You dont have javascript enabled! Please enable it!

বাংলার বাণী
ঢাকাঃ ৭ই জুলাই, রোববার, ২২ শেষ আষাঢ়, ১৩৮১

জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের জাতিসংঘের সাহায্য

বিশ্বজনবর্ষ সফল করার উদ্যোগে ব্যাপকভিত্তিক কর্মসূচি গ্রহণের জন্য জাতিসংঘ বাংলাদেশকে জাতিসংঘের জনসংখ্যা কার্যক্রম তহবিল থেকে সাহায্য হিসেবে এক কোটি ডলার সাহায্য করবে। এ ব্যাপারে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের সচিব এবং জাতিসংঘের আন্ডার সেক্রেটারি জেনারেল এবং জনসংখ্যা কার্যক্রম তহবিলের নির্বাহী পরিচালক মিঃ রাফেল এম সালাসের মধ্যে একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে। এতে উল্লেখ আছে যে, সাহায্যের পরিমাণের মধ্যে ৫২ লাখ ডলার জনসংখ্যা পরিকল্পনা সংক্রান্ত ৮টি প্রকল্পে ব্যয় করা হবে বলে ইতিমধ্যেই স্থির করা হয়েছে। বাকি অর্থের ব্যাপারে দু’পক্ষের মধ্যে সম্প্রতি আলাপ-আলোচনা চলছে।
প্রসঙ্গতঃ উল্লেখ্য যে, এ কর্মসূচি বাস্তবায়নের জন্য সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়গুলো বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা, জাতিসংঘের শিশু তহবিল, আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা, জাতিসংঘের কারিগরি সহযোগিতা দপ্তর ও জাতিসংঘের উন্নয়ন কর্মসূচির সাথে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করবে। এই চুক্তির কার্যকাল তিন বছর অর্থাৎ ১৯৭৪ সালের জানুয়ারি থেকে ১৯৭৬ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত স্থায়ী হবে।
আমাদের মনে রাখতে হবে যে, এদেশের প্রতি বর্গমাইলে ১৪ শত লোক বাস করে। প্রতিদিন এদেশে ১০ হাজার শিশু জন্মগ্রহণ করে। দেশের শতকরা ৯৯ ভাগ দম্পতি আজও সন্তানের জন্মের ব্যাপারে সৃষ্টিকর্তার উপর নির্ভর করে। শতকরা ৯০ ভাগ মেয়ের বিয়ে হয় অপরিণত বয়সে। এগুলো আমাদের দেশের বাস্তব অবস্থা।
আমরা এও জানি, চলতি বছরকে জাতিসংঘ থেকে বিশ্বজন বর্ষ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। বিশ্বব্যাপী জনসংখ্যা বৃদ্ধির আশঙ্কা জনক আনুপাতিক হারকে প্রতিরোধ করার জন্যই এত গুরুত্ব নিয়ে ১৯৭৪ সালকে জনবর্ষ হিসেবে সার্থক করে তোলার ব্যাপক আয়োজন চলছে। বাংলাদেশও সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়গুলোর কিছু তৎপরতার নিদর্শন রাখেছে। সেমিনার, বক্তৃতা, প্রদর্শনী, নানাপ্রকার পুস্তিকা বিতরণ, জন্মনিরোধক ব্যবস্থাপত্রাদি সম্পর্কিত প্রচারণা চলছে। বিশ্বজনবর্ষ সংস্থা, বাংলাদেশ থেকে ১৯৭৪ এর জানুয়ারি- এপ্রিল মাসে কি কি কাজ করা হয়েছে–তথ্যমূলক বিবর্তনের মাধ্যমে তার তালিকা ছাপা হয়েছে। হাজার হাজার কর্মীকে বিশেষ প্রশিক্ষণে শিক্ষিত করা হচ্ছে। গ্রাম বাংলার প্রত্যন্ত অঞ্চলগুলোতে পরিবার পরিকল্পনা কেন্দ্র খোলা হচ্ছে এবং এমনি সব। কিন্তু তবুও মনে হয় কোথায় যেন ফাঁক থেকে যাচ্ছে। কারণ, জনসংখ্যা নিরোধ এককভাবে কোনো মন্ত্রণালয় বা কোনো একক প্রতিষ্ঠানের বিচ্ছিন্ন কর্ম নয়। দেশের পারিপাশ্বিক অর্থনৈতিক, সামাজিক এবং শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক মূল্যবোধ ও নিয়ন্ত্রণের সঙ্গে পরিবার পরিকল্পনা তথা জনসংখ্যা প্রতিরোধের উদ্যোগের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে। সংশ্লিষ্ট সকল দপ্তরের পারিপার্শ্বিক সহযোগিতা ছাড়া আতঙ্কিত জনসংখ্যা বৃদ্ধির প্রবাহকে রুদ্ধ করা যেতে পারে না।
এ প্রসঙ্গে ফরাসি অধ্যাপক রেনে ডুমেণ্ট এর কথা বলা যায়। সমাজকল্যাণ ও বহু অভিজ্ঞতায় সমৃদ্ধ এই প্রাজ্ঞ অধ্যাপক বলেছেন যে, নারী শিক্ষা ও নারী মুক্তি আন্দোলনের যথার্থ বাস্তবায়নের দ্বরাই মাত্র ১২ বছরে বাংলাদেশের জনসংখ্যার রাশ টেনে ধরা যায়। অর্থাৎ জনসংখ্যা বৃদ্ধির মূল কারণ যে অশিক্ষা–এ কথাই তিনি দ্ব্যর্থহীন কন্ঠ বলেছেন। জনসংখ্যা নিরোধক ব্যবস্থাপত্র দিয়ে এবং নানা কর্মকেন্দ্র খোলার সঙ্গে সঙ্গে একটু গভীরভাবে ভাবতে হবে বৈকি! আর এ দায়িত্বের সিংহ ভাগই শিক্ষা দপ্তরের পালনীয়।
পত্র-পত্রিকা অঞ্চলের বিভিন্ন নিবন্ধের জনসংখ্যা রোধে পদক্ষেপ হিসেবে গ্রামাঞ্চলে অবসর বিনোদন ও আনন্দ মিলনায়তনের ব্যবস্থা রাখার বিষয়টি উল্লেখ করা হয়েছে। এ অত্যন্ত কাজের কথা এবং যুক্তির কথা। বৃহত্তর কল্যাণের স্বার্থেই বর্তমান বাংলাদেশের প্রায় সোয়া এক দম্পতিকে অন্যদিকে ডাইভার্ট করতে হবে। এক্ষেত্রে গ্রামোন্নয়ন ব্যবস্থাপনায় সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বই সমধিক।
বিশেষ করে উন্নয়নশীল দেশের ক্ষেত্রে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার একটা অভিশাপ হয়ে দেখা দিয়েছে। অশিক্ষা, দারিদ্র্য, সংস্কার-কুসংস্কার, শিল্প-কারখানার অভাব, অবসর বিনোদনের চূড়ান্ত অব্যবস্থা এবং জীবনবোধের নিম্নমানেই তার জন্য দায়ী। সেটা তো শুধু জন্মনিরোধক বটিকা কতটা সাফল্য এনে দিতে পারে তা গভীরভাবে ভেবে দেখতে হবে বৈকি! তাছাড়া বাস্তব অর্থে পরিবার পরিকল্পনার যে উদ্যোগ আয়োজন তা পর্যাপ্ত বলেও বিশেষজ্ঞ মহল মনে করেন না। সেখানেও অধিক কর্মতৎপরতা রাখতে হবে।
পরিশেষে তাই বলতে হয়–জনসংখ্যা বৃদ্ধিতে রুখে দাঁড়ানো এক পাক্ষিক কোন দায়িত্ব নয়। দেশের সার্বিক কল্যাণ, উন্নতি, অগ্রগতি ও সেইসঙ্গে অধুনা বিশ্বের সামগ্রিক সংকটকে সামনে রেখেই আমাদের কাজ করতে হবে। একাজ গুরুত্বপূর্ণ এবং অবশ্য পালনীয়ও বটে। এবং সেই কথা স্মরণে রেখে বিশ্বজন বর্ষ সফল করার উদ্যোগ সংশ্লিষ্ট সকল দপ্তরকে নিতে হবে। বাংলাদেশের জনসংখ্যা রোধের পরিকল্পনা তবে বাস্তবায়িত হতে পারবে।

সবাই দায় দায়িত্ব এড়িয়ে যেতে চান

পাট চাষীদের নাকি সাবসিডি দেওয়া হবে। উদ্দেশ্য পাট চাষে তাদের উৎসাহ প্রদান। এ মৌসুমে পাটের চাষ কম হবে। কেউ কেউ বলছেন গতবারের তুলনায় অর্ধেক পাটও এবার হবে না। এ আশঙ্কা আজকের নয়। পাট বুনানির মৌসুম শুরু হবার আগে থেকেই আমরা এমন আশঙ্কা প্রকাশ করে আসছিলাম। মন্ত্রী মহোদয় নিজে সে সত্য স্বীকার করেছেন। কারণ হিসেবে উল্লেখ করেছেন তিনি সেই সব কথাই যা গত ক’মাস থেকে দেশের প্রায় সকল সংবাদপত্র বলে আসছে। অথচ সময় থাকতে তার কোনোটিই করা হয়নি। অসময়ে উচ্চারিত হচ্ছে কিছু ভালো ভালো কথা।
পাট শিল্পে লোকসান এর কথা উল্লেখ করে পাটমন্ত্রী সরকারের অতীত ব্যর্থতার কথা বলেছেন। বলেছেন আগামীতে সব ঠিকঠাক হয়ে যাবে। পাটকে রক্ষা করার জন্য এবং সবচেয়ে বেশি বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনকারী এই সম্পদের শ্রী সৌষ্ঠব বৃদ্ধির জন্য তিনি চারটি পদক্ষেপ গ্রহণ করা উচিত বলে তাঁর বক্তৃতায় উল্লেখ করেছেন।
কেন দেশের পাট সম্পদ বর্তমান অবস্থায় এসে দাঁড়াল, কেন বিদেশে প্রচুর পাটের চাহিদা থাকা সত্ত্বেও আমরা পাট রপ্তানি করতে পারছি না, এমনকি পাট উৎপাদন কেন উদ্বেগজনক ভাবে হ্রাস পাচ্ছে তা পাটমন্ত্রী অত্যন্ত নিপুণতার সাথে বয়ান করেছেন। কিন্তু এই বক্তৃতার সময় তিনি যে কথাটি বিস্মরিত হয়েছেন বলে আমাদের মনে হচ্ছে তা হলো এই ব্যর্থতাগুলোর জন্য প্রাথমিকভাবে তিনিই দায়ী।
দেশে একটা মারাত্মক প্রবণতা দেখা দিয়েছে। সবাই বিভিন্ন ক্ষেত্রে ব্যর্থতা নিয়ে আলোচনা করেন, কি করলে ভালো হতো তাও অনর্গল বলে যান। এদের মধ্যে যেমন সাধারণ মানুষ রয়েছে তেমনি রয়েছে সেক্ষেত্রে দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিরাও। সাধারণ মানুষ দেশের নানা সমস্যা নিয়ে আলোচনা করেন, সরকারি নানা ভুল ত্রুটির প্রতি অঙ্গুলিনির্দেশ করেন–এটা অত্যন্ত উৎসাহজনক ব্যাপার। সাধারণ মানুষের সচেতনতা এতে প্রতিফলিত হয়। কিন্তু আমরা আশ্চর্য হই তখনই যখন নির্দিষ্ট ক্ষেত্রে দায়িত্বপ্রাপ্ত লোকেরাও অবলীলাক্রমে নিজের জ্ঞান জাহির করার জন্য তার কর্ম ক্ষেত্রে কি কি অবস্থা চলছে, এর প্রতিকার কি এই নিয়ে নাতিদীর্ঘ বক্তৃতা দিয়ে বেড়ান। অথচ ওই কাজগুলো করার দায়িত্ব ছিল তারই।
ঢাকার হোটেলে বসে পাটমন্ত্রী নিজের যে উপলব্ধির কথা বক্তৃতায় বলেছেন সে উপলব্ধি বাস্তবায়নের দায়িত্ব কার ওপর ছিল এটা কি মাননীয় মন্ত্রী মহোদয় একবার বলবেন? আজ তিনি পাট চাষে উৎসাহ দানের জন্য সাবসিডি প্রদানের কথা বলছেন। অথচ পাটের চারা এখন বেশ বড় হয়ে উঠেছে। নুতন করে পাট লাগানোর মৌসুম এটা নয়। ঢাকার হোটেলে রোটারিয়ানদের দ্বারা পরিবেষ্টিত মন্ত্রী মহোদয় তা বেমালুম ভুলে যেতে পারেন। কিন্তু তিনি ভুলে গেলেও পাট বুননের মৌসুম নতুন করে ফিরে আসার নয়। যে সর্বনাশটা হবার তা তো হয়েই গেছে। মন্ত্রী যদি পঁচাত্তর-ছিয়াত্তুরে যারা পাট বুনবে তাদের সাবসিডি প্রদানের কথা বলে থাকেন তবে তা ভিন্ন কথা, সে ক্ষেত্রে আমাদের প্রশ্ন এত আগ বাড়িয়ে কথা বলার আদৌ কোনো প্রয়োজন ছিল কি? পাট শিল্পকে ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করার জন্য সরকারকে চারটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে বলে মন্ত্রী মহোদয় বক্তৃতায় বলেছেন। এই চারটি পদক্ষেপ হলো পাটের ব্যাপক চাষাবাদ, পাট চাষীদের ন্যায্যমূল্য প্রদান, সঠিক সময় পাট জাহাজ জাতকরণ এবং পাটের বাজার নিশ্চিতকরণ। মন্ত্রী মহোদয়ের সাথে সাথে আমরা সেন্ট পার্সেন্ট একমত। পত্র-পত্রিকা খুললে তিনি শুধু আমাদেরই নয় জাতীয় সকল সংবাদপত্রেই এমন সুপারিশের হাজারো বার উল্লেখ দেখতে পাবেন।
ভালো ভালো কথার ফানুস উড়িয়ে আর লাভ নেই। দেশ একটা চরম বিপর্যয়ের প্রায় কাছাকাছি এসে ঠেকেছে। এখন ভালো কথা গুলো একপাশে রেখে তাঁর উপর যে দায়িত্ব ন্যস্ত হয়েছে তার উচিত সে দায়িত্ব সুষ্ঠুভাবে পালন করা। পাট দপ্তরকে পৃথক করে সে দপ্তর দেখাশোনার ভার যখন একজন মন্ত্রীর উপর দেয়া হয়েছে তখন তাকেই পাট সংক্রান্ত যে কোন সমস্যা সমাধানের পথ খুঁজে বের করে তা বাস্তবায়িত করতে হবে। একাজে ব্যর্থতার দায়িত্ব যেমন তার তেমনি সফলতা এলে প্রশংসাও হবে তার প্রাপ্য।

কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক

পত্রিকার মূল কপি পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!