You dont have javascript enabled! Please enable it! 1974.07.15 | বাংলার বাণী সম্পাদকীয় | নয়া চা-নীতি বাস্তবায়িত হোক | সেই পুরনো কৌশল | শেখ মণি - সংগ্রামের নোটবুক

বাংলা বাণী
ঢাকাঃ ১৫ই জুলাই, সোমবার, ৩০শে আষাঢ়, ১৩৮১

নয়া চা-নীতি বাস্তবায়িত হোক

বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান অর্থকরী সম্পদ চা-শিল্পের পুনর্গঠন ও পুনর্বাসন প্রয়োজনীয়তার প্রতি লক্ষ্য রেখে সরকার ১৯৭৪-৭৫ সালের জন্য চা-নীতি অনুমোদন করেছেন। এ নীতি প্রণয়নে চায়ের রপ্তানিযোগ্য উদ্বৃত্ত উৎপাদন ব্যয়ের প্রত্যাশিত রপ্তানি মূল্য প্রতিও লক্ষ্য রাখা হয়েছে। এবং চা উৎপাদন ও বাজারজাতকরণ সংক্রান্ত যেসব সুযোগ-সুবিধা চা শিল্প বর্তমানে ভোগ করছে তা পর্যালোচনা করে চা শিল্পের উন্নয়নের জন্য প্রয়োজনীয় সুযোগ সুবিধাগুলো ১৯৭৪-৭৫ সালের জন্য অব্যাহত রাখার কথাও এতে বলা হয়।
এই নয়া চা নীতিতে সরাসরি চা-বিক্রির সুবিধা প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। সরকার চট্টগ্রামে আভ্যন্তরীণ বিক্রি এবং বিদেশে রপ্তানির ব্যাপারে চা এর যৌথ নিলাম ১৯৭৪-৭৫ সনের জন্য অব্যাহত রাখার সিদ্ধান্ত নেন। কারণ চট্টগ্রাম নিলাম এখন নিজেকে একটি সংগঠিত ও সুপরিচিত চা বিক্রি কেন্দ্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে। এরই প্রেক্ষিতে এখন থেকে নিম্নোক্তভাবে চা বিলি করা হবে। যথা (ক) চট্টগ্রামের নিলাম বিক্রয়, (খ) চা বোর্ডের অনুমতিক্রমে লন্ডনে নিলাম প্রেরণ, (গ) সর্বশ্রেণীর চা- বাগানের জন্য সর্বাধিক ২০ হাজার এর ক্ষেত্রে আবগারি শুল্ক লাগবেনা। অন্যান্য প্রধান শস্যের ক্ষেত্রে যে হারে সার সরবরাহ করা হয়, সেই একই মূল্যে চা এর জন্য সার সরবরাহ করা হবে। ঋণের সুযোগ-সুবিধা প্রদান অব্যাহত থাকবে। প্যাকিং সামগ্রী জন্য জাহাজ ভাড়া সহ চায়ের মূল্যের উপর শতকরা ৩০ টাকা ভর্তুকি সিদ্ধান্ত ও এই নীতিতে নেয়া হয়েছে।
চা-শিল্পের পুনর্বাসন ও পুনর্গঠনের ব্যাপারে কমনওয়েলথ উন্নয়ন কর্পোরেশনের উদ্যোগে ব্রিটিশ চা-উপদেষ্টা মিশন এবং মরহুম এ, রবের দেয়া প্রতিবেদন দুটি সরকারি বিবেচনাধীন রয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়। ব্যাপক চাষের মাধ্যমে উৎপাদন বৃদ্ধি এবং চা শিল্পের সাথে সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর দক্ষতা বাড়ানো সম্পর্কিত যেসব সুপারিশ প্রতিবেদনটিতে করা হয়েছে–সরকার তা নীতিগতভাবে অনুমোদন করেছেন। এছাড়া ব্যাপক চাষ পুরনো বাগানে নতুন চাষের চারা লাগানো, চা কারখানার সামঞ্জস্য বিধান ও আধুনিকরণের উদ্দেশ্যে সরকার উন্নয়ন কর্মসূচির নেয়ারও সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।
উল্লেখিত সিদ্ধান্তগুলি সবই চা শিল্প উন্নয়নের সহায়ক বলে আমরাও মনে করি। কারণ চা শিল্প থেকেও বাংলাদেশ বেশকিছু বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করে। সেক্ষেত্রে চা উৎপাদন বৃদ্ধি করে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের সম্ভাবনা বাড়াতে পারলে দেশের জন্য মঙ্গল বৈকি! এক্ষেত্রে দাবি শুধু একটি -এগুলোর বাস্তবায়ন যেন হয়। কারণ পরিকল্পনা ও তা বাস্তবায়নের ফাঁকটুকু মারাত্মক আমরা আর তা দেখতে চাই না। প্রসঙ্গক্রমেই বলা যায়, চা শিল্প সঙ্কটের মুখে এই নয়া চা নীতি আমাদেরকে আশান্বিত করেছে। কিছুদিন ধরেই পত্রিকান্তরে প্রতিবেদনগুলোতে চা শিল্প সংকট সংক্রান্ত নানা ক্ষয়ক্ষতি, অব্যবস্থা, প্যাকিং বাক্সের অভাব ইত্যাদি খবর পরিবেশিত হচ্ছিল। কোটি কোটি টাকার উৎপাদিত চা নষ্ট হয়ে যাবার খবর একাধিকবার সংবাদপত্রের মাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। নয়া চা নীতি বাস্তবায়নের পদক্ষেপ গ্রহণের মধ্য দিয়ে ওই বেদনাদায়ক ঘটনাগুলির অবসান হোক আমরা তাই চাই। চা শিল্প একটা লাভজনক বিনিয়োগের মাধ্যমে হোক সেই হবে আমাদের সুখের ও অগ্রগতির আশ্বাস। এবং নাচানীর ঈদে উৎপাদনের দিকে লক্ষ্য দিলে যে তা সর্বাধিক উৎপাদনকেও (১৯৭০-৭১ সালে ৭ কোটি পাউন্ড) ছাড়িয়ে যাবে এ ভরসা আমরা করছি। কারণ চা শিল্পের জন্য বাংলাদেশের পাহাড়ি অঞ্চল উৎকৃষ্ট স্থান। এক রকম বিনা বৈজ্ঞানিক প্রক্রিয়া লালনেই আমরা এই পরিমাণ চা উৎপাদন করি। সেখানে সার, যত্ন, নতুন চারা রোপণের ফলপ্রসূ উদ্যোগ কখনোই বিফলে যাবেনা। তাই আবার বলতে হচ্ছে পরিকল্পনার ছক এঁকে আর যেন কাজে গাফিলতি না করা হয়। এ দেশের অর্থনীতিকে চাঙ্গা করার সময় এখনও শেষ হয়ে যায়নি সে কথা মনে প্রাণে বিশ্বাস করেই কাজে নামতে হবে। হতাশাকে প্রশ্রয় দেওয়া আজ আমাদের জন্য পাপ।

সেই পুরনো কৌশল

পাকিস্তানের সেই পুরনো অভিযোগ আবার তারা তুলেছে। আফগান সীমান্তে নাকি কাবুল কর্তৃপক্ষ তাদের সেনাবাহিনীকে সতর্ক করে দিয়েছে। পাকিস্তানের সীমান্ত এলাকায় খনন করা হচ্ছে নতুন ট্রেঞ্চ, মেরামত করা হচ্ছে পুরনোগুলো। কান্দাহার বিমান বন্দর এখন বিমান বাহিনীর নিয়ন্ত্রণে, সেখানে রিজার্ভ বাহিনী তলব করা হয়েছে।
এসব পাকিস্তানের পররাষ্ট্র দপ্তরের অভিযোগ। পাশাপাশি ভারতের বিরুদ্ধে এ একই অভিযোগ তোলা হয়েছে। পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী জুলফিকার আলী ভুট্টো আফগানিস্তান-পাকিস্তান আক্রমণের বিরুদ্ধে সতর্ক করে দিয়ে অভিযোগ তুলেছেন ভারত এবং আফগানিস্তান দুটো দেশই পাকিস্তান সীমান্তে অস্বাভাবিক ভাবে সৈন্য চলাচল বাড়িয়ে দিয়েছে। উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ এবং বেলুচিস্তানে তার সাম্প্রতিক সফরের সময় এই ‘আক্রান্ত হবার সম্ভাবনা’ তিনি আবিষ্কার করেছেন। এর সঙ্গে রয়েছে আগভাগে সোভিয়েত ইউনিয়নকে একটু জড়িয়ে রাখার প্রচেষ্টা। বার্তা সংস্থা রয়টার্স পররাষ্ট্র দপ্তরের উদ্ধৃতি দিয়ে খবর দিয়েছে আফগান বাহিনীতে এক হাজার পাঁচশত রুশ উপদেষ্টা রয়েছে। পাক পররাষ্ট্র দপ্তর এর তাৎপর্য উপলব্ধি করতে ভুল করে না বলে দাবি করেছে।
পাক-আফগান অথবা পাক-ভারত সীমান্তে বাস্তব অবস্থা সম্বন্ধে কোন নিরপেক্ষ খবর পাওয়া যায়নি। যতটুকু খবর বেরিয়েছে তা হয় পাকিস্তান পররাষ্ট্র দপ্তরের অভিযোগ অথবা সেখানকার নাটুকে প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণা। পাকিস্তানের এই অভিযোগ এবং সেখানকার নেতৃবৃন্দের হঠাৎ করে যুদ্ধাতঙ্ক ছড়িয়ে দেয়ার অন্তর্নিহিত তাৎপর্য সম্বন্ধে অতীত অভিজ্ঞতা আমাদের রয়েছে। বারবার এমনি করে ভয় পাইয়ে দেবার একটা কৌশল পাকিস্তানি নেতৃবৃন্দ রপ্ত করেছিলেন সেই ভারত বিভাগের অব্যবহিত পর থেকেই। যখনই দেশে কোন কোন আন্দোলন দানা বেঁধে উঠত অথবা দেশ বড় রকমের কোন সমস্যার সম্মুখীন হতে তখনই জনসাধারণের দৃষ্টিকে অন্যত্র সরিয়ে দেবার জন্য অবিলম্বিত এমনই নানা কৌশল। হয় ‘কাশ্মীর হাতছাড়া হয়ে গেল’ জিগির তুলে অথবা ‘ভারত বা আফগানিস্তান পাকিস্তানের আক্রমণের পাঁয়তারা করছে’ এমনি ধুয়া তুলে জনমনে আতঙ্ক সৃষ্টির প্রচেষ্টা চালিয়েছে সেখানকার শাসকশ্রেণী।
’৭৩ -এ গোটা বছর পাকিস্তানের দুটো প্রদেশের চলেছে রাজনৈতিক অস্থিরতা। একাত্তুরের অর্থনৈতিক এবং সামাজিক বিপর্যয়ের ধকল সামলে উঠবার আগেই এই দেশের রাজনৈতিক অস্থিরতা সেখানকার শাসকশ্রেণীকে রীতিমতো বিব্রত করে তুলেছিল। তারা এর মোকাবিলায় কোনো সুষ্ঠু গণতান্ত্রিক পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারেনি কারণ মূলতঃ সেই সমস্যাটা ছিল তারা নিজেরাই। ফলে নিতে হয়েছে সামরিক ব্যবস্থা।
গণতন্ত্র এবং স্বাধিকারকামী বেলুচ এবং পাঠানরা পাকিস্তানি শাসকচক্রের সামরিক অভিযানের মোকাবিলায় নিজেরাও প্রস্তুতি গ্রহণ করে। বেলুচদের মুক্তিসংগ্রামের তীব্রতা কিছুদিনের জন্য যতটুকু হ্রাস পেয়েছিল বলে মনে করা হয়েছিল তা কেন্দ্রীয় সরকারের অগণতান্ত্রিক এবং সামরিক ব্যবস্থা গ্রহণের ফলে তুঙ্গে উঠে। বহু বেলুচ পাঠানকে প্রাণ হারাতে হয় আর নির্যাতনের স্টিমরোলার চালিয়ে আপাত কালের জন্য স্তব্ধ করা হয় বেলুচ পাঠানদের গণসংগ্রাম। তখনো অভিযোগ তোলা হয়েছিল সেই আন্দোলনের সঙ্গে আফগানদের সম্পৃক্ততা নিয়ে।
এরপরে সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষ। আল্লাহ এবং ইসলামের নামে সেখানে পুড়িয়ে দেওয়া হল মসজিদ, কোরআন, পবিত্র স্থান। এক গোত্র আর এক গোত্রকে অমুসলিম সংখ্যালঘিষ্ঠ সম্প্রদায় ঘোষণার দাবি জানান। সে বিবাদ এখনো চলছে। পাশাপাশি ভুট্টোর নিজের দল পিপলস পার্টিতে তীব্র হয়ে উঠেছে উপদলীয় কোন্দল। বেশি দিনের কথা না জনাব ভুট্টো তার দলের এককালীন সাধারণ সম্পাদক এবং মন্ত্রিপরিষদের সদস্য জনাব জে, এ, রহিমকে বহিষ্কার করেন। খোদ সিন্ধু এবং পাঞ্জাবেই তার দলের উপদলীয় কোন্দল বিস্ফোরন্মুখ । এমতাবস্থায় যদি পুরনো কায়দায় তিনি জনগণের দৃষ্টিকে সবকিছু থেকে অন্যত্র সরিয়ে নেবার জন্য যুদ্ধের জিগির তোলেন তবে আর যাই হোক আমরা আশ্চর্যান্বিত হবে না। এটা পাকিস্তানিদের পুরনো খেল। অর্থনৈতিক সংকটে নিদারুণভাবে নিমজ্জিত সেখানকার সাধারণ মানুষক কি নতুন করে নেয়া ভুট্টোর পুরনো কৌশলের ফাঁদে পা দেবে?

কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক

পত্রিকার মূল কপি পড়তে এখানে ক্লিক করুন