃথক নির্বাচনে মুসলিম লীগ বা যুক্তফ্রন্টের কোনাে প্রার্থীকেই ভােট দেয়ার অধিকার হিন্দুদের ছিলাে না। হারিকেন মার্কা বা নৌকা মার্কা কোনাে বাক্সই তাদের নয়। তবু যুক্তফ্রন্টের সভাগুলােতে হিন্দুরা দলে দলে যােগ দিতাে। হিন্দুদের সমস্যা বা সংকট সম্পর্কে এ-সব সভায় যদিও টু শব্দটিও উচ্চারণ করা হতাে না, তবু হিন্দুরা যুক্তফ্রন্টকে তাদের একান্ত আপন বলে ভাবতে লাগলাে। সভার শেষে যখন স্লোগান উঠতাে ‘ভােট দেবেন কিসে? নৌকা মার্কা বাক্সে’ তখন অন্য সবার সঙ্গে আমার বন্ধু সুশীল, গােপাল, দীনবন্ধু, ক্ষিতীশ, প্রাণেশরাও প্রবল উৎসাহে গলা মিলাতে।।

সাদা আর সবুজ নিশান, বংশদণ্ড ও পাকিস্তান জাতীয় কংগ্রেস
পাকিস্তান আমলের পূর্ববঙ্গের দুই মাতালের গল্প শুনেছিলাম। একজন হিন্দু মাতাল, অপরজন ‘মুসলমান।
কিছু পরিমাণ লাল পানি পেটে যাওয়ার পরই মুসলমান’ মাতাল একেবারে দিল দরিয়া । সে তখন প্রাণ খুলে গাইছে, চাঁদতারা সাদা আর সবুজ নিশান/ আমাদের কওমি নিশান’। গান গাইছে আর গানের ফাঁকে ফাঁকে পাকিস্তান জিন্দাবাদ’ বলে হাঁক ছাড়ছে।
কিন্তু হিন্দু মাতাল কিছুতেই তার মুসলমান ইয়ারের সঙ্গে গলা মেলাতে পারছে না। এক পর্যায়ে হঠাৎ সে হাউমাউ করে কেঁদে ওঠে। কাঁদতে কাঁদতেই বলে, তােদের জন্য পাকিস্তান হয়েছে। তােরা চাঁদতারা কওমি নিশান পেয়েছিস। কিন্তু আমরা? আমি হিন্দু। আমি কি পেয়েছি? পাকিস্তান তােদের, নিশান তােদের। আমার তাে কিছুই নেই।”
২০০
বলতে বলতে তার কান্নার বেগ আরাে বেড়ে যায়।
তার ইয়ার তাকে সান্ত্বনা দেয়। আহা-হা। এতাে দুঃখ করছিস কেন? তাের জন্যেও তাে পাকিস্তানের নিশানে ভাগ আছে। দেখছিস না ওই সাদা অংশটা? নিশানের একেবারে পয়লাই তাে সাদা। এই সাদাটাই তাে তােরা——হিন্দুরা।
এবার কান্না থামিয়ে হিন্দু মাতাল চিৎকার করে বলে, হুঃ এই সাদাটাই আমরা, হিন্দুরা। ওটা তাে রেখেছিস বাঁশ দেয়ার জন্যে। ওই সাদাটার ভেতর দিয়েই তাে আমাদের বাঁশ দেয়া হয়। ওই বাঁশের আগাতেই তাে পাকিস্তানের নিশান ওড়ে।’
মাতালের কথাকে অবশ্যই বিবেচনায় নেয়ার কথা ছিলাে না। কিন্তু ওই বিজ্ঞ মাতালটির অন্তদৃষ্টির প্রশংসা না-করার কোনাে উপায় নেই।
আসলে পাকিস্তান যে যথার্থই একটি সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র, সে কথাটি এ রাষ্ট্রের নীতি ও শাসকদের আচরণের মধ্যে দিয়ে সব সময় স্মরণ করিয়ে দেয়া হতাে। পাকিস্তান মুসলিম রাষ্ট্র, এখানে ইসলামি হুকুমাত কায়েম হবে, মুসলমানের তাহজিব-তমদ্দুন রক্ষা করাই হচ্ছে এ রাষ্ট্রের মূল দায়িত্ব। এ-সব কথারই বিরামহীন পুনরাবৃত্তি চলতাে শাসকগােষ্ঠীর কণ্ঠে ও প্রচারমাধ্যমে। সে সঙ্গে ‘পবিত্র আমানত’ অমুসলমানদের জন্য কিছু করুণাও বর্ষিত হতাে বৈকি! ওরা সংখ্যালঘু, কাজেই রাষ্ট্রীয় সুযােগ সুবিধার লঘু অংশ তারা অবশ্যই পাবে। চাকরি বাকরিতে একটা কোটা নিশ্চয়ই থাকবে তাদের জন্য! তাই বলে তারা সংখ্যাগুরুর সমান ভাগ সমান মর্যাদা পাবে? অসম্ভব। কওমি নিশানে যে-রকম সাদা একটা অংশ রাখা হয়েছে, সে রকমই হবে তাদের অংশীদারিত্ব!
এ-রকম ঘােষিত নীতির অন্তরালে অঘােষিত ছিলাে সংখ্যালঘুদের বংশদণ্ড প্রদানের যে পাকিস্তানি নীতিটি, ‘হিন্দু মাতালের কথায় সেটিরই খােলাখুলি প্রকাশ ঘটেছিলাে। মাতালেরা বােধ হয় মিথ্যা কথা বলতে পারে না।
তবে মদের মাতালরা যা-ই বলুক, দেশপ্রেমের মাতালরা এ-অবস্থাটি মেনে নিতে পারেননি। ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস’ নামক দলটিতে যে সব যথার্থ দেশপ্রেমিক ছিলেন তাঁদের অনেকেই দেশ মাতৃকার অঙ্গচ্ছেদে যন্ত্রণায় কুঁকড়ে উঠেছিলেন। এদের মধ্যে যাদের জন্মস্থান পড়ে গিয়েছিলাে পাকিস্তানের এলাকায়, তারা পাকিস্তানে অবস্থান করেই দেশপ্রেমিকের দায়িত্ব পালনে ব্রতী হওয়ার সংকল্প ঘােষণা করলেন, মায়ের অঙ্গচ্ছেদ জনিত যন্ত্রণায় নিরসনের পথ খুঁজলেন। এ-রকমই একজন দেশপ্রেমিক কুমিল্লার ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত—তার সে সময়কার মনােভাব ব্যক্ত করে লিখেছিলেন, ‘সংকল্প করিলাম, আমি বাক্যে ও কর্মে নিজেকে পাকিস্তানি মনে করিয়া, পাকিস্তানের সর্বপ্রকার উন্নয়নের চেষ্টা করিব, আর যদি জনগণের সেবা করিতে পারি, তাহাই হইবে আমার জীবনের বিশ্বমানবের সেবা। যদিও ভারত বিভাগ আমরা চাই নাই।’
ভারত বিভাগ তারা না-চাইলেও ভারত বিভক্ত হয়ে বাস্তবে যে দেশটির প্রতিষ্ঠা ঘটেছে সে-দেশটি তাে তাদেরও। সে-দেশেরই জল হাওয়ায় তারা মানুষ হয়েছেন, সে-দেশেরই প্রতি তাদের আবেগঘন ভালােবাসা। এই ভালােবাসার টানেই তারা শত লাঞ্ছনা ও নির্যাতনের মুখেও দেশ ছেড়ে চলে যাননি, নবজাত পাকিস্তান রাষ্ট্রের কল্যাণ ও স্থিতিশীলতা কামনা করেছেন মনে প্রাণে। পাকিস্তান জাতীয় কংগ্রেস’ নাম ধারণ করে তাঁরা কেন্দ্রে (অর্থাৎ গণপরিষদে) ও পূর্ববঙ্গের প্রাদেশিক আইনসভায় বিরােধী দলের আসনে বসলেন। পরিষদীয় বিরােধী দল রূপে
২০১
কংগ্রেস ছাড়া সে সময়কার পাকিস্তানে আর কেউ ছিলাে না। কাজেই, বিরােধী দলের সদস্য হিসেবে কংগ্রেসীরাই দেশের জনগণের আশা আকাঙ্ক্ষার কথা গণপরিষদে ও প্রাদেশিক আইন সভায় তুলে ধরতে লাগলেন। তাঁদের সকল প্রস্তাব ও পরামর্শই ছিলাে অত্যন্ত গঠনমূলক, তাঁদের লক্ষ্য ছিলাে পাকিস্তানকে একটি আধুনিক ও প্রগতিশীল রাষ্ট্র রূপে গড়ে তােলা। কিন্তু পাকিস্তানের শাসকদল মুসলিম লীগ ছিলাে মধ্যযুগীয় চিন্তাচেতনার ধারক, সব ধরনের প্রগতিশীলতার শত্রু। তাই স্বাভাবিক ভাবেই, তারা সব সময়ই বিরােধী দলভুক্ত কংগ্রেসীদের দেশপ্রেম সম্পর্কে কটাক্ষ করতাে, হিন্দুস্থানের দালাল আখ্যা দিয়ে তাঁদের বিরুদ্ধে নানা অবমাননাকর বক্তব্য রাখতাে। তবু, সব অপবাদ আর অবমাননা সয়ে, যথার্থ দেশপ্রেমিকের ভূমিকা পালনে তারা অটল থেকেছিলেন। একদা ভারত বিভাগের বিরােধী ছিলেন বলেই বােধ হয় তাঁদের বিরুদ্ধে যখন-তখন ভারতের দালালির অভিযােগ আনা মুসলিম লিগারদের জন্য অনেক সহজ হয়েছিলাে। কিন্তু তাঁরা প্রতিবেশী ভারতের অসাম্প্রদায়িক জাতীয়তাবাদী ও ধর্মনিরপেক্ষ শক্তির প্রতি যেমন প্রকাশ্য সমর্থন জানাতেন, তেমনি সে-দেশের প্রতিক্রিয়াশীল সাম্প্রদায়িক শক্তির দুরাচার ও মিথ্যাচারের তীব্র প্রতিবাদ জানাতেও বিন্দুমাত্র কুণ্ঠাবােধ করতেন না। এ-বিষয়ে বিশিষ্ট বামপন্থী তাত্ত্বিক ও গবেষক বদরুদ্দীন উমর অত্যন্ত মূল্যবান সাক্ষ্য দিয়েছেন। তিনি লিখেছেন,
“কংগ্রেস সদস্যেরা পূর্ববাংলার জনগণের বিরুদ্ধে ভারতীয় প্রচারণার জোর প্রতিবাদ করেন। সেটা ছিলাে ১৯৫০-এর সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার সময়।
“কলকাতার পত্রিকাগুলােতে পূর্ববাংলার পরিস্থিতির ওপর মিথ্যা সংবাদ প্রচার করার ফলে এখানে দৈনিক আজাদ’ ও ‘মর্নিং নিউজ’-এর মতাে পত্রিকা সেই মিথ্যা সংবাদকে পুঁজি করে সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা সৃষ্টি করতে থাকে। পূর্ববাংলা ব্যবস্থাপক পরিষদের বিরােধী দলের নেতা বসন্তকুমার দাস তখন তদন্ত কমিশনের সামনে সাক্ষ্য দিতে গিয়ে বলেন, পশ্চিমবঙ্গে সাম্প্রদায়িক হাঙ্গামা পূর্ববঙ্গে হাঙ্গামা বাধার অন্যতম কারণ। তিনি আরও বলেন যে, পূর্ববঙ্গ ও পশ্চিমবঙ্গের সংবাদপত্রের বিভিন্ন সংবাদ ও মন্তব্য দাঙ্গা বাধার অন্যতম কারণ।
“কিন্তু সংবাদপত্র ছাড়াও বেতারের মতাে পুরােপুরি সরকার-নিয়ন্ত্রিত ভারতীয় প্রচার মাধ্যমে চরম মিথ্যা এবং তীব্র উত্তেজনা সৃষ্টিকারী সংবাদ সে-সময় প্রচারিত হয়। এ-প্রচারণার একটি উদাহরণ ছিলাে কুমিল্লায় বঙ্কিমচন্দ্রের প্রতিকৃতি অপসারণকে কেন্দ্র করে অল ইন্ডিয়া রেডিও’র অপপ্রচার। এই অপপ্রচার চালাতে গিয়ে বলা হয় যে, চারশাে মুসলমান হল আক্রমণ করে এবং মুসলমানরা দুশাে হিন্দু পরিবারের বাড়িঘর লুটপাট ও ধ্বংস করে। এই মিথ্যা সংবাদের প্রতিবাদ করে কুমিল্লার দুই বিখ্যাত উকিল কংগ্রেস নেতা ও গণপরিষদের সদস্য কামিনী কুমার দত্ত ও ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত বিবৃতি প্রদান করেন। ১৯৫০ সালের পশ্চিম ও পূর্ববাংলায় ব্যাপক সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হয়। সারা বাংলাদেশ অর্থাৎ উভয় বাংলা জুড়ে একই সময়ে এতাে বড়াে দাঙ্গা ইতিপূর্বে অথবা ১৯৫০ এর পর আর সংঘটিত হয়নি।” (ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত স্মারকগ্রন্থ’, ঢাকা- ১৯৯৪, পৃষ্ঠা- ১৩৩)
ধীরেন্দ্রনাথ দত্তসহ পূর্ববঙ্গের সকল কংগ্রেস নেতাই সাম্প্রদায়িকতা প্রসঙ্গে স্বচ্ছ ও বাস্তব দৃষ্টির পরিচয় দিয়েছেন। পাকিস্তান ও ভারত উভয় রাষ্ট্রের সাম্প্রদায়িকতাবাদীদের বিরুদ্ধেই তাঁদের ছিলাে তীব্র ঘৃণা। স্বদেশভূমি পাকিস্তানকে সাম্প্রদায়িকতা-মুক্ত করার লক্ষ্যে তাঁরা। নিজেদের ব্যক্তিস্বার্থ যেমন অনায়াসে ত্যাগ করেছেন, তেমনি ত্যাগ করেছেন সংকীর্ণ সাম্প্রদায়িক সুবিধাবাদও।
২০২
এ-বিষয়টি একান্ত স্পষ্ট হয়ে ওঠে পৃথক নির্বাচনের বিরুদ্ধে তাদের দৃঢ় অবস্থান গ্রহণের মধ্যে।
তখনকার প্রচলিত পৃথক নির্বাচন ব্যবস্থা অমুসলমানদের জন্য নিশ্চয়ই বিশেষ সুবিধাজনক ছিলাে। কারণ, তখন জনসংখ্যার হিসেব অনুসারে পূর্ববঙ্গ প্রাদেশিক পরিষদের তিন শাে নয়টি আসেনের মধ্যে অমুসলমানদের জন্য নির্ধারিত ছিলাে বাহাত্তরটি। (বর্ণ হিন্দু৩১, তফসিলী হিন্দু-৩৭, খ্রিষ্টান-১, বৌদ্ধ-২ সর্বমােট-৭২)। অর্থাৎ এই বাহাত্তরটি আসনে বিভিন্ন গােষ্ঠীর অমুসলমানদের ছিলাে নিরঙ্কুশ অধিকার, এগুলােতে মুসলমানদের সঙ্গে তাদের কোনাে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে হবে না। তাই, সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে বলতেই হবে যে, ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ভুক্ত নেতাদের জন্য পৃথক নির্বাচন ব্যবস্থাই ছিলাে লাভজনক। অথচ, নিজেদের জন্য একান্ত লাভজনক এই ব্যবস্থাটিকে বাতিল করার জন্যই তারা সংগ্রাম করেছিলেন।
অন্যদিকে মুসলিম লীগ, জামাতে ইসলামী ও নেজামে ইসলামের মতাে ধর্মীয় সাম্প্রদায়িক দলগুলাে এই পৃথক নির্বাচন ব্যবস্থাই বহাল রাখতে চেয়েছিলাে। তারা যুক্ত নির্বাচনকে ইসলাম বিরােধী আখ্যা দিয়ে এ ব্যবস্থা প্রবর্তনের বিরুদ্ধে আদাজল খেয়ে লেগে গিয়েছিলাে। তারা বলতাে: মুসলমানরা ব্রিটিশ ভারতে পৃথক নির্বাচনের অধিকার আদায় করতে পেরেছিলাে বলেই তাদের পক্ষে মুসলিম রাষ্ট্র পাকিস্তান কায়েম করা সম্ভব হয়েছিলাে। হিন্দু কংগ্রেসীরা বরাবরই পাকিস্তানের দুশমন। পাকিস্তানকে ধ্বংস করার উদ্দেশ্যেই তারা পৃথক নির্বাচনের ব্যবস্থাটিকে বাতিল করতে চাইছে। এদের বিরুদ্ধে মুসলমানদের হুঁশিয়ার থাকতে হবে।
শুধু কট্টর ইসলামপন্থীরাই নয়, হােসেন শহীদ সােহরাওয়ার্দির মতাে পাশ্চাত্য পন্থী নেতাও প্রথমে পৃথক নির্বাচন পদ্ধতি বহাল রাখার পক্ষে ছিলেন। পরে অবিশ্যি তিনি তাঁর মত বদল করে যুক্ত নির্বাচন পদ্ধতির অনুকূলে জোরালাে যুক্তি উত্থাপন করেছিলেন। তিনি এমনও বলেছিলেন যে, পৃথক নির্বাচন ব্যবস্থা পাকিস্তানকে বিভক্ত করে ফেলবে। অবিভক্ত ভারতের মুসলমানরা পৃথক নির্বাচনের অধিকার প্রয়ােগেই ভারত বিভক্ত করে আলাদা রাষ্ট্র পাকিস্তান কায়েম করতে পেরেছিল। পাকিস্তানেও যদি হিন্দুদের জন্য পৃথক নির্বাচনের ব্যবস্থা বহাল থাকে, তবে তারাও পাকিস্তানের ভেতরেই আলাদা হিন্দুস্থানের দাবি ওঠাতে পারে। অতএব, পাকিস্তানের অস্তিত্ব রক্ষার স্বার্থেই যুক্ত নির্বাচন পদ্ধতি প্রবর্তন করা প্রয়ােজন।
পাকিস্তান কংগ্রেসের নেতারা কিন্তু এ-রকম কোনাে কূট যুক্তিজালের আশ্রয় নেননি। গােড়া থেকেই তারা সব রকম সাম্প্রদায়িক মতলববাজি থেকে দেশকে মুক্ত রাখতে চেয়েছিলেন, ব্যক্তিগত সুবিধা ও সংকীর্ণ সাম্প্রদায়িক স্বার্থের ঊর্ধ্বে উঠেই বলিষ্ঠভাবে পৃথক নির্বাচনের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছিলেন। কারণ, সাম্প্রদায়িক স্বার্থের বদলে জাতীয় স্বার্থই ছিলাে তাদের একমাত্র অন্বিষ্ট। পৃথক নির্বাচন প্রথাকে তারা প্রকৃত জাতীয় চেতনা গড়ে ওঠার পক্ষে প্রতিবন্ধক বলে মনে করেছিলেন। মুসলমান অমুসলমানের রাজনৈতিক বিভাগ ও বিভেদ যেমন তাঁরা সমর্থন করতেন না, তেমনি অমুসলমানদের জন্য বর্ণ হিন্দু, তফসিলি হিন্দু, খ্রিষ্টান ও বৌদ্ধের রাজনৈতিক বিভাজনও তাদের দৃষ্টিতে ছিলাে একান্ত অবাঞ্ছিত। তাঁরা চেয়েছিলেন: দেশের রাজনীতি থেকে সংখ্যাগুরু ও সংখ্যালঘু কথা দুটো মুছে যাক, ধর্ম হােক মানুষের ব্যক্তিগত বিশ্বাস ও আচরণের ব্যাপার, রাষ্ট্র হােক ধর্মনিরপেক্ষ ও গণতান্ত্রিক।
২০৩
বলা নিষ্প্রয়ােজন যে, তাদের চাওয়াকে পাকিস্তান রাষ্ট্রে পাওয়ায় পরিণত করা সম্ভব হয়নি। তাই উনিশ শ চুয়ান্নতেও পৃথক নির্বাচন পদ্ধতির অধীনেই নির্বাচনে যােগ দিতে হয়েছিলাে তাদের।
পাকিস্তান জাতীয় কংগ্রেসের অভ্যন্তরে নীতি ও আদর্শগত ব্যাপারে কোনাে বিরােধ ছিলাে বলে মনে হয় না। তবে রণকৌশললের ব্যাপারে কিছু মতভেদ সে সময়ে দেখা দিয়েছিলাে। মনােরঞ্জন ধর, নেলি সেনগুপ্তা, বসন্তকুমার দাস প্রমুখ নেতৃবৃন্দ ছিলেন কংগ্রেস দলের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার পক্ষে। অন্যদিকে ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত, প্রভাস লাহিড়ি, ত্রৈলােক্যনাথ চক্রবর্তী (মহারাজ) এবং এ-রকম আরাে কয়েকজন নেতা দল হিসেবে কংগ্রেসের বিলুপ্তি চেয়েছিলেন। তাঁদের মতে : পাকিস্তানের কংগ্রেস যেহেতু বাস্তবে হিন্দুদের একটি সংগঠনে পর্যবসিত হয়ে গেছে, তাই এটিকে দিয়ে বৃহত্তর জাতীয় লক্ষ্য সাধন করা যাবে না। এই যুক্তিতেই তারা কংগ্রেস থেকে বেরিয়ে এলেন। কিন্তু তখনাে এদেশে ক্যুনিস্ট পার্টি ছাড়া অন্য কোনাে সেকুলার পার্টির অস্তিত্ব ছিলােই না বলতে গেলে। আওয়ামী মুসলিম লীগ থেকে যেমন মুসলিম’ বাদ পড়েনি, শেরে বাংলার কৃষক শ্রমিক পার্টি তেমনি নামে সাম্প্রদায়িক না হলেও সুস্পষ্ট সেকুলার আদর্শ ধারণ করতে পারেনি। গণতন্ত্রী দল’ নামক রাজনৈতিক দলটিরও তেমন কোনাে সাংগঠনিক ভিত্তি ছিলাে না। তাই কংগ্রেস থেকে-বেরিয়ে-আসা হিন্দু নেতৃবৃন্দ নিজেদেরকে যুক্ত করার মতাে কোনাে অসাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক সংগঠন খুঁজে পেলেন না। নিজেরাও এ-রকম কোনাে সংগঠন গড়ে তুলতে পারলেন না। তা ছাড়া তখনকার পৃথক নির্বাচন পদ্ধতির কারণেই, কংগ্রেসের মতােই, তাদেরও কেবলমাত্র অমুসলমান আসনেই নির্বাচন প্রার্থী হতে হলাে। সংখ্যালঘু যুক্তফ্রন্ট’ নামে যে নির্বাচনী জোটের ঘােষণা তারা দিয়েছিলেন সেটি ছিলাে নিতান্তই নাম সর্বস্ব ও কাগুজে-কার্যকর অস্তিত্বহীন। তবু সে জোটের নামেই আমাদের এলাকায় (নেত্রকোনার দশটি ও কিশােরগঞ্জের আটটি থানা) নির্বাচন-প্রার্থী হলেন মহারাজ’ নামে পরিচিত বিপ্লবী নেতা ত্রৈলােক্যনাথ চক্রবর্তী।
চুয়ান্ন সনের এপ্রিলে ছিলাে আমার ম্যাট্রিক পরীক্ষা। সাধারণ নির্বাচন মার্চে। এ-সময়ে আমার নাকমুখ গুঁজে পরীক্ষার পড়া মুখস্থ করার কথা। অথচ, তখনই আমি নির্বাচনের প্রচার কাজে মেতে উঠলাম ত্রৈলােক্য মাহারাজের পক্ষে। পরীক্ষার পড়া আপাতত শিকেয় উঠলাে।

চুয়ান্নর নির্বাচন ও হিন্দু সমাজ
আমাদের নির্বাচনী এলাকায় বর্ণহিন্দু আসনে, চুয়ান্নর নির্বাচনে, প্রার্থী ছিলেন ছয়জন। কংগ্রেসের দুর্গেশ পত্ৰনবিশ, ক্যুনিস্ট পার্টির নগেন সরকার, সংখ্যালঘু যুক্তফ্রন্টের ত্রৈলােক্য মহারাজ, আর নির্দলীয় নরেশ গুপ্ত, প্যারী মােহন তালুকদার ও লক্ষ্মণ দাস। কংগ্রেসের গরুর গাড়ি, কম্যুনিস্ট পার্টির ধানের আঁটি আর সংখ্যালঘু যুক্তফ্রন্টের সাইকেল ছিলাে নির্বাচনী প্রতীক। নির্দলীয় প্রার্থীদের কার কী প্রতীক ছিলাে, আজ আর মনে নেই।
এই ছয়জন প্রার্থীর মাত্র একজনকেই আমি তখন নিজের চোখে দেখেছি। তিনি ত্রৈলােক্য নাথ চক্রবর্তী,—ত্রৈলােক্য মহারাজ নামেই যার সমধিক পরিচিতি। ত্রৈলােক্য মহারাজ রামপুর বাজারে এসে সভা করেছিলেন। তার সঙ্গে এসেছিলেন আরেকজন নেতা জ্ঞান মজুমদার। এদেরকে এখানে নিয়ে এসেছিলেন আমাদের আশুজিয়া ইউনিয়ন বাের্ডের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট
২০৪
নিশিবাবু—নিশিকান্ত ভট্টাচার্য। আমার প্রিয় শিক্ষক কুমুদ ভট্টাচার্য ও জয়চন্দ্র রায়, আর আমার পিতৃবন্ধু কামিনী কুমার চক্রবর্তী ও সুরেন্দ্র চক্রবর্তীসহ আমাদের গায়ের ও আশপাশের সকল গাঁয়ে আমার যারা গুরুজন স্থানীয়, তাঁদের প্রায় সবাই ছিলেন ত্রৈলােক্য মহারাজের সমর্থক। মহারাজকে দেখে ও তার কথা শুনে সেদিন আবেগে আপ্লুত হয়ে পড়েছিলাম । চেহারায় তার তেমন কোনাে আকর্ষণীয় বৈশিষ্ট্য কিছু নেই। অথচ, এই ছােটখাটো মানুষটিই কিনা ছিলেন ব্রিটিশ শাসকদের ত্রাস, তিরিশ বছর তারা এঁকে জেলে আটকে রেখেছিলাে। কোনাে জেল-জুলুমই যে-মানুষটিকে নতি স্বীকার করাতে পারেনি, সেই মানুষটিই এসেছেন আজ আমাদের কাছে ভােট চাইতে। এঁকে তাে আমরা কিছুতেই ফিরিয়ে দিতে পারি না। নিশিবাবু আর কুমুদ বাবুই আমাকে ত্রৈলােক্য মহারাজের পক্ষে প্রচার কাজ চালাতে উদ্বুদ্ধ করলেন। সহপাঠি বন্ধু অনঙ্গমােহন সরকারকে নিয়ে আমি সােৎসাহে সে কাজে লেগে গেলাম। এরপর সিংহের গ্রামের গােপাল দাস ও সে-গ্রামেরই কর বাড়ির আরেকজন যুবক আমাদের সঙ্গে যােগ দিয়েছিলেন। তবে, প্রচার কাজে আমার আর অনঙ্গর উৎসাহই ছিলাে সবচেয়ে বেশি। টিনের চোঙায় মুখ লাগিয়ে হাটে হাটে গিয়ে বক্তৃতা দিতাম। আমাদের আশপাশের গ্রামগুলাের বর্ণহিন্দুদের বাড়ি বাড়ি ঘুরেও প্রচার কাজ চালিয়েছি। প্রচারে ত্রৈলােক্য মহারাজের বিপ্লবী জীবনের কাহিনীর বর্ণনা যতাে না করেছি, তারচেয়ে বেশি করেছি কংগ্রেস ও কম্যুনিস্টদের নিন্দাবাদ। এ সব নিন্দাবাদের ভাষা নিশিবাবু ও কুমুদবাবুই আমাদের মুখে জুগিয়ে দিয়েছেন।
কংগ্রেস প্রার্থী দুর্গেশ পত্রবিশের পক্ষেও খুব জোর প্রচার কাজ চলেছিলাে। তিনি অবিশ্যি সশরীরে আমাদের এখানে উপস্থিত হননি। তবে তার পক্ষে রামপুর বাজারে একদিন সভা করতে এসেছিলেন নেত্রকোনা মহকুমার তৎকালীন কংগ্রেস নেতা নকুলচন্দ্র সিংহ। তার সঙ্গে ছিলাে বেশ কয়েকজন যুবক কর্মি। নকুল বাবু এ-অঞ্চলে পুরােনাে কংগ্রেস সমর্থকদের সঙ্গে যােগাযােগ করেছিলেন। কিন্তু প্রায় কারাে কাছ থেকেই তেমন সাড়া পাননি। আমাদের আশপাশের গ্রামগুলােতে ছেচল্লিশের নির্বাচনে যারা কংগ্রেসের সক্রিয় সমর্থক ছিলেন, সে-সব প্রবীণের সবাইকেই এবার ত্রৈলােক্য মহারাজকে সমর্থন জানাতে দেখলাম। পাকিস্তান জাতীয় কংগ্রেস সম্পর্কে অত্যন্ত তীব্র বিরূপতা প্রকাশ করেছিলেন আমার শ্রদ্ধেয় শিক্ষক কুমুদচন্দ্র ভট্টাচার্য। পাকিস্তানে কংগ্রেস নামে কোনাে রাজনৈতিক সংগঠনের অস্তিত্ব বজায় রাখার যে কোনাে অর্থ থাকতে পারে না, কুমুদ বাবু এ-ব্যাপারে সেদিন অনেক তীক্ষ যুক্তির অবতারণা করেন।
শ্রীযুক্ত দুর্গেশ পত্রবিশের সঙ্গে আমার প্রত্যক্ষ পরিচয় ঘটে এর অনেক পরে—ঊনষাট সালের দিকে। আমি তখন নেত্রকোনা শহরে তার প্রতিবেশী। প্রতিবেশী থেকে ক্রমে তাঁর একান্ত স্নেহভাজন। তার সঙ্গে আলাপচারিতায় বুঝতে পেরেছি যে, তিনিও আসলে পাকিস্তানে কংগ্রেস নামে কোনাে দল রাখার পক্ষপাতী ছিলেন না। তবে চুয়ান্নতে তার কংগ্রেস প্রার্থী রূপে নির্বাচনে দাঁড়াবার ব্যক্তিক পটভূমিটি তিনি আমার কাছে নানা কথা প্রসঙ্গে অনেকবারই বর্ণনা করেছেন। সেই সঙ্গে তার রাজনৈতিক ও ব্যক্তিক জীবন সম্পর্কেও অনেক কথা জানতে পেরেছি।
বাড়রি গ্রামের সম্ভ্রান্ত ব্রাহ্মণ বংশের সন্তান দুর্গেশ পত্ৰনবিশ ছাত্রজীবন থেকেই ব্রিটিশবিরােধী রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত। সঁইত্রিশ সালে তিনি নেত্রকোনা চন্দ্রনাথ হাইস্কুল থেকে ম্যাট্রিক পাস করেন। সে বছরই সারা ভারত ছাত্র ফেডারেশনের প্রতিষ্ঠা ঘটে। ছাত্র ফেডারেশনের
২০৫
রাজনীতির সূত্রেই তিনি বিপ্লবী সমাজতান্ত্রিক দলের (রিভলিউশনারি সােশ্যালিস্ট পার্টিআরএসপি) সঙ্গে সংশ্লিষ্ট হয়ে পড়েন। একটি অক্যুনিস্ট সমাজতন্ত্রী ধারা এ উপ-মহাদেশের রাজনীতিতে বিশ শতকের তৃতীয় দশক থেকেই চলে আসছিলাে। কংগ্রেস সােস্যালিস্ট পার্টি সেই ধারারই সৃষ্টি। সেই ধারাতেই আরএসপিরও জন্ম। সমাজতন্ত্রী রাজনীতির এ-ধারাটি মার্কসবাদের অনুগত হলেও সােভিয়েত ইউনিয়নে স্তালিনের নেতৃত্ব সম্পর্কে ছিলাে সমালােচনামুখর, এবং কম্যুনিস্ট ইন্টারন্যাশনালের বিরােধী। ভারতীয় কম্যুনিস্টরা যখন দ্বিতীয় মহাযুদ্ধকে ‘জনযুদ্ধ’ আখ্যা দিয়ে সে-যুদ্ধে ব্রিটিশের সহযােগিতার নীতি গ্রহণ করে, তখন কম্যুনিস্টদের সঙ্গে এ ধারার সমাজতন্ত্রীদের ব্যবধান আরাে বেড়ে যায়। সে সময়েই, বিয়াল্লিশ সালে, তীব্র ব্রিটিশ বিরােধী আন্দোলনের মুখে কলকাতায় দুর্গেশ পত্ৰনবিশ গ্রেফতার হন। পঁয়তাল্লিশ সাল পর্যন্ত জেলে আটক থাকেন, জেল থেকে পরীক্ষা দিয়েই এমএ পাস করেন এবং সে সময়েই গুরুতর রােগে আক্রান্ত হন। দীর্ঘদিন লাগে রােগমুক্ত হতে। এর পর কলকাতা থেকে নেত্রকোনায় ফিরে আসেন পঞ্চাশের দশকের গােড়ায়, এবং তখন থেকেই নেত্রকোনা শহরের স্থায়ী বাসিন্দা হয়ে যান। তেপ্পান্ন সালে তার যােগাযােগ ঘটে পাকিস্তান জাতীয় কংগ্রেসের প্রবীণ নেতা মনােরঞ্জন ধরের সঙ্গে। পাকিস্তানে কংগ্রেস দলের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার সার্থকতা সম্পর্কে মনােরঞ্জন বাবুর সঙ্গে তাঁর অনেক বাদানুবাদ হয়। তবে কংগ্রেস ছেড়ে দিয়ে যারা সংখ্যালঘু যুক্তফ্রন্ট গঠন করলেন তাদের কার্যধারাকেও তিনি মেনে নিতে পারলেন না। শেষ পর্যন্ত, বলা যেতে পারে, মনােরঞ্জন ধরের প্রণােদনাতেই চুয়ান্ন সালে দুর্গেশ পত্ৰনবিশ কংগ্রেসের টিকিটে নির্বাচন প্রার্থী হয়ে গেলেন।
কংগ্রেস প্রার্থী দুর্গেশ পত্ৰনবিশের মতাে ক্যুনিস্ট প্রার্থী নগেন সরকারও নিজে আমাদের গ্রামে বা তার আশপাশে কোথাও এসে সভা করতে পারেননি। আঠারােটি থানা নিয়ে গঠিত। বিরাট নির্বাচনী এলাকার সব জায়গায় যাওয়া কোনাে প্রার্থীর পক্ষেই তখন সম্ভব ছিলাে না। কারণ সে সময়ে নেত্রকোনা-কিশােরগঞ্জের গ্রামাঞ্চলে পথঘাট ছিলাে দুর্গম, যান চলাচলের অযােগ্য। তবু, দুর্গেশ পত্ৰনবিশ ও ত্রৈলােক্য মহারাজের তুলনায় বেশ দেরিতে নির্বাচনী প্রচারে নেমেও, অতি অল্প সময়েই কমরেড নগেন সরকারের পক্ষে প্রচার জমজমাট হয়ে উঠলাে। কী করে এমনটি সম্ভব হলাে, অনেক পরে তার হেতুটি বুঝতে পেরেছিলাম।
কম্যুনিস্ট পার্টি যদিও—চুয়ান্নর নির্বাচনের সময়েও—আনুষ্ঠানিকভাবে বেআইনি ঘােষিত হয়নি, তবু দমন-পীড়নের তীব্রতার মুখে কম্যুনিস্টরা প্রকাশ্য কাজকর্ম চালানাের সুযােগ খুব কমই পেয়েছে। তাদের পক্ষে, তাই, গােপন তৎপরতার আশ্রয় গ্রহণ করা ছাড়া উপায় ছিলাে না। তবে স্বীকার করতেই হবে, আধা গােপন ও আধা প্রকাশ্য নানা তৎপরতার মধ্যদিয়ে পূর্ববঙ্গের কম্যুনিস্টরা তাদের সাংগঠনিক কাজ অত্যন্ত নিপুণতার সঙ্গেই চালিয়ে গিয়েছিলাে। মুসলিম লীগ-বিরােধী গণতান্ত্রিক দলগুলাের মধ্যে মােটামুটি একটি প্রভাব বলয়ের সৃষ্টিও তারা করতে পেরেছিলাে। তাই দেখলাম : আমাদের এলাকার বেশ কিছু মুসলিম যুবক কমরেড নগেন সরকারের নির্বাচনী প্রচারে নেমে পড়েছে। আমার বন্ধু আওয়ামী লীগ কর্মি আবদুস শাহিদ হলাে এ প্রচারক দলের মধ্যমণি। শাহিদ এরপর ক্যুনিস্ট পার্টির সঙ্গে আরাে ঘনিষ্ঠ হয়ে ওঠে। এলাকার অনেক তরুণকে সে ক্যুনিস্ট পার্টির সঙ্গে সংযুক্ত বা কমুনিস্ট ভাবাপন্ন করে তােলে। বেখৈরহাটি হাইস্কুলের আরবি শিক্ষক মৌলবী আবদুল গনি সাহেবের পুত্র পারিবারিক প্রভাবের কারণেই ছিলাে গোঁড়া মুসলমান। অথচ এক সময় দেখা গেলাে এই মতিনকেও আবুস শাহিদ ক্যুনিস্ট পার্টির সঙ্গে ভিড়িয়ে ফেলেছে। ক্যুনিস্ট পার্টির বেআইনি
২০৬
আমলে, বিশেষ করে আইয়ুবী সামরিক শাসনের সময়ে, মতিন অনেক ঝুঁকি নিয়ে আত্মগােপনকারী কম্যুনিস্ট নেতাদের আশ্রয়ের ব্যবস্থা করেছে ও নানাভাবে তাদের কাজের সহায়তা করেছে।
আসলে, আমাদের এলাকায় কম্যুনিস্টদের গােপন ও প্রকাশ্য সাংগঠনিক তৎপরতা জোরদার হয়েছিলাে বর্ণহিন্দু আসনে ক্যুনিস্ট প্রার্থী নগেন সরকারের নির্বাচনী প্রচারের মধ্যে দিয়েই। এ নির্বাচনকে উপলক্ষ করেই মুসলিম যুবকদেরর অনেককে কম্যুনিস্ট পার্টি তার সমর্থক ও সহানুভূতিশীলদের পর্যায়ে নিয়ে আসতে পেরেছিলাে। পরে এদেরই কেউ কেউ পার্টির সদস্যপদও লাভ করে।
অর্থাৎ কম্যুনিস্টরা সংগঠন গােছানাে ও রাজনৈতিক তৎপরতা চালানাের সুযােগ হিসেবেই নির্বাচনে যােগ দিয়েছিলাে, জেতাটা তাদের মুখ্য উদ্দেশ্য ছিলাে না।
নির্বাচনে অবিশ্যি কম্যুনিস্ট নগেন সরকার জিততেও পারেননি। সর্বাধিক ভােট পেয়ে নির্বাচিত হয়েছিলেন ত্রৈলােক্য মহারাজ। ভােট প্রাপ্তির দিক দিয়ে নগেন সরকারের ছিলাে দ্বিতীয় স্থান। তবে সারা দেশে অমুসলমানদের চারটি আসনে কম্যুনিস্ট পার্টির প্রার্থী নির্বাচিত হয়েছিলেন। মুসলিম আসনে কম্যুনিস্ট পার্টি প্রকাশ্যে নিজ নামে প্রতিন্দ্বদ্বিতা করেনি। ক্যুনিস্ট পরিচয় অপ্রকাশ্য রেখে যুক্তফ্রন্টের বিভিন্ন অঙ্গ দলগুলাের মধ্য থেকে ঠিক কতাে জন কম্যুনিস্ট নির্বাচিত হতে পেরেছিলেন তার সঠিক সংখ্যাটি বলা কঠিন। তবে সে সংখ্যাটি যে একেবারে অনুল্লেখ্য ছিলাে না—এ-কথা অবশ্যই বলা যেতে পারে। মােট কথা, চুয়ান্নর নির্বাচনকে কম্যুনিস্টরা রাজনৈতিক উদ্দেশ্য হাসিলের দিক থেকে অনেক পরিমাণেই কাজে লাগাতে পেরেছিলাে।
কমরেড নগেন সরকারের পক্ষে যারা প্রচার কাজে নেমেছিলেন—কিংবা যারা তাঁকে ভােট দিয়েছিলেন—রাজনৈতিক আদর্শই তাঁদের মুখ্য বিবেচনার বিষয় ছিলাে। কিন্তু অমুসলমান আসনের অন্য প্রার্থীদের বেলায় ঠিক তেমনটি ছিলাে না।
আমার নিজের কথাই বলি। তখন একুশ বছরের নিচে কেউ ভােটার হতে পারতাে না। কাজেই আমিও ভােটার ছিলাম না। তবে ভােটের ক্যানভাসার হতে কোনাে বাধা ছিলাে না।। আমার প্রকৃত বয়স তখন আঠারাে। কবিকিশাের সুকান্তর ভাষায়-
আঠারাে বছর বয়স কী দুঃসহ
স্পর্ধায় নেয় মাথা তুলবার ঝুঁকি,
আঠারাে বছর বয়সেই অহরহ
বিরাট দুঃসাহসেরা দেয় যে উকি।।
আঠারাের স্পর্ধা নিয়েই আমি ভােটের ক্যানভাসার সেজেছিলাম। গুরুজনদের মুখে ত্রৈলােক্য মহারাজের অতীত জীবনের বর্ণময় কাহিনী শুনে তার প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিলাম। নিশি বাবু ও কুমুদ বাবুর কাছে উৎসাহ পেয়ে টিনের চোঙা হাতে নিয়ে মহারাজের জন্যে ভােট প্রার্থী হয়ে মাঠে নেমে পড়েছিলাম। এর পেছনে আমার নিজস্ব রাজনৈতিক বিচার-বিবেচনা খুব কমই কার্যকর ছিলাে।
কিন্তু প্রচারে নেমে যখন হিন্দু ভােটারদের মতিগতি ও রাজনৈতিক বাস্তবতার দিকে লক্ষ করলাম, তখন অনেক কিছুই নতুন করে ভাবতে বাধ্য হলাম। পরে দিনে দিনে সে ভাবনাই আরাে পরিণতির দিকে গিয়েছে।
২০৭
তবে হ্যা, পাকিস্তানে কংগ্রেস নামক দলটির নিরর্থকতা সম্পর্কে নিশিবাবু ও কুমুদবাবু যেসব যুক্তি দিয়েছিলেন সেগুলাে আমার মনে ধরেছিলাে। পাকিস্তান জাতীয় কংগ্রেস’ যারা গঠন করেছিলেন তাঁদের স্বদেশপ্রেম ছিলাে নিশ্চয়ই প্রশ্নাতীত। কিন্তু ব্রিটিশ ভারতের জাতীয় কংগ্রেসের উত্তরাধিকার দাবি করে পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের কাছে এদের স্বদেশপ্রেমকে বিশ্বাস্য করে তোেলা ছিলাে অসম্ভব। এমনকি প্রাক-পাকিস্তান যুগে যারা জাতীয়তাবাদী মুসলমান নামে পরিচিত ছিলেন, তাঁদের কাছেও না। জাতীয়তাবাদী মুসলমানরাই বরং, একান্ত সঙ্গত কারণেই, কংগ্রেসের ওপর সবচেয়ে বেশি বিরূপ হয়ে উঠেছিলেন। এখানকার হিন্দু কংগ্রেসীদের বৃহৎ অংশটি যখন দেশ বিভাগ স্বীকার করে নিয়ে ভারতে পাড়ি জমালেন, তখন পাকিস্তানে পড়ে থাকা জাতীয়তাবাদী মুসলমানদের একেবারে দরিয়ায় ভাসিয়ে দিয়ে গেলেন। ওরা ডুবলাে কি পাড়ে উঠলাে, তাকিয়েও দেখলেন না। এ-ব্যাপারে অন্নদাশংকর রায়ের পর্যবেক্ষণ :
… এমনি অদৃষ্টের পরিহাস যে স্বাধীনতার পুণ্যলগ্নে খান আবদুল গফফার খানকে নেকড়ের মুখে ঠেলে দেয়া হলাে। তার চেয়ে বড়াে কংগ্রেসী মুসলিম কে? তাঁর মতাে ত্যাগের তুলনাই ক’জন ভারতীয়ের?
পাকিস্তানের জন্মসময়ে অন্দদাশংকর রায় ছিলেন ময়মনসিংহের জেলা জজ। সে-সময়ের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে তিনি লিখেছেন-
“ময়মনসিংহের হিন্দুরা সভা করেন তাদের ভবিষ্যত নির্ধারণ করতে। সেই সভায় যােগ দিতে আসেন কিরণশংকর রায়। আমি তাঁকে ডিনারের নিমন্ত্রণ করি। তিনি আসেন বেশ রাত করে। সভার কাজ যেন শেষ হতে চায় না। লােকের জিজ্ঞাসার যেন অন্ত নেই। কথাবার্তা প্রসঙ্গ থেকে প্রসঙ্গান্তরে যায়। জাতীয়তাবাদী মুসলমানদের নামে তিনি জ্বলে ওঠেন। বলেন, ‘ওরা আমাদের অ্যাসেটস নন, ওরা আমাদের লায়াবিলিটি। ওদের জন্যই, আমাদের এতাে দাম দিতে হয়েছে।’
“হতভাগ্য জাতীয়তাবাদী মুসলমান! দুই পক্ষই তাদের সন্দেহ করে। তবু ভালাে যে তারা প্রাণে বেঁচে গেছেন। গৃহযুদ্ধ হলে হিন্দুরা ওদের কোপাতাে মুসলমান বলে, আর মুসলমানরা কাটতাে হিন্দুঘেঁষা বলে।” (যুক্তবঙ্গের স্মৃতি- কোলকাতা-১৩৯৯, পৃষ্ঠা-১০৮)।
গৃহযুদ্ধ না হলেও পাকিস্তানে যারা ছিলেন প্রকৃতই সেকুলার জাতীয়তাবাদী, তারা কেন কংগ্রেসের লক্কর ঝক্কর ‘গরুর গাড়িতে চড়ে বসবেন?
এ বিষয়টি বরং ত্রৈলােক্য মহারাজরাই ভালাে বুঝেছিলেন। তাঁরা কংগ্রেস ছেড়ে দিয়েছিলেন। কিন্তু তাঁরাও পাকিস্তানের রাজনীতিতে কোনাে তাৎপর্যপূর্ণ অবদান রাখতে পারলেন না, কেবল লাঞ্ছনাই সয়ে গেলেন। কম্যুনিস্ট প্রার্থী নগেন সরকারের পক্ষে নির্বাচনী প্রচার কাজে প্রগতিশীল মুসলিম তরুণরা যেমন যােগ দিয়েছিলেন, তেমন কাউকেই ত্রৈলােক্য মহারাজের সমর্থনে এগিয়ে আসতে দেখা গেলাে না। সংখ্যালঘু যুক্তফ্রন্ট করে মহারাজরা ভােটের রাজনীতিতে যাদের ওপর নির্ভর করলেন সেই হিন্দুরা—বিশেষ করে বর্ণহিন্দুদের একটি বড়াে অংশ—মানসিকভাবে হয়ে পড়েছিলাে নিতান্ত অনিকেত। মধ্যস্বত্বভােগী ‘ভদ্রলােকদের জমিদারি তালুকদারি ছিলাে পূর্ববঙ্গের গ্রামে, কিন্তু তাদের ছেলেপুলেদের অনেকেই চাকরি-বাকরি ও লেখাপড়ার সূত্রে বাস করতে কলকাতায় বা ভারতের অন্যত্র। জমিদারি উচ্ছেদ আইনে তাদের মধ্যস্বত্ব চলে যাওয়ায় পূর্ববঙ্গে আর তাদের শেকড় প্রায় রইলােই না। স্বাভাবিকভাবেই তাদের স্বদেশ-ভাবনায় রূপান্তর ঘটে গেলাে। পাকিস্তানের
২০৮
রাজনীতির ভালােমন্দ নিয়ে ধীরেন দত্ত-প্রভাস লাহিড়ী-ত্রৈলােক্য মহারাজদের খাঁটি দেশপ্রেমিক সুলভ চিন্তা তাদের ছিলাে না। এদেশের রাজনীতিতে আমাদের কী স্বার্থ’—এ-রকমই নিস্পৃহ তাদের দৃষ্টি। চুয়ান্নর ভােটেও তারা অংশ নিয়েছিলাে বটে, কিন্তু তাদের দৃষ্টিভঙ্গিটি ছিলাে একান্তই অরাজনৈতিক বা অপ-রাজনৈতিক।
বর্ণহিন্দুরা স্বভাবতই একটু নাক উঁচু প্রকৃতির। ভদ্রলােকত্বের অভিমান তাদের প্রচণ্ড। আবার, বর্ণহিন্দু নামে যারা ভােটার তালিকাভুক্ত তারাও সকলে একই বর্গের মানুষ নয়। ব্রাহ্মণ-কায়স্থ-বৈদ্যরা যেমন বর্ণহিন্দু, তেমনি নবশাখ গােষ্ঠীর লােকেরা কিংবা সাহা-মাহিষ্যনাথেরাও ভােটার তালিকায় বর্ণহিন্দু বলে স্বীকৃত। অথচ সাহা, মাহিষ্য বা নাথ জাতের মানুষগুলােকে ‘ভদ্রলােক বলে স্বীকার করতে অন্য জাতের মানুষরা রাজি নয়। ভােটের বেলাতেও এদের জাতের বিভেদ ও বিবাদই প্রধান বিবেচনা হয়ে উঠতে আমি চুয়ান্নর নির্বাচনেও দেখেছি। এ নির্বাচনে একজন সম্পূর্ণ অরাজনৈতিক ও নির্দলীয় প্রার্থী – খালিয়াজুড়ির প্যারী মােহন তালুকদার—মাহিষ্য সম্প্রদায়ভুক্ত ভােটারদের প্রায় একচেটিয়া ভােট পেলেন নিজে মাহিষ্য বলেই। একজন ধনবান সাহা মহাজন কংগ্রেসের নমিনেশনে নির্বাচন প্রার্থী হতে চেয়েছিলেন। কিন্তু সে নমিনেশন না পেয়ে কংগ্রেস প্রার্থী দুর্গেশ পত্রবিশের ঘাের শত্রু হয়ে গেলেন। তিনি সাহাদের কাছে প্রচার করলেন যে, ত্রৈলােক্য মহারাজ সাহা সম্প্রদায়ের ব্রাহ্মণ, কাজেই সাহাদের সব ভােট মহারাজকেই দেয়া উচিত। আসলে এটি ছিলাে মিথ্যা প্রচার। ত্রৈলােক্য মহারাজ ছিলেন রাঢ়ী শ্রেণীর ব্রাহ্মণ। দেখলাম: রাঢ়ী ব্রাহ্মণরা বারেন্দ্র ব্রাহ্মণ দুর্গেশ পত্রবিশের বিরুদ্ধে ও ত্রৈলােক্য মহারাজের পক্ষে প্রচার করছে নিতান্ত জাতের কথা তুলেই।
এই তাে গেলাে ‘দ্রলােক’ বর্ণহিন্দুদের চিন্তাচেতনা ও আচার আচরণের কথা। আর ‘ছােটলােক’ তফসিলি হিন্দুরা? তারাও তাদের জন্যে নির্ধারিত আসনে নিজ নিজ জাতের প্রার্থীর খোজ করতে লাগলাে। কৈবর্ত জাতের ভােটার ভােট দিলাে কৈবর্ত প্রার্থীকে, ধােপ ধােপাকে, নমশূদ্র নমশূদ্রকে। রাজনীতির কোনাে বালাই সেখানে ছিলাে না। তবে নেত্রকোনা-কিশােরগঞ্জে ধােপা ও নমশূদ্ররা সংখ্যায় অনেক বেশি লঘু হওয়াতেই বােধহয় তফসিলি হিন্দুর আসনে কৈবর্ত জাতের প্রফুল্ল কুমার সরকার জিতে গেলেন। তিনি ছিলেন কংগ্রেস মনােনীত প্রার্থী।
বিংশ শতাব্দীর মধ্যপর্বেও রাজনীতিতে জাতপাতের এমন নােংরা খেলা দেখে আঠারাে বছর বয়সী আমার মন বিক্ষোভে ভরে গেলাে। কমরেড নগেন সরকারের সমর্থকদের মধ্যেই কেবল অনেক পরিমাণে রাজনৈতিক সুস্থতা দেখতে পেয়েছিলাম। তাই, চুয়ান্নর নির্বাচনের পর থেকেই কম্যুনিস্ট রাজনীতি সম্পর্কে আমার মধ্যে ইতিবাচক ভাবনা জন্ম নিতে থাকে।

রাজনীতিকদের দেউলিয়াপনা ও বাঙালির স্বার্থহানি
চুয়ান্নর মার্চে হলাে নির্বাচন, এপ্রিলে ম্যাট্রিক পরীক্ষা। পরীক্ষা দিলাম। অঙ্কে মাত্র তেত্রিশ নম্বরের উত্তর দিতে পেরেছিলাম। যদি একটা অঙ্কও ভুল হয়ে গিয়ে থাকে, তবে পরীক্ষায় ফেল মারবাে। অঙ্কে যদি পাস করেই ফেলি, আমার ম্যাট্রিক পাস নিশ্চিত।
পাস-ফেল সম্পর্কে এ-রকম নিশ্চিত-অনিশ্চিতের দোলায় দুলতে দুলতেই পরীক্ষার কয়েকদিন পরে বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে পড়লাম। প্রথমে কিশােরগঞ্জ শহরে, পরে কিশােরগঞ্জের
২০৯
একটি গ্রামে এবং সেখান থেকে ঢাকা জেলার কালিগঞ্জ এলাকায়—মাস দেড়েক ঘুরে বেড়ালাম । ঘুরতে ঘুরতেই রাজনীতির নানান খবর পেতে লাগলাম। শেরেবাংলা পূর্ববঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী (আজাদ পত্রিকার ভাষায় ‘উজিরে আলা’) হয়েছেন। কয়েক দিন পরই তিনি কলকাতা গেলেন। কলকাতায় তাকে বিপুল সংবর্ধনা জানানাে হলাে। সংবর্ধনার উত্তরে নাকি তিনি এমন অনেক কথা বলে ফেলেন যাতে বােঝা যায় যে, পাকিস্তান রাষ্ট্রের অস্তিত্বেই তার বিশ্বাস নেই। তার মতে, পাকিস্তানের দু’টি অংশের মধ্যে শুধু ভৌগােলিক দূরত্বই বিস্তর নয়, দুয়ের সব কিছুই আলাদা। এই কৃত্রিম রাষ্ট্র থেকে তিনি বেরিয়ে আসতে চান, তিনি পূর্ববঙ্গের স্বাধীনতা চান।
এ সব কথার উল্লেখ করে নিউইয়র্ক টাইমস পত্রিকায় যে রিপাের্ট ছাপা হয়েছিলাে সেটি পাঠিয়েছিলেন ওই পত্রিকার করাচীতে নিযুক্ত সংবাদদাতা ক্যালাহান। শেরেবাংলা নিজে এই রিপাের্টের প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন, এটিকে তিনি ‘মিথ্যার বেসাতি’ বলে উল্লেখ করেছিলেন। দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলেছিলেন যে, তিনি পূর্ববঙ্গের স্বায়ত্তশাসনের দাবিই শুধু করেছেন, স্বাধীনতার কথা বলেননি।
কিন্তু পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকার মার্কিন সাংবাদিক ক্যালাহানের কথাকেই অমােঘ সত্য বলে গ্রহণ করলেন, শেরেবাংলার প্রতিবাদকে মােটেই আমল দিলেন না। এর কয়েকদিন আগে পাকিস্তানের শাসকগােষ্ঠীর উস্কানিতেই পূর্ববঙ্গে বাঙালি-বিহারি দাঙ্গা হয়ে গিয়েছিলাে। প্রথমে চন্দ্রঘােনার কাগজের মিলে, পরে আদমজীতে। দাঙ্গা বাধানাের প্রধান উদ্দেশ্য ছিলাে পূর্ববঙ্গে শেরেবাংলার নেতৃত্বাধীন যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রিসভাকে একান্ত দুর্বল ও অযােগ্য প্রমাণ করা। ক্যালাহানের রিপাের্ট তাদের মতলব উদ্ধারের সুযােগকে আরাে প্রসারিত করে দিলাে। শেরেবাংলার সরকার পাকিস্তানের জাতীয় সংহতির বিরুদ্ধে হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে, এ-সরকার কম্যুনিস্ট ও হিন্দুস্থানের দালালদের আশ্রয় দিয়েছে—এ-সব কথাই তারা মাঠে ময়দানে প্রচার করতে লাগলাে। যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রিসভা গঠনের পক্ষকালের মধ্যেই, চুয়ান্নর তিরিশ মে, তা বাতিল করে দিয়ে কেন্দ্রীয় সরকার ফরমান জারি করলাে। পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী মােহাম্মদ আলী বেতার ভাষণ দিলেন। ভাষণে শেরেবাংলাকে বিশ্বাসঘাতক’ ও ‘পাকিস্তানের প্রতি আনুগত্যহীন’ বলে চিহ্নিত করা হলাে।
জনগণের বিপুল ভােটে নির্বাচিত মুখ্যমন্ত্রী শেরবাংলা হলেন গৃহবন্দি, জেলে পােরা হলাে শেখ মুজিবসহ তিরিশজন আইনসভা সদস্য ও দেড়শাে রাজনৈতিক নেতা-কর্মিকে। পূর্ববঙ্গের অর্থাৎ পাকিস্তানের পূর্ব অংশের, গণমানুষের রায়কে এভাবে নস্যাৎ করে দিয়ে পাকিস্তান তার স্বৈরতন্ত্রী চেহারাটাকে বিশ্বের সামনে একেবারে উলঙ্গ করে তুলে ধরলাে। এবং সকলের অজান্তে এ-অঞ্চলে পাকিস্তানের মৃত্যুবীজটি পুষ্ট হয়ে ওঠার অনুকূল পরিবেশ পেয়ে গেলাে।
এরই মধ্যে কম্যুনিস্ট পার্টিকে নিষিদ্ধ ঘােষণা করা হয়েছে, আর স্বাক্ষর করা হয়েছে পাকমার্কিন সামরিক চুক্তি। এ চুক্তি স্বাক্ষরের আগেই এর তীব্র বিরােধিতা করে মওলানা ভাসানী যে বক্তৃতা দিয়েছিলেন পত্রিকায় তা পড়েছি। একদিন শাহিদের সঙ্গে দেখা হলাে। দেখলাম সে ভীষণ ক্ষুব্ধ ও উত্তেজিত। পাক-মার্কিন সামরিক চুক্তিতে সই করে পাকিস্তানের প্রতিক্রিয়াশীল সরকার যে দেশটিকে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের হাতে তুলে দিয়েছে—সেটিই তার ক্ষোভ ও উত্তেজনার হেতু। ক্ষোভ তার যুক্তফ্রন্টের অনেক নেতার ওপরও। বিশেষ করে শেরেবাংলা ফজলুল হক সম্পর্কে তাে সে রীতিমতাে কটুক্তি করে চললাে। অথচ, মাত্র এক বছর আগে
২১০
একদিন এই শাহিদই আমার সঙ্গে প্রায় এক ঘণ্টা ধরে শেরেবাংলার উচ্ছসিত গুণগান করেছিলাে। তাঁর মেধা, তাঁর প্রজ্ঞা, তাঁর রসবােধ, বাংলার কৃষকের প্রতি তার অপরিসীম দরদ—এ-সবেরই অনেক অনেক দৃষ্টান্ত শাহিদ সেদিন আমার কাছে তুলে ধরেছিলাে। আর আজ ফজলুল হকের বিশেষণ হিসেবে যে শব্দগুলাে সে প্রয়ােগ করলাে সেগুলাে হচ্ছে: দাম্ভিক, সুবিধাবাদী, মতলববাজ, ডিগবাজি-বিশারদ।
শেরেবাংলা সম্পর্কে শাহিদের এ-রকম দুই বিপরীত মেরুতে বিচরণে আমি অবাক হইনি। কারণ শেরেবাংলার রাজনৈতিক চরিত্রের অসঙ্গতি আর বৈপরীত্যের কথা তাে সবারই জানা। নন্দিত হওয়ার মতাে অনেক রাজনৈতিক ও মানবিক আচরণ যেমন তিনি করেছেন, নিন্দিত হওয়ার মতাে কাজও তিনি কম করেননি। নিন্দা আর নান্দী—সবদিক দিয়েই তিনি কিংবদন্তীর মহানায়ক।
তবে শাহিদের অভিযােগ যে কেবল শেরেবাংলার বিরুদ্ধেই ছিলাে, তা নয়। তার কথায় বােঝা যাচ্ছিলাে যে, চলতি রাজনীতির গােটা প্রক্রিয়াটির প্রতিই সে বীতশ্রদ্ধ। এই বুর্জোয়া রাজনীতি’র খাঁচা ভেঙে বেরিয়ে আসতে হবে—ঘুরিয়ে ফিরিয়ে বারবার এমন কথাই সে বলে যাচ্ছিলাে।
আসলে, চুয়ান্নর নির্বাচনের পরে, রাজনীতিকরা জনগণের প্রত্যাশাকে একেবারে চূর্ণবিচূর্ণ করে দিয়েছিলেন। একুশ দফার কথা বেমালুম ভুলে গিয়ে তারা নিজেদের ব্যক্তিস্বার্থ উদ্ধার, উপদলীয় কোন্দল আর একে অপরকে ল্যাং মারার কাজেই ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলেন। তাঁরা তাদের আত্মসম্মানও বিসর্জন দিয়ে বসেছিলেন, নিজের হাতেই তারা আপন আপন ভাবমূর্তিকে ভেঙে দিচ্ছিলেন। পূর্ববঙ্গের বাঘা বাঘা রাজনীতিকরাও পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকার ও আমলাতন্ত্রের প্রলােভন ও ষড়যন্ত্রের জালে আটকা পড়ে গেলেন। যে শেরেবাংলাকে পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকারের কর্তাব্যক্তিরা বিশ্বাসঘাতক ও দেশদ্রোহী আখ্যা দিয়েছিলাে, জনগণের দ্বারা নির্বাচিত ও বৈধভাবে গঠিত তাঁর মন্ত্রিসভাকে বরখাস্ত করেছিলাে, তাঁকে গৃহবন্দি করে রেখেছিলাে, তাদেরই অনুগ্রহভাজন হওয়ার জন্যে সেই শেরেবাংলাই কি-না রীতিমতাে আদিখ্যেতা শুরু করে দিলেন। তাদেরই প্রসাদভােজী হয়ে তিনি পাকিস্তানের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হলেন, পূর্ববঙ্গের গবর্নর হলেন, আবার তাদেরই রােষদৃষ্টিতে পড়ে পদচ্যুতও হলেন। পাকিস্তানের গবর্নর জেনারেল গােলাম মােহাম্মদ যেদিন পূর্ববঙ্গ সফরে এলেন, সেদিন বিমান বন্দরে তার গলায় মালা পরিয়ে দেয়ার জন্যে ন্যক্কারজনক প্রতিযােগিতায় লিপ্ত হলেন যুক্তফ্রন্টের দুই শরিক দল কৃষক শ্রমিক পার্টি (কেএসপি) ও আওয়ামী লীগের দুই নেতাশেরেবাংলা আবুল কাসেম ফজলুল হক ও আতাউর রহমান খান। উদ্দেশ্য: গােলাম মােহাম্মদের কৃপাদৃষ্টি লাভ করে পূর্ববঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী হওয়া।
পরবর্তীকালে যারা পঞ্চাশের দশকের রাজনৈতিক ইতিহাস নিয়ে আলােচনা করেছেন যেমন আবুল মনসুর আহমদ, কমরুদ্দীন আহমদ, মুনতাসীর মামুন—তারা কেউই পূর্ববঙ্গের এই দুই নেতার মাল্যদান-প্রতিযােগিতার নিন্দা না জানিয়ে পারেন নি। তাঁরা সবাই এ-ঘটনার মধ্যে নেতৃত্বের দেউলিয়াপনা ও জাতীয় আত্মঅবমাননাই প্রত্যক্ষ করেছেন। কমরুদ্দীন আহমদের মতে এটা শুধু নেতৃত্বের পক্ষেই অবমাননাকর ছিলাে না, সারা বাংলার আত্মসম্মানে আঘাত করেছিলেন নেতারা, শুধু মুখ্যমন্ত্রী হবার জন্যে। আবুল মনসুর আহমদ বিষয়টির বিস্তারিত আলােচনা ও বিশ্লেষণ করে লিখেছেন, ‘হক সাহেবকে কেন্দ্রীয় সরকার দেশদ্রোহী
২১১
ঘােষণা করার এবং তিনি রাজনীতি হইতে অবসর গ্রহণ করার ইচ্ছা প্রকাশ করায় আওয়ামী লীগ নেতৃত্বের মধ্যে খুব স্বাভাবিকভাবেই আশা হইয়াছিলাে যে, প্রধানমন্ত্রিত্ব তাদের হাতেই আসিবে। মন্ত্রিত্ব পুনঃপ্রতিষ্ঠার ব্যাপারে গভর্নর জেনারেল গােলাম মােহাম্মদই সর্বময় কর্তা, এটা ছিলাে জানা কথা। অতএব যুক্তফ্রন্টের পক্ষ হইতে যিনি গভর্নর জেনারেলের গলায় মালা দিবেন, কার্যত যুক্তফ্রন্টের নেতা হিসাবেই তিনি মন্ত্রিসভা গঠনে আহুত হইবেন। এই ধারণায় নেতাদের পাইয়া বসিল।’ এ বিষয়ে মুনতাসীর মামুনের বিশ্লেষণী মন্তব্য–পূর্ববঙ্গের দুইজন প্রধান রাজনৈতিক কারক আমলাতান্ত্রিক স্বৈরাচারী রাষ্ট্রের বিপরীতে সিভিল সমাজের অবমাননা স্পষ্ট করে তুলেছিলেন।
এ-রকম আত্মঅবমাননা করেও পূর্ববঙ্গের নেতাদের কেউই হালে পানি পেলেন না। তারা পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব ও আমলাতন্ত্রের খেলার পুতুল হয়ে গেলেন, তাদেরই ইঙ্গিতে তারা রাজনীতির মঞ্চে উঠে ভালুক-নাচ নাচতে লাগলেন। যুক্তফ্রন্টের দুই প্রধান শরিক দল আওয়ামী লীগ ও কেএসপিকে পরস্পরের বিরুদ্ধে লাগিয়ে দিয়ে পাকিস্তানি আমলাতন্ত্র বেশ মজার খেলা শুরু করলাে। আজ আওয়ামী লীগের আতাউর রহমান খানকে মুখ্যমন্ত্রী বানায় তাে কাল বানায় কেএসপির আবু হােসেন সরকারকে। একবার তাে আবু হােসেন সরকার মুখ্যমন্ত্রী হয়ে চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যেই পদচ্যুত হলেন, বিংশ শতাব্দীতে আরব্য রজনীর আবু হােসেনের কাল্পনিক কাহিনীর রাস্তব রূপায়ণ ঘটলাে। মানুষ বেশ মজা করে একদিনের বাদশা আবু হােসেন’-এর গল্পটি নতুনভাবে বলতে লাগলাে।
শুধু ফজলুল হক, আতাউর রহমান খান বা আবু হােসেন সরকাররাই নন, হােসেন শহিদ সােহরাওয়ার্দীর মতাে ধুরন্ধর নেতাকেও পাকিস্তানি আমলাতন্ত্র নাকে রসি লাগিয়ে ঘুরালাে। সামান্য লােভের বশে সােহরাওয়ার্দী সাহেব ওদের ফাঁদে পা দিলেন এবং বারবার হেনস্থা হলেন। একবার তিনি তাঁর এক সময়কার প্রাইভেট সেক্রেটারি বগুড়ার মােহাম্মদ আলীর অধীনে আইনমন্ত্রী হলেন এবং কিছুদিন পরেই অপসৃতও হলেন। আবার পাকিস্তানের সামরিকবেসামরিক আমলাচক্র (যারাই ছিলাে পাকিস্তানের আসল শাসক) তাঁকে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীর আসনে বসিয়ে দিয়েও নিজেদের ঘর গুছিয়ে নিয়েছিলাে। পশ্চিম পাকিস্তানের পাঠান, বেলুচি ও সিন্ধি জাতির অধিকারকে পর্যুদস্ত করে পাঞ্জাবি আমলা শাসন পাকাপােক্ত করার জন্যেই সােহরাওয়ার্দীকে দিয়ে এক ইউনিট সমর্থন করিয়ে নিলাে, পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের সুস্পষ্ট সংখ্যাগরিষ্ঠতাকে পদদলিত করে পাকিস্তানের পার্লামেন্টের আসনে সংখ্যাসাম্যের ব্যবস্থা করে নিলাে। আইনমন্ত্রী সােহরাওয়ার্দীকে দিয়েই তারা ইসলামী প্রজাতন্ত্র পাকিস্তানের সংবিধানের খসড়া তৈরি করালাে। সে সংবিধানে পূর্ববঙ্গের স্বায়ত্তশাসনের কোনাে স্বীকৃতিই রইলাে না, অথচ পরে এক সময় সােহরাওয়ার্দী সাহেবই নির্লজ্জের মতাে বলে বসলেন যে, ‘পূর্ব পাকিস্তান শতকরা আটানব্বই ভাগ স্বায়ত্তশাসন পেয়ে গেছে। বাঙালির জাতীয় স্বার্থকে এভাবেই তিনি খুঁড়িয়ে দিলেন। নিরপেক্ষ পররাষ্ট্র নীতি ছিলাে যুক্তফ্রন্টের ঘঘাষিত আদর্শ। অথচ, যুক্তফ্রন্টের বড়াে শরিক আওয়ামী লীগের নেতা সােহরাওয়ার্দী হলেন পাক-মার্কিন সামরিক চুক্তির উৎসাহী সমর্থক। জোটনিরপেক্ষতাকে তিনি ‘জিরাে প্লাস জিরাে ইজ ইকুয়াল টু জিরাে’ বলে ব্যঙ্গ করলেন। সত্যি কথা বলতে গেলে, পাকিস্তানকে মার্কিন পক্ষপুটে ঢুকিয়ে দেয়ার তিনিই হলেন প্রধান স্থপতি।।
এই সব দেখেশুনে আমার বন্ধু আবদুস শাহিদ একেবারে ক্ষেপে গেলাে। পঞ্চান্ন সাল থেকেই সে বলতে লাগলাে যে, আন্ডারগ্রাউন্ড কম্যুনিস্ট নেতাদের কথা বাদ দিলে একমাত্র
২১২
মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী ছাড়া এ দেশের আর কোনাে রাজনৈতিক নেতার ওপরই আস্থা রাখা চলে না। ভাসানীই হচ্ছেন প্রকৃত জনদরদী নেতা। তার কোনাে ব্যক্তিগত উচ্চাকাক্ষা নেই। তাঁর নেতৃত্বেই এ দেশের মজলুম জনমানুষের মুক্তি আসবে। অন্যসব নেতাই হচ্ছে মতলববাজ, ধোকাবাজ।
বাহাগুন্দ গ্রামের আবদুস শাহিদ হয়ে উঠলাে মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর অন্ধ ভক্ত।
কিন্তু হায়, তখন তাে শাহিদও জানতাে না আমিও জানতাম না যে, এই শাহিদকেই একদিন মওলানার নেতৃত্ব সম্পর্কে পুরােপুরি মােহমুক্ত হতে হবে, নানা সভায় ও বৈঠকে তার বিরুদ্ধে পাকিস্তানের স্বৈরাচারী শাসক আইয়ুব খানের দালালীর অভিযােগ উচ্চারণ করতে হবে।
তবে সে সব অবিশ্যি অনেক পরের, ষাটের দশকের মাঝামাঝি সময়ের কথা। পঞ্চান্ন সাল থেকে অন্তত দশ বছর আমাদের এলাকায় আবদুস শাহিদ প্রকাশ্যে ভাসানীপন্থী ও আড়ালে কম্যুনিস্ট রাজনীতির প্রসারে অসাধারণ অবদান রেখেছে। ভাসানীকে ছাড়লেও সে কম্যুনিস্ট রাজনীতি অবিশ্যি ছাড়েনি অনেকদিন। বাংলাদেশের কম্যুনিস্ট পার্টির সঙ্গে তার সক্রিয় সংযােগ ছিলাে সত্তরের দশকের শেষ ভাগেও।

পাকিস্তান ইসলামী জমহুরিয়াত ও সদরে রিয়াসত
ম্যাট্রিক পরীক্ষার ফল বেরােলে দেখা গেলাে যে, অঙ্কে আমি তেত্রিশ নম্বরই পেয়ে গেছি। অর্থাৎ আমি এখন ম্যাট্রিক পাস।
কিন্তু ‘ কিঅতঃপর’? অর্থাৎ এর পর কী করব?
ম্যাট্রিক পাস করে কলেজে ভর্তি হতে হবে—সােজা হিসেব তাে এই। কিন্তু আমার জীবনে সােজা হিসেব সােজাভাবে মেলে না কখনাে। অনেক কাটাকুটি অনেক পাতা নষ্ট হওয়ার পরে মেলে। জালাল খাঁর গানের ভাষায়—‘সােজা রাস্তা হয় যে বাঁকা। জীবনভাের আমাকে পা টিপে টিপে থেমে থেমে রাস্তায় চলতে হয়েছে।
ম্যাট্রিকের আগেও একাধিকবার আমার অ্যাকাডেমিক পড়ালেখা বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়েছে। পঞ্চাশের রায়টের দরুন ক্লাস এইটে উঠে আমাকে স্কুল ছেড়ে দিতে হয়েছিলাে—সে কথা আগে বলেছি। কিন্তু ওই একটি বছর কী করেছি সে কথা বলিনি। এখন বলি।
আগেই বলেছি, আমার বাবা ছিলেন একজন গোঁড়া হােমিওপ্যাথ। হােমিও শাস্ত্রের বইপত্রিকার বিপুল সংগ্রহ ছিলাে তাঁর, নিষ্ঠাবান ছাত্রের মতাে প্রায় সারা জীবন এ সব তিনি পড়েছেন। হােমিওপ্যাথির প্রতিষ্ঠাতা হানিম্যানের ‘অর্গাননকে ভিত্তি করেই তিনি গড়ে নিয়েছিলেন তাঁর জীবনদর্শন। আয়ুর্বেদীয় চিকিৎসার প্রতিও তার বিশ্বাস ছিলাে, আমাদের অসুখ-বিসুখ হলে অনেক সময়েই তিনি জগদীশ কবিরাজকে দিয়ে চিকিৎসা করাতেন। কিন্তু এলােপ্যাথিক চিকিৎসা শাস্ত্রের প্রতি ছিলেন ভয়ানক বিরূপ। এলােপ্যাথি ওষুধগুলাে তার বিবেচনায় বিষ ছাড়া আর কিছুই নয়। কিন্তু গ্রামের রােগীরা সে কথা বুঝতে যাবে কেন? তারা হচ্ছে প্রাগমাটিক। তাদের মতে এলােপ্যাথি চিকিৎসা হলাে ফৌজদারি আদালতের মতাে, আর হােমিওপ্যাথির তুলনা দেওয়ানি মােকদ্দমার সঙ্গে। চুরি-ডাকাতি-খুনের মােকদ্দমার ফৌজদারি বিচারে আসামীর জেল-জরিমানা যা হােক একটা কিছু ঝটপট হয়ে যায়। কিন্তু জমিজমার
২১৩
স্বত্বের দেওয়ানি মামলা চলে ঢিমে তেতলা লয়ে, নিষ্পত্তি হতে লাগে বহুদিন কিংবা বহু বছর। এলােপ্যাথিও ফৌজদারি বিচারের মতাে ঝটপট রােগ সারিয়ে দেয়, আর হােমিওপ্যাথি চিকিৎসার ফল পাওয়া যায় দেওয়ানি বিচারের মতােই অনেক সময়ের ব্যবধানে। তবে, গায়ের লােকের বিবেচনায়, এলােপ্যাথি যে-রােগীকে সারাতে পারে না—দীর্ঘদিনের পুরােনাে রােগে যে ভুগছে—তাকে হােমিওপ্যাথের কাছে যেতেই হবে। যার নাই অন্য গতি, সেই করে হােমিওপ্যাথি’—গ্রামে এই প্রবাদটি বেশ চালু ছিলাে। রােগী ও চিকিৎসক—উভয়ের ক্ষেত্রেই প্রযােজ্য হতাে প্রবাদটির বক্তব্য। অর্থাৎ যে রােগী কোনাে চিকিৎসাতেই আরােগ্য হয় না, সেই শেষে হােমিওপ্যাথির শরণ নেয়; আর যে লােক রােজগারের কোনাে পথই খুঁজে পায় না, সেই হয় হােমিওপ্যাথি চিকিৎসক।
আসলে সত্যিকারের চিকিৎসা পাওয়ার সুযােগ গ্রামবাসীর খুব কমই ছিলাে। পঞ্চাশের দশকের গােড়ার দিকেও কোনাে মেডিক্যাল গ্রাজুয়েট আমাদের সারা নেত্রকোনা মহকুমাতেই ছিলেন না। দু একজন এলএমএফ ডাক্তার থাকলেও তাদের ফি জোগানাের সাধ্য শতকরা নব্বই জন গ্রামবাসীরই ছিলাে না। আর কোনাে রকমে ডাক্তারের ফি-এর টাকা জোগাড় করলেও ডাক্তারের প্রেসক্রিপশন অনুযায়ী দামি ওষুধ কিনে খাওয়া ছিলাে অসম্ভব। হাটে হাটে ঘুরে যারা কুইনিন, এ্যাসপ্রাে, সােডামিন্ট বা সেন্টোনাইন ট্যাবলেট বিক্রি করতাে তারাই ছিলাে গ্রামের লােকের ডাক্তার। রােগ-বালাইয়ে ওঝা-ফকিরের পানিপড়া আর তাবিজ-কবচই ছিলাে তাদের মূল ভরসা।
এ-রকম পরিস্থিতিতে আমার বাবার হােমিওপ্যাথি চিকিৎসা ব্যবসায় চলতাে মূলত দুটো গ্রামকে কেন্দ্র করে—দলপা ও নন্দী গ্রাম। এই গ্রাম দুটোর হিন্দু অধিবাসীরা ছিলাে মােটামুটি সচ্ছল ও লেখাপড়া জানা। তারাই বাবাকে দিয়ে চিকিৎসা করাতাে, তাঁর প্রতি ছিলাে তাদের গভীর আস্থা। বাবা যা পয়সাকড়ি পেতেন তার তিন ভাগের দু’ভাগই আসতাে এই দুটো গ্রাম থেকে। কিন্তু পঞ্চাশের দাঙ্গায় দু’গায়েরই হিন্দুরা ব্যাপক সংখ্যায় দেশ ছেড়ে চলে যায়, দলপায় তাে প্রায় একঘর হিন্দুও আর অবশিষ্ট থাকে না। যারা দেশত্যাগ করতে পারেনি, কিংবা একবার দেশত্যাগী হয়েও পরে ফিরে এসেছে, তারাও গ্রাম ছেড়ে শহরে গিয়ে আশ্রয় নেয়। আমার বাবার রােজগারের মূল উৎসটাই বলতে গেলে বন্ধ হয়ে যায়। অভাব-অনটনের আবর্তে পড়ে খাবি খেতে থাকে আমাদের পরিবারটি।
পঞ্চাশ সালের দাঙ্গার শুরুতেই স্কুলে যাওয়া বন্ধ করলেও দেশ যখন ছাড়তে পারলাম না, কিংবা অনেকের মতাে শহরবাসীও হতে পারলাম না, তখন গ্রামে থেকেই অভাব-অনটনের বিরুদ্ধে সংগ্রামে নামতে হলাে আমাকে। সেই চৌদ্দ বছর বয়সে আমি দোকানদারি করতে শুরু করে দিলাম। প্রথমে ডালের ব্যবসা। এরপর কিছুদিন করলাম ম্যাচ-বিড়ি ও বিস্কুটের দোকানদারি। রামপুর বাজারে চৌরাস্তার মােড়ে চাটাই পেতে বসেই আমার দোকানদারি চলতাে। ব্যবসায়ে আমার নিষ্ঠা যে খুব প্রবল ছিলাে, তা নয়। নিতান্তই দায়ে ঠেকে এ কাজ করা। দোকানে বসে বইপত্র পড়ার দিকেই বরং ছিলাে আমার বেশি মনােযােগ। তবু সেই দুর্দিনে বাবার সংসারের চাকায় কিছুটা হলেও যে তেল জোগাতে পেরেছিলাম, সেটা ভেবে আমি আজও আত্মপ্রসাদ লাভ করি।
ম্যাট্রিক পাস করার পরও এক বছর রােজগারের ধান্ধায় ঘুরলাম। এবার আর দোকানদারি নয়, চাকরির অনুসন্ধান। প্রাইমারি স্কুলের মাস্টারি, সাব-রেজিস্টারি অফিসের কেরানি এবং এ
২১৪
রকম আরাে কিছু চাকরির জন্যে ঘােরাঘুরি ও চেষ্টা-তদবির করে ব্যর্থতাই সার হলাে। তবে ছাত্র পড়িয়ে সামান্য কিছু পয়সা জোগাড় করে পরের বছর, পঞ্চান্ন সালে, নেত্রকোনা কলেজে ভর্তি হয়ে পড়লাম। শাহিদ এর আগের বছরেই ম্যাট্রিক পাস করে আইএ ক্লাসে কিছুদিন পড়েছিলাে কিন্তু রাজনীতির প্রবল নেশায় অচিরেই সে কলেজ ছাড়লাে এবং তার বইগুলাে আমাকে দান করে দিলাে।
কলেজে ভর্তি হয়েও নিরুপদ্রব স্বস্তিতে আমি লেখাপড়া করতে পারিনি। অর্থাভাবই তার মূল কারণ। কলেজে অবিশ্যি আমি হাফ ফ্রি পেয়েছিলাম এবং শাহিদের কল্যাণে পাঠ্যবইও আমাকে কিনতে হয়নি। তবু খাওয়াসহ অন্যান্য খরচ মেটানাের জন্যে ট্যুইশনি করা ছাড়া উপায় ছিলাে না, আর ভালাে টুইশনি পাওয়া ছিলাে খুবই কঠিন। তবে আমার বন্ধুরা আমাকে নানাভাবে সাহায্য করেছে। বিশেষ করে, সহপাঠি মিরাজের সহায়তা না পেলে নেত্রকোনা শহরে টিকে থাকাই আমার পক্ষে কঠিন হতাে।
নেত্রকোনা কলেজে তখন কেবল ইন্টারমিডিয়েট ক্লাস খােলা হয়েছে। ছাত্রসংখ্যা একান্ত সীমিত। ফার্স্ট ইয়ার সেকেন্ড ইয়ার মিলিয়ে দেড়শাের বেশি নয়। আটজন অধ্যাপক কিন্তু সব মিলিয়ে যেনাে একটি ছােট্ট সুখী পরিবার।
কলেজের ছাত্র সংসদে আমি সাহিত্য সম্পাদক নির্বাচিত হই। সংসদের পক্ষ থেকে সারা বছর অনেক বিতর্ক সভা ও সাহিত্য অনুষ্ঠানের আয়ােজন করেছি। প্রতিটি অনুষ্ঠানেই ছাত্ররা বিপুল উৎসাহের সঙ্গে যােগ দিতাে। অধ্যাপকবৃন্দ এ-সবের প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধান করতেন। এবং আমাদের সঙ্গেই বিতর্ক প্রতিযােগিতায় ও আলােচনায় অংশগ্রহণ করতেন। অধ্যাপকদের আমরা যথাযথ শ্রদ্ধা করছি, কিন্তু ছাত্র-শিক্ষকের মধ্যে অনাকাক্ষিত দূরত্বের সৃষ্টি হয়নি। অধ্যাপকদের প্রায় সবাই ছিলেন তরুণ। আনুষ্ঠানিক বিতর্কের বাইরেও তাঁদের সঙ্গে আমরা নানা বিষয়ে খােলাখুলি আলােচনা ও তকবিতর্ক করতাম। রাজনীতি নিয়েও উত্তপ্ত আলােচনা হতাে। সে আলােচনায় আমরা নানাভাবে উপকৃত হয়েছি।
চল্লিশের দশক থেকেই নেত্রকোনা ছিলাে বামপন্থী রাজনীতির ঘাটি। কলেজেও বামপন্থী ছাত্রদেরই প্রতাপ। আমি যখন ফার্স্ট ইয়ারের ছাত্র তখন সেকেন্ড ইয়ারে পড়তেন আবু তাহের, ফুলে হােসেন, আবদুল কুদ্স এবং এরকম আরাে কয়েকজন তুখােড় ছাত্রনেতা। তখনাে নেত্রকোনায় বামপন্থী ছাত্রসংগঠন ছাত্র ইউনিয়ন গড়ে ওঠেনি, প্রগতিশীল সব ছাত্রই তখন ছাত্রলীগে। আমিও ছাত্রলীগে ভিড়ে গেলাম, হয়ে গেলাম নেত্রকোনা মহকুমা ছাত্রলীগের অন্যতম সহসভাপতি। সে-সময়েই পরিচয় হলাে কাজী আবদুল বারির সঙ্গে। তিনি তখন ময়মনসিংহ জেলা ছাত্রলীগের নেতা। সাংগঠনিক সফরে নেত্রকোনা গিয়েছিলেন। তাঁর বক্তৃতা শুনে অবাক হয়ে গিয়েছিলাম। মনে হলাে : দেশি-বিদেশি রাজনীতির সবকিছুই যেনাে তার নখদর্পণে। আন্ডারগ্রাউন্ড কম্যুনিস্ট পার্টির সঙ্গে যে কাজী বারির যােগ আছে সে-কথাও আমার কানে কে যেনাে ফিসফিস করে বলে গেলাে।
কম্যুনিস্ট পার্টির প্রকাশ্য কাজকর্ম নিষিদ্ধ থাকলেও পঞ্চান্ন ছাপ্পান্ন সালে নেত্রকোনার কম্যুনিস্টরা ছাত্র রাজনীতিতে ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে ছিলাে অত্যন্ত সক্রিয়। নেত্রকোনার সত্যকিরণ আদিত্য তখন বামপন্থী যুব সংগঠন পূর্ব পাকিস্তান যুবলীগের প্রাদেশিক পর্যায়ের নেতা। থাকেন নেত্রকোনাতেই। তাকে কেন্দ্র করে নেত্রকোনা শহরের সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড তখন জমজমাট। রবীন্দ্র-নজরুল জয়ন্তীসহ নানা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান সত্যদার সৃজনশীল হাতের
২১৫
ছোঁয়ায় প্রাণবন্ত হয়ে উঠতাে। সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের মধ্যদিয়েই নেত্রকোনার ছাত্র-যুবকরা প্রগতিশীল ও বামপন্থী চিন্তা চেতনায় অভ্যস্ত হয়ে ওঠে।
ছাপ্পান্ন সালের মার্চে গণপরিষদে পাকিস্তানের সংবিধান গৃহীত হলাে। আনুষ্ঠানিকভাবেই পাকিস্তান হয়ে গেলাে ইসলামী প্রজাতন্ত্র। (আজাদ পত্রিকায় লেখা হলাে ইসলামী জমহুরিয়াত)। ইসলামী প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রপ্রধান বা সদরে রিয়াসত’কে অবশ্যই মুসলমান হতে হবে, অমুসলমানের জন্যে এ পদটি নিষিদ্ধ—এ-কথা সংবিধানেই স্পষ্ট ভাষায় লিখে দেয়া হলাে। এমনিতেই পাকিস্তানের কোনাে অমুসলমান অধিবাসী রাষ্ট্রপ্রধান হওয়ার কথা চিন্তাও করতাে না নিশ্চয়। তবু, সাংবিধানিকভাবে এ-রকম ঘােষণা দিয়ে স্পষ্ট করে জানিয়ে দেয়া হলাে যে, এ রাষ্ট্রে তারা দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক।
নেত্রকোনার দত্ত হাইস্কুলের শিক্ষক হরিশঙ্কর চৌধুরী ছিলেন অত্যন্ত সজ্জন। শুনেছিলাম যে, বেআইনি ঘােষিত ক্যুনিস্ট পার্টির সঙ্গে তাঁরও যােগাযােগ আছে। তাঁর বাসায় প্রগতিশীল ছাত্র যুবকদের সব সময় আনাগােনা। রাজনীতি-অর্থনীতির নানা বিষয় নিয়ে তিনি অত্যন্ত ধীরস্থিরভাবে আলােচনা করেন ও অনুচ্চকণ্ঠে কথা বলেন। সেদিন কিন্তু এই একান্ত শান্ত মানুষটিকে ভীষণ উত্তেজিত হতে দেখলাম। অস্বাভাবিক উচ্চস্বরে তিনি বলছেন, দেখাে, আজকে তাে আমাকে ভাবতে হচ্ছে যে, আমি একজন হিন্দু। আমার জন্মের জন্যেই আমি অপরাধী। এ দেশের যে কোনাে একজন মুসলমানের চেয়ে আমি নিকৃষ্ট, কারণ আমি মুসলমান নই। আর সে আমার চেয়ে শ্রেষ্ঠ, কারণ সে মুসলমান।……এটি কি কোনাে সভ্য রাষ্ট্রের কনস্টিটিউশন হতে পারে? আমরা কি একটা সভ্য রাষ্ট্রের অধিবাসী?
ছাপ্পান্নতে ইসলামী প্রজাতন্ত্রের সংবিধান ঘােষিত হওয়ার পর হিন্দুদের মধ্যে আবার নতুন করে অস্থিরতা দেখা দিলাে। একেবারে খুব ব্যাপক দেশত্যাগ শুরু হলাে না ঠিকই, তবে যারা হয়তাে একটু গােছগাছ করে নিয়ে দু’চার বছর পর দেশ ছাড়তাে, তারা এখনই তল্পিতল্পা গুটোতে শুরু করে দিলাে।
একদিন বারহাট্টা রােডে নবীন ফার্মেসি’তে বসে হরিশঙ্কর বাবুর সঙ্গে কথা বলছিলাম। এ সময়ে এজন ব্যবসায়ী দ্রলােক সেখানে এলেন। হরিশঙ্কর বাবুকে দেখেই তিনি বলতে লাগলেন, এই যে মাস্টার মশাই, শুনলাম আপনি নাকি ইন্ডিয়া চলে যাচ্ছেন? দু’দিন পর পর কী যে হুজুগ আপনারা তােলেন! এই দেশে কে আপনাদের কী ক্ষতিটা করলাে? নিজের দেশ ছেড়ে কেন যে আপনারা চলে যান!……
যতােদূর জানি, হরিশঙ্কর বাবু ইন্ডিয়া যাবার কথা মােটেই ভাবেননি। অথচ, দেখলাম, ওই ব্যবসায়ী দ্রলােকের কথা শেষ না হতেই তিনি বলে উঠলেন, হ্যা, যাবােই তাে। আপনারা যে সুখে রেখেছেন তাতে দেশ না ছেড়ে কি করি!
ভদ্রলােক থতমত খেয়ে গেলেন। আমতা আমতা করে কী যেন বলতে চাইলেন।
হরিশঙ্কর বাবু তাকে থামিয়ে দিয়ে বললেন, “দেখুন, আপনার ছেলে আর আমার ছেলে একই ক্লাসে পড়ে। পরীক্ষায় ‘তােমার জীবনের লক্ষ্য সম্বন্ধে রচনা লিখতে দেয়া হলাে। আপনার ছেলে হয়তাে লিখলাে যে, তার জীবনের লক্ষ্য দেশের রাষ্ট্রপ্রধান হওয়া—অর্থাৎ পাকিস্তান ইসলামী জমহুরিয়াতের সদরে রিয়াসত হওয়া। এর জন্যে সে ঠিকই নম্বর পাবে। কিন্তু আমার ছেলে তাে এ লক্ষ্যের কথা লিখতেই পারবে না। লিখলে নম্বর পাওয়া তাে দূরের কথা, রাষ্ট্রদ্রোহ মামলার আসামীও হতে পারে কিংবা এই নাবালকে ছেলের বাপ হিসেবে
২১৬
আমাকেও আসামী করা হতে পারে। কাজেই, এ-রকম ঘটনা ঘটার আগেই তাে আমার ছেলেকে নিয়ে দেশ ছেড়ে চলে যাওয়া উচিত।’
ব্যবসায়ী ভদ্রলােকটি বুদ্ধিমান ছিলেন। তাই আর কথা বাড়ালেন না।

দুঃসহ যাতনা ও জঙ্গী দৌরাত্ম্য
আমাদের দেশটি তাে দুর্ভিক্ষেরই দেশ। প্রতি বছরই এখানে দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়। ফসল ওঠার আগের দেড়/দুই মাস তাে বাংলার সব গ্রামের প্রান্তিক কৃষকরা আধপেটা খেয়ে থাকতে বাধ্য হয়। বাংলা ব্যাকরণে দুর্ভিক্ষকে বলা হয়েছে অব্যয়ীভাব সমাস, তার ব্যাসবাক্য হলাে ‘ভিক্ষার অভাব। সত্যি সত্যিই আশ্বিন-কার্তিক মাসে এ দেশের গাঁও গেরামে অনিবার্যভাবেই ভিক্ষার অভাব দেখা দেয়। না খেয়ে মারাও যায় অনেক মানুষ। কিন্তু অনাহারে মৃত্যুর খবর এ দেশের কোনাে সরকার বাহাদুরই স্বীকার করেন না। অনেক বাহাদুরী করে প্রেসনােট ছাড়েন :
‘অনুসন্ধান করিয়া জানা গিয়াছে যে, এ লােকগুলাে পেটের পীড়ায় প্রাণত্যাগ করিয়াছে। কুচক্রী মহল উদ্দেশ্য প্রণােদিতভাবে অনাহারে মৃত্যুর খবর প্রচার করিয়া জনপ্রিয় সরকারের বিরুদ্ধে জনগণকে ক্ষেপাইয়া তুলিবার চেষ্টা করিতেছে। সরকারের হাতে প্রচুর খাদ্যশস্য মজুত রহিয়াছে, দেশে দুর্ভিক্ষের কোনাে আশংকাই নাই।
প্রত্যেক সরকারই খাদ্য নিয়ে রাজনীতি না করবার জন্যে সরকার-বিরােধী রাজনীতিকরদের হুঁশিয়ার করে দেন।
অথচ, সংবাদপত্রের পরিভাষায় যাকে বলে নীরব দুর্ভিক্ষ, তার কবলে পড়ে ছােট কৃষকরা প্রতিবছরই কিছু কিছু ফসলের জমি বিক্রি করতে বাধ্য হয় এবং এভাবেই আস্তে আস্তে ভূমিহীন কৃষকে পরিণত হয়। অনেকে ভিটেমাটি হারিয়ে শহরের বস্তিতে এসে ঠাই নেয়। এদেশে নিঃস্বকরণ প্রক্রিয়ায় এই নীরব দুর্ভিক্ষের ভূমিকাটিই হচ্ছে প্রধান।
দুর্ভিক্ষ যে-বছরে নীরব থাকে না, অনাহারী মানুষের মিছিল গ্রাম ছেড়ে শহরের দিকে আসতে থাকে, খাদ্যশস্যের দাম শহরের মধ্যবিত্তদেরও ক্রয়ক্ষমতার সীমা ছাড়িয়ে যায়, সেবছরে সরকার বাহাদুরও আর দুর্ভিক্ষকে অস্বীকার করার বাহাদুরী দেখাতে পারেন না। সরকারি উদ্যোগে তখন খাদ্যশস্যের মূল্য নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা চলে, খাদ্যদ্রব্যের অবাধ চলাচলের ওপর নানা বাধানিষেধ আরােপ করা হয়, এখানে ওখানে রেশনের দোকান খােলা হয়, জনসাধারণকে রেশন কার্ড হাতে নিয়ে দোকানের সামনে লাইন দিয়ে দাঁড়াতে হয়। সরকারি এসব ব্যবস্থার ফলে দুর্ভিক্ষ-তাড়িত মানুষ যে একটুও উপকৃত হয় না, তা নয়। তবে বেশি উপকৃত হয় এসব ব্যবস্থার ব্যবস্থাপকরা। দুর্ভিক্ষের কল্যাণে লাইসেন্স-পারমিটবাজি, চোরাকারবারি, ঘুষখােরির রমরমা বাজারে মধ্যবিত্তেরই একাংশের পােয়াবারাে ও ভুড়িবৃদ্ধি ঘটে।
এরকম দুর্ভিক্ষের সঙ্গে আমি আশৈশব পরিচিত। মাত্র সাত বছর বয়সে পঞ্চাশের মন্বন্তরের প্রত্যক্ষ যন্ত্রণাভােগী আমি, সেই যন্ত্রণার স্মৃতি আজো আমার করােটিতে দুঃস্বপ্নের মতাে অবস্থান করছে।
পাকিস্তানের জন্মলাভের পরবর্তী বছরগুলােতেও কমবেশি দুর্ভিক্ষ হয়েছেই, কিন্তু এসম্পর্কে কেউ কোনাে কথা বলতে গেলেই ‘শিশুরাষ্ট্রের দোহাই পেড়ে তাকে ধমক দিয়ে থামিয়ে দেয়া হতাে। কিন্তু চুয়ান্নর পরে অবস্থাটি আর সে রকম রইলাে না। ভােটে মুসলিম লীগ সরকারের পতন ঘটাতে পেরে মানুষের আত্মবিশ্বাস বেড়ে যায়, সত্য বলার সাহসও জন্ম
২১৭
নেয়। আর ছাপ্পান্ন সালে তাে আসলেই এমন প্রচণ্ড দুর্ভিক্ষ দেখা দেয় যে, তাকে আর লুকিয়ে রাখা সম্ভব হয় না। বিশেষ করে শহরে মধ্যবিত্তরা যখন খাদ্যাভাবের মুখােমুখি হয়, বাজারে চাল আটা দুষ্প্রাপ্য ও দুর্মূল্য হয়ে পড়ে, তখনই দুর্ভিক্ষের সরকারি স্বীকৃতি মেলে। সরকার তখন দুর্ভিক্ষ প্রতিরােধের যে সব পদক্ষেপ গ্রহণ করেন তার প্রায় সবই মুখর শহুরে মধ্যবিত্তের মুখ বন্ধ করার লক্ষে। দুর্ভিক্ষের আসল শিকার যারা, সকলের অন্ন জুগিয়েও নিজেরা যারা অন্নহীন, গাঁয়ের সেই কৃষক ক্ষেতমজুরদের যন্ত্রণার অবসান ঘটানাের দিকে সরকারি প্রয়াস খুব কমই চোখে পড়ে। ছাপ্পান্ন সালের দুর্ভিক্ষেও তার ব্যতিক্রম ঘটেনি।
নেত্রকোনার মতাে মহকুমা শহরেও ন্যায্যমূল্যের দোকান খােলা হয়েছিলাে। শহরবাসীরা রেশনকার্ড দেখিয়ে কিংবা মহকুমা খাদ্য-নিয়ন্ত্রকের অফিস থেকে পারমিট জোগাড় করে সেই দোকান থেকে ধান-চাল- গম-আটা সংগ্রহ করতে পারতাে। কিন্তু দূরের গণ্ডগ্রাম তাে দূরের কথা, শহরের আশপাশের গ্রামগুলাের অভাবী মানুষরাও এ-সুযােগ পেতাে না। গ্রামেও অবিশ্যি রেশন ব্যবস্থা চালু হয়েছিলাে, তবে তা একেবারেই নাম-কা-ওয়াস্তে। এতে গ্রামের মাতব্বর স্থানীয় লােকজন ও রেশন ডিলাররা বাড়তি কিছু সুযােগ-সুবিধা অবশ্যই পেয়েছে, সাধারণ মানুষদের কপালে ছিটেফোঁটার বেশি কিছু জোটেনি। তাই দেখা গেলাে : গ্রামের অভাবতাড়িত মানুষরা শহরে এসে ভিড় করেছে খয়রাতি সাহায্যের আশায়; কিন্তু খয়রাতি দূরে থাক, শহরের মানুষের মতাে হ্রাসকৃত মূল্যে চাল-আটা পাওয়ার ভাগ্যও তাদের হলাে না। এ নিয়ে তাদের ক্ষোভের প্রকাশ ঘটতে দেখলাম এক পল্লী কবির কবিতায়। নেত্রকোনার এই কবি লিখলেন—শহরের সব বড়াে ব্যাটা, পায় গাে তারা চাউল-আটা, আমরার ভাগ্যে মিলে না। তারাও যেমন, আমরাও তেমন, তারা কি তা বােঝে না?’
সাময়িক নানা ঘটনার প্রতিক্রিয়ায় রচিত পল্লীকবিদের এ-রকম কবিতার সঙ্গে আমার পরিচয় সাতচল্লিশ সাল থেকে। সেই যে গাবতলী বাজারে পল্লীকবি ইউনুস আলীর ‘পাকিস্তানের কবিতা’ শুনে ও পড়ে সারা মনপ্রাণ এক অনাস্বাদিতপূর্ব আনন্দে ভরে গিয়েছিল, তখন থেকেই এ-রকম সব কবিতা সংগ্রহ করা আমার হবি হয়ে ওঠে। একাত্তরের মার্চ পর্যন্ত এ ধরনের বহুসংখ্যক কবিতা আমি সংগ্রহ করেছিলাম। ইচ্ছা ছিলাে : এগুলাের ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করে এমন একটি বই লিখবাে যাতে বাংলার লােকমানসের নানামুখী বৈশিষ্ট্য ও তার বিবর্তন ধারাটি স্পষ্ট হয়ে উঠবে। কিন্তু আমার সে ইচ্ছা অপূর্ণই থেকে গেলাে। একাত্তরে আমার সব বইপত্র ও পাণ্ডুলিপির সঙ্গে ওই কবিতাগুলােও লুট হয়ে যায়। তা না হলে পল্লীর গণকবিদের ওসব কবিতার দর্পণে আমার পাকিস্তানের জন্মমৃত্যু দর্শন আরাে স্পষ্ট ও স্বচ্ছ হয়ে উঠতে পারতাে।
ছাপ্পান্ন সালের এই দুর্ভিক্ষের সময়ে, জুলাই মাসে, নেত্রকোনা কলেজে ইন্টারমিডিয়েট ক্লাসে ফার্স্ট ইয়ারের পরীক্ষা পাস করে সেকেন্ড ইয়ারে উঠেছি। বাবা আমার থাকার ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন কলেজের পাশেই সাতপাই পাড়ায় জিতেন্দ্র বিশ্বাসের বাসায়। দলপা গ্রামের জিতেন্দ্র বিশ্বাস ভারতে যেতে পারেননি, পরিবার-পরিজন নিয়ে নেত্রকোনা শহরে এসে উঠেছিলেন। নেত্রকোনাতেই কী এক অসুখে পড়ে প্রায় বিনা চিকিৎসায় তার একমাত্র পুত্রটি মারা গেলাে। পঞ্চান্ন সালের আট আগস্ট, যেদিন আমি কলেজে ভর্তি হই, সেদিনই বাবা আমাকে জিতেন্দ্র বিশ্বাসের বাসায় নিয়ে গিয়েছিলেন। জিতেন্দ্র বিশ্বাস আমাদের বাড়িতে অনেকবার গিয়েছেন, কাজেই তাকে আমি চিনতাম। কিন্তু তাঁর স্ত্রীকে আমি এর আগে
২১৮
কোনােদিন দেখিনি। প্রথম দর্শনেই এই পুত্রশােকাতুরা জননী আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরলেন ও ডুকরে কেঁদে উঠলেন। সেদিন থেকেই বিশ্বাস-দম্পতির পুত্র-প্রতিম হয়ে তাদের বাসায় ঠাই নিলাম।
কিন্তু বিশ্বাস-দম্পতি স্নেহ-সম্পদে ধনী হলেও অর্থ-সম্পদে ছিলেন নিতান্ত দরিদ্র। মােক্তারের মুহুরিগিরি করে জিতেন্দ্র বিশ্বাস যা পেতেন তা দিয়ে তার একটি কন্যা ও আমাকে সহ চারজনের অন্নসংস্থান করা খুবই কঠিন হতাে। মােক্তারের মুহুরি মানে বাঁধা মাইনের কোনাে চাকুরি নয়—এক ধরনের উঞ্ছবৃত্তি মাত্র। এক মােক্তারকে তিনি মক্কেল জোগাড় করে দিতেন। সেই মক্কেলের কাছ থেকে পাওয়া মােক্তার বাবুর ফি-এরই সামান্য অংশ ছিলাে তার মুহুরির অর্থাৎ বিশ্বাস মশাইয়ের প্রাপ্য। যেদিন মক্কেল জোটাতে পারতেন সেদিনই ছিলাে তাঁর প্রাপ্তিযােগ, যেদিন জুটতাে না সেদিন খালি হাত। অর্থাৎ বিশ্বাস পরিবারের ছিলাে দিন এনে দিন খাওয়ার অবস্থা। আমি অবিশ্যি আমার খাই-খরচা বাবদ কিছু টাকা মাসের প্রথমেই তাঁদের হাতে তুলে দিতাম এবং নিতান্ত অনিচ্ছায় ও একান্ত সংকোচের সঙ্গে তাঁরা তা গ্রহণ করতেন। কিন্তু তাতেও শেষরক্ষা হতাে না। আমার দেয়া টাকা পাঁচ/ছয় দিনেই খরচ হয়ে যেতাে। এরপর যেদিন বিশ্বাস মশাই কিছু টাকা পেতেন সেদিন দু’বেলাই খাবার জুটতাে। কিন্তু এমন অনেকদিন গিয়েছে তিনি এক পয়সাও রােজগার করতে পারেননি। সেই দিনগুলােতে না খাওয়া বা আধপেটা খাওয়া ছাড়া অন্য উপায় থাকতাে না। বন্ধুবান্ধবের কাছ থেকে দু’চার টাকা ধার করে কোনােদিন আমিও চাল-ডাল কিনে নিয়ে গিয়েছি, কোনােদিন বিশ্বাস মশাই নিজেও ধারের জন্যে কারাে কাছে হাত পেতেছেন। আজও মনে পড়ে : ছাপ্পান্নর জুলাইয়ে সেই প্রচণ্ড খাদ্যাভাবের সময়ে একবার দু’দিন ঘুরে আমি বিশ সের ধানের একটি পারমিট জোগাড় করেছিলাম। তারপর দোকান থেকে সেই ধান কিনে কলে ভাঙিয়ে চাল নিয়ে গেলে রাতে আমাদের খাওয়া হয়েছিলাে। এর আগের দেড়দিন মুড়ির মােয়া আর জল ছাড়া আর কিছুই খেতে পাইনি।
সে-সময়ে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইস্কান্দর মির্জা, পূর্ববঙ্গের গভর্নর আবুল কাসেম ফজলুল হক ও মুখ্যমন্ত্রী আবু হােসেন সরকার। না, তখন আর পূর্ববঙ্গ’ নেই। ছাপ্পান্ন সালের সংবিধানের বিধানে পূর্ব পাকিস্তান। যুক্তফ্রন্টও ভেঙে গেছে। তার দুই প্রধান শরিক কেএসপি আর আওয়ামী লীগ তখন পরস্পর বিবদমান। কেএসপি সরকারে, আওয়ামী লীগ বিরােধী দলে। কেএসপির আবু হােসেন মন্ত্রিসভা প্রদেশের খাদ্যসংকট তথা দুর্ভিক্ষ মােকাবেলায় পুরােপুরিই ব্যর্থ হলাে এবং শেষ পর্যন্ত এ কাজের দায়িত্ব তুলে দিলাে সামরিক বাহিনীর হাতে। সামরিক বাহিনী নিয়ােগের তীব্র সমালােচনা করলাে আওয়ামী লীগ, ব্যর্থ সরকারের পদত্যাগের দাবিতে শুরু করলাে আন্দোলন। ছাপ্পান্ন সালের ৪ আগস্ট আওয়ামী লীগ যে ভুখা মিছিল বের করলাে তাতে পুলিশের গুলিবর্ষণে মারা গেলাে কয়েকজুন। এতে স্বাভাবিকভাবেই আবু হােসেন সরকারের মন্ত্রিসভা জনধিকৃত হলাে, আওয়ামী লীগ জনপ্রিয় হয়ে উঠলাে। পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট মির্জা তখন সমর্থনের হাত বাড়িয়ে দিলেন আওয়ামী লীগের দিকে। পূর্ব পাকিস্তানে আবু হােসেন সরকারের মন্ত্রিসভা বাতিল হলাে, আতাউর রহমান খানের মুখ্যমন্ত্রিত্বে ক্ষমতায় এলাে আওয়ামী লীগ। আবু হােসেন সরকার তার মুখ্যমন্ত্রিত্বের আমলে যখন খাদ্য সংকট মােকাবেলার জন্যে সেনাবাহিনী নিয়ােগ করেছিলেন তখন আওয়ামী লীগ এর নিন্দা করেছিলাে। কিন্তু আওয়ামী লীগ যখন ক্ষমতায় এলাে—অর্থাৎ আতাউর রহমান খান মুখ্যমন্ত্রী
২১৯
হলেন—তখন আওয়ামী লীগ নিজেই সেনাবাহিনী নিয়ােগ করলাে। এবারের উদ্দেশ্য : সীমান্তে চোরাচালান দমন। এই চোরাচালান দমনের নামে সেনাবাহিনী যে তাণ্ডব চালালাে, রাজনীতিকদের যেভাবে হেনস্থা করে চললাে, জনসাধারণের (বিশেষ করে সংখ্যালঘু হিন্দুদের) ওপর যে রকম উৎপীড়ন ঘটালাে, তাতে মনে হলাে : দেশটার আসল কর্তা সামরিক বাহিনীই, বেসামরিক কর্তৃপক্ষ তথা রাজনীতিকরা নিতান্তই ঢাকের বাঁয়া। এর দু’বছর আগে, চুয়ান্ন সালের অক্টোবরে, পাকিস্তানের তৎকালীন গভর্নর জেনারেল গােলাম মােহাম্মদ যখন গণপরিষদ বাতিল করে দিয়ে মেধা মন্ত্রিসভা গঠন করেছিলেন এবং সে-মন্ত্রিসভায় সেনাধ্যক্ষ আইয়ুব খানকে প্রতিরক্ষামন্ত্রী ও আরেক কুচক্রী জঙ্গী নায়ক ইস্কান্দর মির্জাকে বানিয়েছিলেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, তখন থেকেই পাকিস্তানি সেনাকর্মকর্তারা ক্ষমতার স্বাদ পেয়ে যায়। ছাপ্পান্নয় কেএসপি ও সাতান্নয় আওয়ামী লীগ পূর্ব পাকিস্তানে সেনাবাহিনীকে ক্ষমতার স্বাদ গ্রহণের আরাে সুযােগ করে দিয়েছিলাে। এ-সবের মধ্যদিয়েই যেন আটান্ন সালে সেনাবাহিনীর পুরাে ক্ষমতা দখলের রিহার্সাল সম্পন্ন হচ্ছিলাে এবং তাদের আত্মবিশ্বাস বেড়ে যাচ্ছিলাে।
মনে পড়ে ছাপ্পান্ন সালের একদিনের একটি ঘটনা। ঘটনাটি সামান্যই। কিন্তু সেই সামান্যের মধ্যেই অসামান্যের ইঙ্গিত ছিলাে, পরবর্তী দুঃসময়ের ও দুঃশাসনের পূর্বাভাস ছিলাে।
খাদ্য সরবরাহ তদারকের নামে মিলিটারির জিপ তখন সারা নেত্রকোনা শহরে টহল দিয়ে বেড়াচ্ছে। নেত্রকোনার মতাে গ্রাম্য শহরে সে-সময়ে কোনাে যন্ত্রযানের চলাফেরা প্রায় ছিলােই না বলতে গেলে। সাইকেল রিকশা চলতাে, তারও সংখ্যা ছিলাে নগণ্য। ছােট ছােট ছেলেমেয়েরা শহরের রাস্তার ওপরই অবাধে দৌড়াদৌড়ি করতাে, এমনকি গােল্লাছুট খেলতাে। এতে পথচারিদের চলাচলে কখনাে কখনাে কিছুটা বিঘ্ন ঘটলেও তা খুব একটা ধর্তব্যের মধ্যে ছিলাে না। কিন্তু এরই মধ্যে হঠাৎ করে যখন ছােট্ট শহরের নিস্তরঙ্গ রাস্তায় মিলিটারির জিপ এসে প্রবল তরঙ্গ তুললাে, তখন পথক্রীড়ায় অভ্যস্ত শিশুদের নিরাপত্তার কথা ভেবে তাদের অভিভাবককুল শঙ্কাকুল হয়ে উঠলেন বৈকি। কিন্তু শিশু ভােলানাথদের তাে আর সহজে খেলা ভুলিয়ে দেয়া যায় না! তাই, রাস্তায় তাদের দৌড়ঝাপ বন্ধ করাও খুব কঠিন হলাে।
সেদিন তেরিবাজারে কবিরাজী ওষুধের দোকান আয়ুর্বেদ কুটির’-এর প্রবীণ কবিরাজ ও দার্শনিক পণ্ডিত শৈলেশ তর্কতীর্থ মহাশয়ের সঙ্গে গল্পগুজব করছি। তর্কতীর্থ মহাশয়ের কাছে প্রাচীন ভারতীয় দর্শনের—বিশেষ করে ন্যায়শাস্ত্রের—নানা প্রসঙ্গ শুনে আমি খুবই উপকৃত হতাম। সেদিনও সে-প্রসঙ্গেরই আলােচনা চলছিলাে। হঠাৎ বিকট শব্দ করে একটি জিপ আয়ুর্বেদ কুটিরের সামনে এসে থামলাে এবং তার ভেতর থেকে বেরিয়ে এলাে মােছওয়ালা জঙ্গবাহাদুর। বেরিয়েই একটি পলায়নপর বালককে ধরে সমানে চড়-থাপ্পড় মারতে লাগলাে। আর এর পরই দোকানে উঠে এসে মারমুখী হয়ে তর্জনগর্জন শুরু করলাে। আধা উর্দু আধা বাংলায় সে ঝড়ের বেগে যা বললাে তার মূলমর্ম হচ্ছে: রাস্তায় ছেলেগুলাে যে দৌড়াদৌড়ি করে এর জন্যে দোষী হচ্ছাে তােমরা। তােমরাই ওদের আস্কারা দাও। আর কোনােদিন যদি কোনাে ছেলেকে রাস্তায় দৌড়াতে দেখি, তবে রাস্তার ধারের দোকানে যাকে পাবাে তাকেই পেটাবাে।
ঘটনার আকস্মিকতায় হতভম্ব হয়ে গিয়েছিলাম। তর্কতীর্থ মহাশয়ের চোখের কোণে অশ্রু চিকচিক করে উঠেছিলাে।
২২০
তর্কতীর্থ মহাশয়ের বয়স এখন (উনিশ শাে পঁচানব্বই সালে) নব্বইয়ের কাছাকাছি। সেদিনের ঘটনাটি আজও তার মনে আছে কিনা জানি না। কিন্তু আমি এটি কোনােদিনই ভুলতে পারবাে না।
ছাপ্পান্ন সালে মিলিটারিরা আইনত একটি সিভিল সরকারের অধীনে ছিলাে বলেই হয়তাে যাকে সামনে পাবাে তাকেই পেটাবাে’ কথাটা মুখে বললেও সর্বত্র কাজে সেটি করেনি। কিছুটা চক্ষুলজ্জা বােধহয় তখনাে ছিলাে। কিন্তু এর দু’বছর পরে, আটান্ন সালে, পাক মিলিটারিরা সিভিল কর্তৃত্বকে পুরােপুরি ঝেড়ে ফেলে দিয়ে নিরঙ্কুশ হয়ে গিয়েছিলাে বলেই হয়তে মুখে নাবলেও কাজে তা-ই করেছিলাে। চক্ষুলজ্জা তখন লজ্জায় বিদায় নিয়েছিলাে।

প্রতিক্রিয়াশীলতার বিরুদ্ধে প্রগতিশীল রাজনীতি ও সংস্কৃতি
ছাপান্ন সাল শেষ হওয়ার আগেই—অক্টোবরে কি নভেম্বরে, ঠিক মনে করতে পারছি না— ছাত্রলীগের ময়মনসিংহ জেলা সম্মেলন। ময়মনসিংহ সদর, নেত্রকোনা, কিশােরগঞ্জ, জামালপুর, টাঙ্গাইল—পাঁচটি মহকুমা নিয়ে বিশাল ময়মনসিংহ জেলা। সব মহকুমা থেকেই সম্মেলনের প্রতিনিধি ও পর্যবেক্ষকরা ময়মনসিংহ শহরে এসে জড়াে হয়েছিলাে। এদের মধ্যে আমাদের নেত্রকোনার প্রতিনিধি দলটিই ছিলাে সবচেয়ে বড়াে। টাঙ্গাইল, কিশােরগঞ্জ আর জামালপুর থেকে যারা এসেছিলাে তাদের সকলের সম্মিলিত সংখ্যাও বােধ হয় নেত্রকোনার সমান হয়নি।
সম্মেলনের উদ্দেশ্যে আমাদের সেদিনকার নেত্রকোনা-ময়মনসিংহের বিনা টিকিটের ট্রেনযাত্রার সুমধুর স্মৃতিটি আজও আমার মনে গেঁথে আছে।
নেত্রকোনা শহরের ইস্কুল-কলেজের ছাত্ররা তাে ছিলােই আমাদের দলে; তার সঙ্গে এসে যােগ দিয়েছিলাে মােহনগঞ্জ আর বারহাট্টা ইস্কুলের বহুসংখ্যক প্রাণচঞ্চল কিশাের ছাত্র। প্রাণচাঞ্চল্যে সবাইকে ছাড়িয়ে গিয়েছিলাে আহসাব উদ্দিন। বারহাট্টা ইস্কুলের ক্লাস এইটের ছাত্র, বয়সে অবিশ্যি আমার সমানই, কিছুটা বড়াে হওয়াও অসম্ভব নয়। তাকে বলা যেতে পারে একজন স্বভাব কবি। পূর্ব ময়মনসিংহের কবিয়াল রামু-রামগতি-রাম কানাইয়ের ক্ষুদে উত্তরসুরি।
ট্রেনের কামরায় মুখে মুখে ছড়া আর গান বানিয়ে পরিবেশন করতে লাগলাে আহসাব উদ্দিন। একেকটা স্টেশনে ট্রেন থামে, আর মানুষ ভিড় করে দাঁড়ায় আমাদের কামরাটিকে ঘিরে। হাস্যরসের ভিয়েন-দেয়া গানে আহসাব উদ্দিন বিবৃত করে যায় আমাদের দলের উদ্দেশ্য, ছাত্র-ঐক্যের আবশ্যকতা, দেশের মানুষের অবস্থা, আর রাজনীতির গতি-প্রকৃতি। অবাক বিস্ময়ে মানুষ তার গান শােনে।
ট্রেনের টিকেট চেকার বেচারা আমাদের কামরায় ওঠে বটে, কিন্তু টিকেট চাইতে তার সাহসে কুলােয় না। সে-ও আহসাব উদ্দিনের গান শুনে চলে যায়।
‘ছাত্রলীগ-জিন্দাবাদ’, ‘ছাত্র ঐক্য-জিন্দাবাদ’ ধ্বনি দিতে দিতে আমরা ময়মনসিংহ টাউন হলের সম্মেলন স্থলে এসে উপস্থিত হলাম।
সম্মেলনে আমাদের কী ভূমিকা হবে সে বিষয়ে আগেই নেত্রকোনায় গিয়ে আমাদের সবক দিয়ে এসেছিলেন ময়মনসিংহ জেলা ছাত্রলীগের নেতা কাজী আবদুল বারি। প্রাঞ্জল বক্তৃতায়
২২১
তিনি দেশীয় ও আন্তর্জাতিক রাজনীতি আর ছাত্র সমাজের দায়-দায়িত্ব সম্পর্কে অত্যন্ত চমৎকারভাবে আমাদের বুঝিয়ে দিয়ে এসেছিলেন। তখনাে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির জন্ম হয়নি, কম্যুনিস্ট পার্টি নিষিদ্ধ, গণতন্ত্রী দল প্রায় নিষ্ক্রিয়। তবে আওয়ামী মুসলিম লীগ থেকে ইতিমধ্যেই মুসলিম’ শব্দ বাদ পড়েছে, হয়ে গেছে আওয়ামী লীগ। এই আওয়ামী লীগই তখন সারা দেশব্যাপী সংগঠিত একমাত্র প্রগতিশীল রাজনৈতিক দল। আর ছাত্র সংগঠনের মধ্যে পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগ। ছাত্রলীগের আদর্শ ও উদ্দেশ্য যথেষ্ট প্রগতিশীল।
পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নও গঠিত হয়েছে দু’বছর আগে, চুয়ান্ন সালে। কিন্তু সারা দেশ জুড়ে তার তখনাে তেমন প্রভাব প্রতিপত্তি গড়ে ওঠেনি। কাজী আবদুল বারি আমাদের বুঝিয়েছিলেন, ছাত্রলীগ ও ছাত্র ইউনিয়নের কর্মসূচি প্রায় অভিন্ন; তাই এ দুটো আলাদা সংগঠন রাখা নিতান্তই অযৌক্তিক, দুই সংগঠন মিলে একটি ছাত্র সংগঠন গড়ে তুলতে হবে। ছাত্রলীগের ময়মনসিংহ জেলা সম্মেলনে আমরা যাতে দুই সংগঠনকে একত্রীভূত করার জন্যে জোর স্লোগান তুলি, সে বিষয়ে কাজী বারিই আমাদের উৎসাহিত করে তুলেছিলেন।
সম্মেলন উপলক্ষে একটা আলােচনা সভারও ব্যবস্থা করা হয়েছিলাে। আলােচ্য বিষয় ছিলাে—পূর্ববাংলার সংস্কৃতি। গিরিজাপ্রসন্ন মজুমদার ও আতাউল হক—আনন্দমােহন কলেজের এই দু’জন অধ্যাপক আলােচনায় অংশ নিয়েছিলেন। আমিও বক্তব্য রেখেছিলাম। গুছিয়ে বলতে পারিনি, আর বিষয়বস্তু সম্পর্কে যে খুব একটা স্বচ্ছ ধারণা আমার ছিলাে তাও বলা চলে না। তবু, অনেকেরই প্রশংসা পেয়ে গেলাম। সে প্রশংসাতেই বােধ হয় সংস্কৃতি বিষয়টি নিয়ে চিন্তা-ভাবনা ও পড়াশােনার দিকে আমার আগ্রহ ও উৎসাহ জন্মে যায়।
সেবারের জেলা সম্মেলনে পূর্বপাকিস্তান ছাত্রলীগের তৎকালীন সভাপতি আবদুল আওয়াল এসেছিলেন। এসেছিলেন নির্মল সেন। তিনিও তখন ছাত্রলীগের অন্যতম কেন্দ্রীয় নেতা। জেলা ছাত্রলীগ নেতৃবৃন্দের বিশেষ আমন্ত্রণে পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নের নেতা আনােয়ারুল আজিমও সম্মেলনে উপস্থিত হয়েছিলেন। সম্মেলনের মূল অধিবেশনে নেতাদের বক্তৃতার সময় আমরা খুব জোর স্লোগান তুললাম-ছাত্র ঐক্য জিন্দাবাদ, ছাত্রলীগ-ছাত্র ইউনিয়ন—এক হও’। কাজী আবদুল বারি ছাত্রলীগ-ছাত্র ইউনিয়নের সংযুক্তির পক্ষে জোরালাে যুক্তি দিয়ে বক্তৃতা করলেন। নানা ধ্বনি তুলে আমরা তাঁর বক্তব্যের সমর্থন জানালাম। ঐক্যের দাবিতে সম্মেলন জমজমাট হয়ে উঠলাে।
কিন্তু কিছুক্ষণের মধ্যেই বােঝা গেলাে: ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের প্রভাবশালী অংশই ছাত্র ইউনিয়নের সঙ্গে সংযুক্তির সম্পূর্ণ বিরুদ্ধে। আমাদের ঐক্যের স্লোগানের প্রচণ্ডতার সামনে তাঁদের বিব্রত অবস্থাটাও বেশ পরিষ্কার বােঝা যাচ্ছিলাে। আওয়াল সাহেব ছিলেন যথেষ্ট প্রত্যুৎপন্নমতিত্ব সম্পন্ন মানুষ। তিনি ময়মনসিংহের কর্মিদের প্রবণতাটা সহজেই আঁচ করে নিতে পারলেন। তাই, তার বক্তৃতায় ঐক্য প্রতিষ্ঠার গুরুত্ব ও আবশ্যকতা সম্পর্কে আবেগময়ী সূচনা দিয়ে সম্মেলনের শ্রদ্ধা আকর্ষণ করে নিলেন। কিন্তু, পরক্ষণেই কিন্তু দিয়ে আরম্ভ করে এমন কিছু বাক্য প্রয়ােগ করে চললেন যার মধ্যে তবে, অথচ, বটে, কাজেই’ ইত্যাদি অব্যয় পদগুলাের পৌনঃপুনিক ব্যবহারে এমন অবস্থার সৃষ্টি করলেন যে, তাঁর বক্তব্যের সহজ অর্থটা দাঁড়ালাে ছাত্রলীগ-ছাত্র ইউনিয়নের সংযুক্তির প্রস্তাবটা খুব উত্তম, কিন্তু প্রস্তাব কার্যকর করা অসম্ভব।
তাঁর বক্তব্যের সপক্ষে একটা যুক্তিকে তিনি একরূপ অলংঘনীয়তার পােশাক পরিয়ে হাজির করতে চাইলেন। সেটি হলাে : ছাত্রলীগ প্রতিষ্ঠানটি অগ্রজ ও ঐতিহ্যবাহী, ছাত্র
২২২
ইউনিয়নও বেশ মর্যাদাসম্পন্ন প্রতিষ্ঠান। এখন ছাত্রলীগের পক্ষে নাম বদলিয়ে অন্য কোনাে নামে প্রতিষ্ঠান করা অসম্ভব। তবে, ছাত্র ইউনিয়ন যদি তাদের সংগঠনের বিলুপ্তি ঘােষণা করে, আর এর সদস্যরা ছাত্রলীগে যােগদান করে, তাহলে একটা মীমাংসা হতে পারে বটে। কিন্তু ছাত্র ইউনিয়নের পক্ষেই বা তা কী করে সম্ভব?
অতএব….
আওয়াল সাহেবের এ-রকম ওস্তাদী প্যাচের সামনে প্রথমে আমরা কিছুটা হকচকিয়ে গেলেও, কিছুক্ষণের মধ্যে কায়দাটা পরিষ্কার হয়ে উঠলাে আমাদের কাছে। আমরা আরাে তীব্রতার সঙ্গে স্লোগান তুললাম—“যে কোনাে মূল্যে-ঐক্য চাই, ঐক্য চাই, ঐক্য চাই’, নামের ফ্যাকড়া চলবে না, চলবে না।
আওয়াল সাহেব এতােটা আশঙ্কা করেননি। তাঁর মুখ লাল হয়ে উঠলাে। মামুলি দু’চারটা কথা বলে তিনি বসে পড়লেন। পরদিন সকালের অধিবেশনে এলেন মৌলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী। ভাসানী সাহেব সভামঞ্চে উপস্থিত হলে স্বাগত সম্ভাষণমূলক স্লোগানের সঙ্গে সঙ্গে ঐক্যের স্লোগানগুলােও পুনরাবৃত্তি করলাম আমরা। তিনিও তাঁর ভাষণে ঐক্যের ওপর খুব জোর দিলেন। দেশে প্রতিক্রিয়াশীল শক্তি যে খুব প্রবল হয়ে উঠছে, সমস্ত প্রগতিশীলদের দৃঢ় ঐক্য ছাড়া যে তাদের রােখা যাবে না, আর সে ঐক্য-প্রয়াসে যে প্রধান ভূমিকা গ্রহণ করতে হবে ছাত্রদেরই—এসব কথা তার স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিতে বলে আমাদের উৎসাহ খুব বাড়িয়ে দিলেন। তিনি প্রস্তাব দিলেন যে, ছাত্রলীগ ও ছাত্র ইউনিয়নের নেতৃবৃন্দ একটা সভায় মিলিত হয়ে ঐক্যের অন্তরায়গুলাে দূর করার উপায় নিয়ে আলােচনা করুক। ঐক্য প্রতিষ্ঠা করতেই হবে। প্রয়ােজনবােধ করলে ছাত্ররা জাতীয় নেতৃবৃন্দকেও তাদের সভায় ডাকতে পারে। সভা শেষ হলাে। আমরা বিজয়ীর ভাব নিয়ে নেত্রকোনায় ফিরে গেলাম।
কিন্তু, হায়, সবই ভ্রান্তিবিলাস মাত্র। কিছুদিনের মধ্যে বােঝা গেলাে যে, ঐক্যের বিজয় হয়নি। এক সর্বব্যাপী অনৈক্য তছনছ করে দিয়েছে প্রগতিশীলদের সব সুকৃতিকে। প্রগতির যে ধারার সূচনা হয়েছিলাে আওয়ামী মুসলিম লীগ’-এর ‘আওয়ামী লীগ’ হওয়ার মধ্য দিয়ে, সে ধারাই চরায় এসে ঠেকে গেলাে সােহরাওয়ার্দির নেতৃত্বে সাম্রাজ্যবাদী সামরিক জোটের প্রতি সমর্থনে। ভাসানী-সােহরাওয়ার্দির বিরােধের মধ্যে মূর্ত হয়ে উঠলাে জোটবদ্ধতাজোটনিরপেক্ষতার লড়াই। সে-লড়াইয়ে ছাত্রলীগ হয়ে উঠলাে সােহরাওয়ার্দির আদর্শের পয়লা কাতারের সৈনিক। অন্যদিকে, ছাত্র ইউনিয়নের তীব্র সাম্রাজ্যবাদ-বিরােধিতা সে-সংগঠনটিকে পরিচিত করে তুললাে কম্যুনিস্ট’ বলে। আর সে-যুগের কম্যুনিস্ট’ বা রাশিয়ার চর’-এর মতাে গালির জবাবে ছাত্র ইউনিয়ন তার প্রতিপক্ষকে আখ্যা দিলাে ‘সাম্রাজ্যবাদের দালাল। গালাগালির তােড়ে গলাগলির সব সম্ভাবনা একেবারে ভেসে গেলাে।
বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে উঠেছিলাে আওয়ামী লীগের কাগমারি সম্মেলনকে উপলক্ষ করে। পূর্ববঙ্গের আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন আর জোটনিরপেক্ষ পররাষ্ট্রনীতির প্রশ্নে হােসেন শহীদ সােহরাওয়ার্দি ও তাঁর সমর্থকরা যখন ভিন্ন অবস্থান গ্রহণ করলেন তখনই আওয়ামী লীগের মধ্যে অন্তর্দ্বন্দ্ব প্রকট হয়ে ওঠে। এ দলের অন্তর্ভুক্ত প্রগতিশীলরা মৌলানা ভাসানীর নেতৃত্বে সােহরাওয়ার্দি-বিরােধী ভূমিকা নেয়, তারা পাক-মার্কিন সামরিক চুক্তির বিরুদ্ধে ও পূর্ববঙ্গে স্বায়ত্তশাসনের পক্ষে দ্ব্যর্থহীন বক্তব্য রাখতে থাকে। মৌলানা ভাসানী কাগমারিতে আওয়ামী লীগের বিশেষ কাউন্সিল অধিবেশন ডাকলেন সাতান্ন সালের ফেব্রুয়ারিতে। এই অধিবেশনেই
২২৩
তিনি স্বাধীন পররাষ্ট্রনীতির পক্ষে জোরালাে বক্তব্য তুলে ধরেন ও পূর্ববাংলার একান্ত ন্যায্য দাবি আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন মেনে না নিয়ে যে এ অঞ্চলের মানুষ একদিন পশ্চিম পাকিস্তানকে ‘ওয়া আলাইকুম-আসসালাম’ জানাবে সে-কথাও ব্যঞ্জনাগর্ভ অথচ সুস্পষ্ট ভাষায় বলে দেন। অবিশ্যি এরও এক বছর আগেই, ছাপ্পান্ন সালের পনেরােই জানুয়ারিতে, ঢাকার পল্টন ময়দানের এক জনসভায় পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের উদ্দেশ্যে মৌলানা ভাসানী যে বক্তব্য রাখেন—ষােলই জানুয়ারি দৈনিক ইত্তেফাক-এর প্রতিবেদন অনুসারে তা হচ্ছে :
‘পূর্বপাকিস্তানের ন্যায্য দাবি মানিয়া লউন। অন্যথায় জাগ্রত সমাজের মনে যদি অত্যাচার ও অবিচারের প্রতিশােধ গ্রহণ স্পৃহা বদ্ধমূল হয়, এবং আমাদের মৃত্যুর পর যুবসমাজ নির্যাতনে অতিষ্ঠ হইয়া পশ্চিম পাকিস্তানের সহিত সংশ্রব বর্জনের দাবি উত্থাপন করিলে তাহাতে বিস্মিত হইবার কিছু থাকিবে না।’ (সাঈদ-উর-রহমান পূর্ববাংলার রাজনীতি-সংস্কৃতি ও কবিতা ১৯১৩ পৃষ্ঠা ৪৬-এ উদ্ধৃত)।
সন্দেহ নেই, মৌলানার বক্তব্য ছিলাে খুবই দূরদর্শী। এ অঞ্চলে পাকিস্তানের মৃত্যুর পদধ্বনি তিনি ছাপ্পান্ন সালের গােড়াতেই শুনতে পেয়েছিলেন।
কাগমারিতে বিশেষ কাউন্সিল ডাকার উদ্দেশ্য ছিলাে আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বের মীমাংসা করা। কিন্তু কোনাে মীমাংসাই হলাে না। কাউন্সিল অধিবেশন বিতর্কমূলক বিষয়গুলাে সম্পর্কে কোনাে সুস্পষ্ট সিদ্ধান্ত নিতে পারেনি। অথচ, অধিবেশনের পরে আওয়ামী লীগে সােহরাওয়ার্দি সাহেবেরই প্রভাব প্রবল হতে থাকে। পাশ্চাত্যপন্থী পররাষ্ট্রনীতি ও পূর্ববঙ্গের স্বায়ত্তশাসন-বিরােধী অবস্থান নিয়েই বরং তিনি আওয়ামী লীগে তার নেতৃত্বকে দৃঢ় করে তােলেন। পরিণামে মৌলানা ভাসানীর নেতৃত্বে বামপন্থী ও প্রগতিশীলরা আওয়ামী লীগ থেকে বেরিয়ে আসেন। পশ্চিম পাকিস্তানের ‘পাকিস্তান ন্যাশনাল পার্টির সঙ্গে যুক্ত হয়ে তৈরি হলাে একটি নতুন দল ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি বা ন্যাপ’। এটি কাগমারি সম্মেলনের মাত্র পাঁচ মাস পরের ঘটনা। সাতান্ন সালের জুলাই মাসের পঁচিশ ও ছাব্বিশ তারিখে ঢাকায় অনুষ্ঠিত একটি সম্মেলনে এই নতুন দলটি আত্মপ্রকাশ করে।
সাতান্নর ফেব্রুয়ারিতেই ছিলাে আমার ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষা। তাই, প্রবল ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও কাগমারি সম্মেলনে যেতে পারিনি। আওয়ামী লীগের সঙ্গে আমার কোনাে সম্পর্ক ছিলাে না, তবে আওয়ামী লীগের কাউন্সিলকে উপলক্ষ করে যে সাংস্কৃতিক সম্মেলনটি অনুষ্ঠিত হয়েছিলাে তাতে যােগ দেয়ার লােভ ছিলাে প্রচণ্ড। কিন্তু সে-লােভ সংবরণ করা ছাড়া গত্যন্তর ছিলাে না। তাই, দুধের স্বাদ ঘােলে মেটাতে হলাে পত্রিকায় সম্মেলনের প্রতিবেদন পাঠ করে ও যারা সম্মেলনে যােগ দিয়েছিলেন তাদের মুখের কথা শুনে।
সে-সময়ে আমাদের অত্যন্ত প্রিয় সংবাদপত্র ছিলাে দৈনিক ইত্তেফাক। কিন্তু সেই ইত্তেফাকই যখন আজাদ ও মর্নিং নিউজের সঙ্গে সুর মিলিয়ে কাগমারি সাংস্কৃতিক সম্মেলন সম্পর্কে নানা ধরনের কুৎসা প্রচার করতে লাগলাে, তখন খুবই দুঃখ পেয়েছিলাম। সম্মেলনে গান্ধী, লেনিন ও রবীন্দ্রনাথের নামে তােরণ নির্মাণ করার মধ্যে প্রতিক্রিয়াশীলরা রুশ-ভারতের ষড়যন্ত্রের গন্ধ পেয়েছিলাে। ভারত থেকে অধ্যাপক হুমায়ুন কবীরের নেতৃত্বে পাঁচ সদস্য বিশিষ্ট সাংস্কৃতিক প্রতিনিধি দলের আগমণ তাদের গায়ে জ্বালা ধরিয়ে দিয়েছিলাে। তবে সাম্প্রদায়িকতাবাদী, প্রগতি-বিরােধী ও সাম্রাজ্যবাদের তল্পিবাহকদের ‘গেলাে গেলাে’ চিঙ্কার দেশের প্রগতি-চেতন ও সংস্কৃতিমান মানুষদের বিভ্রান্ত করতে পারেনি। মৌলানা আকরাম
২২৪
খানের ‘আজাদ ও সােহরাওয়ার্দি-সমর্থক ইত্তেফাক-এর বিষােদগার বরং কাগমারি সাংস্কৃতিক সম্মেলনের ইতিবাচক ভূমিকা সম্পর্কে আমাদের নিঃসংশয় করে তুলেছিলাে। গণতান্ত্রিক শিবিরের বাঘা বাঘা রাজনীতিকদের অনেকেই প্রতিক্রিয়াশীলতার ফাঁদে পা দিলেও সংস্কৃতিসেবীদের বৃহদংশই সকল প্রতিকূলতার মুখেও প্রগতির পতাকাকে সমুন্নত রেখেছে। এঅঞ্চলে পাকিস্তানের মৃত্যুবীজকে লালন করার ক্ষেত্রে কয়েকটি সাহিত্য-সংস্কৃতি সম্মেলনের বিশেষ অবদানের কথা স্বীকার করতেই হবে। সেগুলাে হচ্ছে—আটচল্লিশ সালের একত্রিশে ডিসেম্বর ও উনপঞ্চাশের পয়লা জানুয়ারিতে ঢাকায় অনুষ্ঠিত পূর্ব পাকিস্তান সাহিত্য সম্বেলন’, একান্নর মার্চে চট্টগ্রামে ও বায়ান্নর আগস্টে কুমিল্লায় ‘পূর্বপাকিস্তান সাংস্কৃতিক সম্মেলন’, চুয়ান্নর এপ্রিলে ঢাকায় পূর্ব পাকিস্তান সাহিত্য সম্মেলন’ আর সাতান্নর ফেব্রুয়ারিতে ‘কাগমারি সাংস্কৃতিক সম্মেলন।
প্রতিক্রিয়াশীল পাকিস্তানপন্থীরা এগুলাের সুদূরপ্রসারী তাৎপর্য ঠিকই উপলব্ধি করতে পেরেছিলাে। উপলব্ধি করে পাকিস্তানের মৃত্যুভয়ে ভীত হয়ে পড়েছিলাে। প্রতিক্রিয়াশীলদের ভয় রাজনীতিকে নয়, সংস্কৃতিকে। আজাদ, মর্নিং নিউজ আর ইত্তেফাকের পাতায় তাদের সেই ভয়েরই প্রকাশ ঘটেছিলাে।

কাছে থেকে দেখা নীলকণ্ঠ কম্যুনিস্টগণ
সাতান্ন সালে আইএ পাস করলাম। কিন্তু বিএ ক্লাস তাে নেত্রকোনা কলেজে নেই। কাজেই আমার প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা জীবনে আবার অনিশ্চয়তা।
তবু, সেই অনিশ্চয়তার মধ্যেই দুঃসাহসে ভর করে ঝাপিয়ে পড়লাম। থাকা-খাওয়ার কোনাে সংস্থান না করেই ময়মনসিংহ আনন্দমােহন কলেজে ভর্তি হয়ে গেলাম।
নেত্রকোনা থেকেই ময়মনসিংহে এসে আনন্দমােহনে ভর্তি হয়েছিলাে আমার সহপাঠি বন্ধু নৃপেন সরকারও। সেও ছিলাে প্রায় আমারই মতাে হতদরিদ্র। বাড়ি থেকে মাসে মাসে টাকা এনে কলেজে পড়ার মতাে সংগতি তারও ছিলাে না। কিন্তু ময়মনসিংহে খুব ভালাে একটি লজিং পেয়ে যাওয়ায় তার বেশ সুবিধা হয়ে গিয়েছিলাে। সেই নৃপেনই আমাকে বললাে যে, লজিং পেতে হলে মহাদেব সান্যালের শরণাপন্ন হওয়া ছাড়া উপায় নেই এবং সে-ই আমাকে মহাদেব সান্যালের কাছে নিয়ে গেলাে। প্রথম পরিচয়েই বুঝতে পারলাম যে, মহাদেব সান্যাল হচ্ছেন দেবাদিদের মহাদেবের মতােই পতিত-পাবন!
আমরা যারা নেত্রকোনা কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট পাস করে ময়মনসিংহ আনন্দমােহন কলেজে ডিগ্ৰিক্লাসে ভর্তি হয়েছিলাম, আমাদের প্রায় সবারই অলিখিত গার্জেন হয়ে গেলেন মহাদেব বাবু। আমাদের লজিং করে দেয়া, ট্যুইশনি জোগাড় করে দেয়া, এমনকি রােগ হলে যাতে আমরা বিনা পয়সায় ডাক্তারের সাহায্য পেতে পারি তারও ব্যবস্থা করে দেয়া—এরকম অনেক কিছুরই দায়িত্ব মহাদেব বাবু নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছিলেন। তারই প্রচেষ্টায় আমারও থাকা-খাওয়ার একটা অপ্রত্যাশিত রকমের ভালাে ব্যবস্থা হয়ে গেলাে। দু’তিনটি ছেলেমেয়েকে পড়ানাের বিনিময়ে আহার ও আশ্রয় মিললাে শহরের ডেঙ্গু বেপারি রােডের উপেন্দ্র পালের বাসায়। পাল মহাশয় ছিলেন একজন ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী, ডাইলপট্টিতে তার গুড়ের দোকান। আর্থিক অবস্থা তার সচ্ছল না হলেও দরাজ দিল বলতে যা বােঝায়, তিনি ছিলেন তাই। আর তার সহধর্মিনী ছিলেন একেবারে মাতৃরূপা । আমার প্রতি তাঁর স্নেহ ছিলাে একান্তই অকৃত্রিম।
২২৫
আমি যে আমার মায়ের কাছ থেকে দূরে আছি—তেমনটি তিনি আমাকে ভাবতেই দেননি। প্রবাসেও যে এমন বাড়ির মতাে পরিবেশ পেয়ে গেলাম তার সবটাই মহাদেব বাবুর অবদান।
শুধু আমি নই, আমার মতাে এ রকম আরাে অনেককেই তিনি চিরঋণী করে রেখেছেন। কিন্তু যিনি আমাদের সবার উপকারের দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছিলেন তিনি কি পরােপকার করার মতাে অঢেল সম্পদে সম্পন্ন ছিলেন?
মােটেই না। নেত্রকোনার নওপাড়া গ্রামের সান্যাল পরিবারের সন্তান মহাদেব সান্যাল পরিবার-বিচ্ছিন্ন ও সম্পদ-বঞ্চিত হয়ে পড়েছিলেন ক্যুনিস্ট রাজনীতি করতে গিয়ে। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার প্রায় পরপরই কমরেড মনিসিংহের নেতৃত্বে হাজং কৃষকদের টংক আন্দোলনে যােগ দেয়ার অপরাধে মহাদেব সান্যাল সহ যে-সব কম্যুনিস্ট গ্রেফতার হয়েছিলেন, মুসলিম লীগের শাসন যতােদিন ছিলাে ততােদিন তারা কেউই কারা প্রাচীরের বাইরে আসতে পারেননি। চুয়ান্নর নির্বাচনে মুসলিম লীগের ভরাডুবি হলাে, তবু ওই দেশপ্রেমিক রাজবন্দিদের সহজে মুক্তি ঘটলাে না। ছাত্রসমাজের প্রবল দাবির মুখে অনেক দেরিতে একে একে এঁরা মুক্ত হলেন। মুক্ত হলেন মহাদেব বাবুও। কিন্তু মুক্তির পর কোনাে আবাসও নেই, নেই আহারেরও সংস্থান। তবে, মাথা গোঁজার ঠাই একটা মিললাে। সেটি কমরেড শৈলেন রায়ের বাসা। বিপত্নীক শৈলেন রায় নিজে ক্যুনিস্ট বলেই তার বাসাটা হয়ে গিয়েছিলাে ক্যুনিস্টদের মেসবাড়ির মতাে। ময়মনসিংহ টেলিগ্রাফ অফিসের পাশের ওই বাসাটিতেই এসে উঠলেন সদ্য জেলফেরত কমরেড মহাদেব সান্যাস ও কমরেড অজয় রায়। শৈলেন রায়ের ভাই রতু রায়ও কিছুদিন আগে জেল থেকে ছাড়া পেয়ে এখানেই উঠেছেন। শুধু এরাই নন, তখনকার বিশাল ময়মনসিংহ জেলার সব এলাকার কমরেডরাই এ-বাসাতে সাময়িক আশ্রয় নিতেন।
কিন্তু মহাদেব সান্যালের মাথা গোঁজার ঠাই যদি বা মিললাে, আহারের জোগাড় করা হলাে খুবই কঠিন। একমাত্র ভরসা টুইশানি। তাও বেশি পয়সার টুইশানি করা তাঁর পক্ষে সম্ভব ছিলাে না। কোন যুগে ম্যাট্রিক পাস করেছিলেন, অ্যাকাডেমিক পড়াশােনার পাট তাে সেখানেই খতম। ক্লাস নাইন টেনের ছাত্র পড়াতে না পারলে, বিশেষ করে অঙ্ক না জানলে, টুইশানি করে ভালাে পয়সা পাওয়া সম্ভব নয়। মহাদেব বাবুকে তাই নিচের ক্লাসের ছেলেমেয়েদের পড়িয়ে অন্নবস্ত্রের সংস্থান করতে হলাে, আর সে কারণেই অনেকগুলাে ট্যুইশানি নিতে হলাে। এতােগুলাে টুইশানি করার পর সময় বা এনার্জি কোনােটাই অবশিষ্ট থাকার কথা নয়। অথচ মহাদেব বাবুর এনার্জি অফুরন্ত। আর সময়ও তিনি বের করে নিতে জানেন। অবিশ্যি এনার্জি আর সময়—দুটোই নিজের জন্যে খুব কমই ব্যবহার করতেন তিনি, সবই পরার্থে উৎসর্গীকৃত, আমাদের জন্যেই তার সকল ভাবনা ও দুর্ভাবনা নিবেদিত।
এ অবস্থাতেও কিন্তু প্রজাপতির নিবন্ধ ঘটে গেলাে মহাদেব সান্যালের জীবনে।
হরি চক্রবর্তী নামে এক চাটগাঁইয়া ব্রাহ্মণ ময়মনসিংহেরই এক জমিদারি সেরেস্তায় চাকরি করতেন। জমিদারি উঠে যাওয়ার পর তিনি তীব্র জীবিকা সংকটে পড়লেন, এর সঙ্গে এসে যুক্ত হলাে বয়স্কা কন্যাকে পাত্রস্থ করার সমস্যা। যেনতেন প্রকারে যে কোনাে পাত্রের হাতে কন্যা সমর্পণ করে সে-সমস্যার সমাধান করতে চাইলেন তিনি। কমরেড শৈলেন রায়ের পরিচিত ছিলেন এই ভদ্রলােক। শৈলেন বাবু হরি চক্রবর্তীকে কন্যা দায় থেকে উদ্ধার করার জন্যে মহাদেব বাবুকে বর হবার প্রস্তাব দিলেন। মহাদেব বাবু সঙ্গে সঙ্গে রাজি। তড়িৎ সিদ্ধান্ত নিতে তার জুড়ি নেই।
২২৬
বিয়ের ব্যবস্থাও অভিনব। হরি চক্রবর্তী থাকতেন ব্রাহ্মপল্লীতে হৃদয় নিবাস’ নামের একটি মস্ত বড়াে বাড়িতে। বাড়িটি জমিদারদের। জমিদারি উঠে গেলেও এবং হরি চক্রবর্তীর চাকরি না থাকলেও, তিনি তখনাে সেই বাড়িটিতে থাকার সুযােগ পাচ্ছিলেন। বিয়ে হবে ওই বাড়িতেই।
একদিন মহাদেব বাবু আমাকে ডেকে বললেন, “আমার বিয়ের তারিখটির কথা তাে শুনেছেনই। ওই দিন সন্ধ্যাবেলায় খাওয়া-দাওয়া করে আমাদের বাসায় (মানে কমরেড শৈলেন রায়ের বাসায় চলে আসবেন। সেখান থেকে ব্রাহ্মপল্লীর হৃদয় নিবাসে রওয়ানা হয়ে যাবাে। ওখানেই বিয়ে হবে।’
বললাম, তা তাে বুঝলাম। কিন্তু, আপনার বিয়েতে নেমন্তন্ন, আর আমরা নিজের নিজের বাসা থেকে খাওয়া-দাওয়া করে যাবাে?
‘এর মানে’—অতি পরিষ্কার। আমার হবু শ্বশুর ভদ্রলােকের অবস্থা তাে জানেনই। একপাল বরযাত্রীকে খাওয়ানাের সঙ্গতি তার নেই। তবে, হৃদয়-নিবাস বাড়িটাতে তাে বেশ বড়াে বড়াে ঘর আছে, বসতে দিতে কোনাে অসুবিধে হবে না। আমরা বলে দিয়েছি—বরযাত্রী যাবে একশাে জনেরও বেশি, তাদের জন্যে কেবল স্রেফ এক কাপ করে চায়ের ব্যবস্থা করলেই চলবে।’
শুধু চা নয়। মহাদেব বাবুর শ্বশুর বরযাত্রীদের জন্যে প্রতি কাপ চায়ের সঙ্গে একটি করে দুধের নাড়ুও পরিবেশন করেছিলেন।
বর বেশে মহাদেব সান্যাল পিঁড়িতে বসলেন। পুরােহিত মন্ত্র আবৃত্তি করছেন, বর কিন্তু একবােরে মৌন। বিয়ের সব শাস্ত্রীয় অনুষ্ঠান আর স্ত্রী-আচারই পালিত হলাে, কেবল বরের মুখ থেকে কোনাে মন্ত্রই বেরুলাে না। তবু শান্তি চক্রবর্তী নামক কুমারীটি শ্রী মহাদেব সান্যালের ধর্মপত্নী রূপে পরিণত হলেন শ্রীমতি শান্তি সান্যালে।
বিয়ের আসরে প্রচুর হৈ হুল্লোড় করে অনেক রাতে আমরা যার যার আস্তানায় ফিরে এলাম।
শৈলেন রায়ের বাসার মতােই সে-সময়ে ময়মনসিংহে কম্যুনিস্টদের আরেকটি আড্ডাখানা ছিলাে নয়জামানা পুঁথিঘর’। এই বইয়ের দোকানটিকে তাে অনেকে কম্যুনিস্ট পার্টির অঘােষিত অফিস বলেই মনে করতেন। বাস্তবেও অবিশ্যি এটি তা-ই হয়ে উঠেছিলাে। শহরের চন্দ্রকান্ত ঘােষ রােডের যে-ভবনটিতে এই দোকানটির অবস্থান, বিশেষ সূত্রে কম্যুনিস্টরাই ছিলেন সে-ভবনটির মালিক। চুয়ান্ন সালে পাকিস্তান সরকার ক্যুনিস্ট পার্টিকে নিষিদ্ধ ঘােষণা করার পর পার্টি-দরদী জ্ঞান বাগচি মশাইকে মালিকানা দিয়ে এখানে যে বইয়ের দোকানটি খােলা হয় তারই নাম দেয়া হয় নয়া জামানা পুঁথিঘর’। জেল ফেরত কমরেড রতু রায় হন দোকানের প্রধান কর্মচারি বা ম্যানেজার। তাই, স্বভাবতই এটি হয়ে ওঠে নিষিদ্ধ ঘােষিত কম্যুনিস্ট পার্টির লােকজন ও তাদের সহযােগীদের আড্ডাস্থল। এই আডডায় নিয়মিত আসতেন ছাত্রনেতা কাজী আবদুল বারি, বিভূতি আচার্য, আবদুল আলী, আশুতােষ ধর, সুধীর দাস, নরেশ পাল এবং এ-রকম আরাে অনেকে। আলতাব আলী, জ্যোতিষ বােস, অজয় রায়, মহাদেব সান্যাল, বেণীমাধব দেব, ওয়াহেদ আলীর মতাে জেল ফেরত কমরেডদেরও বৈকালিক আড্ডা জমতাে এই নয়াজামানা পুথিঘরেই।
শৈলেন রায়ের বাসা আর পুঁথিঘরের আড্ডায় যাদের সান্নিধ্যে এসেছিলাম তারা—অর্থাৎ কম্যুনিস্টরা—যে অন্য সকল বিষয়বুদ্ধিসম্পন্ন কৃতী লােকদের থেকে আলাদা—সে কথা বুঝতে
২২৭
আমার বিলম্ব হয়নি। জীবিকার জন্যে কমেরেড শৈলেন রায় হয়েছিলেন হােমিওপ্যাথি চিকিৎসক। অথচ নেত্রকোনার রামেশ্বরপুরে সম্পন্ন জোতদার-তালুকদার পরিবারের মানুষটির এমনটি করার কোনােই প্রয়ােজন হতাে না, যদি তিনি কম্যুনিস্ট না হয়ে বৈষয়িক বুদ্ধিসম্পন্ন ব্যক্তি হতেন। তার ভাই রতু রায় ক্যুনিস্ট হওয়ার দরুনই জেল খেটে খেটে আর আত্মগােপনে থেকে থেকে জীবনে সংসারী হওয়ার কোনাে সুযােগই পেলেন না। দৃষ্টিক্ষীণতায় বহুদিন যাবত ভুগছিলেন। সাতান্ন সালে যখন তার সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয়, তখনই দেখেছি, তিনি অনেক মােটা লেন্সের চশমা ব্যবহার করেন। তারপর জঙ্গী শাসক আইয়ুবের জেল থেকে যখন বেরিয়ে এলেন চৌষট্টি সালে, তখন দেখলাম, তিনি সম্পূর্ণ অন্ধ । শৈলেন রায়ের শ্যালিকা-পুত্র অজয় রায় ছিলেন ব্রিলিয়ান্ট ছাত্র। তার সম্পর্কে সংক্ষেপে অত্যন্ত চমৎকার বর্ণনা দিয়েছেন ধনঞ্জয় দাশ তাঁর আত্মকথা আমার জন্মভূমি ও স্মৃতিময় বাংলাদেশ-এ। সেই অজয় রায়ও নিঃস্বের জীবন বেছে নিয়েছিলেন। উনিশোে সাতান্ন/আটান্ন সালে মহাদেব সান্যালের মতােই তারও জীবিকা ছিলাে ছাত্র-পড়ানাে। আটান্নর আইয়ুবী আমল থেকে তাঁর পলাতক জীবন ও মাঝে মাঝে কারাবরণ।
কমরেড জ্যোতিষ বােসের সঙ্গেও আমার পরিচয় সেই উনিশোে সাতান্ন সালেই। দীর্ঘদিন পরে কারাগার থেকে বেরিয়ে এসে কম্যুনিস্টদের মধ্যে একটা সংসারী আমেজ দেখা দিয়েছিলাে। সে আমেজের মধ্যেই জ্যোতিষ বােস বিয়ে করলেন ছায়া সেনকে। ছায়া সেন তখন মাত্র ক্লাস এইটের ছাত্রী। তাকে নিয়ে সংসারও করবেন, আর পড়াশােনা করিয়ে ম্যাট্রিকটাও পাস করাবেন—এ-রকমই সংকল্প করেছিলেন কমরেড জ্যোতিষ বােস। ময়মনসিংহ রামকৃষ্ণ মিশনের কাছাকাছি অবস্থিত তার পৈতৃক বাসভবনের বৈঠকখানায় বসে আমাদের কাছে সেদিন তিনি তার সংসার-জীবনের পরিকল্পনার ছকটা তুলে ধরছিলেন। আমরা ছিলাম চারজন। আবদুল কুদুস, আবদুল আলী, বাণেশ্বর দাস আর আমি। চারজনই আনন্দমােহন কলেজের বিএ ক্লাসের ছাত্র। তার কথা শুনতে শুনতে আমরা রােমাঞ্চিত হয়ে উঠছিলাম। জেলে যাওয়ার গল্প, পলাতক থাকার গল্প, এমনকি পুলিশের হাতে নির্যাতিত হওয়ার গল্পও তিনি এমনভাবে বলে যাচ্ছিলেন যে, আমাদের মনে হচ্ছিলাে—এ সবই বুঝি খুব মজার ব্যাপার । আহা, এ-রকম মজা আমরাও যদি চেখে দেখতে পারতাম!
কিন্তু এ-সব যে মােটেই মজার ব্যাপার নয়, জ্যোতিষ বােসের—এবং আমাদের পরিচিত অন্য অনেক কমরেডের-জীবনের পরবর্তী অধ্যায়গুলাে একান্ত কাছে থেকে পর্যবেক্ষণ করে উপলব্ধি করেছিলাম। নিজের জীবনেও এ সবের তেতাে স্বাদ একেবারে কম পাইনি।
আরেক ছাত্র কম্যুনিস্টকে দেখেছিলাম- বিভূতি আচার্য যার নাম। মুক্তাগাছার জমিদার পরিবারের ছেলে। না, মুক্তাগাছার বিখ্যাত মহারাজার বাড়ির কেউ নয়। তবে ওই জমিদারিরই ছােটখাটো হিস্যা ছিলাে তাদের। আর ছােট সাপও তাে সাপই! ছােট হােক বড়াে হােক, জমিদার বাড়ির ছেলে বলতেই আমাদের সামনে একটা দূরত্বের ও বৃহত্ত্বের ছবি ফুটে উঠতাে। কিন্তু অবাক হলাম বিভূতি আচার্যকে দেখে। সাধারণ পােশাক পরা, সাধারণ মধ্যবিত্ত ছেলেদের মতােই চলাফেরা। একাধিক বার বিএ ফেল করলেও পাঠ্যতালিকা বহির্ভূত বইপত্র পড়ায় ভীষণ মনােযােগ। বিশ্বরাজনীতি, সংস্কৃতি, সাহিত্য ইত্যাদিতে তার জ্ঞানের গভীরতা দেখে আমরা চমকৃত হয়ে যেতাম।
প্রগতিশীল পত্রপত্রিকা বিক্রি করতে দেখেছি কমরেড ওয়াহেদ আলীকে। অ্যাকাডেমিক পড়াশােনা মােটেই বেশি কিছু নয়। কিন্তু দেশি-বিদেশি রাজনীতির জ্ঞান খুবই পাকা।
২২৮
ময়মনসিংহ শহরের পুরােনাে বাসিন্দাদের একজন। পরিবারের আর্থিক অবস্থাও খুব খারাপ ছিলাে না। সে-অবস্থাকে আরাে ভালাে করার কোনাে চেষ্টাই না করে কমরেড ওয়াহেদ ক্যুনিজমের আদর্শের বেদিমূলে জীবনের সব আরাম-আয়েশ বিসর্জন দিয়েছিলেন। অর্থাৎ জেলখাটা, আত্মগােপনে থাকা, আর প্রকাশ্য কাজের সুযােগ পেলে তার জন্যে একেবারে সর্বস্ব সমর্পণ করা।
নয়া জমানা পুঁথিঘরের আড়াতেই দেখেছি সদ্য জেল-ফেরত কমরেড বেণীমাধব দেবকে। সদা প্রফুল্ল আর সদা হাস্যময় মানুষটি। অথচ একটুকুতেই রেগে যান। তার এই দুর্বলতাটাকে কাজে লাগায় সবাই। সুযােগ পেলেই তাঁকে রাগিয়ে মজা দেখে। প্রৌঢ়ত্বের কোঠায় পা দিয়ে তখনাে, সেই সাতান্ন সালেও, তিনি কুমার। এই কৌমার্য ঘুচানাের ব্যাপারে তাঁর অভিনব সব প্রয়াসের মধ্যে বেশ মজার মজার উপাদান মিলতাে। আর প্রায়শই কৃত্রিমভাবে একেকটা রােমাঞ্চকর পরিস্থিতির সৃষ্টি করে নিয়ে বেণীবাবুর বন্ধুরা বেশ মজা করতেন।
অথচ, এ-সব ক্ষ্যাপামির পরও, তাঁর কম্যুনিস্ট সত্তাটি ছিলাে খুবই সিরিয়াস ও নির্ভেজাল। শেরপুরের কমরেড রবি নিয়ােগীর রিক্রুট কমরেড বেণীমাধব দেব সমাজ বদলানাের কাজে মনপ্রাণ সমর্পণ করে দিয়েছিলেন। ক্যুনিজমের আদর্শকে অঙ্গীকার করেই দারিদ্র্যকে বরণ করে নিয়েছিলেন। কিন্তু দারিদ্র্য তাঁকে মরণ কামড় দিতে ছাড়েনি। আমার সঙ্গে যখন তাঁর প্রথম পরিচয় তার বিশ বছর পর তাঁকে মৃত্যুবরণ করতে হলাে এই দারিদ্র্যের কামড়জনিত ক্ষতের দরুনই। প্রতিক্রিয়াশীল পাক শাসকদের অমানবিক অত্যাচার-উৎপীড়নের পাশাপাশি এই দারিদ্র্যের কামড়ে ক্ষতিবক্ষত হতে দেখেছি মহাদেব সান্যাল, জ্যোতিষ বােস, ওয়াহেদ আলীসহ আরাে অনেক কমরেডকে। কিন্তু সেই সঙ্গে অবাক বিস্ময়ে এও লক্ষ করেছি যে, সমাজের বিরূপতা, রাষ্ট্রের উৎপীড়ন দারিদ্র্যের দংশন—কোনাে কিছুই তাঁদের উঁচু মাথা নিচু করতে পারেনি, আদর্শ থেকে বিচ্যুত করতে পারেনি, কিংবা নৈরাশ্যের অন্ধকূপে নিমজ্জিত করতে পারেনি। পুরাণে নীলকণ্ঠের কথা পড়েছি যিনি সমুদ্রমন্থনজাত বিষ নিজে পান করে পৃথিবীকে বিষমুক্ত করেছিলেন। আর বাস্তবে পাকিস্তানি জামানার কম্যুনিস্টদের দেখে আমার মনে হয়েছে যে, এঁরা পুরাণকারের কল্পনার নীলকণ্ঠকেও ম্লান করে দিয়েছেন।
কম্যুনিস্টদের অজস্র ভুলের কথা আমি জানি। সেই সব ভুলের কথা তুলে অন্য অনেকের মতাে আমিও তাদের কম সমালােচনা করিনি। কিন্তু একান্ত কাছে থেকে যখন ক্যুনিস্টদের। দেখলাম তখন বুঝলাম যে, ভুলত্রুটির চেয়ে এঁরা অনেক অনেক বড়াে। নেত্রকোনার একজন। সুরসিক ক্যুনিস্ট ঠাট্টা করে বলতেন, ক্যুনিস্ট কথাটার অর্থ জানাে? কম+অনিষ্ট=কমানিষ্ট। এ থেকেই হয়েছে কম্যুনিস্ট’। অর্থাৎ যারা কম অনিষ্ট করে তারাই হচ্ছে কম্যুনিস্ট। অন্য সবাই সমাজের অনেক বেশি অনিষ্ট করে। সারা দুনিয়ায় কম্যুনিস্টরা যদি অনিষ্ট করেও থাকে, তবে করেছে খুব কম মানুষের।
ঠাট্টা করে তিনি বােঝাতে চাইতেন যে, বুর্জোয়া রাজনীতিকরা শতকরা পাঁচ/দশজন বুর্জোয়া পেটি বুর্জোয়ার ইস্ট করার লক্ষে শতকরা নব্বই জন মানুষের অনিষ্ট করে। আর কম্যুনিস্টরা শতকরা নব্বই জন শােষিত-বঞ্চিত মানুষের ইষ্ট করতে চায় বলে দশজনের অনিষ্ট তাদের করতেই হয়। এ কাজ করতে গিয়ে তারা অনেক ভুল করে বটে, কিন্তু অন্যায় করে না। কম্যুনিস্ট মানেই সত্যিকারের ন্যায়নিষ্ঠ।
২২৯
ডায়ালেকটিক বস্তুবাদী দর্শন ও চেতনার রূপান্তর
চুয়ান্ন সালের সাধারণ নির্বাচনের পর থেকেই ক্যুনিস্টদের সম্পর্কে আমার বিরূপতা কেটে যেতে থাকে। নেত্রকোনা কলেজে ভর্তি হওয়ার পর প্রগতিশীল ছাত্র আন্দোলনের সঙ্গে সংযুক্তি আমার ভাবনায় আরাে পরিবর্তন নিয়ে আসে। ময়মনসিংহে এসে কমুনিস্টদের নীলকণ্ঠ রূপ প্রত্যক্ষ করে তাে আমি পুরােপুরি অভিভূতই হয়ে পড়ি। তাছাড়া কম্যুনিস্টদের মুখেই তাদের আত্মসমালােচনা শুনে আমার সমালােচনার ধার ভোঁতা হয়ে আসে, বিরূপতা প্রায় মিলিয়ে যায়। ছেচল্লিশে পাকিস্তান দাবিকে সংখ্যালঘুর আত্মনিয়ন্ত্রণের স্বাভাবিক অধিকার বলে মনে করাটা ছিলাে একান্তই ভ্রান্ত—সাতান্ন সালে মুক্তকণ্ঠেই কম্যুনিস্টদের এ-কথা স্বীকার করে নিতে দেখি। এরপর পাকিস্তানােত্তর কালে, রনদিভে থিসিস’ যে ছিলাে একান্তই হঠকারী—এরকম কথা নয়াজমানা পুঁথিঘরের আড়ার অনেক কমুনিস্টকে অনেকবারই বলতে শুনেছি। অন্তত বায়ান্ন সাল থেকে যে পাকিস্তানের কম্যুনিস্টরা সঠিক পথে অগ্রসর হচ্ছিলাে—সাতান্ন। সালে এ-রকম ধারণা আমার মনে দৃঢ়মূল হয়ে যায়। পাকিস্তানের অন্যতম জন্মবীজরােপণকারী হয়ে ব্রিটিশ ভারতের কম্যুনিস্ট পার্টি যে পাপ করেছিলাে, পাকিস্তানে বসবাসকারী কম্যুনিস্টরা—বিশেষ করে হিন্দু কম্যুনিস্টরা—তারই প্রায়শ্চিত্ত করে চলছিলাে। তাদের সব কর্মকাণ্ড যে পাকিস্তানের মৃত্যুবীজকে লালন করার কাজেই নিবেদিত, পাকিস্তানি শাসকগােষ্ঠীর উপলব্ধিতে তা সঠিকভাবেই ধরা পড়ে। সেই উপলব্ধি থেকেই তারা কম্যুনিস্টদের সম্পর্কে অতিমাত্রায় সতর্ক হয়ে ওঠে, পাকিস্তানের মৃত্যু ঠেকাবার লক্ষেই কম্যুনিস্ট-দমনে উঠে পড়ে লেগে যায়।
এ-সময়ে কম্যুনিস্টরা সমাজ ও রাজনীতির যে-ধরনের ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ হাজির করতাে, কিংবা বিভিন্ন গণসংগঠনের মাধ্যমে যে সব কর্মসূচি গ্রহণ করতাে, সেগুলাে সবই আমার কাছে সঠিক বলে মনে হতাে। কাজী আবদুল বারি, অজয় রায় আর জ্যোতিষ বােসের পরামর্শে ছাত্রসমাজের মধ্যে এ সবের প্রচারকাজেও তাই উৎসাহের সঙ্গেই লেগে গিয়েছিলাম।
এখন যেমন সাহিত্যিক-খ্যাতি-পাগল ছাত্র-তরুণরা নানাভাবে গােষ্ঠীবদ্ধ হয়ে ‘লিটল ম্যাগাজিন’ বা ‘অনিয়মিত সাহিত্য-সংকলন প্রকাশ করে, আমরা যখন কলেজে পড়ি তখন আমাদের পক্ষে তেমনটি করা সম্ভব হতাে না। অন্তত মফস্বল শহরে তাে নয়ই। সে-সময়ে ‘প্রতিভা’ জাহিরের জন্যে আমরা যে মাধ্যমটিকে বেছে নিতাম সেটি হচ্ছে ‘দেয়াল পত্রিকা। আনন্দমােহন কলেজে ভর্তি হয়েই এ-রকম অনেকগুলাে দেয়াল পত্রিকা দেখতে পেলাম। কিন্তু এর কোনােটিকেই আমার কাছে খুব মানসম্মত বলে মনে হলাে না। একদিন সুধীর দাসের সঙ্গে এ-নিয়ে কথা বলছিলাম। সুধীর সঙ্গে সঙ্গে প্রস্তাব দিলাে, ‘চলাে, আমরাই একটা পত্রিকা বের করে ফেলি। আমিও তার প্রস্তাবে সঙ্গে সঙ্গেই সায় দিলাম। কয়েক দিনের মধ্যেই আনন্দমােহন কলেজের দেয়ালে শােভা পেলাে ‘দিশারি। এই দেয়াল পত্রিকাটির সম্পাদক যতীন সরকার, শিল্পী সুধীর দাস আর প্রকাশক আমিনুল ইসলাম।
সুধীর দাসও নেত্রকোনা কলেজ থেকেই আইএ পাস করে আনন্দমােহনে এসে বিএ ক্লাসে ভর্তি হয়েছিলাে। সে হলাে একজন স্বভাবশিল্পী। ছবি আঁকায় তার হাত এতাে চমৎকার যে, এবিষয়ে কোনােরূপ আনুষ্ঠানিক শিক্ষাই যে সে কোথাও পায়নি, সে কথা কেউই বিশ্বাস করতাে না। পঞ্চান্ন-ছাপ্পান্ন সালে নেত্রকোনা শহরের কম্যুনিস্টরা তাকে দিয়ে নানা ছবি আঁকিয়ে নিয়ে প্রদর্শনীর ব্যবস্থা করেছিলাে, তার আঁকা ছবিগুলাের মধ্যে এ-দেশের মানুষের দুঃখদুর্দশা ও
২৩০
নানা আন্দোলনের রূপ খুবই চমৎকারভাবে মূর্ত হয়ে উঠেছিলাে। কম্যুনিস্টদের প্রেরণাতেই স্বভাবশিল্পী থেকে সুধীর হয়ে উঠেছিলাে গণশিল্পী। ময়মনসিংহে এসে তার সেই গণশিল্পী সত্তাটারই চরিতার্থতা ঘটলাে দিশারিকে কেন্দ্র করে। দিশারির সম্পাদকীয় লিখতাম আমি, আর সে-সম্পাদকয়িকে সচিত্র করে তুলতাে সুধীর। সুধীরের আঁকা কার্টুনগুলাে তাে অনেকের গায়ে বিছুটির জ্বালা ধরিয়ে দিতাে। দিশারির লেখাগুলাে এমন উগ্র হয়ে উঠেছিলাে যে, অচিরেই এটি কম্যুনিস্টদের দেয়ালপত্র হিসেবে পরিচিত হয়ে গেলাে। আর আমার সঙ্গে সঙ্গে সুধীরের গায়েও কম্যুনিস্টের ছাপ পড়ে গেলাে। আসলে সুধীর ছিলাে মূলত শিল্পী এবং শিল্পী বলেই অতিমাত্রায় সংবেদনশীল। সেই সংবেদনশীলতা থেকেই সে কম্যুনিস্টদের সঙ্গে মিশে গিয়েছিলাে, ক্যুনিজমের দর্শন বা কমুনিস্ট পার্টির কর্মসূচির খুঁটিনাটি নিয়ে সে মাথা ঘামাতাে না।
আমি নিজেও ক্যুনিজমের দর্শনটি সহজে গ্রহণ করতে পারিনি। কম্যুনিস্টদের সংস্পর্শে এসে তাঁদের প্রতি শ্রদ্ধা উত্তরােত্তর বেড়ে গেলেও তাদের নাস্তিক্য আমার মােটেই ভালাে লাগতাে না।
বঙ্কিমচন্দ্র-বিবেকানন্দ প্রমুখ চিন্তাবিদের হিন্দু ধর্মের যুক্তিবাদী ব্যাখ্যার সঙ্গে আমি ছেলেবেলা থেকেই পরিচিত হয়ে উঠেছিলাম। ব্রাহ্ম সমাজের ধর্মভাষ্যও আমাকে আকর্ষণ করেছিলাে। স্কুল জীবনেই পুরােনাে তত্ত্ববােধিনী পত্রিকার অনেকগুলাে সংখ্যা আমার হাতে পড়ে। আমি গােগ্রাসে গিলতে থাকি সেগুলাে। হযরত মুহম্মদের জীবনকথা ও ইসলামের তত্ত্বব্যাখ্যামূলক অনেক বই ও প্রবন্ধ আমি কলেজে ঢােকবার আগেই পড়ে ফেলি। এ-সব পড়ার ফলে নিজেকে আমি সাম্প্রদায়িক ধর্মের ঊর্ধ্বে বলে ভাবতে থাকি। পৃথিবীর বিভিন্ন ধর্মকে ঐতিহাসিক দৃষ্টিতে পর্যালােচনা করার একটা অভ্যাস আমার মধ্যে গড়ে উঠতে থাকে, ধর্ম সম্পর্কে তর্কবিতর্ক আমার খুব প্রিয় হয়ে ওঠে। কিন্তু ধর্মবিরােধিতা বা নাস্তিক্য আমি বরদাশত করতে পারতাম না। অর্থাৎ আমি হয়ে উঠেছিলাম একজন যুক্তিশীল ভাববাদী। ঈশ্বরের ব্যক্তিক রূপে আমার বিশ্বাস ছিলাে না, কিন্তু একটা নৈর্ব্যক্তিক ঐশ্বরিক শক্তিতে আমি বিশ্বাসী ছিলাম। সেই ঐশ্বরিক শক্তিতে শক্তিমান ছিলেন বিভিন্ন যুগের অবতার, নবী বা মহাপুরুষবৃন্দ—এ ব্যাপারেও ছিলাম নিঃসংশয়।
নেত্রকোনার কলেজ-জীবনের একটি দিনের কথা এখনাে আমার মনে পড়ে। মাত্র কয়েকদিন আগে কলেজে ভর্তি হয়েছি। শিক্ষক ও সহপাঠিদের কাছে তখনাে প্রায় অপরিচিতই। এরই মধ্যে একদিন ইসলামের ইতিহাসের ক্লাসে অধ্যাপক জিজ্ঞেস করলেন, ‘কোরানের একেবারে প্রথম যে সুরাটি অবতীর্ণ হয়েছিলাে তার প্রথম কথাগুলাে কী?’
ক্লাসভর্তি ছাত্র সবাই চুপ। কেউই উত্তর দিতে পারছে না। আমি তখন আস্তে আস্তে উঠে বললাম, “ইকরা বিসূমে রাব্বিকাল্লাজি খালাক…।’
সেদিন ধুতি পরে ক্লাসে গিয়েছিলাম। তাই সবার দৃষ্টি আমার ওপর পড়লাে। অধ্যাপক অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, তুমি কী করে জানাে? তুমি কি আরবি পড়েছাে?’
আমি সবিনয়ে জানালাম যে, আরবি ভাষার সঙ্গে আমার পরিচয় নেই, তবে ইসলাম সম্পর্কে বিভিন্ন বাংলা বইয়ে পড়া অনেক আরবি শব্দ বা বাক্যাংশ আমার মুখস্থ হয়ে গেছে। অধ্যাপক আবদুল গনি তখন আমাকে ক্লাসের পর তার সঙ্গে দেখা করতে বললেন। তিনি কোরান শরীফের একটি ইংরেজি অনুবাদগ্রন্থ আমাকে পড়তে দিলেন। বিপুল উৎসাহে সেই বইটি আমি পড়ে ফেলেছিলাম। বিশেষ করে সে-বইয়ের প্রায় আশি পৃষ্ঠাব্যাপী ভূমিকাটি আমি
২৩১
খুব যত্নের সঙ্গে পাঠ করেছিলাম। অধ্যাপক গনির কাছ থেকে উৎসাহ পেয়ে ইসলাম সম্পর্কে পড়াশােনা করার আগ্রহ আমার আরাে বেড়ে গিয়েছিলাে।
সেই আগ্রহ নিয়েই আনন্দমােহন কলেজের কেরানি মােহিনী বাবুর কাছ থেকে এনে পড়েছিলাম মানবেন্দ্রনাথ রায়ের হিস্টরিক্যাল রােল অব ইসলাম বইটির অধ্যাপক আবদুল হাইকৃত বাংলা অনুবাদ ইসলামের ঐতিহাসিক অবদান। পরে মানবেন্দ্রনাথের মূল ইংরেজি বইটিরও এক কপি জোগাড় করে পড়েছিলাম। ছেলেবেলা থেকেই ইসলাম ও হযরত মুহম্মদ সম্পর্কে যে গভীর শ্রদ্ধা পােষণ করে আসছিলাম, সন্দেহ নেই, মানবেন্দ্র নাথের বইটি পড়ে সে শ্রদ্ধা আরাে গভীর ও যুক্তিভিত্তিক হলাে। কিন্তু আমার অভ্যস্ত চিন্তায় একটা প্রচণ্ড আঘাত হানলাে এ বইয়ের প্রত্যাদেশ সম্পর্কিত বস্তুবাদী ব্যাখ্যাটি। আমি নিজেকে যুক্তিবাদী বলেই মনে করতাম। আসলে আমার সে যুক্তি ছিলাে ব্রাহ্মসমাজের ব্রহ্মের নিরাকারত্ব প্রতিপাদন কিংবা বঙ্কিম-বিকেকানন্দের হিন্দুধর্মের আধুনিক ব্যাখ্যার পরিধির মধ্যে আবদ্ধ, বস্তুবিজ্ঞানের কষ্টিপাথরে বিচার করলে সে যুক্তির ভিত্তিই যে নড়ে ওঠে, মানবেন্দ্রনাথের বই আমাকে সেই সত্যের মুখােমুখি এনে দাঁড় করিয়ে দিলাে। কিন্তু সে- সত্যের তীব্র আলাে আমি ঠিক সহ্য করে উঠতে পারছিলাম না। অধ্যাত্ম শক্তির কোনাে অস্তিত্বই নেই, সবকিছুই বস্তু ও বস্তুর শক্তিতে চলে, ঐশ্বরিক প্রত্যাদেশের মতাে ব্যাপারটিও একটি বস্তুগত ব্যাপার মাত্র—এ-সব কথা আমার কাছে একবােরেই অসহনীয় মনে হলাে। আমার সমস্ত সত্তা এর বিরুদ্ধে চিৎকার করে উঠতে চাইলাে, আবার সে-চিৎকারের শক্তিও যেনাে আমার ভেতর থেকে উবে গিয়েছিলাে। প্রত্যাদেশ সম্পর্কে মানবেন্দ্রনাথের ব্যাখ্যা গ্রহণ করা যেমন আমার পক্ষে সম্ভব হচ্ছিলাে না, তেমনি সে-ব্যাখ্যাকে অগ্রাহ্য করার মতাে কোনাে জোরালাে যুক্তিও আমি খুঁজে পাচ্ছিলাম না।
সে যে কি এক যন্ত্রণাকর অবস্থা! এ যেনাে ত্রিশঙ্কুর মতাে স্বর্গ আর মর্ত্য, বিশ্বাস আর অবিশ্বাস, আস্থা আর অনাস্থা, আস্তিকতা আর নাস্তিকতার মধ্যবর্তী এক নিরপেক্ষ এলাকায় অবস্থান। সে-এলাকায় অবস্থানের যন্ত্রণা সবাইকে জীবনের কোনাে না কোনাে সময়ে ভােগ করতে হয় কি না, আমার জানা নেই। কিন্তু আমি এ যন্ত্রণাকর অবস্থানে কিছুকালের জন্যে হলেও থেকেছি এবং বুঝেছি যে, এ অবস্থানে বেশিদিন বাস করা যে কোনাে মানুষের পক্ষেই অসম্ভব।
এই দুঃসহ অবস্থা থেকে আমাকে মুক্তির পথ দেখালেন কমরেড রতু রায়। আমার কথাবার্তা থেকে তিনি আমার মানসিক সংকটের স্বরূপটি উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন। ভাববাদ এবং বস্তুবাদের পার্থক্য সম্পর্কে প্রাথমিক কথাগুলাে আলােচনা করে তিনি চেষ্টা করলেন যাতে আমি চিন্তার বিভ্রান্তি কাটিয়ে উঠতে পারি। আমার হাতে তুলে দিলেন ছােট্ট একটি বই—জোসেফ স্তালিনের দ্বন্দ্বমূলক ও ঐতিহাসিক বস্তুবাদ। বইটি আমি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পড়লাম। এ-বইটা পড়েই যেনাে আমার মনের কতকগুলাে গিট খুলে গেলাে। মানবেন্দ্রনাথ রায়ের বইটির বক্তব্যও আমার কাছে অনেকখানি পরিষ্কার হয়ে এলাে। ভাববাদী যুক্তিবাদের সঙ্গে বস্তুবাদী যুক্তিবাদের পার্থক্যটাও উপলব্ধি করতে পারলাম।
এ ব্যাপারে আমাকে আরাে সাহায্য করলেন কমরেড অজয় রায় ও কমরেড জ্যোতিষ বােস। জ্ঞানের বিভিন্ন ক্ষেত্রে অজয়দার বিচরণ। ইতিহাস থেকে দর্শন, সমাজতত্ত্ব থেকে সাহিত্য—সব বিষয়কেই তিনি দেখতেন দ্বান্দিক বস্তুবাদী দৃষ্টিকোণ থেকে। দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদের সঙ্গে যান্ত্রিক বস্তুবাদের পার্থক্যটি অজয়দাই আমার কাছে স্পষ্ট করে তুলে ধরেন। মানবেন্দ্রনাথ
২৩২
রায়ের চিন্তার বিভ্রান্তি ও সীমাবদ্ধতা সম্পর্কেও আমি সচেতন হতে পারি অজয়দার আলােচনা শুনেই। মরিস কর্নফোর্থ, রাহুল সাংকৃত্যায়ন আর সুশােভন সরকারের বই পড়ার পরামর্শও তিনিই আমাকে দিলেন। সৃশৃঙ্খলভাবে পড়াশােনা করার ব্যাপারে সেদিন যদি অজয়দার সাহায্য না পেতাম, তবে আমার বিভ্রান্তি যে কোন পর্যন্ত গিয়ে গড়াতাে—আজকে তা ভাবতেও পারি না।
আর জ্যোতিষ দা আমাকে ধারণা দিলেন বিপ্লবী সংগঠন সম্পর্কে। বস্তুবাদী দৃষ্টিভঙ্গিটি যে কেবল আলােচনা বা পড়াশােনা করেই পুরাে আয়ত্ত করা যায় না, বাস্তব কর্মক্ষেত্রে বিপ্লবী কর্মকাণ্ডের সঙ্গে যুক্ত হয়েই যে কেবল একজন মানুষ জীবন ও জগত সম্পর্কে সঠিক ধারণাটি অর্জন করতে পারে—জ্যোতিষ দা আমাকে সেই দিকটিই বুঝিয়ে দিলেন। নেত্রকোনার আবদুল কুদুস আগে থেকেই কম্যুনিস্টদের সঙ্গে সাংগঠনিকভাবে যুক্ত ছিলেন। আমার চেয়ে বয়সে বেশ কয়েক বছরের বড়াে হয়েও ময়মনসিংহে আমার সহপাঠি হওয়াতে এবং নয়াজামানা’র আড্ডাধারী হওয়াতে, তার সঙ্গে আমার অন্তরঙ্গ সম্পর্ক গড়ে ওঠে। জ্যোতিষদার সঙ্গে আমার ঘনিষ্ঠ সংযােগ আসলে তিনিই ঘটিয়ে দেন। ময়মনসিংহের ছাত্রজীবনে জ্যোতিষদার সঙ্গে মাত্র কয়েকদিনই দীর্ঘসময়ব্যাপী বৈঠকের সুযােগ পেয়েছিলাম। এই বৈঠকগুলােই আমার চেতনার রূপান্তরে দীর্ঘস্থায়ী অবদান রেখেছে।
মানবেন্দ্রনাথ রায়ের ইসলামের ঐতিহাসিক অবদান-এ উল্লিখিত আধ্যাত্মিক উপলব্ধির বস্তুবাদী ব্যাখ্যা পাঠ করে আস্তিকতা ও নাস্তিকতার মধ্যবর্তী যে যন্ত্রণাময় এলাকায় আমি নিক্ষিপ্ত হয়েছিলাম, ডায়ালেকটিক বস্তুবাদের সঙ্গে পরিচয় সে-এলাকা থেকে আমাকে উদ্ধার করলাে। এ-অবস্থানে উত্তরিত হতে অবিশ্যি আমার বেশ কয়েক মাস সময় লেগেছিলাে। কিন্তু যখন ডায়ালেকটিক বস্তুবাদের মােটামুটি মর্ম গ্রহণে সক্ষম হলাম, তখন যথার্থই একটা অনির্বচনীয় তৃপ্তিতে সমস্ত মনপ্রাণ ভরে গেলাে। বলতে গেলে, একটা নতুন মানুষে রূপান্তরিত হয়ে গেলাম আমি। আমার পূর্বেকার জীবনদৃষ্টি আমার নিজের কাছেই একটা কৌতুকের বিষয়ে পরিণত হলাে। সে সময় থেকে এ বিশ্বাস আমার সত্তার সঙ্গে দৃঢ়মূল হয়ে গেছে যে, একজন লােক যতাে গভীর ও বিস্তৃত পাণ্ডিত্যের অধিকারীই হােক না কেন, ডায়ালেকটিক বস্তুবাদী দৃষ্টিভঙ্গি আয়ত্ত করতে না পারলে তার পাণ্ডিত্য তাকে এমন সব অসঙ্গতির পাঁকে নিক্ষেপ করবে, যা থেকে তার উদ্ধার পাওয়া অসম্ভব।
আস্তে আস্তে অবিশ্যি এও উপলব্ধি করতে পারি যে, বই পড়ে ডায়ালেকটিকের কয়েকটি সূত্র মুখস্থ করতে পারাটাই যথেষ্ট নয়। মুখস্থ করা ডায়ালেকটিক বরং মানসিক অগ্নিমান্দ্য ও অজীর্ণের সৃষ্টি করে। আর এ ধরনের অজীর্ণগ্রস্ত ব্যক্তিদের দুর্গন্ধযুক্ত উদগারে আশপাশের পরিবেশ পর্যন্ত দূষিত হয়ে ওঠে।
আসলে ডায়ালেকটির বস্তুবাদী দর্শন বুদ্ধির ব্যায়াম মাত্র নয়। এটি জগত ও জীবনকে অবলােকনের বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি যেমন তেমনি এটি একটি বিরাট ও মহান ভাবাদর্শ এবং এহচ্ছে শ্রমিক শ্রেণীর দর্শন। শ্রমিক শ্রেণীর একজন রূপে আন্তর্জাতিকতার চেতনাদীপ্ত সংগঠনের সঙ্গে একাত্ম হয়েই এ-দর্শনটি আয়ত্ত করা সম্ভব। এ-দর্শন তত্ত্ব ও প্রয়ােগের মণিকাঞ্চনসম্মিলনে সৃষ্ট। প্রয়ােগহীন তাত্ত্বিকতা দিয়ে যারা ‘সেলফস্টাইলড’ ডায়ালেকটিক বস্তুবাদী হন, তাদের অনেকেরই করুণ পরিণতি আমি বিভিন্ন সময়ে প্রত্যক্ষ করেছি।
তাছাড়া, এ-দর্শনটির সূত্র একবার আয়ত্ত হয়ে গেলে চিরকালের জন্যেই নিশ্চিত হওয়া গেলাে, তেমনটিও অবশ্যই নয়। প্রতিদিনের কর্মপ্রবাহের সঙ্গে এ-দর্শনের তত্ত্ব ও প্রয়ােগকে
২৩৩
মিলিয়ে নিতে না পারলে কিংবা কোনাে না কোনােভাবে সাংগঠনিক বিচ্ছিন্নতা ঘটে গেলে জীবন থেকে ডায়ালেকটিকের সূত্র হারিয়ে যায়। আর তখনই নানা অপদর্শন মাথায় এসে ভর করে, সে-সব দর্শন দিয়ে ডায়ালেকটিককে ‘শােধন করে নেয়ার চিন্তাও মনে জাগে। তাছাড়া, আমাদের সমাজের বাস্তব পরিবেশটাই সঠিক দর্শনকে ধরে রাখার এতাে প্রতিকূল যে, পদস্খলনের আশঙ্কা থাকে পদে পদে। বিশেষ করে মধ্যবিত্ত সমাজের মানুষের জন্যে এ-পথ তাে একেবারেই ক্ষুরধার। অনেক ঝড় ঝাপটার মধ্যে সঠিক দর্শনটিকে ধরে রাখার পরও তাে জীবনের একেবারে উপান্তে এসে চিন্তায় ও কর্মে অনেককেই দেউলিয়া হয়ে যেতে দেখেছি।

সাম্প্রদায়িক পাকিস্তানে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ভাববাদী বিভ্রম ও হতাশা
সাতান্ন সালের নভেম্বর কি ডিসেম্বরে একটি অনুষ্ঠান হয়েছিলাে ময়মনসিংহ শহরের দুর্গাবাড়িতে। সে অনুষ্ঠানে ঢাকাস্থ তৎকালীন ভারতীয় ডেপুটি হাইকমিশনারকে সংবর্ধনা দেয়া হয়েছিলাে। সংবর্ধনা সভাটির উদ্যোক্তা ছিলাে ময়মনসিংহের হিন্দুদের শতাব্দী প্রাচীন সংগঠন ‘আর্যধর্ম-জ্ঞান-প্রদায়িনী সভা’। সংক্ষেপে যার পরিচয় ‘ধর্মসভা’ নামে। দুর্গাবাড়িই এই ধর্মসভার কর্মকেন্দ্র তথা প্রাণকেন্দ্র। উনিশ শতকে ব্রাহ্ম আন্দোলনের চ্যালেঞ্জের মুখে ময়মনসিংহের সনাতনপন্থী হিন্দুরা এই ধর্মসভার প্রতিষ্ঠা করেছিলাে। সে সভাকে কেন্দ্র করেই এখানে হিন্দু পুনরুজ্জীবনবাদী আন্দোলন জোরদার হয়ে উঠেছিলাে। ধর্মসভারই আমন্ত্রণে উনিশ শতকের শেষ দশকে দুর্গাবাড়িতে এসে বক্তৃতা দিয়েছিলেন তথাকথিত বৈজ্ঞানিক হিন্দুধর্মের অন্যতম প্রবক্তা শশধর তর্কচূড়ামণি ও থিওসফিক্যাল সােসাইটির প্রতিষ্ঠাত্রী বিদেশিনী মহিলা এ্যানি বেসান্ত। উনিশ শতকের ষাটের দশকে ময়মনসিংহের দুর্গাবাড়িতে প্রতিষ্ঠিত ‘ধর্মসভা অনেক চড়াই-উত্রাই বেয়ে আজো বিশ শতকের উপান্তে এসেও বেশ সচল ও সক্রিয় রয়ে গেছে।
সাতান্ন সালে সেই ধর্মসভার পক্ষ থেকে দুর্গাবাড়িতে যারা ভারতীয় ডেপুটি হাইকমিশনারকে সংবর্ধনা জ্ঞাপন করেছিলেন তাদের কাউকেই আমি তখন চিনতাম না, তাদের কারাে নামও আমার এখন মনে নেই। তবে, সে-সময়ে ধর্মসভার কর্মকর্তাদের মধ্যে যে ছিলেন ময়মনসিংহের অনেক প্রবীণ হিন্দু আইনজীবী, চিকিৎসক, অধ্যাপক ও অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মচারি এবং এঁদের মধ্যে আইনজীবীদেরই ছিলাে প্রাধান্য—সে-কথা আমার জানা ছিলাে। সেদিন একজন প্রবীণ আইনজীবী ডেপুটি হাইকমিশনারের উদ্দেশে ইংরেজিতে লেখা যে দীর্ঘ মানপত্র পাঠ করেছিলেন তার মূল বক্তব্যটি আমার আজো বেশ মনে আছে। সে-সময়কার পূর্ব পাকিস্তানের হিন্দু সম্প্রদায়ের নানা দুঃখ-দুর্দশার বিবরণে ভরা ছিলাে সেই মানপত্রটি। এ দেশের হিন্দুদের প্রতি পাকিস্তান সরকারের নানা বৈষম্যমূলক আচরণের খুঁটিনাটি বর্ণনা দিয়ে মানপত্রটিতে ভারতীয় ডেপুটি হাইকমিশনারের সক্রিয় সহানুভূতি আকর্ষণের চেষ্টা করা হয়েছিলাে। মানপত্রে লিখিত বিবরণ যে একান্তই সত্য ছিলাে সে-কথা অস্বীকার করা যাবে না। দ্বিজাতিতত্ত্বের নিষ্পেষণে পাকিস্তানের হিন্দুদের জীবন যে দুঃসহ হয়ে উঠেছিল, তা তাে সকলেরই জানা।
কিন্তু এ-সব কথা ভিন্ন রাষ্ট্রের একজন ব্যক্তিকে জানানাের সার্থকতা কোথায়? এ রকম করা কি বেআইনি নয়?…আবার, তাই-বা কী করে হয়? ময়মনসিংহের ঝানু আইনজ্ঞরা কি কোনটা আইনি আর কোনটা বেআইনি জানেন না?
২৩৪
যতােক্ষণ মানপত্র পাঠ হচ্ছিলাে ততােক্ষণ এ সব প্রশ্নই আমার মনে খোঁচা দিচ্ছিলাে। সেরকম খোঁচা সম্ভবত সংবর্ধিত কূটনীতিকটির মনেও লাগছিলাে। তাই বােধ হয় সংবর্ধনার উত্তরে তিনি বললেন : আপনাদের দুঃখদুর্দশার বিবরণ শুনে আমি খুবই বিচলিত। আপনাদের প্রতি আমার সহানুভূতির অন্ত নেই। আপনাদের সমস্যা আমি বুঝি। কিন্তু অত্যন্ত দুঃখের সঙ্গে এ-ও আমাকে বলতে হচ্ছে যে, আপনাদের সমস্যা সমাধানে কোনাে ভূমিকা রাখার যােগ্য আমি নই। আপনারা যে রাষ্ট্রের নাগরিক সেই রাষ্ট্রের কর্তৃপক্ষের হাতেই নিহিত রয়েছে আপনাদের সমস্যা সমাধানের চাবিকাঠি। আপনারা নিজেরাই সেই কর্তৃপক্ষের সঙ্গে বােঝাপড়া করবেন, সমাধানের সূত্রও আপনারাই অন্বেষণ করে নেবেন। আমি কেবল আপনাদের প্রতি আমার আন্তরিক শুভেচ্ছাই জ্ঞাপন করতে পারি। এর বেশি কিছু নয়।
এ রকম আরাে কিছু সহানুভূতিসূচক কথাবার্তা বলে ভারতীয় কূটনীতিক তার বক্তব্য শেষ করলেন এবং ভারতীয় জনগণের শুভেচ্ছার নিদর্শনস্বরূপ কিছু বই দুর্গাবাড়ি ধর্মসভা পাঠাগারে উপহার দেয়ার কথা ঘােষণা করলেন।
তার এ-রকম বক্তব্যে সমাগত হিন্দু শ্রোতারা মােটেই খুশি হতে পারেনি। তাদের কথা হচ্ছে: আমরা যে পাকিস্তানে ধর্মীয় সংখ্যালঘু রূপে নানা বৈষম্যের শিকার হচ্ছি ও নানা ধরনের নির্যাতন ভােগ করছি তার জন্যে তাে ভারতীয় নেতারাই দায়ী, তারাই তাে ধর্মের ভিত্তিতে দেশবিভাগ মেনে নিয়ে আমাদেরকে নেকড়ের মুখে ফেলে দিয়ে গেছে। এখন তারা দায়িত্ব অস্বীকার করবে কী করে? পঞ্চাশ সালে নেহরু-লিয়াকত চুক্তিতে স্বাক্ষর দিয়ে পাকিস্তানের সংখ্যালঘুদের ভালােমন্দ দেখার দায়িত্বের কথা তাে তারা স্বীকারই করে নিয়েছে। এখন সেকথা ভুলে গেলে চলবে কেন?
পঞ্চাশের দশকে পূর্ব পাকিস্তানি হিন্দুদেরকে কতাে ধরনের মানসিক আশ্রয়ই না আঁকড়ে ধরতে দেখেছি! নেহেরু-লিয়াকত চুক্তির অভিনব ব্যাখ্যার মতাে হিন্দুরা আরেকটি বড়াে আশ্রয় ও আশ্বাসের কল্পসৌধ নির্মাণ করে নিয়েছিলাে নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসুকে ঘিরে। নেতাজীকে নিয়ে কতাে ধরনের কল্পনারই না তারা বিস্তার ঘটিয়েছে! নেতাজীর মৃত্যুসংবাদকে সত্য বলে বিশ্বাস করতাে এ-রকম হিন্দু আমি পঞ্চাশের দশকের শেষেও খুব বেশি দেখিনি। নেতাজী অবশ্যই জীবিত আছেন এবং তিনি একদিন সশরীরে আবির্ভূত হয়ে খণ্ডিত ভারতকে আবার অখণ্ড করে তুলবেন, হিন্দু-মুসলমান আর ভাই ভাই ঠাই ঠাই হয়ে থাকবে না, পাকিস্তান আর হিন্দুস্থান এই দু’রাষ্ট্রেরই অবলুপ্তি ঘটে যে নতুন রাষ্ট্রটির সৃষ্টি হবে তার সর্বাধিনায়ক হবেন নেতাজী এমন ধরনের কল্পনার জাল শুধু অশিক্ষত-অর্ধশিক্ষিত হিন্দুরাই বুনতাে না, অনেক সুশিক্ষিত’ হিন্দুও এ-রকম জাল বােনায় শরিক হতাে। এ-সময়েই হঠাৎ খবর রটে গেলাে যে, পশ্চিমবঙ্গের জলপাইগুড়ি জেলার শৌলমারিতে এক অলৌকিক ক্ষমতাসম্পন্ন সাধুর আবির্ভাব ঘটেছে। এই সাধু আর কেউ নন, ইনিই হচ্ছেন নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু। লাখ লাখ লােক প্রতিদিন যাচ্ছে এই সাধু সন্দর্শনে এবং তারা সকলে এমন সব নিদর্শন দেখে আসছে যাতে অকাট্য প্রমাণ মিলছে যে সাধু রূপেই নেতাজী আবির্ভূত হয়েছেন! নেতাজীর এক ভ্রাতুস্পুত্রও না-কি শৌলমারিতে গিয়ে নিঃসন্দেহ হয়ে এসেছেন যে, এই সাধুই তারা কাকা অর্থাৎ সুভাষচন্দ্র বসু। অতএব, আর ভয় নেই! নেতাজী এবার এসেছেন আধ্যাত্মিক শক্তিতে শক্তিমান হয়ে! তার এই আধ্যাত্মিক শক্তির কাছে পরাভূত হবে সব আসুরিক শক্তি!! সম্ভবামি যুগে যুগে বলে যে আশ্বাসবাণী দ্বাপরে শ্রীকৃষ্ণের শ্রীমুখে উচ্চারিত হয়েছিলাে, কলিযুগে তাই বাস্তব হয়ে উঠবে সুভাষচন্দ্রের মধ্যদিয়ে।
২৩৫
লােকসেবক নামে একটি বাংলা দৈনিক আসতাে কোলকাতা থেকে। সেই লােকসেবকে ধারাবাহিক প্রতিবেদন প্রকাশিত হতাে শৌলমারিতে সাধুরূপে আবির্ভূত নেতাজী সুভাষ চন্দ্র (!) সম্পর্কে। প্রতিদিনই এই প্রতিবেদনে রহস্য রােমাঞ্চে ভরা নানা ঘটনা ও রটনার কথা থাকতাে। নেত্রকোনা ও ময়মনসিংহ শহরে হিন্দুদের কয়েকটি দোকানে লােকসেবক আসার সঙ্গে সঙ্গে পত্রিকাটি নিয়ে কাড়াকাড়ি পড়ে যেতে দেখেছি। কে কার আগে শৌলমারির সাধুর খবর জেনে নেবে, জেনে সুভাষচন্দ্রের আধ্যাত্মিক শক্তিতে আবির্ভাব সম্পর্কে নিঃসংশয় হবে। এমনিভাবেই হিন্দুরা যুগে যুগে অবতারবাদের কিংবা অবতার-প্রতিম মানুষের আধ্যাত্মিক ক্ষমতায় বিশ্বাস করে শক্তি ও স্বস্তি পেতে চেয়েছে। সেই চিরাচরিত পথ ধরেই তারা, বিংশ শতকের মধ্যপর্বেও, সুভাষচন্দ্রের মতাে সেকুলার রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বকে আধ্যাত্মিক রহস্যময়তায় মুড়ে প্রায়-অবতার বানিয়ে ছেড়েছে।
এ-সময়ে আরেকজন মনীষীরও অবতারত্বের কথা বেশ জোর প্রচার পেয়ে যায়। তিনি শ্রীঅরবিন্দ। অরবিন্দ অবিশ্যি ঋষি অরবিন্দ পরিচয়েই আগে থেকে পরিচিত, কাজেই তার পক্ষে অবতার হয়ে যাওয়াটা মােটেই অস্বাভাবিক কিছু নয়। তবে মজার কথা হলাে, পাকিস্তানি হিন্দুদের কাছে অরবিন্দের অবতার রূপটি প্রকটিত হয়েছিলাে তার জীবনাবসানের পরে। বাল্যকাল থেকেই ইউরােপের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে আধুনিক পাশ্চাত্য শিক্ষাপ্রাপ্ত অরবিন্দ, সকলকে অবাক করে দিয়ে, চিন্তাচেতনায় হয়ে ওঠেন ঘাের প্রাচ্যপন্থী ও ভারতীয় জাতীয়তাবাদী হিন্দু। উনিশ শাে পাঁচ সালের স্বদেশী আন্দোলনে যােগ দিয়ে রাজদ্রোহের অপরাধে ধৃত হওয়ার পরই তিনি হঠাৎ করে হয়ে গেলেন যােগী ও ঋষি, ফরাসি-অধিকৃত পণ্ডিচেরিতে আশ্রম স্থাপন করে দিকে দিকে ছড়িয়ে দিলেন তার ঋষিত্রে বিভূতি। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ পর্যন্ত তাকে শ্রদ্ধা জানালেন অরবিন্দ রবীন্দ্রের লহ নমস্কার’ বলে। সেই অরবিন্দ শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলেন উনিশোে পঞ্চাশ সালে। এরপর শ্রীমা’ নামে পরিচিতা এক ফরাসিনী হলেন তাঁর উত্তরসাধিকা। অরবিন্দের লােকান্তরিত আত্মার সঙ্গে নাকি শ্রীমার ছিলাে সার্বক্ষণিক সংযােগ এবং তারই মাধ্যমে প্রচারিত হয়েছিলাে শ্রী অরবিন্দের এমন একটি ভবিষ্যদ্বাণী, যা সে-সময়কার হিন্দুদের অনেককেই অপরিসীম আশাবাদে উজ্জীবিত করে তুলেছিলাে। বাণীটি ছিলাে এ-রকম: পাকিস্তান রাষ্ট্রটি টিকে থাকবে মাত্র দশ বছর। অর্থাৎ সাতচল্লিশের আগস্টে যে পাকিস্তানের জন্ম, সাতান্নর আগস্টে বা তার আগেই ঘটবে তার মৃত্যু।
এই ভবিষ্যদ্বাণীটির খুব ব্যাপক প্রচার ঘটেছিলাে কি-না জানি না। তবে আমি দেখেছি, আমাদের আশপাশের কয়েকটি গ্রামে মােটামুটি লেখাপড়া জানা হিন্দুদের মধ্যে এ-বাণীটি অগ্নিস্ফুলিঙ্গের মতাে ছড়িয়ে পড়েছিলাে। পণ্ডিচেরি অরবিন্দ আশ্রম থেকে প্রকাশিত শৃৰ নামে একটি মাসিক পত্রিকা আসতাে। সে-পত্রিকার প্রথম পৃষ্ঠার শীর্ষেই মুদ্রিত থাকতে পাকিস্তানের মৃত্যু সম্পৰ্কীয় অরবিন্দের ভবিষ্যদ্বাণীটি। নন্দীগ্রামের কৈলাস দাস পাড়ায় পাড়ায় ঘুরে হিন্দুদের ছােটখাটো বৈঠকে ওই বাণীটির ব্যাখ্যা করতেন, আর হিন্দুরা অদূর ভবিষ্যতে পাকিস্তানের বিনাশ-সম্ভাবনায় উদ্দীপ্ত হয়ে উঠতাে। বাপ-দাদার ভিটেমাটি ছেড়ে যে তাদের ভিনদেশে পাড়ি জমাতে হবে না, অরবিন্দের ভবিষ্যদ্বাণীটি তাদের মনে এ-রকম আশ্বাসের সঞ্চার ঘটিয়ে এক ধরনের প্রশান্তি এনে দিতাে।
কিন্তু উনিশোে সাতান্নর আগস্ট মাস চলে গেলাে, অথচ পাকিস্তান যথারীতি টিকে রইলাে এবং স্বভাবতই, ভবিষ্যদ্বাণীতে বিশ্বাসীদের প্রশান্তি নষ্ট হয়ে গেলাে। দেখা দিলাে হতাশাও।
২৩৬
অবিশ্যি অলৌকিকতায় বিশ্বাস যাদের নিচ্ছিদ্র তাদের কেউ কেউ ভবিষ্যদ্বাণীটির একটি আধ্যাত্মিক ব্যাখ্যা খাড়া করে বলতে লাগলাে যে, আসলে মহাপুরুষের বাণীর স্কুল অর্থ করা ঠিক নয়। এ তাে সূক্ষ্ম জগতের ব্যাপার। সূক্ষ্ম জগতে পাকিস্তানের মৃত্যু নিশ্চয়ই ঘটে গেছে, আমরা স্থল দৃষ্টি দিয়ে তা দেখতে পাচ্ছি না মাত্র।
এ-রকম আধ্যাত্মিক ব্যাখ্যা নিশ্চয়ই বিপুলসংখ্যক মানুষের আধিভৌতিক দুঃখ ভুলিয়ে দিতে পারে না। তবু অনেক মানুষই অতিপ্রাকৃতে বিশ্বাস করে প্রাকৃত দুঃখ অতিক্রমণের স্বপ্ন দেখে, একটা বিশ্বাস নষ্ট হয়ে গেলে অন্য আরেকটা বিশ্বাসে আশ্রয় নেয়। সাধু-সন্ন্যাসীদের অলৌকিক শক্তিতে বিশ্বাসী হিন্দুদের একেক গােষ্ঠীকে দেখেছি একেক ধরনের বিশ্বাসকে ধরে আশ্রয় ও আশ্বাস খুঁজতে। অরবিন্দ-ঘরানার মতাে অন্য সব সাধু, সন্ন্যাসী, গুরু বা ‘অবতারপুরুষদের ঘিরে গড়ে ওঠা ঘরানার অনুবর্তীরাও পাকিস্তানের ভবিষ্যত সম্পর্কে নানা ধরনের ধারণা ও বিশ্বাসে আশ্বস্ত হতে চাইতেন। স্বরূপানন্দ নামক একজন ধর্মগুরু সম্পর্কে লেখা একটি বইয়ে পড়েছি: তিনি নাকি উনিশোে একান্ন সালেই বলেছিলেন যে, পাকিস্তান টিকে থাকবে আর মাত্র বিশ বছর। গুরুর সেই ভবিষ্যদ্বাণী একেবারে অক্ষরে অক্ষরে মিলে যাওয়ায় শিষ্যদের গুরুভক্তি গাঢ়তর হয়েছিলাে নিশ্চয়।
সাতান্ন/ আটান্ন সালে ময়মনসিংহে শৈলেন রায়ের বাসা আর নয়াজামানা পুথিঘরের রাজনৈতিক আড়ার বাইরে আমার অরাজনৈতিক আড়াও ছিলাে কয়েকটি। সে-সব আড্ডায় আমার সঙ্গী হতাে শচীন আইচ। ইংরেজি ভাষায় শচীনের অসাধারণ ব্যুৎপত্তি দেখে আমি বিস্ময়াভিভূত হয়ে পড়েছিলাম। তার সারল্য ও অকপটতা অচিরেই আমাকে তার ঘনিষ্ঠ বন্ধুতে পরিণত করে ফেললাে। তার পুরােনাে বন্ধুদের অনেকের সঙ্গেই পরিচয় ঘটলাে এবং দেখলাম যে, শচীনের মতােই তারাও প্রায় সবাই রাজনীতি-অনীহ ও গতানুগতিক ভাবনার অনুসারী, তবে ব্যবহারে অমায়িক ও বন্ধুবৎসল। শচীনের এ-রকম একজন পুরােনাে বন্ধু ভূদেব আচার্যের। সঙ্গে একদিন কথা হলাে। ভূদেবের বড়াে ভাই বিভূতির সঙ্গে আগেই পরিচয় হয়েছিলাে। দেখলাম: বিভূতির মতাে ভূদেব মােটেই রাজনীতিমনস্ক নয়, তবে অত্যন্ত মেধাবী ছাত্র। সকল পরীক্ষায় তার খুবই ভালাে রেজাল্ট।
কী একটি সরকারি চাকুরির জন্য সে দরখাস্ত করেছিল। ইন্টারভিউও দিয়েছিল। ইন্টারভিউ বাের্ডে প্রথমেই নাকি তাকে প্রশ্ন করা হয়েছিল, তুমি তাে হিন্দু, তবে তুমি ভারতে যাও নি কেন?’
প্রশ্নটি শুনেই সে তেতে উঠেছিলাে। তবু নিজেকে সংযত করে প্রশ্নের উত্তরে সে-ও ছােট্ট একটু প্রশ্ন ছুঁড়ে দিয়েছিলাে, কেন যাবাে বলুন তাে?’
তখন ইন্টারভিউ বাের্ডের আরেকজন তাকে প্রশ্ন করলেন, “আপনাদের প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহেরু খুবই একজন পণ্ডিত ব্যক্তি। ঠিক নয় কি?”
এবার আর ভূদের সংযত থাকতে পারলাে না। বললাে, “জওহরলাল নেহেরু একজন খুবই পণ্ডিত ব্যক্তি—কোনােই সন্দেহ নেই। কিন্তু আমি জানি না, তিনি আপনাদের প্রধানমন্ত্রী কী না।”
ইন্টারভিউয়ের এই অভিজ্ঞতাটি বর্ণনা করে সেদিন আমাদের আড্ডায় ভূদের আরাে অনেক কথা বলেছিল। পাকিস্তানের হিন্দুদের প্রতি অমানবিক ও অপমানকর আচরণের যে-সব তথ্য সে তুলে ধরেছিল, তার একটিকেও অসত্য বলার কোনাে উপায় ছিলাে না। কিন্তু সে-সব তথ্যের ব্যাখ্যা যে-দৃষ্টিকোণ থেকে সে করেছিলাে, সে-দৃষ্টিকোণটিকে কিছুতেই আমি
২৩৭
অনুমােদন করতে পারছিলাম না। অগ্রজ বিভূতির সঙ্গে অনুজ ভূদেবের দৃষ্টিভঙ্গির আকাশপাতাল তফাৎ। সে-তফাৎটি কমুনিস্টের সঙ্গে অক্যুনিস্টের।
যে-সব অরাজনৈতিক হিন্দুর সঙ্গে তখন কথা বলেছি তাদের সবার মধ্যে বিভূতি আচার্য কিংবা তার মতাে ক্যুনিস্টদের বিপরীত দৃষ্টিভঙ্গিই প্রত্যক্ষ করেছি। পাকিস্তানি বিরূপ বাস্তবের ধাক্কায় সবাই আক্রান্ত হয়ে পড়েছিল ভাববাদী বিভ্রম ও প্রতিকারহীন হতাশায়।

জঙ্গী শাসকদের জংলী আইন
জন্মসূত্রে আমি হিন্দু। আমার এই হিন্দুত্ব নিতান্তই একটি ইচ্ছানিরপেক্ষ বাস্তবতা। কিন্তু এই বাস্তবতাকেই যদি চূড়ান্ত ভেবে নিতাম, হিন্দু পরিচয়টাকেই যদি সর্বসাধ্যসার মনে করতাম, তাহলে একান্ত স্বাভাবিকভাবেই পাকিস্তান ছেড়ে হিন্দুস্থান যাওয়ার পথ খোঁজাটাকেই আমার সকল সমস্যার একমাত্র সমাধান বলে ধরে নিতে পারতাম। অথবা এমন কোনাে ধর্মগুরুর সন্ধান করতাম যিনি আমাকে তার অলৌকিক শক্তি বলে পাকিস্তানের মৃত্যুর দিনক্ষণটি বলে দিতে পারেন এবং তাঁরই ভবিষ্যদ্বাণীর ওপর পুরাে আস্থা স্থাপন করে নিজ বাসভূমে পরবাসী হয়ে থাকার যন্ত্রণাকে একান্ত সাময়িক ভেবে দাঁতে দাঁত চেপে সহ্য করে যেতাম। অথবা ত্রাণকর্তারূপে নেতাজী সুভাষচন্দ্রের নতুন অভ্যুদয়ের প্রতীক্ষায় কল্পস্বর্গে বাস করতে পারতাম।
কিন্তু আমার পক্ষে এমন কিছুই করার আর উপায় রইলাে না। কারণ, আধুনিক জ্ঞানবৃক্ষের যে ফল ডায়ালেকটিক বস্তুবাদ, তাই খেয়ে আমি চিরকালের জন্যে হয়ে গেছি কল্পস্বর্গচ্যুত। এখন বাস্তবের রুক্ষ কঠোর মাটির বুকে আমি দণ্ডায়মান। ডায়ালেকটিক আমাকে শিখিয়েছে যে, এই বাস্তবকে বদলানাের কাজে হাত লাগানােই আমার দায়িত্ব এবং একা একা নয়, সংঘবদ্ধতার মধ্যদিয়েই সে দায়িত্ব পালন করা সম্ভব। সংঘের অন্তর্গত থেকে আমার যেটুকু সাধ্য সেটুকুই করে যেতে হবে আমাকে। খুব বড়াে কিছু রােমান্টিক কিছু করার দুঃসাহসী কল্পনা বাদ দিয়ে নিজের শক্তি ও সাধ্যের সীমার মধ্যে বিচরণ করাই উত্তম। যেহেতু আমি তখন ছাত্র, তাই ছাত্রদের নিয়ে সংঘবদ্ধ হওয়াই আমার জন্যে হবে স্বধর্মোচিত আচরণ, সে-কথাই আমাকে বােঝালেন আমার সে সময়কার রাজনৈতিক গুরুস্থানীয় কমরেডগণ।
ছাপ্পান্ন সালে যে ঐক্যের স্লোগান নিয়ে ময়মনসিংহ জেলা ছাত্রলীগ সম্মেলনে যােগ দিয়েছিলাম, সে ঐক্য আর প্রতিষ্ঠিত হতে পারেনি। কাজী আবদুল বারি ছাত্রলীগ ত্যাগ করলেন, সঙ্গে সঙ্গে আমরাও। কাজী বারির ছাত্রজীবনেরও অবসান ঘটলাে। কলেজ ছেড়ে তিনি পুরােপুরি সক্রিয় ও সার্বক্ষণিক রাজনীতিতে যােগ দিলেন, ময়মনসিংহ ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির একজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি হয়ে গেলেন। এ অবস্থায় ময়মনসিংহ জেলায় ছাত্র ইউনিয়ন সংগঠন গড়ে তােলার ভার পড়লাে আমার বয়ােজ্যেষ্ঠ সহপাঠী আবদুল কুদুসের ওপর।
আমি তখন নতুন রাজনৈতিক দর্শনে দীক্ষা নিয়ে উৎসাহ-উদ্দীপনায় রীতিমতাে টগবগ করছি। আমাদের সময়ে কলেজগুলাের ছাত্র সংসদ নির্বাচনের ধারা এখনকার চেয়ে অনেক পৃথক ছিলাে। এখন যেমন ছাত্রলীগ, ছাত্রদল, ছাত্র ইউনিয়ন, ছাত্রশিবির ইত্যাদি ছাত্র সংগঠনগুলাে দলীয় ভিত্তিতে কলেজের ছাত্র সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে, তখন এরকম
২৩৮
হতাে না। নির্বাচনের আগে আগেই ছাত্ররা গােষ্ঠীবদ্ধ হয়ে প্যানেল পেশ করতাে, একেকটি প্যানেলের সমর্থকদের নিয়ে একেকটি দল দাড়িয়ে যেতাে। দলগুলাের নাম হতাে এ ধরনের প্রভাতী, সংহতি, অগ্রণী, জাগরণ ইত্যাদি। নির্বাচন শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই সাধারণত এসব দল লুপ্ত হয়ে যেতাে। আবার পরের বছর নির্বাচন এলে নতুন করে দল গড়ার তােড়জোড় চলতাে। আনন্দমােহন কলেজে এ রকম একটা দল কিন্তু ব্যতিক্রমী চরিত্র নিয়ে গড়ে উঠেছিলাে। অর্থাৎ অন্য দলগুলাের মতাে এ দলটি কেবল ছাত্রসংসদ নির্বাচনের তাৎক্ষণিক প্রয়ােজনে সৃষ্ট হয়ে নির্বাচনের শেষে অবলুপ্ত হয়ে যায়নি। সারাবছর ধরেই এ দলের সদস্যরা ছাত্রদের মধ্যে আদর্শগত প্রচার চালিয়ে যেতাে এবং দলটির অস্তিত্ব ও স্বাতন্ত্র ঘােষণা করতাে। এ দলটির নাম ‘প্রগতি’ । আমি যে বছর আনন্দমােহনে ভর্তি হই তার ছয়/সাত বছর আগে এ দলটির জন্ম হয়েছিলাে। সেই থেকে প্রায় প্রতি বছর এ দলটিই কলেজ ছাত্র সংসদের অধিকাংশ আসন দখল করতাে। বাম প্রত্যয়সম্পন্ন ছাত্ররাই এ দলটিতে সংগঠিত হয়েছিলাে বসে দলটিকে ‘ক্যুনিস্ট’ বলে গালি দিতাে অনেকেই। প্রগতি’র সদস্যরা যে-সব স্লোগান দিতাে, কথায় কথায় যে সব বাকবন্ধ উচ্চারণ করতাে, তাতে তাদেরকে কমুনিস্ট বলার খুবই সঙ্গত কারণ ছিলাে। সাতান্ন-আটান্ন সালে আমি ছিলাম ‘প্রগতি’ দলের একজন মুখর সদস্য। বিশেষ করে ছাত্র সংসদ নির্বাচনের সময় ক্লাসে ক্লাসে গিয়ে যে-রকম আগুনঝরানাে বক্তৃতা দিতাম তাতে আমি তাে একেবারে একজন পাক্কা কম্যুনিস্ট ব’নে গেলাম! নয়া জামানা পুঁথিঘরের আডডা ও অজয়দা-জ্যোতিষদাদের সঙ্গে বৈঠক থেকে প্রগতি-ভাবনায় আমার যে দীক্ষা হয়েছিলাে, তাতে কম্যুনিস্ট’ বলে আমাকে কেউ গালি দিলে মনে মনে বেশ পুলকিত বােধ করতাম।
সেবার কলেজ ছাত্রসংসদের নির্বাচনে প্রগতি’ দল খুব সুবিধা করতে পারেনি। সাহিত্যসম্পাদক, বার্ষিকী সম্পাদক এবং এ রকম আরাে দু’একটি পদ প্রগতির দখলে থাকলেও সহসভাপতি (ভিপি) ও সাধারণ সম্পাদক (জিএস)-এর মতাে গুরুত্বপূর্ণ পদগুলাে অন্য দলের হাতে চলে যায়।
আবদুল কুদুস বললেন, এভাবে হবে না। ছাত্র সমাজের মধ্যে প্রগতিশীল ধ্যানধারণা ছড়িয়ে দেয়ার জন্যে উপযুক্ত সংগঠন চাই। ছাত্র ইউনিয়নকেই সে-রকম একটি সংগঠনরূপে দাঁড় করাতে হবে। তাই ঠিক করেছি—ময়মনসিংহ জেলার প্রতিটি মহকুমা শহরের কলেজগুলােতে গিয়ে ছাত্র ইউনিয়নের শাখা গড়ে তুলবাে। আগামী বিষ্ণুত্বারে জামালপুর যাবাে। চলাে আমার সঙ্গে।
আমি তাে একে পায়ে খাড়া। ছাত্রলীগে কাজ করে ছাত্র সংগঠনের কাজের ধারা সম্পর্কে কিছুটা ধারণা এর মধ্যেই আমার গড়ে উঠেছিলাে। খুব উৎসাহ নিয়ে কুদ্স ভাইয়ের সঙ্গে জামালপুর গেলাম।
জামালপুরের কমরেড আশুদত্ত আশেক মাহমুদ কলেজের কয়েকজন ছাত্রের সঙ্গে আমাদের পরিচয় করিয়ে দিলেন। তাদের সঙ্গে আলাপ করে আমরা জামালপুরে ছাত্র ইউনিয়ন গঠনের প্রাথমিক প্রস্তুতি সম্পন্ন করে ফেললাম। স্থির হলাে: অক্টোবর মাসে (আটান্ন সালের) আমরা আবার জামালপুর যাবাে এবং সমমনা ছাত্রদের একটি সাধারণ সভায় ছাত্র ইউনিয়নের জামালপুর শাখা প্রতিষ্ঠার আনুষ্ঠানিক ঘােষণা দেয়া হবে।
কিন্তু হায়, সেই অক্টোবর এলাে ভিন্ন মূর্তি ধরে। আটই অক্টোবর সকালে ঘুম থেকে উঠেই শুনি পাকিস্তানে মার্শাল ল’ জারি হয়ে গেছে। সভাসমিতি সংগঠন সব নিষিদ্ধ। দু’বছর আগে
২৩৯
পাকিস্তানের গণপরিষদের গৃহীত সংবিধান বাতিল । দেশের রাজনৈতিক নেতারা কেউ গৃহবন্দি, কেউ কারাবন্দি। রেডিওতে বেত্ৰদণ্ড, জেল, জরিমানা, সম্পত্তি বাজেয়াপ্তির ঘােষণা শুনে শুনে মানুষের রক্ত হিম হয়ে এলাে। চার দেয়ালের মধ্যেও কেউ মন খুলে কথা বলার সাহস পায় না।
নয়াজামানা পুঁথিঘরে পুলিশ এসে তালা লাগিয়ে দিলাে। রতুবাবু গ্রেফতার হলেন। অজয় দা, জ্যোতিষ দা, আলতাব আলী এবং এ-রকম অন্যসব কমরেড আত্মগােপন করলেন। আমাদের সবকিছু ছত্রখান হয়ে গেলাে।
সাত অক্টোবর প্রেসিডেন্ট ইস্কান্দর মির্জার ঘােষণায় সামরিক আইন জারি হয়েছিলাে, আর সাতাশ অক্টোবর সেই মির্জাকে ক্ষমতাচ্যুত করে সেনাপতি আইউব খান হলেন পাকিস্তানের হর্তাকর্তা বিধাতা। আরাে কয়েকজন সেনা কর্মকর্তা হলেন তার সহযােগী। জঙ্গীদের হাতে জংলী আইনের চললাে অবাধ ব্যবহার। সে আইনের প্রথম কাজই হলাে মানুষের মনে ভয় ধরিয়ে দেয়া। অর্থাৎ ‘ওরা ভয় দেখিয়ে করছে শাসন, জয় দেখিয়ে নয়। চিরাচরিত অভ্যাসমতাে রাস্তার পাশের নর্দমায় হয়তাে একজন বসে গেছে প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিতে, অমনি তার পিঠে পড়ে যাচ্ছে ডাণ্ডার বাড়ি। কারাে ঘর বা দোকানের সামনে কিছু আবর্জনা জমে রয়েছে, ডাণ্ডা মেরে তাকে ধরে নিয়ে গিয়ে করা হচ্ছে জরিমানা। কারাে মাথায় লম্বা চুল, তার পিঠে লাগিয়ে দেয়া হচ্ছে দু’ঘা। কেউ রাস্তার ডান দিকের বদলে বাঁ দিকে হাঁটছে, তারও সেই দশা। ফরমান জারি হচ্ছে: প্রত্যেকের ঘরের দেয়ালে সাঁটা বিভিন্ন পােস্টার কিংবা কালির লিখন তুলে ফেলতে হবে বারাে বা ষােল ঘণ্টার মধ্যে, বাড়ির সামনের গাছগুলাে কেটে ফেলতে হবে এক্ষুণি, দোকানে প্রতিটি পণ্যের মূল্যতালিকা টানিয়ে দিতে হবে এই মুহূর্তে …। আদেশ অমান্যকারীকে কী ধরনের কঠিন কঠিন শাস্তি পেতে হবে তাও জানিয়ে দেয়া হচ্ছে।
কয়েকদিনের মধ্যেই দুর্গাপূজার ছুটি হলাে। ছুটিতে গ্রামের বাড়িতে গেলাম। দেখলাম: গ্রামেও জঙ্গী আইনের আতঙ্ক আছে, তবে শহরের মতাে নয়। গাঁয়ের মানুষেরা বরং জঙ্গী আইন জারি হওয়াতে বেশ খুশি হয়েছে বলেই মনে হলাে। তারা হাজামজা পুকুরের সংস্কারে লেগে গেছে ও কচুরিপানা ধ্বংস করছে। জঙ্গল পরিষ্কার করার নামে, কিছুটা ভয়ে এবং কিছুটা উৎসাহের প্রাবল্যে, বড়াে বড়াে ফলবান বৃক্ষও কেটে ফেলছে। শহরে গিয়ে তারা অনেকেই জঙ্গী আইনের প্রয়ােগ দেখে এসেছে, সেখানে জঙ্গী শাসনের অনেক সুফল দেখতে পেয়েছে। তারা দেখেছে: শহরের রাস্তাঘাট আর বাড়িঘরের দেয়াল সব ঝকঝকে পরিষ্কার, দোকানে জিনিসপত্র কিনতে গিয়ে দরাদরি করতে হয় না, নিত্যপ্রয়ােজনীয় বহু জিনিসের দাম কমে গেছে, দুধে কেউ জল মিশায় না, অসাধু ব্যবসায়ীরা সব সস্ত্রস্ত, অফিস-আদালতের কাজকর্মেও ঘুষের আদান-প্রদান বন্ধ হয়ে গেছে, ট্রেনে কোনাে বিনা টিকিটের যাত্রী নেই। হ্যা, আটান্ন সনে মার্শাল ল জারির সঙ্গে সঙ্গে নিতান্ত অল্পদিনের জন্যে হলেও, এরকম বেশ কিছু কাঙ্ক্ষিত পরিবর্তন জনসাধারণ সত্যি সত্যিই প্রত্যক্ষ করেছিলাে এবং এ-রকম প্রত্যক্ষ করে জঙ্গী নায়ক আইউব খানকে যে তারা সােল্লাস ও সােচ্চার অভিনন্দন জানিয়েছিলাে, সে-কথাও অস্বীকার করা যাবে না। পল্লীগানের আসরেও তাদের উল্লাসের প্রকাশ আমি দেখেছি। এক বয়াতিকে আসরে উঠে তাৎক্ষণিকভাবে রচিত গানে জঙ্গী শাসনের দুর্নীতিবিরােধী কর্মকাণ্ডের অকুণ্ঠ প্রশংসা করতেও শুনেছি। তার সেই গানের একটি ছত্র আজো আমার মনে পড়ে—‘টিটি সাবের গরম পকেট হইয়া গেছে ঠাণ্ডা। টিকিট না করে ট্রেনে উঠতে যে টিটিরা যাত্রীদের
২৪০
উৎসাহিত করতাে এবং এই বিনা টিকিটের যাত্রীদের কিছু সুবিধা দিয়ে তাদের কাছ থেকে আদায় করা পয়সায় নিজেদের পকেট গরম করতাে, আইউবের জঙ্গী শাসন সেই টিটিদের গরম পকেট ঠাণ্ডা করে দিয়েছে বলে পল্লীর এই বয়াতিটি খুবই উল্লসিত হয়েছিলেন।
এ-ধরনের উল্লাস অবশ্যই বেশিদিন টেকেনি, সামরিক শাসন সম্পর্কে জনগণের মােহমুক্তি ঘটতেও খুব বেশি সময় লাগেনি। তবু, রাজনীতিকদের গণবিরােধী আচরণই যে জনগণকে রাজনীতি-বিতৃষ্ণ করে তােলে, এবং এরকম রাজনীতি-বিতৃষ্ণ জনগণই যে স্বৈরাচারকেও স্বাগত জানিয়ে বসে—এই বেদনাদায়ক সত্যটি থেকে মুখ ফিরিয়ে থাকা যায় না। স্বৈরাচারী আইউবের অভ্যুত্থানের পটভূমিটি তাে রাজনতিকদের মতলববাজিতা, অবিমৃষ্যকারিতা, অদূরদর্শিতা ও সংকীর্ণতার মধ্য দিয়েই তৈরি হয়েছিলাে। চুয়ান্ন সালে যে উৎসাহ-উদ্দীপনা নিয়ে জনগণ মুসলিম লীগ বিরােধী রাজনীতিকদের সমর্থন দিয়েছিলাে, সেই রাজনীতিকরাই জনগণের সঙ্গে বেঈমানির চূড়ান্ত করে ছেড়েছিলেন। রাজনীতিকদের চারিত্রিক দুর্বলতাকে কাজে লাগিয়েই সামরিক বেসামরিক আমলাচক্র দেশের রাজনীতিকে নিজেদের কজায় নিয়ে এসেছিলাে। তারাই ইচ্ছেমতাে রাজনীতিকদের ক্ষমতার মসনদে বসাতাে ও মসনদ থেকে ছুঁড়ে ফেলে দিতাে। চুয়ান্ন থেকে আটান্ন—এই ক’বছরে পাকিস্তানের কেন্দ্রে ও প্রদেশে কতাে বার যে সরকারের কতাে রকম ভাঙাগড়া হয়েছে তার সঠিক হিসেবে দেয়া শক্ত। এমনও হয়েছে যে, সকালে যে মন্ত্রিসভা শপথ গ্রহণ করেছে বিকেলেই সেটি ভেঙে গেছে, এসেছে অন্য আরেকটি। সে-সময়ে তাে এ-রকম একটি কৌতুকই চালু হয়ে গিয়েছিলাে :
সরকারি চাকরির এক প্রতিযােগিতামূলক পরীক্ষায় জিজ্ঞেস করা হয়েছে, পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীর নাম কি?
চাকরি প্রার্থীর জবাব, “ঠিক বলতে পারবাে না। কারণ, আমি আজ সকালে খবরের কাগজ পড়তে পারিনি।’
রাজনীতির এ-রকম অস্থিতিশীল অবস্থা তাে ছিলােই। তার ওপর পূর্ব পাকিস্তানের আইন পরিষদে যেদিন প্রচণ্ড মারামারি হলাে, পরিষদের সদস্যদের হাতেই খুন হলেন ডেপুটি স্পীকার শাহেদ আলী, সেদিন থেকে রাজনীতিকদের মর্যাদা প্রায় শূন্যের কোঠায় নেমে এলাে।
এই পটভূমিতেই রাজনীতিকদের অপসারণ করে ক্ষমতার মসনদ দখল করে বসে পাকিস্তানের জঙ্গী নায়করা এবং পেয়ে যায় আমজনতার সরব অথবা নীরব সমর্থনও।
তবে শহর-গ্রাম নির্বিশেষে যেখানে যতাে চিন্তাশীল মানুষ ছিলেন তারা সবাই চিন্তিত হয়ে উঠলেন, জঙ্গীদের জংলী আইন দেশকে বর্বরতার কোন অতলে তলিয়ে দেবে সে কথা ভেবে তারা আতঙ্কিত হলেন।
ভীষণ আতঙ্কিত, ক্ষুব্ধ ও হতাশাগ্রস্ত হতে দেখলাম হেকিম ভাইকে। জঙ্গী শাসকরা প্রথমেই বড়াে আঘাত হেনেছে দেশের জনগণের শিক্ষার ওপর। শিক্ষা ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তনের লক্ষে তারা একটি শিক্ষা কমিশন বসিয়েছে। এই আমূল কথাটা সম্পর্কে ঠাট্টা করে হেকিম ভাই বলেছিলেন, ‘আমূল পরিবর্তন বলতে এরা আসলে বুঝেছে যে শিক্ষার মূলটিই উপড়ে ফেলতে হবে। জনগণ যদি সত্যি সত্যিই শিক্ষিত হতে থাকে, তবে কিছুতেই স্বৈরাচারী শাসন চালানাে যাবে না। জঙ্গী স্বৈরতন্ত্রকে চিরস্থায়ী করার উপায় খুঁজে বের করার জন্যেই তাে এরা শিক্ষা কমিশন বসিয়েছে।’
২৪১
কথাটার সত্যতা অবিশ্যি এসএম শরীফের নেতৃত্বে গঠিত শিক্ষা কমিশনের রিপাের্ট প্রকাশের পরই প্রমাণিত হলাে। তবে শিক্ষাকে ধ্বংস করে দেয়ার উদ্যোগটির প্রথম প্রমাণ সামরিক শাসকরা রেখেছিলাে আটান্ন সালের অক্টোবরেই এদেশের গ্রাম এলাকার অধিকাংশ হাইস্কুলের সরকারি স্বীকৃতি বাতিল করে দিয়ে। আমার ছােট ভাই মতীন্দ্র তখন বেখৈরহাটি হাইস্কুলে ক্লাস টেনে পড়তাে। অর্থাৎ সে ঊনষাট সালের ম্যাট্রিক পরীক্ষার্থী। কিন্তু স্কুলের স্বীকৃতি বাতিল হয়ে যাওয়ায় সেবার আর তার পরীক্ষা দেয়া হলাে না। এ-রকমই হলাে গ্রামাঞ্চলের স্কুলের অগণিত ছাত্রের নিয়তি। আমাদের এলাকার বেখৈরহাটি, শাহাগঞ্জ, লঙ্কাখােলা, আশুজিয়া, নওপাড়া, সান্দিকোনা, তেলিগাতি—এ-রকম সব হাইস্কুলেরই ‘এফিলিয়েশন’ কেটে দেয়া হলাে। কেবল বিভিন্ন থানা হেডকোয়ার্টারের কয়েকটি স্কুলের এফিলিয়েশন বজায় রাখা হয়েছিলাে। বােঝা গেলাে : গ্রামের সাধারণ মানুষের ছেলেপুলেরা লেখাপড়া শিখুক—সে-রকমটি পাকিস্তানের জঙ্গী শাসকদের মােটেই অভিপ্রেত ছিলাে না।
আশুজিয়া হাইস্কুলের এফিলিয়েশন কেটে দেয়ায় খুবই মর্মাহত হলেন আমাদের হেকিম ভাই। চুয়ান্ন সাল থেকে তিনি আশুজিয়া ইউনিয়ন বাের্ডের নির্বাচিত চেয়ারম্যান (তখন এ পদটির নাম ছিলাে ‘প্রেসিডেন্ট’)। চেয়ারম্যানের ক্ষমতা প্রয়ােগ করে স্কুলটির উন্নয়নে তিনি নানাভাবে সহায়তা করে আসছিলেন। এর দৈন্যদশা অনেক পরিমাণে কেটেও গিয়েছিলাে। কিন্তু সামরিক শাসনের আঘাতে এখন তার অস্তিত্বই বিপন্ন।
মাত্র এক বছর আগে নবগঠিত রাজনৈতিক দল ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টিতে তিনি অত্যন্ত উৎসাহের সঙ্গে যােগ দিয়েছিলেন। সামরিক শাসন তার সেই নতুন রাজনৈতিক জীবনেরও ছন্দপতন ঘটিয়ে দিলাে। তাই তার কথায় কেবল ক্ষোভ আর হতাশার সুর।
তবে আমার বন্ধু শাহিদ কিন্তু ক্ষুব্ধ হলেও হতাশ হয়নি। নিচ্ছিদ্র অন্ধকারেও সে পথের অন্বেষণে বিরত রইলাে না, আত্মগােপনকারী কম্যুনিস্ট নেতাদের সঙ্গে সংযােগ রক্ষা করে চললাে।

গ্রাম বাংলায় শিক্ষার হাল হকিকত
ঊনষাট সালের জুনে বিএ পরীক্ষা দিয়ে বাড়িতে গেলাম। এখন থেকে আমাকে রােজগারের পথে নামতে হবে, তা না হলে সংসারের চাকাটি আর ঘুরবে না।
আমাকে যিনি নাতি ছাত্র’ বলতেন, সেই জয়চন্দ্র রায় আমাকে আশুজিয়া হাইস্কুলের মাস্টারিতে বহাল করে দিলেন। এফিলিয়েশন’ কাটা যাওয়ার পর ইস্কুলটির অবস্থা খুবই করুণ। কুমুদ ভট্টাচার্য বছরখানেক আগেই এ-ইস্কুল ছেড়ে অন্যত্র চলে গেছেন। হেড মাস্টার ক্ষিতীশ চক্রবর্তী আত্মহত্যা করেছেন। বাঁশহাটি গ্রামের আবদুল মজিদ যদিও এসেছেন নতুন হেড মাস্টার হয়ে, তবু তিনি নামেই হেডমাস্টার, সপ্তাহে দু’দিনও ইস্কুলে আসেন না। আর কেনই বা আসবেন? যেখানে মাসের শেষে দক্ষিণা পাবার নিশ্চয়তা নেই, কোনাে ক্লাসেই দশ/বারাে জনের বেশি ছাত্রের উপস্থিতি নেই, মাসের পর মাস চলে গেলেও কোনাে ছাত্রের। মাইনে দেবার গরজ নেই, সে-ইস্কুলের হেডমাস্টার ইস্কুলে এসে কী করবেন? তবে শুনেছি : সপ্তাহে সপ্তাহে তিনি ঢাকা যান, মাধ্যমিক শিক্ষা বোের্ড আর ডিপিআই অফিসে ধর্না দেন, ইস্কুলের এফিলিয়েশেন পাবার জন্যে তদবির করেন। বছর শেষ না হতেই মার্শাল ল’র দুর্নীতি
২৪২
বিরােধী ভাবমূর্তি শেষ হয়ে গেছে, আবার সেই তদবিরের দিন ফিরে এসেছে, তদবির করেই ইস্কুলের এফিলিয়েশন ফিরিয়ে আনতে হবে। তাই, বরাবরের মতােই ইস্কুলের পড়াশােনার ব্যাপারে সবকিছু জয়চন্দ্র বাবুকেই সামাল দিতে হয়। এ জন্যেই আমাকে তার সহকর্মি শিক্ষক বানাতে পেরে জয়চন্দ্র বাবু খুবই খুশি হলেন। কিন্তু তার প্রাণের চেয়েও প্রিয় এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটির ভবিষ্যত সম্পর্কে তিনি খুব আশাবাদী হয়ে উঠতে পারলেন না। আমিও আমার মাতৃপ্রতিম এ বিদ্যামন্দিরটি (আলমা মেটার) সম্পর্কে আশাবাদ পােষণ করার মতাে কিছু খুঁজে পেলাম না। একে তাে ইস্কুলের এফিলিয়েশন পাওয়ার বিষয়টিই অনিশ্চিত হয়ে আছে। এফিলিয়েশন না পেলে কেউ এখানে থেকে ম্যাট্রিক পরীক্ষা দিতে পারবে না, আর তা না। পারলে কোনাে ছাত্রই এ ইস্কুলে পড়বে না। আবার এফিলিয়েশন পেলেই যে ইস্কুলের আর্থিক সচ্ছলতা ফিরে আসবে তারও কোনাে নিশ্চয়তা নেই। কাজেই, আমার নিতান্ত ব্যক্তিস্বার্থের বিবেচনাতেও—অর্থাৎ আমার দরিদ্র পিতার সংসারের চাকায় কিঞ্চিত তেল জোগানাের ব্যবস্থা করার ক্ষেত্রেও—আশুজিয়া ইস্কুলটিকে খুব প্রশস্ত মনে হলাে না।
জয়চন্দ্র বাবুকে কখনাে সমসাময়িক রাজনীতি নিয়ে আলাপ করতে শুনিনি। কিন্তু এবার সামরিক সরকারের শিক্ষানীতির ওপর ক্ষুব্ধ হয়ে ওদের বিরুদ্ধে অনেক কড়া কড়া কথা বলে গেলেন তিনি।
‘ওরা কলমের এক খোচায় ইস্কুলের এফিলিয়েশন কেটে দেয়, কিন্তু আশুজিয়া ইস্কুলের মতাে একেকটি ইস্কুল গড়ে তুলতে গ্রামাঞ্চলের মানুষরা যে কী পরিমাণ ত্যাগ স্বীকার করেছে। ওরা কি তার কোনাে খবর রাখে? পাকিস্তান গভর্নমেন্ট কিংবা ব্রিটিশ গভর্নমেন্টের টাকায় এ সব ইস্কুল খােলা হয়নি। কোনাে গভর্নমেন্ট এসব ইস্কুল চালানাের জন্যে কোনাে পয়সা খরচ করেনি।
‘গাঁয়ের মানুষরা যেমন ইস্কুলের জন্যে জমি দিয়েছে, ঘর করে দিয়েছে, আসবাবপত্রের জোগান দিয়েছে, তেমনি আমরা অর্থাৎ গাঁয়ের ছেলেরাই শহর থেকে লেখাপড়া শিখে এসে ইস্কুলে প্রায় বিনা মাইনেয় মাস্টারি করেছি। গায়ে গায়ে এ ইস্কুলগুলাে যদি গড়ে না উঠতাে, তবে দেশের নানা জায়গায় এতাে সব সচেতন শিক্ষিত লােকের দেখা মিলতাে না; স্বদেশী আন্দোলনও জোরদার হয়ে উঠতাে না, লড়কে লেঙ্গে পাকিস্তানের এতাে সিপাইও কোথাও খুঁজে পাওয়া যেতাে না। আর আজ কিনা বন্দুকের জোরে ক্ষমতায় বসে একদল অর্বাচীন এসব ইস্কুলকে ব্যাঙের ছাতা’ বলে বিদ্রুপ করছে। সারাদেশে নাকি ব্যাঙের ছাতার মতাে ইস্কুল গজিয়েছে। তারা এখন ব্যাঙের ছাতা সাফ করতে চায়। বদমাশ আর কাকে বলে!…যাদের ঘাড়ে পা দিয়ে ওরা পাকিস্তান বানিয়েছে তাদেরই ছেলেপুলেদের ওরা এখন মূখ করে দেবার মতলব এঁটেছে, জাতিটাকে অশিক্ষিত করে রেখে নিরাপদে রাজত্ব করতে চাইছে।…এ দেশের কপালে আরাে অনেক দুর্ভোগ আছে।
এসব কথার সূত্র ধরে বৃদ্ধ জয়চন্দ্র রায় তার বাল্যজীবনের কথায় ফিরে যান। গায়ের গরিব ব্রাহ্মণের ছেলে শহরে গিয়ে কত কষ্টে লেখাপড়া শিখেছেন সে-সব বলতে বলতে তিনি স্মৃতিতাড়িত হয়ে ওঠেন। কথা বলতে বলতে বৃদ্ধকে কথায় পেয়ে বসে। আশুজিয়া, নওপাড়া, সান্দিকোনা, কেন্দুয়া—এমন সব হাইস্কুলের জন্মবৃত্তান্তসহ ইতিহাস বর্ণনা করে যেতে থাকেন। আশুজিয়া আর নওপাড়া—দুটোই ব্রাহ্মণ-অধ্যুষিত গ্রাম। আশুজিয়ার লােকেরা যখন গায়
২৪৩
ইস্কুল বানিয়ে ফেললাে, নওপাড়ার মানুষদের তখন তা প্রেস্টিজে ঘা দিলাে। তারাও প্রতিযােগিতার মনােভাব নিয়েই স্কুল প্রতিষ্ঠার কাজে লাগলাে। এ প্রতিযােগিতার গল্প শুনতে শুনতে আমার বারবার প্রভাত কুমার মুখােপাধ্যায়ের মাস্টার মহাশয়’ গল্পটির কথা মনে পড়ে যাচ্ছিলাে। সেই গোঁসাইগঞ্জ আর নন্দীপুর দুই গাঁয়ের মানুষের ইস্কুল প্রতিষ্ঠার প্রতিযােগিতা, এক গাঁয়ের ব্রজ মাস্টার ও অন্য গাঁয়ের হারান মাস্টারের মধ্যে বিদ্যার লড়াইয়ের কৌতুককর কাহিনী! প্রভাত মুখােপাধ্যায়ের গল্পটির হাস্যরসের অন্তরালে নিহিত আছে যে সমাজসত্য সেটি হচ্ছে: উনিশ শতকের দ্বিতীয় পর্ব থেকেই গ্রামবাংলার মানুষ নিজেদের উদ্যোগে ইংরেজি ইস্কুল প্রতিষ্ঠায় ব্রতী হয়েছে, সে-কাজে গ্রামের সচ্ছল মানুষ তথা জোতদার- তালুকদাররা অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছে। কোনাে কোনাে তালুকদার বা গ্রামীণ সামন্ত ভূস্বামী অবিশ্যি গ্রামে শিক্ষা বিস্তারের কাজটি সুদৃষ্টিতে দেখেনি। ইস্কুলে পড়ে চাষাভুষার ছেলেদের চোখ খুলে গেলে তারা আর তালুকদারদের মান্যগণ্য করবে না—এরকম ভয় অনেকেরই ছিলাে। সেইভয় থেকেই তারা গায়ে ইস্কুল প্রতিষ্ঠায় বাধা দিয়েছে। নেত্রকোনারই কোনাে এক গাঁয়ের এ-রকম এক তালুকদারের কথা আমার বাবার মুখে শুনেছি। গ্রামের কিছু যুবক একটি ইস্কুল খােলার জন্যে সেই তালুকদারের কাছে চাঁদা চাইতে গেলে তিনি নাকি বলেছিলেন, ‘ইস্কুলের জন্যে কোনাে চাদা আমার কাছ থেকে পাবে না, আমি এ-গায়ে কোনাে ইস্কুল হতে দেবাে না। তার চেয়ে তােমরা বরং একটি যাত্রার দল বানাও, যা টাকা লাগে সব আমি দেবাে।’
এ-রকম ইস্কুল-বিরােধী তালুকদার কিছু কিছু থাকলেও ওরা খুব একটা সুবিধে করে উঠতে পারেনি। গাঁয়ের প্রভাবশালী মানুষগুলাে বরং তাদের প্রভাব-প্রতিপত্তির প্রমাণকে জোরদার করার জন্যেই গাঁয়ে ইস্কুল প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নিয়েছে। ভিন গাঁয়ের সঙ্গে এ-রকমই একটি প্রতিযােগিতার কৌতুককর বিবরণ শুনেছিলাম সেদিন স্নেহভাজন প্রদীপ চক্রবর্তীর মুখে। প্রদীপদের গ্রাম শাখুয়াইয়ের দুটো পাড়া—বাগিশপুর আর রামনাথপুর। দুটো পাড়ার মধ্যে দূরত্ব মাত্র ছশাে গজের। অথচ, প্রভাত কুমারের ‘মাস্টার মহাশয়’ গল্পের গোঁসাইগঞ্জনন্দীপুরের মতােই রামনাথপুরের সঙ্গে প্রতিযােগিতা করে বাগিশপুরের প্রভাবশালী তালুকদারের নেতৃত্বে একরাতে একটি ইস্কুল ঘর তৈরি হয়ে যায়।
যাই হােক, কথায় কথায় জয়চন্দ্র রায় সেদিন শুধু আশুজিয়া বা নওপাড়ার মতাে গ্রামে হাইস্কুল প্রতিষ্ঠার ইতিহাস বর্ণনা করেননি, উনিশ শতকে গ্রামাঞ্চলের শিক্ষাব্যবস্থাটি কেমন ছিলাে তাও তার বর্ণনায় উঠে আসে। তার বর্ণনার সঙ্গে আমার বাবার মুখে শােনা অনেক কথা মিলিয়ে দেখে আমাদের এলাকার শিক্ষাব্যবস্থা ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সম্পর্কে আমার একটা ধারণা গড়ে ওঠে। আমার বাবা এসব কথা শুনেছেন তার বাবা অর্থাৎ আমার ঠাকুর্দার মুখে। আমার ঠাকুর্দা তাে একসময় নিজেই ছিলেন শিক্ষক—অর্থাৎ গ্রাম্য পাঠশালার গুরু মহাশয়। সেই পাঠশালাটিও তার নিজেরই প্রতিষ্ঠিত। বলা যেতে পারে, গ্রামীণ শিক্ষা প্রসারে একজন নায়কের ভূমিকাই তিনি পালন করে গেছেন।
ঠাকুর্দার জন্ম সময়ে, আঠারাে শো পঁয়ষট্টি সালে তখন নেত্রকোনা এলাকায় কোনাে ইংরেজি ইস্কুল ছিলাে না। আঠারােশাে তেপ্পান্ন সালে প্রতিষ্ঠিত ময়মনসিংহ জিলা ইস্কুলই ছিলাে সে-সময়কার বিশাল ময়মনসিংহ জেলার একমাত্র ইংরেজিশিক্ষা প্রতিষ্ঠান। দূরদূরান্তের গাঁয়ের খুব অল্প লােকেরই তাদের ছেলেদের ময়মনসিংহ শহরে রেখে পড়ানাের সামর্থ্য ছিলাে। আমার ঠাকুর্দার, আমার বাবার এবং আমার জন্ম যে গ্রামে সেই চন্দপাড়ায়, তখন ঈশান দত্ত
২৪৪
একটি পাঠশালা খুলেছিলেন। সেই পাঠশালাতেই ঠাকুর্দার লেখাপড়ার হাতেখড়ি। সেকালের গ্রামবাংলার অধিকাংশ মানুষের মতােই কোনাে ইংরেজি ইস্কুলে পড়ার সুযােগ তার হয়নি। তবে নিজে নিজে প্রচুর পড়াশােনা করে বাংলা ও সংস্কৃতে তিনি কৃতবিদ্য হয়ে উঠেছিলেন। তাঁকে বলা যায় একজন যথার্থ স্বশিক্ষিত ও সুশিক্ষিত মানুষ। যৌবনে পাশের গ্রাম ভগবতীপুরে তিনি যে পাঠশালা খােলেন, সে পাঠশালায় বাংলা ও গণিত শিক্ষায় পাকা হয়ে কেউ কেউ শহরে গিয়ে ইংরেজি ইস্কুলেও ভর্তি হয়েছে। চন্দপাড়ার ঈশান দত্ত কিংবা আমার ঠাকুর্দা রামদয়াল সরকারের মতাে দলপা গ্রামে ছিলেন গােবিন্দ দেব। এই গােবিন্দ মাস্টারের পাঠশালার খুব সুনাম ছিলাে। সিংহের গাঁয়ের কুঞ্জ কিশাের পাল যে পাঠশালা খুলেছিলেন তারই ছাত্র ছিলেন জয়চন্দ্র রায়। বৃদ্ধ বয়সেও জয়চন্দ্র বাবুকে অত্যন্ত শ্রদ্ধার সঙ্গে তার শিক্ষক কুঞ্জ কিশাের পালের নাম উচ্চারণ করতে শুনেছি।
এসব গুরুমহাশয়দের পাঠশালারই কোনাে কোনােটি পরে ‘নিম্ন প্রাথমিক বিদ্যালয়’রূপে সরকারি অনুমােদন পেয়ে যায়। যেমন পেয়ে গিয়েছিলাে আমার ঠাকুর্দার ‘ভগবতীপুর পাঠশালাটি। সেটিই আরাে পরে হয় ‘ফ্রি প্রাইমারি ইস্কুল। তবে সে হচ্ছে অনেক পরের অর্থাৎ চল্লিশের দশকের গােড়ায় যখন শেরে বাংলা ফজলুল হকের চেষ্টায় বঙ্গদেশে অবৈতনিক প্রাথমিক শিক্ষার প্রচলন ঘটে তখনকার কথা। উনিশ শতকের শেষ, এমনকি বিশ শতকের একেবারে গােড়াতেও, গ্রামবাংলায় আধুনিক শিক্ষার প্রসার খুব কমই ঘটেছিলাে।
নেত্রকোনায় মহকুমা প্রতিষ্ঠিত হয় আঠারাে শ বিরাশি সালে। সে-বছরই নেত্রকোনা শহরে খােলা হয় একটি মিডল ইংলিশ ইস্কুল। সেটিই পাঁচ বছর পরে, আঠারােশ সাতাশি সালে, পরিণত হয় হাইস্কুলে। এটিই নেত্রকোনার প্রথম ইংরেজি ইস্কুল। ময়মনসিংহ জেলার তৎকালীন জেলা ম্যাজিস্ট্রেট ও প্রখ্যাত লেখক রমেশচন্দ্র দত্তের নামে এর নাম হয় দত্ত হাইস্কুল। রমেশ দত্ত কিন্তু এর প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন না, তিনি ইস্কুলটির উদ্বোধন করেছিলেন মাত্র। তার মাধ্যমে সামান্য কিছু সরকারি আনুকূল্যও হয়তাে ইস্কুলটির কপালে জুটেছিলাে। এর বেশি কিছু নয়। আসলে এটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলাে স্থানীয় লােকদেরই উদ্যোগে ও অর্থানুকূল্যে। নেত্রকোনা শহরে উনিশ শো নয় সালে ন্যাশনাল হাইস্কুল (পরে যার নাম হয়। চন্দ্রনাথ হাইস্কুল) ও চৌদ্দ সালে আঞ্জুমান হাইস্কুলের প্রতিষ্ঠাও ঘটে এরকম স্থানীয় জনগণের উদ্যোগেই। শহর থেকে গ্রামেও সে-রকম উদ্যোগের সম্প্রসারণ ঘটে এবং তারই ফলে উনিশ শো চৌদ্দ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় আশুজিয়া হাইস্কুল। ক্রমে কেন্দুয়া, নওপাড়া ও সান্দিকোনার মতাে গ্রামেও হাইস্কুল খােলা হতে থাকে। সেসব হাইস্কুল থেকে ম্যাট্রিক পাস করেই অনেকে ময়মনসিংহ, ঢাকা বা কোলকাতায় যায় কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ গ্রহণ করতে। বাংলার বাঘ’ নামে খ্যাত আশুতােষ মুখােপাধ্যায় যখন কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর তখন না-কি বলেছিলেন যে, বাংলার প্রতি ঘরে তিনি গ্রাজুয়েট তৈরি করবেন। প্রতি ঘরে না হােক, প্রায় প্রতি গ্রামে বিশ শতকের দ্বিতীয় বা তৃতীয় দশক থেকে দু’একজন করে গ্রাজুয়েটের দেখা মিলতে থাকে। অথচ, উনিশ শতকের আশির দশকে নেত্রকোনার চন্দনকান্দি গ্রামের গিরীশ চৌধুরী যেদিন কোলকাতা থেকে বিএ পাস করে বাড়ি এসেছিলেন সেদিন নাকি দূরদূরান্তের বহু লােক তাঁকে দেখার জন্যে চৌধুরী বাড়িতে ভীড় করেছিলাে। বিএ পাস করা একজন ব্যক্তি সেদিনকার গ্রামবাংলার মানুষের কাছে ছিলাে একান্ত দুর্লভ বিস্ময়কর দর্শনীয় বিষয়। সম্ভবত গিরীশ চৌধুরীই ছিলেন আমাদের এলাকার প্রথম বিএ তথা গ্রাজুয়েট।
২৪৫
যেদিন আমার বিএ পরীক্ষার ফল বেরুলাে এবং জানা গেলাে যে আমি পাস করেছি, সেদিন জয়চন্দ্র বাবুর কী আনন্দ! পারেন তাে তিনি আমাকে মাথায় তুলে নাচতে শুরু করে দেন! তার যে-কোনাে ছাত্রের সামান্য কৃতিত্বেই তিনি আনন্দে আত্মহারা হয়ে যেতেন। একালে এমন ছাত্রপ্রাণ শিক্ষক কেউ আছেন কি না সন্দেহ।
বেখৈরহাটি হাইস্কুলের এফিলিয়েশন কেটে দেয়ার পর উনষাট সালে ম্যাট্রিক পরীক্ষা না দিতে পেরে আমার ছােট ভাই মতীন্দ্র সে-বছরেরই জানুয়ারিতে বারহাট্টা হাইস্কুলে ক্লাস টেনে ভর্তি হয়ে গিয়েছিলাে। আমার বিএ পরীক্ষার ফল বেরােবার দু’দিন পরই সে আমার জন্যে বারহাট্টা হাইস্কুলের হেডমাস্টার আবদুল হাকিম সাহেবের একটি বার্তা নিয়ে বাড়িতে এলাে। যদিও আবদুল হাকিম সাহেবের সঙ্গে আমার পূর্ব পরিচয় ছিলাে না, তবু তিনি তার ইস্কুলে একজন সহকারী শিক্ষক হিসেবে যােগ দেয়ার জন্যে আমাকে অনুরােধ জানিয়েছেন। এ যেনাে মেঘ না চাইতেই জল। থানা হেডকোয়ার্টারের একটি সচ্ছল হাইস্কুলে একশাে পঁচিশ টাকা মাইনের চাকরি আমার জন্যে তখন একান্তই লােভনীয়। কিন্তু আশুজিয়া হাইস্কুলের প্রতি তাে আমার একটি নৈতিক দায়িত্ব রয়েছে, সেটিকে উপেক্ষা করি কী করে?
জয়চন্দ্র বাবুকে বিষয়টি জানালাম। কিছুক্ষণ নীরব থেকে তিনি বললেন, ‘এ-রকম একটি সুযােগ ছেড়ে দেয়া তাের পক্ষে মােটেই ঠিক হবে না। আমাদের এ-স্কুলে যদি তােকে রাখা যেতাে তাহলে সেটা আমার জন্যে হতাে খুবই আনন্দের। কিন্তু তাতাে সম্ভব নয়। এখানে পড়ে থাকলে তাের ভবিষ্যৎ হবে অন্ধকার, মাসের পর মাস খেটে যেতে হবে নামমাত্র বেতনে। তাই বলি, তুই বারহাট্টা ইস্কুলেই জয়েন কর।…তবে আরেকটা কথা। স্কুল মাস্টারিতেই যাতে জীবনপাত করতে না হয়, সেদিকটায় খেয়াল রাখবি। তােকে অবশ্যই এমএ পাস করতে হবে। বছরখানেক মাস্টারি করে কিছু পয়সা জমিয়ে ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হওয়ার চিন্তাটা মাথায় রাখিস।
আমার পরম শুভানুধ্যায়ী এই শ্রদ্ধেয় শিক্ষকের কণ্ঠে আমার একান্ত আকাক্ষারই প্রতিধ্বনি শুনতে পেলাম। তার আশীর্বাদ মাথায় নিয়েই বারহাট্টা হাইস্কুলে যােগ দিলাম।

‘অগত্যা’, গােলাম মােস্তফা ও রবীন্দ্ৰশতবার্ষিকীর স্মৃতি
উনষাট সালের আগস্ট থেকে একষট্টির আগস্ট—দু’বছর ছিলাম বারহাট্টা হাইস্কুলে। এখানেই ছাত্র হিসেবে পাই নির্মলেন্দু গুণকে, পরে (অর্থাৎ ষাট/ সত্তরের দশকে) জননন্দিত কবিরূপে সারা দেশে যার পরিচিতি ছড়িয়ে পড়ে। ঊনষাটে নির্মলেন্দু ছিলাে ক্লাস এইটের ছাত্র। বেশ মেধাবী। পড়াশােনার মতাে দুষ্টামিতেও তার মেধার পরিচয় সে যখন-তখনই প্রকাশ করতাে। আবার আবৃত্তি বা রচনা প্রতিযােগিতাতেও সমান উৎসাহের সঙ্গে যােগ দিতে এবং অনায়াসে পুরস্কার পেয়ে যেতাে। কবিতাও অবশ্যই লিখতাে। তবে, বাঙালি বালক বা কিশােরের কবিতা লেখাকে কৌতুকের দৃষ্টিতে দেখা ছাড়া বড়াে কিছু বা সিরিয়াস কিছু বলে সাধারণত কেউ মনে করে না। আমিও না। কোন্ বাঙালি জীবনের এক পর্যায়ে কাব্যরােগে আক্রান্ত না হয়? আমিও তাে হয়েছিলাম। বয়ঃসন্ধিকালের কবিতা লেখাকে আমিও তাই একটা অপরিহার্য ও সাময়িক রােগ বলেই মনে করতাম। সে-কারণেই বারহাট্টা হাইস্কুলের কিশাের ছাত্র নির্মলেন্দুর সেদিনকার কাব্যচর্চার মধ্যে ভবিষ্যতের কবি নির্মলেন্দু গুণকে শনাক্ত করতে পারিনি—আমার এ-অক্ষমতার কথা আমি নির্দ্বিধায় কবুল করি।
২৪৬
ঊনষাট সালে বারহাট্টা হাইস্কুলে আমি ছিলাম তরুণতম শিক্ষক। প্রবীণ সহকর্মিরা আমাকে খুবই স্নেহ করতেন, আমার তারুণ্যের প্রগলভতাকে প্রশ্রয়ও দিতেন। তারা আমাকে শিক্ষক সংসদের সম্পাদক নির্বাচিত করেছিলেন এবং স্কুলের প্রতিনিধি রূপে নানা কাজেকর্মে এখানে সেখানে আমাকেই পাঠাতেন। এ-সব ব্যাপারে আমারও ছিলাে প্রচণ্ড উৎসাহ। সেই উৎসাহ নিয়েই আমি সে-বছর ঢাকায় অনুষ্ঠিত পূর্ব পাকিস্তান শিক্ষক সমিতির কেন্দ্রীয় সম্মেলনে যােগ দিয়েছিলাম। তিন দিনের সেই সম্মেলনের একটি দিন নির্ধারিত ছিলাে ভাষা ও সাহিত্য বিষয়ক সেমিনারের জন্যে। সেই সেমিনারে প্রধান অতিথি হয়ে এসেছিলেন কবি গােলাম মােস্তফা।
গােলাম মােস্তফার কবিতার সঙ্গে তাে আমরা পাঠ্যপুস্তকের কল্যাণে ছেলেবেলা থেকেই পরিচিত। ক্লাস টু-এ পড়ার সময়েই পড়েছিলাম তার বনভােজন’ কবিতাটি। উপরের ক্লাসে উঠে পরিচিত হয়েছিলাম ঘুমিয়ে আছে শিশুর পিতা সব শিশুদের অন্তরে’—গােলাম মােস্তফা রচিত এই অবিস্মরণীয় পংক্তিটির সঙ্গে। ছাত্রজীবনেই তার বিশ্বনবী’র চমৎকার গদ্যশৈলী আমাকে মুগ্ধ করেছিলাে।
অবিশ্যি পাকিস্তান সৃষ্টির পরপরই যে তিনি প্রতিক্রিয়াশীল শাসকচক্রের ক্রীড়নক হয়ে গিয়েছিলেন সে খবরও আমার জানা ছিলাে। নওবাহার পত্রিকায় উর্দুভাষার পক্ষে তাঁর ওকালতি সেদিনকার প্রগতিশীল তরুণ সমাজকে একান্তভাবেই ক্ষুব্ধ ও উত্তেজিত করে তুলেছিলাে। পঞ্চাশের দশকের গােড়ায় ক্ষুব্ধ তরুণদের মুখপত্র অগত্যায় গােলাম মােস্তফা সম্পর্কে যে-সব অম্লমধুর মন্তব্য প্রকাশিত হতাে সে-সবের সঙ্গেও আমি পরিচিত ছিলাম। অগত্যা তাে গােলাম মােস্তফার নামই দিয়েছিলাে ‘গােলমাল মােস্তফা। প্রায় প্রতি সংখ্যা অগত্যাতেই তার সম্পর্কে কোনাে না কোনাে টিপ্পনি থাকতােই এবং অনেক সময়ই তাতে শালীনতার সীমা লংঘিত হতাে। একবার অগত্যায় গােলাম মােস্তফার একটি কবিতার কয়েকটি লাইন ছাপা হলাে| ‘বেতারের খুঁটি এই নিশান মােদের, ইরাক আজম সাথে যােগ আছে এর’… এরপরই একান্ত ধৃষ্ট ও অশিষ্ট মন্তব্য : আমাদের ইচ্ছা হয় গােলমাল কবিকে এই খুঁটির সঙ্গে আষ্টেপৃষ্টে বেঁধে মাথাটা ক্ষুর দিয়ে ভালাে করে কামিয়ে তার ওপর গােল মতাে একটা সুপুরি রেখে কাঠের খড়ম দিয়ে আস্তে আস্তে ভাঙতে।’
অগত্যার কোনাে কপিই এখন আমার হাতে নেই। কিন্তু সে-সময়ে এ-পত্রিকায় প্রকাশিত চুটকিগুলাে এতােবার করে আমি পড়েছি যে, সে-সবের অনেকগুলােই আমার মুখস্থ হয়ে যায়, এখনাে আমি সেগুলাে স্মৃতি থেকে উদ্ধার করতে পারি। জানি, স্মৃতি মানুষকে প্রায়শই প্রতারিত করে। আমি এখানে অগত্যা থেকে যে উদ্ধৃতি পেশ করলাম তাতেও হয়তাে স্মৃতির প্রতারণাজনিত কিছু ভুল থেকে যেতে পারে তবু খুব বেশি ভুল যে নেই, এ-কথা জোরের সঙ্গেই বলতে পারি। অবিশ্যি অগত্যার কোন সংখ্যায় এটি ছাপা হয়েছিলাে তা মনে নেই। অগত্যার সব কপি সংগ্রহ করে কোনাে পরিশ্রমী গবেষক যদি এ-পত্রিকার লেখাগুলাের একটা নির্বাচিত সংকলন প্রকাশ করেন, তবে সেটি হতে পারে আমাদের রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক ইতিহাসের মূল্যবান উপাদান।
শুধু গােলাম মােস্তফা নয়, সে-সময়কার সকল দক্ষিণপন্থী রাজনৈতিক নেতা ও প্রতিক্রিয়াশীল কবি-সাহিত্যিক সম্পর্কেই নানা বিদ্রুপাত্মক মন্তব্যে অগত্যার পাতা ভর্তি
২৪৭
থাকতাে। মওলানা আকরম খাঁর নাম দেয়া হয়েছিলাে ‘আক্রমণ খা। আকরম খাঁর পত্রিকা আজাদ ও মােহাম্মদীতে আরবি ‘সিন’ অক্ষরের বাংলা প্রতিবর্ণীকরণে স’ না লিখে লেখা হতাে ‘ছ। যেমন—ইছলাম, মােছলমান, ইছহাক ইত্যাদি। এ নিয়ে বিদ্রুপ করেই আকরম খাঁর পরিচয় দেয়া হয়েছিলাে এভাবে—‘মাছিক মােহাম্মদীর চম্পাদক মওলানা আক্রমণ খাঁ। একবার অগত্যায় এক পাঠকের একটি চিঠি ছাপা হয় (এ-পত্রিকায় পাঠকের চিঠি বলে যা ছাপা হতাে তার সবই সত্যিকার পাঠকের লেখা কিনা তাতে আমার সন্দেহ আছে। এমনও হতে পারে যে, সম্পাদকমণ্ডলীই কাল্পনিক পাঠকের নাম দিয়ে এ-সব চিঠি পত্রস্থ করে নিজেদের মনােমত জবাব লিখে প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করতেন।) চিঠিটিতে বলা হয়েছিলাে যে, এই পাঠক আকরম খাঁকে একটি পত্র লিখতে চান এবং পত্রে তাকে কলিজেশ্বর’ বলে সম্বােধন করতে চান। কারণ বাংলার সঙ্গে উর্দু মিশিয়ে এক জগাখিচুড়ি তৈরি করে আকরম খাঁ তার প্রাণেশ্বর’ হয়ে গেছেন। কিন্তু তাকে তাে আর প্রাণেশ্বর’ বলে সম্বােধন করা যায় না। তাই প্রাণেশ্বরের বদলে ‘কলিজেশ্বর’ লিখলে কেমন হয়, এই পাঠক অগত্যা সম্পাদকের কাছে সে-বিষয়েই পরামর্শ চাইছেন। উত্তরে সম্পাদক পরামর্শ দিয়েছেন:
না, শুধু কলিজেশ্বর’ লিখলে হবে না। লিখতে হবে—আয়, মেরে গুলে চামান, নূরে দামান, আজাদ-কা-প্রােপ্রাইটার, বাংলা মে উর্দু মিশায়ে কা জগাখিচুড়ি বানানে কা এক নম্বর ওস্তাদ আক্রমণ খাঁ কলিজেশ্বর।
ফাজলামাে ও ফাত্রামির জন্যে অগত্যা প্রচুর খ্যাতি বা অখ্যাতি অর্জন করেছিলাে। অগত্যা মানী লােকের মান হনন করছে—এ-রকম অভিযােগ ছিলাে অনেকেরই। সন্দেহ নেই, তারুণ্যের উগ্রতার প্রকাশ অগত্যায় খুব বাড়াবাড়ি রকমেই ঘটেছিলাে। তবু, ধমক দিয়ে। ঠাসা’ পাকিস্তানি শাসনের শ্বাসরুদ্ধকর পরিবেশে অগত্যা যে হালকা চালে গভীর সত্য কথা শুনিয়ে দেয়ার গুরুদায়িত্ব বহন করেছিলাে, শিক্ষিত তরুণদের মধ্যে আত্মবিশ্বাস ও অপ্রিয় সত্যকথনের সাহস জুগিয়েছিলাে, আপাতশ্রুতিতে দৃষ্ট ও অশিষ্ট বাক্য প্রয়ােগ করেই অনেক তথাকথিত মানী লােকের মুখােশ খুলে দিয়েছিলাে—এসব কথাও অস্বীকার করার উপায় নেই।
যাই হােক, যে কবি গােলাম মােস্তফার প্রতি শৈশবে আমার মনে শ্রদ্ধার ভাব জেগে উঠেছিলাে, অথচ অগত্যার পাতায় নানা বিদ্রুপাত্মক মন্তব্য পড়ে যার সম্পর্কে নানা প্রশ্নের উদয় হয়েছিলাে, শিক্ষক সমিতির সেমিনারে একান্ত কাছে থেকে সেই কবিকে দেখতে পেয়ে আমি খুবই খুশি হয়ে উঠেছিলাম।
কিন্তু তার বক্তৃতা শুনে খুশি হতে পারলাম না। আমাদের সাহিত্যের ভাষা সম্পর্কে তিনি যে-সব কথাবার্তা বলেছিলেন সে-সব ছিলাে একান্ত অবৈজ্ঞানিক ও ঘাের প্রতিক্রিয়াশীল। বক্তৃতার প্রথমেই তিনি সে-সময়কার তরুণ লেখকদের প্রতি তীব্র আক্রমণের শেল নিক্ষেপ করলেন। এঁদের বিরুদ্ধে তার অনেক অভিযােগ। লেখায় এঁরা কঠিন কঠিন সংস্কৃত শব্দ ব্যবহার করে, পূর্ব পাকিস্তানের ভাষার প্রতি এদের দারুণ অবজ্ঞা, পশ্চিমবঙ্গের ভাষা ব্যবহার করে এরা পূর্ব পাকিস্তানের সাহিত্যকে নষ্ট ও বিকৃত করে ফেলছে, পাকিস্তানের তাহজিবতমদুনের প্রতি এদের কোনাে শ্রদ্ধা নেই। পূর্ব পাকিস্তানে সে-সময় বিভিন্ন বিষয়ের জন্য যেসব পরিভাষা তৈরি করা হয়েছিলাে, সে-সবের বিরুদ্ধেও অনেক বিষােদগার করলেন। পশ্চিমবঙ্গের অনুকরণেই এখানকার দেশপ্রেমহীন কিছু লােক এ-সব দুর্বোধ্য ও সংস্কৃত-কণ্টকিত পরিভাষা তৈরি করেছে বা সরাসরি পশ্চিমবঙ্গ থেকে আমদানি করেছে। এ-সব বাদ দিয়ে আমাদের
২৪৮
অবশ্যই খাটি পূর্ব পাকিস্তানি পরিভাষা নির্মাণ করে নিতে হবে। সব শেষে তিনি এ-দেশের লেখকদের সহজ ভাষায় লিখতে ও পূর্ব পাকিস্তানি ভাষা ব্যবহার করতে উপদেশ দিলেন।
গােলাম মােস্তফার বক্তব্য সেমিনারে উপস্থিত তরুণ শিক্ষকদের পছন্দ হয়নি। তারা অনেকেই এর মৃদু প্রতিবাদ জানালেন। আমি সভয়ে ও সবিনয়ে তাকে কিছু প্রশ্ন করেছিলাম। বিষয়ের গুরুত্ব বা লঘুত্ব অনুযায়ীই যে ভাষা কঠিন বা সহজ হয়, বঙ্কিমচন্দ্রের সেই মন্তব্যের প্রতি তার মনােযােগ আকর্ষণের চেষ্টা করেছিলাম। আর জিজ্ঞেস করেছিলাম—পূর্ব পাকিস্তানি ভাষা বলতে তিনি কী বােঝাতে চান? পূর্ব পাকিস্তানের বিভিন্ন আঞ্চলিক ভাষার মধ্যে কোনটিকে দিয়ে আমরা পূর্ব পাকিস্তানি সাহিত্য সৃষ্টি করবাে?
সেমিনারে আমন্ত্রিত হয়ে এসেছিলেন সে সময়কার একজন খ্যাতনামা চিকিৎসক ডাক্তার এমএন নন্দী (মন্মথ নাথ নন্দী)। ডাক্তার নন্দী পরিভাষা সম্পর্কে গােলাম মােস্তফার বক্তব্য মেনে নিতে পারেননি। তিনি জানালেন যে, এখানকার বৈজ্ঞানিক পরিভাষা তৈরির প্রক্রিয়ার সঙ্গে তিনি নিজেও সংশ্লিষ্ট ছিলেন। তাই তিনি জানেন : প্রভাবিত হওয়ার আশঙ্কাতেই পরিভাষাসৃষ্টিতে নিযুক্ত কেউই পশ্চিমবঙ্গের পণ্ডিতদের তৈরি পরিভাষা কোষগুলাে আগে খুলেও দেখেননি। এরপরও যদি পশ্চিমবঙ্গের সঙ্গে আমাদের তৈরি পরিভাষার মিল খুঁজে পাওয়া যায়, তবে বলতে হবে যে দু’দেশের ভাষার অভিন্নতার জন্যেই এমনটি হয়েছে। বাংলা পরিভাষা সৃষ্টিতে সংস্কৃতের সাহায্য গ্রহণ কেন অপরিহার্য তার ভাষাতাত্ত্বিক ব্যাখ্যাও ডাক্তার নন্দী অত্যন্ত চমৎকারভাবে তুলে ধরলেন। ভাষাবিজ্ঞানের খুঁটিনাটি বিষয়ে একজন চিকিৎসা-বিজ্ঞানীর এমন গভীর জ্ঞানের পরিচয় পেয়ে সেমিনারের শ্রোতারা অবাক হয়ে গিয়েছিলেন।
গােলাম মােস্তফার বিরুদ্ধে সবচেয়ে তীব্র, তীক্ষ ও পাণ্ডিত্যপূর্ণ বক্তব্য রেখেছিলেন, চট্টগ্রামের একজন শিক্ষক মিলন প্রভাস বড়ুয়া। আবহাওয়া ক্রমেই উত্তপ্ত হয়ে উঠছে বুঝতে পেরে সভাপতি দ্রুত সভার সমাপ্তি ঘােষণা করলেন।
গােলাম মােস্তফার সেদিনকার কথাগুলাে অবশ্যই বিচ্ছিন্ন বা ব্যতিক্রমী কিছু ছিলাে না। পাকিস্তানবাদীরা যদিও প্রতিনিয়ত জিন্নাহর উক্তি উদ্ধৃত করে বলতাে যে, পাকিস্তান টিকে থাকার জন্যেই এসেছে, তবু মনে মনে তারা বােধহয় সব সময়ই এই অস্বাভাবিক কৃত্রিম রাষ্ট্রটির বিনাশ-আশঙ্কায় শঙ্কিত থাকতাে। তারা সবচেয়ে বেশি ভয় পেতাে আবহমান বাংলার ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতিকে। বাঙালি সংস্কৃতির যে কোনাে রকম অভিব্যক্তির মধ্যেই তারা। পাকিস্তানের তাহজিব-তমদ্দুন ধ্বংসের আলামত দেখতে পেতাে। আর পেতে হিন্দু গন্ধ। সারমেয়র চেয়েও তীক্ষ্ণ এদের ঘ্রাণশক্তি। উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা বানাতে না পেরে বাংলাকেই উর্দু বানানাের চেষ্টা, তাও না পেরে বাংলার হরফ বদলানাের কোশেশ, তাতেও ব্যর্থ হয়ে বাংলা হরফের সংস্কারের নামে সংহারের ষড়যন্ত্র—একের পর এক এ-সব তারা করেই চললাে।
এলাে উনিশ শো একষট্টি সাল। সারা পৃথিবী জুড়ে চললাে রবীন্দ্র-শতবার্ষিকী উদযাপনের আয়ােজন। কিন্তু যে বাংলা ভাষার কবি রবীন্দ্রনাথ, সেই বাংলা ভাষাভাষী মানুষদের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশের অধিবাস যে ভূখণ্ডে, সেই পূর্ব পাকিস্তানেই রবীন্দ্রনাথকে অবাঞ্ছিত বলে ঘােষণা করার মতাে একটি চক্রের অভ্যুত্থান ঘটলাে। পাকিস্তানে তখনাে জঙ্গী শাসনই চলছে। জঙ্গী শাসকরা যদিও রবীন্দ্রনাথ বা রবীন্দ্র শতবার্ষিকী উদযাপন নিয়ে কোনাে উচ্চবাচ্য করলাে না, তবু বাঁশের চেয়ে কঞ্চি দড় পাকিস্তানবাদী বুদ্ধিজীবীর একটি দল মওলানা আকরম খাঁর আজাদ পত্রিকার ওপর ভর দিয়ে হাউমাউ শুরু করে দিলাে। রবীন্দ্রনাথ ছিলেন মুসলিমবিরােধী, কাজেই মুসলিম রাষ্ট্র পাকিস্তানে যারা রবীন্দ্র-শতবার্ষিকী নিয়ে মেতে উঠেছে তাদের
২৪৯
উদ্দেশ্য এই মুসলিম রাষ্ট্রটিকে ধ্বংস করে হিন্দু-শাসিত যুক্তবঙ্গের পথ খােলসা করা—এমন ধারা বক্তব্যের বান ছুটলাে আজাদ-এ প্রকাশিত সম্পাদকীয়তে, নানা প্রবন্ধে-নিবন্ধে ও চিঠিপত্রে। আজাদ-এর এই ন্যক্কারজনক ভূমিকার বিরুদ্ধে দৃঢ় অবস্থান নিয়ে দাঁড়ালাে ইত্তেফাক ও সংবাদ। বিশেষ করে ইত্তেফাক। আমরা দেখেছি : উনিশোে সাতান্ন সালে কাগমারি সম্মেলনকে উপলক্ষ করে ইত্তেফাক যে ভূমিকা নিয়েছিলাে তা ছিলাে আজাদের ভূমিকারই অনুরূপ। তার চেয়েও উগ্র বরং। আজাদ যে- রকম যে-কোনাে প্রগতিশীল চিন্তা ও কর্মকাণ্ডের মধ্যে পাকিস্তান-ধ্বংস ও যুক্তবাংলা প্রতিষ্ঠার ভারতীয় চক্রান্ত দেখতে পেতাে, ইত্তেফাকও সেদিন ওই কাগমারি সম্মেলনের মধ্যে সে-রকমই দেখছিলাে। সেদিন হােসেন শহীদ সােহরাওয়ার্দীর অবস্থান ছিলাে পাকিস্তানের রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার বৃত্তসীমার ভেতর। তাই সােহরাওয়ার্দী-সমর্থক ইত্তেফাকেরও কট্টর পাকিস্তানবাদী প্রতিক্রিয়াশীল ভূমিকা। কিন্তু আটান্নর সামরিক শাসন ক্ষমতার বৃত্ত থেকে সােহরাওয়ার্দীর মতাে রাজনীতিকদের দূরে সরিয়ে দেয়ার পর একষট্টিতে ইত্তেফাকের অবস্থানও স্বাভাবিকভাবেই অন্যরকম হতে বাধ্য। যে-কারণেই হােক, রবীন্দ্র শতবার্ষিকীকে উপলক্ষ করে আজাদের তথা প্রতিক্রিয়াশীল পাকিস্তানবাদীদের রবীন্দ্র-নিন্দা ও বাঙালির সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের বিরােধিতাকে ইত্তেফাক যে-রকম প্রশংসনীয় দৃঢ়তার সঙ্গে মােকাবেলা করেছিল, ভাবীকালের বাঙালিকেও তা কৃতজ্ঞচিত্তে স্মরণ করতে হবে। সেই সঙ্গে, আমি তাে মনে করি, আমাদের কৃতজ্ঞ থাকা উচিত পাকিস্তানবাদী প্রতিক্রিয়াশীলগােষ্ঠী ও তাদের মুখপত্র আজাদের প্রতিও! কারণ, আজাদের রবীন্দ্র-নিন্দার প্রতিক্রিয়াতেই তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের সমগ্র শিক্ষিত সমাজে রবীন্দ্র-বিতর্ক অতি দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। বিশুদ্ধ অ্যাকাডেমিক আলােচনার সীমা ছাড়িয়ে এ-বিতর্ক একটা রাজনৈতিক চারিত্র্য লাভ করে বসে এবং বাঙালি জাতীয়তাবােধের বিকাশে এর ভূমিকা হয়ে পড়ে সুদূরপ্রসারী। প্রতিক্রিয়াশীলদের রবীন্দ্র-বিদ্বেষই এদেশে রবীন্দ্রচর্চার (অন্তত রবীন্দ্রসচেতনতার)—বিস্তৃতি ঘটানােতে অনুঘটকের কাজ করে। রবীন্দ্রসঙ্গীতের এমন জনপ্রিয়তা যে একষট্টি সালের আগে ছিলাে না—এ-কথা মানতেই হবে। প্রতিক্রিয়াশীলরা যদি সেদিন এমন রবীন্দ্রবিরােধী ভূমিকায় প্রকাশ্যে অবতীর্ণ না হতাে, তবে হয়তাে আমাদের দেশে রবীন্দ্র জন্মশতবার্ষিকীর অনুষ্ঠান ততাে জোরদার হতাে না, বড়জোর বিদগ্ধ সাহিত্যসেবী মহলেই তা সীমাবদ্ধ থাকতাে। তার বদলে সেদিনকার পূর্ব পাকিস্তানের রাজধানীতে তাে বটেই, প্রত্যন্ত অঞ্চলের গ্রামেগঞ্জে পর্যন্ত কয়েক মাসব্যাপী রবীন্দ্র শতবার্ষিকী অনুষ্ঠানের জোয়ার বয়ে গিয়েছিলাে। আমরাও বারহাট্টা ক্লাবে আঁকজমকের সঙ্গে অনুষ্ঠানের আয়ােজন করেছিলাম।
রবীন্দ্র জন্ম শতবার্ষিকীকে ঘিরে ঢাকায় যে সব কর্মকাণ্ড চলেছিলাে সে সবের বিবরণ আমরা নানা বইপুস্তকে পাই। কিন্তু বারহাট্টার মতাে একটি স্থানে (যে স্থানটি আসলে একটি গ্রামই) রবীন্দ্র শতবার্ষিকী উদ্যাপনের রেকর্ড কি কেউ রেখেছে কোথাও? রাখেনি বলেই কিংবা ইতিহাসকাররাও রাজধানীর বাইরের মানুষের ভাবনাচিন্তা ও কর্মকাণ্ডকে তেমন। গুরুত্বপূর্ণ মনে করেন না বলেই—সমাজ ও সংস্কৃতির খণ্ডিত ইতিহাস নিয়েই আমাদের তুষ্ট থাকতে হয়।
আমি তখন বারহাট্টা ক্লাবের সাহিত্য-সম্পাদক। কাজেই রবীন্দ্র-শতবার্ষিকীর আয়ােজনের সঙ্গে আমাকে প্রত্যক্ষভাবেই সংশ্লিষ্ট থাকতে হয়েছিলাে। লক্ষ করেছি : থানা পর্যায়ের কিছু কিছু অফিসার ছিল ঘাের প্রতিক্রিয়াশীল, তারা আজাদ পত্রিকার ভাষায় কথা বলতাে। তবে হাজার চেষ্টা করেও তারা রবীন্দ্র শতবার্ষিকীর অনুষ্ঠান বন্ধ করতে পারেনি। কারণ বারহাট্টায়
২৫০
রবীন্দ্র-অনুরাগী তথা প্রগতিশীলদের পাল্লাই ভারি ছিলাে। অফিসারদের অধিকাংশই ছিলেন প্রগতিপন্থী। তখন বারহাট্টা ক্লাবের সভাপতি ছিলেন সাব রেজিস্ট্রার আশরাফ হােসেন। উদারচিত্ত এ-মানুষটি সেদিন বারহাট্টা ক্লাবকে প্রতিক্রিয়াশীলদের শ্যেন দৃষ্টি থেকে রক্ষা করতে সক্রিয়ভাবে এগিয়ে এসেছিলেন। ক্লাবের সাধারণ সম্পাদক নৃপেন্দ্র নারায়ণ চক্রবর্তীও ছিলেন একান্ত দৃঢ়চিত্ত সংস্কৃতিসেবী। এছাড়া ছিলেন আজিজুল ইসলাম খান, ওয়াজেদ আলী, আমজাদ আলী ও আলতাফুর রহমান খানের মতাে ত্যাব্রতী ও প্রগতিচেতন রাজনীতিক নেতাকর্মী। এরা সকলেই রবীন্দ্র জন্ম শতবার্ষিকী উদযাপনকে একটা পবিত্র দায়িত্ব হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন। নির্মলেন্দু গুণের মতাে অনেক কিশাের ছাত্রের উৎসাহ-উদ্দীপনা তিনদিনব্যাপী অনুষ্ঠানকেই একান্ত প্রাণবন্ত করে রেখেছিলাে। মূল অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হয়ে এসেছিলেন নেত্রকোনা মহকুমার তৎকালীন গণসংযােগ অফিসার মােফাজ্জল আলী। প্রতিক্রিয়াশীল পাকিস্তান সরকারের এমন একজন রবীন্দ্র-অনুরাগী কর্মচারীর সরস ও সজীব আলােচনা আমাদের সকলকে সেদিন অবাক করে দিয়েছিলাে।

আইউব-বিরােধী আন্দোলনের বীজতলা তৈরি
বাষট্টি সাল পর্যন্ত মােটামুটি আরামেই রাজত্ব করলেন পাকিস্তানের জঙ্গবাহাদুর মােহাম্মদ আইউব খান। অন্তত প্রকাশ্যে তার বিরুদ্ধে কোনাে আন্দোলন বা বিক্ষোভ হয়নি। সামরিক শাসন জারির মাত্র তিন মাস পরে, উনষাট সালের জানুয়ারিতে আদমজী জুটমিলের পঁচিশ হাজার শ্রমিক মালিকদের নির্যাতনের বিরুদ্ধে যে ধর্মঘট সংগ্রামে নেমেছিলাে, সামরিক শাসনকর্তারা নৃশংস ও বর্বর দমননীতি চালিয়ে সে সংগ্রামকে স্তব্ধ করে দিয়েছিলাে। আদমজীর পর অন্যান্য মিলের শ্রমিকদের আন্দোলনও তারা দমন করেছিলাে একই পদ্ধতিতে। ডাণ্ডা মেরে সব ঠাণ্ডা করে দিয়েছি—এ রকম ভেবে আইউব আর তাঁর জঙ্গী চেলা চামুণ্ডারা বেশ আত্মপ্রসাদে প্রসন্ন হয়ে উঠেছিলেন। সাধারণ মানুষজনও ভাবতে শুরু করেছিলেন যে, আইউব খানকে গদি থেকে নামাতে পারে এমন কোনাে বাপের বেটার জন্ম পাকিস্তানে হয়নি।
আইউব খানদের আত্মপ্রসাদ ও দেশের নাগরিককূলের হতাশা একেবারে অকারণ ছিলাে । আন্দোলন-সংগ্রামের জন্যে যাদের ওপর মানুষ ভরসা করে সেই রাজনৈতিক নেতৃত্বের ক্লীবতা আগে থেকেই স্পষ্ট হয়ে উঠেছিলাে। জঙ্গি আইনে রাজনৈতিক কার্যকলাপ নিষিদ্ধ হয়ে যাবার পর কোনাে রাজনৈতিক দলই সে আইন অমান্য করতে সাহসী হয়নি। প্রকাশ্যে তাে নয়ই, গােপনেও নয়।
তবে ব্যতিক্রম তাে নিশ্চয়ই ছিলাে। কেউ-না-কেউ কোথাও-না-কোথাও হয়তাে জঙ্গি শাসনের বিরুদ্ধে কোনাে-না-কোনােভাবে প্রতিবাদ জানাবার চেষ্টা করছে। কিন্তু এ রকম কোনাে প্রতিবাদকারীর খবর আমার জানা ছিলাে না। ব্যতিক্রমী হিসেবে আমি শুধু জানতাম কম্যুনিস্টদের। সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র পাকিস্তানে কম্যুনিস্টরা যে বিপুল জনপ্রিয়তার অধিকারী ছিলাে না, সে তাে সবাই জানে। প্রকাশ্যে কাজ করার সুযােগ থেকে তারা বহুদিন থেকেই ছিলাে বঞ্চিত। তবু সে সময়কার পূর্ব পাকিস্তানে অন্য কোনাে রাজনৈতিক সংগঠনেরই কমুনিস্টদের চেয়ে বেশি সংহত সাংগঠনিক শক্তি ছিলাে না।
যদিও কমুনিস্টদের গােপন তৎপরতা তখনাে পর্যন্ত ফলপ্রসূ কিছু করে উঠতে পারেনি, তবু তাদের সাধ্য মতাে ভবিষ্যতের আন্দোলনের বীজতলা তৈরির কাজে নিজেদের তারা নিযুক্ত
২৫১
রেখেছিলাে অত্যন্ত নিষ্ঠার সঙ্গে। বীজতলা তৈরির খবরটি আমার কাছেও পৌঁছে গিয়েছিলাে। পৌছিয়ে দিয়েছিলেন দু’জন মানুষ। একজনের নাম আজিজুল ইসলাম খান, অন্যজন শাহ আবদুল মােতালেব ওরফে সুরুজ মিঞা। সুরুজ মিঞার সঙ্গে আমি অনেক আগে থেকেই পরিচিত। আমাদের গ্রাম থেকে মাইল ছয়েক দূরে বায়রাউরা গ্রামে তার বাড়ি। আমার বন্ধু আবদুস শাহিদের সঙ্গেই নানা রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে তাঁকে দেখেছি। যদিও তিনি প্রথমে আওয়ামী লীগ ও পরে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির সঙ্গে যুক্ত থেকে প্রকাশ্য রাজনৈতিক ক্রিয়াকলাপ চালিয়ে গিয়েছিলেন, তবু তার রাজনীতির মূলটি প্রােথিত ছিলাে নিষিদ্ধ ঘােষিত কম্যুনিস্ট পার্টির গােপন গভীরে। বারহাট্টার কাছাকাছি গ্রাম যশমাধবের অধিবাসী আজিজুল ইসলাম খানেরও তাই। বারহাট্টায় গিয়েই, উনষাট সালে, আজিজুল ইসলাম খানের সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয়। তিনি তখন বারহাট্টা হাইস্কুলের ম্যানেজিং কমিটির সদস্য, বারহাট্টা ক্লাবের পরিচালকমণ্ডলীর অন্যতম প্রধান, এলাকার নানা ধরনের সামাজিক-সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে তার সক্রিয় ভূমিকা।
এরা দুজনে মিলেই ক্যুনিস্ট পার্টির গােপন স্রোতধারাটির সঙ্গে, খুব ক্ষীণ হলেও, আমারও একটা যােগসূত্র তৈরি করে দিলেন। পার্টির সাইক্লোস্টাইল করা মুখপত্র শিখা নিয়মিত আমার হাতে আসতে লাগলাে। শিখার পাতা থেকেই পার্টির বক্তব্য সম্পর্কে অবহিত হতে থাকলাম। জানলাম: সামরিক শাসন জারির কিছুদিন পরই কম্যুনিস্ট পার্টি কেন্দ্রীয় কমিটির এক বৈঠকে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক রাজনীতির পর্যালােচনায় বসে। সে বৈঠকে পাকিস্তানে সামরিক অভ্যুত্থানের কারণগুলােও খতিয়ে দেখা হয়। পার্টি লক্ষ করে যে, পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় শাসকগােষ্ঠী অভ্যন্তরীণ সংকটে দিশেহারা হয়ে পড়েছিলাে। দেশে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলে কায়েমি স্বার্থের রক্ষক গােষ্ঠীটি যে ক্ষমতায় থাকতে পারবে না, এ রকম ধারণা তারা করে ফেলতে পেরেছিলাে। তাদের প্রভু মার্কিন সাম্রাজ্যবাদীরাও ছিলাে শঙ্কাকুল। এ-সব লক্ষ করে পূর্ব পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় কমিটি তার প্রস্তাবে বলে :
‘ইরাক বিপ্লব ও বাগদাদ চুক্তির সঙ্গে ইরাকের সম্পর্কচ্ছেদের ফলে মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদীদের সােভিয়েত বিরােধী যুদ্ধচক্রান্তে এক সমস্যা দেখা দিয়েছিলাে। সে অবস্থাতে ঐ যুদ্ধচক্রান্তে পকিস্তানের গুরুত্ব বৃদ্ধি পেয়েছিলাে। তাই তখন পাকিস্তানে সামরিক জোট বিরােধী আন্দোলন দৃঢ় হাতে দমন করা সাম্রাজ্যবাদের স্বার্থেও প্রয়ােজন হয়েছিলাে। অতএব, শুধু পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ ঘটনাবলীই নয়, পরন্তু মার্কিন সাম্রাজ্যবাদীদের ‘গ্লোবাল স্ট্রাটেজি তথা যুদ্ধ চক্রান্তের স্বার্থেও পাকিস্তানে সামরিক শাসন জারি করা হয়েছিলাে।
[দ্রষ্টব্য : খােকা রায়ের সংগ্রামের তিন দশক (ঢাকা-১৯৮৬) পৃষ্ঠা-১৭৫]।
এই সামরিক শাসনের অবসান যারা চায় তাদের ঐক্যবদ্ধ করার একটা তাগিদ কম্যুনিষ্ট পার্টি অনুভব করেছিলাে। সেই তাগিদ থেকেই গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা, সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠান, রাজবন্দিদের মুক্তি এবং খেটে খাওয়া মানুষের আশু ও জরুরি সমস্যার সমাধান—এ রকম কিছু ন্যূনতম দাবিদাওয়ার ভিত্তিতে গণতান্ত্রিক শক্তির ঐক্যমাের্চা গঠন ও ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন গড়ে তুলতে প্রস্তুত হওয়ার প্রয়ােজনীয়তার কথাটাই পার্টি তার সদস্য, কর্মি ও সমর্থকদের সামনে তুলে ধরেছিলাে।
কেন্দ্রীয় কমিটির বিশ্লেষণ ও সিদ্ধান্ত বেশ দ্রুত গতিতেই পার্টির কর্মি ও সমর্থকরা জেনে যায়, তাদের হতাশা কেটে যেতে থাকে, সকলেই আপন আপন ক্ষেত্রে কর্মতৎপর হয়ে ওঠে। এ সব তৎপরতা চলতাে কঠোর গােপনীয়তার সঙ্গে। অন্যের কাছে তাে দূরের কথা, কোনাে
২৫২
কর্মি বা সমর্থকের সামনেও পুরাে তৎপরতার পরিচয় উদ্ঘাটিত হতাে না। শিখায় যা পড়তাম (কিংবা সাধারণ কর্মিদের জন্যে প্রচারিত পার্টির কিছু সার্কুলারের মধ্যে যা পেতাম) তার বাইরে কোনাে কিছু, এমনকি আমার বিশ্বস্ত বন্ধুদের কর্মতৎপরতার বিষয়ে, জানাও তখন আমার পক্ষে সম্ভব ছিলাে না। তবু টের পেলাম : আবদুস শাহিদ পার্টির কাজের সঙ্গে বেশ গভীরভাবে সম্পৃক্ত হয়ে গেছে, বেশকিছু নতুন কর্মি রিক্রুট করেছে, অনেক কট্টর কম্যুনিস্ট বিরােধীকেও কম্যুনিস্ট সমর্থক বানিয়ে ফেলেছে, অত্যন্ত শান্ত ও প্রায় গােবেচারা ধরনের আবদুল মতিনকেও সে দলে ভিড়িয়ে নিয়েছে। কুনিহাটি গ্রামের মৌলবী আবদুল গনি সাহেবের পুত্র আবদুল মতিনকে তাে আমি তার বাপের মতাে গোঁড়া মুসলমান বলেই জানতাম। সেই মতিনকে কম্যুনিস্ট বানিয়ে ফেলা মােটেই চাট্টিখানি কথা নয়। অথচ, আমার মতাে আরাে অনেককে অবাক করে দিয়ে শাহিদ সেই প্রায় অসম্ভব কাজটিই করে ফেলে। আর কমুনিস্ট রূপে মতিন সে সময় নানা কাজে যথেষ্ট যােগ্যতা ও দায়িত্ববােধের পরিচয় দিতে থাকে।
দীননগর গ্রামের আবদুল আজিজ শুধু একজন কৃতী শিক্ষকই ছিলেন না, প্রগতিশীল রাজনৈতিক নেতা হিসেবেও সাধারণ্যে তাঁর পরিচিতি ছিলাে। নেত্রকোনা ন্যাপের তিনি ছিলেন অন্যতম প্রধান সংগঠক। কিন্তু সামরিক শাসন জারির পর সবাই তাকে একজন নিষ্ঠাবান শিক্ষকের ভূমিকাতেই দেখতে পেলাে। রাজনীতির সাতে-পাঁচে আর এই লােকটি নেই– মাস্টারিতে তার নিষ্ঠা দেখে দেশ-গাঁয়ের মানুষের হয়তাে এ রকমই ধারণা হয়েছিলাে। অথচ সেই নিরীহ ইস্কুল-মাস্টারটি যে ক্যুনিস্ট পার্টির পলাতক নেতা ও পাকিস্তানি শাসকদের ঘাের শত্রু মনিসংহকে নিয়ে চলাচল করেন, পুলিশের চোখে ধুলাে দিয়ে তাকে নানা স্থানে নিয়ে যান, অন্য অন্য নেতা-কর্মিদের সঙ্গে তার যােগাযােগ ঘটিয়ে দেন—কাকপক্ষীটিও বােধহয় তা টের পায়নি।
এ রকমই আরেক জন ইস্কুল মাস্টার ছিলেন হরিশঙ্কর চৌধুরী, যার কথা আগেও একবার বলেছি। নেত্রকোনার উকিলপাড়ায় একটা ছােট্ট বাসায় তিনি থাকতেন। সকাল-বিকাল তার ছােট্ট ঘরটিতে বসে ছাত্র পড়াতেন। এরই ফাঁকে ফাঁকে তিনি আসর জমাতেন তরুণ ছাত্র, রাজনীতিক ও সংস্কৃতিকর্মিদের নিয়ে। মিতবাক অথচ সুরসিক হরিশঙ্কর বাবু যে আসরের মধ্যমণি, সে আসর যে হবে সূক্ষ্ম ও মার্জিত রসিকতার একটি স্নিগ্ধ প্রস্রবণের মতাে, তেমনটিই তাে স্বাভাবিক। তবু কিন্তু কোনােমতেই সেটি অলস বিশ্রম্ভালাপের আড্ডা হয়ে ওঠেনি। শিক্ষক হরিশঙ্কর চৌধুরীর উকিলপাড়ার আসরটি আসলে ছিলাে নেত্রকোনার প্রগতি-আন্দোলনের একটি অচিহ্নিত যােগাযােগ কেন্দ্র। আইউবী জঙ্গি শাসনের আমলে কেন্দ্রটি একান্তভাবেই সক্রিয় হয়ে উঠেছিলাে।
নেত্রকোনা শহরে হােমিওপ্যাথি ডাক্তার মৃণাল বিশ্বাস ও তার ভাইদের প্রায় সবাই ছিলেন ক্যুনিস্ট। পুরাে পরিবারটিই ছিলাে প্রগতিশীল কর্মকাণ্ডের সঙ্গে নানাভাবে সংযুক্ত। জঙ্গি শাসনের সেই ভীতিকর দিনগুলােতেও, অনেক বিপদের ঝুঁকি মাথায় নিয়েও, এই পরিবারটি রাজনৈতিক সক্রিয়তা বজায় রেখেছিলাে।
এ রকম মার্কামারা বা মার্কাহীন রাজনৈতিক কর্মিরাই যে কেবল জঙ্গী শাসন-বিরােধী আন্দোলনের বীজতলা তৈরিতে নিযুক্ত ছিলেন, তা নয়। অনেক অবিশ্বাস্য স্থান থেকে, এমনকি শাসকচক্রের একেবারে ভেতর মহল থেকে, অনেকে এ কাজে এগিয়ে এসেছিলেন। অর্থাৎ বাঘের ঘরেও ছিলাে ঘােগের বাসা। যে আমলা-কর্মচারীদের দিয়ে শাসকরা তাদের
২৫৩
স্বৈরশাসনের থাবা সমাজের সকল স্তরে বিস্তৃত করে দেয়, তাদের মধ্যেও সে-শাসনের সক্রিয় ও অক্রিয় শত্রুর সংখ্যা একেবারে কম ছিলাে না। বারহাট্টায় এ রকমই একজন সরকারি কর্মচারীর সংস্পর্শে আমি এসেছিলাম। রবীন্দ্র শতবার্ষিকীর প্রসঙ্গসূত্রে তার নামটি আগেই উল্লেখ করেছি। তিনি আশরাফ হােসেন। বারহাট্টার তৎকালীন সাবরেজিস্ট্রার। সার্কেল অফিসার ছিলাে সে সময়ে থানা পর্যায়ে সর্বোচ্চ পদমর্যাদার অফিসার। বারহাট্টায় সার্কেল অফিসারের অফিস ছিলাে না। তাই মর্যাদার বিচারে সেখানকার সাবরেজিস্ট্রারই ছিলেন সবার ওপরে। সাব রেজিস্ট্রার আশরাফ হােসেনের বৈদগ্ধ্য, সংস্কৃতি-মনস্কতা ও উদারতার পরিচয় বারহাট্টায় পা দিয়েই পেয়েছিলাম। কিছুদিন পর পেলাম তাঁর অন্যতর পরিচয়। সেটি রাজনীতি-সম্পৃক্ততার। ছাত্রজীবনে তিনি ছিলেন ছাত্র ফেডারেশনের কর্মী। সে সময় থেকেই মণি সিংহ ও খােকা রায়ের মতাে ক্যুনিস্ট নেতাদের সঙ্গে তাঁর সংযােগ। কর্মজীবনেও সে সংযােগ ছিন্ন হয়নি, সংগুপ্ত হয় মাত্র। অর্থ সাহায্য থেকে শুরু করে আরাে নানাভাবে কমুনিস্টদের তিনি সহায়তা করতেন। আত্মগােপনকারী অনেক কমুনিস্ট নেতা তাঁর ময়মনসিংহ শহরের বাসায় অনেকবার এসে আশ্রয় নিয়েছেন, গােপন বৈঠক করেছেন। জনাকীর্ণ শহরের বাসভবনে নিষিদ্ধ মানুষদের আশ্রয় দান করার মধ্যে বিপদের ঝুঁকি আছে সন্দেহ নেই, তবু বারহাট্টার মতাে ছােট্ট জায়গায় থানা-পুলিশের একেবারে নাকের ডগায় এমনটি করার ঝুঁকি নিশ্চয়ই অনেক বেশি। অথচ, সে রকম ঝুঁকি নিতেও পিছপা হননি প্রতিক্রিয়াশীল পাকিস্তান সরকারের প্রগতিশীল এই কর্মচারীটি। থানার খুবই কাছে একটি ছােট্ট বাসায়, সেই উনষাট সালে, তিনি থাকতেন। এই বাসাতেই, মিলিটারির হুলিয়া মাথায় নিয়ে, দিন তিনেকের জন্যে আশ্রয় নিয়েছিলেন নেত্রকোর ক্যুনিস্ট নেতা সুকুমার ভাওয়াল।
সে সময়ে পার্টির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট লােকদের রাজনৈতিক প্রশিক্ষণ দেয়ার ব্যাপারে বিশেষ জোর দেয়া হয়েছিলাে। সে সূত্রেই বিভিন্ন গােপন আস্তানায় কমরেড সুকুমার ভাওয়ালের সঙ্গে আমার দেখা হতাে। একবার দেখা হলাে কমরেড অজয় রায়ের সঙ্গে। যশমাধব গ্রামে আজিজুল ইসলাম খানের এক আত্মীয়ের বাড়িতে দু’দিন দু’রাত পলাতক অজয়দার সাহচর্যে কাটিয়েছিলাম। তার সঙ্গে সেবার অনেক বাকবিতণ্ডা ও তর্কবিতর্ক হয়েছিলাে। বিভিন্ন বিষয়ে আমি হতাশা প্রকাশ করলেও অজয়দাকে দেখলাম প্রচণ্ড আশাবাদী। নানা তথ্য ও যুক্তি প্রয়ােগ করে তিনি বললেন যে, কিছুটা সময় লাগলেও দেশে সামরিক শাসন বিরােধী আন্দোলন শুরু হবেই। আইউব সম্পর্কে জনগণের মােহ এরই মধ্যে কাটতে শুরু করেছে। অজয়দা তার সেই আশাবাদ আমার এবং আমার সেদিনকার সঙ্গীদের মধ্যেও সঞ্চারিত করে ছেড়েছিলেন।
এর কিছুদিন পরই অজয়দার গ্রেফতারের খবর পেলাম।
ঈশ্বরগঞ্জে কমরেড পরেশ দাসের বাড়িতে কমরেড জ্যোতিষ বােস আর সুকুমার ভাওয়াল পুলিশের হাতে ধরা পড়লেন উনষাট সালের শেষ দিকে। সেই সঙ্গে পরেশ দাস আর তার স্ত্রীও গ্রেফতার হয়েছিলেন। পরেশদার স্ত্রী ছাড়া পেলেও কোর্টের বিচারে পরেশ দা ও সুকুমার দা’র সাজা হয়ে যায়। পাঁচ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড। সুকুমার দা’র ওপর তাে পুলিশ অমানুষিক নির্যাতন চালায়। এতে বেশ কিছুদিনের জন্যে তিনি মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেন।
কাজী আবদুল বারিও এরই কাছাকাছি সময়ে গ্রেফতার হয়ে যান। তার সঙ্গে ছিলাে নিষিদ্ধ কম্যুনিস্ট পার্টির নিষিদ্ধ কাগজপত্র। এই ‘বিপজ্জনক’ মানুষটিকে জঙ্গি শাসকরা তাদের জংলী আইনে বিচারের নামে প্রহসন করে চৌদ্দ ঘা বেতের বাড়ি দেয়। এতে চিরজীবনের জন্যে তিনি বধির হয়ে যান ও স্নায়ুবৈকল্যে আক্রান্ত হন।
২৫৪
কমরেড জ্যোতিষ বােসের কারাদণ্ড হয়। জঙ্গি শাসকরা তার সমস্ত সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করে এবং সঙ্গে সঙ্গে নিলামে বিক্রি করে দেয়। স্বামীর ‘অপরাধে’ তাঁর স্ত্রী ছায়া বােস সদ্যজাত কন্যাসন্তান নিয়ে আশ্রয়হীন ও নিরাপত্তাহীন হয়ে নানাজনের করুণানির্ভর জীবন যাপনে বাধ্য হন।
শাহিদের কাছে শিখা সহ আরাে নানা নিষিদ্ধ কাগজপত্র আছে—এই খবর পেয়ে পুলিশ তার গ্রামের বাড়িতে হানা দেয়। কিন্তু সে সব কাগজপত্রের হদিস পায়নি। শাহিদের ছােট ভাই সেগুলাে আগেই সরিয়ে ফেলেছিলাে।
এরকম হয়রানি ও নির্যাতন চালিয়েও জঙ্গী শাসকরা নীলকণ্ঠ ক্যুনিস্টদের দমন করতে পারেনি। বরং তারা যে সার্থকভাবেই আন্দোলনের বীজতলা তৈরি করতে পেরেছিলাে, বাষট্টির ছাত্র বিক্ষোভেই তার প্রমাণ মেলে।

ছাত্র আন্দোলন বনাম সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা
দু’বছর বারহাট্টা হাইস্কুলে মাস্টারি করে একষট্টির আগস্টে ছেড়ে দিলাম। বাংলায় এমএ পড়ার জন্যে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হলাম। মাস্টারের চেয়ার ছেড়ে আবার ছাত্রের বেঞ্চে।
রাজশাহীতে যদিও বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলাে উনিশ শো তেপ্পান্ন সালে, তবু প্রতিষ্ঠার আট বছর পরেও, একষট্টি সালেও, বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি পূর্ণাঙ্গ রূপ তৈরি হয়ে ওঠেনি। সে সময়েও রাজশাহী শহরের বাইরে মতিহারে বিরাট এলাকা নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের নির্মাণ কাজ চলছে মাত্র।
তখন মতিহারে কয়েকটি মাত্র নির্মীয়মাণ ভবনে চার-পাঁচটি বিভাগের ক্লাস চালু হয়েছে। অধিকাংশ ক্লাস বসে রাজশাহী সরকারি কলেজ ভবনে। বিশ্ববিদ্যালয়ের অফিসও শহরে পদ্মার পাড়ে, লালকুঠিতে। বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব কোনাে ছাত্রাবাস নেই। রাজশাহী কলেজের ফুলার হােস্টেলেই তখন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা অবস্থান করে। এছাড়া শহরের এখানে-ওখানে কিছু বাড়ি ভাড়া নিয়েও বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ কিছু ছাত্রের থাকার ব্যবস্থা করেছিলেন। মতিহারে যাদের ক্লাস হতাে সে ছাত্ররা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাসে চড়ে শহর থেকে যাতায়াত করতাে। কিছু ছাত্রের জন্যে অবিশ্যি মতিহারে কয়েকটি টিন শেডে থাকার ব্যবস্থা হয়েছিলাে। এমনই এক জৌলুসহীন অবস্থার মধ্যে তখনকার রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের দিন কাটাতে হতাে যে তারা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের সঙ্গে তুলনা করে এক ধরনের হীনমন্যতায় ভুগতাে।
আমার সঙ্গে শচীন আইচও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র হয়েছিলাে। সে ভর্তি হয়েছিলাে ইংরেজির এমএ ক্লাসে। আমরা দুজনেই শহরের রানীবাজারে সুধীর গােবিন্দ মৈত্রের বাসায় পেয়িং গেস্ট হিসেবে থাকার জায়গা করে নিয়েছিলাম। কিন্তু কিছুদিনের মধ্যেই শচীনের এক ধরনের ভীতিরােগ দেখা দিলাে। রাস্তায় বেরােলেই সে মারা যাবে—এমন একটা ধারণা তাকে পেয়ে বসে। এমন কি ঘরেও সে একা থাকতে ভয় পেতে লাগলাে, আমাকে সে কিছুতেই বাইরে যেতে দিতে চাইতাে না। শেষ পর্যন্ত তাকে আমি ময়মনসিংহে তার বাসায় রেখে আসতে বাধ্য হলাম। তার আর এমএ পড়া হলাে না।
শচীন রাজশাহী থেকে চলে যাওয়ার কিছুদিন পরই—বাষট্টির ফেব্রুয়ারি থেকে মে মাসের মধ্যে—দু’দু’টো ঘটনা ঘটে গেলাে। প্রথমটি ছাত্র আন্দোলন ও পরেরটি সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা। ঢাকাতে আইউব বিরােধী ছাত্র আন্দোলন শুরু হয়ে যাওয়ার অনেকদিন পরও রাজশাহীর ছাত্ররা
২৫৫
নিরুত্তাপই ছিলাে। রাজধানীর তুলনায় এই বিভাগীয় সদরটির ছাত্রদের রাজনৈতিক সচেতনতা কিছুটা কম থাকা মােটেই অস্বাভাবিক নয়। তবে একটা বিশ্ববিদ্যালয় তাে আছে সেখানে, বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা এতাে পিছিয়ে থাকবে কেন—এ ধরনের অনুযােগ ঢাকার ছাত্রদের কাছ থেকে প্রতিনিয়তই আসতে লাগলাে। রাজশাহীর ছাত্ররা কি মার্শাল ল’র ডাণ্ডার ভয়ে আন্দোলনে নামছে না? এতােই যদি ভয়, তবে তারা শাড়ি আর চুড়ি পরে অন্দরে চলে গেলেই পারে, বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে আসার শখ কেন তাদের? সত্যি কি না জানি না, এ-কথাটাই স্মরণ করিয়ে দেয়ার জন্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা নাকি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের নামে ডাকযােগে শাড়ি ও চুড়ি পাঠিয়ে দিয়েছিলাে। হতে পারে এসব কথা নিতান্তই রটনা, তার পেছনে ঘটনা হয়তাে একটুও ছিলাে না। পুরুষের শাড়ি আর চুড়ি পরার কথা বলে কাপুরুষ বাঙালি পুরুষতন্ত্র তার বিকৃত পৌরুষের অহমিকার তৃপ্তি ঘটায়। এ-ধরনের রটনার মূলেও হয়তােবা এরকমই তৃপ্তিলাভের অভিলাষ কার্যকর ছিলাে।
সে যাই হােক, কিছুটা দেরিতে হলেও বাষট্টি সালে রাজশাহীতে যে ছাত্র আন্দোলন হয়েছিলাে, প্রচণ্ডতা ও তীব্রতায় তা ঢাকার চেয়ে কম ছিলাে না কিছুতেই। একদিন সরকারি কলেজের ক্যাম্পাসে রাজশাহীর প্রায় সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের বিপুল সংখ্যক ছাত্র সমবেত হয়ে এক বিরাট মিছিল বের করার প্রস্তুতি নেয়, কিন্তু কলেজের গেট অতিক্রম করার আগেই পুলিশের ব্যারিকেডের সামনে পড়ে যায়। ছাত্রদের সঙ্গে প্রত্যক্ষ সংঘর্ষের পরে পুলিশ সমানে কাঁদানে গ্যাস ছুঁড়তে থাকে। ছাত্ররা দৌড়ে গিয়ে ফুলার হােস্টেলে আশ্রয় নেয় এবং ছাদের ওপর থেকে পুলিশদের লক্ষ করে সমানে ইট ছুঁড়ে মারে। কয়েক ঘণ্টা প্রচণ্ড লড়াই চলে। বহু ছাত্র গ্রেফতার হয়। কাজী শহীদ নামক একজন ছাত্রের সামরিক আদালতের বিচারে চৌদ্দ বছরের জেল হয়ে যায়।
ঘটনার দিন বিকেলেই রাজশাহী কলেজের কর্তৃপক্ষ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের ফুলার হােস্টেল ছেড়ে যেতে বাধ্য করেন। ওই হােস্টেলের দরােজা তাদের জন্যে চিরতরে বন্ধ হয়ে যায়। অনেক ছাত্র মতিহারে বিশ্ববিদ্যালয়ের নির্মীয়মান ভবনে গিয়ে আশ্রয় নেয়, অনেকেই আপাতত বাড়ি চলে যায়। কিন্তু আন্দোলন তাতে স্তব্ধ হয় না। আন্দোলনের তীব্রতার মুখে জঙ্গি শাসকরাই বরং তাদের জংলি আইনে নেয়া শাস্তিমূলক ব্যবস্থা প্রত্যাহার করে নিতে বাধ্য হয়, আটক ছাত্রদের ছেড়ে দেয়, চৌদ্দ বছরের কারাদণ্ডপ্রাপ্ত ছাত্র কাজী শহীদও অচিরেই সসম্মানে জেল থেকে বেরিয়ে আসেন।
আইউব-বিরােধী তথা মার্শাল ল’ বিরােধী ছাত্র আন্দোলনে জনমনে বিশেষ আশাবাদে উদ্বুদ্ধ হতে শুরু করেছে যে-সময়, সে-সময়েই প্রতিক্রিয়াশীলরা দেশের মানুষের দৃষ্টিকে ভিন্ন দিকে ঘুরিয়ে দেয়। খবর এলাে : পশ্চিমবঙ্গের মালদহে প্রচণ্ড মুসলিম-বিরােধী দাঙ্গা লেগে গেছে। রাজশাহীর সীমান্তবর্তী বলে মালদহ থেকে অতি সহজে নানান ধরনের সত্যিমিথ্যে খবর এখানে এসে পৌছায় এবং উত্তেজনার সৃষ্টি করে। এ-সময়েই তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর আজম খান যান রাজশাহী সফরে। নানা জায়গায় তিনি মালদহের দাঙ্গা সম্বন্ধে উত্তেজনকার বক্তৃতা দিতে থাকেন। সে সব বক্তৃতায় ভারতের মুসলমানদের জন্যে যেমন তিনি উদ্বেগ প্রকাশ করেন, তেমনি পাকিস্তানের হিন্দুরা যে পরম নিশ্চিন্তে বাস করছে সে কথাও বারবার উল্লেখ করেন। এ-দেশেও দাঙ্গা করার জন্যে যে তিনি প্রকাশ্যে সংখ্যাগুরু সম্প্রদায়ের লােকদের উস্কানি দিয়েছেন, তা অবশ্যই নয়। কিন্তু প্রতিক্রিয়াশীল সাম্প্রদায়িক শাসকদের
২৫৬
শাসন-কৌশলই এমন যে, স্থল ও সূক্ষ্ম বিভিন্ন উপায়ে তারা সব সময়ই সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষকে জাগিয়ে রাখে। তাদের শুভেচ্ছামূলক বাচনভঙ্গির মধ্যেও সে কৌশলটি সক্রিয় থাকে।
পাকিস্তানের অন্যতম জঙ্গি নায়ক আজম খানের বক্তব্যও নিশ্চয়ই প্রতিক্রিয়াশীলদের উৎসাহিত হওয়ার মতাে অনেক উপাদানই ধারণ করেছিলাে। তাই তার রাজশাহী সফর শেষ হওয়ার পরপরই সেখানে ভয়াবহ সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা শুরু হয়ে যায় এবং সে যে কতােখানি ভয়াবহ তার বর্ণনা দেয়া আমার সাধ্যাতীত।
দাঙ্গা যখন শুরু হয়ে গেলাে, তখন রাণীবাজারে সুধীর গােবিন্দ মৈত্রের বাসায় অবস্থান করতে আমার সাহসে কুলালাে না। ইংরেজির ছাত্র বারহাট্টার তাহের উদ্দিন খান মতিহার থেকে খবর পাঠালেন ; আমি যেন যতাে তাড়াতাড়ি সম্ভব শহর ছেড়ে সেখানে চলে যাই।
শহর ছেড়ে যাওয়ার প্রস্তুতি নিয়েই বিকেলে আমাদের বাংলা বিভাগের শিক্ষক সুধেন্দু ভট্টাচার্যের সঙ্গে দেখা করতে তার বাসায় গেলাম। গিয়ে দেখি স্যার বাসায় নেই। লালকুঠিতে (রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অফিস) কী একটা মিটিং করতে গিয়েছেন। পরিবারের বয়স্ক পুরুষদেরও সকলেই বাইরে। দু’জন গুণ্ডা মতােন লােক উঠোনে দাঁড়িয়ে আছে। সমস্ত বাড়িটাতে থমথমে ভাব। ঘরে ঢুকে দেখি স্যারের স্ত্রী সজল চোখে হাত থেকে সােনার চুড়ি খুলছেন। অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, এ কী করছেন কাকি মা?”
ঝরঝর করে কাকিমার চোখ থেকে জল ঝরে পড়লাে। কাঁদতে কাঁদতে কাকিমা যা বললেন তার সারমর্ম হলাে; উঠোনে দাঁড়ানাে গুণ্ডা দুটো এ পাড়ারই বাসিন্দা। তারা জানাতে এসেছে যে, আজ রাতেই এ বাড়িতে হামলা হবে এবং বিহারী গুণ্ডারা সুধেন্দু বাবুর মেয়ে দুটোকে ধরে নিয়ে যাবে। তবে পাড়ার গুণ্ডারা সুধেন্দু বাবুর বাড়ির লােকদের আশ্বাস দিচ্ছে যে, যদি তাদের হাতে এক্ষুণি একশােটি টাকা তুলে দেয়া হয় তবে তারা এ- বাড়ি পাহারা দেবে, বিহারী গুণ্ডাদের এখানে কিছুতেই ঢুকতে দেবে না।
(পাঠক, দয়া করে একশাে টাকার মূল্যমান বাষট্টি সালের নিরিখে বিচার করুন— আজকের চাঁদাবাজদের দাবির সমমানে নয়। সেদিনকার চাঁদাবাজ গুণ্ডারা একশাে টাকার বেশি দাবি করার মতাে সাহস অর্জন করতে পারেনি, তখনকার অর্থনীতিই তাদের সে সাহস দেয়নি।)।
—“কিন্তু হাতের চুড়ি খুলছেন কেন?’ উদ্বেগের সঙ্গে আমি কাকিমার কাছে জানতে চাইলাম।
– ‘এছাড়া কী করি বলাে? নগদ টাকা তাে এখন আমার হাতে নেই, এই ক’গাছা চুড়ি দিয়েই ওদের মুখ বন্ধ করতে হবে।
আমি খুব জোরের সঙ্গে বললাম, না, তা হবে না। আমি এক্ষুণি লালকুঠিতে যাচ্ছি। ফিরে না আসা পর্যন্ত আপনি এই গুণ্ডাদের হাতে কিছুই তুলে দেবেন না। যা করবার হয় স্যার নিজেই করবেন।’
লালকুঠিতে গিয়ে খবরটা জানানাে মাত্রই মিটিং ভেঙে দিয়ে সবাই উঠে পড়লেন। উপাচার্য মমতাজ উদ্দিন আহমদ, রেজিস্ট্রার (নামটি আজ আর মনে নেই), বাংলা বিভাগের অধ্যক্ষ ডক্টর মুহম্মদ এনামুল হক এবং আরাে কয়েকজন অধ্যাপক ও কর্মচারি সুধেন্দু বাবুকে নিয়ে সঙ্গে সঙ্গে তার বাসায় চলে এলেন। উপাচার্য টেলিফোনে রাজশাহীর ডেপুটি কমিশনারকে খবরটি জানিয়ে দিলেন। গুণ্ডা দুটো অবিশ্যি এরই মধ্যে কেটে পড়ে।
২৫৭
সারা শহরের হিন্দুদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ায় তাদের অনেকেই নিজ নিজ বাসা ছেড়ে দিয়ে নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধান করতে থাকে। সুধেন্দু বাবুদের পাড়ার সব হিন্দু সুধেন্দু বাবুর বাসায় এসে আশ্রয় নেয়। কারণ, এ বাসাটা দেয়ালঘেরা থাকায় অন্য অনেক বাসার চেয়ে ছিলাে সুরক্ষিত। তা ছাড়া এটি বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন সম্মানিত অধ্যাপকের বাসা; অনেকেরই ধারণা হয়েছিলাে যে, বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের প্রভাবে শাসন কর্তৃপক্ষও এবাসাটির নিরাপত্তা রক্ষার ব্যবস্থা অবশ্যই করবেন। তাই কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই অধ্যাপক সুধেন্দু ভট্টাচার্যের বাসাটি এলাকার হিন্দুদের আশ্রয় শিবিরে পরিণত হয়ে যায়। আমারও আর মতিহার যাওয়া হলাে না। কাকিমা আমাকে কিছুতেই যেতে দিলেন না। মাসখানেক সুধেন্দুবাবুর বাসাতেই থেকে যেতে হলাে।
দাঙ্গার সময়ে ডক্টর মুহম্মদ এনামুল হকের অনুপ্রেরণায় বিশ্ববিদ্যালয়ের কুড়ি/ বাইশ জন ছাত্র সারা রাত ধরে সুধেন্দু বাবুর বাড়িতে পাহারায় নিযুক্ত রইলাে। আমরা সবাই মিলে ছাদের ওপর ইটের টুকরাে জড়াে করলাম। উদ্দেশ্য: গুণ্ডারা হামলা করতে এলেই ইট ছুঁড়ে তাদের প্রতিহত করবাে।
ছাদের ওপরই বিদ্রি কাটালাম কয়েক রাত।
সুধেন্দু বাবুর বাসায় বা রাজশাহী শহরের অন্য কোথাও অবিশ্যি কোনাে হামলা হয়নি। কিন্তু শহরের আশপাশের এলাকাগুলাে যে পৈশাচিক হামলার শিকার হয়েছিলাে তা সুধেন্দু বাবুর বাড়ির ছাদের ওপর বসেই কিছুটা প্রত্যক্ষ ও অনেকখানি অনুমান করতে পেরেছি। সন্ধ্যার কিছু পরই চারদিকে আগুনের শিখা জ্বলে উঠেছে, আর শােনা গেছে গগনভেদী আর্তচিৎকার। ছাদে বসেই আমরা শিউরে শিউরে উঠেছি, আর অক্ষম ক্ষোভে ঠোট কামড়িয়েছি। সকালবেলায় দেখেছি রাস্তা দিয়ে চাঙারি করে বয়ে নিয়ে যাওয়া বহুসংখ্যক লাশের মিছিল। গ্রাম থেকে বহু লােক শহরে চলে এলাে। তাদের অনেকেই ভারতের এ্যাসিস্টেন্ট ডেপুটি হইকমিশনারের রাজশাহীস্থ অফিসের সামনে গিয়ে ভিড় করলাে মাইগ্রেশন সার্টিফিকিটের জন্যে।
সেবার সবচেয়ে ভয়াবহ দাঙ্গা (ভুল বললাম, দাঙ্গা নয় হত্যাকাণ্ড) হয়েছিলাে রাজশাহী শহর থেকে বেশ কয়েক মাইল দূরে একটি গ্রামে। যতােদূর মনে পড়ে, গ্রামের নামটি দারসা। পাকিস্তানের সংবাদপত্রে অবশ্যই সে-হত্যাকাণ্ডের বিবরণ ছাপা হয়নি। তবে লােকমুখে ভেসে আসা খবরের স্বাভাবিক অতিরঞ্জনটুকু বাদ দিলে যা থাকে তা শতাংশের একাংশই গায়ের রক্ত হিম করে দেয়ার জন্যে যথেষ্ট। শুনেছি, দারসার হিন্দুরা নাকি একটি দেয়ালঘেরা ইস্কুল বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছিলাে। আর এটাই হয়েছিলাে ঘাতকদের জন্যে মােক্ষম সুযােগ। নারী-বৃদ্ধ-শিশু নির্বিশেষে সকলকেই তারা ধরে ধরে এনে ছুরি মেরে লাশ বানিয়ে একটা একটা করে পাশের পুকুরে ফেলে দিয়েছিলাে। পুকুরটা রক্তে লাল হয়ে গিয়েছিলাে। পরদিন খবর পেয়ে সেনাবাহিনীর কয়েকজন লােক সেখানে যায়। লাশের স্তুপ আর রক্তের প্রবাহ দেখে তারা নাকি ডুকরে কেঁদে উঠেছিলাে। উন্মত্ত রক্তপিপাসুরা ওই রােরুদ্যমান সৈন্যদেরও আক্রমণ করতে গেলে তারা গুলি চালায় এবং ছ’জন লােক মারা যায়।
সৈন্যদের হাতে এই ছ’জন লােকের নিহত হওয়ার সংবাদটি গুজব থেকে পাওয়া নয়। সৈন্যরাই এ-কথা সেদিন মাইকযােগে রাহশাহী শহরে প্রচার করে এবং কারফিউ জারি করার ঘােষণা দেয়। এরপর আমরা দেখলাম : সেনাবাহিনীই দাঙ্গা থামানাের দায়িত্ব নিজ হাতে তুলে দিয়েছে, আর দাঙ্গা বন্ধ হয়ে গিয়েছে।
২৫৮
‘সর্প হইয়া দংশন করাে, ওঝা হইয়া ঝাড়াে’—কার সম্পর্কে কথাটি বলেছিলেন মরমী কবি? অপার্থিব নিরাকার জগদীশ্বর সম্পর্কে? নাকি পাকিস্তানের মতাে রাষ্ট্রের জঙ্গি শাসকদের সম্পর্কে।
পশ্চিমবঙ্গের মালদহের মুসলিম-বিরােধী দাঙ্গা, সেখান থেকে সীমান্ত পেরিয়ে কিছু। মুসলমানের রাজশাহীতে চলে আসা, দাঙ্গাপীড়িত পশ্চিমবঙ্গের মুসলমানদের রাজশাহীতে অবস্থানকারী আত্মীয়-স্বজনের স্বাভাবিক ক্ষোভ ও হতাশা এবং এ-সময়েই জঙ্গি গভর্নর আজম খানের রাজশাহী সফর ও তার কৌশলী বক্তৃতায় ছাত্র আন্দোলন-প্রসূত সরকার বিরােধী গণচেতনাকে সাম্প্রদায়িক খাতে ঘুরিয়ে দেয়ার ধূর্ত প্রয়াস—এ-সবের ফলে বাষট্টিতে রাজশাহীতেই সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার সূচনা ঘটে এবং মূলত সেখানেই তা কেন্দ্রীভূত থাকে। তবে, রাজশাহীর মতাে ততােটা ব্যাপক না হলেও দেশের অন্যান্য জায়গাতেও দাঙ্গা ছড়িয়ে পড়েছিলাে বৈকি। রাজধানী ঢাকা নগরীতেই বাষট্টির তিরিশে মে সন্ধ্যার স্নানালােকে ঘাতকের ছুরিকাঘাতে প্রাণ হারান অজাতশত্ৰু কবি প্রজেশ কুমার রায়।
দাঙ্গা বন্ধ হবার পরও অনেকদিন সুধেন্দু বাবুর বাড়িতে বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু ছাত্র পাহারায় ছিলাে। এ সময়ে ডক্টর মুহম্মদ এনামুল হকের মানবিকতার যে পরিচয় পেয়েছি তার তুলনা মেলা ভার। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদেরই শুধু নয়, নিজের ছেলে মুহম্মদকেও ডক্টর হক সুধেন্দু বাবুর বাড়ি-পাহারার কাজে নিযুক্ত করে রেখেছিলেন। মুহম্মদ তখন কলেজের ইন্টারমিডিয়েট ক্লাসের ছাত্র। বয়স নেহাতই কম। কাটাকাটি খুনােখুনির পরিবেশে তার পক্ষে ভয় পাওয়া মােটেই অস্বাভাবিক ছিলাে না। তাছাড়া তার মায়ের পক্ষে সন্তানের জন্যে উদ্বেগাকুল থাকা তাে ছিলাে একান্তই স্বাভাবিক। তাই প্রথম দিনেই রাত আটটার দিকে মুহম্মদ তার মায়ের কথা বলে সুধেন্দু বাবুর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বাসায় চলে যায়।
পরদিন ভােরে সূর্য ওঠার আগেই মুহম্মদকে দেখা গেলাে অধ্যাপক সুধেন্দু ভট্টাচার্যের বাড়ির গেটে মলিন মুখে দাঁড়িয়ে থাকতে।
– কী ব্যাপার মুহম্মদ স্যার উদ্বিগ্ন কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলেন।
কাঁদো কাঁদো হয়ে মুহম্মদ জানালাে: কাল রাতে বাড়ি ফিরে যেতেই তার বাবা একেবারে আগুন হয়ে ওঠেন। ডক্টর মুহম্মদ এনামুল হকের কথা হলাে, ইউনিভার্সিটির এতােগুলাে ছেলে বিপদের মুখে থাকতে পারলাে, আর তুমি প্রাণের ভয়ে পালিয়ে এলে? তুমি একাই মায়ের ছেলে, আর ওদের বুঝি মা-বাবা নেই, ওদের প্রাণের কোনাে মূল্যই নেই?
রাতেই তাকে বাড়ি থেকে বের করে দিতে চেয়েছিলেন তিনি। অনেক বকুনি খেয়েও তার মা তাকে কোনাে রকমে ঘরে রেখেছিলেন। ভােরে উঠেই সে চলে এসেছে। এখন সুধেন্দু বাবু। যদি ডক্টর হককে বুঝিয়ে না বলেন তবে বেচারা আর নিশ্চিন্তে ঘরেই ফিরতে পারবে না।
আমার একান্ত শ্রদ্ধেয় শিক্ষক ডক্টর মুহম্মদ এনামুল হকের এ-রকম আচরণ মােটেই লােক দেখানাে ব্যাপার ছিলাে না। অনেক উপলক্ষেই প্রত্যক্ষ করেছি যে, তিনি ছিলেন সব রকম মােনাফেকির ঊর্ধ্বে। আকাশের মতােই যেমন উদার তার হৃদয়, তেমনি আকাশের বজ্রের মতােই একান্ত কঠোর তার ব্যক্তিত্ব। আবার এই কঠোর ব্যক্তিত্বের-আবরণে যে মনটিকে তিনি ধারণ করতেন তা যে কতাে বেশি কোমল, তাও প্রত্যক্ষ করার সুযােগ আমার হয়েছে।
২৫৯
সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় নানা জনের নানা রূপ
রাজশাহীর সাম্প্রদায়িক দাঙ্গাকে উপলক্ষ করে মানব চরিত্রের বহু রকম দিকই উন্মােচিত হয়েছে। আমার সামনে। নীচতা ক্ষুদ্রতা ভীরুতা দোদুল্যমানতা যেমন দেখেছি, তেমনি দেখেছি এ সবের। বিপরীত সব মানস প্রবণতার প্রকাশও। অনেকেই হিন্দুদের ওপর হামলা ও নির্যাতনে আন্তরিকভাবে দুঃখিত হয়েছেন, সাধ্য মতাে তাদের পাশে দাঁড়িয়েছেন, এ-ধরনের অমানবিকতার বিরুদ্ধে তীব্র ঘৃণা প্রকাশ করেছেন। আবার হিন্দুস্থানের মুসলমানদের ওপর যা হয়েছে তার তুলনায় এ-দেশের হিন্দুদের কিছুই করা হয়নি’—এস্ত ও আতঙ্কিত হিন্দুদের বারবার এমন কথাও স্মরণ করিয়ে দিয়ে তাদের ত্রাস ও আতঙ্ক বাড়িয়ে দেবার দুবুদ্ধির প্রকাশও অনেকের মধ্যে দেখেছি।
বাষট্টির দাঙ্গার পুরাে সময়টা এবং তারপরও বেশ কিছুদিন—আমি অধ্যাপক সুধেন্দু ভট্টাচার্যের বাড়িতে কাটিয়েছিলাম বলেই নানান কিসিমের মানুষকে কাছে থেকে দেখার ও তাদের কথা শােনার সুযােগ আমার হয়েছিলাে। বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও ছাত্রদের তাে সেসময়ে সে-বাড়িতে নিয়মিত উপস্থিতি ছিলােই, প্রশাসনের উঁচু-নিচু মাঝারি পর্যায়ের অনেক কর্মকর্তা কর্মচারিও খোঁজখবর নিতে প্রায় রােজই সেখানে যেতেন। প্রায় সারাদিনই এবং রাতেরও অন্তত দেড় প্রহর, নানা জাতের মানুষের সংলাপে মতবিনিময়ে বাড়িটা জমজমাট হয়ে থাকতাে। সারাক্ষণ এ-রকম বিভিন্ন মানুষের সাহচর্য বিষন্নতার হাত থেকে মুক্ত থাকতে আমাদের অনেক পরিমাণে সহায়তা করেছিলাে। আবার এ বাড়িতে সমাগত অনেক মানুষের সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গি আমাদের ক্ষুব্ধ ও উত্তেজিত করেও তুলতাে। শহরের আশপাশের গ্রামগুলাের হিন্দুদের বাড়িঘর যখন পুড়ে ছাই করে দেয়া হচ্ছে, ঘাতকের ছুরি যখন তাদের নিহত ও আহত করছে, গ্রাম থেকে তারা যখন দলে দলে নিরাপত্তার সন্ধানে শহরের দিকে ছুটে আসছে, রাজশাহীর রাণীবাজার এলাকার হিন্দুরা যখন নিজেদের ঘর ছেড়ে অধ্যাপক সুধেন্দু ভট্টাচার্যের বাড়িতে আশ্রয়ের জন্যে ছুটে আসছে তখন মাঝারি পদের একজন সরকারি কর্মকর্তা যা তা বলে সেই সন্ত্রস্ত মানুষদের ধমকাতে লাগলেন।
–‘কোথায় রায়ট দেখলেন আপনারা? কিছুই তাে হয়নি এখানে। রায়ট তাে হয়েছে মালদায়। মালদা’র সব মুসলমানের বাড়ি লুট হয়েছে, মুসলমান বস্তিগুলাে পুড়ে ছাই হয়েছে, মুসলমান মেয়েদের ইজ্জত নিয়ে ছিনিমিনি খেলা হয়েছে। সেখান থেকে পালিয়ে আসা লােকদের মুখে এ-সব কথা শুনে কোন্ মুসলমানের না রক্ত গরম হয়ে ওঠে? আমাদের এখানে এ-রকম কিছু হয়েছে কি? দিব্যি ভালাে আছেন আপনারা। তবু নিজেরাই এখানে শুধু শুধু প্যানিক সৃষ্টি করছেন নানা গুজব শুনে।
কাটা ঘায়ে নুনের ছিটার মতাে ছিলাে ওর কথাগুলাে। তবু ভেতরে ভেতরে তীব্র জ্বালা নিয়েও কেউই মুখ ফুটে কিছু বলছিলাে না। হঠাৎ আমার মুখ থেকে বেরিয়ে গেলাে—কিছুই যদি এখানে না হবে তাে, আপনি কি বলতে চান এই যে লােকগুলােকে চাঙারিতে করে গা থেকে নিয়ে আসা হলাে, এরা কি সব ডিসপেপসিয়ায় মারা গেছে?
কর্মকর্তাটি আমার দিকে কটমট করে তাকালেন। কোনাে পরােয়া না করে আরাে উঁচু গলায় বলতে লাগলাম, মালদায় মুসলমানদের মেরেছে, তাদের বাড়িঘর লুট করেছে, আগুন লাগিয়েছে, মেয়েদের ইজ্জত লুট করেছে কারা? এখানকার হিন্দুরাই কি সীমানা পেরিয়ে গিয়ে
২৬০
এসব করে এসেছে? আর সে সবের কি প্রতিশােধ নেয়ার জন্যে এখানকার হিন্দুদের ওপর এসব করাটা জায়েজ বলে আপনি মনে করেন? ……
আমার গলা ক্রমেই চড়ে যাচ্ছিলাে। বাইরের ঘরে বসে আমরা কথা বলছিলাম। কিন্তু আমার কলিংবেল-নিন্দিত কণ্ঠস্বর ভেতরে-বাইরে সকলকে হতচকিত করে তুলেছিলাে। বিরক্ত, ব্যস্ত ও ত্রস্ত হয়ে সুধেন্দু বাবু বাড়ির ভেতর থেকে বেরিয়ে এলেন। আমাকে প্রচণ্ড ধমক দিয়ে থামিয়ে দিলেন। এবং তার এই অর্বাচীন ছাত্রটির এ-রকম বেয়াদবির জন্যে দুঃখ প্রকাশ করে কর্মকর্তাটির কাছে নিজেই মাফ চাইতে লাগলেন। কর্মকর্তাটি তখন সুযােগ পেয়ে আমাকে ভর্ৎসনা করে চললেন। জলে বাস করে যে কুমিরের সঙ্গে বিবাদ করা চলে না সে-কথাটি বার বার স্মরণ করিয়ে দিলেন।
এর দুদিন পরই অধ্যাপক সুধেন্দু ভট্টাচার্যের বাড়িতে পাকিস্তান সরকারের বুদ্ধি বিভাগ -এর একজন লােক এসে এই বেয়াদব ছাত্রটির (অর্থাৎ আমার) নাম, বাপের নাম, বাড়ির ঠিকানা এবং এ-রকম আরাে কিছু তথ্য খাতায় লিখে নিয়ে গেলাে। সুধেন্দু বাবুসহ বাড়ির সবাই ঘাবড়ে গেলেন। আমাকে যে খুব শিগগিরই পুলিশ এসে ধরে নিয়ে যাবে—এ-বিষয়ে সকলেই প্রায় নিঃসন্দেহ হয়ে উঠলেন। আশঙ্কা করতে লাগলেন: এই বাচাল ছােকরাটির দোষে তাদের না দুর্ভোগ পােহাতে হয়।
পুলিশ অবিশ্যি সেবার আমাকে ধরেনি। একটি অখ্যাত ছােকরার বাচালতাকে গুরুত্ব দিয়ে রাতারাতি বিখ্যাত করে তােলা যে মােটেই বুদ্ধিমানের কাজ হবে না, অন্তত এটুকু কাণ্ডজ্ঞান যে পুলিশের ছিলাে তা বােঝা গেলাে। এ দাঙ্গার সময়ে রাজশাহী শহরের বেশ কিছু গণ্যমান্য হিন্দুকে ধরে নিয়ে জেলে আটকে রেখেছিলাে। তাদের বিরুদ্ধে কোনাে মামলা হয়নি, কোনাে সুনির্দিষ্ট অভিযােগও তাদের বিরুদ্ধে ছিলাে না। বেয়াদবির জন্যেই বােধহয় তাদের কারাবাস করতে হয়েছিলাে। কিল খেয়ে কিল চুরি করতে যারা শেখেনি, স্থানকালপাত্র বিবেচনা না করে যারা কোদালকে কোদাল বলে যায় অনায়াসে, তারা বেয়াদব ছাড়া আর কী? এ-রকম বেয়াদবদের জন্যেই ছিলাে পাকিস্তানের নিরাপত্তা আইন। জেলের বাইরে থাকলে যারা দাঙ্গার নিন্দা করবে, দাঙ্গা-বিধ্বস্ত মানুষদের পুনর্বাসনের দাবি জানাবে, ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ভুক্ত মানুষ হয়েও অপ্রিয় সত্য কথা বলতে যারা একটুও ইতস্তত করবে না, এমন লােকদেরকে জেলে পুরে রাখাই তাে পাকিস্তানের মতাে একটি সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্রে প্রশাসনের কাজ চালাবার জন্যে একান্ত সুবিধাজনক, নিরাপদ।
পাকিস্তানি শাসকরা ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষদের দেশপ্রেমহীনতার অপবাদ দিতাে, অথচ এ সম্প্রদায়ের খাঁটি দেশপ্রেমিক ও স্পষ্টভাষী মানুষদের তারা একদম সহ্য করতে পারতাে না। কিছু ধামাধরা বা ‘জি-হুজুর’ মার্কা লােকই ছিলাে তাদের পছন্দ। এ-রকম কিছু লােক রাজধানী ঢাকাসহ বিভিন্ন জেলা ও মহকুমা শহরে সব সময়েই মজুত থাকতাে। নানা উপলক্ষে এদের দিয়ে পাকিস্তানের বিভিন্ন পর্যায়ের শাসনকর্তারা নিজেদের মর্জিমাফিক বিবৃতি দেয়াতাে। শ্রী অমুকচন্দ্র রায়, অমুককুমার শর্মা, অমুকনাথ দাস—এ-রকম কতকগুলাে লােককে সংখ্যালঘু নেতা’ বলে আখ্যায়িত করে পত্রিকার পাতায় তাদের নামে বিবৃতি ছাপা হতাে। সে-সব বিবৃতিতে ভারতের মুসলমান-বিরােধী দাঙ্গার জন্যে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা ও ভারত সরকারের নিন্দা থাকতাে, আর পাকিস্তানে হিন্দুসহ সকল সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের প্রতি সদাশয় পাকিস্তান সরকারের উদার ও সদয় ব্যবহারের জন্যে বিবৃতিদাতারা কৃতজ্ঞতার বন্যায় সকলকে
২৬১
ভাসিয়ে দিতে চাইতাে। বিভিন্ন পেশাধারী বিশেষ করে উকিল মােক্তারদের মধ্য থেকেই এরকম চিরকৃতজ্ঞ সংখ্যালঘু নেতা’ জোগাড় করা হতাে। ময়মনসিংহে এ-রকম একজন ‘হিন্দু উকিল তাে স্থানীয় মুসলিম লীগের অনেক নেতার মুরুব্বির মতােই ছিলেন। মুসলিম লীগের খেদমতের বিনিময়ে তার কপালে তমঘা-ই-খিদমত’ খেতাবও জুটেছিলাে। ব্রিটিশ আমলে এরকম লােকেরাই হিন্দু হলে হতেন রায় সাহেব’ ও ‘রায় বাহাদুর’, আর মুসলমান হতেন ‘খান সাহেব’ ও ‘খান বাহাদুর।
ময়মনসিংহের এই উকিলটি অবিশ্যি রায় সাহেব’ বা ‘রায় বাহাদুর’ ছিলেন না। কোনাে কোনাে জেলায়, ষাটের দশকেও, সরকারের ধামাধরায় নিপুণ কিছু কিছু রায় সাহেব বা রায় বাহাদুরের অস্তিত্ব ছিলাে। রাজশাহীতেও, বাষট্টি সালে, এ-রকম একজন রায় বাহাদুর ছিলেন। সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার সময়েও, স্বাভাবিকভাবেই, তার ভূমিকা রায় বাহাদুর-সুলভ ধামাধরারই ছিলাে। স্ব-সম্প্রদায়ের মানুষের দুর্দশায় তার চিত্তবৈকল্য ঘটেনি একটুও, কিংবা সরকারতােষণেও ভাটার টান লাগেনি। অধ্যাপক সুধেন্দু ভট্টাচার্যের বাড়িতেই তার আচরণ সম্পর্কে হিন্দুদের মুখে নানা অম্লমধুর কথা শুনেছি। সুধেন্দু বাবুর ছােট ভাই ভূপেন ভট্টাচার্য ছিলেন অত্যন্ত রসিক মানুষ। দাঙ্গার দুর্যোগের দিনগুলােতেও অনেক রসের কথা বলে তিনি আমাদের চাঙ্গা করে রাখতেন। কি করে কোনাে লােক প্রথমে রায় সাহেব ও পরে রায় বাহাদুর হতাে তার কায়দা-কানুন বর্ণনা করে একদিন তিনি একটি মজার গল্প বলেছিলেন। গল্পটি এ-রকম:
ইংরেজ লাট সাহেবকে রােজ দুবার করে নিয়মিত সালাম দিয়ে এক ব্যক্তি রায় সাহেব হয়েছিলেন। এরপর সেই রায় সাহেব লাট সাহেবের বাড়িতে গেলেন কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপনের জন্যে। লাট সাহবে তার অন্তঃসত্ত্বা পত্নীকে পাশে নিয়ে বসেছিলেন। রায় সাহেব প্রথমে লাট সাহবকে ও পরে লাট সাহেবের পত্নীকে সালাম দিলেন। এরপর লাট সাহেবের পত্নীর পেটে একটা সালাম ঠুকলেন। লাট সাহেব অবাক হয়ে জিজ্ঞস করলেন, এটা কী করলে রায় সাহেব? আমার বিবির পেটে সালাম দিলে কেন?
রায় সাহেব হাত কচলাতে কচলাতে বললেন, উনার পেটে যিনি আছেন তিনি তাে কিছুদিন পরে মাটিতে নেমে আসবেন। আসার আগেই তাকে ‘অ্যাডভান্স’ সালামটি জানিয়ে রাখলাম।
লাট সাহেব খুশিতে একবােরে আত্মহারা হয়ে গেলেন। এরকম রাজভক্ত মানুষ ক’জন হয়? লাট সাহেব রায় সাহেবের পিঠ চাপড়ে দিয়ে বললেন, তুম রায় বাহাদুর বন যাওগে।
কয়েকদিনের মধ্যেই সেই রায় সাহেব প্রমােশন পেয়ে রায় বাহাদুর’ হয়ে গেলেন।
এ-রকম রসের গল্প গুজবে মেতে থেকে আমরা দাঙ্গার উদ্বেগকে প্রশমিত করতে চাইতাম।
কিন্তু এরই ফাঁকে ফাঁকে উদ্বিগ্ন হিন্দুদের উদ্বায়ু (হিস্টিরিয়া) রােগগ্রস্তের মতাে কথাবার্তা আমাকে খুবই আহত করতাে। জানি, চারপাশের নানা অমানবিক ঘটনা প্রবাহের চাপে ওদের চিন্তার ভারসাম্য নষ্ট হয়ে যাচ্ছিলাে। তবু, ওরা যখন বলতাে যে, এদেশ ছেড়ে ভারতে গিয়ে ওখানকার মুসলমানদের বুঝিয়ে দেবে কত ধানে কত চাল’ কিংবা এখানকার মুসলিম সাম্প্রদায়িকতাবাদীদের বিপরীত অবস্থানে দাঁড়িয়ে নিজেদের হিন্দু সাম্প্রদায়িকতাবাদী রূপটি প্রকট করে তুলে নানা ধরনের প্রতিক্রিয়াশীল কথাবার্তা বলতাে, তখন ওদের ওরকম অসুস্থ মনােবৃত্তির প্রতিবাদ না করে আমি পারতাম না। এই নিয়ে ওদের সঙ্গে প্রায় সর্বদাই আমার
২৬২
উত্তেজিত বাক্যবিনিময় হতাে এবং আমার পক্ষ সমর্থনের জন্যে কাউকেই আমি পাশে পেতাম না। দাঙ্গার কারণে যতাে না, তার চেয়ে বেশি অস্বস্তি বােধ করতাম আমি মানুষের এ ধরনের বিকারগ্রস্ত মানসিকতার প্রকাশ দেখে।
তবে বাষট্টিতে রাজশাহীর সাম্প্রদায়িক দাঙ্গাকে উপলক্ষ করে সাম্প্রদায়িকতা-বিরােধী চেতনার বহিঃপ্রকাশও দেখেছি এবং সেটিই আমাকে সুতীব্র আশাবাদে উজ্জীবিত করে তুলেছিলাে।
ঢাকার দু’একটি সংবাদপত্র সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষে ইন্ধন জোগালেও সাম্প্রদায়িকতা-বিরােধী বাঙালি জাতীয় চেতনাই তখন প্রবল হয়ে উঠছিলাে। রাজশাহী থেকে তখন প্রকাশিত হতাে একটি অত্যন্ত উন্নতমানের সাহিত্যপত্র ‘পূর্বমেঘ। এর সম্পাদক ছিলেন জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী ও মুস্তফা নূরউল ইসলাম। শেষােক্ত জন ছিলেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার শিক্ষক। তার সাম্প্রদায়িকতা বিরােধী চিন্তাধারার সঙ্গে আমি খুবই ঘনিষ্ঠভাবে পরিচিত ছিলাম। তিনিই সম্ভবত ইউরােপ-প্রত্যাগত বদরুদ্দীন উমরকে বাংলা লেখায় উদ্বুদ্ধ করে তােলেন। এ-সময়েই ‘পূর্বমেঘ’-এ বদরুদ্দীন উমরের কয়েকটি চমৎকার মননশীল লেখা ছাপা হয়েছিলাে। ওই লেখাগুলােই পরে ‘সাম্প্রদায়িকতা নামক চটি বইটিতে সংকলিত হয়। বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিতে সাম্প্রদায়িকতার স্বরূপ উদ্ঘাটনের এরকম বলিষ্ঠ প্রয়াস এর আগে আর এ-দেশে দেখা যায়নি।

জাতীয়তাবাদের আন্দোলনে সাম্যবাদীদের নেপথ্য বিধান
বদরুদ্দীন উমরকে আমি প্রথম দেখি রাজশাহীতে—ঊনিশোে একষট্টি সালে! দূর থেকেই দেখেছি, কাছে যাওয়ার সাহস পাইনি। বিদেশ থেকে উচ্চশিক্ষা নিয়ে এসে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি দর্শনের অধ্যাপক হন, পরে তাঁকেই বিভাগীয় প্রধান করে সে বিশ্ববিদ্যালয়ে খােলা হয় রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ। আমি ছিলাম বাংলা সাহিত্যের ছাত্র, তাই তার কাছ থেকে যদিও প্রত্যক্ষভাবে পাঠ গ্রহণের সুযােগ আমার ছিলাে না, তবু তিনি তাে সেই বিশ্ববিদ্যালয়েরই সম্মানিত শিক্ষক, আর আমি একজন সাধারণ শিক্ষার্থী মাত্র। তাই, তাঁর একান্ত সান্নিধ্যে না গিয়েও, দূর থেকেই তাকে আমার শিক্ষক রূপে শ্রদ্ধা জানিয়েছি। এরপর তার লেখার সঙ্গে পরিচিত হয়ে তাঁর প্রতি আমার শ্রদ্ধা গভীর থেকে গভীরতর হয়েছে।
বাষট্টি সালে দাঙ্গা চলার সময়েই পূর্বমেঘ’-এ প্রবন্ধ প্রকাশ করে সাম্প্রদায়িকতা-বিরােধী লেখালেখির সূচনা ঘটানাের পর থেকে বদরুদ্দীন উমর অবিরাম উপমহাদেশের সাম্প্রদায়িক সমস্যার মূলটি অন্বেষণ করতে থাকেন, নানা প্রবন্ধে নিবন্ধে সেই অন্বেষার প্রতিবেদন প্রকাশ করে চলেন। বাষট্টি থেকে সাতষটি সালের সময়-পরিধিতে তিনি এমন কতকগুলাে প্রবন্ধ লিখেছিলেন যেগুলাে সাম্প্রদায়িকতার উদ্ভব ও বিকাশের কার্যকারণ সম্পর্ককে একান্ত গভীরভাবে স্পর্শ করেছিলাে। এই প্রবন্ধগুলােরই সংকলন ‘সাম্প্রদায়িকতা, সাংস্কৃতিক সাম্প্রদায়িকতা, সংস্কৃতির সংকট।
সাম্প্রদায়িকতা-বিরােধী লেখা উমরের আগেও অনেকেই লিখেছেন নিশ্চয়। সে-সব লেখায় আবেগ ছিলাে, আন্তরিকতা ছিলাে, মানবিকতা ছিলাে, ধর্মবর্ণ নির্বিশেষে সকল মানুষের প্রতি অহৈতুকী ভালােবাসারও প্রকাশ ছিলাে। কিন্তু বস্তুনিষ্ঠ তথা বিজ্ঞানসম্মত বিশ্লেষণ ছিলাে না। উমরের বিশ্লেষণে ছিলাে ডায়ালেকটিক বস্তুবাদী দর্শন তথা মার্কসবাদের সুনিপুণ প্রয়ােগ। দ্বিজাতিতত্ত্ব যে একান্তই ভুয়া একটি তত্ত্ব, সাম্প্রদায়িক সমস্যার ওপর মার্কসবাদের আলাে
২৬৩
ফেললে তা স্পষ্ট হয়ে যায়। উমরের লেখাতেও তা-ই হয়েছিলাে। আর দ্বিজাতিতত্ত্বই যদি ভুয়া প্রমাণিত হয়, তবে সে-তত্ত্ব দিয়ে গড়া যে রাষ্ট্র পাকিস্তান, সে-রাষ্ট্রটির ভিত্তিমূলই তাে কেঁপে ওঠে। তাই, উমরের সাম্প্রদায়িকতা সম্পর্কীয় লেখাগুলাে পড়ে পাকিস্তানের রাষ্ট্র-বিধায়করাও কেঁপে কেঁপে উঠছিলাে। কাঁপুনির সঙ্গে তাদের শুরু হয়েছিলাে চিড়বিড়ানি। উমরের যুক্তির জবাব যুক্তি দিয়ে দেয়ার এলেম বা হিম্মত কোনােটাই তাদের ছিলাে না। এলােপাথাড়ি গালাগালি দিয়েই তারা গায়ের জ্বালা জুড়ােতে চেয়েছিলাে। উমরের বইগুলাে বাজেয়াপ্ত করার দাবিও তারা তুলেছিলাে । সাহিত্যপত্র ‘পূর্বমেঘ’-এর পাতায় উমরের সাম্প্রদায়িকতা-বিরােধী বক্তব্যের সমালােচনা করে সৈয়দ সাজ্জাদ হােসায়েনের একটি লেখা ছাপা হয়েছিলাে এবং পূর্বমেঘেই উমর তার দাঁতভাঙা জবাবও দিয়েছিলেন। জানতাম: সৈয়দ সাজ্জাদ হােসায়েন ছিলেন কট্টর পাকিস্তানবাদী। তবু, ইংরেজি সাহিত্যের এই খ্যাতনামা অধ্যাপকের চিন্তাচেতনায় বিবর্তন ঘটে উদারতার সঞ্চার হয়েছে বলে এক সময়ে আমার মনে হয়েছিলাে। একষট্টি সালে রবীন্দ্র শতবার্ষিকী উদ্যাপনের সময় তিনি আজাদ পত্রিকার সঙ্গে গলা মেলাননি। তিনি বরং সােৎসাহে শতবার্ষিকী উৎসবে যােগদান করেছিলেন এবং রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে অত্যন্ত চমৎকার বক্তব্য রেখেছিলেন। রবীন্দ্রনাথ পাকিস্তানের জাতীয় কবি নন—এই অজুহাত তুলে এদেশে তাঁর জন্মশতবার্ষিকী উদ্যাপনের যারা বিরােধিতা করেছিলাে তাদের উদ্দেশ্যে সৈয়দ সাজ্জাদ হােসায়েন বলেছিলেন: রবীন্দ্রনাথ হলেন একজন মহৎ কবি, জাতীয় কবি’ হওয়া কোনাে মহৎ কবির পক্ষেই গৌরবজনক নয়। চসার, শেক্সপীয়র, বালজ্যাক বা ভলতেয়ারের মতাে রবীন্দ্রনাথও যে সমগ্র পৃথিবীরই বুদ্ধিজীবীদের শ্রদ্ধার পাত্র এমন অভিমত তিনি প্রকাশ করেছিলেন।
কিন্তু এই ‘উদার’ সাজ্জাদ হােসায়েনও সাম্প্রদায়িকতা সম্পর্কে বদরুদ্দীন উমরের ব্যাখ্যাবিশ্লেষণ পড়ে একেবারে ক্ষেপে গেলেন। ক্ষেপে গেলেন সৈয়দ আলী আহসানের ভাই সৈয়দ আলী আশরাফও। আবুল মনসুর আহমদের মতাে রাজনীতিক সাহিত্যিক বুদ্ধিজীবীও উমরের বক্তব্যের প্রতিবাদ জানালেন। অর্থাৎ উমরের লেখায় সাম্প্রদায়িকতার বিশ্লেষণ সূত্রে দ্বিজাতিতত্ত্বের স্বরূপ উন্মােচিত হতে দেখে পাকিস্তানবাদীদের সকলেই বিচলিত হয়ে উঠলেন। এমনটি হওয়াই স্বাভাবিক। কারণ পাকিস্তানবাদের সঙ্গে মার্কসবাদের তাে বটেই, সামান্যতম উদারতারও সহাবস্থান অসম্ভব। তাই, কখনাে কোনাে পাকিস্তানবাদী বুদ্ধিজীবী যদি কোনাে দুর্বল মুহূর্তে উদারতাবাদের কোলে আত্মসমর্পণ করে বসেনও, পরমুহূর্তেই তাকে সেখান থেকে ছিটকে পড়তে হয়, আরাে প্রচণ্ডভাবে প্রতিক্রিয়াশীলতাকে আঁকড়ে ধরতে হয়। এ কারণেই সৈয়দ সাজ্জাদ হােসায়েন রবীন্দ্রনাথ প্রসঙ্গে সুস্থ মানসিকতার পরিচয় দিলেও সাম্প্রদায়িক ভাবনা থেকে নিজেকে মুক্ত করতে পারেন না। সাহিত্যতত্ত্ব আলােচনায় সৈয়দ আলী আশরাফের বৈদগ্ধ্য ও ঔদার্যের প্রকাশ ঘটলেও পাকিস্তানবাদ তাকে সাম্প্রদায়িকতার সংকীর্ণ বৃত্তেই আটকে রাখে। এদের মতাে মানুষেরা, তাই, পাকিস্তান প্রেমে উন্মত্ত হয়ে স্বজাতি অর্থাৎ বাঙালি জাতির বিরুদ্ধেই অবস্থান গ্রহণ করে বসেন। সম্প্রদায়কে ‘জাতি’ ভাবার এই তাে স্বাভাবিক পরিণাম।
বদরুদ্দীন উমর জাতীয়তাবাদেরও সমর্থক নন। মার্কসবাদী রূপে জাতীয়তাবাদকে তিনি বুর্জোয়া মতাদর্শ বলেই জানেন। তবু, মজার কথা হলাে, ষাটের দশকে তাঁর লেখাগুলাে এদেশে বাঙালি জাতীয়তবাদের প্রসারেই প্রভূত সহায়তা করেছে। বাঙালি মুসলমানের স্বদেশ
২৬৪
প্রত্যাবর্তন’ কথাটি ষাটের দশকের তরুণ প্রজন্মের ভেতর জাতীয় আত্মচেতনা জাগানাের ক্ষেত্রে মন্ত্রের মতাে কাজ করে। বাঙালি মুসলমান কীভাবে কাল্পনিক প্যান ইসলামের স্বপ্ন ছেড়ে স্বদেশের মাটিতে নেমে আসে ও ধীরে ধীরে বাঙালিত্বকে বরণ করে নিতে থাকে, তারই বস্তুনিষ্ঠ ও নিপুণ বিশ্লেষণ ছিলাে উমরের রচনাবলিতে। এভাবেই বদরুদ্দীন উমর হয়ে ওঠেন। পাকিস্তানে বাঙালি জাতীয় জাগরণের অন্যতম পুরােধা তাত্ত্বিক।
মার্কসবাদী রূপেও উমর একান্ত স্বকীয়তাসম্পন্ন বলেই এ-দেশের কম্যুনিস্ট আন্দোলনের প্রচলিত ধারার সঙ্গে খাপ খাওয়ানাে তার পক্ষে অসম্ভব হয়ে পড়ে। ষাটের দশকে তথাকথিত মস্কোপন্থী’ বা ‘পিকিংপন্থী’ রূপে বিভাজিত ক্যুনিস্ট গ্রুপগুলাের কোনােটার সঙ্গেই শেষ পর্যন্ত তিনি নিজেকে যুক্ত রাখতে পারেননি। হয়ে পড়েন প্রায় নিঃসঙ্গ। তবে, এই নিঃসঙ্গতা তাঁকে নৈরাশ্যবাদী করেনি। আদর্শনিষ্ঠা তাঁর মেরুদণ্ডকে সব সময়েই সােজা রেখেছে। এস্টাব্লিশমেন্টের কাছে তিনি নতি স্বীকার করেননি। যদি করতেন তাহলে অনেক অর্থবিত্ত ও লােভনীয় পদের অধিকারী থাকতে পারতেন। তার বদলে স্বেচ্ছায় তিনি বেছে নিয়েছেন বিত্তবৈভবহীন ও পদমর্যাদাহীন এক অনিশ্চিত জীবন। স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে, এবং পাকিস্তান আমলেও, উমরের অনেক রাজনৈতিক বক্তব্যের সঙ্গে একমত হতে পারিনি; কিন্তু তাঁর চিন্তার সততা ও আন্তরিকতা সম্পর্কে আমার মনে সন্দেহ জাগেনি কোনাে দিনই।
বদরুদ্দীন উমরের দৃষ্টিতে পূর্ব পাকিস্তানের কম্যুনিস্ট পার্টি (স্বাধীনতার পরে যেটি হয় বাংলাদশের ক্যুনিস্ট পার্টি বা সিপিবি) মার্কসবাদ-বিচ্যুত ও সংশােধনবাদী’ একটি দল। এদলটি তার সমালােচনার শিকার হয়েছে অনেক কারণেই। প্রধান কারণটি বােধহয় এ-দলের আওয়ামী লীগ তথা বুর্জোয়া জাতীয়তাবাদের প্রতি দুর্বলতা।
অথচ এ বিষয়ে কমুনিস্ট পার্টির বিবেচনা ছিলাে সম্পূর্ণ অন্যরকম। ধর্মীয় জাতীয়তাবাদভিত্তিক সাম্প্রদায়িক পাকিস্তান রাষ্ট্রে ভাষাভিত্তিক বাঙালি জাতীয়তাবাদের প্রসারকে ক্যুনিস্ট পার্টি একটি ইতিবাচক ও প্রগতিশীল ঘটনারূপেই গ্রহণ করেছিলাে। পার্টি লক্ষ করে যে, ষাটের দশকের শুরু থেকেই বাঙালি জাতির ভেতর জাতীয় অধিকার লাভের আকাক্ষা’ ‘প্রবল থেকে প্রবলতর হয়ে উঠেছিলাে, এবং “গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক মহলের কোনাে কোনাে অংশে ‘স্বাধীন পূর্ব পাকিস্তান দাবি’ গুঞ্জরিত হচ্ছিলাে।” সিপিবি নেতা খােকা রায় জানিয়েছেন, “১৯৬০-৬১ সালে কম্যুনিস্ট পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির ভেতর স্বাধীন পূর্ব পাকিস্তান’ দাবি নিয়ে একটি সাধারণ আলােচনা হয়েছিলাে। কেন্দ্রীয় কমিটির প্রায় সব সভ্যই স্বাধীন পূর্ব পাকিস্তান’ দাবিকে ন্যায়সঙ্গত বলে মনে করেছিলেন। এই বিষয়ে অভিমত পার্টি একটি সার্কুলারে সে-সময় প্রকাশ করেছিলাে।” (সংগ্রামের তিন দশক’, পৃষ্ঠা ১৮১)।
তখনকার বাস্তব পরিস্থিতি ও জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষার কথা বিবেচনায় নিয়ে ক্যুনিস্ট পার্টি ‘পূর্ব পাকিস্তানের গণতান্ত্রিক শক্তিসমূহের ঐক্য, অন্তত আওয়ামী লীগ ও ক্যুনিস্ট পার্টির ভেতর ঐক্য ও সমঝােতা, একান্ত প্রয়ােজন বলে মনে করে। সামরিক শাসন জারির পর, সবরকম প্রতিকূলতাকে মােকাবেলা করেই, কম্যুনিস্ট পার্টি যখন আইউব-বিরােধী আন্দোলনের বীজতলা তৈরিতে নিযুক্ত ছিলাে তখন, এমনকি, দক্ষিণপন্থী আওয়ামী লীগ নেতা হােসেন শহিদ সােহরাওয়ার্দীও কম্যুনিস্টদের ওপরই ভরসা করতে চেয়েছিলেন। আইউব খান এবভাে’ নামক একটি সামরিক আদেশ জারি করে সােহরাওয়ার্দীসহ পাকিস্তানের বাঘা বাঘা রাজনীতিকদের রাজনীতি থেকে দূরে সরিয়ে রাখার ব্যবস্থা করেছিলেন। যাদের বিরুদ্ধে এই আদেশ জারি করা
২৬৫
হবে তারা পরবর্তী পাঁচ বছরের জন্যে পার্লামেন্টসহ যে কোনাে জনপ্রতিনিধিত্বমূলক প্রতিষ্ঠানের নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ার অযােগ্য বিবেচিত হবেন। অবিশ্যি ‘এবডাে’র নােটিশপ্রাপ্ত রাজনীতিকদের একটি ট্রাইব্যুনালের সামনে হাজির হয়ে আত্মপক্ষ সমর্থনের লােক দেখানাে বিধানও আইউব খান রেখেছিলেন। আসলে এই ট্রাইব্যুনালে হাজার জোরালাে যুক্তি দেখালেও লাভ যে কিছুই হবে না, আইউব যাদের টার্গেট করেছেন তাদের বিরুদ্ধে উত্থাপিত সকল অভিযােগই যে বহাল থাকবে, এ-কথা অন্যান্য রাজনীতিকের মতাে সােহরাওয়ার্দীও জানতেন এবং এ-ও জানতেন যে, প্রচণ্ড গণআন্দোলন সৃষ্টি না করতে পারলে আইউবকে কাবু করা যাবে না। অথচ আওয়ামী লীগসহ কোনাে রাজনৈতিক দলেরই সে-রকম আন্দোলন সংঘটনের যােগ্যতা যে নেই সে-কথাও তার অজানা ছিলাে না। তবে ইত্তেফাক সম্পাদক তফাজ্জল হােসনে মানিক মিঞাকে তিনি বলেছিলেন যে, একমাত্র কন্যুনিস্ট পার্টিই গণআন্দোলনের সূচনা করতে পারে। আইউবের ‘এবডাে ট্রাইব্যুনালে হাজির হয়ে তিনি আত্মপক্ষ সমর্থনে বক্তব্য রাখতে পারেন, যদি ক্যুনিস্ট পার্টি আন্দোলন শুরু করার প্রতিশ্রুতি তাকে দেয়। ট্রাইব্যুনালে যে-সব বক্তব্য উত্থাপিত হবে সেগুলােকে আন্দোলনের কাজে লাগানাে যেতে পারে বলে তিনি মনে করেন। সােহরাওয়ার্দীর এই অভিমত সংবাদ সম্পাদক জহুর হােসেন চৌধুরীকে মানিক মিঞাই অবহিত করেন। কারণ জহুর হােসেন চৌধুরীর সঙ্গে যে গােপন ক্যুনিস্ট পার্টির সংযােগ ছিলাে এ-কথা মানিক মিঞা জানতেন। মানিক মিঞার অনুরােধ রক্ষা করে জহুর হােসেন চৌধুরী কম্যুনিস্ট পার্টিকে সােহরাওয়ার্দীর অভিমতটি জানিয়ে দিয়েছিলেন।
এ-সব কথা বিবৃত করে সত্তরের দশকে জহুর হােসেন চৌধুরী ‘সংবাদ’-এ একটি দীর্ঘ প্রবন্ধ লিখেছিলেন। এ প্রবন্ধে প্রকাশিত বেশ কিছু তথ্য বাংলাদেশের ইতিহাস রচনার জন্যে বিশেষ গুরুত্ববহ। পত্রিকার পাতাতেই প্রবন্ধটি আমি সে-সময়ে পড়েছিলাম। এরপর সেটি আর কোথাও সংকলিত হয়েছে কিনা আমার জানা নেই।
খােকা রায় তাঁর সংগ্রামের তিন দশক’-এ সােহরাওয়ার্দীর প্রসঙ্গটি উল্লেখ করেননি। তবে সে বইয়ে তিনি উনিশ শো একষট্টি সালের শেষ দিকে অনুষ্ঠিত আওয়ামী লীগ ও কম্যুনিস্ট পার্টির প্রতিনিধিদের মধ্যকার বৈঠকের বিবরণ দিয়েছেন। সে বৈঠকে আওয়ামী লীগের পক্ষে উপস্থিত ছিলেন শেখ মুজিব ও মানিক মিঞা এবং কনিস্ট পার্টির পক্ষে মনি সিংহ ও খােকা রায়। এদের মধ্যে অনুষ্ঠিত তিন চারটি বৈঠকে আইউব শাহীর বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ার সম্ভাব্যতা ও প্রক্রিয়া নিয়ে দীর্ঘ আলােচনা হয়েছিলাে। শেখ মুজিব তখনই স্বাধীন পূর্ববাংলা প্রতিষ্ঠার আন্দোলন শুরু করে দিতে চেয়েছিলেন। স্বাধীন পূর্ববাংলার দাবিতে কম্যুনিস্ট পার্টির সমর্থন থাকলেও সেই একষট্টি বাষট্টি সালে এ-দাবি নিয়ে আন্দোলন করার পরিবেশ ও পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়নি বলেই পার্টি মনে করতাে। তাই সামরিক শাসনের অবসান, গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা, রাজবন্দিদের মুক্তি, চুয়ান্নর একুশ দফা কর্মসূচি মােতাবেক পূর্ববাংলার স্বায়ত্তশাসন, ছাত্রদের শিক্ষার অধিকার এবং শ্রমিক-কৃষক ও অন্যান্য শ্রমজীবী জনগণের বিভিন্ন দাবি-দাওয়া নিয়ে আন্দোলন গড়ে তোেলাই সে-সময়ের জন্যে বাস্তবসম্মত বলে কম্যুনিস্ট পার্টি অভিমত প্রকাশ করেছিলাে। শেখ মুজিব তখনকার মতাে কম্যুনিস্ট পার্টির এঅভিমতই মেনে নিয়েছিলেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত যে পূর্ববাংলার স্বাধীনতার জন্যেই আন্দোলন করতে হবে—উনিশ শো একষট্টি সালেই শেখ মুজিব এ-কথা বারবার দৃঢ়তার সঙ্গে বলেছিলেন।
২৬৬
যাই হােক, আওয়ামী লীগ ও কম্যুনিস্ট পার্টির গােপন বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়েছিলাে যে, বাষট্টির একুশে ফেব্রুয়ারিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের দিয়েই আন্দোলনের সূচনা ঘটাতে হবে। কিন্তু তিরিশ জানুয়ারি হােসেন শহীদ সােহরাওয়ার্দী গ্রেফতার হয়ে যাওয়ায় তার পরদিন অর্থাৎ বাষট্টির একত্রিশ জানুয়ারিতেই ছাত্র আন্দোলন শুরু হয়ে যায়। বাষট্টির এই আন্দোলনই দ্বিতীয় পর্যায়ে প্রবেশ করে আগস্ট সেপ্টেম্বর মাসে। আইউব-নিয়ােজিত কুখ্যাত শিক্ষা কমিশনের প্রতিক্রিয়াশীল রিপাের্ট বাতিলের দাবিতে সেই আন্দোলনে শ্রমিক জনতাও যােগ দেয়। সতেরােই সেপ্টেম্বর পুলিশের গুলিতে নিহত হন পূর্ব পাকিস্তান সড়ক পরিবহণ সংস্থার কন্ডাক্টর গােলাম মােস্তফা।
বাষট্টিতে যার শুরু, নানা চড়াই-উত্রাই বেয়ে সেই আন্দোলনেরই পরিণতি উনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানে ও একাত্তরের সশস্ত্র স্বাধীনতা সংগ্রামে। আন্দোলনে বাঙালি জাতীয়তাবাদই হয় প্রধান শক্তি, জাতীয়তাবাদীরাই এসে যেতে থাকে আন্দোলনের পুরােভাগে। তবে, জাতীয়তাবাদীদের আন্দোলনের নেপথ্য বিধান করে দেয় যে সাম্যবাদীরাই—সে সত্য থেকেও মুখ ফিরিয়ে নেয়া উচিত নয়।

ব্রাহ্মণ্য রক্ষণশীলতার দেয়াল ভাঙা
‘পেয়িং গেস্ট’ কথাটার কোনাে দেশীয় প্রতিরূপ নেই।’ ‘গেস্ট’ শব্দটির বাংলা অতিথি’ হয়তাে যথার্থই। কিন্তু এর সঙ্গে ‘পেয়িঙ’ যুক্ত হলে ইংরেজি গেস্টকে আর বাংলায় অতিথি বলা চলে না। আমাদের প্রাচীন ঐতিহ্যে অতিথি হলেন নারায়ণ । এই নারায়ণ যার গৃহে পদধূলি দিতেন তিনি ধন্য হয়ে যেতেন, তাঁর সেবা করতে পেরে কৃতার্থ হয়ে যেতেন। সেবার বিনিময়ে অতিথির কাছ থেকে পয়সা নেবেন—তেমন ভাবাই তাে ছিলাে পাপ। তবে, এটাও ঠিক, অতিথি কখনাে অনির্দিষ্টকালের জন্যে গৃহস্থের ঘাড়ে চেপে বসে থাকতেন না। মাত্র এক তিথি বা চব্বিশ ঘণ্টার জন্যে যিনি কারাে বাড়িতে অবস্থান গ্রহণ করেন, তিনিই অতিথি। এমনটিই ‘অতিথি’ শব্দটির ব্যুৎপত্তিগত অর্থ এবং এর ব্যবহারিক অর্থও ছিলাে তা-ই।
কিন্তু যে-লােক এক তিথি ছাড়িয়ে বহু পক্ষ বা বহু মাস ধরে কারাে বাড়িতে অবস্থান করতে থাকে তাকে যেমন অতিথি বলা যায় না, তেমনি তাকে বিনি পয়সায় সেবাও দেয়া চলে না। এমন লােককে অর্ধচন্দ্র দিয়ে বিদায় করতে হয় অথবা তাকে সেবা প্রদান করলে বাধ্য হয়ে তার মূল্য আদায় করতে হয়। মূল্যের বিনিময়ে সেবা প্রদানের প্রথাটির প্রচলন, স্বাভাবিকভাবেই, ঘটে পাশ্চাত্য দেশে। সে-দেশেই, তাই, উদ্ভব ঘটে ‘পেয়িং গেস্ট’ শব্দটিরও। এক পর্যায়ে বিকশিত পুঁজিবাদের পাশ্চাত্য দেশ থেকেই আমাদের মতাে হতদরিদ্র দেশেও পণ্যে রূপান্তরিত অতিথি-সেবার ধারণাটি চলে আসে এবং সেই সঙ্গে এসে যায় ‘পেয়িং গেস্ট শব্দটিও। রাজশাহী শহরের রাণীবাজারে সুধীর গােবিন্দ মৈত্রের বাড়িতে পেয়িং গেস্ট হয়ে থাকার আগে এ-শব্দটির সঠিক তাৎপর্য আমি উপলদ্ধি করতে পারিনি।
মৈত্র বাড়িতে এসেই দেখতে পেলাম যে, কিছু লােককে পেয়িং গেস্ট হিসেবে সেবা প্রদান করে একটি দরিদ্র পরিবার নিজেদের আহারের সংস্থান করতে এবং কোনাে রকমে টিকে থাকতে পারছে। মৈত্র মহাশয়ের সহধর্মিণী, যাকে আমরা বলতাম মৈত্র মাসি’, ছিলেন অত্যন্ত বুদ্ধিমতী ও প্র্যাকটিকেল ভদ্রমহিলা। ক্ষয়িষ্ণু ও ক্ষুদ্র জমিদার পরিবারের সন্তান সুধীর গােবিন্দ
২৬৭
মৈত্র লেখাপড়া জানতেন খুবই সামান্য। বােধহয় ক্লাস নাইন পর্যন্ত পড়াশােনা করেছিলেন। পঞ্চাশ সালে পূর্ব পাকিস্তান সরকারের জমিদারি উচ্ছেদ আইন পাস হওয়ার পর স্ত্রী ও নাবালক ছেলেমেয়েদের নিয়ে মৈত্র মহাশয় পড়ে যান একান্ত বিপাকে। সেই বিপাক থেকে তার স্ত্রী অর্থাৎ আমাদের মৈত্র মাসিই তাঁকে উদ্ধার করেন।
না, শুরু থেকেই তিনি বাড়িতে পেয়িং গেস্ট রাখতে শুরু করেননি। এ-ব্যবস্থাটি গ্রহণ করেন অনেক পরে। এর আগে মৈত্র মাসি তার স্বামীর জন্যে জীবিকার অন্যতম ক্ষেত্রের সন্ধান করেছিলেন। মৈত্ররা পৌরােহিত্য করার মতাে যােগ্যতা সম্পন্ন ব্রাহ্মণ। তবে, পৌরােহিত্য করার অধিকার থাকলেও সুধীর গােবিন্দ মৈত্র বা তার পূর্বপুরুষরা কেউই পুরােহিত ছিলেন না। কারণ, ছােট হলেও তারা তাে জমিদার। জমিদাররা বাড়িবাড়ি ঘুরে পুরুতের কাজ করতে যাবেন কেন?
কিন্তু গরজ বড়াে বালাই। ভালাে কোনাে চাকরি-বাকরি করার শিক্ষাগত যােগ্যতা কিংবা ব্যবসা-বাণিজ্য করার মূলধন কোনােটাই যেহেতু সুধীর গােবিন্দ মৈত্রের নেই, জমিদারি চলে যাওয়ার পর তিনি কি করবেন? মৈত্র মাসি স্বামীকে বললেন, ‘কুছ পরােয়া নেই। তুমি তাে বামুনের ছেলে বামুন। গলায় এক গাছা পৈতা আছে। এই পৈতা দিয়েই তুমি রােজগার করতে পারাে। পুরুত ঠাকুর হয়ে যাও। পুরুত ঠাকুরদের রােজগার একেবারে কম নয়। যজমানদের কাছ থেকে চালকলা আর দক্ষিণা যা পাবে তা দিয়ে কোনাে রকমে অন্তত জীবনটা তাে বাঁচানাে যাবে।”
কিন্তু বামুনের ছেলে হলেও পুরুতগিরি করা সবার পক্ষে সম্ভব হয় না। এর জন্যে যেমন একটা বংশগত পশ্চাৎপট চাই, তেমনি পুরুত হওয়ার একটা টেকনিক্যাল প্রশিক্ষণেরও প্রয়ােজন পড়ে। আর পেশাদার পুরুতদের এমন একটা কৃত্রিম ভঙ্গি থাকতে হয় যা অতি সহজে যজমানদের মনে এক ধরনের সম্ভ্রমের উদ্রেক করে। সুধীর গােবিন্দ মৈত্রের এ-সব কোনাে কিছুই নেই। তা ছাড়া বংশপরম্পরায় একটি পুরােহিত পরিবারের থাকে সুনির্দিষ্ট যজমান গােষ্ঠী। কুল পুরােহিতকে পরিত্যাগ করে কোনাে যজমানই সাধারণত নতুন পুরােহিতের কাছে যেতে চায় না। এ অবস্থায় মৈত্র মাসি চাইলেও ব্রাহ্মণ-কায়স্থ-বৈদ্য বা নবশাখদের মধ্য থেকে যজমান জোগাড় করে নিয়ে তার স্বামীর পক্ষে পুরুতের ব্যবসায়ে নামা সম্ভব ছিলাে না।
মৈত্র মাসি এতেও হাল ছাড়েননি। তিনি স্বামীকে পাঠিয়ে দিলেন রাজশাহী শহর থেকে পাঁচ-সাত মাইল দূরে বাগদি পাড়ায়।
কোনাে শ্রোত্রীয় ব্রাহ্মণ বাগদিদের মতাে অন্ত্যজ জাতের লােকদের যজমান বানিয়ে তাদের পুরােহিত হয় না। হলে সে সমাজচ্যুত হয়, শ্রোত্রীয় ব্রাহ্মণ সমাজে তার আর ঠাই থাকে না। মৈত্র মাসি সমাজচ্যুতির পরােয়া করেন না, জাতপাত নিয়ে মাথা ঘামান না। ভাত না থাকলে জাতের কী দাম আছে? কিন্তু মৈত্রদের জ্ঞাতিগােষ্ঠী বা আত্মীয়-স্বজনরা, যারা বড়াে চাকুরে কিংবা ডাক্তার মাস্টার উকিল ইঞ্জিনিয়ার, তারা ব্যাপারটিকে খুব সহজ মনে মেনে নিতে পারেন না। তাদের গৃহিণীরা মৈত্র মাসিকে বলেন, ‘আমাদের চৌদ্দ পুরুষের কেউ পুরুতগিরি করেননি। তা বামুনের ছেলে পুরুত হলে নিন্দার অবিশ্যি কিছু নেই। তাই বলে তাের স্বামীকে তুই ছােটজাত বাগদিদের পুরুত হতে দিলি? লজ্জায় যে আমাদের মাথা কাটা যায়।
২৬৮
মৈত্র মাসি তাদের প্রশ্ন করেন, ‘কেন, লজ্জায় মাথা কাটা যাবে কেন? তােমাদের স্বামী বা ছেলেরা যে ডাক্তারি করে তারা কি কেবল বামুন রােগীরই চিকিৎসা করে? উকিল কি মেথর মক্কেলের মামলা করে দেয় না? মাস্টার কি বেছে বেছে কেবল উঁচু জাতের হিন্দুর ছেলেমেয়েদেরই পড়ায়? ডাক্তার উকিল মাস্টার যদি বামুন-শূদ্র বা হিন্দু-মুসলমান সব জাতের রােগী বা মক্কেল বা ছাত্র নিতে পারে, তবে আমার স্বামী বাগদিদের পুরােহিত হয়ে কি দোষ করলাে?’
তার দাঁতভাঙা যুক্তির সামনে কেউ ভিষ্টোতে পারেনি।
মৈত্র মাসি খুব আলাপী মহিলা ছিলেন। আলাপে আলাপে তিনি তাঁদের পরিবারের সব কথাই আমার কাছে খােলাখুলি বলে ফেলতেন, কোনাে রূপ লুকোছাপা করতে জানতেন না। স্বামীকে বাগদিদের পুরােহিত বানিয়ে তিনি যে পরিবারটিকে অনাহারের হাত থেকে বাঁচাতে পেরেছিলেন মৈত্রমাসি সে-কথা গর্বের সঙ্গেই উল্লেখ করতেন। তাঁর বড়াে মেয়েটিও বলতাে, বাবার গলার পৈতাটিই আমাদের অনেকদিন ধরে খাবার জুগিয়েছে। ওটি না থাকলে আমরা বেঁচে থাকতেই পারতাম না।’
সুধীর গােবিন্দ মৈত্রের পরিবার-পরিজনের খাবার জোটার ব্যাপারটা একান্ত বাস্তবই ছিলাে বটে এবং সে বাস্তবের খবর মৈত্র পরিবারের সদস্যদের মুখ থেকেই পেয়েছিলাম। কিন্তু শ্রোত্রীয় বাহ্মণকে (অর্থাৎ ‘আসল’ ও ‘খাটি’ ব্রাহ্মণকে) পুরুত রূপে পেয়ে অস্পৃশ্য অন্ত্যজ বাগদিরা যে কী পরিমাণে খুশি হয়ে উঠেছিলাে তা তাদের না দেখে বা তাদের কথা না শুনেও আমি ঠিকই কল্পনা করে নিতে পেরেছিলাম। দুলে বাগদি হাড়ি ডােম মুচি—এ-রকম অন্ত্যজ জাতের লােকেরা নিজেদের হিন্দু বলেই বিবেচনা করে, আদম শুমারিতেও তাদের নাম হিন্দুর তালিকাতেই লেখা হয়, হিন্দুদের শাস্ত্র মেনেই তারা পূজা-পার্বণ বা বিবাহ ও শ্রাদ্ধের অনুষ্ঠানও করে বা করতে চায়। অথচ ব্রাহ্মণ্যবাদী হিন্দু সমাজ ওদের ধর্মীয় অনুষ্ঠান পরিচালনার জন্যে কোনাে ব্রাহ্মণ- পুরােহিতেরই ব্যবস্থা রাখেনি। এমনকি, তারা নিজেদের উদ্যোগে ব্রাহ্মণ্য শাস্ত্রের আচার অনুসরণ করতে চাইলেও উঁচু জাতের হিন্দুদের হাসির খােরাক হয়েছে বা ব্যঙ্গবিদ্রুপের শিকার হয়েছে। কখনাে কখনাে সেই শাস্ত্র অনুসরণ করতে গিয়ে কারাে কারাে করুণ পরিণতিও ঘটেছে। কথাশিল্পী শরৎচন্দ্র তার গল্প উপন্যাসে অত্যন্ত দরদ দিয়ে অন্ত্যজ শ্রেণীর হিন্দুদের এ-রকম কিছু প্রসঙ্গের অবতারণা করেছেন। শরশ্চন্দ্রের যে কোন পাঠক ‘অভাগীর স্বর্গ’ গল্পের সেই দুলে বৌটির কথা স্মরণ করতে পারবেন। রসিক দুলের বৌ অভাগীর সাধ ছিলাে যে, তার মরার পর ছেলে কাঙালি ওই বামুনদের মতাে আচার অনুষ্ঠান পালন করে তার মুখে আগুন দেবে, আর তাতেই সে মুখুজ্যে গিন্নির মতাে রথে চড়ে স্বর্গে চলে যাবে। কিন্তু ব্রাহ্মণদের হৃদয়হীনতা দুলে বৌয়ের এই সাধটুকুও পূর্ণ হতে দেয়নি। শ্রীকান্ত উপন্যাসের তৃতীয় পর্বে মধু ডােমের কন্যার বিবাহ অনুষ্ঠানের বর্ণনা আছে। ডােমেদের কোনাে ব্রাহ্মণপুরােহিত না থাকলেও নিজেদের জাতের মধ্য থেকেই কেউ কেউ গলায় পৈতা ঝুলিয়ে স্বঘােষিত ব্রাহ্মণ-পণ্ডিত সেজে পুরােহিতের কাজ করে। মধু ডােমের মেয়ের বিয়ের অনুষ্ঠানে এ-রকমই দু’জন পুরােহিতের মধ্যে তুমুল ঝগড়া বেধে গিয়েছিলাে। মেয়ে পক্ষের পুরােহিত রাখাল পণ্ডিতের মন্ত্রজ্ঞানকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে বসেছিলাে বরপক্ষের পুরােহিত শিবু পণ্ডিত। রাখাল পণ্ডিত মন্ত্র পড়াচ্ছিলাে, ‘মধু ডােমায় কন্যায় নমঃ।… … ভগবতী ডােমায় পুত্রায় নমঃ। শিবু পণ্ডিত এই মন্ত্র শুনে রাখালের মুখ চেপে ধরেছিলাে। শিবুর মতে রাখাল ব্যাটা মন্ত্রের ‘ম’
২৬৯
ও জানে না। শিবু নিজে তখন সকলকে তাক লাগিয়ে ‘আসল’ মন্ত্রগুলাে বললাে, মধুডােমায় কন্যায় ভুজ্যপত্রং নমঃ। যতদিন জীবনং ততােদিন ভাতকাপড় প্রদানং সাহা।
শিবুর মুখে এই সব অসাধারণ মন্ত্র শুনে ডােমদের সকলে বলতে লাগলাে, ‘হ্যা, একজন শাস্ত্রজানা লােক বটে! মন্তর পড়ালে বটে! রাখাল পণ্ডিত এতােকাল আমাদের কেবল ঠকিয়েই খাচ্ছিলাে।
অনুমান করতে পারি: রাজশাহীর বাগদিরা তাদের নিজেদের ভেতরকার রাখাল পণ্ডিত বা শিবু পণ্ডিতদের বদলে একেবারে ‘আসল’ ব্রাহ্মণ-পণ্ডিত সুধীর গােবিন্দ মৈত্রকে পেয়ে হাতে আকাশের চাঁদ পেয়ে গিয়েছিলাে। তাই তারা তাদের সাধ্যের চেয়েও বেশি দক্ষিণা দিয়ে এই ব্রাহ্মণকে তুষ্ট রাখতে সচেষ্ট হয়েছিলাে।
কিন্তু এই ব্রাহ্মণের কপালে এ-রকম সুখ বেশিদিনের জন্যে লেখা ছিলাে না। বাগদিরাও বর্ণহিন্দুদের মতােই দলে দলে দেশত্যাগ করে হিন্দুস্থানে পাড়ি জমাতে লাগলাে। সুধীর গােবিন্দ মৈত্রের পৌরােহিত্যের পালেও লাগলাে ভাটার টান। তখনই বাড়িতে পেয়িং গেস্ট রাখার ব্যবস্থা করে মৈত্র মাসি নতুন কায়দায় তার সংসারটির হাল ধরলেন। আমি আর শচীন সে বাড়িতে যাওয়ার আগে থেকেই সেখানে পেয়িং গেস্ট ছিলাে রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজের ছাত্র ফণীভূষণ দাস ও শিবুপদ সাহা। ওরা হােস্টেলে সিট পেয়ে চলে গেলে আমিই ময়মনসিংহ থেকে জোগাড় করে নিয়ে গিয়েছিলাম হরকিশাের মিশ্র আর অহীন্দ্র চৌধুরীকে।
প্রাক্তন জমিদার ও শ্রোত্রীয় ব্রাহ্মণ সুধীর গােবিন্দ মৈত্র বাগদিদের পুরুতগিরি করলেও পাকিস্তান জামানায় বর্ণহিন্দুরা তাকে সমাজচ্যুত করেনি বা করতে পারেনি। কিংবা ছাত্রদের পেয়িং গেস্ট রেখেও, অর্থাৎ সাদামাটা কথায় ভাতের ব্যবসা করেও, মৈত্র পরিবারটি ‘পতিত ব্রাহ্মণ’ হয়ে যায়নি। এর আগের জামানায় মানে ইংরেজ আমলে হলে এদের সমাজচ্যুত বা পতিত হতেই হতাে। কর্নওয়ালিশের চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের পর বর্ণহিন্দু জমিদার-তালুকদারদের সৃষ্ট নয়া সামন্ততন্ত্রে ব্রাহ্মণ্য স্মৃতিশাস্ত্রের হৃদয়হীন বিধানই হিন্দু সমাজের ওপর নিষ্ঠুরভাবে চেপে বসেছিলাে। কোলকাতার মতাে মহানগরীতে বিত্তবান হিন্দুরা সে-বিধানকে কখনাে কখনাে বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ দেখাতে পারলেও গ্রামে বা মফস্বল শহরে তেমনটি করা কারাে পক্ষেই সম্ভব হতাে না। ব্রাহ্মণ্য স্মৃতির বিধানে জন্মসূত্রেই যার জন্যে যে আচার ও কর্ম নির্দিষ্ট থাকতাে তার বাইরে যাওয়া একেবারে অসম্ভব না হলেও খুবই কঠিন ছিলাে। পাকিস্তান জামানায় সে-সব কঠিন দেয়াল ভেঙে পড়লাে। পঞ্চাশের দশকেই ময়মনসিংহ শহরেও এমন একটি ভাঙন প্রত্যক্ষ করেছিলাম।
বাঙালি হিন্দুরা বিভিন্ন দেবদেবীর যে সব মূর্তির পূজা করে সে সব মাটির মূর্তি কিন্তু যে কেউ বানাতে পারে না। বানালেও সে মূর্তি দিয়ে পূজা হবে না। পূজা হবে কেবল ‘আচার্য। ব্রাহ্মণ’ সম্প্রদায়ভুক্ত কারিগরের তৈরি মূর্তিতে। এমনকি পাল-পদবিধারী কুমারদের তৈরি মূর্তিকে পূজা করাও বিধিসম্মত ছিলাে না। অথচ, পঞ্চাশের দশকে ময়মনসিংহ শহরে দেখলাম হিন্দুদের পূজার মূর্তি তৈরি করে দিচ্ছে একজন মুসলমান শিল্পী। নাম তার রশিদ।
সে-সময়ে ময়মনসিংহে দাশুবাবু ছিলেন অত্যন্ত দক্ষ একজন মূর্তি শিল্পী। বালক রশিদ কী করে জানি দাশু বাবুর শিষ্য হয়ে পড়ে। অল্পদিনেই শিষ্য শিল্পনৈপুণ্যে গুরুকে ছাড়িয়ে যায়। ময়মনসিংহ শহরের পূজারিরা দাশু বাবুর চেয়ে রশিদের তৈরি মূর্তিকেই বেশি পছন্দ করতে থাকে, মুসলমানের তৈরি মূর্তিকে পূজা করা শাস্ত্রসম্মত কিনা সে প্রশ্ন তারা একবারও তােলে
২৭০
না। মনসা, কালী, লক্ষ্মী, সরস্বতী, কার্তিক, গণেশ, বিশ্বকর্মা সারা বছর ধরে রশিদ এ সব মূর্তি তৈরি করে চলে, দুর্গাপূজার সময় তার ডিমান্ড একেবারে সর্বোচ্চ পর্যায়ে উঠে যায়। তার তৈরি সকল মূর্তিই হতাে গতানুগতিকতা বর্জিত ও মৌলিকতার স্পর্শমণ্ডিত। শাস্ত্রীয় বিধান মেনেই যদিও দেবদেবীর মূর্তি নির্মাণ করতে হয়, তবু শিল্পীর স্বাধীনতাও এতে যথেষ্ট পরিমাণে আছে। সেই স্বাধীনতার সর্বোচ্চ ব্যবহার ঘটিয়ে প্রতিভাধর শিল্পী রশিদ মূর্তি শিল্পে নতুন নতুন মাত্রা যােগ করতে থাকে।
শুধু পূজার মূর্তিই নয়, পূজামণ্ডপের সৌষ্ঠব বৃদ্ধি করতে রশিদের তৈরি পৌরাণিক কাহিনীভিত্তিক মূর্তিগুলাে। সেগুলােতেই বরং তার প্রতিভা আরাে উজ্জ্বলতর রূপে মূর্ত হয়ে উঠতাে। দেবদেবী বা পৌরাণিক চরিত্রের মূর্তি নির্মাণ করতে করতে সে ঝুঁকে পড়লাে একান্ত বাস্তব সাধারণ মানুষের মূর্তি নির্মাণের দিকে। মেহনতি কৃষক আর প্রাকৃতিক দুর্যোগের বিরুদ্ধে সংগ্রামরত মানুষের কয়েকটি মূর্তি তৈরি করে সে শিল্পরসিকদের অকুণ্ঠ প্রশংসা পেয়ে যায়। শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদীনের স্নেহদৃষ্টি লাভেও সে ধন্য হয়।
দুর্গাপূজা উপলক্ষে আরাে একটি কাজ করতাে রশিদ। পূজামণ্ডপে বসে সে চণ্ডীপাঠ করতাে। তার সুরেলা কণ্ঠ আর নিখুঁত উচ্চারণের চণ্ডীপাঠ শুনতে শুনতে মানুষ তন্ময় হয়ে যেতাে। ব্রাহ্মণ্য রক্ষণশীলতার দেয়াল ভাঙায় রশিদ এভাবেও অবদান রেখেছিলাে। ছেলেবেলায় শুনেছি: ব্রাহ্মণ ছাড়া অন্য কেউ চণ্ডীপাঠ করলে তার জিভ খসে পড়ে। অথচ, চণ্ডীপাঠ করে অব্রাহ্মণ ও অহিন্দু রশিদের জিভ খসে পড়েছিলাে বলে শুনিনি।
তবে তার বিরুদ্ধে অনেকেরই জিভ শাণিত হতে দেখেছি। বুৎপূজারি হিন্দুদের বুৎ তৈরি করে দেয় যে-লােকটি সেও তাে বুৎপূজারিদেরই দলের। এই অভিশপ্ত লােকটিকে মুসলমান বলবে কেন?
যারা তাকে অভিশপ্ত আর অমুসলমান বলতাে তারাই তাকে একাত্তরের এপ্রিল মাসে পাকিস্তানি মিলিটারির হাতে তুলে দেয়। মিলিটারির ক্যাম্প থেকে সে আর ফিরে আসেনি। বাঙালির মুক্তিসংগ্রামে অগণিত শহীদের রক্তের স্রোতে মিশে যায় আরেকজন শহীদের রক্ত। শহীদ শিল্পী রশিদের রক্ত ।

দেয়াল ভাঙার সূচনা: পাকিস্তানের আগে
এদেশে ব্রাহ্মণ্য রক্ষণশীলতার দেয়ালটি পাকিস্তান জামানাতেই ভেঙে পড়েছিলাে। এবং এব্যাপারে, পরােক্ষ হলেও, পাকিস্তান রাষ্ট্রটির একটি জোরালাে ভূমিকা ছিলাে। পাকিস্তানি উৎপীড়নের ধাক্কায় হিন্দুদের শান্তি ও স্বস্তি বিপর্যস্ত হয়েছিলাে অবশ্যই। তবে সেই ধাক্কাতেই তাদের রক্ষণশীলতার দেয়ালটিও যে হুড়মুড় করে ভেঙে পড়েছিলাে, সে-কথাও অস্বীকার করা যাবে না। যে-কাজটি নিজেরা করতে পারেনি, সেটিই তাদের উৎপীড়ক প্রতিপক্ষ করেছিলাে।
তাই বলে এমন ভাবাও সঙ্গত হবে না যে, পাকিস্তান জামানার আগে ব্রাহ্মণ্য রক্ষণশীলতার দেয়ালটিতে কোনাে ফাটলও দেখা দেয়নি, কিংবা হিন্দুরা সে দেয়াল ভাঙার কোনাে উদ্যোগও গ্রহণ করেনি। বাঙালির ইতিহাসের যে কোনাে পাঠকই উনিশ শতকের হিন্দু কলেজের ছাত্র তথা ইয়ং বেঙ্গলের বিদ্রোহের খবর জানেন। ইয়ং বেঙ্গলের একজন মুখপাত্র রূপে এক হিন্দু সন্তানই লিখেছিলেন যে, তারা হিন্দু ধর্মকে অন্তরের অন্তস্থল থেকে ঘৃণা করেন।
২৭১
(It there is anything that we hate from the botton of our heart, it is Hinduism.) এ-রকমই আরেকজন হিন্দু ছাত্র গঙ্গাজল স্পর্শ করে আদালতে শপথ করতে অস্বীকার করেছিলেন, কারণ তিনি গঙ্গার পবিত্রতায় বিশ্বাস করেন না। মুসলমানের দোকান থেকে গরুর মাংস কিনে খেয়ে তার হাড়গুলাে সােল্লাস চিৎকারে ব্রাহ্মণের বাড়িতে নিক্ষেপ করে ওই ইয়ংবেঙ্গল হিন্দু সন্তানরাই হিন্দুত্বের সংস্কারের মাথায় তীব্র পদাঘাত হেনেছিলাে।
ইয়ং বেঙ্গলের এ-রকম কালাপাহাড়ি আচরণের কথা বাদও দিই যদি, রামমােহন বিদ্যাসাগরের সংস্কার আন্দোলন যে হিন্দু রক্ষণশীলতার দেয়ালে বেশ বড় ধরনের ফাটল ধরিয়েছিলাে, সে-কথা না মেনে পারবাে না। এমনকি পরবর্তীকালে বঙ্কিমচন্দ্রকৃত হিন্দু ধর্মব্যাখ্যাও, আপাত রক্ষণশীলতা সত্ত্বেও, সেই দেয়াল ভাঙার কাজেই সহায়তা করেছে। শ্রীরামকৃষ্ণ আর তাঁর শিষ্য স্বামী বিবেকানন্দের ধর্মসমন্বয়ের বাণীও দেয়াল ভাঙার ক্ষেত্রে কম অবদান রাখেনি।
তবু, এ-সবের পরও, বলতেই হবে যে, রামমােহন থেকে বিবেকানন্দ পর্যন্ত সকল মনীষীর ধর্মসংস্কার ও সমাজসংস্কারের প্রয়াস হিন্দু সমাজের সর্বস্তরে সমানভাবে ব্যাপ্ত হতে পারেনি। নাগরিক সমাজে এ-সব যতােটা সুফল ফলিয়েছিলাে, গ্রামীণ সমাজে ততােটা পারেনি। নাগরিক সমাজেরও উচ্চস্তরে এ-সবের প্রভাব ছিলাে একরকম, মধ্য ও নিম্নস্তরে অন্যরকম। কোলকাতা মহানগরীতে যে রকম ছিলাে, মফস্বলের শহর-নগরগুলােতে সে-রকম নয়। গ্রামীণ হিন্দু সমাজ তাে ব্রাহ্মণ্য স্মৃতিশাস্ত্রের হৃদয়হীন বিধানের দাপটে জবুথবু হয়ে থেকেছে এই সেদিন পর্যন্ত।
তবে গ্রামীণ সমাজেও দেয়াল ভাঙার প্রক্রিয়া চলছিলােই। সে প্রক্রিয়ায় নাগরিক সমাজে উদ্ভুত ধর্মসংস্কার ও সমাজ সংস্কারের প্রভাব পড়েছিলাে বটে, কিন্তু এর আসল শক্তিটি এসেছিলাে গ্রামীণ সমাজের নিজস্ব বাস্তবতা থেকে। সে-বাস্তবতাকে আমি সে-সমাজের একেবারে ভেতর থেকে দেখেছি। ধর্মীয় রক্ষণশীলতা ও প্রতিক্রিয়াশীলতার বিরুদ্ধে লােকসমাজ যে লৌকিক রীতিপদ্ধতিতেই রুখে দাঁড়িয়েছিলাে তার উল্লেখ আগেই করেছি। অপমানে জর্জরিত নিরক্ষর কৃষকদের ভাবলােক যে গঠিত হয়েছিলাে সম্প্রদায়ের গণ্ডিভাঙা সমন্বয়ের উপাদান দিয়ে, আর তাতে যে বিদ্রোহের ভাবও প্রচুর পরিমাণে ছিলাে, সে সবের পরিচয়ও জেনেছি। আবার, বেদনার সঙ্গে এও লক্ষ করেছি যে, লােকসমাজের সমন্বয়ী ধর্মচিন্তা ও বিদ্রোহী চেতনা শেষ পর্যন্ত ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতার উত্থানকে ঠেকিয়ে রাখতে পারেনি। হিন্দু ও মুসলমান দুই ধর্মসম্প্রদায়ই এক সময়ে স্বাতন্ত্রের চেতনা নিয়ে পরস্পরের মুখােমুখি দাঁড়িয়ে গেছে। এ-রকম করতে গিয়ে উভয় সম্প্রদায়কেই আবার নিজেদের ভেতরকার দুর্বলতা ও অসঙ্গতিগুলাের বিরুদ্ধে লড়তে হয়েছে এবং তাতে অভ্যন্তরীণ সংঘাতও কম হয়নি। সংঘাতসমন্বয়ের এ-প্রক্রিয়াতেই গ্রামীণ হিন্দু সমাজের ভেতরেও ব্রাহ্মণ্য রক্ষণশীলতার দেয়াল ভাঙার কাজটি ধীরে ধীরে এগিয়ে চলছিলাে।
আমার নিজের গ্রাম ও তার আশপাশের গ্রামগুলাের হিন্দুদের মধ্যে এ-প্রক্রিয়াটি ছেলেবেলায় আমি নিজেও কিছুটা অবলােকন করেছি, গুরুজনদের মুখেও অনেক কথা শুনেছি।
হিন্দু সমাজে বিশেষ করে গ্রামে কি ধরনের রক্ষণশীলতা-যে ছিলাে, কতাে যে-তার কুঠুরি আর দেয়াল ছিলাে, যুক্তিহীন সংস্কার-যে মুক্তবুদ্ধিকে কতােভাবে দাবিয়ে রেখেছিলাে, তুচ্ছ আচারের মরুবালি রাশি যে বিচারের স্রোতপথকে কেমনভাবে গ্রাস করে নিয়েছিলাে—
২৭২
সে-সবের বিবরণ বর্তমান প্রজন্মের কাছে হয়তাে একেবারেই অবিশ্বাস্য মনে হবে। সমস্ত হিন্দুর জন্যে প্রযােজ্য কতকগুলাে সাধারণ নিষেধবিধি তাে ছিলােই, তার ওপর জাতভেদকণ্টকিত হিন্দুসমাজের বিভিন্ন জাতের জন্যে ছিলাে কতকগুলাে বিশেষ বিশেষ বিধিবিধান। সে-সব বিধিবিধান লংঘন করলেই জাত যেতাে। এই জাত যাওয়ার বিষয়টাকে বুঝানােই তাে এখন কঠিন ব্যাপার। অথচ তখন ব্রাহ্মণ্য বিধিবিধানের একটু এদিক-ওদিক করলেই, পান থেকে চুন খসলেই, জাত যেতাে। সমাজে একঘরে হতে হতাে। ধােপা-নাপিত বন্ধ হতাে। অবিশ্যি একঘরে হওয়া থেকে কিংবা জাত খােয়ানাে থেকে ফেরারও পথ ছিলাে বটে। সে-পথ হলাে প্রায়শ্চিত্তের। প্রায়শ্চিত্ত’ কথাটার আক্ষরিক অর্থ হলাে ‘পাপক্ষয়-সাধন কর্ম’। অভিধানেই তার ব্যাখ্যায় লেখা হয়েছে—প্রায়ঃ শব্দের অর্থ তপঃ অর্থাৎ তপস্যা এবং চিত্ত শব্দের অর্থ নিশ্চয়; নিশ্চয়-সংযুক্ত অর্থাৎ পাপক্ষয় সাধন বিষয়ে নিশ্চিত তপস্যা প্রায়শ্চিত্ত নামে অভিহিত। তবে আভিধানিক অর্থ যাই হােক, ব্রাহ্মণ্য স্মৃতিশাস্ত্রের বিধানে, প্রায়শ্চিত্তের ব্যবহারিক অর্থ হয়ে গিয়েছিলাে অন্যরকম। এর সঙ্গে তপস্যা টপস্যার কোনাে সম্পর্ক ছিলাে না। ওই বিধানে যা কিছুই পাপ বলে সাব্যস্ত হতাে তা থেকে পরিত্রাণের জন্যে ব্রাহ্মণের পৌরােহিত্যে বিশেষ ধরনের অনুষ্ঠান করতে হতাে। সেই অনুষ্ঠানটিরই নাম প্রায়শ্চিত্ত। সেই প্রায়শ্চিত্ত অনুষ্ঠানের আসল বিষয়টিই হচ্ছে: ব্রাহ্মণকে অর্থ, স্বর্ণ, বস্ত্র, ধেনু ইত্যাদি দান করতে হবে। পাপের রকম অনুযায়ী দানেরও আছে রকমফের। তবে যে-রকম পাপই হােক, ব্রাহ্মণকে তার মূল্য না দিয়ে তা থেকে রেহাই পাওয়া যাবে না, অর্থ দিয়েই পাপের মূল্য পরিশােধ করতে হবে।
আর হিন্দুর পাপ যে কতাে কিছুতে হতাে তার পূর্ণাঙ্গ তালিকা কে তৈরি করতে পারবে?
স্মৃতি শাস্ত্রের বিধানে কলিযুগের হিন্দুর জন্যে একটি বড়াে পাপ হলাে সমুদ্রযাত্রা। সমুদ্র পাড়ি দিয়ে যে-হিন্দু বিলাত যেতাে, তার জাত খােয়ানাে ছিলাে অবধারিত। তবে শিক্ষিত বিলেত ফেরতদের কেউই সাধারণত জাতের পরােয়া করতেন না এবং গ্রামসমাজের সঙ্গে তাদের খুব একটা সম্বন্ধ থাকতাে না বলেই পরােয়া না করে পারতেন। কেউ কেউ অবিশ্যি ব্রাহ্মণ্য বিধান মেনে মাথা ন্যাড়া করে, গােবর খেয়ে ও ব্রাহ্মণকে অর্থ দান করে প্রায়শ্চিত্তের অনুষ্ঠান করতেন এবং সেভাবেই খােয়ানাে জাত ফিরে পেতেন। যাঁরা তা করতেন না তাঁদের অনেককে হিন্দু সমাজের বাইরে অন্য সমাজে গিয়ে আশ্রয় নিতে হতাে। বাবার মুখে শুনেছি: কিশােরগঞ্জের রমেশ চক্রবর্তী নামক এক ব্রাহ্মণ ডাক্তারি পড়তে বিলেত গিয়েছিলেন। বিলেত ফেরত এই ডাক্তার প্রায়শ্চিত্ত করতে রাজি হননি বলে সমাজচ্যুত হয়েছিলেন, এবং শেষ পর্যন্ত খ্রিস্টান হয়ে গিয়েছিলেন। এমনকি আমেরিকায় গিয়ে হিন্দুধর্মের বিজয় বৈজয়ন্তী উড়িয়ে দিয়ে এসেছিলেন বলে যাকে নিয়ে হিন্দুদের গর্বের অন্ত নেই, সেই স্বামী বিবেকানন্দকেও হিন্দুরা সমুদ্রযাত্রার অপরাধে ‘সমাজচ্যুত করেছিলাে। তাঁকে তার গুরু শ্রীরামকৃষ্ণের সাধনপীঠ দক্ষিণেশ্বর কালী মন্দিরে ঢুকতে দেয়নি। জাত খােয়ানাে এই লােকটি মন্দিরে ঢুকলে মন্দির যে অপবিত্র হয়ে যাবে!
তবে স্বামী বিবেকানন্দ সংসারত্যাগী সন্ন্যাসী ছিলেন বলে তাকে সমাজচ্যুত করলেও তার কিছু যায় আসে না, জাত খােয়ানাে নিয়েও তাঁর ভয় পাবার কিছু ছিলাে না। সন্ন্যাসী রূপে তিনি তাে ছিলেন সব জাতবর্ণের ঊর্ধ্বে। কিন্তু সমাজে যাদের বাস করতে হতাে তারা যখন ব্রাহ্মণ্য বিধানকে তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করে হিন্দু সমাজে একঘরে হয়ে যেতেন, তখন তাদের বাসযােগ্য অন্যতর কোনাে সমাজকে খুঁজে নিতেই হতাে। তাদের অনেকেই ব্রাহ্মসমাজে আশ্রয় নিতেন।
২৭৩
ব্রাহ্মরা আসলে ছিলেন ব্রাহ্মণ্য কুসংস্কারত্যাগী ‘এনলাইটেন্ড হিন্দু’। এই এনলাইটেন্ড হিন্দুদের গ্রামসমাজে অবস্থান করা খুব কঠিন হতাে, স্বভাবতই তারা হতেন শহর-নগরের বাসিন্দা। শহর-নগর থেকে তাদের কেউ কেউ যখন গ্রামের বাড়িতে যেতেন, তখন প্রথাবদ্ধ গ্রামীণ সমাজের ঘােলাজলের ডােবাতেও তারা ঢেউ জাগিয়ে তুলতেন। এদের অনেকেই ছিলেন মধ্যস্বত্বভােগী জমিদার তালুকদার শ্রেণীর মানুষ। তাই গ্রামীণ সমাজপতিরা এদের সঙ্গে সহজে এঁটে উঠতে পারতেন না।
নেত্রকোনার চন্দনকান্দি গ্রামের সূর্যকান্ত চৌধুরী ছিলেন প্রবল প্রতাপান্বিত গ্রামীণ ভূস্বামী। কায়স্থ জাতের এই তালুকদারটি স্বাভাবিক ভাবেই ছিলেন ব্রাহ্মণ্য রক্ষণশীলতার পৃষ্ঠপােষক। কিন্তু তার ইংরেজি শিক্ষিত পুত্র গিরীশ চৌধুরী ও শ্ৰীশ চৌধুরী এবং পৌত্র মনােরঞ্জন চৌধুরী ও সরােজ রঞ্জন চৌধুরীর অবস্থান ছিলাে তার বিপরীত মেরুতে। তারা দীক্ষিত ব্রাহ্ম না হলেও শহর-নগরে ব্রাহ্মদের সঙ্গেই ছিলাে তাদের ওঠা-বসা। ব্রাহ্মণ্য স্মৃতিশাস্ত্রের বিধানের প্রতি তাদের মােটেই আনুগত্য ছিলাে না। আমাদের এলাকার প্রথম গ্রাজুয়েট গিরীশ চৌধুরী ছিলেন উকিল। শহরেই ছিলাে তার কর্মস্থল । শ্ৰীশ চৌধুরী কী একটা সরকারি চাকরি করতেন। রিটায়ার করার পর তিনি গ্রামের বাড়িতে চলে এলেন। কিন্তু গাঁয়ের মানুষের চোখে তার আচার-আচরণ হয়ে উঠলাে একান্তই কালাপাহাড়ি। ছাগমাংস তার প্রিয় খাদ্য ছিলাে, তাই প্রায়ই তার বাড়িতে ছাগ হত্যা করা হতাে। ছাগহত্যা বা ছাগমাংসভক্ষণ হিন্দুর জন্যে নিষিদ্ধ নয়। কিন্তু যে নিষিদ্ধ কাজটি শ্রীশ বাবু করলেন সেটি হচ্ছে চর্মকারের কাছে ছাগচর্ম বিক্রি করে দেয়া। চামড়া বেচা হচ্ছে কসাই কিংবা মুচিদের ব্যবসা। কায়স্থ সন্তান শ্ৰীশ চৌধুরী চামড়া বিক্রি করে তাে প্রকারান্তরে কসাইয়ের ব্যবসাই করলেন। অর্থাৎ নিজের জাত থেকে নিচে নেমে পড়লেন, অস্পৃশ্যের দলভুক্ত হেয়ে গেলেন। তাই শ্রোত্রীয় ব্রাহ্মণরা তার বাড়িতে জলস্পর্শ করতে পারেন না, তার পুরােহিত হতে পারেন না, তিনি ‘পতিত’ হয়ে গেছেন। এখন এই পাতিত্য মােচনের একমাত্র পথ প্রায়শ্চিত্ত করা। সেই প্রায়শ্চিত্ত করার জন্যেই ব্রাহ্মণরা শ্রীশ বাবুর ওপর চাপ সৃষ্টি করলেন।
শ্রীশ বাবু তাদের বললেন, হ্যা, পাপ যদি আমি করে থাকি তাে প্রায়শ্চিত্ত অবশ্যই করবাে। কিন্তু আমি পাপ করেছি কি না সেই রায় কে দেবে? আপনাদের কি সেই রায় দেবার অথরিটি আছে? স্মৃতিশাস্ত্র সম্পর্কে আপনাদের জ্ঞান কি অভ্রান্ত? স্মৃতিশাস্ত্র অনুযায়ী বিধান দেয়ার প্রকৃত অথরিটি হচ্ছে কাশীর পণ্ডিতসমাজ। সেই পণ্ডিতসমাজ যদি আমাকে পাপী বলে সাব্যস্ত করে প্রায়শ্চিত্তের বিধান দেয়, তবেই আমি প্রায়শ্চিত্ত করতে পারি।…বিষয়টি নিয়ে কাশীতে আপনারা পত্র লিখুন। আমিও আমার বক্তব্য তাদের লিখে জানাবাে। এরপর ঠিক হবে আমাকে প্রায়শ্চিত্ত করতে হবে কি না।’
কাশীর পণ্ডিত সমাজ কিন্তু শ্রীশ বাবুর পক্ষেই রায় ছিলেন। কারণ, শাস্ত্রমতে হিন্দু কখনাে বৃথা মাংস ভক্ষণ করতে পারে না। দেবতার কাছে যে পশু উৎসর্গ করা হয়, সেই পশুর মাংস ভক্ষণই শাস্ত্রসম্মত। দেবতার কাছে উৎসর্গ না করে কোনাে পশু বধ করে তার মাংস খাওয়া হলেই হয় ‘বৃথা মাংস ভক্ষণ। পূর্ববাংলার নেত্রকোনা এলাকার হিন্দুদের সবাই যেহেতু বৃথা মাংস ভক্ষণ করে, তাই এটি সেখানে প্রথাসিদ্ধ হয়ে গেছে। যেখানে দেবতাকে উৎসর্গ না। করেও আহারের জন্যে ছাগবধ করা হয়, সেখানে কেউ ছাগচর্ম বিক্রি করলেও তা প্রায়শ্চিত্ত যােগ্য অপরাধ হতে পারে না।
২৭৪
কাশীর পণ্ডিত সমাজের এ-রায় আমাদের এলাকার ব্রাহ্মণদের খুব বেকায়দায় ফেলে দিলাে। অগত্যা তারা একটা আপস ফর্মুলা উত্থাপন করলেন। বললেন: কাশীর পণ্ডিত সমাজের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে যদিও আমরা কোনাে কথা বলতে পারি না, তবু দেশাচার মান্য করে চলাই তাে আমাদের উচিত । বৰ্ণহিন্দুর পক্ষে চামড়া বিক্রি করা হলাে দেশাচার বিরুদ্ধ একটি কাজ। শ্ৰীশ বাবু যখন এ-রকম কাজ করেই ফেলেছেন, তখন কী আর করা যাবে! এখন ব্রাহ্মণ সমাজের মর্যাদা রক্ষার্থে তিনি যদি একদিন তার বাড়িতে আমাদের ভােজে আপ্যায়িত করেন, তবে তার বিরুদ্ধে আমাদের আর কোনাে অভিযােগ থাকে না।
শ্ৰীশ বাবু শুনে বললেন, ‘এতাে খুবই আনন্দের কথা। ব্রাহ্মণ পণ্ডিতরা যদি আমার বাড়িতে একবেলা অন্ন গ্রহণ করেন তাে আমি ধন্য হয়ে যাই।’
ব্রাহ্মণদের পাতেও তিনি ছাগমাংস পরিবেশনের ব্যবস্থা করলেন। ভােজনপর্বের মাঝামাঝিতে যখন ব্রাহ্মণগণ পরমানন্দে ছাগশিশুর কচি হাড় চর্বণ করছিলেন, তখনই শ্রীশ বাবুর পূর্ব বন্দোবস্ত মতাে সেখানে একটি মুচি এসে দাঁড়ালাে। তাকে দেখেই শ্রীশ বাবু ভােজনরত ব্রাহ্মণদের সামনে দাঁড়িয়ে জোরে জোরে বলতে লাগলেন, ‘ও, তুই বুঝি পাঁঠার চামড়া নিতে এসেছিস? দে, দাম দে।…ওরে কে আছিস, ওকে চামড়াগুলাে দিয়ে দে তাে।
শ্রীশ বাবুর হাতে দাম দিয়ে চামড়াগুলাে মাথায় তুলে নিয়ে মুচিটি চলে গেলাে। ভােজনরত ব্রাহ্মণরা আড়চোখে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখলেন। কিছুই বললেন না, খাওয়া ছেড়ে উঠেও পড়লেন না।
সেই থেকে এ এলাকার হিন্দুদের মধ্যে চামড়া বিক্রির প্রচলন হয়ে গেলাে।
এ-ঘটনাটির বর্ণনা আমার বয়ােজ্যেষ্ঠদের মুখে শুনেছি। ঘটনাটি বিশ শতকের বিশের দশকের শেষ দিককার। এ সময়েই পূর্ববঙ্গের গ্রামাঞ্চলে ব্রাহ্মণেরা অধিকার সচেতন হয়ে ওঠে। তারা আর ঢালাওভাবে শুদ্রত্ব স্বীকার করে নিতে রাজি থাকে না। কায়স্থরা বলতে থাকে: আমাদেরকে বামুনরা মিছিমিছি শুদ্র বানিয়ে রেখেছে। আমরা তাে আসলে ক্ষত্রিয়। কাজেই আমরা এখন থেকে ক্ষত্রিয়ের আচার পালন করবাে। বাপ-মা কিংবা গােষ্ঠী-জ্ঞাতিদের কেউ মারা গেলে ব্রাহ্মণেরা ‘অশৌচ’ ধারণ করে মাত্র এগারাে দিন, আর শূদ্র রীতিতে আমাদের অশৌচ হয় এক মাস। এখন থেকে আমরা আর এক মাস ধরে অশৌচ ধারণ করবাে না। বামুনদের কথায় আমরা দ্র হয়ে থাকবাে কেন? ক্ষত্রিয়দের মতােই আমাদের অশৌচ হবে তেরাে দিন।
কায়স্থের চেয়ে নিচু জাতের মানুষেরাও ব্রাহ্মণবিরােধী হয়ে ওঠে। ধােপা, নমশূদ্র, কৈবর্ত ও পাটনিদের মধ্যেও অনেকে নিজেদের ব্রাহ্মণ বলে দাবি করে বসে এবং গলায় উপবীত (পৈতা) ধারণ করতে থাকে। এ-ব্যাপারে পাবনা জেলার কাওয়াকোলা নিবাসী বিখ্যাত পণ্ডিত দিগিন্দ্র নারায়ণ ভট্টাচার্য লিখিত ‘জাতিভেদ’, ‘শূদ্রের পূজা ও বেদাধিকার’, ‘জলচল’, ‘খাদ্যাখাদ্য বিচার’ ইত্যাদি পুস্তকগুলাে বিশেষ প্রেরণা জোগায়। এ-সমস্ত পুস্তকে ভট্টাচার্য মহাশয় বিভিন্ন স্মৃগ্রিন্থ থেকে উদ্ধৃতি দিয়ে ও স্মৃতিশাস্ত্রের নতুন ব্যাখ্যা হাজির করে অব্রাহ্মণ জনগণের হীনমন্যতা দূর করতে সহায়তা করেন। বিধবা বিবাহের পক্ষে স্মৃতিশাস্ত্রের নতুন ব্যাখ্যা দিয়ে উনিশ শতকের কোলকাতায় বিদ্যাসাগর মহাশয় হিন্দু সমাজে যে আলােড়ন সৃষ্টি করেছিলেন সে-নিয়ে অনেক আলােচনা অনেক দৃষ্টিকোণ থেকে হয়েছে। কিন্তু মফস্বলের অধিবাসী দিগিন্দ্র নারায়ণ ভট্টাচার্য ‘বিশ শতকের গােড়ায় পূর্ববাংলায় পল্লী এলাকার হিন্দু
২৭৫
সমাজে যে সংস্কার আন্দোলন সৃষ্টি করেন, সে-বিষয়ে আমাদের সামাজিক ইতিহাসের গবেষকগণ প্রায় নীরব। অথচ বিদ্যাসাগরের চেয়ে দিগিন্দ্র নারায়ণের সংস্কার আন্দোলনের মূল্য কম তাে নয়ই, এক অর্থে বেশিই বরং। নাগরিক মনীষী বিদ্যাসাগরের অবদানের কথা সবাই জানে। কিন্তু গ্রামীণ সংস্কারক দিগিন্দ্র নারায়ণ পূর্ববঙ্গের পল্লীর বিস্তৃত এলাকা জুড়ে তথাকথিত নিচু জাতের হিন্দুদের মধ্যে জাগরণ সৃষ্টির ক্ষেত্রে যে অবদান রেখেছেন তার কথা এখন কেউই আর স্মরণ করে না।
বিশ শতকের বিশ ও তিরিশের দশকে পল্লীবাংলায় যে ধর্মান্দোলনগুলাে হয়েছিলাে সে গুলােই আসলে ব্রাহ্মণ্য রক্ষণশীলতার দুর্গে প্রবল আঘাত হেনেছিলাে। ব্রাহ্মণদের এতােদিনকার একচেটিয়া অধিকার ভেঙে ফেলে এ-সময়েই অব্রাহ্মণের মধ্যে থেকেও ধর্মগুরুদের আবির্ভাব ঘটতে থাকে।
সেকালের পূর্ব ময়মনসিংহের জগদল গ্রামের ভারত ব্রহ্মচারী মহােদয় কায়স্থকুলে জন্ম নিয়েও একজন বিশিষ্ট ধর্মসাধকরূপে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেন, বেশ কয়েকজন ব্রাহ্মণসন্তানও তাঁর শিষ্যত্ব গ্রহণ করে। এ-রকমটি এর আগে কখনাে হতে পারতাে না। কারণ, হিন্দুধর্ম তাে আসলে ব্রাহ্মণ্য ধর্মই। জন্মসূত্রে ব্রাহ্মণ না হয়ে কারাে পক্ষে ধর্মগুরু হওয়া তাে ছিলাে অসম্ভব ব্যাপার।
ভারত ব্রহ্মচারী পূর্ব ময়মনসিংহের বৈরাটি, জগদল, লক্ষ্মীয়া ও মালনী গ্রামে চারটি আশ্রম প্রতিষ্ঠা করে এক উদারতামূলক ধর্ম প্রচারে ব্রতী হন। তারই সুযােগ্য শিষ্য অশ্বিনীকুমার ধর ‘সােনার বাংলা নামে একটি মাসিক পত্র প্রকাশ করেন ও পরে এটির নাম হয় ভারত সমাজ। জমিদার অধ্যুষিত গৌরীপুরের পাশের একটি গণ্ডগ্রাম ভালুকায় সে-সময়ে ‘হরিপ্রেস’ নামে একটি ছাপাখানা বসানাে হয়েছিলাে। হরিপ্রেস থেকেই এই মাসিকপত্রটি ছাপা হতাে। ময়মনসিংহের গ্রামাঞ্চলের হিন্দু সমাজে রক্ষণশীলতা-বিরােধী উদার ধর্মীয় জাগরণ সৃষ্টিতে এই পত্রিকার অবদান অসামান্য। এ-পত্রিকাটিও দিগিন্দ্র নারায়ণ ভট্টাচার্যের সংস্কারমূলক চিন্তাচেতনায় উদ্বুদ্ধ ছিলাে।
নতুন এ-ধর্মান্দোলনের অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন আমাদের চন্দপাড়ার দেবেন্দ্র চন্দ্র দাস। আমার ঠাকুর্দার অনুজপ্রতিম এ-মানুষটিকে আমরা দাস দাদা বলে ডাকতাম। কায়স্থ বংশীয় হয়েও দাস দাদা ব্রাহ্মণত্বের প্রতীক পৈতা ধারণ করে নিজের পৌরােহিত্যেই দুর্গা পূজার অনুষ্ঠান করেন। তিনি নিজ হাতেই দুর্গা এবং অন্যান্য দেবদেবীর প্রতিমাও তৈরি করতেন। এসবই ছিলাে ব্রাহ্মণ্য অনুশাসনের সুস্পষ্ট লংঘন। একজন ব্রাহ্মণের এ-রকম স্পর্ধা ব্রাহ্মণ সমাজ-নায়কদের সহ্য হয়নি। আশুজিয়ার পণ্ডিত গিরিশ বেদান্ততীর্থ উদ্যোগী হয়েছিলেন দেবেন্দ্র দাস মহাশয়কে সমাজচ্যুত করতে, কিন্তু সফল হননি। বরঞ্চ গ্রামাঞ্চলের আরাে অনেক অব্রাহ্মণই দেবেন্দ্র দাস মহাশয়ের পদাঙ্ক অনুসরণ করতে থাকেন। পুরাে হিন্দু সমাজটাকে ব্রাহ্মণ্য ফ্রেমে বেঁধে রাখার জন্যে যে-সব বিধিবিধান তৈরি হয়েছিলাে, কোলকাতা মহানগরে উনিশ শতকে ও গ্রাম বাংলায় বিশ শতকের বিশের দশক থেকে সে ফ্রেম ভেঙে বেরিয়ে আসার একটা দুর্দমনীয় প্রয়াস লক্ষণীয় হয়ে উঠেছিলাে।
২৭৬
বাঙালির জাতীয় সংস্কৃতি বনাম পাকিস্তানি তমদ্দুন

হিন্দুসমাজের রক্ষণশীলতার দেয়াল ভাঙার কাহিনী বর্ণনা করা পাকিস্তানের জন্মমৃত্যু দর্শনের জন্যে প্রাসঙ্গিক কিনা, এ প্রশ্ন হয়তাে অনেকেই তুলতে পারেন। কিন্তু আমি বিষয়টিকে একটু অন্য দিক থেকে দেখি। আমি মনে করি হিন্দুদের সামাজিক রক্ষণশীলতা এবং সে-রক্ষণশীলতা থেকে বেরিয়ে আসার বিভিন্ন প্রক্রিয়া ও পর্যায়ের সঙ্গে পাকিস্তানের জন্ম ও মৃত্যু উভয়েরই নিবিড় সম্পর্ক আছে।
হিন্দু রক্ষণশীলতা নিজের সম্প্রদায়ের ভেতরই যেখানে অজস্র কুঠুরি বানিয়ে আত্মবিচ্ছিন্নতার জন্ম দেয়, সেখানে অন্য সম্প্রদায়কে কাছে টানা তাে তার পক্ষে অসম্ভবই। তবু, প্রথাশাসিত গ্রামীণ সমাজের লৌকিক সংস্কৃতিতে এমন একটি ঐক্যসূত্র ছিলাে যা সকল সাম্প্রদায়িক বিচ্ছিন্নতার মধ্যে সেতুবন্ধনের কাজ করতাে। কিন্তু এক সময় সেই সেতুটি জীর্ণ ও অকেজো হয়ে পড়ে। মুসলমানদের ভেতর থেকে যখন একটি শিক্ষিত ও আত্মসচেতন মধ্যবিত্ত গােষ্ঠীর উদ্ভব ঘটে, তখন সেই মধ্যবিত্ত তরুণরা হিন্দুদের সকল আচরণের মধ্যেই মুসলমানদের প্রতি ঘৃণা ও অবজ্ঞার প্রকাশ দেখতে পায়। তারাও মুসলিম রক্ষণশীলতার দুর্গটিকে আরাে পােক্ত করে নিয়ে সেখানে বসেই হিন্দুদের বিরুদ্ধে ঘৃণার তীর ছুঁড়তে শুরু করে দেয়। হিন্দু রক্ষণশীলতাই আরাে যুক্তিহীন হয়ে, কিংবা অভিনব সব কুযুক্তির আশ্রয় নিয়ে, প্রতিক্রিয়াশীল হিন্দু রিভাইভ্যালিজমের সৃষ্টি করেছিলাে। মুসলিম মধ্যবিত্ত তার উদ্ভব লগ্নেই এই হিন্দু রিভাইভ্যালিজমের মুখােমুখি হয়ে পড়ে। তারাও এখন এর মােকাবেলা করতে চায় মুসলিম রিভাইভ্যালিজম দিয়ে। এ-ধরনের সব রিভাইভ্যালিজমই অতীতের এক কল্পলােক সৃষ্টি করে তাতে প্রত্যাবর্তনের স্বপ্ন দেখে। মুসলিম রিভাইভ্যালিজমও তাই করেছিলাে।
মুসলিম রিভাইভ্যালিজম যখন স্বাতন্ত্র্য-চেতনায় উদ্দীপ্ত হয়ে জঙ্গীরূপ ধারণ করতে থাকে, তখন হিন্দুরাও তাদের সম্প্রদায়গত অস্তিত্ব সংরক্ষণের জন্যেই অভ্যন্তরীণ সংস্কারের দিকে মনােযােগ দিতে বাধ্য হয়। উনিশ শতকে যে-সংস্কার আন্দোলন মূলত নাগরিক পরিমণ্ডলের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিলাে, বিশ শতকে তাই নতুন রূপে গ্রামীণ সমাজেও ছড়িয়ে পড়ে। ছেচল্লিশে হিন্দু-মুসলমানের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার পৃষ্ঠপটে হিন্দু মহাসভার মতাে প্রতিক্রিয়াশীল রাজনৈতিক দলও যে অস্পৃশ্যতাবর্জন আন্দোলন সংগঠিত করে প্রগতিশীল ভূমিকায় মঞ্চাবতীর্ণ হয়েছিলাে, তাও আমরা লক্ষ করেছি।
অন্যদিকে যতােই অতীতের কল্পলােকের গুণগান করুন না কেন, বর্তমানকে উপেক্ষা করে যে বাস্তবে টিকে থাকা যায় না সে-কথা মুসলিম রিভাইভ্যালিজমের প্রবক্তারাও হাড়ে হাড়ে টের পেতে থাকে। নাসারাদের ভাষা শেখা জায়েজ কিনা, ইংরেজ শাসকদের চাকরিবাকরি করা ঠিক কিনা ও দেশটি দারুল হরবৃ’ কিনা—এ-সব তর্কবিতর্ক পেছনে ফেলে বিশ শতকের সচেতন মুসলমান যুগের বাস্তবতাকে গ্রহণ করে নিতেই বেশি পরিমাণে উদ্যোগী হয়ে ওঠে। এবং তা হতে গিয়েই অগ্রবর্তী হিন্দুদের প্রতিবন্ধকতার মুখে পড়ে যায়। এই প্রতিবন্ধকতা দূর করতে হলে কেবল যে হিন্দুদের গালাগালি আর অতীত মুসলিম গৌরবের রােমন্থন করলেই চলবে না, এ বিষয়েও তাদের বােধােদয় ঘটে। তারা বুঝে নেয় শক্তিশালী প্রতিপক্ষের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় টিকে থাকতে হলে নিজেদেরও প্রভূত শক্তি সঞ্চয় করতে হবে। আর সে-শক্তির বিস্তার ঘটাতে হবে শিক্ষায় মননে ক্রীড়ায় সাহিত্যে নৃত্যে চিত্রে এক কথায়
২৭৭
সভ্যতা ও সংস্কৃতির সকল এলাকায়। সে-সময়ে তাই যে কোনাে বিষয়ে যে কোনাে মুসলমানের কৃতিত্ব সকল মুসলমানকে গর্বে ও গৌরবে স্ফীত করে তুলতাে। গায়ের সাধারণ শিক্ষিত মুসলমানও বহুভাষাবিদ ও ভাষাবিজ্ঞানী শহীদুল্লাহর প্রসঙ্গ গর্বের সঙ্গে উল্লেখ করতাে, বিশ্ববিদ্যালয়ের অসাধারণ কৃতি ছাত্র হুমায়ুন কবিরকে ছেলেপুলেদের সামনে মডেল হিসেবে উপস্থিত করতাে, বিজ্ঞানসাধক কুদরত-ই-খােদার নামটি বিস্ময়-মিশ্রিত শ্রদ্ধার সঙ্গে উচ্চারণ করতাে। ফুটবল খেলােয়াড় গােষ্ঠপালদের বিপরীতে সামাদদের নিয়ে মুসলমানদের অহংকার ছিলাে সাম্প্রদায়িক স্বাতন্ত্র্যবােধেরই স্পষ্ট প্রকাশ। একটি ধর্মান্ধ গোঁড়া গােষ্ঠী নজরুলকে কাফের’ আখ্যা দিয়ে নানা কটুকাটব্য করলেও শিক্ষিত মুসলমানদের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশেরই অপরিসীম সমাদর পেয়ে যান এই কবি। তাঁর শ্যামাসংগীত ও বৈঞ্চব ভাবাত্মক ভজনগুলাে (কিংবা অন্যান্য গানে ও কবিতায় হিন্দু পুরাণের ব্যবহার) অনেককে ব্ৰিত করলেও ইসলামী গান কবিতা গজলের নজরুল ইসলাম গৃহীত হন মুসলিম জাগরণের কবিরূপে। সংগীত নৃত্য চিত্র শরিয়ত-সম্মত কিনা সে-বিতর্কে সংস্কৃতি মনস্ক তরুণ মুসলমানরা মওলানা আকরম খাঁর মতাে ইসলাম বিশেষজ্ঞকে পর্যন্ত তাঁদের পক্ষ সমর্থনের জন্যে পেয়ে যান। মওলানার সমস্যা
ও সমাধান গ্রন্থটিতে গীতবাদ্য সহ নানা ললিতকলার সমর্থনে কোরান হাদিসের প্রচুর উদ্ধৃতি মুসলমান কলা রসিকদের মনে দ্বিধাদ্বন্দ্ব ঘুচিয়ে দেয়। আব্বাস উদ্দীন, জয়নুল আবেদিন আর বুলবুল চৌধুরী শুধু শিল্পী রূপেই নন, মুসলমান শিল্পী হিসেবেও হন মুসলমান-নন্দিত।
এ-ভাবেই বিশ শতকের শুরু থেকে চল্লিশের দশকের মধ্যে (অর্থাৎ অর্ধশতাব্দীরও কম সময়ে) নবজাগ্রত বাঙালি মুসলমান মধ্যবিত্ত নানা ক্ষেত্রে কৃতির সঞ্চয় করে সাম্প্রদায়িক আত্মবিশ্বাসে’ বলীয়ান হয়ে ওঠে। সম্প্রদায়গতভাবে হিন্দুদের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে আত্মপ্রতিষ্ঠা অর্জন করতে হচ্ছিলাে বলে মুসলমান মধ্যবিত্তের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশের ভাবনায় সাম্প্রদায়িকতাই প্রবল হয়ে দেখা দেয়। এবং হিন্দু রিভাইভ্যালিজমের প্রতিক্রিয়া-থেকে-উদ্ভূত ও বিকশিত মুসলিম রিভাইভ্যালিজমই মুসলমানদেরকে সব পেয়েছির দেশ পাকিস্তান রাষ্ট্রের স্বপ্ন দেখায়।
কিন্তু বাস্তবে এই স্বপ্নের রাষ্ট্রটির জন্ম হয়ে যাওয়ার পর স্বপ্নভঙ্গ হতেও বেশিদিন লাগে না। আটচল্লিশ থেকে আটান্ন—এই এক দশকেই বাঙালি মুসলমান মধ্যবিত্ত যেনাে এক শতাব্দীর অভিজ্ঞতা অর্জন করে ফেলে। মুসলমান ও ইসলামের নাম করে তাদের যে কী পরিমাণে প্রতারিত করা হয়েছে, মধ্যবিত্তের মর্মে মর্মে সে উপলব্ধির সঞ্চার ঘটে। এই উপলব্ধিই তাদের চেতনা থেকে দ্বিজাতিতত্ত্বের ভ্রান্তিকে খসিয়ে দেয়। শাসক দল মুসলিম লীগের বিরুদ্ধে সৃষ্টি হয়েছিলাে যে আওয়ামী মুসলিম লীগের, সে-দলটি মুসলিম বাদ দিয়ে হয়ে যায় শুধু আওয়ামী লীগ। আর তা থেকেই বেরিয়ে আসে রেডিক্যাল রাজনৈতিক গােষ্ঠী ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি। এরও আগে জন্ম নেয় ‘গণতন্ত্রী দল’। অর্থাৎ রাজনীতিতে মুসলিম রিভাইভ্যালিজমের আবেদন অনেক দূরে সরে যায়, সেকুলার ভাবনাচিন্তাই জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। আবার এসব কিছুর পেছনে বস্তুবাদী কম্যুনিস্টদের অনুঘটকের ভূমিকাটাও একেবারে গােপন থাকে না।
অন্যদিকে মূলত হিন্দুদের বিরুদ্ধে তােলা হয়েছিলাে যে লড়কে লেঙ্গে পাকিস্তান’ এর জিগির, পাকিস্তানের জন্মের পর তাে সে- জিগিরের সব কার্যকারিতাই নিঃশেষ হয়ে যায়। বিপুল সংখ্যায় হিন্দুরা দেশত্যাগ করে চলে যাওয়ার পর যারা এ-দেশে রয়ে গেলাে তারা ছিলাে
২৭৮
বৈষয়িক প্রভাব প্রতিপত্তিহীন। তাদের জমিদারি তালুকদারি মহাজনি নেই, বড়াে ব্যবসায়ী শিল্পপতিও তারা নয়, বড়াে সড়াে চাকরিতে তাে তাদের অবস্থান শূন্যের কোঠায়। কাজেই হিন্দু জুজুর ভয় দেখিয়ে দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের ক্রমবর্ধমান অসন্তোষকে চাপা দিয়ে রাখা অসম্ভব হলাে। মুসলমানের প্রতি হিন্দুদের অবমাননাকর ব্যবহারের গল্প নতুন প্রজন্মের মুসলমান তরুণ তরুণীদের কাছে মােটেই বিশ্বাসযােগ্য হলাে না। কারণ তারা দেখলাে : মুরুব্বিরা যেমন বলে থাকেন হিন্দু ছেলে মেয়েরা তাে তাদের তেমন অস্পৃশ্য বিবেচনা করে না, মফস্বল শহরে ও গ্রামে-গঞ্জেও হিন্দু-মুসলমানে একসঙ্গে পানাহার করে, নানা সামাজিক কর্মকাণ্ডে উভয় সম্প্রদায়ের মানুষ একই সঙ্গে অংশগ্রহণ করে।
শুধু তাই নয়। পাকিস্তান জন্মের পর পর কেন্দ্রীয় গণপরিষদ ও পূর্ববঙ্গের আইন পরিষদের মুসলিম আসনগুলােতে সরকারি মুসলিম লীগ দলেরই ছিলাে একাধিপত্য। সেখানে বিরােধী দলের আসনে বসে বাঙালির মাতৃভাষার অধিকারসহ গণমানুষের নানা দাবি দাওয়া তুলে ধরেন ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত থেকে শুরু করে মনােরঞ্জন ধর পর্যন্ত প্রবীণ হিন্দু রাজনীতিকরাই। এর জন্যে তাদের নানা কুৎসা ও নির্যাতনও সইতে হয়। আত্মগােপনকারী ও কারাগারে আটক (এবং খুব অল্প সময়ের জন্যে হলেও প্রকাশ্য রাজনৈতিক কার্যকলাপের সঙ্গে যুক্ত) কম্যুনিস্ট কর্মীদেরও অধিকাংশই হিন্দু। অথচ হিন্দু হয়েও তারা যে পাকিস্তান ছেড়ে চলে যাননি, এবং পাকিস্তানের জনগণের স্বার্থে যে তারা কথা বলেন, আন্দোলন করেন, নির্যাতিত হন—এ-ও তাে সকলে চোখের সামনেই দেখে। কাজেই ‘হিন্দুরা দেশদ্রোহী ও হিন্দুস্থানের দালাল’ পাকিস্তানবাদীরা অবিরাম এ ধরনের অপপ্রচার চালিয়ে গেলেও এর ধার খুব বেশিদিন ধরে বজায় থাকে না।
আগে হিন্দুদের বিরুদ্ধে মুসলমানদের যে-সব অভিযােগ ছিলাে সে-সব নিশ্চয়ই একদিনে দূর হয়ে যায়নি। এক সময়ে প্রতিপত্তিশালী হিন্দুদের কার্যকলাপ ও ব্রাহ্মণ্য আচার নিয়ম অবশ্যই সাধারণভাবে মুসলমানদের হিন্দুবিরােধী করে তুলেছিলাে। সেই বিরােধিতার মুখে নিজেদের শক্তিকে সংহত করার জন্যে ব্রাহ্মণ্য রক্ষণশীলতার দেয়াল ভেঙে যে উদারতার বাতাবরণ তৈরি করতে চেয়েছিলাে তাতে তারা মুসলমানদের ডাকেনি, একথা ঠিক। কিন্তু একবার দেয়াল ভেঙে গেলে কারাে প্রবেশই আর নিষিদ্ধ থাকে না। তাই গ্রামে-গঞ্জে জাতপাত আর অস্পৃশ্যতার বিরুদ্ধে হিন্দুদের সংস্কার আন্দোলনের সীমানা অনায়াসেই হিন্দুসমাজের বাইরেও প্রসারিত হয়ে যায়। তারা অহিন্দুদেরও আর অস্পৃশ্য করে রাখে না। হিন্দুদের রক্ষণশীলতা ও অনুদারতাই দ্বিজাতিতত্ত্বকে শক্তি যুগিয়ে পাকিস্তানের জন্মকে ত্বরান্বিত করেছিলাে। আবার, রক্ষণশীলতার দেয়াল ভেঙে-বেরিয়ে-আসা হিন্দুদের ভূমিকাই পাকিস্তানােত্তর নতুন প্রজন্মের মুসলমানদের কাছে দ্বিজাতিতত্ত্বের অসারতাও তুলে ধরেছিলাে। দ্বিজাতিতত্ব অসার প্রমাণিত হওয়ার পরই পকিস্তানের মৃত্যুর প্রক্রিয়াও শুরু হয়ে গিয়েছিলাে। তাই বলছিলাম: হিন্দুদের রক্ষণশীলতার দেয়াল ও সে দেয়াল ভাঙার প্রক্রিয়ার সঙ্গে পাকিস্তানের জন্ম ও মৃত্যু দুই-ই সম্পর্কযুক্ত।
সাম্প্রদায়িকতার জিগির দিয়ে পাকিস্তানােত্তর কালের তরুণদের, বিশেষ করে ছাত্রদের, আর ভজানাে যায় না। বাঙালি জাতীয়তাবাদী ছাত্রলীগ ও রেডিক্যাল ভাবনার অনুসারী ছাত্র ইউনিয়ন—সচেতন ছাত্র সমাজের প্রায় সকলেই এই দুটো ছাত্র সংগঠনের কোনাে একটার সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়ে। মতের খুঁটিনাটি কিংবা নেতৃত্ব নিয়ে সংঘাতের ফলে দু’দলের মধ্যেই
২৭৯
হয়তাে নানা ফ্যাকশনের সৃষ্টি হয়েছে, ডান-বামের চেতনায় এরা নানাভাবে দোলায়িত হয়েছে, কিন্তু সাম্প্রদায়িক ভাবনায় আক্রান্ত হয়েছে খুব কম ছাত্র তরুণই। ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতা-ভিত্তিক ‘ইসলামি ছাত্র সংঘ’ বৃহত্তর ছাত্রসমাজের মধ্যে কোনাে আবেদনই সৃষ্টি করতে পারেনি।
তরুণ প্রজন্মের সঙ্গে মনীষা-সম্পন্ন প্রবীণরাও এসে যােগ দেয়ার ফলে এদেশে দ্বিজাতিতত্ত্ব ভিত্তিক মুসলিম স্বাতন্ত্রবাদী বা রিভাইভ্যালিস্ট তমদ্দুন’ দ্রুত বিলীয়মান হয়ে যেতে থাকে। প্রসার ঘটতে থাকে বাঙালি জাতীয়তাবাদী ও আন্তর্জাতিক সাম্যবাদী সাংস্কৃতিক ভাবনার। বাংলা ভাষার জন্যে সংগ্রামের মধ্যেই নয় শুধু, আটচল্লিশ থেকে সাতান্ন পর্যন্ত অনুষ্ঠিত কয়েকটি সাহিত্য-সংস্কৃতি-সম্মেলন আর একষট্টিতে রবীন্দ্রজন্ম শতবার্ষিকীর উৎসবের মধ্যেও আমরা এর প্রমাণ পেয়ে যাই।
বাঙালির জাতীয় সংস্কৃতির এই প্রসারে পাকিস্তানি তমদ্দুনওয়ালারা আতঙ্কিত ও ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে। তমদুনের বদলে সংস্কৃতির প্রতিষ্ঠা মানেই তাে পাকিস্তানের অক্কা পাওয়া। এই অক্কা পাওয়া থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্যে এরা নানা বালকসুলভ আচরণ করতে থাকে।
তেষট্টি সালে এমএ পরীক্ষা দিয়েই আমি গৌরীপুর হাইস্কুলে মাস্টারি নিই। আমাকে ম্যাট্টিক ক্লাসে বাংলা পড়াতে হতাে। ক্লাস নাইনে বাংলা সাহিত্যের জন্যে নির্বাচিত পাঠ্য বইটি দেখে তাে একেবারে অবাক হয়ে গেলাম। কবি গােলাম মােস্তফা সম্পাদিত এই সংকলনটিতে সম্পাদক একটি দীর্ঘ ভূমিকা জুড়ে দিয়েছেন। উদ্দেশ্য কোমলমতি ছাত্র ছাত্রীদের ভাষা সাহিত্য সম্পর্কে সঠিক জ্ঞান প্রদান। ভূমিকাটিতে তিনি বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের ইতিহাস বর্ণনা করেছেন। ইতিহাসটি অভিনব। প্রাচীন ভারতীয় আর্য ভাষার বিবর্তনে নব্য ভারতীয় আর্যভাষা রূপে বাংলা ভাষার উৎপত্তি ঘটেছে,—গােলাম মােস্তফার মতে এ-বক্তব্য ভুল। তিনি বলেন, সংস্কৃত ভাষার সঙ্গে বাংলার কোনাে সম্পর্ক নেই। বাংলা হচ্ছে দ্রাবিড় গােষ্ঠীর ভাষা। সংস্কৃতের চেয়ে সেমেটিক ভাষা আরবির সঙ্গে এর সম্পর্ক অনেক বেশি ঘনিষ্ঠ। হিন্দুরা সব সময়েই বাংলা ভাষার শত্রুতা করেছে। মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্য রচিত হয়েছে মুসলমান সুলতানদের পৃষ্ঠপােষকতায়। আধুনিক যুগের বাংলা সাহিত্যেও হিন্দুদের কোনাে মৌলিক অবদান নেই। আধুনিক বাংলা সাহিত্যের সৃষ্টিই হয়েছে খ্রিষ্টান মাইকেল, ব্রাহ্ম রবীন্দ্রনাথ ও মুসলমান নজরুল—এই তিন অহিন্দুর হাতে। কথাগুলাে পড়ে মনে হলাে ভাগ্যিস নজরুল মুসলমান হয়ে জন্ম নিয়েছিলেন। আর মাইকেল হিন্দু ধর্ম ছেড়ে দিয়ে এবং রবীন্দ্রনাথ হিন্দু ধর্ম ত্যাগী ব্রাহ্ম দেবেন্দ্রনাথের ঔরসে জন্ম নিয়ে বেঁচে গিয়েছিলেন! হিন্দু হলে এরা বােধ হয় কেউই বাংলা ভাষার কবি হতে পারতেন না।
নজরুলের কাণ্ডারী হুশিয়ার’ কবিতাটি (যেটি আসলে একটি গান, এবং হিন্দু মুসলিম দাঙ্গার প্রতিবাদে রচিত) গােলাম মােস্তফা সম্পাদিত এই বইটিতে সংকলিত হয়েছিলাে। কিন্তু কবিতাটি থেকে বাদ দেয়া হয়েছিলাে সেই অবিস্মরণীয় দু’টি পংক্তি যাতে এই কবিতার মর্মবাণী বা অন্তঃসার নিহিত:
“হিন্দু না ওরা মুসলিম? ওই জিজ্ঞাসে কোন্ জন।
কাণ্ডারী! বলাে, ডুবিছে মানুষ, সন্তান মাের মা’র!
এ থেকেই বইটির সংকলয়িতা তথা পাকিস্তানি শিক্ষা কর্তৃপক্ষের উদ্দেশ্য সম্পর্কে ধারণা করা যায়।
পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর পরই বাংলা সাহিত্যের নতুন ইতিহাস’ বইটিতে নাজিরুল ইসলাম মােহাম্মদ সুফিয়ান বাংলা ভাষার উৎপত্তির অভিনব ইতিহাস বিকৃত করেছিলেন।
২৮০
পাকিস্তানবাদীরা এ-ইতিহাস নিয়ে কিছুদিন বাজার গরম করতে চাইলেও ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, ডক্টর মুহম্মদ এনামুল হক, অধ্যাপক আবদুল হাইসহ বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের খ্যাতকীর্তি পণ্ডিতদের কেউই সুফিয়ানের যুক্তিপ্রমাণহীন ও স্বকপােল-কল্পিত মতকে স্বীকৃতি দেননি। কোনাে বিশ্ববিদ্যালযেই যে-মতটি গৃহীত হয়নি সেই মতটিকেই তেষট্টি সালে গােলাম মােস্তফাকে দিয়ে ইস্কুল-পর্যায়ে চালু করে দেয়ার প্রয়াসের মধ্যে নিশ্চয়ই পাকিস্তানি শাসকদের একটা বদমতলব ছিলাে। সেটি হচ্ছে এদেশের মানুষকে আবহমান কালের বাঙালির ভাষা সাহিত্য-সংস্কৃতির ঐতিহ্য থেকে বিচ্ছিন্ন করে তথাকথিত পাকিস্তানি তমদুনের অনুসারী বানানাে। এই বদ মতলব থেকেই জঙ্গী শাসক আইউব খান হরফুল কোরান দিয়ে বাংলা লেখার প্রস্তাব করেন, ধামাধরা পণ্ডিতদের দিয়ে বাংলা বর্ণমালা সংস্কারের নতুন উদ্যোগ গ্রহণ করান, এমনকি বাংলা ভাষাকে বিলুপ্ত করে দিয়ে পাকিস্তানি জবান’ বানানাের মূর্ধসুলভ স্পর্ধা ও দুঃসাহস নিয়ে ঘােষণা করেন :
‘সারি জবান মিলিজুলি কর এক জবান বানা চাহিয়ে, উয়াে উর্দু নেহি, উয়াে বাংলা ভি নেহি, উয়াে পাকিস্তানি জবান।
বাঙালির জাতীয় ভাষা ও সংস্কৃতির বিরুদ্ধে পাকিস্তানি জবান ও তমদ্দুন’-এর এসব ষড়যন্ত্র বাঙালিরা অবশ্যই সফল হতে দেয়নি। সারা দেশে প্রতিবাদের ঝড় উঠলাে। গৌরীপুরে বসেই সংবাদপত্রের পাতায় পড়লাম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের উদ্যোগে তেষট্টি সনের বাইশে থেকে আটাশে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বাংলাভাষা ও সাহিত্য সপ্তাহ উদযাপনের খবর। এই অনুষ্ঠানে যে প্রতিদিন হাজার হাজার লােক অকৃত্রিম কৌতূহল ও আগ্রহ নিয়ে প্রদর্শনী দেখেছে, আলােচনা শুনেছে এবং বিভিন্ন অনুষ্ঠান উপভােগ করেছে’ এর হেতু ও তাৎপর্য বর্ণনা করে একজন গবেষক সঙ্গতভাবেই বলেছেন যে, বাঙালি জাতীয়তাবাদের যে অস্ফুট বিকাশ শুরু হয়েছিলাে সেকালে, তাই টেনে নিয়ে গেছে সবাইকে অনুষ্ঠানের দিকে।”
[সাঈদ-উর-রহমান— পূর্ববাংলার রাজনীতি- সংস্কৃতি ও কবিতা (ঢাকা-১৯৮৩) পৃষ্ঠা ৮৩]

সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার দ্বান্দ্বিক চরিত্র
পাকিস্তানের জন্মের তিন দিন আগেই, সাতচল্লিশের এগারাে আগস্ট, পাকিস্তানের জনক বলে কথিত মােহাম্মদ আলী জিন্নাহ দ্বিজাতিতত্ত্বকে নাকচ করে দিয়েছিলেন—এ-রকম মন্তব্য অনেকেই করেছেন। পাকিস্তানের গণপরিষদের প্রথম সভায় তার ওই ভাষণকে বিশ্লেষণ করে কেউ কেউ এমনও বলে থাকেন যে, জিন্নাহ সাহেব ওই ভাষণেই পাকিস্তানকে ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র করার সুস্পষ্ট ইঙ্গিত দিয়ে রেখেছিলেন।
হঁা, জিন্নাহর এগারােই আগস্টের ভাষণে অনেক সুস্থ ও যৌক্তিক বক্তব্য ছিলাে, ধর্মভিত্তিক সাম্প্রদায়িক রাজনীতির বিরুদ্ধেই তিনি সেদিন কথা বলেছিলেন। আর তাছাড়া এ কথাও তাে সত্য যে, জিন্নাহর আদতে ধর্ম নিয়ে কোনােদিনই মাথাব্যথা ছিলাে না; তার মনমানস গড়ে উঠেছিলাে পশ্চিমা সেকুলার শিক্ষাদীক্ষার পরিমণ্ডলে; তাঁর রাজনৈতিক জীবনের অর্ধেক সময় কেটেছে সেকুলার রাজনীতি করেই।
কিন্তু তা হলেই বা কী হবে? জীবনের এক পর্যায়ে এসে ব্যক্তিক উচ্চাকাক্ষা চরিতার্থ করার লক্ষে নিজেকে তিনি ধর্মীয় সাম্প্রদায়িক রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত করলেন। সংখ্যাগরিষ্ঠ
২৮১
মুসলমান’ কায়েমী স্বার্থের মুখপাত্র হলেন, আবার অগণিত দলিত ও নির্যাতিত মুসলমানেরও মনে স্বপ্ন জাগিয়ে তাদেরকে সাম্প্রদায়িকভাবে সংঘবদ্ধ করে তুললেন এবং নিজেই পাকিস্তান নামক বিষবৃক্ষটির জন্ম দিলেন। এরপর যতােই তিনি সাম্প্রদায়িকতা-বিরােধী ভালাে কথা বলুন না কেন, তার সে- সব কথা যেন তাকেই ব্যঙ্গ করতে থাকে। বিষবৃক্ষের বীজ রােপণ করে যে অমৃত ফলের আশা করা যায় না, অচিরেই তিনি তা নিজেও বােধহয় টের পেলেন। তাই, যে ক’দিন বেঁচেছিলেন সাতচল্লিশের এগারােই আগস্টের ভাষণের আর পুনরাবৃত্তি করেননি। বরং আটচল্লিশের মার্চে ঢাকায় এসে তিনি উর্দুকে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার কথাই শুধু ঘােষণা করলেন না, পূর্ববাংলার হিন্দু ও ক্যুনিস্টদের প্রতি ইঙ্গিত করে সকলকে এদের সম্পর্কে সাবধান থাকতে বললেন ও স্মরণ করিয়ে দিলেন যে, ‘পূর্ববাংলাকে ভারতের অন্তর্ভুক্ত করার চেষ্টা তারা পরিত্যাগ করেনি এবং এখনাে পর্যন্ত সেটাই তাদের লক্ষ। আরাে বললেন, আমরা বাঙালি বা সিন্ধি বা পাঠান বা পাঞ্জাবি এ-কথা বলার প্রয়ােজন কি? না, আমরা সকলেই হলাম মুসলমান।
লক্ষ করার বিষয়: এবার আর তিনি পাকিস্তানি’ জাতির কথাও বললেন না, যেমনটি সাতচল্লিশের এগারাে আগস্টে বলেছিলেন। আটচল্লিশের একুশ মার্চ ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে প্রদত্ত জিন্নাহর ভাষণটি পড়লে বােঝা যায় যে, তিনি পাকিস্তানে মুসলমান ছাড়া অন্য কোনাে সম্প্রদায়ের মানুষের নাগরিক অধিকারই স্বীকার করেন না, তার মতে এখানকার সকল অমুসলমানই দেশদ্রোহী। যে মুসলমানরা বাঙালির ভাষা ও সংস্কৃতির অধিকারের কথা বলে তারা বিভ্রান্ত এবং ওই অমুসলমানরাই তাদের বিভ্রান্ত করেছে। অর্থাৎ সাম্প্রদায়িকতা ছেড়ে দিলে পাকিস্তানের আর কিছুই অবশিষ্ট থাকে না—পাকিস্তানের জনক মহােদয় প্রকারান্তরে একথাই বলে গেলেন। ঢাকা থেকে করাচিতে ফিরে যাওয়ার পাঁচ মাস পরেই তাঁর মৃত্যু হলাে। এরপর তাঁর উত্তরসুরিরাও নিষ্ঠার সঙ্গে সাম্প্রদায়িকতার উত্তরাধিকারই বহন করে চললেন।
এই উত্তরাধিকার বহনের অর্থ হচ্ছে: দেশের ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের বিশেষ করে হিন্দুদের বিরুদ্ধে কুৎসা প্রচার করা, তাদের ওপর সর্বদা মানসিক নির্যাতন করা, স্বাভাবিক মানবিক অধিকার থেকে বঞ্চিত রেখে বাস্তবে তাদেরকে দ্বিতীয় বা তৃতীয় শ্রেণীর নাগরিকে পরিণত করা এবং মাঝে মাঝে তাদের জানমালের ওপর হামলা করা। এই শেষের কাজটিই হচ্ছে সাম্প্রদায়িকতার সবচেয়ে নগ্ন ও প্রত্যক্ষ প্রকাশ। সব দেশের সাম্প্রদায়িকতাবাদীরা এ-কাজটি করে থাকে। উপমহাদেশটি ধর্মের ভিত্তিতে বিভক্ত হওয়ার পর পাকিস্তান ও ভারত উভয় রাষ্ট্রেই এ-কাজ করা অনেক সহজ হয়ে যায়, উভয় রাষ্ট্রেই ধর্মীয় সংখ্যালঘুরা যখন তখন সাম্প্রদায়িক হামলার শিকার হয়। তবে, ভারতে গণতন্ত্রের (আসলে বুর্জোয়া গণতন্ত্রের’) প্রক্রিয়াটি চালু থাকার ফলে সেখানকার সুস্থ বুদ্ধিসম্পন্ন মানুষরা নিজেদের দেশে অনুষ্ঠিত সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার বিরুদ্ধে যেমন প্রকাশ্যে ক্ষোভ প্রকাশ করতে পেরেছেন, তেমনি বিভিন্ন। দাঙ্গার সঠিক তথ্যও সেখানকার দায়িত্ববান সাংবাদিক ও ইতিহাসকাররা বই-পুস্তক লিখে জনগণকে জানাতে পেরেছেন। এ-মুহূর্তে আমার হাতের কাছে এ-রকম যে বইটি আছে সেটি শৈলেশ কুমার বন্দোপাধ্যায়ের ‘দাঙ্গার ইতিহাস। কোলকাতা থেকে উনিশোে তিরানব্বই সালে প্রকাশিত প্রায় চারশাে পৃষ্ঠার এ বইটিতে বিরানব্বই সাল পর্যন্ত ভারত রাষ্ট্রে যতােগুলাে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হয়েছে তার সবগুলাের পক্ষপাতহীন বর্ণনা আছে। শুধু বর্ণনা নয়, যৌক্তিক বিশ্লেষণও। তীব্র ঘৃণাও। কিন্তু পাকিস্তানের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার তথ্যভিত্তিক ইতিহাস কেউ
২৮২
লিখে রাখেননি, লিখে রাখতে পারেননি। পাকিস্তানে অন্য অনেক কিছুর মতাে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার খবর প্রকাশ—এমন কি দাঙ্গা হয়েছে বলে স্বীকার করাও ছিলাে নিষিদ্ধ। আর পাকিস্তানের সেই ঐতিহ্য যে স্বাধীন বাংলাদেশেও পরিত্যক্ত হয়নি, এ-তথ্যটিই বড়াে বেশি মর্মপীড়াদায়ক।
তবু, স্বাধীন বাংলাদেশের কথা আপাতত মুলতুবি থাক। এখন শুধু বলি পাকিস্তান জামানার সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার কথাই। পাকিস্তানের দাঙ্গার কোনাে লিখিত ইতিহাস না থাকলেও উনিশোে পঞ্চাশ, বাষট্টি আর চৌষট্টি—অন্তত এই তিনবার যে এখানে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ওপর জঘন্য হামলা হয়েছে, সে-কথা কেউই লুকিয়ে রাখতে পারেনি। এই তিনবারের দাঙ্গাই আমার স্মৃতিতে ছাপ রেখে গেছে। পঞ্চাশে আমি গ্রাম্য কিশাের, বাষট্টিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র, চৌষট্টিতে এক ইস্কুলের শিক্ষক। পঞ্চাশ আর বাষট্টির দাঙ্গার কিছু কথা তাে আগেই বলেছি, এবার বলছি চৌষট্টির কথা ।
পাকিস্তানের স্বৈরশাসক ও কর্তৃত্নশীল গােষ্ঠী সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার অস্ত্রটিকে বারবার ব্যবহার করেছে তাদের নিজেদের সংকট মােচনের জন্যে। চৌষট্টিতেও তাই করতে চেয়েছিলাে। তবে যে কোনাে অস্ত্র যে বারবার ব্যবহার করলে তার ধার ক্ষয়ে যায়, চৌষট্টির দাঙ্গায় তারই প্রমাণ পাওয়া গিয়েছিলাে।
চৌষট্টির দাঙ্গা তীব্রতায় ও নৃশংসতায় আগের সব দাঙ্গাকে ছাড়িয়ে গিয়েছিলাে কিনা বলতে পারবাে না। তবে এ-কথা বলতে পারি যে, চৌষট্টি সালে দাঙ্গার বিরুদ্ধে যে-রকম প্রতিরােধ সৃষ্টি হয়েছিলাে সে-রকমটি আগে কখনাে হয়নি। সরকারি নিষেধবিধিকে উপেক্ষা করে এখানকার সকল পত্রপত্রিকায় দাঙ্গা ও দাঙ্গা-প্রতিরােধের সব খবর বিস্তৃত অনুপুঙ্খসহ ছাপা হয়েছিলাে, তীব্র আবেগ নিয়ে সেদিন বাঙালি সাংবাদিকরা সাম্প্রদায়িকতা-বিরােধী সংগ্রামে কলমের অস্ত্র হাতে নিয়ে ঝাপিয়ে পড়েছিলেন। ‘আজাদ’-এর মতাে সাম্প্রদায়িকতাবাদী কাগজও অন্যান্য সংবাদপত্রের সঙ্গে মিলে দাঙ্গাবিরােধী যৌথ সম্পাদকীয় প্রকাশ করেছিলাে। আর এবারই সর্বপ্রথম এখানকার রাজনীতিবিদ থেকে শুরু করে সমাজকর্মী, শিল্পী, সাহিত্যিক, বুদ্ধিজীবী এবং সচেতন শ্রমিক সমাজ পর্যন্ত সকলে মিলে সমস্বরে আওয়াজ তুললেন— বাঙালি রুখিয়া দাঁড়াও’। শুধু ফাঁকা আওয়াজ নয়, সক্রিয় প্রতিরােধেও নেমে পড়েলেন। দাঙ্গা প্রতিরােধ করতে গিয়েই দাঙ্গাবাজদের হাতে প্রাণ দিলেন সংগ্রামী বুদ্ধিজীবী আমির হােসেন চৌধুরী। শােনা যায়, ঘাতকের আঘাতে মাটিতে লুটিয়ে পড়ার আগে তিনি একটি দুষ্কৃতকারীকে নিজ হাতে গুলি করেছিলেন। অর্থাৎ শক্রর সঙ্গে সম্মুখ সমরে তিনি আত্মাহুতি দিয়েছিলেন, রণক্ষেত্র থেকে পলায়ন করেননি। নজরুল-সাহিত্যের প্রবল অনুরাগী ও বিপ্লবী মানবতাবাদী এই শহীদ বুদ্ধিজীবীর কথা আজ আমরা ভুলতে বসেছি। অথচ, এঁর আত্মত্যাগ সেদিনকার সকল পূর্ববঙ্গবাসীর বিবেককে প্রচণ্ড ঝাঁকুনি দিয়ে জাগিয়ে দেয়। আর তাতেই সারাদেশ সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে ক্ষোভে ও ক্রোধে ফেটে পড়ে। রাজধানীতে সে সময় একটি শক্তিশালী দাঙ্গা প্রতিরােধ কমিটি’ গঠিত হয়েছিলে। আমির হােসেন চৌধুরী নিহত হওয়ার পর (চৌষট্টির সতেরাে জানুয়ারি) দেশবাসীর উদ্দেশ্যে এই কমিটি একটি ইশতেহার প্রকাশ করেছিলাে। ইশতেহারটি ছিলাে এরকম :
২৮৩
পূর্ব পাকিস্তান রুখিয়া দাঁড়াও
সাম্প্রদায়িক দুবৃর্তদের ঘৃণ্য ছুরি আজ ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ ও অন্যান্য স্থানের শান্ত ও পবিত্র পরিবেশ কলুষিত করিয়া তুলিয়াছে। ঘাতকের ছুরি হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে পূর্ববাংলার মানুষের রক্তে লাল হইয়া উঠিয়াছে। দুবৃত্তদের হামলায় ঢাকার প্রতিটি পরিবারের শান্তি ও নিরাপত্তা আজ বিপন্ন। হিন্দু-মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের নিরীহ মানুষের ঘরবাড়ি পােড়ান হইতেছে, সম্পত্তি বিনষ্ট করা হইতেছে, এমনকি আমির হােসেন চৌধুরীর মত শান্তিকামী মানুষদেরও দুবৃত্তের হাতে জীবন দিতে হইতেছে। তাদের অপরাধ কি ছিল একবার চিন্তা করিয়া দেখুন। গুণ্ডারা মুসলমান ছাত্রীনিবাসে হামলা করিয়াছে এবং হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে আমাদের মা-বােনের সম আজ মুষ্টিমেয় গুণ্ডার কলুষ স্পর্শে লাঞ্ছিত হইতে চলিয়াছে।
এই সর্বনাশা জাতীয় দুর্দিনে আমরা মানবতার নামে, পূর্বপাকিস্তানের সম্মান ও মর্যাদার নামে দেশবাসীর নিকট আকুল আবেদন জানাইতেছি, আসুন সর্বশক্তি লইয়া গুণ্ডাদের রুখিয়া দাঁড়াই, শহরে শান্তি ও পবিত্র পরিবেশ ফিরাইয়া আনি।
পূর্ববাংলার মানুষের জীবনের উপর এই পরিকল্পিত হামলার বিরুদ্ধে রুখিয়া দাঁড়াইতে আমরা পূর্ব বাংলার সকল মানুষকে আহবান জানাইতেছি।
X প্রতি মহল্লায় দাঙ্গা প্রতিরােধ কমিটি গঠন করুন,
X গুণ্ডাদের শায়েস্তা করুন, নির্মূল করুন,
X পূর্ব পাকিস্তানের মা-বােনের ইজ্জত ও নিজেদের ভবিষ্যৎকে রক্ষা করুন।
‘দাঙ্গা প্রতিরােধ কমিটির এই ইশতেহারটি প্রচুর সংখ্যায় বিলি করা হয়েছিলাে, সংবাদপত্রেও বাঙালির সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশেরই মনের কথার প্রতিফলন ঘটেছিলাে। অন্য অন্যবার সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার সময়ে সাধারণ মানুষদের অনেককেই সরকারি প্রচারণায় বিভ্রান্ত হতে দেখেছি। এদেশের হিন্দুদের গায়ে আঁচড়টিও লাগছে না, অথচ ভারতের মুসলমানদের ওপর কি অত্যাচারটাই না করা হচ্ছে!’—অনেকের মুখেই সরকারি প্রচারণার এ রকম প্রতিধ্বনি শুনেছি। কিন্তু চৌষট্টি সালের জানুয়ারিতে শুনলাম অন্যরকম কথা। এ-সময়ে আমি গৌরীপুর থেকে ট্রেনে ময়মনসিংহে ও নেত্রকোনায় কয়েকবার যাতায়াত করেছি, শহরের বিভিন্ন এলাকায় ঘুরেছি। ট্রেনের সাধারণ যাত্রী কিংবা শহরের নানা স্তরের মানুষের মধ্যে দেখলাম : ভারতের দাঙ্গা নয়, এ-দেশের নিরীহ মানুষের ওপর হামলার জন্যেই সকলের কণ্ঠে ক্ষোভ ঝরে পড়ছে; সর্বসাধারণের সেই ক্ষোভই সর্বত্র তীব্র প্রতিরােধের জন্ম দিচ্ছে। প্রতিরােধের এই তীব্রতা দেখে সেদিনকার পূর্ব পাকিস্তানের শাসন-কর্তৃপক্ষ সত্যি সত্যিই ঘাবড়ে গিয়েছিলাে। তড়িঘড়ি করে তারা দাঙ্গা থামাতে সক্রিয় হলাে। যদি তা না হতাে, কর্তৃপক্ষ যদি গড়িমসি করে আরাে কিছুদিন দাঙ্গা চলতে দিতাে, তাহলে কী যে ঘটতে পারতাে আর কী যে ঘটতাে না তা বলা খুবই মুশকিল। ল্যাজে যদি তাের লেগেছে আগুন তবে স্বর্ণলঙ্কাই পােড়া’—এই বলে বাঙালি সেদিনই হয়তাে এ-অঞ্চলে পাকিস্তানকে কবর দিয়ে দিতাে। একাত্তর পর্যন্ত অপেক্ষা করতে না।
যাহােক, এ-সবই হচ্ছে জল্পনা-কল্পনার বিষয়। বাস্তবটি হচ্ছে যে, চৌষট্টির সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা সে-সময়কার পাকিস্তানের বাঙালিদের চেতনায় সাম্প্রদায়িকতা-বিরােধিতার একটা নতুন মাত্রা যােগ করেছিলাে। এই নতুন মাত্রাটিই ক্রমে আরাে প্রসারিত হয়ে দ্বিজাতিতত্ত্বের বিপরীতে
২৮৪
বাঙালি জাতীয়তাবাদের চেতনাকে শক্তিশালী করে তুলেছিলাে এবং বাঙালির এ-জাতীয় চেতনাই সেকালের পূর্ব পাকিস্তানের মৃত্যু পরােয়ানা রচনায় নিয়ােজিত হয়েছিলাে।
পাকিস্তান ভেঙে বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস যারা লিখেছেন তারা ভাষা-আন্দোলন। থেকে সশস্ত্র সংগ্রাম পর্যন্ত বিভিন্ন আন্দোলন-সংগ্রামগুলাের কথা যথেষ্ট গুরুত্ব সহকারেই বিবৃত করেছেন সন্দেহ নেই। কিন্তু তারা পাকিস্তানের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হাঙ্গামাগুলাের গুরুত্ব ও তাৎপর্য অনুধাবনের চেষ্টা খুব বেশি করেননি বলেই আমার ধারণা। অথচ, এ-দাঙ্গাগুলাের তাৎপর্য বহুমুখী । এগুলাের গুরুত্বকে অস্বীকার করে যথার্থ ইতিহাস রচনা করা চলে না।
পাকিস্তান রাষ্ট্রের শাসকগােষ্ঠী ও কায়েমী স্বার্থের ধারকরা প্রধানত দুটো বিবেচনা থেকে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা লাগাতাে।
এক, সাম্প্রদায়িক গােলযােগ চলতে থাকলে দেশের অভ্যন্তরীণ নানা সমস্যা থেকে নাগরিকদের দৃষ্টি অন্যদিকে সরিয়ে রাখা যায়, জনগণের নানা দাবিদাওয়া নিয়ে গড়ে ওঠা আন্দোলন-সংগ্রামগুলােকে সাময়িকভাবে হলেও ভোঁতা করে দেয়া যায়, অনেকটা নিশ্চিন্তে শাসন-শােষণ চালিয়ে যাওয়া যায়।
দুইদাঙ্গা লাগলেই হিন্দুরা দলে দলে দেশ ছেড়ে চলে যেতে থাকে, তখন তাদের সয়সম্পত্তি দখল করে নেয়ার মােক্ষম সুযােগ পাওয়া যায়; তাই সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা লাগানাে হচ্ছে একটি লাভজনক কর্ম।
হ্যা, পাকিস্তানে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা শাসকগােষ্ঠীর অনেক সুবিধা করে দিয়েছিলাে এবং অনেককেই লাভের মুখ দেখিয়েছিলাে বটে। কিন্তু এ হচ্ছে মুদ্রার এক পিঠ। অন্যপিঠের চিত্র অন্যরকম।
পাকিস্তান আর ভারত এই দু’য়ের এক রাষ্ট্রে দাঙ্গা লাগলে অন্য রাষ্ট্রে তার যে প্রতিক্রিয়া হয় তাতে উভয় রাষ্ট্রেরই ধর্মীয় সংখ্যালঘুরা বিপন্ন হয়ে পড়ে এং উভয় রাষ্ট্র থেকেই সংখ্যালঘুদের বাস্তুত্যাগের প্রবণতা দেখা দেয়। তাতে ভারত ও পাকিস্তান দু’রাষ্ট্রই ক্ষতিগ্রস্ত হয়। পরে যদিও ভারতের মুসলমানদের পাকিস্তানে চলে আসা প্রায় বন্ধ হয়ে যায়, তবু অন্তত প্রথম দিকে বাস্তুত্যাগীদের চাপে পাকিস্তানেরই ক্ষতির আশঙ্কা বেশি দেখা দিয়েছিলাে। কারণ পাকিস্তানের হিন্দুর চেয়ে ভারতের মুসলমানের সংখ্যা বেশি আর আয়তনে পাকিস্তান ভারতের চেয়ে অনেক ছােট। ভারতের সব মুসলমান পাকিস্তানে এসে আশ্রয় নিলে পুরাে পাকিস্তান রাষ্ট্রটিই তলিয়ে যাবে। এ-রকম আশঙ্কা থেকেই সে-সময়ে অনেকে পাকিস্তানে দাঙ্গা রােধ করার প্রয়ােজন অনুভব করেছেন। কেউ কেউ পাকিস্তানের হিন্দুদের ওপর উৎপীড়নের ফলে ভারতের মুসলমানদের বিপন্ন হওয়ার ভয়ে উৎকণ্ঠিত হয়েছেন। কিছুসংখ্যক বুদ্ধিজীবী, ব্যবসায়ী ও রাজনীতিক মিলে উনিশোে পঞ্চাশ সালে দাঙ্গার সময়ে যে পূর্ববঙ্গ শান্তি ও পুনর্বসতি কমিটি গঠন করেছিলেন সেই কমিটির পক্ষ থেকে এক বিবৃতিতে বলা হয়েছিলাে—
‘আমরা আমাদের মুসলমান ভাইগণকে সবিনয়ে দৃঢ়ভাবে বলিব যে , এই প্রকার কার্যের [অর্থাৎ পাকিস্তানের হিন্দুদের হত্যা ও উৎপীড়ন করা] দ্বারা পরােক্ষভাবে ও অজ্ঞাতসারে তাহারা ভারতে চারি কোটি মুসলমানের ধনপ্রাণ বিপন্ন করিয়া তুলিতেছেন এবং পাকিস্তানের অশেষ ক্ষতিসাধন করিতেছেন। এ প্রকার কার্যের ফলে আকস্মিক লােকবিনিময়ে রাষ্ট্রের উপর এমন চাপ পড়িবে যে, তার ফলে ভারত ও পাকিস্তান উভয় রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক কাঠামাে ভাঙিয়া পড়িবে। উচ্ছংখল কার্যকলাপের ফলে, শিল্পবাণিজ্য এবং স্কুল-কলেজ,
২৮৫
ইউনিভার্সিটি প্রভৃতি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলি বন্ধ হইয়া উভয় রাষ্ট্রই অচল হইবে যার ফলে আমাদের এই সাধের আজাদী বিপন্ন হইবে।…পাকিস্তানের প্রত্যেক মুসলমানের মনে রাখা উচিত যে, কলিকাতা বা হিন্দুস্থানের কোন অংশে হিন্দুদের দ্বারা অনুষ্ঠিত কোন অন্যায়ের জন্য এ দেশের হিন্দুদের কিছুতেই দায়ী করা চলে না। মুসলমানদের ন্যায় তাহারাও স্বাধীন পাকিস্তানের নাগরিক এবং পাকিস্তান সরকার যখন তাহাদের নাগরিক বলিয়া স্বীকার করিয়াছে তখন জানমালের নিরাপত্তার জন্য মুসলমানদের ন্যায় তাহাদেরও রাষ্ট্রের উপর সম্পূর্ণ দাবী আছে। এ কথা প্রত্যেক মুসলমানের স্মরণ রাখা উচিত যে, পাকিস্তানের হিন্দুরা হিন্দুস্থানের মুসলমানদের বিনিময়ে জামানত হিসাবে বাস করিতেছে না। তাহারা পাকিস্তান। রাষ্ট্রের নাগরিক অধিকারের বলেই বাস করিতেছে। অতএব একজন মুসলমানের যে তারই মত একজন পাকিস্তানের স্বাধীন নাগরিক এমন একজন হিন্দুর উপর কোন অবস্থাতেই অন্যায় উৎপীড়ন করার অধিকার নাই। প্রত্যেক শিক্ষিত ও বিবেচক মুসলমানের স্মরণ রাখা উচিত যে, পশ্চিবঙ্গের দাঙ্গার প্রতিবাদে এখানে নিরপরাধ হিন্দুদের প্রতি অত্যাচার করিলে তাহাতে হিন্দুস্থানের মুসলমানদের কোনই উপকার হইবে না। বরং বিহার, উড়িষ্যা, বােম্বাই, মাদ্রাজ, নাগপুর প্রভৃতি প্রদেশে এখনও যে সব কোটি কোটি মুসলমান হিন্দুদের সঙ্গে সুখেশান্তিতে বাস করিতেছে তাহাদের জীবন বিপন্ন হইয়া পড়িবে। দেশে শান্তি রক্ষার দ্বারা পাকিস্তানের ভিত্তিকে সুদৃঢ় করার দ্বারাই একমাত্র হিন্দুস্থানের মুসলমানদের আপনারা সত্যিকার উপকার করিতে পারেন।’
বােঝা গেলাে : দূরদৃষ্টিহীন প্রতিক্রিয়াশীলরা আপাত লাভের তাড়নায় সাম্প্রদায়িক গােলযােগের প্রশ্রয় দিলেও সুস্থবুদ্ধি ও দূরদৃষ্টিসম্পন্ন মানুষেরা এর ভয়াবহ পরিণতির কথা সহজেই আঁচ করতে পেরেছিলেন। পাকিস্তানের জন্মের মাত্র তিন বছর পরে পঞ্চাশের দাঙ্গার সময় অবিশ্যি প্রগতিচেতন মানুষেরাও বিষয়টিকে নিতান্তই উদার মানবিকতার দৃষ্টিতে দেখেছেন এবং সকলের শুভবুদ্ধির কাছে আবেদন জানানাের বেশি কিছু তারা করেননি। কিন্তু এর বারাে বছর পরে বাষট্টির দাঙ্গা তাদের দৃষ্টিকে আরাে স্বচ্ছ করে দিলাে, বদরুদ্দীন উমরের মতাে বুদ্ধিজীবীদের মার্কসবাদী বিশ্লেষণ সাম্প্রদায়িকতার কার্যকারণ সম্পর্কটিকে সকলের সামনে স্পষ্ট করে তুললাে। আর চৌষট্টির দাঙ্গা বাঙালির চেতনায় প্রচণ্ড ঘা দিয়ে তাকে জাগিয়ে দিলাে এবং প্রতিরােধে উজ্জীবিত করলাে। ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতার বদলে ভাষিক জাতীয়তার বােধ বাঙালি মুসলমানের মধ্যে প্রবলতর হয়ে উঠলাে। এই ভাষিক জাতীয়তার রুদ্ররােষ জাগ্রত হতে দেখেই চৌষট্টির পর পাকিস্তানের শাসক শােষকরা আর কোনাে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ঘটাতে সাহস পায়নি।
এভাবেই পঞ্চাশ, বাষট্টি আর পঁয়ষট্টির দাঙ্গায় প্রতিক্রিয়াশীল সাম্প্রদায়িকতাবাদী ও কায়েমি স্বার্থের ধারকরা যেমন নানাভাবে লাভবান হয়েছে, তেমনি অন্যদিকে তাদের স্বার্থের দুর্গটিতে আঘাত হানতে পারার মতাে শক্তিও ধীরে ধীরে বেড়ে উঠেছে। এবং সে শক্তিই এক সময়ে আরাে প্রবল হয়ে সাম্প্রদায়িক পাকিস্তান রাষ্ট্রটিরই ওপর মৃত্যুশেল নিক্ষেপ করেছিলাে।
অর্থাৎ অন্য সবকিছুর মতােই সাম্প্রদায়িক দাঙ্গারও একটি দ্বান্দ্বিক চরিত্র আছে। তাই বলি: পাকিস্তানের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গাগুলাের দ্বান্দ্বিক তাৎপর্য অনুধাবন না করতে পারলে পাকিস্তানের মৃত্যুর রহস্যও পুরােপুরি উন্মােচন করা যাবে না।
২৮৬
পঁয়ষট্টির পাক-ভারত যুদ্ধ: সাম্প্রদায়িকতার অন্যরূপ
চৌষট্টির জানুয়ারির পর পঁয়ষট্টির জানুয়ারি। মুসলমানি জোশের বদলে পূর্ব পাকিস্তানের মুসলমানরা যে বাঙালিত্বের দীপ্ত চেতনায় গা ঝাড়া দিয়ে উঠবে এবং হিন্দুবিরােধী দাঙ্গায় অংশ না নিয়ে দাঙ্গাবাজদের শায়েস্তা করতে লেগে যাবে, চৌষট্টির জানুয়ারির আগে পাকিস্তানের কোনাে শাসকই এমনটি বােধহয় ভাবতে পারেননি। ভাবতে পারেননি জঙ্গী শাসক আইউব খান ও তার একান্ত অনুগত ছােটলাট মােনেম খানও। তবু, তখনই, ক্ষমতা হারাবার আশঙ্কাও সম্ভবত তারা করেনি। কারণ, ইতিমধ্যেই আইউব খান ‘মৌলিক গণতন্ত্র নামে একটি অদ্ভুত চিজ সৃষ্টি করেছেন। সেই মৌলিক গণতন্ত্রীদের আস্থা ভােট নিয়ে তিনি পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট হয়েছেন, পাকিস্তানের জন্যে একটি শাসনতন্ত্রও জারি করেছেন। সেই শাসনতনন্ত্রে মৌলিক গণতন্ত্রীদেরই ভােটে প্রাদেশিক পরিষদ ও জাতীয় পরিষদ গঠনের ব্যবস্থা রেখেছেন। কিন্তু এ- সব পরিষদ নিতান্তই ঠুটো জগন্নাথ। সকল ক্ষমতার মালিক প্রেসিডেন্ট আইউব। তার এই শাসনতন্ত্রের বিরােধিতা করতে কিংবা তার নিরঙ্কুশ ক্ষমতাকে চ্যালেঞ্জ করতে, কেউ যাতে
পারে তার জন্যেও নানা আইন তিনি জারি করে রেখেছেন। এভাবে আঁটঘাট বেঁধে দুনিয়ার সামনে তার স্বৈরশাসনের একটি ‘গণতন্ত্রী’ রূপ তুলে ধরার জন্যে তিনি প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের ঘােষণা দিলেন। পঁয়ষট্টির দুই জানুয়ারি সেই নির্বাচন।
যে নির্বাচনের ভােটার হচ্ছে আইউবের একান্ত অনুগ্রহপ্রাপ্ত ও সুবিধাভােগী আশি হাজার মৌলিক গণতন্ত্রী (বাঙালিরা যাদের ‘আশি হাজার ফেরেশতা বলে বিদ্রুপ করতাে), সেই নির্বাচনে যে আইউব খান জিতবেনই সে-বিষয়ে স্বভাবতই তিনি ছিলেন আস্থাবান। জিতেছিলেনও তিনি। কিন্তু যে-রকম ভেবেছিলেন সে-রকম সহজে নয়। অন্তত পূর্ব পাকিস্তানে তাে নয়ই। প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে তার বিরােধী প্রার্থী ফাতেমা জিন্নাহ সমগ্র পাকিস্তানে প্রদত্ত ভােটের শতকরা মাত্র ছত্রিশ ভাগ পেলেও পূর্ব পাকিস্তানে তিনি পেয়েছিলেন প্রায় সাতচল্লিশ শতাংশ ভােট। আইউব খানের অনুগ্রহভাজন মৌলিক গণতন্ত্রীরাই তার বিরুদ্ধে এতগুলাে ভােট দিয়েছিলেন। জনসাধারণের ভােটাধিকার ছিলাে না বটে কিন্তু তারা মৌলিক গণতন্ত্রীদের ওপর এমন চাপ সৃষ্টি করেছিলেন যে শাসকদের সব অনুগ্রহ ও নিগ্রহ উপেক্ষা করে জনগণের প্রার্থী ফাতেমা জিন্নাহকে তারা এতােগুলাে ভােট দিতে বাধ্য হয়েছিলেন। শুধু জনসাধারণের চাপে নয়। মৌলিক গণতন্ত্রীদের নিজেদের মধ্য থেকেও একটা উল্লেখযােগ্য অংশ সচেতন ও সক্রিয় আইউব বিরােধী তথা স্বৈরাচার-বিরােধী রূপে বেরিয়ে এসেছিলেন। আমার হেকিম ভাই, মানে আশুজিয়া ইউনিয়ন কাউন্সিলের চেয়ারম্যান খান মােহাম্মদ আবদুল হাকিম, ছিলেন এ-রকমই একজন মৌলিক গণতন্ত্রী। ফাতেমা জিন্নাহর পক্ষে ভােট দেয়ার জন্যে তিনি সারা নেত্রকোনা মহকুমার মৌলিক গণতন্ত্রীদের মধ্যে রীতিমতাে ক্যাম্পেন করেছেন। মার্শাল ল’ জারি হওয়ার পর তিনি যে বিষাদ ও হতাশায় আক্রান্ত হয়েছিলেন, এ সময়ে তা পুরােপুরি কেটে গিয়েছিলাে। এখানকার মৌলিক গণতন্ত্রীদের মধ্যে হেকিম ভাইয়ের মতাে প্রকৃত গণতন্ত্রমনা মানুষের সংখ্যা নেহায়েত কম ছিলাে না। সে-কারণেই নেত্রকোনা মহকুমায়, উনিশ শাে ষাট সালেও, মৌলিক গণতন্ত্রীরাই আইউব খানের বিরুদ্ধে অনেকগুলাে অনাস্থা ভোেট দিয়েছিলাে। তাই সে-সময়ে ময়মনসিংহের একজন জেলা-কর্মকর্তা কম্যুনিস্ট-প্রভাবিত নেত্রকোনাকে পূর্ব পাকিস্তানের কেরালা’ আখ্যা দিয়েছিলেন। এই আখ্যা দিয়ে পাকিস্তানভক্ত ও
২৮৭
গণবিরােধী ওই কর্মকর্তাটি যদিও তার ক্ষোভেরই বহিঃপ্রকাশ ঘটাতে চেয়েছিলেন, তবু আমরা এ-আখ্যা পেয়ে যথেষ্ট আত্মপ্রসাদে প্রসন্ন হয়েছিলাম।
ফাতেমা জিন্নাহ সেদিন জনগণেরই কাছে গণাধিকারের প্রতীক হয়ে পঁড়িয়েছিলেন। তাঁর নির্বাচনী সভাগুলােতে যে-রকম জনসমুদ্রের সৃষ্টি হতাে সে-রকমটি আগে কোনাে সভাতেই কখনাে হয়নি। তিনি যেদিন ময়মনসিংহ সার্কিট হাউজের মাঠে বক্তৃতা দিতে এসেছিলেন সেদিন আমি অনেক চেষ্টা করেও মাঠের কাছাকাছি পৌছতে পারিনি। সারাটা শহরই যেন সেদিন জনসভার ময়দানে পরিণত হয়ে গিয়েছিলাে।
ভােটের ফল প্রকাশের পর পূর্ব পাকিস্তানের মানুষ যতােটা না হতাশ হয়েছিলাে তার চেয়ে বেশি হয়েছিলাে ক্ষুব্ধ এবং মৌলিক গণতন্ত্র সম্বন্ধে মােহমুক্তও। মৌলিক গণতন্ত্রীদের প্রতি তারা ধিক্কারেও সােচ্চার হয়ে উঠেছিলাে। কোথাও কোথাও এই মৌলিক গণতন্ত্রীরা জনতার নিগ্রহেরও শিকার হতে লাগলাে। নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট হয়েও আইউব মােটেই স্বস্তি লাভ করতে পারেননি।
তেষট্টির নভেম্বরে আমার এমএ পরীক্ষার ফল বেরােবার পর স্কুল ছেড়ে কোনাে কলেজের শিক্ষকতায় ঢােকার জন্যে চেষ্টা-তদবির করতে থাকি। ময়মনসিংহ শহরের নাসিরাবাদ কলেজে ইন্টারভিউ দিই। বেশ বড়াে সড়াে একটি ইন্টারভিউ বাের্ড। সে বাের্ডে নাসিরাবাদ কলেজের অধ্যক্ষ রিয়াজউদ্দিন আহাম্মদ উপস্থিত ছিলেন, কিন্তু তিনি আমাকে প্রায় কিছুই জিজ্ঞেস করেননি। বাইরে থেকে একজন পদস্থ ব্যক্তিকে বাের্ডের প্রধান করে আনা হয়েছিলাে। এই পদস্থ ব্যক্তিটি বাংলা সাহিত্যের অধ্যাপক ছিলেন না, তবে সাহিত্য সম্পর্কে যে তিনি অগাধ পাণ্ডিত্যের অধিকারী এমন একটি আত্মশ্লাঘা তাঁর ছিলাে। প্রথমে অবিশ্যি তিনি আমাকে সাহিত্য বিষয়ক কোনাে প্রশ্ন করেননি। কেবল বললেন, আপনি কেন এখানে ইন্টারভিউ দিতে এসেছেন? দু’দিন পরেই তাে ইন্ডিয়ায় চলে যাবেন। আপনাকে এ্যাপয়ন্টমেন্ট দিলে এই কলেজের তাে লাভ হবে না কোনাে। আবার তাে দরখাস্ত চেয়ে পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি দিতে হবে।’
তার মন্তব্যটি আমাকে প্রচণ্ড আহত করলেও আমি এর জবাবে কিছুই বললাম না । একেবারে মূক হয়ে রইলাম। আমার আশু দেশত্যাগ সম্পর্কে যিনি এমন নিশ্চিত তার বক্তব্যের প্রতিবাদ করি আমি কোন যুক্তি দিয়ে?
যাই হােক, ইন্টারভিউ বাের্ডের অন্যতম সদস্য মাহবুবুল আলম (ময়মনসিংহ আনন্দমােহন কলেজে সে-সময়কার বাংলার অধ্যাপক) আমাকে প্রশ্ন করলেন, “উভয় বাংলার জীবিত মুসলমান কবিদের মধ্যে কাকে আপনি শ্রেষ্ঠ বলে মনে করেন?
আমি বললাম, জসিম উদ্দীনকে।’
সঙ্গে সঙ্গে বাের্ডের সেই প্রধান ব্যক্তিটি তীব্র বিদ্রুপের সঙ্গে বলে উঠলেন, নজরুল কি মারা গেছেন?
তার ফঁাসফেঁসে কণ্ঠের বিদ্রুপাত্মক কথায় বাের্ডের সবাই হেসে উঠলেন।
সকলের হাসি থামলে আমি বললাম, সাহিত্য ক্ষেত্রে জীবিত কবি বলতে আমরা তাকেই বুঝি যিনি সাহিত্যিক হিসেবে জীবিত, অর্থাৎ সৃষ্টিশীল । এই বিচারে বাংলা সাহিত্যের অসাধারণ প্রতিভাবান কবি নজরুল তাে মৃতই। উনিশ শাে বিয়াল্লিশ সালেই কবি নজরুলের মৃত্যু হয়ে গেছে বলে আমরা ধরে নিতে পারি। তাই আমি নজরুলের কথা না বলে জসিম উদ্দীনের নামটি বলেছি।’
২৮৮
আমার এ-কথায় হাসির স্থলে বাের্ডে একটা গম্ভীর ভাবের সঞ্চার হলাে। অধ্যাপক মাহবুবুল আলম তখন জিজ্ঞেস করলেন, ‘পল্লীকবি হিসেবে জসিম উদ্দীনকে আপনি তার কোন কাব্যগ্রন্থটিতে সার্থক বলে মনে করেন?
আমি বললাম, জসিম উদ্দীন তাে পল্লীকবি নন।’ কী কী, কী বললেন? জসিম উদ্দীন পল্লীকবি নন?’ ফঁাসফেঁসে কণ্ঠের প্রধান ব্যক্তিটি যেনাে আকাশ থেকে পড়লেন।
আমি খুব দৃঢ়তার সঙ্গেই বললাম, হ্যা, জসিম উদ্দীনকে আমি মােটেই পল্লী কবি বলে মনে করি না। পল্লীকবি বলতে আমরা তাদেরই বুঝি যারা পল্লীর বাসিন্দা, নিরক্ষর বা প্রায় নিরক্ষর, মূলত মুখে মুখেই যারা কবিতা রচনা করেন। ময়মনসিংহের পল্লীর মনসুর বয়াতি কিংবা রামু মালীদের মতাে কবিরাই হচ্ছেন পল্লীকবি। জসিমউদ্দীন পল্লী গ্রামে জন্মগ্রহণ করলেও তিনি তাে আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রিপ্রাপ্ত একজন নগরবাসী কবি। তবে পল্লী সাহিত্য তথা লােক সাহিত্য-সংস্কৃতির সঙ্গে তার নিবিড় যােগ আছে, তিনি পল্লীর মানুষের হাসিকান্না তার কবিতায় তুলে এনেছেন, পল্লীর মানুষের ভাষাভঙ্গিও কিছুটা নিয়ে এসেছেন। আসলে তিনি লােকসাহিত্যের ঐতিহ্যের নবায়ন ঘটিয়ে এক ধরনের আধুনিক নাগরিক কবিতাই রচনা করেছেন। আর এ ক্ষেত্রে তিনি ‘নক্সীকাঁথার মাঠ ও ‘সােজন বাদিয়ার ঘাট’-এই দুটো কাব্যেই যথার্থ সার্থকতা দেখিয়েছেন।
‘সােজন বাদিয়ার ঘাট? বলুন তাে সােজন বাদিয়ার ঘাটের প্রথম লাইনটি কী? ফাসফেসে কণ্ঠের প্রশ্ন।
‘আমার মনে নেই।’
-“ওঃ, আপনি আসলে কোনাে ওরিজিন্যাল বই পড়েননি। কেবল কতকগুলাে সমালােচনার বই পড়েছেন।’ এই বলে তিনি নিজেই ‘সােজন বাদিয়ার ঘাট -এর প্রথম লাইনটি দু’তিনবার আবৃত্তি করলেন—ইতল বেতল ফুলের বনে ফুল বকুব করে রে ভাই, ফুল ঝুরঝুরে করে।
এরপর তিনি আমার দিকে নিতান্ত করুণার দৃষ্টি মেলে ধরলেন। আমি খুবই অপমানিত বােধ করলাম। আমার দ্বিতীয় রিপু উত্তেজিত হয়ে উঠলাে। তাই একটু কঠোর ভাষাতেই বলে ফেললাম, – “আপনি যাকে ওরিজিন্যাল বই বলছেন তা যে আমি একেবারে কম পড়েছি, তা নয়। বরং একটু বেশি পড়েছি বলেই হয়তাে কোনাে একটা বিশেষ বইয়ের প্রথম লাইনটি মনে করে রাখা সম্ভব হয়নি।’
ধরেই নিয়েছিলাম যে নাসিরাবাদ কলেজে আমার চাকরি হবে না। কিন্তু দু’তিন দিন পরেই শুনলাম যে, একজন বাদে ইন্টারভিউ বাের্ডের অন্য সকল সদস্যই আমার উত্তরে খুব খুশি হয়েছেন। মাহবুবুল আলম, শাসসুল ইসলাম আজিজুল হক চৌধুরী ও নজরুল ইসলাম বাের্ডে এই চারজন বাংলার অধ্যাপক ছিলেন। অর্থাৎ এঁরাই ছিলেন বিষয় বিশেষজ্ঞ। তাই, বাের্ডের অন্য সকলের চেয়ে এদের সুপারিশেরই গুরুত্ব ছিলাে বেশি। এরা সকলে আমাকেই নিয়ােগপত্র দেয়ার জন্যে জোর সুপারিশ করলেন।
আমি চৌষট্টি সালের পয়লা আগস্ট থেকে ময়মনসিংহ শহরের নাসিরাবাদ কলেজে বাংলার শিক্ষক হলাম।
চৌষট্টির জানুয়ারিতে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার সময়ে আমি গৌরীপুর হাইস্কুলের শিক্ষক, আর পঁয়ষট্টির জানুয়ারিতে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের সময়ে নাসিরাবাদ কলেজের। দাঙ্গার
২৮৯
সময় থেকে সাম্প্রদায়িকতা বিরােধী যে আবহটির সৃষ্টি হয়েছিলাে, এক বছর পরে, নির্বাচনের সময়েও তা অটুট থাকতে দেখলাম। ময়মনসিংহ শহরে বেশ কয়েকজন ‘হিন্দু’কে হিন্দুমুসলমান সাধারণের ভােটে ‘মৌলিক গণতন্ত্রী নির্বাচিত হতে দেখেছি। ফাতেমা জিন্নাহকে ভােট দেয়ার উপলক্ষ করে কোনাে সাম্প্রদায়িক জিগির ওঠেনি।
কিন্তু এই অতি সুন্দর আবহটিকে কৃত্রিমভাবে নষ্ট করে দেয়া হলাে পঁয়ষট্টির সেপ্টেম্বরে। আইউব খান ভারতের সঙ্গে যুদ্ধ বাধিয়ে দিলেন। এই যুদ্ধ বাধানাের পেছনে সিআই এর কী ভূমিকা ছিলাে, আইউব সিআই’র পাতা ফাঁদে পা দিয়েছিলেন কি না; আইউবের সঙ্গে আমেরিকার সম্পর্কের কী ধরনের টানা পােড়েন তখন চলছিলাে—এসব নিয়ে রাজনীতি বিশ্লেষকরা অনেকে অনেক কথা বলেছেন, ভবিষ্যতে আরাে হয়তাে বলবেন। আমি সেদিকে যাচ্ছি না।
যুদ্ধ তাে দেখিনি, তবে যুদ্ধের হুংকার শুনেছি রেডিও পাকিস্তানে। রেডিও খুললেই শােনা যেতাে কাফের-বিরােধী চিৎকার। হিন্দুস্থানের সঙ্গে পাকিস্তানের যুদ্ধ মানে কাফেরদের বিরুদ্ধে জেহাদ। মানে হিন্দু-মুসলমানের যুদ্ধ। পাকিস্তানের জন্মের পর থেকেই এ-দেশের হিন্দুদের যারা হিন্দুস্থানের চর’ বলে জেনে এসেছে, হিন্দুস্থানের সঙ্গে সরাসরি যুদ্ধ লেগে যাওয়ার পর তাে আর সেই শত্রুর চরদের তারা কিছুতেই মুক্ত বায়ুতে বিচরণ করতে দিতে পারে না। এ সময়ে, তাই, হিন্দুদের অনেককেই ভারতীয় নাগরিক বলে চিহ্নিত করে বন্দি শিবির’-এ নিয়ে রাখা হলাে। ময়মনসিংহের মুক্তাগাছায় এ- রকমই একটি বন্দি শিবির খােলা হয়েছিলাে। সবাইকে অবিশ্যি বন্দি শিবিরে নিয়ে যাওয়া হয়নি, তবে সমাজে প্রতিষ্ঠিত ব্যক্তিদের অনেকেই—যেমন উকিল, ডাক্তার, ব্যবসায়ী ইত্যাদি কারাবন্দি হলেন। অনেকের সম্পর্কেই নানা রকম অবিশ্বাস্য গুজব ছড়ানাে হলাে। অমুকের বাড়িতে ভারতীয় হাই কমিশনের লােকজন যাতায়াত করে, অমুক ভারতে গিয়ে এদেশের গােপন তথ্য পাচার করে দিয়ে আসে, অমুক ব্ল্যাক আউটের সময় ছাদে লাইট জ্বালিয়ে ভারতীয় বিমানকে শহরের দিশা দেখিয়ে দেয় ইত্যাদি ইত্যাদি। ময়মনসিংহের একজন খুব নামকরা ডাক্তার ছিলেন কে, পি, ঘােষ। তার বাড়িতে নাকি অয়্যারলেস সেট পাওয়া গিয়েছিলাে, ব্রহ্মপুত্রের ব্রিজটি উড়িয়ে দেয়ার জন্যে নাকি তাকে নিযুক্ত করা হয়েছিলাে। এরকম আরাে সব হিন্দু ডাক্তার-উকিল-ব্যবসায়ীর সম্বন্ধে এমন সব গুজব এমন নিপুণভাবে আকাশে-বাতাসে ছড়িয়ে দেয়া হলাে যে, এ-সবের সত্যতা সম্পর্কে কোনাে মুসলমানের মনে বিন্দুমাত্র সন্দেহও যেনাে দেখা দিতে না পারে।
পঁয়ষট্টিতে কোথাও সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হয়নি। হিন্দুদের শারীরিকভাবে আক্রমণ করা হয়েছে কিংবা তাদের সম্পত্তি লুট করা হয়েছে—এমন কিছু শুনিনি। কিন্তু তাদের ওপর মানসিক নির্যাতন একেবারে মাত্রা ছাড়িয়ে গেলাে।
সম্প্রদায়গতভাবে তাদের সকলকেই সন্দেহের পাত্র করে তােলা হলাে। নিজ বাসভূমে পরবাসী তাে তারা অনেকদিন ধরেই হয়েছিলাে, এবার পুরােপুরি স্বদেশদ্রোহী বলে চিহ্নিত হয়ে গেলাে। আমার জন্মভূমিটিকে আমিও ভালােবাসি’—এমন কথা উচ্চারণ করার অধিকারটুকু পর্যন্ত যেন তাদের কারাে রইলাে না। প্রচার মাধ্যমগুলােতে এমন একটি গণহিস্টিরিয়ার সৃষ্টি করা হলাে যে, কিছুকালের জন্যে হলেও সকলের সাধারণ বিচারবুদ্ধিই যেনাে লােপ পেয়ে যায়, যুক্তি-বিচার-বিবেচনা সব বিসর্জন দিয়ে সবাই যেনাে ‘রেডিও পাকিস্তান’এর মনমােহিনী কথার জালে আটকা পড়ে যায়।
২৯০
যুদ্ধ লাগার প্রায় সঙ্গে সঙ্গে ডাক্তার কে. পি. ঘােষ, ডাক্তার অবনী নন্দী, ডাক্তার রবি সেন, উকিল কুমুদ চক্রবর্তী, জ্যোৎস্নাময় দত্ত, ব্যবসায়ী মােহিনী মােহন বণিক, ভাই সেন এবং এরকম আরাে অনেককেই গ্রেফতার করে জেলে পাঠিয়ে দেয়া হলাে। রাজনীতির সঙ্গে এদের কারাে প্রায় কোনাে যােগই ছিলাে না। কেউ কেউ ব্রিটিশ বিরােধী রাজনীতি করলেও পাকিস্তান আমলে ছিলেন নিতান্ত সাদামাটা গৃহস্থ। যারা প্রত্যক্ষ রাজনীতি করতেন, পাকিস্তানকে একটি অসাম্প্রদায়িক প্রগতিশীল রাষ্ট্ররূপে গড়ে তােলার প্রত্যয় ছিলাে যাদের রাজনীতির মূলমর্ম, তাঁরা যে গ্রেফতারির হাত থেকে রেহাই পাবেন না সে-তাে জানা কথাই। অজয় রায়, জ্যোতিষ বােস, মহাদেব সান্যাল, মন্মথ দে, সুকুমার ভাওয়াল, রবি নিয়ােগী, নগেন সরকার, গঙ্গেশ সরকার—এ-সব কম্যুনিস্ট নেতা পাকিস্তান আমলে খুব কম সময়ই জেলের বাইরে থাকতে পারতেন, পঁয়ষট্টি সালে এদের সবাইকে একসঙ্গে জেলে পুরে দেয়া হলাে। কংগ্রেস নেতা মনােরঞ্জন ধর, বিনােদ চক্রবর্তী—এ-রকম সকলেরই হলাে একই নিয়তি। হালুয়াঘাট থেকে ধরে আনা হলাে মদনমােহন পালকে, কিশােরগঞ্জ থেকে ডাক্তার প্রফুল্ল বীরকে, নেত্রকোনাটাঙ্গাইল-জামালপুর থেকে এ-রকম আরাে অনেককে।
আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধুদেরও একজন গ্রেফতার হয়েছিলাে। সে আলােকময় নাহা। আনন্দমােহন কলেজে সেও প্রগতি’ দল করতাে। ওই ‘প্রগতি’র সূত্রেই, ছাত্রজীবন থেকেই, তার কম্যুনিস্ট নামে পরিচিতি।
ষাটের দশকের গােড়ায় আলােকময়ের বাবা মারা যান। তার ভাইবােনরা আগে থেকেই ভারতে বসবাস করে আসছিলেন। শিক্ষিত হিন্দু মধ্যবিত্ত পরিবারে এমনটি মােটেই অস্বাভাবিক ছিলাে না। কোলকাতা-কেন্দ্রিক অবিভক্ত বাংলায় চাকরি-বাকরির সুবাদে অনেকেই কোলকাতাসহ যে- সব জায়গায় বসবাস করতেন, সাতচল্লিশে র্যাডক্লিফ রােয়েদাদের কল্যাণে সেগুলাে সবই ভারত রাষ্ট্রের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যায়, আপন হয়ে পড়ে আরেক রাষ্ট্র পাকিস্তান। এভাবেই তখন অনেকের জন্মভূমি বিদেশভূমি হয়ে গিয়েছিলাে। আলােকময় নাহার ভাইবােনদের জন্যেও তাই হয়েছিলাে। কিন্তু আলােকময় তাে তার জন্মভূমিতেই অবস্থান করছিলাে। এবং সে-অবস্থানে ছিলাে গভীর দেশপ্রেমের উৎসার। অথচ, কি আশ্চর্য, আলােকময়কে দেশদ্রোহিতার অপবাদ সইতে হলাে, ভারতের দালালির অভিযােগে পঁয়ষট্টির পাক-ভারত যুদ্ধের সময় তাকেও কারাবাস করতে হলাে।
মনােরঞ্জন ধর ছিলেন যুক্তফ্রন্ট ও আওয়ামী লীগ আমলে পূর্ব পাকিস্তানের মন্ত্রিসভার সদস্য। প্রশ্নাতীত তার স্বদেশপ্রেম, নিকিতা ও সততা। আর এগুলােই হয়েছিলাে তার অপরাধ। এর জন্যে বারবারই তাকে কারাপ্রাচীরের অন্তরালে প্রবেশ করতে হয়েছে। কারাগারেও তার নির্ভীক আচরণের কোনাে ব্যত্যয় দেখা দেয়নি। তাঁরই অন্যতম কারাসঙ্গী অবনী নন্দীর মুখে শুনেছি পঁয়ষট্টি সালে পাক-ভারত যুদ্ধের সময় ময়মনসিংহ জেলখানায় জেলা প্রশাসনের একজন কর্মকর্তা মনােরঞ্জন ধরসহ ‘পাকিস্তান প্রতিরক্ষা আইন’-এ গ্রেফতারকৃত বন্দিদের সঙ্গে দেখা করতে যান। তাঁর কুশল জিজ্ঞাসার জবাবে মনােরঞ্জন ধর ওই কর্মকর্তঅকে প্রশ্ন করেছিলেন, ‘আচ্ছা, আপনি তাে আমাদের কুশল সংবাদ জানতে এসেছেন, কিন্তু বলতে পারেন কি আমরা এখানে কেনাে?’
প্রশ্ন শুনে কর্মকর্তাটি একটু হকচকিয়ে গিয়েছিলেন। কোনাে কথা বলতে পারছিলেন না। মনােরঞ্জন ধরই আবার বললেন, ‘জানি, আপনি এ-প্রশ্নের জবাব দিতে পারবেন না। আমার কাছেই শুনুন। আসলে আমরা আমাদের জন্মের অপরাধেই এখানে এসেছি।
২৯১
কর্মকর্তাটি নিশ্চয় কথাটার ইঙ্গিতটি ধরতে পেরেছিলেন। তাই চুপ করে রইলেন। মনােরঞ্জন ধর আবার প্রশ্ন করলেন, আমরা কি একটি সভ্য রাষ্ট্রের সভ্য সরকারের অধীনে বাস করছি বলে আপনি মনে করেন?
কর্মকর্তাটি, বােধগম্য কারণেই, এবারও নিরুত্তর হয়ে রইলেন।

পঁয়ষট্টির যুদ্ধের বিপরীত ফল: বাংলার স্বাধীনতার রক্তবীজ
পঁয়ষট্টির পাকভারত যুদ্ধে পশ্চিম পাকিস্তানের অধিবাসীদের প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে আমি কিছু জানি না। তবে পূর্ব পাকিস্তানে যে প্রচণ্ড উত্তেজনার সঞ্চার হয়েছিলাে তার তাপ তাে আমার গায়েও লেগেছিলাে। আমি যে হিন্দু সে কথা আমাকে বারবার স্মরণ করিয়ে দেয়া হচ্ছিলাে। এর আগে আমার ছাত্র জীবনের দুটো বছর ময়মনসিংহ শহরে কাটলেও মাত্র এক বছর আগে আমি এ শহরে কর্মজীবন শুরু করেছি, তাই তখনাে এখানে আমার ব্যাপক পরিচিতি গড়ে ওঠেনি। সেকারণেই পাকিস্তান প্রতিরক্ষা আইনের চাবুকের হাত থেকে আমি বেঁচে গেলাম, সেবার আমাকে জেলে যেতে হলাে না। তবে আমার বন্ধু আলােকময় নাহা গ্রেফতার হয়ে যাওয়ার পর শুভানুধ্যায়ীরা আমাকে নিয়েও উদ্বিগ্ন হয়ে উঠলেন, আমাকে সাবধানে চলতে-বলতে উপদেশ দিলেন। কিন্তু কী ভাবে সাবধান হবাে আমি? আমার বয়স তখনাে তিরিশ পূর্ণ হয়নি, তখনাে অকৃতদার আমি, আজন্ম চঞ্চল বাচাল আমি, কী করে হঠাৎ চলনে-বলনে সুধীর ও সংযত হয়ে যাই? ভারতের সঙ্গে যুদ্ধকে উপলক্ষ করে যারা সহসাই ঘােরতর পাকিস্তানবাদী হয়ে উঠেছিলাে এবং এক ধরনের ‘শভিনিজমে আক্রান্ত হয়ে পড়েছিলাে, আমার সে-সব মুসলমান’ বন্ধুদের সঙ্গে সে-সময় তুমুল তর্কাতর্কিতে জড়িয়ে পড়তাম। আবার ‘হিন্দুদের পরিমণ্ডলেও আমি বেমানান হয়ে পড়েছিলাম। কারণ ঘটনাবলির একপেশে হিন্দু ব্যাখ্যা আমি মেনে নিতে পারতাম না। কাজেই পঁয়ষট্টিতে বড়াে যন্ত্রণাবিদ্ধ সময় কেটেছে আমার।
যুদ্ধের পর আস্তে আস্তে পাকিস্তান প্রতিরক্ষা আইনের বন্দি হিন্দুরা জেল থেকে ছাড়া পেতে লাগলেন। আমি তাদের অনেকের সঙ্গেই দেখা করলাম। কংগ্রেস নেতা মনােরঞ্জন ধরের’বা দুর্গেশ পত্ৰনবিশের প্রতিক্রিয়া যেমন বুঝতে চেষ্টা করেছি, তেমনি কম্যুনিস্ট মহাদেব সান্যালের সঙ্গেও কথা বলেছি। আবার, রাজনীতি-সংস্পর্শহীন ব্যবসায়ী মােহিনী মােহন বণিক কিংবা সংস্কৃতিসেবী ডাক্তার অবনী নন্দীর চিন্তাচেতনার সঙ্গেও পরিচিত হয়েছি। এদের সকলের বিষয়গত ও ভাবনাগত অবস্থানে পার্থক্য থাকলেও এরা সকলে একই নিয়তির অধীন হয়েছিলেন জন্মগত হিন্দুত্বের কারণে। পঁয়ষট্টির পাক-ভারত যুদ্ধ দেশের মানুষের অন্য সকল পরিচয়কে গৌণ করে দিয়ে ধর্মীয় সাম্প্রদায়িক পরিচয়কে বড়াে বিশ্রী রকমে প্রকট করে তুলেছিলাে।
আটচল্লিশ সালের ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে পঁয়ষট্টির জানুয়ারিতে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে বিরােধী দলীয় প্রার্থী ফাতেমার পক্ষে জনউত্থান পর্যন্ত প্রবাহিত নানা ঘটনা ধারার জোয়ারভাটার মধ্যদিয়ে এখানে সাম্প্রদায়িকতার শক্তি প্রায় নিঃশেষিত হয়ে আসছিলাে। কিন্তু সেই মুমূর্ষ সাম্প্রদায়িকতাকে জেহাদের টনিক খাইয়ে পঁয়ষট্টির সেপ্টেম্বরে নতুনভাবে চাঙা করে তােলা হলাে। রেডিও পাকিস্তানে সে-সময়ে যেসব গান, কবিতা, নাটিকা, কথিকা, জীবন্তিকা ইত্যাদি প্রচার করা হতাে সে-সবের ভেতরে ভারত-বিরােধিতার নামে চলতাে হিন্দু
২৯২
বিদ্বেষের বিষােদগার। তখনাে এদেশে টেলিভিশনের ব্যাপক প্রচলন ঘটেনি বটে, কিন্তু ঘরে ঘরে রেডিও ছিলাে। সস্তায় ট্রানজিস্টার কিনে গাঁয়ের কৃষকও তা ক্ষেতের আলে রেখে দিয়ে রেডিওর অনুষ্ঠান উপভােগে অভ্যস্ত হয়ে উঠছিলাে। সেই সুযােগেই পাকিস্তানের শাসককুল। নানা মােহিনী মিথ্যা দিয়ে এদের সকলের কান ভারি করে তুলেছিলাে। কান থেকে মনে, মন থেকে প্রাণে ছড়িয়ে পড়ে এই মিথ্যাগুলােই এক ধরনের আবেশের সৃষ্টি করে ফেলেছিলাে। সেই আবেশের বশে পাকিস্তান রক্ষার জন্যে সে-সময়ে হয়তাে জ্বলন্ত আগুনে ঝাঁপ দিয়ে পড়তেও তারা দ্বিধা করতাে না।
শুধু নিরক্ষর বা স্বল্পশিক্ষিত সাধারণ মানুষই নয়, সুশিক্ষিত বিদগ্ধজনও পাকিস্তানি প্রচার মাধ্যমের মায়ার ফাঁদে ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায় আটকা পড়ে গিয়েছিলেন এবং এঁদের অনেকেই সেই প্রচার কাজে নিজেদেরও যুক্ত করে নিয়েছিলেন। ফররুখ আহমদ বা তালিম হােসেনের মতাে পাকিস্তানবাদী কবিরা যে নিজেদের অন্তর্গত বিশ্বাস থেকেই এ-সময়ে জেহাদী কবিতা লিখবেন, তেমনটিই তাে ছিলাে স্বাভাবিক। তাই ফররুখ লিখলেন—
জঙ্গে জেহাদ! জঙ্গে জেহাদ
এল জেহাদের দিন!
চল মুজাহিদ জ্বেহাদী জামাতে
উদ্যত সঙ্গীন।
চল নিয়ে দিলে আল্লাহর নাম
খুন খােশরােজ এল পরগাম
গাজী বা শহীদ হবে তুমি জানাে
দ্বিধা সংশয়হীন।

আর তালিম হােসেন ক্ষমা করব না’
কবিতায় হিন্দুস্থানীয় হামলাকারী দুশমন’দের স্পষ্ট জানিয়ে দিলেন ।
হামলা করেছ, পাক ওয়াতনের পরে
দুশমন আমি করব না ক্ষমা, করব না।
আগুন জ্বেলেছ এই শান্তির ঘরে
জালিম তােমাকে না মেরে আমি মরব না।।
তবে মজার কথা হলাে, পঁয়ষট্টির যুদ্ধ এই পাকিস্তানবাদী কবিদের সঙ্গে সঙ্গে অসাম্প্রদায়িক মানবতাবাদী প্রগতিচেতন কবি-সাহিত্যিক-চিন্তকদেরও এক ধরনের আবেশে আবিষ্ট করে ফেললাে। এদের অনেকেই, একান্ত সাময়িকভাবে হলেও, পাকিস্তানি মৌতাতে আচ্ছন্ন হয়ে পড়লেন। [দ্রষ্টব্য : সাঈদ-উর রহমানের পূর্ববাংলার রাজনীতি-সংস্কৃতি ও কবিতা, পৃষ্ঠা ১৯৫-১৯৬] কবি হাসান হাফিজুর রহমান তাে অত্যন্ত উৎসাহের সঙ্গে পশ্চিম পাকিস্তানে গিয়ে যুদ্ধশিবির পর্যবেক্ষণ করলেন এবং সীমান্ত শিবির’ শীর্ষক একটি বই লিখে পাকিস্তান লেখক সংঘ’ প্রবর্তিত ৬ই সেপ্টেম্বর’ পুরস্কার পেয়ে গেলেন। পাকিস্তানের জাতীয় বীরদের গুণ বা কার্যাবলীর ভিত্তিতে রচিত অথবা পাকিস্তানের ভৌগােলিক অখণ্ডতা ও সংহতি রক্ষায় সহায়তাকারী গ্রন্থই পুরস্কারের জন্যে বিবেচিত হতাে। [পূর্বোক্ত গ্রন্থ, পৃষ্ঠা ১০৩]
পাকিস্তান নামক একটি কৃত্রিম ও অবৈধ রাষ্ট্রের পক্ষে ভৌগােলিক অখণ্ডতা বা তথাকথিত সংহতি রক্ষা করে এতােদিন ধরে বেঁচে থাকা মােটেই সম্ভব হতাে না, যদি না এ-রকম নানান
২৯৩
কৃত্রিম পদ্ধতি প্রয়ােগ করে একে বাঁচিয়ে রাখা হতাে। পাকিস্তানকে বাঁচিয়ে রাখার জন্যে বারবার এমন একটি মনস্তাত্ত্বিক পদ্ধতি প্রয়ােগ করা হয়েছে, যে পদ্ধতিটির নাম—অভিভাবন বা সাজেশন (Suggestion) প্রদান। ডায়ালেকটিক বস্তুবাদভিত্তিক পাভলভীয় মনােবিজ্ঞান দেখিয়েছে যে, মানুষের মানস গঠনে অভিভাবন বা সাজেশন খুবই গুরুত্বপূর্ণ ও শক্তিশালী উপাদান। সম্মােহিত অবস্থায় তাে মানুষকে অভিভাবিত করা যায়ই, এমনকি জাগ্রত অবস্থাতেও মানুষ নানাভাবে অভিভাবিত হয়ে থাকে। জাগ্রত অবস্থাতেও মানুষ পুরাে জেগে থাকে না। অর্থাৎ তখনাে মস্তিষ্কের কিছু অংশ আধাঘুমন্ত অবস্থায় থাকে। এ-অবস্থাতেই বাইরে থেকে আসা নানা সাজেশন—মুখের কথা কিংবা লিখিত ভাষার আকারে মস্তিষ্কের ওই আধাঘুমন্ত অংশে জোরালাে উত্তেজনার সৃষ্টি করে ও মানুষ ওই কথাগুলাে বিশ্বাস করে বসে, তার ভেতর বিশেষ ধরনের সংস্কার ও ধারণার সৃষ্টি হয়ে যায়। এ-বিষয়টিকে ব্যাখ্যা করেই একজন পাভলভপন্থী মনােবিজ্ঞানী বলেন, এমন অনেক কিছু আমরা নির্বিচারে গ্রহণ করি, যার বাস্তব ভিত্তি নেই। গােটা মস্তিষ্কের যুক্তিতর্ক, সামগ্রিক বিচার পদ্ধতি আমরা সব সময় মেনে চলি না। আরাে সঠিকভাবে বলতে গেলে বলা উচিত, মস্তিষ্ক সব সময় সামগ্রিকভাবে কাজ করে না। খণ্ডিত আধা-ঘুমন্ত অংশ সমগ্র থেকে আলাদা হয়ে অভিভাবনের জোরে আমাদের কাজকর্ম, আচার-ব্যবহারকে অনেক সময়ই নিয়ন্ত্রিত করে। [ধীরেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায়, পাভলভ পরিচিতি’, দ্বিতীয় পর্ব (কোলকাতা ১৯৮৫), পৃষ্ঠা ৪৬] ।
ঠিক এ-ব্যাপারটিই পঁয়ষট্টির পাক-ভারত যুদ্ধকে কেন্দ্র করে এদেশের মানুষের মধ্যে ঘটেছিলাে। যুদ্ধ বা যুদ্ধ প্রস্তুতির সময় বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন যুগে এ-রকমই ঘটানাে হয়ে থাকে। ফ্যাসিবাদীরা কেমনভাবে নির্জলা মিথ্যা দিয়ে, কিংবা সামান্য পরিমাণ সত্যে প্রচুর মিথ্যার ভেজাল মিশিয়ে, মানুষকে অভিভাবিত করে বিকৃত ও অসুস্থ বানিয়ে ফেলে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ বাধার আগে এবং যুদ্ধ চলাকালেও, জার্মানিসহ বহু দেশে আমরা তা প্রত্যক্ষ করেছি। অনেক বিবেকবান বুদ্ধিজীবীও যে ফ্যাসিবাদের কাছে নিজেদের বিবেক বন্ধক রেখে মানবতাবিরােধী ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছেন, তাও তাে আমরা দেখেছি। তাই, পঁয়ষট্টির পাক-ভারত যুদ্ধে শাসকগােষ্ঠীর প্রচারের গােলকধাধায় সাধারণ মানুষের মতাে সৎ বুদ্ধিজীবীদেরও কেউ কেউ যদি পথ হারিয়ে থাকেন, কৃত্রিম স্বদেশপ্রেমের উগ্রতায় তাদের মস্তিষ্কের একাংশে যদি চরম উত্তেজনার সঞ্চার ঘটে থাকে, তবে তাকে অস্বাভাবিক বলা যায় না মােটেই। মানবমনের স্বাভাবিক নিয়মেই তা ঘটেছে।
কিন্তু মনােবিজ্ঞান এ-ও আবিষ্কার করেছে যে, অবাস্তব ও ভুল বিশ্বাসে সব মানুষ সব সময়ের জন্য অভিভাবিত হয়ে থাকে না; প্রকৃত বাস্তবের রূঢ় আঘাতে পূর্বেকার অভিভাবন ভেঙে যায়, মানুষ তার ধ্যানধারণা ও বিশ্বাসগুলাে নতুনভাবে যাচাই করে নেয়ার তাগিদ বােধ করে, মিথ্যা বিশ্বাসের ফাঁদ থেকে মুক্ত হয়ে প্রকৃত সত্যকে গ্রহণ করে।
পঁয়ষট্টির পাক-ভারত যুদ্ধের প্রায় অব্যবহিত পরেই, পূর্ব পাকিস্তানের মানুষের চিন্তাভাবনাতেও মনােবিজ্ঞানের এ নিয়মটিই কার্যকর হতে থাকে। অচিরেই সকলের ঘাের কেটে যায়। বানিয়ে তােলা আবেগের উত্তেজনার অবসান ঘটে যাওয়ার পর এখানকার মানুষ বাস্তব সত্যের দিকে খােলা চোখে তাকিয়ে দেখে। তাকিয়েই উপলব্ধি করে ;
আরে, এতক্ষণ তাে আসল সত্যের দিক থেকেই মুখ ফিরিয়ে ছিলাম। চিলে কান নিয়ে গেছে বলে আন লােকের কানকথা শুনে চিলের পেছনে পেছনে ধাওয়া করেছিলাম, অথচ
২৯৪
নিজের কানে হাত দিয়ে দেখিনি সেটি যথাস্থানে আছে কিনা! কাশ্মীরের মুসলমানদের আজাদ করার জন্যে আমরা ভারতের সঙ্গে জেহাদ করেছি, কিন্তু আমাদের নিজেদের আজাদী রক্ষা করা যাবে কিনা সেদিকে খেয়াল করিনি। এক হাজার মাইলের ব্যবধানে পশ্চিম পাকিস্তান ও পূর্ব পাকিস্তানের অবস্থিতি, আর এই দু’য়ের মাঝে দাড়িয় আছে শত্রু’ রাষ্ট্র ভারত। এই শত্রু যদি সত্যি সত্যিই সেদিন পূর্ব পাকিস্তান আক্রমণ করতাে তাহলে পশ্চিম পাকিস্তানের কোনাে সাধ্য ছিলাে না তাকে রক্ষা করার। এখানে থেকে যতােই জেহাদি জোশ দেখাই না কেন, আসলে তাে যুদ্ধের সময় আমরা বেঁচেছিলাম শত্রু রাষ্ট্রের করুণার ওপর। আমাদের পাকিস্তান রেডিও থেকে দম্ভ ভরে বলা হচ্ছিলাে যে, আমাদের বীরযােদ্ধারা বিমান আক্রমণ করে পশ্চিবঙ্গের কলাইকুণ্ডা বিমানবন্দর বিধ্বস্ত করে দিয়েছে। আমরা এ কথা শুনে জয়ের গর্বে স্ফীত হয়েছি। কিন্তু ভারত যদি তার বিমানবহর নিয়ে আমাদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়তাে, তাহলে কী হতাে? না, আমরা অবশ্যই বিনাযুদ্ধে শত্রুর কাছে আত্মসমর্পণ করতাম না। আমরা নিশ্চয়ই আমাদের সর্বশক্তি দিয়ে লড়ে যেতাম। তবে আমাদের সেই সর্বশক্তি’র সীমানা কতােটুকু? পশ্চিম পাকিস্তানি প্রভুরা কি আমাদের ঢাল-তলােয়ারহীন নিধিরাম সর্দার বানিয়ে রাখেনি? আমাদের প্রতিরক্ষার কোনাে শক্তিশালী ব্যবস্থা না রেখেই কি ওরা ভারতের সঙ্গে যুদ্ধে প্রবৃত্ত হয়নি? কেবলমাত্র ইসলাম আর পিআইএ বিমান ছাড়া পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে অন্য কোনাে যােগসূত্র নেই—এমন কথা পঁয়ষট্টির আগেও তীক্ষ্ণধী ব্যক্তিরা বলেছেন। পঁয়ষট্টির যুদ্ধে পিআইএ’র সেই সংযােগও বিচ্ছিন্ন ও অকার্যকর হয়ে গেলাে। বাকি রইলাে কেবল ইসলাম। সেই মহান ও পবিত্র ইসলামকে এবারও ওরা প্রতারণার কাজে ব্যবহার করলাে, স্কুল সাম্প্রদায়িক প্রচার দিয়েই ওরা আমাদের মনমেজাজকে আচ্ছন্ন করে রাখলাে। এ-আচ্ছন্নতাই আমাদের সর্বনাশ করেছে। নতুন জেগে-ওঠা এসব উপলব্ধিই পূর্ব পাকিস্তানের মানুষকে সম্পূর্ণ বিপরীত মেরুর দিকে ঠেলে দিলাে। পঁয়ষট্টির যুদ্ধ পূর্ব পাকিস্তানে যে-রকম পাকিস্তান-প্রেম ও পাকিস্তানি আবেগ জাগিয়ে তুলেছিলাে, সেরকম প্রেম ও আবেগ অন্য কোনাে ঘটনা থেকেই এর আগে কখনাে জাগেনি। আবার, প্রচণ্ড আঘাত হেনে সেই পাকিস্তান-প্রেম ও পাকিস্তানি আবেগকে যা বিধ্বস্ত ও ছিন্নভিন্ন করে দিতে পারে সে-রকম বড়াে ধরনের ঘটনাটিও এবারই প্রথম ঘটলাে। সেই প্রয়ােজন বােধ থেকেই, যুদ্ধকালীন জরুরি অবস্থা ও প্রতিরক্ষা আইনের তােপের মুখেও, সচেতন বুদ্ধিজীবীরা সাম্প্রদায়িক প্রচারণার প্রতিবাদ করলেন। যুদ্ধ ও সাম্প্রদায়িকতা’ শীর্ষক একটি প্রবন্ধ প্রকাশিত হলাে ‘সমকাল সাহিত্যপত্রে। প্রবন্ধটির লেখক আবু আহসান। অনেক পরে জানা গিয়েছিলাে যে, আবু আহসান আসলে প্রখ্যাত প্রবন্ধকার আবদুল হকের ছদ্মনাম। পাকিস্তানের একজন সরকারি কর্মচারি হয়েও আবদুল হক এপ্রবন্ধটিতে সাম্প্রদায়িক প্রচারণার ভয়াবহ পরিণাম সম্পর্কে শাসক চক্রকে সতর্ক করে দিয়েছিলেন। এরপর ওই ‘সমকাল’-এর পাতাতেই মুসলিম জাতীয়তাবাদ- পুনর্নিরীক্ষা’ নামে যে প্রবন্ধটি লিখলেন তাতে তাে তিনি পাকিস্তানের মূল ভাবাদর্শকেই তুলােধুনাে করে ছাড়লেন। রীতিমতাে রাষ্ট্রবিরােধী ছিলাে সেই প্রবন্ধটি। মুসলিম জাতীয়তাবাদের বিপরীতে বাঙালি জাতীয়তাবাদের আবেগই স্পষ্ট হয়ে উঠেছিলাে এতে।
এই পটভূমিতেই ছেষট্টির ফেব্রুয়ারিতে ঘােষিত হলাে শেখ মুজিবের ছয় দফা। পূর্ব পাকিস্তানের পূর্ণ স্বায়ত্তশাসনের দাবিরূপে এই ছয় দফা যে সঠিক সময়ে সঠিকভাবেই উত্থাপিত হয়েছিলাে তা শুধু বাঙালিদের মধ্যে এর বিপুল জনপ্রিয়তা থেকেই বােঝা যায়নি, বােঝ
২৯৫
গিয়েছিলাে এর বিরুদ্ধে পাকিস্তানের শাসক শ্রেণীর তুরিত প্রতিক্রিয়া দেখেই। প্রেসিডেন্ট আইউব খান শেখ মুজিব তথা বাঙালি জাতির প্রতি অস্ত্রের ভাষা প্রয়ােগের হুমকি দিয়ে ছয় দফার প্রতি এ অঞ্চলের মানুষের আবেগকে আরাে বাড়িয়ে দিলেন। এই ছয় দফাতে কি এমন নতুন কথা কিছু ছিলাে যা এর আগে কখনাে বলা হয়নি? না, চুয়ান্ন সালের যুক্তফ্রন্টের একুশ দফার উনিশ নম্বর দফাটিতেই ছয় দফার মূল কথাগুলাে ছিলাে। এরও আগে, তেপ্পান্ন সালের জানুয়ারিতে, পূর্ব পাকিস্তান গণতন্ত্রী দল’-এর আত্মপ্রকাশই ঘটেছিলাে পাকিস্তানে কনফেডারেশন প্রতিষ্ঠার জন্য দাবি জানিয়ে। এই দলের প্রথম অধিবেশনেই পাঞ্জাবের স্যার শওকত হায়াত খান স্পষ্ট ভাষায় বলেছিলেন, পশ্চিম পাকিস্তানের গদিতে আসীন থাকিয়া পূর্ব পাকিস্তানের বাসিন্দাদের অভাব-অভিযােগের সঠিক সন্ধান রাখা এবং তাহা নিরসনের উপযুক্ত উপায় নির্ধারণ করা সম্পূর্ণ অসম্ভব কল্পনা। পূর্ব পাকিস্তানের অধিবাসীর সুবিধা-অসুবিধার প্রতি দৃষ্টি রাখা এবং এই প্রদেশের বিবিধ উন্নতির উপায় নির্ধারণ একমাত্র পূর্ব পাকিস্তানবাসীর দ্বারাই সম্ভব!’ এই জন্যেই শওকত হায়াত খান সেদিন পূর্ব পাকিস্তানবাসীকে সম্মিলিতভাবে কনফেডারেশন প্রতিষ্ঠার দাবিতে আন্দোলন শুরু করার উপদেশ দিয়েছিলেন। ছাপ্পান্ন সালেই কম্যুনিস্ট পার্টির অধিবেশনে একজন কমরেড পূর্ববাংলার স্বাধীনতা আন্দোলন শুরু করার প্রস্তাব। উত্থাপন করে বসেছিলেন। সাতান্ন সালে কাগমারি সম্মেলনে মওলানা ভাসানী তাে পশ্চিম পাকিস্তানকে ‘আস্সালামু আলায়কুম’ জানিয়ে দেয়ার ইচ্ছাই ব্যক্ত করেছিলেন। আটান্ন সালেই যে কিছু দুঃসাহসী তরুণ পূর্ববাংলা লিবারেশন ফ্রন্ট গঠন করে বাঙালির স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলেন, সে-তথ্যও তাে আজ আর গােপন নেই। একষট্টি সালের সেপ্টেম্বরে বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ প্রফেসর রেহমান সােবহান পাকিস্তানের দুই অংশের জন্যে দুই অর্থনীতির সুপারিশ রেখেছিলেন। আর চৌষট্টি সালের জুলাই মাসেই যে আওয়ামী লীগের ছাত্রসংগঠন ছাত্রলীগের অভ্যন্তরে স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী পরিষদ গঠিত হয়ে গিয়েছিলাে, সে-কথাও আজ অনেকেই জানে।
তাই বলছিলাম, শেখ মুজিবের ছয় দফায় একেবারে নতুন কিছু ছিলাে না। পাকিস্তানের জন্মের অল্প কিছুদিন পর—অর্থাৎ আটচল্লিশ সাল থেকেই পূর্ব পাকিস্তানের মানুষের মনের গভীরে যে পাকিস্তান-বিরােধী চিন্তাচেতনা একটু একটু করে দল মেলে চলছিলাে, তারই একটা স্বাভাবিক পরিণতি এই ছয় দফায় রূপ ধারণ করেছিলাে।
তবে ছয় দফায় আনকোরা নতুন কিছু থাকুক আর নাই থাকুক, নতুন ছিলাে এর প্রভাবের ব্যাপকতা, গভীরতা ও প্রচণ্ডতা। ছয় দফার প্রভাব যে-রকম গভীর ও প্রচণ্ড হয়েছিলাে, এর আগে বাঙালির আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকার আদায়ের লক্ষে উত্থাপিত কোনাে বক্তব্য বা কর্মসূচিই সে রকম হয়নি—হতে পারেনি। কারণ এর আগে তাে এই শুভলগ্নটি আসেনি। উপযুক্ত লগ্ন ছাড়া কি কোনাে কাজে সফলতা আসে?
উপযুক্ত এই লগ্নটির জন্যেই শেখ মুজিবুর রহমান দীর্ঘদিন অপেক্ষায় ছিলেন, এতােদিনে তার সেই অপেক্ষার অবসান ঘটলাে। বাষট্টি সালেই কম্যুনিস্ট পার্টির সঙ্গে গােপন বৈঠকে শেখ মুজিব পূর্ববাংলার স্বাধীনতার জন্যে আন্দোলনের যে প্রস্তাব দিয়েছিলেন, এবং তখনাে সেই আন্দোলন শুরু করার সময় হয়নি বলে ক্যুনিস্ট নেতাদের যুক্তি মেনে নিয়ে তিনি যে ধৈর্য ধারণ করেছিলেন, সেই ধৈর্যের ফল ফললাে এতােদিনে—ঊনিশ শো ছেষট্টি সালে। আর সেই ফলটি তার হাতে তুলে দিলাে পাকিস্তানের অতি চালাক শাসকরাই। অতি চালাকি করে তারা
২৯৬
যদি পঁয়ষট্টি সালে ভারতের সঙ্গে যুদ্ধ না বাধিয়ে দিতাে, তাহলে এমনভাবে তাদের গলায় ছয় দফার দড়ি পড়তাে না। এবং ছয় দফার দড়িতেই ফাঁস আটকে এক পর্যায়ে এখানে। পাকিস্তানের মৃত্যু ঘটতাে না। ছয় দফায় স্বাধীনতার কথা না থাকলেও, পাকিস্তানি শাসকদের মনে হয়েছিলাে যে, ওতেই বাঙালির স্বাধীনতার বীজ লুকিয়ে আছে। সেই রক্তবীজকেই ওরা নিপীড়নের অস্ত্র দিয়ে উপড়ে ফেলতে চেয়েছিলাে। তার পরিণতি তাে সবারই জানা।

ছয় দফার শক্তি ও বাঙালিত্বের জাগরণ
শেখ মুজিব প্রস্তাবিত ছয় দফার নানামুখী প্রতিক্রিয়া হয়েছিলাে, বিভিন্ন মহল থেকে এর বিভিন্ন ধরনের ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করা হচ্ছিলাে। এ সব ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণে ব্যাখ্যাতাদের আপন আপন দৃষ্টিভঙ্গিরই প্রকাশ ঘটছিলাে।
পঁয়ষট্টির সেপ্টেম্বর মাসের ছয় তারিখে সূচিত সর্বাত্মক পাক-ভারত যুদ্ধের সমাপ্তি ঘটে সতেরাে তারিখে। সােভিয়েত প্রধানমন্ত্রী আলেক্সি কোসিগিনের উদ্যোগেই এ যুদ্ধবিরতি ঘটে। কোসিগিনের মধ্যস্থতাতেই ছেয়ট্টির জানুয়ারিতে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট আইউব খান ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী লাল বাহাদুর শাস্ত্রী তাসখন্দে এক বৈঠকে মিলিত হন। সে বৈঠকেই দু’দেশের মধ্যে একটি শান্তিচুক্তি স্বাক্ষরিত হয়।
যুদ্ধবিরতি আর শান্তিচুক্তির মধ্যদিয়ে পাকিস্তানের জেহাদি জোশ শেষ হয়ে যায়। শুধু পূর্ব পাকিস্তানে নয়, পশ্চিম পাকিস্তানেও। সারা পাকিস্তানেই আইউবের ভাবমূর্তি বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। রাজধানী রাওয়ালপিন্ডিতে ছাত্ররা আইউব-বিরােধী মিছিল করে। পুলিশ সে মিছিলে গুলি চালালে সমগ্র পশ্চিম পাকিস্তানই আইউব-বিরােধিতায় সােচ্চার হয়ে ওঠে। আর পূর্ব পাকিস্তানের মানুষের মগজে তাে পঁয়ষট্টির যুদ্ধের উত্তেজনার বদলে নেমে এসেছে নিস্তেজনা। দেখা দিয়েছে নতুন ধরনের বিচার-বিবেচনা। ঠিক সে-সময়েই পাকিস্তানের রাষ্ট্র কাঠামাে থেকে বেরিয়ে আসার ভাবনা না করলেও তাদের মধ্যে পূর্ব পাকিস্তানের স্বয়ংসম্পূর্ণতার আর্তি প্রবল হয়ে উঠেছে। অন্তত আইউব-বিরােধী চিন্তা তাে প্রকট রূপই ধারণ করেছে।
পাকিস্তানের উভয় অংশের অধিবাসীদের ভাবনাচিন্তার এ-পটভূমিতেই ন্যাশনাল ডেমােক্রেটিক ফ্রন্ট, কাউন্সিল মুসলিম লীগ, জামাতে ইসলামী, নেজামে ইসলাম ও আওয়ামী লীগ—এই পাঁচটি দল পশ্চিম পাকিস্তানের লাহােরে একটি সম্মেলনে মিলিত হয়। উদ্দেশ্য— একটি সরকার বিরােধী মাের্চা গড়ে তােলা।
এ-সম্মেলনেই পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের শেখ মুজিবুর রহমান সেই বহুখ্যাত ছয় দফা প্রস্তাব উত্থাপন করলেন। সম্মেলনে মিলিত পাঁচ দলের কোনাে দলই এ-রকম প্রস্তাবের জন্যে প্রস্তুত ছিলাে না, এমনকি আওয়ামী লীগও না। আওয়ামী লীগের পূর্ব পাকিস্তানি সদস্যরাও জানতেন না যে, শেখ মুজিব এমন একটি প্রস্তাব সম্মেলনে উত্থাপন করবেন। ফলে এ-প্রস্তাব সম্পূর্ণ উপেক্ষিত হয়, মুজিবকে এ-নিয়ে সম্মেলনে কোনাে আলােচনারই সুযােগ দেয়া হয় না। মুজিব, তাই, সংবাদ সম্মেলন করে পশ্চিম পাকিস্তানের মানুষকে ছয় দফা সম্পর্কে জানিয়ে দিয়ে ঢাকায় ফিরে এলেন। পশ্চিম পাকিস্তান আওয়ামী লীগ ছয় দফা মেনে নিতে পারেনি বলেই পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সঙ্গে তার পূর্ণ বিচ্ছেদ ঘটে গেলাে। বাস্তবে পশ্চিম পাকিস্তানে আওয়ামী লীগের বিলুপ্তিই ঘটলাে। আওয়ামী লীগ হয়ে উঠলাে সম্পূর্ণ রূপে
২৯৭
বাঙালিদের প্রতিষ্ঠান, আর শেখ মুজিব আওয়ামী লীগের মূল নেতা এবং অচিরেই তিনি আওয়ামী লীগের নেতা থেকে উন্নীত হয়ে গেলেন বাঙালির জাতীয় নেতায়। এক সময়ে ছাত্রদের দেয়া খেতাব বঙ্গবন্ধু’ তার নামের সঙ্গে অনপনেয় সূত্রে গেঁথে গেলাে।
আওয়ামী লীগের স্থপতি ছিলেন হােসেন শহীদ সােহরাওয়ার্দী। আমৃত্যু তিনিই ছিলেন আওয়ামী লীগের অবিসংবাদিত নেতা। শেখ মুজিবেরও তাঁর প্রতি ছিলাে গভীর শ্রদ্ধা ও নিঃশর্ত আনুগত্য। সেই সােহরাওয়ার্দী মারা গেলেন তেষট্টি সালের পাঁচ ডিসেম্বর। এরপর থেকেই শেখ মুজিবের হাতে এসে যায় আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব। আটান্ন সালে আইউবের সামরিক শাসনে সকল রাজনৈতিক দলের কার্যকলাপ নিষিদ্ধ হয়ে যাওয়ার পর শেখ মুজিবই প্রথম আওয়ামী লীগের আনুষ্ঠানিক পুনরুজ্জীবন ঘটান এবং সেটি ঘটিয়েছিলেন সােহরাওয়ার্দীর মৃত্যুর অল্পদিন পরেই।
সােহরাওয়ার্দী যদি সে-সময়েও বেঁচে থাকতেন তাহলে কী হতাে? ছেষট্টি সালে আওয়ামী লীগ কি ছয় দফা ঘােষণা করতে পারতাে? পূর্ব পাকিস্তান শতকরা আটানব্বই ভাগ স্বায়ত্তশাসন পেয়ে গেছে বলে যে-সােহরাওয়ার্দী সাতান্ন সালের জুন মাসেই ঘােষণা করেছিলেন, সেই সােহরাওয়ার্দী কি ছেষট্টি সালে অন্যরকম কথা বলতেন? সােহরাওয়ার্দীর মধ্যে কি বাঙালিত্বের আবেগ ছিলাে, যে-আবেগ দিয়ে তিনি পদ্মা-মেঘনা-যমুনার ঠিকানা খুঁজে খুঁজে বাংলার স্বায়ত্তশাসন থেকে স্বাধিকারের পথ বেয়ে স্বাধীনতার উপল উপকূলে পৌঁছে যেতে পারতেন?
জানি, এ-ধরনের হাইপােথেটিকাল প্রশ্নের কোনাে নিঃসংশয় উত্তর দেয়া যায় না। তবু এসব প্রশ্ন আমার মনে জাগে। সােহরাওয়ার্দীকে যে ‘গণতন্ত্রের মানসপুত্র’ আখ্যা দেয়া হয়, পাকিস্তানি স্বৈরতন্ত্রের প্রেক্ষাপটে সে আখ্যা হয়তাে একেবারে অযৌক্তিক নয়। বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক ধ্যান-ধারণা তাঁর মধ্যে যথেষ্ট পরিমাণেই ক্রিয়াশীল ছিলাে। কিন্তু তাঁর মন যে বাঁধা পড়ে ছিলাে ইঙ্গ-মার্কিন সাম্রাজ্যবাদীর চক্রের জালে, মূলত তিনি যে ছিলেন অভিজাত গােষ্ঠীর স্বার্থেরই ধারক-বাহক, গণবিপ্লবে নেতৃত্ব দেয়ার মন মেজাজ যে তার মােটেই ছিলাে না—তাঁর সারা জীবনের আচার-আচরণ তাে সে-রকমই সাক্ষ্য দেয়। তাই, আমার মনে হয়, সােহরাওয়ার্দী বেঁচে থাকলে মুজিবের নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠা অসম্ভব হতাে। সেক্ষেত্রে সােহরাওয়ার্দী যদি ছয় দফার মতাে কোনাে রাজনৈতিক কর্মসূচি হাজিরও করতেন, তবে একে তিনি বড়ােজোর রাজনৈতিক দরকষাকষির হাতিয়ার করে তুলতেন—বাঙালি গণমানুষের হাতে মুক্তি সংগ্রামের অস্ত্ররূপে ব্যবহৃত হতে দিতেন না। জীবনমঞ্চ থেকে সােহরাওয়ার্দী অপসৃত হয়েছিলেন বলেই এ-দেশের রাজনৈতিক মঞ্চে শেখ মুজিবের পক্ষে নায়কের ভূমিকায় অবতরণ করা অনেক সহজ হয়ে উঠেছিলাে। সােহরাওয়ার্দীর রাজনৈতিক শিষ্য হলেও মুজিব ছিলেন অন্য ধাতুতে গড়া, তার সামাজিক প্রেক্ষাপটও ছিলাে সােহরাওয়ার্দীর থেকে সম্পূর্ণ অন্যরকম। শেখ মুজিব যতােখানি রাজনীতিক ছিলেন, তারচেয়ে বেশি ছিলেন দেশপ্রেমিক। দেশপ্রেমই যে তাঁর নিজের দেশটিকে একটি স্বাধীন রাষ্ট্রে পরিণত করার সগ্রামে তাকে উদ্বুদ্ধ করেছিলাে, এবিষয়ে কোনােই সন্দেহ নেই।
মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ যে-আইউবকে পাকিস্তানের ক্ষমতার মঞ্চে বসিয়েছিলাে, সেই আইউবের সঙ্গেই ষাটের দশকে তার কিছুটা স্বার্থের সংঘাত লেগে গিয়েছিলাে। তাই, আইউবকে উৎখাত করে অন্য কোনাে বিশ্বস্ত অনুগামীকে গদিতে বসানাের প্রয়ােজন মার্কিনিরা
২৯৮
তখন অনুভব করেছিলাে। এ-কারণেই শেখ মুজিব যখন ছয় দফা উত্থাপন করলেন, তখন অনেকেই বলতে লাগলেন যে, এটি হচ্ছে মার্কিনি চাল। এমনকি, মার্কিন গােয়েন্দা সংস্থা সিআইএ-ই হচ্ছে এই ছয় দফার প্রণেতা—বামপন্থী বলে পরিচিত অনেকের মুখেই এমন কথাও শােনা যাচ্ছিলাে। এ-রকম কথা যারা বলছিলেন তাদের সঙ্গে আমি কিছুকালের জন্যে গলা মিলিয়েছিলাম। আমিও সেদিন ছয় দফাকে খুবই সন্দেহের চোখে দেখেছিলাম।
তবে, ছয় দফার সমালােচনা করলেও এর অন্তর্বস্তুকে বাতিল বা অস্বীকার করতে পারছিলাম না। শেখ মুজিব মার্কিনপন্থী হলেও হতে পারেন। কিন্তু তাঁর ছয় দফায় যে পূর্ববাংলার স্বায়ত্তশাসনের দাবি বলিষ্ঠভাবে ফুটে উঠেছে, তাই বা অস্বীকার করি কী করে? শেখ মুজিব প্রলেতারিয়েতের প্রতিনিধি নন, তার ছয় দফা বাঙালি উঠতি বুর্জোয়াদের স্বার্থের অনুকূল, ছয় দফায় বাঙালি কৃষক-শ্রমিক-মেহনতি মানুষের কোনাে দাবি অন্তর্ভুক্ত হয়নি—এসব কথা নিশ্চয়ই সত্য। কিন্তু তাই বলে ছয় দফাকে গণবিরােধী বলি কী করে? ছয় দফাকে প্রতিক্রিয়াশীল বললে কি প্রতিক্রিয়াশীল আইউব তথা সকল পাকিস্তানবাদীদেরই সমর্থন করা হয় না?
এ-সব প্রশ্ন ও সন্দেহ নিয়ে আমি ও নেত্রকোনার শ্রী হরিশংকর চৌধুরী আলাপ-আলােচনা করতাম। কিন্তু দু’জনের কেউই নিঃসংশয় সিদ্ধান্তে পৌছতে পারছিলাম না।
হরিশংকর চৌধুরী সে সময় নেত্রকোনা থেকে ময়মনসিংহে চলে এসেছেন, দত্ত হাইস্কুল ছেড়ে ময়মনসিংহ শহরে রাধাসুন্দরী গার্লস হাইস্কুলে মাস্টারি নিয়েছেন। তাঁর সঙ্গেই তখন দিনরাত চুটিয়ে আড্ডা দিই এবং নিয়মিত পিকিং রিভিউ পড়ি। শুধু ‘পিকিং রিভিউ নয়, চীন ও রাশিয়া থেকে প্রকাশিত মার্কসবাদী বইপুস্তক ও পত্রপত্রিকায় তখন আমরা আকণ্ঠ নিমজ্জিত। আইউবের সামরিক শাসন জারির পর থেকে এ-দেশে প্রায় সবরকম ক্যুনিস্ট সাহিত্যই নিষিদ্ধ হয়ে গিয়েছিলাে। নীহার সরকারের ‘ছােটদের রাজনীতি কিংবা অনিল মুখার্জির ‘সাম্যবাদের ভূমিকার মতাে গণবােধ্য মার্কসবাদী বইগুলােও তখন লুকিয়ে চুরিয়ে পড়তে হতাে। অথচ, কী আশ্চর্য, চৌষট্টি-পঁয়ষট্টি সালের আইউবি স্বৈরশাসনের চণ্ডতার মধ্যেই চীন-রাশিয়া থেকে আসা মার্কসবাদী বইপত্রে এখানকার বাজার সয়লাব হয়ে গেলাে। আমরা তখন মার্কসীয় ক্লাসিকসহ নানা ধরনের প্রগতিশীল সাহিত্য ও সমাজবিজ্ঞান পাঠের অবাধ সুযােগ পেয়ে গেলাম। এ-সবের ওপর আর কোনাে নিষেধাজ্ঞা কার্যকর থাকলাে না। বুর্জোয়া শাসন নীতির সব ক্ষেত্রেই বােধহয় এ-রকম বজ্র আঁটুনি ফস্কা গেরাে।।
এ-সময়েই সােভিয়েত ইউনিয়ন ও চীনের কম্যুনিস্ট পার্টির মতাদর্শগত বিরােধ তুঙ্গে উঠে গিয়েছিলাে। সে বিরােধের তাপ এসে লাগলাে পূর্ব পাকিস্তানের আন্ডারগ্রাউন্ড কমুনিস্ট পার্টির গায়েও। বাষট্টি সালের শেষ দিকেই পূর্ব পাকিস্তানের কম্যুনিস্ট পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির দু’জন সদস্য—মােহাম্মদ তােয়াহা ও সুখেন্দু দস্তিদার—চীনের কম্যুনিস্ট পার্টির অনুরাগী ও সমর্থক হয়ে উঠেছিলেন। এদের মতামত এখানকার পার্টির সদস্য ও সমর্থকদের মধ্যে প্রচারের ব্যবস্থা কেন্দ্রীয় কমিটিই করে দিয়েছিলাে। আমরা পার্টির গােপন মুখপত্র ‘শিখার পাতায় এদের বক্তব্য পাঠ করেছিলাম। পাঠ করে হরিশংকর বাবু ও আমি দু’জনই যথেষ্ট অনুপ্রাণিত হয়েছিলাম। আমাদের সমর্থনের পাল্লাটা চীনের দিকেই বেশি পরিমাণে ঝুঁকে পড়ার অন্যতম কারণ ছিলাে নিয়মিত ‘পিকিং রিভিউ পাঠ। সােভিয়েতের কমুনিস্ট পার্টি বিপ্লবী উদ্যম হারিয়ে সংশােধনবাদী হয়ে পড়েছিলাে বলেই আমাদের মনে হয়েছিলাে।
২৯৯
কিন্তু কিছুদিনের মধ্যেই আমাদের ভাবনায় পরিবর্তন দেখা দেয়। বিশেষ করে মওলানা ভাসানী যখন আমাদের দেশের পিকিংপন্থীদের নিয়ে আইউব খানকে নানা ইস্যুতে সমর্থন জোগাতে লাগলেন, তখন আমরা অন্যরকমভাবে ভাবতে বাধ্য হলাম। তেষট্টি সালের সেপ্টেম্বর-অক্টোবরে আইউব খানের প্রতিনিধিরূপে চীন সফর করে আসার পর থেকেই মওলানা পিকিংপন্থী হয়ে ওঠেন এবং আইউবকে ব্ৰিত না করার (‘Don’t disturb Ayub’) নীতি অনুসরণ করতে শুরু করেন। মওলানার পিকিংপন্থী অনুসারীদের অনেকে আইউবকে ‘প্রগতিশীল’ বলেও প্রচার করতে থাকে। এই পিকিংপন্থীরা পঁয়ষট্টি সালের এপ্রিল মাসেই এদেশের ঐতিহ্যবাহী প্রগতিশীল ছাত্র সংগঠন ছাত্র ইউনিয়নকে দ্বিধাবিভক্ত করে ফেলেন। পঁয়ষট্টি সালের পাক-ভারত যুদ্ধের সময় এরা আইউবকে সমর্থন জানান এবং ভারত-বিরােধী জজবায় মেতে ওঠেন। চীনা নেতৃত্ব ভারত-বিরােধী, তাই এরাও ভারত-বিরােধী। ভারত বিরােধিতার সুবাদে চীন যে চরম প্রতিক্রিয়াশীল পাকিস্তান সরকারকে সমর্থন জানিয়ে মার্কসলেনিনের মৌল নীতি থেকেই বিচ্যুত হয়ে গেছে—এ-কথা আমাদর দেশের চীনপন্থীরা একবারেও ভেবে দেখলেন না। পাক-ভারত যুদ্ধের আগে যেমন এরা ছাত্র ইউনিয়নকে দ্বিধাবিভক্ত করেছিলেন, তেমনি এদের প্ররােচনাতেই যুদ্ধের পরে—ছেষট্টির জুলাই-আগস্টে ন্যাপও দু’ভাগ হয়ে যায়। সবশেষে ছেষট্টির ডিসেম্বর মাসে পূর্ব পাকিস্তানের মূল কম্যুনিস্ট পার্টিটিও দ্বিধাবিভক্ত হয়ে পড়ে।
ছেষট্টির ফেব্রুয়ারিতে যখন শেখ মুজিবের ছয় দফা ঘােষিত হলাে, তখন আমাদের মধ্যে বেশ দ্বিধাদ্বন্দ্বের সঞ্চার হয়েছিলাে। বিশেষ করে পিকিংপন্থীদের ছয় দফা বিরােধিতার বাড়াবাড়ি আমাদের দ্বিধাদ্বন্দ্বকে আরাে বাড়িয়ে দিয়েছিলাে। তখনাে অবিশ্যি পূর্ব পাকিস্তানের কমুনিস্ট পার্টিতে আনুষ্ঠানিক বিভক্তি ঘটে যায়নি।
হরিশংকর বাবুই সে-সময়ে আন্ডারগ্রাউন্ড ক্যুনিস্ট পার্টির সঙ্গে যােগাযােগ রক্ষা করে পার্টির মতামত ও নির্দেশ আমাকে অবহিত করতেন। ছয় দফা সম্পর্কে পার্টির অভিমত পেতে বেশ বিলম্ব হচ্ছিলাে বলে আমাদের টেনশন খুব বেড়ে যাচ্ছিলাে। অনেক প্রতীক্ষার পর সে অভিমত জানতে পেলাম।
ছয় দফা সম্পর্কে সেদিনকার কমুনিস্ট পার্টির অভিমতটি অনেক পরে, স্বাধীন বাংলাদেশে, পার্টি নেতা খােকা রায় তার স্মৃতিকথায় যেভাবে বিবৃত করেছেন সেটিই আমি এখানে হুবহু তুলে দিচ্ছি।
“পূর্ব পাকিস্তানের কম্যুনিস্ট পার্টি আওয়ামী লীগের ৬ দফা আন্দোলনের প্রতি পূর্ণ সমর্থন জানিয়েছিল।
“তবে, আওয়ামী লীগের পক্ষ হতে ৬ দফা কর্মসূচীকে যেভাবে ‘বাঙালী জাতির মুক্তিসনদ’ বলে অভিহিত করা হচ্ছিল, ক্যুনিস্ট পার্টি তার সাথে একমত হতে পারেনি। কমুনিস্ট পার্টির অভিমত ছিল যে, ৬ দফা কর্মসূচীর মধ্যদিয়ে বাঙালী জাতির পূর্ণ স্বায়ত্তশাসনের অধিকারের দাবি ধ্বনিত হয়েছিল। সেজন্য পার্টি ঐ কর্মসূচীর প্রত্যেকটি দফাকে সমর্থন করেছিল। কিন্তু সাম্রাজ্যবাদীদের নয়া ঔপনিবেশিক শােষণের অবসান, ভূমি ব্যবস্থা ও কৃষকদের উপর থেকে সামন্তবাদীদের শােষণের উচ্ছেদ এবং শ্রমিক ও অন্যান্য শ্রমজীবী জনগণের উপর থেকে বৃহৎ একচেটিয়া পুঁজিপতিদের শােষণের বিলােপ ছাড়া আপামর বাঙালী জনগণের মুক্তি সম্ভব ছিল না। অথচ ৬ দফা কর্মসূচীতে ঐ সব শােষণ উচ্ছেদের দাবি ছিল না।
৩০০
“তাই কমুনিস্ট পার্টি ৬ দফার আন্দোলনকে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের পূর্ণ স্বায়ত্তশাসনের আন্দোলন হিসাবে দ্বিধাহীনভাবে সমর্থন করেও ঐ কর্মসূচীকে বাঙালী জাতির মুক্তির সনদ’ বলে মনে করে নাই।
“৬ দফা কর্মসূচীতে ১, সাম্রাজ্যবাদী সামরিক জোটগুলির সঙ্গে সম্পর্কচ্ছেদ, ২. আমূল ভূমিসংস্কার ও কৃষকের হাতে জমি, ৩. বৃহৎ শিল্পগুলির জাতীয়করণ ও ৪. শ্রমিক কর্মচারীদের জীবন ধারণের উপযােগী মজুরী ও মাহিনার গ্যারান্টি—এই চারটি দাবি অন্তর্ভুক্ত করে ঐ কর্মসূচীকে প্রকৃত অর্থে বাঙালী জাতির মুক্তির সনদে পরিণত করার জন্য কম্যুনিস্ট পার্টি আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দের নিকট আবেদনও জানিয়েছিল।
আওয়ামী লীগের ৬ দফা কর্মসূচী সম্পর্কে পার্টির ঐ নীতি ও বক্তব্য দৈনিক সংবাদে প্রকাশের ব্যবস্থা হয়েছিল। পার্টির ঐ নীতি পূর্ব পাকিস্তানের গণতান্ত্রিক মহলে সমাদৃত হয়েছিল।”
[খােকা রায় : সংগ্রামের তিন দশক’, পৃষ্ঠা ১৯৬]।
ক্যুনিস্ট পার্টির এই বিশ্লেষণ ও অভিমত যে সঠিক ছিলাে তা পরবর্তী ঘটনাধারায় প্রমাণিত হয়েছে। ছয় দফার সংগ্রামই বাঙালিকে আস্তে আস্তে জঙ্গি করে তুলেছিলাে। ছয় দফার দাবিকে স্তব্ধ করে দেয়ার লক্ষেই পাকিস্তানের প্রতিক্রিয়াশীল শাসকরা শেখ মুজিবকে ‘আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় জড়িয়েছিলাে। সে মামলাই পাকিস্তানের প্রতি বাঙালির পবিত্র ঘৃণা উদ্রেকে প্রচুর পরিমাণে সহায়তা দেয়। ক্যুনিস্ট পার্টি ছয় দফার সঙ্গে অন্য যে চারটি দাবি অন্তর্ভুক্ত করার প্রস্তাব দিয়েছিলাে, সেগুলােই ঊনসত্তরে ছাত্রদের এগারাে দফায় সংযােজিত হয়। এগারাে দফা বাঙালির জাতীয় দাবিতে পরিণত হয়েই একদিন স্বাধীনতার এক দফায় রূপ নেয়। পাকিস্তানের মৃত্যু ও বাংলাদেশের জন্ম অপ্রতিরােধ্য হয়ে ওঠে।

ষাটের দশকে ভাবাদর্শের সংগ্রাম
ছেষট্টির মার্চ কি এপ্রিলে আনন্দমােহন কলেজের অধ্যক্ষ হয়ে এলেন কবীর চৌধুরী। ঊনসত্তরের মার্চ পর্যন্ত তিনি ময়মনসিংহে ছিলেন। এই ক’বছরে কবীর চৌধুরীর অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ সান্নিধ্য লাভের সুযােগ আমার হয়েছিলাে। তাঁর স্নেহসান্নিধ্য আমার চৈতন্যকে নানাভাবে সমৃদ্ধ করেছে। আনুষ্ঠানিক অর্থে তিনি আমার শিক্ষক ছিলেন না, কিন্তু প্রকৃত অর্থে তার ছাত্র হতে পেরে আমি ধন্য হয়েছিলাম।
তেরাে শো তেয়াত্তর বঙ্গাব্দের নববর্ষে (অর্থাৎ উনিশ শাে ছেষট্টি খ্রিস্টাব্দের এপ্রিলে) ময়মনসিংহ শহরের পণ্ডিতপাড়া ক্লাবে কবীর চৌধুরী একটি চমৎকার বক্তৃতা দিয়েছিলেন। বাংলা নববর্ষ সম্পর্কে বলতে গিয়ে তিনি বাঙালি জাতি ও সংস্কৃতির কথা বলেছিলেন। নববর্ষ উৎসব পালনের মধ্যদিয়ে যে আমরা আমাদের বাঙালি সত্তা সম্পর্কে সচেতন হতে পারি, এবং এখানেই যে এই উৎসবটি পালনের গুরুত্ব, কবীর চৌধুরী অত্যন্ত প্রাঞ্জল ভাষায় এ-কথাগুলাে উল্লেখ করেছিলেন।
কথাগুলাে ছিলাে আমারও মনের কথা। কবীর চৌধুরীর মতাে একজন বিদগ্ধ মানুষের মুখে এ কথাগুলােই শুনে আমার নিজের মনের ভাবনাগুলােকে আরাে ভালাে করে গুছিয়ে নিতে উৎসাহিত হলাম। পয়লা বৈশাখের অনুষ্ঠান পণ্ডিতপাড়া ক্লাবে হয়েছিলাে সকাল বেলায়, বিকেল
৩০১
বেলায় অনুষ্ঠান ছিলাে মুকুল ফৌজে। ময়মনসিংহ মুকুল ফৌজের সংগঠক ও অধিনায়ক আমির আহমদ চৌধুরী আমাকে সে-অনুষ্ঠানে বাংলা নববর্ষ সম্পর্কে আলােচনা করার জন্যে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। আমি সােৎসাহে সে-আমন্ত্রণ গ্রহণ করেছিলাম।
মুকুল ফৌজের বর্ষবরণ অনুষ্ঠানে সভাপতি ছিলেন জেলার একজন উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মকর্তা। (জেলা প্রশাসক নন)। তিনি ছিলেন কানে খাটো। পদাধিকার বলেই তিনি শহরের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে সভাপতি বা প্রধান অতিথির আসনটি দখল করে বসতেন। এবং অনেক দীর্ঘ ভাষণ দিতেন। তাঁর ভাষণে একটি কথাই বারবার ঘুরেফিরে আসতাে। কথাটি হচ্ছে : ‘পাকিস্তান না হলে আমি সার্কেল অফিসারের চেয়ে বড়াে কিছু হতে পারতাম না, পাকিস্তানের জন্ম হয়েছিলাে বলেই আমি জেলা পর্যায়ের এমন একজন কর্মকর্তা হতে পেরেছি।’
এই লােকটিকেই বাংলা নববর্ষ অনুষ্ঠানেও সভাপতির আসনে বসে থাকতে দেখে আমি কিছুটা অস্বস্তি বােধ করছিলাম। তবু সকালবেলায় কবীর চৌধুরীর আলােচনা শুনে আমার ভেতরে যে প্রবল উৎসাহের সঞ্চার হয়েছিলাে সেই উৎসাহের বশেই আমি অনেক কথা বলে ফেললাম। বললাম : আমাদের অনেক উৎসব আছে। ঈদ, দুর্গাপূজা, বড়দিন কিংবা বুদ্ধপূর্ণিমাও আমাদের দেশের মানুষের উৎসব। কিন্তু এগুলাে সবই বিশেষ বিশেষ সম্প্রদায়ের ধর্মীয় উৎসব। এ-সবের মধ্যেও সর্বজনীনতার উপাদান কিছু কিছু আছে নিশ্চয়ই, ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতার গণ্ডি ভেঙে এ-সব উৎসবে, ভিন্ন সম্প্রদায়ের মানুষরাও শরিকানা লাভের কিছু সুযােগ পায় অবশ্যই। তবু, স্বীকার করতেই হবে যে, এ-সব উৎসব সম্প্রদায়-নির্বিশেষে সকল বাঙালিকে এক সঙ্গে মেলাতে পারে না। কিন্তু পয়লা বৈশাখের বর্ষবরণে বাংলাদেশের সকল মানুষই একসঙ্গে অংশগ্রহণ করে। এই উৎসবই আসলে বাঙালির জাতীয় উৎসব। ধর্মীয় সম্প্রদায়ের সীমা অতিক্রম করে আবহমান কালের বাঙালি এই ধর্মনিরপেক্ষ উৎসবটি পালন করে এসেছে। বর্তমানে যখন নতুন করে সাম্প্রদায়িক ভাবনার বিস্তার ঘটানাে হচ্ছে তখন তাে এ-উৎসবের গুরুত্ব অপরিসীম। বাংলাদেশের মানুষ সেই গুরুত্বটি উপলব্ধি করতে পেরেছে বলেই এবার অত্যন্ত উদ্দীপনার সঙ্গে নববর্ষ উৎসব পালিত হচ্ছে। এটি অবশ্যই শুভ লক্ষণ।
আমার বক্তব্য শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই সভাপতি একেবারে ফেটে পড়লেন। অনুষ্ঠানটির পুরাে কর্মসূচি সমাপ্ত করতে না দিয়েই তিনি সভাপতির ভাষণ শুরু করে দিলেন। আগেই বলেছি, এই ভদ্রলােক ছিলেন কানে খাটো। আমার সব কথা তার কানে ঢুকেছিলাে কিনা জানি না। তবে বাংলাদেশ’ ‘বাঙালি’ ও ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ এই কয়েকটি শব্দ যে তার কানের ভিতর দিয়ে মরমেই প্রবেশ করেনি শুধু একেবারে যে কলিজা ফুটো করে দিয়েছিলাে, তার ক্রুদ্ধ বাকবিন্যাসেই তা বােঝা গিয়েছিলাে। তিনি বলতে লাগলেন :
‘আমি বুঝতে পারছি না, আমি কি এখন পূর্ব পাকিস্তানে আছি না ভারতের পশ্চিমবঙ্গের কোনাে জায়গায় আছি? বাংলাদেশ বলে কোনাে দেশ আছে বলে তাে আমার জানা ছিলাে না। আমি তাে জানতাম যে, আমরা পূর্ব পাকিস্তানের বাসিন্দা এবং আমরা সবাই পাকিস্তানি। কিন্তু আজ পূর্ব পাকিস্তানের ময়মনসিংহ শহরে বসে আমাকে শুনতে হচ্ছে বাংলাদেশের কথা। শুনতে হচ্ছে যে, আমরা বাঙালি। এ কিসের আলামত?…আসলে বাংলাদেশ আর বাঙালির নাম করে আমাদের মধ্যে অতি সুকৌশলে ভারতীয় কালচারের অনুপ্রবেশ ঘটানাে হচ্ছে, এমনকি মুকুল ফৌজের মতাে সংগঠনের শিশু-কিশােরদের চিন্তাকেও বিকৃত করে ফেলার চক্রান্ত চলছে। এ-ব্যাপারে এখনই সতর্ক না হলে আমাদের সর্বনাশ হয়ে যাবে, বিদেশি
৩০২
অনুপ্রবেশকারী ও চক্রান্তকারীরা আমাদের জাতীয় অস্তিত্বকেই বিপন্ন করে তুলবে।…ব্রিটিশ আমলে তাে কখনাে এ-রকম নববর্ষের অনুষ্ঠান দেখিনি। তখন হিন্দু মহাজনরা পয়লা বৈশাখে হালখাতা করতাে। আর আজ করা হচ্ছে বর্ষবরণ। শুধু বর্ষবরণ নয়। বর্ষামঙ্গল, শারদোৎসব, বসন্তবরণ। কতাে কী? আপনারা কি অস্বীকার করতে পারেন যে, এ-সব অনুষ্ঠান আসলে প্রকৃতি-পূজা মাত্র? ইসলাম সব সময়ই প্রকৃতিপূজার বিরােধী। অথচ আজকে এ-দেশের মুসলমানদের প্রকৃতি পূজারী বানিয়ে ফেলা হচ্ছে।…আপনারা এই সব বিদেশি চক্রান্তকারীদের চিনে রাখুন। আপনারা…’
উপস্থিত ক্ষেত্রে আমাকেই যে সেই কথিত চক্রান্তকারীদের একজন বলে শনাক্ত করা হলাে, এ-কথা সবাই বুঝে গেলেন। চক্রান্তকারী ধরা পড়ায় সেই অনুষ্ঠানের শ্রোতা-দর্শকদের কেউ কেউ অবশ্যই খুশি হয়েছিলেন। তবে সকলেই খুশি হওয়ার দলে ছিলেন না। অনেকেই আমার সম্ভাব্য বিপদের কথা ভেবে শঙ্কিত হলেন। শঙ্কিত আমি নিজেও হলাম। একজন ক্ষমতাবান সরকারি কর্মকর্তা যেখানে আমার বক্তব্যের মধ্যে পাকিস্তান-বিরােধী চক্রান্ত। আবিষ্কার করে ফেলেছেন, সেখানে যে-কোনাে সময় যে আমার ওপর ‘পাকিস্তান প্রতিরক্ষা আইন’-এর খড়গ নেমে আসতে পারে—আমার শুভানুধ্যায়ীদের এমন আশঙ্কাকে অমূলক বলে উড়িয়ে দিই কী করে?
যদিও সত্যিসত্যিই আইনের খড়গাঘাত আমার ঘাড়ে পড়েনি, তবু সে-খড়গটিকে প্রতিনিয়ত আমার সামনে আন্দোলিত করে করে এমন একটা ভীতির ভাব সৃষ্টি করে রাখা হলাে যে, আসল খড়গাঘাতটিই আমার জন্যে এরচেয়ে কম অস্বস্তিকর হতাে।
এ-রকম ছিলাে ঊনসত্তরের পঁচিশ মার্চ পর্যন্ত। প্রবল গণআন্দোলনের ধাক্কায় আইউবের পতন ও ইয়াহিয়ার উত্থানের পর অনেক পরিমাণে স্বস্তি পাওয়া গিয়েছিলাে। আসলে চব্বিশ বছরের পাকিস্তানি জামানার ঊনসত্তরের পঁচিশ মার্চ থেকে একাত্তরের পঁচিশ মার্চ—এই দু’বছরই এ-দেশের মানুষ সবচেয়ে বেশি নাগরিক স্বাধীনতা ভােগ করেছে। আর এই দু’বছরই রাজত্ব করেছে লম্পট, মদ্যপ ও দুনিয়ার জঘন্যতম নরঘাতকদের একজন, যার নাম ইয়াহিয়া খান। বাঙালির এ-রকম দুশমন তাে আর দু’টি ছিলাে না। সারা দুনিয়াতেই বা এ-রকম গণদুশমন ক’টি আছে? অথচ, আমি কিনা সেই ইয়াহিয়ার রাজত্বকালকেই প্রশংসা করে। ফেললাম! এতে একান্ত সঙ্গতভাবেই, যে-কোনাে বাঙালি আমাকে ধিক্কার জানাতে পারেন।
আসলে গণদুশমনদের হাত দিয়েও কখনাে কখনাে যে কিছু কিছু গণমুখী কাজ হয়ে যায়, এটিই বােধহয় সমাজ বিকাশের দ্বান্দ্বিক নিয়ম তথা ইতিহাস-বিধাতার পরিহাস। সেই পরিহাসের ফলেই ইয়াহিয়া তার রাজত্বের প্রথম দু’বছরে এমন কিছু রাজনৈতিক পদক্ষেপ গ্রহণ করে বসে যেগুলাে পরিণামে বাঙালিদের মুক্তিসংগ্রামে অনেক পরিমাণে অবস্থানগত সুবিধা। করে দেয়। যেমন-—এই লােকটিই পশ্চিম পাকিস্তানের এক ইউনিট ভেঙে দিয়ে চারটি প্রদেশ পুনর্গঠন করে, আইউবি মৌলিক গণতন্ত্রের পরােক্ষ নির্বাচনের বদলে সর্বজনীন ভােটাধিকারের ভিত্তিতে জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদ নির্বাচনের ব্যবস্থা করে এবং পশ্চিম ও পূর্ব পাকিস্তানের সংখ্যাসাম্যমূলক জন প্রতিনিধিত্বের জায়গায় জনসংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্বের বিধান প্রবর্তন করে। পাকিস্তানের দু’অংশের সংখ্যাসাম্য বাতিল করে দেয়ার ফলে পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের ৩১৩টি আসনের মধ্যে পূর্ব পাকিস্তানের ভাগে পড়ে ১৬৯টি ও পশ্চিম পাকিস্তানের ১৪৪টি। আর এতেই সত্তরের নির্বাচনে বাঙালি জাতীয়তাবাদ প্রচণ্ড শক্তি নিয়ে বেরিয়ে আসতে
৩০৩
পারে। একাত্তরের পঁচিশে মার্চ থেকে ইয়াহিয়া যতাে চণ্ডরূপই দেখাতে থাক, স্বাধিকার-চেতন বাঙালিকে দমন করার ক্ষমতা সে হারিয়ে ফেলে এবং স্মরণীয় যে, এ-অবস্থাটি সৃষ্টির পেছনে ইয়াহিয়া আর তার সাঙাৎদের নিজেদেরই রয়েছে যথেষ্ট অবদান। অর্থাৎ ছাপ্পান্ন সাল থেকে বলবৎ সংখ্যাসাম্য তুলে দিয়ে ওরা, নিজেদের অজ্ঞাতসারেই, বাঙালির হাতে বাড়তি শক্তির জোগান দিয়ে ফেলে।
তাছাড়া, শােনা যায়, ইয়াহিয়া তার সেনাবাহিনীর বিশেষ অনুসন্ধানী বিভাগটির প্রতিবেদন থেকে নিশ্চিত হয়েছিলাে যে, পশ্চিম পাকিস্তানে যেমন আওয়ামী লীগ একটি আসনও পাবে না, তেমনি পূর্ব পাকিস্তানেও এই বাঙালি জাতীয়তাবাদী দলটি সবগুলাে আসন দখল করতে পারবে না। এখানেও অন্তত পঁচিশ/তিরিশ ভাগ আসন পাকিস্তানবাদী দক্ষিণপন্থী দলগুলাে পেয়ে যাবে। পরিণামে জাতীয় পরিষদের সংখ্যাগরিষ্ঠতা বাঙালি জাতীয়তাবাদ-বিরােধীদের হাতেই থাকবে। এই বিশ্বাস থেকেই ইয়াহিয়া আত্মপ্রসন্ন থেকেছে এবং মানুষের মত প্রকাশের স্বাধীনতার ওপর খুব একটা নিয়ন্ত্রণ আরােপ করেনি। তাই, উনসত্তরের মাঝামাঝি থেকে একাত্তরের পঁচিশে মার্চ পর্যন্ত আমরা যেরকম স্বচ্ছন্দে ও বিনা বাধায় সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড চালিয়েছি, নানা বিষয়ে সেমিনার সিম্পােজিয়াম করে অবাধে প্রগতিশীল মত ব্যক্ত করেছি, সে রকমটি সারা পাকিস্তান আমলে আর কখনাে করতে পারিনি। সত্তরের একুশে ফেব্রুয়ারিতে আলােকময় নাহার নেতৃত্বে গানের দল নিয়ে আমরা সারা ময়মনসিংহ শহর পরিক্রমা করেছি, বিপুল সংখ্যক মানুষ আমাদের মিছিলে সামিল হয়েছে, শহীদ দিবসের অনেকগুলাে আলােচনা সভায় আমরা অনেক কড়া কড়া কথা বলেছি। সত্তর সালে বিপুল উদ্দীপনায় আমরা লেনিন জন্মশতবার্ষিকী উদযাপন করেছি, কোনাে কর্তৃপক্ষীয় বাধার সম্মুখীন হইনি। এর আগে পাকিস্তানে লেনিনের নাম উচ্চারণই প্রায় নিষিদ্ধ ছিলাে, তাঁকে নিয়ে উৎসবের সমারােহ করা কিংবা প্রকাশ্যে লেনিনবাদের ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করা তাে ছিলাে সম্পূর্ণ অসম্ভব। একারণেই বলছিলাম যে, চব্বিশ বছরের পাকিস্তানি শাসনে একমাত্র ইয়াহিয়ার অগণতান্ত্রিক শাসনের প্রথম দু’বছরই এ-দেশের মানুষ সবচেয়ে বেশি গণতান্ত্রিক অধিকার ভােগ করেছে। তবু, এর আগেও, চৌষট্টি সালে ময়মনসিংহ শহরের নাসিরাবাদ কলেজের শিক্ষক হওয়ার পর থেকেই প্রগতিশীল কর্মকাণ্ডের সঙ্গে নিজেকে যুক্ত রেখেছি— যদিও কর্তৃপক্ষীয় ধমক খেতে হয়েছে প্রতিনিয়তই। তবে, সুখের কথা, সেই দুর্বিনীতকালেও আমরা এমন কিছু সহৃদয় ও সাহসী মানুষকে পেয়েছি যারা প্রতিক্রিয়াশীল পাকিস্তান সরকারের কর্মচারি হয়েও প্রগতিশীল সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে প্রত্যক্ষ ও পরােক্ষ সহায়তা জুগিয়েছেন।
চৌষট্টিতেই আনন্দমােহন কলেজ ও নাসিরাবাদ কলেজের কয়েকজন ছাত্র মিলে সুন্দরম’ নামে একটি সাংস্কৃতিক সংগঠন গড়ে তুলেছিলাে। প্রগতিচেতন এই ছাত্রদের মধ্যে ছিলাে আবদুর রফিক, বিমল কান্তি দে, মতীন্দ্র সরকার, নূরুল হক, আমীন আহমদ চৌধুরী, সরদার নূরুল আনােয়ার ও তারিক সালাউদ্দীন। বছরখানেক পরেই অবিশ্যি সংগঠনটি সক্রিয়তা হারিয়ে ফেলে। ময়মনসিংহের কলেজের পাঠ চুকিয়ে ওরা বিভিন্ন দিকে ছড়িয়ে পড়ে। পরবর্তীকালে ওই সাতজনের প্রথম চারজনই হয়েছে অধ্যাপক। আমীন আহমদ চৌধুরী পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে যােগ দিয়ে একাত্তরে মুক্তিযােদ্ধা এবং পরে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে পদোন্নতি পেয়ে বর্তমানে (১৯৯৫) মেজর জেনারেল পদে আসীন। সরদার নূরুল আনােয়ার পরিবার পরিকল্পনা বিভাগের চাকরি থেকে শুরু করে অনেক ঘাটের পানি খেয়ে এখন কোথায়
৩০৪
গিয়ে ভিড়েছে জানি না। সেকালের তুখােড় আবৃত্তিকার তারিক সালাউদ্দীন আজ শারীরিক ও মানসিক উভয় দিক থেকেই বিধ্বস্ত বিপর্যস্ত ও হতশ্রী।
সুস্থ প্রগতিশীল সাহিত্য-সংস্কৃতির পরিমণ্ডল গড়ে তােলা ছিলাে সুন্দরম’-এর ঘােষিত আদর্শ। এর অঘােষিত পৃষ্ঠপােষক ছিলেন সে-সময়কার ময়মনসিংহের পুলিশ সুপার আবদুল খালেক। চৌষট্টির সেপ্টেম্বর কি অক্টোবরে খালেক সাহেবের সভাপতিত্বে সুন্দরম’ ময়মনসিংহ প্রেসক্লাব মিলনায়তনে একটি আলােচনা সভার আয়ােজন করেছিলাে। আলােচনার বিষয়বস্তু ছিলাে পাকিস্তানের সংস্কৃতি। আলােচক ছিলেন সৈয়দ নজরুল ইসলাম (মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে বাংলাদেশের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি ও পঁচাত্তরের নভেম্বরে জেলখানায় নিহত), সৈয়দ আবদুস সুলতান (বায়াত্তর সাল থেকে যুক্তরাজ্যে বাংলাদেশের হাইকমিশনার), রিয়াজ উদ্দিন আহমদ (সে-সময়ে নাসিরাবাদ কলেজে অধ্যক্ষ) ও মুসলিম চৌধুরী (তখনকার ময়মনসিংহ জেলার ‘এডুকেশন অফিসার)। আলােচকদের মধ্যে আমি ছিলাম সর্বকনিষ্ঠ। |
নাথের সংস্কৃতি ভাবনার প্রসঙ্গ টেনে এনে সাধারণভাবে সংস্কৃতি সম্পর্কে খুবই হৃদয়গ্রাহী আলােচনা করেছিলেন তিনি। সৈয়দ নজরুল ইসলাম তখনই বাঙালি জাতীয়তাবাদী ভাবধারার ধারক। তার আলােচনায় তাই বাঙালি সংস্কৃতির ওপরই জোর পড়েছিলাে বেশি, বাঙালি সংস্কৃতিকে অবদমনের জন্যে পাকিস্তানি শাসকদের বিরুদ্ধে অভিযােগও কম ছিলাে না। সৈয়দ আবদুস সুলতান তখনাে মুসলিম লীগের রাজনীতি ছাড়েননি; তবে সে রাজনীতির সঙ্গে তাঁর যে খুব ববিবনা হচ্ছিলাে না, এমন কথাও বাজারে চালু ছিলাে। তার আলােচনা তাই সেদিন হয়েছিলাে অনেকটা সাপও মরে লাঠিও না ভাঙে’ গােছের। কিন্তু তার বক্তৃতাশৈলী খুবই চমৎকার ছিলাে বলে শ্রোতাদের কাছে তার কথাগুলাে উপভােগ্য হয়েছিলাে।
আমি তখন কলেজের তরুণ শিক্ষক। গা থেকে ছাত্রের গন্ধ একেবারে মুছে যায়নি। তাই কথাবার্তায় ভয়ডর বা বৈষয়িক বিবেচনাটা ছিলাে খুবই কম। পাকিস্তানের সংস্কৃতি’ বলে কোনাে একক সংস্কৃতির অস্তিত্বেই আমার বিশ্বাস ছিলাে না। বহুজাতিক পাকিস্তান রাষ্ট্রে সংস্কৃতিও বহু। সেই বহুর মধ্যে বাঙালিদের সংস্কৃতিই প্রধান, কারণ বাঙালি জাতির মানুষেরাই পাকিস্তান রাষ্ট্রের সংখ্যাগরিষ্ঠ অধিবাসী। একাধিক জাতি আছে যে-রাষ্ট্রে, সে-রাষ্ট্রের সাংগঠনিক কাঠামােকে হতে হয় ফেডারেল ধরনের। ফেডারেল রাষ্ট্রে সংস্কৃতি বা কালাচরেরও ফেডারেশন গড়ে উঠতে পারে, কোনাে একটি নামে বা পরিচয়ে সে-রাষ্ট্রের সংস্কৃতিকে চিহ্নিত করা চলে না। পাকিস্তান রাষ্ট্রেও তাই আছে পাঞ্জাবি, সিন্ধি, বালুচি, পাঠান, বাঙালি প্রভৃতি সংস্কৃতি–পাকিস্তানি সংস্কৃতি বলে কিছু নেই। পাকিস্তানের প্রতিটি সংস্কৃতিরই নির্বাধ বিকাশ নিশ্চিত করা পাকিস্তানি রাষ্ট্রবিধায়কদের দায়িত্ব। অথচ সে-দায়িত্ব পালনের বদলে তারা ‘পাকিস্তানি সংস্কৃতি’ নামে একটি কিস্তুত পদার্থ সৃজনের অপপ্রয়াসে রত। বিশেষ করে বাঙালি সংস্কৃতির স্বাভাবিক বিকাশকে তারা নানাভাবেই রুদ্ধ করতে চাইছে। এ-রকমটি মােটেই কাক্ষিত নয়।
এ-সব কথাই খুব কড়া ভাষায় সেদিন আমি বলেছিলাম। আমার বক্তব্যের প্রতিবাদ করলেন আমারই কলেজের অধ্যক্ষ রিয়াজউদ্দিন আহমদ সাহেব। দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে স্বতন্ত্র রাষ্ট্ররূপে পাকিস্তানের সৃষ্টি হওয়ায় এখানে বহু জাতির বা বহু সংস্কৃতির অস্তিত্ব থাকতে পারে না। পাকিস্তানের সংস্কৃতির মূল মর্ম হচ্ছে ইসলাম, ইসলামের বিধানই হবে পাকিস্তানি সংস্কৃতির একমাত্র চালিকাশক্তি, কালচারের ফেডারেশন’ ধারণাটি পাকিস্তান রাষ্ট্রের মূলনীতির পরিপন্থী।
৩০৫
রিয়াজউদ্দিন সাহেবের এই বক্তব্য সভায় বেশ আলােড়নের সৃষ্টি করলাে, প্রতিক্রিয়া হলাে মিশ্র ধরনের। প্রবীণ শ্রোতারা তার বক্তব্যে খুশি হলেও নবীনদের মধ্যে একটু ভিন্ন মতের অনুরণন শােনা গেলাে। সবাই সভাপতির মন্তব্য শােনার জন্যে উৎকর্ণ হয়ে রইলাে। পাকিস্তান সরকারের একজন পুলিশ অফিসার হয়ে সভাপতি এখানে কী অবস্থান গ্রহণ করেন, সবারই কৌতূহল সেদিকে।
সবাইকে অবাক করে দিয়ে সভাপতি কিন্তু পাকিস্তানের সংস্কৃতির কথা বলতে গিয়ে বাঙালি সংস্কৃতির কথাই বেশি করে বললেন। আমার কালচারের ফেডারেশন সম্পর্কীয় বক্তব্যকে তিনি সরাসরি সমর্থন জানালেন। পাকিস্তান সরকার-নিযুক্ত একজন পুলিশ। অফিসারের মুখে এ-রকম বক্তব্য শােনা যাবে বলে বােধহয় শ্রোতাদের কেউই আশা করেননি।
একাত্তরে যখন শুনলাম পুলিশ অফিসার আবদুল খালেক মুক্তিযুদ্ধে যােগ দিয়েছেন, তখন সেটি আমার কাছে খুবই স্বাভাবিক মনে হয়েছিলাে। চৌষট্টি সালে যিনি বাঙালিত্বের পক্ষে দ্ব্যর্থহীন বক্তব্য রাখতে পারেন, একাত্তরে তিনি মুক্তিযােদ্ধা হওয়া ছাড়া আর কীই বা করতে পারেন?
ষাটের দশকে যারা পাকিস্তানের সঙ্গে ভাবাদর্শের সংগ্রাম করেছে, একাত্তরে তারাই বাঙালির সশস্ত্র মুক্তিসংগ্রামে সামিল হয়েছে।

ভাবাদর্শের সংগ্রামের ব্যাপক বিস্তৃতি
আটান্নয় সামরিক শাসন জারির পর থেকে সারা ষাটের দশক জুড়ে স্বৈরশাসন চললেও তার বিরুদ্ধে সংগ্রাম কখনাে থেমে থাকেনি। প্রবল নিপীড়নের ফলে রাজনীতিকদের সংগ্রাম কখনাে কখনাে ঝিমিয়ে পড়লেও ভাবাদর্শ ও সংস্কৃতির সংগ্রাম বিরামহীনভাবেই চলেছে। অন্তত পূর্ব পাকিস্তানে তাে কর্তৃপক্ষের প্রতিরােধের মুখে এ-সংগ্রাম অনেক বেশি গতিবেগ পেয়েছে বরং। ভাবাদর্শ ও সংস্কৃতির সংগ্রামে বুদ্ধিজীবী ও সংস্কৃতিসেবীদের প্রজ্ঞা, দৃঢ়তা ও নৈপুণ্য রাজনীতিকদের নানাভাবে সহায়তা করেছে। বাংলা ভাষার বিরুদ্ধে নানামুখী ষড়যন্ত্র, প্রগতিশীল বইপত্র বাজেয়াপ্ত করার পাঁয়তারা, রবীন্দ্রসঙ্গীত নিষিদ্ধকরণ ও নজরুলের মুসলমানীকরণ’–এরকম অনেক কিছুর বিরুদ্ধেই বাঙালি বুদ্ধিজীবী, সংস্কৃতিসেবী ও ছাত্রদের সংগ্রাম পরিচালিত হয়েছে। প্রতিক্রিয়াশীল পাকিস্তানি ভাবাদর্শ যতাে বেশি চণ্ডরূপ ধারণ করেছে, বাঙালি মধ্যবিত্ত তার নিজস্ব সংস্কৃতি ও ভাবাদর্শ সম্পর্কে ততাে বেশি সচেতন হয়ে উঠেছে, ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতার নির্মোক ভেঙে ধর্মনিরপেক্ষ সংস্কৃতির উদার ভূমিতে পা রেখেছে। পঞ্চাশের দশকের গােড়ায় তারা যেমন মুখের কথা কাইড়া নেয়ার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়ে রাজপথে বুকের রক্ত ঢেলে দিয়েছে, তেমনি এরপর তাদের ভাষার বর্ণমালার বিরুদ্ধে যতােবার যতাে চক্রান্ত পরিচালিত হয়েছে সে-সব চক্রান্তকেই তারা সর্বশক্তি দিয়ে প্রতিহত করেছে। তাদের কবি ‘দুঃখিনী বর্ণমালা’র প্রশস্তি রচনা করেছেন, তাদের পণ্ডিতরা সেই বর্ণমালার দুঃখ ঘুচানােয় সক্রিয় হয়েছেন। পাকিস্তানি স্বৈরশাসক তথাকথিত জাতীয় ভাষা সৃষ্টির অপপ্রয়াসে মেতেছে, আত্মসচেতন বাঙালি সর্বস্তরে বাংলা ভাষা প্রচলনের উদ্যোগ নিয়েছে। পাকিস্তানবাদীরা রবীন্দ্র-জন্ম-শতবার্ষিকীর সময় থেকে রবীন্দ্রনাথকে নিষিদ্ধ ও অবাঞ্ছিত ঘােষণা করার অপচেষ্টা চালিয়েছে, বাঙালি জাতীয়তাবাদে উদ্বুদ্ধ সংস্কৃতিসেবীরা
৩০৬
রবীন্দ্রচর্চার বিস্তার ঘটিয়েছে। ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতার ধারকরা নজরুলের খণ্ডীকরণ ঘটিয়ে তাকে মুসলমান বানাতে চেয়েছে, ধর্মনিরপেক্ষ প্রগতিশীলরা নজরুলের অখণ্ড সত্তার উন্মােচন ঘটাতে প্রবৃত্ত হয়েছে। প্রতিক্রিয়াশীল কূপমণ্ডুক ও ধর্মান্ধ সাম্প্রদায়িকতাবাদীরা আধুনিক বিজ্ঞানচেতনাসম্পন্ন বই-পুস্তক বাজেয়াপ্ত করার পায়তারা করেছে, উদার জাতীয়তাবাদী ও প্রগতিশীল আন্তর্জাতিকতাবাদীরা সেই অপপ্রয়াস ব্যর্থ করে দিয়েছে।
সংস্কৃতি ও ভাবাদর্শের এই সংগ্রামে, সন্দেহ নেই, রাজধানী ঢাকার সংস্কৃতিকর্মি ও বুদ্ধিজীবীরাই অগ্রণীর ভূমিকা নিয়েছেন। তবে, সে-সংগ্রাম একান্তভাবে ঢাকাকেন্দ্রিক হয়ে থাকেনি বলেই তা জোরদার হতে পেরেছিলাে, এবং পরিণামে পাকিস্তানি ভাবাদর্শকে স্থানচ্যুত করে বাঙালিত্বের প্রতিষ্ঠাদানে সক্ষম হয়েছিলাে।
ময়মনসিংহের মতাে জেলা শহরের সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের মধ্যেও আমি এ-বিষয়টিই লক্ষ করেছি।
ষাটের দশকের প্রায় গােড়া থেকেই মুসলিম চৌধুরী ছিলেন ময়মনসিংহের ‘জিলা শিক্ষা অফিসার’। শ্রীহট্ট-সন্তান এই সুরসিক ভদ্রলােক প্রায় এক দশক ময়মনসিংহে ছিলেন। এমন বিদগ্ধ সাহিত্যপ্রাণ অমায়িক ও উদার হৃদয় মানুষ আমি খুব কমই দেখেছি। রবীন্দ্রনাথের ‘সঞ্চয়িতার প্রায় পুরােটাই তাঁর মুখস্থ ছিলাে। নানা আলােচনা সভায় সিলেটি উচ্চারণে মুসলিম চৌধুরীর রবীন্দ্র কবিতার আবৃত্তি হতাে খুবই উপভােগ্য। এমন একজন রবীন্দ্রপ্রেমিক সরকারি কর্মচারিকে পেয়ে ষাটের দশকের সেই বিরূপ সময়টিতে আমাদের খুবই সুবিধা হয়েছিলাে।
চৌষট্টি সালে সুন্দর’ সংগঠনটির পাশাপাশি আমার ছােট ভাই মতীন্দ্র সরকার, আমার অত্যন্ত প্রিয় ছাত্র নূরুল হক, মতীন্দ্রর ছাত্র খগেশ কিরণ তালুকদার এবং আরাে কয়েকজন তরুণ মিলে গড়ে তুলেছিলাে বাংলাভাষা প্রচার-অভিযান সমিতি’। এর সভাপতি হয়েছিলেন আমার বন্ধু ও সহকর্মী রাহাত খান, সম্পাদক মতীন্দ্র সরকার। জীবনের সর্বস্তরে বাংলা ভাষা ব্যবহার করুন’–এ-রকম স্লোগান নিয়ে রাজধানী ঢাকাসহ বিভিন্ন শহরে এ-ধরনের বেশকিছু সমিতি গড়ে উঠেছিলাে। ময়মনসিংহের তরুণদের ওই সমিতিটিও ছিলাে অনুরূপ। অল্প কয়েকদিনেই এই সমিতিটি বেশ আলােড়ন সৃষ্টি করে ফেলেছিলাে। বাংলা ভাষা ব্যবহারের আবেদন জানিয়ে লিফলেট বিতরণ করা, দেয়ালে দেয়ালে পােস্টার সেঁটে দেয়া, অফিসে অফিসে গিয়ে সকলের কাছে বাংলায় অফিসের কাজকর্ম করার জন্যে অনুরােধ জানানাে—এসবই ছিলাে এ-সংগঠনটির কর্মকাণ্ড। একবার প্রেসক্লাবে একটি সেমিনারও করেছিলাে এরা। সেমিনারে সভাপতি ছিলেন মুসলিম চৌধুরী। এ-সেমিনারেই বেশ একটি মজার ঘটনা ঘটেছিলাে। একজন অধাপিকা বাংলা ভাষার ব্যবহার সম্পর্কে বক্তব্য রাখছিলেন। বক্তব্যের এক পর্যায়ে তিনি ময়মনসিংহসহ পূর্ববাংলার বিভিন্ন অঞ্চলের মানুষদের উচ্চারণভঙ্গি নিয়ে কিছু কটাক্ষ করেছিলেন। (প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, ওই অধ্যাপিকা জন্মসূত্রে ছিলেন পশ্চিমবঙ্গীয়, পশ্চিমবঙ্গসুলভ উচ্চারণ পদ্ধতি ব্যবহার করে তিনি সব সময় স্বাতন্ত্র ঘােষণা করতেন, এবং ‘বাঙাল’দের সামনে তার উচ্চমন্যতাকে গােপন রাখতেন না।) পূর্ববাংলার মানুষদের উচ্চারণরীতি পরিবর্তনের জন্যে তিনি উপদেশবাণীও বর্ষণ করেছিলেন। সভাপতির আসনে বসে শ্রীহট্ট-সন্তান মুসলিম চৌধুরী ওই অধ্যাপিকার বক্তব্যে যে রীতিমতাে অস্বস্তিবােধ করছিলেন সে-অস্বস্তির বহিঃপ্রকাশ ঘটালেন তিনি প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই। অধ্যাপিকার বক্তৃতা শেষ
৩০৭
হতেই সভাপতি উঠে দাঁড়ালেন। শ্রীহট্টীয় উচ্চারণভঙ্গিতে বেশ মজা করে তিনি বলতে লাগলেন—“বেগম সাহেবার কথাগুলাে আমি পুরােপুরি মেনে নিতে পারলাম না। উনি যেঅঞ্চলে জন্মেছেন সে-অঞ্চলের উচ্চারণভঙ্গি খুবই সুন্দর সন্দেহ নেই। কিন্তু তাই বলে বাংলার সকল অঞ্চলের মানুষকে যে ওই রকম উচ্চারণেই কথা বলতে হবে—তেমন দাবি তিনি করতে পারেন না। কারণ ভাষার মূল বিষয় হলাে ভাব। [ভাষা’ ও ‘ভাব’ শব্দ দুটি তার উচ্চারণে হয়ে গিয়েছিলাে অনেকটা বাষা ও বাব’-এর মতাে। ভাব প্রকাশই হলাে বড়াে কথা, উচ্চারণের জন্যে কিছু আসে যায় না। [উচ্চারণ’ শব্দটিও তিনি উচ্চারণ করেছিলেন অনেকটা ‘উচ্ছারণ’-এর মতাে] ওই যে ময়মনসিংহ গীতিকা’য় আছে-নায়ক বলছে নায়িকাকে ।
কোথায় পাইবাম কলসী, কন্যা,
কোথায় পাইবাম দড়ি,
তুমি হও গহীন গাঙ
আমি ডুইবা মরি।
[এই কথাগুলাে তিনি বলেছিলেন পুরাে সিলেটি উচ্চারণে—এখানে ‘উচ্চারণ শুদ্ধ হলাে বলে কি ডুইবা মরণ আঁটকিয়া রইলাে?’ সারা সভায় হাসির রােল উঠলাে।
উচ্চারণ সম্পর্কে কোনাে কথা উঠলেই মুসলিম চৌধুরীর ওই বক্তৃতাটির কথা আমার চট করে মনে পড়ে যায়।
পঁয়ষট্টির পাক-ভারত যুদ্ধের পর থেকে উনিশ ‘শাে উনসত্তরের ফেব্রুয়ারি—এই ক’বছরে ময়মনসিংহ শহরের প্রগতিশীল সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে নিজেদের নানাভাবে জড়িয়ে রেখেছিলেন মুসলিম চৌধুরী ও কবীর চৌধুরী। এরা দু’জনই সরকারি কর্মচারি হলেও পাকিস্তানি সাংস্কৃতিক ভাবদর্শের বিপরীত ভূমিতেই ছিলাে এদের অবস্থান। ময়মনসিংহের প্রায় সব সাহিত্য-সংস্কৃতি সংগঠনের সঙ্গেই এরা যুক্ত হয়ে পড়েছিলেন।
সে-সময়কার ময়মনসিংহ শহরে ‘মােমেনশাহী সাহিত্য মজলিস’ ছিলাে একটি বনেদি সাহিত্য সংগঠন। পঞ্চাশের দশকে প্রখ্যাত লেখক মােহাম্মদ বরকতুল্লাহ যখন জেলা পর্যায়ের একজন কর্মকর্তা রূপে ময়মনসিংহে কর্মরত ছিলেন তখন তার হাতেই এই সংগঠনটির প্রতিষ্ঠা ঘটে। এ-সংগঠনটির নির্মিতিতে সে-সময়কার আনন্দমােহন কলেজের অধ্যাপক সৈয়দ বদরুদ্দীন হােসাইনের ভূমিকা ছিলাে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ষাটের দশকের দ্বিতীয়ার্ধে এর পড়তি দশা হলেও তখনাে এটি মােটামুটি সক্রিয়। খান সাহেব আবদুল্লাহর নেতৃত্বে পরিচালিত হতাে ‘শুক্ৰবাসরীয় সাহিত্য সংসদ। আর ছিলাে ময়মনসিংহ প্রেসক্লাব’। নামে প্রেসক্লাব হলেও এটি শুধু সাংবাদিকদের ক্লাব ছিলাে না, ছিলাে শহরের সকল সুধীজনের মিলনকেন্দ্র।
বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ‘মােমেনশাহী সাহিত্য মজলিস’ বিলুপ্ত হয়ে গেছে, ‘শুক্ৰবাসরীয় সাহিত্য সংসদ’ কোনাে রকমে তার অস্তিত্ব টিকিয়ে রেখেছে, সক্রিয় আছে কেবল ময়মনসিংহ ‘প্রেসক্লাব’। আরাে আছে ‘আর্য ধর্মজ্ঞান প্রদায়িনী সভা’ ও ‘মুসলিম ইনস্টিটিউট নামে দুটো প্রতিষ্ঠান। নামেই প্রকাশ যে, এ-দুটো প্রতিষ্ঠানই ধর্ম সম্প্রদায়কেন্দ্রিক। কিন্তু তাই বলে এ-দু’য়ের একটিকেও পুরােপুরি, অন্তত নিন্দার্থে, সাম্প্রদায়িক প্রতিষ্ঠান বলে চিহ্নিত করা উচিত হবে না।
প্রথমেই ময়মনসিংহ শহরের দুর্গাবাড়ি’তে অবস্থিত ‘আর্য ধর্মজ্ঞান প্রদায়িনী সভা’র কথা বলি। দুর্গাবাড়ি, বলাবহুল্য, হিন্দুদের একটি ধর্মকেন্দ্র। আঠারােশাে পঁয়ষট্টি সালে
৩০৮
ময়মনসিংহের ধনাঢ্য ও ধর্মপ্রাণ হিন্দুগণ দুর্গাবাড়ির প্রতিষ্ঠা করেন। এর দশ বারাে বছর আগেই ময়মনসিংহ শহরে ব্রাহ্ম আন্দোলন শুরু হয়ে গেছে। ব্রাহ্মরাই এ-শহরে আধুনিক চিন্তাচেতনার গােড়াপত্তন করে। স্বাভাবিকভাবেই প্রগতিশীল ব্রাহ্ম আন্দোলনের প্রসারে রক্ষণশীল হিন্দুদের মধ্যে রােষের সঞ্চার ঘটে। সেই রােষ থেকেই ব্রাহ্মদের বিরুদ্ধে তারা সংগঠিত হন। দুর্গাবাড়ি প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়েই ঘটে তাঁদের সংগঠিত হওয়ার সূচনা। ব্রাহ্মসমাজের বিপরীতে দুর্গাবাড়িকে কেন্দ্র করেই তারা গড়ে তােলেন ‘আর্য ধর্মজ্ঞান প্রদায়িনী সভা-সংক্ষেপে ‘ধর্মসভা। উনিশ শতকের ষাটের দশকে যে প্রতিষ্ঠানটির পত্তন ঘটেছিলাে একুশ শতকে এসেও তার অস্তিত্ব বিলুপ্তি ঘটেনি। তবে একটি রক্ষণশীল ধর্মীয় সাম্প্রদায়িক প্রতিষ্ঠানরূপে আত্মপ্রকাশ করলেও কালের গতিতে তার চরিত্রে অনেক পরিবর্তন ঘটে যায়। উদ্যোক্তাদের ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায় এ-প্রতিষ্ঠানটি আস্তে আস্তে অনেক সেকুলার কর্মকাণ্ডেও জড়িয়ে পড়ে। ধর্মসভা পরিচালিত দুর্গাবাড়ি পাঠাগারটি ছিলাে অত্যন্ত সমৃদ্ধ। সে-পাঠাগারে ধর্মীয় পুস্তকের সংগ্রহ যতাে না ছিলাে, তারচেয়ে অনেক বেশি ছিলাে ধর্মনিরপেক্ষ নানা জ্ঞানবিজ্ঞানের পুস্তকসম্ভার। “হিন্দু ছাড়া কেউ ধর্মসভার সদস্য হতে না পারলেও ধর্ম-সম্প্রদায় নির্বিশেষে সকল শ্রেণীর পাঠকের পক্ষেই দুর্গাবাড়ির পাঠাগারটি ব্যবহার করতে কোনাে বাধা থাকে না। দুর্গাবাড়িতে প্রতি পূর্ণিমায় তিনদিনব্যাপী শাস্ত্র, সাহিত্য ও সঙ্গীত সম্মেলনের আয়ােজন করা হতাে। প্রথম দিনে শাস্ত্র সম্মেলন, দ্বিতীয় দিনে সাহিত্য সম্মেলন ও তৃতীয় দিনে সঙ্গীত সম্মেলন। পূর্ণিমা তিথিকে কেন্দ্র করে আয়ােজিত তিন দিনব্যাপী এই অনুষ্ঠানের নাম ছিলাে ‘পূর্ণিমা সম্মেলন। প্রথম দিনের শাস্ত্র সম্মেলনটি অবিশ্যি ছিলাে নিতান্তই ‘পণ্ডিতি’ ব্যাপার। হিন্দুর স্মৃতিশাস্ত্রের নানা আনুষ্ঠানিক বিধি-বিধানই ছিলাে এ-সম্মেলনের আলােচ্য বিষয়, তাই এতে সাধারণ রসপিপাসু মানুষের তেমন কোনাে আগ্রহ থাকার কথা নয়। তবে দ্বিতীয় ও তৃতীয় দিনের সাহিত্য ও সঙ্গীত সম্মেলনে ধর্মবর্ণের বাধা ডিঙিয়ে সকল সম্প্রদায়ের রসলিসু মানুষ দুর্গাবাড়িতে সমবেত হতেন। সাহিত্য সম্মেলনে ধর্মভিত্তিক বিষয়বস্তুর পাশাপাশি ধর্মনিরপেক্ষ গল্প-কবিতা-প্রবন্ধ প্রচুর পঠিত হতাে। পূর্ণিমা সম্মেলনকে কেন্দ্র করে বর্ষবরণ, বর্ষামঙ্গল, বসন্তোৎসব ও রবীন্দ্র-নজরুল জয়ন্তীর মতাে সাহিত্য-সংস্কৃতি বিষয়ক আরাে নানা অনুষ্ঠানে দুর্গাবাড়ি সারা বছর জমজমাট হয়ে থাকতাে। প্রতি বছর বৈশাখী পূর্ণিমায় উদযাপিত হতাে ‘বুদ্ধজয়ন্তী’। বুদ্ধের জীবন ও দর্শন সম্পর্কে খুব গভীর তত্ত্বপূর্ণ আলােচনা হতাে সেখানে। ময়মনসিংহস্থ বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে এক সময় অনেক বিদেশি ছাত্রও পড়তে আসতাে। এদের মধ্যে বৌদ্ধ ছাত্রদের দুর্গাবাড়ির বুদ্ধজয়ন্তী উৎসবে যােগদান করতে আমি কয়েকবারই দেখেছি।
হিন্দুদের ‘আর্য-ধর্মজ্ঞান প্রদায়িনী সভা’ বা ‘ধর্মসভা যেমন হিন্দুত্বের গণ্ডি ছাড়িয়ে অনেক সেকুলার কর্মকাণ্ডের সঙ্গে যুক্ত হয়, মুসলিম ইনস্টিটিউট’ও তেমনি কেবল ইসলাম ও মুসলিমের মধ্যে আবদ্ধ হয়ে থাকে না। আমরা তাে জানি : আমাদের দেশে নাগরিক মধ্যবিত্তের উত্থান ঘটেছিলাে, বলতে গেলে, সম্প্রদায়-ভিত্তিতেই। উনিশ শতকে কোলকাতাকেন্দ্রিক মধ্যবিত্তের উদ্ভব হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপরতলার কিছু মানুষকে নিয়েই। এরপর দেশের বিভিন্ন স্থানে নগরায়ণের বিস্তৃতির সঙ্গে সঙ্গে ওই হিন্দু মধ্যবিত্ত গােষ্ঠীটিরই বিস্তার ঘটতে থাকে বেশ কয়েক দশক ধরে। এদের বিভিন্ন অনুষ্ঠান-প্রতিষ্ঠানেও, স্বাভাবিকভাবেই, হিন্দুত্বের ছাপ পড়ে—অর্থাৎ সাম্প্রদায়িক চরিত্র ধারণ করে। এর অনেক পরে
৩০৯
মুসলমান সমাজ থেকে হাঁটি হাঁটি পা পা করে যে মধ্যবিত্ত গােষ্ঠীটি উঠে আসে সেটিও যে চরিত্রে সম্প্রদায়-চেতনাকেই ধারণ করবে তাতে অস্বাভাবিকতার কী আছে? ময়মনসিংহ শহরেও উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধ থেকে যেমন হিন্দু সম্প্রদায়-চেতনা নিয়েই বিভিন্ন নাগরিক মধ্যবিত্ত প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছিলাে, তেমনি বিলম্বে উদ্ভূত মুসলিম মধ্যবিত্ত সমাজ আঞ্জুমান’এর মতাে যে-সব প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছিলাে সে-সবের মধ্যেও স্ব-সম্প্রদায়প্রীতিই স্বাভাবিক প্রাধান্য পেয়েছিলাে। মুসলিম মধ্যবিত্ত সম্প্রদায়ের অভীপ্সকে ধারণ করেই বিশ শতকের তিরিশের দশকে মুসলিম ইনস্টিটিউটের প্রতিষ্ঠা। যতােই সম্প্রদায়চেতনা থাকুক, এ-ধরনের প্রতিষ্ঠানের মূল লক্ষ থাকে আধুনিকতাকে ধারণ করার দিকেই। আধুনিক নানা বিষয়ের চর্চাই হয়ে ওঠে এর উপজীব্য, মুসলিম সম্প্রদায়ের বাইরের মানুষদের জন্যও এর দরােজা একেবারে বন্ধ থাকে না। অন্তত পাকিস্তান আমলে তাে ময়মনসিংহের মুসলিম ইনস্টিটিউটকে আমি এক ধরনের অসাম্প্রদায়িক চরিত্রের রূপ পরিগ্রহ করতেই দেখেছি। ইনস্টিটিউটের পরিচালন ব্যবস্থায় মুসলিম-নিয়ন্ত্রণ বজায় থাকলেও এর নানা কর্মকাণ্ডে মুসলিম-অমুসলিম নির্বিশেষে সকলেরই অংশগ্রহণে কোনাে বাধা থাকেনি। ষাটের দশকে মুসলিম ইনস্টিটিউটের অনেক অনুষ্ঠানেই আমি অংশ নিয়েছি আমার জন্মগত সম্প্রদায়-পরিচয় নিয়ে সেখানে কেউ প্রশ্ন তােলেনি।
পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে মুসলিম ইনস্টিটিউট নিশ্চয়ই সংগ্রামী ভূমিকা রেখেছিলাে। কিন্তু ষাটের দশকে মুসলিম ইনস্টিটিউটে যে-সব আলােচনা সভায় আমি যােগ দিয়েছি। সেগুলােতে নানাভাবে পাকিস্তানি ভাবাদর্শের প্রত্যক্ষ ও পরােক্ষ সমালােচনাই আমি শুনেছি। পুলিশ সুপার আবদুল খালেক, এডুকেশন অফিসার মুসলিম চৌধুরী, সরকারি আনন্দমােহন কলেজের অধ্যক্ষ কবীর চৌধুরী এবং এ-রকম আরাে অনেকে মুসলিম ইনস্টিটিউটের আলােচনা সভায় যে-সব বক্তব্য রাখতেন সে-সব কোনাে মতেই মুসলিম স্বাতন্ত্র বা পাকিস্তানি ভাবাদর্শের পােষকতা করতাে না। ইনস্টিটিউটের রক্ষণশীল কর্মকর্তারা নিজেরা যা-ই ভাবুন না কেন, তাদের চিন্তা-ধারা তখন যুগের দাবির কাছে পরাভব মানতে বাধ্য হয়েছিলাে।
আর দুর্গাবাড়ির ধর্মসভার পক্ষে তাে পাকিস্তানি ভাবাদর্শের পােষকতা করার বিষয়টি ছিল একেবারেই অবান্তর। পূর্ণিমা সম্মেলনের উদ্যোক্তারা রাষ্ট্রদ্রোহিতার অপবাদ মাথায় নিয়েই বাঙালি সংস্কৃতির সনিষ্ঠ চর্চা করে চলেছিলেন। পূর্ণিমা সম্মেলনের কয়েকটি অনুষ্ঠানে মুসলিম চৌধুরীর সরস ও বলিষ্ঠ বক্তব্য সে-সময়ে ময়মনসিংহ শহরের প্রগতিশীল সাংস্কৃতিক আন্দোলনকে যথেষ্ট চাঙা করে তুলেছিলাে।
এভাবে ষাটের দশকের ময়মনসিংহ শহরে, মােমেনশাহী সাহিত্য মজলিস’ বা ‘প্রেসক্লাবের মতাে বিদ্বৎসভাগুলাের পাশাপাশি ধর্মসভা’বা মুসলিম ইনস্টিটিউটের মতাে সম্প্রদায়ভিত্তিক প্রতিষ্ঠানগুলাের কিছু কিছু কর্মকাণ্ডেও পাকিস্তানের ভাবাদর্শবিরােধী ভূমিকাই পালিত হচ্ছিলাে। তবু, এ-সব সংগঠন ও প্রতিষ্ঠানের যে এ-ক্ষেত্রে অনেক সীমাবদ্ধতা ও পিছুটান ছিলাে, সে-কথাও স্বীকার করতেই হবে। তাই, তরুণরা এগুলাের সঙ্গে যুক্ত থাকতে খুব পছন্দ করতাে না, তারা তাদের নিজস্ব সংগঠন নিয়ে এগিয়ে এলাে। সুন্দরম’–এর পর গড়ে উঠলাে ‘আমরা সমুদ্রমুখী’। কবীর চৌধুরীর সক্রিয় আনুকূল্যে কাজকর্ম চালিয়ে আমরা সমুদ্রমুখী’ অল্পদিনেই ময়মনসিংহ শহরে সাড়া জাগিয়েছিলাে। একটি রাষ্ট্রবিরােধী সংগঠন হিসেবে পাকিস্তানবাদীরা একে চিহ্নিত করেছিলাে, পাকিস্তানের বুদ্ধিবিভাগ’ এর পেছনে
৩১০
লেগেছিলাে। তরুণ ছাত্রদের প্রতিষ্ঠান ‘আমরা সমুদ্রমুখী’র সঙ্গে আমি যদিও সাংগঠনিকভাবে যুক্ত ছিলাম না, তবু এর সব কর্মকাণ্ডেই অংশগ্রহণ করতাম বলে আমার বিরুদ্ধেও পাকিস্তানবাদীদের আক্রোশের কমতি ছিলাে না।
মুসলিম চৌধুরী কখনাে সরাসরি কোনাে রাজনৈতিক বক্তব্য রাখতেন না। কিন্তু কবীর চৌধুরীর সংস্কৃতি-সম্পর্কিত আলােচনাতেও রাজনৈতিক প্রসঙ্গ অনেক তীক্ষ্ণতার সঙ্গে উঠে আসতাে। উনিশ শাে ছেষট্টি সালের ছয় সেপ্টেম্বর ময়মনসিংহ টাউন হলে ‘পাকিস্তান প্রতিরক্ষা দিবস’ পালন করা হয়েছিলাে। এক বছর আগে সংঘটিত পাক-ভারত যুদ্ধের স্মরণে আয়ােজিত অনুষ্ঠানটির উদ্যোক্তারা অবশ্যই ছিলেন সরকারি আশীর্বাদপুষ্ট জঙ্গী পাকিস্তানবাদী। তারা অনেক গরম গরম কথা বলেছিলেন। তাদের সব কথাতেই ছিলাে উগ্র সাম্প্ৰয়িকতার উদগার। কিন্তু, সেই অনুষ্ঠানেই, কবীর চৌধুরী সম্পূর্ণ বিরীতধর্মী কথা বলে সভার শ্রোতা ও উদ্যোক্তাদের অবাক করে দিয়েছিলেন। পাক-ভারত যুদ্ধকে উপলক্ষ করে এদেশে যে সাম্প্রদায়িকতার বিস্তার ঘটানাে হচ্ছে, রবীন্দ্রনাথের সাহিত্য ও সঙ্গীতকে অপাংক্তেয় ও অবাঞ্ছিত ঘােষণার যে অপপ্রয়াস চালানাে হচ্ছে, পাকিস্তানের জাতীয় সংহতির নামে আবহমানকালের বাঙালি সংস্কৃতিকে যেভাবে অবদমন করা হচ্ছে, এ-সবই অত্যন্ত অশুভ ফল বয়ে আনবে বলে সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। এর কিছুদিন পরে জিলা পরিষদ হলে সরকারি উদ্যোগে আয়ােজিত আরেকটি অনুষ্ঠানেও তিনি এ-কথাগুলােই আরাে তীক্ষ্ণভাবে উপস্থিত করলেন, প্রতিক্রিয়াশীল সংস্কৃতি-ব্যাখ্যাতাদের মুখােশ উন্মােচন করে দিলেন।
সরকারি কলেজের একজন অধ্যক্ষ হয়ে কবীর চৌধুরী যে-সব কথাবার্তা বলে চলছিলেন, এবং তরুণদের যে-সব কর্মকাণ্ডে উৎসাহ জোগাচ্ছিলেন তাতে তার ওপর রাষ্ট্রশক্তির সুনজর থাকার কথা নয়। কিন্তু দৃঢ়চিত্ত কবীর চৌধুরী ছিলেন লা-পারওয়া।

মুক্তি সংগ্রামের অগ্রসেনানী রবীন্দ্রনাথ ও নজরুল
সৈয়দ নজরুল ইসলাম একান্ত আবেগে আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরলেন। উচ্ছাসের সঙ্গে বলতে লাগলেন, ‘অসাধারণ কাজ করছেন আপনারা। আমার বহুদিনের স্বপ্ন ছিলাে এ-রকম কিছু করার। কিন্তু পারিনি, চেষ্টা করেও পারিনি। আর এখন তাে রাজনীতির সঙ্গে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে গেছি, সংস্কৃতির সঙ্গে যােগ রাখা আর সম্ভব হচ্ছে না। তবু এটা বুঝি যে, সংস্কৃতির ক্ষেত্রে কাজ না করতে পারলে আমাদের রাজনীতি কোনােমতেই এগিয়ে যাবে না।…এই যে আবহমান বাঙালির সংস্কৃতিকে তুলে ধরলেন, জোরালােভাবে উপস্থিত করলেন, এ-রকমটি তাে খুবই দরকার এ-সময়।…আপনারা এগিয়ে যান, আমার সহযােগিতা সব সময়ই পাবেন। তবে, সরাসরি আমার মতাে রাজনীতির মানুষকে এর সঙ্গে জড়াবেন না। তাহলে আপনাদের কাজে অনেক বাধা আসবে।…এসব কাজ করতে তাে টাকা-পয়সার প্রয়াজন। সে-ব্যাপারে আমি আপনাদের যথাসাধ্য সাহায্য করতে চেষ্টা করবাে।’
কথাগুলাে তিনি বলেছিলেন ময়মনসিংহ জেলা পরিষদ হলের বারান্দায় দাঁড়িয়ে। কথাগুলাের উপলক্ষ একটু আগে সমাপ্ত হওয়া ‘আমরা সমুদ্রমুখী’র একটি অনুষ্ঠান। সময়টা সাতষট্টির সেপ্টেম্বর কি অক্টোবরের একটি সন্ধ্যা। অনুষ্ঠানে উপস্থাপন করা হয়েছিলাে মতীন্দ্রর লেখা একটি গীতিআলেখ্য—কালের যাত্রার ধ্বনি। আলেখ্যটিতে ছিলাে চর্যাপদের কাল থেকে
৩১১
শুরু করে বিংশ শতাব্দীর ষাটের দশক পর্যন্ত বাংলা সাহিত্য-সংস্কৃতির একটি চমৎকার রূপরেখা । অনুষ্ঠানে সঙ্গীত পরিচালনা করেছিলেন অধ্যাপক আজিজুল হক চৌধুরী। অধ্যাপক আনােয়ারুল ইসলাম (যিনি পরে আমেরিকা থেকে মৎস্যবিজ্ঞানে ডক্টরেট ডিগ্রি নিয়ে এসেছেন) স্বরচিত জারী গানে বাঙালি সংস্কৃতির অসাম্প্রদায়িক রূপটি চমৎকারভাবে তুলে ধরেছিলেন। আলােচনা করেছিলাম আমি ও অনুষ্ঠানের সভাপতি কবীর চৌধুরী।
পুরাে অনুষ্ঠানটি সৈয়দ নজরুল ইসলাম অত্যন্ত আগ্রহের সঙ্গে উপভােগ করেছিলেন। যিনি পরবর্তীকালে আমাদের মুক্তিসগ্রামে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন, স্বাধীন। দেশের কারাগারে আততায়ীর হাতে প্রাণ বিসর্জন দিয়েছিলেন, সেই সৈয়দ নজরুলের কর্মজীবনের প্রধান অংশটি অতিবাহিত হয়েছে ময়মনসিংহ শহরেই। আমার বন্ধুদের অনেকেই আনন্দমােহন কলেজে ইতিহাসের জাদরেল অধ্যাপক সৈয়দ নজরুলের ছাত্র ছিলেন। তাঁর ছাত্র হওয়ার সৌভাগ্য আমার হয়নি। কারণ নেত্রকোনা কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট পাস করে আমি যখন আনন্দমােহন কলেজে ভর্তি হই, সেই সাতান্ন সালের আগেই সৈয়দ নজরুল অধ্যাপনা ছেড়ে আইন ব্যবসায়ে যােগ দিয়েছেন। তবে কলেজে পড়ার সময়েই আমি তার সান্নিধ্যে আসার সুযােগ পাই একটি বিতর্ক অনুষ্ঠানকে উপলক্ষ করে। আটান্ন সালের গােড়ার দিকে আনন্দমােহন কলেজে জাতিসংঘের এক নকল অধিবেশনের অনুষ্ঠান হয়েছিলাে। ‘গণচীনের জাতিসংঘে অন্তর্ভুক্তি’ ছিলাে অধিবেশনে’র আলােচ্য বিষয়। সৈয়দ নজরুল তখন অধ্যাপনায় না থাকলেও তার প্রাক্তন সহকর্মী অধ্যক্ষ সৈয়দ বদরুদ্দীন হােসাইন তাঁকে ওই বিতর্ক অনুষ্ঠানটিতে আমন্ত্রণ করে নিয়ে এসেছিলেন। আমি জাতীয়তাবাদী চীনের প্রতিনিধির ভূমিকা নিয়েছিলাম, আর সৈয়দ নজরুল হয়েছিলেন তিউনিসিয়ার প্রতিনিধি। সেই জাতিসংঘ অধিবেশনে’র ছ’বছর পর কর্মসূত্রে ময়মনসিংহ শহরে এসে মুসলিম ইনস্টিটিউট, প্রেসক্লাব, মােমেনশাহী সাহিত্য মজলিস এবং আরাে অনেক প্রতিষ্ঠানে সৈয়দ নজরুল ইসলামের সঙ্গে সাহিত্য-সংস্কৃতি বিষয়ে নানা আলােচনায় যােগ দিয়ে তাঁর পরিশীলিত ব্যক্তিত্বের সংস্পর্শ অনুভব করি। নানা উপলক্ষে তার সঙ্গে আমার অনেক আলাপ-আলােচনা হয়েছে। আলােচনা হতাে মূলত সাহিত্য-সংস্কৃতি নিয়ে, রাজনীতির প্রসঙ্গ তাতে খুব কমই থাকতাে। বাংলাদেশের মানুষ রাজনীতিক সৈয়দ নজরুল ইসলামের কথা জানে, কিন্তু খুব কম লােকই তার সংস্কৃতিচিন্তার সঙ্গে পরিচিত। আমরা যারা ময়মনসিংহে তাঁর ঘনিষ্ঠ সংস্পর্শে আসতে পেরেছিলাম তাদের কাছেই তার সংস্কৃতি-ভাবনার স্বরূপটি উন্মােচিত হয়েছিলাে।
সাতষট্টি সালের জুনে পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের বাজেট অধিবেশনে খান আবদুস সবুর ও খাজা শাহাবুদ্দিনের রবীন্দ্রবিরােধী বক্তব্য বাঙালিদের সাংস্কৃতিক স্বাধিকার চেতনাকে নতুনভাবে জাগিয়ে তােলে। তারই ফলে, একষট্টির পরে, আবার এখানে রবীন্দ্র চর্চার জোয়ার আসে। আগে এখানে পঁচিশ বৈশাখে রবীন্দ্র জন্মবার্ষিকী উদযাপন করা হতাে বেশ সাড়ম্বরেই, কিন্তু বাইশ শ্রাবণে রবীন্দ্র মৃত্যুদিবস পালনের রেওয়াজ খুব একটা ছিলাে না। সাতষট্টি সালেই প্রথম পাকিস্তানি শাসকদের চ্যালেঞ্জ জানিয়ে ব্যাপকভাবে রবীন্দ্র মৃত্যুবার্ষিকীর অনুষ্ঠান করা হয়। শুধু ঢাকায় নয়, ঢাকার বাইরেও।
মুকুল ফৌজ’ সংগঠনটিকে খুব একটা প্রগতিবাদী বলা যায় না, পাকিস্তানি আদর্শের প্রতিই বরং এর পক্ষপাতিত্ব ছিলাে। ময়মনসিংহে কিন্তু ষাটের দশকের মাঝামাঝি থেকেই মুকুল ফৌজের চরিত্র পাল্টে যেতে থাকে। সাতষট্টি সালে এখানে অন্যান্য সংগঠনের মতাে
৩১২
মুকুল ফৌজকেও দেখি রবীন্দ্রচর্চায় ব্রতী হতে। ময়মনসিংহ মুকুল ফৌজের কর্ণধার আমীর আহমদ চৌধুরীকে আমরা একজন দক্ষ ক্রীড়াসংগঠক বলেই জানতাম, সংস্কৃতির অন্য কোনাে শাখায় তাকে আগে কখনাে মনােযােগী হতে দেখিনি। সেবারই প্রথম দেখলাম আমীর আহমদ চৌধুরী সােৎসাহে তার মুকুল ফৌজকে রবীন্দ্রনাথের ‘শ্যামা নৃত্যনাট্য মঞ্চায়নে লাগিয়ে দিয়েছেন। অমার্জিত পাকিস্তানবাদীরা শ্যামা’ মঞ্চায়ন নিয়ে নানা কুৎসা রটনা করেছে, বলেছে। ‘হিন্দুদের সঙ্গে মিলে এখানে কালীর নাচ নাচানাে হচ্ছে।’ গুণ্ডা লাগিয়ে ওরা নাট্যানুষ্ঠানটি পঙ্গু করেও দিতে চেয়েছে। কিন্তু আমীর আহমদ চৌধুরী ওদের সব কুৎসা উপেক্ষা করে ও চক্রান্ত ব্যর্থ করে দিয়ে খুবই সাফল্যের সঙ্গে ‘শ্যামা’র মঞ্চায়ন সম্পন্ন করালেন। ময়মনসিংহে রবীন্দ্রচর্চায় আরেকটি নতুন মাত্রা সংযােজিত হলাে।
রবীন্দ্র-বিদ্বেষী তথা অসাম্প্রদায়িক বাঙালি সংস্কৃতির দুশমনরা এ সবের ফলে আরাে ক্ষেপে যায় এবং একেবারে দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে ওঠে। আটষট্টি সালে আমরা সমুদ্রমুখী আয়ােজিত রবীন্দ্র মৃত্যুবার্ষিকীর অনুষ্ঠানে তারা সরাসরি হামলা করে বসে। খান সাহেব আবদুল্লাহর সভাপতিত্বে প্রেসক্লাবে অনুষ্ঠান হচ্ছিলাে। সে-সময়কার একজন প্রতিশ্রুতিশীল ছােটগল্পকার নীলু দাস বক্তৃতা দিচ্ছিলেন। তিনি বলছিলেন রবীন্দ্রনাথের কবিতা ও গান বাঙালির সংস্কৃতিকে কতােটা সমৃদ্ধি দিয়েছে তারই কথা। রবীন্দ্রনাথকে বাদ দিলে সাংস্কৃতিক সম্পদে আমরা কেন একেবারেই দীন হয়ে যাবাে, সে কথাটারই তিনি ব্যাখ্যা দিচ্ছিলেন। হঠাৎ কয়েকটি যুবক চিৎকার করে উঠলাে, চুপ করুন, চুপ করুন। বক্তার সামনে তর্জনী উচিয়ে বলতে লাগলাে, ‘থাকবেন পাকিস্তানে আর হিন্দুস্থানের কবির গুণগান করবেন, সেটি হবে না। পাকিস্তানে থাকতে হলে ইকবালের কথা বলতে হবে, নজরুলের কথা বলতে হবে। তারপরই ওরা একটা অভিনব স্লোগান তুললাে—রবীন্দ্রগােষ্ঠী মুর্দাবাদ, নজরুলগােষ্ঠী জিন্দাবাদ।
মঞ্চে উঠে ওরা এক টান মেরে রবীন্দ্রনাথের ছবিটি ছিড়ে ফেললাে। হারমােনিয়াম তবলা আছাড় দিয়ে ফেলে দিলাে। পকেট থেকে ছােরা বের করে আস্ফালন করতে লাগলাে। ফুলের বাগানে বুনাে শূয়ােরের মতাে ঢুকে ওরা সুন্দর অনুষ্ঠানটিকে লণ্ডভণ্ড করে দিয়ে গেলাে।
আমার সুরসিক বন্ধু অধ্যাপক আবদুল কাদির খান পুরাে ঘটনাটির প্রত্যক্ষদর্শীদের একজন ছিলেন। পরদিন প্রেসক্লাবের আড্ডায় বসে তিনি আগের দিনের রবীন্দ্রস্মৃতিবাসরে ওই বর্বরদের হামলার বর্ণনা দিচ্ছিলেন। রবীন্দ্রগােষ্ঠী মুর্দাবাদ, নজরুলগােষ্ঠী জিন্দাবাদ’ স্লোগানটির উল্লেখ করে তিনি বলছিলেন, আমাকে যদি জিজ্ঞেস করা হয় রবীন্দ্রনাথ বড়াে না, নজরুল বড়াে’ তা হলে আমি কি বলবাে জানেন? বলবাে—রবীন্দ্রনাথও বড়াে না, নজরুলও বড়াে না। বড়াে হচ্ছে লাঠি। লাঠি যার হাতে আছে তার চেয়ে বড়াে কেউ নেই!’
তখনাে বােমাবাজির ব্যাপক প্রচলন ঘটেনি। লাঠিবাজি করেই তখন গুণ্ডামি চলতাে, মাঝে মাঝে ছােরা বের করে ভয় দেখানােই যথেষ্ট হতাে। এ-রকম একদল লাঠিবাজ গুণ্ডাকেই ষাটের দশকে পূর্ব পাকিস্তানের শাসকরা এনএসএফ’ (ন্যাশনাল স্টুডেন্টস ফেডারেশন) নাম দিয়ে সংগঠিত করেছিলাে এবং এদের দিয়েই তারা নানা অপকর্ম করাতাে। নজরুলগােষ্ঠী জিন্দাবাদ’ বলে এরাই সেদিন রবীন্দ্রগােষ্ঠীকে শায়েস্তা করতে গিয়েছিলাে।
আসলে রবীন্দ্রনাথ বড়াে না নজরুল বড়াে’ এই মূঢ় প্রশ্নটি তুলে পাকিস্তানবাদীরা দীর্ঘকাল ধরে চূড়ান্ত মূঢ়তার প্রদর্শনী করেছে। গাঁয়ের স্কুলে পড়ার সময়ই রবীন্দ্র-নজরুলের এই দ্বৈরথ দেখেছি। নজরুল আর পাকিস্তানি জোশ তখন এক হয়ে গিয়েছিলাে। নজরুলের
৩১৩
নােবেল প্রাইজটি পাওয়ার কথা ছিলাে, হিন্দু আর ইংরেজরা মিলে ষড়যন্ত্র করে সেটি নজরুলের বদলে রবীন্দ্রনাথকে পাইয়ে দিয়েছে; নজরুলের পেছনে মেয়ে লাগিয়ে দিয়ে হিন্দুরা তাকে ভুলিয়ে-ভালিয়ে নিয়ে গেছে, তাকে দিয়ে হিন্দুয়ানি গান-কবিতা লিখিয়ে নিয়েছে। এ ধরনের হাস্যকর স্কুল বক্তব্য তাে গাঁয়ের অর্ধশিক্ষিত পাকিস্তানি জোশওয়ালা মানুষদের মুখে শুনেছিই, শহরের শিক্ষাভিমানীদের নজরুল চর্চাতেও হাস্যকরতার পরিচয় কম পাইনি।
আমাদের জেলা শহরে বিদগ্ধ সাহিত্যরসিক বলে পরিচিত একজন বক্তা তাে নজরুল জয়ন্তীর অনুষ্ঠানে দাড়িয়েই বলতে শুরু করতেন :
রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, আমার মাথা নত করে দাও হে তােমার চরণ ধূলার তলে। আর নজরুল বলেছেন, ‘বল বীর, চির উন্নত মম শির।’ এতেই বােঝা যায় যে, নজরুল হলেন পৌরুষের কবি আর রবীন্দ্রনাথ নিতান্ত দুর্বল আত্মনিবেদনপ্রবণ একজন কবি।…রবীন্দ্রনাথ সাম্প্রদায়িক, কেবল হিন্দুশাস্ত্রের নানা কথা নিয়ে গান-কবিতা লিখেছেন, মুসলমানের কথা কিছুই লিখেননি। নজরুল রবীন্দ্রনাথের মতাে সাম্প্রদায়িক ছিলেন না বলেই হিন্দুর পুরাণ নিয়েও কতাে কথা বলেছেন।…রবীন্দ্রনাথকে বিশ্বকবি বলা তাে একান্তই মিথ্যাচার। বিশ্বকবি বলা যায় শেক্সপীয়রকে। তিনি যে বলেছেন, কাওয়ার্ডস ডাই মেনি টাইমস বিফোর দেয়ার ডেথ…’ এটি হচ্ছে বিশ্বজনীন বাণী, বিশ্বের সকল মানুষের জন্যে তা সত্য, জাতিধর্ম নির্বিশেষে সর্বজনগ্রাহ্য। আর অন্যদিকে, হিন্দুদের উপনিষদে যে-সব কথা আছে সে-সবেরই পুনরাবৃত্তি করেছেন রবীন্দ্রনাথ। সেসব হচ্ছে হিন্দুদের বিশ্বাসের কথা, বিশ্বজনীন বাণী নয়। কাজেই রবীন্দ্রনাথ বিশ্বকবি হন কী করে?…তা ছাড়া পৃথিবীর সব বড়াে কবিরই একেকটি মাস্টারপিস থাকে। যেমন—ফেরদৌসির শাহনামা, শেক্সপীয়রের হ্যামলেট, গ্যেটের ফাউস্ট। রবীন্দ্রনাথের কি এমন কোনাে মাস্টারপিস আছে?…
এই বক্তাকে সমর্থন জানানাের মতাে লােকও ছিলাে কিছু। সারাদেশ জুড়েই এ-রকম ছিলাে। রবীন্দ্রনাথ-নজরুলের তুলনা করে নজরুলকে বড়াে আর রবীন্দ্রনাথকে ছােটো প্রমাণ করার জন্যে কতাে ধরনের কুযুক্তিই না ওরা উত্থাপন করতাে। এ-রকম করতে গিয়ে নজরুলের প্রকৃত মহত্ত্বকেই ওরা খর্ব করতাে, প্রতিনিয়ত তাঁকে খণ্ডিত ও বিকৃত করে তুলতাে, নিজেদের অসংস্কৃত মন ও হীনমন্যতারই পরিচয় রাখতাে।
ষাটের দশকেই ময়মনসিংহের ত্রিশাল ও কাজির সিমলায় কর্তৃপক্ষীয় উদ্যোগে নজরুল জয়ন্তী অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা করা হয়েছিলাে। সুস্থ নজরুল চর্চার সাধু উদ্দেশ্য এর পেছনে কতােটুকু ক্রিয়াশীল ছিলাে জানি না। তবে আমরা জানি : সে-সময় সারাদেশে একটি প্রগতিশীল সাংস্কৃতিক জাগরণ দেখা দিয়েছিলাে, রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলের সাহিত্যকর্ম থেকে প্রেরণা নিয়ে বাঙালির অসাম্প্রদায়িক সংস্কৃতি-চেতনার ধারাটি শক্তিশালী হয়ে উঠেছিলাে। পাকিস্তানবাদীরা নজরুলকে ব্যবহার করে বাঙালির সেই নবজাগ্রত চেতনাকেই ভোঁতা করে দিতে চেয়েছিলাে, প্রগতিশীল সংস্কৃতির ধারা-প্রবাহটিকে প্রতিরােধ করারই একটি মরিয়া প্রয়াস গ্রহণ করেছিলাে। ঢাকা থেকে শিল্পীদের এনে ত্রিশালে নজরুলসঙ্গীত পরিবেশন করা হতাে। সব রকম নজরুল সঙ্গীত নয়, কেবল যেগুলাে দিয়ে পাকিস্তানি ভাবাদর্শ প্রচার করা সম্ভব সেগুলােই। শুনেছি, ত্রিশালে প্রথমবারের নজরুল জয়ন্তী অনুষ্ঠানেই একজন সরকারি বক্তা বলেছিলেন :
নজরুল অনেক হামদ্-নাত রচনা করেছেন, অনেক ইসলামী গান ও কবিতা লিখেছেন। এ-সবই আমাদের পাকিস্তানের আদর্শকে মজবুত করে তুলেছে। কিন্তু নজরুল কিছু কিছু
৩১৪
খােদাদ্রোহী কথাও বলেছেন। তিনি ‘খােদার আসন আরশ’ ছেদন করতে চেয়েছেন, ভগবানবুকে পদচিহ্ন এঁকে দিতে চেয়েছেন। এ-সবই হচ্ছে বড়াে ধরনের গুনাহ্। এই গুনাহর জন্যেই আল্লাহ্ তাকে শাস্তি দিয়েছেন। তিনি আর এখন কথাই বলতে পারেন না, তার মস্তিষ্ক বিকৃত হয়ে গেছে।…আসুন, আমরা সকলে তার জন্যে দোয়া করি, আল্লাহ্ যেন তার গুনাহ্ মাফ করে দেন।
তবু, এ-সবের পরও, বলতেই হবে যে, নজরুলের বাল্যস্মৃতি-বিজড়িত ত্রিশাল ও কাজির সিমলায় যারা নজরুল জয়ন্তী উদ্যাপনের সাংবাৎসরিক ব্যবস্থাটির প্রবর্তন করেছিলেন, তারা একটি মহৎ কাজ করে গিয়েছেন। ওই গ্রামাঞ্চলের অতি সাধারণ মানুষরাও আজ নজরুলের কথা জানে। তারা জানে : নজরুলের মতাে একজন বড়াে কবি তাদেরই এলাকায় তার ছেলেবেলায় কিছুটা সময় কাটিয়ে গেছেন। এর জন্যে তাদের গর্বের অন্ত নেই। নজরুলের নামে তারা স্কুল করেছে, কলেজ করেছে, পাঠাগার প্রতিষ্ঠা করেছে। এলাকার তরুণরা নজরুলচর্চার প্রেরণা পাচ্ছে।
তাছাড়া, সেকালের পাকিস্তানি কর্তৃপক্ষীয় মহলের যে-রকম মতলবই থাকুক না কেন, নজরুলকে তারা তাদের সংকীর্ণ উদ্দেশ্যের ঘেরাটোপে আটকে রাখতে পারেনি।
পারেনি যে, ষাটের দশক শেষ হওয়ার আগেই তার প্রমাণ মিললাে। ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানের ধাক্কায় পাকিস্তানি অনেক বদমতলবের মতাে নজরুলের ‘পাকিস্তানিকরণের মতলবও ছিন্নভিন্ন হয়ে গেলাে। ঊনসত্তরের ত্রিশালে নজরুল জয়ন্তী উপলক্ষে যে অনুষ্ঠানটি হয়েছিলাে তাতে অধ্যাপক আলী নওয়াজ, শামসুজ্জামান খান, সেকান্দর হায়াৎ, রিয়াজুল ইসলামসহ ময়মনসিংহ শহর থেকে অনেকেই আমরা যােগ দিয়েছিলাম। এর আগের বছরগুলােতে এখানে নজরুল সম্পর্কে যে-ধরনের কথাবার্তা বলা হতাে সে-বারের কথাবার্তাগুলাে হলাে তার থেকে অন্য রকম। নজরুলের রচনায় হিন্দু-মুসলিম ঐতিহ্যের সম্মিলন, ধর্মান্ধ ও ধর্মব্যবসায়ীদের প্রতি নজরুলের ঘৃণা, শােষণ-নিপীড়নের বিরুদ্ধে তাঁর বিদ্রোহ, কৃষক-শ্রমিকের প্রতি তাঁর সংগ্রামী আহ্বান—এ-সব কথাই সেবারকার আলােচনায় উঠে এসেছিলাে। গ্রামের শ্রোতারা এসব শুনে উদ্দীপ্ত হয়ে উঠেছিলাে। আর তারই ফলে স্বাভাবিকভাবেই, প্রতিক্রিয়াশীলদের চিড়বিড়ানি শুরু হয়ে গিয়েছিলাে। মঞ্চের পেছনে বসে থাকা জেলা পর্যায়ের একজন কর্মকর্তা তাে পাশের একজনের সঙ্গে অনুচ্চকণ্ঠে, অথচ তীব্র রােষে, বলে যাচ্ছিলেন, নজরুলকে নিয়ে পলিটিকস্ করা হচ্ছে।…নজরুলকে নিয়ে এতাে মাতামাতি করার কী আছে?…পশ্চিমবঙ্গে কি এভাবে নজরুলজয়ন্তী উদযাপন করা হয়?….আমাদের সবকিছুতেই বাড়াবাড়ি। কথা বলতে গিয়ে আমাদের ঈমান-আকিদার কথা, আমাদের রাষ্ট্রের আদর্শের কথাও আমরা মনে রাখি না…।’

সংস্কৃতি ও ভাবাদর্শের সংগ্রামে কতিপয় অখ্যাত সৈনিক
আটচল্লিশ সাল থেকেই সাংস্কৃতিক আন্দোলনের ভেতর দিয়ে এদেশে পাকিস্তানের ভাবাদর্শবিরােধী সংগ্রাম চলে আসছিলাে। সে সংগ্রামের ইতিহাস আমাদের একেবারে অজানা নয়। বেশ কিছু বই-পুস্তকে সে ইতিহাস লেখা হয়েছে। তবে বই পুস্তক পড়ে যা জানা যায় তা একেবারেই মােটা দাগের কিছু তথ্য। সে-সব তথ্য মূলত রাজধানী-কেন্দ্রিক নানা কর্মকাণ্ডের,
৩১৫
ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইল আয়তন বিশিষ্ট ভূখণ্ডটির অন্য অন্য জনপদের খবর বই-পুস্তকে খুব কমই পাওয়া যায়। সন্দেহ নেই, দেশের বিভিন্ন স্থানে যতাে বড়াে বড়াে ঘটনাই ঘটুক না কেন, সে সবের চেয়ে রাজধানী-জাত অনেক ছােট ঘটনারও প্রভাব অনেক বেশি বড়াে হয়ে দেখা দেয়। রাজধানীর কেন্দ্র থেকে সে-সব ঘটনার প্রভাব দেশের অন্যত্র ছড়িয়ে পড়ে জাতীয় ঘটনার রূপ নেয়। রাজধানীর বাইরে প্রত্যন্ত এলাকার ঘােলা জলের ডােবায় খুব বড়াে ঢিল ছুঁড়ে মারলেও তার ঢেউ তাে ডােবার ভেতর পাক খেতে খেতেই মিলিয়ে যায়, জাতীয় তরঙ্গের রূপ নিতে পারে না। তাই, রাজধানী-কেন্দ্রিক কর্মকাণ্ডের বিবরণই যে লিখিত ইতিহাসের পাতায় সিংহভাগ জুড়ে থাকবে তা হয়তাে খুব অসঙ্গতও নয়, অস্বাভাবিকও নয়।
তবু, মানতেই হবে, ঢাকা-থেকে-সূচিত সংস্কৃতি-আন্দোলন ও ভাবাদর্শের সংগ্রাম মােটেই সফল হতাে না, যদি সেই আন্দোলন-সংগ্রামে দেশের সকল অঞ্চলের মানুষের সংযুক্তি না ঘটতাে। আর সে সংযুক্তি ঘটতেই পারতাে না, যদি সেই আন্দোলন সংগ্রামের বীজ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে আগে থেকেই পোঁতা না থাকতাে। কিন্তু, দুঃখ এই, সেই বীজ পোঁতার ইতিহাসকে আমরা যথাযথ মূল্য দিইনি, মফস্বল শহর বা-গ্রাম-গঞ্জের মানুষের চৈতন্যলােকের খোঁজ-খবর নেয়ার খুব একটা গরজ বােধ করিনি। একারণেই আমাদের মুক্তিসংগ্রামের অখণ্ড ইতিহাসটি অজানাই থেকে গেছে।
আমি এখানে সেই অজানা ইতিহাস উদ্ধারে ব্রতী হচ্ছি না, সে-যােগ্যতাও আমার নেই। আমি কেবল স্মৃতির জানালা খুলে ষাটের দশকের ময়মনসিংহ শহরটার দিকে একটু উকি দিয়ে দেখে নিচ্ছি।
চৌষট্টি সনেও ময়মনসিংহ শহরে পাকিস্তানবাদিদের তৈরি রবীন্দ্র-বিরােধিতার আবহ প্রত্যক্ষ করি। তবে সে-বিরােধিতাকে অগ্রাহ্য করার মতাে শক্তিও এখানে অনুপস্থিত ছিলাে না। এ-শহরে রবীন্দ্রচর্চার একটা অন্তঃশীল প্রবাহ দীর্ঘকাল ধরেই বিদ্যমান ছিলাে। উনিশ শাে ছাব্বিশ সালে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ময়মনসিংহে এসেছিলেন। অনেকগুলাে সভায় তিনি বক্তৃতাও দিয়েছিলেন। সে স্মৃতি রােমন্থন করার মতাে অনেক প্রবীণ ব্যক্তি সে-সময়েও, ষাটের দশকেও, জীবিত ছিলেন। তাঁদের অনুপ্রেরণায় সঞ্জীবিত থেকে রবীন্দ্র-চর্চায় উৎসাহী হয়ে উঠেছিলেন অনেক তরুণ সংস্কৃতি-কর্মিও। যেমন আলােকময় নাহা, নূরুল আনােয়ার, আনােয়ারুল হক, সুমিতা হােম রায়, নবনীতা চক্রবর্তী এবং এ-রকম আরাে অনেকে। তাদের মধ্যে নুরুল আনােয়ারের রবীন্দ্র-চর্চা ছিলাে সবচেয়ে গভীর ও দুঃসাহসী। এডভােকেট শামসুদ্দিন আহমেদের পুত্র নুরুল আনােয়ার তখন ছিলেন কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র। কৃষিবিদ্যায় তাঁর অনুরাগ কতােখানি ছিলাে, আমরা বলতে পারবাে না। তবে তার ক্রিকেট-অনুরাগ ও রবীন্দ্রঅনুরাগ ছিলাে স্বতঃপ্রকাশিত ও সর্বজনবিদিত। তরুণদের ক্রিকেট খেলায় উৎসাহিত করে তুলতে তার উৎসাহ ছিলাে প্রচণ্ড। এদের নিয়ে তিনি গড়ে তুলেছিলেন কাউন্টি ক্রিকেট ক্লাব। সে-ক্লাবের সদস্যদের নিয়েই তিনি তৈরি করেছিলেন আরেকটি সংগঠন ‘সন্ধান গােষ্ঠী। বাড়ির ছাদের ওপর কিংবা ব্রহ্মপুত্রের ধারে সার্কিট হাউস সংলগ্ন গীর্জার আমতলায় ‘সন্ধান গােষ্ঠী প্রতিবছর রবীন্দ্র জয়ন্তী উদযাপন করতাে। সন্ধান গােষ্ঠীর কর্ণধার নুরুল আনােয়ারের রবীন্দ্রচর্চাকে দুঃসাহসী বলছি এ কারণে যে, পঁয়ষট্টির পাক-ভারত যুদ্ধের পর ভারতের সঙ্গে বাণিজ্যিক লেনদেন প্রায় বন্ধ হয়ে গেলেও ভারত থেকে চোরাচালান করে রবীন্দ্র সঙ্গীতের পুরনাে গ্রামােফোন রেকর্ড আনাতেন তিনি। আমরা তাে জানি চোরাচালানি যারা করে তারা হয়
৩১৬
মূলত তেল নুন লাকড়ির কারবারি, বৈষয়িক লাভ-অলাভটাই হয় তাদের মুখ্য বিবেচনা। কিন্তু রবীন্দ্র সঙ্গীতের মতাে স্থল বৈষয়িকতার স্পর্শশূন্য নিতান্ত ‘আধ্যাত্মিক বিষয়ের চোরাচালানি নিয়ে কেউ মেতে থাকতে পারে, নুরুল আনােয়ার ছাড়া এ-রকম দৃষ্টান্ত বােধ হয় দ্বিতীয়টি পাওয়া যাবে না। রবীন্দ্রনাথের একটি গানই যে কতাে ভিন্ন ধারার গায়কী ঢঙে একাধিক শিল্পী গেয়েছেন, বিভিন্ন রেকর্ড থেকে তার তুলনামূলক বিচারে নুরুল আনােয়ারের ছিলাে সীমাহীন আগ্রহ। সঙ্গীতের ক্ষেত্রে নুরুল আনােয়ারের মতাে এমন শুদ্ধতাবাদী আমি খুবই কম দেখেছি। ক্রিকেটর বিভিন্ন প্রশ্ন নিয়ে যেমন ইংল্যান্ডের নেভিল কার্ডাস ও ভারতের শঙ্করীপ্রসাদ বসুর সঙ্গে পত্রালাপ করতেন, তেমনি রবীন্দ্র সঙ্গীতের বিভিন্ন খুঁটিনাটি প্রসঙ্গ নিয়ে তাঁর পত্রযােগাযােগ ছিলাে রবীন্দ্র-স্নেহধন্য ও রবীন্দ্রসঙ্গীত-বিশারদ শান্তিদেব ঘােষের সঙ্গে। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর তিনি এদেশের প্রখ্যাত রবীন্দ্র সঙ্গীত বিশেষজ্ঞ ও বিশিষ্ট বুদ্ধিজীবী ওয়াহিদুল হকের ঘনিষ্ঠ সান্নিধ্যে আসেন। রবীন্দ্র সঙ্গীতের অন্যতম প্রধান ভাণ্ডারী শৈলজারঞ্জন মজুমদারের স্নেহভাজন হন তিনি। শৈলজারঞ্জন যে বায়াত্তর সালের পর একাধিকবার ময়মনসিংহে এসেছেন এবং এখানকার ছেলেমেয়েদের রবীন্দ্র সঙ্গীত শিখিয়েছেন তাতে প্রধান প্রবর্তনা ছিলাে নুরুল আনােয়ারেরই।
সুমিতা হােম রায়দের পরিবারটি ছিলাে রবীন্দ্র-রসধারায় স্নাত, এবং বলতে গেলে, রবীন্দ্রপরিমণ্ডলেরই অন্তর্গত। সুমিতার এক জ্যাঠামশাই নীহাররঞ্জন রায় তাে বিশ্বখ্যাত মনীষী। তিনি শুধু ‘বাঙালির ইতিহাস’-এরই অমর লেখক নন, তাঁর রবীন্দ্র সাহিত্যের ভূমিকা রবীন্দ্র সমালােচনা সাহিত্যের একটি স্মরণীয় গ্রন্থ। সুমিতারই আরেক জ্যাঠা মশাই অমল হােম দীর্ঘদিন ধরে ছিলেন রবীন্দ্রনাথের একান্ত সচিব। তার পুরুষােত্তম রবীন্দ্রনাথ রবীন্দ্র ব্যক্তিত্বের পরিচয় জ্ঞাপক একটি চমৎকার বই।
রবীন্দ্র চর্চার এ-রকম উত্তরাধিকার নিয়েই সুমিতা ও তাঁর অন্যান্য ভাই-বােনেরা বেড়ে ওঠেন। রবীন্দ্র সঙ্গীতে এঁদের সবারই কিছু না কিছু দখল আছে। এদের মধ্যে সুমিতা সঙ্গীত চর্চায় বিশেষ অধিকার অর্জন করেন। উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের পাঠ নেন তিনি ময়মনসিংহের প্রখ্যাত সঙ্গীতগুরু মিথুনদের কাছে। একাত্তরের স্বাধীনতাযুদ্ধের সময়ে আকাশ বাণীর কোলকাতা কেন্দ্র থেকে অতিথি শিল্পী রূপে সঙ্গীত পরিবেশন করে বিশেষ কৃতির পরিচয় রাখেন।
ষাটের দশকে সুমিতাদের বাসায় প্রতি বছর রবীন্দ্রজয়ন্তী উদযাপিত হতাে সমস্ত রকম বিরােধিতাকে উপেক্ষা করে। সেখানে অনেকের সঙ্গে আলােকময় নাহাও এসে যােগ দিতেন। আলােকময় নাহা ছিলেন স্বাভাবিক সঙ্গীত-প্রতিভার অধিকারী একজন উঁচু মানের শিল্পী। এক সময়ে তাে ময়মনসিংহে রবীন্দ্রসঙ্গীত আর আলােকময় নাহা যেন একাৰ্থবােধক হয়ে উঠেছিলাে। রবীন্দ্রসঙ্গীতের কথা বলতেই আলােকময় নাহার চেহারাটি সকলের চোখের সামনে ভেসে উঠতাে। পরে যখন আলােকময় নাহা আর সুমিতা হােমরায় পরিণত সূত্রে আবদ্ধ হলেন, তখন ময়মনসিংহের সকলের নিকটই এই দম্পতিকে রাজযােটক বলে মনে হয়েছিলাে। এই শিল্পী দম্পতির কাছে সকলের প্রত্যাশা ছিলাে অনেক। কিন্তু হায়, একানব্বইয়ের ডিসেম্বরের আট তারিখে আলােকময় নাহার অকাল ও আকস্মিক মৃত্যু সকলকে চরমভাবে আশাহত ও বেদনাবিধুর করে তুললাে। সুমিতা হােম রায় সুমিতা নাহা হয়ে সেই বেদনার স্মৃতিকেই ধরে রাখলেন।
সঙ্গীত-সংস্কৃতির সৃষ্টিশীল চর্চার পাশাপাশি মননচর্চাতেও ষাটের দশকে নতুন গতিবেগের সঞ্চার ঘটে। মননচর্চার জন্যে সবচেয়ে প্রয়ােজনীয় উপাদান বই। বইয়ের জন্যে গণপাঠাগারের
৩১৭
সহায়তা তাে অপরিহার্যই। তবু ব্যক্তিগত পুস্তকসংগ্রহের যে একটি ভিন্ন মাত্রা আছে তা অস্বীকার করা যাবে না। ষাটের দশকের ময়মনসিংহে পুস্তকসংগ্রহের মধ্যে মননের সেই মাত্রাটিরই প্রকাশ ঘটিয়েছিলেন শহরের সানকিপাড়া এলাকার অধিবাসী আনােয়ারুল হক। নূরুল আনােয়ার যেমন দুঃসাধ্য সাধনায় ভারত থেকে রবীন্দ্রসঙ্গীতের রেকর্ড সংগ্রহ করে আনতেন, নানা বিষয়ের গ্রন্থ সংগ্রহে আনােয়ারুল হকেরও ছিলাে তেমনি দুঃসাধ্য সাধনা। গ্রন্থনির্বাচন ও সংগ্রহেই শুধু তিনি রুচি, যত্ন ও অধ্যবসায়ের পরিচয় দেননি, গ্রন্থ সংরক্ষণে তার নিপুণ প্রযত্নও যে কারাে মনে সম্ভ্রমের উদ্রেক করে। তার এই বিপুল ও অমূল্য সংগ্রহকে শুধু যখের ধনের মতাে নিজের জন্যেই আগলে রাখেন নি, ময়মনসিংহের যে কোনাে অনুসন্ধিৎসু মানুষের জন্যেই তাঁর গ্রন্থাগারের দরজা তিনি খুলে দিতেন। এখানকার সাংস্কৃতিক আন্দোলনে ও পাকিস্তান-বিরােধী ভাবাদর্শের সংগ্রামে আনােয়ারুল হকের ব্যক্তিগত গ্রন্থাগারটির ভূমিকাকে খাটো করে দেখা মােটেই ঠিক হবে না।
প্রখ্যাত আইনব্যাখ্যাতা ও বিদগ্ধ রসজ্ঞ গাজী শামছুর রহমান ষাটের দশকের শেষের দিকে ময়মনসিংহে এসেছিলেন এডিশনাল ডিস্ট্রিক্ট জজ হয়ে। এ-রকম পদাধিকারী ব্যক্তিরা সাধারণত ‘পাবলিকে’র ছোঁয়া এড়িয়ে চলেন। কিন্তু গাজী শামছুর রহমান হলেন সম্পূর্ণ ব্যতিক্রমী ও ভিন্নধর্মী একজন মানুষ। বয়স ও পদমর্যাদার কথা ভুলে গিয়ে তিনি আমাদের আড্ডায় ভিড়ে গেলেন। অথচ আমাদের আডড়াগুলাে মােটেই ‘নির্দোষ ছিলাে না। তখন আমরা নিতান্ত অলস ও লক্ষহীন বিশ্রম্ভালাপের জন্যে মিলিত হতাম না। অনেক সিরিয়াস বিষয়, এবং তখনকার রাষ্ট্রশক্তির বিবেচনায় একান্ত নিষিদ্ধ ও বিপজ্জনক বিষয়ই, আমাদের আড্ডায় উঠে আসতাে।
এ-সময় আমরা একটি অনামী পাঠচক্র বা আলােচনাচক্র গড়ে তুলেছিলাম। সেই চক্রের চক্রধর হয়ে পড়েছিলেন গােলাম সামদানী কোরায়শী। বিস্ময়কর মানুষ ছিলেন এই সামদানী।
সামদানী সাহেব আটষট্টির শেষ দিকে আমারই সহকর্মি রূপে নাসিরাবাদ কলেজের বাংলা বিভাগে যােগ দেন। এর আগে কয়েক বছর ধরে বাংলা একাডেমীতে তিনি ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লার সঙ্গে পূর্ব পাকিস্তানের আঞ্চলিক ভাষার অভিধান সংকলনের কাজ করেন। ডক্টর কাজী দীন মুহম্মদ বাংলা একাডেমীর পরিচালক নিযুক্ত হওয়ার পর (তখনাে ‘মহাপরিচালক পদটির সৃষ্টি হয়নি) সামদানী সাহেব একাডেমীতে খুব স্বাচ্ছন্দ্য বােধ করেননি। তাই, বাংলা একাডেমী তথা ঢাকা ছেড়ে তিনি ময়মনসিংহে চলে এলেন।
গােলাম সামদানী কোরায়শী ছিলেন ‘মমতাজুল মােহাদ্দেসিন’ উপাধিধারী জবরদস্ত মওলানা । ওল্ড স্কিম মাদ্রাসার পড়াশােনা শেষ করে তিনি সেকুলার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তি হন, এবং শেষ পর্যায়ে বাংলায় এমএ পাস করেন। মূল আরবি, পার্সি ও উর্দু থেকে অনেক বইয়ের তিনি অনুবাদ করেছেন। অনুবাদ সাহিত্যে তাঁর অক্ষয় কীর্তি ইবনে খলদুনের ‘আল মুকাদ্দিমা’।
আমি যখন সামদানী সাহেবকে আমার সহকর্মি রূপে পেলাম তখন অবাক বিস্ময়ে লক্ষ করলাম যে, মাদ্রাসায় পড়া এই মানুষটি গোড়া মােল্লা তাে ননই, প্রচলিত অর্থে ধর্মবিশ্বাসীও নন। নাস্তিক না হলেও প্রচণ্ড সংশয়বাদী। ব্যক্তিত্ব অত্যন্ত দৃঢ়, অথচ হৃদয়টি তার একান্তই কোমল। ধর্মীয় বিষয়ে সীমাহীন পাণ্ডিত্য, অথচ ধর্মের কঠোর সমালােচক।
আমার মার্কসবাদী দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে প্রথম দিকে প্রায়ই তার ঠোকাঠুকি লেগে যেতাে। ধর্ম সম্পর্কে নির্মোহ হয়েও মার্কসবাদকে তিনি মেনে নিতে পারেননি।
৩১৮
এরপর দীর্ঘদিন তাঁর সঙ্গলাভ করেছি। বলা উচিত : প্রায় সার্বক্ষণিক সঙ্গী হয়ে উঠেছিলাম আমরা দু’জন। নানা বিষয়ে মতান্তর হয়েছে, কিন্তু মনান্তর হয়নি একদিনের জন্যেও। এক সময় তাে দু’জনেই লক্ষ করলাম যে আমাদের মধ্যে মতান্তরও প্রায় অবশিষ্ট নেই। আমি যে তার কাছে কতাে কিছু শিখেছি তার সঠিক বিবরণ দেয়ার সাধ্য আমার নেই। বিশেষ করে ইসলামের ইতিহাস ও দর্শনের নানা খুঁটিনাটি বিষয়ে প্রশ্ন করে করে সব সময় আমি তাঁকে ব্যতিব্যস্ত রেখেছি। তিনি আমার সকল জিজ্ঞাসার জবাব দিয়েছেন পরম আন্তরিকতায়। আমাদের যৌথ অনুশীলনের এক পর্যায়ে দেখলাম : তিনি ডায়ালেকটিক বস্তুবাদকে তাঁর জীবন দর্শনের অঙ্গীভূত করে নিয়েছেন, কিন্তু তাই বলে মানবিক জ্ঞানের কোনাে উত্তরাধিকারকেই বর্জন করেননি। বিভিন্ন সভায় বা ঘরােয়া আলােচনায় তিনি প্রায়ই বলতেন, আমার গুরু হচ্ছেন সাতজন। প্রথম গুরু সক্রেটিস, দ্বিতীয় গুরু শ্রীকৃষ্ণ, তৃতীয় গুরু গৌতম বুদ্ধ, চতুর্থ গুরু যীশু খ্রীষ্ট, পঞ্চম গুরু হযরত মুহম্মদ (দঃ), ষষ্ঠ গুরু কার্ল মার্কস এবং সপ্তম গুরু একান্তই আমার নিজের আমার পিতা।
অপরীক্ষিত জীবন তাে যাপনের উপযুক্তই নয়’ (A life un-examined is not worth living) সক্রেটিসের এই বক্তব্যকে তিনি সারা অন্তর দিয়ে বিশ্বাস করতেন। সেই বিশ্বাস থেকেই সারা জীবন চালিয়েছেন আত্মসমীক্ষা। তার বিশ্বাস ও আচরণের মধ্যে কখনাে কোনাে ফাঁক দেখা যায়নি। অন্যায় দেখলে তিনি প্রচণ্ড ক্রোধে ফেটে পড়তেন। কোনাে অন্যায়ের প্রতিকার না করতে পারলে তিনি খুবই কষ্ট পেতেন, সেই কষ্টের অভিব্যক্তি তার চোখে মুখে ফুটে উঠতাে, রাগে কাঁপতে থাকতেন। মহানবি বলেছেন—অন্যায়কে প্রতিরােধ করবে, যদি না পারাে তবে প্রতিবাদ করবে, তাও যদি না পারাে তবে অন্তত মনে মনে ঘৃণা করবে। শেষেরটুকু হচ্ছে দুর্বলতম ঈমানের লক্ষণ, এটুকু না করলে ঈমানের কিছুই অবশিষ্ট থাকে না।
সামদানী সাহেব যথার্থ ঈমানদার ছিলেন বলেই দুর্বলতম ঈমান নিয়ে সন্তুষ্ট থাকতে পারতেন না। পাকিস্তানকে তিনি একটি বে-ঈমানি রাষ্ট্র বলেই শনাক্ত করতে পেরেছিলেন। তাই, পাকিস্তানি ভাবাদর্শ-বিরােধী সংস্কৃতি-সংগ্রামের সঙ্গে কায়মনােবাক্যে যুক্ত না হয়ে তিনি পারেননি। ময়মনসিংহে সে-সংগ্রামে তাঁর ভূমিকা ছিলাে খুবই উজ্জ্বল।

উনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানের কথা
পঁয়ষট্টির দোসরা জানুয়ারিতে মৌলিক গণতন্ত্রীদের ভােটে আইউব খান প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ায় এবং সম্মিলিত বিরােধী দলের প্রার্থী ফাতেমা জিন্নাহ হেরে যাওয়ায়, জনগণ আইউবউদ্ভাবিত মৌলিক গণতন্ত্রের স্বরূপটি পুরােপুরি চিনে নিতে পারে। সবাই বুঝে নেয় : তথাকথিত এই মৌলিক গণতন্ত্রে গণতন্ত্রের ছিটেফোঁটাও নেই, এ ব্যবস্থায় কোনাে দিনই প্রকৃত গণপ্রতিনিধি নির্বাচিত হওয়ার বিন্দুমাত্র সম্ভাবনাও নেই। তাই, এরপর যখন মৌলিক গণতন্ত্রীদের ভােটেই পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদ ও প্রাদেশিক পরিষদ নির্বাচনের অনুষ্ঠান হয় তখন জনসাধারণ তাতে কোনােই আগ্রহ দেখায় না। পঁয়ষট্টির প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের অভিজ্ঞতাই তাদের প্রকৃত গণতান্ত্রিক নির্বাচনের সঙ্গে ওই ভূয়া মৌলিক গণতান্ত্রিক নির্বাচনের পার্থক্যটি বুঝিয়ে দেয়।
আবার পঁয়ষট্টির সেপ্টেম্বরের পাক-ভারত যুদ্ধ পূর্ব পাকিস্তানের মানুষকে শিক্ষা দেয় যে, হাজার মাইল দূরে অবস্থান করে পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকার কোনাে মতেই পূর্ব পাকিস্তানের
৩১৯
নিরাপত্তা দিতে পারবে না। তাই এ অঞ্চলের পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন চাই-ই চাই। বাঙালি জনগণের এই চাওয়াকেই মূর্তরূপে উপস্থাপন করে শেখ মুজিবের ছয় দফা।
পাকিস্তানি শাসকগােষ্ঠী এই ছয় দফাকে আঁতুড়েই হত্যা করতে চাইলাে, এর বিরুদ্ধে অস্ত্রের ভাষা প্রয়ােগের হুমকি দিলাে। কিন্তু সবই যখন ব্যর্থ হলাে, শক্রর মুখে ছাই দিয়ে দু’বছরেরও কম সময়ের মধ্যে এই ছয় দফা যখন যৌবনের অমিত তেজ নিয়ে স্পর্ধিত হয়ে উঠলাে, তখন আইনের অস্ত্র দিয়ে একে ধ্বংস করা যায় কিনা শাসকরা তা-ই পরখ করে দেখতে চাইলাে। তারা শেখ মুজিবকে প্রধান আসামী করে সামরিক বেসামরিক কিছু কর্মচারি ও অন্যান্য পেশার পঁয়ত্রিশ জন বাঙালির বিরুদ্ধে স্পেশাল ট্রাইব্যুনালে একটি মামলা দায়ের করলাে। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা নামে পরিচিত এই মামলায় অভিযােগ আনা হলাে : এই আসামীরা ভারতের আগরতলায় বসে পাকিস্তানের অখণ্ডতার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করেছে, ভারতের সাহায্যে পূর্ব পাকিস্তানকে বিচ্ছিন্ন করার চক্রান্ত এঁটেছে।
পাকিস্তানি শাসকরা বােধহয় ভেবেছিলাে যে ভারতের সঙ্গে মিলে শেখ মুজিবরা পাকিস্তান বিরােধী ষড়যন্ত্র করেছিলাে—এমন কথা শুনেই পূর্ব পাকিস্তানের মুসলমানরা মুসলমানি জোশে আক্রান্ত হয়ে পড়বে, পাকিস্তানের অখণ্ডতা রক্ষার জন্যে কোমর বাঁধবে, শেখ মুজিবদের দুশমন বলে ঠাওরাবে, আর তারই পরিণামে ছয় দফার দফারফা হয়ে যাবে। অথচ, কী আশ্চর্য, ঘটলাে তার উল্টোটা। পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালিরা পাকিস্তানি শাসকদের দায়ের করা মামলাকে মিথ্যা মামলা বলে জেনেই ওদের সব অভিযােগ প্রত্যাখ্যান করলাে । কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে এই মামলাই আবার এ অঞ্চলের মানুষের সুপ্ত স্বাতন্ত্র-চেতনাকে জাগিয়ে তুললাে। সে সময়ে সংবাদপত্রের পাতায় আমরা রােজ অধীর আগ্রহে মামলার ধারাবিবরণী পড়েছি। পড়তে পড়তে ক্ষুব্ধ, ক্রুদ্ধ, উত্তেজিত হয়েছি। আবার উৎসাহিত ও স্বপ্নাতুরও হয়েছি। ক্ষুব্ধ হয়েছি পাক শাসকদের মিথ্যাচারে। ক্রুদ্ধ ও উত্তেজিত হয়েছি মামলার আসামীদের প্রতি ওদের বর্বর নির্যাতনের কথা শুনে। উৎসাহিত হয়েছি অভিযুক্ত ব্যক্তিদের জবানবন্দিতে নির্ভীকতা ও দেশপ্রেমের পরিচয় পেয়ে। আর শাসকদের মিথ্যা অভিযােগটিই যদি সত্য হয়ে উঠতাে তাহলে কেমন হতাে, সে কথা কল্পনা করে স্বপ্নাতুর হয়ে উঠেছি। পত্রিকার পাতায় অভিযােগের বিবরণ পড়ে অনেকের চোখেই স্বাধীনতার স্বপ্ন চকচক করে উঠতে দেখেছি।
অভিযােগকারী সরকার ও তার পক্ষের রাজসাক্ষীরা বলেছে : চৌষট্টি সাল থেকেই করাচিতে ‘স্বাধীন পূর্ব বাংলা প্রতিষ্ঠার ষড়যন্ত্রটি শুরু হয়েছিলাে, এরপর পঁয়ষট্টি ও ছেষট্টিতে ঢাকা ও চট্টগ্রামে কয়েকটি সভায় সে ষড়যন্ত্র পাকাপােক্ত করে তােলা হয়, সাতষট্টির বারাে জুলাই আগরতলায় ভারতীয় কর্তৃপক্ষের সঙ্গে বৈঠকে তার চূড়ান্ত রূপ দেয়া হয়ে যায়। ওই ষড়যন্ত্রকারীরা নাকি তাদের পরিকল্পনা সফল করার জন্যে বেশ বড়াে ধরনের কর্মসূচি গ্রহণ। করে। সে-কর্মসূচিতে পাকিস্তানের সামরিক-বেসামরিক কর্মচারিদের দলভুক্ত করার কথা যেমন ছিলাে, তেমনি ছিলাে ভারত থেকে অস্ত্র আমদানির কথাও। দেশে প্রচণ্ড রাজনৈতিক অসন্তোষ সৃষ্টি করে উপযুক্ত সময়ে ক্ষমতা দখল তথা স্বাধীনতা ঘােষণার প্রস্তুতিও তারা গ্রহণ করে রেখেছিলাে, আর সে জন্যে ভারত ছাড়া অন্য রাষ্ট্র থেকেও নাকি বৈষয়িক সাহায্য পেয়েছিলাে।
ঢাকার খবরের কাগজগুলাে—বিশেষ করে ইত্তেফাক’ ও ‘সংবাদ’ষড়যন্ত্র মামলার শুনানির বিবরণ অত্যন্ত বিস্তৃতভাবে ও মর্মস্পর্শী ভাষায় তুলে ধরতে লাগলাে। সব আডডায় ও সমাবেশে চললাে কেবল এই মামলারই আলােচনা।
৩২০
কলেজে আমার সহকর্মী কিংবা আশপাশের পরিচিতজনদের মধ্যে যাদের কট্টর পাকিস্তানবাদী বলে জানতাম, ওই মামলা চলার সময়ে তাদেরও পাকিস্তানপ্রীতি শিথিল হয়ে পড়তে দেখলাম। আর তরুণ প্রজন্ম যে পাকিস্তানবাদকে পুরােপুরি প্রত্যাখ্যান করার দিকেই অগ্রসর হচ্ছে তা আর গােপন রইলাে না।
পাকিস্তানি শাসকরাই কি আগরতলা ষঢ়যন্ত্রের কল্পিত কাহিনী প্রচার করে বাঙালি জনগণের মনে স্বাধীনতার সুপ্ত বাসনাকে জাগ্রত করে দিলাে না? বাঙালিরা তখনাে যা করেনি তা করার জন্যেই কি পাকিস্তান তাদের মানসিকভাবে প্রস্তুত করে তুললাে না? একাত্তরে বাঙালিদের সশস্ত্র মুক্তিযােদ্ধা হওয়ার পরােক্ষ অনুঘটকের কাজটি কি উনসত্তরেই পাকিস্তানি শাসকরা করে রাখলাে না?
উনসত্তরের জানুয়ারির গােড়াতেই ছাত্ররা ঘােষণা করলাে এগারাে দফা। এই এগারাে দফা শুধু শেখ মুজিবের ছয় দফাকে সম্পূর্ণতা দিয়ে বাঙালি জাতির স্বাধিকার-চেতনাকেই পুষ্ট করে তুললাে না, পাকিস্তানি শাসনমুক্ত ভবিষ্যত বাংলাদেশের আর্থসামাজিক রূপরেখাটিও জনগণের সামনে তুলে ধরলাে। যদিও বাংলাদেশ নামে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সুস্পষ্ট দাবি তখনাে কেউই উচ্চারণ করেনি, তবু বাঙালি জাতির স্বাধীনতার অন্তঃসারকে ধারণ করেই সংঘটিত হয়েছিলাে উনসত্তর সালের এগারাে দফা-ভিত্তিক গণঅভ্যুত্থান। এই গণঅভ্যুত্থানই তথাকথিত আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার নামে-জারি-করা সকল পাকিস্তানি ষড়যন্ত্র ছিন্নভিন্ন করে দিলাে, বাঙালি-স্বার্থবিরােধী কতিপয় বাঙালি মন্ত্রী ও নেতাসহ আগরতলা মামলার প্রধান বিচারপতির বাসভবনে আগুন লাগিয়ে দিলাে, শেখ মুজিবসহ মামলার আসামীদের মুক্ত করে নিয়ে এলাে। ঊনসত্তরের গণআন্দোলন পর্বেই, জানুয়ারির বিশ তারিখে, শহীদ হলেন ছাত্রনেতা আসাদ। চব্বিশ তারিখে ইস্কুল ছাত্র মতিয়ুর ও শ্রমিক রুস্তম। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার বিচারাধীন বন্দি সার্জেন্ট জহুরুল হক ক্যান্টনমেন্টে নির্মমভাবে নিহত হলেন ফেব্রুয়ারির পনেরাে তারিখে, আর বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে হত্যা করা হলাে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ডক্টর শামসুজ্জোহাকে।
ময়মনসিংহ শহরে আন্দোলনের উত্তাল রূপটি প্রত্যক্ষ করেছিলাম চব্বিশে জানুয়ারি। রাজপথের মিছিলে পুলিশ গুলি করে হত্যা করলাে আমারই একান্ত প্রিয় ছাত্র আলমগীর মনসুরকে, যার ডাক নাম ছিলাে মিন্টু। মিন্টু হত্যার পরে একশাে চুয়াল্লিশ ধারার নিষেধ বিধি উপেক্ষা করে রাজপথে ছাত্রজনতার যে রকম উত্তাল তরঙ্গের সৃষ্টি হলাে, তেমনটি ময়মনসিংহ শহরে এর আগে কেউ দেখেনি। পুলিশের উদ্যত বন্দুকের সামনে ছাত্ররা জামার বােতাম খুলে বুক পেতে দিয়ে বললাে, ‘গুলি ছুঁড়াে, আমাদের বুকেও গুলি ছুঁড়াে।’
এ-রকম অকুতােভয় তারুণ্যের মুখােমুখি হয়ে পুলিশের হাত আর সেদিন বন্দুকের ট্রিগার স্পর্শ করতে পারেনি। শুনেছি, পুলিশও নাকি সেদিনকার অভিনব পরিস্থিতিতে এক ইতিবাচক আবেগে আপ্লুত হয়ে উঠেছিলাে।
কর্তৃপক্ষ একশাে চুয়াল্লিশ ধারা তুলে নিতে বাধ্য হলাে। মিন্টুর মরদেহ নিয়ে যে বিরাট শােভাযাত্রা বের হয়েছিলাে, প্রথাসম্মতভাবেই তা ছিলাে মৌন—কোনাে স্লোগান সেদিন। রাজপথকে প্রকম্পিত করে তােলেনি। কিন্তু মৌনের শক্তি স্লোগানের মুখরতাকে অনেক দূর ছাড়িয়ে গিয়েছিলাে। মৌনমুখর’ কথাটির তাৎপর্য বােধহয় আমি প্রথম স্পষ্ট উপলব্ধি করেছিলাম আমার স্নেহভাজন ছাত্র মিন্টুর শােক মিছিল দেখেই।
৩২১
আমার ভাবাবেগ সেদিন মাত্রা ছাড়িয়ে গিয়েছিলাে। অজাতশত্রু কিশাের ছাত্রটি হাসতে হাসতে জীবন দিয়েছিলাে, তার সতীর্থরা তার মরদেহ স্পর্শ করে দেশমাতৃকার দুর্দশামােচনের শপথ গ্রহণ করলাে, আর আমি তার শিক্ষক হয়ে কী করলাম? শ্রেণীকক্ষে কিংবা বক্তৃতামঞ্চে অনেক বড়াে বড়াে কথা বলি, কিন্তু আজ সে-সব আমার নিজের কাছেই একান্ত অন্তঃসারশূন্য গলাবাজি বলে মনে হলাে, আত্মধিক্কারে জর্জরিত হওয়া ছাড়া আমার আর কোনাে উপায় রইলাে না।
প্রিন্সিপালের তলব পেয়ে সন্ধ্যায় কলেজে গিয়ে আরেক ধরনের অভিজ্ঞতার মুখােমুখি হলাম। কলেজের কেরানিরা কাগজপত্র ঘেঁটে কিছুতেই এমন প্রমাণ সংগ্রহ করতে পারছেন না যে, আলমগীর মনসুর মিন্টু নামক নিহত ছাত্রটি নাসিরাবাদ কলেজ থেকে ট্রান্সফার সার্টিফিকেট নিয়ে আগেই অন্যত্র চলে গিয়েছিলাে। অথচ, মরার সময় মিন্টু যে এ-কলেজের ছাত্র ছিলাে না, এ-কথা প্রমাণ করতে না পারলে এ কলেজের ওপর সরকারি গজব নেমে আসবে। প্রশাসন কর্তৃপক্ষ না-কি এমন কথা বলেই বারবার প্রিন্সিপালকে টেলিফোনে ধমকাচ্ছেন। প্রিন্সিপালসহ আমার সকল সহকর্মী মুখ ব্যাজার করে বসে আছেন—নিহত ছাত্রের শােকে নয়, কলেজের ওপর গজব পড়ার ও নিজেদের জীবিকাচ্যুতির আশঙ্কায়। আমরা সবাই জানতাম যে, তখনকার গণবিরােধী শাসকদের হাতে সে-রকম আশঙ্কা অচিরেই বাস্তব হয়ে ওঠা মােটেই অসম্ভব নয়। তবু হঠাৎ আমার মুখ দিয়ে কিছু বেফাঁস কথা বেরিয়ে গেলাে। ভবিষ্যতে যা হবার হবে, এই মুহূর্তে আমাদের কর্তব্য হচ্ছে আমাদেরই ছাত্র মিন্টুর জন্যে অন্তত আনুষ্ঠানিক শােক প্রকাশ করা। তার হত্যার প্রতিবাদ বা নিন্দা করার সাহস আমাদের না থাকতে পারে, কিন্তু নিহত ছাত্রটির জন্যে শােক প্রকাশ না করে যদি সে আমাদের ছাত্র ছিলাে না সে-কথা প্রমাণের জন্যেই ব্যস্ত হয়ে পড়ি, তবে তা মােটেই শিক্ষকসুলভ আচরণ হবে না। এই ক’টি কথা বলতে গিয়ে আমার কণ্ঠস্বর বােধহয় অস্বাভাবিক ও বিকৃত হয়ে গিয়েছিলাে। সকলেই তাতে হকচকিয়ে গিয়েছিলেন। প্রিন্সিপাল সাহেব মুখ কালাে করে মােনাজাতের জন্যে দু’হাত তুলে বললেন, আসুন, আমরা মিন্টুর রুহের মাগফেরাত কামনা করি।’
এর দু’তিন দিন পরই প্রিন্সিপাল সাহেব আবার শিক্ষকদের মিটিং ডাকলেন। বললেন, ছাত্ররা ক্লাসে আসছে না। শুধু আমাদের কলেজে নয়, সব স্কুল-কলেজেই। তবু, আমাদের কলেজটির ওপরই প্রশাসনের বিষ নজর পড়েছে। আমাদের কলেজের ছাত্ররাই নাকি বেশি উচ্ছংখল, ওরাই নাকি শহরের সব স্কুল-কলেজের ছাত্রদের উস্কানি দেয়।…প্রশাসনের নির্দেশ : আমাদের সকলকে বাড়ি বাড়ি গিয়ে ছাত্রদের ও তাদের অভিভাবকদের বােঝাতে হবে, ছাত্রদের ক্লাসে নিয়ে আসার চেষ্টা করতে হবে, তা না হলে….।
আমি বললাম, ‘বর্তমান আন্দোলনটি হচ্ছে সম্পূর্ণ রাজনৈতিক। রাজনৈতিক দাবি-দাওয়ার ভিত্তিতেই ছাত্ররা ক্লাস বর্জন করছে। শিক্ষক হিসেবে কোনাে রূপ রাজনীতির সঙ্গেই আমাদের সংশ্রব নেই। এখন যদি আমরা ছাত্রদের ক্লাসে নিয়ে আসার জন্যে তাদের বা অভিভাবকদের বােঝাতে যাই, তবে আমরাও তাে এক পক্ষের রাজনীতির সঙ্গে জড়িয়ে গিয়ে বিতর্কিত হয়ে পড়বাে। এ রকমটি আমরা হতে যাবাে কেন? আমরা নিজেরা তাে আর ক্লাস বর্জন করিনি, ছাত্ররা ক্লাসে উপস্থিত হলে আমরা তাদের পড়াবােই, তা না করে…।’
আমার কথা শেষ করতে না দিয়েই প্রিন্সিপাল সাহেব চিৎকার করে উঠলেন, আপনি সাবধান হয়ে যান যতীন বাবু। আপনার মতাে শিক্ষকদের জন্যেই বিপদ-আপদ এসে পড়ে।
৩২২
তলে তলে রাজনীতি করেন, আর মুখে বলেন যে, রাজনীতির সঙ্গে কোনাে সংশ্রব নেই। আপনার বিরুদ্ধে অনেক রিপাের্ট আছে, আপনি…।
সহকর্মী বন্ধু সেকান্দর হায়াত আমার পক্ষে দু’এক কথা বলতে যাচ্ছিলেন। তিনিও প্রিন্সিপাল সাহেবের ধমক খেয়ে বসে পড়লেন।
ফেব্রুয়ারি মাসের শুরুতে আন্দোলন আরাে প্রচণ্ড রূপ ধারণ করলাে। সব স্কুল-কলেজ অনির্দিষ্টকালের জন্যে বন্ধ। এ সময়েই একদিন প্রিন্সিপাল সাহেব আমাকে বাড়ি থেকে ডেকে আনালেন। বললেন, ‘সেদিন আমি মানসিকভাবে খুবই বিপর্যস্ত ছিলাম। সে-অবস্থায় আপনাকে কিছু অবাঞ্ছিত ও কটু কথা বলে ফেলেছি বলে আমি খুবই দুঃখিত।
এরপর তিনি নেপথ্যের কিছু বিষয় বিবৃত করলেন।
আড়াই বছর আগে বাংলা নববর্ষের অনুষ্ঠানে বাংলা ও বাঙালি সংস্কৃতির কথা বলায় আমাকে রাষ্ট্রবিরােধী ও ভারতীয় অনুপ্রবেশকারী বলে চিহ্নিত করেছিলেন যে জেলা কর্মকর্তাটি, তিনিই প্রিন্সিপাল রিয়াজউদ্দিন আহমদ সাহেবের কাছে আমার বিরুদ্ধে অনেকদিন ধরে অনেক কথা বলে যাচ্ছিলেন। মিন্টু নিহত হওয়ার পর ময়মনসিংহের ছাত্ররা অনেক বেশি জঙ্গি হয়ে ওঠায় আমার বিরুদ্ধে ওই কর্মকর্তাটির আক্রোশ একেবারে সীমা ছাড়িয়ে গেছে। তার বিশ্বাস, আমিই পেছন থেকে নাসিরাবাদ কলেজের ছাত্রদের নষ্ট করছি, তা না হলে ছাত্ররা এতাে বেপরােয়া হয়ে উঠতাে না।
রিয়াজউদ্দিন সাহেব বললেন, ‘সেদিন সকালেও ওই কর্মকর্তাটি টেলিফোনে আমাকে আপনার সম্পর্কে এ-সব কথাই বলেছিলেন। আপনার বিরুদ্ধে কোনাে ব্যবস্থাই নিচ্ছি না এ বলে আমাকে দোষারােপ করছিলেন।…বলতে গেলে আমাকে হুশিয়ারই করে দিচ্ছিলেন।…এই সব নানা কারণে আমার টেনশন বেড়ে গিয়েছিলাে, তাই সেদিন আপনাকে…।
প্রিন্সিপাল সাহেবের মুখে আমার সম্পর্কে কানে খাটো’ জেলা কর্মকর্তাটির ধারণার কথা শুনে আমি যেমন অবাক হয়েছিলাম, তেমনি কৌতুকও বােধ করেছিলাম। আমার এতাে ক্ষমতা। এতাে বড়াে একটা ছাত্র আন্দোলনের পরিচালক হয়ে গেলাম আমি–আমার এমন অমিত শক্তির পরিচয় ওই কানে খাটো’ লােকটি ছাড়া অন্য কেউ দূরে থাক আমি নিজেও জানতে পেলাম না!
ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানের পরও বছর দেড়েক ওই দ্রলােক ময়মনসিংহেই কর্মরত ছিলেন। তখনাে নানা আলােচনা সভায় তাকে দেখা গেছে। এবং আশ্চর্যের ব্যাপার, সে-সময়ে তার কথাবার্তার ধরন-ধারণ সম্পূর্ণ অন্যরকম, বাঙালি সংস্কৃতির মহিমাকীর্তনে তিনি উচ্চকণ্ঠ। কৃতী আমলারা এ-রকমই চালাক-চতুর হয়ে থাকে, মৌসুম অনুযায়ী খােলস পাল্টানােয় তাদের অপরিসীম দক্ষতা।

উনসত্তরে জনতার আত্মশক্তির উন্মেষ
উনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থান শুধু শেখ মুজিব আর আগরতলা মামলার আসামিদেরই নয়, জেল থেকে বের করে আনলাে সব রাজবন্দিকেই। মুক্তি পেলেন মণি সিংহ সহ কম্যুনিস্ট বন্দিরাও।
উনিশোে আটচল্লিশ/উনপঞ্চাশের পর মণি সিংহকে কেউ প্রকাশ্যে দেখতে পায়নি। পাকিস্তান সৃষ্টির পর থেকেই মুসলিম লীগ সরকার যে প্রচণ্ড দমন নীতি চালায় তাতে
৩২৩
কম্যুনিস্টদের পক্ষে প্রকাশ্যে কাজ করা অসম্ভব হয়ে দাঁড়িয়েছিলাে। জেলখানাগুলাে ভরে গিয়েছিলাে ক্যুনিস্ট বন্দিদের দিয়ে। পাকিস্তান রাষ্ট্রশক্তির এ রকম আক্রমণ থেকে পার্টিকে বাঁচিয়ে রাখার জন্যে কম্যুনিস্ট নেতারা আত্মগােপনে থাকার কৌশল গ্রহণ করাটাই যুক্তিযুক্ত মনে করেছিলেন। সে সময়ে পূর্ব পাকিস্তানের কম্যুনিস্ট পার্টির প্রাদেশিক নেতৃবৃন্দ—যেমন নেপাল নাগ, খােকা রায়, নিরঞ্জন গুপ্ত, ফণী গুহ, মণি সিংহ, আলতাব আলী, অবনী বাগচী, বারীণদত্ত—আন্ডারগ্রাউন্ডে গিয়েই পুলিশের নজর এড়িয়ে চলতে ও দীর্ঘকাল ধরে পার্টির কাজকর্ম চালিয়ে যেতে পেরেছিলেন। কিন্তু আন্ডারগ্রাউন্ড অবস্থাতেই সাতষট্টির নভেম্বরে পূর্ব পাকিস্তানের ক্যুনিস্ট পার্টির সম্পাদক মণি সিংহ আকস্মিকভাবে গ্রেফতার হয়ে যান। এরপর আবদুস সালাম নাম ধারণ করে পার্টির অস্থায়ী সম্পাদকের দায়িত্ব গ্রহণ করেন কমরেড বারীণ দত্ত। বছরখানেক পরে, আটষট্টির অক্টোবরে, গােপনেই পূর্ব পাকিস্তানের ক্যুনিস্ট পার্টির প্রথম কংগ্রেস অনুষ্ঠিত হয়। সে কংগ্রেসে বারীণ দত্ত তথা আবদুস সালামই পার্টির সম্পাদক নির্বাচিত হন।
ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানের ফলে মণিসিংহ সহ অন্যান্য কমিউনিস্ট নেতারা জেল থেকে মুক্তি পাওয়ার পর ময়মনসিংহে মণি সিংহকে সংবর্ধনা জানানাের আয়ােজন করা হয়েছিলাে। ছাত্র ইউনিয়ন, ন্যাপ ও মহিলা পরিষদের কর্মিরা সংবর্ধনা অনুষ্ঠানের প্রস্তুতির কাজে উৎসাহের সঙ্গে লেগে গিয়েছিলাে। সাধারণের মধ্যেও উৎসাহের কমতি দেখা দেয়নি। টংক আন্দোলনখ্যাত মণি সিংহকে নিজের চোখে দেখেছে তখনকার প্রজন্মের খুব কম মানুষই। কিন্তু তাঁর সম্পর্কে সবাই এতাে কথা শুনেছে যে, এই মানুষটির একটা কল্পরূপ সবার মনের পটে আঁকা হয়ে গেছে। তাই, সফল গণঅভ্যুত্থানের পর এই মানুষটিকে নিয়ে একটি উৎসবের আনন্দে মেতে উঠতে চায় সবাই।
কিন্তু প্রমাদ গুণলাে কট্টর পাকিস্তানবাদীরা। মণি সিংহের মতাে একজন কম্যুনিস্ট, যে লােকটি পাকিস্তানের জন্মলগ্নেই এই মুসলিম রাষ্ট্রটিকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে বসেছিলাে কতকগুলাে জংলী মানুষকে সঙ্গে নিয়ে, যে লােকটিকে মুসলিম লীগ সরকার ভিটেমাটি থেকে উচ্ছেদ করেছিলাে, সেই লােকটিই পাকিস্তানের বুকে পেয়ে যাবে নাগরিক সংবর্ধনা! তাহলে তাে কম্যুনিস্টদের হাতে পাকিস্তানের পরাভবই মেনে নিতে হয়! না, তেমনটি কিছুতেই হতে দেয়া যায় না। মরিয়া হয়ে ওরা কম্যুনিস্টদের সম্পর্কে সেই পুরােনাে কুৎসা কীর্তন নতুন করে শুরু করলাে—রাশিয়ার দালাল, হিন্দুস্থানের চর, ইসলামের দুশমন, খােদাদ্রোহী ইত্যাদি ইত্যাদি।
পাকিস্তানবাদী প্রতিক্রিয়াশীলদের কম্যুনিস্ট-বিদ্বেষ ও মণি সিংহকে সংবর্ধনা দেয়ার উদ্যোগে তাদের গায়ে জ্বালা ধরে যাবার ব্যাপারটা স্বাভাবিক ও বােধগম্য। কিন্তু ছয় দফা ও বাঙালি জাতীয়তাবাদের সমর্থনে যারা এতােদিন গলাফাটা স্লোগান দিয়েছে তাদেরও একটা অংশকে যখন পাকিস্তানবাদীদের সঙ্গে গলা মিলাতে দেখলাম, তখন অবাক না হয়ে পারলাম না। ওদেরই কেউ কেউ বলতে লাগলাে, কম্যুনিস্টরা ফাঁকতালে মতলব হাসিল করতে চাইছে। আমাদের শেখ সাহেব রাওয়ালপিন্ডি গেছেন গােলটেবিল বেঠকে যােগ দিতে, আর এই ফাঁকে কম্যুনিস্টরা মণি সিংহকে হিরাে বানিয়ে তােলার ব্যবস্থা করছে।…এতােদিন গর্তের তলায় লুকিয়ে থেকে এখন সুযােগ পেয়ে মাথা ভাসিয়েছে, সব ক্রেডিট নিজেরা নিয়ে নিতে চাইছে…।’
দেখা গেলাে : ময়মনসিংহে মণি সিংহের সংবর্ধনা বানচাল করার জন্যে সাম্প্রদায়িকতাবাদীদের সঙ্গে জাতীয়তাবাদী বলে পরিচয়দানকারী কিছু লােকের একটা অশুভ
৩২৪
আঁতাত গড়ে উঠেছে এবং সেই আঁতাত সন্ত্রাস সৃষ্টির পথ ধরেছে। ক্যুনিস্টদের তারা কিছুতেই মাথা তুলতে দেবে না। প্রথমেই তারা টার্গেট করলাে কমরেড অজয় রায়কে। অজয় দা ময়মনসিংহ শহর থেকে বাসে চেপে ফুলবাড়িয়ায় যাচ্ছিলেন। মারাত্মক অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে কতকগুলাে লােক সেই বাসেই উঠে বসেছিলাে। কিন্তু অজয় রায়ও যে সেই বাসেই আছেন তা ওরা টের পায়নি। অজয় দা দীর্ঘদিন জেলে ও আত্মগােপনে থাকায় ওরা তাকে চিনতাে না। তবে হাবভাব দেখে ও কথাবার্তা শুনে অজয় দা ওদের মতলব বুঝে ফেললেন। তাই ফুলবাড়িয়া পর্যন্ত না গিয়ে মাঝপথেই তিনি এক জায়গায় নেমে পড়লেন। ওদিকে অজয় দার সমর্থকদের কাছে খবর পৌছলাে যে, গুণ্ডারা তাকে রাস্তায় আক্রমণ করেছে। সে খবর পেয়ে তারাও সশস্ত্র হয়ে এগিয়ে এলাে। যাই হােক, যখন জানা গেলাে যে, অজয় দা নিরাপদেই রয়েছেন তখন সবাই শান্ত হলাে। প্রতিরােধের শক্তি দেখে প্রতিপক্ষও দমে গেলাে।
তবু শেষ পর্যন্ত উদ্যোক্তারা মণি সিংহের সংবর্ধনা অনুষ্ঠানটি বাতিল করে দিতে বাধ্য হলেন। কারণ, বিষয়টিতে সাম্প্রদায়িক রঙ ধরতে যাচ্ছিলাে। বিশেষ করে হিন্দু ব্যবসায়ীরা ভয় পাচ্ছিলেন যে, এই সংবর্ধনা অনুষ্ঠানকে উপলক্ষ করে লুটপাট শুরু হয়ে যায় কি না। নানা লােকে তাদের এ রকম ভয়ই দেখাচ্ছিলাে। আর এ কথা কে না জানে যে, এ দেশের হিন্দুদের অতি সহজেই ভয় দেখানাে যায়? ব্যবসায়ী ছাড়াও শহরের হিন্দুদের আরাে কেউ কেউ তাদের ভয় ও উদ্বেগের কথা জানিয়ে সংবর্ধনা অনুষ্ঠানটি না করার জন্যে উদ্যোক্তাদের অনুরােধ জানালেন। উদ্যোক্তারা তাদের অনুরােধ বিবেচনায় না নিয়ে পারলেন না।
যে কোনাে বড়াে ধরনের গণআন্দোলনেই নানা ধরনের শক্তির সমাবেশ ঘটে, অনেক বিপরীতধর্মী শক্তিও একটি অভিন্ন উদ্দেশ্য সাধনের জন্যে সাময়িকভাবে একত্র মিলে যায়। কিন্তু উদ্দেশ্যটি সফল হয়ে যাবার পর সেই ঐক্যটি স্বাভাবিক নিয়মেই ভেঙে যায়, তখন আন্দোলনকারী শক্তিগুলাের বিভিন্নমুখী স্বার্থের সংঘাতই প্রবল হয়ে ওঠে। ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানের বেলাতেও তা-ই হয়েছিলাে। কম্যুনিস্ট-বিরােধিতার ব্যাপারটি তাে দীর্ঘকালের, সেটি এতাে সহজে অবশ্যই দূর হয়ে যাবার নয়। কম্যুনিস্ট-বিরােধিতার সূত্র ধরেই অন্তর্লীন সাম্প্রদায়িকতাকেও কাজে লাগানাে যায়। এতাে বড়াে একটি গণঅভ্যুত্থানও যে সেই কম্যুনিস্ট বিরােধিতা ও অন্তর্লীন সাম্প্রদায়িকতাকে মুছে দিতে পারেনি তারই প্রমাণ পাওয়া গেলাে ময়মনসিংহে মণি সিংহকে সংবর্ধনা দিতে না পারার মধ্যে। তবে, এ রকম পরােক্ষ সাম্প্রদায়িক রাজনীতির শক্তি যে ক্ষীয়মান হয়ে আসছিলাে তারও প্রমাণ পাওয়া গেলাে জামায়াতে ইসলামীর ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্রসংঘের একটি সভাকে উপলক্ষ করে।
পাকিস্তান সরকার আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহার করে নেয়ার পর শেখ মুজিব মুক্ত হয়ে এসে ছাত্রসমাজের এগারাে দফার প্রতি অকুণ্ঠ সমর্থন জানালেন। রেসকোর্স ময়দানে দেয়া এক সংবর্ধনা সভায় ছাত্রনেতা তােফায়েল আহমদ জনতার পক্ষ থেকে শেখ মুজিবকে ভূষিত করেন বঙ্গবন্ধু’ উপাধিতে। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে বাঙালি জাতীয়তাবাদের রাজনীতিই হয়ে ওঠে এখানকার রাজনীতির মূল ধারা, আর ছাত্রদের এগারাে দফা সেই মূলধারার রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত করে দেয় র্যাডিকেল উপাদান। রাজনীতির এই ধারাটিকে মেনে নেয়া যে ধর্মীয় ও সাম্প্রদায়িক রাজনীতির প্রবক্তাদের পক্ষে কোনাে মতেই সম্ভব নয়, সে তাে সহজেই বােঝা যায়। তারা এগারাে দফার তীব্র বিরােধিতা শুরু করে দেয় ঊনসত্তরের ফেব্রুয়ারিতেই।
মার্চের প্রথম সপ্তাহে ময়মনসিংহের টাউনহল মাঠে ইসলামী ছাত্রসংঘ একটি জনসভা আহ্বান করে। আমরা কয়েক বন্ধু মাঠের এক কোণে দাঁড়িয়েছিলাম। সেখানেই পুলিশের
৩২৫
দারােগা মােজাহারুল ইসলাম সাহেবকেও সিভিল ড্রেসে বাইসাইকেলে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলাম। পুলিশ হলেও মােজাহারুল ইসলাম সাহেবের সঙ্গে আমাদের বন্ধুত্বের সম্পর্ক ছিলাে। তিনি ছিলেন কবি। ময়মনসিংহের ‘শুক্ৰবাসরীয় সাহিত্য সংসদের সভায় নিয়মিত কবিতা পাঠ করতেন। সেই সূত্রেই তাঁর সঙ্গে আমার পরিচয় ও বন্ধুত্ব।
জিজ্ঞেস করলাম, ‘কী ব্যাপার ইসলাম সাহেব? পুলিশের ধড়াচূড়া ছেড়ে একেবারে পৌরজন হয়ে এখানে এলেন যে!
ইসলাম সাহেব ঠোটে তর্জনী চেপে বললেন, চুপ, চুপ।…আমাকে তাে সরকার ডিআইবি বানিয়ে দিয়েছে। মানে আমি এখন গুপ্ত পুলিশ।
–তা, আপনাকে হঠাৎ ব্যক্ত থেকে গুপ্ত করে দেয়ার হেতু?”
—“আরে, তাও বুঝলেন না? সরকার জানে যে, আমার সাহিত্য টাহিত্য করার বাতিক আছে। তাই আপনাদের, মানে সংস্কৃতিওয়ালাদের, খবরাখবর আমি ভালাে সরবরাহ করতে পারবাে।’ বলেই আমার পিঠে দুটো চাপড় দিয়ে মুচকি মুচকি হাসতে লাগলেন।
চিনাবাদাম চিবােতে চিবােতে আমরা বক্তৃতা শুনছিলাম। ওরা বলছিলাে ওদের ‘আটদফা’র কথা। আটদফায় কী কী ছিলাে তা আজ আর মনে নেই। তবে মনে আছে, ছাত্রসমাজের ‘এগারাে দফা’র বিরুদ্ধে ওরা বিষােদগার করে চলছিলাে। এগারাে দফা যে বিদেশিদের মদদে তৈরি, কমুনিস্টরা যে বদ মতলব নিয়ে এগারাে দফা ফিরি করছে, পাকিস্তানকে ধ্বংস করাই যে এগারাে দফাওয়ালাদের মূল লক্ষ—এ সবই ছিলাে ওদের বক্তৃতার উপজীব্য।
হঠাৎ দেখলাম সভামঞ্চে বৃষ্টির মতাে ঢিল পড়তে শুরু করেছে। মুহূর্তেই সভা বন্ধ। শুরু হয়ে গেছে ধুন্ধুমার আর দৌড়াদৌড়ি। আমরাও দৌড়ে রাস্তায় ওপাশে তাহেরুদ্দীন মল্লিকের ছাপাখানা এনাম প্রেসে গিয়ে উঠলাম। শুক্রবাসরীয় সাহিত্য সংসদের অন্যতম কর্মকর্তা মল্লিক সাহেব আমাদের চা-মিষ্টি দিয়ে আপ্যায়ন করলেন। কিন্তু গুপ্ত পুলিশ মােজাহারুল ইসলাম সাহেব চা না খেয়েই উঠে পড়লেন।
‘আপনারা বসুন। আমি একটু ডিউটি করে আসি।’ বলেই তিনি বাইসাইকেলে চেপে বসলেন।
দশ বারাে মিনিট পরেই ফিরে এলেন হাঁপাতে হাঁপাতে। একটু ধাতস্থ হয়ে তার দশ মিনিটের অভিজ্ঞতার বর্ণনা দিলেন।
টাউন হল মাঠ থেকে বিদ্যাময়ী ইস্কুলের দূরত্ব আধ মাইলের বেশি হবে না। কিন্তু এইটুকু জায়গার মধ্যেই আমাদের গুপ্ত পুলিশ মহােদয় অনেকগুলাে মারামারির দৃশ্য প্রত্যক্ষ করেন।
না, মারামারি নয়। একতরফা মার। তুমুল মার খাচ্ছে আটদফাওয়ালারা। মার খেতে খেতে কেউ কেউ পড়ে যাচ্ছে রাস্তার ড্রেনে। সেখানেও রেহাই নেই। সমানে মার চলছেই। এ রকম একটি ছেলেকে বিদ্যাময়ী স্কুলের পাশের ড্রেনটিতে তুমুল পিটুনি খেতে দেখে প্রহারকারী যুবকদের তিনি বলেছিলেন, এভাবে ওকে মারছাে কেন তােমরা? ছেড়ে দাও ওকে। তােমাদের নেতারা কোথায়? তােমরা…।’
তার কথা আর শেষ করতে পারেননি। ওরা তার দিকে এমনভাবে তাকালাে যে, ভাবলেন পিটুনিটা বােধহয় এবার তার ঘাড়েই পড়বে।
“ঠিক আছে, ঠিক আছে। ছেড়াে না ওদের, আচ্ছাসে মার দেও’—বলেই তাড়াতাড়ি উল্টোমুখি সাইকেল চালিয়ে চলে এলেন।
৩২৬
চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে গুপ্ত পুলিশ (অথচ কবি) মােজাহারুল ইসলাম সাহেব বললেন, যখনই কোনাে গণআন্দোলন বিজয়ের দ্বারপ্রান্তে এসে দাঁড়ায় তখনই গণবিরােধীরা ধর্মের ধুয়া তুলে মানুষকে বিভ্রান্ত করতে লেগে যায়। এবারাে এরা তাই করতে চাইছে।…তবে, এবার খুব সুবিধে করতে পারবে বলে মনে হয় না।
ঊনসত্তরে এ রকম বােধদয় হয়ে যাওয়ার ফলেই বােধহয় একাত্তরে নির্দ্বিধায় তিনি মুক্তিযুদ্ধে যােগ দিতে পেরেছিলেন।
পঁচিশে মার্চ আইউবের পদত্যাগ, ইয়াহিয়ার ক্ষমতা দখল ও জঙ্গী শাসন জারির মধ্যদিয়ে সেবারের গণঅভ্যুত্থান পর্বের সমাপ্তি ঘটে। মওলানা ভাসানী যে উনিশোে তেষট্টি সাল থেকেই আইউবের প্রচ্ছন্ন সমর্থক’ হয়ে গিয়েছিলেন—সে কথা ঠিক। তবু, উনসত্তরের গণআন্দোলন ছাত্রদের দ্বারা সূচিত হলেও মওলানাই যে ছিলেন এর প্রাণপুরুষ’—সে কথাও অস্বীকার করা যায় না। সে সময়ে মওলানা যে ‘ঘেরাও’ আন্দোলন শুরু করেছিলেন, এ দেশে তা ছিলাে একান্তই অভিনব। প্রশাসনিক কর্মকর্তা বা অন্যান্য ক্ষমতাধর মানুষদের অফিস বা বাড়ি ঘেরাও করে জনসাধারণের দাবি আদায় করার এই পদ্ধতিকে এদেশে এর আগে কখনাে কাজে লাগানাে হয়নি। কেবল শহরের মধ্যবিত্তের মধ্যে সীমিত না থেকে গ্রামগঞ্জের জনসাধারণের মধ্যে ছড়িয়ে পড়েই উনসত্তরের গণআন্দোলন যথার্থ গণঅভ্যুত্থানে পরিণত হয়েছিলাে এবং কোথাও কোথাও তা সহিংস রূপও ধারণ করেছিলাে, আইউব-প্রবর্তিত মৌলিক গণতন্ত্রকে প্রত্যাখ্যানই শুধু নয়—দু’জন মেধাবী গবেষক সঠিকভাবেই দেখিয়েছেন—“মৌলিক গণতন্ত্রের ভিত ধ্বংস করার জন্যে ছাত্রনেতারা আন্দোলনের সময় মৌলিক গণতন্ত্রীদের পদত্যাগ করতে বলেছিলেন। গ্রামাঞ্চলে, অনেক জায়গায় মৌলিক গণতন্ত্রীরা পদত্যাগে রাজি না হলে মানুষ তাদের বাধ্য করেছিলাে পদত্যাগ করতে। মৌলিক গণতন্ত্রীদের সুনজরে দেখার কোনাে কারণ ছিলাে না। অর্থনৈতিক শক্তির সঙ্গে তারা রাজনৈতিক শক্তির অধিকারী হয়েছিলাে এবং এ দুটোর মিলিত শিকার ছিলাে বঞ্চিত গ্রামবাসীরা। এছাড়া চোর, ডাকাত, গরুচোর, টাউট এবং মৌলিক গণতন্ত্রীদের দালালদের অনেকক্ষেত্রে গণআদালতে বিচার করে শাস্তি দেয়া হচ্ছিলাে। অন্যদিকে, স্বার্থান্বেষী কিছু ব্যক্তি এ সুযােগে নিজেদের স্বার্থ চরিতার্থ করার জন্যে লুটপাটে অংশ নিচ্ছিলাে। ছাত্র বা রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছিলাে ঘটনাবলী এবং এতে তারা হয়ে উঠছিলেন উদ্বিগ্ন। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, প্রায় দশ হাজার মৌলিক গণতন্ত্রী পদত্যাগ করেছিলেন। এর মধ্যে স্বেচ্ছায় পদত্যাগকারীর সংখ্যা ছিলাে ২৫০০ থেকে ৩০০০ মাত্র।
মুনতাসীর মামুন ও জয়ন্ত কুমার রায় : বাংলাদেশে সিভিল সমাজ প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম (ঢাকা-১৯৯৫) পৃষ্ঠা ৪১-৪২)।
জনতার আদালত যে কী প্রচণ্ড শক্তিধর হতে পারে জামালপুরে মাদারগঞ্জ থানার মানুষ ঊনসত্তরে তার কিছু দৃষ্টান্ত দেখিয়েছিলাে। আধুনিক যােগাযােগ ব্যবস্থাহীন চর এলাকা মাদারগঞ্জে একটি কলেজে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলাে এর বছরখানেক আগে। আমার ভাই মতীন্দ্র ছিলাে সে কলেজের ভাইস প্রিন্সিপাল। সে সূত্রেই আমার সেবার মাদারগঞ্জে যাওয়া। গণআন্দোলনের ওখানকার মানুষদের বীরত্বের কাহিনী শুনে চমকৃত হয়ে গেলাম। বহুকাল ধরে মাদারগঞ্জের ‘জইট্যার চর’ গ্রামটি ছিলাে গরুচোরদের ঘাঁটি। এখানকার চোরেরা দূরদূরান্তের গ্রাম থেকে গরু চুরি করে এনে আটকে রাখতাে, এবং গেরস্তের কাছ থেকে মােটা
৩২৭
টাকা আদায় করে সে গরু ফেরত দিতাে। থানা-পুলিশের অনুমােদন ও সহায়তা নিয়ে বহু বছর ধরে এ রকম ঘটনা ঘটে আসছিলাে। বারবার ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে দেনদরবার করেও গেরস্তরা কোনাে প্রতিকার পায়নি। ঊনসত্তরে প্রতিকারের পথ নিজেরাই বেছে নিলাে। এলাকার মানুষ চারদিক থেকে এই গ্রামটি ঘেরাও করে ফেলে ও চিহ্নিত চোরদের বাড়িঘরে আগুন ধরিয়ে দেয়। বেশ কিছু চোরকে ধরে সঙ্গে সঙ্গে জবাই করে ফেলে। গরু চোরদের সরদার জয়নাল হজ করে এসে নাম নিয়েছিলাে জয়নাল হাজী। লােকজন যখন ওই জয়নাল হাজীকে ধরে জবাই করতে নিয়ে যাবে, তখন সে নাকি নামাজ পড়ার সুযােগ দেয়ার জন্যে তাদের কাছে প্রার্থনা জানিয়েছিলাে। লােকেরা তার প্রার্থনা মঞ্জুর করেছিলাে। তবে নামাজ শেষ করার পরপরই তাকে কোতল করে ফেলে। মাদারগঞ্জে যাদের মুখে আমি গণরােষের এই সব লােমহর্ষক বিবরণ শুনছিলাম তারা বারবার কৃতজ্ঞতার সঙ্গে মওলানা ভাসানীর নাম উচ্চারণ করছিলাে। মওলানা ভাসানী সেখানে যাননি। তাদের অনেকেই মওলানাকে কোনােদিন দেখেওনি। তবু মওলানার বিপ্লবী আহ্বানে তারা আত্মশক্তিতে উদ্বুদ্ধ হতে পেরেছিলাে বলে তাদের এই কৃতজ্ঞতা। ঊনসত্তরে যদি জনগণের আত্মশক্তির জাগরণ না ঘটতাে তাহলে একাত্তরে তারা মুক্তিযােদ্ধা হতে পারতাে না।

নানান কিসিমের ডান-বামের প্রাদুর্ভাব
গণঅভ্যুত্থানের সমাপ্তি ঘটবে সামরিক অভ্যুত্থানের ফলে—এমনটি অবশ্যই কাঙ্ক্ষিত ছিলাে না। তবু, ঊনসত্তরের পঁচিশ মার্চ আইউবের বদলে পাকিস্তানের প্রধান সেনাপতি ইয়াহিয়া খান যখন ক্ষমতা দখল করে বসলাে এবং দেশে আবারাে মার্শাল ল জারি হলাে, তখন জনসাধারণ খুব একটা অখুশি হয়নি। আইউব-মােনেমের পতনের মধ্যদিয়ে আন্দোলনের একটি বড়াে বিজয় ঘটলাে—এরকমই হয়েছিলাে জনগণের মনােভাব। আর মার্শাল ল’ সম্পর্কে ঊনসত্তরের মানুষের মনে আটান্নর মতাে ভীতি, উদ্বেগ বা সমীহা কোনােটাই ছিলাে না। ইয়াহিয়ার মার্শাল ল’ যে আইউবের মতাে হতে পারবে না, তার প্রকৃতি যে অনেকটা নিরামিষই হবে—জনগণ তাও বুঝে নিয়েছিলাে। সার্বজনীন ভােটাধিকারের ভিত্তিতে সাধারণ নির্বাচনের অনুষ্ঠান না করে যে নতুন সামরিক সরকার পার পাবে না, জনগণের মনে এমন প্রত্যয়েরও জন্ম হয়েছিলাে। আট মাস পরে ইয়াহিয়ার এক ভাষণে জনগণের সে প্রত্যয়েরই সমর্থন পাওয়া গেলাে। এক লােক এক ভােট’ নীতির ভিত্তিতে সত্তর সালের অক্টোবরের পাঁচ তারিখ সাধারণ নির্বাচন হবে, জনগণের প্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরিত হবে, পশ্চিম পাকিস্তানের এক ইউনিট ভেঙে দেয়া হবে, পাকিস্তানের উভয় অংশের জন্যেই অধিকতর স্বায়ত্তশাসন নিশ্চিত করা হবে ঊনসত্তরের আটাশে নভেম্বর এক বেতার ভাষণে ইয়াহিয়া এ রকমই সব প্রতিশ্রুতি উচ্চারণ করে। সত্তরের পয়লা জানুয়ারি থেকে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের ওপর থেকে সব বাধানিষেধ উঠে যাবে—ওই ভাষণে ইয়াহিয়া এ-রকম ঘােষণাও দেয়।
এ-সবই হচ্ছে সফল গণঅভ্যুত্থানের প্রাপ্তি। মার্শাল ল’ সত্ত্বেও এ-সময়েই যে দেশের মানুষ যথেষ্ট পরিমাণে নাগরিক স্বাধীনতার স্বাদ গ্রহণ করেছিলাে যা এর আগের বাইশ বছরে কখনাে করতে পারেনি, এ-কথাটি আমার বারবারই মনে পড়ে। তাই, আগেই একবার এ
৩২৮
কথাটি বলেছি যদিও, তবু আরেকবার তার পুনরাবৃত্তি না করে পারলাম না। এ সময়ে মানুষের অধিকারবােধ ক্রমেই তীব্রতর হয়ে উঠছিলাে। রাজনৈতিক নেতারা স্বভাবতই অনেক কৌশলী, তাই তারা গুণে গুণে পা ফেলেন। কৌশলের খাতিরে তারা অনেক সময় নীতিকেও আড়াল করে রাখেন। কিন্তু তরুণ ছাত্ররা সহজ কথা সহজ ভাষায় বলতেই পছন্দ করে, জনগণের অভীপ্সাকে তারাই স্পষ্ট ভাষায় রূপ দেয়। এবারও, তাই, স্পষ্ট কথা বলতে ছাত্ররাই প্রথম এগিয়ে এলাে। ইয়াহিয়ার আটাশ নভেম্বরের ভাষণে বেশ কিছু ভালাে ভালাে কথা থাকলেও সামরিক শাসনের খাড়া ঝুলিয়ে রাখলে যে এসব কথার কানাকড়িও মূল্য থাকে না, ছাত্ররা বেশ জোরেশােরেই সে-কথাটা বললাে। অবিলম্বে সামরিক শাসন-প্রত্যাহার করে নিয়ে পূর্ণ ব্যক্তিস্বাধীনতা ও মৌলিক অধিকার ফিরিয়ে দেবার দাবি জানালাে তারা। তাছাড়া তাদের দাবির মধ্যে আরাে ছিলাে : ‘সকল রাজবন্দি ও রাজনৈতিক কারণে সামরিক সাজাপ্রাপ্ত ও আটক সকল বন্দিদের মুক্তি এবং রাজনৈতিক কারণে জারিকৃত মামলা, সামরিক আইনের মামলা, ঘােষিত সাজা, গ্রেফতারি পরােয়ানা প্রভৃতি অবিলম্বে প্রত্যাহার।
১১-দফার সংগ্রাম চলবেই/ইয়াহিয়া খানের ভাষণ সম্পর্কে ছাত্র সমাজের অভিমত শিরােনামে সে-সময়কার পূর্ব পাকিস্তানের তিনটি বৃহৎ ছাত্র সংগঠনের ইস্তেহারে ঘটেছিলাে তীক্ষ অন্তর্দৃষ্টি ও গভীর প্রজ্ঞার প্রকাশ। দীর্ঘ ইস্তেহারের আত্মসন্তুষ্টির অবকাশ নাই’ শীর্ষক অনুচ্ছেদটিতে ছাত্ররা বলেছিলাে—
‘ইহা সকলের জানা আছে যে আমাদের দেশে গণতন্ত্র বিকাশে ও বাংলাসহ বিভিন্ন ভাষাভাষী জাতির জাতীয় অধিকার লাভের বিরুদ্ধে দেশি-বিদেশি কায়েমি স্বার্থবাদী গােষ্ঠী গত ২২ বছরব্যাপী প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করিয়া আসিয়াছে এবং দেশে একটি সাধারণ নির্বাচন পর্যন্ত অনুষ্ঠিত হইতে দেয় নাই। এই প্রতিক্রিয়াশীল গােষ্ঠী শেষ পর্যন্ত ষড়যন্ত্র চালাইয়া যাইবে, ইহাতে কোনাে সন্দেহ নাই। কাজেই নির্বাচন ও পার্লামেন্টারি গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা এবং পূর্ববাংলাসহ সকল ভাষাভাষী জাতির পূর্ণ ও প্রকৃত স্বায়ত্তশাসন অর্জনের জন্যে আজ আমাদের সকলকে ঐক্যবদ্ধভাবে থাকিতে হইবে ও আন্দোলনের তীব্রতা বৃদ্ধি করিতে হইবে। অন্যথায় বর্তমান বিজয়সমূহও পুনরায় নস্যাৎ হইবার আশংকা আছে।…এক্ষেত্রে আমরা সুস্পষ্টভাবে ঘােষণা করিতে চাই যে, শুধু নির্বাচন ও পার্লামেন্টারি গণতন্ত্র অর্জন করিলেই জনগণের জীবনের সকল সমস্যার সমাধান হইয়া যাইবে, এ-কথা আমরা মনে করি না। সাম্রাজ্যবাদ, সামন্তবাদ ও একচেটিয়া পুঁজির উচ্ছেদ, দেশে পূর্ণ গণতন্ত্র কায়েম, বাঙালিসহ সকল জাতির পূর্ণ জাতীয় স্বাধিকার প্রতিষ্ঠা এবং ছাত্র-শ্রমিক-কৃষক ও অন্যান্য মেহনতি মানুষের বিভিন্ন সমস্যার সমাধানের মধ্য দিয়াই দেশ মুক্তির পথে যাইতে পারে। এই জন্য নির্বাচন ও পার্লামেন্টারি গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা দ্বারা যে ব্যক্তিস্বাধীনতা ও মৌলিক অধিকার অর্জিত হয় উহা ঐ লক্ষে অগ্রসর হইবার একটি পথ মাত্র।
ইশতেহারটিতে স্বাক্ষর করেছিলেন ছয়জন ছাত্রনেতা। স্বাক্ষরকারীদের মধ্যে পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নের শামসুদ্দোহা ও নূরুল ইসলাম এবং ছাত্রলীগের তােফায়েল আহমেদ ও আবদুর রব তাে ছিলেনই, জাতীয় ছাত্র ফেডারেশনের সভাপতি ইব্রাহীম খলিল ও সাধারণ সম্পাদক ফখরুল ইসলামও ছিলেন। এ-রকম ইশতেহারে ছাত্র ইউনিয়ন ও ছাত্রলীগের নেতারা যে স্বাক্ষর করবেন তা তাে একান্তই স্বাভাবিক। কিন্তু জাতীয় ছাত্র ফেডারেশন নামক ছাত্র সংগঠনটির পরিচয় যারা জানেন তাদের কাছে এই ইশতেহারের সঙ্গে এ-সংগঠনের নেতাদের
৩২৯
সংযুক্তির বিষয়টি অস্বাভাবিকই মনে হবে। অথচ ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান এই অস্বাভাবিককেও স্বাভাবিকে পরিণত করে ফেলেছিলাে।
এনএসএফ নামে পরিচিত জাতীয় ছাত্র ফেডারেশনকে কোনাে ছাত্র সংগঠন না বলে ছাত্র নামধারী ভাড়াটে গুণ্ডাদের একটি বাহিনী বলাই সঙ্গত। তেষট্টি সাল থেকে এই বাহিনীটিকেই প্রগতিশীল ছাত্রদের দমনের কাজে লাগানাে হয়। গভর্নর মােনেম খান ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন উপাচার্য ডক্টর এম ও গনির প্রত্যক্ষ মদদপুষ্ট হয়ে এ-বাহিনী বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে। এনএসএফ’র তাণ্ডবের বিরুদ্ধে প্রবল প্রতিরােধের সৃষ্টি করেই ষাটের দশকের সুস্থ ছাত্র আন্দোলনকে এগিয়ে যেতে হয়। সাধারণ ছাত্রদের হাতেই নিহত হয় পাঁচপাণ্ডুর’ নামে পরিচিত, একজন কুখ্যাত এনএসএফ নেতা, যে নেতা বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে তার রুমে সাপ পুষতাে বলে শােনা যায়। জাগ্রত ছাত্রসমাজ যখন এগারাে দফার আন্দোলন শুরু করে, এবং সে আন্দোলন যখন গণঅভ্যুত্থানের রূপ ধারণ করতে থাকে, তখন ছাত্রজনতার রুদ্ররােষের হাত থেকে এনএসএফ-ওয়ালাদের রক্ষা করার কোনাে ক্ষমতাই থাকে না গণবিরােধী শাসকের হাতে। তাই বাধ্য হয়েই, নিজেদের চামড়া বাঁচানাের খাতিরেই, এনএসএফ নেতৃত্ব এগারাে দফা আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়ে। উনসত্তরের জানুয়ারিতে আন্দোলনরত ছাত্রদের ওপর পুলিশ ও ইপিআরের হামলার নিন্দা জানিয়ে বিবৃতি দিতে দেখি মাহবুবুল হক দোলন, নাজিম কামরান চৌধুরী, ইব্রাহিম খলিল, সাইফুল্লাহ চৌধুরী। ও জমির আলীর মতাে এনএসএফ নেতাদেরও। ঊনসত্তরের নভেম্বরেও তাই দেশের ছাত্রসমাজ তথা জাগ্রত জনগণের মূলধারার সঙ্গে এনএসএফ নেতারা আন্তরিক সক্রিয়তায় সংযুক্ত থাকুক আর নাই থাকুক, এ-ধারার প্রকাশ্য বিরােধিতা করার শক্তি ও সাহস তারা হারিয়ে ফেলে।
তবে জাতীয়তাবাদী ও প্রগতিশীল ছাত্ররা এ বিষয়ে সচেতন থাকে যে, দেশে উগ্র দক্ষিণপন্থী ও উগ্র হঠকারী বামপন্থীগণ কর্তৃক পুনরায় নির্বাচন বানচালের সুযােগ সৃষ্টি করিয়া দেওয়ার বিপদ এখনও আছে তারা তাই তাদের ইশতেহার শেষ করে দেশি-বিদেশি প্রতিক্রিয়াশীল কায়েমি স্বার্থবাদী গােষ্ঠীর চক্রান্ত ও উগ্র দক্ষিণ ও উগ্র বামের বিপদের বিরুদ্ধে ১১ দফার ভিত্তিতে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার জন্যে জনগণ ও গণতান্ত্রিক শক্তির প্রতি আহ্বান জানিয়ে। এ আহ্বান ছিলাে খুবই সঠিক ও সময়ােচিত। | উগ্র দক্ষিণপন্থীদের তৎপরতা তাে পাকিস্তানে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপােষকতাতেই দীর্ঘকাল ধরে চলে আসছিলাে। এবার হঠাৎ করে সারা দেশজুড়ে উগ্র বামাচারের ঝড়াে যাওয়া বইতে লাগলাে। যে পাকিস্তান শুরু থেকেই কম্যুনিস্ট ও বামপন্থীদের ওপর সীমাহীন দমন-পীড়ন চালিয়ে যাচ্ছিলাে, সেই পাকিস্তানেই কী করে যে হরেক কিসিমের বামের প্রাদুর্ভাব ঘটে গেলাে, সেটি একটি প্রহেলিকাই বটে। এতােকাল যাদের বাম বলে লােকে জেনে এসেছিলাে, সেই মণি সিংহ ও তার অনুসারীদের সম্পর্কে এবার শােনা গেলাে : না, এরা মােটেই বাম নয়। এরা হলাে গিয়ে ‘সংশােদনবাদী’ আর ‘সামাজিক সাম্রাজ্যবাদের দালাল। এদের দিয়ে বিপ্লব হওয়ার কোনােই সম্ভাবনা নেই।
অথচ, পাকিস্তান রাষ্ট্রের শাসকরা কিন্তু ওই সংশােদনবাদী’দের যথেষ্ট সংশােধিত বা পাকিস্তানের জন্যে নিরাপদ বলে ঊনসত্তর/সত্তর সালেও মনে করেনি। ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানের ফলে যে সংশােদনবাদী’রা কারামুক্ত হয়ে এসেছিলেন—যেমন মণি সিংহ ও অজয় রায়—তারা উনসত্তরের মে-জুন মাসের মধ্যেই আবার কারারুদ্ধ হয়ে গেলেন। ইয়াহিয়ার তখনকার নিরামিষ মার্শাল ল’ও এদের সম্পর্কে হিংস্রতা পরিহার করতে পারেনি।
৩৩০
এদের বিপরীতে নিজেদের যারা সাচ্চা বিপ্লবী আর খাঁটি বাম বলে প্রচার করতাে তারা মােটেই এক গােষ্ঠীর লােক ছিলাে না। নানা গােষ্ঠী ও উপগােষ্ঠীতে বিভক্ত ওই সব বামদের নানা থিসিস’, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পরিস্থিতির নানা মূল্যায়ন’ নানা রণনীতি ও রণকৌশল’। পরস্পরের প্রতি বিদ্বেষও তাদের কম নয়। তবে সাধারণের কাছে তাদের সবাই ‘পিকিংপন্থী’ নামে পরিচিত এবং কয়েকটি বিষয়ে তারা একই রকম বা প্রায় একই রকম মতের অনুসারী। যেমন—তারা সবাই মস্কো’ অথবা মস্কোপন্থীদের বিরুদ্ধে, সােভিয়েত ইউনিয়নের ক্যুনিস্ট পার্টিকে তারা কেউই খাঁটি কম্যুনিস্ট বলে মনে করে না; এ-দেশেও সােভিয়েত পার্টির অনুসারী ‘পূর্ব পাকিস্তানের ক্যুনিস্ট পার্টি’ ও ‘মােজাফফর ন্যাপ’ এবং এদের অনুগামী ছাত্র ইউনিয়ন’-ও একান্তই বিপথগামী; এই বিপথগামী ‘মস্কোপন্থী’রা বাঙালি বুর্জোয়া-পেটি বুর্জোয়াদের পার্টি আওয়ামী লীগের লেজুড়ে পরিণত হয়ে গেছে।
পিকিংপন্থী বলে পরিচিত কিছু ছাত্র প্রায়ই আমার কাছে আসতাে। পশ্চিমবঙ্গের নক্সালপন্থীদের নানা কাগজপত্র, ওখানকার নক্সালদের মুখপত্র দেশব্রতীর কাটিং এবং চারু মজুমদারের লেখা পুস্তিকা আমাকে দিয়ে যেতাে। ওদের নিজেদের কর্মসূচি ও কাজকর্মের বিবরণও আমাকে শােনাতাে। ওদের চোখেমুখে দেখেছি প্রত্যয়ের আলাে, সুন্দর আগামীর স্বপ্ন। বিশেষ করে দুটি ছেলের কথা আমার আজো প্রায়ই মনে পড়ে। তাদের একজনের নাম মহিউদ্দীন বাহার ও আরেকজন দেলােয়ার আহমদ চঞ্চল। বন্দুকের নলই ক্ষমতার উৎস’মাও সেতুঙ-এর এই উক্তিটি ঘুরেফিরেই তারা উচ্চারণ করতাে। সশস্ত্র সংগ্রাম ছাড়া শান্তিপূর্ণ পন্থায় সমাজতন্ত্রে উত্তরণ যে অসম্ভব সে-সম্পর্কে তাদের মনে বিন্দুমাত্রও সন্দেহ ছিলাে না। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর বাহার কোথায় কী করছে জানি না। চঞ্চল তেয়াত্তর কি চুয়াত্তর সালে রাজশাহীর কোনাে এক এলাকায় সশস্ত্র সগ্রাম করতে গিয়ে প্রাণ বিসর্জন দিয়েছে।
ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানের অল্প কিছুদিন আগে আমার বাসায় এসেছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডাক্তার মােহাম্মদ মাের্তজা। মাের্তজা ছিলেন আপাদমস্তক ও কায়মনােবাক্যে বিপ্লবী । বিপ্লবই ছিলাে তার সর্বক্ষণের ধ্যানজ্ঞান। বিপ্লবের জন্যে নিজেকে প্রস্তুত করার লক্ষেই নিবেদিত ছিলাে তাঁর সকল চিন্তা ও কাজ। সব রকম কপটতা ও সংকীর্ণ স্বার্থপরতার উর্ধ্বে ছিলাে তার অবস্থান। পেশায় চিকিৎসক হয়েও দর্শন ও সাহিত্যের অনুশীলনে তিনি ছিলেন একান্ত নিষ্ঠাবান। এক সময় বার্নাড শ’-এর রচনাবলি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পড়েছেন। ধ্রুপদী মার্কসীয় গ্রন্থের গভীরে প্রবেশ করার জন্যে ছিলাে তার অক্লান্ত প্রয়াস। বিপ্লবের স্বপ্ন দেখতে দেখতেই একাত্তরের চৌদ্দ ডিসেম্বর এ-দেশের আরাে কয়েকজন মুক্তমতি বুদ্ধিজীবীর সঙ্গে শহীদ হয়েছিলেন আমার একান্ত সুহৃদ ডাক্তার মােহাম্মদ মাের্তজাও।
মাের্তজার সঙ্গে আমার পরিচয় ও সৌহার্দ্য খুব বেশিদিনের নয়। তবু অল্পদিনেই— কোনাে কোনাে বিষয়ে মতানৈক্য নিয়েই আমরা বেশ ঘনিষ্ঠ হয়ে পড়েছিলাম। আটষট্টি সালে তাে তিনি ঘাের ‘পিকিংপন্থী’। পিকিংপন্থীদের সকল কথার সঙ্গেই যে আমি দ্বিমত পােষণ করতাম, তা নয়। বরং ওদের কিছু কিছু বক্তব্যের আমি দৃঢ় সমর্থক ছিলাম বলেই আমার মস্কোপন্থী’ পার্টির কারাে কারাে দৃষ্টিতে আমি ‘পিকিংপন্থী’ হয়ে গিয়েছিলাম। কিন্তু মাের্তজা যখন মাও সেতুঙ-এর সাংস্কৃতিক বিপ্লবের প্রতি তার নিঃশর্ত আনুগত্য ও কট্টর সমর্থনের কথা বলতে লাগলেন, তখন আমি তার প্রতিবাদ না করে পারলাম না। সাংস্কৃতিক বিপ্লবের নামে অতীত ঐতিহ্যকে অস্বীকার করা একান্ত মূঢ়তা এবং চীনের ওই তথাকথিত সাংস্কৃতিক বিপ্লব
৩৩১
মার্কসবাদ-বিরােধী—এ-কথা আমি খুব জোরের সঙ্গেই সেদিন বলেছিলাম। তর্কাতর্কির এক পর্যায়ে যখন বুঝতে পারলাম যে মাের্তজা আমার কথায় আহত হচ্ছেন, তখন আমি তর্কের রাশ টেনে ধরলাম, আলােচনার মােড় অন্যদিকে ঘুরিয়ে নিয়ে গেলাম, গৃহাগত অতিথি বন্ধুর মনঃকষ্টের কারণ হয়েছি ভেবে দুঃখিত ও লজ্জিত হলাম।
নিজে মস্কোপন্থীদের সঙ্গে সংযুক্ত থাকলেও পিকিংপন্থীদের বিভিন্ন গােষ্ঠীর বক্তব্য আমি শ্রদ্ধার সঙ্গে অনুধাবন করতে চেষ্টা করতাম। কিন্তু ওদের কোনাে গােষ্ঠীরই সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য সম্পৰ্কীয় বক্তব্যের সঙ্গে একমত হতে পারিনি। পঞ্চাশের দশকের গােড়ায়—উগ্র বাম বিচ্যুতির সময়ে—কম্যুনিস্টরা উনিশ শতকের বঙ্গীয় রেনেসাঁসকে নস্যাৎ করে দিতে চেয়েছিলাে, রামমােহন থেকে রবীন্দ্রনাথ পর্যন্ত সকল মনীষীকেই প্রতিক্রিয়াশীল’ আখ্যা দিয়েছিলাে, তাদের সকলকেই মুৎসুদ্দি বুর্জোয়া ও সাম্রাজ্যবাদের সহযােগী বলে চিহ্নিত করেছিলাে। অল্পদিন পরেই অবশ্যি আত্মসমালােচনা করে এ-সব বালখিল্য বক্তব্য সে সময়কার বামপন্থীরা প্রত্যাহার করে নিয়েছিলাে। কিন্তু সেই বাতিল কথাগুলােরই প্রতিধ্বনি শােনা গেলাে দেড় দশক পরে নক্সালপন্থা’ কিংবা ‘পিকিংপন্থা’র অনুসারীদের মুখে। তখনকার পূর্ব পাকিস্তানে তাে এ-সব কথা আরাে বিপজ্জনক হয়ে দাঁড়ালাে এ-কারণে যে, ঠিক এই কথাগুলােই এখানকার দক্ষিণপন্থী ও সাম্প্রদায়িকতাবাদীদেরও কথা। ভঙ্গি আলাদা, কিন্তু সিদ্ধান্ত এক। একদল সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে রবীন্দ্র বিরােধিতা করছে, অন্যদলের রবীন্দ্র-নিন্দা প্রগতি ও বামপন্থার আলখাল্লা গায়ে দিয়ে। প্রগতিকামী যে তরুণটি ডানপন্থী ও সাম্প্রদায়িকতাবাদীদের বক্তব্যকে দৃঢ়তার সঙ্গে প্রত্যাখ্যান করেছে, বাম মােড়কে পরিবেশিত সেই একই বক্তব্যকে সেই তরুণটিই হয়তাে পরম সমাদরে গ্রহণ করেছে।
উগ্র ডান ও উগ্র বাম যে একই বিন্দুতে এসে মিলে যায়, সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য-বিচারেও তার প্রমাণ মেলে।

উদ্ভ্রান্ত বামপন্থা ও মওলানা ভাসানীর দুর্বোধ্য চরিত্র
ঊনসত্তর সালে রবীন্দ্রজয়ন্তীর একটি ঘরােয়া অনুষ্ঠানে একজন বালখিল্য বামাচারীর দেখা পেয়েছিলাম।
বামপন্থী ছাত্র-যুবকরাই অনুষ্ঠানটির উদ্যোক্তা ছিলাে। ওদের চোখে বিপ্লবের স্বপ্ন, কিন্তু মনে অনেক প্রশ্ন ও জিজ্ঞাসা। রবীন্দ্রজয়ন্তীর আয়ােজনের মধ্যেও সেই সংশয় নিরসনের পথসন্ধান কিংবা জিজ্ঞাসার জবাব খোজাই ছিলাে তাদের উদ্দেশ্য। সে উদ্দেশ্যেই বােধহয় তারা আমাকে আলােচনার জন্যে নিয়ে গিয়েছিলাে। আমি মহামতি লেনিনের একটি কথা দিয়ে আলােচনা শুরু করেছিলাম। তলস্তয়কে যখন রাশিয়ার চ্যাংড়া কম্যুনিস্টরা প্রতিক্রিয়াশীল বলে বাতিল করে দিতে চেয়েছিলাে তখন লেনিন বলেছিলেন যে, তলস্তয় হচ্ছেন রুশ বিপ্লবের দর্পণ। তলস্তয় ছিলেন একজন মহৎ শিল্পী। মহৎ শিল্পীদের সম্পর্কে লেনিনের বক্তব্য—যে কোনাে সত্যিকার মহৎ শিল্পীই তার শিল্পকর্মে বিপ্লবের কোনাে না কোনাে মর্মগত অংশের প্রতিফলন না ঘটিয়ে পারেন না।’ রবীন্দ্রজয়ন্তীর তরুণ শ্রোতাদেরকে লেনিনের এই উক্তিটি স্মরণ করিয়ে দিয়ে আমি বলেছিলাম : মহৎ শিল্পী রবীন্দ্রনাথেরও রচনায় স্বাভাবিকভাবেই বিপ্লবের নানা উপাদান ধরা পড়েছে, রবীন্দ্রনাথের অন্তর্নিহিত বিপ্লবী সত্তাটি আমাদের অবশ্যই চিনে নিতে হবে। ‘অচলায়তন’, মুক্তধারা, রক্তকরবী’ ও রথের রশি—এই কয়েকটি নাটক থেকে দৃষ্টান্ত টেনেই আমি ‘বিপ্লবী রবীন্দ্রনাথ’কে উপস্থিত করেছিলাম।
আলােচনা করতে করতেই আমি লক্ষ করছিলাম যে, শ্রোতাদের একেবারে পেছনের সারিতে প্রায় আমারই সমবয়সী একজন লােক, চোখে যার পুরু লেন্সের চশমা, তাঁর পাশের শ্রোতাদের সঙ্গে ফিসফিস করে কথা বলছেন। তার কথাগুলাে যে ছিলাে আমারই বক্তব্যের বিরুদ্ধে ব্যঙ্গাত্মক মন্তব্য তা তার মুখচোখের ভাব ও হাত নাড়া দেখেই আন্দাজ করতে পারছিলাম। আমার আলােচনা শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই তিনি এক অদ্ভুত ভঙ্গিতে ও কৃত্রিম উচ্চারণে আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, “আচ্ছা অধ্যাপক বাবু, ‘হৃদয় আমার নাচেরে আজিকে ময়ূরের মতাে নাচে রে’—রবি ঠাকুর এ কবিতাটি কবে লিখেছিলেন?”
তার কথায় ব্যঙ্গের সুর থাকলেও আমি শান্ত ও স্বাভাবিকভাবেই উত্তর দিলাম, “এটি তাে ‘ক্ষণিকা’ কাব্যের নববর্ষা’ কবিতার প্রথম ছত্র। ক্ষণিকা প্রকাশিত হয় বর্তমান শতাব্দীর একেবারে শুরুতে সম্ভবত উনিশোে দুই কি তিন সালে। ওই কবিতাটি ওরই কাছাকাছি সময়ের লেখা হবে।”
–“সে সময়ে কি দেশের মানুষের দুঃখ-দৈন্য-অভাব ছিলাে না?”
–“তা তাে ছিলােই।”
– “দুঃখ-দৈন্য-ছিলাে, মানুষ ছিলাে ঔপনিবেশিক শাসনে জর্জরিত, চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ফলে কৃষকদের ত্রাহি ত্রাহি অবস্থান, আর সেই সময়েও—আপনি যাকে বলেছেন ‘বিপ্লবী’– সেই প্রজা-শােষক জমিদার রবি ঠাকুরের হৃদয় একেবারে ময়ূরের মতাে নাচে? তখনাে তার হৃদয় নাচে এবং নাচতে পারে?”
–“হ্যা, নাচে এবং নাচতে পারে। কারণ তখনাে তাে মানুষের ছেলেপুলে হওয়া বন্ধ থাকেনি।”
–“মানে?”
–“মানে অতি পরিষ্কার। মানুষের দুঃখ দৈন্য চিরকালই ছিলাে, তবু সেই দুঃখদৈন্যের মধ্যেও নরনারী পরস্পরকে ভালােবেসেছে, সন্তান-সন্ততি উৎপাদন করেছে, হেসেছে, খেলেছে। সবকিছু বন্ধ করে দিয়ে কেবল কান্নাকাটি করেনি, কিংবা বিপ্লবের নামে গলাকাটা শুরু করে দেয়নি। বর্ষায় ময়ূর যেমন পেখম মেলেছে, মানুষের হৃদয়ও তেমন নেচেছে, মানুষের কবি রবীন্দ্রনাথেরও হৃদয় নেচেছে। রবীন্দ্রনাথের হৃদয় এ রকম নাচতাে বলেই তিনি যান্ত্রিক বস্তুবাদী হননি কিংবা লেনিন-কথিত ‘ইনফ্যান্টাইল ডিজ-অর্ডারে আক্রান্ত হননি…।”
আমার কলিংবেল-নিন্দিত কর্কশ কণ্ঠস্বরে বিদ্রুপ ও উগ্রতা ঝরে পড়েছিলাে, আমি রীতিমতাে অভদ্র হয়ে উঠেছিলাম। তবে ওই বামাচারী মানুষটিকে দেখলাম তিনি যে ভঙ্গিতে আমার প্রতি প্রশ্ন ছুঁড়ে দিতে শুরু করেছিলেন শেষে সে ভঙ্গিটি পরিহার করেছেন, আমার অভদ্র আচরণের মুখে খুবই ভদ্র ও সংযত হয়ে গেছেন। শেষ পর্যন্ত হাসিঠাট্টার মধ্যেই আমরা দুজনে হাত মিলালাম।
উনি ঢাকা থেকে ময়মনসিংহে এসেছিলেন সম্ভবত বাহার ও চঞ্চলদের মতাে বামপন্থী তরুণ ছাত্রদের আমন্ত্রণেই। চঞ্চল নামের ছেলেটি ভেতরে ভেতরে খুবই চঞ্চল ও অশান্ত হলেও আচরণে ছিলাে ভদ্র ও বিনয়ী। আমাকে সে ‘সংশােধনবাদী’ বলেই জানতাে। তবু নানা বিষয় নিয়ে আলােচনা করার জন্যে বারবার সে আমার কাছেই ছুটে আসতাে। আবার, আমি যেহেতু তার শিক্ষক, সেজন্যে শ্রদ্ধার ভাবটি বজায় রেখেই সে আমার সঙ্গে তর্কবিতর্ক করতাে, উদ্ধত আচরণ বা বেয়াদবি কখনাে করতাে না। লক্ষ করেছি, যখনই সে আমার সংশােধনবাদী’
৩৩৩
বক্তব্যের বিরুদ্ধে যথেষ্ট যুক্তির জোগান দিতে পারে না, তখনই সে ঢাকায় তার নেতাদের কাছে চলে যায়। তাদের কাছ থেকে তথ্য ও যুক্তির অস্ত্র সংগ্রহ করে নিয়ে আসে। সে গল্প কবিতাও লিখতাে। শিল্পসাহিত্যের সঙ্গে বিপ্লবের সম্পর্কটি বুঝতে চাইতাে। এ বিষয়ে আমার বক্তব্য তার ও তার সহমর্মিদের কাছে নিতান্তই অবিপ্লবী মনে হতাে। আবার তাদের একান্ত কাক্ষিত বিপ্লবী সাহিত্য তত্ত্বটিও তারা খুঁজে পাচ্ছিলাে না। তাই হয়তাে তারা ওই বিপ্লবী তাত্ত্বিক কমরেডটিকে ময়মনসিংহে নিয়ে এসেছিলাে। তবে, স্বাভাবিকভাবেই, সত্তর সালে বামমার্গীদের কার্যকলাপ তত্ত্ব আলােচনার মধ্যে সীমিত থাকে না। দ্রুত ‘অ্যাকশন’-এ চলে যাওয়ার জন্যে তারা ব্যগ্র হয়ে ওঠে। তাদের দৃঢ় বিশ্বাস জন্মে গিয়েছিলাে : সারাদেশে এখন চমৎকার বিপ্লবী পরিস্থিতি বিরাজ করছে। বুর্জোয়াদের দল আওয়ামী লীগ সেই বিপ্লবী পরিস্থিতি নষ্ট করে দেয়ার উদ্দেশ্যেই তাড়াতাড়ি ইলেকশন করার জন্যে পাগল হয়ে উঠেছে। তাদের সঙ্গে এসে যােগ দিয়েছে মণি সিংহ-মােজাফফরের অনুসারী সংশােধনবাদী চক্রটি। মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের এজেন্টদের সঙ্গে মিলিত হয়েছে রুশ সামাজিক সাম্রাজ্যবাদ ও ভারতীয় সম্প্রসারণবাদ। এই দুষ্টচক্রের হাত থেকে দেশকে বাঁচাতে হবে। ভােটের রাজনীতি দিয়ে দেশের কোনাে কল্যাণ হবে না। চাই বিপ্লব। বিপ্লবের লক্ষে সশস্ত্র সংগ্রাম। তাই তারা স্লোগান তুললাে ‘ভােটের আগে ভাত চাই।’
এই স্লোগানটি তারা তুলেছিলাে মওলানা ভাসানীর প্রশ্রয়ের ছায়ায় দাঁড়িয়ে। বামপন্থীরা বরাবরই ভেবে এসেছে যে তারা মওলানাকে ব্যবহার করছে। কিন্তু আসলেই মওলানা কি তাদের দ্বারা ব্যবহৃত হয়েছেন? এর জবাবে হ্যা বলা কোনাে মতেই সম্ভব নয়। মওলানা ভাসানী দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে কখনাে ডানে কখনাে বামে সঞ্চরণ করেছেন। চলার পথে প্রয়ােজন ও পছন্দমতাে কখনাে ডানদের কখনাে বামদের সঙ্গে নিয়েছেন, আবার প্রয়ােজন ফুরিয়ে যাবার পর তাদের ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছেন। পাকিস্তানের জন্মের পর শাসকদল মুসলিম লীগের বিরুদ্ধে যে রাজনৈতিক সংগঠন তিনি গড়ে তােলেন সেই আওয়ামী মুসলিম লীগে তাে ডানদেরই প্রাধান্য ছিলাে, তবু বামরাও সে সংগঠনকে আশ্রয় করতে বা সমর্থন জানাতে বাধ্য হয়েছে। আর এই বামদের সমর্থন নিয়েই তিনি আওয়ামী লীগের ডানদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেছেন এবং সাতান্ন সালের পশ্চিম পাকিস্তানকে ‘আচ্ছালামু আলাইকুম’ জানিয়েছেন, আওয়ামী লীগ ছেড়ে দিয়ে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির মতাে একটি রেডিক্যাল রাজনৈতিক দল গঠন করেছেন। আবার তেষট্টি সাল থেকে যে তিনি নানাভাবে ডানপন্থী স্বৈরাচারী আইউব শাহীকে সমর্থন জোগাতে শুরু করেন, সে বিষয়টিও তাে মিথ্যা নয়। এ নিয়ে রাজনীতিবিশ্লেষকদের কেউ কেউ আলােচনাও করেছেন। তবে তেষট্টির আগেও, এমনকি সাতান্ন সালে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ) গঠন করার সময়কালেও, মওলানার ভূমিকা নিতান্ত সরল ও সহজবােধ্য ছিলাে না। চুয়ান্ন সালে পূর্ববাংলার মানুষের নির্বাচনী রায়কে নস্যাৎ করে দিয়ে এখানে যখন ৯২ (ক) ধারা (অর্থাৎ গভর্নরের শাসন) জারি করা হয়, তখন মওলানা ভাসানী ছিলেন দেশের বাইরে। গভর্নর ইস্কান্দর মির্জা সে সময় ঘােষণা করেছিলেন যে, ভাসানী দেশে ফিরে এলে তাকে গুলি করে মারা হবে। অথচ, এই মির্জাই যখন পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট হলেন তখন ভাসানীর সঙ্গে তার সম্পর্ক হয়ে উঠলাে একান্ত হৃদ্য। আটান্নর শেষ বা ঊনষাটের শুরুতে ছাপ্পান্নর সংবিধানের অধীনে পাকিস্তানে সাধারণ নির্বাচন হবে—এ রকমটি যখন সবাই আশা করছে, তখনই রেডিক্যাল রাজনৈতিক দল ন্যাপের সভাপতি মওলানা আবদুল হামিদ খান
৩৩৪
ভাসানী যে অন্যরকম ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছিলেন, সে কথা আমি ময়মনসিংহের কমরেড আলতাব আলীর মুখে শুনেছি। আটান্নর জুলাই কি আগস্ট মাসে আলতাব আলী গিয়েছিলেন মওলানার সঙ্গে দেখা করে আসন্ন নির্বাচনের প্রস্তুতি সম্পর্কে আলাপ-আলােচনা করতে । মওলানা নাকি তখন তাকে বলেছিলেন, ইস্কান্দর মির্জাকে আমাদের সমর্থন জানাতে হবে। উনিই হবেন পাকিস্তানের নাসের।’
ইঙ্গ-মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে দৃঢ় অবস্থান নেয়ার জন্যে মিসরের জামাল আবদুন নাসের তখন সারা দুনিয়ার প্রগতিশীলদের কাছে অত্যন্ত শ্রদ্ধেয়। সেই নাসেরের সঙ্গে কিনা মওলানা ভাসানী তুলনা দিচ্ছেন সাম্রাজ্যবাদের তল্পিবাহক পাকিস্তানের প্রতিক্রিয়াশীল প্রেসিডেন্ট ইস্কান্দর মির্জার!
কমরেড আলতাব আলী অবাক হয়ে বলেছিলেন, আপনি একি বলছেন হুজুর? আমরা যখন আগামী ইলেকশানের প্রস্তুতির কথা চিন্তা করছি, তখন আপনি বলছেন ইস্কান্দর মির্জাকে সাপাের্ট দেয়ার কথা। মওলানা বলেছিলেন, “ইলেকশান টিলেকশান হবে না। চুপচাপ বসে থাকো। দেখাে, কী হয়।’
এর মাস দুই পরেই ইস্কান্দর মির্জা পাকিস্তানে সামরিক শাসন জারির ঘােষণা দিয়েছিলেন, সংবিধান বাতিল করে দিয়েছিলেন, রাজনৈতিক কার্যকলাপ নিষিদ্ধ করে দিয়েছিলেন। এ রকমটি যে ঘটবে মওলানা ভাসানী কি আগে থেকেই তা জানতেন?
ইস্কান্দর মির্জা অবশ্যি সামরিক আইন জারি করার তিন সপ্তাহের মধ্যে ক্ষমতাচ্যুত হলেন, মঞ্চাবতীর্ণ হলেন আইউব খান। মওলানাকেও ঢাকার একটি বাড়িতে অন্তরীণ করে রাখা হলাে। আইউব একটি তথাকথিত শাসনতন্ত্র জারি করার পর এক সময় মওলানা মুক্ত হয়ে এলেন, জনগণের দাবির সঙ্গে তিনিও কণ্ঠ মেলালেন। তারপর আইউবের দূত রূপে তার চীনে যাওয়া এবং এর পরবর্তী সময়ের ভূমিকা নিয়ে যতাে প্রশ্নই আমরা উত্থাপন করি না কেনাে, উনসত্তরে গণঅভ্যুত্থানের এক পর্যায়ে তাে সেই মওলানাকে আমরা গণআকাক্ষার মুখপাত্র রূপেই পেলাম। আবার সত্তরে সাধারণ নির্বাচনের আগে-পরে তার ভূমিকায় তাে হরেক রকম রঙ ধরেছে। এই অল্পদিনের মধ্যেই কখনাে তিনি পাকিস্তানের অখণ্ডতা রক্ষার জন্যে জান কোরবান করার কথা বলেছেন, কখনাে লাহাের প্রস্তাব বাস্তবায়নের প্রস্তাব উত্থাপন করেছেন, কখনাে ইসলামী সমাজতন্ত্রের প্রবক্তা হয়েছেন, কখনাে বা একেবারে স্বাধীন পূর্বপাকিস্তানের ঘােষণাই দিয়ে ফেলছেন। যে ‘চীনপন্থী কম্যুনিস্টরা মওলানাকে ঘিরে রেখেছিলেন তারা প্রায় সবাই একাত্তরের জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি মাসের মধ্যেই তার নেতৃত্ব অস্বীকার করলেন, অথবা তিনিই তাদের দূরে ঠেলে দিলেন। পাকিস্তানের এককালের প্রখ্যাত বামপন্থী ছাত্রনেতা তারিক আলী থেকে শুরু করে এখানকার হাজী দানেশ, মােহাম্মদ তােয়াহা, বদরুদ্দীন উমর, মাহবুব উল্লাহ কিংবা মফিদুল হক পর্যন্ত অনেকের বক্তব্যের সারসংক্ষেপ নিয়ে মওলানার ভূমিকার সংক্ষিপ্ত অথচ মূল্যবান বিশ্লেষণ উপস্থিত করেছেন তরুণ গবেষক ডক্টর মােহাম্মদ হাননান তার বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস-এ [দ্রষ্টব্য : ড. মােহাম্মদ হাননান, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস, (ঢাকা-১৯৯২), পৃষ্ঠ ২১২-২১৯] ।
আমার ঘনিষ্ঠ পরিচিতজনদের মধ্যে অধ্যাপক সৈয়দ আবদুস সাত্তার মওলানা ভাসানী সম্পর্কে অত্যন্ত কড়া মন্তব্য করেছেন।
সাত্তার ভাই শেরপুরের লােক। উনিশ শাে আঠাশ সালে তাঁর জন্ম। ছাত্রজীবন থেকে বৃদ্ধ বয়স পর্যন্ত তিনি বামপন্থী আন্দোলনের সঙ্গে নিজেকে সংযুক্ত রেখেছেন। সারা জীবনের
৩৩৫
অভিজ্ঞতা নিয়ে রচিত তার মূল্যবান স্মৃতিকথা আমার দেশ আমার জীবন। এই স্মৃতিকথারই এক জায়গায় তিনি লিখেছেন— ‘আইয়ুবের প্রতি সমর্থন ও ছয়দফা আন্দোলনের বিরােধিতার মাধ্যমে ভাসানীর গৌরবময় জীবনে অধঃপতনের সূচনা হয়। অবশেষে ‘৭০-এর নভেম্বরে বরিশালের মহাদুর্যোগকে কেন্দ্র করে ভাসানী, আতাউর রহমান ও পীর মােহসেন উদ্দীন দুদু মিঞার আকস্মিক স্বাধীনতা ঘােষণা, অতিবিপ্লবী পদক্ষেপের মাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তি আন্দোলনকে পথভ্রষ্ট করার এক সুপরিকল্পিত চক্রান্ত ছিলাে। সেই কারণেই পাকিস্তান সরকার স্বাধীনতার এই তিন প্রবক্তাকে সারা বাংলা ঘুরে বেড়ানাের সুযােগ দিয়েছিলেন এবং ২৫ মার্চে স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই এই তিন সৈনিকের দুইজন আতাউর রহমান খান ও পীর মােহসেন উদ্দীন আত্মসমর্পণ করে পাকিস্তানের অখণ্ডতা প্রচারে আত্মনিয়ােগ করেন। পাকবাহিনী মওলানা ভাসানীর বাড়ি পুড়িয়ে দেয়ায় তিনি বাধ্য হয়ে অথবা পরিকল্পনামাফিক ভারতে আশ্রয়গ্রহণ করেন। তার দক্ষিণ হস্ত মশিউর রহমান যাদু মিঞা ভারত থেকে ফিরে এসে সরকারের পক্ষে প্রচারে অবতীর্ণ হন। স্বাধীনতার পর মওলানা ভাসানী বাংলাদেশে ফিরে এসেই সাম্প্রদায়িকতা ও ভারত-বিদ্বেষ প্রচারে আত্মনিয়ােগ করেন। স্বাধীনতা সংগ্রামে রক্তের রাখিবন্ধনের মাধ্যমে যে সাম্প্রদায়িকতা ও ভারত-বিদ্বেষের প্রায় মৃত্যু ঘটেছিলাে মওলানা ভাসানী তাকে পুনর্জীবন দান করে জামাতে ইসলামী ও মুসলিম লীগের পুনঃআবির্ভাবের সুযােগ করে দিলেন। শেখ মুজিবের অন্ধ বিরােধিতা ও জিয়াউর রহমানের আবির্ভাবকে অভিনন্দন জানিয়ে এই বর্ষীয়ান নেতা শেষ জীবনে এ দেশের প্রগতিশীল আন্দোলনের যে ক্ষতি করে গেলেন তা অপূরণীয়। প্রগতিশীল আন্দোলনের অন্যতম পুরােধা এবং অবশেষে ঐ আন্দোলনের বৃহত্তম ক্ষতিকারক মওলানা ভাসানী সত্যই এক দুর্বোধ্য চরিত্র।’ [অধ্যাপক সৈয়দ আবদুস সাত্তার : আমার দেশ আমার জীবন (ঢাকা-১৯৯৫), পৃষ্ঠা ১৫২-৫৩]

ভােটের রাজনীতি ও জনগণের প্রজ্ঞা :‘ভােটের আগে ভাত চাই’ কিংবা
‘ভােটের বাক্সে লাথি মারাে, বাংলাদেশ স্বাধীন করাে’—এরকম স্লোগান সত্তর সালের পূর্ব পাকিস্তানকে উচ্চকিত করে তুললেও এখানকার সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষেরই ভােটের ব্যাপারে ছিলাে অপরিসীম উৎসাহ। সে উৎসাহের সামনে ভােট-বিরােধীদের ‘বিপ্লবী কণ্ঠস্বর আস্তে আস্তে ক্ষীণ হয়ে এসেছিলাে। তবু কট্টর ভােট-বিরােধী একটি গােষ্ঠী তাদের বিরােধিতার আদর্শ পরিত্যাগ করেনি। জনগণের ভালাে করতে চায় তারা, অথচ বেকুব জনগণ তাদের সমর্থন। করে না! এ দুঃখ তারা রাখবে কোথায়! জনগণের ওপর বড়াে অভিমান হয় তাদের। এ-রকম একটি অভিমানী গােষ্ঠীই বােধ হয় সেদিন মনের দুঃখে বনে চলে গিয়েছিলাে। দেয়াল লিখনে তারা জানিয়ে দিয়েছিলাে—শুয়রের বাচ্চা জনগণ, করগে তােরা নির্বাচন, চললাম আমরা সুন্দরবন’। না, এই লিখনটি কোনাে দেয়ালে আমি নিজ চোখে দেখিনি। একটি সাপ্তাহিকে এ রকম একটি দেয়াল লিখনের যে-ছবি ছাপা হয়েছিলাে সেটিই দেখেছিলাম। গুজব রটেছিলাে : বিপ্লবীদের একটি গােষ্ঠী সুন্দরবনের গভীরে ঘাঁটি তৈরি করে সশস্ত্র বিপ্লবের প্রস্তুতি নিচ্ছে, এক সময় তারা বন থেকে বেরিয়ে এসে বুর্জোয়াদের উৎখাত করবে, দেশে প্রলেতারিয়েতের রাজত্ব কায়েম করবে। গ্রাম দিয়ে শহর ঘেরাও করা কিংবা কৃষকদের মুক্তাঞ্চল গঠন করার কথাও
৩৩৬
তখন খুব শােনা যাচ্ছিলাে। ইতিহাসের দুই নাম, নক্সালবাড়ি ভিয়েনাম’—এই স্লোগান ও নক্সাল নেতা চারু মজুমদারের ‘চীনের চেয়ারম্যান আমাদের চেয়ারম্যান’ও অনেক শহুরে ছাত্রযুবকের প্রাণে উৎসাহের আগুন জ্বালিয়ে দিয়েছিলাে। তবে, সত্যি কথা হলাে, জনগণ এআগুনে ইন্ধন জোগায়নি। তাই, এ-আগুন এখানে ওখানে খপ করে জ্বলে উঠেই দপ করে নিভে গেছে।
এ দেশের মানুষ ইলেকশান ও ভােটের সঙ্গে দীর্ঘদিন ধরে পরিচিত। ইউনিয়ন বাের্ড আর লােকাল বাের্ডের ইলেকশানেই ভােটে তাদের হাতে খড়ি। তারপর সেই ইংরেজ আমলেই আইন সভায় প্রতিনিধি পাঠাতেও তারা ভােট দিয়েছে। ছেচল্লিশ সালে ভােটের অধিকার প্রয়ােগ করেই পাকিস্তানের জন্মকে সম্ভব করে তুলেছে। আবার পাকিস্তান সৃষ্টির পর দোর্দণ্ড প্রতাপ মুসলিম লীগ সরকারকে চুয়ান্ন সনে তারা প্রত্যাখ্যান করেছে এই ভােটের শক্তিতেই। অবশ্যি তাদের ভােট পেয়েই একটি ক্ষুদ্র গােষ্ঠী ক্ষমতাধর হয়েছে, জনগণের শাসক ও শােষক হয়ে বসেছে। জনগণের ভােটের জোরে ক্ষমতায় বসেই এই শাসক-শােষকরা জনগণের রায়কে উপেক্ষা ও অপমান করেছে, জনগণকে প্রতারিত করেছে। এক পর্যায়ে পাকিস্তানের জঙ্গ বাহাদুররা জঙ্গি শাসন জারি করে জনগণের ভােটের অধিকারও কেড়ে নিয়েছে। গণদুশমন ওই শাসক শােষকরা জনগণের হাতের ওই ভােটের অস্ত্রটিকে ভীষণ ভয় করে বলেই তাে তাদের নিরস্ত্র করে রাখতে চায়। জঙ্গি শাসক আইউবের ‘মৌলিক গণতন্ত্র’ তাে জনগণকে নিরস্ত্রকরণেরই অপর নাম। তবু, মৌলিক গণতন্ত্রী ব্যবস্থাতেও ভােটের যেটুকু অধিকার জনগণের হাতে ছিলাে সে অধিকারটুকুরই সর্বাধিক ব্যবহার তারা করতে চেয়েছে। মৌলিক গণতন্ত্রের নির্বাচনে ভােট দিতেও তাদের উৎসাহে ঘাটতি পড়েনি। এমনকি, পঁয়ষট্টির জানুয়ারিতে তারা মৌলিক গণতন্ত্রীদের ভােটেই আইউবকে গদিচ্যুত করে ফাতেমা জিন্নাকে ক্ষমতাসীন করার স্বপ্ন দেখেছে।
তাদের স্বপ্নভঙ্গ ঘটেছে অবশ্যই। প্রমাণিত হয়েছে যে, তথাকথিত মৌলিক গণতন্ত্রীদের দিয়ে সত্যিকারের গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা অসম্ভব। তবে স্বপ্নভঙ্গ হয়েছে বলেই জনগণ নিষ্ক্রিয় হতাশার কোলে আত্মসমর্পণ করে বসেনি। তারা বরং অধিকতর সক্রিয় ও সংগ্রামী হয়ে উঠেছে। স্বপ্নভঙ্গের ফলেই মরীচিকার মােহ থেকে তারা মুক্তি পেয়েছে, বাস্তব সচেতন হয়েছে, আসল শত্রুদের ভালাে করে চিনে নিয়েছে। যাদের আমরা অজ্ঞ মূর্খ অশিক্ষিত বলে জানি, সেই সাধারণ জনগণ আসলে অসাধারণ প্রজ্ঞার অধিকারী। এই প্রজ্ঞার বলেই বাস্তব অভিজ্ঞতা থেকে তারা শিক্ষা নেয়, কিংবা বাস্তব অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়েই তারা প্রজ্ঞাবান হয়ে ওঠে। সঠিকভাবে ভােটের অধিকার প্রয়ােগ করতে তারা জানে, আবার যখন তাদের ভােটকে শাসকরা প্রহসন বানিয়ে ফেলবে বলে বুঝে ফেলে তখন তারা ভােট দেয়া থেকে বিরতও থাকতে পারে। অর্থাৎ তারা তাদের স্বাভাবিক প্রজ্ঞা বলেই জানে কখন কোন নির্বাচনে ভােট দিতে হবে আর কোন নির্বাচন বর্জন বা প্রত্যাখ্যান বা প্রতিহত করতে হবে। সে কারণেই পঁয়ষট্টির প্রেসিডেন্ট নির্বাচন ও পাক-ভারত যুদ্ধের অভিজ্ঞতা থেকে তারা যেমন ছেষট্টির ছয়দফা আন্দোলনকে মনে প্রাণে সমর্থন জানিয়েছে, তেমনি এর পরে মৌলিক গণতন্ত্রকে পুরােপুরি প্রত্যাখ্যান করে সার্বজনীন ভােটাধিকারের দাবিতে আন্দোলনে নেমেছে। সেই আন্দোলনই উনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানে পরিণত হয়েছে, গণঅভ্যুত্থানের পরিণতিতেই সত্তরে জনগণ তাদের হারানাে ভােটাধিকার ফিরে পেয়েছে। সেই ফিরে পাওয়া অধিকার তারা ছেড়ে
৩৩৭
দেবে কেন? ভাতের অভাবে সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ জর্জরিত অবশ্যই। ভাতের প্রয়ােজন তাদের কাছে বড়াে বেশি তীব্র। কিন্তু ভােটের অধিকার ছেড়ে দিলেই কি তারা ভাতের অধিকার পেয়ে যাবে? স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা তারা মনের গভীরে সযতনে সংগােপনে লালন করে নিশ্চয়ই। কিন্তু ভােটের বাক্সে লাথি মারলেই কি স্বাধীনতা তাদের হাতের মুঠোয় এসে যাবে?
এ-প্রশ্নগুলাে তারা এ-রকম ভাষায় করে না বটে, কিন্তু প্রশ্নগুলাের উত্তর তাদের জানা আছে বলেই ভােটবিরােধীদের বালখিল্য আহ্বানে তারা সাড়া দেয় না। লক্ষ স্থির করে ফেলে তারা। ছেচল্লিশে পাকিস্তান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার লক্ষে ভােটের বাক্স ভরে তুলেছিলাে যারা, সত্তরের নির্বাচনে তারাই সেই পাকিস্তানের কবর রচনার সিদ্ধান্ত জানিয়ে দেবার প্রস্তুতি নেয়। ক্ষুদ্র একটি বামপন্থী গােষ্ঠীর নির্বাচন-বর্জনের প্রয়াসকে এদেশের জনগণ প্রত্যাখ্যান করে।
সত্তরের নভেম্বরে প্রলয়ংকরী সামুদ্রিক ঝড়ে এখানকার একটি অঞ্চলের লাখ লাখ মানুষ যখন প্রাণ হারায়, এবং পাকিস্তানের শাসককুল এ-রকম বিপর্যয়েও সীমাহীন ঔদাসীন্য ও দায়িত্বহীনতার পরিচয় দেয়, তখন পাকিস্তানের প্রতি বাঙালিদের বিন্দুমাত্র মােহও আর অবশিষ্ট থাকে না। মােহমুক্তির এই প্রেক্ষাপটেই সত্তরের ডিসেম্বরের নির্বাচনে এখানকার ভােটাররা বাঙালি জাতীয়তাবাদের পক্ষে তাদের ভােটগুলাে উজাড় করে দিয়ে দেয়। চুয়ান্নর যুক্তফ্রন্টের মতাে সত্তরের নির্বাচনেও বাঙালি জাতীয়তাবাদী আওয়ামী লীগের নির্বাচনী প্রতীক ছিলাে নৌকা। চুয়ান্নয় যে জনগণ নৌকাকে তাদের প্রাণের প্রতীক বানিয়েছিলাে, ষােল বছর পরে তারাই আবার সেই নৌকায় নতুন করে পাল উড়িয়ে দিলাে।
সত্তরে ময়মনসিংহ সদর থানা নির্বাচনী এলাকায় আওয়ামী লীগের প্রার্থী ছিলেন সৈয়দ আবদুস সুলতান। কৃতী আইনজীবী সুলতান সাহেব ছিলেন একজন বিশিষ্ট লেখক ও সুবক্তা। ‘মােমেনশাহী সাহিত্য মজলিস’ সহ ময়মনসিংহের বিভিন্ন সাংস্কৃতিক সংগঠনের সঙ্গে তাঁর। সক্রিয় সংযােগ ছিলাে। সেই সূত্রে আমি তাকে খুব ঘনিষ্ঠ ভাবেই জানতাম। সৈয়দ নজরুল ইসলামের সঙ্গেও তার ব্যক্তিগত সম্পর্ক ছিলাে অত্যন্ত হৃদ্য। কিন্তু রাজনীতিতে তাে আটষট্টি সাল পর্যন্তও সুলতান সাহেব ছিলেন মুসলিম লিগার। কাউন্সিল মুসলিম লীগের প্রার্থী হিসেবে আইউব খানের মৌলিক গণতন্ত্রীদের ভােটে তিনি পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন। উনসত্তরে আওয়ামী লীগে যােগ দিয়ে সত্তরেই তিনি দলীয় মনােনয়ন পেয়ে যান। দু’দিন আগেও যিনি সাম্প্রদায়িক রাজনীতি করতেন তাঁকেই আওয়ামী লীগের মতাে অসাম্প্রদায়িক দল নমিনেশন দিয়ে দেয়ায় সে দলের অনেককেই ক্ষুব্ধ হতে দেখেছি। কিন্তু ভােটারদের মনে এ নিয়ে কোনাে প্রশ্ন ওঠেনি। তারা তখন কোনাে বিশেষ প্রার্থীকে চেনে না, চিনতেও চায় না। তারা কেবল চেনে শেখ মুজিব আর তার নৌকা। চুয়ান্ন সালে বলতাে হক সাহেবের নৌকা, এবার বলে মুজিবরের নৌকা। সত্তরের নির্বাচনের সময় কিংবা তার পরেও গাঁয়ের লােকের মুখে ‘বঙ্গবন্ধু’ কথাটা শুনিনি। বঙ্গবন্ধু’ না বলে তাঁর প্রতি যে তারা শ্রদ্ধা ভালােবাসা কম দেখিয়েছে, তা কিন্তু নয়। তাদের মুখে মুজিবর’ নামটির দরদভরা উচ্চারণের মধ্যেই এই মানুষটির প্রতি তাদের আপন-জনসুলভ নির্ভরতা ও ভালােবাসার বহিঃপ্রকাশ ঘটতাে। নৌকায় ভােট দিলে সে ভােটটা পেয়ে যাবে মুজিবর—এই ছিলাে তাদের সহজ হিসাব। কাজেই কোন প্রার্থীকে তারা ভােট দিচ্ছে, কী তার নাম পরিচয়, এ নিয়ে তাদের কোনাে মাথাব্যথা ছিলাে না।
গাঁয়ের নিরক্ষর কৃষকদের (অর্থাৎ এদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ ভােটারদের) এই সহজিয়া আচরণ ও বিবেচনাকে শহুরে শিক্ষিত মানুষেরা মােটেই ভালাে চোখে দেখে না। ওই অশিক্ষিত
৩৩৮
মানুষগুলাে চলে হুজুগে ভর করে, গাঁয়ের মােড়ল মাতব্বররা যেমন বােঝায় তেমনি তারা বােঝে, রাজনীতির জটিল সূক্ষ্ম বিষয় বুঝবার মতাে ক্ষমতা বা যােগ্যতা তাদের নেই— শিক্ষাভিমানী মানুষদের এ-রকমই উন্নাসিক ধারণা।
সংস্কারমুক্ত দৃষ্টি দিয়ে বিচার করলে কিন্তু এদের এ-রকম ধারণার ফাঁক ও ফাকিগুলাে অতি সহজেই ধরা পড়ে। উনিশ শো সাঁইত্রিশ, ছেচল্লিশ ও চুয়ান্নর নির্বাচনে বাংলার নিরক্ষর কৃষকরা যে যথাক্রমে প্রজাপার্টি, মুসলিম লীগ আর যুক্তফ্রন্টকে ভােটে জিতিয়ে দিয়েছিলাে তা কি কেবল হুজুগের বশেই? কিংবা হুজুগই যদি হয়ে থাকে তবে সে হুজুগে কি জনগণের আশা আকাক্ষারই প্রতিফলন ছিলাে না? জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠার একেকটি বৃহৎ ইস্যুকে কেন্দ্র করেই কি সে হুজুগ সৃষ্টি হয়নি? আর এ ক্ষেত্রে গাঁয়ের মােড়ল মাতব্বরদের মেনেই কি তারা চলেছে? আমরা তাে জানি : গাঁয়ের মােড়ল মাতব্বররা সব সময়েই কায়েমি স্বার্থের ধারক, সাধারণের স্বার্থের বিরুদ্ধেই তাদের অবস্থান। সবগুলাে নির্বাচনেই তাে কৃষকরা ওই সব কায়েমি স্বার্থবাদী মােড়ল মাতব্বরদের অভিপ্রায়ের বিরুদ্ধেই তাদের ভােটাধিকার প্রয়ােগ করেছে। ওই সব নির্বাচনে একেকটি জাতীয় ইস্যুই প্রধান হয়ে এসেছে, নির্বাচনগুলাের চরিত্র হয়ে উঠেছে রেফারেন্ডামের। কাজেই এ সব নির্বাচনে ভােটারদের কাছে বিশেষ প্রার্থীটির ব্যক্তিগত পরিচয় মােটেই বড়াে হয়ে দেখা দেয় না, বড়াে হচ্ছে তার দলীয় পরিচয়। আর দলীয় পরিচয়ের প্রতীক হয়ে আসে তার বড় নেতা, সেই নেতাকে লক্ষ করেই তারা ভােট দেয়। তাই সাঁইত্রিশ, ছেচল্লিশ ও চুয়ান্ন—প্রত্যেকবারের নির্বাচনেই তাদের সে সময়কার আস্থাভাজন নেতার কথায় তারা কলাগাছে’ ভােট দিয়েছে। না কলাগাছ মার্কায় নয়। নেতারা ভােটারদের বলেছেন, আমরা যাকে প্রার্থী হিসেবে দাঁড় করিয়েছি সে যদি কলাগাছও হয়, তবু তাকেই আপনারা ভােটটা দেবেন। কলাগাছ হলেও আমাদের কথাতেই সে চলবে-ফিরবে, তাকে ভােট দিলেই আমরা আপনাদের প্রাপ্য আদায় করে দিতে পারবাে।’
সত্তরের নির্বাচনেও তারা তাদের নেতা শেখ মুজিবের কলাগাছেই ভােট দিয়েছে। নৌকা প্রতীকটিকেই তারা চিনেছে, অন্য কোনাে দিকেই তাকানাের প্রয়ােজন মনে করেনি। এ রকম করে যে তারা ভুল করেনি, ইতিহাসই তার সাক্ষী। তথাকথিত শিক্ষিত ও শিক্ষাভিমানী লােকেরা বিশেষ বিশেষ রাজনৈতিক পরিভাষা ব্যবহার করে রাজনীতির সূক্ষ্ম জটিলতার বিশ্লেষণ করতে পারেন। অগণিত অনক্ষর কৃষক ভােটাররা তা না পারলেও তাদের নিজেদের স্বার্থটি বােঝার ক্ষমতা ও যােগ্যতা তাদের আছে, ভােটের বেলায় সেই ক্ষমতা ও যােগ্যতার পরিচয়ই তারা রাখে।
বিভ্রান্তি ও বিদ্বেষ ছড়ায় বরং শিক্ষিত মধ্যবিত্তদের কিংবা কায়েমি স্বার্থের ধারকদের মধ্য থেকে বেরিয়ে আসা বিভিন্ন গােষ্ঠী ও তাদের নেতারাই, অশিক্ষিত ও নিঃস্ব নির্যাতিত কৃষকরা নয়। চুয়ান্নর নির্বাচনে সাম্প্রদায়িকতার প্রচার করেছে যারা তারা কি হুজুগে চলা কৃষক, না মতলববাজ শিক্ষিত নেতা? সত্তরের নির্বাচনেও তাে শিক্ষাভিমানীদের বিভিন্ন গােষ্ঠীর নেতারাই নানা অভিনব তত্ত্ব হাজির করেছে ও মুখরােচক স্লোগান তুলেছে। নানান কিসিমের ডান-বাম দলের এরাই তাে স্রষ্টা। এদের কেউ যেমন বিপ্লবের নামে ‘ভােটের আগে ভাত কিংবা ‘ভােটের বাক্সে লাথি মেরে বাংলাদেশ স্বাধীন করার কথা বলেছে, তেমনি এদেরই অন্যগােষ্ঠী ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতার উস্কানি দিয়ে বাঙালি জাতির আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকারের বিরােধিতা করেছে। ওরাই বাঙালি জাতীয়তাবাদের নেতা শেখ মুজিবকে ব্যঙ্গ করে বলেছে বঙ্গবন্ধুর রঙ্গ দেখে অঙ্গ
৩৩৯
জ্বলে যায়’, সাম্প্রদায়িক উস্কানি ভরা স্লোগান দিয়েছে জয়বাংলা জয়হিন্দু, লুঙ্গি খুইল্যা ধুতি পিন্দ’ । ও রকম সকল ডান-বাম গােষ্ঠীর সকল রকম মুখরােচক স্লোগানকে প্রত্যাখ্যান করেই সংখ্যাগরিষ্ঠ নিরক্ষর ভােটাররা নির্বাচনে অংশ নিয়েছে, পূর্ব পাকিস্তানে জাতীয় পরিষদের একশাে বাষট্টিটি আসনের মধ্যে একশাে ষাটটিতেই বাঙালি জাতীয়তাবাদী আওয়ামী লীগকে জিতিয়ে দিয়েছে। অন্য দুটো আসনের একটিতে জিতে যান চাকমা রাজা ত্রিদিব রায়, আর অন্যটিতে পূর্ব পাকিস্তানের এককালের মুখ্যমন্ত্রী নূরুল আমিন।
তাহলে কি ওই দুটো আসনের ভােটাররা ভুল সিদ্ধান্ত দিয়েছিলাে? সারা দেশে যখন বাঙালি জাতীয়তাবাদী নৌকার জোয়ার, তখন সেই জোয়ারের বিরুদ্ধে পার্বত্য চট্টগ্রামের ভােটাররা কেন ভােট দিলাে উপজাতির রাজাকে? আর ময়মনসিংহ জেলার নান্দাইলের ভােটাররা বাঙালির মাতৃভাষার দুশমন ও বায়ান্নর একুশের খুনী নূরুল আমিনকে?
পার্বত্য চট্টগ্রাম সম্পর্কে প্রত্যক্ষ জ্ঞান আমার নেই। তবে অনুমান করতে পারি : ওখানকার পাহাড়ি অধিবাসীরা তাদের নিজস্ব অস্তিত্ব ও কৃষ্টিগত অধিকার রক্ষার বিষয়টিকে সংগত কারণেই গুরুত্ব দিয়েছে, বাঙালি জাতীয়তাবাদের জোয়ারে আত্মসমর্পণের আত্মঘাতী নীতি গ্রহণ করতে পারেনি। তাই তাদের রাজাকে ভােট দিয়ে তারা ভুল করেছে, এমন কথা সম্ভবত বলা যায় না। ময়মনসিংহের নান্দাইলের ঘটনাটিকে মােটামুটি কাছে থেকেই অনুধাবন করবার সুযােগ আমার হয়েছে। নান্দাইলে আওয়ামী লীগের প্রার্থী ছিলেন ময়মনসিংহ জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি রফিক উদ্দিন ভূইয়া। ভূইয়া সাহেব সংগ্রামী নেতা। এ জেলায় আওয়ামী লীগ দলটিকে গড়ে তােলার পেছনে তার অবদানের কথা কেউই অস্বীকার করতে পারবে না। ভাষা আন্দোলনের জন্যে তিনি কারা নির্যাতনও ভােগ করেছেন। গণমনে তাঁর প্রতি শ্রদ্ধাও কম ছিলাে না। অথচ, নান্দাইলের ভােটাররা তার বদলে নূরুল আমিনকেই ভােট দিয়ে জিতিয়ে দিলাে। এরও কারণ, আমি মনে করি, ভােটারদের ভ্রান্তি নয়। এর আগে প্রতারিত হয়েছে বলেই নেতাদের বিরুদ্ধে নান্দাইলের ভােটারদের প্রচণ্ড ক্ষোভ ছিলাে। চুয়ান্নর নির্বাচনে শেরে বাংলা ফজলুল হক সে সময়কার বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র খালেক নেওয়াজকে কলাগাছ’ খাড়া করে তাঁর পক্ষে নান্দাইলবাসীদের ভােট চেয়েছিলেন। নান্দাইলের ভােটাররা শেরে বাংলার প্রতি একান্ত স্বাভাবিক ও সংগত আনুগত্য প্রকাশ করে খালেক নেওয়াজকেই ভােট দিয়েছিলাে। কিন্তু ভােটে জেতার পর খালেক নেওয়াজ ভােটারদের আস্থার মর্যাদা রক্ষা করেননি। তাঁর দলত্যাগ ও অন্যান্য কার্যকলাপ এলাকাবাসীদের রুষ্ট ও ক্ষুব্ধ করে তুলেছিলাে। রােষ ও ক্ষোভ শুধু খালেক নেওয়াজের বিরুদ্ধে নয়, খালেক নেওয়াজদের দল ও গােষ্ঠীর বিরুদ্ধেও। অন্যদিকে এরই প্রতিক্রিয়া থেকে তাদের মনে নূরুল আমিনের প্রতি সহানুভূতি জন্মে গিয়েছিলাে। নূরুল আমিনের মুখ্যমন্ত্রিত্ব চলে চাওয়ার পর যারা ক্ষমতাসীন হয়েছে তাদের কারাে আমলেই এলাকার কোনাে উন্নয়ন ঘটেনি বলে নান্দাইলবাসীদের দৃষ্টিতে ধরা পড়েছিলাে। এ-রকম নানা ক্ষোভ রােষ ও প্রতিক্রিয়া থেকেই, সারা দেশে নৌকার জোয়ার সত্ত্বেও, সত্তরের নির্বাচনে নান্দাইলের ভােটাররা উল্টোমুখী অবস্থান নেয়। এ-রকম ব্যতিক্রমী ঘটনার জন্যেও ভােটারদের বুদ্ধি বিবেচনাকে কটাক্ষ না করে রাজনৈতিক নেতাদেরই আত্মসমালােচনার কষ্টি পাথরে নিজেদের যাচাই করে নেয়া উচিত নয় কি?
৩৪০
সত্তরের নির্বাচনে পর্যদস্ত সাম্প্রদায়িকতা
সত্তরের নির্বাচনে বাঙালি জাতীয়তাবাদী আওয়ামী লীগের সঙ্গে অধ্যাপক মােজাফফর আহমদের নেতৃত্বাধীন রেডিক্যাল রাজনৈতিক দল ন্যাপের একটি ঐক্যজোট গড়ে উঠকু– আন্ডারগ্রাউন্ড কম্যুনিস্ট পার্টির এ রকমই প্রত্যাশা ছিলাে। ন্যাপও বারবার আওয়ামী লীগকে ঐক্য প্রস্তাব দিয়েছে। কিন্তু আওয়ামী লীগ প্রতিবারই সে প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছে। আওয়ামী লীগের ডানপন্থীরাই যে ঐক্যের কট্টর বিরােধী ছিলাে, সে কথা ঠিক। তবে অন্যরাও যে ঐক্য প্রস্তাবকে সুনজরে দেখেছে, তেমন বলা যাবে না। আওয়ামী লীগে যারা ছিলেন উদারপন্থী বা বামঘেঁষা, আন্দোলনে তারা ন্যাপ-কম্যুনিস্টদের সহায়তা নিতে আগ্রহী ছিলেন। আওয়ামী লীগ দলের অভ্যন্তরেই নির্বাচনে ক্যান্ডিডেট হবার মতাে বহু লােক ছিলাে, নিজেদের মধ্যেই দলের মনােনয়ন পাওয়া নিয়ে কম গুতােগুতি চলছিলাে না। এর ওপর যদি অন্য দল এসে প্রার্থী পদে ভাগ বসায় তবে সমস্যা আরাে প্রকটই হয়ে উঠবে। কাজেই ঠেকাও ন্যাপ-কম্যুনিস্টদের সঙ্গে নির্বাচনী ঐক্য।
আওয়ামী লীগের মূল নেতাদের ঐক্যভীতি অবিশ্যি অন্য কারণে। অন্য দলের সঙ্গে নির্বাচনী মাের্চা করা মানে সেই দলের স্বাতন্ত্রকে স্বীকার করে নিয়েই মাের্চার প্রার্থী পদে মনােনয়ন দেয়া। এমনটি করলে আওয়ামী লীগ বহির্ভূত অন্যদলের সদস্যটির ওপর তাে আওয়ামী নেতা নিরঙ্কুশ নেতৃত্ব ফলাতে পারবে না। আওয়ামী লীগের মতাে বড়াে ও রমরমা অবস্থার একটি দলের নেতারা এমনটি মেনে নেবেন কেন? এছাড়া তারা বুঝে ফেলেছিলেন যে, বাঙালি জাতীয়তাবাদের পক্ষে যে রকম গণজোয়ার জাগতে শুরু করেছে তাতে আওয়ামী লীগ একাই অনায়াসে নির্বাচনী দরিয়া পার হয়ে যেতে পারবে, অন্যকে সঙ্গে নেয়ার কোনাে প্রয়ােজনই পড়বে না। এ সুযােগে অন্য অন্য দলগুলােকে দুর্বল করে দিয়ে আওয়ামী লীগকে আরাে শক্তপােক্ত করে তােলার চেষ্টা করাই বরং বুদ্ধিমানের কাজ। তাই, শেখ মুজিব একদিন তাে ন্যাপ সম্পর্কে ইঙ্গিত করে বলেই ফেললেন, ‘একটি দল ঐক্য ঐক্য করে আমার মাথা খারাপ করে ফেলছে। অতােই যদি ঐক্যের শখ তাে ওরা সাইনবাের্ড বদলে আওয়ামী লীগে চলে এলেই পারে।
ন্যাপের জন্যে কথাটা খুবই কঠোর ও অপমানজনক ছিলাে সন্দেহ নেই। তবু তার পক্ষে সেদিন তা হজম করা ছাড়া উপায় ছিলাে না।
শেষ পর্যন্ত, নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রতি সাধারণ সমর্থন জানিয়েও, জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদের কয়েকটি আসনে ন্যাপ তার নিজস্ব প্রার্থী দাঁড় করিয়েছিলাে আন্ডারগ্রাউন্ড কম্যুনিস্ট পার্টির সমর্থন নিয়েই। ন্যাপের নির্বাচনী প্রতীক হলাে কুঁড়েঘর। ময়মনসিংহ সদর থানার নির্বাচনী এলাকা থেকে পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক পরিষদে ন্যাপের টিকিটে প্রার্থী হলেন দীর্ঘকালের পােড় খাওয়া ক্যুনিস্ট কমরেড আলতাব আলী। এই এলাকায় জাতীয় পরিষদের আসনেও আওয়ামী লীগের বদলে পাকিস্তান জাতীয় কংগ্রেসের শ্রীমনােরঞ্জন ধরকে ন্যাপ ও ক্যুনিস্ট পার্টি সমর্থন জানালাে। আলােকময় নাহা ও আমি তার মনােনয়নপত্রে প্রস্তাব ও সমর্থক হিসেবে স্বাক্ষর করেছিলাম। শুধু আনুষ্ঠানিক প্রস্তাব ও সমর্থক হওয়াই নয়, মনােরঞ্জন ধরের পক্ষে নির্বাচনী প্রচারে আলােকময় ও আমি দু’জনই কোমর বেঁধে লেগে গিয়েছিলাম। চুয়ান্নর নির্বাচনে ত্রৈলােক্য মহারাজের সমর্থনে গাঁয়ের হাটে-বাজারে চোঙা ফুঁকেছি; আর
৩৪১
ষােলাে বছর পরে, সত্তরে, ময়মনসিংহ শহরে ত্রৈলােক্য মহারাজের মতােই আরেকজন স্বাধীনতা-সংগ্রামীর পক্ষে প্রচারে নেমে খুবই আনন্দ ও গৌরব বােধ করলাম। আমি মাঝে মাঝে চিন্তা করতাম শেখ মুজিব কি ময়মনসিংহের এই আসনটিতে সৈয়দ আবদুস সুলতানকে দাঁড় না করিয়ে এটি মনােরঞ্জন ধরকে ছেড়ে দিতে পারতেন না? এতে কি মুজিবের বাঙালির স্বাধিকার সগ্রাম ক্ষতিগ্রস্ত হতাে, না জোরদার হতাে? মনােরঞ্জন ধর তাে শুধু ব্রিটিশ বিরােধী স্বাধীনতা সগ্রামেরই সৈনিক নন, পাকিস্তানি অমানবিক শাসনের বিরুদ্ধেও তাে তিনি চব্বিশটি বছর ধরে অবিরাম সংগ্রাম করে এসেছেন। পূর্ব পাকিস্তানের আইনসভার সদস্য হিসেবে বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনে তার একান্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকার কথা কে অস্বীকার করতে পারবে? এ দেশের সকল হিন্দুর মতাে ভারতের দালাল’—বারবার এই কটাক্ষের শিকার হয়েও তিনি জন্মভূমি পরিত্যাগ করে ভারতে পাড়ি জমাননি। অথচ স্বাধীনতা-সংগ্রামী এই মানুষটি ভারতে চলে গেলে স্বস্তি, সম্মান ও প্রতিষ্ঠা—সবই একান্ত অনায়াসে পেতে পারেন। তার বদলে তিনি নিজের জন্মভূমিকে একটি সভ্য ও আধুনিক রাষ্ট্রে পরিণত করার প্রত্যয়ে নানা অপবাদ ও নির্যাতন সয়ে গেছেন, বারবার কারা নির্যাতন ভােগ করেছেন। শেখ মুজিব ছয় দফা ঘােষণা করেছিলেন যে সুদূরপ্রসারী লক্ষকে সামনে রেখে, সেই লক্ষ সাধনেই তাে মনােরঞ্জন ধর জীবনভর ব্রতী থেকেছেন। শেখ মুজিব আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা থেকে মুক্ত হয়ে এলে মনােরঞ্জন ধর তাকে অভিনন্দিত করে যে তারবার্তাটি পাঠিয়েছিলেন তার ভাষা ছিলাে একান্ত উষ্ণ ও হৃদ্য।
যাই হােক, মনােরঞ্জন ধর নির্বাচনে ন্যাপ-কম্যুনিস্টদের সমর্থন পেলেন। কিন্তু তাদের সে সমর্থনেও যথেষ্ট সীমাবদ্ধতা ছিলাে। পার্টি কেন্দ্রের অনুমােদন নিয়েই তারা তাকে সমর্থন জানিয়েছিলাে স্থানীয়ভাবে-কেন্দ্রীয়ভাবে নয়। অর্থাৎ ময়মনসিংহে ন্যাপ-কম্যুনিস্টদের কর্মিসমর্থকরা স্থানীয়ভাবে মনােরঞ্জন ধরের জন্যে কাজ করবে, কিন্তু তার সঙ্গে নির্বাচনী মৈত্রীটা আনুষ্ঠানিক হবে না, পার্টির পক্ষ থেকে তা প্রচারও করা হবে না—আমাদের এ রকম পার্টিসিদ্ধান্তই জানিয়ে দেয়া হয়েছিলাে। এটিও এক ধরনের লুকোচুরিই বলা যায়—বামপন্থী লুকোচুরি! এ রকমটি কেন করা হয়েছিলাে তা নেতাদের জিজ্ঞেস করেও আমি ঠিক বুঝে উঠতে পারিনি। আত্মগােপনকারী পার্টি নেতা কমরেড জ্যোতিষ বােসের সঙ্গে এ সময়ে কয়েকবারই আমার দেখা হয়েছিলাে। তিনিও আমাকে পার্টির সিদ্ধান্তটিই শুধু জানিয়ে দিয়েছেন, এ রকম সিদ্ধান্ত গ্রহণের কারণ সম্পর্কে স্পষ্ট করে কিছুই বলেননি।
পাকিস্তান জাতীয় কংগ্রেসের অস্তিত্ব বাস্তবে ছিলােই না। এককালের ডাকসাইটে কংগ্রেস নেতা মনােরঞ্জন ধর নিজের ও অন্য কয়েকজন প্রার্থীর পক্ষে কংগ্রেস’ নামটি ব্যবহার করেছিলেন মাত্র। অবশ্যি সত্তরের নির্বাচনের কিছুদিন আগেই একটি সংবাদ সম্মেলনে পাকিস্তান জাতীয় কংগ্রেস দলটির আনুষ্ঠানিক পুনরুজ্জীবনের কথা জানিয়ে রেখেছিলেন। নির্বাচন কমিশনের কাছ থেকে কংগ্রেসের জন্যে কলস’ প্রতীকটিও মঞ্জুর করিয়ে রেখেছিলেন। ছেচল্লিশেও কংগ্রেসের নির্বাচনী প্রতীক ছিলাে কলস’। সেকুলার জাতীয়তাবাদ এ দলের ঘােষিত আদর্শ হলেও, সত্তরেও, মুষ্টিমেয় কিছু হিন্দু ছাড়া কংগ্রেসের অন্য কোনাে সদস্য ছিলাে না। অর্থাৎ বাস্তবে এটি একটি অতি ক্ষুদ্র হিন্দু সংগঠনেই পরিণত হয়েছিলাে।
এরপরও কিন্তু ময়মনসিংহে মনােরঞ্জন ধরের নির্বাচন প্রার্থী হওয়া নিয়ে অনেক রকম প্রশ্নই উঠেছিলাে। প্রশ্নগুলাে একদিকে তুলেছিলাে আওয়ামী লীগ, অন্যদিকে সাম্প্রদায়িক দলগুলাে।
৩৪২
আওয়ামী লীগের অভিযােগ ছিলাে ন্যাপ-কমুনিস্টদের বিরুদ্ধে। ন্যাপ-কমুনিস্ট সমর্থকদের সকল ভােট এবং হিন্দু সম্প্রদায়ের ভােট পেলে আওয়ামী লীগ প্রার্থীরই ভােট কমে যাবে, জিতে যাবে বাঙালি জাতীয়তাবাদ-বিরােধী সাম্প্রদায়িক দলের কোনাে প্রার্থী। ন্যাপকমুনিস্টরা এভাবে বাঙালি জাতীয়তাবাদের বিরুদ্ধে না লাগলেই কি পারতাে না? আর লাগাবেই বা না কেন? ওরা তাে আসলে দেশ-জাতি নিয়ে ভাবে না। ওরা হলাে গিয়ে রাশিয়ার দালাল। রাশিয়ার নির্দেশেই ওরা সবকিছু করে। বাঙালি জাতি ধ্বংস হয়ে গেলে ওদের কী?
সাম্প্রদায়িক দলগুলাের ভাবনা অন্যরকম। তাদের আশংকা : মুসলমানদের ভােটগুলাে নানা দলের মধ্যে ভাগাভাগি হয়ে যাবে, আর হিন্দুরা একচেটিয়া আওয়ামী লীগকে জিতিয়ে দেবে। এটি তাে ভারতীয় চক্রান্তেরই অংশ।
কিন্তু নির্বাচনের দিন যতাে এগিয়ে আসতে লাগলাে ততােই দেখা গেলাে যে, বিপুল সংখ্যক সাধারণ ভােটার সবরকম সাম্প্রদায়িক বিবেচনাকে দূরে ঠেলে দিচ্ছে। শেখ মুজিব, নৌকা আর জয়বাংলা’–এছাড়া অন্য কোনাে চিন্তা তাদের মাথায় নেই। নৌকায় ভােট দিলে দেশটি হিন্দুস্থান হয়ে যাবে—এরকম প্রচার মুসলমান ভােটারদের মনে কোনাে বিকার সৃষ্টি করতে পারলাে না। মনােরঞ্জন ধর হিন্দু, কাজেই আমাদের ভােটটা তার কলস মার্কাতেই দিতে হবে—এরকম চিন্তায় হিন্দু ভােটাররা আক্রান্ত হলাে না। বিপুল ভােটে আওয়ামী লীগ প্রার্থী সৈয়দ আবদুস সুলতান যে জিতে গেলেন তাতে যেমন ভােটারদের রাজনৈতিক বিবেচনাটাই ছিলাে প্রধান, তেমনি হেরে গেলেও মনােরঞ্জন ধর যে ভােটগুলাে পেলেন তাতেও সেই ভােটারদের রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গিটিই কার্যকর ছিলাে। সাম্প্রদায়িক ভাবনা এখানে সামান্যতম প্রভাবও খাটাতে পারেনি। সত্তরের নির্বাচনে এ দেশে সাম্প্রদায়িকতা পুরােপুরি পর্যদস্ত হয়ে গিয়েছিলাে। তবু যেমন ময়মনসিংহে তেমনি সারাদেশেই—সাম্প্রদায়িক দলগুলাে তাদের পরাজয়কে স্বাভাবিকভাবে মেনে নিতে পারলাে না। তাদের পরাজয়ের কারণ নির্ণয়ে বস্তুনিষ্ঠতার বদলে তারা সাম্প্রদায়িক ভাবনাকেই আঁকড়ে ধরলাে। মুসলমান নয়, হিন্দুদের ভােটেই আওয়ামী লীগ জিতেছে’ এরকম মূঢ় সিদ্ধান্তের কোলে আত্মসমর্পণ করে তারা আত্মগ্লানির হাত থেকে বাঁচতে চাইলাে, হিন্দু ও মুসলমান ভােটারদের সংখ্যার অনুপাতটির দিক থেকে পর্যন্ত চোখ ফিরিয়ে রাখলাে।

সত্তরের নির্বাচনের তাৎপর্য
মনােরঞ্জন ধর নির্বাচনে জয়লাভ করুন—সত্তরে সারা মনপ্রাণ দিয়ে এমনটিই কামনা করেছিলাম। তাই তাঁর পরাজয় স্বভাবতই আমাকে দুঃখ-ভারাক্রান্ত করে তুলেছিলাে। তবে নির্বাচনের সার্বিক ফলাফলে দুঃখের চেয়ে আনন্দই পেয়েছিলাম বেশি। আনন্দের প্রধান কারণ অবশ্যই, আগে যেমন বলেছি, নির্বাচনে সাম্প্রদায়িকতার পরাভব। বাঙালি জাতীয়তাবাদের একটি প্রবল আবেগ সেদিন জনসাধারণকে অধিকার করেছিলাে। সে আবেগ মােটেই নেতিবাচক ছিলাে না। কিংবা হঠাৎ করেই যে একটা যুক্তিহীন আবেগ তখন বাঙালিকে ভাসিয়ে নিয়ে গিয়েছিলাে, তাও নয়। অত্যন্ত ধীর লয়ে, দীর্ঘ দিনের পরিসরে, অভিজ্ঞতায় পােড় খেয়ে খেয়ে এই জাতীয়তাবাদী আবেগটি তার সত্তায় ধারণ করে সত্তরের নির্বাচনকালে বাঙালি নতুন
৩৪৩
প্রত্যয়ে জেগে উঠেছিলাে। সােনার বাংলা শ্মশান কেন?’ শীর্ষক প্রচারপত্রটিতে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের ভেতরকার যে বৈষম্যের খতিয়ান তুলে ধরা হয়েছিলাে তাতে পশ্চিম পাকিস্তানের বিরুদ্ধে পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালিদের বিক্ষোভের সুস্পষ্ট প্রকাশ ছিলাে, সে বৈষম্যের অবসান ঘটিয়ে হিসেবের পাওনা বুঝে নেয়ার প্রত্যয়ও ছিলাে। তবু সে প্রত্যয় তখনাে যে পাকিস্তান রাষ্ট্রটিকে পুরােপুরি অস্বীকার করার পর্যায়ে উঠে যায়নি—সে কথাটিও মনে না রাখলে চলবে না। নির্বাচনের সময়েই এখানকার সকল মানুষ পাকিস্তানের খােলস থেকে বেরিয়ে আসতে চেয়েছিলাে এবং স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার জন্যেই নৌকায় ভােট দিয়েছিলাে—এমন কথা যদি বলি তবে তা হবে নিতান্তই অতিকথন। পাকিস্তান তার নিজের জায়গায় থাকুক আপত্তি নেই। কিন্তু বাঙালির স্বাধিকারের প্রতিষ্ঠা চাই-ই। সত্তরের নির্বাচনে এই ছিলাে সেদিনকার পাকিস্তানের পূর্বাঞ্চলের মানুষের মনােভঙ্গি। তবে এই মনােভঙ্গির নিভতেই যে স্বাধীনতার আকাক্ষাটিও অঙ্কুরিত হচ্ছিলাে, তাও অস্বীকার করতে পারবাে না। নির্বাচনের পর যখন স্বাধিকারের দাবিটি পাকিস্তান একেবারেই অস্বীকার করে বসেছিলাে, “বিনা যুদ্ধে নাহি দিব সূচ্যগ্র মেদিনী’র মতাে মনােভাব জানিয়ে দিয়েছিলাে, তখনই স্বাধিকার-কামনার যবনিকা ভেদ করে বাঙালি স্বাধীনতার পতাকা হাতে বেরিয়ে আসে।
নির্বাচনের সময়েই জনগণকে এভাবে প্রস্তুত করে তুলেছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব। সত্তরের নির্বাচনটিকে তিনি ভােটারদের সামনে ছয় দফার পক্ষে বা বিপক্ষে রেফারেন্ডাম রূপে উপস্থাপন করেছিলেন। অর্থাৎ জনগণকে তিনি বােঝাতে পেরেছিলেন যে, আওয়ামী লীগের নিরঙ্কুশ বিজয় ঘটলেই ছয় দফা কার্যকর হবে, ছয় দফা কার্যকর হলেই বাঙালির স্বাধিকার প্রতিষ্ঠা হবে। এর অন্যথা হলে বাঙালির সামনে আর কোনাে আশা-ভরসা থাকবে না।
শুধু ছয় দফা নয়। ছয় দফার ভিত্তিতে স্বাধিকার অর্জিত হয়ে যাবার পর কী হবে—সে প্রশ্নেরও জবাব বঙ্গবন্ধু বাঙালি জনগণের সামনে রেখে দিয়েছিলেন। জেল থেকে বেরিয়ে এসেই তিনি যে ছাত্রদের এগারাে দফার প্রতি সমর্থন জানিয়েছিলেন তা থেকে পিছু হটে তাে যানইনি, বরং নির্বাচনী ওয়াদায় সে সমর্থনটিকে আরাে দৃঢ় ও স্পষ্ট করে তুললেন। সিয়াটো, সেন্টো, পাক-মার্কিন সামরিক চুক্তি—এরকম সব সামরিক জোট থেকে বেরিয়ে আসার ও জোটনিরপেক্ষ পররাষ্ট্রনীতি গ্রহণ করার অঙ্গীকার ঘােষণা করলেন।
ছয় দফা কিংবা এগারাে দফার কোনােটিতেই ছিলাে না এমন কতকগুলাে দাবিও আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারে যুক্ত করা হয়েছিলাে। এ ইশতেহারে প্রশাসনের গণতন্ত্রায়নের লক্ষ্যে বলা হয়েছিলাে যে, পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সুপিরিয়র সার্ভিস বিলুপ্ত করা হবে, জনসংখ্যার ভিত্তিতে প্রতিটি প্রদেশে নিযুক্তির ব্যবস্থা চালু করা হবে, নির্বাচিত প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে জেলা প্রশাসন গঠন করা হবে, সবগুলাে মহকুমাকে জেলায় উন্নীত করে সেগুলােকেই প্রশাসনের মূলকেন্দ্র রূপে গড়ে তােলা হবে। মানুষের ওপর মানুষের শােষণ’ বন্ধ করার জন্যে সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি প্রবর্তনের অঙ্গীকারের কথাও ইশতেহারে ঘােষণা করা হয়, বৃহদায়তন শিল্প প্রতিষ্ঠানের রাষ্ট্রীয়করণ এবং সরকারি বৃহদায়তন শিল্পে শ্রমিক-কর্মচারিদের অংশীদারিত্ব নিশ্চিত করার কথাও বলা হয়।
এমনকি বঙ্গবন্ধু নিজেকে একজন সমাজতন্ত্রী বলেও ঘােষণা করেন। অর্থাৎ যে কোনাে প্রগতিকামী বাঙালি একটা নির্বাচনের মধ্যদিয়ে যতােটুকু প্রাপ্তির আশা করতে পারে, তার প্রায় সবটুকুই বঙ্গবন্ধু তার দলের নির্বাচনী মেনিফেস্টোতে কিংবা বক্তৃতা-বিবৃতিতে প্রকাশ করে
৩৪৪
ফেলেছিলেন। কাজেই অধিকতর প্রগতিশীল ও বাস্তববাদী কোনাে কর্মসূচি হাজির করে। আওয়ামী লীগের মতাে একটি বৃহৎ দলকে চ্যালেঞ্জ জানানাের ক্ষমতা সে সময়ে এখানকার কোনাে রাজনৈতিক দল বা গােষ্ঠীরই ছিলাে না।
এ রকম অবস্থার মুখােমুখি হয়েই বিভিন্ন গােষ্ঠীর পিকিংপন্থীরা নির্বাচনে পিঠটান দিলাে এবং বুর্জোয়া নির্বাচনের বিরুদ্ধে নানা মার্কসীয় বাক্যগুচ্ছ আউড়িয়ে নিজেদের অক্ষমতাকে আড়াল করতে চাইলাে। আওয়ামী লীগের ম্যানিফেস্টোতে সমাজতন্ত্রের অন্তর্ভুক্তি কিংবা মুজিবের মুখে সমাজতন্ত্রের কথা নিয়ে ওরা নেতিবাচক ব্যঙ্গ বিদ্রুপে মেতে উঠলাে।
অন্যদিকে, মস্কোপন্থী নামে পরিচিত দল ও গােষ্ঠীগুলাে আওয়ামী লীগ ও মুজিবের প্রগতিমুখী বক্তব্যকে একান্ত নেতিবাচক দৃষ্টিতে না দেখে অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে এর বস্তুনিষ্ঠ পর্যালােচনা করেছিলাে। তারা জানতাে : আওয়ামী লীগ মূলত বাঙালি ধনিক গােষ্ঠীর দল এবং ধনিক মানেই শােষক এবং সে কারণে সর্বহারা মেহনতি মানুষের বিরুদ্ধে তারা অন্যান্য শােষক শ্ৰেণীগুলাের সঙ্গে আপসে দ্বিধা করে না এবং সংগ্রামে থাকে দোদুল্যমান। তবু কথিত মস্কোপন্থীরা আওয়ামী লীগকে সমর্থন জানিয়েছিলাে। পিকিংপন্থীদের নানা ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ ও আওয়ামী লীগের লেজুড়বৃত্তি করার অপবাদ মাথায় নিয়েও তারা সেই সমর্থন প্রত্যাহার করে নেয়নি। কারণ, ইতিহাসের হাতে-মার-খাওয়া বাঙালি বুর্জোয়াদের দল আওয়ামী লীগের বিশেষ সময়কার প্রগতিশীল ভূমিকাটিকে তারা শনাক্ত করতে পেরেছিলাে। তা’ পেরেছিলাে বলেই ওদের সঙ্গে সহযােগিতা করা বিশেষ প্রয়ােজন বলে মনে করে। উনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানের মূল্যায়ন করে তখন পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়ন (মতিয়া গ্রুপ) তাই বলে, ‘এগারাে দফা কর্মসূচি হলাে মূল বিপ্লবী কর্মসূচির ভিত্তিতে গণসংগ্রাম গড়ে তােলার প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে খুবই তাৎপর্যপূর্ণ ও গুরুত্বপূর্ণ কৌশলগত কর্মসূচি। এক্ষেত্রে এগারাে দফা কার্যকর করণের প্রশ্নে তাই বিপ্লবী লক্ষের স্বার্থ হতেই বড়াে ধনিক ও প্রতিক্রিয়াশীলদের বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগ-ছাত্রলীগের সঙ্গে দরকার মতাে সহযােগিতা ও ঐক্য কায়েমের নীতি অনুসরণ করা এখনকার একটি কর্তব্য। এই কর্তব্যবােধ থেকেই সত্তরের নির্বাচনে ন্যাপ কম্যুনিস্টরা আওয়ামী লীগকে সক্রিয় সমর্থন জানায়। তবে আওয়ামী লীগের শ্ৰেণীচরিত্র ও সে দলের মনােনীত অনেক প্রার্থীর প্রতিক্রিয়াশীল ভূমিকা সম্পর্কে তারা সচেতন ছিলাে। এর বিরুদ্ধে একটি কার্যকর প্রতিরােধও ন্যাপ-কম্যুনিস্টরা তৈরি করতে চেয়েছিলাে। তাই কতকগুলাে আসনে তারা নিজেদের প্রার্থী দাঁড় করিয়ে দিয়েছিলাে এবং কিছু আসনে মনােরঞ্জন ধরের মতাে ত্যাগী ও দেশপ্রেমিক প্রার্থীদের পক্ষে অবস্থান নিয়েছিলাে। কিন্তু ন্যাপক্যুনিস্টদের এই অবস্থানটির সমর্থনে ভােটাররা এগিয়ে আসেনি। ময়মনসিংহেই দেখলাম, জাতীয় পরিষদের আসনটিতে মনােরঞ্জন ধর আর প্রাদেশিক পরিষদেরটিতে আলতাব আলী নির্বাচিত হতে পারলেন না, দুটোতেই বিপুল সংখ্যায় ভােট পেলেন আওয়ামী লীগের প্রার্থীরা। তাই বলে ভােটাররা যে মনােরঞ্জন ধর কিংবা আলতাব আলীর মতাে ত্যাগব্রতী ও স্বদেশপ্রেমিক মানুষগুলােকে নস্যাৎ করে দিলাে, তাও কিন্তু নয়। এদের বিরুদ্ধে অবস্থানকারী রাজনৈতিক দলগুলাের নেতাকর্মিরা এদের সম্পর্কে নানা কুৎসা রটনা করেছে, অনেক নােংরা কথাও বলেছে। কিন্তু বিপুলসংখ্যক সাধারণ ভােটার এ সব নােংরামির সঙ্গে নিজেদের যুক্ত করেনি। তাদের অনেককে বরং বলতে শুনেছি যে, এই ভালাে মানুষগুলাে নৌকা মার্কা না নিয়ে অন্য মার্কায় দাঁড়ালাে কেন? এরা যদি নৌকা মার্কা নিতাে তাহলে তাে আমাদের সবার
৩৪৫
ভােটগুলােই পেয়ে যেতাে, দেশের কতাে ভালাে হতাে। কেউ কেউ এমনাে বলেছে, এবার ওরা ভােট না পাক, পরেরবার আমরাই তাদের ভােট দেবাে। এবার মুজিবুরের নৌকাটারই জেতা দরকার। কেবল নৌকা দিয়া কাম অইবাে না, এরপরে আইতাছে কুড়ে ঘর। হেই কুঁড়েঘরই গরিব মাইনসেরে সুখ দিবাে।’—এ রকম কথা আমি গ্রামের বেশ কিছু কৃষকের মুখেই শুনেছি। অথচ, যারা এ রকম বলেছে তারাও সত্তরে কিন্তু কুঁড়েঘরে নয়, নৌকা মার্কাতেই ভােট দিয়েছে। আশা করে থেকেছে, মুজিবুরের ‘নৌকা’ এমন একটা জয়বাংলা’র প্রতিষ্ঠা করবে, যে জয়বাংলায় অনায়াসে কুঁড়েঘরের মানুষরাই রাজত্ব করবে। জয়বাংলা’ শব্দটা তাদের কাছে ছিলাে একান্তই ব্যঞ্জনাগর্ভ। এই ব্যঞ্জনার সঠিক অর্থ ভদ্রলােকের ভাষা দিয়ে প্রকাশ করা কঠিন। তখাকথিত ভদ্রলােকের বৃত্তসীমার বাইরে মানুষরা সত্তরে-একাত্তরে পাগলের মতাে যে জয়বাংলা’ ধ্বনি দিয়েছে সে জয়বাংলার অর্থ কোনাে অভিধানে লেখা নেই। এর অর্থ তারা ঠিক করে নিয়েছে তাদের আকাক্সক্ষা, কল্পনা, স্বপ্ন আর উল্লাস দিয়ে। যদিও এর পরবর্তীকালের রাজনীতি কৃষক জনগণের আকাঙ্ক্ষার সঙ্গে সঙ্গতি রেখে চলেনি, রাজনীতিকদের কার্যকলাপই তাদের কল্পনার মূলােচ্ছেদ করেছে, তাদের স্বপ্নকে গুঁড়িয়ে। দিয়েছে, তাদের উল্লাসকে বিষাদে পরিণত করেছে। তবু সত্তরের নির্বাচনের সময় সাধারণ মানুষদের সরল অভিব্যক্তির কথা শুনতে শুনতে নিরক্ষর জনগণের বিচারবুদ্ধির ওপর আমার আস্থা দৃঢ় থেকে দৃঢ়তর হয়েছে। বুঝেছি : আমরা শিক্ষাভিমানী মানুষরা আমাদের প্রচণ্ড রাজনৈতিক পাণ্ডিত্য দিয়ে নানা কূটতর্ক করেও যে সমস্যার স্বরূপ উপলব্ধিতে ব্যর্থ হই, আনুষ্ঠানিক শিক্ষাবর্জিত জীবনবাদী সাধারণ মানুষগুলাে তাদের নিজের মতাে করে নিজের ভাষায় তা অত্যন্ত স্পষ্টভাবে বুঝে নেয়, এবং সেই অনুযায়ী তাদের কর্তব্য করে। তাই, যখন দেখি যে, দীর্ঘকালের সাম্প্রদায়িক নিপীড়নের শিকার সাধারণ হিন্দু ভােটাররাও মনােরঞ্জন ধরের বদলে আওয়ামী লীগ প্রার্থী সৈয়দ আবদুস সুলতানকেই বেছে নিলাে, তখন আমার আকাক্ষার পরাভবের দরুন মনে আঘাত পেলেও জনগণের বিচারশীলতার প্রতি শ্রদ্ধাশীল না হয়ে পারিনি। সব রকম গােষ্ঠী স্বার্থের চিন্তা এক পাশে সরিয়ে রেখে বাঙালিত্বের মর্যাদাকেই সেদিনের মতাে তারা সর্বসাধ্যসার করে নিয়েছিলাে বলেই দেশ তখন একটা প্রচণ্ড সংঘশক্তিতে বলীয়ান হয়ে উঠতে পেরেছিলাে। সেই শক্তি বাঙালি জনসাধারণের মধ্যে দারুণ আত্মবিশ্বাস জাগিয়ে তুলেছিলাে। সকল মানুষের যেন রাতারাতি নিঝরের স্বপ্নভঙ্গ ঘটে যায়। নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রতি বাঙালির নিরঙ্কুশ সমর্থন এই দলটিকে বিশেষ দায়িত্ব সচেতন করে তােলে। ওয়াদা খেলাপের যে ঐতিহ্য’ আমাদের দেশের রাজনৈতিক নেতাদের আছে, সে ঐতিহ্য অনুসরণ করা যে এবার আর সম্ভব হবে না তা আওয়ামী নেতারা বুঝে ফেলেন। বঙ্গবন্ধু সে বিষয়টি তার দলের বিজয়ী প্রার্থীদের আরাে ভালাে করে বুঝিয়ে দেন একাত্তরের তেসরা জানুয়ারিতে রমনা রেসকোর্সের এক বিশাল জনসমাবেশে। ছয় দফা নির্বাচনী ওয়াদাকে তিনি পবিত্র ওয়াদা বলে ঘােষণা করেন। তিনি যদি এ ওয়াদা খেলাপ করেন তবে তাকে জীবন্ত মাটিতে পুঁতে ফেলার জন্যে জনগণের প্রতি আহ্বান কানান। জনগণের সামনে নেতার এ রকম ঘােষণার পর তার দলের নির্বাচিত প্রার্থীদের পক্ষে ওয়াদা খেলাপ করার আর কোনাে পথ খােলা থাকে না। আওয়ামী লীগের ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগের নেতারা যেমন ছয়দফা ভিত্তিক সংবিধান রচনার পক্ষে আপসহীন প্রত্যয় ঘােষণা করেন, তেমনি রেডিক্যাল ছাত্রসংগঠন পূর্ব পাকিস্তানের ছাত্র ইউনিয়ন(মতিয়া গ্রুপ)ও বিশেষ জরুরি কাউন্সিল ডেকে দাবি জানায় যে,
৩৪৬
‘পাকিস্তানে যে মূল পাঁচটি ভাষাভাষী জাতির অবস্থান উহাদের সকলকে পাকিস্তান ফেডারেশন হইতে বিচ্ছিন্ন হইয়া স্বতন্ত্র স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র গঠনের অধিকার দিতে হইবে।’ এরকম দাবি তাে স্পষ্টতই স্বাধীনতার দাবি। ছাত্র ইউনিয়ন এ দাবি উত্থাপন করে একাত্তরের ফেব্রুয়ারির চৌদ্দ তারিখ । এর আগের দিনই পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ঘােষণা দেন যে, মার্চের তিন তারিখে ঢাকায় নবনির্বাচিত জাতীয় পরিষদের অধিবেশন বসবে। অথচ সে ঘােষণার একদিন পরই অর্থাৎ ফেব্রুয়ারির পনেরাে তারিখে, পাকিস্তান পিপলস পার্টির নেতা জুলফিকার আলী ভুট্টো পেশােয়ারে এক সংবাদ সম্মেলনে জানান যে, তিনি জাতীয় পরিষদের অধিবেশনে যােগ দিতে ঢাকায় যাবেন না।
পশ্চিম পাকিস্তানের নেতার এই অস্বীকৃতি পূর্ব পাকিস্তানে স্বভাবতই প্রচণ্ড প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে। সে প্রতিক্রিয়ার বিবরণ সে সময়কার পত্রপত্রিকার পাতা থেকে তুলে এনেছেন ডক্টর মােহাম্মদ হান্নান তার বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস গ্রন্থে। হাসান হাফিজুর রহমান সম্পাদিত বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ : দলিলপত্র দ্বিতীয় খণ্ডে আছে এর প্রামাণ্য নিদর্শন। আরাে অনেক লেখক তাদের লেখায় সে সময়কার অবস্থার অনুপুঙ্খ বর্ণনা দিয়েছেন। আমি আর সে সবের পুনরাবৃত্তি করতে চাই না। আমি মফস্বল শহরের বাসিন্দা। রাজধানী ঢাকা নগরীর প্রতিক্রিয়ার প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা আমার নেই। তবে সে বছরের একুশ ফেব্রুয়ারিতে ময়মনসিংহ শহরের জনতার যে বিদ্রোহ বিক্ষোভের প্রকাশ প্রত্যক্ষ করেছিলাম তা থেকেই ভবিষ্যত সগ্রামের ছবিটি আমার কাছে স্পষ্ট হয়ে উঠেছিলাে।

‘স্বাধীনতা এই শব্দটি কীভাবে আমাদের হলাে?
একাত্তরের মার্চের তিন তারিখে ঢাকায় জাতীয় পরিষদের অধিবেশন বসবে বলে ইয়াহিয়ার ঘােষণা সত্ত্বেও এ ব্যাপারে কেউই নিশ্চিন্ত হতে পারছিলেন না। ভুট্টোর মতিগতি দেখে সন্দেহ হচ্ছিলাে যে, অধিবেশন হয়তাে নাও বসতে পারে। সারাদেশে একটা কী হয়, কী হয়’ ভাবনা। তবু মানুষ আশা ছাড়েনি। এখানকার গণপ্রতিনিধিরাও ছয়দফাভিত্তিক সংবিধান রচনার প্রস্তুতি সম্পন্ন করছেন। তােমার আমার ঠিকানা, পদ্মা-মেঘনা-যমুনা’র স্লোগান আকাশে-বাতাসে রণিত হচ্ছিল বটে, কিন্তু এখানকার মাটি থেকে পাকিস্তানের উচ্ছেদ হয়েই যাবে—এ রকম ভাবনা, তখনাে, একেবারে নিরঙ্কুশ হয়ে ওঠেনি। ভুট্টো ঢাকায় জাতীয় পরিষদের অধিবেশনে যােগদান করবেন না বললেও পশ্চিম পাকিস্তানের অন্যান্য নেতারা তার সঙ্গে একমত হননি। তারা অনেকেই বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করে গিয়েছেন, তাকে সহযােগিতার আশ্বাসও দিয়েছেন। এমন কি স্বয়ং ইয়াহিয়া খানও শেখ মুজিবকে ‘পাকিস্তানের ভাবী প্রধানমন্ত্রী বলে উল্লেখ করেছেন। তবু, এর পরও, ফেব্রুয়ারির ছাব্বিশ তারিখে তেসরা মার্চের জাতীয় পরিষদের অধিবেশন বাতিল হয়ে গেছে বলে গুজব ছড়িয়ে পড়ে। অবশ্যি আটাশ তারিখের দৈনিক পাকিস্তান-এর সর্বশেষ খবর’ কলামে জনগণকে আশ্বস্ত করা হয় যে, জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত হয়নি, মার্চের তিন তারিখেই ঢাকাতে এ অধিবেশন বসবে, পশ্চিম পাকিস্তানের অন্য সব দলের সঙ্গে ভুট্টোর পিপলস পার্টি ও তার পূর্ব ঘােষণার পুনর্বিবেচনা করে অধিবেশনে যােগদানের সিদ্ধান্ত নিতে যাচ্ছে। আর এদিকে, সাতাশে ফেব্রুয়ারিতে, আওয়ামী লীগের পার্লমেন্টারি পার্টির বৈঠকে পাকিস্তানের সংবিধানের খসড়া পেশ করা হয়ে
৩৪৭
গেছে। মুজিবের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সে বৈঠকে সংবিধানের খসড়াটি পাঠ করে শুনিয়েছেন ডক্টর কামাল হােসেন। পাকিস্তানের অভ্যন্তরেই বাংলাদেশ স্বায়ত্তশাসন পেয়ে যাবে, পূর্ণ স্বাধীনতা ছাড়াই বাঙালি স্বাধিকারের স্বাদ উপভােগ করবে, জয়বাংলা আর জয় পাকিস্তান একই সঙ্গে উচ্চারণে কোনাে বাধা থাকবে না—একাত্তরের ফেব্রুয়ারির শেষ দিনটি পর্যন্ত, নানা রকম সংশয় ও আশঙ্কা সত্ত্বেও, সর্বসাধারণের মধ্যে মােটামুটি এ রকম ধারণাই বহাল ছিলাে।
সবই ওলােট পালােট হয়ে গেলাে মার্চের প্রথম দিনে। সেদিন দুপুরে রেডিও পাকিস্তানে জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত করে দেয়া সংক্রান্ত ইয়াহিয়া খানের বিবৃতিটি প্রচারিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ঢাকা স্টেডিয়ামে কি রকম তুলকামাল কাণ্ড ঘটেছিলাে সে খবর পত্রিকার পাতায় পড়েছি, নিজ চোখে দেখিনি। তবে এ খবর ময়মনসিংহ শহরে এসে পৌছার সঙ্গে সঙ্গে যে স্বতঃস্ফূর্ত জঙ্গী মিছিলগুলাে রাজপথ কাঁপিয়ে দিয়েছিলাে সেগুলাে দেখেছি। আওয়ামী লীগের নেতা সৈয়দ নজরুল ইসলাম তখন ঢাকায়। জাতীয় নেতা হিসেবে অনেক বড়াে ও কঠিন দায়িত্ব নেয়ার জন্যে তিনি প্রস্তুতি নিচ্ছেন। ময়মনসিংহ শহরে আছেন রফিক উদ্দিন ভূঁইয়া। নির্বাচনী যুদ্ধে তিনি যদিও নুরুল আমিনের হাতে পরাজিত হয়েছেন, তবু সারা ময়মনসিংহ জেলায় আওয়ামী লীগের তিনি অপ্রতিদ্বন্দ্বী নেতা। আর একাত্তরের মার্চে শুধু আওয়ামী লীগের নন, বাঙালির স্বাধিকার সংগ্রামেরই অন্যতম নেপদে তিনি আসীন। তাই টাউন হলের সামনে তিনি যখন নিজ হাতে আগুন ধরিয়ে পাকিস্তানের জাতীয় পতাকাটি পুড়িয়ে ফেলেছেন, তখন এর প্রতীকী তাৎপর্যটি অনেক বড়াে হয়ে দেখা দিলাে।
পাকিস্তানবাদী দক্ষিণপন্থী দলগুলাে তখন একেবারেই কোণঠাসা। ওরা পাকিস্তানের অখণ্ডতা রক্ষার কথাটিও খুব জোরেশােরে বলতে পারছিলাে না, কারণ তা বললে বাঙালি জাতীয়তাবাদের বিরােধিতা করা হয়। বাঙালি জাতীয়তাবাদের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে কথা বলার হিম্মৎ সে সময়ে কারাে ছিলাে না। তাই দক্ষিণপন্থী নেতারা শেখ মুজিবের সঙ্গে সহযােগিতা করার জন্যে ভুট্টোকে অনুরােধ জানিয়ে চলছিলেন। তারা আশা করছিলেন যে ভুট্টো-মুজিবের সহযােগিতায় যদি ছয়দফা ভিত্তিক সংবিধানও গৃহীত হয়, তাহলেও পাকিস্তান কোনাে রকমে টিকে যাবে। অধ্যাপক মােজাফরের নেতৃত্বাধীন বামপন্থী ন্যাপের যদিও আদর্শগতভাবেই বাঙালি জাতীয়তাবাদের বিরুদ্ধে অবস্থান গ্রহণের কথা নয়, তবু তখনাে, একাত্তরের মার্চের প্রথম সপ্তাহেও, সােজাসুজি বাঙালির স্বাধীন রাষ্ট্রের পক্ষে কথা বলতে ন্যাপও এগিয়ে আসেনি। একটা দ্বিধা বােধ হয় তার রয়েই গিয়েছিলাে। বুর্জোয়াদের নেতৃত্বে যে আন্দোলন শুরু হয়েছে। সে আন্দোলন মাঝপথে আপসের চোরাবালিতে হারিয়ে যাবে কি-না, এমন প্রশ্নও সন্দেহে তারা দীর্ণ হচ্ছিলাে। তা ছাড়া এ আন্দোলনের নেতারা সাম্রাজ্যবাদের সহযােগিতা নিয়ে অগ্রসর হবে,
সাম্রাজ্যবাদ-বিরােধী পথে জাতীয় মুক্তি সংগ্রামে নামবে—সে প্রশ্ন ও ছিলাে। গােপন ক্যুনিস্ট পার্টিও এসব বিবেচনায় অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে অগ্রসর হচ্ছিলাে।
কিন্তু মার্চের প্রথম দিন থেকেই জনসমুদ্রে জাগলাে বাঁধভাঙা জোয়ার। রাজনৈতিক দলের আদেশ-নির্দেশের জন্যে জনতা আর তখন বসে থাকতে রাজি নয়। সকল রাজনৈতিক দল ও গােষ্ঠীকে অনেক পেছনে ফেলে জনতার মিছিল অনেক সামনে এগিয়ে এসেছে। পাকিস্তানের নামনিশানা মুছে না যাওয়া পর্যন্ত এ মিছিল থামবে না। ছয়দফা এখন অতীতের ব্যাপার। এখন শুধু একটাই লক্ষ্য স্বাধীন বাংলাদেশ। বীর বাঙালি অস্ত্র ধর, বাংলাদেশ স্বাধীন কর’।
জন-উত্থানের এই প্রবলতার মুখে বুদ্ধিজীবীরাও গা ঝাড়া দিয়ে উঠলেন। ঢাকার মতাে ময়মনসিংহের বুদ্ধিজীবীরাও গণসংগ্রামের সঙ্গে সাংগঠনিকভাবে যুক্ত হওয়ার তাগিদ অনুভব
৩৪৮
করলেন। ময়মনসিংহ প্রেসক্লাবের তৎকালীন সম্পাদক সৈয়দ আহমদ বুদ্ধিজীবীদের একটা সভা ডাকলেন। সেই সভাতেই গঠন করা হলাে বুদ্ধিজীবী সংগ্রাম শিবির’। এই সংগঠনটিতে ময়মনসিংহের বিভিন্ন স্কুল-কলেজ ও কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদেরই প্রাধান্য ছিলাে। কয়েকজন সাংবাদিক, উকিল, ডাক্তার ও বেসরকারি চাকুরেও এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছিলেন। একাত্তরের মার্চের সেই বুদ্ধিজীবী সগ্রাম শিবিরের কথা উঠলেই আমি একান্ত স্মৃতি-তাড়িত হয়ে পড়ি। খুব বেশি করে মনে পড়ে গােলাম সামদানী কোরায়শী, আলােকময় নাহা আর ডক্টর মােস্তফা হামিদ হােসেন—আমার এই তিন জন প্রয়াত সুহৃদের কথা। কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে তখন বাংলার অধ্যাপক ছিলেন আমার একান্ত ঘনিষ্ঠ বন্ধু শামসুজ্জামান খান। বর্তমানে (১৯৯৬) তিনি বাংলা একাডেমীর ফোকলাের বিভাগের পরিচালক। এই জামান সাহেবের সৃজনশীলতায় বুদ্ধিজীবী সংগ্রাম শিবির অত্যন্ত সমৃদ্ধ হয়েছিলাে। কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়েরই আরেকজন অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাক কবি। গণকবি বলতে যা বােঝায় তিনি আসলে তা-ই। বাঙালির স্বাধিকার সংগ্রামের পক্ষে অতি দ্রুত তিনি অনেকগুলাে কবিতা লিখে ফেলেছিলেন। সে সময়ে বুদ্ধিজীবী সংগ্রাম শিবিরের ব্যানার নিয়ে ময়মনসিংহ শহরে আমরা রাস্তার মােড়ে মােড়ে যে সভাগুলাে করতাম সে সব সভায় কবি অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাক উদাত্ত কণ্ঠে স্বরচিত কবিতা পাঠ করতেন। রুশ কবি মায়াকোভস্কির সঙ্গে তুলনা করে আমরা তাকে সে সময়ে রাজ্জাকোভস্কি বলে ডাকতে শুরু করেছিলাম। তার কবিতা ও আলােকময় নাহার দরাজ গলার গান আমাদের পথসভাগুলাের প্রধান আকর্ষণ। এদের কবিতা আর গান দিয়ে মানুষ জড়াে করেই আমরা বক্তৃতা শুরু করতাম। কৃষিবিশ্ববিদ্যালয়ের কন্ট্রোলার অব এগজামিনেশন মােহাম্মদ হােসেন, অধ্যাপক আলি নওয়াজ, শামসুজ্জামান খান, মুক্তাগাছা কলেজের অধ্যাপক সুধীর দাস, মিন্টু কলেজের অধ্যক্ষ মতিউর রহমান, নাসিরাবাদ কলেজের অধ্যাপক গােলাম সামদানী কোরায়শী, রিয়াজুল ইসলাম এবং এরকম আরাে কয়েকজন ছিলেন পথসভাগুলাের বক্তা। আমিও বায়সকণ্ঠে সেই মার্চে অনেক পথসভায় শ্রোতাদের কর্ণপীড়া উৎপাদন করেছি।
ময়মনসিংহ বুদ্ধিজীবী সংগ্রাম শিবিরের সদস্যরা একজন অবাঙালি অধ্যাপককে তাদের মধ্যে পেয়ে অত্যন্ত উৎসাহিত হয়েছিলেন। কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের জীববিদ্যার এই শ্রুতকীর্তি অধ্যাপকের নাম আশরাফুল হক। অকৃতদার এই জ্ঞানতাপসের জন্মভূমি ছিলাে ভারতের উত্তর প্রদেশ। অথচ, বাংলা ও বাঙালিকে তিনি কী গভীরভাবেই না ভালােবেসে ফেলেছিলেন। মার্চের সেই ঝড়াে দিনগুলােতে সগ্রাম শিবিরের পথসভায় ভাঙা ভাঙা বাংলায় দরদভরা কণ্ঠে তিনি যখন বাঙালির স্বাধিকারের কথা বলতেন, তখন প্রতিটি শ্রোতা তার আন্তরিকতায় অভিভূত হয়ে যেতেন।
আমার সহকর্মি অধ্যাপক মাহমুদুল হাসান খুব ভালাে বক্তা নন। তবে সাংগঠনিক কাজে দক্ষ। সেই দক্ষতা তিনি সংগ্রাম শিবিরের নেতৃত্ব দানে কাজে লাগিয়েছিলেন। সাংগঠনিক দক্ষতার পরিচয় দিয়েছিলেন আমাদের পীযূষ দাও। ক্রীড়া সংগঠক হিসেবে পীযূষকান্তি ঘােষকে ময়মনসিংহের সবাই চেনে। সেই পীযূষদা এবার দেখালেন যে, শুধু ক্রীড়ায় নয়, সগ্রামেও তিনি নিষ্ঠাবান।
আমাদের বুদ্ধিজীবী সংগ্রাম শিবিরটির জন্ম হয়েছিলাে মার্চের সাত তারিখের আগেই, এর কাজকর্মে তীব্র গতির সঞ্চার ঘটলাে আট তারিখ থেকে। বলা নিষ্প্রয়ােজন : বঙ্গবন্ধুর সাতই মার্চের ভাষণই আমাদের উৎসাহের পালে হাওয়া লাগিয়ে দিয়েছিলাে। সাত তারিখ বেলা
৩৪৯
দশটায় প্রেসক্লাবে সংগ্রাম শিবিরের একটা সভা করছিলাম। সভায় বসেই শুনলাম, বিকেলে বঙ্গবন্ধু ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে যে ভাষণ দেবেন সেটি ঢাকা বেতার থেকে সরাসরি সম্প্রচার করা হবে। সে ভাষণেই বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘােষণা করবেন—অনেকেই এরকম বলাবলি করছিলাে। আমাদের সভা সংক্ষিপ্ত করে সবাই তাড়াতাড়ি করে ফিরে গেলাম রেডিওতে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ শুনবাে বলে। কিন্তু বেলা সাড়ে তিনটা পর্যন্ত অধীর অপেক্ষা করে যখন দেখলাম যে আমার সােনার বাংলা গানের পর হঠাৎ করে ঢাকা বেতার স্তব্ধ হয়ে গেছে, তখন আমরা যে কী গভীর উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা আর উত্তেজনায় আক্রান্ত হয়ে পড়লাম তা বুঝিয়ে বলা সত্যিই অসম্ভব। আবার পরদিন সকালে যখন রেডিওতে হঠাৎ বঙ্গবন্ধুর গলা শুনতে পেলাম, আমাদের তখনকার অনুভূতিও অনির্বচনীয়।
আগের দিন, অর্থাৎ সাতই মার্চে, বঙ্গবন্ধুর ভাষণ যখন সরাসরি রেডিও থেকে প্রচার করতে দেয়া হলাে না, তখনই ঢাকা বেতারের সকল কর্মি বেতার কেন্দ্র থেকে বেরিয়ে আসেন। জানিয়ে দেন যে, বঙ্গবন্ধুর পুরাে ভাষণটি রেডিও থেকে প্রচার করতে না দিলে তারা আর রেডিও স্টেশনে ফিরে যাবেন না। তাদের অনমনীয়তার কাছে নতি স্বীকার করেই কর্তৃপক্ষ আট তারিখ সকালে সেই ঐতিহাসিক ভাষণটি প্রচার করতে দেয়।
বারান্দায় বসে সপরিবারে রেডিও শুনছিলাম। পাড়ার বেশ কিছু ছেলেমেয়েও জড়াে হয়েছিলাে। আজ ভাবি: বঙ্গবন্ধুর ভাষণ শুনতে শুনতে সকলের ভেতর কেমন আবেগউত্তেজনার কাঁপন দেখা দিয়েছিলাে, সকলের চোখ কেমন চৰ্চ করে উঠেছিলাে, তার একটা চলচ্চিত্র যদি সেদিন রাখতে পারতাম!
‘স্বাধীনতা, এই শব্দটি কী করে আমাদের হলাে’—এই নামে নির্মলেন্দু গুণ একটি কবিতা লিখেছেন। স্বাধীনতার সে কবিতায় বঙ্গবন্ধুকে কবি’ আর তার সাতই মার্চের সেই ভাষণকে ‘কবিতা’ আখ্যা দিয়েছেন। কবিতাটি শুরু এরকম—একটি কবিতা লেখা হবে তার জন্যে অপেক্ষার উত্তেজনা নিয়ে লক্ষ লক্ষ উন্মত্ত অধীর ব্যাকুল বিদ্রোহী শ্রোতা বসে আছে ভাের থেকে জনসমুদ্রের উদ্যান-সৈকতে, কখন আসবে কবি?’
আর এর শেষের পংক্তিগুলাে একটি কবিতা পড়া হবে, তার জন্যে কি ব্যাকুল প্রতীক্ষা। মানুষের, কখন আসবে কবি?’ ‘কখন আসবে কবি?’
শত বছরের সংগ্রাম শেষে
রবীন্দ্রনাথের মতাে দৃপ্ত পায়ে হেঁটে
অতঃপর কবি এসে জনতার মঞ্চে দাঁড়ালেন।
তখন পলকে দারুণ ঝলকে তরীতে উঠিল জল,
হৃদয়ে লাগিল দোলা, জনসমুদ্রে জাগিল জোয়ার
সকল দুয়ার খােলা। কে রােধে তাহার বজ্রকণ্ঠ বাণী?
গণসূর্যের মঞ্চ কাঁপিয়ে কবি শােনালেন তাঁর অমর কবিতাখানি ?
‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম,
এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।
সেই থেকে স্বাধীনতা শব্দটি আমাদের।
‘স্বাধীনতা’ শব্দটিই শুধু নয়, বলা উচিত, খােদ স্বাধীনতাই
সেই থেকে আমাদের।
৩৫০
অথচ, সেই সত্যটিকে চাপা দেয়ার জন্যে কি প্রাণান্তকর প্রয়াসই-না আজ চলছে। নির্মলেন্দু তাঁর কবিতার তৃতীয় স্তবকে সে কথাটাই বলে রেখেছেন—
জানি, সেদিনের সব স্মৃতি মুছে দিতে হয়েছে উদ্যত কালাে হাত। তাই দেখি কবিহীন এই বিমুখ প্রান্তরে আজ
কবির বিরুদ্ধে কবি,
মাঠের বিরুদ্ধে মাঠ,
বিকেলের বিরুদ্ধে বিকেল,
উদ্যানের বিরুদ্ধে উদ্যান,
মার্চের বিরুদ্ধে মার্চ….।।

‘পাগলামি তুই আয়রে দুয়ার ভেদি’
ময়মনসিংহ শহরের সবচেয়ে ব্যস্ত সড়কটির ধারেই মেয়েদের হাইস্কুল—মহাকালী পাঠশালা। সামনে উঁচু দেয়াল। সে সময়ে, একাত্তরে মার্চের নয় কি দশ তারিখে, কোনাে স্কুল-কলেজেই ক্লাস হচ্ছিলাে না। মার্চের শুরু থেকেই চলছিলাে সর্বাত্মক অসহযােগ। তবু, ক্লাস চালু না থাকলেও, কোনাে মেয়েদের স্কুলের ভেতরে কোনাে ছেলের ঢুকে পড়ার কথা নয়। কিন্তু সেদিন দেখলাম বিভিন্ন স্কুল-কলেজে পড়ুয়া অনেকগুলাে ছেলে হৈ হৈ করতে করতে মহাকালী পাঠশালা থেকে বেরিয়ে আসছে। সামনের ছেলেটির হাতে একটি ছবি। রাস্তায় নেমেই ছেলেটি ছবিটিকে উপরে তুলে ধরলাে। সবাই দেখলাম : ছবিটি জিন্নাহ সাহেবের, যাকে গত চব্বিশ বছর আমরা জিন্নাহ্ বলিনি, বলেছি কায়েদে আজম’, বলেছি জাতির পিতা’। মুহূর্তের মধ্যে উত্তেজিত ও উল্লসিত ছেলেরা জাতির পিতা’র সেই ছবিটিকে টুকরাে টুকরাে করে ছিড়ে ফেললাে। টুকরােগুলাে রাস্তায় ছড়িয়ে পা দিয়ে মাড়াতে লাগলাে। পরে শুনেছি : শহরে যতাে স্কুল-কলেজে বা অফিস-আদালতে জিন্নাহর যতাে ছবি ছিলাে সবগুলােরই একই পরিণতি ঘটেছে।
বুঝতে বাকি রইলাে না যে, মুমূর্ষ পাকিস্তান রাষ্ট্রটিকে অক্সিজেন দিয়েও বাঁচিয়ে রাখার আর কোনাে সম্ভাবনা নেই।
এই শহরেরই রাজপথে এর দেড় বছর আগে, সত্তরের আগস্টে, স্কুলের ছাত্রছাত্রীদের একটা মিছিল দেখেছিলাম। মিছিলের স্লোগানটি কানে আসতেই রীতিমতাে হকচকিয়ে গিয়েছিলাম। রাজপথ কাঁপিয়ে দিচ্ছে কতকগুলাে কচিকণ্ঠের ধ্বনি—‘পাকিস্তান দেশ ও কৃষ্টি তুলে নাও তুলে নাও।’
পাকিস্তানের বুকে দাঁড়িয়েই ওরা পাকিস্তান দেশ ও কৃষ্টি তুলে নিতে বলছে! এ রকম রাষ্ট্রবিরােধী কথা বলার পরও পাকিস্তানের সদাজাগ্রত প্রহরী পুলিশ-পুঙ্গবেরা ওদের ওপর ঝাপিয়ে পড়ছে না! কী তাজ্জব ব্যাপার! অমন অঘটন ঘটলাে কী করে!
পরে বুঝলাম যে, আসলে তারা শুরু করেছিলাে এই বলে—পাকিস্তান : দেশ ও কৃষ্টি বইটি, তুলে নাও তুলে নাও। কিন্তু বারবার এ রকম বলতে বলতে শেষে স্লোগান থেকে বইটি কথাটা বাদ পড়ে যায়, হয়ে যায় পাকিস্তান দেশ ও কৃষ্টি, তুলে নাও তুলে নাও।’ স্লোগানটি
৩৫১
শুনতে শুনতে আমার মনে হয়েছিলাে যে, বাঙালি কিশাের-কিশােরীদের নিজেদের অজ্ঞাতসারে মুখ ফসকে যে কথাটি বেরিয়ে এসেছে সেটিই তাদের মনের আসল কথা। আসলে তারা শুধু একটি বইকেই তুলে নেবার দাবি করছে না, তাদের দাবি পাকিস্তানকেই তুলে নেয়া। ‘পাকিস্তান’–এই দেশ-নামটি বড়াে কৃত্রিমভাবে সােনার বাংলার বুকে চাপিয়ে দেয়া হয়েছিলাে, ‘পাকিস্তানি কৃষ্টি’ নামের একটি অস্তিত্বহীন অপধারণা দিয়ে এ দেশের শিশু-কিশােরদের মস্তিষ্ক কোষ আচ্ছন্ন করে দেয়ার চেষ্টা হচ্ছিলাে। তাদের ওই মিছিলের ভাষা ছিলাে সেই অপচেষ্টারই প্রতিবাদ, ওতে স্পষ্ট হয়ে উঠেছিলাে ওই দুঃস্বপ্নের দেশ ও কৃষ্টির হাত থেকে মুক্তিলাভের আর্তি।
পাকিস্তান : দেশ ও কৃষ্টি নামের বইটি স্কুলের ছেলেমেয়েদের ঘাড়ে চেপে বসেছিলাে উনসত্তরের গণআন্দোলনের পরে, ইয়াহিয়ার জঙ্গি হুকুমাতের আমলে। গণআন্দোলনের ধাক্কায় পাকিস্তানের অবস্থা যে নড়বড়ে হয়ে পড়েছে সে কথা উপলব্ধি করেই রাষ্ট্রের কর্তাব্যক্তিরা বাঙালি ছেলেমেয়েদের কচিমাথায় নতুন করে পাকিস্তানবাদের বীজ রােপণ করার ব্যবস্থা করলেন। সেই ব্যবস্থার অংশ হিসেবেই রচনা করা হলাে পাকিস্তান : দেশ ও কৃষ্টি বইটি, এবং সে বইটি অবশ্যপাঠ্য করা হলাে এখানকার হাইস্কুলগুলাের ক্লাস নাইন-টেনে। অবিভক্ত ভারতবর্ষে কীভাবে মুসলিম জাতীয়তাবাদের সৃষ্টি হয়েছিলাে, কীভাবে এই মুসলিম জাতীয়তাবাদের বিকাশের চূড়ান্ত পর্যায়ে পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠা হয়েছিলাে, পাকিস্তানের বিভিন্ন অঞ্চলের মানুষের ভাষায় ও আচরণে নানা অমিল সত্ত্বেও কিভাবে গড়ে উঠেছিলাে একটি অখণ্ড জাতীয়তাবাদী চেতনা’—সে সব কথাই লেখা ছিলাে পাকিস্তান : দেশ ও কৃষ্টি বইটির পাতায় পাতায়।
বইটির লেখক তথা পাকিস্তানের রাষ্ট্রীয় কর্তৃপক্ষের দৃষ্টিতে ‘অখণ্ড’ জাতীয়তাবাদী চেতনা’ মানে ছিলাে ধর্ম ইসলাম। তাই, বইটিতে লেখা হয়েছিলাে-
“…টেকনাফ থেকে তুরখাম পর্যন্ত সমগ্র ভূখণ্ডের প্রায় সকল অধিবাসীই এক ধর্মবিশ্বাসের সূত্রে আবদ্ধ। একে অন্যের সুখ-দুঃখের ভাগীদার হিসেবে পাকিস্তানিরা একটি সুসংহত জাতি গড়িয়া তুলিয়াছে। আর সেই সঙ্গে গড়িয়া উঠিয়াছে তাহাদের নিজস্ব একটি কৃষ্টিগত বুনিয়াদ।….পাকিস্তানের নিজস্ব কৃষ্টিগত বুনিয়াদকে আমরা পাকিস্তানি কৃষ্টি আখ্যায়িত করিতে পারি। এই পাকিস্তানি কৃষ্টি ও সভ্যতার পশ্চাৎপটই দেশের জনগণের মধ্যে সংহতির একটি যােগসূত্র রক্ষা করিয়া চলিযাছে।”
কথাগুলাে ছিলাে ডাহা মিথ্যা। পাকিস্তানের পশ্চিম অঞ্চলের অধিবাসী সিন্ধি-বেলুচপাঠানদের ভাব-ভাবনা ও সংগ্রামের প্রসঙ্গ এখানে তুলছি না। বলছি শুধু পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালিদের কথাই। আটচল্লিশ থেকে উনসত্তরের নানা তিক্ত অভিজ্ঞতার মধ্যদিয়ে তারা বুঝে নিয়েছিলাে : পাকিস্তানি জাতি বলে কোনাে জাতি নেই, পাকিস্তানি কৃষ্টি সােনার পাথর বাটিরই আরেক নাম। অথচ, উনসত্তরের উথালপাথাল-করা জনউত্থানের পরও পাকিস্তানের শাসকরা মনে করেছিলাে যে, সুসংহত পাকিস্তানি জাতির কল্পকথা শুনিয়েই তাদের কল্পরাষ্ট্রটিকে বাঁচিয়ে রাখতে পারবে। তাদের সেই খায়েশ যে পূর্ণ হবার নয়, সে কথাটিই সত্তরের আগস্টে মিছিল করে জানিয়ে দিয়েছিলাে সদ্য-জেগে-ওঠা বাঙালি কিশাের-কিশােরীরা। উচ্চকণ্ঠে তারা পাকিস্তান দেশ ও কৃষ্টি তুলে নেয়ার দাবি জানিয়েছিলাে। আর একাত্তরের মার্চে শুধু দাবি নয়, নিজেরাই পাকিস্তানের মূল উপড়ে ফেলার কাজে হাত লাগালাে এ রাষ্ট্রের জাতীয় পতাকা
৩৫২
পুড়িয়ে দিয়ে, তথাকথিত জাতির পিতার প্রতিকৃতিকে পায়ের তলায় পিষে ফেলে। এ রকম প্রতীকী কাজে বালক-কিশােরদের প্রচণ্ড উৎসাহের মধ্যে সমগ্র জাতির আকাক্ষারই দৃশ্যরূপটি ফুটে উঠেছিলাে।
সে আকাক্ষার প্রতিধ্বনি শােনা গিয়েছিলাে, এমন কি, পাগলদের কথায় ও আচরণেও। তিন-চার বছর ধরেই একটি পাগলকে দেখেছি ছেড়া চট পরে শহরের গাঙিনার পার, মদনবাবু রােড ও নতুন বাজারের রাস্তায় ঘুরে বেড়ায়। কখনাে তার হাতে থাকে খবরের কাগজের ছেড়া পাতা, কখনাে কোনাে মানুষের ছবি। ওগুলাে হাতে নিয়ে কী আবােল তাবােল বকতে থাকে তার মাথামুণ্ডু কিছুই বােঝা যায় না। কিংবা বলা উচিত, তার কথা আমরা কোনােদিন বুঝতে চেষ্টা করিনি, মনােযােগ দিয়ে শুনিওনি। পাগলের কথা তাে কথা নয়—প্রলাপ। সে প্রলাপে কে কবে মনােযােগ দেয়? কিন্তু একাত্তরের মার্চে সেই পাগলটিও আমাদের মনােযােগ কেড়ে নিলাে। কোথা থেকে সে জোগাড় করে নিয়ে এসেছে পাকিস্তানের জাতির পিতার একটা ছবি, সে ছবির গলায় ঝুলিয়ে দিয়েছে একটি ছেড়া সেন্ডেল, একখণ্ড বাঁশের আগায় ছবিটা ঝুলিয়ে নিয়ে সারা শহর জুড়ে হাঁটছে আর অদ্ভুত কণ্ঠস্বরে বলে যাচ্ছে-‘জিন্নাহ সাবের পাকিস্তান, আজিমপুরের গােরস্থান। কে তাকে এ কথা শিখিয়ে দিয়েছে জানি না। তবে কথাটা যে সে সময়কার নিদারুণ সত্য, তা তাে আর অস্বীকার করতে পারি না। আমরা সবাই বলি, ছাগলে কী না খায়, পাগলে কী না কয়? কিন্তু কোন এক রসিক ব্যক্তি যে এর ওপর টিপ্পনি কেটে বলেছিলেন, ছাগলে ঘুষ খায় না, আর পাগলে মিছা কথা কয় না’—সে কথা তাে মােটেই ‘মিছা’ নয়। পাগলরাই সত্য কথা বলে, অথবা অজস্র মিথ্যার ভিড়ে যারা সত্য কথা বলে তারাই পাগল।
সেদিন সারাটা দেশই যেন এ রকম পাগল হয়ে গিয়েছিলাে, যাকে বলে মুক্তিপাগল। ‘পাগলামি তুই আয়রে দুয়ার ভেদি’—কবিগুরুর এই আহ্বান একাত্তরের মার্চের, বিশেষ করে সাতই মার্চের, আগে এমন করে কোনােদিন সত্য হয়নি। আওয়ামী লীগের বাইরে অন্য অন্য প্রগতিশীল দল ও গােষ্ঠীগুলাের মধ্যে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সম্পর্কে যে সব দ্বিধাদ্বন্দ্ব ও দোদুল্যমানতা ছিলাে সে সবই মার্চের সাত তারিখ থেকে শূন্যে মিলিয়ে যায়। সাত তারিখেই তখনকার নিখিল পাকিস্তানভিত্তিক অন্যতম রাজনৈতিক দল ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি বা ন্যাপের (যার সভাপতি পশ্চিম পাকিস্তানের ওয়ালি খান) পূর্বাঞ্চল শাখা স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্র গঠনের প্রস্তাব গ্রহণ করে। সে প্রস্তাবে ওই দলের কেন্দ্রেরও সায় ছিলাে। সাধারণ নির্বাচনে ওই দলটি বেলুচিস্তান ও উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশে সরকার গঠন করার মতাে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়েছিলাে এবং নৌকার প্রবল জোয়ারের মুখেও সে দলের সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত পূর্বপাকিস্তান প্রাদেশিক পরিষদের একজন সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন। কাজেই নিখিল পাকিস্তান ভিত্তিক এই দলটির গুরুত্বকে কোনােমতেই অস্বীকার করা চলে না। এ দলটি যখন বাঙালির স্বাধীন রাষ্ট্রের প্রস্তাব গ্রহণ করে তখন সেটি হয়ে ওঠে অনেক গভীর তাৎপর্যমণ্ডিত একটি প্রস্তাব। তাছাড়া নিষিদ্ধ ও আন্ডারগ্রাউন্ড রাজনৈতিক দল পূর্ব পাকিস্তানের ক্যুনিস্ট পার্টির পূর্ণ সমর্থন ও পৃষ্ঠপােষকতা ছিলাে এই দলটির (ন্যাপের) প্রতি। মস্কোপন্থী-বলে-পরিচিত এই কম্যুনিস্ট পার্টি যে সেই ছাপ্পান্ন সাল থেকেই বাঙালিদের স্বাধীন রাষ্ট্রের কথা ভেবে আসছে, এবং বাষট্টি সালেই শেখ মুজিবের সঙ্গে এ নিয়ে এ পার্টির নেতাদের কথাবার্তা হয়ে গেছে—সে সব খবরও আমাদের জানা। তবু সরাসরি স্বাধীনতার কথা বলার উপযুক্ত লগ্ন কোনটি হবে, সে ব্যাপারে
৩৫৩
এ দলটি যে সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছিলাে তাও অস্বীকার করা যাবে না। এবার সেই সিদ্ধান্তহীনতার পূর্ণ অবসান ঘটলাে। মার্চের এগারাে কি বারাে তারিখেই আমরা কম্যুনিস্ট পার্টির একটি ইশতেহার হাতে পেয়ে গেলাম। মার্চের নয় তারিখে প্রচারিত এই ইশতেহারটির শিরােনাম ছিলাে ‘শত্রুবাহিনীকে মােকাবেলায় প্রস্তুত হউন/গণস্বার্থে স্বাধীন বাংলা প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম অব্যাহত রাখুন। এর বিভিন্ন অনুচ্ছেদগুলাের শিরােনাম ছিলাে এ রকম—জনগণের দুশমন কাহারা?’ ‘প্রকৃত মুক্তির লক্ষে অবিচল থাকুন’, ‘বিভ্রান্ত হইবেন না’, ‘দৃঢ়সংকল্প বজায় রাখুন’, ‘ক্ষমতা হস্তান্তরে বাধ্য করুন’, ‘সেনাবাহিনীর আক্রমণ প্রতিহত করুন’, শ্রমিক-কৃষক ভাইরা এগিয়ে আসুন।
ইশতেহারটির শুরুতেই বলা হয়েছে—“বাংলাদেশের জনগণ আজ গণতন্ত্র ও নিজেদের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্যে এখানে একটা পৃথক ও স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র কায়েম করিতে বদ্ধপরিকর হইয়াছেন ও এইজন্য এক গৌরবময় সংগ্রাম চালাইতেছেন। এই সংগ্রামে জনগণ সশস্ত্র সেনাবাহিনীকে অসম সাহসিকতার সহিত মােকাবেলা করিতেছেন এবং নিজেদের আশাআকাঙ্ক্ষা পূরণের জন্যে বুকের রক্ত ঢালিতেও দ্বিধা করিতেছেন না। কম্যুনিস্ট পার্টি পূর্ববাংলার সংগ্রামী বীর জনগণকে আন্তরিক অভিনন্দন জানাইতেছে। পূর্ববাংলার কম্যুনিস্টরা দীর্ঘকাল হইতেই বাঙালিসহ পাকিস্তানের সকল ভাষাভাষী জাতির বিচ্ছিন্ন হইয়া রাষ্ট্র গঠনের অধিকার তথা আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকার দাবি করিয়া আসিতেছে। পূর্ববাংলার জনগণ আজ অনেক ঘটনার ঘাত-প্রতিঘাতের ভিতর দিয়া পূর্ববাংলায় একটি পৃথক ও স্বাধীন রাষ্ট্র গঠনের যে দাবি উত্থাপন করিয়াছেন, আমরা উহাকে ন্যায্য মনে করি, তাই পূর্ববাংলার জনগণের বর্তমান সংগ্রামে আমরাও সর্বশক্তি লইয়া শরিক হইয়াছি।”
পার্টির কুরিয়ার’ মারফৎ এই ইশতেহারটি যেদিন হাতে পেলাম সেদিন সত্যি সত্যিই আনন্দে নৃত্য শুরু করে দিয়েছিলাম। এর আগে পার্টির ময়মনসিংহ জেলা কমিটির নেতা জ্যোতিষ বােসের সঙ্গে আমাদের (আমার এবং পার্টি গ্রুপ’-এর অন্য সদস্যদের) কয়েকবার গােপন সাক্ষাত হয়েছে। স্বাধীনতা সম্পর্কে পার্টি কোনাে স্পষ্ট সিদ্ধান্ত না দেয়ায় জ্যোতিষদার কাছে প্রতিবারই আমরা ক্ষোভ প্রকাশ করেছি। জ্যোতিষদা অনেক তত্ত্বকথার অবতারণা করে পার্টির অবস্থান সম্পর্কে আমাদের বােঝাতে চেষ্টা করেছেন, কিন্তু আমরা বুঝ মানিনি। সারাদেশের মানুষ যখন স্বাধীনতা ছাড়া অন্য কোনাে কথাই শুনতে চায় না, তখন কম্যুনিস্ট পার্টির এই তত্ত্বের কচকচানি যে আমাদের কাছে অসহ্য হয়ে উঠেছে, এ রকম কথা বলে আমরা জ্যোতিষ দা’কে রাগাতে চেষ্টা করেছি। তিনি রাগেননি। তাঁর ব্যক্তিগত অভিমত যে প্রায় আমাদেরই মতাে, এ কথা তার কথাবার্তায় বের হয়ে এসেছে। তবু পার্টির সিদ্ধান্ত না হওয়া পর্যন্ত তিনি আমাদের সংযত থাকতে উপদেশ দিয়েছেন।
ইশতেহারটি পেয়ে আমাদের ক্ষোভের অবসান হলাে। প্রচণ্ড উৎসাহে স্বাধীনতার কথা বলতে শুরু করলাম। সে সময়ে আমাদের বক্তব্য প্রকাশের প্রধান ফোরাম হিসেবে বুদ্ধিজীবী সংগ্রাম শিবিরকেই বেছে নিয়েছিলাম।
বঙ্গবন্ধুর সাতই মার্চের ভাষণের পর এর বিরােধিতা করে সােজাসুজি কিছু বলার সাহস কারাে রইলাে না। সত্যি কথা বলতে কি, এটি হয়ে গিয়েছিলাে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘােষণাপত্র ও এদেশে পাকিস্তানের মৃত্যুদণ্ডের আদেশনামা। এ অঞ্চলে এ আদেশনামার কট্টর বিরােধী পাকিস্তানবাদীরাও (যেমন মুসলিম লীগ নেতা খান সবুর ও অন্যান্যরা) শেখ মুজিব বা
৩৫৪
আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে কিছু না বলে দোষারােপ করতে লাগলেন পশ্চিম পাকিস্তানের নেতাদেরই। দেশের গুরুতর পরিস্থিতিতে নূরুল আমীনেরও প্রাণ আকুল’ হলাে। ঘুরিয়ে ফিরিয়ে তিনি অনেক কথাই বললেন, কিন্তু স্পষ্ট করে পাকিস্তানের অখণ্ডতা রক্ষার কথা উচ্চারণ করতে পারলেন না। পাকিস্তানবাদী নন, অথচ শেখ মুজিবকে সহ্য করতে পারেন না এমন রাজনীতিক বাংলা জাতীয় লীগের সাধারণ সম্পাদক অলি আহাদ পর্যন্ত তার দলকে ‘শেখ মুজিবের নির্দেশিত পথে কর্মসূচি পালন করতে নির্দেশ দিলেন। আতাউর রহমান খান তাে শেখ মুজিবের ভাষণের সঙ্গে কণ্ঠ মিলিয়েই বললেন, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’
আর মওলানা ভাসানী তাে অন্তত সে মুহূর্তের জন্যে তার সকল স্ববিরােধিতা পরিত্যাগ করে দ্ব্যর্থহীন ভাষায় শেখ মুজিবকে সমর্থন জানালেন। বললেন, পূর্ব পাকিস্তান স্বাধীন হইবে। পাকিস্তান অখণ্ড থাকিবে না, অখণ্ড রাখিব না। ইয়াহিয়ার বাপেরও ক্ষমতা নাই ইহা ঠেকায়।’
একাত্তরের মার্চে, অন্তত পঁচিশ মার্চ পর্যন্ত, বাংলাদেশে পাকিস্তানের দালাল কেউ ছিলাে না। পরে যারা দালাল হয়েছিলাে, এ সময়ে তাদের কেউ কেউ মুক্তিযােদ্ধা বা বিপ্লবীর মতাে কথা বলছিলাে, অন্যেরা মৌন-মূক হয়ে ভবিষ্যতের আশায় ঘাপটি মেরে পড়েছিলাে।
এছাড়া আর সবাই ছিলাে মুক্তিপাগল। পাগলামি সেদিন সত্যি সত্যিই দুয়ার ভেদ করে। চলে এসেছিলাে।

ইতিহাসের একটি অমােচনীয় কলঙ্কচিহ্ন
অধিকাংশ বাঙালিই সেদিন সত্যিকারের মুক্তিপাগল হয়ে গিয়েছিলাে যদিও, তবু অনেক মতলবি পাগলও যে এদের মধ্যে ভিড়ে গিয়েছিলাে এবং আসল পাগল না হয়েও অত্যন্ত নৈপুণ্যের সঙ্গে পাগলের অভিনয় করে যাচ্ছিলাে, সে কথাও অস্বীকার করা যাবে না। মতলবি পাগলরাই বরং পাগলামিতে আসল পাগলদের ছাড়িয়ে গিয়েছিলাে। বুদ্ধিজীবীদের মধ্যেই, স্বভাবত, মতলবিদের ছিলাে সংখ্যাধিক্য।
একাত্তরের মার্চে আমার জেলা শহর ময়মনসিংহেও দেখেছি নিজেদের বাঙালি জাতীয়তাবাদের একনিষ্ঠ সেবক প্রমাণ করার জন্যে বুদ্ধিজীবীদের পরস্পরের মধ্যে কি প্রচণ্ড প্রতিযােগিতা! যে বুদ্ধিজীবীটি দুদিন আগেও পাকিস্তানের অখণ্ডতা রক্ষার জন্যে জান কোরবান করতে একপায়ে খাড়া ছিলেন, তিনিই রাতারাতি ঘাের বাঙালি সেজে গেলেন, এই মুহূর্তেই বাংলাদেশ স্বাধীন করার জন্যে পারলে খালি হাতেই পাকিস্তানি মিলিটারির ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েন। জামায়াতে ইসলামী দলের ভাববাহী বুদ্ধিজীবীকেও দেখলাম কোন্ যাদুবলে হঠাৎ করে কট্টর আওয়ামী লিগার হয়ে গেছেন, সেমিনারে বাঙালি জাতীয়তাবাদ সম্পর্কে প্রবন্ধ পাঠ করছেন, পশ্চিমাদের তাড়িয়ে দিয়ে বাঙালির জাতীয় রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পক্ষে আবেগভরা বাক্যাবলি উচ্চারণ করে যাচ্ছেন। সে বাক্যাবলিতে পরিশীলিত স্বদেশপ্রীতির কোনাে প্রকাশ নেই, আছে কেবল স্তুল জাতিবিদ্বেষ। ওরা উর্দুতে কথা বলে, আমরা বাংলায়। ওরা রুটি খায়, আমরা ভাত। ওদের মেয়েরা কামিজ পরে আমাদের মেয়েরা শাড়ি। এরকম ‘ওরা আর আমরা’র আরেকটি সাম্প্রদায়িক ফর্মুলা দিয়েই এক সময়ে দ্বিজাতিতত্ত্ব খাড়া করে পাকিস্তানের জন্ম দেয়া হয়েছিলাে। সে-সময়কার ‘ওরা ছিলাে হিন্দু আর আমরা মুসলমান। সে সময়ে
৩৫৫
বলা হয়েছিলাে—ওরা ধুতি পরে, আমরা লুঙ্গি, ওরা জল খায়, আমরা পানি; ওরা স্নান করে, আমরা গােসল। আর এখন উর্দু-বাংলা, রুটি-ভাত, শাড়ি-কামিজ এসব দিয়েই নতুন ‘ওরা আর আমরা’র বিভাজনকে বােঝাতে চাইলেন সদ্য গজিয়ে ওঠা একদল বাঙালি জাতীয়তাবাদী অর্বাচীন বুদ্ধিজীবী। সে-সময়ে যেমন ‘হিন্দু হঠিয়ে মুসলমানের পাকিস্তান হয়েছিলাে, এখন তেমনি পশ্চিমা’ তাড়িয়ে বাঙালির বাংলাদেশ হবে।
অথচ, পাকিস্তানে বাঙালি জাতীয়তাবাদের বিকাশ কিন্তু এই সদ্য গজিয়ে ওঠা স্কুলচিত্ত বুদ্ধিজীবীদের হাতে হয়নি। আটচল্লিশের ভাষা আন্দোলনের সময় থেকেই এখানে নতুন করে বাঙালি জাতীয়তাবাদের সূচনা। সে সূচনালগ্ন থেকেই এই বাঙালি জাতীয়তাবাদ বিকশিত হতে থাকে হাজার বছরের বাংলার ভাষা সাহিত্য-সংস্কৃতির উত্তরাধিকারকে চেতনায় ধারণ করে। এ জাতীয়তাবাদে কোনাে স্থূলতা ছিলাে না। নঞর্থক ও রুগণ নয়, একান্ত সদর্থক ও সুস্থ ছিলাে এ জাতীয়তাবাদের আবেগ। বাংলার ভাষা, বাংলার বর্ণমালা, বাংলার রবীন্দ্রনাথ-নজরুলের বিরুদ্ধে পরিচালিত ষড়যন্ত্রকে মােকাবেলা করেই বাঙালির এ-জাতীয়তাবাদ ধীরে ধীরে শক্তিমান হয়ে উঠেছিলাে। বাঙালির অর্থনৈতিক মুক্তি ও রাজনৈতিক সাংস্কৃতিক স্বাধিকার প্রতিষ্ঠার চেতনাই ছিলাে বাঙালি জাতীয়তাবাদের মূল শক্তি। অন্য জাতির অধিকার হরণের কোনাে বদ মতলব কিংবা অন্যের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের প্রতি সামান্যতম ঘৃণাও বাঙালি জাতীয়তাবাদের মূল প্রবক্তাদের মনে স্থান পায়নি। এর প্রবক্তাদের মধ্যে ভাষা-বিজ্ঞানী, সাহিত্য-শাস্ত্রী ও সংস্কৃতি-তাত্ত্বিকরা যেমন ছিলেন, তেমনি ছিলেন রাষ্ট্রবিজ্ঞান ও অর্থবিজ্ঞানের জঁদরেল পণ্ডিতরাও। এঁরা সকলে পূর্বপাকিস্তানের বাঙালিদের জাতীয় স্বাধিকারের পাশাপাশি পশ্চিম পাকিস্তানের সকল জাতির অধিকারের প্রতিও শ্রদ্ধাশীল ছিলেন।
কিন্তু বাঙালি জাতীয়তাবাদের প্রবাহ যতােই বেগবান হয়ে ওঠে ও এর সংগ্রাম যতােই সাফল্যের দিকে এগােতে থাকে, ততােই মতলববাজরা এর ভেতরে বেশি বেশি সংখ্যায় উড়ে এসে জুড়ে বসতে শুরু করে। তখন সাম্প্রদায়িকতাবাদী দাঁড়কাকেরাই জাতীয়তাবাদের ময়ূরপুচ্ছ গায়ে চাপিয়ে দিয়ে সামনে এসে দাঁড়ায়। একাত্তরের মার্চে ওই ময়ূরপুচ্ছধারিদের কণ্ঠই অনেক বেশি সােচ্চার হয়ে উঠেছিলাে। আর তারই নিচে যে বাঙালির জাতীয় চেতনার সুস্থ ধারাটি, একান্ত সাময়িক কালের জন্যে হলেও, চাপা পড়ে গিয়েছিলাে—সে এক বেদনাউদ্দীপক ও কলঙ্কজনক সত্য।
লক্ষ করেছি, রাতারাতি পাকিস্তানি থেকে বাঙালি বনে যাওয়া ভােল পাল্টানাে ও বােল পাল্টানাে লােকগুলাের প্রায় সবাই কম্যুনিস্টদের বিরােধিতায় সমান সােচ্চার। বাংলাদেশের স্বাধীনতা অবশ্যই চাই এবং সেই সঙ্গে চীন রাশিয়ার দালাল কম্যুনিস্টদেরও অবশ্যই প্রতিহত করতে চাই। কম্যুনিস্টরা ঘােলা পানিতে মাছ শিকারে ওস্তাদ, এবারও ওরা তাই করবে। আমরা বাঙালি। দেশে বাঙালির রাজত্ব চাই। এখানে চীন রাশিয়ার কথা আসবে কেন? অথচ, এই কম্যুনিস্টরা নিজের দেশ বােঝে না। ওদের স্বদেশ প্রেম নেই মােটেই। কেউ এরা চীনের নামে অজ্ঞান, কেউ রাশিয়ার নামে। চীনপন্থী, রুশপন্থী সব ক্যুনিস্টই বাঙালির শত্রু।
ছেলেবেলা থেকেই এ-কথাগুলাে যে কতােবার কতাে ভাষায় শুনে আসছি। যখন চীনরাশিয়ার কম্যুনিস্টদের মধ্যে বিবাদ দেখা দেয়নি তখন যেমন শুনেছি, তেমনি কম্যুনিস্টরা রুশপন্থী ও চীনপন্থীতে বিভক্ত হয়ে যাওয়ার পরও শুনেছি। তাই পাকিস্তান যখন মৃত্যুশয্যায় শায়িত এবং স্বাধীন বাংলাদেশের জন্ম আসন্ন বলে আশা করা হচ্ছে যখন, তখনাে এ-সব কথা
৩৫৬
শুনে অবাক হইনি। মতলববাজরাই যে কম্যুনিস্ট বিদ্বেষ প্রচারে উচ্চকণ্ঠ থাকে তাতেও বিস্ময়ের কিছু নেই। কারণ ধর্ম, সম্প্রদায় বা জাতি কোনাে কিছুর নামেই মতলববাজী কিংবা উগ্রতা ও বিদ্বেষ প্রচারকে কম্যুনিস্টরা বরদাস্ত করে না। সামাজিক সব সমস্যাকে তারা দেখে শ্রেণী দৃষ্টিকোণ থেকে। এই শ্রেণীদৃষ্টিভঙ্গিটি সব মতলববাজদেরই সব সময়ই অপছন্দ। তাই পাকিস্তানে বাংলা রাষ্ট্রভাষার আন্দোলনকে পাকিস্তানের শাসকরা যেমন কম্যুনিস্ট ষড়যন্ত্র আখ্যা দিয়েছিলাে, তেমনি সে-আন্দোলনকালে উগ্র বাংলাপ্রেমিকরাও কমুনিস্টদের ওপর মহা বিরক্ত ও বিদ্বিষ্ট হয়ে গিয়েছিলাে। বাঙালি স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সংগ্রামের কালেও, এই শ্রেণী দৃষ্টিভঙ্গিটির জন্যেই, কম্যুনিস্টদের প্রতি ওদের বিরক্তি ও বিদ্বেষ দূর হয়ে যায়নি। বরং আরাে বেড়ে যায়, আরাে উগ্র হয়ে ওঠে। বাংলাই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা’—কম্যুনিস্টরা এরকম দাবিকে যেমন সমর্থন করেনি, তেমিন এরপর বাংলা ও উর্দু রাষ্ট্রভাষা চাই’ স্লোগানেরও তারা সমালােচনা করেছিলাে। সেই বায়ান্ন সালেই কম্যুনিস্টরা পাকিস্তানকে একটি বহুজাতিক রাষ্ট্র বলে আখ্যায়িত করে, এবং এ রাষ্ট্রের সকল জাতির ভাষার (অর্থাৎ বাংলা, উর্দু, সিন্ধি, পাঞ্জাবি, পুস্তু, বেলুচি ও গুজরাটির) সমান মর্যাদা দাবি করে। এরপর ধাপে ধাপে বাঙালির আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার সংগ্রাম এগিয়ে নিতে যখন তৎপর হয় তখনাে তারা পাকিস্তানের অন্যান্য জাতির অধিকারের প্রতি সমান দৃষ্টি রাখার কথা বলে, সকল জাতির মেহনতি মানুষের স্বার্থকে অগ্রাধিকার দেয়, জাতীয় অধিকার আদায়ের সংগ্রামকে সাম্রাজ্যবাদ-বিরােধী সংগ্রামের অবিচ্ছেদ্য অংশ বলে মনে করে। আমরা দেখেছি, শেখ মুজিব ছয়দফা ঘােষণা করলে তার প্রতি কম্যুনিস্টরা যেমন সমর্থন জানিয়েছিলাে, তেমনি এও বলেছিলাে যে, এতে মেহনতি মানুষের দাবির উল্লেখ থাকা প্রয়ােজন। জাতীয় মুক্তির সংগ্রামে জয়লাভের জন্যে দৃঢ়ভাবে সাম্রাজ্যবাদ-বিরােধী হওয়ার প্রয়ােজনীয়তার প্রতি কমুনিস্টরা সব সময়েই জোর দিয়ে এসেছে। একাত্তরের পঁচিশে ফেব্রুয়ারিতে গৃহীত রাজনৈতিক প্রস্তাবেও কম্যুনিস্ট পার্টি পূর্বপাকিস্তানের বাঙালিদের স্বাধিকার সংগ্রাম প্রসঙ্গে বলেছে—’…পূর্ববাংলার জনগণকে বুঝাইতে হইবে যে, এই সংগ্রাম পশ্চিম পাকিস্তানের বিভিন্ন ভাষাভাষী জাতির জনগণ ও অবাঙালি জনগণের বিরুদ্ধে নয়। বরং ইহা পূর্ববাংলা ও পশ্চিম পাকিস্তানের সমশত্রু সাম্রাজ্যবাদ, সামন্তবাদ ও একচেটিয়া পুঁজির বিরুদ্ধে সংগ্রাম এবং এই সংগ্রাম সারা পাকিস্তানের বিভিন্ন ভাষাভাষী জাতির জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামের অঙ্গ। এই সগ্রামে পশ্চিম পাকিস্তানের সহযােগিতা ও সমর্থন চাই এবং তাহাদের জাতীয় অধিকার ও গণতন্ত্রের সংগ্রাম আমরা সমর্থন করি। এই সংগ্রামের সফলতার জন্যে উগ্র বাঙালি জাতীয়তাবাদের অবাঙালি জনগণ বিরােধী জিগির এবং মওলানা ভাসানীর পশ্চিম পাকিস্তানের জনগণ বিরােধী জিগিরের মুখােশও আমাদের খুলিয়া দিতে হইবে।
পরিশেষে আমাদের অবশ্যই মনে রাখিতে হইবে যে, এই সগ্রামে স্বাধীন জাতীয় গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ সম্মুখে রাখিয়া আমাদের প্রচেষ্টা হইবে এই সংগ্রামকে সাম্রাজ্যবাদ, সামন্তবাদ ও একচেটিয়া পুঁজির তথা দেশি-বিদেশি প্রতিক্রিয়াশীলদের চক্রান্তের বিরুদ্ধে পরিচালিত করা।
এই ধরনের কথা শুধু রুশপন্থী কম্যুনিস্ট পার্টিরই নয়। রুশপন্থীদের সঙ্গে মত-পথের অনেক গরমিল সত্ত্বেও ‘চীনপন্থী কম্যুনিস্টরাও নিশ্চয়ই স্কুল ও উগ্র জাতীয়তাবাদের বিরােধী। তারাও শ্রেণীদৃষ্টিতেই সামাজিক সমস্যার বিচার করে। এরকম বিচারধারার অনুসারী আর
৩৫৭
যেসব গােষ্ঠী যেমন বিভিন্ন গ্রুপের ছাত্র ইউনিয়ন, মােজাফফর ন্যাপ কিংবা শ্রমিক কৃষক পেশাজীবীদের নানা সংগঠন-সবাই ওই হঠাৎ বাঙালিদের চোখে কম্যুনিস্ট। কম্যুনিস্টরা উগ্র বাঙালিত্বের ঘাের বিরােধিতা করেছিলাে বলেই একাত্তরের ‘হঠাৎ বাঙালি’রা কম্যুনিস্টদের ওপর বড়াে বেশি ক্ষেপে গিয়েছিলাে।
হঠাৎ বাঙালিদের হঠকারি কথাবার্তার ধূম্রজালে সকল সুস্থ বিচার-বিবেচনাই আচ্ছন্ন হয়ে যায়। বিচার-বিবেচনায় যখন সুস্থতা থাকে না তখনই তাে নানা রকম মূঢ়তার প্রকাশ ঘটে। সেই মূঢ়তা একাত্তরেও বাঙালিদের একাংশের মধ্যে সঞ্চারিত হয়েছিলাে। একটা-দুইটা পাঞ্জাবি ধর, সকাল-বিকাল নাস্তা কর’ কিংবা একটা-দুইটা বিহারি ধর, সকাল-বিকাল নাস্তা কর’-এ-রকম জিগির তােলার মধ্যেই তারা বাঙালিত্বের চরম প্রকাশ দেখতে পেয়েছিলাে। পাঞ্জাবিদের তাে আর হাতের কাছে পাওয়ার উপায় ছিলাে না, চোখের সামনে ছিলাে বিহারিরা। বাংলা ভাষাভাষী ছাড়া যারাই সাতচল্লিশের পর ভারত থেকে উদ্বাস্তু হয়ে এদেশে এসেছে— তারা বিহার, উত্তর প্রদেশ কিংবা অন্য যে কোনাে এলাকারই হােক না কেন—বাঙালিদের চোখে সবাই বিহারি। সেকালের পূর্ব পাকিস্তানের কোন এলাকায় কতাে সংখ্যক বিহারির অধিবাস ছিলাে আমার জানা নেই। ময়মনসিংহ শহরেই যে তাদের সংখ্যা কতাে ছিলাে তাও জানি না। শহরের বাঁশবাড়ি, ছত্রিশবাড়ি, সানকিপাড়া—এ-রকম কয়েকটি কলােনিতে বিহারিরা থাকতাে। কলােনির বাইরেও কিছু বিহারির বাড়ি ছিলাে। কেউ কেউ বলেন, সেসময়ে ময়মনসিংহে অন্তত পঁচিশ হাজার বিহারি পরিবারের আবাস ছিলাে। ওই বিহারিরা তাদের স্বাতন্ত্র সম্পর্কে ছিলাে খুবই সচেতন। শুধু তাই নয়। ওদের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ যদিও ছিলাে সাধারণ শ্রমজীবী গােষ্ঠীর মানুষ, তবু পাকিস্তানের শাসকগােষ্ঠী ওদের মধ্যে একটি কৃত্রিম উচ্চমন্যতা বােধের সঞ্চার করে দিয়েছিলাে। এর ফলে ওদের সঙ্গে এদেশের বাঙালি সমাজের বিচ্ছিন্নতা দুর্ভেদ্য হয়ে পড়ে। এই বিচ্ছিন্নতারই সুযােগ নিয়ে একাত্তরের এপ্রিলে এক শ্রেণীর বাঙালি’ গুণ্ডা ও মতলববাজদের দল বিহারিদের ওপর পৈশাচিক হামলা চালিয়ে বাঙালি জাতির ইতিহাসে একটি অমােচনীয় কলঙ্ক চিহ্ন এঁকে দেয়।
সত্তরের নির্বাচনের সময় থেকেই বিহারিদের মধ্যে আতঙ্ক ও নিরাপত্তাহীনতা দেখা দিতে থাকে। তবু সে-সময়ে তারা সরাসরি কোনাে হামলার শিকার হয়নি। একাত্তরের মার্চে ইয়াহিয়া যখন জল্লাদ টিক্কা খানকে পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর নিয়ােগ করে তখন বাঙালিদের মধ্যে তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়, হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতিও টিক্কা খানকে শপথ গ্রহণ করাতে অস্বীকার করেন। সে-সময়ে ময়মনসিংহের বিহারিরাও টিক্কা খান-বিরােধী মিছিল বের করে, এবং আন্দোলনরত বাঙালিদের সঙ্গে একাত্মতা ঘােষণা করে। তবু সত্যি সত্যি একাত্ম তারা হতে পারেনি। কারণ, এতাে দিনে অবিশ্বাস ও ব্যবধান বাড়তে বাড়তে একেবারে দুর্লঙ্ হয়ে গেছে। তবে, আওয়ামী লীগসহ অন্যান্য রাজনৈতিক দলের নেতারা একাত্তরের এপ্রিলের দ্বিতীয় সপ্তাহ নাগাদও বিহারিদের ওপর হামলা ঠেকিয়ে রেখেছে। অন্তত ময়মনসিংহ শহরে তাে তা-ই দেখা গেছে। সানকিপাড়া বিহারি কলােনিতে সামিয়ানা খাটিয়ে জনসভা হয়েছে। আওয়ামী লীগ নেতা রফিকউদ্দিন ভূইয়া সে সভায় বিহারিদের নিরাপত্তার আশ্বাস দিয়েছেন, বিহারিদের ওপর কোনােরূপ অত্যাচার-অবিচার হতে দেয়া হবে না বলে দ্ব্যর্থহীন ঘােষণা দিয়েছেন।
কিন্তু হায়, বিহারিদের জন্যে সব আশ্বাস আর ঘােষণা অকার্যকর হয়ে গেলাে এপ্রিলের সতেরাে তারিখে। তখনাে ময়মনসিংহ শহর মুক্ত, পাকিস্তান মিলিটারি তখনাে ঢাকা থেকে
৩৫৮
এখানে এসে পৌছুতে পারেনি। সেই মুক্ত শহরে মিলিটারিরা বিমান থেকে অনেকক্ষণ ধরে গােলাবর্ষণ করে চললাে সতেরােই এপ্রিল।
সারা শহরে আতঙ্ক ছড়িয়ে জঙ্গী বিমান চলে যাওয়ার পর সে-আতঙ্কের সঙ্গে এসে যুক্ত হলাে একটি গুজব। শােনা গেলাে : সানকিপাড়া কলােনি থেকে বিহারিরা নাকি লাল নিশান উড়িয়ে পাকিস্তানি জঙ্গি বিমানকে শহরের দিশা দেখিয়ে দিয়েছে, আর সেই সংকেত অনুসরণেই পাক মিলিটারিরা গােলাবর্ষণ করে চলে গেছে। যারা সেদিন শহরে ছিল তারা এই গুজবের সত্যাসত্য নির্ণয়ের কোনাে সুযােগ পায়নি। অনেকেই গােলাবর্ষণের পর দ্রুত শহর ছেড়ে চলে যায়। তবে, শহরে যে-সব ‘হঠাৎ বাঙালিরা সেদিন থেকে গিয়েছিল তারা সেদিন বিহারি কলােনি গুলিতে যে-সব পৈশাচিক কাণ্ড ঘটিয়েছিল সে-সবের কিছু খবর আমি পরে শুনেছি। সে-সব খবরের এক শতাংশও যদি সত্য হয়ে থাকে, তবে বাঙালি হিসেবে চিরকাল আমাকে লজ্জায় নতমস্তক হয়ে থাকতে হবে।

সশস্ত্র মুক্তিসংগ্রামের শুরুতে
একাত্তরের মার্চের কথা বলতে বলতে এপ্রিলের এমন একটি প্রসঙ্গকে ছুঁয়ে গেলাম যে প্রসঙ্গটি আমরা এড়িয়ে যেতে, ভুলে থাকতে, এমনকি অস্বীকার করতেই চেষ্টা করি। এবং এ-রকম চেষ্টা যে আত্মপ্রতারণারই নামান্তর, তাও মানতে চাই না। আত্মপ্রতারণা যে আত্মঘাতী, সেকথাটা সব সময়েই মনে রাখা উচিত। সেই ঔচিত্যবােধ থেকেই ময়মনসিংহে বিহারি নির্যাতনের বিষয়টি আমি উল্লেখ করলাম। প্রত্যক্ষ দর্শনজাত নয় বলে আমার কথাগুলাে হয়েছে একান্তই ভাসা ভাসা। তবু আমি মনে করি, বিহারিদের প্রসঙ্গটি পাকিস্তানের জন্মমৃত্যুদর্শনের অবিচ্ছেদ্য অংশ। এখনাে এ-অঞ্চলে পাকিস্তানের মৃত্যু ও বাংলাদেশের জন্মের পঁচিশ বছর পরও—যখন ময়মনসিংহে ব্রহ্মপুত্রের-পারে বিহারি ক্যাম্পে ওদের করুণ জীবন যাপনের দৃশ্য দেখি, তখন বিষন্নতায় আচ্ছন্ন হয়ে পড়ি। সে সঙ্গে অপরাধবােধেও। আবার পাকিস্তান নামক সেই শয়তান রাষ্ট্রটির প্রতি পুরনাে ঘৃণাটিও নতুন করে জেগে ওঠে। ভাবি : পৃথিবীতে রাষ্ট্রব্যবস্থা উদ্ভবের পর থেকে পাকিস্তানের চেয়ে জঘন্যতর কোনাে রাষ্ট্রের কি জন্ম হয়েছে কোনােদিন? পাকিস্তান তাে শুধু তার শত্রুদেরই ক্ষতিসাধন করেনি, চূড়ান্ত ক্ষতি ঘটিয়েছে তার অকপট ও ত্যাগী মিত্রদেরও। বিহারি নামে যারা আজকে পরিচিত, অবিভক্ত ভারতের নানা অঞ্চলে যাদের আদিবাস, পাকিস্তানের জন্যে তাদের অকপট ত্যাগের কথা কি কেউ অস্বীকার করতে পারবে? নিজেদের জন্মস্থান পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত হবে না জেনেও যে পাকিস্তানের জন্যে সংগ্রাম করতে গিয়ে ব্রিটিশ আমলে প্রতিপক্ষের রােষের শিকার হয়েছে যারা, সেই জন্মভূমি-ত্যাগী পাকিস্তানপ্রেমীদের পাকিস্তানেই কেন ধর্ষিত, লুণ্ঠিত ও নিহত হতে হলাে? পাকিস্তানপ্রেমে তাে কমতি দেখা দেয়নি ওদের। বংশানুক্রমেই সেই প্রেমে ওরা নিষ্ঠ থেকেছে। স্বাধীন বাংলাদেশের জন্মের পরও নিজেদের ওরা পাকিস্তানি বলে ঘােষণা করে রেখেছে। কিন্তু এখনাে জীবিত আছে যে পাকিস্তান—অর্থাৎ এককালে যা ছিলাে পশ্চিম পাকিস্তান—সেই পাকিস্তানকে ওরা নিজের চোখে দেখেইনি। তবু সেই পাকিস্তানই ওদের স্বপ্নদিয়ে-তৈরি ও স্মৃতি-দিয়ে-ঘেরা স্বদেশ। সে স্বদেশের মাটি তারা কোনাে দিন ছুঁতে পারবে কিনা কেউ তা জানে না। গত পঁচিশ বছরে ওই অস্বাস্থ্যকর ক্যাম্পে জন্মে নিয়েছে যে সব শিশু,
৩৫৯
যাদের শৈশব গড়িয়েছে যৌবনে, প্রকৃতপক্ষে তারাই এখন বিহারিদের ভেতর সংখ্যাগরিষ্ঠ। এদেশে জন্মেও তারা বিদেশি, অথচ তাদের কথিত স্বদেশের নেতানেত্রীরা তাদের স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের অধিকারটুকু পর্যন্ত স্বীকার করতে চায় না। ত্রিশঙ্কু এক মানবগােষ্ঠীর উদাহরণ হয়ে রয়েছে এই বিহারিরা।
একাত্তরে বাঙালি যখন স্বাধীনতার জন্যে মরণপণ সংগ্রামে লিপ্ত, তখনাে পাকিস্তান ওই বিহারিদের নিজের স্বার্থেই পুরােপুরি ব্যবহার করতে চেয়েছে। শুনেছি, তেইশে এপ্রিল ঢাকা থেকে পাকিস্তানি মিলিটারিরা ময়মনসিংহ শহরে ঢােকে। ঢুকেই তারা অতিরিক্ত বিহারি দরদ দেখাতে থাকে। কিন্তু ক্ষতিগ্রস্ত বিহারিদের স্বাভাবিক জীবনে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার কোনাে ব্যবস্থা তারা নেয় না, বরং ওদের ভেতর প্রতিশােধ স্পৃহা উস্কিয়ে দেয়। ওদের প্রশ্রয় ও উস্কানিতে বিহারিরা অনেক বাঙালির বাড়িঘরে লুটপাটে লেগে যায়। কিছু কিছু বাঙালি নিহতও হয় ওদের হাতে। আর পাকিস্তানি কর্তৃপক্ষ বিহারিদের দুর্দশাকে আন্তর্জাতিক প্রচার প্রােপাগান্ডার কাজে লাগায়। বাঙালিদের মুক্তিসংগ্রামকে ওরা বলে ভারতীয় ষড়যন্ত্র। ভারতীয়দের লেলিয়ে দেয়া দুষ্কৃতকারীরা বিহারিদের ওপর অত্যাচার করেছে, পূর্ব পাকিস্তানের ভেতর অন্তর্ঘাতী কার্যকলাপ চালিয়েছে, ওইসব দুষ্কৃতকারীকে শায়েস্তা করতে পারলেই তথাকথিত মুক্তিযুদ্ধ শেষ হয়ে যাবে—এসব কথাই ওরা অবিশ্রাম বলে গেছে।
যাই হােক, সেসব হচ্ছে আরাে পরের ব্যাপার। আমি বলছিলাম একাত্তরের মার্চের কথা। এবং ময়মনসিংহ শহরের কথা। সারাটা মার্চেই শহরটি ছিলাে অগ্নিগর্ভ। চব্বিশ তারিখ পর্যন্ত শহরেই বুদ্ধিজীবী সগ্রাম শিবির’-এর ব্যানারে আমরা পথসভা করেছি, গণসংগীত পরিবেশন ও বিপ্লবী কবিতা আবৃত্তি করেছি। পঁচিশ তারিখে আমরা সভা করতে গেলাম শহরের বাইরে। কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসসংলগ্ন গ্রাম দিঘারকান্দায়। সেখানকার প্রাইমারি স্কুলের সামনে গাঁয়ের মানুষরাই বক্তৃতামঞ্চ তৈরি করে দিয়েছিলেন। সভায় প্রচুর গ্রামীণ শ্রোতার সমাগম হয়েছিলাে। বক্তা ছিলেন কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন অধ্যাপক শামসুজ্জামান খান, আবদুর রাজ্জাক, মােস্তফা হামিদ হােসেন—এরা তাে ছিলেনই। এছাড়া এমন কেউ কেউ ছিলেন, যারা বিশ্ববিদ্যালয়ের শ্রেণীকক্ষের উচ্চশিক্ষার্থীদের বদলে গ্রামের নিরক্ষর মানুষের সামনে বক্তৃতা দেয়ার কথা এর আগে কোনােদিন ভাবতেও পারেননি।
এদের কথা বলতে গিয়েই মনে পড়ছে কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের জিনাত আরা ও অধ্যাপক ডক্টর করিমের সহধর্মিনী মিসেস সােফিয়া করিমের কথা। দিঘারকান্দার সভায় তাঁরা বক্তৃতা করেছিলেন কিনা আজ আর সে কথা স্মরণ করতে পারছি না। তবে বুদ্ধিজীবী সংগ্রাম শিবিরের অনেকগুলাে পথসভায় অধ্যাপিকা জিনাত আরার উদ্দীপনা পূর্ণ বক্তৃতার কথা আজো, স্বাধীনতা সংগ্রামের পঁচিশ বছর পরও, অনেকে সগৌরবে ও সানন্দে স্মরণ করেন। জিনাত আরা অবশ্যি বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছেন। কিন্তু মিসেস করিম সেই যে একাত্তর সালে জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে নেমে এসেছিলেন, আজো সে-সংগ্রামে তিনি বিরামহীনভাবে লেগেই রয়েছেন। মিসেস সােফিয়া করিমের অংশগ্রহণ ছাড়া, নব্বইয়ের দশকেও, ময়মনসিংহ শহরে কোনাে প্রগতিশীল কর্মকাণ্ডের কথা ভাবাই যায় না।
পঁচিশে মার্চের সন্ধ্যায় শহর থেকে যারা বক্তৃতা দিতে দিঘারকান্দায় গিয়েছিলেন তাদের মধ্যে মতিউর রহমান, গােলাম সামদানী কোরায়শী, রিয়াজুল ইসলাম, সৈয়দ আমীরুল ইসলাম—এই ক’জন অধ্যাপক বক্তার কথা আমার মনে পড়ছে। এদের বাইরেও হয়তাে আরাে
৩৬০
দু’একজন ছিলেন। সবাই খুব ভালাে বক্তৃতা দিচ্ছিলেন, সকলের কণ্ঠেই দেশপ্রেমের আবেগ ঝরে পড়ছিলাে, সকলের বক্তব্যেই পাকিস্তানি দুঃশাসনের হাত থেকে বাঙালি জাতির মুক্তিলাভের আর্তির প্রকাশ ঘটছিলাে। তবে, বক্তৃতা শুনতে শুনতে আমার মনে হচ্ছিলাে : বুদ্ধিজীবীরা যে ভাষায় কথা বলছেন সেটি গ্রামীণ জনগণের বােধগম্য ও হৃদয়গ্রাহী ভাষা নয়। গ্রামীণ শ্রোতারা অখণ্ড মনােযােগে বক্তাদের কথা শুনছে বটে, কিন্তু কঠিন কঠিন শব্দের বেড়া ডিঙিয়ে তাদের বক্তব্যের ভেতরে ঢুকে পড়তে পারছে না। যে কথাটি তারা শুনতে চায় ঠিক তা যেন ওই বিজ্ঞ বক্তাদের কাছ থেকে তারা পাচ্ছে না। বক্তৃতার ওই ধারাটি আমি উল্টে দিতে চাইলাম। মঞ্চে উঠেই বললাম : আজ থেকে ঠিক দু’বছর আগে, এরকমই আরেকটি পঁচিশে মার্চে, পাকিস্তানের প্রধান সেনাপতি দেশে মার্শাল ল’ নামে একটি আইন জারি করেছিলাে। আমার মনে হয়েছে, এই মার্শাল ল’ মানে হলাে, ‘মার শিয়াল ল’—অর্থাৎ ‘শিয়াল মারার আইন। এর আগে আইউব খানও এ-রকম শিয়াল মারার আইন জারি করেছিলাে। এখন কথা হচ্ছে, শিয়ালের প্রতি আক্রোশ থাকে কার?—কুত্তার। মানুষকে যারা শিয়ালের মতাে মনে করে তাকে মারার জন্যে ঝাপিয়ে পড়ে, তাদেরকে কুত্তা ছাড়া আর কী বলা যায়? ওই পাকিস্তানি জংলি শাসকরা আসলে কুত্তাই । চলুন আমরা আজকে, এই দিনে, ওদের মার শিয়াল ল’-এর বিপরীতে জারি করি—মার কুত্তা ল’। ওই কুত্তাদের মেরে আমরা আমাদের দেশকে স্বাধীন করবাে—আজকে এই হােক আমাদের প্রতিজ্ঞা।
আমার কথাগুলােতে কোনাে গভীরতা ছিলাে না, এগুলাে ছিলাে নিতান্তই স্কুল ও হালকা চালের কিছু প্রগলভ উক্তি মাত্র। কিন্তু কথাগুলাে বলেছিলাম পূর্ব ময়মনসিংহের উপভাষা তথা আঞ্চলিক ভাষায়। আর সে কারণেই আমার কথা যে শুধু সরলপ্রাণ গ্রামীণ শ্রোতাদেরই মনকে স্পর্শ করেছিলাে, তা নয়। যারা স্ট্যান্ডার্ড বাংলায় কথা বলেন, সেই বুদ্ধিজীবীরাও এতে বেশ আমােদ পেয়েছিলেন বলেই মনে হলাে। শুধু আমােদ নয়, আমার ওই গ্রাম্য বাগভঙ্গির দরুন আলােচ্য বিষয়টিও যে তাদের কাছে অনেক বেশি অনুভূতিগ্রাহ্য হয়ে উঠেছিলাে, সে কথা তারা সে-সময়ে মুক্তকণ্ঠে স্বীকার করেছিলেন। আসল ব্যাপারটা হচ্ছে : আমাদের আঞ্চলিক ভাষাগুলাের অকৃত্রিম ও অসাধারণ প্রকাশ-ক্ষমতার সঙ্গে পালিস করা স্ট্যান্ডার্ড ভাষার কোনাে তুলনাই চলে না। জনগণের অন্তরে প্রবেশ করার জন্যে যে জনগণের মুখের ভাষার কোনাে বিকল্প নেই, সে-কথা বুদ্ধিজীবীরা তাে বটেই, জনগণের জন্যে রাজনীতি করেন বলে যারা বাগাড়ম্বর করেন তারাও বােঝেন না। সমাজ পরিবর্তনের লক্ষ্যে সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকারে যারা কুণ্ঠিত হন না কখনাে, সেই কম্যুনিস্ট নেতারাও যে ব্যাপক সংখ্যক জনগণের অন্তরে প্রবেশ করতে পারেননি তার হাজারাে কারণের মধ্যে একটি বড় কারণ বােধহয় জনগণের ভাষা থেকে তাদের দূরে সরে যাওয়া। তাদের মগজের কোষগুলাে ভরপুর হয়ে থাকে ক্যুনিস্ট পরিভাষায়, জনগণের সঙ্গে আলাপে সেই পরিভাষাগুলাের তারা অজীর্ণ উদগার ঘটান, পরিভাষাকে জনগণের ভাষায় প্রাঞ্জল অনুবাদ করতে পারেন না। জনগণের ভাষায় জনগণের সঙ্গে কথা বলতে একান্ত পারঙ্গম, এরকম অন্তত দু’জন বক্তার বক্তৃতা আমি শুনেছি। এদের একজন প্রয়াত কৃষকনেতা আবদুল ওয়াহেদ বােকাইনগরী, অন্যজন শ্রমিক নেতা জসিম মণ্ডল। এদের কাছ থেকে যদি আমাদের সকল প্রগতিশীল নেতা ও বুদ্ধিজীবী গণভাষার ও গণমনস্তত্ত্বের তালিম নিতেন, তবে তারা অনায়াসে জনগণের অন্তরে প্রবেশ করতে পারতেন, ধর্মব্যবসায়ী প্রতিক্রিয়াশীল ডেমাগগদের বাকচাতুরি জনতাকে বিভ্রান্ত করতে পারতাে না।
৩৬১
সেদিন দিঘারকান্দায় একটি সফল জনসভা করতে পেরে আমরা, বুদ্ধিজীবী সংগ্রাম শিবিরের সদস্যরা, খুশিতে টইটম্বুর হয়ে ঘরে ফিরছিলাম। বুদ্ধিজীবী হয়েও শ্রমজীবীদের সঙ্গে যে আমরা একাত্ম হতে পেরেছি, সে-কথা ভেবে বেশ আত্মপ্রসাদ অনুভব করছিলাম। খুব সহজেই যে আমরা স্বাধীনতা পেয়ে যাবাে, এমন সরল বিশ্বাসও আমাদের মনে জন্মে গিয়েছিলাে। কিন্তু কয়েক ঘণ্টা পরেই যে আমাদের খুশি দূর হয়ে যাবে, আত্মপ্রসাদ ছিন্নভিন্ন হয়ে যাবে, সরল বিশ্বাসে প্রচণ্ড ঘা লাগবে, পঁচিশে মার্চের রাত দশটায়ও আমরা তেমন ভাবতে পারিনি।
খুব ভােরে দরােজায় প্রচণ্ড ধাক্কার শব্দে জেগে উঠলাম। দরােজা খুলে দেখি : পাশের বাসার নজরুল ইসলাম খােকনের বােন রুবী। সে বললাে, এই মাত্র তাদের বাসায় খােকনের বন্ধুরা এসে খবর দিয়ে গেছে যে, ইয়াহিয়া-মুজিব আলােচনা ভেঙে গেছে, ঢাকায় মিলিটারিরা সমানে বাঙালিদের মেরে চলছে, ময়মনসিংহের দিকেও তারা এগিয়ে আসছে। খােকন তার বন্ধুদের নিয়ে শহরে বেরিয়ে গেছে, বলে গেছে আমিও যেন তাড়াতাড়ি চলে যাই।
দ্রুত প্রাতঃকৃত্য সেরে নিয়ে বেরিয়ে দেখি সারা শহরের মানুষ যেন ঘর ছেড়ে রাজপথে বেরিয়ে এসেছে। আপাতত তাদের লক্ষ শহরের খাগডহর এলাকায় অবস্থিত ইপিআর (ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস) ক্যাম্প। সেই ক্যাম্পে পাঞ্জাবি সেনাদের বাঙালিরা ঘিরে রেখেছে, পাঞ্জাবিরাও বন্দুক তাক করে আছে বাঙালিদের দিকে। অর্থাৎ পাঞ্জাবি-বাঙালি মুখােমুখি যুদ্ধ। এ যুদ্ধে সব বাঙালিই সৈনিক। সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের প্রথম দিনেই ময়মনসিংহবাসীও তার সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়লাে।
ইপিআরের পাঞ্জাবি কিংবা অন্য কোনাে পাকিস্তানি সেনা যাতে শহরে ঢুকতে না পারে তার জন্যে রাস্তার এখানে-ওখানে এরই মধ্যে অনেক ব্যারিকেড তৈরি হয়ে গেছে। গাছের ডাল, ভাঙা ল্যাম্পপােস্ট, কেরােসিনের ড্রাম, টেবিল-চেয়ার-বেঞ্চি—যে যা হাতের কাছে পাচ্ছে। তাই দিয়ে ব্যারিকেড বানাচ্ছে। থানার পুলিশরাও জনগণের সহযােগী। রাজারবাগ ব্যারাকের পুলিশরা যে বীরত্বের সঙ্গে পাক মিলিটারির হামলা প্রতিরােধ করতে গিয়ে আত্মাহুতি দিয়েছে, সে খবর ময়মনসিংহ শহরেও পৌঁছে গেছে। দু’দিন আগেও যে পুলিশরা আন্দোলনকারী জনতার দিকে বন্দুক তাক করে ধরেছে, আর জনতাও একান্ত ঘৃণায় যে পুলিশের ওপর ইটপাটকেল ছুঁড়ে মেরেছে, সেই বাঙালি পুলিশ আর জনতা আজ এক হয়ে গেছে। সকলেই ছুটছে খাগডহর ইপিআর ক্যাম্পের দিকে।
ছাব্বিশে মার্চ সারাদিন ধরে যুদ্ধ চলে। একপক্ষে ইপিআর-এর কতিপয় বাঙালি সৈনিক এবং তাদের সহযােগিতায় বিপুল জনতা; আর অন্যপক্ষে ইপিআর ক্যাম্পের ষাট-সত্তরজন অবাঙালি সেনা, ওদের কোনাে সাহায্যকারী নেই, ক্যাম্পের বাইরে বেরিয়ে আসারও কোনাে উপায় নেই। সারাদিনের যুদ্ধে ওরা সব মারা পড়লাে।
ছাত্রকর্মিরা ট্রাকে করে সারাদিন ধরে মাইকে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘােষণার বার্তাটি প্রচার করে চললাে। পঁচিশে মার্চের রাতে গ্রেফতার হওয়ার আগে বঙ্গবন্ধু যে বার্তাটি ইপিআর-এর ওয়ারলেসযােগে চট্টগ্রামে পাঠিয়েছিলেন সেটি ছাব্বিশ তারিখেই ময়মনসিংহেও পৌছে গিয়েছিলাে। সেদিন ছাত্রলীগের কর্মিদের পাশে সেই বার্তা প্রচার করতে দেখলাম এনএসএফ কর্মিদেরও। ময়মনসিংহের ছাত্র ইউনিয়ন কর্মিরা ছাব্বিশ তারিখেই ডামি রাইফেল কাঁধে নিয়ে সারা শহরে মার্চপাস্ট করে। তাদের প্রাথমিক সামরিক প্রশিক্ষণ দেয় ইউওটিসি’র ক্যাডেট শাহ
৩৬২
মুজতবা ও ইসমাইল তরফদার। ওরা পয়লা মার্চ তারিখেই—জাতীয় পরিষদের অধিবেশন বাতিল সংক্রান্ত ইয়াহিয়ার ঘােষণার পরপরই—প্রতিবাদী মিছিল নিয়ে শহর প্রদক্ষিণ করেছিলাে, জনতার স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণে সেটি অতি দ্রুত একটি জঙ্গি মিছিলে পরিণত হয়ে গিয়েছিলাে। ছাব্বিশে মার্চেই ছাত্র ইউনিয়নের নেতাকর্মিরা গােপন কমুনিস্ট পার্টি ও মােজাফফর ন্যাপের কর্মিদের সঙ্গে মিলে মহাকালী পাঠশালায় একটি কন্ট্রোল রুম স্থাপন করে। সাতাশে মার্চে এরা মিছিল নিয়ে ময়মনসিংহ জেলখানায় যায় ও কমরেড অজয় রায়কে মুক্ত করে নিয়ে আসে। এ ব্যাপারে নেতৃত্বের ভূমিকাটি ছিলাে ন্যাপ নেতা কফিলউদ্দিন লালমিয়ার। মিছিলে ছিলেন কমরেড মন্মথ দে, আজিজুল ইসলাম খান, আলােকময় নাহা, আবদুল কুদুস, মকবুল হােসেন, নজরুল ইসলাম খােকন এবং প্রদীপ চক্রবর্তীর মতাে ক্যুনিস্ট, ন্যাপ ও ছাত্র ইউনিয়নের নেতৃবৃন্দ। অজয়দাকে মুক্ত করে আনার ব্যাপারে সক্রিয় সহযােগিতা করেছিলেন আওয়ামী লীগ নেতা রফিক উদ্দিন ভূঁইয়া ও সৈয়দ আহমদ।
সাতাশ তারিখেই সন্ধ্যায় চট্টগ্রাম বেতার থেকে মেজর জিয়ার কণ্ঠে স্বাধীনতার কথা শুনলাম। আহা, কী যে ভালাে লাগলাে। যারা নিজের কানে জিয়ার কথাগুলাে শােনেনি তাদের কাছেও প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই অন্যের মুখ থেকে সে কথাগুলাে পৌছে গেলাে। সকলের উৎসাহের পালে লাগলাে নতুন হাওয়া। নিরস্ত্র বাঙালির মুক্তিযুদ্ধে সেদিন একজন সশস্ত্র সেনাপতির যােগদানের ঘটনাটির গুরুত্বই ছিলাে অপরিসীম। আর তার কণ্ঠের ধ্বনি তাে সেদিন বাঙালির কানে ধ্বনিত হয়েছিলাে মৃতসঞ্জীবনী মন্ত্রের মতাে।
জিয়ার ওই বেতার ভাষণটি নিয়ে পরে অনেক ধূম্রজাল ছড়ানাে হয়েছে। তাকে ‘স্বাধীনতার ঘােষক’ বলে প্রতিষ্ঠা করার প্রাণপণ প্রয়াস চালানাে হয়েছে। অথচ এ-রকম করার কোনাে প্রয়ােজন ছিলাে না। তার আপন কৃতিই তাকে ইতিহাসে যথাযােগ্য আসনে প্রতিষ্ঠিত রাখার জন্যে যথেষ্ট ছিলাে। বেতারের ক্ষীণ তরঙ্গে ভেসে আসা কণ্ঠধ্বনি বাঙালির অন্তরে মুক্তি সৈনিক জিয়ার জন্যে প্রীতি ও কৃতজ্ঞতার আসন বিছিয়ে দিয়েছিলাে মুক্তিসগ্রামের শুরুতেই। কিন্তু জিয়ার অতিভক্তের দল চাইলাে তাকে এমন একটি আসনে বসাতে যেটি তার কোনােমতেই প্রাপ্য নয়। বঙ্গবন্ধুকে স্থানচ্যুত করে জিয়াকে প্রতিষ্ঠিত করার স্পর্ধাও তারা দেখালাে। আর এ-রকমটি করে তারা জিয়াউর রহমানের আসল ভূমিকাটিকেও আড়াল করে দিলাে, তার প্রাপ্য আসনটি থেকেও তাকে টেনে নামালাে, তার তর্কাতীত মর্যাদাকে বিতর্কিত করে ফেললাে।

প্রত্যাশার ফুল ও সংশয়ের কাঁটা
কমরেড অজয় রায় জেল থেকে বেরিয়ে এসেই আমাদের সঙ্গে আলােচনায় বসলেন। গত এক/দেড় মাস ধরে প্রচণ্ড উত্তেজনার আগুনে আমরা নিজেদের তাতিয়ে নিয়েছি, কেবলই ভেবেছি স্বাধীনতা আমাদের হাতের মুঠোয় প্রায় এসেই গেছে, এ ব্যাপারে কোনাে সন্দেহ। সংশয়কেই আমরা বিন্দুমাত্রও প্রশ্রয় দিতে রাজি হইনি। মার্চের শুরু থেকেই আমরা মুক্তির মাতাল তরণীতে সওয়ার। পাকিস্তান রাষ্ট্রের সকল প্রতীককেই আমরা একে একে প্রত্যাখ্যান করে চলেছি। পাকিস্তানের ‘চাঁদ-তারা সাদা আর সবুজ নিশান’ নামিয়ে ফেলে সগর্বে উড়িয়ে দিয়েছি রক্ত সূর্য লাঞ্ছিত পতাকা, যে পতাকার বুকে আঁকা ‘আমার সােনার বাংলার মানচিত্র।
৩৬৩
বিজাতীয় ভাষায় শব্দাবলিতে গাঁথা ‘পাকসার জামিন সাদবাদ’ আর আমার জাতীয় সংগীত নয়, তাকে স্থানচ্যুত করেছে আমরি বাংলা ভাষায় রচা ‘আমার সােনার বাংলা, আমি তােমায় ভালােবাসি…’। পাকিস্তানি রাষ্ট্রযন্ত্রটির সঙ্গে সর্বাত্মক অসহযােগ, বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ, পাকিস্তানি কর্তৃপক্ষের বদলে বাঙালি জনগণের নির্বাচিত নেতা বঙ্গবন্ধুর নির্দেশের প্রতি সরকারি-বেসরকারি সকল মহলের আনুগত্য—এইসব কিছুই আমাদের পুরনাে থেকে নতুন অবস্থানে নিয়ে এসেছে, সে-অবস্থান থেকে কেউ যে আর আমাদের সরিয়ে নিতে পারবে না সে-বিষয়ে আমরা নিঃসংশয়। এমনকি নিরস্ত্র বাঙালি জনগণের ওপর ২৫ মার্চের রাতে পাকিস্তানি মিলিটারিদের অতর্কিত হামলায় আমাদের সরল বিশ্বাসে প্রচণ্ড ঘা লাগলেও মুহুর্ত পরেই সে বিশ্বাস ফিরিয়ে আনতে পেরেছিলাম, গভীরতর আত্মপ্রসাদ ও প্রচণ্ডতর আত্মপ্রত্যয়ে উদ্বুদ্ধ হয়ে উঠেছিলাম। কসাই টিক্কাখানের রেডিওতে প্রচারিত হুংকারভরা ভাষণকে সঙ্গে সঙ্গেই আমরা প্রত্যাখ্যান করেছিলাম। ভাষণটি শেষ হওয়ার দশ মিনিটের মধ্যেই শহরের সবক’টি রাস্তায় নেমে এসেছিল অনেকগুলাে মিছিল। সবগুলাে মিছিলের একই স্লোগান‘টিক্কাখানের ঘােষণা, মানি না মানি না। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব পাকিস্তানি মিলিটারির হাতে ২৫ মার্চ রাতেই গ্রেফতার হয়েছেন—এ-খবর আমরা এক ফোঁটাও বিশ্বাস করিনি। আমরা বিশ্বাস করেছি, কিংবা বিশ্বাস করতে চেষ্টা করেছি, বঙ্গবন্ধু আমাদের মধ্যেই আছেন এবং অলক্ষে নেতৃত্ব দিয়ে যাচ্ছেন। ঢাকায় পাক সৈন্যদের নৃশংস অত্যাচারের খবরে আমরা ক্ষুব্ধ ও ক্রুদ্ধ হয়েছি, কিন্তু কোনাে কিছুই আমাদের অবিচলিত প্রত্যয়কে বিচলিত কিংবা সংশয়ান্বিত করতে পারেনি। বরং পঁচিশে মার্চের রাতের আক্রমণের পর যখন অন্যতম বাঙালি সেনাপতি মেজর শফিউল্লাহ দ্বিতীয় বেঙ্গল রেজিমেন্ট নিয়ে বিদ্রোহ ঘােষণা করে ময়মনসিংহে চলে আসেন, তখন আমাদের প্রত্যয়দীপ্ত আনন্দে আরেকটি নতুন মাত্রা যুক্ত হলাে। মুক্ত ময়মনসিংহে আমরা একজন অধিনায়ক পেয়ে গেলাম। সর্বাত্মক গণ অসহযােগের ধাক্কায় জেলা প্রশাসন প্রায় এক মাস ধরেই অকেজো হয়েছিলাে। মেজর শফিউল্লাহ ময়মনসিংহে এলে জনগণের একান্ত স্বতঃস্ফূর্ত সমর্থনেই যেন তিনি প্রশাসক হয়ে গেলেন, কোনাে রাষ্ট্রীয় ফরমানেরই প্রয়ােজন পড়লাে না। মার্চের ২৭ কি ২৮ তারিখের সকালে একদল বিদ্রোহী সৈন্য যখন শহরের প্রধান সড়কটি দিয়ে দৃপ্তপায়ে হেঁটে যাচ্ছিলেন, তখন সেই মিছিলে আমরা আমাদের স্বাধীনতার লাল সূর্যটিকেই দেখতে পেয়েছিলাম। সৈন্যদের মিছিলটি যখন সিটি স্কুলের সামনে তখন হঠাৎ শােনা গেলাে একটা গুলির শব্দ। বেশ কিছু দূরে থেকেই শব্দটা শুনেছিলাম। অনেকের সঙ্গে আমিও দৌড়ে সেখানে ছুটে যাই। গিয়ে দেখি রাস্তার ওপর পড়ে আছে একটা মানুষের নিথর নিষ্প্রাণ দেহ। ওই মানুষটাকে আমি চিনতাম। ওর নাম তুলসী রাজভড়, পুরুষানুক্রমে এ দেশে বসবাসকারী ‘পশ্চিমা বা হিন্দিভাষী হিন্দুদের একজন। তুলসীর কোনাে পূর্বপুরুষ উত্তর প্রদেশ না বিহার থেকে এদেশে এসেছিলাে তার সঠিক খবর সেও হয়তাে জানতাে না। রাজনীতিটাজনীতি নিয়ে কখনাে মাথা ঘামাতাে না। গতর খাটিয়ে পরিবার পরিজন নিয়ে জীবন চালাতাে। এদেশের মানুষের সঙ্গে সম্পর্কটা ছিলাে সম্প্রীতির। তবু ‘পশ্চিমা’ পরিচয়ে তুলসিদের সঙ্গে বাঙালিদের একটা স্বাতন্ত্র্য রয়েই গিয়েছিলাে। বাড়িতে ওরা হিন্দিতে কথা বলতাে, বাইরে বাংলায়। তবে সে-বাংলায় পশ্চিমা টান ও হিন্দি শব্দের মিশেলে তাদের পশ্চিমা বলে সহজেই চেনা যেতাে। ওই পশ্চিমা ভাষাতেই নাকি তুলসী রাস্তার ধারে দাঁড়িয়ে কথা বলছিলাে। আর তা শুনেই বাঙালি সৈন্যদের মাথায় আগুন ধরে গিয়েছিলাে। বিভাষী শত্রুদের
৩৬৪
কেউ বলে চিহ্নিত করে এদের একজন হঠাৎ তুলসীর ওপর গুলি ছুঁড়ে দেয়, আর সঙ্গে সঙ্গেই তুলসী মাটিতে লুটিয়ে পড়ে লাশ হয়ে যায়।
নিরীহ গােবেচারা তুলসীর মৃত্যু সবাইকে শােকাহত করেছিলাে, অনেকের চোখেই জল দেখেছিলাম। কিন্তু, কি আশ্চর্য, তুলসীর হত্যাকারীর প্রতি কাউকে ক্ষোভ প্রকাশ করতে দেখিনি সে সময়ে। বরং নিহতের জন্যে শোকের সমপরিমাণেই—কিংবা কিছুটা বেশি পরিমাণে ছিলাে হত্যাকারির প্রতি সহমর্মিতা। আহা ওই সৈনিক বেচারারা বিদ্রোহ করে স্বদেশের স্বাধীনতার জন্যে অনিশ্চিতের পথে নেমে এসেছে, কেউ বলতে পারে না এই বিদ্রোহের শেষ পরিণাম কি হবে! যদি বাংলাদেশ স্বাধীন না হয়ে পাকিস্তানই টিকে যায় তবে ওদের মৃত্যুদণ্ডততা অনিবার্য। এরকম অনিশ্চিত জীবন যারা বেছে নিয়েছে তাদের মনমেজাজ তাে গরমই থাকবে। তাই হঠাৎ যদি একটা অবাঙালিকে দেখে ওদের পায়ের রক্ত মাথায় উঠে যায়, আর রাগের বশে গুলিই করে বসে, তবে ওদের দোষ কি? অবশ্যি তুলসীরও কোনাে দোষ ছিলাে না। ভাগ্যদোষেই বেচারা মারা পড়লাে। কি যে দুর্মতি হয়েছিলাে ওর। তা না হলে সেসময়ে বাঙালি মুক্তিসেনাদের সামনেই-বা পশ্চিমা ভাষায় কথা বলতে যাবে কেন সে?
এভাবেই সেদিন তুলসী হত্যার প্রত্যক্ষদর্শী বা পরােক্ষদর্শী মানুষদের সহানুভূতির পাল্লা হত ও ঘাতকের জন্যে প্রায় সমান ভারি হয়ে গিয়েছিলাে। একই রকম দরদ ও মমতায় তারা হত পশ্চিমা’ তুলসী রাজভড়ের শেষকৃত্যের ব্যবস্থা করেছিলাে, এবং ঘাতক বাঙালি সৈন্যদের জন্যে আতিথ্যের আয়ােজন করেছিলাে।
আমরা সেদিন সীমাহীন বিশ্বাস ও প্রত্যাশা অর্পণ করেছিলাম বিদ্রোহী বাঙালি সৈনিক, ইপিআর, পুলিশ ও আনসারদের ওপর। সেই বিশ্বাস ও প্রত্যাশার জোরেই শক্তিশালী শত্রুর বেষ্টনির মধ্যে থেকেও মেরুদণ্ড খাড়া করে দাঁড়িয়ে ছিলাম। ওই সশস্ত্র ও অস্ত্রচালনায় প্রশিক্ষিত বিদ্রোহী দেশপ্রেমিকদের সক্রিয় সহায়তার জোরেই আমাদের তরুণরাও শিক্ষিত অস্ত্রধারী হয়ে উঠবে, এবং তারা সবাই মিলে অচিরেই দেশকে শত্রুমুক্ত করে ফেলবে—এ-রকম আস্থা আমাদের মর্মে মর্মে সঞ্চারিত হয়ে গিয়েছিলাে। দুশমনদের আমরা পানিতে মারবাে’, ভাতে । মারবাে, যার যা আছে তাই নিয়ে শত্রুর মােকাবেলা করবাে’, ‘দেশকে মুক্ত করে ছাড়বাে ইন্শাআল্লাহ’—বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণের এরকম টুকরাে টুকরাে বাক্য আমাদের আশাবাদকে সতেজ করে রেখেছিলাে।
কিন্তু জেল থেকে আসা কমরেড অজয় রায়ের কথাগুলাে এ-রকম সরল আশাবাদের বেলুনটাকে অনেক পরিমাণেই চুপসে দিলাে। অজয় দার সঙ্গে কথা বলছিলাম, আমি, আলােকময় নাহা, সৈয়দ আমীরুল ইসলাম এবং এ রকম আরাে কয়েকজন।
অজয়দা বলছিলেন ব্যাপারটা অতাে সহজ নয়। কোনাে দেশই মুক্তিযুদ্ধে খুব সহজে বা অনায়াসে জয়লাভ করতে পারে না। এর জন্যে অনেক মূল্য দিতে হয়। মুক্তিযুদ্ধ হয় অনেক দীর্ঘস্থায়ী। ভিয়েনামের দিকেই তাকিয়ে দেখাে না। কতাে বছর ধরে ওদেশের মানুষ যুদ্ধ করছে, কতাে ত্যাগ স্বীকার করছে। ওদের তুলনায় আমাদের প্রস্তুতি কতােটুকু? শেখ মুজিব যে গ্রেফতার হয়েছেন এতে তাে কোনেই সন্দেহ নেই। এখন মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দেবে কে? আওয়ামী লীগের তেমন সাংগঠনিক প্রস্তুতি আছে? আর আমাদের দেশের যে ভৌগলিক অবস্থান তাতে ভারতের সাহায্য আমাদের মুক্তিযুদ্ধের জন্য অপরিহার্য। ভারতের সঙ্গে এবিষয়ে শেখ মুজিব বা আওয়ামী লীগের কতােখানি সমঝােতা হয়েছে তা আমাদের কাছে স্পষ্ট
৩৬৫
নয় ।… এদিকে মুজিবের সঙ্গে আলােচনার নাম করে ইয়াহিয়া-ভুট্টোরা সব কিছু বেশ ভালােভাবেই গুছিয়ে নিয়েছে। গুছিয়ে নিয়েই আক্রমণটা করেছে। ওদের মােকাবেলা করা আমাদের জন্যে খুবই কঠিন। প্রচুর নিরস্ত্র মানুষ মারা পড়বে, প্রচুর…।’
অজয়দার কথাগুলাে শুনতে শুনতে আমি আতঙ্কিত হয়ে উঠছিলাম। চিৎকার করে বলে ফেরেছিলাম, তা হলে আমাদের কী হবে? আমাদের মুক্তিযুদ্ধ…’।
অজয়দা হেসে বললেন, না, আমি কোনাে ভয় বা হতাশার কথা বলছি না। কম্যুনিস্টরা বিপদের সামনে ভয় হতাশা ছড়ায় না। ক্যুনিস্টদের দর্শন মার্কসবাদ তাে আশাবাদেরই দর্শন।
‘মার্কসবাদ একটি আশাবাদী দর্শন’–একথাটা অজয়দার মুখে সেই ৫৭ সাল থেকে বহুবারই শুনেছি। শুনে শুনে মনের ভেতর অপরিমেয় শক্তি পেয়েছি। এবারাে সেই শক্তির ছোঁয়া পেলাম।
অজয় দা বললেন—জনগণের শক্তিতেই কম্যুনিস্টরা সব সময় বিশ্বাস রাখে। সেই জনগণকে নিয়েই আমাদের সব বিপদের মােকাবেলা করতে হবে ।…রেলপথের বা অন্য সড়কের ব্রিজগুলাে ভেঙে দেয়া হয়েছে বলে, কিংবা রাস্তায় ব্যারিকেড তৈরি করা হয়েছে বলে, পাক মিলিটারিরা যে ঢাকা থেকে ময়মনসিংহে এসে পৌছতে পারবে না, এমনটি মনে করাে না।…আজ হােক কাল হােক, শহর তােমাদের ছাড়তেই হবে। গ্রামগঞ্জের জনগণকে নিয়েই মুক্তিযুদ্ধ সংগঠিত করতে হবে।…এখানে তােমাদের সমমতের যারা আছে তাদের সবাইকে খবর দাও। ইউনিভার্সিটিতে অধ্যাপক শামসুজ্জামান খান আর মােস্তফা হামিদ হােসেনের কথা তাে জানি। আর কে আছে?…ছাত্রদের সঙ্গে তাে কথা হচ্ছেই।…মহাদেব সান্যাল কোথায়? শিল্পী শাহতাব? সেকান্দার হায়াৎ…
এ-রকম আরাে অনেকেরই খোঁজ-খবর নিলেন অজয় দা। সবার সঙ্গেই যােগাযােগ করতে চেষ্টা করলাম।
কৃষিবিশ্ববিদ্যালয়ে গেলাম। সেখানে এক বন্ধুর মুখে একজন বিশিষ্ট আওয়ামী লীগ নেতার কথা শুনে তাে আমার আক্কেল গুড়ুম। ২৫ মার্চের পরই ওই নেতা শহর ছেড়ে সস্ত্রীক বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে চলে গিয়েছিলেন। এ কয়দিনে আমার বন্ধুটির সঙ্গে তার কয়েকবারই দেখা ও কথা হয়েছে। ওই নেতা খুবই বিমর্ষ হয়ে পড়েছেন। পাকিস্তানের অন্ধকার ভবিষ্যতের কথা ভেবেই তার ওই বিমর্ষতা। তার কথা হলাে : পশ্চিম পাকিস্তান আমাদের ওপর খুবই অবিচার করেছে সন্দেহ নেই। সে জন্যে ওদের কাছ থেকে আমাদের প্রাপ্য বুঝে নেয়ার জন্যে আমরা সংগতভাবেই এতােদিন ধরে আন্দোলন করে আসছি। কিন্তু আন্দোলনটা এখন যেদিকে মােড় নিচ্ছে, সে-রকমটি মােটেই বাঞ্ছিত ছিলাে না।…পশ্চিম পাকিস্তান থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পূর্ব পাকিস্তান স্বাধীন হতে পারে, তাতে আপত্তি নেই। কিন্তু সেই স্বাধীনতা কেমন করে পাবাে আমরা? আমাদের নিজের শক্তিতে তাে তা হচ্ছে না। এখন তাে বােঝা যাচ্ছে যে, ভারতের কাছেই সাহায্য চাইতে হবে। এটি কেমন করে হয়? ‘হিন্দু ভারত’ হলাে আমাদের ইটার্নাল এনিমি’। ওদের হাত থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্যেই তাে আমরা পাকিস্তান এনেছিলাম। আজ সেই এনিমির সাহায্য নিয়ে আমাদের স্বাধীন হতে হবে? এটা কোন ধরনের স্বাধীনতা হবে?
ওই নেতাটি অবশ্যি কিছু দিন পরই ভারতে চলে গিয়েছিলেন, এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষেই কাজ করেছিলেন। তবু, আমার বন্ধুর কাছ থেকে সে-নেতার বিশেষ ধরনের
৩৬৬
মনােভাবের কথা শুনে সেদিন খুব একটা ধাক্কা খেয়েছিলাম। পরে দেখেছি, এ-রকম মনােভাব সম্পন্ন নেতা আরাে অনেকেই ছিলেন। এদের কেউ ঘটনাচক্রে মুক্তিযােদ্ধা হয়েছেন, কেউ রাজাকার হয়েছেন। সে কারণেই, স্বাধীনতার পরে, এ-রকম আনুষ্ঠানিক মুক্তিযােদ্ধাদের অনেকের রাজাকারদের পক্ষে যােগদানের ফলে রাজাকারের সংখ্যা ও শক্তি অনেক বেড়ে গেছে। স্বাধীন বাংলাদেশেও পাকিস্তানের ভূত আমাদের ঘাড়ে চেপে বসতে পেরেছে।
ভারতের বা অন্য কোনাে দেশের সাহায্য ছাড়াই যদি আমরা জয়লাভ করতে পারতাম, তবে মুক্তিযােদ্ধা হিসেবে আমাদের কৃতিত্ব অবশ্যই অনেক বেশি হতাে। তবে যে কোনাে কারণেই হােক, ভারতের সাহায্য আমাদের নিতে হয়েছে। এতে কি আমাদের মর্যাদা হানি হয়েছে? আমাদের মুক্তিযােদ্ধাদের বীরত্বের বা স্বদেশ প্রেমের কি কোনাে ঘাটতি ছিলাে? আমরা কি কারাে করুণার দান হিসেবে স্বাধীনতা পেয়েছি? আমরা কি স্বাধীনতার জন্যে অপরিমেয় মূল্য দিই নি?
স্বাধীনতা আন্দোলনে ও সংগ্রামে যারা যােগ দিয়েছিলেন তাঁদেরও অনেকের মস্তিষ্ককোষ যে পাকিস্তানি সাম্প্রদায়িক ভাবধারায় আচ্ছন্ন ছিলাে, এ এক মর্মান্তিক সত্য। সেই সাম্প্রদায়িকতা স্বাধীনতা সংগ্রামের উত্তাল দিনগুলােতে কোণঠাসা ও মিয়মাণ হয়ে ছিলাে, বিনষ্ট বা বিলীন হয়ে যায়নি। একাত্তরের মার্চে বুদ্ধিজীবী সংগ্রাম শিবির’-এর সভাগুলােতে আমি দ্বিজাতিতত্ত্বকে তীব্রভাবে আক্রমণ করতাম। বলতাম—বাঙালি জাতির স্বাধিকার আন্দোলনের মধ্যদিয়ে দ্বিজাতিতত্ত্বের কবর রচিত হয়ে গেছে। আলােকময় নাহাও এ-রকমই বলতাে, এবং মহাউৎসাহে রবীন্দ্রনাথের বাংলার মাটি বাংলার জল’-এর মতাে স্বদেশি গানগুলাে গাইতাে। এতে যে আমরা ‘লিবার্যাল’ বলে পরিচিত অনেক মানুষেরও ক্রোধের শিকার হয়েছিলাম, সেবিষয়ে আমাকে সচেতন করে দিয়েছিলেন বন্ধু সৈয়দ আমীরুল ইসলাম। বেশ কয়েকজন ‘গণ্যমান্য লােকই তার কাছে গিয়ে আমাদের বিরুদ্ধে বিষােদগার করেছেন। বলেছেন, বাংলাদেশ স্বাধীন হবে, এ তাে বেশ ভালাে কথা। কিন্তু এ নিয়ে আলােকময় নাহা আর যতীন সরকারের এতাে লাফালাফি কেন?
৩১ মার্চ শ্রী মনােরঞ্জন ধরের সঙ্গে দেখা করতে গেলাম। তাকে খুবই উদ্বিগ্ন মনে হলাে। অস্থিরভাবে তিনি পায়চারি করছিলেন। আমাকে দেখেই বললেন, তােমার কাছে এখনই আমি লােক পাঠাতে চেয়েছিলাম। শুনেছাে তাে, কুমিল্লায় ধীরেন দা’কে (ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত) পাক সেনারা ধরে নিয়ে গেছে।…সারা দেশেই এমনটি হবে। তােমারও এখন তাড়াতাড়ি শহর ছেড়ে দেয়া উচিত। আমি আজই চলে যাচ্ছি। আপাতত গৌরীপুরের কাছে ডেউয়াখলা গ্রামে গিয়ে উঠবাে। এরপর দেখা যাবে, কী করা যায়। খুব কঠিন সময় এসেছে আমাদের জন্যে।

মুক্তিযুদ্ধ ও কৃষকের মনােলােক
এপ্রিলের শুরুতেই স্পষ্ট হয়ে উঠলাে যে, শহর আমাদের ছাড়তেই হবে। যে কোনাে সময় ঢাকা থেকে পাকসেনারা ময়মনসিংহে চলে আসতে পারে।
কিন্তু যাবাে কোথায়? এবং কী ভাবেই বা যাবাে? গ্রামের বাড়িতে ঘরদোর প্রায় নেই বললেই চলে। সে সময়ে একটি ছােট্টো ঘরে কোনােমতে মাথা গুঁজে আছেন আমার বাবা আর ঠাকুরমা। তবে গ্রামে গিয়ে উঠতে পারলে থাকার কোনাে অসুবিধা যে হবে না তা জানি।
৩৬৭
প্রতিবেশীরাই পরম আদরে আমাদের রাখবে। কিন্তু এখন সেখানে সকলকে নিয়ে যাওয়াই খুব কঠিন। নেত্রকোনা শহর থেকে দশ মাইল দক্ষিণে আমাদের গ্রাম। কাঁচা সড়ক। বাহন বলতে একমাত্র রিকশা। লটবহর নিয়ে সেই রাস্তা পাড়ি দেয়া মােটেই সহজ নয়। তাছাড়া ময়মনসিংহ থেকে নেত্রকোনা পর্যন্ত যাওয়ারই তাে কোনাে সহজ বাহন নেই। রেল চলে না, বাস চলে না। পাকসেনার চলাচলকে দুঃসাধ্য করে তােলার জন্যে ব্রিজ ও কালভার্টগুলাে ভেঙে দেয়া হয়েছে, বড়াে বড়াে গাছ কেটে রাস্তায় ব্যারিকেড বানানাে হয়েছে। পাকসেনাদের জন্যে হয়তাে এ সব প্রতিবন্ধক অতিক্রম করা আপাত দুঃসাধ্য হয়েছে, কিন্তু আমাদের নিজেদের জন্যে হয়ে পড়েছে প্রায় অসাধ্য।
সাড়ে তিন বছর আগে বিবাহিত জীবনে প্রবেশ করেছি। আমার অন্তরঙ্গ বন্ধু শচীন আইচের ছােটো বােন কানন আইচ আমার সহধর্মিণী। পুত্র সুমনের বয়স সােয়া দু’ বছর। প্রায়ই সে নানা অসুখ-বিসুখে ভােগে। ওর জন্যেই সবচেয়ে বেশি দুশ্চিন্তা। আমি, আমার মা, ছােটো ভাই, ছােটো বােন, একটি দূরসম্পৰ্কীয় ভাগ্নি এবং আমার স্ত্রী ও পুত্র—এই সাতজন তখন আমরা ময়মনসিংহের ভাড়াটে বাসায় থাকি। শহর ছেড়ে এই বৃহৎ পরিবার নিয়ে কোথায় গিয়ে উঠবাে তাই যখন ভাবছিলাম, তখন শচীন জানালাে যে, তারা ফুলবাড়িয়ায় তাদের গ্রামের বাড়িতে চলে যাচ্ছে। যে-গ্রামে তাদের বাড়ি, ময়মনসিংহ শহর থেকে তার দূরত্ব মাইল। বিশেক মাত্র, সেখানকার যাতায়াত ব্যবস্থা সে-সময়েও একান্ত দুরূহ হয়ে ওঠেনি। তাই শচীন যখন তার বােন ও ভাগ্নেকে (অর্থাৎ আমার পত্নী ও পুত্রকে) সঙ্গে নিয়ে গেলাে, তখন সমস্যার আংশিক ও আপাত সমাধানে আমি কিছুটা হলেও স্বস্তি পেয়েছিলাম বৈকি। কিন্তু সেই স্বস্তি যে অচিরেই চূড়ান্ত অস্বস্তির রূপ নেবে তা তখন বুঝতে পারিনি।
দু’একদিন পর আমি পরিবারের আর সবাইকে নিয়ে কিছুদূর পর্যন্ত ট্রাকে, কিছুদূর রিকশায় এবং কিছুটা গােরুর গাড়িতে করে নেত্রকোনা শহর হয়ে বারহাট্টায় গিয়ে পৌছলাম। বারহাট্টায় আমি দু’বছর মাস্টারি করেছি, এ-এলাকায় অনেকেই আমার পরিচিত, আমার শুভানুধ্যায়ীর সংখ্যাও এখানে অনেক। তাছাড়া ছােটো ভাই মতীন্দ্র এই বারহাট্টা ইস্কুল থেকেই ম্যাট্রিক পাস করেছে। তারও বন্ধুবান্ধব এখানে কম নেই। তাই বারহাট্টাতেই আপাতত আশ্রয় নেয়া সমীচীন মনে করলাম।
বারহাট্টার পাশেই কলমাকান্দা থানা। কলমাকান্দার পরই সীমান্ত। এরপরই ভারতের মেঘালয় রাজ্য। কাজেই বারহাট্টায় থাকলেই সীমান্ত পাড়ি দেয়াটাও অনেক সহজ হবে। এবিবেচনাটাও মাথায় ছিলাে। তাই মা-বােন-ভাগ্নির সঙ্গে মতীন্দ্রকে বারহাট্টায় রেখে আমি গ্রামের বাড়িতে বাবা ও ঠাকুরমার সঙ্গে দেখা করতে গেলাম। কিন্তু বারহাট্টায় আর আমার ফিরে যাওয়া হলাে না। ফুলবাড়িয়ায় স্ত্রী-পুত্রের খবর নেয়াও অসম্ভব হয়ে উঠলাে। পাকসেনারা কিছুদিনের মধ্যেই ময়মনসিংহ-কিশােরগঞ্জ-নেত্রকোনা শহরগুলাে দখল করে নিলাে। পথঘাট আর আমাদের জন্যে নিরাপদ রইলাে না।
এপ্রিলের চার কি পাঁচ তারিখে গ্রামের বাড়িতে যাই। গ্রামের মানুষের চেতনার রূপান্তর দেখে চমৎকৃত হয়ে গেলাম। পাকিস্তানের পক্ষে কথা বলার মতাে একটি লােকও আমি সেদিন আমার গায়ে কিংবা আশপাশের গায়ে পাইনি। যাদের আমি এক সময় কট্টর মুসলিম লিগার বা পাকিস্তানপন্থী বলে জানতাম, তাদেরও অনেককে দেখলাম চূড়ান্ত পাকিস্তানবিরােধী হয়ে যেতে, তাদেরও মুখে জয়বাংলা’ ধ্বনি। তাই বলে সবারই যে চেতনার সত্যি সত্যি রূপান্তর
৩৬৮
ঘটে গিয়েছিলাে, তা নয়। গোঁড়া পাকিস্তানপন্থিদের কেউ কেউ পরিস্থিতির রূপান্তর দেখে তাদের বুলির রূপান্তর ঘটিয়েছিলাে মাত্র। এবং তারা যে সুযােগের অপেক্ষায় থেকেই তখনকার মতাে সংযত আচরণ করে যাচ্ছিলাে তা বােঝা গিয়েছিলাে মাসখানেক পরেই। নেত্রকোনা শহরটি যখন আর শত্রুমুক্ত রইলাে না, পাকসেনারা যখন সেখানে প্রশাসনিক কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠায় সক্ষম হলাে তখনই অন্য অন্য শহরের মতাে সেখানেও তারা পাকিস্তানপন্থিদের দিয়ে তথাকথিত শান্তি কমিটি গঠন করলাে। সেই শান্তি কমিটির সঙ্গে যােগাযােগ করেই আমাদের এলাকারও পাকিস্তানপন্থিদের কেউ কেউ রাজাকার রিকুটে মনােযােগ দিয়েছিলাে। তবে এ এলাকা থেকে যারা রাজাকার হয়েছিলাে তাদের সংখ্যা ছিলাে একেবারেই নগণ্য।
আমাদের রামপুর বাজারটি তখন আগের চেয়ে অনেক সমৃদ্ধ হয়ে উঠেছে। বাজারে অনেকগুলাে স্থায়ী দোকান, ক’বছর আগে দোকানের সংখ্যা এর দশ ভাগের এক ভাগও ছিলাে না। পাঁচ বছর আগেও রামপুর বাজারে কোনাে চায়ের দোকান দেখিনি। এখন দেখলাম রাস্তার ধারেই অন্তত দশটি দোকানে সারাক্ষণ কেটলিতে চায়ের জল ফুটছে। আর সবগুলাে দোকানেই, শহরের মতােই জমজমাট আড্ডা। সে আড্ডায় গাঁয়ের কিশাের-তরুণ-প্রৌঢ়-বৃদ্ধ সকলের সমাবেশ। আড্ডা চলে রাত দশটা-এগারােটা পর্যন্ত। তবে নিতান্ত অলস আড্ডা নয়। কথাবার্তা সব মুক্তিযুদ্ধকে কেন্দ্র করেই। মুক্তিযুদ্ধ শেষ হতে, অর্থাৎ পাঞ্জাবিদের এ দেশ থেকে তাড়াতে, আর কতােদিন লাগবে? ভারত কি আমাদের সাহায্য করবে না? বঙ্গবন্ধু এখন কোথায় আছেন?
এ-সব প্রশ্ন তারা করে বটে, কিন্তু মজার কথা হলাে, প্রশ্নগুলাের উত্তর তারা নিজেরাই ঠিক করে রেখেছে। সকলের কাছ থেকে তারা সেই উত্তরই শুনতে চায়। যদি কেউ একটু অন্যরকম কথা বলে, তাদের ঠিক-করে-রাখা উত্তরের সঙ্গে যা মেলে না তেমন কিছু যদি বলে কেউ, তবে আর তার রক্ষে নেই। পারে তাে তার ওপর সবাই ঝাপিয়ে পড়ে। তাদের প্রশ্নের উত্তরে বলতেই হবে : খুব তাড়াতাড়িই দেশ স্বাধীন হয়ে যাবে, পাঞ্জাবিরা আর বেশিদিন এদেশে টিকে থাকতে পারবে না, ভারত আমাদের অবশ্যই সাহায্য করবে, বঙ্গবন্ধু দেশের ভেতরে থেকেই গােপনে যুদ্ধ পরিচালনা করে যাচ্ছেন।
আসলে মুক্তিপাগল জনতা তখন তাদের প্রশ্নের উত্তরে নিরেট বাস্তবের সত্য জানতে চাইতাে না। যা ঘটেছে সেই সত্য নয়, যা ঘটা উচিত সেই সত্য জানতে চাইতাে। চাইতাে ভাবসত্যের শক্তিতে শক্তিমান হতে, আপন আকাক্ষার আগুনের ইন্ধন সংগ্রহ করতে।
শহর থেকে সাইকেলে বা রিকশায় যে কেউ এ পথ দিয়ে যেতেন তাকেই রামপুর বাজারে নামতে হতাে, ব্যাকুল জনতার প্রশ্নের উত্তর দিতে হতাে। এ রকমই একজন বলেছিলেন, বঙ্গবন্ধুকে পঁচিশে মার্চ রাতেই পাকসেনারা গ্রেফতার করে পশ্চিম পাকিস্তানে নিয়ে গেছে। আর যায় কোথায়! সবাই তাকে টিটকিরি দিতে লাগলাে, কিছু অশালীন ভাষাও প্রয়ােগ করলাে। তারপর সেই ভদ্রলােক তার কথা কোনােরকমে ঘুরিয়ে নিয়ে বাঁচলেন। বললেন : শেখ সাহেব যে গ্রেফতার হয়েছেন এ-কথা তিনিও বিশ্বাস করেন না। পাকিস্তান অবজারভার পত্রিকায় এ-রকম একটা খবর বেরিয়েছে বলে তিনি শুনেছেন, সেই শােনা কথাটিই তিনি বলেছিলেন মাত্র।
বাজারে বা গায়ের কোনাে বাড়িতে অনেক রাত পর্যন্ত অনেকে একত্রে বসে রেডিওর খবর শােনে। রেডিও পাকিস্তান’-এর খবর তারা শুনতে চায় না, শুনলেও বিশ্বাস করে না।
৩৬৯
আকাশবাণী-বিবিসি-ভয়েস অব আমেরিকার সংবাদ ও সংবাদভাষ্যের প্রতিই তাদের আগ্রহ। বিশেষ করে আকাশবাণী। আকাশবাণীতে দেবদুলাল বন্দ্যোপাধ্যায় কণ্ঠে ‘সংবাদসমীক্ষা তাদের আশা ও আশ্বাস জোগায়।
গাঁয়ের নিরক্ষর ও প্রায়-নিরক্ষর মানুষগুলাে যেন রাতারাতি রাজনীতি-সচেতন হয়ে উঠেছে। সম্প্রদায় ও জাতির সীমানা ছাড়িয়ে আন্তর্জাতিক বিষয়ও তাদের চেতনার চৌহদ্দিতে ঢুকে পড়েছে। কথায় কথায় তারা জাতিসংঘের নাম উচ্চারণ করে। জাতিসংঘের সেক্রেটারি জেনারেল উ-থান্ট (অনেকেরই উচ্চারণে উথান’) নামটি সকলের মুখে মুখে। তারা জেনে গেছে : বাঙালিদের ওপর পাকসেনাদের নির্যাতনে রাশিয়া দেশটি ভীষণ অসন্তুষ্ট। রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট পদগর্নি, তাই, আচ্ছা করে প্যাদানি দিয়েছে পাকিস্তানের ইয়াহিয়া খানকে। বাঙালির ওপর পাকিস্তানিরা অত্যাচার করেছে এতােদিন, এখন আর তা চলবে না। আমরা আর এখন একা নই। রাশিয়ার মতাে দেশ আমাদের পক্ষে। উথান’ আমাদের পক্ষে। আর সবার ওপরে আছে ভারত।
কয়েক বছর আগেও এই রামপুর বাজারের আড্ডায় আড্ডাধারিদের ভারতের (তাদের ভাষায় ‘হিন্দুস্থান’-এর) বিরুদ্ধে কতাে বিষােদগারই না করতে দেখেছি। হিন্দুর দেশ হিন্দুস্থান। তাে মুসলমানের রাষ্ট্র পাকিস্তানের দুশমন না হয়েই পারে না। সেই দুশমন দেশটিই কী করে যেন কোনাে জাদুমন্ত্রবলে বন্ধু ও সুহৃদ হয়ে গেলাে! আজ আর কেউ সে দেশকে ‘হিন্দুস্থান’ বলে না, বলে ভারত কিংবা ইন্ডিয়া। সবাই ভারতনেত্রী ইন্দিরা গান্ধী নামটি উচ্চারণ করে একান্ত আপনজনের মতাে। আকাশবাণীর কোলকাতা কেন্দ্র থেকে বাংলাদেশের সমর্থনে বাঙালি কবি-সাহিত্যিক-বুদ্ধিজীবীদের প্রচারিত বক্তব্যগুলাে শুনতে শুনতে কেমন যেনাে আবিষ্ট হয়ে যায়। শুধু আবিষ্ট নয়, আশায় আনন্দে উৎসাহে উজ্জীবিত হয়ে ওঠে। নিজের পাশে শক্তিমান ও দরদী বন্ধুর উপস্থিতি অনুভব করে।
রেডিও থেকেই গাঁয়ের মানুষ একটি নতুন শব্দও শিখে নেয়—স্বীকৃতি। এই স্বীকৃতি কথাটার মধ্যেও সম্ভাব্য একটা শক্তির উপাদান খুঁজে পায় তারা। ভারত যদি বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়, তবে আর কোনাে ভাবনাই থাকে না আমাদের, কেউ আমাদের ঠেকাতে পারবে না। ভারত কেন এখনাে স্বীকৃতি দিচ্ছে না? কবে দেবে? পরস্পরের কাছে প্রতিনিয়ত এ প্রশ্নের উত্তর সন্ধান করে সবাই।
আরাে প্রশ্ন করে : ভারত তাে আমাদের বন্ধু। তবে তারা এখনাে কেনাে দুশমন পাকিস্তানি সৈন্যদের হাত থেকে বাঁচানাের জন্যে তাদের সৈন্য দিয়ে আমাদের সাহায্য করছে না? এ প্রশ্নে গ্রামীণ সারল্যের একটা অদ্ভুত প্রকাশ দেখেছিলাম করিম ভাই ও তার কয়েকজন কৃষক সাথীর মধ্যে। রামনগর গ্রামের কৃষক করিম ভাইয়ের বয়স তখন পঞ্চাশের কোঠায়। ছেলেবেলা থেকেই আমি তার ও তার মতাে আরাে অনেক বয়ােজ্যেষ্ঠ কৃষকের স্নেহ পেয়ে এসেছি। বড়াে হয়ে শহর থেকে যখন বিভিন্ন সময় গ্রামের বাড়িতে গিয়েছি, তখন করিম ভাই খুবই কৌতূহলের সঙ্গে আমার কাছ থেকে দেশের রাজনীতির নানা খবর জানতে চাইতেন। এবার, স্বাধীনতা-সংগ্রামের পটভূমিতে তার কৌতূহল যে অনেক বেশি হবে তাই তাে স্বাভাবিক। কিন্তু, কী আশ্চর্য, এবার তিনি কোনাে কৌতূহল প্রকাশ করলেন না। দেখা হতেই সােজাসুজি আমাকে অভিযুক্ত করে বসলেন। বললেন, তুমি অহনাে এইখানে বইস্যা রইছাে কিয়ের লাইগ্যা? তুমি ইন্ডিয়ায় যাইয়া হেই দ্যাশের গবরমেন্টের কাছে আমরারে সৈন্য দিয়া সাহায্য করণের কথা কও না ক্যারে কেন?
৩৭০
আচমকা তার এ-রকম কথা শুনে আমি হেসে ফেললাম। আমাকে হাসতে দেখে তিনি রীতিমতাে রেগে গেলেন। ধমক দিয়ে বললেন, হাসত্যাছাে কিয়ের লাইগ্যা? এইডা কি একটা হাসির কথা অইলাে? তােমার মতাে শিক্ষিৎ মানুষরা যদি ভারতের গবরমেন্টের কাছে আমরার অবস্থা বুজাইয়া কয়, তাইলে কি তারা তােমরার কথা ফালাইয়া দিতে পারবাে? পাকিস্তানের মিলিটারিরা আমরার দেশের মাইনসেরে মাইর্যা শ্যাষ কইরা দিতাছে, তারারে এইডা জানাইলে তারাও তারার মিলিটারি পাডাইয়া দিয়া পাকিস্তানি মিলিটারিগুলারে খতম কইর্যা দিবাে, আমরাও বাইচ্যা যাইয়াম।…আর বইস্যা না থাইক্যা হেই দেশে যাইয়া আমরার বাচনের একটা ব্যবস্থা কইরা আইস্যো।
করিম ভাইয়ের সঙ্গে সেদিন আর কারা ছিলেন আজ মনে নেই। তবে তার সাথীদের সবাই যে করিম ভাইয়ের কথারই প্রতিধ্বনি করেছিলেন, সে কথা বেশ মনে আছে। কৃষকের বিশ্বাস কী সরল আর সবল!
শুধু বিশ্বাস নয়, কৃষক একেক সময় একেকটা প্রত্যয়কে আশ্রয় করে। সেই প্রত্যয়ই তার শক্তি। সেই প্রত্যয়ের বশেই যে কৃষক একদিন লড়কে লেঙ্গে’ বলে পাকিস্তান নামক একটি রাষ্ট্রের জন্ম দিয়েছিলাে, সেই কৃষকই আজ জয়বাংলা’ বলে সেই পাকিস্তানের মৃত্যু ঘটানাের জন্যে জীবন পণ করে বসেছে।
শুধু তাই নয়। কৃষকের প্রত্যয় থেকেই বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন ধরনের শক্তিশালী ‘মিথ’-এর সৃষ্টি হয়। পাকিস্তানের জন্মের সময় সৃষ্টি হয়েছিলাে একরকম মিথ, বাংলাদেশের জন্মমুহূর্তে অন্য আরেক রকম। একাত্তরের এপ্রিলের শুরুতেই গ্রামে গিয়ে কৃষকদের মুখে এ-রকম একটি নবসৃষ্ট মিথের পরিচয় পেলাম। মিথটি হানাদার পাকিস্তানিদের নিয়ােজিত জঙ্গি গভর্নর টিক্কা খানকে নিয়ে। শহরে থেকেই শুনেছিলাম যে, টিক্কা খান বাঙালি মুক্তিসেনানিদের হাতে নিহত হয়েছে। কিন্তু পরে এ-ও জেনেছিলাম যে, খবরটি সত্য নয়। কিন্তু গাঁয়ের কৃষক সে-খবরকে শুধু সত্য বলেই বিশ্বাস করেনি, তা থেকে একটি আখ্যানও তৈরি করে নিয়েছে। সে আখ্যানটি এরকম :
টিক্কা খান তাে মারা পড়ে, আর সঙ্গে সঙ্গে ইয়াহিয়া খান বাংলাদেশ ছেড়ে রাওয়ালপিন্ডিতে চলে যায়। তখন টিক্কা খানের ছেলে এসে ইয়াহিয়াকে জিজ্ঞেস করে, “তুমি যে ফিইর্যা আইলা, আমার বাজানেরে কই রাইখ্যা আইছাে?’ ইয়াহিয়া তার জবাব দিতে চায় না, নানা আবােল-তাবােল বলে টিক্কার ছেলেকে বুঝ দিতে চেষ্টা করে। এরপরও সে বুঝ না মানলে ইয়াহিয়ার মিলিটারি মেজাজ গরম হয়ে ওঠে। সে ওই ছেলেকে শূওর কা বাচ্চা’ বলে গাল দেয়। টিক্কার ছেলেও কম যায় না, কারণ সেও তাে মিলিটারিরই বাচ্চা। ইয়াহিয়ার গালি শুনে সঙ্গে সঙ্গে ওই মাতাল বদমাইশটাকে সে গুলি করে বসে। সেই গুলিতে অবশ্যি ইয়াহিয়া মারা যায়নি, তবে গুরুতর জখম হয়ে হাসপাতালে আছে।
রামপুর বাজারে বসেই এই আখ্যানটি আমি শুনেছিলাম। কৃষকের তৈরি এ-আখ্যানটি শুধু নেহায়েৎ গালগল্প ছিলাে না। এর ভেতর কৃষকের কৌতুকবােধ ও কল্পনাশক্তির পরিচয় যেমন মেলে, তেমনি এর পেছনে যে সক্রিয় ছিলাে পাকিস্তানি দুশমনদের প্রতি তীব্র ঘৃণা তাও স্পষ্ট হয়ে ওঠে। এ-রকম আখ্যান সৃষ্টির মধ্যদিয়ে কৃষক-জনতার ইচ্ছা পূরণেরই অভিব্যক্তি ঘটে।
এই সময়েই আকাশবাণী থেকে প্রচারিত হয়েছিলাে রওশন আরার কাহিনী। পঁচিশে মার্চ ঢাকার রাস্তায় যখন পাকিস্তানি সৈন্যরা নির্বিচারে গুলিবর্ষণ করে চলছিলাে, তখন রওশন আরা
৩৭১
নামের এক কলেজ ছাত্রী ওদের ট্যাংকের সামনে ঝাপিয়ে পড়ে আত্মাহুতি দিয়ে ট্যাংকটিকে ধ্বংস করে দিয়েছিলাে—এই বানােয়াট খবরটিও গ্রামের মানুষের সাহসী কল্পনার উজ্জীবন ঘটায়। মুখে মুখে পল্লবিত হতে থাকে রওশন আরার কাহিনী, সৃষ্টি হয় রওশন আরা মিথের। রওশন আরার মতাে একটা মেয়ে যদি দেশের জন্যে জীবন দিয়ে দিতে পারে, তবে আমরা মরদরা কেন তা পারবাে না?
কৃষক জনতার সরল ও সবল প্রত্যয় এবং সেই প্রত্যয় থেকে উৎসারিত নানা মিথ—এ সবই ছিলাে মুক্তিযুদ্ধে কৃষক-জনতার শক্তিশালী মানস অস্ত্র । এই অস্ত্রের গুরুত্বকে অস্বীকার বা উপেক্ষা করে, কিংবা কৃষকের মনােলােকের বৈশিষ্ট্যের খবর না নিয়ে, কোনােমতেই মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ও অন্তরঙ্গ ইতিহাস রচনা করা যাবে না।

গাঁও গেরামে মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি
এপ্রিলেও আমরা স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের অনুষ্ঠান শুনতে পাইনি। এর ওর মুখে শুনেছি এরকম একটি বেতারকেন্দ্র নাকি খােলা হয়েছে, কিন্তু কেন্দ্রটি খুবই দুর্বল বলে আমাদের কাছে তার ধ্বনিতরঙ্গ এসে পৌছায় না। তখন আকাশবাণী থেকে যা কিছু প্রচার করা হতাে গায়ের মানুষের কাছে তার প্রতিটি শব্দই হয়ে ওঠে একান্ত বিশ্বাস্য ও মান্য। এমনকি যে কথা আকাশবাণী বলেনি সে কথাও তারই বরাত দিয়ে মানুষ মুখে মুখে প্রচার করে, কিংবা নিজের ইচ্ছাপূরণের অনুকূলে তার ভাষ্য রচনা করে নেয়। যেমন, একরাতে আকাশবাণীর একটি কথিকায় বলা হলাে : বাংলাদেশের মানুষ হানাদার বাহিনীর জন্যে অর্থের জোগান দিতে কিছুতেই রাজি নয়। বাংলাদেশের প্রধান অর্থকরী ফসল পাট। সেই পাটের থেকে পাওয়া বৈদেশিক মুদ্রার সিংহভাগই পশ্চিম পাকিস্তানিরা আত্মসাত করে নেয়। এবার আর বাংলাদেশের কৃষক তাদের সেই সুযােগ দেবে না। জানা গেছে যে, কৃষকরা এবার আর জমিতে পাট বুনবে না।
পরদিন সকালেই দেখলাম আমার ছেলেবেলায় এক বন্ধু (যে প্রাইমারি স্কুলের গণ্ডি না। পেরিয়েই পড়াশােনার পাট চুকিয়ে দেয় এবং কৃষিকাজে মন দিয়ে যে এখন একজন জাদরেল গৃহস্থ হয়েছে) বাড়ি বাড়ি গিয়ে বলছে, জয়বাংলা গরমেন্ট অর্ডার দিছে ইবার আর নাইল্যা (পাট) করণ যাইবাে না। পাকিস্তানিরা আমরার নাইল্যা বেচা টাকা দিয়া বােমা-বন্দুক কিইন্যা আইন্যা আমরারেই মারে।…কাজেই যারা যারা নাইল্যা ক্ষেত করছুইন তারার হগলেরই হেই ক্ষেত ভাইঙ্গা দেওন লাগবাে।’
এবং সত্যি সত্যিই দেখলাম তাই হলাে। সকল কৃষক ক্ষেতের পাট গাছ নষ্ট করে দিলাে। শুধু আমাদের গ্রামে নয়, আশপাশের সব গ্রামেও। পরে শুনেছি, সারা বাংলাদেশ জুড়েই এ রকমটি হয়েছে।
কিছুদিন পর যখন পাকিস্তান একশাে টাকার নােট বাতিল করে দিলাে এবং একটা নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে সে সব নােট ব্যাংকে জমা দিয়ে নতুন নােট নিয়ে আসার জন্য সাধারণকে নির্দেশ দিলাে—তখনাে আকাশবাণীর এক কথিকায় বলা হলাে যে, বাংলাদেশের মানুষ ওই সব একশাে টাকার নােট জমা দিয়ে পাকিস্তানিদের বাঙালিঘাতী অস্ত্র কেনার জন্য অর্থ জোগান দিতে রাজি নয়। (অবশ্য আমি ঠিক মনে করতে পারছি না, ওই কথিকাটি আকাশবাণী থেকে
৩৭২
স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্র থেকে প্রচারিত হয়েছিলাে। কারণ সে সময়ে স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্রের অনুষ্ঠানও গ্রামে থেকেই আমরা শুনতে পাচ্ছিলাম।) গাঁয়ের কৃষকরা এই কথিকাটির অর্থ করলাে : জয়বাংলার গবরমেন্ট’ একশাে টাকার নােট জমা দিতে নিষেধ করেছে এবং এ রকম সব নােট নিজেদের কাছে রেখে দিতে বলেছে। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর সে সব নােটের বদলে তাদের নতুন নােট দেয়া হবে।
দেখা গেলাে, সত্যি সত্যিই অনেকে পাকিস্তানি একশাে টাকার নােটগুলাে নিজেদের কাছে রেখে দিয়েছে। বিশ্বাস করেছে যে, দেশ স্বাধীন হলে সেই নােটের বদলে নতুন সরকারের কাছ থেকে নতুন নােট পাবে। তবে এ কথাও ঠিক : এ রকম একশাে টাকার নােটের মালিক গাঁয়ের সাধারণ কৃষকের মধ্যে খুব বেশি ছিলাে না। গাঁয়ে যারা টাকাওয়ালা তারা ধনী কৃষক ও জোতদার। কৃষক সমাজের ভেতরে থেকেও এদের জাত আলাদা। এদের বৈষয়িক বুদ্ধি খুবই প্রখর। মেহনতি কৃষক বা ভাগচাষীদের গায়ের রক্ত চুষেই এদের বাড়-বাড়ন্ত। গাঁয়ের মহাজন বা ব্যাপারিদের উদ্ভবও এদের ভেতর থেকেই। কাজেই বেনে বুদ্ধিতেও এরা পাকা। ‘জয়বাংলা’র প্রতি এদের সমর্থন থাকলেও জয়বাংলার আবেগের তােড়ে ভেসে যেতে এরা রাজি নয়। তাই, দশ/পনেরাে মাইল দূরের ব্যাংকে গিয়ে নােট জমা দিয়ে আসতে এরা একটুও ভুল করে না।
অন্যদিকে, যারা সাধারণ কৃষক, যারা নিজেদের মালিকানার সামান্য জমিতে গতর খাটিয়ে ফসল ফলায় কিংবা অন্যের জমি ভাগে চাষ করে, তারাই সমগ্র কৃষক সমাজের তথা গাঁয়ের মানুষের মধ্যে সংখ্যাগরিষ্ঠ। চির দারিদ্রের ভেতরই তাদের বসবাস। তবু গায়ের রক্ত জল করে তারাও কিছু টাকা জমায়, রাখে মাটির পাতিলে, বালিশের খােল কিংবা ঘরের বাঁশের খুঁটি ফুটো করে তারই ভেতরে। এভাবেই তাদের কারাে কারাে কাছেও একশাে টাকার নােট দুটো একটা জমা হয়ে যায়। লােককথায় আমরা টুনির ধনের গল্প শুনেছি। এক টুনটুনি কোথেকে একটি টাকা কুড়িয়ে পেয়ে তার বাসায় নিয়ে রেখেছিলাে। আর সেই এক টাকার গর্বেই সে বলে বেড়াতে শুরু করেছিলাে—রাজার ঘরে যে ধন আছে, টুনির ঘরেও সে ধন আছে।’ এ রকম টুনির ধনের মতাে একশাে টাকা মূল্যমানের নােট নিয়ে টুনির মতােই একান্ত ক্ষুদ্র মেহনতি কৃষকেরও গর্ব। সেই গর্বই সে একাত্তরে মিশিয়ে দিয়েছিলাে জয়বাংলা’র গর্বের সঙ্গে। জয়বাংলার গর্বের সেই টুনির ধনকে যক্ষের ধনের মতাে আগলে রেখেছিলাে মুক্তবাংলার সরকারের হাতে তা তুলে নিয়ে নতুন গর্বের ধন পাবে বলে। (কিন্তু একান্ত স্বাভাবিক ও বাস্তব কারণেই তা পায়নি এবং এই না-পাওয়া তার স্বাধীনতার গর্বকে ভীষণভাবে আহত করে। তবে, সে প্রসঙ্গ এখন নয়।)
আকাশবাণী শুনে গাঁয়ের মানুষকে সবচেয়ে বেশি উল্লাসে ফেটে পড়তে দেখেছিলাম সতেরােই এপ্রিল রাতে। সেদিনই মুজিবনগরে স্বাধীন বাংলাদেশের অস্থায়ী সরকার শপথ গ্রহণ করেন। আকাশবাণীতে সেই শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানের বিবরণী প্রচার করা হয়েছিলাে। সে বিবরণী শুনে শহরের মানুষের কেমন প্রতিক্রিয়া হয়েছিলাে জানি না। গাঁয়ের মানুষের প্রতিক্রিয়া আমি প্রত্যক্ষ করেছি। বুঝেছি, তাদের আস্থা ও প্রত্যয় মৃত্যুঞ্জয়ী হয়ে উঠেছে।
গ্রামে গিয়ে, একটুও দেরি না করে, হেকিম ভাইয়ের সঙ্গে দেখা করি। খান মােহাম্মদ আবদুল হাকিম, চুয়ান্ন সাল থেকে যিনি আশুজিয়া ইউনিয়ন কাউন্সিলের চেয়ারম্যান, ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির জন্মলগ্ন থেকে যিনি এ পার্টির কেন্দুয়া থানা শাখার সভাপতি, আমার সেই
७৭७
হেকিম ভাইকে দেখলাম কেমন যেন নিষ্প্রভ ও বিবর্ণ হয়ে গেছেন। আগের সেই উৎসাহ উদ্দীপনা আর নেই। সিনিকের মতাে তাঁর কথাবার্তা। বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামকে সমর্থন করেন বটে, কিন্তু যাদের হাতে এ সংগ্রামের নেতৃত্ব সেই আওয়ামী লীগ দলটির ওপর তাঁর মােটেই আস্থা নেই। সেই আস্থাহীনতা থেকেই মুক্তিসগ্রামের ভবিষ্যত সম্পর্কে তার হতাশা। সেই হতাশাই তাকে অসুস্থ ও উড্রান্ত করে তুলেছে।
তবে আমি বরাবরই দেখে এসেছি, হেকিম ভাই যতাে হতাশ আর অসুস্থই থাকুন না কেন, আমার সঙ্গে কথা বলতে বলতে তিনি অল্প সময়েই চাঙ্গা হয়ে ওঠেন। এবারও তাই দেখলাম। এই মুক্তিসংগ্রামে যে আমাদের নিষ্ক্রিয় থাকা চলবে না, এ বিষয়ে তিনি আমার সঙ্গে একমত হলেন। হেকিম ভাই সেই বায়ান্ন সালের মতােই যেনাে আরেকবার উৎসাহে জ্বলে উঠতে চাইলেন। বসুর বাজারের পাশের মাঠটিতে একটি জনসভা ডাকলেন। অনেক লােকের জমায়েত হলাে। গাঁয়ের কৃষক, দোকানদার, গ্রাম্য ডাক্তার, স্কুল মাস্টার এবং স্কুল-কলেজের ছাত্রের উপস্থিতিতে সভা জমজমাট হয়ে উঠলাে। হেকিম ভাই-ই প্রথমে বক্তৃতা দিলেন। তিনি যে কবি, সে বক্তৃতায় তারই প্রকাশ ঘটেছিলাে। জনসভায় বক্তৃতা দিচ্ছিলেন বটে, কিন্তু আমার মনে হয়েছিলাে, তিনি যেন নিজের সঙ্গেই কথা বলে যাচ্ছেন, নিজের সঙ্গেই বােঝাপড়া করছেন। যে সব শব্দ ও উপমা তিনি তার বক্তৃতায় ব্যবহার করছিলেন সেগুলাে সেখানকার অধিকাংশ শ্রোতারই বােধগম্য হওয়ার কথা নয়। তবু সে সব শব্দ ও উপমা তিনি কেন টেনে এনেছিলেন? নিজেকে শােনানাের জন্যেই নয় কি? কৈশােরে ও প্রথম যৌবনে যিনি পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার জন্যে মুসলিম লীগের রাজনীতিকে সক্রিয় সমর্থন দিয়েছিলেন, পাকিস্তানের জন্মের পর মুসলিম লীগ নেতৃত্বের প্রতি বীতশ্রদ্ধ হয়েও যিনি আশা রেখেছিলেন যে, দেশটিতে ইসলামিক ন্যায়বিচারের প্রতিষ্ঠা হবে এবং সেই লক্ষেই মহা-উৎসাহে যােগ দিয়েছিলেন তমদ্দুন মজলিসে, সেই তিনিই নিজের তিল তিল স্বপ্ন ও আবেগ দিয়ে গড়া পাকিস্তানের মৃত্যু ঘটাতে কৃতসংকল্প হয়েছেন। এর কৈফিয়ৎ কি নিজের কাছে না দিয়ে তিনি পারেন? নিজের কাছে কৈফিয়ৎ দিচ্ছিলেন বলেই তার সেদিনের কথা অন্য কেউ বুঝলাে কি বুঝলাে না সেদিকে তার খেয়াল ছিলাে না।
আগাগােড়া যারা পাকিস্তানপন্থী ছিলাে, পাকিস্তানি দুঃশাসনের প্রতি যাদের কোনােই ক্ষোভ ছিলাে না, বাঙালির সশস্ত্র মুক্তিসংগ্রামের দিনগুলােতে যারা অনায়াসে বর্বর পাকিস্তান বাহিনীর সঙ্গে সক্রিয় সহযােগিতা করতে পেরেছিলাে, বাংলাদেশের সেই সব বিবেকহীন মানুষগুলাের ভাবনাচিন্তা ছিলাে একান্তই স্থবির ও একমাত্রিক। বিবেকহীন বলেই আপন বিবেকের মুখােমুখি দাঁড়াবার কোনাে দায় তাদের ছিলাে না। আর পাকিস্তান সৃষ্টির সঙ্গে যারা ছিলাে অসম্পর্কিত, সেই তরুণ প্রজন্মের বাঙালিদের দৃষ্টি তাে সামনের দিকে, বাঙালির জন্যে একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রের জন্মদানই তাদের লক্ষ। তাদের বিবেক তাে একান্ত পরিষ্কার, নিজের কাছে কৈফিয়ত দেবার জন্যে কিছুই তাদের নেই। কিন্তু হেকিম ভাইয়ের মতাে যারা পাকিস্তানের সৃষ্টি-প্রক্রিয়ার সঙ্গে ওতপ্রােতভাবে জড়িত ছিলেন, তারাই যখন সেই পাকিস্তানের ধ্বংসের প্রয়ােজনে হাত লাগাতে বাধ্য হলেন, তখন তারা অবশ্যই নিজের সঙ্গে বােঝাপড়া না করে নিয়ে পারেন না। হেকিম ভাই ছাড়াও এরকম আরাে কিছু মানুষকে আমি খুবই কাছে থেকে দেখেছি এবং তাদের আত্মদ্বন্দ্বের পরিচয়ও কিছু কিছু পেয়েছি। এই মানুষদের অনেকে আত্মদ্বন্দ্বে জয়ী হতে পেরেছেন, অনেকে তা পারেননি। যারা জয়ী হতে পেরেছেন তারাই
७৭8
অতীতকে পেছনে ফেলে সামনে এগিয়ে গেছেন, দ্বিজাতিতত্ত্বের ভ্রান্তি উপলব্ধি করে বাঙালির অসাম্প্রদায়িক জাতিরাষ্ট্র গঠনের সংগ্রামে যুক্ত হয়েছেন। আর যারা নিজেদের ভেতরকার পাকিস্তানি ও সাম্প্রদায়িক সত্তাটিকে পরাজিত করতে পারেননি, অথচ বাঙালিত্বের আবেগেও ক্ষণে ক্ষণে আন্দোলিত হয়েছেন, তাঁরাই থেকে গেছেন চির দোদুল্যমান। বাঙালির সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের সময়টিতে তাঁদের কেউ নিষ্ক্রিয় থেকেছেন, কেউ পাক হানাদারদের তৈরি তথাকথিত শান্তি কমিটিতে যােগ দিয়ে বা অন্যভাবে মুক্তিযুদ্ধের বিরােধিতা করেছেন। আবার এদেরই কেউ কেউ কখনাে কখনাে নিজেদের আচরণের জন্যে লজ্জিত বা অনুতপ্ত যে হননি, তাও নয়। তবু শেষ বিচারে এই দোদুল্যমান মানুষগুলােকে মুক্তিকামী বাঙালির দুশমন ও পাকিস্তানের দালাল বলেই চিহ্নিত করতে হয়।
মুক্তিসংগ্রামের প্রশ্নে হেকিম ভাইয়ের ভেতর কোনাে দোদুল্যমানতা ছিলাে না। ধর্মীয় জাতীয়তাবাদের মােহপাশ তিনি অনেক আগেই ছিড়ে ফেলে দিয়েছিলেন। কিন্তু পাকিস্তানােত্তর কালে পাকিস্তানবাদী মুসলিম লীগ নেতাদের আচরণে তাদের প্রতি যে অবিশ্বাস তার ভেতর দেখা দিয়েছিলাে, সেই অবিশ্বাসের দৃষ্টি দিয়েই তিনি বাঙালি জাতীয়তাবাদী আওয়ামী লীগ নেতাদের দিকেও তাকিয়েছিলেন। নেতৃত্বের ওপর এ রকম অবিশ্বাসই তাকে মুক্তিযুদ্ধের সাফল্য সম্পর্কে সংশয়ী করে তুলেছিলাে। সেই সংশয় সত্ত্বেও তিনি যে বাঙালি জাতির এই মুক্তিযজ্ঞ থেকে দূরে সরে থাকতে পারেন না, পাকিস্তান নামক যে প্রতারণার ফাঁদে তিনি যৌবনে পা দিয়েছিলেন সেই ফাঁদ থেকে যে তাকে বেরিয়ে আসতে হবেই—বসুর বাজারের সভায় হেকিম ভাই সেদিন সে কথাগুলােই স্বগতােক্তির মতাে বলে গিয়েছিলেন।
হেকিম ভাইয়ের বক্তৃতার পর সকলের করণীয় নিয়ে অনেক আলােচনা হলাে। মুক্তিযুদ্ধের গতিপ্রকৃতি আসলে কোথায় কীভাবে কোনদিকে যাবে তা তখনাে আমাদের কাছে স্পষ্ট হচ্ছিলাে না। একটি মুক্তিযুদ্ধ যে শুরু হয়েছে, এবং এ যুদ্ধ যে অনেক তীব্র হয়ে একটা পরিণতির দিকে এগিয়ে যাবে, এ বিষয়ে কোনাে সংশয় অবিশ্যি ছিলাে না। কিন্তু গাঁয়ের তরুণরা প্রশ্ন করছিলাে, কীভাবে আমরা মুক্তিযুদ্ধে যােগ দেবাে, কারা কোথায় আমাদের রিক্রুট করবে? এ প্রশ্নের জবাব এপ্রিলের প্রথম বা দ্বিতীয় সপ্তাহেও আমরা জানতাম না। তবু বসুর বাজারের সেদিনের সভায় খান মােহাম্মদ আবদুল হাকিমের নেতৃত্বে সংগ্রাম পরিষদ’ ধরনের একটা শিথিল সংগঠন আমরা খাড়া করেছিলাম। গাঁয়ে যাতে কোনাে পাকিস্তানি দালালের উদ্ভব ঘটতে না পারে, আইনশৃঙ্খলার যাতে অবনতি না ঘটে, ব্যবসায়ীরা যাতে জিনিসপত্রের কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে অনুচিত মূল্যবৃদ্ধি না ঘটাতে পারে, কোনাে সাম্প্রদায়িকতার যেন সৃষ্টি না হতে পারে—এই সব বিষয়ে সচেতন থাকা ও ব্যবস্থা গ্রহণ করাই সংগ্রাম পরিষদ-এর দায়িত্ব বলে সেই সভায় সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়েছিলাে।

মুক্তিযুদ্ধ ও নতুন পুরাতনের দ্বন্দ্ব
সাতষট্টির পরে বেশ ক’বছর গ্রামের বাড়িতে আসা হয়নি। এরপর এলাম এই একাত্তরের এপ্রিলে। ছেষট্টির ছয়দফা, আটষট্টি-উনসত্তরের আইউব বিরােধী আন্দোলন, সত্তরের সাধারণ নির্বাচন ও একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের সূচনা—এ-সব যে গ্রামের মানুষের ভাবনায় ও আচরণে অসাধারণ পরিবর্তন নিয়ে এসেছে তা সহজেই বােঝা যায় তবে পরিবর্তনের প্রকৃতি ও প্রকাশ
৩৭৫
সকলের মধ্যে একই রকম নয়। সামাজিক অবস্থান, বয়স, শিক্ষা, কিংবা পারিবারিক পরিবেশভেদে পরিবর্তনের প্রকৃতি যেমন পৃথক, এর প্রকাশও তেমনি স্বতন্ত্র।
আমাদের এলাকার গ্রামগুলােতে বেশ কিছু ধনী কৃষক পরিবারের উদ্ভব ঘটেছে। বলার অপেক্ষা রাখে না যে, এগুলাে সবই মুসলিম পরিবার। ব্যাপকভাবে হিন্দুদের দেশত্যাগের ফলেই এগুলাের উদ্ভব সম্ভব হয়েছে। আর এভাবেই জন্ম হয়েছে কিছু মাঝারি মাপের স্বচ্ছল পরিবারেরও। এ সব পরিবারের মূল উপজীবিকা কৃষি হলেও সে সঙ্গে আয়ের অন্যান্য পথও এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে। কেউ ছােট খাটো ব্যবসা করে এবং কারাে ছেলেপুলে প্রাইমারি কিংবা হাইস্কুলে মাস্টারি অথবা শহরে অন্য কোনাে চাকরি করে। উকিল কিংবা ডাক্তারও হয়েছে দু’একজন। এ পরিবাগুলাের সদস্যদের চরিত্র আর এখন মেহনতি কৃষকের নয়। কৃষকের সরল আর সবল বিশ্বাস এখন তাদের নেই। তাদের মাথায় এখন নানান পঁাচ, ভাবনায় হরেক রকম জটিলতা। একই পরিবারের ভেতরে একাধিক ও পরস্পর-বিরােধী ভাবনাচিন্তার ট্রেন্ড।
মুসলিম কৃষক সমাজের মধ্য থেকে ইংরেজ আমলে বা পাকিস্তান জামানার গােড়ার দিকে বেরিয়ে এসেছিলেন যে-সব গ্রামীণ এলিট তাদের সঙ্গে এ-সমাজের নতুন এলিটদের চিন্তা ভাবনা ও দৃষ্টিভঙ্গির ফারাকটি বেশ স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। এ ব্যাপারটি আমার কাছেও বিশেষভাবে ধরা পড়েছিলাে আমার ছেলেবেলার শিক্ষক সােনার মাস্টার সাহেবের তখনকার অবস্থান ও তার প্রতি গ্রামের তরুণদের আচরণ দেখে।
একাত্তরে রামনগর গ্রামের সােনার মাস্টার সাহেবের বয়স পঁচাত্তরের কম নয়। চুয়াল্লিশ থেকে ছেচল্লিশ সাল—এই তিন বছর আমি রামপুর প্রাইমারি স্কুলে তার কাছে পড়েছি। তিনিই ছিলেন এই স্কুলটির প্রধান শিক্ষক। শুধু প্রাইমারি স্কুলের প্রধান শিক্ষক নন, তিনি তখন দলপা ইউনিয়ন বাের্ডের প্রেসিডেন্ট, রামপুর পােস্টাপিসের পােস্টামাস্টার এবং সরকারি বেসরকারি একমিটি সে-কমিটির চেয়ারম্যান বা মেম্বার। একসঙ্গে এতােগুলাে দায়িত্ব পালন করতে গেলে কাজের চাপে অবশ্যই হিমশিম খাওয়ার কথা। অথচ তার চলাফেরা দেখে এরকম মনে হতাে না। প্রায় সারাক্ষণই তাকে দেখেছি মজলিসি মেজাজে এখানে-ওখানে আসর জমিয়ে বসতে, নানান ধরনের মানুষের সঙ্গে গল্পগুজব করতে। আসলে এ-সব মজলিস বা আড্ডাগুলাের মধ্যেই অনেক সামাজিক কাজকর্ম তিনি সেরে ফেলতেন, অনেক বিচার-সালিশও সেখানে সম্পন্ন হয়ে যেতাে। আর তাছাড়া সব কাজে সাহায্য করার জন্যে তার ভক্তরা যেন সব সময় তৈরি হয়েই থাকতাে। ইউনিয়ন বাের্ডের অফিসিয়াল কাজের জন্যে তিনি একজন খুব দক্ষ কেরানি পেয়েছিলেন। কাজেই বাের্ডের কাজ নিয়ে তাকে খুব মাথা ঘামাতে হতাে না, কেরানি সাহেবের বাড়িয়ে দেয়া কাগজপত্রে চোখ বুজে কিছু সই দিয়ে দিলেই চলতাে। রামপুরের কামিনী কুমার চক্রবর্তী ও চন্দপাড়ার নগেন্দ্র দত্ত তাঁকে পােস্টমাস্টারি চালাতে সাহায্য করতেন। তবু অন্য সব দায়িত্ব ও দেনদরবার সেরে স্কুলের মাস্টারি করার মতাে সময় তিনি খুব কমই পেতেন। তার দুই সহকর্মি শিক্ষক নগেন্দ্র নন্দী ও সুরেশ পণ্ডিত ছাত্রদের পড়ানাের কাজ চালিয়ে নিতেন। সপ্তাহে দু’তিন দিনের বেশি তিনি স্কুলে যেতে পারতেন না। অথচ, এ নিয়ে তার সহকর্মিদের কিংবা গাঁয়ের অন্য মানুষদের কারাে কোনাে অভিযােগ ছিলাে না। এমনকি স্কুল ইন্সপেক্টরও সােনার মাস্টারের স্কুলে অনুপস্থিতিটাকে স্বাভাবিক বলে মেনে নিয়েছিলেন। পল্লীর জননেতা ও সমাজসেবী হিসেবে সােনার মাস্টার সকলের শ্রদ্ধেয়। তার ওপর সকলের আস্থা ও নির্ভরতা।
৩৭৬
সাধারণ কৃষকের ছেলে সােনাফর উদ্দিন ম্যাট্রিক পাস করেননি। ক্লাস টেন পর্যন্ত পড়েই স্কুল ছেড়ে দিয়েছিলেন। এরপর গুরু ট্রেনিং স্কুল থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে (জিটি পাস করে) প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষক হয়েছিলেন। এইটুকু অ্যাকাডেমিক শিক্ষাই সােনার মাস্টারকে গ্রামে এলিট হিসেবে প্রতিষ্ঠা দেয়ার জন্যে যথেষ্ট হয়েছিলাে। তার সমসময়ে আমাদের গ্রাম এলাকায় তার মতন এ রকম নন ম্যাট্রিক জিটিও মুসলমানের মধ্যে কম ছিলেন। তাছাড়া তিনি কাব্যচর্চাও করতেন, অর্থাৎ ছন্দ মিলিয়ে পদ্য রচনা করতেন। বিভিন্ন আসরে তার সে-সব পদ্য তিনি পড়ে শােনাতেন, শ্রোতারা তাতে খুবই আমােদ পেতাে। চলতি রাজনীতির খোঁজখবর যেমন তিনি ভালােভাবেই রাখতেন, তেমনি ইতিহাস, ঐতিহ্য ও পৌরাণিক কাহিনীর সঙ্গেও তার পরিচয় ছিলাে খুবই ঘনিষ্ঠ। হিন্দু পুরাণ সম্পর্কে তার জ্ঞান সকলকে অবাক করে দিতাে। হরধনু ভঙ্গ করে জনক রাজার কন্যা সীতাকে বিবাহ করেছিলেন রামচন্দ্র। সেই সীতাকে হরণ করে নিয়ে গিয়েছিলাে লংকার রাজা রাবণ। রামচন্দ্র বানর সৈন্যদের সাহায্য নিয়ে রাবণ বধ করে সীতা উদ্ধার করেছিলেন—রামায়ণের এই বহুল প্রচলিত কাহিনী তাে আমাদের সকলেরই জানা। কিন্তু গ্রামীণ লােকসমাজে মানুষের মুখে মুখে কিংবা রামমঙ্গল গানের আসরে গায়েনের তাৎক্ষণিক উপস্থাপনায় রামকাহিনীর কতাে যে রূপভেদ তৈরি হয়েছিলাে তার খবর আমাদের ফোকলাের-বিশেষজ্ঞরাও খুব কমই রাখেন। কৃষক সন্তান সােনার মাস্টার ছিলেন ওই সব লৌকিক রামকথার ভাণ্ডারী। রামকথার অনেকগুলাে রূপভেদের সম্মিলন ঘটিয়ে তিনি একটি চমৎকার পালা রচনা করেছিলেন। এই পালাটিতে জনক ও রামচন্দ্রের রাজরূপের চেয়ে কৃষকরূপই বড়াে হয়ে উঠেছিলাে। কৃষকের সেই সীতাকে অপহরণ করে নিয়ে যায় যে-রাবণ সে হচ্ছে গ্রামীণ জোতদার-মহাজনেরই প্রতিভূ। সােনার মাস্টার তার সেই পালাটিতে জোতদার-মহাজনদের বিরুদ্ধে সংগ্রামে কৃষক প্রজার বিজয়ের প্রত্যয়ই ঘােষণা করেছিলেন।
ছেলেবেলায় মাস্টার সাহেবের লেখা এই পালাটি আমাকে খুবই মুগ্ধ করেছিলাে। কিন্তু মাস্টার সাহেব সেটি সংরক্ষণ করেননি। পরে অনেকবার খোঁজ করেও পালার পাণ্ডুলিপিটি উদ্ধার করতে পারিনি। বড়াে হয়ে যখন সমগ্র নজরুল-রচনাবলী পড়েছি, তখন লক্ষ করে অবাক হয়ে গিয়েছি : নজরুল রামকথার যে তাৎপর্য নিষ্কাশন করেছিলেন সেটি সােনার মাস্টার সাহেবের পালার বক্তব্যের সঙ্গে স্বরূপে এক। মাস্টার সাহেব নজরুলের ওই রচনাগুলাের সঙ্গে পরিচিত ছিলেন বলে মনে হয় না। তবু, দুজনের বক্তব্যে এ-রকম ঐক্য ঘটে যাওয়ার কারণ সম্ভবত লােককথার স্পিরিটের মধ্যেই নিহিত আছে।
সােনাফার মাস্টার তাঁর রাজনৈতিক জীবনের শুরুতে কৃষকপ্রজা পার্টির সঙ্গে যুক্ত হয়েছিলেন। বিশ ও তিরিশের দশকে মুসলমান কৃষক পরিবার থেকে উঠে আসা যে কোনাে লেখাপড়া জানা মানুষের জন্যে এরকমটিই ছিলাে স্বাভাবিক। সে সময়েও মুসলিম লীগ যে একান্ত প্রভাবশালী হয়ে উঠতে পারেনি, সাঁইত্রিশ সনের নির্বাচনে ফজলুল হকের নেতৃত্বাধীন কৃষকপ্রজা পার্টির বিজয়ই তার প্রমাণ। সে-সময়কার পূর্ব ময়মনসিংহে আবদুল ওয়াহেদ বােকাইনগরী কৃষকপ্রজা পার্টর নেতা হিসেবে অসাধারণ জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন। বােকাইনগরীর একনিষ্ঠ ভক্ত হয়ে গিয়েছিলেন আমাদের সােনার মাস্টার সাহেব। বােকাইনগরীর অনুসরণেই তিনি প্রাকৃত বাংলায় লােকায়ত বাকরীতি ও প্রবাদ-প্রবচন প্রয়ােগ করে চমক্কার গণমনােহর বক্তৃতা দিতেন। তিনি যে কৃষকের সন্তান সেটির জন্যেই ছিলাে তার গর্ব, সে গর্বই তিনি সকল কৃষক-সন্তানের মধ্যে সঞ্চারিত করে দিতে চাইতেন। বােকাইনগরী ও সােনার মাস্টারদের
৩৭৭
মতাে মানুষদের প্রয়াস যে গ্রামবাংলায় মুসলমান কৃষকদের হীনমন্যতা অনেক পরিমাণেই দূর করে দিতে পেরেছিলাে, সে কথা মানতেই হবে। চল্লিশে লাহাের প্রস্তাব উত্থাপনের পরে যখন মুসলমান সমাজে মুসলিম লীগের জনপ্রিয়তা অবিশ্বাস্য দ্রুতগতিতে বেড়ে যায়, বলতে গেলে মুসলিম লীগই হয়ে ওঠে সকল মুসলমানের একমাত্র রাজনৈতিক সংগঠন, তখন সােনার মাস্টারও মুসলিম লিগার হয়ে যান। এবং মুসলিম লিগার হলেও সাম্প্রদায়িক হননি। আমি জানি, এই তথ্যটির সত্যতা সম্পর্কে অনেকেই তীব্র সন্দেহ ব্যক্ত করবেন। মুসলিম লিগারদের সামাজিক ও রাজনৈতিক দর্শনের ভিত্তিই দ্বিজাতিতত্ত্ব তথা মুসলিম সাম্প্রদায়িকতা, তাই সােনার মাস্টার নামক এক ব্যক্তি মুসলিম লিগার হয়েও অসাম্প্রদায়িক হন কী করে?
কী করে হন তা বলতে পারবাে না। তবে সােনার মাস্টার যে মুসলিম লিগার হয়েও সাম্প্রদায়িকতা-বিরােধী থেকেছিলেন, আমি নিজে তা প্রত্যক্ষ করেছি। পাকিস্তানের জন্মের আগে মুসলিম লীগের পক্ষ নিয়ে মহেন্দ্র চৌধুরী, কামিনী চক্রবর্তী কিংবা পবিত্র দাশের সঙ্গে সােনার মাস্টার সাহেবকে খােলামেলা তর্কবিতর্ক করতে দেখেছি। তর্কের ক্ষেত্রে আপন আপন অবস্থান থেকে একটুও হেলেননি এঁরা। অথচ তারপরও যে এঁরা সম্প্রীতি ও প্রসন্নতা বজায় রাখতে পেরেছেন তার মূল কারণটা নিহিত ছিলাে সােনার মাস্টারের উদার চরিত্রের মধ্যেই। মুসলিম লীগের পাকিস্তান প্রস্তাবকে তিনি এ দেশের সাম্প্রদায়িক সমস্যার সমাধান বলেই দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করতেন। এ বিশ্বাস পােষণের জন্যে তাঁকে সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষপরায়ণ হতে হয়নি। যে হিন্দু ভদ্রলােকদের সঙ্গে পাকিস্তান নিয়ে তিনি তুমুল তর্কবিতর্ক করতেন তাঁদের তিনিই ছিলেন প্রকৃত শুভানুধ্যায়ী। শুধু ভদ্র’ হিন্দুরা নয়, তথাকথিত ‘ছােটোলােক হিন্দুরাই সােনার মাস্টারকে বেশি আপন বলে ভাবতাে। দলপা আর আশুজিয়া—পাশাপাশি দুটো ইউনিয়ন বাের্ড, সােনার মাস্টার দলপা ইউনিয়নের প্রেসিডেন্ট। কিন্তু দলপা ইউনিয়নের সংলগ্ন রামপুর ও চন্দপাড়া সহ আশুজিয়া ইউনিয়নের অনেকগুলাে গ্রামের হিন্দুরা ন্যায়বিচারের জন্যে সােনার মাস্টারের ওপরই ভরসা রাখতাে। পাকিস্তানের জন্মের ঠিক আগে এবং পরে যখন বেশ কয়েকবার আমাদের এলাকাতেও সাম্প্রদায়িক গােলযােগ বেধে যাওয়ার মতাে অবস্থার উদ্ভব ঘটেছিলাে, তখনাে শেষ পর্যন্ত যে তা ঘটতে পারেনি তাতে সােনার মাস্টারের অবদান ছিলাে সবচেয়ে বেশি। অথচ তিনি মুসলিম লীগের প্রতি সমর্থন বা পাকিস্তানবাদ পরিত্যাগ করেননি একদিনের জন্যেও। চুয়ান্নর নির্বাচনেও তিনি ছিলেন যুক্তফ্রন্টের বিরুদ্ধে, সত্তরের নির্বাচনেও উল্টো হাওয়ার পন্থি।
একাত্তরের এপ্রিল-মে মাসে এই সােনার মাস্টারকে দেখলাম খুবই বিমর্ষ। বৃদ্ধ হয়ে গেলেও তিনি বেশ সুস্থ ও সবল। ইচ্ছে করলে সে সময়ে তিনি জয়বাংলা’র পক্ষে বা বিপক্ষে একান্ত সক্রিয় হয়ে উঠতে পারতেন, কিন্তু তিনি তা হলেন না। তবে নিষ্ক্রিয় হয়ে থাকলেও মনের দিক দিয়ে যে শান্ত থাকতে পারছিলেন না আচরণে তার প্রকাশ ঘটে যাচ্ছিলাে। আমার সঙ্গে অনেকদিন পর দেখা হলেও সামান্য কুশল বিনিময়ের চেয়ে বেশি আর কিছু বললেন না। তাঁর এ রকম শীতল ব্যবহারে আমি খুবই বিস্মিত হলাম। রামপুর প্রাইমারি স্কুলে আমার যারা সহপাঠী ছিলাে—অর্থাৎ যারা আমার মতােই সােনাফার মাস্টার সাহেবের ছাত্র—সেই সুরুজ, হামিদ, রাশিদ, তাহেররা বললাে যে, এতে বিস্মিত হওয়ার কিছু নেই। গত ইলেকশানের পর থেকেই তিনি তাঁর প্রাক্তন ছাত্র বা আশপাশের লােকজনের সঙ্গে খুব কম কথা বলেন, প্রায় সব সময়েই গম্ভীর হয়ে থাকেন, অস্থিরভাবে পায়চারি করেন। প্রথম দিকে তিনি পাকিস্তানের পক্ষে
৩৭৮
কিছু যুক্তি উত্থাপনের চেষ্টা করেছেন, কিন্তু অন্য সকলের মধ্যে উল্টোভাবের প্রসার দেখে আস্তে আস্তে নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছেন। তরুণদের প্রায় সবাই এখন তাকে এড়িয়ে চলে, তার ছেলে হাশিম উদ্দিনের অবস্থানও জয়বাংলা’র শিবিরে। মন খুলে কথা বলার মতাে কাউকে পান না বলেই পারতপক্ষে তিনি মুখ খােলেন না। কেবল অন্তরঙ্গ দু’একজনের সঙ্গেই একান্ত নিভৃতে তিনি মুক্তিযুদ্ধ নামক এক ‘পাগলামি’ ও মুসলমান ছেলেছােকরাদের এ-ধরনের ‘আত্মঘাতী’ কর্মকাণ্ডের জন্যে ক্ষোভ ও হতাশা ব্যক্ত করেন। দলপা আর আশুজিয়া—পাশাপাশি এই দুই ইউনিয়ন বাের্ডে দীর্ঘদিন ধরে চেয়ারম্যানগিরি করেছেন যথাক্রমে সােনার মাস্টার ও খান মােহাম্মদ আবদুল হাকিম। দু’জনের বয়সের ব্যবধান প্রায় বিশ বছরের। পাকিস্তান আন্দোলনে দুজনেই সক্রিয় ভূমিকা রেখেছিলেন। মাস্টার সাহেব পাকিস্তানবাদের বৃত্তের মধ্যেই আটকে রইলেন, আর হেকিম ভাই সারা জীবন নিজের সঙ্গে যুদ্ধ করে করেই এক সময়ে পাকিস্তানবাদকে প্রত্যাখ্যান করলেন ও বাংলাদেশ সৃষ্টির আয়ােজনের সঙ্গে নিজেকে যুক্ত করে দিলেন। একজন অতীতকে আঁকড়ে ধরে থেকে বিচ্ছিন্ন ও নিঃসঙ্গ হলেন, অন্যজন নতুনকে স্বাগত জানিয়ে মূলধারার সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকলেন। গ্রামের মুসলিম সমাজের মনােভাবের রূপান্তর প্রক্রিয়ায় এই দু’জনকে দুটি প্রতীকী চরিত্র বলে আমার মনে হয়।

সমাজমানসের বহুমুখী দ্বন্দ্ব ও মুক্তিযুদ্ধ
আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস ও তার প্রকৃত তাৎপর্য উদ্ঘাটন করতে হলে শুধু মােটা দাগে এ যুদ্ধের শক্ৰমিত্রদের কথা বললেই যথেষ্ট হবে না। মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষ শক্তি বলে আমরা যাদের নির্দেশ করি তাদের ভেতরেও যে ছিলাে নানা ভাবনার ধারা-উপধারা, ছিলাে নানান ধরনের আত্মদ্বন্দ্ব ও স্ববিরােধিতা, একই পরিবার থেকে যে বেরিয়ে এসেছিলাে মুক্তিযােদ্ধা ও রাজাকার, আবার ঘােষিত মুক্তিযােদ্ধা ও রাজাকাররাও যে সকলে সব সময় নিজ নিজ দায়িত্বে নিষ্ঠাবান না থেকে প্রতিপক্ষের স্বার্থসাধক কাজকর্ম করে বসেছে—সে-সমস্ত বিষয়ও অবশ্যই বিবেচনার মধ্যে রাখতে হবে। অর্থাৎ আমাদের মুক্তিযুদ্ধটি ছিলাে অত্যন্ত জটিল একটি প্রক্রিয়া, এই জটিলতার সরল ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে আমরা প্রায়শই আত্মপ্রতারণার শিকার হই।
একই পরিবারে বাপ-ছেলের মধ্যেও মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে চলেছে দ্বন্দ্ব। বাপ পাকিস্তানের দালাল বা শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান আর ছেলে হয়েছে মুক্তিবাহিনীর কমান্ডার—এ রকম দৃষ্টান্ত তাে অনেক আছে। এ ধরনের স্পষ্ট দ্বন্দ্বের কথা আমি এখানে বলছি না। আমি বলতে চাইছি সূক্ষ্মতর দ্বন্দ্ব-বিরােধের কথা। পাকিস্তানি মিলিটারির অত্যাচার-উৎপীড়নে যে কোনাে পরিবারের সবাই ক্ষুব্ধ হয়েছেন, সবাই এ অবস্থার অবসান চাইছেন। কিন্তু পরিবারের বয়ােজ্যেষ্ঠ ব্যক্তিটি বলেছেন, পাকিস্তান ভেঙে সমস্যার সমাধান করা যাবে না। শেখ মুজিব আর আওয়ামী লীগের ছেলেছােকরারা বড়াে বেশি রকমের বাড়াবাড়ি করে ফেলেছে। এই বাড়াবাড়ির ফলেই তাে আমাদের এই দুর্ভোগ।…এখনাে সময় আছে। একটা মীমাংসা হওয়া অবশ্যই প্রয়ােজন।’
পরিবারের তরুণ সদস্যটি পিতার বক্তব্যের প্রতিবাদ জানিয়ে বলে, ‘কোনাে মীমাংসার আর সুযােগ নেই এখন। হানাদারদের তাড়িয়ে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠা করতেই হবে। আর পাকিস্তান নয়, বাংলাদেশের স্বাধীনতা আমাদের চা-ই চাই।
৩৭৯
এই নিয়ে পিতাপুত্রের ঘাের তর্ক ও মন কষাকষি।
এ-রকম মতের দ্বন্দ্বের দৃষ্টান্ত হিসেবে বারবার আমার বন্ধু সৈয়দ আমীরুল ইসলাম ও তার বাবা সৈয়দ আফসার উদ্দিন সাহেবের মধ্যেকার বাদ-প্রতিবাদের কথাগুলাে মনে পড়ে।
না, আমি নিজের কানে পিতাপুত্রের বাদ-প্রতিবাদ শুনিনি। তারা আমাকে সাক্ষী রেখে মতের দ্বন্দ্বে অবতীর্ণ হননি। নানা কথাপ্রসঙ্গে আমীরুল ইসলামই তার পিতার ক্ষোভের কথাগুলাে আমাকে জানিয়েছেন। পিতার সঙ্গে সে সময়ে তার যে-সব সংলাপ হয়েছিলাে, মুক্তিযুদ্ধের সময় পিতার যে-দৃষ্টিভঙ্গির প্রকাশ ঘটেছিলাে, সে-সব নিয়ে সৈয়দ আমীরুল ইসলাম স্বাধীনতার পরে একটি উপন্যাস লিখেছিলেন—‘আমার পিতা অসুস্থ।’ আমি উপন্যাসটি একাধিকবার পড়েছি। উপন্যাসের কাহিনীতে অবশ্যই, স্বাভাবিকভাবেই, নানা কাল্পনিক ঘটনার সমাবেশ আছে। তবে, পিতাপুত্রের সংলাপগুলােতে কাল্পনিকতা প্রায় নেই বললেই চলে। পিতা সৈয়দ আফসার উদ্দিন আর পুত্র আমীরুল ইসলামের সংলাপে পাকিস্তান প্রসঙ্গে দুই প্রজন্মের মনােভঙ্গির পার্থক্যটিই ফুটে উঠেছে।
আফসার সাহেব একজন আইনজীবী। জীবিকার ক্ষেত্রে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে তাকে প্রথম যৌবনে অনেক কঠিন সংগ্রাম করতে হয়েছে। সে-সংগ্রামে তার প্রতিপক্ষ যারা ছিলেন তাঁদের প্রায় কেউই আজ আর এদেশে নেই। আফসার সাহেব যখন কর্মজীবনে প্রবেশ করেন তখন যারা পূর্ব থেকেই প্রতিষ্ঠিত ছিলেন, জাতে তাঁরা হিন্দু। এদের প্রতিষ্ঠাকে অতিক্রম করে কোনাে মুসলমানের ছেলের নিজেকে প্রতিষ্ঠা করা কী যে কঠিন কর্ম ছিলাে তা আজকালকার ছেলেছােকরারা বুঝবে কেমন করে? কেমন করে বুঝবে পাকিস্তান না হলে এদেশের মুসলমানরা আজো কোন পর্যায়ে থাকতাে? পাকিস্তানের জন্ম হলাে বলেই তাে সেই প্রবল পরাক্রমশালী হিন্দুদের পরাক্রমের অবসান ঘটলাে, ওরা অনেক দীর্ঘদিনের অনেক কায়েমি আসন ছেড়ে দিতে বাধ্য হলাে, অনেকে দেশ থেকেই পালালাে। আর তার ফলেই তাে এদেশের মুসলমানরা মানুষের মর্যাদায় আসীন হতে পারলাে। যে পাকিস্তানের কল্যাণে এরকমটি সম্ভব হয়েছে একালের মুসলমান ছেলেরা কিনা সেই পাকিস্তানটিকেই ভেঙে ফেলার উদ্যোগ নিয়েছে। হিন্দুরা কিংবা ভারতের নেতারা পাকিস্তানের অস্তিত্বকেই মেনে নিতে পারেনি। পাকিস্তানের জন্মকে যেমন তারা ঠেকাতে চেয়েছে, জন্মের পর সেই পাকিস্তানকে ধ্বংসের জন্যে তারা অবিরাম চেষ্টা করে গেছে। এখন তাে পূর্ব পাকিস্তানের মুসলমান ছেলেরাই হিন্দু ও হিন্দুস্থানের হাতে পাকিস্তান ধ্বংস করার সেই সুযােগটি তুলে দিয়েছে।
না, অধ্যাপক সৈয়দ আমীরুল ইসলামের আইনজীবী পিতা সৈয়দ আফসার উদ্দিন সাহেব হুবহু এ-রকম ভাষাতেই যে-কথাগুলাে বলেছেন, তা নয়। তবে তিনি কিংবা তার সমবয়সী সমভাবুক মানুষেরা যা বলতেন তার মর্মার্থ এ রকমই। ওই প্রজন্মের কৃতী ও প্রতিষ্ঠিত মানুষদের পাকিস্তান-প্রীতি ও পাকিস্তান ভাঙার ভীতির আরাে একটা বড়াে কারণ ছিলাে। গ্রাম ও শহর দু’জায়গাতেই সমান ক্রিয়াশীল ছিলাে সে কারণটি। সেটি হচ্ছে সম্পত্তি বিষয়ক। শহরে দেখেছি : পাকিস্তান আমলে নবপ্রতিষ্ঠিত মুসলিম মধ্যবিত্তেরা যে বাড়িগুলােতে বসবাস করতাে সেগুলাের প্রায় সবক’টিরই পূর্বতন মালিক ছিলাে হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষ। তারা এই দেশ ছেড়ে চলে গেছে তাদের বাড়িগুলাের মালিকানাও বদলে গেছে। এই বদল যে সব ক্ষেত্রে ‘আইনসঙ্গত’ ও নীতিসঙ্গতভাবে ঘটেছে, তা মােটেই নয়। পরিত্যক্ত হিন্দু সম্পত্তির মালিকানা বদলের প্রক্রিয়াটি সম্পর্কে যদি একটি নিরপেক্ষ ও বস্তুনিষ্ঠ তদন্ত চালানাে হয়, তবে কেঁচো
৩৮০
খুঁড়তে গিয়ে শুধু সাপ নয়, অনেক বড়াে বড়াে অজগর বেরিয়ে পড়বে। নব্য মালিকদের এই অদৃশ্য অজগরকে বড়াে ভয়। সে-ভয় আসলে তাদের একান্ত হীনমন্যতা ও অপরাধবােধজাত । বাস্তবে ওই সব মালিকানার শবব্যবচ্ছেদের কোনােই সম্ভাবনা ছিলাে না। তবু, ভারতের সাহায্য নিয়ে পাকিস্তান ভেঙে যে বাংলাদেশ তৈরি করা হবে সে-বাংলাদেশে হুড়মুড় করে দেশত্যাগী হিন্দুরা এসে ঢুকে পড়বে, তাদের পরিত্যক্ত বাড়িঘরগুলাে পুনর্দখল করে নেবে, মুসলমানদের ফকির বানিয়ে ছাড়বে—আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের শুরুতেই প্রবীণ প্রজন্মের কিছু লােকের মনে এ-ধরনের এক স্বকপােলকল্পিত ভীতি বাসা বেঁধেছিলাে। এই ভীতিই তাদের মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে দাঁড় করিয়ে দেয়, পাকহানাদার বাহিনীর দালালি করতে প্ররােচিত করে, তথাকথিত শান্তি কমিটি গঠনের দুর্বুদ্ধি জোগায়।
পাক হানাদাররা যে-সময়ে বাংলাদেশের শহরগুলােকে দখল করে নেয় সে-সময়ে আওয়ামী লীগ-ন্যাপ-কম্যুনিস্ট-ছাত্রলীগ-ছাত্র ইউনিয়নের নেতাকর্মিরা শহর ছেড়ে দেশের অভ্যন্তরে ও দেশের বাইরে ছড়িয়ে পড়েছেন মুক্তিযুদ্ধ সংগঠনের কাজে, হিন্দুদের মুষ্টিমেয় কিছু লােক বাদে সবাই শহর ছাড়া। সেই সুযােগ বা দুর্যোগেই শহরে পাক হানাদারদের ছত্রছায়ায় একদল মুক্তিযুদ্ধবিরােধী ও পাকিস্তান সহযােগী দালালের সৃষ্টি। শহর ছেড়ে যাওয়া মানুষদের পরিত্যক্ত বাড়িঘর ও দোকানপাটগুলাে দখল করে নেয় ওই সব দালাল ও তাদের আত্মীয়স্বজনেরা। লুটের মালে তাদের ঘর ভরে যায়।
এ-রকমটি ঘটেছে ছােটো বড়াে প্রায় সব শহরেই, কোনাে কোনাে থানা সদরেও। তবে প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলে, যেখানে পাকসেনারা প্রবেশ করতে পারেনি, সেখানকার অবস্থা ছিলাে অন্যরকম। সেখানে কোনাে সক্রিয় দালাল গােষ্ঠীর সৃষ্টি হতে পারে নি, লুটেরা দলের দৌরাত্ম দেখা যায়নি। তবু, পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা ও হিন্দুদের দেশত্যাগের কল্যাণে গ্রামে যারা সম্পত্তিবান হয়েছিলাে তারাও শহুরে সম্পত্তিবানদের মতােই ‘যাহারে পেয়েছি তারে কখন হারাই’র দুর্ভাবনায় আক্রান্ত হয়ে পড়েছিলাে। কারণ, হিন্দু জমিদার-তালুকদার-জোতদার-মহাজনরা দেশছাড়া হওয়ার পর এরাই তাে হয় গ্রামের ‘পাওয়ার এলিট’ । গ্রামে প্রতিষ্ঠিত হয় এদেরই নিরঙ্কুশ রাজত্ব। হিন্দু ব্রাহ্মণের স্থান দখল করে এরাই হয় নয়া আশরাফ’, ‘আতরাফ মুসলমানের প্রতি এরা আচরণ করতে থাকে শূদ্রের প্রতি ব্রাহ্মণদের মতােই। পাকিস্তান জিন্দাবাদ’ ছিলাে তাদের শাসন-শােষণকে আড়াল করে রাখার মােহিনী মন্ত্র । আর এখন দেখা যাচ্ছে হঠাৎ গাঁয়ের কৃষক-ক্ষেতমজুররাও ‘পাকিস্তান জিন্দাবাদ’-এর বদলে ‘জয়বাংলা’ মন্ত্র জপতে শুরু করেছে। পাকিস্তানের আসল মজা যারা বিনা বাধায় লুটে এসেছে এতােদিন ধরে, তাদের কানে জয়বাংলা’ ধ্বনি তাে বিষের মতােই লাগবার কথা। লেগেছেও সেই রকমই। তাই, ভাটি এলাকার কোনাে এক গ্রামেও সাধারণ কৃষকের মধ্যে যখন মুক্তিযুদ্ধের প্রতি অকুণ্ঠ ও দ্ব্যর্থহীন সমর্থন দেখেছি, তখন সেই গ্রামের এক ব্যাপারীকে দেখেছি ভিন্ন অবস্থানে। একাধারে জোতদার ও ব্যাপারী এই মানুষটি তার জনমজুর ও কামলাদের কাছে প্রায় স্বগতােক্তির মতাে করে ক্ষোভের কথাগুলাে প্রকাশ করেছে। বলেছে, খুব তাে মুক্তিযুদ্ধ মুক্তিযুদ্ধ কইরা লাফাইতাছ। মজাডা টের পাইবা পরে। বাড়ি-সম্পত্তি ফালাইয়া রাইখ্যা এই দেশ থেইক্যা যে হিন্দুরা হিন্দুস্থানে চইল্যা গেছে, হ্যারা যখন ফিইর্যা আইয়া হেইগুলার দখল লইবাে, তখন বুঝবা জয়বাংলা কারে কয়। হ্যাই আগের মতন অবস্থা অইবাে। আগে কুনাে দিন হিন্দু বাড়ির আশপাশ দিয়া কুনাে মুসলমানরে জুতা পায় দিয়া ছাতি টাঙাইয়া যাওনের
৩৮১
দিতাে? অহনও হ্যাই রকম অইবাে। পাকিস্তান না থাকলে সব মুসলমানেরই হিন্দুর গােলাম অইয়া থাকন লাগবাে।’
এ-সব উদ্ভট ও কাল্পনিক আশঙ্কার কথায় পাত্তা দেয়নি নতুন প্রজন্মের মুসলমান তরুণরা। শহরে যেমন দেখেছি, গ্রামের তরুণদের মধ্যেও স্বাধীনতা সম্বন্ধে সেই একই রকমের আবেগের প্রকাশই দেখলাম। তবে ছাত্র-তরুণদের সকল গােষ্ঠীর মধ্যে সে-আবেগের প্রকৃতি ও প্রকাশে ঐক্য ছিলাে—এমন কথা বলা যাবে না। বিশেষ করে ছাত্রলীগ ও ছাত্র ইউনিয়ন—এই দু’দলের দৃষ্টিভঙ্গির পার্থক্য ও সে-পার্থক্যজনিত রেশারেশি অনেক ক্ষেত্রেই শােভনতার মাত্রা ছাড়িয়ে গিয়েছিলাে। ছাত্রলীগের ছেলেরা একটু বেশিমাত্রায় উগ্রতা নিয়ে নিজেদেরকে স্বাধীনতা সংগ্রামের পাইওনিয়ার বলে দাবি করছিলাে, আর ছাত্র ইউনিয়নকে চিহ্নিত করেছিলাে কম্যুনিস্ট অর্থাৎ রাশিয়ার দালাল বলে। ছাত্র ইউনিয়নের দৃষ্টিতে ছাত্রলীগের ছেলেরা ছিলাে স্কুল ও অমার্জিত, শ্রেণীদৃষ্টি-বর্জিত উগ্র জাতীয়তাবাদের ধারক ও সাম্রাজ্যবাদের তল্পিবাহী। ছাত্রলীগের ছিলাে বঙ্গবন্ধু মুজিবের নেতৃত্বের প্রতি সমালােচনাহীন দৃঢ় আস্থা, ছাত্র ইউনিয়ন শেখ মুজিবকে মানলেও তাঁর সম্পর্কে তাদের সমালােচনাও কম ছিলাে না। জয়বাংলা’ স্লোগান নিয়েও ছাত্র ইউনিয়নের দ্বিধা ছিলাে, এ-স্লোগানটির বিপরীতে তারা চালু করতে চেয়েছিলাে জয় সর্বহারা’। গ্রামে গিয়ে শুনেছি, মার্চের শুরুতে নাকি এই নিয়ে ছাত্রলীগ-ছাত্র ইউনিয়নের মধ্যে ছােটোখাটো একদফা সংঘর্ষও হয়ে গেছে। ছাত্রলিগাররা মিছিলে জয়বাংলা’ ধ্বনির সঙ্গে জোরেশােরে বলেছে, তােমার নেতা আমার নেতা—বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব’, ‘এক নেতা এক দেশ—বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশ। ছাত্র ইউনিয়নের ছেলেদের মতে, এ-ধরনের স্লোগানে আছে ফ্যাসিবাদের গন্ধ। তারা কোনাে এক নেতার নামে জিগির তুলতে রাজি নয়। আবার, এর বিপরীতে কোন স্লোগানটি জুৎসই হবে তাও ঠিক করতে পারছিলাে না। একদিন তারা মিছিলে স্লোগান দিলাে ‘তােমার নেতা আমার নেতা—এই দেশেরই বীর জনতা। প্রায় অর্থহীন স্লোগান। এই নিয়েই দু’দলে প্রথমে কথা কাটাকাটি, তারপর হাতাহাতি। মুক্তিযুদ্ধ যখন পুরােপুরি একটা নির্দিষ্ট রূপ নেয়নি, তখনই ছাত্রলীগ-ছাত্র ইউনিয়ন এরকম অর্থহীন বিবাদে লিপ্ত হয়ে গিয়েছিলাে শুনে আমার খুবই দুঃখ লাগলাে। এ-নিয়ে আমার বন্ধু শাহিদের সঙ্গে আলাপ করলাম।
শাহিদ প্রকাশ্যে কেন্দুয়া থানা ন্যাপের সেক্রেটারি হলেও তার সঙ্গে গােপন কম্যুনিস্ট পার্টির সম্পর্কের কথা আমার জানা ছিলাে। তাই মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে কম্যুনিস্ট পার্টির সর্বশেষ মূল্যায়নের কথাটি তাকে স্মরণ করিয়ে দিলাম। এবং ছাত্রলীগ-ছাত্র ইউনিয়নের এ-রকম অবাঞ্ছিত দ্বন্দ্ব নিরসনে তারা কী করেছে তা জানতে চাইলাম।
শাহিদের সঙ্গে কথা বলে বুঝলাম যে, ছাত্রলীগ-ছাত্র ইউনিয়নের দ্বন্দ্বের বিষয়টি অনেক জটিল ও গভীর। আসলে স্বাধীনতা ও রাষ্ট্রনীতি সম্পর্কে দুটি ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গির দ্বন্দের বহিঃপ্রকাশই ঘটেছে এই দুই তরুণ ছাত্রগােষ্ঠীর দ্বন্দ্বের মধ্যে। ছাত্রলীগের মূল পৃষ্ঠপােষক রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগের মেনিফেস্টোতে যদিও সমাজতন্ত্রের কথা ছিলাে, ছিলাে সাম্রাজ্যবাদ-বিরােধী নিরপেক্ষ বৈদেশিক নীতির কথা এবং এর ফলে ছাত্র ইউনিয়ন তথা বামপন্থী রাজনৈতিক গােষ্ঠীগুলাের সঙ্গে এর ব্যবধান খুবই কমে এসেছিলাে, তবু আওয়ামী লীগের অধিকাংশ নেতাকর্মী রক্ষণশীল অবস্থানটিকেই ধরে রেখেছিলেন। সে-কারণেই কোনাে বামপন্থীকেই তারা সহ্য করতে পারতেন না। দ্বন্দ্বের মূলটি এখানেই। সে-দ্বন্দ্ব শুধু চিহ্নিত বামপন্থীদের সঙ্গেই নয়। আওয়ামী লীগের একেবারে ভেতর মহলেও যে চরম অন্তর্দ্বন্দ্ব ছিলাে,
৩৮২
সে কথাও আজ আর গােপন নেই। এছাড়া বামপন্থীরাও যে পুরােপুরি সংকীর্ণতামুক্ত ছিলাে, তাই বা কে বলবে? ছাত্র ইউনিয়নের ছেলেরা পড়াশােনায় অনেকখানি অগ্রসর বলে তাদের মধ্যে এ-নিয়ে এক ধরনের অহমিকা তথা সুপিরিয়রিটি কমপ্লেক্স’ও ছিলাে। এর ফলে ছাত্রলীগের সঙ্গে তাদের ব্যবহারে অবজ্ঞা ও তুচ্ছতাচ্ছিল্যের ভাবটি সহজেই প্রকাশ হয়ে পড়তাে। অন্যদিকে পেশীশক্তি প্রদর্শনে ছাত্রলীগের তুলনায় তাদের নৈপুণ্য ছিলাে খুবই কম। তাছাড়া দুয়ের মধ্যেই তরুণ সুলভ অসহিষ্ণুতা ও অপরিপক্কতা তাে ছিলােই।
এইসব কারণে মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষ শক্তির মধ্যেকার ডানবাম দ্বন্দ্বের পুরাে মীমাংসা কখনাে হয়নি। এ দ্বন্দ্বের নানামুখী প্রকাশ যে মুক্তিযুদ্ধের ভাবমূর্তিতেও কালাে রঙের ছােপ লাগিয়েছে—সে-কথা অস্বীকার করার উপায় নেই।

ক্ষয়িষ্ণু হিন্দু ও একাত্তরের বাংলাদেশ
একাত্তরের এপ্রিল-মে মাসে আমাদের এলাকার গ্রামে গ্রামে ঘুরেছি। ঘুরে ঘুরে নানা স্তরের মানুষের চিন্তাচেতনার পরিচয় নিতে চেষ্টা করেছি, বুঝতে চেষ্টা করেছি গ্রাম-সমাজের রূপান্তরের প্রক্রিয়াটিও। সেই সঙ্গে পূর্বেকার অবস্থা ও অবস্থানের সঙ্গে বর্তমানের তুলনাও করেছি মনে মনে। স্মৃতিতে ভেসে উঠেছে আমার শৈশব ও কৈশােরের দিনগুলাে।
রূপান্তর তাে সমাজের সব স্তরেই হয়েছে, তবে সর্বত্র সেটি একই ধরনের হয়নি। বর্ধিষ্ণুতা ও ক্ষয়িষ্ণুতা—দুটোই রূপান্তর-প্রক্রিয়া হলেও একটি সদর্থক, অন্যটি নঞর্থক। একাত্তরে দেখলাম : সম্প্রদায়গত বিচারে গ্রামের হিন্দুরা সবাই নঞর্থক রূপান্তর প্রক্রিয়ার অধীন, সব হিন্দু পরিবারের অবস্থানই চরম ক্ষয়িষ্ণু। এ-রকমটি অবশ্যই একদিনে ঘটেনি। ছেলেবেলা থেকেই যে এই ক্ষয়িষ্ণুতার সূচনা ও ক্রমপরিণতি আমি দেখে এসেছি—সে-কথা আমার এই পাকিস্তানের জন্মমৃত্যু-দর্শন-এ বহুবারই স্মরণ ও উত্থাপন করেছি। বিশেষ করে পঞ্চাশের দাঙ্গার আগে-পরে হিন্দুদের বাস্তব অবস্থা ও মানসিক প্রবণতা কেমন দাঁড়িয়েছিলাে, নিজ বাসভূমে পরবাসী হয়ে কেমন করে তাদের ভেতর বহিঃরাষ্ট্রীয় আনুগত্য বাসা বেঁধেছিলাে, সে সবের বিস্তারিত বর্ণনাই দিয়েছি। তবু একাত্তরে গ্রামে গিয়ে হিন্দুদের অবস্থা দেখে আমি বিষয়টির যে-রকম বিশ্লেষণ করেছিলাম সেটিকেই স্মৃতি থেকে আবার তুলে নিয়ে আসছি।
পাকিস্তানের জন্ম হয়েছিলাে মুসলমানের রাষ্ট্র রূপে। মুসলমানরা একটা আলাদা জাতি’–এই থিয়ােরিকে ভিত্তি করে যে তথাকথিত জাতিরাষ্ট্রের জন্ম, সে রাষ্ট্রে মুসলমান ছাড়া অন্যরা যে নিতান্তই ফালতু কিংবা করুণার পাত্র, সে-কথা বােঝার জন্যে খুবই বেশি বুদ্ধির প্রয়ােজন পড়ে না। পাকিস্তানের জনক জিন্নাহ সাহেবের সেই ফালতু কথা-“আজ থেকে হিন্দু আর হিন্দু থাকবে না, মুসলমান আর মুসলমান থাকবে না’ ইত্যাদি নিয়ে রাজনীতিকরা নানা ধরনের কৌশলগত মাতামাতি করেছেন বটে, কিন্তু গ্রাম বা শহরের হিন্দু জনসাধারণের চিত্তে পাকিস্তানকে আপন দেশ বলে ভাবতে পারার মতাে পরিস্থিতির সৃষ্টি কখনাে হয়নি। বরং এ রকম পরিস্থিতির সৃষ্টি যাতে না হতে পারে রাষ্ট্রীয় ভাবে সব সময় সে-রকম ব্যবস্থাই চালু রাখা হয়েছে। চুয়ান্ন সালের নির্বাচনে যুক্তফ্রন্টের বিজয়ে হিন্দুরাও সামান্য কিছুদিনের জন্যে আশার একটা ক্ষীণ আলাের রেখা দেখলেও দু’মাস যেতে-না-যেতেই ৯২ (ক) ধারার গভর্নরি শাসন জারি হলাে যখন, তখনই তাদের চোখের সামনে সে-আলাে নিভে গিয়েছিলাে। সাতচল্লিশ সাল
৩৮৩
থেকেই হিন্দুরা দেশান্তরী হচ্ছিলাে। দেশত্যাগের গতিবেগ কখনাে বাড়তাে, কখনাে কিছু কম থাকতাে, পুরােপুরি বন্ধ থাকেনি কোনােদিনই।
তবে, গ্রামের তথাকথিত নিম্নবর্ণের হিন্দুদের দেশত্যাগে প্রবল অনীহা বরাবরই লক্ষ করেছি। তবু অনীহা সত্ত্বেও, একেক সময় দল বেঁধে তারা দেশ ছেড়েছে। মূলত যারা হিন্দু কৃষিজীবী তারা দেখেছে : হিন্দু বাবুদের জমি হাতছাড়া হয়ে যে মুসলমানদের হাতে যাচ্ছে সেই মুসলমানরা নিজেরাই চাষবাদের কাজে দক্ষ, তাদের কাছ থেকে জমি বর্গা পাওয়ার কিংবা তাদের ক্ষেতে মজুরের কাজ করার কোনাে সুযােগ নেই। খোঁজ নিয়ে তারা জানতে পেরেছে যে, ভারতের আসামে আর কুচবিহারে প্রচুর অহল্যা ভূমি আছে এবং সেখানে কৃষি-মজুরের বড়াে অভাব। তাই দেখা গেছে, আমাদের এলাকার কৃষিজীবী হিন্দুরা পাকিস্তান সৃষ্টির কয়েক বছরের মধ্যেই মূলত আসাম ও কুচবিহারেই পাড়ি জমিয়েছে। মধ্যস্বত্বভােগী উচ্চবিত্তের শিক্ষিত হিন্দুদের চাকরি-বাকরির সূত্রে আগে থেকেই কোলকাতার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিলাে। তারা আস্তে আস্তে সপরিবারে সেদিকেই চলে গেলাে। যারা কৃষিজীবীও নয়, আবার সচ্ছলতারও কমতি যাদের, ছােটোখাটো ব্যবসা ও সামান্য ভূসম্পত্তির ওপর নির্ভরশীল যারা, বিপদ ঘটলাে তাদেরই। পাকিস্তানে যে থাকা যাবে না, এ-বিষয়ে তারা প্রায় নিঃসংশয়। কিন্তু বােধগম্য কারণেই, দেশ ছেড়ে যাওয়ার বা ভিন দেশে গিয়ে সুস্থির হওয়ার যে উপায় নেই। তবে যেতে যখন হবেই, তার জন্যে প্রস্তুতি নেয়া দরকার। সে প্রস্তুতির মধ্যে ছিলাে :
প্রথমত, পরিবারের কোনাে সদস্যকে ভারতে পাঠিয়ে দিয়ে সেখানে একটা ঠিকানা তৈরি করা এবং সেই ঠিকানায় এ-ভাবে সে-ভাবে কিছু টাকা-পয়সা পাঠিয়ে সেখানে ঠাই নেয়ার একটা ভিত্তি নির্মাণ করে রাখা।
দ্বিতীয়ত, নিজেদের সন্তানদের লেখাপড়ার প্রতি মনােযােগী করে তােলা, কারণ এই লেখাপড়াই (অর্থাৎ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ডিগ্রি-ডিপ্লোমা) হতে পারে প্রায় নিঃস্ব মানুষগুলাের। বৈষয়িক জীবনের তথা জীবিকার প্রধান পুঁজি, এই পুঁজি নিয়েই দেশান্তরে গিয়েও টিকে থাকার একটা উপায় হয়তাে খুঁজে পাওয়া যেতে পারে।
একটা রাষ্ট্রের কোনাে বিশেষ সম্প্রদায়ের মানুষের এ-রকমভাবে দেশত্যাগের প্রস্তুতি গ্রহণ কি ন্যায়সঙ্গত? এতে কি জন্মভূমির প্রতি সম্প্রদায়গতভাবেই বিশ্বাসঘাতকতা করা হয় না?
চব্বিশ বছর ধরে পাকিস্তানের হিন্দুদের সম্পর্কে এ-রকম প্রশ্ন যে একান্ত মােলায়েমভাবে উত্থাপন করা হয়েছে, তা নয়। এ সব প্রশ্নের সঙ্গে আরাে আরাে অনেক উদ্ভট অভিযােগ তুলে তাদের সর্বক্ষণ আসামীর কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে রাখা হয়েছে। তারাও সাধারণভাবে বিনা প্রতিবাদে মুখ-বঁজে এসব অভিযােগের লড়াঘাত সহ্য করে গেছে। অভিযােগকারীদের ন্যায়নিষ্ঠা কিংবা দেশপ্রেমের অকৃত্রিমতা নিয়ে পাল্টা প্রশ্ন উত্থাপনের ধৃষ্টতা তারা দেখায়নি। জলে বাস করে কুমিরের সঙ্গে বিবাদ না করার বাস্তব বুদ্ধি তাদের ছিলাে।
এভাবে-সেভাবে টাকা-পয়সা পাঠানাে’টা যে বেআইনি পথে দেশের টাকা বিদেশে পাচার করা এবং এই কাজটি করে এদেশের হিন্দুরা যে দেশদ্রোহিতার পরিচয় দিচ্ছে, এ-অভিযােগটা পাকিস্তান আমলে প্রায়ই তাদের বিরুদ্ধে তােলা হতাে। কিন্তু মজার কথা হচ্ছে যে, এই অভিযােগ যারা করতেন তারাই অনেকে ছিলেন এই দেশদ্রোহী কাজে হিন্দুদের সক্রিয় সহযােগী এবং তারা ছিলেন সে-সময়কার পূর্ব পাকিস্তানের শাসকগােষ্ঠীর পৃষ্ঠপােষকতা ধন্য প্রতিপত্তিশালী মানুষ। সহজে জলের দামে বাড়ি-সম্পত্তি পাওয়ার জন্যেই অনেক হিন্দুর
৩৮৪
‘দেশদ্রোহী’ কাজে ছিলাে তাদের সক্রিয় সহযােগিতা। শােনা গেছে, ওই সব স্বঘােষিত দেশপ্রেমিকদেরই অনেকে অনেক হিন্দুকে নিরাপদে দেশের সীমান্ত পার করে দিয়েছেন এবং তার পেছনে যে সক্রিয় ছিলাে প্রচণ্ড স্বার্থবুদ্ধি—সে-কথা বলাই বাহুল্য। সেই স্বার্থবুদ্ধি থেকেই যে তারা অনেক হিন্দুকে প্রথমে দেশত্যাগে উৎসাহিত ও পরে বাধ্য করেছেন, তাও মিথ্যে নয়।
এ-দেশের জনগণের অর্থে পরিচালিত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে শিক্ষা নিয়ে হিন্দু তরুণরা দেশের মানুষের সেবা করার কোনে দায়িত্ব বােধ করে না, তারা তাদের মেধা ও শিক্ষাকে কাজে লাগায় ভিন্ন দেশের সেবায়। দেশদ্রোহিতার এরচেয়ে বড়াে প্রমাণ আর কী থাকতে পারে?
এ অভিযােগেরও জবাব দেয়ার সুযােগ অভিযুক্তরা কোনােদিন পায়নি, কিংবা সে সুযােগ চায়ওনি। শিক্ষা শেষে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা যে পাকিস্তানের হিন্দুদের জন্যে একান্ত সংকুচিত করে রাখা হয়েছিলাে, দিনের আলাের মতাে স্পষ্ট এই সত্যটি সকলেরই জানা ছিলাে, কিন্তু বলতে ছিলাে মানা। আর দেশত্যাগী বা ত্যাগে শিক্ষিত তরুণদের দেশদ্রোহী বলার ফ্যাশন যারা রপ্ত করেছিলাে তারা কি আসলেই চাইতাে যে মুসলমানের রাষ্ট্র পাকিস্তানে চাকরি-বাকরির ক্ষেত্রে ব্রিটিশ আমলের মতােই হিন্দুরা শক্তিশালী প্রতিদ্বন্দ্বী রূপে অবস্থান করুক?
প্রশ্নটির উত্তর নিশ্চয়ই—না’।
তাই মুখে যারা অভিযােগের তুবড়ি ছােটাতাে তারা যে আসলে হিন্দুদের দেশত্যাগের প্রস্তুতি প্রক্রিয়ায় ছিলাে ভীষণ খুশি—এই হচ্ছে ওপেন সিক্রেট।
অথচ এরপরও, অনেক হিন্দুর পক্ষেই এ-ধরনের প্রস্তুতি নেয়ারও কোনাে সামর্থ্য ছিলাে । তবু, তারাও পারেনি জন্মভূমিকেই চিরকালের আপন ভূমি ভেবে শিকড় বিস্তার করে অবস্থান করতে। বাস্তবে না হলেও মানসিকভাবে এরা উদ্বাস্তুই হয়ে গিয়েছিলাে। দেশত্যাগের সুযােগ, সংগতি বা সম্ভাবনা কোনােটাই যাদের ছিলাে না, তারাও এদেশে ছন্নছাড়া ও লক্ষ্মীছাড়ার মতাে বাস করতাে। যে সব ক্ষেত্রে বাস্তবে কোনাে সমস্যাই ছিলাে না, সে সব ক্ষেত্রেও কাল্পনিক ভীতি তাদের অধিকার করে রাখতাে, মানসিক স্বাস্থ্যই তাদের নষ্ট হয়ে গিয়েছিলাে। একেই বলে মাইনােরিটি কমপ্লেক্স’।
গ্রামে খুব কম হিন্দুকেই নতুন জমি কিনতে দেখা যেতাে, বিক্রি করতে প্রায় সবাই। যদিও জমি বিক্রি করাটাও হিন্দুদের জন্যে মােটেই ঝামেলামুক্ত ছিলাে না। ইচ্ছেমতাে যে কারাে কাছে উচিত মূল্যে জমি বিক্রি করা হতাে তাদের পক্ষে অসম্ভবই ছিলাে। আইনি-বেআইনি নানা বাধা অতিক্রম করতে হতাে নিজেদের পৈতৃক সম্পত্তি বিক্রি করতেও এবং শেষ পর্যন্ত গ্রাম বা অঞ্চলের বিশেষ বিশেষ প্রভাবশালী ব্যক্তি বা গােষ্ঠীর লােভের কাছে নতি স্বীকার করে নামমাত্র মূল্যে সম্পত্তি হস্তান্তর করতে হতাে। পঁয়ষট্টিতে শত্রু সম্পত্তি আইন জারি হওয়ার পর তাে অবস্থা হলাে আরাে জটিল ও করুণ।
নতুন জমি কেনা তাে দূরের কথা, বাড়িতে একটা গাছ লাগাতে কিংবা নতুন একটা ঘর বানাতেও পাকিস্তানি হিন্দুদের কোনাে উৎসাহ ছিলাে না। অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের সম্প্রসারণের বদলে কেবল ‘দিনগত পাপক্ষয় করে যাওয়াই হয়ে গিয়েছিলাে তাদের জীবননীতি ও জীবনদর্শন। এ-রকম জীবনে সদর্থক রূপান্তরের কোনাে সম্ভাবনাই থাকে না, ক্ষয়িষ্ণুতারই সম্প্রসারণ ঘটতে থাকে শুধু।
আমাদের রামপুর, চন্দপাড়া, দলপা, চন্দনকান্দী, ভগবতীপুর—এই সব গ্রামে অনেক হিন্দুর বাস ছিলাে, তবে তাদের মধ্যে বিশাল মধ্যস্বত্বভােগী কিংবা বড়াে জোতদার কেউ ছিলাে
৩৮৫
না। বাংলাদেশের গ্রামগুলােতে বসতির বিন্যাস ছিলাে মূলত গােষ্ঠীকেন্দ্রিক। বিভিন্ন বৃত্তিজীবীদের নিয়ে আলাদা আলাদা পাড়া গড়ে উঠতাে। পাশাপাশি হিন্দুপাড়া ও মুসলমানপাড়ার অবস্থান ছিলাে, কিন্তু হিন্দুপাড়ার একেবারে ভেতরে কোনাে মুসলমানের বাড়ি কিংবা মুসলমানপাড়ায় কোনাে হিন্দুবাড়ি সাধারণত থাকতাে না। পাকিস্তান সৃষ্টির পর গ্রামের লােকবসতির এ বিন্যাসটি আস্তে আস্তে ভেঙে যেতে লাগলাে। যে বাড়ির হিন্দুরা দেশান্তরিত হলাে তাদের বাড়িটিতে হয়তাে হলাে ভিনগায়ের কোনাে মুসলমানের বসতি—একেবারে হিন্দুপাড়ার ভেতরে। প্রথম প্রথম এতে ভীষণ অস্বস্তি বােধ করেছে আশপাশের বাড়ির হিন্দুরা। তারপরে সবই সয়ে গেছে। একাত্তরে দেখলাম রামপুরের অক্ষয় সরকারের বাড়ির দু’পাশেই মুসলমান বাড়ি। সরকার পরিবারের সদস্যদের জিজ্ঞেস করলাম, মুসলমান বাড়ির পাশে থাকতে আপনার অসুবিধে হয় না? তারা সকলে প্রায় সমস্বরে জবাব দিলেন, একদম না। বরং মুসলমান পড়শিরা বিপদে-আপদে আমাদের পাশে যেভাবে এসে দাঁড়ায় সেভাবে আমাদের হিন্দু পড়শিরা কখনাে দাঁড়াতাে না।
এরপর তারা মুসলমান প্রতিবেশীদের সৎ প্রতিবেশী সুলভ আচরণের অনেক বাস্তব দৃষ্টান্ত আমার সামনে তুলে ধরলেন। এর সঙ্গে প্রতিতুলনা করে দেখালেন পূর্বেকার হিন্দু প্রতিবেশীদের সংকীর্ণতাদুষ্ট ব্যবহারের।
এ-রকম কথা অন্য গ্রামের হিন্দুদের মুখেও শুনেছি। প্রায় সকলেই বলেছেন যে, মুসলমান প্রতিবেশীর সঙ্গে বাস তাদের অনেক স্বাচ্ছন্দ্য ও নিরাপত্তা দিয়েছে।
তবু যে পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রযন্ত্রটি তাদের সতত অস্বচ্ছন্দ ও অনিরাপদ করে রেখেছে, সেটিই হচ্ছে মর্মান্তিক সত্য। একটি কৃত্রিম রাষ্ট্রের অমানবিক রাষ্ট্রনীতিই তাদের এই মর্মান্তিক সত্যের শিকার বানিয়েছে, সহৃদয় প্রতিবেশীর সহমর্মিতা রাষ্ট্রিক ভেদনীতির হাত থেকে তাদের বাঁচাতে পারেনি। সেই ভেদনীতিকে সফল করে তােলার জন্যে প্রতিটি গ্রামে ও শহরেই ছিলাে রাষ্ট্রশক্তির সহায়তাপুষ্ট বরকন্দাজরা। সংখ্যায় ওরা লঘু হলেও তাদের ক্ষমতার দাপট ও পৈশাচিক লােভই সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের সহৃদয়তাকে কোণঠাসা করে রেখেছে। এভাবেই বাংলার মাটিতে চব্বিশটি বছর ধরে পাকিস্তান বেঁচে রয়েছে।
অক্ষয় সরকারের ছেলে অনিল রামপুর প্রাইমারি স্কুলে আমার নিচের ক্লাসে পড়তাে। পড়াশােনা তার বেশিদূর এগােয়নি। এখন সে পেটের তাগিদে শহরে এক মিষ্টির দোকানে চাকরি নিয়েছে। এপ্রিলের শুরুতেই সেও শহর ছেড়ে চলে এসেছে। অনেকদিন পরে তার সঙ্গে অন্তরঙ্গ আলাপ মেতে উঠলাম। অনিলের কথায় কেবলই হতাশা আর বেদনার বিচ্ছুরণ।
অনিলের ঠাকুরদা (অর্থাৎ পিতামহ) অমর সরকার ছিলেন একজন মহাজন। অক্ষয় সরকার তারই একমাত্র পুত্র। অমর সরকার পুত্রের জন্যে মােটামুটি ভালােই বিষয় সম্পত্তি রেখে গিয়েছিলেন। কিন্তু কথায় বলে বসে বসে খেলে কুবেরের ভাণ্ডারও ফুরিয়ে যায়। অক্ষয় সরকারেরও হলাে সেই দশা। অমর সরকারের মৃত্যুর কয়েক বছর পরই জন্ম হলাে পাকিস্তান রাষ্ট্রের। শুরু হলাে হিন্দুদের অস্থিরতা। অন্যদের সঙ্গে হিন্দু মহাজনরাও অনেকেই দেশ ছেড়ে চলে গেলাে। যারা যেতে পারলাে না তারাও ব্যবসা গুটিয়ে ফেললাে। পুরােপুরি ঘটালাে না যারা তারাও ব্যবসার সম্প্রসারণ বন্ধ করে দিলাে। বেখৈরহাটি বাজারে যে বিরাট দোকান ঘরটি ছিলাে অমর সরকারের, পুত্র অক্ষর সরকার তা হস্তান্তরিত করে দিলেন। কী আর হবে এদেশে দোকানপাট রেখে? চলেই তাে যাবাে।’—সাতচল্লিশ-আটচল্লিশ সাল থেকে যার মুখে এ রকম
৩৮৬
কথা শুনে এসেছি, সেই অক্ষয় সরকার একাত্তরেও পাকিস্তানেই রয়ে গেলেন। একাত্তরের এপ্রিল-মে মাসে যখন সব হিন্দুই সীমান্ত পাড়ি দেয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে তখন অক্ষয় সরকারের বােধশক্তিই প্রায় লুপ্ত হয়ে গেছে। বিনা চিকিৎসায় দীর্ঘদিন ধরে ডায়াবেটিসে ভুগে তিনি মৃত্যুপথযাত্রী, কেবল ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকেন, কোনাে প্রশ্নের উত্তর দিতে পারেননি। সাতচল্লিশ সাল থেকেই তিনি একটু একটু করে পৈতৃক সম্পত্তি হস্তান্তর করে করে পরিবারের অন্নবস্ত্রের সংস্থান করেছেন, তিন তিনটি মেয়ের বিয়ে দিয়েছেন, একজন মেয়ে-জামাইকে দীর্ঘদিন সপরিবারে তার বাড়িতে রেখে পুষেছেন। এই করে করে বর্তমানে তার নিঃস্বতা এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, সীমান্ত পাড়ি দেয়ার পাথেয় জোগাড় করাই তার পক্ষে অসম্ভব।
অনিল বললাে, “পাকিস্তানি মিলিটারি আর রাজাকাররা মেরে ফেললেও আমাদের এখানেই থেকে যেতে হবে।…তােমরা যাও ভাই। আমাদের জন্যে আশীর্বাদ রেখাে।…যদি বেঁচে থাকি, আর যদি দেশ স্বাধীন হয়, তবে ফিরে এসে আমাদের আবার দেখা পাবে।’
অনিল যে এতাে গুছিয়ে এ-রকম করুণ কথা বলতে পারে, আমার ধারণা ছিলাে না।
তবে, তার কথা সত্য হয়েছিলাে। রামপুর ও আশপাশের প্রায় সব হিন্দুই সীমান্ত পাড়ি দিলেও অনিলরা গায়ে থেকে গিয়েছিলাে। আমিও এর প্রায় সাড়ে তিন মাস পরে বাবা ও ঠাকুরমাকে নিয়ে দেশ ছেড়েছিলাম। এক সময় দেশ শত্রুমুক্ত স্বাধীন হয়েছিলাে। কিন্তু অনিলের বাবা অক্ষয় সরকারের স্বাধীনতা সংগ্রাম চলাকালে দেশের বাড়িতেই মৃত্যু হয়েছিলাে। মিলিটারি বা রাজাকারের হাতে নয়, রােগে ভুগে স্বাভাবিক মৃত্যু। মৃত্যুর পর পুত্র অনিল আর সুনীলই তার মুখাগ্নি করেছিলাে। তখন গ্রামে অনিলরা ছাড়া বােধহয় আর এক ঘর মাত্র হিন্দু ছিলাে—দিনমজুর রামচরণের পরিবার। তবু সনাতন হিন্দু প্রথা মতােই অক্ষয় সরকারের শেষকৃত্য সম্পন্ন হয়েছিলাে গাঁয়ের মুসলমানদের সহায়তায়।
উৎসবে, ব্যসনে, দুর্ভিক্ষে, রাষ্ট্রবিপ্লবে, রাজদ্বারে ও শ্মশানে যারা একসঙ্গে অবস্থান করে তারাই বান্ধব। সম্প্রদায়ের কৃত্রিম গণ্ডি ভেদ করেও মানুষ যে পরস্পরের এ-রকম বান্ধব হতে পারে, দ্বিজাতিতত্ত্বের পাকিস্তানের অন্তিম দিনগুলােতেও মানুষ তার প্রমাণ রেখেছে।

ক্ষয়িষ্ণুতার অন্ধকারে প্রগতির আলােকরেখা
পাকিস্তানের চব্বিশ বছর ধরে এদেশের হিন্দুরা যে কেবলই ক্ষয়িষ্ণু হয়ে চলেছে, জন্মভূমি যারা পরিত্যাগ করেনি বা করতে পারেনি তারাও যে বিদেশ ভূমিরই মানস বাসিন্দা হয়ে রয়েছে, দেশের রাজনৈতিক আলােড়ন-আন্দোলনে প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণের বদলে নিষ্ক্রিয় দার্শনিক’ হয়ে থাকটাই তারা পছন্দ করেছে—এ-সব কথা অবশ্যই সত্য। কিন্তু, মনে রাখা দরকার, সত্য কখনাে একমাত্রিক নয়। ভিন্ন ভিন্ন মাত্রাগুলাের দিকে দৃষ্টি না দিলে সত্য খণ্ডিত হয়ে যায়। আর খণ্ডিত সত্য তাে মিথ্যারই সহােদর।
যতােই ক্ষয়িষ্ণু বলি পাকিস্তানের হিন্দু সমাজকে, এই ক্ষয়িষ্ণুতার বিপরীত একটি শক্তির ক্ষীণধারাও যে ওই সমাজের ভেতরে ভেতরেই প্রবহমান ছিলাে সে-কথাও অস্বীকার করা ঠিক হবে না। মুসলমানদের মতাে হিন্দুদের মধ্যেও নবীন-প্রবীণের দ্বন্দ্ব ক্রিয়াশীল হয়ে উঠেছিলাে। প্রবীণ হিন্দুদের মধ্যেও যারা ব্রিটিশ আমল থেকে কংগ্রেসী বা বামপন্থী রাজনীতির সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত ছিলেন, দেশকে ভালােবাসতে গিয়ে যারা জেল খেটেছেন, তাদের সঙ্গে
৩৮৭
সাধারণ অরাজনীতিক হিন্দুদের একটা পার্থক্য তাে গােড়া থেকেই ছিলাে। পাকিস্তান রাষ্ট্রটির অস্তিত্ব মেনে নিয়েই এর স্বরূপ বদলিয়ে ফেলার দুঃসাহসী বাসনা পােষণ করতেন যারা, সেই কংগ্রেসী বা বামপন্থী রাজনীতিকরা নিজেদের হিন্দু পরিচয়কে মােটেই বড়াে মনে করতেন না। সে-রকম মনে করলে তাে পাকিস্তানে বাস করার চিন্তাই তারা করতে পারতেন না, রাজনীতি করা তাে অনেক দূরের কথা। এই ত্যাব্রতী ও আদর্শবাদী প্রবীণরা হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে তরুণদের একটা অংশের ওপর গভীর ও তাৎপর্যময় ইতিবাচক প্রভাব ফেলেছিলেন। সেপ্রভাবে মুসলমান তরুণ সমাজেই চেতনার রূপান্তর বেশি মাত্রায় হয়েছিলাে, এ-কথা ঠিক। তবে পাকিস্তানের ক্ষয়িষ্ণু হিন্দু সমাজের ভেতরে মহলেও যে সদর্থক ভাবনার একটা হাওয়া বয়ে গিয়েছিলাে, সে-কথাও অস্বীকার করা যাবে না। অধিকাংশ বাপ-কাকাই ছেলে-ভাইপােকে কলেজ ইউনিভার্সিটিতে পাঠান যে-উদ্দেশ্যে, সে-উদ্দেশ্যের সঙ্গে সংগতি রেখে-যে তরুণ শিক্ষার্থীরা সব সময় চলে না বা চলতে পারে না, সে তাে জানা কথাই। উনিশ শতকে কলকাতার নব্যধনী হিন্দুরাই উদ্যোগী হয়ে ‘হিন্দু কলেজ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। তাদের উদ্দেশ্যটা ছিলাে নিতান্তই বৈষয়িক। নিজেরা তাে অনেকেই ‘ইয়েস-নাে-ভেরিগুড’ জাতীয় কিছু শব্দ রপ্ত করে নিয়ে ইংরেজের সঙ্গে কোনাে রকমে যােগাযােগ রক্ষা করে তাদের বেনিয়ানমুৎসুদ্দি হয়েছেন, প্রভূত অর্থের মালিক হয়েছেন, হয়ে গেছেন হঠাৎ নবাব’। তবুও ভালাে করে ইংরেজি ভাষাটা আয়ত্ত করতে না পারার দরুণ সাহেবদের সঙ্গে পুরােপুরি ভাববিনিময় করা সম্ভব হয়নি বলে তাদের মধ্যে বেশ কিছু পরিমাণে হীনমন্যতাও বাসা বেঁধেছিলাে। তাদের ইংরেজি জ্ঞানকে বিদ্রুপ করে অনেক মুখরােচক গল্পও তৈরি হয়েছিলাে সে-সময়। তাই তারা তাদের ছেলেপুলেদের চৌকস ইংরেজিওয়ালা বানিয়ে তুলতে চেয়েছিলেন। নিজেরা ধনবান হয়েও ইংরেজ সমাজে সমান মর্যাদার আসনে যে বসতে পারেনি তারই ক্ষতিপূরণ হবে ইংরেজি-শিক্ষিত সন্তানদের দ্বারা হিন্দু কলেজের প্রতিষ্ঠা ও কলেজে সন্তানদের পাঠানাের পেছনে এ-রকম বাসনাই ক্রিয়াশীল ছিলাে। তাদের সে-বাসনা কিছু পরিমাণে পূরণ হয়েছিলাে অবশ্যই। তবে তারা যে রকম আশঙ্কা করেননি সে-রকম ঘটনাই বেশি পরিমাণে ঘটেছিলাে। হিন্দু কলেজে পড়া ছেলেরা একেকজন কালাপাহাড় হয়ে উঠেছিলাে। বাপ-কাকার হিন্দুত্বকেই তারা যেমন প্রত্যাখ্যান করে বসেছিলাে, তেমনি বাপ-কাকাদের ‘হঠাৎ নবাব’ হওয়ার নৈতিকতা-বিরােধী প্রক্রিয়াটিকেও তার ঘৃণা করতে শুরু করেছিলাে। বলা যেতে পারে, এই ‘ইয়ংবেঙ্গল’রা তাদের বাপ-কাকাদের প্রত্যক্ষ উদ্দেশ্যকে ব্যর্থ করে দিয়েছিলাে।
এমনটিই হয়, এ-রকমই বাস্তবের নিয়ম। এ-নিয়মই অনেক পরিমাণে কার্যকর হয়েছিলাে বিশ শতকের পঞ্চাশ-ষাটের দশকে পাকিস্তানের হিন্দুদের বেলাতেও। বিশেষ করে ষাটের দশকে। দেশত্যাগের প্রস্তুতি-প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে যে হিন্দু বাপকাকারা তাদের ছেলেভাইপােদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পাঠাতেন, তারা পই পই করে ওদের বলে দিতেন, “দেখাে হে বাপু, তােমাকে পড়তে পাঠানাে হয়েছে। ভালােভাবে পড়াশােনা করে পরীক্ষায় ভালােভাবে পাস করাই তােমার কাজ। নানান হুজুগে মেতে জীবনটাকে নষ্ট করাে না। রাজনীতিফাজনীতির ধারে কাছেও যেও না। এই দেশে রাজনীতি করে কী হবে আমাদের? পাকিস্তানের রাজনীতি তাে মুসলমানদের জন্যে। তারা কি এদেশে আমাদের মান-ইজ্জত নিয়ে থাকতে দেবে?…দেশ তাে ছাড়তেই হবে আমাদের। কিন্তু ভিন দেশে যাবে কী সম্বল নিয়ে? সেখানে গিয়ে খাবে কী করে? লেখাপড়া শিখলে ওটাই হবে একমাত্র সম্বল।…কাজেই নিজের বুঝটা বুঝতে চেষ্টা করাে বাপু।”
৩৮৮
অথচ, তারুণ্য কিন্তু কোনাে যুগেই অঙ্ক কষে কেবলই নিজের বুঝটা বুঝটা বুঝে নেয় না, পূর্বসূরির বেঁধে দেয়া পথ ধরে চলে না, কোনাে ছকেই বাঁধা পড়ে থাকে না। ছক ভেঙে বেরিয়ে আসতে গিয়ে কারাে কারাে অবশ্যই পা পিছলে যায়, গতির বদলে দুর্গতির পাঁকে তলিয়ে যায়, উদ্ভ্রান্তির জালে আটকা পড়ে যায়। এক কথায়, বখে যায়। তবে আরেক দল তরুণ পুরনাে ছকটা ভেঙে বেরিয়ে এসে নতুন ও অগতানুগতিক বিচরণ ক্ষেত্রকে বেছে নেয়। বাপদাদার পথ ছেড়ে তারা আলাদা পথ ধরে, প্রগতির অভিযাত্রী হয়।
পাকিস্তানের হিন্দু সমাজেও এ-ব্যাপারটি ঘটেছিলাে। কলেজ ইউনিভার্সিটিতে পড়তে আসা হিন্দু তরুণরা সবাই বাপ-কাকার বাসনা পূরণ করে নিতান্ত ভালাে ছাত্র ও ভালাে মানুষ হয়ে উঠতে পারেনি। স্বাভাবিকভাবেই, সব যুগেই যেমনটি হয়ে থাকে কিছু তরুণ বখে গিয়েছিলাে, বাপ-কাকার আশাভঙ্গ ও মানসিক যন্ত্রণার কারণ হয়েছিলাে। আর এদেরই অন্য একটা অংশ প্রচলিত হিন্দু মানসিকতার গণ্ডিটাতে আবদ্ধ থাকলাে না, ‘মাইনােরিটি কমপ্লেক্স’কে তারা মন থেকে ঝেড়ে ফেলে দিলাে। বাপ-কাকাদের ‘এদেশে থাকা যাবে না’-ধরনের পলায়নী ভাবনাকে প্রত্যাখ্যান করলাে। তারা বাঙালি জাতীয়তাবাদী ছাত্রলীগ কিংবা রেডিক্যাল ছাত্র ইউনিয়নের সঙ্গে যুক্ত হয়ে ছাত্র রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়লাে। ষাটের দশকের একেবারে শেষ দিকে ছাত্রলীগের সঙ্গে অনেকে ভিড়েছিলাে। তবে হিন্দু ছাত্রদের যােগ ছাত্র ইউনিয়নের সঙ্গেই ছিলাে বেশি। কারণ পাকিস্তানি ভাবধারার বদলে বাঙালি জাতীয়তাবাদ গ্রহণ নয় শুধু, জাতিকে আরাে এগিয়ে নেয়ার স্বপ্ন কল্পনা তাদের মনকে অধিকার করেছিলাে। যারা ছাত্র রাজনীতির সঙ্গে তেমনভাবে যুক্ত হয়নি, তাদের অনেকে প্রগতিশীল সাংস্কৃতিক আন্দোলনের ক্ষেত্রটিকে। বেছে নিলাে, বাঙালির হাজার বছরের ঐতিহ্য সন্ধানে ও ঐতিহ্যের পুনর্মূল্যায়নে মন দিলাে। সাম্প্রদায়িকতার বদলে জাতীয়তাবাদ নয় শুধু, শ্ৰেণীদৃষ্টিভঙ্গিতে ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির বিচারে প্রবৃত্ত হলাে। গােপন কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে সংযােগ গড়ে তুললাে অনেকেই। এ-রকমভাবে বাপ-কাকাদের সাম্প্রদায়িক হীনমন্যতা থেকে তারা নিজেদের মুক্ত করে নিতে পারলাে, বিচ্ছিন্নতা নিরসনের পথ খুঁজে পেলাে। স্বদেশ ত্যাগে সমস্যার সমাধান হবে বলে না ভেবে স্বদেশের প্রতি দায়িত্ব পালনে অঙ্গীকারবদ্ধ হলাে। সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গির অনুসারী রূপে বিদেশে না গিয়ে স্বদেশে বাস করেই আন্তর্জাতিক চেতনার লালন করে চললাে। ষাটের দশকের ছাত্র-রাজনীতিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অমুসলমান ছাত্রাবাস জগন্নাথ হল। পাকিস্তানবাদ-বিরােধী প্রগতিশীল ছাত্র রাজনীতির প্রধান কেন্দ্র হয়ে উঠেছিলাে। এই হল। থেকেই বেরিয়ে এসেছিলেন সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত ও পঙ্কজ ভট্টাচার্যের মতাে চৌকস নেতারা। একারণেই জগন্নাথ হলটির ওপর পাকিস্তানি শাসকদের ক্রোধ ও বিদ্বেষ সীমা ছাড়িয়ে গিয়েছিলাে, একাত্তরের পঁচিশে মার্চের রাতে বর্বর পাক সেনারা এই হলটিতেই সবচে’ বেশি নারকীয় তাণ্ডব চালিয়েছিলাে।
শুধু ঢাকাতেই নয়। মফস্বল শহরগুলােতেও হিন্দু তরুণদের মধ্যে চেতনার রূপান্তরের বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে উঠেছিলাে। রাজনীতিক ও সাংস্কৃতিক আন্দোলনে সুস্থ ধারাটির সঙ্গে তাদের সক্রিয় সংযােগ দিন দিনই বেড়ে যাচ্ছিলাে। ময়মনসিংহ শহরে দেখলাম, নেত্রকোণার ভাটি এলাকার অজপাড়া গাঁয়ের ছেলে খগেশ কিরণ তালুকদার আনন্দমােহন কলেজে পড়তে এসে পাকিস্তানবাসী হিন্দু পরিবারের পলায়নী ও ভীরু ভাবনার খােল নলচে পাল্টে ফেলে সাহসী ও আত্মবিশ্বাসী হয়ে উঠেছে। ষাটের দশকের শেষ দিকে আমরা সমুদ্রমুখী’ নামক সাংস্কৃতিক
৩৮৯
সংগঠনটি শহরে প্রগতিশীল সংস্কৃতি চর্চায় যে আলােড়ন সৃষ্টি করেছিলাে, খগেশ হয়ে উঠেছিলাে সেই সংগঠনটির সামনের সারির কর্মি।
প্রধানত খগেশের উৎসাহেই সত্তর-সালে ময়মনসিংহ শহরে একটি সাংস্কৃতিক সপ্তাহ অনুষ্ঠিত হয়েছিলাে। এটি ছিলাে সবদিক দিয়েই একটি ব্যতিক্রমী অনুষ্ঠান। প্রচুর শ্রোতাদর্শকের উপস্থিতিতে রােজ বিকেল চারটা থেকে শুরু হয়ে চলতাে রাত দশটা পর্যন্ত। একেক দিন বাঙালি সংস্কৃতির একেকটি দিক নিয়ে বিদগ্ধ আলােচনা হতাে, তারপর হতাে সংগীত-নৃত্য ও নাট্যানুষ্ঠান। গারাে উপজাতিদের ঐতিহ্যবাহী সংগীত-নৃত্য পরিবেশিত হয়েছিলাে একদিন। একদিন ছিলাে উচ্চাঙ্গ সংগীতের অনুষ্ঠান। একদিন গণসংগীত। অন্য অন্য দিন পল্লী গ্রামের বিভিন্ন শিল্পীদের পরিবেশনা। স্থানীয় প্রবন্ধ পাঠক ও আলােচকরা ছাড়াও সপ্তাহের বিভিন্ন দিনে প্রধান অতিথি হিসেবে অনুষ্ঠানে যােগ দিয়েছেন শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন, আবু হেনা মােস্তফা কামাল, সত্যেন সেন, রণেশ দাশগুপ্ত ও সন্তোষ গুপ্ত। আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রাম চলাকালে রণেশ দাশগুপ্ত কোলকাতার একটি সাহিত্যপত্রে বাংলাদেশের সংস্কৃতি সম্পর্কে একটি প্রবন্ধ প্রকাশ করেছিলেন। ময়মনসিংহের ওই সাংস্কৃতিক সপ্তাহ’টির বিবরণ দিয়ে প্রবন্ধে রণেশদা লিখেছিলেন যে, বাংলাদেশের সংস্কৃতি বলতে যা বােঝায় তারই পরিচয়বাহী ছিলাে সপ্তাহব্যাপী ওই অনুষ্ঠানটি।
আসলে পুরাে পাকিস্তান আমল জুড়ে শাসকদের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে দেশের বিভিন্ন স্থানে এ-রকম যে-সব সাংস্কৃতিক সপ্তাহ’, সম্মেলন’ ও ‘সেমিনার ইত্যাদি অনুষ্ঠিত হয়েছিলাে, সেগুলাে সবই ছিলাে আমাদের মুক্তিসংগ্রামের অবিচ্ছেদ্য অংশ। আর এগুলােতে অংশগ্রহণকারী সবাই মুক্তিসংগ্রামী।
মুক্তিসংগ্রামের নেপথ্যবিধানকারী রূপে ষাটের দশকে মুসলমান ছেলেদের পাশাপাশি অনেক হিন্দু ছেলেকেও রাজনীতিতে অগ্রণী ভূমিকায় দেখলাম। ময়মনসিংহ শহরে এ-ব্যাপারে সবচে’ অগ্রবর্তী হতে দেখেছি প্রদীপ চক্রবর্তীকে। আন্তরিকতা ও নিষ্ঠার জোরেই সে ময়মনসিংহ জেলার ছাত্র ইউনিয়নের নেতৃপদে আসীন হয়েছিলাে। প্রদীপের পারিবারিক পটভূমিটা অবশ্যি অন্য অনেক হিন্দু তরুণের চে’ একটু অন্য রকম ছিলাে। তার বাবা সত্যেন চক্রবর্তী একসময় কমিউনিস্ট পার্টিতে ছিলেন। তাই শহরে পড়তে আসা অন্য অন্য হিন্দু ছেলেদের অভিভাবকদের মনােবৃত্তির সঙ্গে প্রদীপের বাবার পার্থক্য অবশ্যই ছিলাে। অন্যসব কমিউনিস্টদের মতােই তিনিও হয়তাে সংগ্রাম করেই পাকিস্তান রাষ্ট্রটির স্বরূপ বদলে ফেলার স্বপ্ন দেখতেন। পরে যদিও তিনি কমিউনিস্ট পার্টি ছেড়ে দিয়েছিলেন, তবু তার দেশপ্রেমে কখনাে ঘাটতি পড়েনি, দেশত্যাগের মধ্যে সমস্যার সমাধান খোঁজেননি। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার পরও তিনি দেশেই রয়ে গেলেন। ময়মনসিংহ শহরে অনেকগুলাে হিন্দু পরিবার সে-সময় তার ফুলপুরের গ্রামের বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছিলাে। সে পরিবারগুলােতে বেশ কিছু জোয়ান ছেলেও ছিলাে। এরা কেউই মুক্তিযােদ্ধা ছিলাে না, অন্তত তখন পর্যন্ত এদের কেউই মুক্তিযােদ্ধা হয়নি। কারণ মুক্তিযুদ্ধের সাংগঠনিক রূপটি তখনাে তৈরি হয়ে ওঠেনি। অথচ তখনই এই জোয়ান হিন্দু ছেলেরা পাকিস্তান-বিরােধী তৎপরতায় লিপ্ত, এরা গােপনে ভারতের সঙ্গে যােগাযােগ করে, এসব দুষ্কৃতকারীদের মদদ জোগাচ্ছেন সত্যেন চক্রবর্তী—এ সব অভিযােগ তুলে স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের পাকিস্তানপন্থী চেয়ারম্যান নানাভাবে তাকে হেনস্থা করতে চাইলাে, তার কাছে মােটা। অঙ্কের টাকা দাবি করে বসলাে। অকুতােভয় সত্যেন চক্রবর্তী চেয়ারম্যানের অন্যায় দাবির
৩৯০
কাছে মাথা নত করেননি। তখন সেই চেয়ারম্যান হালুয়াঘাট থেকে পাক সেনাদের খবর দিয়ে নিয়ে এলাে, এরা চক্রবর্তী পরিবারে আশ্রয় গ্রহণকারী যুবকদের ধরে নিতে চাইলাে।
পাক সেনাদের কাছেও সত্যেন চক্রবর্তী একান্ত দৃঢ়তার পরিচয় দিলেন। বললেন, “ওরা আমার বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছে, ওদের আমি কিছুতেই তােমাদের হাতে তুলে দিতে পারি না। ওরা কোনােই দোষ করেনি। যদি নিতে হয় তাে আমাকেই তােমরা নিয়ে যাও।”
পাক সেনারা তাই করলাে। মে মাসের একুশ তারিখ ওরা তাকে বাড়ি থেকে ধরে নিয়ে গেলাে। ওদের ঘাঁটি থেকে তিনি আর ফিরে আসতে পারেননি, চিরতরে হারিয়ে যান।
প্রদীপ এই খবরটি পায় এর মাসখানেক পরে। সে তখন কমিউনিস্ট পার্টির নির্দেশে নেত্রকোণার গ্রামে গ্রামে ঘুরে মুক্তিযুদ্ধে যােগদানের জন্যে তরুণদের উদ্বুদ্ধ করে যাচ্ছে। এরপর সে সীমান্ত পাড়ি দিয়ে মেঘালয়ে চলে যায় ও কমিউনিস্ট পার্টি-পরিচালিত শিবিরের মুক্তিযুদ্ধের সাংগঠনিক কাজে আত্মনিয়ােগ করে। সদ্য পিতৃবিয়ােগ-জনিত বিপর্যয়েও সে ভেঙে পড়েনি বা কর্তব্যচ্যুত হয়নি।
গ্রামে গিয়েও দেখলাম : যে-সব হিন্দু পরিবার সাতচল্লিশ সাল থেকে স্বদেশে নিতান্ত উড়নচণ্ডীর মতাে বাস করছিলাে, দেশত্যাগ না করেও দেশত্যাগের কল্পনা ও পরিকল্পনা করাই ছিলাে যাদের একমাত্র মানসিক আশ্রয় সে-রকম কিছু পরিবারেও ভাবনার ক্ষেত্রে একটা পরিবর্তনের হাওয়া বয়ে যাচ্ছে। সে-হাওয়াটা নিয়ে এসেছে সেইসব পরিবারের কিছু তরুণ। কলেজ বা ইউনিভার্সিটির ছাত্র এই তরুণদের কেউ ছাত্রলিগার, কেউ ছাত্র ইউনিয়নের নেতাকর্মী। প্রগতিশীল তারুণ্যের প্রভাবে একান্ত রক্ষণশীল প্রবীণ অভিভাবকেরও যে চিন্তার বদল ঘটে যেতে পারে তারই নমুনা প্রত্যক্ষ করলাম ভগবতীপুরের দিলীপদের পরিবারে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র দিলীপের বাবা উপেন্দ্র ধর ছিলেন ভগবতীপুর প্রাইমারি স্কুলের প্রধান শিক্ষক। একেবারেই টিপিক্যাল হিন্দু। রাজনীতির ত্রিসীমানায় পা দেননি কোনাে দিন। তার দৃষ্টিভঙ্গিকে প্রতিক্রিয়াশীল যদি নাও বলি, রক্ষণশীল বলতেই হবে। পাকিস্তানের গড়পড়তা হিন্দুদের থেকে তাকে আলাদা করে দেখার কোনােই উপায় ছিলাে না। অথচ, একাত্তরের এপ্রিল মাসে তার মুখে যে ধরনের কথা শুনলাম তাতে অবাক না হয়ে পারলাম না। দৃষ্টিভঙ্গির একেবারে আমূল পরিবর্তন বলতে যা বােঝায়, উপেন্দ্র ধরের ক্ষেত্রে তাই ঘটে গেছে। বুঝলাম, এ পরিবর্তনের উৎস গােপন কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে সংযুক্ত ও নিষ্ঠাবান ছাত্র ইউনিয়ন কর্মী পুত্র দিলীপ ধর।
আরাে কয়েকটি হিন্দু পরিবারেও এমন পরিবর্তনের আঁচ পেলাম। ক্ষয়িষ্ণুতার অন্ধকারেও প্রগতির এ রকম আলােকরেখা দেখে খুবই ভালাে লাগলাে।

অনিশ্চিত ও শঙ্কিত পদযাত্রা
সাম্প্রদায়িকতাবাদ দিয়ে জাতীয়তাবাদকে ঠেকিয়ে রাখার পাকিস্তানি কৌশল যে বাঙালিরা ব্যর্থ করে দিয়েছিলাে, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ তারই প্রমাণ। তবু, মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি শাসকচক্র ও তাদের সহযােগীরা একেবারে মরিয়া হয়ে সাম্প্রদায়িকতার নগ্ন ব্যবহার শুরু করেছিলাে। তারা প্রমাণ করতে চেয়েছিলাে যে, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধটা আসলে হিন্দু ও ভারতীয় ষড়যন্ত্র ছাড়া আর কিছুই না। তবে তাদের মতে, হিন্দুদের সঙ্গে সঙ্গে কিছু মুসলমানও
৩৯১
বিভ্রান্ত হয়েছে বৈকি। বিভ্রান্ত হয়েই তারা দুস্কৃতকারীতে পরিণত হয়েছে। পাকিস্তানের অস্তিত্ব রক্ষা করতে হলে এই পাকভূমি থেকে ওই সব দুষ্কৃতকারী ও কাফেরদের অবশ্যই উৎখাত করতে হবে। আমরা যাদের মুক্তিযােদ্ধা বলতাম, পাকিস্তানের চোখে তারাই ছিলাে দুষ্কৃতকারী। একাত্তরে পাকসেনারা এদেশের সর্বত্র দু’দল লােকেই খুঁজে ফিরতাে। একদল ‘মুক্তি’, অন্যদল ‘উন্দু’ (হিন্দু)।
‘মুক্তি’—মানে মুক্তিযােদ্ধা তাে হয়ে-ওঠার ব্যাপার। জন্ম থেকেই কেউ মুক্তিযােদ্ধা হয়ে যায় না। মনে ও মগজে মুক্তির আকাঙ্ক্ষা লালন করে করে এক সময় সেই আকাক্ষাকে বাস্তব রূপ দেয়ার জন্যে হাতে অস্ত্র তুলে নিয়েই একাত্তরের মুক্তিযােদ্ধাদের সৃষ্টি হয়েছিলাে। অবশ্যি এই চিহ্নিত ও সশস্ত্র মুক্তিযােদ্ধারা ছাড়াও এদেশে অচিহ্নিত ও অশস্ত্র মুক্তিযােদ্ধার সংখ্যা ছিলাে অগণ্য। এরাই ছিলাে মুক্তিযুদ্ধের প্রধান শক্তি। নগণ্য সংখ্যক দালালকে বাদ দিলে, বলতে হয়, এদেশের প্রায় সবাই ছিলাে মুক্তিযােদ্ধা। তাই, ধর্ম বর্ণ গােষ্ঠী নির্বিশেষে সকল বাঙালি ও বাংলাদেশের সকল আদিবাসী উপজাতির প্রতিই পাকিস্তানের ছিলে বিজাতীয় রােষ, সারা বাংলাদেশ জুড়েই চলেছে পাকিস্তানি উৎপীড়ন। তবু পাকিস্তান রাষ্ট্রটির দর্শন তথা অপদর্শনের সঙ্গে সঙ্গতি রেখেই একাত্তরেও পাক হানাদাররা হিন্দুদেরকে আলাদাভাবে পাকিস্তানের বিশেষ দুশমন বলে চিহ্নিত করেছে। শুধু চিহ্নিত করেই ক্ষান্ত হয়নি, তাদের এ দেশীয় দালালদের সহযােগিতায় হিন্দুদের নিশ্চিহ্নকরণের উদ্যোগ নিয়েছে। হিন্দু বসতিগুলাের ওপর পৈশাচিক হামলা চালিয়েছে, হত্যা ধর্ষণ লুণ্ঠন অগ্নিসংযােগ সবই করেছে। হিন্দুদের মধ্যেকার বুদ্ধিজীবী কিংবা রাজনীতি সংশ্লিষ্ট লােকজন কিংবা সমাজে কোনাে না কোনােভাবে পরিচিতি ও প্রতিষ্ঠা আছে যাদের তাদের তাে এই হায়েনাদের হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার কোনাে উপায়ই রইলাে না। পঁচিশ থেকে একত্রিশ মার্চের মধ্যেই ওদের জিঘাংসার শিকার হলেন গােবিন্দ দেব ও জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতার মতাে বরেণ্য বুদ্ধিজীবী, ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের মতাে দেশপ্রেমিক রাজনীতিবিদ, আয়ুর্বেদশাস্ত্রী যােগেশ ঘােষের মতাে প্রখ্যাত ব্যবসায়ী, দানবীর বলে পরিচিত রণদাপ্রসাদ সাহার মতাে বিশিষ্ট নাগরিক।
পাক হানাদারদের এই উগ্র সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গিটি সকলের কাছেই স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিলাে। তাই, গ্রামে তখন দেখেছি, সকল সহৃদয় মুসলমানেরই তাদের প্রতিবেশী হিন্দুদের নিরাপত্তার প্রতি সতর্ক দৃষ্টি। গাঁয়ের মুসলমান যুবকদের অনেকে সুযােগ পেলেই মুক্তিযুদ্ধে যােগ দেয়ার জন্যে সীমান্ত পাড়ি দিয়েছে বটে, কিন্তু সপরিবারে দেশত্যাগের চিন্তা আমাদের এলাকার কোনাে মুসলমানই করেনি। তবে সুসঙ্গ দুর্গাপুরের মতাে সীমান্তবর্তী অঞ্চলের যে সব জায়গায় পাক সেনারা ঘাঁটি গেড়েছিলাে, পাকিস্তানের দালাল ছাড়া অন্য কোনাে বাঙালির পক্ষেই সে সব জায়গায় বাস করা সম্ভব ছিলাে না। সেখানকার অনেক মুসলমানই পরিবার পরিজনসহ ভারতের মেঘালয় রাজ্যে আশ্রয় নিয়েছে, অথবা বাড়ি ঘর ছেড়ে দেশের ভেতর অন্য কোনাে নিরাপদ জায়গায় চলে গেছে। আমাদের এলাকায় অবস্থাটা ঠিক এ রকম ছিলাে না। এখানে মে মাসের শেষ নাগাদও পাক সেনারা এসে পৌঁছায়নি। মে মাসের পরও ওরা এখানে এসে ঘাঁটি গাড়েনি, কেবল সড়ক পথে গাড়ি চালিয়ে মাঝে মাঝে যাতায়াত করেছে। মাত্র। সড়কের আশে পাশে বাজারগুলােতে কখনাে কখনাে টু মেরেছে, মানুষের ওপর কিছু হম্বিতম্বি করেছে, দু’একটি খুন জখমও করেছে। রাস্তার পাশের মাঠ থেকে গরু-ছাগল ধরে নিয়ে গেছে।
৩৯২
আবার এদের সম্বন্ধে কিছু কিছু কৌতুককর কথাও শােনা গেছে। নওয়াপাড়া গ্রামে গিয়ে শুনেছিলাম যে, এক দঙ্গল মিলিটারি একদিন ওই গ্রামের হাটে গিয়ে ঢােকে। হাটে গাঁয়ের এক লােক তার গাছের ফল বিক্রি করছিলাে। একটা বেলের তখন কতাে আর দাম। বড়াে জোর আট আনা কি এক টাকা। একটি পাকিস্তানি সৈন্য যখন একটি বেল নিয়ে দশ টাকার একটি নােট দিলাে, তখন বেলওয়ালা বললাে, আমার কাছে ভাঙতি নেই। সৈন্যটি তাে আর বাংলা বােঝে না। সে মনে করলাে যে বেলের দাম বােধ হয় আরাে বেশি। সে তখন আরাে একটি দশ টাকার নােট দিলাে। এবারাে বেলওয়ালা বললাে যে তার কাছে ভাঙতি নেই। এরপর স্বাভাবিকভাবেই সেই সৈনিক প্রবল ক্রোধান্বিত হয়ে উর্দুতে কি সব বলতে বলতে বেলওয়ালার গালে বসিয়ে দিলাে এক চড়, এবং আরাে একটি দশ টাকার নােট ফেলে দিয়ে—অর্থাৎ ত্রিশ টাকা দামে দিয়ে—একটি বেল নিয়ে চলে গেলাে। হাটের লােকেরা হাসাহাসি করতে লাগলাে। বেলওয়ালাকে বললাে, “মিলিটারির একটা চড় খেয়েছিস তাে কী হয়েছে? এক বেলের দাম তাে পেলি তিরিশ টাকা।
না, এ রকম এক চড়ে তিরিশ টাকা’র কৌতুক নাটক অভিনয় করার জন্যে পাক মিলিটারিরা এদেশে আসেনি। পাকিস্তানের প্রতিনিধি হিসেবে জাতিসংঘে গিয়ে ভুট্টো সাহেব তাে বলেই দিয়েছিলেন, ‘পাক সেনারা পূর্ব পাকিস্তানে ফুটবল খেলতে যায়নি। অর্থাৎ ওরা এসেছিলাে বেয়াদব বাঙালিদের শায়েস্তা করতে। এই শায়েস্তা করার পদ্ধতিটি যে কী নির্মম ও অমানবিক ছিলাে তার বর্ণনা দেয়া আমার সাধ্যাতীত। সে বর্ণনা দেয়ার প্রয়ােজনও হয়তাে এখানে নেই। অনেকেই সেই দুঃস্বপ্নের দিনগুলাের স্মৃতি তাদের চেতনায় ধরে রেখেছেন, অনেক বই পুঁথিতেও সে সবের বিবরণ লেখা হয়েছে।
পূর্ব ময়মনসিংহের সেই গ্রামাঞ্চলে এপ্রিলের চতুর্থ সপ্তাহের শুরুতে প্রথম আমরা পাক মিলিটারিদের হামলা প্রত্যক্ষ করেছিলাম। অবশ্য একেবারে সামনাসামনি নয়। অন্তত মাইল দশেক দূর থেকে। সেখান থেকেই রায়ের বাজারে মিলিটারিদের লাগানাে আগুনের কালাে ধোয়া দেখেছি।
রামপুর বাজারের দশ মাইল দক্ষিণে আঠারােবাড়ি রেল স্টেশন, তারই পাশে রায়ের বাজার। পাকিস্তানি মিলিটারিরা ভৈরব হয়ে রেলপথে আঠারােবাড়ির দিকে আস্তে আস্তে এগিয়ে আসছিলাে, আর পথে পথে তাদের অত্যাচারের স্বাক্ষর রাখছিলাে। পথেই তারা এদেশের কিছু কুলাঙ্গারকে তাদের দুষ্কর্মের সহযােগী বা দালাল রূপে পেয়ে গিয়েছিলাে। কিশােরগঞ্জ শহরে কয়েকজন বিশিষ্ট মৌলানার নেতৃত্বে সে সময়েই একটি দালালচক্র তৈরি হয়ে যায়। শুনেছি, আঠারােবাড়ি রেল স্টেশনে কতিপয় পাকিস্তানপন্থী বাঙালি পাকিস্তানের পতাকা হাতে নিয়ে ‘পাকিস্তান জিন্দাবাদ’ ধ্বনি দিতে দিতে হানাদার পাক সেনাদের অভ্যর্থনা জানায়। ওরাই তাদের পথ দেখিয়ে রায়ের বাজারে নিয়ে যায়। তখন বাজারের অধিকাংশ দোকানপাটই ছিলাে তালাবন্ধ। দোকানদারদের প্রায় সবাই অনুপস্থিত। দালালদের সহযােগিতায় পাক সেনারা বাজারের আশপাশের গ্রাম থেকে অনেক মানুষকে ধরে নিয়ে আসে। দালালরাই চিনিয়ে দেয় তালাবন্ধ কোন দোকানটির মালিক আওয়ামীপন্থী মুসলমান, কোনটির মালিক কাফের হিন্দু। পাক সেনারা গায়ের লােকদের হুকুম দেয় ওই সব দোকানের তালা ভাঙতে। যন্ত্রচালিতের মতাে সে হুকুম তারা তামিল করে। এরপর হুকুম আসে লুট করাে। জানি না, নিরক্ষর গ্রামবাসীদের মনে এ রকম হুকুমের তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া কি হয়েছিলাে। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষার
৩৯৩
কাজে নিয়ােজিত বলে কথিত সশস্ত্র মানুষেরা লুণ্ঠন দমনের বদলে লুণ্ঠনের আদেশ দেয়—এবং সে আদেশ পালন না করলে মেরে ফেলার হুমকি দেয়—এমন তাে তারা বাপের জন্মে কোনাে দিন শােনেনি। তবু, রামপুর বাজারে বসে, আঠারােবাড়ি এলাকার উদ্রুত মানুষদের মুখেই শুনেছি যে সেদিন সেনানীদের আদেশে রায়ের বাজারে লুণ্ঠনকার্য চলেছিলাে অনেকক্ষণ ধরে । আদিষ্ট মানুষেরা দোকানের মালপত্র লুট করে নিয়ে যাচ্ছে, আর আদেশকারীরা ক্যামেরায় তার ছবি তুলে রাখছে বাঙালিদের লুটেরা প্রমাণ করার জন্যে এবং লুট শেষ হতে না হতেই দোকান পাটে পেট্রোল দিয়ে আগুন ধরিয়ে দিচ্ছে—যে ক’জন প্রত্যক্ষদর্শী মানুষ আমাদের কাছে ঘটনার এ রকম বিবরণ তুলে ধরছিলেন তাদের চোখ মুখ থেকে আতঙ্কের ছাপটি তখনাে মুছে যায়নি। কী করে যাবে? আমরা যারা সামনাসামনি ঘটনাটি দেখিনি, কেবল দূর থেকে আগুনের কালাে ধোঁয়া দেখেছি, সেই আমরাও তাে সেদিন আতঙ্কে অবশ হয়ে গিয়েছিলাম।
আঠারােবাড়ি রায়েরবাজারের ঘটনার পর থেকে আমাদের গ্রামেও মিলিটারির আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়লাে। এতােদিন পর্যন্ত রামপুর বাজারে বসে আমরা কেবল গুজববাহিত নানা খবর শুনেছি, এবং উত্তেজনার আগুনে গা গরম করেছি। কিন্তু এখন আর তা নয়। সবাই বুঝে গেলাম : দুশমন আমাদেরও ঘাড়ের ওপর পড়লাে বলে। বিশেষ করে আমাদের রামপুর বাজারটি তাে সড়কের ধারেই। এই সড়ক ধরে যে মিলিটারিরা নেত্রকোনা থেকে কেন্দুয়া পর্যন্ত যাতায়াত করবে তারা কি আমাদের ছেড়ে দেবে? নানা জায়গা থেকে যেসব রক্ত হিম করা খবর আসছে তাতে তাে নিরাপত্তার ভরসা পাওয়া যাচ্ছে না। তবু, বেঁচে থাকার পথ খুঁজে বের করতেই হবে।
জোয়ান ছেলেদের কেউ কেউ মুক্তিযুদ্ধে যােগ দেয়ার জন্যে আগেই ঘর ছেড়েছে, আরাে কেউ কেউ তার প্রস্তুতি নিচ্ছে। কিন্তু আবালবৃদ্ধবনিতা সবারই তাে আর সশস্ত্র মুক্তিযােদ্ধা হওয়া সম্ভব নয়। তাই হানাদার পাক সেনাদের ধোঁকা দেয়ার জন্যে রামপুর বাজারের দোকানদাররা একটা কৌশল উদ্ভাবন করলাে। প্রত্যেকেই তারা একেকটি পাকিস্তানি পতাকা হাতের কাছে রেখে দিলাে। সারাদিনরাত তাে এখন দোকানে টানানাে থাকে রক্তসূর্য লাঞ্ছিত ও বাংলাদেশের মানচিত্র খচিত সবুজ পতাকা। তারা ঠিক করলাে, যখনই পাকিস্তানি মিলিটারির গাড়ির শব্দ শােনা যাবে তখনই তাড়াতাড়ি বাংলাদেশের পতাকাটা নামিয়ে ফেলে পাকিস্তানি পতাকাটি টানিয়ে দেয়া হবে, এবং মিলিটারির গাড়ি চলে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই যথারীতি স্বাধীন বাংলার জাতীয় পতাকা উড়তে থাকবে। এ কৌশল কাজে লাগিয়ে অনেক দিন পর্যন্ত বাজারের দোকানদাররা আত্মরক্ষা করতে পেরেছিলাে বৈকি।
তবে সকলেই নিশ্চিত সিদ্ধান্তে পৌছলাে যে, অন্যদের দিন যেভাবেই চলুক, হিন্দুদের পক্ষে এখন শত্রুমুক্ত না হওয়া পর্যন্ত এদেশে বাস করা অসম্ভব। অথচ, একেবারে সেই মুহূর্তেই দেশত্যাগ করা ছিলাে কঠিন। আমাদের এলাকা থেকে বাংলাদেশের সবচেয়ে কাছের বর্ডার হলাে মহেশখলা বাজার। মহেশখলার পরই ভারতের মেঘালয় রাজ্য। সেই বর্ডারে পঁচিশে মার্চের পর থেকে পাকিস্তানি সেনাদের কোনাে ঘাঁটি ছিলাে না। তখন থেকেই এটি মুক্ত এলাকা। কিন্তু মহেশখলা যেতে হয় ছােটো বড়াে কয়েকটি হাওড় পাড়ি দিয়ে। সেই হাওড়গুলােতে জল জমেছে বটে, কিন্তু তখনাে নৌকা চলাচলের উপযুক্ত হয়নি, পুরােপুরি বর্ষা নামার আগে তা হবে না। সে পর্যন্ত মরণের ঝুঁকি নিয়েই দেশের মাটি কামড়ে পড়ে থাকা ছাড়া গত্যন্তর নেই।
৩৯৪
কিন্তু আমার সকল শুভানুধ্যায়ী মানুষেরা আমাকে নিয়ে চিন্তিত হয়ে পড়লেন। তাঁদের নিশ্চিত ধারণা হলাে যে পাকসেনা কিংবা তাদের দালালেরা আমাকে কিছুতেই ছাড়বে না। কারণ একে তাে আমি হিন্দু, তার ওপর কলেজের শিক্ষক। উদ্বিগ্ন গ্রামবাসীরা আমাকে তাগাদার পর তাগাদা দিতে লাগলেন, “তুমি এক্ষুনি এ গ্রামটি ছেড়ে দাও। সড়কের ধারে কোনাে গ্রামে তােমার থাকা মােটেই ঠিক হবে না। বর্ডার পেরিয়ে এখনই যেতে না পার তাে, এখান থেকে দূরে ভাটি এলাকায় চলে যাও। ভাটি এলাকায় খুব শিগগির মিলিটারি গিয়ে পৌছতে পারবে না।”
স্বতস্ফূর্তভাবে তারা অনেকে তাদের ভাটি এলাকার আত্মীয়-স্বজনদের নাম ঠিকানা আমাকে জানাতে লাগলেন। দু’একজন তাদের আত্মীয়দের নামে চিঠি লিখেও আমার হাতে দিলেন। বললেন, আমাদের আত্মীয় বাড়িতে তােমার কোনাে কষ্ট বা অসুবিধাই হবে না। ওরা তােমাকে মাথায় করে রাখবে।
আমার জন্যে গ্রামবাসীদের এই স্নেহসিক্ত উদ্বেগ আমাকে অভিভূত করে ফেললাে। বাবা আর বৃদ্ধা ঠাকুরমাকে বাড়িতে ফেলে রেখে গ্রাম ছেড়ে চলে যাওয়া ঠিক হবে কি না, এই নিয়ে একটা দ্বিধাও আমার মনে ছিলাে। কিন্তু এখন বাবা আমাকে তাড়াতাড়ি গ্রাম ছাড়ার পরামর্শ দিলেন। তাই আর বিলম্ব না করে ভাটি এলাকার উদ্দেশে পদযাত্রা করলাম । ছাব্বিশে মার্চের সকাল থেকেই তাে মিলিটারির তাড়া খাওয়া বাঙালি পদযাত্রা শুরু করেছে—অনিশ্চিত ও শঙ্কিত পদযাত্রা। আমিও সেই যাত্রীদের একজন হলাম। সঙ্গী হলাে আমার মাস্টার মশাই নগেন্দ্র নন্দীর ছেলে ননী গােপাল ও আমার শ্রদ্ধাস্পদ পিতৃবন্ধু কামিনী চক্রবর্তীর ছেলে সুজিৎ। ওরা দুজনই তখনাে ছাত্র–একজন কলেজের ও অন্যজন বিশ্ববিদ্যালয়ের ।
ঠিক করলাম : তিন জনই আপাতত মদন থানার বালালি গ্রামে আমার ছাত্র নূরুল হকের বাড়িতে গিয়ে উঠবাে, তারপর অন্য চিন্তা।

‘মাটির দেহ খাটি কর খুলে তােমার দ্বীল-কোরান
মদন থানার বালালি গ্রামে আমি এর আগে কোনাে দিন যাইনি, রাস্তাঘাটও চিনি না। সুজিৎ বললাে, এর জন্যে কোনাে অসুবিধে হবে না। চলুন প্রথমে পাহাড়পুরে প্রাণেশ বাবুর বাড়িতে যাই। শুনেছি পাহাড়পুর থেকে বালালি খুব বেশি দূরে নয়। সেখানে গেলে অতি সহজেই বালালির নূরুল হক ভাইয়ের বাড়ি খুঁজে বের করা যাবে।’
সুজিৎ চক্রবর্তী—যার ডাক নাম নারায়ণ বা নারু—দার্শনিকতা তার ভেতর নেই, সে এক অস্থির অশান্ত প্রাণবন্ত তরুণ। প্রাণবন্যায় পথের বাধা ভাসিয়ে দিতে তার উৎসাহের কোনাে সীমা-পরিসীমা নেই। আর সে-উৎসাহের প্রাবল্যে যখন চাহে এ মন যা করে ফেলাই তার স্বভাব, আগে-পিছে তাকিয়ে দেখার হিসেবি বুদ্ধি নিয়ে সে চলে না।
ভাটি এলাকার দিকে পদযাত্রায় আমার অন্য সঙ্গী ননী গােপাল হলাে সুজিতের একেবারে সম্পূর্ণ উল্টো। নিতান্তই শীতল নিস্পৃহ, তারুণ্যহীন তরুণ। ময়মনসিংহে আমার বাসায় থেকেই সে স্কুল-কলেজে পড়েছে। স্কুলে প্রতি ক্লাসে একাধিক বছর ধরে অবস্থান করতে করতে কলেজে পা দিতে তার কতাে বছর লেগেছে চট করে সে হিসেব করে ফেলা কঠিন।
এ-রকম দুই বিপরীত স্বভাবের সঙ্গী নিয়ে অনিশ্চিত পদযাত্রা শুরু করতে আমি ভয় ও ভরসার দোলায় দুলতে লাগলাম।
৩৯৫
যাত্রার শুরুতেই দেখা করলাম হেকিম ভাইয়ের সঙ্গে। উদ্বিগ্ন ও শঙ্কিত হেকিম ভাই সম্ভাব্য নানা বিপদ সম্পর্কে আমাকে সতর্ক করে দিলেন। বললেন, গত ক’মাস ধরে ডুব মেরে থাকা পাকিস্তানপন্থীরা আবার মাথা তুলতে শুরু করেছে। পাক মিলিটারিরা শহরগুলাে দখল করে নেয়ার পর পাকিস্তানের দালালরা নতুন শক্তিতে বলীয়ান হয়ে উঠেছে, শহরে শহরে তারা ‘শান্তি কমিটি বানিয়ে কেবলই অশান্তি সৃষ্টি করছে। গ্রামগুলােতেও পাকিস্তানপন্থীরা কিছুটা প্রকাশ্যে ও কিছুটা গােপনে সংগঠিত হচ্ছে। শহরের শান্তি কমিটির সঙ্গে ওরা যােগাযােগ করছে, শান্তি কমিটির মধ্যস্থতায় পাকসেনাদের সঙ্গেও যােগসূত্র গড়ে তুলছে। কায়দা পেলেই ওরা গায়ে মিলিটারি ডেকে আনবে। মিলিটারিদের ওরাই চিনিয়ে দেবে কে আওয়ামী লিগার, কে কলেজ ইউনিভার্সিটির ছাত্র, কে হিন্দু। আর মিলিটারিদের যেখানে নিয়ে যেতে পারবে না, সেখানেও ওই দালালরা নানান রকম গােলযােগ পাকিয়ে তুলতে চেষ্টা করবে। জয়বাংলা’ওয়ালাদের মিলিটারির হাতে তুলে দেয়ার সুযােগ ওরা খুঁজবেই। কাজেই, হেকিম ভাই আমাকে বললেন, ভাটি এলাকায় গিয়েও আমি যেন খুবই সাবধানে চলাফেলা করি, নিজের পরিচয় যথাসাধ্য গােপন রাখি, অচেনা লােকদের এড়িয়ে চলি।
হেকিম ভাইয়ের বাবা জালাল উদ্দিন খায়ের মধ্যে কিন্তু কোনাে উদ্বেগ বা আশঙ্কার প্রকাশ দেখলাম না। গ্রাম বাংলার এই বাউল কবি কুছপরােয়া নেই’ ভাব নিয়েই সারাটা জীবন কাটিয়ে এসেছেন। এখনাে, সেই সাতাত্তর বছর বয়সেও, একই রকম আছেন। জীবনভর তিনি মােল্লাতন্ত্রের বিরুদ্ধে লড়েছেন লােকায়ত জীবন দর্শনের অস্ত্র হাতে নিয়ে। সে লড়াইয়ে ক্ষতবিক্ষত হয়েছেন, কিন্তু হার মানেননি কোনাে দিন। তবে কখনাে কখনাে বাঙালি জাতির কূপমণ্ডুকতা ও অনৈক্যে ব্যথিত হয়েছেন, অভিমানের বশে স্বজাতিকে ধিক্কার জানিয়ে গানের ভাষায় বলেছেন-
দীন-দরিদ্র সেজেছাে আজ আত্মঘাতী জাত-বাঙালি
স্বভাব যেমন হিংসা-প্রিয় জগৎকে তাই খুব দেখালি৷
বিলাত-প্রবাসী নীরদ চৌধুরীও বাঙালিকে ‘আত্মঘাতী’ আখ্যা দিয়েছেন। কিন্তু লােক ঐতিহ্যের ধারক জালাল খাঁ আর বিলেতি ভাবনার চশমাধারী নীরদ চৌধুরীর দৃষ্টি এক নয়। বাউল কবি জালাল খাঁ দেখেছেন যে বাঙালি আত্মঘাতী হয়েছে মােল্লা পুরুতের শয়তানিতে, শােষক শ্রেণীর শােষণে। সমাজে ন্যায় বিচারের অভাব দেখে তার মন হাহাকার করে
উঠেছে—
তাজ্জব হয়ে গেলাম বাবা দিন দুনিয়ার ব্যবহারে
চোরেরা খায় খােরমা পােলাও সাধু ঘুরায় দ্বারে দ্বারে।
পরের সম্পদ করে শােষণ ধনীর ঘরে হয়েছে ধন।
খাট পালঙ্কে শুইয়া এখন গাঁজা-মদের আড্ডা মারে।
দাদা ছিল যার চৌকিদার বড় বড় উপাধি তার।
মামারে কয় চাকর আমার বাপ বেটায় তামাক ভরে৷
ভিতর খুঁজলে ঢুলের মত বাবা মিঞা সাহেব কতাে
জাল জুয়াচোর উচ্চাসনে সাধু রয় সব নীচে পড়ে৷
জালাল কহে ভুল বুঝেছাে যতই চুরির পথ খুঁজেছাে
নাতি-পুতির ভাত মেরেছাে হিসাব দিবে এক্কেবারে।।
৩৯৬
জালাল খাঁ ইংরেজ রাজত্ব দেখেছেন, পাকিস্তানি শাসনও দেখেছেন। পরের সম্পদ করে শােষণ’ ধনী হয়েছিলাে যারা, সেই বাবু’দের দৌরাত্ম তিনি যেমন ইংরেজ আমলে প্রত্যক্ষ করেছেন, তেমনি পাকিস্তান জামানায় ‘মিঞা সাহেবদের দেখেছেন আঙুল ফুলে কলাগাছ হয়ে। যেতে। দাদা যার চৌকিদার ছিলাে সেই হয়েছে বড়াে বড়াে উপাধিধারী, সে তাে পাকিস্তানেরই বদৌলতে। সেই পাকিস্তানের বিরুদ্ধে আজ যে স্বাধীন বাংলার সগ্রাম শুরু হয়েছে তাতে বিশেষ আশাবাদী হয়ে উঠেছেন এই চিরবিদ্রোহী বাউল কবি।
আমাকে বললেন যে ভাটি এলাকার গ্রামে গ্রামে তার অনেক শিষ্য আছে, ওদের সঙ্গে যেন আমি যােগাযােগ করি। ওদেরই মধ্যে একজনের কথা তিনি বিশেষ করে বলেছিলেন। তার নাম হুসেন আলী। তার গ্রামের নাম সুইত্যার পার। বালালির পথেই পড়বে এই সুইত্যার পার গ্রামটি। আমি যেন সে গ্রামে হুসেন আলীর সঙ্গে দেখা করে যাই। হুসেন আলীর কাছে লেখা একটি চিঠিও তিনি আমার হাতে দিয়েছিলেন।
সঠিক তারিখটি মনে নেই, তবে মে মাসের প্রথম সপ্তাহেই হবে, বিকেলের দিকে বাড়ি থেকে রওয়ানা হয়ে পাঁচ মাইল দূরে বলাই শিমুল গ্রামে পৌছাই। সে-গ্রামেই আমার শিক্ষক ফজলুল হক (ডাক নাম সম্রাজ মিঞা) সাহেবের বাড়ি। মাস্টার সাহেব আমাদের তিনজনকে পেয়ে খুবই খুশি হলেন। সে-সময়ে তিনি, যতােদূর মনে পড়ে, তেলিগাতি হাইস্কুলের হেডমাস্টার ছিলেন। বঙ্গবন্ধু-ঘােষিত অসহযােগ আন্দোলনের শুরু থেকেই স্কুল ছেড়ে বাড়িতে বসে আছেন। এতােদিন ধরে কথাবলার মতাে সঙ্গী না পেয়ে রীতিমতাে হাঁফিয়ে উঠেছিলেন। প্রাণ খুলে কথা বলা ও শােনার লােভেই তিনি আমাদের সেদিন তার বাড়িতে রেখে দিলেন, প্রায় সারারাত জেগে আমরা আলাপ করলাম। আলাপে মুক্তিযুদ্ধের অনেক কথাই উঠে এলাে। মার্চের শুরুতে যারা জয়বাংলা’ বলতে অজ্ঞান ছিলাে, শহরে মিলিটারি আসার সঙ্গে সঙ্গে তাদের অনেকেরই যে বােল পাল্টে গেছে, মাস্টার সাহেব সে-রকম বেশ কিছু মতলববাজের কথা বললেন। গ্রামগুলােও এখন নিরাপদ নয়, এমন কি ভাটি এলাকারও কোনাে কোনাে গ্রামে পাক দালালরা আস্তে আস্তে সক্রিয় হয়ে উঠছে। তাই মাস্টার সাহেবও হেকিম ভাইয়ের মতােই, আমাকে খুব সাবধানে থাকার উপদেশ দিলেন।
তবে, গাঁয়ের যারা খাঁটি কৃষক তাদের ভেতর যে কোনাে মতলববাজি নেই, মনে মুখে তারা যে এক, সংকটের দিনগুলােতেও বারবার সে পরিচয় পেয়েছি।
বলাই শিমুল থেকে গেলাম সুইত্যার পর গ্রামে। হুসেন আলী তার বাড়িতে ছিলেন না মাঠে কাজ করছিলেন। মাঠে গিয়েই তার সঙ্গে দেখা করে জালাল খার চিঠিটি তার হাতে। দিলাম। বানান করে করে চিঠিটি তিনি পড়লেন। বাউল গুরুর চিঠিটি পড়তে পড়তে শিষ্যের মুখ যে কি রকম উজ্জ্বল হয়ে উঠেছিলাে তা ভাষা দিয়ে বােঝানাে যায় না। আজও হুসেন আলীর সেই উজ্জ্বল মুখটি প্রায়ই আমার চোখের সামনে ভেসে ওঠে।
গুরুর চিঠি পড়া শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সব কাজ ফেলে রেখে তিনি আমাদের নিয়ে তাঁর বাড়িতে চলে এলেন। আমাদের নাম পরিচয় তিনি চিঠিতেই পেয়েছিলেন। তাই বললেন, এই গায়ে একটা বামুন বাড়ি আছে। আপনেরারে হেই বাড়িতে খাওনের বন্দোবস্ত কইরা দিতাছি। আমরা বললাম, না, না, তার কোনাে প্রয়ােজন নেই। আমরা আপনার বাড়িতেই খাবাে।
হিন্দু হয়েও আমরা তার বাড়িতে খাবাে শুনে তিনি অবাকও হলেন, আবার খুশিও হলেন প্রচণ্ড। তিনি একা নন শুধু। খুশি হলেন তাঁর বাড়ির সবাই। সবাই আমাদের যত্নআত্তিতে লেগে গেলেন।
৩৯৭
নিতান্ত গরিব কৃষক তিনি, ভাঙা খড়াে ঘরে কোনাে রকমে মাথা গুঁজে থাকেন। কিন্তু আমাদের আপ্যায়নে সেদিন তিনি তাঁর সাধ আর সাধ্য উজাড় করে দিলেন।
দোতরা বাজিয়ে তিনি তাঁর গুরুর রচিত গান আমাদের শােনাতে চেয়েছিলেন। কিন্তু আমরাই তাঁকে বারণ করলাম। গান শুনে লােক জমায়েত হবে, আর সবাই আমাদের পরিচয় জেনে যাবে এই ছিলাে আমাদের আশঙ্কা। অগত্যা তিনি খালি গলায়ই গুন গুন করে জালাল গীতিকা’র অনেক কলি আমাদের শােনাতে লাগলেন।
জালালের গানের সঙ্গে আমি আশৈশব পরিচিত। কিন্তু হুসেন আলীর মুখ থেকে সেদিন জালালের গান আর তারই ফাঁকে ফাঁকে কিছু মন্তব্য শুনে এই গানের প্রচণ্ড শক্তিটি আমি নতুন করে অনুভব করলাম।
ছেলেবেলা থেকেই বহুবার আমি গ্রামের ধর্মসভায় গিয়ে ওলামায়ে কেরামে’র ‘ওয়াজ শুনেছি, বাউলের আসরে বসে ‘বিচার গান’-ও শুনেছি। অনলবর্ষী বক্তা বলে পরিচিত মৌলানারা, প্রায় প্রতিটি ধর্মসভাতেই, আপশােস করে বলতেন : এই যে এখানে দ্বীনের কথা হচ্ছে তাতে শ্রোতার সংখ্যা একেবারে মুষ্টিমেয়, কিন্তু বসতাে যদি এখানে গানের আসর তবে এর দশ গুণেরও বেশি লােকের সমাগম হতাে।…এই সব গান-বাজনাই মানুষের ঈমান নষ্ট করেছে; নাফরমানিতে দেশ ডুবে যাচ্ছে; আল্লাহ-রসুলের কথা, কেয়ামতের কথা, শেষ বিচারের কথা কেউ শুনতে চায় না।
যতােই আপশােস করুন মৌলানা সাহেবরা, বাউলের আসরে যােগ দেয়া থেকে গাঁয়ের মানুষকে কোনােদিন তারা ফেরাতে পারেননি। জালাল খাঁ, রসিদ উদ্দিন, মিরাজ উদ্দিনের বাউল গানে গাঁয়ের কৃষক তার মনের কথা যেভাবে আর যে ভাষায় শুনতে পেয়েছে, তেমনটি সে পায়নি কোনাে ওয়াজ মাহফিলে গিয়ে। মােল্লা-মৌলবিদের মুখে সে বেহেশতের সুখের কথা শুনেছে, দোজখের ভয়াবহ আজাবের কথা শুনেছে। বাউলের মুখে শুনেছে রসের কথা, আনন্দের কথা। ওয়াজ মহফিলে সে আল্লাহর বিচারের কথা শুনেছে, বাউলের আসরে মহফিলে খােদার প্রেমের কথা, প্রেমিক খােদার কথা শুনতে শুনতে বিচারক আল্লাহর কথা সে ভুলে গেছে। তাই সে আসরে জালাল খার তার গানের কথার সঙ্গে একাত্ম হয়ে মনের আনন্দে সে গেয়ে উঠেছে-
মােল্লাজী কন কি আজি
শুনলে আমার পায় হাসি,
মইলে (মরলে) পরে বিচার হবে
জ্বইলে মরে মাের মন-খাসি৷
কে গড়েছে ভালাে মন্দ এই যে দুঃখের দুনিয়ায়
ফুল ফোটে আর গন্ধ ছােটে ফুল বাগানে কার দয়ায়,
কার বা বিচার কে করিবে।
আপনার কুল নাশি।
জালাল খাঁর গানে সে যে-আল্লাহর পরিচয় পেয়েছে, সে আল্লাহ্ বলেন—
আমি তুমি তুমিই আমি দু’জনার এক পরিচয়
শাস্ত্র পড়ে আমায় জানা কখন কিন্তু নাহি হয়।
তাই শাস্ত্র জানে না বা পড়তে পারে না বলে নিরক্ষর কৃষেকের কোনাে আপশােস থাকে নি। সে তাে পড়তে শিখেছে ‘দ্বীল-কোরান’, অর্থাৎ অন্তরের গহন গভীরে যে-কোরানের বাণী
৩৯৮
সদা-সর্বদা ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত হয় সেই কোরান । বাউলের আসরে গিয়েই গাঁয়ের কৃষক সেই প্রত্যয়ে উদ্বুদ্ধ হয়েছে—
মাটির দেহ খাটি কর খুলে তােমার দ্বীল-কোরান। হুসেন আলীর গান আর কথা শুনতে শুনতে আমার মনে হলাে ; এই দ্বীল-কোরানের নির্দেশ মেনে চলতে পেরেছে বলেই অবিশ্রান্ত পাকিস্তানি প্রচারণাও তাদের ধর্মান্ধ বানাতে পারে নি, সম্প্রদায়-ধর্মের খপ্পরে পড়ে মানব-ধর্মকে তারা বিসর্জন দেয়নি। লক্ষ লক্ষ কৃষক যে আজ বাঙালির মুক্তিযুদ্ধের মূল শক্তিতে পরিণত হয়েছে তার মূল প্রেরণাটি তাে ওরা ‘দ্বীল-কোরান থেকেই পেয়েছে। অসাম্প্রদায়িক লােক ধর্মের সাধক বাউল কবির কাছে তারা শুনেছে—
করিম-কিষণ-হরি-হজরত লীলার ছলে ঘােরে—
ভাবে ডুবে খুঁজে দেখ, ভেদাভেদ কিছু নাইরে।
হিন্দু কিংবা মুসলমান, শা-বৌদ্ধ খৃষ্টিয়ান
বিধির কাছে সবাই সমান পাপ-পুণ্যের বিচারে…।
বাউল কবি জলাল তাদের ডেকে বলেছেন
দলাদলির ভাবটি ছাড়, বলি বিনয় করে,
কর না দু’দিনের বড়াই, সং সেজে সংসারে
একই হাতের তৈয়ারি জীব, আসা-যাওয়া এক বাজারে।
হুসেন আলীর ঘরে কোনাে খাট-পালঙ্ক ছিলাে না। ছােট্ট যে-ঘরটিতে তিনি আমাদের থাকতে দিয়েছিলেন সে-ঘরে ছিলাে একটি বাঁশের মাচা। সেই মাচার ওপরই একটি কাঁথা বিছিয়ে যতােদূর সম্ভব পরিপাটি করে আমাদের নৈশ শয্যা রচনা করে দিলেন। আর তিনি নিজে মাটিতে একটি চাটাই পেতে শুয়ে পড়লেন। শিয়রের কাছে রাখলেন একটি ধারালাে দা ।
আমাদের নিরাপত্তার জন্যেই এ-রকম ব্যবস্থা। কোনাে দুশমন যদি ঘরে ঢােকে তবে সঙ্গে। সঙ্গেই হুসেন আলীর ওই দায়ের কোপে তার ঘাড়টি ধড় থেকে আলাদা হয়ে যাবে।

কৃষক-সমাজের ভেতর মহলে
সুইত্যার পর গ্রামে হুসেন আলীর বাড়িতে মাত্র একরাতই ছিলাম। পরদিন সকালে উঠে আমরা যখন পাহাড়পুরের দিকে রওয়ানা হলাম তখন হুসেন আলীও আমাদের সঙ্গ নিলেন। আমরা যতােই বলি আমাদের সঙ্গে যাবার কোনাে প্রয়ােজন নেই, আমরা ঠিকই পথ চিনে চলে যেতে পারবাে’ তিনি সে কথা কিছুতেই মানবেন না। তার কথা হলাে : পথে হয়তাে আমাদের কোনাে বিপদ হতে পারে এবং তেমনটি হলে তার বাউল গুরু জালাল উদ্দিন খাঁ কিছুতেই তাকে ক্ষমা করবেন না।
কিছুদূর পথ চলার পরই হুসেন আলীর এক বন্ধুর দেখা পাওয়া গেলাে। তিনিও পাহাড়পুরের দিকেই যাচ্ছিলেন। ওই মানুষটিকে পেয়ে আমরা হুসেন আলীকে বাড়ি ফিরে যেতে রাজি করাতে পারলাম। তবে ফিরে যাওয়ার আগে বন্ধুকে বারবার দিব্যি দিয়ে গেলেন যে তিনি যেন আমাদের পাহাড়পুরের প্রাণেশ বাবুর বাড়িতে পৌছিয়ে দিয়ে পরে তার নিজের গন্তব্যে যান।
বন্ধুটি তাই করেছিলেন।
৩৯৯
অনেক জলকাদার পথ পাড়ি দিয়ে আমরা অধ্যাপক প্রাণেশ চৌধুরীর বাড়ি গিয়ে পৌছলাম। প্রাণেশ বাবু আমারই সমবয়সী, ময়মনসিংহ আনন্দমােহন কলেজে আমার নিচের ক্লাসে পড়তেন, এখন কিশােরগঞ্জের গুরুদয়াল কলেজে ইংরেজির অধ্যাপক তিনি এবং তাঁর বাবা বনমালী বাবু আমাদের সাদরে স্বাগত জানালেন।
তাদের একান্নবর্তী পরিবারে অনেক সদস্য। তার ওপরে বাড়িতে অনেক অতিথি। অতিথিদের সবাই আমাদের মতােই অনিশ্চিত পথের যাত্রী। বাড়িতে, বলতে গেলে, তিল ধারণেই ঠাই নেই। তবু, আমরা সেখানে অবাঞ্ছিত বিবেচিত তাে হলামই না, বরং চৌধুরী পরিবারের আতিথ্যে পরম আন্তরিকতার স্বাদ পেলাম।
পাহাড়পুরের চৌধুরী বাড়িতে দিন তিনেক ছিলাম। এরই মধ্যে নূরুল হক সেখানে এসে হাজির হলাে। গুজব-বাহিত নানান উদ্বেগজনক খবর শুনে আমার খোঁজে সে আমাদের গ্রামের বাড়িতে গিয়েছিলাে। সেখান থেকেই জানতে পারলাে যে আমি তারই বাড়ির উদ্দেশে রওয়ানা হয়ে এসেছি। এর পর এর-ওর কাছে জিজ্ঞেস করে জেনে নিয়ে আমার বর্তমান অবস্থানে তার আগমন।
নূরুল হক আমাকে আর ননী গােপালকে তার বাড়িতে নিয়ে গেলাে। সুজিৎ গেলাে না। ননীগােপালও কয়েকদিন পর বাড়ি ফিরে গেলাে। রয়ে গেলাম আমি একাই, মে থেকে আগস্টের মাঝামাঝি নাগাদ।
এই ক’ মাস বালালি গ্রামের নূরুল হকের বাড়িই আমার ঠিকানা ছিলাে তবে একটানা পুরাে সময়টা আমি সেখানে থাকিনি। কখনাে মিলিটারি এসে পড়ার ভয়ে, কখনাে বাড়িতে বাবা ঠাকুরমা কী অবস্থায় আছেন সেই খোঁজ নেবার তাগিদে, কখনাে বা ভাটি এলাকাটা ভালাে করে দেখে নেয়ার কৌতূহলে, এ গা থেকে সে গাঁয়ে ঘুরেছি। অনেক দিন বালালি থেকে চলে গিয়েছি উজানে আমার বাড়ির কাছাকাছি গ্রাম ভটের গাতির সামাদের বাড়িতে। সামাদের মারফতেই বাড়িতে বাবার সঙ্গে যােগাযােগ রক্ষা করেছি। বাবা গােপনে সামাদের বাড়িতে এসে আমার সঙ্গে দেখা করে গেছেন। সামাদ আমার স্কুল জীবনের সহপাঠী এবং নূরুল হকের আত্মীয়। স্কুল ছাড়ার পরে সামাদের সঙ্গে খুব একটা দেখা সাক্ষাৎ হয়নি। এবার রাষ্ট্র বিপ্লবের কালে তার সাক্ষাৎ পেয়ে আমি বেঁচে গেলাম, সে যে আমার যথার্থ বান্ধব তার পরিচয় পেলাম। কয়েক বারই সে আমাকে নিয়ে ভটের গাতি থেকে বালালি এবং বালালি থেকে ভটের গাতি যাতায়াত করেছে। দু একবার তার কোনাে কোনাে আত্মীয়ের বাড়িতে আতিথ্যও নিয়েছি। তার আত্মীয়রা সবাই কৃষক। সামাদের আত্মীয়রাই নয় শুধু, এই ক’মাসে আমি যে সব পরিবারের আশ্রয়ে থেকেছি তারা সবাই কৃষক। মুসলমান কৃষক। নূরুল হকরাও তা-ই।
গ্রামের নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান রূপে জন্মের পর থেকেই কৃষকদের সঙ্গে আমাদের ওঠা-বসা। চারপাশের মানুষদের অধিকাংশই তাে কৃষক। একেবারে ছেলেবেলায় গ্রামে যারা আমার খেলার সঙ্গী ছিলাে তাদের প্রায় সবাই তাে কৃষক পরিবারেরই ছেলে। স্কুলে ভর্তি হওয়ার পর যারা আমার সহপাঠী হলাে তাদেরও বেশির ভাগই কৃষক সমাজ থেকে আগত।
তবু, পরিপার্শ্বে এ রকম কৃষক-সম্পৃক্ততা সত্ত্বেও, কৃষক সমাজের থেকে একটা দূরত্ব আমাদের ছিলােই। সে দূরত্ব রক্ষা করে চলার ব্যাপারে আমাদের অভিভাবকরা থাকতেন সদা সতর্ক। কৃষকদের সম্পর্কে একটা অবজ্ঞার ভাবও তারা আমাদের মধ্যে সঞ্চার করে দিতে চাইতেন। সকল তথাকথিত ভদ্রলােকেরাই এমনটি করতেন। হিন্দু ভদ্রলােকদের মধ্যেই এ
৪০০
প্রাকটিসটি সবচেয়ে বেশি মাত্রায় চালু ছিলাে। গ্রামীণ মধ্যস্বত্বভােগী ধনী ভদ্রলােকেরাই নয় শুধু, গরিব ভদ্রলােকদেরও ছিলাে একই দস্তুর। বাঙালি হিন্দুদের সামাজিক বিন্যাসটাই এ রকম যে এ সমাজের ব্রাহ্মণ-কায়স্থ-বৈদ্যদের মধ্যে যারা নিতান্ত দরিদ্র, যাদের নুন আনতে পান্তা ফুরায়, তাদের জন্যেও ভদ্রলােকের আসনটি একেবারে পাকাপােক্ত। উৎপাদনের প্রত্যক্ষ প্রক্রিয়া থেকে বিযুক্ত পরগাছা হয়েও উৎপাদনসংশ্লিষ্ট মেহনতি মানুষদের তারা ছােটলােক’ বলে তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করে। খাদ্যের জোগানদার কৃষকদের বলে চাষা। আর এই চাষা’ শব্দটি যে তার ব্যুৎপত্তিগত অর্থ পরিত্যাগ করে একান্তই অবজ্ঞা ও ঘৃণার প্রতীক হয়ে উঠেছে সে কথা তাে আমরা সবাই জানি। গতর খাটিয়ে জীবিকা নির্বাহ করে যারা, সে রকম সব মানুষের গায়েই ‘ছােটলােক’-এর ছাপ মেরে দেয় পরশ্রমজীবী স্বঘােষিত ভদ্রলােকেরা। পরিশ্রমের প্রতি তাদের প্রচণ্ড ঘৃণা, পরশ্রমের ফল আত্মসাৎ করে জীবন যাপন করাই তাদের কাছে পরম মর্যাদাকর। চড়া কথা ফাটা পায়, ছােটলােক চেনা যায়’–এরকম প্রবচন ওই ভদ্রলােকরাই তৈরি করেছে। গ্রীষ্মের রৌদ্রদগ্ধ কঠিন মাটিতে ও বর্ষার জলে-কাদায় খালি পায়ে যারা কঠোর পরিশ্রম করে ফসল ফলায়, সেই চাষাদের পা কখনাে তুলতুলে নরম থাকতে পারে না। সারা বছরই তাদের পা থাকে ফাটা। সেই ফাটা পায়ের মানুষগুলাের কণ্ঠ থেকেও মিহি স্বরধ্বনি নির্গত হয় না, চড়া গলায় কথা বলাই তাদের স্বভাবগত বৈশিষ্ট্য হয়ে দাঁড়ায়। অন্যদিকে মাটিতে চরণ না ঠেকিয়েও যারা মাটির মালিক, সেই ভদ্রলােকদের পদযুগল থাকে পাদুকাবৃত। তাই পা ফাটার আশঙ্কা তাদের থাকে না। পরিশ্রমে পরিতৃপ্ত বলেই তাদের গলা থেকেও নরম নরম বুলি বেরােতে পারে। সেই নরম বুলির ভদ্রলােকদের মুখে যতাে মধু থাকে, পেটে থাকে ততাে বিষ। সেই বিষে হরহামেশাই জর্জরিত হতে হয় ‘চড়া কথা ফাটা পায়ের। ছােটোলােকদের।
ছােটো, বড়াে, মাঝারি—এরকম নানা স্তরবিন্যস্ত গ্রামীণ ভদ্রলােকদের সকলেই জীবন যাত্রার এমন একটি বেড়া তৈরি করে রাখে যাতে ‘ছােটলােক’ চাষাদের থেকে সব সময়ই তাদের স্বাতন্ত্র্য বজায় থাকে। সেই স্বাতন্ত্রর বেড়া কখনাে যাতে ভেঙে না পড়ে সেদিকে কড়া নজর রাখে একান্ত দরিদ্র ও হা-ভাতে দ্রলােকেরাও। তাদের ছেলেপুলেদেরও ঘিরে রাখে অকারণ আত্মাভিমানের পর্দা দিয়ে। তাই ভদ্রলােকের নাবালক ছেলেদেরও ‘ছােটোলােকদের পাড়ার প্রাঙ্গণের ধার থেকেই ফিরে আসতে হয়, ভেতরে প্রবেশ করার শক্তি একেবারেই থাকে ।
কাজেই আবাল্য কৃষক-পরিবৃত হয়ে থেকেও, আমিও কৃষক-সমাজের একেবারে ভেতর মহলে প্রবেশ করতে পারিনি। বিশেষ করে মুসলমান কৃষকদের ভেতর। জাতভেদ-কণ্টকিত হিন্দুসমাজে—অন্তত গ্রামীণ হিন্দুসমাজেঠুত্সর্গের পাঁচিল ভেদ করে নিম্নবর্ণের হিন্দুদের সঙ্গে মিশতে পারাটাই উচ্চবর্ণের মানুষদের জন্যে সহজ ছিলাে না। মুসলমান কৃষকদের সঙ্গে সত্যিকার অন্তরঙ্গ হয়ে মিশে যাওয়া বা একাত্ম হওয়া তাে ছিলাে অসম্ভব।
সেই অসম্ভবের পাঁচিলটাই এবার হুড়মুড় করে ভেঙে পড়লাে বাঙালির সশস্ত্র মুক্তি সংগ্রাম তথা রাষ্ট্র বিপ্লবের ধাক্কায়। সেই ধাক্কাতেই শহুরে ভদ্রলােকদের অনেকে প্রথমবারের মতাে গ্রাম চেনেন, গ্রামের কৃষকদের শরণ নিয়ে অস্তিত্ব রক্ষা করেন। সেই রামধাক্কা খেয়েই আমিও বাঙালি কৃষক সমাজের একেবারে অন্দর মহলে গিয়ে আশ্রয় নিতে বাধ্য হই। জীবনের পঁয়ত্রিশটি বছর পার হয়ে একাত্তর সালে এসেই কৃষকদের এবং মুসলমান কৃষকের এমন অন্তরঙ্গ পরিচয় লাভের সুযােগ ঘটে আমার।
৪০১
আমার নাম-পরিচয় যথাসাধ্য গােপন রাখতে চেষ্টা করেও সবসময় তা পারিনি। যখনই মুসলমান কৃষকরা জেনে ফেলেছে যে আমি হিন্দু, অথচ তাদেরই হাতের রান্না খাচ্ছি, তখনই তারা আমাকে একটু অন্য ধরনের বা ব্যতিক্রমী মানুষ বলে ধরে নিয়েছে। সুইত্যার পর গ্রামে হুসেন আলীর বাড়িতেই এ-ব্যাপারটি আমি প্রথম টের পেলাম। নাগরিক হিন্দু সমাজ যে খাওয়া-দাওয়ায় ছোঁয়াছুঁয়ির বাছ-বিচারের ব্যাপারটি অনেকদিন আগেই চুকেবুকে গেছে, প্রত্যন্ত অঞ্চলের গ্রামীণ কৃষকরা সে বিষয়ে তখনাে তেমন করে সচেতন হয়নি।
বালালি গ্রামে আসার পর থেকে আমি দাড়ি কামাইনি। লুঙ্গি পরে থাকি সব সময়। পানি ও ‘গােসল’ বলি, ভুলেও কখনাে ‘জল’ বা ‘স্নান’ বলি না। এখন যেন আমি মুসলমান কৃষক পরিবারেরই একজন। তাদের সঙ্গেই থাকি, খাই, ঘুমাই, কথা বলি। তাদের অন্দর মহলেরও খবর জানতে পারি। গরিব কৃষকদের অবশ্যি অন্দর-বাহির বলে আলাদা তেমন কিছু নেই। মেয়েদের অবরােধবাসিনী করে কিংবা পর্দা দিয়ে ঘিরে রাখা হচ্ছে ধনীদের ব্যাপার, গরিবদের ওসবের বালাই নেই, থাকার উপায়ই নেই। নূরুল হকদের বাড়ির বাইরের ঘরটিতেই আমি থাকতাম বটে, কিন্তু সেখানে শুয়ে বসে থেকেই আমি সারা পাড়ার কর্মরত কৃষক রমণীদের দেখতাম, তাদের ঝগড়া-ফ্যাসাদ চুলােচুলি প্রত্যক্ষ করতাম, তাদের উচ্চকণ্ঠ বকাবকিও শুনতাম। অনক্ষর কৃষক পুরুষদের মতাে রমণীরাও রেগে গেলে অবলীলায় যে সব শব্দ ও বাক্য প্রযােগ করে, ভদ্র সমাজের বিচারে সেগুলাে মােটেই শ্লীল নয়। কৃষক সমাজের নারীপুরুষ কিন্তু সচেতন অশ্লীলতায় সেগুলাে উচ্চারণ করে না। শ্লীলতা-অশ্লীলতার বাইরে এ সব শব্দ ও বাক্য তাদের আবেগমােচনের একান্ত স্বাভাবিক উপায় মাত্র, এর পেছনে অন্য কিছুর উপস্থিতি নেই।
কৃষক তার আবেগকে লুকিয়ে রাখে না, রাখতে পারে না। প্রেম, ঘৃণা, হর্ষ, বিষাদ, ক্রোধ, হিংসা—কৃষকের সব আবেগের প্রকাশই সরব ও সক্রিয়। আবেগের প্রকাশে তার কণ্ঠে কখনাে শােনা যায় মেঘের গর্জন, কখনাে ঝড়াে হাওয়ার হাহাকার বা মাতলামি, কখনাে বাঁধভাঙা জোয়ারের অট্টহাসি। কখনাে বর্ষার জল ধারার মতাে তার চোখ বেয়ে নেমে আসে অশ্রুধারা। আবার যখন প্রতিহিংসা বা প্রতিশােধে উন্মত্ত হয়ে ওঠে তখন তার চোখ থেকে ঠিকরে বেরােয় আগুনের হল্কা। সে-আগুনে প্রতিদ্বন্দ্বীকে পুড়ে মারতে একটুও ইতস্তত করে না সে। জান নেয়া আর জান দেয়া দুটোই তার কাছে হয়ে যায় সমান সহজ।
কৃষকের আবেগ খুব কম ক্ষেত্রেই ব্যক্তিক সীমায় আবদ্ধ থাকে, প্রায়শই তার প্রকাশ সমষ্টিগত রূপ ধারণ করে। একের আবেগ অন্যে ভাগ করে নেয়। পরস্পরের শোকে দুঃখে সারা গায়ের মানুষ দল বেঁধে গলা ছেড়ে কাঁদে, সকলে সকলের সুখে প্রাণ ভরে হাসে। বাংলার কৃষকের চেতনায় এক ধরনের ট্রাইব্যাল সংহতি সব সময়ই সক্রিয়। তাই, এক গাঁয়ের কোনাে কৃষকের গায়ে অন্য গাঁয়ের কেউ যখন হাত তােলে বা তাকে অন্যভাবে অপমান করে তখন তা আর নিতান্ত ব্যক্তির ব্যাপার হয়ে থাকে না, দুই গাঁয়ের সকল কৃষকই তখন আপন আপন গাঁয়ের পক্ষ নিয়ে পরস্পরের মুখােমুখি দাঁড়িয়ে যায়। নিতান্ত তুচ্ছ বিষয় নিয়েই হয়তাে দুই গাঁয়ের কৃষক রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে মেতে ওঠে, মামলা-মােকদ্দমায় সর্বস্বান্ত হয়ে যায়। তবু সামষ্টিক মর্যাদার লড়াইয়ে কেউ পিছু হঠতে রাজি হয় না।
একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধ চলার সময়েও, কী একটা ব্যাপার নিয়ে, এ রকমই এক মর্যাদার লড়াই প্রায় শুরু হয়ে গিয়েছিলাে বালালি ও ফতেপুর গ্রামের মধ্যে। ফতেপুর গ্রামে নূরুল হকের শ্বশুর
৪০২
বাড়ি। নূরুল হকের স্ত্রী রুপু স্বামীকে ঠাট্টা করে বলেছিলাে, এবার আর তুমি শ্বশুর বাড়ি যেতে। পারবে না। বালালির লােক পেলেই ফতেপুরের মানুষ তার ঠ্যাং ভেঙে দেবে, জামাই বলে খাতির করবে না।’
অন্য সময় হলে হয়তাে বালালি ও ফতেপুর গ্রামের ব্যাপারটি এ রকম নিতান্ত ঠাট্টাবিদ্রুপের বিষয় হয়ে থাকতাে না। মুক্তিযুদ্ধের সময় বলেই হয়তাে সেটি খুব বেশি দূর গড়াতে পারেনি। উভয় গ্রামেরই বিবেচক মানুষদের হস্তক্ষেপে একটা মিটমাট হয়ে যায়।
লাগতে লাগতে মিটে যাওয়া ঝগড়াটির সূত্র ধরেই আমি গ্রামীণ কৃষকদের কাইজ্যাফ্যাসাদের বহুকাহিনী শুনলাম। নূরুল হকের এক চাচার সঙ্গে আমার অনেক গল্প হতাে। বেশ আলাপী মানুষ তিনি। খুব গুছিয়ে গল্প করতে পারতেন। তার কাছে কাইজ্যা-ফ্যাসাদের গল্প শুনতে শুনতে জসীম উদ্দিনের নক্সী কাঁথার মাঠ ‘সােজন বাইদ্যার ঘাট’-এর কাইজ্যার চিত্রগুলাে আমার চোখের সামনে ভেসে উঠতাে।

অনক্ষর মেহনতি মানুষ ও উদ্বৃত্ত মূল্যের তত্ত্ব
গাঁয়ের মেঠো পথ ধরে আপনি হেঁটে যাবেন, অথচ কাউকে আপনার নাম-পরিচয় বলবেন না, তেমনটি একেবারেই অসম্ভব। শুধু আপনার নিজের নাম-ধাম নয়, আপনার উধ্বর্তন অন্তত দু’তিন পুরুষের খবরাখবর, আপনার ঘনিষ্ঠ আত্মীয়-স্বজনের ঠিকানা—এ রকম অনেক কিছুই জিজ্ঞাসু জনকে জানাবার জন্যে আপনাকে অবশ্যই প্রস্তুত থাকতে হবে। নিজের গাঁয়ের ভেতরে বাইরের আগন্তুকের প্রতি কৃষকের থাকে সন্দেহ ও কৌতূহল-মিশ্রিত দৃষ্টি। তাই সে প্রতিটি আগন্তুককে বাজিয়ে দেখে নিতে চায়। আগন্তুক সম্পর্কে সন্দেহমুক্ত না হওয়া পর্যন্ত সে স্বস্তি পায় না। সন্দেহমুক্ত হলে আগন্তুককে সহজেই সে আপন করে নেয়।
আঁকা-বাঁকা পথ চলতে চলতে আপনি হয়তাে বুঝে উঠতে পারছেন না আপনার গন্তব্যস্থলটি ঠিক কোন দিকে। ক্ষেতে কর্মরত একজন কৃষককে ডেকে জিজ্ঞেস করলেন, ভাই, অমুক গ্রামে কিংবা এ গ্রামের অমুকের বাড়িতে যাওয়ার পথ কোনটি?
কৃষকটি তখন লাঙ্গলে হাত রেখে কিংবা কাটা ধানের আটিটি হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে পড়বে। আপনার দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকাবে। আপনার আপাদমস্তক ভালাে করে দেখে নেবে। আপনার জিজ্ঞাসার জবাব দেবার আগে আপনাকেই পাল্টা প্রশ্ন করবে, আপনের বাড়ি? কই থাইক্যা আইছুইন? অমুকের বাড়িৎ কিয়ের লাইগ্যা যাইবাইন? অমুক আপনের কি অয় (অর্থাৎ তার সঙ্গে আপনার কী সম্বন্ধ)?
সবগুলাে প্রশ্নের উত্তর পাওয়ার পর সে আপনার গন্তব্যস্থলের সঠিক পথটি দেখিয়ে দেবে, সম্ভব হলে আপনার সাথী হয়ে কিছুদূর আপনাকে এগিয়ে দিতে আসবে, অথবা কাউকে আপনার সঙ্গে পাঠিয়ে আপনাকে উদ্দিষ্ট স্থানটিতে পৌছিয়ে দেবে।
নূরুল হকের সঙ্গে পথ চলতে গিয়ে এরকম অভিজ্ঞতা আমার কয়েকবারই হয়েছে। তবে আমাকে মুখ খুলতে হয়নি। নূরুল হকই কৃষকের জিজ্ঞাসার জবাব দিয়েছে এবং আমার যা হােক একটা কিছু বানানাে পরিচয় দিয়ে জিজ্ঞাসুর কৌতূহলের নিবৃত্তি ঘটিয়েছে।
গাঁয়ের কৃষকের আত্মীয়-স্বজনও কোনাে এক ব্যক্তির বা পরিবারের নয়, সারা গায়ের সকলের। অমুক গাঁয়ের কেউ তমুক গাঁয়ে মেয়ের বিয়ে দিয়েছে, কিংবা অমুক গাঁয়ের কারাে
৪০৩
শালার শ্বশুর বাড়ি তমুক গাঁয়ে, তাতেই সেই দুই গাঁয়ের প্রত্যেকে প্রত্যেকের কুটুম। এবং সে পরিচয় দিয়ে যে কেউ যে কারাে বাড়িতে গিয়েই উঠুক না কেন, কুটুমের মর্যাদা সে ঠিকই পাবে। গাঁয়ের কৃষকের মেহমানদারিতে শহুরে ভদ্রলােকের কৃত্রিমতা থাকে না। গরিব কৃষক নিজে যা খায় তাই দিয়েই সে মেহমানকে আপ্যায়িত করে, মেহমানও তাতেই পরম পরিতুষ্ট হয়। স্বাধীনতা সংগ্রামের দিনগুলােতে ভাটি এলাকার কৃষকের এরকম মেহমান হওয়ার আনন্দ আমি বহুবার পেয়েছি।
ধনী কৃষক বা জোতদারের আতিথ্যও আমি নিয়েছি দু’একদিন। তবে ভাটি এলাকায় প্রবাসের প্রায় পুরাে সময়টাই আমি কাটিয়েছি গরিব ও মাঝারি কৃষকের বাড়িতে। এসব কৃষকের জীবনযাত্রার ধরন একান্তই সাদাসিধে। অভাবের ভেতর বাস করেও তাদের অভাববােধ খুবই কম। খাদ্যদ্রব্য সব তারা নিজেরাই উৎপাদন করে। খাল বিল নদী থেকে মাছ ধরে। বাড়িতে যে সবজি জন্মায় তার কিছুটা নিজেরা খায়, বাকিটা বাজারে বিক্রি করে তেল আর নুন কিনে আনে। কেরােসিনের কুপি জ্বালিয়ে সন্ধ্যার পরপরই তারা রাতের খাওয়া সেরে ফেলে। এরপর তাদের অনেকের ঘরেই আর আলাে জ্বলে না। রাত আটটার ভেতরেই সারা গায়ে নেমে আসে মাঝ রাতের আঁধার ও স্তব্ধতা।
আমার ছাত্র নূরুল হকও সাধারণ মাঝারি কৃষক পরিবার থেকেই উঠে এসেছে। বাংলায় এমএ পাস করে একাত্তরে সে নেত্রকোনা কলেজের অধ্যাপক। বিএ পরীক্ষা দিয়ে যে মাস দুই আমি আশুজিয়া হাইস্কুলে মাস্টারি করি সে সময়েই নূরুল হককে আমি ছাত্র হিসেবে পাই। গ্রাম্য স্কুলের ক্লাস সিক্সের একটি ছাত্রের মধ্যে যে এমন মেধা ও কৌতূহল থাকতে পারে তা ভাবতে পারিনি। ওই সময়েই চমৎকার কবিতা লিখতাে এবং তার গদ্যেরও একটি নিজস্ব স্টাইল তৈরি হয়ে গিয়েছিলাে। তার কথা শুনে ও লেখা পড়ে বিস্মিত হয়ে গিয়েছিলাম। কবিপ্রতিভাদীপ্ত এই ছেলেটিকে আমি হেকিম ভাইয়ের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিই। এরপর আমি আশুজিয়া হাইস্কুলের মাস্টারি ছেড়ে চলে গেলে নূরুল হকই হয় হেকিম ভাইয়ের অন্তরঙ্গ সঙ্গী। বাংলাদেশে একজন প্রথম শ্রেণীর কবিরূপে আত্মপ্রকাশ করার মতাে প্রতিভা, যােগ্যতা ও প্রস্তুতি সবই নূরুল হকের ছিলাে। সে হতে পারতাে একজন উচুমানের প্রবন্ধকার কিংবা কাব্যসমালােচকও। কিন্তু কেন যে সে এ সবের কোনাে কিছুই হলাে না কিংবা আত্মপ্রকাশের কোনাে চেষ্টাই সে পরে আর করলাে না—সে এক দুর্বোধ্য রহস্য। তবে এটুকু বলতে পারি যে, তিরিশ বছরেরও বেশিকাল ধরে স্কুল কলেজে মাস্টারি করে যতাে ছাত্র আমি পেয়েছি তাদের কেউই মেধায় মননে ও মৌলিক চিন্তায় নূরুল হকের সমকক্ষ তাে নয়ই, তার ধারে কাছে। যাওয়ারও যােগ্যতা কারাে নেই।
একান্তভাবে কৃষক-অধ্যুষিত গ্রাম বালালিতে নূরুল হকের আগের প্রজন্মের কেউই সম্ভবত বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রি নিতে পারেনি। ম্যাট্রিক পাসও কেউ ছিলাে না বােধ হয়। সে গ্রামেরই মােতালেব নূরুল হকের খালাতাে বড়াে ভাই—নাসিরাবাদ কলেজের নৈশ বিভাগে পঁয়ষট্টিছেষট্টির দিকে আমার ছাত্র হয়েছিলাে। একাত্তরে দেখলাম বালালি গ্রামে স্কুল কলেজে পড়ুয়া কিশাের তরুণের সংখ্যা অনেক। বেশ কয়েকজন তাে আমারই ছাত্র—নাসিরাবাদ কলেজে পড়ে। এরা সবাই মাঝারি কৃষকের ছেলে। এদের প্রায় সবারই ওপর নূরুল হকের কিছু না কিছু প্রভাব আছে। নূরুল হকের দৃষ্টান্তই, আমার মনে হয়, বালালি গ্রামের ছেলেদের শিক্ষার দিকে টেনে এনেছে।
৪০৪
আমি যখন নূরুল হকের বাড়িতে আস্তানা গাড়ি তখন এই ছেলেরা আমার চারপাশে এসে জমায়েত হয়। প্রচণ্ড কৌতূহল নিয়ে ওরা জানতে চায় মুক্তিযুদ্ধের তাৎপর্য ও গতি প্রকৃতি। সমাজ ও রাজনীতির নানা বিষয় নিয়েও তাদের অনেক জিজ্ঞাসা।
এ রকম আগ্রহ লক্ষ করে নূরুল হকের বাড়িতেই এদের নিয়ে একটা ‘পাঠচক্র’ বসালাম। মতিন, গিয়াস, মুজিবর, করিম এবং এরকম আরাে কয়েকজন স্কুল কলেজের ছাত্র সেই পাঠচক্রে নিয়মিত হাজিরা দিতে লাগলাে। কম্যুনিস্ট পার্টির রাজনৈতিক ক্লাসগুলােতে আমরা যা যা আলােচনা করতাম এখানেও মােটামুটি সে সব বিষয়েরই অনুশীলন চলতাে। এই পাঠচক্রটি ওদের চেতনার পুরাে রূপান্তর ঘটাতে পারেনি হয়তাে, তবে ওদের বােধ বুদ্ধিতে যে একটা প্রচণ্ড ঝাকুনি দিয়েছিলাে—সে কথা মানতেই হবে। অদৃষ্টবাদ-নির্ভর কৃষক সমাজের প্রভাব কাটিয়ে রাতারাতি ওরা বিজ্ঞানমনস্ক ও যুক্তিবাদী হয়ে উঠেছিলাে, সে রকম দাবি করলে তা অতিকথা হবে অবশ্যই। তবু, ওই অনানুষ্ঠানিক পাঠচক্রটি যে ওদের নতুনভাবে জীবনকে দেখতে শিখিয়েছিলাে, পড়াশােনার প্রতি গভীর আগ্রহ জাগিয়ে তুলেছিলাে, সে কথাটি না বলে পারছি না। ওই পাঠচক্রটি গ্রামীণ কৃষক সমাজ-থেকে-পাওয়া অভ্যস্ত ভাব ভাবনার বিপরীত মেরুতে তাদের দাঁড় করিয়ে দিয়েছিলাে। সত্তরের নির্বাচনের মধ্যদিয়ে সারাদেশের মতাে এ অঞ্চলেও আওয়ামী ভাবনার একটা হাওয়া বয়ে গিয়েছিলাে, মুক্তিযুদ্ধের প্রতি সমর্থনেও আওয়ামী লীগের দৃষ্টিভঙ্গিটিই সেখানে সক্রিয় হয়ে উঠেছিলাে। কিন্তু নূরুল হকের বাড়ির ওই পাঠচক্রটির সঙ্গে যারা সংশ্লিষ্ট হয়েছিলাে তারা তখন, স্বাভাবিকভাবেই, বামপন্থার দিকে ঝুঁকে পড়ে। মুক্তিযুদ্ধটিকেও তারা বামপন্থিদের দৃষ্টিতে—আরাে স্পষ্ট করে বললে ‘মস্কোপন্থী কম্যুনিস্ট পার্টির দৃষ্টিতে—দেখতে শুরু করে। কিছুদিন পর ওরা সীমান্ত পাড়ি দিয়ে মুক্তিবাহিনীতে যােগ দেয়, এবং সেখানেও ভাবনাচিন্তায় বামপন্থী অবস্থানটিকেই লালন করে চলে। যুদ্ধ শেষে গাঁয়ে ফিরে এসে ওরা বিপুল উৎসাহে কৃষক সমিতি ও ক্ষেতমজুর সমিতির মতাে সংগঠন গড়ে তােলে। বালালি ও তার আশপাশের গ্রামগুলােতে কৃষকদের মধ্যে অধিকার চেতনার বিস্তার ঘটে ওদেরই কর্মতৎপরতায়। কিন্তু, দুঃখ এই, সে তৎপরতাকে ওরা সঠিক পরিণতির দিকে পৌছিয়ে দিতে পারেনি। মুক্তিসংগ্রামীদের হাতে পাকিস্তান নিহত হওয়ার পর স্বাধীন বাংলাদেশে প্রগতির রথযাত্রায় শুরু হয় যে উল্টোরথের পালা, তারই চাকায় পিষ্ট হয়ে অকালে মুখ থুবড়ে পড়ে বালালি গ্রামের স্বাপ্নিক তরুণদের সকল প্রগতি-প্ৰয়াস। তবে সে প্রসঙ্গ এখন নয়, সেটি আসবে পাকিস্তানের ভূতদর্শনের বেলায়।
স্কুল কলেজে পড়ুয়া ছাত্র তরুণরা সমাজনীতি ও অর্থনীতির যে সব বিষয় বুঝতে পারতাে , সেই সব বিষয়েও নিরক্ষর কৃষকদের অনায়াস উপলব্ধি দেখে অবাক হয়ে গেছি। একবার বালালি থেকে নৌকা করে অন্য এক গ্রামে যাচ্ছিলাম। সঙ্গী ছিলাে পাঠচক্রের সদস্য ওই ছাত্র তরুণরা। নৌকায় বসেই সেদিন আমরা পাঠচক্রের কাজ চালাচ্ছিলাম। পড়া হচ্ছিলাে নীহার সরকারের ‘ছােটোদের অর্থনীতি’ বইটি। থিওরি অফ সারপ্লাস ভ্যালু’ বা উদ্বৃত্ত মূল্যের তত্ত্বটি কিছুতেই বুঝতে চাইছিলাে না পাঠচক্রের ওই তরুণরা। শ্রমিকের তৈরি-করা উদ্বৃত্ত মূল্য চুরি করেই পুঁজিপতিরা ফুলে ফেঁপে ওঠে—একথা তাদের কাছে অবিশ্বাস্য। শ্রমিকের শ্রম দিয়ে কেবল উৎপাদিত পণ্যের মূল্য নির্ধারিত হবে কেন? পুঁজিপতি যে পুঁজির যােগান দিলাে তা না পেলে কি শ্রমিক ওই পণ্যটি উৎপাদন করতে পারতাে? পুঁজিপতি যে ঝুঁকিটি নিলাে তার কি কোনাে দাম নেই? শ্রমিককে তার শ্রমের মূল্য চুকিয়ে দিয়েই তাে পুঁজিপতি তার লাভের
৪০৫
অংশটি নিয়ে থাকে। লাভ না পেলে সে পুঁজি বিনিয়ােগ করে শিল্প প্রতিষ্ঠা করতে যাবে কেন?—এ রকম হাজারাে প্রশ্নে ওরা বর্ষার হাওড়ের বুকে প্রচণ্ড কোলাহলের সৃষ্টি করলাে। ওদের প্রশ্নের তােড়ে আমার তাে ভেসে যাওয়ার মতাে অবস্থা!
হঠাৎ শুনি নৌকার মাঝির গলা। ছােট্ট একটা ধমক দিয়ে ওই ‘অশিক্ষিত’ মাঝিটি তার গাঁয়ের ‘শিক্ষিত ছেলেদের থামিয়ে দিলাে।
—স্যার তাে ঠিক কথাই কইছুইন। তােমরা তার কথা বুঝছাে না ক্যারে (কেন)? সবাই হকচকিয়ে গেলাে। মুহুর্তে সব কোলাহল স্তব্ধ।
আমি মাঝিকে জিজ্ঞেস করলাম, আমরা এখানে কী আলােচনা করছি তুমি তা বুঝতে পারছাে?
—বুঝতাম না ক্যারে? আমার মনের কথাডাই তাে আপনে কইছুইন। এই শিক্ষিত পােলাপানরা এই কথা বুঝতে পারে না। বুঝবাে কী কইর্যা? শিক্ষিত অইলে কী অইবাে? এরা তাে আর আমার মতাে খাইট্যা খায় না, নাও বাইয়া তারার সংসার চালানি লাগে না।
আমার বিস্ময় তখন তুঙ্গে। মাঝিটি তার জীবন বৃত্তান্তের কিছু অংশ তুলে ধরলাে।
সে জাতে মাঝি নয়। ভাটি এলাকায় হাওড়ে নৌকা চালানাে যাদের পেশা ছিলাে তারা ছিলাে আলাদা এক জাতের মানুষ হিন্দু মাঝি। পাকিস্তান হওয়ার পর ওই জাত মাঝিদের অনেকেই দেশ ছেড়ে চলে গেছে। এখন আর জাত-বেজাতের কোনাে কথা নেই, মুসলমানরাও মাঝি হয়েছে। আমাদের নৌকার মাঝিটিও মুসলমান। তার বাপদাদা কখনাে নৌকা বেয়ে পেট চালানাের কথা ভাবেনি। তারা ছিলাে কৃষক। কৃষিকাজই ছিলাে তাদের জীবিকা। সেও বাপদাদার মতাে কৃষকই ছিলাে। বাপদাদা যা জমি জিরেৎ রেখে গিয়েছিলাে তাতে ফসল ফলিয়েই তার সংসার কোনাে রকমে চলে যেতাে। কিন্তু অদৃষ্টের ফেরে সেই জমি জিরেৎ সব তার হাতছাড়া হয়ে গেছে। এখন সে চাষের মওসুমে পরের জমিতে কামলা খাটে। আর বর্ষায় হাওড়ে নৌকা চালায়। আজ সে মাঝি। | যে নৌকাটি চালিয়ে সে আমাদের হাওড় পাড়ি দিয়ে নিয়ে যাচ্ছে, সেই নৌকার মালিক গাঁয়েরই এক ব্যাপারি। ওই ব্যাপারি নৌকাটি বানিয়েছিলাে দশ বছর আগে। নৌকা বানাতে তার খরচ পড়েছিলাে মাত্র ছয় কুড়ি’ মানে একশাে বিশ টাকা। আমাদের আজকের এই মাঝিটিই দশ বছর ধরে ব্যাপারির এই নৌকাটি চালিয়ে আসছে। তাই এই নৌকা থেকে ব্যাপারির কী আয় রােজগার হয় সবই সে জানে।
—আইজ যে আপনেরারে আমি নাও বাইয়া লইয়া যাইতেছি এর লাইগ্যা আপনেরা আমারে দিবাইন দশ ট্যাহা (টাকা)। এর থ্যাইক্যা আমার ব্যাপারিরে দেওন লাগবাে পাঁচ ট্যাহা…এইরকম কইর্যা নাও বাইয়া ব্যাপারিরে আমি দশ বছর ধইরা ট্যাহা দিয়া আইতাছি। নাওডা বানাইতে ব্যাপারির খরচ অইছিলাে মাত্র ছয় কুড়ি ট্যাহা। আর আমি যে কতাে ছয় কুড়ি ট্যাহা এই কয় বছরে তারে দিয়া দিছি তার কি কোনাে হিসাব আছে….’
মাঝিটির কথা হচ্ছে : ব্যাপারি যে টাকা খরচ করে নৌকা বানিয়েছিলাে তার কয়েকগুণ টাকা তাে সে প্রথম দুই/তিন বছরেই পেয়ে গেছে। এরপর সাত/আট বছর ধরে যে টাকা সে মাঝির কাছ থেকে নিচ্ছে তা কি তার প্রাপ্য? ব্যাপারি যে নৌকাটির জন্যে পুঁজি খাটিয়েছে একথা অবশ্যই মানতে হবে। কিন্তু পুঁজি খাটিয়ে নৌকা বানিয়ে যদি তার ঘাটে বেঁধে রাখতাে
৪০৬
তবে কি আপনা থেকেই নৌকাটি চলতে শুরু করতাে? মাঝি যদি তার নিজের হাতে লগি ঠেলে নৌকাটি চালিয়ে নিয়ে না যেতাে তাহলে কি যাত্রীরা কেউ ব্যাপারির নৌকায় এসে বসে থেকেই তাকে টাকা দিয়ে যেতাে? ব্যাপারি যে নৌকা থেকে এতাে টাকা পাচ্ছে তা তাে মাঝিরই হাতের মেহনতের গুণে। আর কতাে লাভ করবে ওই ব্যাপারি? এতাে বছর নৌকা চালিয়ে মাঝি ব্যাপারিকে যে এতাে টাকা দিয়েছে তাতে কি মাঝিরই এখন নৌকাটির মালিক হয়ে যাওয়া উচিত নয়? এখনাে যে ব্যাপারি তার কাছ থেকে টাকা নিচ্ছে তা কি অন্যায় নয়?…..। মাঝি যে প্রশ্নগুলাে করছিলাে সেগুলাে ছিলাে তার স্বগতােক্তি মাত্র। প্রশ্নের জবাব সে আমার কাছে চায়নি। তবে এই অশিক্ষিত’ মাঝির প্রশ্নগুলাে থেকেই বােধ হয় আমার পাঠচক্রের ‘শিক্ষিত তরুণরা তাদের সব প্রশ্নের জবাব পেয়ে গিয়েছিলাে। উদ্বৃত্তমূল্যের তত্ত্ব আমি তাদের বােঝাতে পারিনি। শ্ৰমফল-বঞ্চিত ওই ভুক্তভােগী মানুষটির কাছ থেকেই সে তত্ত্ব তারা সেদিন শিখে নিয়েছিলাে। শুধু তারা নয়, আমিও। পুঁথির অক্ষর আমার কাছে যা স্পষ্ট করতে পারেনি, এই নিরক্ষর মাঝিটি তাই করলাে।

‘ক্ষিদা লাগলে দারুণ পেট বাঘের চিৎকার মারে’
কৃষকের মনােলােকে অদৃষ্টবাদের প্রভাব অত্যন্ত প্রবল। অদৃষ্ট মানে যা দেখা যায় না, যার পূর্বাভাস পাওয়া যায় না, আগাম যার প্রতিকার করা যায় না, অকস্মাৎ অজান্তে যা ঘাড়ের ওপর চড়ে বসে। বন্যা, খরা, শিলাবৃষ্টি, অতিবৃষ্টি, অনাবৃষ্টি, সর্পাঘাত, মহামারী সবই কৃষকের কাছে অদৃষ্ট। এবং এই অদৃষ্টই তার জীবনকে নিয়ন্ত্রণ করে বহুলাংশে। অদৃষ্টের হাতের মার খায় সে প্রতিনিয়ত। তাই সে অদৃষ্টবাদী না হয়ে পারে না।
ভাটির দেশের কৃষকদের জীবনে শিলাবৃষ্টিই সবচেয়ে বেশি দূরদৃষ্টের পরিচায়ক। মূলত একটি ফসলের ওপরই তাদের নির্ভর করতে হয়। সেটি বােরাে ধান। চৈত্র বৈশাখে যখন বােরাে ধান ফলনের সময় তখনই শিলাবৃষ্টিরও মওসুম। বৃষ্টির সঙ্গে শিলা তাে বােরাে ধানের ক্ষেতে পড়ে না, পড়ে একেবারে কৃষকের বুকের ভেতরে, তার হাড়গােড় সব চুর্ণ-বিচূর্ণ করে দিয়ে যায়। শিলাবৃষ্টির হাত থেকে বােরাে ক্ষেত যদি রক্ষা পেয়ে যেতে পারে, তবেই ভাটির কৃষকের ঘরে সারা বছরের জন্যে ধান উঠবে। ধানই তার ধন, ধানের বদৌলতেই সে ধনবান। আর বৃষ্টির সঙ্গে পতিত শিলা যদি ধান ক্ষেতকে দেয় তছনছ করে, তবে তার গােলা হবে শূন্য, শূন্য উদরে সারা বছর তাকে দুঃখের গান গেয়ে যেতে হবে। অনেক ধনবান কৃষকও এক লহমায় হয়ে যাবে ধনহীন।
এই দুরদৃষ্টের প্রতিকার করার কোনাে বাস্তব সাধন কৃষকের হাতে নেই। বিজ্ঞানও আজ পর্যন্ত সে রকম কোনাে সাধন উদ্ভাবন করতে পারেনি। তাই অসহায় কৃষক কী করবে? অদৃষ্টকেই চূড়ান্ত নিয়ামক ধরে নিয়ে তার কাছে আত্মসমর্পণ করা ছাড়া আর কিই বা সে করতে পারে? না, একেবারে নিঃশর্ত আত্মসমর্পণ যে সে করে বসে তা নয়। অদৃষ্টকে প্রচণ্ড শক্তিশালী বলে মানলেও মানুষ তাকে বরাবরই জয় করতে চেয়েছে। আদিম মানুষ অদৃষ্ট জয়ের জন্য হাতিয়ার বানিয়ে নিয়েছিলাে ম্যাজিক বিলিফ’ যা যাদু বিশ্বাসকে। সেই যাদু বিশ্বাস এখনাে কৃষকের সঙ্গী। ভাটি দেশের কৃষক শিলাবৃষ্টি প্রতিরােধের জন্যে আজও এক ধরনের যাদুবিশ্বাসের আশ্রয় নেয়। সেই যাদুর কারিগর বা গুণীদের বলে ‘হিরালি’। ভাষাতত্ত্বের
৪০৭
পণ্ডিতরা বলেন, ‘হিরালি’ হচ্ছে আসলে ‘শিলারি’ অর্থাৎ শিলের অরি বা শত্রু। শ’-টাই ভাটির উচ্চারণে হ’ হয়ে শেষে বর্ণবিপর্যয়ের ফলে শিলারি’ হয়েছে ‘হিরালি। কৃষকের মনে হিরালির জন্যে পাতা আছে একান্ত সম্ভ্রমের আসন। এই বিষয়ে হিন্দু মুসলমানের কোনাে পার্থক্য নেই। আগে হিন্দু সমাজের ‘নাথ’ সম্প্রদায়ের মানুষরাই সাধারণত হিরালি হতাে। এরপর মুসলমানরাও আসে এ পেশায়। হিরালি নানা তুকতাক করে কৃষকের ক্ষেতের রক্ষা কবচের ব্যবস্থা করে যায়। এই সব তুকতাকের সঙ্গে হিন্দু বা মুসলমানের ধর্মের কোনাে সম্পর্ক নেই, বরং বৈরিতা আছে। তবু কৃষক সমাজে হিরালিদের অপ্রতিদ্বন্দ্বী প্রভাব লক্ষ করেই হিন্দু পুরােহিত বা মুসলমান মােল্লা কেউই ওদের ঘাঁটায় না, ঘটাতে সাহস পায় না। যে বছর শিলাবৃষ্টি’র হাত থেকে বােরাে ক্ষেত রক্ষা পায় সে-বছর কৃষক হিরালির শক্তিতে মুগ্ধ হয়ে তার প্রতি কৃতজ্ঞতা জানায়। আর যে বছর এর বিপরীতটি ঘটে সে বছর সে শূন্য গােলার সামনে দাঁড়িয়ে তার অদৃষ্টকেই ধিক্কার দেয়, হিরালিকে দোষী করে না। বরং পরের বছর আবারাে হিরালির কাছেই যায়।
জলজঙ্গলের দেশে সর্পাঘাতও অদৃষ্টের মার হয়েই আসে। সেই অদৃষ্টকে মােকাবেলা করার জন্যেও হিরালির মতােই ‘ওঝা’ হচ্ছে কৃষকের ভরসা। বসন্ত রােগের মহামারীতে যখন গাঁয়ের পর গাঁ উজাড় হতে থাকে তখনাে কৃষক আশ্রয় নেয় কবিরাজ’-এর। ওঝা, কবিরাজ, হিরালি—যাদুবিশ্বাসমূলক নানা তুকতাকই এদের সকলের হাতিয়ার। এই হাতিয়ার দিয়েই কৃষক চায় সকল প্রাকৃতিক অদৃষ্টের মার ঠেকাতে। ‘সাপান্ত শিলান্ত বসন্ত’—এ রকম তিনটি শব্দ পাড়া গাঁয়ের লােক আজও ব্যবহার করে। মন্ত্রশক্তি ছাড়া সাপ শিলা ও বসন্তের হাত থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার অন্য কোনাে পথ নেই, কৃষক সমাজের এমনই লােকবিশ্বাস। ওঝা-হিরালিকবিরাজের হাতে প্রতারিত হয়েও কৃষক ওদের ওপর বিশ্বাস হারাতে ভরসা পায় না।
তাই বলে এমন মনে করারও কোনাে কারণ নেই যে, বাস্তব বা বিজ্ঞানসম্মত প্রতিকারের পথ দেখালেও কৃষক সে-পথ ধরে না-হেঁটে অদৃষ্ট-নির্ভর হয়ে যাদুবিশ্বাসের পথই আঁকড়ে ধরে থাকবে। শিলাবৃষ্টি প্রতিরােধের পথ বিজ্ঞান আজও দেখাতে পারেনি। তবে যেখানে ডিজেল চালিত পাওয়ার পাম্প পৌছে গেছে সেখানকার কৃষকরা বৃষ্টি নির্ভরতা কিংবা মান্ধাতা আমলের সেচ পদ্ধতি ব্যবহারের হাত থেকে নিষ্কৃতি পেয়ে গেছে, কোথাও কোথাও কৃষক শিলাবৃষ্টির মওসুম এড়িয়ে ক্ষেতে ধান চাষের অন্য সময় বেছে নিয়েছে, এবং এভাবেই অদৃষ্টের একটি মার জয় করতে পেরেছে। খুবই ধীর গতিতে হলেও আধুনিক প্রযুক্তি বিজ্ঞানের অবদানগুলাে গ্রামেও তাে পৌছেছে কিছু কিছু। সে সবের সুফল তারা ভােগ করছে। আধুনিক চিকিৎসার সুযােগ মিললে কৃষক তা গ্রহণ করতে দ্বিধা করে না। অদৃষ্টের মারের মােকাবেলা করার জন্যে যাদু বিশ্বাসের চেয়ে বিজ্ঞানের শক্তি যে বেশি, এ কথা সে বােঝে।
কিন্তু এসব তাে হচ্ছে প্রাকৃতিক অদৃষ্ট। কৃষকের কাছে সামাজিক অদৃষ্টগুলাে আসে মর্মান্তিক ও ভয়াবহ রূপ ধরে। দেশে বড়াে ধরনের দুর্ভিক্ষ হয় কোনাে কোনাে বছর। সে সময় পত্রপত্রিকায় তা নিয়ে প্রচুর লেখালেখি হয়। সরকার পক্ষ বলে, দেশে প্রচুর খাদ্য মজুত আছে, কোনাে লােককে না খেয়ে মরতে দেয়া হবে না। সরকার-বিরােধীরা যখন অনাহারে মৃত মানুষদের নাম-ধাম প্রকাশ করে তখন সরকার জানায়, ওরা না খেয়ে মরেনি, মরেছে পেটের পীড়ায়। দুর্ভিক্ষকে নিয়ে চলে দুই প্রতিদ্বন্দ্বী পক্ষের এ রকম ‘চাপান-উতাের’। দুর্ভিক্ষকে পুঁজি করে অনেকেই অনেক রকম ফায়দা তুলে নেয়।
৪০৮
তবে এ রকম ব্যাপক দুর্ভিক্ষ ছাড়া প্রতি বছরই গরিব কৃষকরা অপরিহার্য রূপে যে মওশুমি দুর্ভিক্ষের কবলে পড়ে সেটিকে নিয়ে কারাে কোনাে মাথা ব্যথা আছে বলে মনে হয় না। ফসল ওঠার আগে আগে (ভাটি এলাকায় যেটি হয় সাধারণত চৈত্র মাসের মাঝামাঝিতে) গরিব কৃষক বরাবরই অনাহারের মুখােমুখি হয়। তখন ধনী কৃষকের কাছে তাকে হাত পাততে হয়। ধনী কৃষকের দয়ার শরীর। দয়া করে গরিবের বাঁচার জন্যে তিনি ধান ধার দেন। এর জন্যে কোনাে সুদ তিনি দাবি করেন না। বিশেষ করে পরহেজগার মুসলমান ধনিক যিনি, তিনি তাে জানেন, সুদ খাওয়া হারাম। ওই হারাম খেয়ে তিনি কি তার পরকালটা নষ্ট করতে পারেন? তবে আল্লাহ্ তার জন্য সুদ হারাম করলেও তেজারতি হালাল করে দিয়েছেন। ওই হালাল তেজারতিই তিনি করেন। তার তেজারতির পদ্ধতিটা অবশ্য অন্যরকম।
চৈত্র মাসের অভাবের সময় ধানের দাম খুবই বেড়ে যায়। নগদ টাকা দিয়ে গরিব কৃষক তাে আর সেই ধান কিনতে পারে না। পারলে আর সে গরিব হবে কেন? কিন্তু আল্লাহ যাকে দৌলত দিয়েছেন, সেই দৌলতের বদৌলতে যার নামের শেষে তালুকদার বা চৌধুরী বা ভূইঞার মতাে কৌলিক উপাধি যুক্ত হয়েছে, ইতিমধ্যে যিনি হজব্রতও সমাপন করে এসে হাজি সাব’ হয়েছেন, তিনি তাে আর চোখের সামনে তার পাশের বাড়ির মানুষটিকে না খেয়ে বৌ-বাচ্চা নিয়ে মরে যেতে দিতে পারেন না। আগেকার দিনের চশমখাের হিন্দু মহাজনরা উঁচু সুদে টাকা ধার দিয়ে ওদের সর্বস্বান্ত করে রেখে গেছে। এখন হাজি সাব শুধু ওর কাছে উপযুক্ত মূল্যে ধান বিক্রি করেন মাত্র, সুদের কারবার করেন না। এখন এই চৈত্রমাসে যে পরিমাণ ধানের দাম এক শাে টাকা, সেই পরিমাণ ধানই তিনি বাকিতে ওকে দিয়ে দেন। এক/দেড় মাস পরে ওর ঘরে ধান উঠলে টাকাটা তাকে শােধ করে দেবে। অভাবের সময়টায় খেয়ে তাে বাঁচুক বেচারা।
কৃষকের ঘরে ধান ওঠার সঙ্গে সঙ্গেই হাজিসাব নৌকা নিয়ে হাজির হবেন। কারণ গরিবের সংসারে অভাবের তাে শেষ নেই। যে কয় মুঠো ধান সে পেয়েছে সেটুকু খরচ করে ফেলতে ক’দিনই বা লাগবে। তাই তাড়াতাড়িই তিনি তার প্রাপ্য আদায় করে নিতে চান। খাতক কৃষক আর নগদ টাকা দেবে কোত্থেকে? ধান দিয়েই তাকে ধানের ধার শােধ করতে। হবে। তখন একশাে টাকা দাম ধরে যে পরিমাণ ধান সে নিয়েছিলাে এখন সেই টাকায় ধান বিক্রি হয় আগের পরিমাণের প্রায় তিনগুণ। সেই তিন গুণ ধানই হাজি-মহাজনের নৌকায় সে। তুলে দেয়। সেই কৃষকের যদি রবি ঠাকুরের কবিতা জানা থাকতাে তাহলে সে মহাজনের ধানে ভরা নৌকার দিকে তাকিয়ে আবৃত্তি করতাে-
এতকাল নদী কূলে যাহা লয়ে ছিনু ভুলে
সকলই দিলাম তুলে থরে বিথরে
শূন্য নদীর তীরে রহিনু পড়ি
যাহা ছিল নিয়ে গেল সােনার তরী।
রবি ঠাকুরের কবিতা সে না-ই জানুক, এটা সে জানে যে, পরের চৈত্র মাসেও এই তালুকদার বা চৌধুরী বা ভুইঞার কাছে যেতে হবে, একই কড়ারে ধান আনতে হবে, এবং একই রকমে বৈশাখ জ্যৈষ্ঠে, তার হাড়ভাঙা খাটুনি দিয়ে ফলানাে ধান ওই তালুকদার বা চৌধুরী বা ভূইঞার নৌকায় তুলে দিতে হবে।
প্রতিবছর কৃষকের আপন চোখে দৃষ্ট এই বিষয়টিকেও সে তার ‘অদৃষ্ট’ বলেই মনে করে, মনুষ্য-সৃষ্ট সকল দুর্ভোগের জন্যেও সে তার দুর্ভাগ্যকেই দায়ী করে। তবে অদৃষ্ট বা দুর্ভাগ্যকে
৪০৯
দায়ী করেই হাত-পা ছেড়ে সে বসে থাকতে পারে না। নিজের ও পরিবার পরিজনের সকলের ‘পেট’ নামক বৃহৎ গর্তটি ভরানাের জন্যেই উদয়াস্ত তাকে গতর খাটিয়ে যেতে হয়। তবু এই পেট ভরানাে যায় না সেটি কেবলই শূন্য হয়ে যায়। যতােই সে অদৃষ্টের দোহাই দিক, দৃষ্ট’ পেটের নির্দেশ না মেনে তার উপায়ান্তর নেই। এই পেটই তাকে দিনরাত বোঁ বোঁ করে ঘুরায়। এই পেটই তার হাতকে দিয়ে লাঙলের মুঠি ধরায়, দাঁড়-বৈঠা ধরে নৌকা বাওয়ায়, মাছ ধরার জন্যে খালে-বিলে জাল ফেলায়। আবার কাজের সব সুযােগ হারিয়ে তার কাজের হাত কখনাে। কখনাে হয়ে যায় ভিক্ষার হাত। কখনাে কখনাে কেউ কেউ ওই হাত দিয়েই চুরি করার জন্যে সিঁদ কাটা ধরে। সবই ওই পােড়া পেটের কারণে।
‘পােড়া পেট’ কথাটা ভদ্রলােকের ভাষার। নেত্রকোনার ভাটি এলাকায় বলে মাইল্যা পেট। মাইল্যা’ শব্দটির ব্যুৎপত্তিগত অর্থ আমার জানা নেই। তবে ব্যবহারিক অর্থে অবাঞ্ছিত সব কিছুকেই বলে মাইল্যা। পেট ভরানাের দায় নিতান্ত কঠিন বলেই কৃষকের কাছে সেই পেট হয়ে গেছে একান্ত অপরিহার্য অথচ অবাঞ্ছিত, তাই তার নাম দিয়েছে ‘মাইল্যা পেট’। কৃষক রমণীদের মধ্যে প্রচলিত প্রবাদ বাক্য বাপ মরে মা মরে, মাইল্যা পেডে (পেটে) হাক করে (হা-করে)।’ অর্থাৎ পেটের চাহিদা এমনই যে তা সন্তানের পিতৃ-মাতৃ শােকও ভুলিয়ে দেয়।
বালালি গ্রামে এক পল্লী কবির দেখা পেয়েছিলাম যিনি পেট নিয়ে একটি দীর্ঘ কবিতা রচনা করেছিলেন। কবির নাম রুকনউদ্দিন মুন্সী। ভাটি এলাকার গ্রাম্য ভাষায় লেখা তার ‘পেটের কবিতা’র কয়েকটি ছত্র এরকম-
হায় পেট, হায় পেট, হায় মাইল্যা পেট,
তাের লাগি আর কতাে করবাম ক্যাট ক্যাট।
বুঝ দিবার জিনিস নয়, বুঝ দিবাম কারে?
ক্ষিধা লাগলে দারণ পেট বাঘের চিৎকার মারে।
বাঘের মতাে চিৎকার দিয়ে যে পেট ক্ষুধার কথা জানিয়ে দিয়ে যায়, সেই ‘মাইল্যা পেটের অধিকারী কৃষকদের কাছে ক্ষুধাও তাে অদৃষ্টেরই আরেক মার। এই মারের হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার পথ খুঁজতে কৃষক কতােবার কতাে রাজনীতিকের কাছে ছুটে গেছে। হক সাহেবের মুখে ‘ডালভাতে’র কথা শুনে তাকে বিশ্বাস করেছে। আবার, এই পেটের ক্ষুধার সুরাহা হবে শুনেই পাকিস্তানের বাক্সে ভােট দিয়েছে। পাকিস্তানেও কেটে গেছে চব্বিশটি বছর, কিন্তু ক্ষুধার জ্বালায় এখনাে তার দারুণ পেট বাঘের চিৎকার মারে।
তবে গায়ের অন্যান্য কৃষকদের মতােই পেটের কবিতা’র কবি রুকনউদ্দিন মুন্সীকে দেখলাম দারুণ আশাবাদী। তিনি মুন্সী মানুষ। মৌলানা বা মৌলবি বলে আখ্যায়িত হওয়ার যােগ্যতা যাঁদের নেই, অথচ যারা এমন ধর্মীয় জ্ঞানের অধিকারী যার সাহায্যে গাঁয়ের লােকের আনুষ্ঠানিক ধর্মীয় কাজে সহায়তা করতে পারেন, গ্রামে তাঁরাই সাধারণত ‘মুন্সী সাব’ বলে পরিচিত হন। রুকন উদ্দিন ছিলেন এ রকমই একজন মুন্সী সাব, কিন্তু লক্ষ করলাম, মুন্সী’র চেয়ে তার কবিসত্তাটিই প্রবল। সেই কবিসত্তাটিই অন্যান্য মুন্সী-মােল্লা-মৌলবির বিপরীত অবস্থানে তাকে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। তিনি অত্যন্ত আবেগের সঙ্গে ‘জয়বাংলা’র সমর্থন করেন। বাংলাদেশ স্বাধীন হলে ‘মাইল্যা পেটের জন্যে আর ক্যাট ক্যাট করতে হবে না, তার চোখে-মুখে এমন আশাবাদের ঝিলিক।
৪১০
স্বজাতি-বিরােধী কুকুর ও পাকিস্তানের দালাল
রুকন উদ্দিন মুন্সী স্কুল-কলেজে পড়েননি। মক্তব-মাদ্রাসার ছাত্র ছিলেন, কিন্তু মাদ্রাসায় শেষ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে সনদ নিয়ে আসতে পারেননি বলে মৌলবি বা মৌলানা হওয়ার সুযােগও তিনি পাননি। তবু, মুন্সী সাব নামে পরিচিত হয়েও, নিজের যােগ্যতা ও একান্ত আন্তরিকতার বলেই ধর্মপ্রাণ সাধারণ গ্রাম্যজনের শ্রদ্ধা তিনি লাভ করেছিলেন। তার সঙ্গে মাত্র কয়েকদিন আলাপ করেই বুঝেছিলাম যে অন্য অনেক মােল্লা-মৌলবির সঙ্গে তাঁর চিন্তার তফাৎ আছে। শুধু তফাৎ নয়, রীতিমতাে বৈপরীত্য। নিজে তিনি কবিপ্রাণ ছিলেন, গ্রাম্য বাউল কবিদের প্রভাবও তার ওপর বেশ সক্রিয় ছিলাে। তাঁর কথাবার্তায় যথেষ্ট শ্লেষের পরিচয় পাওয়া যেতাে। শ্লেষ বর্ষণ করতেন তিনি ধর্মধ্বজী ধর্ম ব্যবসায়ী মােল্লা-মৌলবিদের প্রতি, ভালাে মানুষের মুখােশধারী টাউট বাটপারদের প্রতি।
একদিন খুব উত্তেজিত হয়ে এসে আমাকে বললেন, “শুনেছেন, অমুক জায়গার অমুক তাে এসডিও আর অমুক এসপি হয়ে গেছে।’
তার প্রথম অমুক জায়গাটি সে সময়কার একটি মহকুমা শহর, দ্বিতীয় ও তৃতীয় অমুক ব্যক্তিদ্বয় দু’জন মশহুর আলেম। তারা ওই শহরের শান্তি কমিটির পদস্থ কর্মকর্তা হয়েছিলেন— সে-খবরটি ঘিরেই মুন্সী সাহেব তাদেরকে ব্যঙ্গ করেছিলেন ‘এসডিও’ এবং ‘এসপি’ আখ্যা দিয়ে।|
আমি বললাম, “সে তাে খুব ভালাে কথা। এরা তাে আপনাদেরই লােক। ধার্মিক মানুষেরা এ রকম উচ্চপদ পেয়েছেন, সে জন্যে আপনার তাে খুশি হওয়ারই কথা।
—হু, খুশি হওয়ার কথা! ধার্মিক মানুষ! …কুকুর মানুষের এতাে উপকার করে, তবু কুকুরের ছোঁয়া লাগলে অজু নষ্ট হয়ে যায় কেন বলতে পারেন?
‘তা আমি কি করে বলবাে? এর জবাব তাে আপনিই ভালাে জানেন।
তা হলে শুনুন। কুকুর মানুষের উপকার করে ঠিকই, কিন্তু তার স্বজাতিকে সে দু’চোখে দেখতে পারে না। পরজাতি মানুষের জন্যে কুকুর জান দেয়, কিন্তু স্বজাতির কাউকে দেখলেই তার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে, কামড়াকামড়ি করে। কুকুর তার স্বজাতিকে অর্থাৎ অন্য কুকুরকে ভালােবাসে—এ রকম আপনি কোথাও দেখতে পাবেন না। স্বজাতিকে এমন হিংসা করে বলেই কুকুর প্রাণীটা একেবারে না-পাক।
একটু থেমে আবার সেই মহকুমা শহরের শান্তি কমিটির চাইদের কথা তুললেন রুকনউদ্দিন মুন্সী। বললেন, ‘ওরাও ওই কুকুরের মতাে। ওরা পরজাতি পাকিস্তানিদের জন্যে জান কোরবান করতে নেমেছে স্বজাতি বাঙালিদের সর্বনাশ করে। ওরাও না-পাক। যতাে বড়াে আলেমই হােক এরা, এদের পিছনে দাঁড়িয়ে নামাজ পড়লে তা কবুল হবে না কিছুতেই।
বড়ােলােকদের কুকুর প্রীতি দেখলেই আমার রুকনউদ্দিন মুন্সীর কথাগুলাে মনে পড়ে যায়। কুকুরের প্রতি ওদের ভালােবাসার মূলে কি আছে নিজেদেরই স্বজাতি-বিদ্বেষ ও পরজাতির প্রতি ভক্তির আতিশয্য? কুকুরের চরিত্রই কি ওদের আদর্শ? শাসক শ্রেণীর মানুষগুলাে কি কুকুরের প্রতি যত্নের অতিরেক দেখিয়ে শাসিতদের সামনে কুকুরকেই আদর্শস্থানীয় করে তুলে ধরতে চায়?
৪১১
আসলে এ প্রশ্নগুলাে এ রকম করে আমার মনে কোনােদিনই জাগেনি। রুকনউদ্দিন মুন্সী সাহেবের কথাগুলাে শুনেই আমার ভেতর প্রশ্নগুলাের উদয় ঘটেছিলাে এবং সেগুলাের সন্তোষজনক উত্তরও পেয়ে গিয়েছিলাম। ঠিকই তাে। কৃতজ্ঞতার জ্বলন্ত দৃষ্টান্ত আমাদের সামনে কুকুরের মতাে আর কেউই উপস্থিত করতে পারেনি। অকৃতজ্ঞতা কিংবা অকৃতজ্ঞ আমাদের সকলের কাছেই নিন্দনীয় এবং সকৃতজ্ঞকে আমরা প্রশংসার চোখেই দেখি। কিন্তু তাই বলে, আমরা কি কখনাে কৃতজ্ঞতার প্রতীক রূপে কুকুরকে দৃষ্টান্ত হিসেবে গ্রহণ করার জন্যে উদ্বুদ্ধ হই, কিংবা কাউকে কুকুরের মতাে হওয়ার জন্যে উদ্বুদ্ধ করি? কৃতজ্ঞতার অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন যে লােকটি তাঁকেও যদি একজন কুকুরের মতাে মানুষ’ বলে আখ্যা দিই তবে সে আখ্যাতে তিনি সন্তুষ্ট হবেন, না উল্টোটা হবেন?
গালি দেয়া বা নিন্দামন্দ করা ছাড়া কোনাে মানুষের সঙ্গে কুকুরের তুলনা আমরা কখনই করতে পারি না। অথচ, মানুষকে বাঘের বাচ্চা কিংবা সিংহ পুরুষ’ বলে আমরা প্রশংসা করি। বাঘ বা সিংহ তাে হিংস্র পশু, ওরা অন্য প্রাণী বা মানুষের প্রতি কখনাে সদাচরণ করে না, কৃতজ্ঞতার প্রকাশও ঘটায় না। তবু, ওদের সঙ্গে তুলনা করে মানুষ নিজেকে সম্মানিত, আর কুকুরের মতাে উপকারী পশুর সঙ্গে তুলনায় অপমানিত বােধ করে কেন?
রুকনউদ্দিনের মতাে একজন স্বল্পশিক্ষিত গ্রামীণ মানুষের কাছে এ রকম সব প্রশ্নেরই একটি মাত্র উত্তর। অর্থাৎ পরম উপকারী ও গুণান্বিত হয়েও কুকুর ঘৃণ্য, কারণ সে স্বজাতিদ্রোহী। একাত্তরের বাংলাদেশে পাকিস্তানের দালালরাও সে-রকম ঘূণ্যই হয়েছিলাে, কারণ তারাও ছিলাে সে-রকমই স্বজাতিদ্রোহী। এইসব দালালদেরও অনেকেরই অনেক গুণ ছিলাে নিশ্চয়, তাদের মধ্যে অনেক আলেম বা বিদ্বানও ছিলাে। তবু ঘৃণা ছাড়া এদের আর কিছুই প্রাপ্য হতে পারে না।
ঘূণার এ-রকম প্রখর অনুভূতি ব্যক্ত করেছিলেন যে মানুষটি সে মানুষটির অ্যাকাডেমিক শিক্ষার সঞ্চয় যতাে কমই থাকুক, তিনি ছিলেন লােকসাধারণ ও লৌকিক চিন্তা-চেতনার সঙ্গে ওতপ্রােতরূপে সংশ্লিষ্ট। সে জন্যেই এমন সরল, সবল ও সঠিক লৌকিক ঘৃণাকে তিনি অন্তরে ধারণ করতে পেরেছিলেন। আর যারা তথাকথিত উচ্চশিক্ষা পেয়ে লােকসাধারণের ও লৌকিক চিন্তা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছিলাে তাদের অনেকেই এ-রকম ঘৃণাবােধও হারিয়ে ফেলেছিলাে। তারাই অনায়াসে পাকিস্তানি হানাদারদের যােগসাজশে স্বজাতির বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছিলাে, তথাকথিত শান্তি কমিটির নেতা হয়েছিলাে, আলবদর হয়েছিলাে, সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষদের ভয় দেখিয়ে বা অর্থলােভে প্রলুব্ধ করে রাজাকার বানিয়েছিলাে।
স্বজাতিদ্রোহী অবস্থান নিয়েছিলাে কি কেবল মক্তব-মাদ্রাসায় আরবি পড়া মানুষরাই? কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি পড়া মানুষেরা নয় কি?
মক্তব-মাদ্রাসা আর কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় দু’রকম শিক্ষা প্রতিষ্ঠানই স্বদেশ-স্বজাতিস্বসমাজ-বিচ্ছিন্ন সংকীর্ণ স্বার্থপর কিছু মানুষ তৈরি করে। তাই দু’রকম প্রতিষ্ঠান থেকেই বাঙালির মুক্তিযুদ্ধ-বিরােধী পাকিস্তানি দালালরা বেরিয়ে আসে। এ-রকম দালাল বরং আধুনিক শিক্ষার পীঠস্থান কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়গুলােই বেশি তৈরি করেছে। আলবদর বাহিনীর অধিকাংশ ছেলেই তাে ছিলাে কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী ছাত্র। এদের ভেতরও বিজ্ঞানের ছাত্রদের সংখ্যাটি ছিলাে উল্লেখযােগ্য। তা হলে, প্রাচীন পন্থার ধর্মীয় শিক্ষাপ্রাপ্ত মানুষদের সঙ্গে আধুনিক বিজ্ঞান শিক্ষিতদের পার্থক্যটা থাকলাে কোথায়?
৪১২
আধুনিক শিক্ষিতদের কেউ কেউ যেমন মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে ছিলাে, তেমনি এদেরই কেউ কেউ মুক্তিযুদ্ধের বিরােধিতা করেছে। আবার মাদ্রাসায় শিক্ষাপ্রাপ্ত মৌলানাদের সকলেই যে মুক্তিযুদ্ধের বিরােধী ছিলেন, এমনও নয়। রুকনউদ্দিনের মতাে স্বল্পশিক্ষিত মুন্সী সাব’ই নন। শুধু, সংখ্যায় কম হলেও, উঁচু দরের কিছু আলেম বা মৌলানাও মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে প্রত্যক্ষ বা পরােক্ষ অবদান রেখেছেন। কোনাে কোনাে মৌলানা দৃশ্যত হানাদার বাহিনীর পক্ষ সমর্থন করলেও কার্যত তাদের বিরুদ্ধাচরণই করেছেন। এ-রকমই একজন মৌলানার কথা একান্ত শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ না করে পারছি না। তিনি মৌলানা শামছুল হুদা পাঁচবাগী।
গফরগাঁওয়ের পাঁচবাগের অধিবাসী বলেই মৌলানা পাঁচবাগী নামে তিনি পরিচিত হয়েছিলেন। ভারতের রামপুর এস্টেট মাদ্রাসায় শিক্ষাপ্রাপ্ত এই মৌলানা আরবি ফারসি উর্দুর পাশাপাশি ইংরেজি ও বাংলা ভাষাতেও ছিলেন পারদর্শী। গ্রামের লােকজন মনে করতাে যে মৌলানা পাঁচবাগী অলৌকিক শক্তির অধিকারী, অলৌকিক শক্তি-বলেই তিনি অসাধ্য সাধন করতে পারেন। তাই তারা মুশকিল আসানের জন্যে তাঁর কাছে ছুটে যেতাে, তাঁর দোয়া চাইতাে, তাঁর কাছ থেকে তাবিজ-কবচ চেয়ে আনতাে। অলৌকিক শক্তি তাঁর সত্যিসত্যিই ছিলাে কি-না সে বিষয়ে আমরা সঙ্গতভাবেই সন্দেহ পােষণ করতে পারি। কিন্তু মানুষের লৌকিক সমস্যা সমাধানের জন্যে লৌকিক পদ্ধতিতেই যে তিনি সারা জীবন প্রয়াস চালিয়েছিলেন, সে-ব্যাপারে সন্দেহের কোনােই অবকাশ নেই। জমিদার মহাজনদের রক্তচক্ষুকে অগ্রাহ্য করেও তিনি তাদের শােষণের বিরুদ্ধে সংগ্রাম চালিয়েছেন, শােষিত কৃষক প্রজার অধিকার আদায় করতে গিয়ে মিথ্যা মামলায় জড়িয়ে পড়েছেন, সরকারি স্বৈরাচারের প্রতিবাদ করতে গিয়ে কারাবাসও করেছেন। ইংরেজ আমল থেকে পাকিস্তান আমল পর্যন্ত সারা জীবনই তাকে এ-সব করতে হয়েছে। ছেচল্লিশ সনে মুসলিম লীগের প্রবল প্রতাপের বিরুদ্ধে তিনি প্রতিষ্ঠা করেন ইমারত পার্টি’। সেই পার্টির প্রার্থীরূপে ইলেকশানে দাঁড়িয়ে মুসলিম লীগ প্রার্থীকে হারিয়ে দেন। ছেচল্লিশে মুসলিম লীগ-বিরােধী প্রার্থীর এ-রকম বিজয় ছিলাে অচিন্তনীয়। সাতচল্লিশের পরও তিনি পাকিস্তান রাষ্ট্রকে স্বীকার করে নিতে পারেননি। পাকিস্তানকে প্রকাশ্যেই তিনি বলতেন ফঁাকিস্তান। গ্রামের বাড়িতেই তিনি একটি ছাপাখানা প্রতিষ্ঠা করেন ও সেখান থেকে অজস্র পাকিস্তান-বিরােধী লিফলেট ছেপে বিলি করতেন। মুক্ত বাংলার দাবিতে লিফলেট ছেপে প্রচার করেছিলেন বলে পাকিস্তান সরকার তার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহের মামলা দায়ের করে দীর্ঘ দিন জেলে আটকে রেখেছিলাে। এরপর আট বছর তাকে ময়মনসিংহ শহরে নজরবন্দি হয়ে থাকতে হয়েছিলাে। নজরবন্দি অবস্থায় থেকেও তিনি ভাষাআন্দোলনের পক্ষে কাজ করেন, হাজার হাজার প্রচারপত্র ও ইশতেহার বিলি করেন। পঁয়ষট্টির পাক-ভারত যুদ্ধের সময় পাকিস্তানের সাম্প্রদায়িক কার্যকলাপের এবং উনসত্তরে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার প্রতিবাদেও তিনি প্রচুর লিফলেট ছাড়েন।
এহেন পাকিস্তান-বিরােধী মৌলানা একাত্তরে গফরগাঁয়ে শান্তি কমিটির আহ্বায়ক বা চেয়ারম্যান হয়েছেন, এ খবরটি শুনে প্রথম আমি দুঃখই পেয়েছিলাম। কিন্তু পরে জেনেছিলাম, এটি ছিলাে তার একটি কৌশলগত অবস্থান। কৌশলগত অবস্থানের কথা বলে অনেক রাজনীতিকও অনেক সময় নানান স্ববিরােধী ও সুবিধাবাদী আচরণ করে থাকেন। নিজেদের সুবিধাবাদী চরিত্রকে আড়াল করার জন্যেই তারা কৌশলের কথা বলেন। মৌলানা পাঁচবাগীর অবস্থানে এ-রকম কোনাে সুবিধাবাদ ছিলাে না, ব্যক্তিগত মতলব হাসিলের কোনাে প্রয়াস
৪১৩
ছিলাে না। তিনি বরং কৌশলগত অবস্থান গ্রহণ করে হানাদার পাকিস্তানিদের অনেক মতলব ব্যর্থ করে দিয়েছিলেন। সাধারণ মানুষকে মিলিটারি ও পাক দালালদের অত্যাচারের হাত থেকে বাঁচিয়েছিলেন। মতলববাজ দালালরা মৌলানা পাঁচবাগীকে ডিঙিয়ে নিজেদের মতলব হাসিলের কোনাে সুযােগ করে নিতে পারেনি। মৌলানা পাঁচবাগী মুক্তিযােদ্ধাদের প্রত্যক্ষ বা পরােক্ষভাবে সাহায্য করতেন কি-না জানি না। কিন্তু বাড়ির জোয়ান ছেলেটি মুক্তিযুদ্ধে যােগ দিয়েছে এই অপরাধে সেই বাড়ির অন্য মানুষদের অত্যাচারিত হতে দেননি। তার এলাকার শান্তি রক্ষায় তিনি যথার্থ সহায়তা করেছেন। অন্য এলাকার শান্তি কমিটি’ গুলাের মতাে অশান্তির সৃষ্টি করেননি।
তার কাছ থেকে সব চেয়ে বেশি সহায়তা পেয়েছে হিন্দুরা। সে এলাকার হিন্দুদের খুব কম লােকই দেশত্যাগ করতে পেরেছিলাে। পাক মিলিটারিদের হিংস্র থাবার আওতায় তারা পড়ে গিয়েছিলাে। সেই থাবা থেকে মৌলানা পাঁচবাগীই তাদের বাঁচিয়ে রেখেছিলেন। তিনি তাদের প্রত্যেকের একেকটি মুসলমান নামকরণ করে সেই নামেই শান্তি কমিটির পক্ষ থেকে আইডেনটি কার্ড ইস্যু করে দিয়েছিলেন। অথচ একজন হিন্দুকেও তিনি ধর্মান্তিরিত করেননি। বরং মুসলমান নামধারী সেই হিন্দুরা যাতে বাড়িতে তাদের নিজেদের ধর্ম পালন করে, আপন আপন বিশ্বাস ও অভ্যাস মতাে পূজা অর্চনা করে, সে বিষয়ে তাদের উৎসাহিত করেছেন। স্বাধীনতার পরে গফরগাঁয়ের বেশ কিছু হিন্দুর মুখে এ-সব কথা আমি শুনেছি। মৌলানা শামছুল হুদা পাঁচবাগীর নামটি উচ্চারণ করার সঙ্গে সঙ্গে তাদের একান্ত শ্রদ্ধা ও আবেগের প্রকাশ লক্ষ করেছি। তারা মৌলানার উদ্দেশে বারবার যুক্তকর মাথায় ঠেকিয়েছে।
পাকিস্তানি হানাদারদের তথাকথিত শান্তি কমিটিতে যােগ দিয়েছেন যে মৌলানা, তাকে কি নামে আখ্যায়িত করবাে? পাকিস্তানের দালাল? রুকনউদ্দিন মুন্সী যাদের বিরুদ্ধে ঘৃণা ও ক্রোধে ফেটে পড়েছিলেন সেই আলেমদের সঙ্গে এক কাতারে ফেলবাে কি মৌলানা পাঁচবাগীকেও?

মুক্তাঞ্চলের মুক্ত মানুষ ও গণ-আত্মশাসন
রুকন উদ্দিন মুন্সী কথিত স্বজাতি-বিরােধী কুকুর বাংলাদেশের সব এলাকাতেই দু’চারটি করে ছিলাে নিশ্চয়। কিন্তু সব জায়গায় ওরা ওদের স্বজাতিদ্রোহী চরিত্রের প্রকাশ ঘটাতে পারেনি, ঘটানাের সুযােগ পায়নি। সুযােগ পেয়েছে সেখানেই যেখানে ওরা পাক মিলিটারিদের সহজে নিয়ে যেতে পেরেছে। যেখানে তা পারেনি সেখানে ওরা বকধার্মিক বা বিড়াল তপস্বীর মতাে আচরণ করেছে। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের জনগণের সঙ্গে মিনমিন করে তাদের মনরাখা কথা বলেছে, আর নিজেদের সমমনা লােকদের কাছে মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে বিষােদগার করে অন্তর্জালা শান্ত করতে চেয়েছে। ভাটি এলাকার এরকম বহু লােকের কথা আমি গাঁয়ের কৃষকদের মুখেই শুনেছি। ও-রকম লােকদের ওপর গাঁয়ের মানুষ তীক্ষ্ণ নজর রেখেছে, প্রকাশ্যে ওদের বিরুদ্ধে কিছু বলেনি।
মদন থানায় আগস্ট মাসের শেষ সপ্তাহের আগে পাক মিলিটারিরা যেতে পারেনি বলে ওখানে কোনাে দালালের উপদ্রব হয়নি, রাজাকার বাহিনীতে যােগ দিয়েছে এমন লােকেরও দেখা পাওয়া যায়নি। অন্তত আমি যে গ্রামে ছিলাম সেই বালালি বা আশপাশের গ্রামে কোনাে
৪১৪
দালাল-রাজাকারের দেখা পাইনি। মদনের পুব দিকের থানা খালিয়াজুড়ি ছিলাে হানাদার বাহিনীর জন্য একান্তই দুর্গম এলাকা। তাই দালালদের তালিকায় যুক্ত করার মতাে একটি লােকও সেখানে ছিলাে না। অথচ মদনেরই অন্য পাশের থানা আটপাড়ার তেলিগাতিতে জনৈক হাফিজ সাহেব’ মিলিটারিদের ডেকে এনে গ্রামে ত্রাসের সৃষ্টি করেছে। নেত্রকোনা থেকে সড়কপথে মিলিটারিরা জিপ নিয়ে তেলিগাতিতে সহজে যেতে পারতাে বলেই ওই হাফিজ ওদের দালালি করার সহজ সুযােগ পেয়ে গেছে। বিশেষ অত্যাচার চালিয়েছে, স্বভাবতই, আওয়ামী লিগার ও হিন্দুদের বাড়িতে। হত্যা, লুণ্ঠন, অগ্নিসংযােগ—সবই করেছে। আমি যে জায়গায় ছিলাম সেটিকে বলা যেতে পারে মুক্ত এলাকা। অন্তত আগস্টের শেষ সপ্তাহ পর্যন্ত সেটি মুক্ত এলাকাই ছিলাে। শুধু মুক্ত এলাকা বলাই যথেষ্ট নয়। আমার তাে মনে হয়েছিলাে, আমি যেন রাষ্ট্রহীন এক সমাজে বাস করছি। কারণ তখন সেখানে থানা-পুলিশ ছিলাে না। দেওয়ানি বা ফৌজদারি আদালত, জজ ম্যাজিস্ট্রেট, উকিল-মােক্তার কিছুই ছিলাে না। অথচ, এসব ছিলাে না বলে জনগণের একটুও অসুবিধা হয়নি। এমন হয়নি যে মানুষ মানুষের মাথা খেয়েছে, অবাধে লুটপাট করেছে, সব ন্যায়নীতি বিসর্জন দিয়ে অমানুষ হয়ে গেছে। হয়েছে বরং তার উল্টোটা। রাষ্ট্রীয় আইন সেখানে মানবিক ন্যায়কে শাসন করতে পারেনি বলে সত্যিকার ন্যায়েরই প্রতিষ্ঠা হয়েছে, আইনের ফাঁক গলিয়ে কোনাে অন্যায়কারী রেহাই পেয়ে যায়নি।
থানা-পুলিশ, উকিল-মােক্তার, মামলা-মােকদ্দমা তথা রাষ্ট্রীয় শাসন ও বিচার-প্রণালী সম্পর্কে সাধারণ মানুষের অভিজ্ঞতা খুব সুখকর নয়। চোর-ডাকাতের উপদ্রবে অতিষ্ঠ হয়েও মানুষ সহজে থানায় যেতে চায় না। পুলিশের সংশ্রব এড়িয়ে চলতেই সকলে পছন্দ করে। বাঘে ছুলে আঠারাে ঘা, আর পুলিশে ছুলে ছত্রিশ ঘা’—এ-রকম প্রবাদবাক্য মানুষের পুঞ্জীভূত তিক্ত অভিজ্ঞতা থেকেই তৈরি হয়েছে। থানার পুলিশের চেয়ে থানার টাউটরা আরাে মারাত্মক। নিরীহ মানুষের শান্তিভঙ্গ করার জন্য প্রায় প্রতি গ্রামেই আছে এ ধরনের টাউট। আরাে আছে কিছু চিহ্নিত মামলাবাজ লােক। মামলা করাই যেন ওদের পেশা। ওরাই শহরের উকিলমােক্তার-পেস্কারদের ভাত জোগায়। গ্রামের মানুষ ওদেরই কূটচক্রের প্যাচে পড়ে মামলা মােকদ্দমায় জড়িয়ে যায়। মামলা-মােকদ্দমা করে ন্যায়বিচার হয়তাে পায়ও কখনাে কখনাে। তবে অধিকাংশ ক্ষেত্রে এসবে কেবল হয়রানিই সার হয়। আর হয় টাকার শ্রাদ্ধ। টাকা ছাড়া কেউ উকিল-মােক্তারদের সেবা বা পরামর্শ পায় না, টাকা খরচ না করে কেউ মামলায় জিততে পারে না। অথচ, মতলববাজ লােকের প্ররােচনায় গায়ের অনেক মানুষকেই মদগাঁজার নেশার মতাে মামলা-মােকদ্দমার নেশায় পেয়ে বসে। মামলা করে অনেকে ফতুর হয়ে যায়। তাের ঘরে মামলা ঢুকুক’—এ যে কতাে বড়াে অভিশাপ তা কেবল ভুক্তভােগীই টের পান। মুক্তিযুদ্ধের সময় মুক্ত এলাকায় এই ভুক্তভােগীদের মধ্যে যেন অন্য এক রকম বােধের উদ্বোধন ঘটলাে। এলাকায় যে সব চোর-ডাকাত দীর্ঘদিন ধরে উপদ্রব করে চলেছে, কেউ কেউ কিছুদিনের জন্য হাজতবাস বা কারাবাস করলেও থানা-পুলিশের আশ্রয়-প্রশ্রয়েই যারা চুরিডাকাতির পেশা চালিয়ে গেছে, এখন থানা-পুলিশ-আদালতের অনুপস্থিতিতে গাঁয়ের মানুষ নিজেরাই তাদের বিচার করেছে। পরিচিত ও চিহ্নিত চোর বা ডাকাতটিকে তারা ধরে এনেছে, তার কৃতকর্মের কথা তাকে স্মরণ করিয়ে দিয়েছে, এবং শেষে দায়ের কোপে বা অন্যভাবে তাকে হত্যা করেছে। এই বিচারের প্রক্রিয়াটি অত্যন্ত সংক্ষিপ্ত। আদালতের বিচারের মতাে
৪১৫
লম্বা-লম্বা তারিখ পড়া, দুই পক্ষের উকিলের সওয়াল জবাব, দু’পক্ষেরই খােলাম কুচির মতাে টাকা ছড়ানাে—এ-রকম নানা কিছুর উপস্থিতিতে বিচারকে বিলম্বিত করার কোনাে ব্যবস্থা সেখানে ছিলাে না। এজাহার, জামিন, পেস্কার, উকিল, মক্কেল, হাকিম, কোর্ট ফি—এ-রকম কোনাে শব্দের ব্যবহারই সেখানকার বিচারের বেলায় হয়নি। কিন্তু তাতে ন্যায়বিচার বিঘ্নিত হয়েছে, এমন কথা কেউই বলতে পারবে না। বরং সত্যিকার দোষী ব্যক্তিটিই সাজা পেয়েছে, রামের অপরাধে শ্যামের মাথা কাটা পড়েনি।
তবে ভুল যে মানুষের একটুও হয়নি তা নয়। পাকিস্তানি দালাল বা দুষ্ট লােক সন্দেহে, কিংবা নিতান্ত গােলেমালে পড়ে গিয়ে, দু’একজন ভালাে মানুষও জনগণের হাতে নিগৃহীত ও নিহত হয়েছে বটে। কিন্তু এ-সব ভুলের পুনরাবৃত্তি রােধের ব্যবস্থাও জনগণই নিয়েছে। মানুষের স্বাভাবিক প্রতিশােধ-স্পৃহাও মুক্তিকামী ও শান্তিকামী জনগণের প্রচেষ্টাতেই সংযত থেকেছে। হাতে ক্ষমতা পেয়ে জনগণের দায়িত্ববােধ বেড়ে গেছে, তারা প্রজ্ঞার অনুশীলনের সুযােগ পেয়েছে। ভাটির ওই মুক্তাঞ্চলে জনগণের দায়িত্ববােধ ও প্রজ্ঞার পরিচয়-জ্ঞাপক অসাধারণ একটি ঘটনা ঘটেছিলাে জুনের শেষ সপ্তাহে। ওই ঘটনার সাক্ষী ছিলেন আমার সহকর্মী বন্ধু অধ্যাপক আনােয়ারুল হাকিম খান। ওই ঘটনাটির সঙ্গে নিজেও তিনি জড়িত হয়ে পড়েছিলেন। জনগণের প্রজ্ঞার সঙ্গে তাঁর নিজের প্রজ্ঞা মিশিয়ে ঘটনাটিকে একটা বাঞ্ছিত পরিণতিতে পৌছে দেয়ার ব্যাপারে অবিস্মরণীয় ভূমিকা রেখেছিলেন তিনি। ওই এলাকারই কদমশ্রী গ্রামে আনােয়ারুল হাকিম খানের গ্রামের বাড়ি। শহর ছেড়ে এ সময়ে তিনি গ্রামের বাড়িতেই অবস্থান করছিলেন। এ সময়েই তার পিতৃবিয়ােগ ঘটে। প্রয়াত পিতার বিদেহী আত্মার শান্তি কামনায় চেহলাম অনুষ্ঠানের আয়ােজনে যখন তিনি ব্যস্ত ঠিক তখনই ওই ঘটনাটি ঘটেছিলাে।
শিবপাশা গ্রামের কুখ্যাত সুন্দরিয়া চোরের শ্বশুর বাড়ি ছিলাে কদমশ্রী গ্রামে। এ সময়ে সে শ্বশুর বাড়িতে বেড়াতে এলে এ-গাঁয়ের লােক তাকে জামাই আদরে বরণ করেনি। বরং বহুদিন ধরে চৌর্যাপরাধ করেও রাজদণ্ড এড়িয়ে চলতে পেরেছিলাে যে সুন্দরিয়া চোরা, এবার সে শ্বশুরের গায়ে এসেই গণদণ্ডে নিহত হলাে।
না, আমি যে ঘটনাটির কথা বলছি সেটি এই সুন্দরিয়া চোরার দণ্ডপ্রাপ্তির বিষয়ে নয়। সুন্দরিয়া চোরার এই পরিণতি সকলকে খুশিই করেছিলাে। কিন্তু সকলের খুশিকে বিষাদে ও ভয়ে পরিণত করলাে ওই চোরার সঙ্গে আর দু’জন নির্দোষ লােকের নিহত হওয়ার ঘটনাটি। এই দু’জনের একজন ছিলাে একটি কিশাের। সে দেওসহিলা গ্রামের এক বিধবা মায়ের একমাত্র পুত্র। সে সময়ে সে ইস্কুলে ক্লাস সেভেনে পড়তাে। পিতৃহীন এই নিস্পাপ বালকটির নির্মমভাবে নিহত হওয়ার খবর দেওসহিলা গ্রামে পৌছার সঙ্গে সঙ্গে সেই গ্রামবাসীদের মধ্যে দেখা দিলাে একান্ত স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া। এ সব ক্ষেত্রে গ্রামীণ লােকসমাজের প্রতিক্রিয়া, আমরা আগেই দেখেছি, ব্যক্তির বদলে সমষ্টিকে আশ্রয় করে প্রকাশ পায়। তাই ভিন গাঁ থেকে নৌকা বেয়ে দেওসহিলা গ্রামের পাশ দিয়ে ঘরে ফিরছিলাে কদমশ্রীর যে চারজন লোেক তারা বন্দী হয়ে গেলাে দেওসহিলাবাসীদের হাতে। অন্য সময় হলে হয়তাে খুনের বদলা খুন হয়ে যেতাে সঙ্গে সঙ্গেই, বন্দিদের একজনও প্রাণ নিয়ে ফিরতে পারতাে না। তারপর দীর্ঘদিন ধরে চলতে থানা-পুলিশ, আইন-আদালত, মামলা-মােকদ্দমা, নিম্ন আদালতে সাজা ও উচ্চ আদালতে আপিলের ঘূর্ণিপাক ঘূর্ণন। কিন্তু এখন, মুক্তিযুদ্ধকালীন মুক্তাঞ্চলে, এসব কিছুর
৪১৬
বালাই নেই। তাই এখানে সামাজিক মানুষেরই দায়িত্ব-সচেতন হওয়ার ক্ষেত্র প্রস্তুত হয়। এবং সত্যি সত্যিই সেই ক্ষেত্রটিতে সচেতনতার বীজ উপ্ত হয়ে যায়। সে কারণেই সম্ভবত, একটি আপােস ফর্মুলা উদ্ভাবনের লক্ষেই, দেওসহিলাবাসীরা কদমশ্রীর চার বন্দির দু’জনকে ছেড়ে দিলাে, আর অন্য দু’জনকে আটকে রেখে দিলাে। অর্ধেক সংখ্যক বন্দি মুক্তির তাৎপর্যটি কদমশ্রীবাসীদের কাছে মােটেই অস্পষ্ট রইলাে না। বিশেষ করে অধ্যাপক আনােয়ারুল হাকিম খান বিষয়টি সঠিকভাবেই অনুধান করতে পারলেন। নিজে অগ্রণী হয়ে কয়েকজন লােক নিয়ে গেলেন দেওসহিলা গ্রামে। বলতে গেলে জীবনের ঝুঁকি নিয়েই গেলেন। দেওসহিলার লােকেরা তাঁদের আতিথ্য যেমন দিলাে, তেমনি তীব্র তীক্ষ্ণ বাক্যবাণ নিক্ষেপ করে ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ ঘটাতেও ইতস্তত করলাে না। বিধবা মায়ের ছেলেটির হত্যার প্রতিশােধ কদমশ্রীর কাউকে না কাউকে হত্যা করেই নিতে হবে—এমন উগ্ৰ অভিমতের ধারকের সংখ্যাও সেখানে একেবারে কম ছিলাে না। এ অভিমতকে কার্যকর করার শক্তিও তাদের ছিলাে। তবু, একান্ত স্বস্তিকর ব্যাপারটি হলাে যে, সেই শক্তিপ্রয়ােগ থেকে গ্রামবাসী বিরত রইলাে। গুরুত্ব আরােপ করলাে আসল ক্ষতিগ্রস্ত মানুষটির—অর্থাৎ সেই বিধবা মায়ের-বিবেচনার ওপর। সেই মা বললেন, ‘আমার বুক খালি করে ছেলে আমার চলে গেছে, এখন আরেক জনকে খুন করলে তাে আরেক মায়ের বুক খালি হবে। তাতে কি আমার শূন্য বুক ভরে উঠবে?…তবে কেন এমনটি করা? পুত্রশােকের যে জ্বালা আমি বহন করছি সে জ্বালা আর কাউকে দগ্ধ করুক, তেমনটি আমি চাই না, তেমনটি যেন না হয়।’
নিরক্ষর হতভাগিনী গ্রাম্য মায়ের ভাষাটি নিশ্চয়ই এ-রকম পালিশ করা ছিলাে না। কিন্তু তিনি যা বলেছিলেন তার মর্ম এ-রকমই। সেই মায়ের কথা বলতে গিয়ে, সিকি শতাব্দী পরও, অধ্যাপক আনােয়ারুল হাকিম খান আবেগাপ্লুত হয়ে ওঠেন। মাতৃহৃদয়ের সেই অনুভূতি সেদিন গ্রামের সকল মানুষের মর্মে মর্মে সঞ্চারিত হয়ে গিয়েছিলাে। শােককে শক্তিতে পরিণত করতে হবে—এমন একটি কথা আমরা প্রায়ই বলে থাকি। মহান মুক্তিযুদ্ধের সেই দিনগুলােতে ভাটি অঞ্চলের দেওসহিলা, কদমশ্রী ও আশপাশের গ্রামের কৃষক জনতাকে শােক শুধু শক্তিই দেয়নি, তাদের ভেতর প্রকৃত মনুষ্যত্বেরও জাগরণ ঘটিয়েছিলাে। সেদিনের গণবিচারের রায়েও সেই মনুষ্যত্বের স্পর্শ লেগেছিলাে। সেই রায়ে কোনাে দণ্ড ঘােষিত হয়নি, কিন্তু সকলে আত্মসমালােচনা ও অনুতাপের আত্মদণ্ড গ্রহণ করেছিলাে একান্ত স্বেচ্ছায়। কদমশ্রী গ্রামের অপরাধী মানুষদের কাছ থেকে কিছু অর্থ আদায় করা হয়েছিলাে পুত্রহারা মায়ের সাহায্যের জন্যই। প্রচলিত আদালতের অর্থদণ্ডের সঙ্গে এর তুলনা করা চলে না। অনুতাপের আগুনে পুড়ে সকলে, অন্তত তখনকার মতাে, খাটি মানুষে পরিণত হয়েছিলাে।
মুক্তিযুদ্ধের সময়কার মুক্তাঞ্চলে ওইসব গণবিচারের কথা স্মরণ করে আমার মনে দৃঢ় প্রত্যয় জাগে : সাম্যবাদী তাত্ত্বিকরা যে ভবিষ্যতের রাষ্ট্রহীন সমাজে সাম্যবাদী গণ আত্মশাসন’ (Communist Public Self Administration) প্রতিষ্ঠার ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন, বাস্তবে তার প্রতিষ্ঠা হওয়া একান্তভাবেই সম্ভব। শুধু সম্ভব নয়, এমনটি হতেই হবে। এ রকম হওয়া ছাড়া মনুষ্যত্বের মুক্তি ঘটবে না, মানুষ প্রকৃত স্বাধীন হবে না। চারদিকে পাকিস্তানি বর্বরতা তথা শ্রেণী শােষণমূলক রাষ্ট্র ব্যবস্থা দ্বারা পরিবেষ্টিত হয়ে থেকেও মুক্তাঞ্চলের বাঙালি নিতান্ত স্বল্পদিনের জন্যে হলেও যে স্বাধীনতা ভােগ করেছিলাে এবং রাষ্ট্রশাসন-মুক্ত স্বাধীনতার যে চমকপ্রদ প্রকাশ ঘটিয়েছিলাে, সেই সব দেখে শুনেই আমার মনে ভবিষ্যতের রাষ্ট্রহীন সমাজ
৪১৭
ব্যবস্থা সম্পর্কে প্রত্যয়টি দৃঢ়মূল হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধোত্তর কালের বাংলাদেশকে সম্পূর্ণ উল্টোপথে যাত্রা করতে দেখেও, সমাজতান্ত্রিক বিশ্বের অচিন্তনীয় বিপর্যয় অবলােকন করেও, সারা পৃথিবী জুড়ে বাজার অর্থনীতির ঢক্কা নিনাদে কানে তালা লাগার উপক্রম হওয়া সত্ত্বেও, আমার সেই প্রত্যয়ে একটুও চিড় ধরেনি। গােষ্পদে আকাশ দর্শনের মতাে মুক্তাঞ্চলে ‘গণ-আত্মশাসনের যে অতি ক্ষুদ্র রূপ প্রত্যক্ষ করেছিলাম, সেটিই অনেক বড়াে পরিসরে ভবিষ্যতের মানুষ অর্জন করবে না, এ রকম ভাবলে মানুষের প্রতিই বিশ্বাস হারানাে হয়। আর মানুষের প্রতি বিশ্বাস হারানাে পাপ’–এই মহাবাণীকে অবিশ্বাস করি কী করে?

নিরাপত্তার সন্ধানে দেশত্যাগ
মুক্তিযুদ্ধের সময়ে উপদ্রুত বাঙালির মনােবলকে চাঙা করে রাখার ক্ষেত্রে অসাধারণ ভূমিকা ছিলাে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে’র। বিশেষ করে ‘চরমপত্র’ অনুষ্ঠানটির। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের অনুষ্ঠানগুলাে সুনির্দিষ্ট সময়সূচি ধরে প্রচারিত হতাে না। ‘চরমপত্র’ প্রচারেরও নির্দিষ্ট কোনাে সময় ছিলাে না। সন্ধ্যা ছ’টা থেকে রাত এগারােটা পর্যন্ত আমরা রেডিওর পাশেই বসে থাকতাম। আকাশবাণী’, ‘বিবিসি’ বা ‘ভয়েস অব আমেরিকার প্রতি আকর্ষণ অবশ্যই ছিলাে। কিন্তু কোনমতেই চরমপত্র শােনা থেকে যাতে বঞ্চিত না হই সেদিকে থাকতাে আমাদের সতর্ক দৃষ্টি। তাই একটু পরপর রেডিওর নব’ ঘুরিয়ে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে চলে আসতাম । আর যখন কানে ভেসে আসতাে ‘বিচ্ছুর লাহান পােলাপানগুলার গাবুইর্যা মাইরের কথা, ‘পাকিস্তানি মিলিটারির ভুমা ভুমা মুছুয়াগুলা’র ছ্যারাবেরা অবস্থার কথা, তখন সাক্ষর-নিরক্ষর ছেলে-বুড়াে মেয়ে-পুরুষ নির্বিশেষে সবাই নড়েচড়ে বসতাে। মুহূর্তকাল আগেও যার মধ্যে ছিলাে বিমর্ষতা আর হতাশা, চরমপত্রের যাদুমন্ত্র এক মুহূর্তেই তার মধ্যে খুশির জোয়ার বইয়ে দিতাে, হতাশাকে ঝেড়ে ফেলে দিতাে। মানুষের মনে কীভাবে আশাবাদকে জাগিয়ে রাখা যায়, কীভাবে সকলকে আত্মবিশ্বাসে উদ্বুদ্ধ করতে হয়, নেতিবাচক ভাবনার বিপরীতে ইতিবাচকতাকে কোন পন্থায় ঊর্ধ্বে তুলে ধরতে হয়—চরমপত্রকার সেই আর্টটি ভালাে করেই জানতেন। বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলের উপভাষার সুদক্ষ ব্যবহার ছিলাে চরমপত্রের অসাধারণ শক্তির প্রধান উপাদান। মানুষের প্রাত্যহিক মুখের ভাষার যে কী বিস্ময়কর প্রকাশ ক্ষমতা এবং এর মধ্যদিয়ে লােকসমাজের সাধারণ মানুষের সঙ্গে কতাে গভীরভাবে একাত্ম হওয়া যায়—সেটি চরমপত্র শুনে আমি নতুন করে উপলব্ধি করলাম। চরমপত্রকারের নাম-পরিচয় তখন জানতে পারিনি, জেনেছিলাম মুক্তিযুদ্ধের একেবারে শেষ পর্যায়ে। নিজেই তিনি সেদিন জানিয়ে দিয়েছিলেন যে তার নাম—এম আর আখতার মুকুল। পরে জেনেছিলাম, আমার একান্ত শ্রদ্ধেয় শিক্ষক মুস্তাফা নূর-উল ইসলামের তিনি ছােট ভাই। স্বাধীনতার পরে মুকুল সাহেবের লেখা ‘আমি বিজয় দেখেছি পড়ে যদিও খুশি হতে পারিনি, কোলকাতাকেন্দ্রিক বুদ্ধিজীবীদের সম্পর্কে তার লেখা বই পড়ে তার ওপর একান্ত বিরূপতা জেগেছে যদিও, তবু মুক্তিযুদ্ধের সময়কার চরমপত্রের জন্যে শুধু আমি নই, সমগ্র বাঙালি জাতিই তার প্রতি কৃতজ্ঞ থাকবে। মুক্তকণ্ঠে বলবাে ; আমাদের স্বাধীনতা-সংগ্রামে চরমপত্রের অবদান অসামান্য ও অবিস্মরণীয়।
শুধু ‘চমরপত্র’ নয়, গান, নাটিকা, কথিকাসহ স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের সকল অনুষ্ঠানই সেই আশানিরাশার দ্বন্দ্বে দোলা দিনগুলােতে বাঙালি জাতির জন্যে প্রভূত মনােবলের
৪১৮
জোগান দিয়েছে। যুদ্ধের সময় সবার আগে নিহত হয় ‘সত্য’—এ কথাটি মােটেই মিথ্যা নয়। যুধ্যমান সকল পক্ষই যুদ্ধকালে নানারকম তথ্যবিকৃতি ঘটায়, নির্জলা অসত্য পরিবেশন যেন যুদ্ধনীতিরই অঙ্গ হয়ে ওঠে। কিন্তু বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় এ ক্ষেত্রে কিছুটা হলেও ব্যতিক্রম দেখা গেছে। সংবাদভাষ্যে কিংবা বিভিন্ন কথিকায় অতিরঞ্জন কিছু থাকলেও স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্র যুদ্ধের খবর পরিবেশনে যথেষ্ট তথ্যনিষ্ঠ ছিলাে। মুক্তিযােদ্ধা গেরিলারা যেএলাকায় অপারেশন চালিয়েছে সে-এলাকার মানুষ তাে সঙ্গে সঙ্গেই সে-খবরটি জানতে পেরেছে। এবং দু’চারদিন পরে সেই খবরটিই যখন অবিকৃতরূপে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে শুনতে পেরেছে তখন ওই বেতার কেন্দ্রটির ওপর তাদের আস্থা দৃঢ় হয়েছে। সকলে বিশ্বাস করতে পেরেছে যে, স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্র কোনাে মিথ্যা খবর দেয় না। দু’একটি ভুল তথ্য কখনাে কখনাে পরিবেশিত হলেও সংবাদ প্রচারের ক্ষেত্রে এই বেতারকেন্দ্রটি কখনাে। মিথ্যার আশ্রয় গ্রহণ করেনি। এ কারণেই স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্র-পরিবেশিত খবরগুলাের একটা আলাদা মূল্য ছিলাে।
বেতারে যুদ্ধের উদ্দীপনামূলক খবর শুনতে শুনতে বালালি গ্রামের যুবকরা মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে নিজেদের প্রত্যক্ষভাবে যুক্ত করার জন্যে অস্থির হয়ে উঠেছিলাে। বিশেষ করে আমাদের পাঠচক্রের সদস্যদের মধ্যে আবেগের সঙ্গে একটা যৌক্তিক দায়িত্ববােধ এসে যুক্ত হয়েছিলাে। ইতিমধ্যে মুক্তিযােদ্ধা গেরিলারারও এলাকায় যাতায়াত করতে শুরু করেছে। ওদের কাছ থেকে দিশা পেয়েই মুক্তিযুদ্ধে নাম লেখানাের জন্যে বালালির তরুণরা মন স্থির করে ফেললাে।
আমি যখন ভাটি এলাকায় প্রায় পলাতক জীবন কাটাচ্ছি, তখন আমার বাবা ও ঠাকুরমা গ্রামের বাড়িতে। ছােটো ভাই মতীন্দ্র, মা, ছােটো বােন এবং একটি ভাগ্নিকে—অর্থাৎ আমার মাসতুতাে বােনের মেয়েকে বারহাট্টায় রেখে এসেছিলাম। কিন্তু ওখানে তাদের বেশিদিন থাকা হয়নি। কারণ এপ্রিলের শেষদিকে নেত্রকোনা শহরে পাক মিলিটারিরা পৌঁছে যাওয়ার পর থেকেই বারহাট্টা আর মুক্তাঞ্চল থাকেনি, সেখানে পাক দালালদের তৎপরতা বেড়ে যায়। যান। চলাচলের সুবিধা নিয়ে দালালরা পাক হানাদার বাহিনীর সঙ্গে নিয়মিত যােগাযােগ করে, রাজাকার বাহিনী গড়ে তােলে, এলাকায় ত্রাসের রাজত্ব চালায়। তাই মতীন্দ্রকে মা-বােনভাগ্নিদের সঙ্গে নিয়ে বারহাট্টা থেকে পালিয়ে নানা গাঁয়ে আশ্রয় নিতে হয়। মে মাসের শেষদিকে জানতে পেরেছিলাম যে, তারা কলমাকান্দা থানার রানাগাঁয়ে খগেশ কিরণ তালুকদারের বাড়িতে আছে। এরপর আর তাদের কোনাে খবর পাইনি।
জুনের শেষদিকে আজিজুল ইসলাম খান (তখনকার ন্যাপ নেতা, বর্তমানে নব্বইয়ের দশকে গণতন্ত্র পার্টির সহসভাপতি) আমাকে খুঁজতে খুঁজতে ভটেরগাতি গ্রামে সামাদের বাড়িতে গিয়ে হাজির হলেন। সামাদকে দিয়ে খান সাহেব আমাকে খবর পাঠালেন যে, ফুলবাড়িয়ার শিবরামপুরে আমার শ্বশুরবাড়িতে গিয়ে তিনি আমার স্ত্রী ও শিশুপুত্রের সঙ্গে দেখা করে এসেছেন। আমার শ্বশুর-পরিবারের সকলকে সহ ওরা সুস্থ আছে বটে, কিন্তু ফুলবাড়িয়া এলাকায় পাক মিলিটারি ও রাজাকারদের উৎপাত বেড়ে গেছে। একান্ত অনিশ্চয়তার ভেতর উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠায় সকলের দিন কাটছে। অথচ এলাকা থেকে বেরিয়ে অন্য কোথাও চলে যাওয়ারও কোনাে সুযােগ নেই।
আগস্টের প্রথম সপ্তাহেই একদল মুক্তিযােদ্ধা বালালি গ্রামে এলাে। নাসিরাবাদ কলেজের ছাত্র আবদুল জব্বার ছিলাে সে দলের কমান্ডার। ময়মনসিংহ শহরে আমার প্রতিবেশী বিমল
৪১৯
পালও সে দলে ছিলাে। জব্বার জানালাে : মতীন্দ্রর সঙ্গে তার দেখা হয়েছে সীমান্তের মুক্তাঞ্চল মহেশখােলায়। ওখানকার এক হাজং বাড়িতে সে মা-বােন-ভাগ্নিকে নিয়ে সীমান্ত পাড়ি দেয়ার অপেক্ষায় আছে। এর আগে নানা গাঁয়ে ঘুরে অনেক বিপদের মােকাবেলা তাদের করতে হয়েছে। খগেশদের বাড়িতে তারা বেশ কিছুদিন নিরাপদেই ছিলাে। কিন্তু এক সময় সে বাড়িতেও তাদের ডাকাতের কবলে পড়তে হলাে। মতীন্দ্র জানতাে যে, আমি বালালি গ্রামে আছি, কিন্তু কিছুতেই সে আমার সঙ্গে যােগাযােগ করতে পারছিলাে না। জব্বার মদন থানায় অপারেশনে যাবে শুনে তাকে দিয়েই সে খবরটি আমাকে পাঠিয়ে দিয়েছে। বলে দিয়েছে, আমি যেন তাড়াতাড়ি বাবা আর ঠাকুরমাকে নিয়ে মহেশখােলায় চলে যাই, তারপর সকলে একত্র হয়ে ভারতের মেঘালয় রাজ্যে যাওয়া যাবে।
এ খবর পেয়ে দেশত্যাগের ব্যাপারে মনস্থির করতে আমার পক্ষে আর কোনাে বাধা রইলাে না। ফুলবাড়িয়ায় আমার স্ত্রী-পুত্র বা শ্বশুর পরিবারের সঙ্গে যােগাযােগ রক্ষা করা যে অসম্ভব, সে তাে বুঝেই ফেললাম। এতােদিন মনে মনে আশা করছিলাম যে, ফুলবাড়িয়া থেকে কোনাে-না-কোনােভাবে ওদের সকলকে এদিকে নিয়ে আসতে পারবাে এবং তারপর সকলে একই সঙ্গে সীমান্তের ওপারে চলে যাবাে। কিন্তু যেভাবে পাক মিলিটারি আর তাদের দোসর রাজাকাররা রাস্তায় রাস্তায় তাদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে ফেলেছে তাতে সে আশা পুরােপুরিই ভেঙে গেলাে। তাছাড়া বাবা আর ঠাকুরমার পক্ষেও গ্রামের বাড়িতে থাকা অসম্ভব হয়ে গেছে। নেত্রকোনা শহরের পাক দালালরা এখন মিলিটারিদের সঙ্গে নিয়ে প্রতিনিয়তই আমাদের গাঁয়ের ওপর দিয়ে যাতায়াত করে, আর এলাকার হিন্দু ও আওয়ামী লিগাররা কে কোথায় আছে তার খোঁজ নেয়। একদিন তাে আমার বাবা, তার বন্ধু কামিনী চক্রবর্তী ও আমার প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষক নগেন্দ্র নন্দী ওদের বন্দুকের গুলির মুখেই প্রায় পড়ে গিয়েছিলেন। প্রাণে বেঁচে যান নিতান্তই দৈবক্রমে।
তারা তিনজনে সেদিন কামিনী বাবুর বাড়ির ভেতরের ঘরে বসে গল্প করছিলেন। বাড়িটি বড়াে সড়কের পাশেই। সড়কে একটি জিপের শব্দ শুনেই তারা উঠে দাঁড়িয়েছিলেন। হঠাৎ জিপটি বাড়ির কাছে এসেই থেমে গেলাে। সঙ্গে সঙ্গে তিনজন দৌড়ে বাড়ির পেছনের জঙ্গলে ঢুকে গেলেন। একটু পরই কয়েকজন সৈনিক ও নেত্রকোনার শান্তি কমিটির এক সদস্য বাড়ির ভেতরে এসে ঢােকে। শান্তি কমিটির ওই লােকটি কামিনী বাবুর বিশেষ পরিচিত এবং প্রায় বন্ধুস্থানীয় । এ বাড়িতে সে আগে অনেকবারই এসেছে, চা-নাস্তা খেয়েছে, বিনয়ে বিগলিত হয়ে মিষ্টি মিষ্টি কথা বলেছে। কিন্তু আজ তার অন্য মূর্তি। বাড়িতে ঢুকেই কর্কশ কণ্ঠে কামিনী বাবুর স্ত্রীকে জিজ্ঞেস করে, কামিনী চক্রবর্তী কোথায় গেছে?
—কোথায় গেছেন জানি না। তিনি তাে…’।
একটি অশ্লীল বাক্য উচ্চারণ করে দালালটি ধমক দিয়ে কামিনী বাবুর স্ত্রীকে থামিয়ে দেয়। আর সৈনিকগুলাের সঙ্গে বিজাতীয় ভাষায় কী সব বলে। সঙ্গে সঙ্গে একটি সৈনিক জঙ্গলের দিকে গুলি ছোঁড়ে এবং অনুপস্থিত কামিনী বাবুর উদ্দেশে ক্রুদ্ধ বাক্যবাণ বর্ষণ করতে করতে চলে যায়।
বাবার মুখে ঘটনাটির বর্ণনা আমি শুনেছিলাম সামাদের বাড়িতে বসে। বাবা বলছিলেন ‘আমরা জঙ্গলটি পেরিয়ে পশ্চিম পাড়ার দিকে চলে গিয়েছিলাম। একটু আগে যদি গুলিটি ছুঁড়তাে তবে আমরা সবাই না হলেও তিনজনের কেউ-না-কেউ মারা পড়তামই।
৪২০
একটি বড়াে মহাজনী নৌকা ভাড়া করে নন্দীগ্রামের কয়েকটি হিন্দু পরিবারকে সঙ্গে নিয়ে নারী-শিশুসহ জনা পঞ্চাশেক লােক—মহেশখােলার উদ্দেশে হাওড়ের জলে ভাসলাম। জলে ভেসেও স্বস্তি পাচ্ছিলাম না। দেখা গেলাে ; হাওরের কিনারার কিছু কিছু গায়েও—যেখান থেকে শহরে যাতায়াতের সহজ ব্যবস্থা আছে—রাজাকার সৃষ্টি হয়ে গেছে। এ রকমই বন্দুকধারী এক রাজাকার-দলের প্রায় সামনাসামনি আমরা পড়ে গিয়েছিলাম। মাঝিদের ডেকে ওরা নৌকা ভিড়াতে আদেশ করেছিলাে। মাঝিরা তাদের আদেশ না মেনে দ্রুত নৌকাটিকে হাওড়ের মাঝখানে নিয়ে যায়। তাই আমরা রাজাকারের হাত থেকে বেঁচে যাই। দেখলাম : রাজাকাররা আমাদের নৌকা লক্ষ করে গুলি ছুঁড়ছে, তবে তাদের স্বল্পশক্তি বন্দুকের গুলি আমাদের ক্ষিপ্রগতি নৌকাটিকে স্পর্শ করতে পারেনি।
হঠাৎ তাকিয়ে দেখি কিছুদূরে একটি গ্রাম আগুনে পুড়ছে। বােঝা গেলাে যে, মিলিটারিরা ওই হিন্দু গ্রামটিতে আগুন লাগিয়েছে। আগুনের লকলকে শিখা দেখে নৌকার ভেতর থেকে মেয়েরা ভয়ে আর্তনাদ করে উঠলাে। মাঝিরা সকলকে অভয় দিলাে। জানালাে হাওড়ে এখন অনেক জল, বলতে গেলে বিস্তৃত এলাকার সব মাঠই এখন হাওড়। মিলিটারিরা যে গ্রামে আগুন লাগিয়েছে সে গ্রামটি পাশ কাটিয়ে আমাদের নৌকাটিকে অন্য পথ দিয়ে অনায়াসে চালিয়ে নেয়া যাবে। তাই ভয়ের কোনাে কারণ নেই।
আমাদের নৌকার মাঝিরা আসলে ছিলাে গােপালপুর গ্রামের কৃষক। কৃষিই তাদের মূল উপজীবিকা, বর্ষায় নৌকা বেয়ে তারা কিছু বাড়তি রােজগার করে মাত্র। কৃষকের ঐতিহ্যগত মূল্যবােধ তাদের সমগ্র সত্তায় মিশ্রিত । তাই ওই মাঝি তথা কৃষকরা ধর্মীয় সম্প্রদায়ের পরিচয়ে মুসলমান হলেও নৌকার হিন্দু যাত্রীদের প্রতি তাদের ব্যবহারে বা দায়িত্ব পালনে বিন্দুমাত্র সাম্প্রদায়িকতার প্রকাশ ঘটে না। তাদের কথাবার্তায় ও আচরণে অসামান্য দরদের প্রকাশ দেখেছিলাম। মানবিক দরদের সঙ্গে মিশেছিলাে মুক্তিযুদ্ধের আবেগ। কতকগুলাে উপদ্রুত মানুষকে নিরাপদ আশ্রয়ে পৌছে দেয়ার দায়িত্ব কাঁধে নিয়ে তারা যেন সেই মহান আবেগের আগুনেই ইন্ধন জুগিয়েছিলাে, মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে নিজেদের সম্পৃক্ত করেছিলাে।
ঘুরপথে নৌকা চালিয়ে নিয়ে যাওয়ার ফলে গন্তব্যে পৌঁছতে আমাদের চব্বিশ ঘণ্টা সময় বেশি লেগেছিলাে। আমাদের নৌকার প্রধান মাঝিটি বললাে যে, রাতে নৌকা চালিয়ে যাওয়া ঠিক হবে না। গাগলাজোড় গ্রামে তার এক আত্মীয় আছেন, বেশ সম্পন্ন কৃষক। তার বাড়ির ঘাটে সন্ধ্যায় নৌকা বাঁধা হলাে। বৃদ্ধ মানুষটি আমাদের পরম সমাদর করলেন। রাতে মহিলাদের শােবার জন্যে একটি বড়াে ঘর ছেড়ে দিলেন। আর নিজে তিনি সে ঘরের বারান্দায় একটা রামদা হাতে নিয়ে সারারাত জেগে কাটালেন। মহিলাদের বললেন, আম্মারা, আপনেরা নিশ্চিন্তে ঘুমাইয়া পড়ুইন। এই বুইড়া ছাওয়াল আপনেরার ঘরের দরজায় জাইগ্যা রইলাে।

টঙ্ক আন্দোলন-খ্যাত হাজংদের সঙ্গে
মহেশখােলা ভারতের মেঘালয়ের সীমানার একেবারে লাগােয়া একটি গ্রাম। গারাে পাহাড়ের নিচেই গ্রামটির অবস্থান। পাহাড় ভারতের এলাকায়, নিম্নাঞ্চলের ভূমিটিই বাংলাদেশে। মহেশখােলা ও তার আশপাশের এলাকার কিছুটা অংশ পড়েছে সে-সময়কার সিলেট জেলার সুনামগঞ্জ মহকুমার অধীনে এবং কিছুটা ময়মনসিংহ জেলার নেত্রকোনা মহকুমায়। একাত্তরের
৪২১
মার্চের আগে গারাে পাহাড়ের নিম্নাঞ্চলের এই মহেশখােলায় ছিলাে পাকিস্তানি দাপট, ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলসের সদম্ভ বিচরণ। ছাব্বিশে মার্চের পরপরই রাইফেসের বাঙালি সদস্যরা ‘জয় বাংলা’ ধ্বনি দিয়ে পাকিস্তান রাষ্ট্রটিকে প্রত্যখ্যান করে, পাকিস্তানি সহকর্মীরা বিরােধিতা করলে তাদের পরাভূত করে এবং শেষে হত্যা করে। এরপর আর পাকিস্তানি সেনারা মহেশখােলায় যেতে পারেনি, পাকিস্তানি শাসনও আর সেখানে বলবৎ হয়নি। অর্থাৎ আমাদের সশস্ত্র মুক্তিসংগ্রামের প্রথম দিনেই মহেশখােলা ও তার আশপাশের বিস্তৃত এলাকা হয়ে যায় মুক্তাঞ্চল, পপত্ করে সেখানে উড়তে থাকে রক্তসূর্য-লাঞ্ছিত বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা, কেউ এ পতাকা নামাতে পারেনি।
সেই মহেশখােলারই যে হাজং বাড়িতে মা-বােন-ভাগ্নিদের নিয়ে আমার ভাই মতীন্দ্র আশ্রয় নিয়েছিলাে সেখানেই বাবা ও ঠাকুরমাকে নিয়ে গিয়ে উঠলাম। বিচ্ছিন্ন-হয়ে-থাকা পরিবারের সদস্যরা এতােদিন পরে একত্র হলাম, স্বাভাবিকভাবেই সেখানে খুশির জোয়ার বয়ে যাওয়ার কথা। কিন্তু খুশিকে ছাপিয়ে উঠলাে বিষাদ। আমার মা হাউমাউ করে কেঁদে উঠলেন। কারণ তার পুত্রবধূ আর একমাত্র নাতিকে আমরা সঙ্গে করে নিয়ে যেতে পারিনি। আজিজুল ইসলাম খানের মারফৎ যতােটুকু খবর পেয়েছিলাম তা-ই মাকে জানালাম। মা এতে একটুও আশ্বস্ত হতে পারলেন না। মা তার একান্ত আদরের নাতিকে ডাকতেন ‘সােনাভাই’ বলে। তার সেই ‘সােনাভাইটি’ কি আজো বেঁচে আছে? শক্ৰবেষ্টিত দেশে তার কি বেঁচে থাকা সম্ভব? মা কাঁদেন আর তার আড়াই বছর বয়সী সােনাভায়ের আধাে আধাে কথাগুলাে স্মরণ করেন। যেদিন সােনাভাই তার মায়ের সঙ্গে মামার বাড়িতে রওয়ানা হয়ে যায় সেদিন তার গলা জড়িয়ে ধরে কী বলে গিয়েছিলাে, অন্য কোন দিন কী দুষ্টুমি করেছিলাে, কোন দিন কী বায়না ধরেছিলাে সেই সব অতিমূল্যবান স্মৃতির কৌটো খুলে ধরেন আর তার কান্নার বেগ কেবলই বেড়ে চলে। হাসির মতাে কান্নাও সংক্রামক। স্ত্রী ও একমাত্র শিশুপুত্রকে দূরে অনিশ্চিত ও শঙ্কিত অবস্থার মধ্যে ফেলে রেখেও আমার কোনােদিন কান্না পায়নি, এমন কথা যদি বলি তাহলে কেউই আমাকে স্বাভাবিক মানুষ বলে মেনে নেবেন না। তবে পুরুষ মানুষ তার পৌরুষের অভিমান দিয়ে উদ্গত কান্নাকে চেপে রাখতে পারে, আমিও তা পেরেছিলাম। কিন্তু মায়ের কান্না আমার রুদ্ধ অশ্রুকে ঠেলে বের করে দিলাে, আমি তার সামনে থেকে দ্রুত পালিয়ে গিয়ে তা গােপন করলাম।
আগের কয়েক মাস কাটিয়েছি মুসলমান কৃষকদের ভেতর। সেখানে থেকে কৃষকমানসের অন্তরঙ্গ পরিচয় নিতে চেষ্টা করেছি, সে-সমাজের অভ্যন্তরীণ বিরােধ বৈপরীত্যগুলাে অবলােকন করেছি, আধুনিক শিক্ষাপ্রাপ্ত কৃষক সন্তানদের চিন্তাচেতনার বাঁকগুলােও লক্ষ করেছি। এবার মহেশখােলায় এসে মুখােমুখি হলাম আদিবাসী হাজং কৃষকদের। মহেশখােলায় মাত্র অল্প কয়েকদিনই ছিলাম, তাই হাজং কৃষকদের একেবারে ভেতর মহলের খবর নেয়া সম্ভব হয়নি। যে লড়াকু হাজং কৃষকদের অংশগ্রহণে টঙ্ক আন্দোলন একটি অসাধারণ জঙ্গিরূপ লাভ করেছিলাে বলে শুনেছি ও বইয়ে পেড়েছি, মহেশখােলার শান্ত নিরীহ হাজংদের চোখের সামনে দেখে আমার সেই শ্রুত ও পঠিত ইতিহাসের সঙ্গে তাকে কিছুতেই মিলিয়ে নিতে পারলাম না। এ-বিষয়টি নিয়ে পরে আমি কমরেড মন্মথ দের সঙ্গে আলাপ করেছিলাম। মন্মথ দা যা বলেছিলেন তার মর্মার্থ হলাে, হঁ্যা, হাজংরা খুবই শান্ত, নিরীহ ও সরল। কিন্তু এই নিরীহ মানুষগুলাের ভেতরে আছে প্রতিবাদের আগুন। উপযুক্ত ইন্ধন পেয়ে সেই আগুনই একবার জ্বলে উঠেছিলাে, সৃষ্টি হয়েছিলাে টঙ্ক আন্দোলনের মতাে এক দাবানলের।
৪২২
কিন্তু সেই দাবানল নিভে গেলাে কেন? এ-প্রশ্নের এক কথার উত্তর কেউই দিতে পারেন । কিংবা অনেকেই যার যা মনগড়া উত্তর দিয়ে সেটাকেই মােক্ষম উত্তর বলে চালাতে চান। মহেশখােলার নিশি মাস্টারকে আমি প্রশ্নটা জিজ্ঞেস করেছিলাম। এই হাজং যুবক বলেছিলেন, ‘হাজংরা তাে আন্দোলন থেকে হঠে আসেনি। তারা চরম আত্মত্যাগ করেছে।…কিন্তু আন্দোলনের নেতারাই আন্দোলন তুঙ্গে উঠে যাওয়ার পর এক সময় বললেন যে আন্দোলনে অনেক ভুল হয়ে গেছে, এবং সেই নেতারাই হঠাৎ করে আন্দোলনটি বন্ধ করে দিলেন।
নিশি মাস্টারের কথাও হয়তাে পুরাে সত্য নয়। তার নিজস্ব স্মৃতি বা অভিজ্ঞতা থেকে তিনি কথাগুলাে বলেননি। কারণ টঙ্ক আন্দোলনের সময় তার বয়স খুব বেশি ছিলাে না, আন্দোলনে প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণ তিনি করতে পারেননি। তবে আন্দোলন-পরবর্তীকালের হাজংদের দুর্দশার তিনি অংশীদার। পাকিস্তান সরকারের নির্মম অত্যাচারে অধিকাংশ হাজংই দেশ ছাড়া হয়েছে, চলে গেছে ভারতের মেঘালয়ে ও আসামে। তবে অনেকেই দেশত্যাগ করতে পারেনি, সামান্য ফসলের জমি আঁকড়ে দেশের মাটিতে পড়ে থেকেছে। মহেশখােলা এ রকম দরিদ্র হাজংদেরই গ্রাম। মেয়ে-পুরুষ মিলে হাজংরা ক্ষেতে কাজ করে। মেয়েরা বরং পুরুষদের চেয়ে অনেক বেশি পরিশ্রমী, নানা ধকলও তাদেরই সইতে হয় বেশি। ক্ষেতে যেমন কাজ করে তারা, তেমনি সন্তানের পরিচর্চা রান্নাবান্না ও ঘর গেরস্তালির সব কাজ করে সমান তালে, সমান নৈপুণ্যে। আবার এই মেয়েরাই বিয়ের বাসরে সুরেলা কণ্ঠে গীত গায়, ছেলে ভুলানাে গল্প ও ব্রতকথা বলে, নানা শােলােক ও প্রবাদ আওড়ায়, সূক্ষ্ম সূচিকর্ম করে, গৃহসজ্জায় শিল্পনৈপুণ্যের পরিচয় দেয়। মহেশখােলার কলানিপুণা হাজং রমণীদের দেখে আমি ভাবছিলাম, বীরাঙ্গনা রাসিমণির কথা। টঙ্ক আন্দোলনে এই হাজং নারীর বীরত্বের কাহিনী কিংবদন্তীতে পরিণত হয়েছে। রাসিমণিতাে এ-রকম একজন শান্ত স্বভাবের গৃহবধূই ছিলেন। অথচ, প্রবলের অত্যাচার প্রতিরােধ করতে গিয়েই তিনি রণরঙ্গিনী মূর্তিতে আত্মপ্রকাশ করেছিলেন। রাসিমণি একা নন, তার সঙ্গে এসে যােগ দিয়েছিলাে চাষবাস ও গৃহকর্মে নিরতা একদল হাজং রমণী। যে দা-বটি দিয়ে তারা কুটনা কুটতাে, সেই দা বটি নিয়েই তারা শত্রুর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েছিলাে। রাসিমণি আর তার নারীবাহিনীর কথা ভাবতে ভাবতে আমার মনে হয়েছিলাে : প্রতিটি হাজং নারীর ভেতরই বােধ হয় একেক জন রণরঙ্গিনী রাসিমণি লুকিয়ে আছে, প্রয়ােজনের মুহূর্তে তার প্রকাশ ঘটে।
আমার বােন মায়া ছিলাে বাংলা অনার্সের ছাত্রী। তার সঙ্গে বেশ কয়েকজন হাজং মেয়ের ভাব জমে যায়। ওদের কাছ থেকে শুনে শুনে হাজং ভাষার অনেকগুলাে শােলােক সে খাতায় লিখে নিয়েছিলাে। ওদের ভাষাটাও তার অল্পদিনেই রপ্ত হয়ে যায়। হাজংরা অবশ্যি বাংলাভাষীই। তবু বৃহত্তর বাঙালি সমাজের বাইরে অবস্থানকারী হাজংদের একটা আলাদা বৈশিষ্ট্য আছে। শুধু ভাষায় নয়, জীবন-ভাবনা ও জীবন-আচরণেও তাদের স্বাতন্ত্র প্রকট। হাজংদেরই প্রতিবেশী অন্য আদিবাসীগােষ্ঠীটির নাম গারাে। সমতলের বাঙালিরা দুটো গােষ্ঠীর মানুষকেই অভিন্ন বা প্রায়-অভিন্ন বলে মনে করেন, একই সঙ্গে দু’য়ের নাম বলে ‘গারােহাজং’। কিন্তু দুটো গােষ্ঠীর মানুষের ভেতর নৃতাত্ত্বিক বিচারে ঐক্য থাকলেও দু’য়ের মধ্যে বহু বিষয়ে বিস্তর ফারাক। গারােরা মাতৃতান্ত্রিক, হাজংরা পিতৃতান্ত্রিক। গারােরা সর্বপ্রাণবাদী আদিম ধর্মের অনুসারিতা ছেড়ে উনিশ শতক থেকেই খ্রিষ্টান মিশনারিদের প্রভাবে খ্রিষ্টান হয়ে যেতে থাকে এবং বর্তমানে গারােদের শতকরা আটানব্বই ভাগেরও বেশি মানুষ খ্রিষ্টান। হাজংরা
৪২৩
খ্রীষ্টান হয়নি, চৈতন্যদেবের প্রচারিত গৌড়ীয় বৈষ্ণব ধর্মের সংস্পর্শে এসে তারা আস্তে আস্তে হিন্দুকরণ প্রক্রিয়ার ভেতরে পড়ে গেছে। তবু, হিন্দু হয়েও বাঙালি হিন্দু সমাজের সঙ্গে তাদের স্বাতন্ত্র্য ঘুচে যায়নি। আদিম লােকায়ত ধর্মের ঐতিহ্য তাদের ভেতর এখনাে জীবন্ত। ব্রাহ্মণ্যবাদী হিন্দু দেবদেবীদেরও তারা মানে, তবে সেই মান্যতার ক্ষেত্রেও নিজস্ব বৈশিষ্ট্যটি তারা হারিয়ে ফেলেনি, তাদের নিজস্ব দেবদেবীর চরিত্র বৈশিষ্ট্যগুলির সঙ্গে মিলিয়ে দেবতাকল্পনাতেও তারা অভিনবত্বের সৃষ্টি করেছে। হাজংদের এই স্বাতন্ত্র্যমণ্ডিত ভাবজগৎটি সম্পর্কে বাঙালি হিন্দু-মুসলমানের ধারণা নিতান্তই ভাসা ভাসা। এ বিষয়টি নিয়ে পণ্ডিতরাও তেমন একটা গরজ দেখাননি। এভাবেই নিকট প্রতিবেশিদের পরিচয়ও আমাদের কাছে অন্ধকারাচ্ছন্ন হয়ে পড়ে, সামাজিক বিচ্ছিন্নতা বেড়ে যায়।
মহেশখােলায় যে-হাজংদের আমি দেখেছিলাম তারা তখন শুধু দরিদ্র নয়, একান্তই অসহায়। টঙ্ক আন্দোলনের আংশিক সফলতা এবং পর্বত প্রমাণ ব্যর্থতা ও ক্ষয়ক্ষতির পর যে হাজংরা দেশত্যাগ করতে পারেনি তাদেরই দারিদ্র ও অসহায়ত্ব একেবারে সীমা ছাড়িয়ে গিয়েছিলাে। পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রটি তাদের ওপর অমানুষিক বর্বর আচরণ করেছে, সর্বদা শারীরিক-মানসিক নির্যাতন চালিয়েছে। গ্রামে অনেকগুলাে পােড়ড়া বাড়ি দেখেছিলাম। জিজ্ঞেস করে জেনেছিলাম যে ওই সব বাড়ির মানুষদের কেউই দেশত্যাগী হয়নি, মায়ের দয়ায় তারা ইহলােক ছেড়েই চলে গেছে। মায়ের দয়া মানে বসন্ত মহামারী। যে বাড়িতে ‘রােদন ভরা এ বসন্ত ঢুকেছে সে বাড়িতে শেষ পর্যন্ত রােদন করার জন্যেও কোনাে লােকই জীবিত থাকেনি। মহামারীতে আক্রান্ত মানুষদের কোনাে চিকিৎসা হয়নি, সুস্থ মানুষদের জন্যে প্রতিষেধক টিকা। নিয়ে কোনাে স্বাস্থ্যকর্মী সে গ্রামে কোনাে দিন যায়নি। রাষ্ট্র এখানকার প্রজাদের জন্যে কল্যাণমূলক কাজ কিছুই করেনি, কিন্তু দমনমূলক কর্মকাণ্ড চালিয়েছে প্রবল পরাক্রমের সঙ্গে। হাজংরা যেহেতু হিন্দু, তাই মুসলমানের রাষ্ট্র পাকিস্তানের তারা শত্রু—পাকিস্তান রাষ্ট্রের এই সরল সমীকরণ তাে গােড়া থেকেই ছিলাে। টঙ্ক আন্দোলনের পর সে সমীকরণটিই হাজংদের সম্পর্কে রাষ্ট্রনীতির অপরিহার্য অঙ্গ হয়ে যায়। পাকিস্তানের পুলিশ ও সীমান্ত রক্ষীরা প্রতিনিয়তই হাজংদের রাষ্ট্রবিরােধিতার প্রমাণ প্রস্তুত করতাে। এবং সেই প্রস্তুত করা প্রমাণের সাহায্যে তাদের নানাভাবে হেনস্থা করতাে। কোনাে হাজংয়ের ঘরে হয়তাে পাওয়া গেলাে দু’ প্যাকেট ভারতীয় বিড়ি কিংবা এ রকমই সামান্য কোনাে ভারতীয় জিনিস। ব্যস, পাকিস্তানের আইন-শৃঙ্খলা ও সীমান্ত রক্ষাকারীদের বিচারে সে হয়ে গেলাে ভয়ংকর একজন স্মাগলার, পাকিস্তানের অর্থনীতি-ধ্বংসকারী, এবং হিন্দুস্থানের চর। এ রকম ‘স্মাগলার’ বা হিন্দুস্থানের চরদের আদালতে খুব কমই সােপর্দ করা হতাে, পুলিশ বা সীমান্তরক্ষীরা নিজেরাই তাদের বিচার করতাে। অর্থাৎ প্রচণ্ড শারীরিক নিগ্রহ ভােগ করে এবং ওদের হাতে সাধ্যের অতিরিক্ত অর্থ তুলে দিয়ে তবে ওই কথিত অপরাধীরা রেহাই পেতাে। এমনই চলেছে দিনের পর দিন।
মেঘালয়ের বাঘমারা শরণার্থী শিবিরে গিয়ে টঙ্ক আন্দোলনের দুই লড়াকু হাজং বীর ললিত সরকার ও বিপিন গুণের দেখা পেয়েছিলাম। (সরকার ও গুণের মতাে বাঙালি হিন্দুর কৌলিক পদবিগুলাে নাকি হাজংদের দিয়েছিলেন সুসঙ্গের মহারাজা।) ললিত সরকারের বাড়িঘরসহ সকল সম্পত্তি পাকিস্তান সরকার বাজেয়াপ্ত করেছিলাে। এরপর তিনি নিঃসম্বল অবস্থায় ভারতে চলে যেতে বাধ্য হন। ভারতেও তিনি কম্যুনিস্ট পার্টির সদস্যরূপে নানা গণআন্দোলনের সঙ্গে সক্রিয়ভাবে যুক্ত থাকেন। আমাদের স্বাধীনতা-সংগ্রাম চলাকালে তিনি নানাভাবে আমাদের
৪২৪
সাহায্য সহযােগিতা করেন। বিপিন গুণ শত অত্যাচার সহ্য করেও আগে দেশত্যাগ করেননি, মুক্তিযুদ্ধের কালে আমাদের সঙ্গে তিনি একই শরণার্থী শিবিরে আশ্রয় নেন। সেখানেও তিনি নিষ্ক্রিয় হয়ে থাকেননি। শরণার্থীদের বিভিন্ন সমস্যা সমাধানের জন্যে কর্তৃপক্ষের পক্ষে দেনদরবার করেছেন, শরণার্থীদের মধ্য থেকে মুক্তিযােদ্ধা রিক্রুটে নিযুক্ত থেকেছেন।
কয়েক জন হাজং তরুণ আমার ছিয়াশি বছর বয়সিনী ঠাকুরমাকে বাঁশের তৈরি দোলায় চড়িয়ে কাঁধে করে বয়ে নিয়ে মহেশখােলা থেকে ষাট মাইল পাহাড়ি রাস্তা পাড়ি দিয়ে বাঘমারা শরণার্থী শিবিরে পৌছিয়ে দিয়েছিলাে। আমাদের বাঘমারা যাওয়ার মাস তিনেক আগেই মহাদেব সান্যাল সেখানে আশ্রয় নিয়েছিলেন। তিনি ভারত সরকারের তৈরি করে দেয়া ক্যাম্পে’র খুপড়িতে থাকতেন না। বাঘমারা বাজারের পাশে মালিকোণা এলাকায় বেশ কিছু ফাঁকা জায়গা ছিলাে। স্থানীয় গারাে মালিকদের কাছ থেকে বন্দোবস্ত নিয়ে অনেকগুলাে শরণার্থী পরিবার সে জায়গায় বাঁশের মাচার ওপর ঘর তৈরি করে নিয়েছিলাে। মহাদেব বাবুও তাই করেছিলেন। ঘরের মূল নির্মাণ সামগ্রী বাঁশ সেখানে বেশ শস্তায় পাওয়া যেতাে। তাই আমরাও মহাদেব বাবুর ঘরটির পাশেই একটি ঘর তৈরি করে নিলাম। আমরা বাঘমারা শরণার্থী শিবিরে পৌছাই সেপ্টেম্বরের দ্বিতীয় সপ্তাহে। পৌছানাের দু’তিন দিন পরেই ময়মনসিংহ থেকে একটি চিঠি পেলাম। আমার কলেজ জীবনের বন্ধু (এবং পরে যার ছােট বােন হয় আমার স্ত্রী) শচীন আইচের এই চিঠিটি অনেক দিন পরে অনেক হাত ঘুরে আমার হাতে এসে পৌছায়। চিঠিতে শচীন জানিয়েছে যে, ফুলবাড়িয়ায় গ্রামের বাড়িতে রাজাকারদের অত্যাচারে ও পাক সেনাদের দৌরাত্ম্যে টিকতে না পেরে তারা ময়মনসিংহ শহরে চলে এসেছে। এবং এখানে এসে তার ছােট বােন অর্থাৎ আমার স্ত্রীসহ পরিবারের সকলকে নিয়ে পবিত্র ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছে। এ ছাড়া জীবন রক্ষার আর কোনাে উপায় ছিলাে না।

প্রাণের ভয়ে ধর্মান্তর গ্রহণের ছেলেখেলা
বাড়ির বউ তার বাবার পরিবারের সবার সঙ্গে ইসলাম গ্রহণ করেছে—এই খবরে আমার বাবামার মধ্যে কোনাে বিকার লক্ষ করলাম না। বরং তারা অনেকটা স্বস্তি পেয়েছেন বলে মনে হলাে। শচীনের চিঠিটা পড়ে তাে এটুকু অন্তত বােঝা গেছে যে, মুসলমান হওয়ার ফলে ময়মনসিংহ শহরে তারা নিরাপদে থাকতে পারবে। আমার স্ত্রী একটি ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে মাস্টারি করতাে। সেখানে সে আবার জয়েন করেছে। তার দাদা শচীনও সিটি কলেজিয়েট স্কুলের মাস্টারিটি ফিরে পেয়েছে। তাই তাদের জীবিকার ব্যাপারটিও এখন মােটামুটি নিশ্চিত। এই সব বিবেচনাতেই আমার মা বাবাকে বেশ আশ্বস্ত হতে দেখা গেলাে।
হিন্দু থেকে মুসলমান হয়ে যাওয়াটা যেন কোনাে ব্যাপারই নয়, আমার মা বাবার ভেতর এমন একটা ভাবনার প্রকাশ দেখে আমি অবাক হয়ে গেলাম। অথচ তারা যে ধর্ম কিংবা জাতপাত সম্পর্কে সংস্কারমুক্ত, তা তাে নয়। আমার মা তাে বটেই, বাবাও মুসলমানের ছোয়া খাবার খেতে রাজি নন। স্টলে বসে তিনি চা খাননি কোনাে দিন। কারণ সেখানে জাতপাত মানা হয় না। বাবা গ্রামসমাজের টিপিক্যাল হিন্দুদেরই একজন। ধর্ম সম্পর্কে উদার, কিন্তু জাতপাতের বিষয়ে রক্ষণশীল। ধর্ম সম্পর্কে পড়াশােনাও তিনি কম করেননি। আমি যে বস্তুবাদী মত পােষণ করি, এ বিষয়েও তিনি অবগত। শুধু অবগত নন, আমার এ মতকে তিনি
৪২৫
স্নেহসিক্ত প্রশ্রয়ও দেন। কিন্তু চিন্তার অবাধ স্বাধীনতায় বিশ্বাসী হলেও তার ছেলে মেয়েরা হিন্দু আচারের গণ্ডি ভেঙে বেরিয়ে আসবে, এমনটি তিনি মেনে নিতে পারেন না। বাবার ভেতর আমি অদ্ভুত স্ববিরােধিতা দেখেছি। শুধু আমার বাবা নন। গ্রামে যে হিন্দুরা থাকতেন তাদের প্রায় সবাই এরকম। এদের মধ্যে যারা গ্রামীণ এলিট তাদের মধ্যেই চিন্তায় আচরণে স্ববিরােধিতাটা বেশি মাত্রায় প্রকট। তারা যথাসম্ভব পড়াশােনা করেন, আধুনিক নাগরিক সাহিত্য-সংস্কৃতিরও খোজ খবর রাখেন। তাদের কথাবার্তার মধ্যে অনেক রেডিক্যাল ভাবনার প্রকাশ থাকে। কিন্তু আচার আচরণে তারা একেবারে ষােল আনা রক্ষণশীল হিন্দু। ব্রাহ্মণ্যবাদী আচার নিয়মের পান থেকে চুন খসে পড়ার ব্যাপারেও তারা সদা সতর্ক। খাওয়া দাওয়ায় মুসলিম সংস্পর্শ তাে বটেই, নিম্নবর্ণের হিন্দুদেরও ছোঁয়া বাঁচিয়ে চলেন সব সময়। কোনাে হিন্দু আনুষ্ঠানিকভাবে ইসলাম গ্রহণ করলে তার সঙ্গে সামাজিক সম্পর্ক বজায় রাখার মতাে উদারতা ষাটের দশকেও কোনাে হিন্দুর মধ্যে আমি দেখিনি। আমার বাবাও এর ব্যতিক্রম নন। অথচ সেই তিনিই কি না ছেলের বউ মুসলমান হয়ে গেছে শুনেও নির্বিকার—এমনটি কী করে হয়?
এও বােধ হয় মহান মুক্তিযুদ্ধেরই অবদান। মুক্তিযুদ্ধই একথা স্পষ্ট করে দিয়েছিলাে যে এখন আর হিন্দু বা মুসলমান নয়, বাঙালি হয়ে আমাদের বাঁচতে হবে। তাই একাত্তরের এপ্রিলে আমি যখন মুসলমান কৃষকদের বাড়িতে আহার ও আশ্রয় গ্রহণ করি, তখন বাবা সেটাকে খুব স্বাভাবিক বলেই মেনে নেন। গ্রামের সকল দ্র’ হিন্দুর মতােই আমার বাবাও কোনােদিন লুঙ্গি পরে ঘরের বার হতেন না, এমনকি ঘরেও লুঙ্গি পরে থাকতে অস্বস্তি বােধ করতেন। পাকিস্তান সৃষ্টির পরে শহর নগরে ধুতির ব্যবহার ক্রমে ক্রমে কমে এলেও গ্রামের হিন্দুরা ধুতি ছেড়ে দেয়নি, অন্তত আমার বাবার প্রজন্মের হিন্দুরা তাে নয়ই। স্বাধীনতার সংগ্রাম শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে কিন্তু দেখা গেলাে ধুতি-লুঙ্গি সম্পর্কীয় সব সংস্কার হাওয়ায় মিলিয়ে গেছে, আমি যাকে বলি ‘ধুতি-লুঙ্গি দ্বন্দ্ব সমাস’ তা আর নেই। আমার বাবাসহ গায়ের সকল হিন্দুই লুঙ্গি পরে বৃহত্তর সমাজের মানুষদের সঙ্গে মিশে যেতে চাইলেন, লুঙ্গিকে মুসলমানের পােশাক বলে বিবেচনা করা ছেড়ে দিলেন, গাঁয়ের সকল মানুষ অভিন্ন পােশাক পরে একই উৎপীড়িত জনসংঘের সদস্য হয়ে গেলাে। উৎপীড়নের বিরুদ্ধে মাথা তুলে দাঁড়ালাে এই বিদ্রোহী জনসংঘ। সেই আপকালে তাদের অন্তরঙ্গ বহিরঙ্গ এক, খাওয়া ছোঁয়া বা পােশাক পরিচ্ছদের বিরােধ বৈপরীত্যও প্রায় লুপ্ত । হিন্দুর জাতধর্ম নষ্ট হতাে বেজাতের বা বেধর্মের মানুষের ছোঁয়া খাদ্য গ্রহণ করলে। এখন যেহেতু মুসলমানের ভাত খেলে হিন্দুর জাত যায় না, তাই তার ধর্ম। নষ্ট হবে কিসে? বাবাও বােধ হয় ভাবলেন যে জাত যখন যাবে না তখন কলেমা পড়লেও তার পুত্রবধূর ধর্ম নষ্ট হবে না, হিন্দুই থেকে যাবে। আর মুসলমান হয়ে গিয়ে যদি পাকহানাদার কবলিত বাংলাদেশে জীবন রক্ষা করা যায় তাতে একবার কেন একশ’ বার মুসলমান’ হতেই আপত্তিটা কিসের? ধর্ম রক্ষার আগে তাে আত্মরক্ষা।
এ ব্যাপারে আমার মায়ের বিবেচনাটা আরাে বেশি প্র্যাকটিক্যাল। তার কথা হলাে, ‘আমার বউমা আর আমার নাতি তাে আমারই আছে, আমারই থাকবে। তারা মুসলমান হলেই কি, খ্রিস্টান হলেই কি?…ভালােয় ভালােয় যুদ্ধটা শেষ হয়ে যাক, আমরা দেশে ফিরে যাই, আমার সােনা ভাইকে কোলে তুলে নিই।
তার সােনাভাই অর্থাৎ ছােট্ট নাতিটিই তার কাছে সব। দেশে ফিরে গিয়ে কখন সােনাভাইকে কোলে তুলে নিতে পারবেন সে-চিন্তাই তার সমস্ত সত্তাকে সব সময় ঘিরে রাখে। জাতধর্মের ভাবনা তার কাছে এখন একান্তই তুচ্ছ ।
৪২৬
আমার শ্বশুর পরিবারের মুসলমান হওয়ার পরিপ্রেক্ষিতটি বর্ণনা করে লেখা আমার স্ত্রী শ্রীমতি কানন সরকারের একটি স্মৃতিকথামূলক প্রবন্ধ ‘মর্মান্তিক ধর্মান্তর’ রশীদ হায়দার সম্পাদিত ১৯৭১ ; ভয়াবহ অভিজ্ঞতা বইয়ে ছাপা হয়েছে। সে সময়ে ময়মনসিংহ শহরে। অবস্থানরত প্রায় সকল হিন্দুই ধর্মান্তর গ্রহণ করেছিলেন। বাংলাদেশের আরাে অনেক স্থানেই এ রকমটি ঘটেছিলাে। কিন্তু কাগজেপত্রে সে সবের বিবরণ খুব কমই ধরে রাখা হয়েছে। মুসলমান হয়ে যাওয়া সব হিন্দুই দেশ স্বাধীন হওয়ার পর আপনা থেকেই হিন্দু হয়ে গেছে, গােবর খেতে হয়নি বা অন্য কোনাে প্রায়শ্চিত্ত করতে হয়নি। এ রকম সকল হিন্দুই মুসলমান হয়ে যাওয়ার সেই মর্মান্তিক স্মৃতিটি ভুলে যেতে চেয়েছে। সেই সঙ্গে ভুলে যেতে চেয়েছে হিন্দুর স্মৃতিশাস্ত্রের সব কঠিন কঠোর বিধিবিধানকে। বড়াে বড়াে সংস্কারকদের এক দেড়শাে বছরের প্রচার ও প্রয়াসে যা হয়নি, রাষ্ট্রবিপ্লবের ধাক্কায় অতি অল্পদিনে তা হয়ে গেছে, বাঙালি হিন্দু অনেক অর্থহীন আচার সংস্কারের হাত থেকে নিজেকে মুক্ত করে নিয়েছে। শুধু আচার সংস্কার নয়, জাতধর্মের সব ব্যাপারই হাসি ঠাট্টার বিষয় হয়ে গেছে।
স্বাধীনতার পর আমার বাবাকে দেখেছি তার বেয়াইয়ের (অর্থাৎ আমার শ্বশুর মহাশয়ের)। মুসলমান হওয়া নিয়ে নানা রকম রসিকতা করতে। আমার ঠাকুরদা (পিতামহ) ছিলেন ঘাের শাক্ত। সেই হিসেবে, পারিবারিক ঐতিহ্যের দিক দিয়েই আমার বাবাও শাক্ত। আর আমার শ্বশুর মহাশয় তার পূর্ব পুরুষের ঐতিহ্যের অনুসরণে দীক্ষা নিয়েছিলেন বৈষ্ণব গুরুর কাছ থেকে। তাই আমার বাবা আর তার বেয়াইয়ের মধ্যে শাক্ত বৈষ্ণবের কৃত্রিম ঝগড়া খুব জমে উঠতাে। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর সে ঝগড়াতেই একটা নতুন মাত্রা যুক্ত হলাে। শাক্ত বেয়াই তার বৈষ্ণব বেয়াইকে মুসলমান হওয়ার কথাটা স্মরণ করিয়ে দিয়ে তাতিয়ে তুলতে চেষ্টা করতেন। বলতেন, “বেয়াই, মুসলমান হয়ে মসজিদে গিয়ে আপনি যখন আল্লাহর নাম করতেন তখন কি আপনার ইস্ট দেবতা কৃষ্ণের কথা মনে পড়তাে না?
বেয়াই জবাব দিতেন, “আরে, তা মনে পড়বে না কেন? আমার কৃষ্ণই তাে আমাকে সে সময় বিপদ থেকে উদ্ধার পাওয়ার জন্যে মুসলমান হওয়ার বুদ্ধি জুগিয়ে দিয়েছিলেন। আর ঈশ্বরের নাম কি শুধু একটা? কৃষ্ণ যার নাম আল্লাহও তাে তারই নাম। কৃষ্ণ নামে তাকে ডাকলে যা আল্লাহ নামে ডাকলেও তা-ই। ডাকার মতাে ডাকতে পারলে যে কোনাে নামে ডাকলেই তিনি সাড়া দেন…।
এসব কথা বলতে বলতে দু বেয়াই শেষ পর্যন্ত রসিকতা বা ঠাট্টা তামাশার কথা ভুলে গিয়ে সিরিয়াস হয়ে উঠতেন। এদিক দিয়ে হিন্দুর খুবই সুবিধাজনক অবস্থান। রাম রহিম না। জুদা করাে ভাই’ কিংবা ‘ঈশ্বর আল্লাহ তেরে নাম’—এ সব কথা হিন্দুরা একান্ত গভীর বিশ্বাসের সঙ্গেই বলতে পারে। যে যথা মাং প্রপদ্যন্তে তাংস্তথৈব ভজাম্যহম’ (যে আমাকে যেভাবে উপাসনা করে, আমি তাকে যেভাবেই তুষ্ট করি)—হিন্দুদের সকল সম্প্রদায়ের একান্ত মান্য গ্রন্থ গীতায় ভগবান শ্রীকৃষ্ণের মুখ দিয়ে এমন কথাই বলানাে হয়েছে। তাই এক সময়ে হিন্দুর পক্ষে যে বাঁধন কেটে বেরিয়ে আসা একেবারেই অসম্ভব ছিলাে, বাস্তব পরিপার্শ্বের ধাক্কায় সেই ‘জাতের বাঁধন’ যখন আলগা হয়ে পড়েছে তখন ধর্মান্তরের ব্যাপারটিও, আমার শ্বশুরের মতাে রক্ষণশীল হিন্দুর কাছেও নিতান্ত ছেলে খেলা হয়ে গেছে।
তবে ধর্মান্তরিত হয়েও সকল হিন্দুর পক্ষেই প্রাণে বেঁচে যাওয়া সম্ভব হয়নি। ডিসেম্বরের দশ তারিখেই যদি ময়মনসিংহ শহর হানাদার মুক্ত না হতাে, তবে আমার শ্বশুর পরিবারেরও
৪২৭
কেউই বাঁচতে পারতেন না। আমার স্ত্রীর ছােট ভাই সুকান্তর ওপর আল বদরদের নজর পড়েছিলাে, বড়াে ভাই শচীন আইচের নাম ঘাতকদের তালিকায় উঠে গিয়েছিলাে।
ময়মনসিংহ শহরের পাক দালালরা আমাকে অনেক খোঁজাখুঁজি করেছে। তারা ধারণা করে নিয়েছিলাে যে, আমি গােপনে শহরে এসে আমার স্ত্রী পুত্রের সঙ্গে মাঝে মাঝে দেখা করে যাই। এই নিয়ে অনেক গুজব তারা ছড়িয়েছে। এসব গুজবের কথা সীমান্তের ওপারে বসেই আমি কিছু কিছু শুনেছি। আমার এক দুঃসাহসী ছাত্র ওপার থেকে এসে একদিন ময়মনসিংহ শহরের অনেক খবরাখবর সংগ্রহ করে নিয়ে গিয়েছিলাে। সে বললাে, ‘স্যার, দালালরা নাহা দা আর আপনার ওপর ভীষণ খাপ্পা। ওরা বলে যে, আলােকময় নাহা আর যতীন সরকারকে একবার পেলে হয়।
স্বাধীনতার পরে আহমদ তৌফিক চৌধুরী তার সম্পাদিত দ্বিমাসিক ঋতুপত্র পত্রিকায় একটি স্মৃতিচারণমূলক লেখা প্রকাশ করেন। তার সেই লেখায় তিনি আমার সম্পর্কে সে সময়কার ‘পাকিস্তান কাউন্সিল’ নামক সংস্থাটির ময়মনসিংহের রেসিডেন্ট ডিরেক্টরের কিছু বক্তব্যের উদ্ধৃতি দিয়েছেন। তৌফিক চৌধুরী লিখেছেন, “ডিরেক্টর সাহেব বললেন যে, যতীন সরকারের পরিবার মুসলমান হয়ে গেছে। তবে যতীন সরকার নেই এখানে। তিনি বললেন, যতীন সরকার এসে যদি মুসলমানও হয় তবুও তাকে ক্ষমা করা হবে না। কারণ যতীন সরকার ক্ষমার অযােগ্য।
আহমদ তৌফিক চৌধুরী আমার একজন বিশেষ শুভাকাঙ্ক্ষী সুহৃদ। সিলেটের সেলবরষ পরগণার এক সম্ভ্রান্ত পরিবারের সন্তান তৌফিক চৌধুরী আহমদীয়া মুসলিম জামাতের সদস্য। (এই আহমদীয়ারাই সাধারণ্যে কাদিয়ানি’ নামে পরিচিত। বর্তমানে, ১৯৯৬ সালে, আহমদ তৌফিক চৌধুরী বাংলাদেশ আহমদীয়া জামাতের প্রধান ন্যাশনাল আমীর) সেই তৌফিক চৌধুরী একাত্তরের এপ্রিলের উনিশ তারিখে তার ময়মনসিংহের বাসা ছেড়ে ত্রিশাল থানার ধানীখােলা গ্রামে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছিলেন। সে সময়কার স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে তিনি ময়মনসিংহ শহরে একজন বিশিষ্ট হিন্দু নাগরিকের ইসলাম গ্রহণের বিবরণ দিয়েছেন এভাবে-
“ময়মনসিংহ শহরের মহারাজ রােডে আমার বাসার (১ নম্বর) সংলগ্ন ৩ নম্বর বাসায় থাকতেন একজন হিন্দু ব্রাহ্মণ) এডিশনাল জজ। তাদের এক ছেলে ও দুই মেয়ে। প্রথমে তিনি আমার বাসায়ই আশ্রয় নিয়েছিলেন। পরে ধানীখােলায় যাবার সময় তাকে খন্দকার সাহেবের ৭ নম্বর বাসায় রেখে যাই।”
“ধানীখােলা থেকে একদিন মােটর সাইকেলে করে মাথায় জিন্নাহ টুপি দিয়ে আমি শহরে এসেছিলাম বাসায় হাল হকিকত দেখতে। বাড়ি থেকে আসা চাল ছিলাে কয়েক বস্তা। আশ্রয় প্রার্থীরা তিন মাস অনায়াসে খেতে পারবে। বাসায় আসার পর খবর দিলেন জজ বাবু। সাক্ষাতে বললেন, ‘চৌধুরী সাহেব, আপনি আমার ভাই। আমাকে বাঁচান। আমাকে মুসলমান বানান। আপনারা তাে দেশে বিদেশে প্রচার করেন। আমাকে আমার বাচ্চাগুলােসহ রক্ষা করুন।’ বললাম, আপনি কি ইসলামের সৌন্দর্য দেখে মুসলমান হতে চান, না মুসলমানদের দানবীয় রূপ দেখে ভয় পেয়ে ইসলাম গ্রহণ করতে চান? তিনি বললেন, “যে কারণেই হােক আমাকে বাঁচান। আমি বল্লাম, এভাবে কাউকে মুসলমান করা যায় না। আন্তরিকভাবে গ্রহণ না করলে কেউ ইসলাম গ্রহণ করতে পারে না। মুসলমান সাজা যায় মাত্র। তিনি নিরাশ হয়ে বড়াে মসজিদে গিয়ে কলেমা পড়লেন। বড়াে মসজিদের বড়াে ইমাম তার নতুন নাম দিলেন আশরাফ আলী চৌধুরী। আশরাফ আলী ইমাম সাহেবের পীরের নাম।”
৪২৮
ধর্মান্তরিত এই এডিশনাল ডিস্ট্রিক্ট জজের আসল নাম ছিলাে দ্বিজেন চৌধুরী। ভীষণ ভয় পেয়েই এমনভাবে তিনি ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন। তার সেই ভয়ের কারণটিও সকৌতুক বর্ণনা দিয়েছেন আহমদ তৌফিক চৌধুরী। দ্বিজেন বাবু যখন খন্দকার সাহেবের বাসায় আশ্রয় নিয়েছিলেন তখনই এই ভয়ের ব্যাপারটি ঘটেছিলাে। তৌফিক চৌধুরী লিখেছেন— “একদিন খন্দকার সাহেবের বাসায় দরজায় করাঘাতের শব্দ এবং উর্দুতে দরওয়াজা খােলাে’ হুঙ্কার শােনা গেলাে। ব্যাপারটি বুঝে খন্দকার সাহেব জিন্নাহ টুপিটি জজ বাবুর মাথায় দিয়ে তিনি এসে দরজা খুললেন। পাকিস্তানি সেনা মিলিশিয়াটি ঘরে ঢুকে টুপি পরা জজ বাবুকে জিজ্ঞেস করলাে, “আপ কৌন হ্যায়?’ উত্তরে বললেন, ‘এডিশনাল ডিস্ট্রিক্ট জজ। সেপাইটি বললাে, “আপ জজ সাহেব হ্যায়, তশরিফ রাখিয়ে। এরপর ধরলাে খন্দকার সাহেবকে। বললাে, “মালাউন তুম হাে। খন্দকার সাহেব কলেমা ও কুরআনের আয়াত পড়ে প্রমাণ করতে চাইলেন যে তিনি একজন পাক্কা মুসলমান। কিন্তু কিছুতেই ওরা বিশ্বাস করতে চাইলাে না। বললাে, “মালাউন বহুত হুঁশিয়ার হ্যায়। কলেমা শিখ লিয়া। শেষ পর্যন্ত এসডিও সাহেব এসে রক্ষা করলেন।
“মুসলমান সাজার (হওয়া বললাম না) পর জজ সাহেব শেরওয়ানি টুপি পরে মসজিদে গিয়ে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়তেন। ওই সময় পাড়ার আরাে কিছু লোেক মুসলমান সেজেছিলাে প্রাণের ভয়ে।”

বাঘমারা শিবিরে শরণার্থী জীবন
‘হিন্দু রাজাকার’–এরকম একটি কথা শুনলে সবাই হাসে। মনে হয়, এর চেয়ে বড়াে রসিকতা যেন কিছু কিছু হতে পারে না। কিন্তু কেন? হিন্দুদের জন্যে রাজাকার হওয়া কি নিষিদ্ধ ছিলাে? না সব হিন্দুই এমন সৎ ও দেশপ্রেমিক যে তাদের সম্পর্কে রাজাকার হওয়ার কথা ভাবাই যায় ? কিংবা সকল হিন্দুই কি এমন বােকারাম যে ভাজা মাছটি উল্টে খেতে জানে না?
না, এর কোনােটাই নয়। আসলে কোনাে হিন্দুকে রাজাকার হওয়ার কোনাে সুযােগই পাকহানাদাররা দেয়নি। তারা প্রথমেই এদেশের হিন্দুদেরকে মুসলমানদের থেকে আলাদা করে ফেলতে চেয়েছিলাে। মুসলমানি জোশ তুলে সমস্ত মুক্তিযুদ্ধটাকেই হিন্দু ও হিন্দুস্তানের ষড়যন্ত্র হিসেবে প্রমাণ করতে পারলেই এখানকার সব মুসলমান মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে চলে যাবে এবং পাকিস্তান বেঁচে যাবে—এ রকমই তারা মনে করেছিলাে। তাই, মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে হিন্দুদের ব্যবহার করার কোনাে কৌশল গ্রহণের কথা তারা চিন্তা করেনি। পাকিস্তান যদি তখন তেমনটি করতাে তবে হিন্দু রাজাকারও কম তৈরি হতাে না, দালালিতে হিন্দুদের ভূমিকাও অনুল্লেখ্য হতাে না, মুক্তিযুদ্ধে আরাে জটিলতা ও বিভ্রান্তি তারা সৃষ্টি করতে পারতাে।
তবু, এরপরও, সংখ্যায় সামান্য হলেও কিছু ধুরন্ধর হিন্দু যে রাজাকারির ব্যাপারেও যথেষ্ট কুশলতা দেখিয়েছে—এবং অন্য দালালসহ হানাদারদেরও বােকা বানিয়ে ছেড়েছে—এমন কিছু হিন্দু রাজাকারের কথা এর ওর মুখে শুনেছি। তবে ওই হিন্দু রাজাকাররা মতলব হাসিলের জন্যে আগে মুসলমান সেজেছে, তারপর রাজাকারি করেছে।
সুসং দুর্গাপুরের দুর্গাপ্রসাদ তেওয়ারির কাছে এ-রকমই একজন হিন্দু দালাল রাজাকারের গল্প শুনেছিলাম। ছিয়াত্তর সনে ময়মনসিংহ জেলখানায় দুর্গাপ্রসাদ বাবু আমার সহবন্দি ছিলেন।
৪২৯
কর্মহীন কারাবাসে সারাদিন ধরে কত গল্পই যে চলে। একদিন উঠলাে ঐ হিন্দু রাজাকার প্রসঙ্গ। দুর্গাপ্রসাদ যার কথা বললেন সে ছিলাে একটা মহা ধড়িবাজ হিন্দু। সীমান্তের কাছাকাছি তার বাড়ি হওয়া সত্ত্বেও সে দেশ ছেড়ে ওপারে যায়নি। তার পরিবারের অন্য সবাই অবশ্যি চলে গিয়েছিলাে। সে এখানে থেকে যথারীতি ইসলাম গ্রহণ করলাে, মাথায় টুপি পরে ‘পাক্কা মুসলমান হয়ে গেলাে। তারপর শুরু করলাে পাকসেনাদের ক্যাম্পে যাতায়াত। ওদের অফিসারদের সঙ্গে তার গড়ে উঠলাে রীতিমতাে মহব্বতের সম্পর্ক। তার এই মিলিটারি ক্যাম্পে যাতায়াত আর অফিসারদের সঙ্গে দহরম মহরম সাধারণের চোখে তাকে ক্ষমতাধর করে তুললাে। সেই ক্ষমতার সে ব্যবহার করলাে পুরােদমে। দালালদের মধ্যে সে অনেক উঁচু পজিশন পেলাে। তাই নিচু পর্যায়ের দালালরা তাকে রীতিমতাে ভয় করতাে এবং তাকে লুটপাটের ভাগ দিতাে। নিজের ক্ষমতাকে এভাবে সংহত করে নেয়ার পর এই নও-মুসলিমটি আরাে এক কদম এগিয়ে গেলাে। মসজিদের যে ইমামের হাতে সে মুসলমান সেজেছিলাে, সেই ইমামেরই সুন্দরী কন্যাকে তার শাদি করার খায়েশ হলাে। সেই খায়েশের কথাই সে ব্যক্ত করলাে মিলিটারি ক্যাম্পের কর্তাদের কাছে। কর্তারা সানন্দে তার খায়েশ পূরণের সাহায্যে এগিয়ে এলাে, তার কাছে মেয়ের বিয়ে দেবার জন্যে ইমামের ওপর চাপ সৃষ্টি করলাে। নিজে মুসলমান বানালেও ইমাম সাহেবের কাছে ওই নও মুসলিমটির খাসলত তাে আর অজানা ছিলাে না। তাই, সজ্ঞানে তিনি কিছুতেই ওই ইবলিসের হাতে আপন কন্যাকে তুলে দিতে পারেন না। অথচ, না দিলে মিলিটারির হাত থেকে তাঁর রক্ষা নেই। অগত্যা বাড়িঘর ছেড়ে কন্যার হাত ধরে ইমাম সাহেবের পলায়ন এবং দেশের অভ্যন্তরে নানা স্থানে শঙ্কিত অবস্থান।
এমনই দাপট দেখিয়ে ছিলাে এই ‘হিন্দু রাজাকার’।
দুর্গাপ্রসাদ তেওয়ারির মুখে এই গল্পটি শুনতে শুনতে আমি অনেক কথা ভাবছিলাম। যে লােকটি পাকহানাদার কবলিত বাংলাদেশের ভেতরে থেকে এমন দাপটে রাজাকারি করছে, তারই সমচরিত্রের কতকগুলাে লােককে তাে আমি সীমান্তের ওপারেও দেখেছি। ওরাও সেখানে এক ধরনের রাজাকারিই করেছে। রাজাকার শব্দটির আভিধানিক অর্থ যাই হােক না কেন বাঙালির মুক্তিযুদ্ধ এর এমন একটি অনুষঙ্গ তৈরি করে দিয়েছে যে, শব্দটি শােনার সঙ্গে সঙ্গে আমাদের চোখের সামনে কতকগুলাে স্বজাতিদ্রোহীর চেহারা ভেসে ওঠে। কিন্তু স্বজাতিদ্রোহিতা কি কেবল এপারে যারা ছিলাে তারাই করেছে? ওপারে যারা গিয়েছিলাে তারা কি সবাই ছিলাে ধােয়া তুলসী পাতা? সেখানে গিয়ে পাকহানাদারদের সঙ্গে সহযােগিতা করার সুযােগ অবশ্যি তাদের ছিলাে না। তবু, অন্যরকমে ওরা স্বজাতির মানুষদের ওপর কম উপদ্রব করেনি। ওদেরই বা রাজাকার বলবাে না কেনাে?
ভারতের মেঘালয় রাজ্যের বাঘমারা শরণার্থী শিবিরে এরকম অনেক রাজাকারি কার্যকলাপ আমি প্রত্যক্ষ করেছি। এদের মধ্যে মুসলমানও অবশ্যই ছিলাে কিছু কিছু, তবে অধিকাংশ ছিলাে হিন্দু। বলতে পারি ‘হিন্দু রাজাকার’ । মুক্তিযুদ্ধের নেপদে অবস্থান নিয়ে। মুক্তিযুদ্ধটাকে একেবারে ভেতর থেকে নস্যাৎ করে দেয়ার লক্ষে খন্দকার মােশতাক বা মাহবুবুল আলম চাষীরা হয়েছিলাে উঁচুদরের রাজাকার। আমি যাদের হিন্দু রাজাকার বলছি তারা যদিও ছিলাে অন্য ধরনের—এবং নিতান্তই হঁাচড়া—তবু, দাপট তাদের কম ছিলাে না। আমি যাদের দেখেছি তারা দাপট খাটাতাে বাঘমারায় নিরীহ শরণার্থীদের ওপর।
পরিবার-পরিজন নিয়ে শরণার্থী শিবিরে যারা আশ্রয় নিয়েছিলাে, শিবির ছেড়ে তাদের বাইরে কোথাও গিয়ে বসবাস করার অনুমতি ছিলাে না। ভারতের অভ্যন্তর থেকে কোনাে
৪৩০
আত্মীয়-স্বজন এসে অবশ্যি তাদের নিয়ে যেতে পারতাে, তবে সে ক্ষেত্রে ছিলাে বেশ কিছু শর্ত। বাঘমারা থানায় গিয়ে শরণার্থীর আত্মীয়কে একটি অঙ্গীকারনামায় সই করে আসতে হতাে। সে অঙ্গীকারনামায় লেখা থাকতাে যে নিজ দায়িত্বে তিনি তাকে শরণার্থী শিবির থেকে নিয়ে যাচ্ছেন, এই আত্মীয়ের পরিবার-পরিজনের ভরণপােষণ তিনিই করবেন, কোন সরকারি সাহায্যের দাবি করতে পারবেন না। শিবিরত্যাগী শরণার্থীকেও অনুরূপভাবে অঙ্গীকার করতে হতাে যে ভারতের অভ্যন্তরে গিয়ে তিনি কোনাে সরকারি সাহায্য গ্রহণ করবেন না।
শিবির ত্যাগের এই প্রক্রিয়াটিতে খুব একটা জটিলতা থাকার কথা নয়। কিন্তু দেখলাম, সেখানেও কৃত্রিম জটিলতা তৈরি করে নিয়েছে যারা তারাও শরণার্থী শিবিরের আশ্রয় গ্রহণকারী বাঙালিই। দেশে যারা থানা-পুলিশের ‘টাউট’ ছিলাে, বিভিন্ন অফিস-আদালতের দুর্নীতিবাজ কর্মচারিদের সঙ্গে যােগসাজশে টু পাইস বাগিয়ে নেয়াই ছিলাে যাদের পেশা, দেশের বাইরে গিয়েও নতুন করে সেই পেশাটিই তারা জুটিয়ে নিলাে। বাঘমারা থানার সামনে টুল পেতে বসে যাওয়া এই টাউটদের দেখে আমার চোখের সামনে আমাদের দেশের আদালত ভবনের সামনেকার বটতলা কিংবা সাবরেজিষ্ট্রি অফিসের বারান্দার দৃশ্যটিই ভেসে উঠতাে। সেই একই লােকজন। একই প্রক্রিয়া। বাঘমারা শরণার্থী শিবিরে এক লাখেরও বেশি শরণার্থী আশ্রয় নিয়েছিলাে। এরা ছিলাে মূলত আমাদের নেত্রকোনা এলাকার অধিবাসী। অধিকাংশই কৃষক পরিবারের মানুষ। তাদের যেসব আত্মীয়-স্বজন পাকিস্তান সৃষ্টির পর বিভিন্ন সময়ে বাস্তুত্যাগ করে ভারতের নাগরিক হয়েছে তারাও নিরক্ষর বা প্রায়-নিরক্ষর কৃষিজীবীই। দুপক্ষের মানুষগুলােই নিতান্ত সরল। অঙ্গীকার পত্রের ফরমটি কোথায় পাওয়া যাবে, কিভাবে তা পূরণ করতে হবে, থানায় কার কাছে তা নিয়ে যেতে হবে, কি বলতে হবে কিছুই জানে না। তাই তারা সহজ শিকার হয় থানার সামনে বসা টাউটদের, যাদের আচরণ রাজাকারদের চেয়ে কম ন্যক্কারজনক নয়। শিবির-ত্যাগেচ্ছ লােকটিকে ও তার ভারতবাসী আত্মীয়টিকে সে নানা অবান্তর ও উল্টাপাল্টা প্রশ্ন করে প্রথমেই ঘাবড়িয়ে দেয়। তারপর নানা ধমক-ধামক দিয়ে তাদের আরাে কাবু করে ফেলে। এরপর সেই টাউটকে তার দাবি অনুসারে অর্থ দিতে পারলেই ওই বেচারা শরণার্থীটি থানা থেকে ছাড়পত্র পাবে, নতুবা নয়। শেষ পর্যন্ত যারা শিবির ছেড়ে কোনাে আত্মীয়-স্বজনের আশ্রয়ে যেতে না পেরেছে তাদেরও ওই টাউটদের হাতে দুর্ভোগ পােহাতে হয়েছে প্রতিনিয়ত। ওদের খুশি না করতে পারলে নিয়মিত রেশন পাওয়া যায় না, তাবুর জন্যে সরকারের বরাদ্দ করা ত্রিপল কিংবা রিলিফের কম্বলও ভাগে পড়ে না। অসহায় ও সর্বহারা অনেক শরণার্থীর বধূ ও কন্যাদের ইজ্জত নিয়ে ছিনিমিনি খেলার কথাও কানে এসেছে। এবং এ ক্ষেত্রেও অনুঘটকের ভূমিকা পালন করেছে শরণার্থীদের স্বদেশীয় স্বজাতি ওই রাজাকার-প্রতিম টাউটেরা। এক রাজাকারের ভয়ে দেশ ছেড়ে দিয়ে দেশান্তরেও অন্য রাজাকারদের হাত থেকে পরিত্রাণ পাওয়া যায়নি।
ভারতের অন্যান্য শিবিরগুলােতে শরণার্থীরা কি অবস্থায় দিন কাটিয়েছিলাে জানি না। কিন্তু বাঘমারাতে যা দেখেছি তা একান্তই করুণ ও ভয়াবহ। বাঘমারার স্থায়ী বাসিন্দারা গারাে উপজাতির লােক। এই স্থানীয়দের সংখ্যা যা, শরণার্থী সমাবেশ ঘটেছিলাে তার অন্তত দশগুণ। বিপুল সংখ্যক বহিরাগতের চাপে স্থানীয় গারােদের তখন কোণঠাসা অবস্থা। গারােদের ভয় হচ্ছিলাে এরা না আবার স্থায়ীভাবে ওখানেই থেকে যায়। সেই ভয়ের দরুণই বাঙালি শরণার্থীদের তারা সহজভাবে নিতে পারেনি। দুয়ের মধ্যে তখন গড়ে উঠেছিল বিশ্বাসের বদলে
৪৩১
সন্দেহ। সহযােগিতার বদলে বৈরিতার সম্পর্ক। মৃতদের নিয়েই হতাে শরণার্থী হিন্দুদের সবচেয়ে করুণ দশা। বাঘমারায় কোনাে শ্মশান ছিলাে না। গারােরা তাদের এলাকায় কোনাে মৃতদেহ দাহ করতে দিতাে না। শরণার্থী পরিবারের কারাে মৃত্যু হলে সেই মৃতদেহ কাঁধে করে বয়ে নিতে হতাে বাংলাদেশ সীমানায়। সেখানেও সেই যুদ্ধের আতংকের দিনগুলােতে, কোন মৃতদেহ দাহ করা সম্ভব ছিলাে না। মুখে একটু আগুন ছুঁইয়ে কোনাে রকমে হিন্দু আচারের মর্যাদা রক্ষা করে সেই মরদেহকে নদীর চরে সামান্য বালির নিচে চাপা দিয়ে রেখে তাড়াতাড়ি চলে আসতে হতাে। আর পরক্ষণেই মহানন্দে ভােজ শুরু করতাে বুনাে শিয়ালের দল। বাঙালির মাংস খেয়ে খেয়ে শিয়ালগুলাে হয়ে উঠেছিলাে অস্বাভাবিক মােটা তাজা।
বাঘমারায় বিশুদ্ধ পানীয় জল প্রায় মিলতােই না। পাহাড়ি ঝর্ণার দূষিত জল যারা সিদ্ধ করে খেতাে তারা পেটের পীড়ায় আক্রান্ত হয়নি। কিন্তু সবসময় জল সিদ্ধ করে খাওয়া বেশিরভাগ শরণার্থীর পক্ষেই সম্ভব হতাে না। সামান্য জ্বালানি কিনে আনার পয়সাও তাদের ছিলাে না। তাই সেই শিবিরে পেটের পীড়ার চলছিলাে সার্বক্ষণিক মহামারী। প্রতিদিনই প্রায় প্রতি পরিবারেই কেউ-না-কেউ মারা যেতাে। কোনাে কোনাে পরিবারে শেষ পর্যন্ত একটি মানুষও জীবিত থাকেনি, একজনও স্বাধীন স্বদেশভূমি দেখে যেতে পারেনি। মৃত্যুটা সেখানে এমন স্বাভাবিক হয়ে গিয়েছিলাে যে, একই ঘরে বাস করছে যে দুটো পরিবার তার একটির একজন শিশু বা যুবক বা বৃদ্ধ সদস্যের মৃত্যু হয়েছে, সন্তানহারা মা কিংবা স্বামীহারা স্ত্রী কিংবা পিতৃহারা সন্তানের বুকফাটা কান্নার রােল আকাশ ভেদ করছে। অথচ সেই ঘরেরই অন্য পাশে শুয়ে থাকা অন্য পরিবারটির কেউ মাথা তুলে তাকিয়েও দেখছে না। অবিরাম মৃত্যু দেখতে দেখতে সকলে যেন অনুভূতিশূন্য পাথর হয়ে গেছে।
পেটের পীড়ায় যারা মরেনি তারাও জীবিত থেকেছে সারা শরীরে যন্ত্রণাকর খােশ পাচড়া নিয়ে। আর সেই সঙ্গে ক্ষুধার জ্বালা। ভারত সরকার প্রতিটি শরণার্থীর প্রতিদিনের জন্যে যে পরিমাণ চাল-ডাল-আটা বরাদ্দ করেছিলেন তাতে ক্ষুধার জ্বালা না মেটার কোনাে কারণ ছিলাে না। কিন্তু বাঘমারা ক্যাম্পে নিয়মিত সেই বরাদ্দ এসে পৌছুতাে না। সে সময়েও মেঘালয়ের পাহাড়ি রাস্তাগুলাে মালবাহী যানবাহনের জন্যে খুব সুগম ছিলাে না, বিশেষ করে ভারি বৃষ্টি হলে তাে সেগুলাে একান্ত বিপজ্জনকই হয়ে উঠতাে। তাই এক সপ্তাহ রেশন পাওয়া গেলাে তাে আর এক বা দেড় সপ্তাহ বন্ধ । বিনামূল্যের রেশন বন্ধ থাকলে বাজার থেকে চাল-আটা কিনে খাওয়ার সামর্থ খুব কম শরণার্থী পরিবারেরই ছিলাে। ক্ষুধা আর মৃত্যু তাদের জন্যে হয়ে উঠেছিলাে অপ্রতিরােধ্য।
দু’ভাইয়ে মিলে কিছু নগদ টাকা সঙ্গে নিয়ে যেতে পেরেছিলাম বলে আমরা তাে অন্যের তুলনায় অনেক স্বচ্ছন্দেই ছিলাম। সব সময় ফুটানাে জল খেতাম, তাই পেটের পীড়ার কবলে। পড়িনি।
ছােট মামা কুচবিহার থেকে চিঠি লিখেছিলেন যে তিনি আমাদের তাঁর কাছে নিয়ে যাওয়ার জন্যে বাঘমারায় আসবেন। চিঠির উত্তরে তাঁকে আসতে বারণ করে দিয়েছিলাম। আমরা যদিও মেঘালয় ছেড়ে আর কোথাও যাইনি, তবু সেখানেই ভারতের বিভিন্ন জায়গার অনেক লােকের দেখা পেয়েছিলাম। আত্মীয়-শরণার্থীদের নিয়ে যেতে যারা এসেছেন—বিশেষ করে মধ্যবিত্তশ্রেণীর চাকুরিজীবী বা পেশাজীবী—তাঁদের অনেকেই আমাদের বাঁশের ঘরটিতে এসে বসেছেন। প্রায় সারাদিন এখানে আড্ডা লেগেই থাকতাে।
৪৩২
আমাদের মুক্তিযুদ্ধ ও ভারতমানস
বাঘমারা শরণার্থী শিবিরে যারা আশ্রয় নিয়েছিলাে তাদের অধিকাংশই দরিদ্র ও নিরক্ষর কৃষক সমাজের মানুষ হলেও মধ্যবিত্ত ও শিক্ষিত পরিবারের মানুষের সংখ্যাও একেবারে কম ছিলাে না। এদেরই আত্মীয়-স্বজনরা কলকাতা ও পশ্চিমবঙ্গের অন্যান্য জায়গা থেকে বাঘমারায় আসতেন। শিবির থেকে শরণার্থী আত্মীয়দের নিয়ে যাওয়ার অফিসিয়াল আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করার জন্যে এই শিক্ষিত মানুষদের অবশ্যি টাউটদের খপ্পরে পড়তে হয়নি। তারা থানা থেকে নিজেরাই ফরম সংগ্রহ করে নিয়ে আসতেন এবং এদের অনেকেই আমার ঘরে বসে ফরম পূরণ করতেন। বাঘমারায় চা পাওয়া যেতাে বেশ শস্তায়। কাজেই এদের চা পানে আপ্যায়িত করতে আমার খুব অসুবিধে হতাে না। চা খেতে খেতে চলতাে গল্প গুজব। সব গল্পই মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে শুরু হয়ে বিষয় থেকে বিষয়ান্তরে ছড়িয়ে পড়তাে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন শ্রেণীর মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি, ভারত সরকারের নীতি কৌশল, পৃথিবীর বিভিন্ন রাষ্ট্রের সমর্থন ও অসমর্থনের প্রকৃতি এসব বিষয়ের পাশাপাশি দেশি বিদেশি রাজনীতি অর্থনীতি সমাজনীতির কোনাে প্রসঙ্গই বাদ যেতাে না। শিল্পসাহিত্যের কথাও উঠে পড়তাে।
শরণার্থী শিবিরে আগন্তুক পশ্চিমবঙ্গের এই ভদ্রলােকেরা সকলে অবশ্যই অভিন্ন দলমতের অনুসারী ছিলেন না। তাই একই বিষয়ের ব্যাখ্যাতেও তাঁদের ছিলাে ভিন্ন ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের প্রতি কারাে ছিলাে আন্তরিক সমর্থন, এর প্রতি একান্ত বিদ্বিষ্টও ছিলেন কেউ কেউ। এরা সবাই তাে এক সময় পূর্ব পাকিস্তান থেকে উদ্বাস্তু হয়েই ভারতে গিয়েছেন, এখনাে তাদের গা থেকে রিফিউজি’র ছাপটি মুছে যায়নি। জন্মভূমির প্রতি টান এদের একটুও কমেনি, আবার দেশত্যাগের পূর্বেকার তিক্ত স্মৃতিগুলােও এরা ভুলতে পারছেন না। এইসব কারণে এদের চিন্তায় বড়াে জটিলতা। এদের কারাে কারাে মস্তিস্ককোষ প্রচণ্ড সাম্প্রদায়িক ভাবনায় আচ্ছন্ন, মুসলিম-বিদ্বেষে ভরপুর। কী ধরনের অত্যাচার উৎপীড়নের মুখে বাড়িঘর সহায় সম্পদ ফেলে রেখে তারা দেশ ছেড়ে যেতে বাধ্য হয়েছিলেন, সে সব কথা অত্যন্ত ঝঝের সঙ্গে স্মরণ করেন আর বলেন, মুসলমানদের হাড়ে হাড়ে হিন্দুবিদ্বেষ, ওরা পাকিস্তান ভেঙে বেরিয়ে আসবে না কখনাে। ওই সব মুক্তিযুদ্ধ টুদ্ধ কিছুই না। কিছু চ্যাংড়া পােলাপানের হুজুগ, দু’চার দিন পরই সব শেষ হয়ে যাবে। তখন আবার সেই মুসলমানে মুসলমানে ভাই ভাই।
কেউ কেউ আবার এ প্রসঙ্গে কথা বলতে গিয়ে ভারত-গৌরবে একেবারে ফেটে পড়তেন, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ আর মুক্তিযােদ্ধাদের ফুঁ মেরে উড়িয়ে দিতে চাইতেন। গলা চড়িয়ে বলতেন, ভারত হচ্ছে একটি মহান দেশ। তাই মানবতার খাতিরেই ভারত পূর্বপাকিস্তানের মানুষদের বিপদের সময় সাহায্য দিচ্ছে। ওদের রাজনীতিকরাও এদেশের বুকে বসে সেদেশের রাজনীতি করছে। ভারত আছে বলেই না ওদের মুক্তিযুদ্ধের যতাে সব বড়ফট্টাই । আজ ভারত ওদের সাহায্য বন্ধ করে দিক, তখন কোথায় থাকবে ওদের ওই মুক্তিযুদ্ধ? তখন বুঝবে কতাে ধানে কত চাল।
বাঘমারার শরণার্থী শিবিরে বসে শােনা এদের এ রকম কথার সঙ্গে আমি সে সময়কার পাকিস্তান সরকারের বক্তব্যের অনেক মিল খুঁজে পেতাম। তফাৎটা কেবল এই যে পাকিস্তান এসব বলতাে ভারতকে গালাগালি করে, আর এরা বলতেন ভারতগৌরবে গদগদ হয়ে।
৪৩৩
উভয়ের কাছেই বাংলাদেশের মানুষের আবেগ, উপলব্ধি, সংগ্রাম, আত্মদান এ সব ছিলাে মূল্যহীন।
পশ্চিমবঙ্গের বাইরের কোনাে এক হিন্দিভাষী রাজ্য থেকে এক ভদ্রলােক তার আত্মীয়কে নিয়ে যেতে এসেছিলেন। একটা সবজান্তা ভাব নিয়ে তিনি কথা বলেন। তার কথা শুনে মনে হয়, ভারত সরকার তার সঙ্গে পরামর্শ করে কোনাে কাজ করে না বলে কেবলই ভুল করে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ব্যাপারেও তাই। মুখে একটা অবজ্ঞার ভাব ফুটিয়ে তুলে বললেন, ‘দেখলাম তাে আপনাদের ওই মুক্তিযােদ্ধাদের চেহারা। একেক জন তালপাতার সেপাই। মালকোচা দিয়ে লুঙ্গি পরে তারা গেরিলা যুদ্ধের ট্রেনিং নিচ্ছে। হু। যুদ্ধ করা এতােই সােজা। হুড়মুড় করে কতকগুলাে লােক পূর্ব পাকিস্তান থেকে এসে ইন্ডিয়াতে ঢুকে পড়লাে। ইন্ডিয়া গভর্নমেন্ট এদের আশ্রয় দিলাে, খাবার দিলাে। এই তাে যথেষ্ট ছিলাে। এর ওপর আবার এই উটকো ঝামেলা কাঁধে তুলে নেয়া কেন? স্বাধীন বাংলা টাংলা কিছু হবে না। মাঝখান থেকে ইন্ডিয়া পড়বে বিপাকে।’
কিছু কিছু লােক এ ধরনের সিনিক কথাবার্তা বললেও আমাদের মুক্তিযুদ্ধের প্রতি অনুকূল মনােভাব পােষণকারী মানুষেরাই ছিলাে সংখ্যায় ভারি। বিশেষত পশ্চিমবঙ্গের মানুষদের মধ্যে বাংলাদেশের মানুষের জন্যে ছিলাে একটা আবেগাপ্লুত সহমর্মিতা। সে সহমর্মিতার মূল উৎস ছিলাে বাঙালিত্ব। বাঙালিদের একটা স্বাধীন রাষ্ট্র হবে, বাংলা ভাষায় যারা কথা বলে তারাই রাষ্ট্র পরিচালনা করবে, সব কাজ কর্ম চলবে বাংলায়, আবহমান বাংলা ও বাঙালি সংস্কৃতির ধারক বাহক হবে সেই রাষ্ট্রটি—এ রকম একটি সম্ভাবনা সকল বাঙালির বুকে শিহরণ জাগাতাে। যে বাঙালিরা পশ্চিমবঙ্গের আদি বাসিন্দা অর্থাৎ ‘ঘটি’ নামে পরিচিত, আর বাঙাল’ নামধারী যে বাঙালিরা এক কালের পূর্বপাকিস্তান থেকে রিফিউজি হয়ে গিয়ে ভারতের নাগরিক হয়েছে, ‘জয়বাংলা’ ধ্বনি এরকম সব বাঙালিরই কানের ভেতর দিয়ে একেবারে মরমে প্রবেশ করে তাদের মন প্রাণ আকুল করে তুলেছিলাে। সেই আকুলতা নিয়েই তারা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে একাত্ম হয়ে গিয়েছিলাে। বহুজাতিক রাষ্ট্র ভারতের অন্য অন্য জাতির লােকেরাও বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে সমর্থন করেছিলাে বটে, কিন্তু তাদের সে সমর্থনের পেছনে ছিলাে বৌদ্ধিক যৌক্তিক রাজনৈতিক ও মানবিক বিবেচনা। তাদের হৃদয়ে বাঙালি জাতির মানুষদের মতাে এমন উথালপাথাল করা আবেগ ছিলাে না। না থাকাটাই স্বাভাবিক। আর যারা সে সময়ে ভারতের রাষ্ট্র পরিচালনায় ছিলেন, তারা? তারা যে সেদিন আবেগের তােড়ে ভেসে গিয়ে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে সমর্থন করেছিলেন, তেমন তাে নিশ্চয়ই নয়। আবেগ দিয়ে রাষ্ট্র পরিচালনার রাজনীতি চলে না।
তবু যে ভারতের শাসক ও শাসক শ্রেণীর মানুষেরা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে সক্রিয় সমর্থন দিয়েছিলেন, সেও তাে দিবালােকের মতাে সত্য। ওই শ্রেণীর লােকদের মধ্যে বাঙালি আর ক’জন ছিলেন, সিংহভাগই তাে অবাঙালি। এদের সমর্থনের পেছনে যা সক্রিয় ছিলাে তা জাতীয় আবেগ নয়, তা হচ্ছে তাদের শ্রেণী ও শ্ৰেণীরাষ্ট্রের স্বার্থ। স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠায় সহায়তা দেয়া মানে পাকিস্তানের মাজা ভেঙে দেয়া। সাম্প্রদায়িক পাকিস্তান রাষ্ট্রের মাজা ভেঙে যাওয়া অবশ্যই ভারতের সামগ্রিক স্বার্থের অনুকূল। কিন্তু বাংলাদেশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় সমর্থনটা তাে দেয়া হচ্ছে একটা জাতির আত্মনিয়ন্ত্রণের তথা আত্মপ্রতিষ্ঠার প্রতি। অথচ সেই বাঙালি জাতিরই একটি বড়াে অংশ আছে ভারত রাষ্ট্রের অন্তর্ভুক্ত হয়ে। পাকিস্তানের শাসনাধীন
৪৩৪
বাঙালিদের স্বাধীনতা লাভের অধিকার যদি ন্যায় ও যুক্তিসঙ্গত হয়, তবে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের জন্যে তা হবে না কেন? ভারতীয় বাঙালিরা যদিও স্বাধীনতার দাবি তােলেনি, তবু যে দুর্দমনীয় আবেগ নিয়ে তারা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে একাত্ম হয়েছে, সেই আবেগ যে সেখানেই আটকে থাকবে তার নিশ্চয়তা কোথায়?
এ বিষয়টি নিয়েও ভারতের শাসক শ্রেণী গভীরভাবে ভেবেছে, এর বিভিন্ন দিক নিয়ে চুলচেরা বিশ্লেষণ করেছে। তবে ভবিষ্যতের প্রতিক্রিয়ার কথা মাথায় রেখেও সে সময়কার বর্তমানটিকে বাস্তবতার নিরিখে বিচার করে, অনেক যােগ বিয়ােগের অঙ্ক কষে, তারা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে সফল হতে দেয়াটাকেই তাদের বৃহত্তর স্বার্থের অনুকূল বলে বুঝে নিয়েছে। একাত্তরে বাঙলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের প্রতি পশ্চিমবঙ্গের বাঙালিদের আবেগ যে উত্তুঙ্গ পর্যায়ে পৌছেছিলাে তার বিরুদ্ধ স্রোতে গেলে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের জন্যে সম্পূর্ণ বিপদ দেখা দিতাে। এমনকি বাঙালি জনউত্থানে ভারতের অখণ্ডতাই বিপর্যস্ত হয়ে যেতাে, সে সময়কার সরকারি নীতি নির্ধারণে এ বিবেচনাটিও বিশেষভাবে সক্রিয় ছিলাে। শাসকগােষ্ঠীর বাইরে যাদের অবস্থান তাদেরও ছিলাে নিজ নিজ বিবেচনা। কেউ কেউ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে একটি বর্বর ও অত্যাচারী শাসনের বিরুদ্ধে নিপীড়িত একটি গােষ্ঠীর ন্যায়সঙ্গত সংগ্রাম হিসেবে দেখেছেন। ভারতের হিন্দু সাম্প্রদায়িকতাবাদী শক্তিগুলাে যে কোনােভাবে মুসলমানের রাষ্ট্র পাকিস্তানকে খণ্ডিত ও বিপর্যস্ত দেখতে পারলেই খুশি। এই দৃষ্টিকোণ থেকেই আমাদের মুক্তিযুদ্ধ তাদেরও সমর্থন পেয়েছে। ভারতের বণিকরা নিশ্চয়ই ভবিষ্যতের স্বাধীন বাংলাদেশকে তাদের বাণিজ্যিক স্বার্থের অনুকূল বলেই ভেবেছে। বামপন্থীদের মধ্যে নানান ধারা থাকলেও, এই বুর্জোয়া নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধ সফল হতে পারে না বলে এদের কেউ কেউ তাত্ত্বিক বক্তব্য দিলেও, বামপন্থী কোনাে গােষ্ঠীই বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সরাসরি বিরােধিতা করেনি। ভারতের ক্যুনিস্ট পার্টি (সিপিআই) তাে আন্তর্জাতিক দায়িত্ববােধের দৃষ্টিতেই বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে দেখেছে, এবং একে সফল করে তােলার জন্যে সক্রিয় উদ্যোগ গ্রহণ করেছে।
অর্থাৎ যার যার নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বিচার করেই ভারতের নাগরিকদের বিভিন্ন দল ও গােষ্ঠী বাঙলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে সমর্থন দিয়েছে, এ বিষয়টিকে কেন্দ্র করে সারা ভারতে একটি জাতীয় ঐকমত্য গড়ে উঠেছে। এরই ফলে ভারতের সাধারণ মানুষও আমাদের মুক্তিযুদ্ধের জন্যে অনেক স্বার্থত্যাগ ও আত্মত্যাগ করেছে, অতিরিক্ত করের বােঝা হাসিমুখে বহন করেছে। ভারতের সশস্ত্র বাহিনীর সৈনিকদের রক্ত বাঙালি মুক্তিযােদ্ধাদের রক্তস্রোতের সঙ্গে মিশে গেছে, পনেরাে ষােল হাজার ভারতীয় সেনা আমাদেরই মুক্তির সােপানতলে আত্মবলি দান করেছে। ভারতের সরকার তথা শাসকগােষ্ঠী তাদের শ্রেণী ও শ্ৰেণীরাষ্ট্রের স্বার্থেই আমাদের স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় সহায়তা দিয়েছিলাে নিশ্চিত, তবে এ কথাও তাে সত্য যে, আমাদের জাতীয় স্বার্থের সঙ্গে তাদের স্বার্থ সেদিন একবিন্দুতে মিলে গিয়েছিলাে বলেই আমরা তাদের এ রকম সহযােগিতা পেয়েছিলাম ও নিয়েছিলাম।
তবু, একাত্তরেও দেখা গেছে যে, দ্বিজাতিতত্ত্বের বিষক্রিয়া সারা উপমহাদেশকেই কোনাে-কোনাে ভাবে আচ্ছন্ন করে রেখেছে। দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে দেশ ভাগ এ ভূখণ্ডের মানুষের চেতনার জগতে এমনই বিকৃতি ঘটিয়ে রেখে গেছে যে, সে-বিকৃতি প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে বহমান থেকে মনুষ্যত্বের সুস্থ বিকাশকেই রুদ্ধ করে দিচ্ছে। পাকিস্তানের হিন্দুদের ভেতর এই
৪৩৫
বিকৃতির দুষ্টক্ষত যেমন ছিলাে, তেমনি ছিলাে ভারতের মুসলমানদের মধ্যেও। রাজনীতিসচেতন বা প্রগতিশীল রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক আন্দোলনের সঙ্গে সক্রিয়ভাবে যুক্ত মুসলমানদের কথা বলছি না। বলছি ভারতের ‘অ্যাভারেজ’ মুসলমানদের কথা। ওই মুসলমানদের মনে পাকিস্তান সম্বন্ধে আছে একটা অব্যক্ত আবেগ। দ্বিজাতিতত্ত্ব-ভিত্তিক দেশ বিভাগই তাদের সেই আবেগ সৃষ্টি করে রেখে গেছে। সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র পাকিস্তানে হিন্দুদের অবস্থান যেমন ছিলাে নিজ বাসভূমে পরবাসীর মতাে তেমনি ধর্মনিরপেক্ষ বলে ঘােষিত ভারতে মুসলমানদের অবস্থানেও খুব একটা ইতরবিশেষ ছিলাে না। হিন্দুরা যে সংখ্যায় পাকিস্তান ছেড়ে ভারতে গেছে, ভারতত্যাগী মুসলমানের সংখ্যা তার চেয়ে অনেক কম নিশ্চয়ই। তবু বাস্তবে ভারতে বাস করেও অনেক মুসলমানেরই মানসিক আশ্রয় ছিলাে পাকিস্তান। তাদের এ রকম একটি মানসিক আশ্রয়কে যারা ভেঙে দিচ্ছে সেই বাঙালি মুক্তিযােদ্ধাদের প্রতি তারা প্রসন্ন ছিলাে না। এমনকি মুক্তিযােদ্ধাদের মুসলমান পরিচয়ও তাদের অপ্রসন্নতাকে দূর করতে পারেনি। ধর্ম সম্প্রদায় নির্বিশেষে সব মুক্তিযােদ্ধাই তাদের চোখে ছিলাে ভারতীয় ষড়যন্ত্রের সহযােগী। বাংলাদেশের শরণার্থী বা মুক্তিযােদ্ধা মুসলমানদের যারা পশ্চিমবঙ্গের মুসলমানদের সঙ্গে সাক্ষাত করতে গিয়েছেন তারা অনেকেই ভারতীয় মুসলিম মানসের এ রকম পরিচয় পেয়েছেন। পশ্চিমবঙ্গের মুসলমানের একটি প্রভাবশালী গােষ্ঠী তাে আমাদের সশস্ত্র মুক্তিসংগ্রাম শুরু হওয়ার কিছুদিন পূর্ব পর্যন্তও ইনসাফ নাম দিয়ে একটি সংবাদপত্র প্রকাশ করেছে। সে পত্রিকার মারফৎ তারা শেখ মুজিব, আওয়ামী লীগ ও বাঙালি জাতীয়তাবাদের বিরুদ্ধে কুৎসা রটিয়েছে, এবং জুলফিকার আলী ভুট্টোর প্রশস্তি পেয়েছে।
মেঘালয়ে বসেই পশ্চিমবঙ্গ তথা ভারতের মুসলমানদের একটি বৃহৎ অংশের এ রকম মানস প্রতিবন্ধের কথা শুনে দুঃখ পেয়েছি অবশ্যই। তবে অবাক হইনি। কিংবা এ জন্যে ভারতীয় মুসলমানদের আসামির কাঠগড়ায় দাঁড় করাতেও আমার মন সায় দেয়নি। কারণ ভারত ও পাকিস্তান উভয় রাষ্ট্রেরই ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ভেতর মানস প্রতিবন্ধ সৃষ্টি হওয়ার বাস্তব কারণগুলােকে তাে কিছুতেই উপেক্ষা করতে পারি না। শরণার্থী শিবিরে আশ্রয়প্রাপ্ত হিন্দুদের যে মানস প্রবণতার প্রকাশ দেখেছি তাকেও সঙ্গত বলে মেনে নেয়া আমার পক্ষে সম্ভব ছিলাে না। তবু এ রকম মানস প্রবণতা গড়ে ওঠার বাস্তব পটভূমির দিক থেকেই বা চোখ ফিরিয়ে থাকি কী করে?
দীর্ঘদিন ধরে গড়ে ওঠা ও বাড়তে থাকা সাম্প্রদায়িক মনােভঙ্গিকে একাত্তরের সেই উপপ্লবের দিনগুলােকেও সকলে পরিহার করতে পারেনি। মুসলিম সাম্প্রদায়িকতা আলবদর রাজাকার শান্তি কমিটির হয়ে পাক বাহিনীর সহযােগিতায় মুক্তিযােদ্ধাদের যেমন আঘাত হানছিলাে, তেমনি হিন্দু সাম্প্রদায়িকতা মুক্তি শিবিরের অভ্যন্তরেই এক অদ্ভুত ও বিব্রতকর অবস্থার সৃষ্টি করে রেখেছিলাে। মুক্তিযােদ্ধাদের মধ্যে সকল ধর্ম সম্প্রদায়ের বাঙালিই ছিলাে। কোন সম্প্রদায়ের ক’জন যােগ দিলাে এ নিয়ে কোনাে প্রশ্ন উত্থাপিত হয়নি সেদিন। এর পরও কিছু কথা থেকে যায়। সর্বজনজ্ঞাত কারণেই শরণার্থীদের মধ্যে হিন্দুরা ছিলাে সংখ্যাগরিষ্ঠ, এবং তারা মূলত শরণার্থী হয়েই ভারতে গিয়েছিলাে, যেতে বাধ্য হয়েছিলাে। অন্যদিকে অধিকাংশ মুসলমান, বিশেষ করে তরুণরা, দেশত্যাগ করেছিলাে মুক্তিযুদ্ধে যােগ দেয়ার সচেতন ও সক্রিয় উদ্দেশ্য নিয়েই। শরণার্থী শিবিরে আশ্রয় নিয়েছিলাে যে সব হিন্দু তরুণ তাদের একটা বড়াে অংশই মুক্তিযুদ্ধে যােগ দেয়ার ব্যাপারে গরজ করেনি। যদিও যােদ্ধা
৪৩৬
হওয়ার শারীরিক ও অন্যবিধ যােগ্যতা এদের প্রায় সবারই ছিলাে। মুক্তিযােদ্ধা হওয়ার বদলে এদেরই দু’চার জন বরং ভারতে স্থায়ীভাবে থেকে যাওয়ার মতলব এঁটেছে, কিংবা মুক্তিযুদ্ধ যদি সফলই হয়ে যায় তবে স্বাধীন বাংলাদেশে ফিরে গিয়ে নিকট বা দূর অতীতের কোনাে অত্যাচার উৎপীড়নের বদলা কার ওপর কীভাবে নেবে তারই দিবাস্বপ্ন দেখেছে, নানা চাপের মুখে হাতছাড়া হয়ে যাওয়া জমি বা অন্য স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি ফেরৎ আনার প্ল্যান প্রােগ্রাম করেছে। অনেকে নিজে মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে কোনাে সম্পর্ক না রেখেও দর্প করে বলেছে, এইবার মুসলমানরা বুঝুক আমাদের হিন্দুদের দেশে না এসে তারাও পার পায় না। যুদ্ধটা তাে আমরাই করছি। আমাদের ইন্দিরা গান্ধী ওদের খাবার দিয়েছে, অস্ত্র দিয়েছে, ট্রেনিং দিয়েছে—তবেই না মুক্তিযােদ্ধা নাম নিয়ে ওদের এতাে চিকনাই।’ বােঝা যায় চব্বিশ বছর ধরে পাকিস্তান থেকে যারা হিন্দুস্থানের চর বা দালালের অপবাদ শুনে এসেছে, বার বার যাদের স্মরণ করিয়ে দেয়া হয়েছে যে হিন্দু বলে হিন্দুস্থানই তাদের আপন দেশ, তাদেরই এক অংশের অসুস্থ প্রতিক্রিয়ার প্রকাশ ঘটেছে এ ধরনের মূঢ় বক্তব্যে। এরকম বক্তব্য তারা যে শুধু ঘরােয়া বা পারিবারিক পরিবেশে একান্ত নিভৃত সংলাপে উচ্চারণ করেছে, তা নয়। মুক্তিযুদ্ধের অনেক নেতা বা নেতৃস্থানীয় কর্মীকে সামনাসামনি এ সব কথা ক্ষোভ ক্রোধ বা বিদ্রুপের সঙ্গে শুনিয়ে দিয়েছে, এমনকি কিছু কিছু ক্ষেত্র অসৌজন্যমূলক আচরণও করেছে। কিছু সংখ্যক সাম্প্রদায়িকতাগ্রস্ত হিন্দুর এ ধরনের অনাকাক্ষিত কথা বা আচরণ হয়তাে মুসলিম সাম্প্রদায়িকতাকে উত্তেজিত করে সেদিনকার মুক্তিসংগ্রামে বিপর্যয়েরও সৃষ্টি করতে পারতাে। আমাদের সৌভাগ্য যে, তেমনটি ঘটেনি। কারণ বাঙালির মুক্তিসংগ্রামের ঐক্যতানের সুর অনেক উঁচু পর্দায় বাঁধা ছিলাে, সেখানে দু’চারটি বেসুরাে আওয়াজ এর সামগ্রিকতার তাল কেটে দিতে পারেনি।

মুক্তিযুদ্ধে বামপন্থীদের অবদান
আমাদের মুক্তিযুদ্ধে ভারতের সরকারসহ বিভিন্ন মহলের সহায়তার কথা অবশ্যই কৃতজ্ঞচিত্তে স্মরণযােগ্য। তবে সরকারের বাইরে যে সংগঠিত শক্তিটির কার্যকর সহায়তার কথা বিশেষ করে স্মরণ না করলেই নয় সেটি হচ্ছে ভারতের ক্যুনিস্ট পার্টি (সিপিআই)। আন্তর্জাতিক সমাজতান্ত্রিক শিবিরের সহযােগিতা প্রাপ্তির ক্ষেত্রেও সিপিআইয়ের ছিলাে খুব বড়াে ধরনের অনুঘটকের ভূমিকা। বাংলাদেশের কম্যুনিস্ট পার্টি মুক্তিযুদ্ধে যেটুকু অবদান রাখতে পেরেছে। তারও পেছনে বিশেষভাবে কার্যকর ছিলাে সিপিআইয়ের প্রযত্ন। সে-সময়েই সিপিআইয়ের কংগ্রেস (সম্মেলন) অনুষ্ঠিত হয়েছিলাে। শরণার্থী শিবিরে বসেই সে-কংগ্রেসের বিবরণ শুনেছিলাম কমরেড রবীন রেমার মুখে। কমরেড রেমা ছিলেন মেঘালয় রাজ্যের তুরার সিপিআই জেলা কমিটির সম্পাদক। একাত্তরের সেপ্টেম্বরে কোচিনে অনুষ্ঠিত সিপিআইয়ের পার্টি কংগ্রেসে তিনি প্রতিনিধি হয়ে গিয়েছিলেন। তিনি বলছিলেন যে, সিপিআইয়ের ওই কংগ্রেসে ভারতের অভ্যন্তরীণ রাজনীতির আলােচনা যতােটা হয়েছিলাে তার চেয়ে কম আলােচিত হয়নি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ প্রসঙ্গ। এক পর্যায়ে তাে এরকমই মনে হয়েছিলাে যে, পার্টির ওই কংগ্রেসে মূল এজেন্ডাই যেনাে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ। অন্য সব কিছু নিতান্তই গৌণ। বাংলাদেশের কম্যুনিস্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদক আব্দুস সালাম (বারীণ দত্ত) যখন হলে এসে উপস্থিত হলেন তখন কংগ্রেসে আগত সকল প্রতিনিধি উল্লাসে একেবারে ফেটে পড়লেন।
৪৩৭
পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে ভ্রাতৃপ্রতিম কম্যুনিস্ট পার্টিগুলাের যেসব প্রতিনিধি ওই কংগ্রেসে যােগ দিয়েছিলেন তারাও বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে সংগ্রামী একাত্মতা প্রকাশ করলেন।
এরকম বাইশটি দেশের প্রতিনিধিদের সঙ্গে বাংলাদেশের কম্যুনিস্ট পার্টির বিস্তৃত আলাপআলােচনা হয়েছিলাে। এর ফলে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের প্রগতিশীল মানুষদের সমর্থনের পথ আরাে সুগম হয়েছিলাে। বাংলাদেশের কম্যুনিস্ট পার্টি অবশ্যি দেশে গণহত্যা শুরু হওয়ার বেশ কয়েকদিন আগেই—একাত্তরের চৌদ্দই মার্চে—সােভিয়েত ইউনিয়নসহ পৃথিবীর প্রায় সব কম্যুনিস্ট পার্টির কাছেই ‘আমাদের স্বাধীনতা সগ্রামে সমর্থন ও সাহায্যের আবেদন জানিয়ে চিঠি দিয়েছিলেন। সশস্ত্র সংগ্রাম শুরু হওয়ার পর মে মাসে দিয়েছিলাে অনুরূপ আরাে একটি চিঠি। সে সময়কার বাংলাদেশের কমুনিস্ট পার্টির অবিসংবাদিত নেতা মণি সিংহ লিখেছেন, “আমাদের পার্টি আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের পক্ষে বিশ্বের সমাজতান্ত্রিক, প্রগতিশীল ও শান্তির শক্তিসমূহের সমর্থন ও সাহায্য সমাবেশ করার কাজে উদ্যোগ নিয়েছিলাে। আমাদের পার্টি উদ্যোগী হয়ে এপ্রিল মাসে বিশ্ব শান্তি পরিষদের সাধারণ সম্পাদক রমেশ চন্দ্রের সঙ্গে যােগাযােগ করে তার সহায়তায় তিন সদস্যের প্রতিনিধি দল বিদেশে পাঠায়। এই দলের সদস্য ছিলেন আওয়ামী লীগের আবদুস সামাদ আজাদ, ন্যাপের দেওয়ান মাহবুব আলী (ফেরার পথে দিল্লিতে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।) এবং কমিউনিস্ট পার্টির ডা. সারােয়ার আলী। এই শান্তি প্রতিনিধি দল’ ইউরােপের বিভিন্ন রাজধানী সফর করে প্রগতিশীল শক্তিসমূহের কাছে বাংলাদেশে ইয়াহিয়া বাহিনীর ভয়াবহ গণহত্যা এবং আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের বিষয় তুলে ধরেন। এটাই ছিলাে বিদেশে বাংলাদেশের প্রথম প্রতিনিধি দল। তখন পর্যন্ত কোলকাতা ছাড়া কোথাও বাংলাদেশের সরকারের মিশন সংগঠিত হয়নি।”
এ-ভাবে গােড়া থেকেই আমাদের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে বিশ্বজনমত গড়ে তােলার জন্যে মস্কোপন্থী বলে পরিচিত বাংলাদেশের কম্যুনিস্ট পার্টি যেসব উদ্যোগ নিয়েছিলাে তার পেছনে সিপিআইয়ের ছিলাে অতন্দ্র সক্রিয় সহযােগীর ভূমিকা। শুধু তাই নয়। সিপিআইয়ের প্রভাব ভারতের কংগ্রেস সরকারের ওপরও যথেষ্ট পরিমাণে কার্যকর হয়েছিলাে। সােভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে ভারতের যে মৈত্রী চুক্তি একাত্তরের আগস্টে স্বাক্ষরিত হয়েছিলাে তার পেছনেও সিপিআইয়ের ভূমিকার গুরুত্ত্বকে কেউ অস্বীকার করতে পারবে না। ভারতসােভিয়েত মৈত্রী চুক্তি যে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে প্রত্যক্ষ সহায়তা দানের ব্যাপারে ভারত সরকারকে সাহস জুগিয়েছে, সে-কথাই বা স্বীকার না করবে কোন মূর্খ?
সিপিআইয়ের মতাে সিপিএমও অর্থাৎ ভারতের ক্যুনিস্ট পার্টি (মার্কসবাদী)’ ভারতের একটি সংগঠিত ও শক্তিশালী বামপন্থী দল। সিপিএম-এর সাংগঠনিক শক্তি বরং সিপিআই-এর চেয়ে বেশি। অন্তত পশ্চিমবঙ্গে তাে বটেই। কিন্তু তখনকার শাসকদল ইন্দিরা কংগ্রেসের সঙ্গে সিপিএম-এর মােটেই সদ্ভাব ছিলাে না। এক সময়ে পিকিংপন্থী পরিচয়ে সিপিআই থেকে বেরিয়ে এসে এটি পৃথক দলে সংগঠিত হয়। কিন্তু পরে পিকিংয়ের সঙ্গেও এর সম্পর্ক শীতল হয়ে পড়ে, এবং দলটির নীতি হয় মস্কো-পিকিং থেকে সমদূরত্ব’। এতে আন্তর্জাতিক ক্যুনিস্ট আন্দোলনে তার প্রভাব একেবারেই ক্ষীণ হয়ে যায়। তাই, সাংগঠনিক দিক দিয়ে যতাে শক্তিধরই হােক, ভারতের তৎকালীন শাসকগােষ্ঠীর সঙ্গে দূরত্ব ও আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে প্রভাবহীনতার দরুণ সিপিএম-এর পক্ষে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে খুব একটা কার্যকর
৪৩৮
সহযােগিতা দেয়া সম্ভব ছিলাে না। তবু এ-রকম সীমাবদ্ধতার ভেতরেও সিপিএম আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ব্যাপারে একেবারে নিষ্ক্রিয় থাকেনি। আমাদের দেশের পিকিংপন্থী নামে পরিচিত কিছু গ্রুপ (যারা মুক্তিযুদ্ধকে ‘দুই কুকুরের লড়াই’ বলে মনে করতাে না) সিপিএমের সহায়তা লাভ করেছিলাে। পিকিংপন্থী ছাত্রসংগঠন ‘পূর্ববাংলা বিপ্লবী ছাত্র ইউনিয়ন’ যে ভারতে গিয়ে ভাসানী ন্যাপ ও কম্যুনিস্ট বিপ্লবীদের সমন্বয় কমিটির সঙ্গে যুক্ত হয়ে যুদ্ধের ট্রেনিং নিয়েছিলাে, সেটি সিপিএমের সহায়তা ছাড়া কিছুতেই সম্ভব হতাে না।
তবু, আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে ও ভারতের কংগ্রেসী সরকারের সহায়তায় বাংলাদেশে যে মুক্তিযুদ্ধ চলছিলাে তার প্রতি সিপিএমের দৃষ্টিটি ছিলাে অনেকাংশেই নেতিবাচক। বুর্জোয়া নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধ সফল হতে পারে না—এ-বক্তব্যটিই তারা জোরের সঙ্গে প্রচার করতাে। দলের তরুণ কর্মী ও সমর্থকদের মধ্যে এক রকম নেতিবাদী ভাবনাটাই বেশি পরিমাণে ক্রিয়াশীল ছিলাে বলে মনে হয়।
একবার বাসে চড়ে মেঘালয়ের পাহাড়ি পথ ধরে এক জায়গায় যাচ্ছিলাম। বাসযাত্রীদের মধ্যে ছিলাে অনেকগুলাে ভারতীয় বাঙালি তরুণ। ওরা পশ্চিমবঙ্গ থেকে এসে মেঘালয়েরই কোথায় জানি যাচ্ছিলাে। কথাবার্তায় বােঝা গেলাে যে ওরা সিপিএম-এর কর্মি। আমার পরিচয় জেনে জিজ্ঞেস করলাে, আপনি কি শরণার্থী শিবির ছেড়ে আর কোথাও যাওয়ার কথা ভাবছেন না? আমি ‘না’ বললে ওদের রীতিমতাে বিস্মিত হতে দেখলাম।
‘ও, ভাবছেন যে ভারতের ইন্দিরা কংগ্রেসের সহায়তায় আপনারা বাংলাদেশ স্বাধীন করে ফেলবেন, আর সেই স্বাধীন দেশেই ফিরে যাবেন। সােভিয়েতের সঙ্গে ভারতের চুক্তি হয়েছে দেখে আপনারা বােধ হয় স্বাধীনতা পেয়ে গেছেন বলেই মনে করছেন।
এই বলে একটি তরুণ বাঁকা হাসি হাসতে লাগলাে। সে হাসিতে যােগ দিলাে অন্য তরুণরাও। এরপর নানা বিদ্রুপাত্মক বাক্যে বুর্জোয়া ভারত ও সংশােদনবাদী’ সােভিয়েতের তীব্র নিন্দাবাদ করে চললাে, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ যে ব্যর্থ হতে বাধ্য সে-বিষয়ে অকাট্য সব প্রমাণ হাজির করতে থাকলাে। বাস থেকে নামবার সময় ওদেরই একজন আমাকে উপদেশ দিয়ে গেলাে যে আমি যেন ভারতেরই কোথাও কর্মসংস্থানের চেষ্টা করে সেদেশেই থেকে যাই, কারণ বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার কোনােই সম্ভাবনা নেই।
সংশােধনবাদী বলে পরিচিত সিপিআইয়ের বিরুদ্ধে ইন্দিরা কংগ্রেস তথা বুর্জোয়াদের লেজুড় বৃত্তির অভিযােগ তাে ভারতের অন্য অন্য বামপন্থী দলগুলাের কাছ থেকে হরহামেশাই শােনা যেতাে। সিপিআইয়ের মিত্র বাংলাদেশের কম্যুনিস্ট পার্টির বিরুদ্ধেও ছিলাে একই রকম অভিযােগ। বাংলাদেশের ক্যুনিস্ট পার্টি এবং তাদের মিত্র ও সহযােগী মােজাফফর ন্যাপ, ছাত্র ইউনিয়ন সবাই বুর্জোয়া আওয়ামী লীগের বি-টিম।
আমাদের যুক্তিযুদ্ধ চলার সময়েই ভারতের এক শ্রেণীর বামপন্থীরা মিছিলে স্লোগান দিতাে‘ইয়াহিয়া-ইন্দিরা এক হ্যায়, ভুলাে মৎ ভুলাে মৎ।
শুনেছি, সিপিআইয়ের বিশ্বনাথ মুখার্জি নাকি এই স্লোগানদাতাদের বলেছিলেন, ইয়াহিয়াইন্দিরা যে এক, সে তাে ইন্দিরার দেশে তােমরা গলা উঁচিয়ে বলছাে। এখন ইয়াহিয়ার দেশে গিয়ে ঠিক একই কথা বলে দেখে এসাে না কি হয়। তখন বুঝতে পারবে ইয়াহিয়া আর ইন্দিরা এক, না দুই।
যাই হােক, মস্কোপন্থী’ বামেরা ‘বি-টিম’ আখ্যা পেয়েও কিন্তু আওয়ামী লীগের যথেষ্ট আস্থা অর্জন করতে পারেনি। আওয়ামী লীগের একটা বড়াে অংশই ওদের শুধু প্রতিদ্বন্দ্বী নয়,
৪৩৯
রীতিমতাে শত্রু বলে মনে করতাে। মুক্তিযুদ্ধের একেবারে শুরু থেকেই তারা এই শত্রুতার প্রকাশ ঘটাতে থাকে।
বাংলাদেশের কম্যুনিস্ট পার্টি, ন্যাপ ও ছাত্র ইউনিয়নের কর্মীদের সমন্বয়ে একটি যৌথ বাহিনী গড়ার প্রস্তুতি মার্চ-এপ্রিলেই নেয়া হয়ে গিয়েছিলাে। এই যৌথ বাহিনীর দুই নেতা কমরেড জ্যোতিষ বসু ও কমরেড আলতাব আলী মে মাসের প্রথম সপ্তাহে নেত্রকোনার কলমাকান্দা থানার লেঙ্গুরা হয়ে ভারতের মেঘালয়ের দিকে যাচ্ছিলেন। সীমান্তের ওই এলাকাটি তখনই ছিলাে মুক্তাঞ্চল। পাকিস্তানের প্রতি আনুগত্য-ত্যাগকারী ইপিআরের বাঙালি সৈনিকদের নিয়ে স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতারা সেখানে ক্যাম্প তৈরি করে অবস্থান নিয়েছিলেন। প্রশাসন বলতে যা বােঝায় তার কিছু না থাকলেও একজন ইপিআর ক্যাপ্টেনের নেতৃত্বে ওই ক্যাম্পটিই তখন সেখানে কর্তৃত্বশীল শক্তিকেন্দ্রে পরিণত হয়েছিলাে। ওই ক্যাম্পের সঙ্গে যুক্ত আওয়ামী লীগ নেতাদের কারাে কারাে ভেতরে ছিলাে তীব্র ক্যুনিস্ট-বিদ্বেষ। সেই বিদ্বেষ থেকেই ওরা সীমান্ত-অতিক্রমরত জ্যোতিষ বসু ও আলতাব আলীকে ইপিআর ক্যাপ্টেনের হাতে তুলে দিলাে। এই দুই ব্যক্তি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের বিরােধী এবং পাকিস্তানের চর—এই অভিযোেগ এনে ক্যাম্পেই তাদের বিচার হলাে। বিচারে তাদের দোষী সাব্যস্ত করে ফায়ারিং স্কোয়াডে মৃত্যুদণ্ডের রায় দেয়া হলাে। সেই রায় হয়তাে কার্যকরও হয়ে যেতাে। কিন্তু অচিরেই খবরটি লেঙ্গুরার হাজং কৃষকদের মধ্যে পৌঁছে গিয়ে ভীষণ উত্তেজনার সৃষ্টি করলাে। পাকিস্তানের তীব্র দমন-পীড়ন এবং সাম্প্রদায়িক ও কম্যুনিস্ট-বিরােধী লাগাতার প্রচারের পরও, টঙ্ক ও তেভাগা আন্দোলনের ঐতিহ্য-লালিত লেঙ্গুরার কৃষকরা কম্যুনিস্ট নেতাদের প্রতি শ্রদ্ধা হারিয়ে ফেলেনি। হাজং কমরেড বিপিন গুণের নেতৃত্বে তারা তীর ধনুক ও বর্শা নিয়ে ক্যাম্প ঘেরাও করে ফেললাে, আটক জ্যোতিষ বসু ও আলতাব আলীকে ছিনিয়ে আনতে উদ্যোগী হলাে। একটা রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ ঘটে যাচ্ছিলাে প্রায়। তখনই স্থানীয় একজন ডাক্তার মধ্যস্থতা করতে এগিয়ে এলেন। তারই প্রয়াসে জ্যোতিষ বসু ও আলতাব আলী মুক্তি পেলেন। পরিস্থিতি শান্ত হলাে।
জ্যোতিষ বসু ও আলতাব আলীর মতাে কমরেডগণ সীমান্তের ওপারে গিয়ে উপলব্ধি করলেন যে, বাম প্রগতিশীল তরুণদের মুক্তিবাহিনীতে অন্তর্ভুক্ত করানাে খুবই কঠিন। আওয়ামী লীগের কট্টর দক্ষিণপন্থীরা সদা সতর্ক দৃষ্টি রাখতাে যে কোনাে মতেই যাতে কোনাে বামপন্থী তরুণ মুক্তিবাহিনীতে ঢুকে পড়তে না পারে। এর ফলে কম্যুনিস্ট পার্টি, ন্যাপ ও ছাত্রইউনিয়নের যে সব কর্মী মুক্তিযুদ্ধে যােগ দেয়ার জন্যে ভারতে গিয়েছিলাে তাদের মধ্যে ক্ষোভ ও হতাশার সৃষ্টি হলাে। এ-সব সংগঠনের নেতারা তখন অন্য পথের খোঁজ করতে বাধ্য হলেন।
এ ব্যাপারেও কার্যকর সহযােগিতা পাওয়া গেলাে সিপিআইয়ের কাছ থেকেই। তাদেরই সক্রিয় প্রচেষ্টায় শেষ পর্যন্ত কম্যুনিস্ট পার্টি ন্যাপ ও ছাত্র ইউনিয়নের সম্মিলিত গেরিলা বাহিনী ভারত সরকারের আনুকূল্য ও ট্রেনিং গ্রহণের সুযােগ পায়। ওই গেরিলা বাহিনীতে পাঁচ হাজার তরুণকে ট্রেনিং দিয়ে মুক্তিযুদ্ধে পাঠানাে হয়েছিলাে, এবং কম্যুনিস্ট পার্টিরই উদ্যোগে আরাে বারাে হাজার তরুণ স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের মুক্তিবাহিনীতে সংযুক্ত হতে পেরেছিলাে। এভাবেই সতেরাে হাজার মুক্তিযােদ্ধাকে ট্রেনিং ও যুদ্ধের জন্যে সংগঠিত করে বাংলাদেশের কম্যুনিস্ট ও বামপন্থী দেশপ্রেমিকরা। মুক্তিযুদ্ধে এদের অবদান সম্পর্কে কমরেড মণি সিংহ বলেছেন
“আমাদের গেরিলা টিম সকল জেলায় পাঠানাে হয়েছিলাে। ঢাকার খােদ রাজধানী, নরসিংদি, রায়পুরা, কুমিল্লায়, নােয়াখালিতে, চট্টগ্রামে, রংপুরসহ উত্তরবঙ্গের কয়েকস্থানে
৪৪০
আমাদের টিমগুলাে গেরিলা অ্যাকশন করেছে এবং রণক্ষেত্রে আমাদের কমরেডরা প্রাণ দিয়েছেন। যারা ভারতে যাননি, সেই কমরেডরা দেশের ভেতরে থেকে যুদ্ধের সংগঠন গড়ে তুলেছিলেন এবং এরাই ভারত থেকে আগত আমাদের গেরিলাদের অ্যাকশনে সাহায্য করেছেন।…আমরা নিজেরা, বাংলাদেশ সরকার এবং মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে সহযােগিতায় সারাদেশে যুদ্ধরত ছিলাম। যুদ্ধ ছাড়া সংবাদ বহন, রেকি করা প্রভৃতি যুদ্ধের সহায়ক ঝুঁকিপূর্ণ কাজ আমাদের কমরেডরা করেছেন। কেবল নিচু পর্যায়ের নয়, উঁচু পর্যায়েও যুদ্ধের সংগঠনে আমাদের ভূমিকা ছিলাে। যেমন অস্থায়ী বাংলাদেশ সরকারের প্রথম বিমান বাহিনী গঠনে আমাদের পার্টির অবদান ছিলাে। ছােট খাট গেরিলা অ্যাকশন ছাড়া আমাদের গেরিলারা চট্টগ্রাম বন্দরে পাকিস্তানি জাহাজ ডুবিয়েছিলাে। কুমিল্লা জেলার চৌদ্দগ্রাম এলাকায় ঢাকাচট্টগ্রাম সড়কে বেতিয়ারা নামক স্থানে আমাদের কমরেড আজাদ, মুনীর প্রমুখ আমাদের গেরিলা বাহিনীর ৯ জন সদস্য পাকবাহিনীর সঙ্গে এক লড়াইয়ে নভেম্বর মাসের ১১ তারিখে নিহত হন।”

সংকট ও সম্ভাবনার জোয়ারভাটা
সেপ্টেম্বর মাসে যখন বাঘ মারা আশ্রয় শিবিরে গিয়ে পৌছাই তখন সেখানে কমরেড মহাদেব সান্যাল আর গঙ্গেশ সরকার বাংলাদেশের ক্যুনিস্ট পার্টি ও ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (মােজাফফর)-র পক্ষ থেকে মুক্তিযােদ্ধা রিক্রুটের ব্যাপারে কর্মরত। এদের সঙ্গে ছিলেন হাজং কমরেড বিপিন গুণ ও প্রফুল্ল । মহাদেব বাবুর মুখে অনেক কথাই শুনলাম। মাস দুই আগে থেকে তিনি বাঘমারায় আছেন। তাঁর সঙ্গে এসে দেখা করে গেছেন কমরেড মণি সিংহ ও কমরেড খােকা রায়। তাঁরাই তাঁকে পার্টির কিছু দায়িত্ব বুঝিয়ে দিয়ে গেছেন। যে সব প্রগতিশীল ছাত্র তরুণ সীমান্ত পার হয়ে বাঘমারা আশ্রয় শিবিরে এসে উঠতাে তাদের দেখাশােনার ভার পড়েছিলাে মহাদেব বাবুর ওপরই। আমি আসার পর তিনি আমাকেও কিছু কাজের ভাগ দিলেন। বিদেশের মাটিতে পা দিয়ে হঠাৎ করে অনাত্মীয় পরিবেশের মধ্যে পড়ে আমাদের তরুণদের অনেকের ভেতরই একটা অনিশ্চয়তা ও অনিরাপত্তার ভাব দেখা দিতাে। বামপন্থী ছাত্রসংগঠন ছাত্র ইউনিয়নের কর্মিরাই এ অবস্থার বিশেষ শিকার হতাে। তাদের এই বামপন্থী পরিচয়টিই যখন মুক্তিবাহিনীতে যােগ দেয়ার পথে বাধা হয়ে দাঁড়াতাে তখন স্বাভাবিক ভাবেই ক্ষোভ ও হতাশা তাদের আক্রমণ করতাে। সে অবস্থায় আমরা তাদের মনােবল চাঙা রাখার চেষ্টা করতাম। মুক্তিযুদ্ধে যােগদানে বামপন্থী ছাত্র তরুণদের জন্যে ন্যাপ কম্যুনিস্ট পার্টির উদ্যোগে বাঘমারায় যে ছােট্ট ক্যাম্পটি তৈরি করা হয়েছিলাে সেটি ছিলাে আমার আর মহাদেব বাবুর ঘরের পাশেই। সেখানে ওই তরুণদের রাজনৈতিক প্রশিক্ষণ দিতাম। মার্কসবাদী দৃষ্টিকোণ থেকে তরুণদের কাছে মুক্তিযুদ্ধের তাৎপর্য ও তাদের দায়িত্ব সম্পর্কে ব্যাখ্যা দেয়ার ফলে তারা সহজেই হতাশামুক্ত হতাে। এরপর তারা চলে যেতাে বারেঙ্গাপাড়ায়। সেখানেই ছিলাে কম্যুনিস্ট পার্টি ন্যাপ ছাত্র ইউনিয়নের যৌথ বাহিনীর প্রশিক্ষণ ক্যাম্প। সেই ক্যাম্পের মূল দায়িত্বে ছিলেন কমরেড জ্যোতিষ বসু। তার সহযােগী ছিলেন কমরেড অজয় রায় কমরেড মন্মথ দে ও ন্যাপ নেতা আজিজুল ইসলাম খান। আর ছিলেন কাজী আবদুল বারি। মেঘালয়ের সীমান্তে ওই যৌথবাহিনীর আরাে দুটো ক্যাম্প ছিলাে—একটি চান্দুভুইয়ে ও
৪৪১
আরেকটি সিসিং পাড়ায়। চান্দুভুই ক্যাম্পে ছাত্র ইউনিয়ন নেতা নূর মােহাম্মদ তালুকদারের সহযােগিতায় মূল দায়িত্ব পালন করতেন কমরেড আলতাব আলী, আর সিসিংপাড়ায় প্রদীপ চক্রবর্তী। চান্দুভুই কিংবা সিসিংপাড়ায় আমি যাইনি, বারেঙ্গা পাড়ায় গিয়েছি।
বারেঙ্গা পাড়া থেকেই বাঘমারায় এসে আমাদের সঙ্গে যােগাযােগ করতেন এবং পার্টির বিভিন্ন নির্দেশ ও সিদ্ধান্ত জানিয়ে যেতেন কমরেড শাহ আবদুল মােতালেব ওরফে সুরুজ মিঞা। মুক্তিযুদ্ধে বামপন্থী ছাত্র তরুণদের যুক্ত করার কাজে আমার দীর্ঘকালের রাজনৈতিক সুহৃদ সুরুজ মিঞার ছিলাে অত্যন্ত সক্রিয় ভূমিকা। বহুদিন পরে আমার কলেজ জীবনের বন্ধু ফরিদের সঙ্গে দেখা হলাে ওই বারেঙ্গাপাড়াতেই। ন্যাপের সক্রিয় কর্মী ফরিদ যৌথবাহিনীতে যােগ দিয়ে মুক্তিযােদ্ধা হয়েছিলাে। কমরেড রবি নিয়ােগী ও কমরেড পরেশ দাসকেও বারেঙ্গাপাড়া ক্যাম্পেই পেয়েছিলাম। আমার ছাত্র ও নাসিরাবাদ কলেজ ছাত্রসংসদের নির্বাচিত সহ সভাপতি আতা এলাহিও সে ক্যাম্পে থেকে কাজ করছিলাে। বৃহত্তর ময়মনসিংহ অঞ্চলের কম্যুনিস্ট পার্টি ন্যাপ ছাত্র ইউনিয়নের নেতাকর্মী যারাই সীমান্ত পার হয়ে মুক্তিযুদ্ধে নানাভাবে অংশ নিয়েছিলেন তাদের প্রায় সবারই বারেঙ্গাপাড়া ক্যাম্পের সঙ্গে কোনাে না কোনাে যােগসূত্র তৈরি হয়ে গিয়েছিলাে। ওই ক্যাম্পে বসেই মুক্তিযুদ্ধের নাড়ীর গতিটা আমি অনুভব করতে পেরেছিলাম। আওয়ামী লীগের দক্ষিণপন্থীদের নাশকতামূলক কার্যকলাপের পাশাপাশি যথার্থ দেশপ্রেমিক আওয়ামী নেতাদের প্রশংসনীয় ভূমিকা, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে সিপিআই নেতৃবৃন্দ ও কংগ্রেসের প্রগতিশীল অংশের অবদান, আমাদের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে বিভিন্ন শক্তির টানাপােড়েন, এ সব সম্পর্কে অনেক কথাই বারেঙ্গাপাড়ায় কার্যরত আমাদের কমরেডদের কাছে শুনেছিলাম। অনেক সিপিআই নেতা এই ক্যাম্প পরিদর্শন করতে আসতেন। তাঁদের কাছ থেকেই আমাদের কমরেডরা অনেক অজানা বিষয় অবহিত হতেন। আমাদের মুক্তিযুদ্ধে যেসব সিপিআই নেতার বিশেষ অবদান ছিলাে তাদের অন্যতম ছিলেন ভূপেশ গুপ্ত। নভেম্বরের শেষ দিকে ভূপেশ গুপ্ত বারেঙ্গাপাড়া ক্যাম্প পরিদর্শনে এলে কমরেড জ্যোতিষ বসু ও অন্যরা তার কাছে আমাদের নানা অভাব ও অসুবিধার কথা তুলে ধরেছিলেন। ভূপেশ গুপ্ত এর কয়েকদিন আগেই মস্কোতে গিয়ে সােভিয়েত নেতাদের সঙ্গে আলাপ আলােচনা করে এসেছেন। তিনি বললেন, আপনাদের বেশিদিন আর কষ্ট করতে হবে না। শিগগিরই তাে দেশে ফিরে যাচ্ছেন। এবং হলােও তাই। মাত্র সপ্তাহ তিনেকের মধ্যেই পাকবাহিনী আত্মসমর্পণ করলাে।
বারেঙ্গাপাড়াতেই ছিলাে ময়মনসিংহের মিন্টু কলেজের প্রিন্সিপাল ও আমার বন্ধু মতিউর রহমানের পরিচালনায় আওয়ামী লীগের মুক্তিযােদ্ধা রিক্রুটমেন্ট শিবিরটিও। মুক্তিযুদ্ধ সংগঠনে মতিউর রহমান অসাধারণ দক্ষতা ও যােগ্যতার পরিচয় দিয়েছিলেন। ছিলেন তরুণ শিক্ষক, বঙ্গবন্ধুর ডাকে সেই তারুণ্যকে তিনি নিবেদন করলেন দেশমাতৃকার শৃঙ্খল মােচনে। সীমান্ত পেরিয়ে গিয়ে এমন একটি ক্যাম্প গড়ে তুলতে তাকে যথেষ্ট শ্রম দিতে হয়েছে, অনেক কষ্ট স্বীকার করতে হয়েছে। তবে আমার সঙ্গে যখন মতিউর রহমান সাহেবের দেখা তখন তিনি ক্যাম্পে বেশ গুছিয়ে বসেছেন। তখন তার শ্রম ও কষ্টের ফল ফলেছে। হাজার হাজার মুক্তিযােদ্ধাকে তিনি সংগঠিত করে চলেছেন।
ময়মনসিংহের অনেক আওয়ামী লীগ নেতার সঙ্গেই মেঘালয়ের বিভিন্ন স্থানে আমার দেখা হয়েছিলাে। এদের কারাে মধ্যে প্রত্যয়ী মনােভঙ্গির প্রকাশ দেখতে পেয়েছিলাম, কাউকে
৪৪২
দেখেছিলাম একান্ত হতাশ। ময়মনসিংহ শহরে আমার নিকটতম প্রতিবেশী আনিসুর রহমান খান এ্যাডভােকেট সাহেবের দেখা পেয়েছিলাম বাঘমারায়। বয়সে আমার চেয়ে কয়েক বছরের বড়াে হলেও তরুণের উৎসাহ নিয়ে তিনি মুক্তিযুদ্ধের সাংগঠনিক কাজে ব্রতী হয়েছিলেন। সেদিন তার সঙ্গে আলাপ করে আমার এই বিশ্বাস জন্মেছিলাে যে, আওয়ামী লিগারদের মধ্যে চিন্তার বিভিন্নমুখী স্রোত থাকলেও তাজুদ্দীনের নেতৃত্বে স্বাধীন বাংলাদেশের অস্থায়ী সরকার মােটামুটি একটা দৃঢ় ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে গেছে এবং মুক্তিযুদ্ধে জয় আমাদের অবশ্যম্ভাবী। বাঘমারা যাবার পথে রংরা নামক একটি জায়গায় কয়েকদিন ছিলাম। সেখানেই দেখা হয়েছিলাে ময়মনসিংহের আওয়ামী লীগ নেতা রফিক উদ্দিন ভূঁইয়া, নেত্রকোনার জোবেদ আলী ও ত্রিশালের ইমান আলীর সঙ্গে। রফিক উদ্দিন ভূইয়া ছিলেন আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতাদের একজন। যদিও তিনি সত্তরের নির্বাচনে ময়মনসিংহের নান্দাইল আসনে নুরুল আমিনের কাছে পরাজিত হয়েছিলেন, তবু ভারতীয় কর্তৃপক্ষ সেদিন তাকে একজন গণ প্রতিনিধির মর্যাদা দিয়েই গ্রহণ করেছিলাে। মুক্তিযুদ্ধে ভূঁইয়া সাহেব অত্যন্ত দৃঢ় ও কার্যকর ভূমিকা রেখেছিলেন।
বালালি গ্রামে যে ছাত্র তরুণদের নিয়ে আমি পাঠচক্র গড়ে তুলেছিলাম তাদের প্রায় সবাই মুক্তিযুদ্ধে যােগ দিয়েছিলাে। গিয়াস, মতিন, করিম, মুজিবর—বালালির এসব ছেলেদের বামপন্থী পরিচয়টি খুব প্রগাঢ় হয়ে ওঠেনি বলেই আওয়ামী লীগ পরিচালিত মুক্তিবাহিনীতে রিকুটেড হতে কোনাে অসুবিধে দেখা দেয়নি। কিন্তু কলেজের তরুণ অধ্যাপক নূরুল হকের পক্ষে তেমনটি সম্ভব ছিলাে না। তাকে যেতে হয়েছিলাে বারেঙ্গাপাড়ায় কমরেড জ্যোতিষ বসু পরিচালিত ক্যাম্পে। সেখান থেকেই সে বামপন্থীদের যৌথবাহিনীতে যােগ দিয়ে আসামের তেজপুরে গিয়ে সামরিক প্রশিক্ষণ নিয়েছিলাে। সেই হয়েছিলাে ওই প্রশিক্ষণার্থীদের টিম লিডার। আমাদের এলাকার বামপন্থী তরুণদের যারা এ সময় ক্যুনিস্ট ন্যাপ ছাত্র ইউনিয়নের যৌথ বাহিনীতে যােগ দিয়েছিলাে তাদের অনেকের কথাই এখন আমরা ভুলে গিয়েছি। প্রদীপ চক্রবর্তীর সঙ্গে আলাপ করে যে ক’টি নাম মনে করতে পেরেছি সেগুলাে হচ্ছে—নজরুল ইসলাম খােকন, হান্নান, প্রতাপ দাশ, আবুল হাশেম, শফিকুল ইসলাম, প্রাণেশ, শামসুল আলম তালুকদার, অঞ্জন ভদ্র, ফরিদ, জিন্নাতুল ইসলাম, আমিরুল ইসলাম, ইসমাইল তরফদার, ইশরাত মুজতবা, ওয়ারেস হােসেন, আশুতােষ, লুৎফর রহমান, আশরাফুল ইসলাম, শহীদুল ইসলাম, দিলীপ ধর, আবদুল বারি, আবদুল গফুর।
আইয়ুবের সামরিক শাসনে যাকে বেত্রদণ্ডে দণ্ডিত করা হয়েছিলাে, বেত্রাঘাতের ফলে যার শ্রবণশক্তি নষ্ট হয়ে গিয়েছিলাে, সেই কাজী আবদুল বারি একাত্তর সনেও জঙ্গী উদ্যম হারিয়ে ফেলেননি। কাজী বারি ছিলেন খােন্দকার মােশতাক আহমদের আপন ভাগ্নে। মামা ভাগ্নের চেহারা চরিত্রে সাধারণ অনেক মিল থাকে। কিন্তু কাজী বারির সঙ্গে খােন্দকার মােশতাকের চেহারায় কিছু মিল থাকলেও চরিত্র ছিলাে সম্পূর্ণ বিপরীত। কাজী বারির মতােই খােন্দকার মােশতাকের আরেক ভাগ্নে (অর্থাৎ কাজী বারির খালাতাে ভাই)র সঙ্গে আমার পরিচয় ও ঘনিষ্ঠতা জন্মে বাঙলাদেশের স্বাধীনতার অনেক পরে। এই ভদ্রলােকের নাম মােসলেহ উদ্দিন চৌধুরী। পেশায় ইলেকট্রনিক ইঞ্জিনিয়ার। তিনিও মুক্তিযােদ্ধা ছিলেন। তার মধ্যেও দেখেছি মামা মােশতাকের চরিত্রের বিপরীত বৈশিষ্ট্যাবলি। মােশতাক খল, নিষ্ঠুর, বিশ্বাসহন্তা। তার ভাগ্নে মােসলেহ উদ্দিন সরল, সহৃদয়, বন্ধুবৎসল।
৪৪৩
মােসলেহ উদ্দিনের কথা এখানে প্রাসঙ্গিক নয়। তবু তার কথা উল্লেখ করছি মামা ভাগ্নের চরিত্রের বৈপরীত্য প্রদর্শনের জন্যেই। নরাণাং মাতুলক্রমঃ—এরা বােধ হয় এই সংস্কৃত প্রবাদটিকে মিথ্যা করে দিয়েছেন। মামা মােশতাকের মার্কিন প্রীতির কথা তুলে লড়াকু ও নির্যাতিত মস্কোপন্থী কম্যুনিস্ট ভাগ্নে কাজী বারিকে আমরা ক্ষেপাতে চেষ্টা করতাম। তাকে ক্ষেপাতে অবশ্যি পারতাম না, তবে মামার চরিত্রের এমন সব অন্ধকারের কথা ভাগ্নের মুখ দিয়ে বেরিয়ে আসতাে যে শুনে আমরা মূক হয়ে যেতাম। মােশতাককে রাজনৈতিক বিচারে প্রতিক্রিয়াশীল বলে আমরা জানতাম, কিন্তু তার ব্যক্তি চরিত্রের নীচতা ও জটিলতার কথা ভাগ্নে কাজী বারির মুখেই প্রথম শুনি। আবার আশ্চর্যের বিষয় এই, ব্যক্তিগত চরিত্র ও রাজনৈতিক অবস্থানে সম্পূর্ণ বিপরীত মেরুর হলেও মােশতাক সাহেব তার এই ভাগ্নেটিকে ভীষণ স্নেহ করতেন। ভাগ্নেও মামার এই দুর্বলতার সুযােগ নিতে ছাড়তেন না।
মুক্তিযুদ্ধ চলার সময় মােশতাক সাহেবের সঙ্গে কাজী বারি একবার দেখা করে এলেন। ক্যাম্পে ফিরে এলে দেখা গেলাে তার বেশ দরাজ দিল। বন্ধুদের কাউকে কাউকে টাকা দিয়ে সাহায্য করছেন, যখন তখন সিগারেট খাওয়াচ্ছেন। ব্যাপার কী জিজ্ঞেস করলে একগাল হেসে কাজী বারি বললেন, ‘মামার সঙ্গে দেখা হতেই বললাম যে, তুমি তাে বরাবরই তােমার স্যাম চাচার দেশ থেকে অনেক টাকা পয়সা পাও। এবার নিশ্চয়ই আরাে বেশি পাচ্ছে। এদিকে খুব কষ্টে আমরা ক্যাম্পে দিন কাটাচ্ছি। তােমার ওই ভাণ্ডার থেকে কিছু মালকড়ি ছাড়াে তাে আমাদের জন্যে। মামার সঙ্গে আমি সব সময় এভাবেই কথা বলি মামাও তাে আমাকে ভালাে করেই চেনে। তাই বেশি ঘাটাতে সাহস পায় না। এবারাে তার কাছ থেকে কিছু খসালাম।
সে সময়েই নাকি খােন্দকার মােশতাক কাজী বারিকে বলেছিলেন, “দেখ, মুক্তিযুদ্ধ বলিস আর যাই বলিস, আমেরিকা ছাড়া কিছু হবে না। ইন্ডিয়াই কি আমেরিকাকে চটিয়ে কিছু করবে নাকি? তােদের রাশিয়া কেবল বড়াে বড়াে কথাই বলবে, আসল কাজে তাকে পাওয়া যাবে না। শেষ পর্যন্ত আমেরিকাই একমাত্র ভরসা।
খােন্দকার মােশতাকের মার্কিন প্রীতিতে একটুও খাদ ছিলাে না। স্বাধীন বাংলাদেশের অস্থায়ী সরকারের পররাষ্ট্র মন্ত্রী হয়েও সেই নিখাদ মার্কিন প্রীতির সুবাদেই যে তিনি ভেতরে ভেতরে একটা ষড়যন্ত্র পাকিয়ে যাচ্ছিলেন, কাজী আবদুল বারির সে সন্দেহ পরে সত্য বলে। প্রমাণিত হয়েছিলাে।
একটা খুব জোর গুজব ছড়িয়ে পড়েছিলাে যে, মার্কিন মধ্যস্থতায় শিগগিরই পাকিস্তানের সামরিক সরকারের সঙ্গে একটা আপসরফা হতে যাচ্ছে। কনফেডারেশন ধরনের একটা কিছু হয়তাে হয়ে যাবে। এতে ভারতে আশ্রয় নেয়া প্রায় এক কোটি শরণার্থীর দুর্ভোগ দূর হবে, সকলেই দেশে ফিরে যাবে। যুদ্ধ করে পাকিস্তানের শক্তিশালী সেনাবাহিনীকে কি হারানাে সম্ভব? তাছাড়া সবচেয়ে বড়াে কথা, বঙ্গবন্ধুকে তাে আমাদের চাই। একটা আপসরফা হয়ে গেলেই বন্দিদশা থেকে তিনি মুক্তি পাবেন। তা না হলে তাকে যে পাকিস্তানিরা হত্যা করে ফেলবে এতাে একেবারে সুনিশ্চিত।
এই রটনার খুব তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছিলাে তরুণ মুক্তিযােদ্ধাদের মধ্যে। জীবন বাজি রেখে যারা ময়দানে থেকে লড়াই করেছিলাে তারা আপস তাে দূরের কথা, আপসের সামান্য সম্ভাবনাকে পর্যন্ত বরদাশত করতে রাজি নয়। বারেঙ্গাপাড়া যাওয়ার পথে একটি হাইড আউট’ ক্যাম্পে হঠাৎ দেখা হয়ে গিয়েছিলাে কয়েকজন মুক্তিযােদ্ধার সঙ্গে। ওদের একজন
৪৪৪
ছিলাে ময়মনসিংহ এলাকারই ছেলে। আমাকে চিনতে পেরে ওরা সবাই আমার পাশে এসে ভিড় করে দাঁড়ালাে। পাকিস্তানের সঙ্গে সত্যি সত্যিই আপস হয়ে যাবে কিনা, ওরা আমার কাছে তাই জানতে চায়। প্রচারিত খবরটির সত্যাসত্য যাচাইয়ের সুযােগ বা ক্ষমতা যে তাদের মতাে আমারও নেই, সে কথা তারা নিশ্চয়ই জানে। তবু আমার কাছে প্রশ্নটি উত্থাপন করার উদ্দেশ্য হলাে বিষয়টি নিয়ে কিছু কথা বলে তাদের ভেতরকার ক্ষোভের প্রকাশ ঘটানাে। ওদের একজন বলছিলাে, ‘স্যার, আপসই যদি করে তবে আমাদের নেতাদের আমরা ছেড়ে দেবাে না। আগে ওদের গুলি করে পরে নিজেদের বুকেও গুলি চালিয়ে দেবাে। পরাধীন দেশে কিছুতেই ফিরে যাবাে না। স্থানীয় পর্যায়ের কিছু নেতার বিরুদ্ধেও দেখলাম তাদের প্রচণ্ড ক্ষোভ। ওদের তীব্র তীক্ষ্ণ কথাবার্তা শুনে ও চোখমুখের অভিব্যক্তি দেখে আমি স্থির নিশ্চিত হয়ে গিয়েছিলাম যে, কিছু নেতা চাইলেও মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করতে পারবে না। মুক্তিপাগল তরুণদের রুদ্ররােষের আগুনে সব মতলবি আপসের অপপ্রয়াস ছাই হয়ে যাবে।
এ সময়েই আরেকটি গুজবও বাজারে ছেড়ে দেয়া হয়েছিলাে। আমেরিকা নাকি ভারত সরকারের কাছে প্রস্তাব দিয়েছে যে, পূর্ব পাকিস্তানের বিদ্রোহী রাজনীতিকদের সাহায্য করা তােমরা ছেড়ে দাও। তাহলে তারা সবাই পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকারের সঙ্গে আপস করতে বাধ্য হবে, শান্তিপূর্ণভাবে সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে, তােমরাও ঝামেলা থেকে বেঁচে যাবে। শরণার্থী যারা এসেছে তাদের অধিকাংশই তাে হিন্দু। একটা আপস হয়ে গেলে মুসলমানরা সব দেশে চলে যাবে। পূর্ব পাকিস্তানের বাস্তুত্যাগী হিন্দুদের বােঝা তাে তােমাদের বরাবরই বইতে হয়। এখন যে হিন্দুরা এসেছে তারা যদি দেশে ফিরে না যেতে চায় তাে তাদেরও এদেশেই তােমরা পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করে নাও। এর জন্যে কতাে টাকা লাগবে তার একটা হিসাব দাও, মার্কিন সরকার পুরাে টাকাটাই তােমাদের হাতে তুলে দিতে রাজি আছে…
এ গুজবটি অবশ্যি খুব বেশি ছড়ায়নি। তবে বাঘমারা শরণার্থী শিবিরে দেখলাম কিছু মানুষের মধ্যে এটি বেশ সমাদর পেয়েছে। বিশেষ করে যে সব হিন্দু পরিবার দেশ ছাড়ার জন্যে কেবলই প্রস্তুতি নিচ্ছিলাে, অথচ কিছুতেই প্রস্তুতি শেষ করে ভিনদেশে গিয়ে বসবাসের ইচ্ছাটি বাস্তব করে তুলতে পারছিলাে না, তারা তাে মহাখুশি। কিসের মুক্তিযুদ্ধটুদ্ধ। স্বাধীন হলেই দেশে গিয়ে করবােটা কী? তার চেয়ে সত্যি সত্যিই যদি এমনটি হয়, তবে….
যাই হােক, এ রকম গুজবের কোনােটিই সত্য হয়নি, গুজবই থেকে গেছে। মুক্তিযুদ্ধই বরং দিন দিন তীব্র থেকে তীব্রতর হয়ে উঠছিলাে। পাকিস্তানের সঙ্গে ভারতের সরাসরি যুদ্ধ লেগে যাবে এমন সম্ভাবনাও স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিলাে। রণাঙ্গন থেকে বিজয়ের অসাধারণ সব খবর আসছিলাে। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের ‘চরমপত্র’ আর ‘জল্লাদের দরবার’ অনুষ্ঠান দুটো ক্রমেই বেশি বেশি উদ্দীপনাময় হচ্ছিলাে। কাজেই হতাশার কারবারিরা তাদের প্রতিক্রিয়াশীল ভীরুতার পণ্য আর ফেরি করতে পারছিলাে না। সকলে বুঝে নিয়েছিলাে, মুক্তি এখন আমাদের দোর গােড়ায়।

‘সুতীক্ষ্ণ কৃপাণের প্রতি অজস্র সালাম
শরণার্থী শিবিরে বসে রেডিওর নব ঘােরাতে ঘােরাতে এক কেন্দ্র থেকে আরেক কেন্দ্রে চলে যেতাম। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের তাে প্রায় সব অনুষ্ঠানই শুনতাম। সেই সঙ্গে আকাশ
৪৪৫
বাণী, বিবিসি, ভয়েস অব আমেরিকা। রণাঙ্গনে আমাদের মুক্তিযােদ্ধাদের একেকটি সাফল্যের সংবাদে আমাদের উদ্দীপনা ক্রমেই বেড়ে যেতে লাগলাে। তবে অক্টোবরের দ্বিতীয় সপ্তাহে রেডিওর একটি খবর আমাদের পুরাে শিবিরটিকে যেভাবে বিজয়ের উল্লাসে মাতােয়ারা করে তুলেছিলাে, তেমনটি এর আগে কোনাে খবরই করতে পারেনি। খবরটি হলাে : মুক্তিযােদ্ধার হাতে গুলিবিদ্ধ হয়ে পূর্ব পাকিস্তানের সাবেক গভর্নর মােনায়েম খানের মৃত্যু। মােনায়েম খান তখন পাদপ্রদীপের সামনে ছিলেন না। আমাদের মুক্তিযুদ্ধের বিরােধিতায় তার কোনাে সক্রিয় ভূমিকার কথাও শােনা যায়নি। উনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানের ধাক্কায় গভর্নরের পদত্যাগ করতে বাধ্য হয়ে করুণ বিদায় নেবার পর থেকেই তিনি আস্তে আস্তে বিস্মৃতির অন্তরালে চলে গিয়েছিলেন। তাই তাকে নিয়ে সাধারণের মধ্যে তখন কোনাে কৌতূহল থাকার কথা নয়, ছিলােও না। তবু তার নিহত হবার সংবাদটি স্বদেশের বাইরে শরণার্থী শিবিরে অবস্থানরত মানুষগুলাের চৈতন্যে এমন উৎসাহ ও উল্লাসের জোয়ার বইয়ে দিলাে কেন?
আসলে মুক্তিযােদ্ধাদের শক্তি যে ইতিমধ্যে তুঙ্গস্পর্শী হয়ে উঠেছে, মােনায়েম খান হত্যার সংবাদটি ছিলাে তারই সংকেতবাহী। ঢাকার একটি অভিজাত এলাকায় নিচ্ছিদ্র নিরাপত্তা ব্যবস্থার মধ্যে বসবাস করছিলেন যে মােনায়েম খান, মুক্তিযােদ্ধারা তাকেই যদি হত্যা করে নিরাপদে চলে আসতে পারে তবে তাে মুক্তিযুদ্ধের একজন দুশমনও প্রাণে বাঁচতে পারবে না। কাজেই এরপর আমাদের চূড়ান্ত বিজয়কে ঠেকিয়ে রাখবে কোন অপশক্তি? এছাড়া চৌষট্টি থেকে উনসত্তর পর্যন্ত পাকিস্তানের স্বৈরাচারী শাসক আইয়ুবের সকল অপকর্মের সহযােগী মােনায়েম খানের কথা তার মৃত্যুই মানুষকে চট করে আবার মনে করিয়ে দিয়েছিলাে। মােনায়েম খানের শাসনকাল তাে খুবই নিকট অতীতের। তাই তাকে এতাে তাড়াতাড়ি পুরােপুরি ভুলে যাওয়ারও কথা নয়। ছয়দফা থেকে এগারাে দফা পর্যন্ত এদেশের সকল গণআন্দোলন দমনে তার হিংস্রতার কথা সকলের মনের গভীরে তখনাে দুঃস্বপ্নের স্মৃতিরূপে বিদ্যমান। সেই স্মৃতিই মােনায়েম-নিধনের সংবাদকে এতাে উল্লাস মুখর করে তুলেছিলাে।
অক্টোবরের তেরাে তারিখে মােনায়েম খানের নিহত হওয়ার সংবাদটির পর মাস দেড়েক ঠিক এ রকম কোনাে খবর পাওয়া যায়নি যার মধ্যে এমন মহা উত্তেজনা ও মহা উল্লাসের উপাদান ছিলাে। সে সময়ে বরং মুক্তিযােদ্ধা শিবিরের অভ্যন্তরীণ অনৈক্য ও পাকিস্তানের সঙ্গে আপসরফার নানা গুজবই মানুষকে সংশয়ের দোলায় দোলায়িত করে তুলছিলাে। এরপর নভেম্বরের শেষ সপ্তাহ থেকেই সন্দেহ সংশয়ের কুয়াশা কেটে যেতে শুরু করলাে। ডিসেম্বরের শুরু থেকেই শুরু হলাে চরম উত্তেজনার পালা। তিন তারিখে যখন সরাসরি পাকিস্তান-ভারত যুদ্ধ বেধে গেলাে আর ছয় তারিখে ভারত স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারকে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি জানালাে, শরণার্থীরা তখন উত্তেজনায় একেবারে ফেটে পড়লাে, বাঁধন হারা উল্লাসে মাতােয়ারা হয়ে উঠলাে। ভারত ও ভুটানের স্বীকৃতির সংবাদ প্রচারিত হবার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই বাঘমারায় শরণার্থীদের এক বিরাট মিছিল পথ পরিক্রমায় বেরিয়ে পড়ে। কমরেড মহাদেব সান্যাল আর গঙ্গেশ সরকারই মিছিলটির আয়ােজন করেছিলেন। প্রচুর মহিলারও জমায়েত হয়েছিলাে। গঙ্গেশদার স্ত্রী আর আমার বােন মায়া শরণার্থী শিবিরের এই দুজন তখন রীতিমতাে মহিলা নেত্রী। তাদের দুজনের হাতে দুটো জাতীয় পতাকা—ভারত আর বাংলাদেশের। মিছিলের স্লোগান ‘জয় বাংলা’ ও ‘জয় হিন্দ’। বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দানের জন্যে ভারতের প্রতি কৃতজ্ঞতা-প্রকাশক কিছু স্লোগানও ছিলাে। কিন্তু বাঘমারার স্থানীয় প্রশাসনের কাছে আপত্তিকর
৪৪৬
ঠেকলাে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ বিরােধী স্লোগানগুলাে। এই নিয়ে কিছু বাদ বিতণ্ডা হলাে। আগেই লক্ষ করেছি যে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের পররাষ্ট্রনীতি যাই হােক, মেঘালয়ের এলিটরা ভীষণ মার্কিন ভক্ত। তাই বাংলাদেশের শরণার্থীদের মিছিলেও মার্কিন বিরােধী স্লোগানে তাদের আপত্তি। বাদ বিতণ্ডার এক পর্যায়ে হঠাৎ করে স্থানীয় একটি লােক মিছিলে মেয়েদের মধ্যে ঢুকে পড়ায় মিছিলটি বিশৃঙ্খল হয়ে গেলাে। মিছিলের ওই মেয়েদের প্রায় সবাই ছিলাে গ্রাম্য বালিকা ও গৃহবধূ। মিছিলে যাওয়ার অভিজ্ঞতা তাদের নেই। ঘটনার আকস্মিকতায় তারা আতঙ্কিত হয়ে পড়লাে, কেউ কেউ চিৎকার করে কেঁদেও উঠলাে। থানা থেকে পুলিশও বেরিয়ে এলাে। এরই ফাঁকে ধাক্কাধাক্কিতে এক সময় মায়ার হাত থেকে ভারতের জাতীয় পতাকাটি মাটিতে পড়ে যায়। মায়া সেই পতাকাটি মাটি থেকে তুলে নিয়ে তারস্বরে চিৎকার জুড়ে দেয়, তার চিৎকারে কণ্ঠ মেলান বৌদি (গাঙ্গশদার স্ত্রী)। মিছিলে অনুপ্রবেশকারী লােকটি ভারতের জাতীয় পতাকার অবমাননা করেছে—তাদের তীব্র চিৎকার এই অভিযােগটিরই অভিব্যক্তি ছিলাে। সকলকে নিয়ে থানায় গিয়ে মায়া এই অভিযােগটি লিখিতভাবেও পেশ করে। এতে থানার দারােগা পড়ে গেলেন খুবই বিব্রতকর অবস্থায়। জাতীয় পতাকার অবমাননার অভিযােগটি অত্যন্ত গুরুতর। অভিযুক্ত ব্যক্তিটিকে তিনি গ্রেফতার করলেন বটে, কিন্তু এ নিয়ে মামলা-মােকদ্দমা যে অনেক জটিলতার সৃষ্টি করবে, সে কথা ভেবেই তিনি শঙ্কিত হলেন। তাই অভিযােগটি প্রত্যাহার করে নেয়ার জন্যে ওই মহিলা নেত্রীদের তিনি রীতিমতাে তােয়াজ তােষামােদ করতে শুরু করলেন। যাই হােক, ব্যাপারটি শেষ পর্যন্ত খুব বেশিদূর গড়ায়নি। তবে ছয় তারিখ থেকে পরবর্তী দশদিন আমরা কেবলই উত্তেজনার আগুনে গা গরম করে চলেছি। আবার এরই মধ্যে অনেক হতাশা, অনিশ্চয়তা ও আশঙ্কার খবরও আমাদের শুনতে হয়েছে। শুনেছি বঙ্গোপসাগরে মার্কিন সপ্তম নৌবহরের উপস্থিতির কথা, জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে মার্কিন উদ্যোগে যুদ্ধবিরতি প্রস্তাবের কথা, এবং সে প্রস্তাবে সােভিয়েত ভেটোর কথা।
আমাদের মুক্তিযুদ্ধ অনেক দীর্ঘায়িত হবে, বিজয় অবশ্যই বিলম্বিত হবে,—বাংলাদেশের ক্যুনিস্ট পার্টি গােড়া থেকেই এরকম ধারণা নিয়ে অগ্রসর হয়েছিলাে। শরণার্থী শিবিরে যে কম্যুনিস্টরা ছিলেন তারাও এ ধারণার ভিত্তিতে দীর্ঘস্থায়ী মুক্তিযুদ্ধের জন্যে নিজেদের প্রস্তুত করার উদ্যোগ নিয়েছিলেন। তাই বাঘমারা শিবিরেও তরুণদের রাজনৈতিক প্রশিক্ষণে আমরা এ বিষয়টির ওপরই জোর দিয়েছিলাম। শরণার্থীদের বিভিন্ন গােষ্ঠীর মানুষকে দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধের জন্যে প্রস্তুত করে তােলার প্রয়ােজনীয়তার ব্যাপারে আমাদের মনে কোনাে সন্দেহ ছিলাে না। গঙ্গেশদা বললেন, এই শিবিরে মহিলা পরিষদ গড়ে তুলতে হবে। আমি বললাম, মহিলাদের মধ্যে এখানে এমন মহিলা কে আছে যাকে নিয়ে মহিলা পরিষদ গড়ে তুলবেন?’ গঙ্গেশদা হেসে বললেন, “কেন, আমি তাে আছি।’ তারপর সত্যি সত্যিই একদিন তিনি কিছু শরণার্থী মহিলাকে একত্র করে মহিলা পরিষদ গঠন করে ফেললেন। আমি আড়াল থেকে তার বক্তৃতাটা শুনেছিলাম। গঙ্গেশদা বক্তৃতা শুরু করেছিলেন এভাবে—‘আমরা যারা মহিলা আছি তাদের অনেক সমস্যা আছে, আমাদের সমস্যার সমাধান অন্য কেউ করে দিতে আসবে না, মহিলাদের সমস্যার সমাধান আমরা মহিলারাই করবাে। এই মুক্তিযুদ্ধেও মহিলাদের দায়িত্বের কথা আমরা মহিলারা ভুলে থাকবাে …’
এই বক্তৃতাটি নিয়ে তাকে ক’দিন খুব ক্ষেপালাম। গঙ্গেশদা’র বদলে তাকে ‘গঙ্গেশদি’ বলে ডাকতে শুরু করলাম। তবু যতােই হাসিঠাট্টা করি, গঙ্গেশদার গড়া মহিলা পরিষদ যে
৪৪৭
শরণার্থী মহিলাদের মধ্যে আত্মসচেতনা জাগানােতে একটুও সাহায্য করেনি—এমন কথা। বলতে পারবাে না। ওই মহিলা পরিষদের সদস্যরাই সেদিন আনন্দ মিছিল বের করে ও থানার ওসিকে পর্যন্ত বিব্রতকর অবস্থায় ফেলে দিয়ে আলােড়ন সৃষ্টি করে ফেলেছিলেন।
কম্যুনিস্টরা তাে মুক্তিযুদ্ধের দীর্ঘস্থায়িত্বের কথা ভেবেছিলােই। সাধারণ মানুষদের অনেকের মধ্যেও এ ভাবটির সঞ্চার ঘটে গিয়েছিলাে। এর ফলে বহু লােকের মধ্যে যেমন হতাশা দেখা দিয়েছিলাে, তেমনি কেউ কেউ অবস্থাটি মেনে নিয়ে তার সঙ্গে নিজেদের খাপ খাইয়ে নিতে চেষ্টা করছিলাে। ডিসেম্বরের শুরুতে তাদের কাছেও স্পষ্ট হয়ে গেলাে যে যুদ্ধ আর দীর্ঘস্থায়ী হচ্ছে না, জয় সন্নিকট, অচিরেই দেশে ফিরে যাওয়ার লগ্ন এসে যাচ্ছে ।
কিন্তু আমরা তাে আছি নিরাপদ দূরত্বে। যারা দেশের ভেতরে আছে তাদের অবস্থা কী দাঁড়িয়েছে। সেখানে যারা রয়ে গেছে এখন তাে তাদের অবস্থান একেবারে দু’পক্ষের গােলাগুলির মুখে। পাকিস্তানি মিলিটারি বা তাদের দালালদের হাতে যারা মরেনি, এখন হিন্দুস্থানের বােমাই কি তাদের শেষ করে দেবে না? কিংবা শেষ মুহূর্তে পাকিস্তানিরাই ওদের খতম করে যাবে না? প্রশ্নগুলাে আমার মা-ই আমার মনে জাগিয়ে দিলেন। মােনায়েম খানের মৃত্যুসংবাদে আমার মায়ের উল্লাস নেই, খােন্দকার মােশতাক কি সব ষড়যন্ত্র পাকাচ্ছে সে সব আমার মা জানেন না, রুশ-মার্কিন দ্বন্দ্ব আমাদের মুক্তিযুদ্ধকে কোন পরিণতিতে নিয়ে যাবে সে প্রশ্ন আমার মাকে তাড়া করে না। আমার মায়ের একমাত্র ধ্যানজ্ঞান তার সােনা ভাই অর্থাৎ তার আড়াই বছর বয়সের নাতিটি। সেই সােনা ভাইয়ের ভাবনাই তাকে দেশের ভেতরের অন্য সবার ভাবনা ভাবায়। আমিও মায়ের কথাতেই বিচলিত হয়ে পড়ি। স্ত্রী পুত্রের ভাবনার সঙ্গে সঙ্গে আমার বন্ধু বান্ধবের ভাবনা আমাকে আক্রান্ত করে। কী করছেন আমার সেই বন্ধুরা। যাদের নিয়ে বুদ্ধিজীবী সংগ্রাম শিবির গঠন করে রাস্তায় রাস্তায় বাঙালির অধিকারের কথা বলে সভা করেছিলাম, গান গেয়েছিলাম, কবিতা আবৃত্তি করেছিলাম?
সে সময়ে খুব বেশি কিছু জানতে পারিনি। ছিটে ফোটা কিছু খবর অবশ্যি পেয়েছি সেই সব মুক্তিযােদ্ধার কাছে যারা তখন ময়মনসিংহে যেতাে গােপনে হালচাল দেখে আসার জন্যে। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর তাে সব কথাই শুনেছি ও জেনেছি।
আমার সহকর্মী অধ্যাপক রিয়াজুল ইসলাম ও অধ্যাপক গােলাম সামদানী কোরায়শী আতঙ্ক ও ভীতির মুখেও আমার স্ত্রী পুত্রের খোঁজ খবর রেখেছেন, বল-ভরসা দিয়েছেন। আর মুক্তিযােদ্ধাদের মারফত আমি যে সব চিরকুট দেশের ভেতরে পাঠিয়েছিলাম সেগুলাে আমার স্ত্রীর হাতে পৌঁছে দিয়েছেন আমার শিল্পী বন্ধু শাহতাব। অনেক ঝুঁকি নিয়ে শাহতাব মুক্তিযুদ্ধে প্রচুর সহায়তা করেছেন। আমার আরেক বন্ধু ডাক্তার মনােয়ার হােসেন তাে এ কাজে যুক্ত হয়ে পাক মিলিটারির হাতে নির্মম নির্যাতন ভােগ করেছেন। মিলিটারির বন্দুকের মুখ থেকে বেঁচে এসেছেন কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক শামসুজ্জামান খান। আমার এই বন্ধুটি তার স্ত্রীকে নিয়ে কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস থেকে শহরে এসে নিয়মিত আমার স্ত্রী পুত্রের খোঁজ নিয়ে গেছেন। তাদেরই সঙ্গে থাকতেন বিশ্ববিদ্যালয়ের ডক্টর এ আর এম মাসুদ, ডক্টর মােস্তফা হামিদ হােসেন ও তার স্ত্রী (আমাদের সালেহা ভাবী)। আমার স্ত্রী পুত্র ও আমার শ্বশুরের পরিবারটিকে বাঁচাতে প্রভুত সাহায্য করেছেন অবাঙালি অধ্যাপক ও বিজ্ঞানি আশরাফুল হক। তিনিও বুদ্ধিজীবী সংগ্রাম শিবিরের সদস্য ছিলেন, এবং আমাদের মুক্তিযুদ্ধের প্রতি ছিলাে তাঁর সক্রিয় সহানুভূতি। প্রখ্যাত বিজ্ঞানী প্রফেসর করিমের স্ত্রী মিসেস সােফিয়া করিম যেন হয়ে
৪৪৮
গিয়েছিলেন আমার পরিবারেরই একজন। তিনিও একেবারে গােড়া থেকেই মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট হয়ে গিয়েছিলেন।
কিন্তু আমরা যখন ভারতের শরণার্থী শিবিরে আসন্ন জয়ের উল্লাসে মাতায়ােরা, ঠিক তখনই, ডিসেম্বরে তিন তারিখে পাকিস্তানি হানাদার লেফটেন্যান্ট কর্নেল আমির মােহাম্মদ খানের স্বাক্ষরিত একটি শাস্তি পরােয়ানা জারি হয়ে যায় ময়মনসিংহের বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে। শাস্তি পরােয়ানার নাম ছিলাে ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের দশজন অধ্যাপক, একজন কর্মচারী ও একজন ছাত্রের। অধ্যাপকরা হলেন ডক্টর মােস্তফা হামিদ হােসেন, আলি নেওয়াজ, শামসুজ্জামান খান, আবুদর রাজ্জাক, আবদুল বাকী, এআরএম মাসুদ, আবুদল হক ও আবুদল হালিম। আরাে নাম ছিলাে পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক মুহাম্মদ হােসেন ও ছাত্রনেতা শামসুল আলম তালুকদারের।
পাকহায়েনারা অবশ্যি এই শাস্তি পরােয়ানা কার্যকর করার সময় পায়নি। ডিসেম্বরের তিন তারিখে জারি করা ওই পরােয়ানা বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে পৌছেছিলাে ছয় তারিখে। আর দশ তারিখেই সব পাক সেনা ময়মনসিংহ ছেড়ে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়। মুক্তিযােদ্ধা ছাত্রনেতা শামসুল হক অবশ্যি আগেই শহীদ হয়েছিলেন।
কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে আমাদের আরেক অগ্রজপ্রতিম বন্ধু নাইব উদ্দিন আহমেদ। তিনি অধ্যাপক, নন আলােকচিত্র শিল্পী ! আলােকচিত্র শিল্পে তার খ্যাতি আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে বিস্তৃত। স্বাধীনতার পর দেশে ফিরে এসে তার মুক্তিযুদ্ধকালীন অনেক অভিজ্ঞতার কথা শুনেছিলাম। সে সময়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মচারী হিসেবে বিভিন্ন স্থানে তাকে আলােকচিত্র তুলতে যেতে হয়েছে। এই সূত্রে তাকে পাকহানাদার বাহিনীর অফিসারদের সংস্পর্শেও আসতে হয়েছে। ওদের ক্যামেরা মেরামত করে দেয়ার ছলে ওদের অপকীর্তির অনেক ছবি ওদের ক্যামেরার ভেতর থেকে বের করে নিজের কাছে রেখে দিয়েছেন। ওগুলােই পরে মুক্তিযুদ্ধের মূল্যবান দলিল হয়ে গেছে।
ক্যামেরার খুঁটিনাটি বুঝে নেয়ার জন্যেই পাঞ্জাবি মেজর কাইয়ুম আসতাে নাইবউদ্দিন সাহেবের বাসায়। নাইবউদ্দিনের ছেলে নিপুণের বয়স তখন মাত্র পাঁচ। মেজর তার পিস্তলটি টেবিলের ওপর রেখে গল্প করছিলাে। বালক নিপুণের কৌতূহল ওই পিস্তলটির প্রতি। সে সেটি নিতে চায়। মেজর নিপুণকে আদর করে কাছে টেনে নেয়। জিজ্ঞেস করে, “এই পিস্তল নিয়ে তুমি কী করবে?’ নিপুণ সঙ্গে সঙ্গে উত্তর দেয়, একটা পাঞ্জাবি মারুম।’ মেজরের মুখ অন্ধকার। আর সস্ত্রীক নাইবউদ্দিন সাহেব ভয়ে একেবারে কাঠ।
যাই হােক মেজর আর কিছুই করে না। শুধু যে কথা বলে সে চলে যায় তার নির্গলিতার্থ হলাে—“যে দেশের একটি অবুঝ বালকের পর্যন্ত পাকিস্তানি পাঞ্জাবিদের প্রতি এতাে ঘৃণা, সে দেশের মানুষকে কেউ পাকিস্তানের ঘেরাটোপে আটকে রাখতে পারবে না। তারা স্বাধীন হবেই।’
কর্তৃপক্ষের নির্দেশেই নাইবউদ্দিন সাহেবকে এর কিছুদিন পর পাকিস্তানের করাচি লাহাের পিন্ডি পেশােয়ার সফর করতে যেতে হয়েছিলাে। লাহােরে গিয়ে তিনি দেখা করেন প্রখ্যাত প্রগতিশীল উর্দু কবি ফয়েজ আহমদ ফয়েজের সঙ্গে। নাইবউদ্দিন সাহেব বুঝতে পারলেন যে ওই এলাকার সাধারণ মানুষের মতােই কবি সাহিত্যিক বুদ্ধিজীবীরাও বাংলাদেশ পাক সেনাদের বর্বরতার খবর রাখেন না। রাখলেও অতি সামান্য। নাইবউদ্দিন সাহেবের ডায়রিটা টেনে নিয়ে
৪৪৯
কবি ফয়েজ তাতেই লিখে ফেললেন একটি কবিতা। সেই কবিতাটির স্বচ্ছ বাংলা অনুবাদ দাঁড়িয়েছে এরকম—
১। তােমার স্মৃতি এই দেশ তােমার আবেগ/সুতীক্ষ্ণ কৃপাণের প্রতি অজস্র সালাম।
২। আমার দেশ যা ছিলাে তােমার আঁচল/আজ তা ছিন্নভিন্ন/তাই তােমার দেশত্যাগ।
৩। রক্তের মাঝ দিয়ে সৃষ্ট তােমার দৃঢ় প্রত্যয়দীপ্ত/ব্যক্তিত্বের প্রতি আমার অভিবাদন।
৪। তােমার এ দেশ ত্যাগের মানসিক ক্ষত/ ও যন্ত্রণা আমার সজীব অনুভূতি।

‘নতুন মানুষ, নতুন পরিচয় এবং নতুন একটি প্রভাত’
পাকিস্তানের সঙ্গে ভারতের সরাসরি যুদ্ধ চলে মাত্র তেরাে দিন। বাংলাদেশের মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে ভারতীয় মিত্র বাহিনীর সংযােগে তৈরি হয়ে যায় যৌথ বাহিনী। এই যৌথবাহিনীর হাতেই পতন ঘটে পাক হানাদার বাহিনীর। ডিসেম্বরের ষােল তারিখে পাক হানাদার বাহিনীর আত্মসমর্পণের মধ্যদিয়েই সমাপ্তি ঘটে যুদ্ধের।
তেরােটি দিন বড়াে দ্রুত চলে যেতে থাকে। রণাঙ্গন থেকে ঘণ্টায় ঘণ্টায় নতুন নতুন খবর আসে। যুদ্ধের খবরের পাশাপাশি আমাদের বিরুদ্ধে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদীদের নানা অপতৎপরতার খবর আতঙ্কিত করে তােলে আমাদের। সেই সঙ্গে আসে ক্যুনিস্ট চীনের শত্রুতার খবর । ষাটের দশকে পিকিং রিভিউয়ে সােভিয়েত সংশােধনবাদীদের বিরুদ্ধে চীনের অনেক অভিযােগের কথাই পড়তাম। শুধু সংশােধনবাদী নয়, সােভিয়েত ইউনিয়ন যে সামাজিক সাম্রাজ্যবাদী রাষ্ট্রে পরিণত হয়ে গেছে পিকিং রিভিউয়ে সে বিষয়েও অনেক লেখা পড়েছি। জেনেছি যে, স্তালিনের মৃত্যুর পর থেকেই সােভিয়েত ইউনিয়নের বিচ্যুতি শুরু হয়েছে। এবং বিচ্যুতি এমন পর্যায়ে পৌছেছে যে, সারা দুনিয়ায় আধিপত্য বিস্তারের জন্যে সােভিয়েত সামাজিক সাম্রাজ্যবাদ সহযােগিতা করে যাচ্ছে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের সঙ্গে। সমাজ বিপ্লব ও মানব প্রগতির পক্ষে সােভিয়েত এখন কোনাে ভূমিকাই রাখবে না। সােভিয়েতের শাসকরা লেনিনের আদর্শ জলাঞ্জলি দিয়েছে স্তালিনের মৃত্যুর পরই। এখন লেনিনবাদের পতাকা হাতে তুলে নিয়েছে মাও সেতুঙ-এর মহান চিন্তাধারায় সমৃদ্ধ গণচীন।
গণচীনের এ-রকম গরম বক্তব্য আমাদের অবশ্যই আলােড়িত করতাে। সে-সময়কার পূর্বপাকিস্তানের ক্যুনিস্ট পার্টিতেও এক সময় ভাঙন ধরেছিলাে চীনা ক্যুনিস্টদের গরম কথার তাপেই। সংশােধনবাদী’দের সংস্পর্শ পরিত্যাগ করে বিপ্লবীরা আন্ডার গ্রাউন্ড অবস্থাতেই নতুন পার্টি গড়লেন। সংশােধনবাদী’ আর ‘বিপ্লবীরা পরস্পরের বিরুদ্ধে এতাে বিষােদগার করলেন যে এর শতাংশের একাংশ যদি তারা ঢেলে দিতে পারতেন তাদের সাধারণ শত্রু অর্থাৎ ধনতন্ত্রী শােষক গােষ্ঠীর ওপর তা হলে সে-গােষ্ঠীর কবেই উচ্ছেদ হয়ে যেতাে।
তবে, আমাদের দেশের সংশােদনবাদী’ কমুনিস্ট পার্টিটি মস্কোর দালাল’ ছিলাে বলেই মস্কো যতদিন ক্যুনিজমের সাইনবাের্ডটি অন্তত ধরে রেখেছিলাে, ততােদিন এ পার্টিতে কোন ভাঙন দেখা দেয়নি। কিন্তু পিকিংপন্থী বলে পরিচিত বিপ্লবী কম্যুনিস্টরা এক পার্টিতে মিলিত হয়ে থাকতে পারেনি, পঁয়ষট্টি থেকে একাত্তর সালের মধ্যেই বহুধা বিভক্ত হয়ে গিয়েছিলাে। পিকিং বােধ হয় বহুধা বিভক্ত পিকিং পন্থীদের কোনাে অংশকেই নিরঙ্কুশ সমর্থন দেয়নি। ‘চীনের চেয়ারম্যান আমাদের চেয়ারম্যান বলে তারা ভর্ৎসনার পাত্র হয়েছিলাে। আমাদের
৪৫০
পিকিংপন্থীদের পিকিংপন্থা তথা মাও সেতুঙ-এর চিন্তাধারার ব্যাখ্যাতেও ছিলাে বহু বৈচিত্র্য। সে-সব বিচিত্র ব্যাখ্যার সবগুলাে কিংবা কোনাে একটাকে সঠিক বলে অনুমােদন দেয়াও সম্ভবত পিকিং-এর পক্ষে সম্ভব ছিলাে না।
মস্কোপন্থী ও পিকিংপন্থী উভয়গােষ্ঠীর মধ্যেই সুবিধাবাদী, মতলববাজ ও দুর্বলচিত্ত কিছু লােক অবশ্যই ছিলাে। সন্দেহ নেই যে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন রকমের বিভ্রান্তির শিকার হয়ে ক্যুনিস্ট ও বামপন্থীরা অনেক আত্মঘাতী ঘটনাও ঘটিয়েছে। বামপন্থী শিবিরে অবস্থান নিয়েই কিছু লােক প্রতিক্রিয়াশীল শাসক শােষকদের দালালিও করেছে। তবু কিন্তু বলতেই হবে যে, সামগ্রিকভাবে কম্যুনিস্ট ও বামপন্থীরা ছিলাে প্রকৃত অর্থেই দেশপ্রেমিক, দেশের অধিকারবঞ্চিত জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে নিবেদিত প্রাণ ও সমাজ বিপ্লবের জন্যে আত্মােৎসর্গে সদা প্রস্তুত। তাই আমরা দেখেছি একাত্তরে বামপন্থী পরিচয়দানকারী কিছু লােক যদিও বাঙালির মুক্তিযুদ্ধে পাক হানাদারদের সহযােগিতা করেছে, তাদের জন্যে মুরগি সাপ্লাইয়ের কাজও করেছে কেউ, তবু এ-ধরনের কুলাঙ্গারের সংখ্যা মুষ্টিমেয়ই ছিলাে। মস্কোপন্থী পিকিংপন্থী নির্বিশেষে বিপুল সংখ্যক নেতা কর্মী বরং যে যে অবস্থায় যেখান থেকে পেরেছেন মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন। দেশপ্রেমিক দায়িত্ব পালনে কেউই পিছিয়ে থাকেননি। এমন কি পিকিংপন্থীদের যে গােষ্ঠীটি মুক্তিযুদ্ধকে আখ্যা দিয়েছিলাে দুই কুকুরের লড়াই’ বলে, তারাও নিজেদের মতাে করে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছে, একই সঙ্গে পাক হানাদার বাহিনী ও মুক্তিবাহিনীর বিরুদ্ধে লড়ে জীবন দিয়েছে। এদের এই আচরণকে বিভ্রান্ত, উদভ্রান্ত, উন্মাদ, হঠকারী, আত্মঘাতী, বালখিল্য কিংবা বাংলা ভাষায় প্রচলিত এ-রকম হাজারাে বিশেষণ প্রয়ােগ করেও সঠিকভাবে প্রকাশ করা যাবে বলে আমার মনে হয় না। তবু একান্ত স্ববিরােধী হবে জেনেও—এই বিপথগামী তরুণদের আমি আন্তরিক শ্রদ্ধা করি, এদের বিভ্রান্তিমূলক করুণ। পরিণতিতে আমি গভীর বেদনাহত হই। এরা বিপজ্জনক বিপথে পা দিয়ে নিজেদেরই সর্বনাশ করেছে বটে, কিন্তু এদের লক্ষ্যের মহত্ত্ব সম্পর্কে আমি একটুও সন্দেহ পােষণ করি না।
এদের এই সর্বনাশা বিপথগামিতার জন্যে বরং ধিক্কার জানাতে হয় এদের আন্তর্জাতিক মুরুব্বি গণচীনের ভ্রান্তিবিলাসমত্ত নেতাদের। আন্তর্জাতিক ক্যুনিস্ট আন্দোলনে ও মার্কসবাদের বিকাশ সাধনে মাও সেতুঙের অবদানকে যারা পুরােপুরি অস্বীকার করেন কিংবা একান্তই খাটো করে দেখেন, আমি তাদের দলে নই। নব্বইয়ের দশকে, সমাজতন্ত্রের এই একান্ত দুঃসময়েও, মাও সেতুঙের রচনাবলি পাঠ করে আমি গভীর আশাবাদে উদ্দীপ্ত হই। কিন্তু সেই মাও সেতুঙনেতৃত্বাধীন গণচীনই যখন বাঙালির মুক্তিযুদ্ধের সক্রিয় বিরােধিতা করে নিতান্ত সংকীর্ণ জাতিগত স্বার্থের দৃষ্টিকোণ থেকে, ‘বিশ্বে আধিপত্য বিস্তারের জন্যে সােভিয়েত-মার্কিন সহযােগিতার অভিযােগ উত্থাপনকারী চৈনিক নেতৃত্বই যখন বাঙালির মুক্তিসংগ্রামকে চূর্ণ বিচূর্ণ করে দেয়ার জন্যে আমেরিকার সঙ্গে মিলে পাকিস্তানকে মদদ দেয়, তখন ক্ষুব্ধ না হয়ে পারি । শুভবুদ্ধিসম্পন্ন কোন মানুষই বা তা পারে?
আমাদের সৌভাগ্য যে, সে সময়ে মুক্ত বিশ্বের নেতা’ ‘গণতন্ত্রী আমেরিকা ও বিপ্লবী গণচীনের বিপরীতে ‘সংশােধনবাদী’ ও ‘সামাজিক সাম্রাজ্যবাদী’ সােভিয়েত ইউনিয়ন, সােভিয়েত ব্লকের অন্যান্য দেশ ও সারা দুনিয়ার মস্কোপন্থী’ ক্যুনিস্ট পার্টিগুলাে একান্ত দৃঢ়ভাবে আমাদের পাশে এসে দাঁড়িয়েছিলাে, মুক্তিযুদ্ধে আমাদের বিজয় লাভে সহায়তা করেছিলাে।
৪৫১
ভারতের মস্কোপন্থী’ পার্টিটি আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ব্যাপারে বুর্জোয়া কংগ্রেসী সরকারের কার্যক্রম সমর্থন করলেও বুর্জোয়াদের শয়তানি সম্পর্কে সচেতনতা পরিত্যাগ করেনি। প্রতিক্রিয়াশীল বুর্জোয়াদের বাংলাদেশ-প্রেম যে কামগন্ধহীন নিকষিত হেম’ ছিলাে না, কম্যুনিস্টরা তা বুঝতাে। তাই ৩ ডিসেম্বর থেকে ভারত-বাংলাদেশ যৌথ বাহিনীর অগ্রাভিযানের খবর দিতে গিয়ে ভারতের একচেটিয়া পুঁজিপতিদের একটি পত্রিকা যখন যশাের আমাদের দখলে’, ‘হিলি আমাদের দখলে’ এরকম শিরােনাম জুড়ে দিচ্ছিলাে, তখন ভারতের কম্যুনিস্ট পার্টির বাংলা মুখপত্র কালান্তর তার তীব্র প্রতিবাদ জানায়। ভারতীয় সেনাবাহিনীর বাংলাদেশের অভ্যন্তরে প্রবেশের ব্যাপারটির প্রতিই ভারতের অনেক কম্যুনিস্ট নেতা অন্তর থেকে সায় দিতে পারেননি। বাংলাদেশের মুক্তিসেনারাই তাদের মাতৃভূমিকে শত্রুমুক্ত করবে, ভারত তাদের সহায়তা করবে মাত্র প্রগতিশীল মানুষদের এরকমই প্রত্যাশা ছিলাে। তবু ঘটনা-পরম্পরা যখন শেষে পাক-ভারত যুদ্ধ পর্যন্তই গড়ালাে এবং তৈরি হলাে যৌথ বাহিনী, তখন ভারতীয় সেনাদের সকর্মক ভূমিকাকে মেনে নিতেই হলাে। তবে ভারতীয় বাহিনীর ভেতর যাতে দখলদার বাহিনীর মনােবৃত্তি দেখা না দেয়, ভারতীয় বুর্জোয়াদের বৃহৎ শক্তির দম্ভ প্রকাশিত হতে না পারে, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযােদ্ধাদের প্রতি থাকে শ্রদ্ধাবােধ ভারতের প্রগতিশীল শক্তিসমূহের এমনটিই কাম্য ছিলাে। বামপন্থীরা এ ব্যাপারেও যথাযথ ভূমিকা রেখেছিলাে!
সন্দেহ নেই যে বাংলাদেশের জাতীয়তাবাদীরাই মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব দিয়েছিলাে, তাদেরই ছিলাে মূল ভূমিকা। এ যুদ্ধে ভারতেরও মূল ও সক্রিয় সহায়তাটি এসেছিলাে একটি বুর্জোয়া জাতীয়তাবাদী সরকারের তরফ থেকেই। তবু মুক্তিযুদ্ধের আনুপূর্বিক ঘটনাধারার পর্যালােচনায় দেখা যায় যে জাতীয়তাবাদীদের সঙ্গে সাম্যবাদী বামপন্থীদের সক্রিয় সংযােগের মধ্যদিয়েই এ যুদ্ধ সফল পরিণতিতে পৌছেছিলাে, ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইল এলাকার একটি ভূখণ্ডে পাকিস্তান নামক একটি কৃত্রিম রাষ্ট্রের মৃত্যু ঘটিয়ে বাংলাদেশ নামক একটি যৌক্তিক রাষ্ট্রের জন্ম দিয়েছিলাে।
পাকিস্তানের মৃত্যু ও বাংলাদেশের জন্ম ঘটানােতে জাতীয়তাবাদের সঙ্গে কম্যুনিস্টদের সংযােগের গুরুত্ব ও তাৎপর্যটি অনেকেই ধরতে পারেননি। অনেক বাঘা বাঘা রাজনৈতিক ভাষ্যকারেরও বােধ এ ব্যাপারে একান্ত ভোঁতা। অথচ একজন বাঙালি কথাশিল্পীর ভেতর এ বােধের জাগরণ ঘটেছিলাে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের প্রায় শুরুতেই। এই কথাশিল্পীর নাম আনােয়ার পাশা। ইনি ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের একজন অধ্যাপক। অবরুদ্ধ ঢাকা নগরীতে বসেই ইনি একাত্তরের এপ্রিল থেকে জুন মাসের মধ্যে রচনা করে ফেলেছিলেন একটি উপন্যাস—রাইফেল রােটি আওরাত। সশস্ত্র মুক্তিসংগ্রাম তখনাে মােটেই সংহত হয়ে ওঠেনি। তখনকার বর্তমান ছিলাে একান্তই সংকটময় ও ভবিষ্যত নিতান্তই অনিশ্চিত। তবু সেই সংকট ও অনিশ্চিতির ভেতরই কথাশিল্পী আনােয়ার পাশা ভবিষ্যত দ্রষ্টার দৃষ্টি দিয়ে দেখে নিলেন যে, বাঙালির মুক্তিযুদ্ধ সফল হবেই। তিনি উপন্যাসের যে নায়ক চরিত্রটি সৃষ্টি করেছিলেন তার নাম সুদীপ্ত। সেই সুদীপ্ত আসলে আনােয়ার পাশারই প্রতিরূপ। সুদীপ্তও তার স্রষ্টা আনােয়ার পাশার মতােই জীবন বাঁচানাের তাগিদে হানাদার কবলিত ঢাকার এক এলাকা থেকে আরেক এলাকায় পালিয়ে বেড়াচ্ছে। উপন্যাসটিতে সুদীপ্ত তথা কথাশিল্পীর নিজের দৃষ্টিকোণ থেকে সেকালের পূর্বপাকিস্তানের নাগরিক মধ্যবিত্তের চরিত্রের নানা অসঙ্গতির
৪৫২
দিকগুলাে উদ্ঘাটিত হয়েছে। পাকিস্তানের বিরুদ্ধে সুদীপ্তর অন্তরে ক্ষোভের অন্ত নেই। বাংলাদেশের জন্ম হােক এমনটিই তার উদগ্র আকাঙ্ক্ষা। অথচ সেই আকাক্ষার পরিপূর্তি ঘটার মতাে অনুকূল অবস্থাও সে তার চারপাশে দেখতে পায় না। কিন্তু উপন্যাসের শেষ পরিচ্ছেদে এসে দেখি, সুদীপ্ত পরিচিত হয়েছে জাতীয়তাবাদী জামাল আহমদ ও কম্যুনিস্ট নেত্রী বুলার সঙ্গে। সুদীপ্ত দেখলাে, এই দুজনের কর্মপ্রয়াস বাংলাদেশের স্বাধীনতার লক্ষ্যে একত্র সংযুক্ত হয়েছে। আর তখনই সুদীপ্ত তথা তার স্রষ্টা আনােয়ার পাশার চকিত উপলব্ধি
পুরনাে জীবনটা সেই পঁচিশের রাতেই লয় পেয়েছে। আহা, তাই সত্য হােক। নতুন মানুষ, নতুন পরিচয় এবং নতুন একটি প্রভাত । সেই আর কতাে দূরে? বেশি দূর হতে পারে । মাত্র এই রাতটুকু তাে! মা ভৈঃ। কেটে যাবে।
আনােয়ার পাশা তার উপন্যাস রাইফেল রােটি আওরাত-এর এই শেষ কথাগুলাে লিখেছিলেন একাত্তরের জুন মাসের তৃতীয় সপ্তাহে। তখনই রাত কেটে যাবে বলে তার মনে দৃঢ় প্রত্যয় জেগেছিলাে। এরপর ছয় মাসের মাথাতেই রাত কেটে গিয়েছিলাে বটে, কিন্তু আনােয়ার পাশা দেখে যেতে পারেননি। শুধু আনােয়ার পাশা নয়। তার মতাে বােধির অনুশীলনে যারা রত ছিলেন, পাকিস্তানের নিচ্ছিদ্র তমসার ভেতরে বসেই আপন আপন প্রাণের প্রদীপ জ্বালিয়ে যারা নতুন একটি প্রভাতের আগমনী রচনা করে চলেছিলেন, বিপ্লব স্পন্দিত বুকে যারা পাকিস্তানের মৃত্যু ও বাংলাদেশের জন্মের মুহূর্তটির জন্যে প্রতীক্ষা করছিলেন, তাদের অনেকেরই সৌভাগ্য হলাে না সেই একান্ত কাক্ষিত মাহেন্দ্রক্ষণটি প্রত্যক্ষ করার। তার আগেই কতকগুলাে অন্ধকারের জীব ওই আলােক-তাপসদের জীবন প্রদীপ নিভিয়ে দিলাে।
ডিসেম্বরের ১০ তারিখেই যে ময়মনসিংহ শহর মুক্ত হয়ে গেছে, সে খবর প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই পেয়ে গিয়েছিলাম। ১৬ ডিসেম্বরে পাকবাহিনীর চূড়ান্ত আত্মসমর্পণের পর আর ভিনদেশে শরণার্থী শিবিরে বসে থাকতে পারছিলাম না। অস্থির হয়ে পড়েছিলাম মুক্ত স্বদেশের মাটি স্পর্শ করার জন্যে। ১৮ কি ১৯ তারিখেই মহাদেব বাবুকে সঙ্গে নিয়ে সীমান্ত পার হয়ে স্বাধীন বাংলাদেশের মাটিতে পা রাখলাম। অনুভব করলাম : মানুষের অন্তরে অন্তরে বয়ে যাচ্ছে আনন্দের এক ঝর্ণাধারা। পরিচিত যার সঙ্গে দেখা হয় সেই বুকে জড়িয়ে ধরে। কেমন আছেন? এ প্রশ্ন কেউ জিজ্ঞেস করে না। চোখ বড়াে বড়াে করে শুধু বলে, ‘বেঁচে আছেন? পাকিস্তানি বর্বরদের সেই মারণযজ্ঞের ভেতরেও যার জানটা কেবল বেঁচে রয়েছে, সেই তাে মহা ভাগ্যবান। সে কেমন আছে—সে প্রশ্ন তখন একান্তই অবান্তর। কতাে প্রিয়জনের মৃত্যুর খবর শুনতে শুনতেই না হালুয়াঘাট থেকে ময়মনসিংহ শহর পর্যন্ত পথটুকু পাড়ি দিলাম।
রাস্তার সব সেতু ও কালভার্ট ভাঙা। যুদ্ধ চলার সময় এর কতকগুলাে ভেঙেছিলাে মুক্তিবাহিনীর গেরিলারা। অবশিষ্ট ছিলাে যেগুলাে, পাকসেনারা পলায়নের সময় সেগুলােকে ভেঙে গুঁড়িয়ে দিয়ে গেছে। কাজেই রাস্তায় কোনাে মােটরযানের চলাচল নেই। পায়ে হেঁটেই পাড়ি দিচ্ছিলাম দীর্ঘ পথ। সারাদিন পথ চলার পর সন্ধ্যা নামলাে সরচাপুর নামক একটি গ্রামের ধারে এসে। সে গ্রামেই মহাদেব বাবুর পরিচিত এক ভদ্রলােকের বাড়িতে রাত কাটালাম। শুয়ে শুয়ে রেডিওতে খবর শুনছিলাম। হঠাৎ কানে এলাে এক মর্মান্তিক সংবাদ। পাক সেনাদের আত্মসমর্পণের মাত্র দু’দিন আগে ১৪ ডিসেম্বর ওদের এদেশীয় দালালরা বেশ কয়েকজন বুদ্ধিজীবীকে তাদের বাড়ি থেকে ধরে নিয়ে গিয়ে হত্যা করেছে। এই বুদ্ধিজীবীদের বিকৃত মরদেহ পাওয়া গেছে ঢাকার রায়ের বাজারের বধ্যভূমিতে। সে রাতে আকাশবাণীর
৪৫৩
খবরে সম্ভবত মুনীর চৌধুরী, মােফাজ্জল হায়দার চৌধুরী, গিয়াসুদ্দিন আহমদ, সন্তোষ ভট্টাচার্য, শহীদুল্লা কায়সার, ডাক্তার আলিম চৌধুরী, ডাক্তার ফজলে রাব্বি, ডাক্তার মাের্তজা—এই ক’জন বুদ্ধিজীবীর শহীদ হওয়ার কথা শুনি। এরপর আরাে কয়েকজনের নাম জানতে পারি। শুনি আনােয়ার পাশার নামটিও। আনােয়ার পাশার লেখার সঙ্গে আগেই পরিচয় ছিলাে, তেমন কোনাে অসাধারণ বৈশিষ্ট্য তাতে খুঁজে পাইনি। কিন্তু স্বাধীন বাংলাদেশের জন্মের অল্পদিন পরেই যখন সেই আনােয়ার পাশার উপন্যাস রাইফেল রােটি আওরাত প্রকাশিত হলাে, তখন সেটি পড়ে যেন একজন দিব্যদৃষ্টিসম্পন্ন শিল্পীর সাক্ষাত পেলাম। দিব্যদৃষ্টিতে যিনি বাংলাদেশের জন্ম প্রত্যক্ষ করেছিলেন চর্মচক্ষে সেই দেশটিকে প্রাণভরে দেখার সৌভাগ্য থেকে তাঁকে বঞ্চিত করলাে এদেশেরই কতকগুলাে মনুষ্যরূপী সারমেয় ।
সম্ভবত ডিসেম্বরের ২০ তারিখে ময়মনসিংহ শহরে এলাম। স্ত্রী পুত্রসহ আত্মীয়দের সঙ্গে মিলিত হলাম দীর্ঘ নয় মাস পরে।
একাত্তরে আমার বয়স পঁয়ত্রিশ। এই বয়সেই ত্রিকালদর্শী দার্শনিক হয়ে গেলাম। ব্রিটিশ শাসনের অবসান আর পাকিস্তানের জন্ম দর্শন করলাম। আবার দর্শন করলাম পাকিস্তানের মৃত্যু আর বাংলাদেশের জন্মও। বাংলাদেশের জন্মের ক্ষণটিতে কিন্তু মােটেই ভাবতে পারিনি যে অল্প দিনের মধ্যেই বাংলাদেশেই আমাকে পাকিস্তানের ভূত দেখতে হবে।
৫৫৪