You dont have javascript enabled! Please enable it! আমি আলেন্দে হবাে - সংগ্রামের নোটবুক
আমি আলেন্দে হবাে
কিসিঞ্জারের ঢাকা সফরের পর পরই কু প্লানিং সেল’-এর সঙ্গে ঢাকাস্থ মার্কিন দূতাবাসের কন্টাক্ট হয়। এই কন্টাক্ট পেতে তাদের বিশেষ বেগ পেতে হয়নি। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় হতেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কলকাতাস্থ দূতাবাস ও সি. আই.-এর সঙ্গে এদের যথারীতি যােগাযােগ হয়েছিল। এর কিছুটা বিবরণ দ্বিতীয় অধ্যায়ে উল্লেখ করেছি। বঙ্গবন্ধু হত্যার ব্যাপারে মার্কিনীদের এত আগ্রহ কেন?
১. মার্কিন গােয়েন্দা সংস্থার প্রাক্তন কর্মকর্তা রজার্স মরিস ‘হেনরি কিসিঞ্জার ও মার্কিন ফরেন পলিসি’ নামক একটি তথ্যবহুল বই লিখেছেন। তিনি ন্যাশনাল সিকিউরিটি কাউন্সিলের কিসিঞ্জারের স্টাফ এসিস্ট্যান্ট হিসেবে কয়েক বছর কর্মরত ছিলেন। তিনি ১৯৭৫ সনের প্রথমার্ধে অর্থাৎ কিসিঞ্জারের ঢাকা সফরের পর কিসিঞ্জারের বিশ্বস্ত ও ঘনিষ্ঠ এক সাহায্যকারীর ইন্টারভিউ গ্রহণ করেন। ইন্টারভিউ গ্রহণের সময় আশ্চর্যের বিষয় এই যে, কিসিঞ্জারের বিদেশনীতির সমালােচক হিসেবে নয়, তিনি বললেন যে, কিসিঞ্জারের আমলে মার্কিন বিদেশ নীতিতে তিনটি ফরেন এনেমি’-র তালিকাভুক্ত নাম এবং কিসিঞ্জারের কাছে সবচেয়ে ঘৃণিত ব্যক্তিত্ব : তারা হলেন- আলেন্দে, থিউ এবং মুজিব।
১.১ কেন ঘৃণিত? এর উত্তর কিসিঞ্জার নিজেই দিয়েছেন। বলেছেন তার ভাষায়, “এ কাইন্ড অব অবসট্রিপরাস হু ওয়াজ নট বিহেভিং ইন এ প্রপার ওয়ে।” ১৯৭০ সনের জাতীয় পরিষদের নির্বাচনের পর পরই তদানীন্তন পাকিস্তানে মার্কিন রাষ্ট্রদূত যােশেফ ফারল্যান্ড বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। ফারল্যান্ড বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দক্ষিণ-পূর্ব-এশিয়ায় মার্কিন নীতি নিয়ে আলােচনা করেন এবং বলেন যে, পাকিস্তানের সঙ্গে বিচ্ছিন্নতাকে যুক্তরাষ্ট্র কোনােক্রমেই সমর্থন দেবে না।
১.২ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় মার্কিন নীতির ও সমর্থনের তােয়াক্কা না রেখে, বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘােষণা করেন। শুধু তাই নয়, মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের সরাসরি বিরােধিতা ও শেখ মুজিবকে ফাসিতে লটকানাের ষড়যন্ত্র ব্যর্থ হওয়ায় এবং বাংলাদেশের অভ্যুদয় ও শেখ মুজিবের স্বদেশে প্রত্যাবর্তন ছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তার ক্লায়েন্ট’ পাকিস্তানের জন্য প্রকৃত পরাজয় এবং মার্কিন প্রশাসনের নিকট এটি ছিল বড় রকমের বিড়ম্বনা ।
১.৩ ব্যক্তিগত চরিত্রে কিসিঞ্জার ছিলেন অত্যন্ত ‘ভিডিকটিভ’ প্রকৃতির। পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অভ্যুদয়কে তিনি ব্যক্তিগত পরাজয় হিসেবেই গ্রহণ করেছিলেন।
১.৪ কিসিঞ্জারের আমলে তার গৃহীত বিদেশনীতির মূল কথাই ছিল, নাে পারমানেন্ট ফ্রেন্ডস অব এনিমিজ, অনূলি পারমানেন্ট ইন্টারেস্টস। এই “চিরস্থায়ী স্বার্থের কথা বিবেচনা করেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশে তার। আসন পাকাপােক্ত করার জন্য বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয় এবং সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয়।
১.৫ বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের পর পরই জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব এ দেশের মূল ও ভারী শিল্পসমূহ এবং অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠানাদি জাতীয়করণ করলেন। ব্যক্তিপুঁজির বিকাশকে নিয়ন্ত্রণ করে গণমানুষের স্বার্থে পদক্ষেপসমূহ গ্রহণ করলেন। একই সাথে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে তিনি যা বললেন তা আরাে মারাত্মক। বললেন, পাকিস্তান কর্তৃক গৃহীত ঋণের বােঝার দায় দায়িত্ব তিনি নেবেন না। ঢাকায় সফররত বিশ্বব্যাংকের প্রতিনিধি দলকে ডেকে বললেন : দ্র মহােদয়গণ, শর্তযুক্ত ঋণের কথা বললে আপনারা যেতে পারেন। বললেন : তৃতীয় বিশ্বের শােষণের কথা। বললেন ঃ শােষণ বন্ধের কথা। সাম্রাজ্যবাদ বিরােধিতায় বিশ্বব্যাপী সােচ্চার হলেন। সমাজতান্ত্রিক বিশ্বের সঙ্গে নিবিড় সম্পর্ক গড়ে তুললেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র দেখল : মুজিব আর তাদের লােক নন। সুতরাং কিসিঞ্জারের নীতি হলাে—“গেট আওয়ার পিপল ইন্ এন্ড দেয়ার পিপুল আউট।” সি. আই.-এর খেলাই হলাে ‘গেট ই’ আর ‘গেট আউটের খেলা। অর্থাৎ বাংলাদেশ থেকে মুজিবকে আউট করাে। মােশতাককে বসাও। জিয়াকে বসাও।
১.৬ কিসিঞ্জার আরাে মনে করতেন শেখ মুজিব জীবিত থাকলে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় মার্কিন নীতি চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হবে। কথাটির যথার্থতা ছিল। বাংলাদেশই প্রথম রাষ্ট্র যে মার্কিন প্রভাব বলয়কে উপেক্ষা করে দক্ষিণ ভিয়েতনামের অস্থায়ী বিপ্লবী সরকারকে স্বীকৃতি প্রদান করে এবং বাংলাদেশে তাদের মিশন খুলবার অনুমতি দেয়। বঙ্গবন্ধু পি. এল. ও. কে, মিশন খােলার অনুমতি প্রদান করেন এবং একই সঙ্গে ইসরাইলের মিশন স্থাপনের জন্য মার্কিনের মৌন ইংগিতকে প্রত্যাখ্যান করেন। তাছাড়া কিউবার সঙ্গে বাণিজ্য চুক্তি, আলজিয়ার্স-এর জোট নিরপেক্ষ আন্দোলনে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদী শােষক শ্রেণীর বিরুদ্ধে দ্ব্যর্থহীন ঘােষণা প্রকৃতপক্ষেই দক্ষিণ-পূর্ব মার্কিন বিদেশী নীতির প্রতি বঙ্গবন্ধু হয়ে দাঁড়ান। ‘জলন্ত থ্রেট’। ফিদেল ক্যাস্ট্রো যেমন ল্যাটিন আমেরিকায় মুজিব তেমনি দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় এক সার্বক্ষণিক সমস্যা হয়ে দাঁড়াবে। এটাই ছিল সি. আই.-এর এসেসমেন্ট।
১.৭ এ সম্পর্কে বঙ্গবন্ধুর ধারণা যে একেবারেই ছিল না তা নয়। তাছাড়া জোট নিরপেক্ষ সম্মেলনে বঙ্গবন্ধুর দুই পৃথিবীর তত্ত্বে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ প্রমাদ গুণলাে। বঙ্গবন্ধু ঐ সম্মেলনে ভাষণে বলেছিলেন, “পৃথিবী আজ দুই ভাগে বিভক্ত শােষক আর শােষিত। আমি শােষিতের পক্ষে।” সেই ভাষণের পর পরই ফিদেল ক্যাস্ট্রো তাঁকে জড়িয়ে ধরে অভিনন্দিত করেছিলেন এবং বলেছিলেন যে আজ থেকে একটি বুলেট অহরহ তােমার পিছু নেবে। ক্যাস্ট্রো ব্যাতীত ভারতের প্রয়াত প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরাগান্ধী ষড়যন্ত্র সম্পর্কে বঙ্গবন্ধুকে বিভিন্নভাবে সতর্ক করে দেবার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু চারিদিকে তখন মহাবিপদ সংকেত। প্রচণ্ড দাবদাহ … জমির ফসল পুড়ে গেল। পর পরই আকাশ ভেঙে নামল অবিরাম বর্ষা। হল বন্যা। দেশ ডুবল। ফসল ডুবল। ডুবল ঢাকা শহর। বঙ্গবন্ধু থমকে দাঁড়ালেন। মানুষকে বাঁচাতে হবে। অথচ তেলের মূল্য বৃদ্ধিতে রাজকোষ শূন্য। মুদ্রাস্ফীতি পৃথিবীর সর্বত্র আঘাত হেনেছে। বেশি আঘাত করল যুদ্ধে ধ্বংসপ্রাপ্ত বাংলাদেশকে। এরই মধ্যে খরা আর বন্যা। বাংলাদেশ মহাসংকটে। বঙ্গবন্ধু ভাবলেন। সুর নরম করলেন। শিল্প বিনিয়ােগের সিলিং বাড়িয়ে দিলেন।
বিশ্ব ব্যাংক বলল : টাকার দাম কমাও। বঙ্গবন্ধু নিরন্ন জনগণকে বাঁচানাের স্বার্থে টাকার অবমূল্যায়ন করলেন। রেশনের দাম বাড়ালেন। বেসরকারি মালিকানায় শিল্প প্রত্যাবর্তন পুঁজি প্রতাহারের নীতি বিবেচনা করে দেখলেন। দেশের ভয়াবহ অবস্থা দেখে এই প্রথম বারের মতাে শেখ মুজিব ভেঙে পড়লেন। বঙ্গবন্ধু মার্কিন-যুক্তরাষ্ট্রের দিকে হাত বাড়ালেন ঐ৩। ছুটলেন ওয়াশিংটনে। Bangladesh crumbled before aid dooner pressure. কিসিঞ্জার ঢাকায় এলেন। তাজউদ্দিনের বিদায় পর্ব সমাপ্ত হলাে। মনে হলাে বঙ্গবন্ধু মার্কিন-সাম্রাজ্যবাদের হাতে নিজেকে সঁপে দিলেন। নতজানু … আত্ম সমর্পিত …. পরাজিত সিপাহসালার। আসলে কি তাই?
২. বঙ্গবন্ধু কোনােদিন পরাজয়ের পরাভবকে মেনে নেননি। দুর্ভিক্ষে মার্কিনীদের বিশ্বাসঘাতকতা, শঠতা তার মনে বড় রকমের দাগ কেটে গেল। বঙ্গবন্ধু আঘাত সামলে নিলেন। সাতাশ হাজার বুভুক্ষু লােকের লাশ, বিবেক দংশনে অহরহ জর্জরিত তিনি। পথ খুঁজতে লাগলেন। মুক্তির পথ কোথায়? সাম্রাজ্যবাদী ষড়যন্ত্রের হাত থেকে স্বনির্ভর সােনার বাংলা গড়ার মন্ত্র আবিষ্কারে তিনি ব্যস্ত। যেমন বাঙালির জাতীয় স্বাধীনতার জন্য তিনি প্রণয়ন করেছিলেন ৬ দফা কর্মসূচি এবারও তাকে মুক্তির লক্ষ্যে দিতে হবে কর্মসূচি। বঙ্গবন্ধু পথ অন্বেষায় অস্থির .৭
২.১ বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে সি, আই.-এর এসেসমেন্ট অত্যন্ত নির্ভুল ছিল। ১৯৭৪ সনের দুর্ভিক্ষের ক্রান্তিলগ্নে শেখ মুজিবের মার্কিনীদের প্রতি ঝুঁকে পড়া এবং কতিপয় গৃহীত কার্যক্রমকে পেন্টাগণ ‘সংকটজনক অবস্থার সাময়িক প্রবণতা’ বলে চিহ্নিত করলেন। তাদের ধারণা Mujib’s concessions, were in a sense, a desperate reaction to the crisis not a firm commitment to the principle and not a necessarily a position a patron would bank on the future. I বাংলাদেশে অত্যন্ত সংগোপনে সি, আই, এ, তার পরিকল্পনা মাফিক এগুতে থাকে।
২.২ এই পরিকল্পনার অংশ হিসেবে ফিলিপ চেরী ১৯৭৪ সনের মাঝামাঝি সময়ে বাংলাদেশের সি, আই.-এর স্টেশনচিপ হিসেবে ঢাকায় বদলী হয়ে আসেন। ১৯৭১ সনের মার্চে বাংলাদেশে পাকবাহিনীর হত্যাকাণ্ড শুরু হয়। উপমহাদেশে সংকট ঘনীভূত হলাে। বাংলাদেশে গেরিলা যুদ্ধ চলতে থাকে। এমন অবস্থায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র দিল্লী কলকাতায় সি, আই.এ-এর নেটওয়ার্ক যখন আরাে বিস্তৃত করছিল তখন ১৯৭১ সনের জুন মাসে ফিলিপ চেরী- নয়াদিল্লীস্থ কর্মক্ষেত্রে যােগদান করেন। ১৯৭৪ সনের আগস্ট মাসে, কিসিঞ্জারের আগমনের ও তাজউদ্দিনের বিদায়ের দুই মাস পূর্বে তিনি সি, আই, এ-এর প্রধান হয়ে বাংলাদেশে বদলী হয়ে আসেন। তারপর থেকেই সি. আই. এ আরাে বেশি তৎপর হয়ে উঠে। ঢাকায় কিসিঞ্জারের সফরের সময় মুজিব হত্যার গ্রিন সিগন্যাল পেয়ে সি, আই. এ নেট ওয়ার্ক অবিলম্বে তাদের পুরনাে কনটাক্টদের সঙ্গে যােগাযােগ স্থাপন করে।
২.৩ এই যােগাযােগ পেতে তাদের বিলম্ব হয়নি। কেননা বাংলাদেশে তাদের যে সব পরীক্ষিত ও বিশ্বস্ত বন্ধু ছিলেন মাহবুব আলম চাষী তাদের অন্যতম। মাহবুব আলম চাষী প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের পররাষ্ট্র মন্ত্রী খন্দকার মােশতাকের অধীনে পররাষ্ট্র সচিবের পদে কাজ করছিলেন। সি, আই, এর সঙ্গে তার যােগসাজশ প্রকাশিত হয়ে পড়ল তাকে যুদ্ধকালীন প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন সাহেব ঐ পদ থেকে অপসারিত করেন। দেশ স্বাধীন হলে মাহবুব আলম চাষী প্রধানত মার্কিন সাহায্যে পরিচালিত সংস্থা কুমিল্লার বাের্ডে যােগদান করেন। সি, এস, পি, অফিসার হিসেবে চাকুরীর প্রথম ধাপেই তিনি পাকিস্তানের কূটনৈতিক মিশনের একজন। অফিসার হিসেবে ওয়াশিংটনে অবস্থান গ্রহণ করেন। ১৯৬৫ সনের পাকভারত যুদ্ধে তার ভূমিকা পাকিস্তানের চেয়ে মার্কিন স্বার্থ সংরক্ষণের দিকে। বেশি ঝুঁকে পড়ে এবং সি. আই. এর রিক্রুটি হিসেবে কাজ করার ঘটনা প্রমাণিত হলে ১৯৬৭ সনে তাকে চাকুরী হারাতে হয়। চাকুরীচ্যুতির srecants ay “He is to Pro-American even for Pakistan.
২.৪ ১৯৭১ সনের এপ্রিল। মােশতাক পররাষ্ট্র মন্ত্রী আর মাহবুব আলম চাষী পররাষ্ট্র সচিব। ১৯৭৫ সনের আগস্ট মাসে মােশতাক প্রেসিডেন্ট আর চাষী প্রিন্সিপ্যাল সেক্রেটারি। আর মাঝখনে স্বাধীনতা যুদ্ধকালীন ফিলিপ চেরী বাংলাদেশের সি. আই. এ স্টেশন চিফ।
২.৫ আসলে লিফজের সঙ্গে সাক্ষাৎকারে চেরী মুজিব হত্যার সঙ্গে তার সম্পর্ক অস্বীকার করলেও এ কথা স্বীকার করেছেন যে, ১৯৭৪ সনের শেষ দিকে মুজিবকে উৎখাত করার প্রস্তাব নিয়ে তাদের এপ্রােচ’ করা হয়েছিল।১০
২.৬ প্রকৃত ঘটনা পূর্ব পরিচয় ও বন্ধুত্বের কারণে ফিলিপ, চেরী ব্লুপ্রিন্ট মােতাবেক চাষীকে কাজে লাগায়। চাষী গােপনে মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে তার সমর্থন আদায়ের চেষ্টা করে। জিয়াউর রহমান পরিবর্তনের প্রয়ােজনীয়তার বিষয়ে ঐক্যমত পােষণ করেন। এই স্তরে জিয়াউর রহমানের প্রত্যক্ষ ও সক্রিয় সাহায্য না পেয়ে অনন্যোপায় হয়ে মােশতাক গ্রুপ মেজর রশীদের সঙ্গে যােগাযােগ স্থাপন। করে।
৩. খন্দকার মােশতাক আহমদের ভাগিনা মেজর রশীদকে সহজেই হাত করা সম্ভব হয়। বলাবাহুল্য, মেজর রশীদের ভায়রা হলাে মেজর ফারুক রহমান। মেজর ফারুক রহমান জিয়াউর রহমানের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে সরকার পরিবর্তনে তাদের সাহায্য করার জন্য আবেদন জানায়। ফারুক রহমান এক সাক্ষাৎকারে জিয়াউর রহমানের সঙ্গে তার সাক্ষাৎ ও অলােচনাকে নাটকীয়ভাবে উপস্থাপন করেছেন, যা নিম্নরূপএ্যন্থনী মাসকারেনহাস : শেখ মুজিবকে সরিয়ে তার স্থলে তরুণ কর্নেলবৃন্দ সেনাবাহিনীর একজন লােককে সেখানে বসানাের সিদ্ধান্তে তারা মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। ফারুক রহমান : দেখুন, আমি সেনাবাহিনীর ডেপুটি চীফের সঙ্গে কথা বলছিলাম। আমি সরাসরি দেশের প্রেসিডেন্টকে উৎখাতের কথা বললে হয়ত তিনি আমাকে গ্রেফতার করে জেলে পাঠাতে পারতেন। সে জন্য আমি কথাটি ঘুর পথে শুরু করেছিলাম। দুর্নীতি, সব কিছুই বিশৃংখলা ইত্যাদির কথা তুলে বলেছিলাম দেশ পরিবর্তন চায়। এ কথা শুনে তিনি বললেন, চলুন বাইরে চলুন, লনে কথা বলা যাক। এ্যন্থনী মাসকারেনহাসঃ জিয়া এরূপ বলল? ফারুক রহমান : হ্যা, আমরা লনে আসলাম। তাকে বললাম আমরা পেশাগত সৈনিক, আমরা দেশকে সেবা করব, কোন ব্যক্তিকে নয়। সেনাবাহিনী, সিভিল সার্ভিস, সরকার সবকিছুই ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। আমাদের এগুলাের পরিবর্তন করতে হবে। আমরা জুনিয়ার অফিসারবৃন্দ ইতিমধ্যেই অগ্রসর হয়েছি। এখন প্রয়ােজন আপনার সমর্থন এবং নেতৃত্ব। জিয়া বললেন : আমি দুঃখিত, আমি এ সব ব্যাপারে জড়াতে চাই না। যদি তােমরা কিছু করতে চাও তাহলে এটা জুনিয়র অফিসারদেরই করা উচিত।১১
৩.১ তদানীন্তন প্রধান সেনাপতি বঙ্গবন্ধুর হত্যার সঙ্গে জিয়াউর রহমানের জড়িত থাকার বিষয়ে অত্যন্ত স্পষ্ট করে বলেছেন (পরিশিষ্ট দ্রষ্টব্য)।
৩.২ নির্বাচিত সরকার উৎখাত এবং প্রেসিডেন্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের হত্যা সংক্রান্ত এ চক্রান্তের বিরুদ্ধে সেনাবাহিনীর উপপ্রধান হিসেবে যে দায়িত্ব পালনের কথা ছিল জিয়া তা পালন করেনি। বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীদের সঙ্গে যােগসাজশ অব্যাহত দেখে সেনাবাহিনীর নীতি-ধৰ্ম ও সেনাবাহিনীর আইনের একত্রিশ ধারাকে অবমাননা করে জিয়াউর রহমান প্রকৃত প্রস্তাবে বঙ্গবন্ধু হত্যার বিশেষ একজন হয়ে আছেন।
৩.৩ সামরিক আইন বিধি ভঙ্গ করে পাবনা জেলা গভর্নর হওয়ার পর তিনি আমাকে অভিনন্দন জানিয়ে একটি পত্র লেখেন।১৩ ৩.৪ স্বাধীনতা যুদ্ধে তার ঔদ্ধত্যপূর্ণ ঘােষণা যুদ্ধকালীন সময় তার রহস্যজনক। আচরণ, স্বাধীনতা উত্তর যুগে তার বিভিন্ন বক্তব্য কার্যক্রম থেকে এ কথা প্রমাণিত যে, জিয়াউর রহমান একজন উচ্চাভিলাষী ব্যক্তি ছিলেন। জিয়াউর রহমানের শঠতা ও বিশ্বাসঘাতকতার বিবরণ কর্নেল তাহের তার জবানবন্দীতে লিপিবদ্ধ করে গেছেন।১৪
৪. বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় কিসিঞ্জারের বিশেষ আস্থাভাজন ব্যক্তি হ্যান্ড স্যানডার্স ন্যাশনাল সিকিউরিটি কাউন্সিলের ডেপুটি ছিলেন। তিনি ১৯৫৯ সনে সি, আই, এ যােগ দেন। ১৯৬১ সনে তিনি হােয়াইট হাউজের ন্যাশনাল সিকিউরিটি কাউন্সিল-এ চলে আসেন। কিসিঞ্জার স্টেট ডিপার্টমেন্টের দায়িত্ব গ্রহণ করলে সৌভাগ্যবান কয়েকজন অফিসারদের মধ্যে স্যান্ডার্স এখানে চলে আসেন। কিসিঞ্জার তাকে স্টেট ডিপার্টমেন্টের গােয়েন্দা ও গবেষণা বিভাগের পরিচালক নিযুক্ত করেন। ওয়াশিংটন সূত্রে কথিত যে স্যান্ডার্স কলকাতায় মােশতাক গ্রুপের সঙ্গে যােগাযােগ করেন। এই যােগাযােগের ক্ষেত্রে কলকাতাস্থ কনসাল জেনারেল হার্বটি গর্ডন। অথবা নয়া দিল্লীস্থ মার্কিন রাষ্ট্রদূত ফিটিংকে অন্ধকারে রাখা হয়। এদেরকে নিরপেক্ষ থাকার নামে চক্রান্ত হতে সরিয়ে রাখা হয়। কলকাতাস্থ কনস্যুলের জর্জ গ্রিফিনকে মােশতাক গ্রুপের সংগে যােগাযােগের দায়িত্ব অর্পণ করা হয়েছিল। গ্রিফিন ছিলেন স্যান্ডার্সের ঘনিষ্ঠ। তাই দেখা যায় ১৯৭৫ সনে স্যান্ডার্স তাকে স্টেট ডিপার্টমেন্টের গােয়েন্দা ও গবেষণা ডিভিশনের চিফ হিসেবে নিয়ে আসেন এবং সাউথ এশিয়া ডিভিশনের চিফ হিসেবে নিয়ােগ করেন। প্রখ্যাত সাংবাদিক লিফজের সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে তিনি স্বীকার করেন যে, তিনি কতিপয় বাঙালি নেতৃত্বের সঙ্গে যােগাযােগ রাখতেন।১৫
৪.১ ১৯৭৩ সনের শেষের দিকে পেন্টাগণ বিশেষকরে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার ঘটনাবলির নিয়ন্ত্রণে কিসিঞ্জার চক্র অপ্রতিহত ক্ষমতার অধিকারী হয়। স্যান্ডার্স, গ্রিফিন ফিলিপ চেরি পেন্টাগণ কলকাতা ও বাংলাদেশে তাদের অবস্থান তখন সুদৃঢ়। সি. আই. এ নেট ওয়ার্ক পুরােদমে চালু হলাে। প্লানিং সেল গঠিত হলাে। ব্লুপ্রিন্ট তৈরি হলাে। সংগােপনে কাজ শুরু হলাে। নেটওয়ার্কের আওতায় ক্ষুব্ধ মেজর জেনারেল জিয়াকে গেঁথে নেয়া হলাে। ফারুক আর রশীদকে টানা হলাে। এ প্রসঙ্গে বলে নেয়া ভালাে যে, ফারুক-রশিদ মনে করতে পারে যে তারাই ঘটনার মূল শক্তি ও নিয়ন্ত্রক এবং তারাই খন্দকার মােশতাককে রিক্রুট করেছে। প্রকৃত প্রস্তাবে বলা যেতে পারে “More accurate it was Mastaque and his political nexus who had taken these Majors on board.”SG
৪.২ ১৯৭৫ সনের আগস্টের প্রথম সপ্তাহ। সি. আই. এর শক্তিধর ব্যক্তিত্ব জর্জ গ্রিফিন তখন কলকাতায়। একটি দল বাংলাদেশ থেকে বেড়াতে কলকাতায় গেল। গােপনে যােগাযােগ করল গ্রিফিনের সাথে। ঐ দলের মধ্যে ছিল মেজর (অব.) ডালিম। দলের অন্যান্যদের একদিন সে কথা প্রসংগে বলেই ফেলেছে এ মাসেই আর্মি কু হবে। ক্ষমতা আমাদের হাতে আসবে। ঢাকায় ফিরে এসে দলসংগীদের একজন এ কথা বললে, ষড়যন্ত্রের আভাস পেয়ে ঐ দিন রাতে আমি তদানীন্তন প্রধানমন্ত্রী ও বাকশালের সেক্রেটারি জেনারেল এম, মুনসুর আলীকে বিষয়টি রিপাের্ট করি। প্রধানমন্ত্রী সেদিন যশােহর ক্যান্টনমেন্টে সেনাবাহিনী পরিদর্শন করে এসেছেন। উৎপাদনশীল কাজে সেনাবাহিনীর ভূমিকা নিয়ে বক্তব্য রেখেছেন। তাদের দ্বিতীয় বিপ্লবের ক্যাডার হওয়ার উপদেশ দিয়ে এসেছেন। তিনি বেশ ক্লান্ত ছিলেন। আমার এই রিপাের্ট শােনার পর তিনি স্প্রিং-এর মতাে চেয়ার থেকে লাফিয়ে উঠলেন। আমার হাত ধরে। লনে নিয়ে এলেন। জিজ্ঞেস করাতে বলেছিলাম, খন্দকার মােশতাকের নেতৃত্বে কু সংগঠিত হবে। তিনি নির্বাক হয়ে গেলেন। বহুক্ষণ পায়চারী করার পর তিনি বললেন :কু করলে মােশতাক করবে —করবে তাজউদ্দিন। কু-এর পরে মুনসুর আলীকে মােশতাক প্রধানমন্ত্রী হওয়ার প্রস্তাব দিয়েছিলেন। মুনসুর আলী ঘৃণাভরে তা প্রত্যাখান করেছিলেন। ইতিহাসে প্রমাণ করেছে রাজনীতিতে ব্যক্তিগত সম্পর্কের তেমন কোনাে মূল্য নেই।
মুনসুর-তাজুদ্দিনকে প্রাণ দিতে হলাে সি, আই, এ-এর বিশ্বস্ত লােক মােশতাকের হাতে। যদিও মােশতাকের সংগে মুনসুর আলীর
ব্যক্তিগত সম্পর্ক ছিল অত্যন্ত চমৎকার। আমার ধারণা বঙ্গবন্ধুও বিষয়টি বােধ হয় জানতেন। আগস্টের প্রথম সপ্তাহে তােফাজ্জল হােসেন মানিক মিয়ার পুত্র আনােয়ার হােসেন মঞ্জু কলকাতায় ছিলেন। ১২ই আগস্ট আনােয়ার হােসেন মঞ্জু ঢাকায় ফিরে এলে বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক সহকারী তােফায়েল আহমদ তাকে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে অবিলম্বে সাক্ষাৎ করার পরামর্শ প্রদান করেন। ১৩ই আগস্ট আনােয়ার হােসেন মঞ্জু গণভবনে গমন করেন। বঙ্গবন্ধু শেষ বিকেলে ছড়ি হাতে গণভবনের লনে পায়চারী করছিলেন। তার সাথে ছিলেন তাহের উদ্দিন ঠাকুর। বঙ্গবন্ধু হাতের ছড়িটি উচিয়ে আনােয়ার হােসেন মঞ্জুর মুখের সামনে বললেন, টেল ইয়াের ফ্রেন্ডস আই অ্যাম নট এফ্রেইড।১৭
৫.১ বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর পর ভারতীয় লােক সভায়, এই উপমহাদেশে সি. আই. এ এজেন্টদের নামের তালিকায় বাংলাদেশের স্বনাম ধন্য সম্পাদক আনােয়ার হােসেন মঞ্জুর নাম অন্তর্ভুক্ত ছিল (পরিশিষ্ট দ্রষ্টব্য)।
৫.২ বাকশাল ঘােষণার পর ইত্তেফাক সম্পাদক আনােয়ার হােসেন মঞ্জু এক বৈঠকে কথা প্রসঙ্গে বলেছিলেন; দেশে রক্ত গংগা বইয়ে যাবে।১৮
৫.৩ সচেতনভাবে ইত্তেফাক পাঠ করলে দেখা যাবে পত্রিকাটি পুরােপুরিভাবে এ দেশের শােষিত মানুষের বিরুদ্ধে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের পক্ষে সুপরিকল্পিতভাবে কাজ করে চলছে। আনােয়ার হােসেন মঞ্জু দৈনিক ইত্তেফাকের জাদরেল সম্পাদক। ৫.৪ বঙ্গবন্ধু হত্যার পর বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুকে জাস্টিফাই করে আনােয়ার হােসেন মঞ্জু ইত্তেফাকে এক উপ সম্পাদকীয় লেখেন১৯ (পরিশিষ্ট দ্রষ্টব্য)।
৬. ১৪ই আগস্ট ১৯৭৫। গভর্নরদের প্রশিক্ষণ চলছে। শেখ ফজলুল হক মনি সেদিন গভর্নরদের সামনে আবেগ নির্ভর এক ভাষণ প্রদান করেন। তার বক্তব্যের মাঝে একটি কথা এখনাে আমার মনে দাগ কেটে আছে। তার বক্তব্য ছিল সাম্রাজ্যবাদী প্রতিক্রিয়াশীল সামরিক বেসামরিক-আমলাগণ একজোট হয়ে তৃতীয় বিশ্বের বিভিন্ন দেশে সমাজ প্রগতির ধারাকে বানচাল করার অশুভ তৎপরতায় লিপ্ত, বাংলাদেশের বর্তমান ক্রান্তিকালে সমাজ পরিবর্তনের ধারায় উত্তরণের সময় সাম্রাজ্যবাদী শক্তি আঘাত করতে পারে, সবাইকে সতর্ক, সাবধান ও ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে ইত্যাদি। প্রখ্যাত চিন্তাবিদ খন্দকার মােহাম্মদ ইলিয়াস আমার সঙ্গে এ আলােচনায়। বলেছেন, ১৪ আগস্ট বিকেলে তিনি যখন নবগঠিত বাকশাল কার্যালয়ে উপস্থিত তখন পূর্ব ইউরােপের দূতাবাসের জনৈক কর্মকর্তা বাকশাল সম্পাদক ফজলুল হক মনির সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। তার প্রস্থানের পর আমি রুমে ঢুকলাম। ফজলুল হক মনি তখন অত্যন্ত উত্তেজিত। এটাচিকেস বন্ধ করে উঠে দাঁড়ালেন। কক্ষ থেকে প্রস্থানের প্রাক্কালে খন্দকার ইলিয়াসকে বলেন, সি, আই, এ-এর সাহায্যে মােশতাক ক্য করার পরিকল্পনা করেছে : আমি গণভবনে যাচ্ছি। ফজলুল হক মনি দ্রুত বেগে প্রস্থান করেন। খন্দকার মােহাম্মদ ইলিয়াস আরাে বলেছেন, তিনি ঘটনার পরিণতি কি হলাে তা জানার জন্য মনির সঙ্গে সন্ধ্যার পরে দেখা করলে শেখ ফজলুল হক মনি বললেন : মামাকে বলেছি। উনি যথাযথ ব্যবস্থা নিচ্ছেন। চিন্তার কারণ নেই।২০

৭. ১৪ই আগস্ট অপরাহ্নে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে কয়েকটি উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন বােমা বিস্ফোরিত হয়। এটাকে জাসদ বা গণবাহিনী অথবা উগ্রপন্থী সশস্ত্র বিপ্লবে বিশ্বাসী চৈনিক গ্রুপের কাজ বলে অনেকই ধারণা করেন। সন্ধ্যার পূর্বেই স্বরাষ্ট্র মন্ত্রীর নিকট রিপাের্ট এল, এই বােমা কোনাে বিশেষজ্ঞর, পক্ষেও হাতে তৈরি সম্ভব নয়। কেবলমাত্র সেনাবাহিনীর কাছে এ ধরনের বােমা মজুত আছে। বিষয়টি নিয়ে তদন্ত চলানাের নির্দেশ দেয়া হয়।২১
৮. ১৫ই আগস্ট সকালে প্রেসিডেন্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সম্বর্ধনা। বিশ্ববিদ্যালয় তাঁর সম্বর্ধনায় নবরূপে সুসজ্জিত। কর্তৃপক্ষের নির্দেশে বিশ্ববিদ্যালয়ের নিরাপত্তা অবস্থা জোরদার করা হলাে। পর্যাপ্ত পুলিশ ও রক্ষীবাহিনীকে মােতায়েন করা হলাে। রাত আটটায় প্রেসিডেন্ট শেখ মুজিব উপরাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলামকে টেলিফোনে বললেন : দুই জনে একত্রে যাওয়া ঠিক হবে না। তাকে ১০.৪৫ মিনিটে টি, এস, সি-তে যাবার নির্দেশ দিলেন। আজ প্রশ্ন থেকে যায়, বঙ্গবন্ধু কেন এ নির্দেশ দিয়েছিলেন?
৯. ১৪ আগস্ট সন্ধ্যেয় সবকিছুই যেন খাপছাড়া। সন্ধ্যে সাতটায় নব নিযুক্ত গভর্নরদের সম্বর্ধনা উপলক্ষে বেতার বাংলাদেশ এক অনুষ্ঠানের আয়ােজন করেছিল, কিন্তু আটটা বেজে গেলেও অনুষ্ঠান শুরু হচ্ছিল না। আমিই নই অনেকেই বিরক্ত বােধ করছিলেন। অনেকেই উঠে চলে গেলেন। রাত সাড়ে আটটার দিকে হস্তদন্ত হয়ে তথ্য প্রতিমন্ত্রী তাহেরউদ্দিন ঠাকুর এলেন। অস্থির। অনুষ্ঠান শুরু হলাে। মন্ত্রী প্রবর ভাষণ দিয়ে তড়িঘড়ি কেটে পড়লেন। মনে হলাে তিনি অসম্ভব ব্যস্ত।

কিছু প্রাসঙ্গিক কথা
১০, এই সময়ে জেনারেল ওসমানীর আচরণ ষড়যন্ত্রকারীদের উৎসাহিত করে তােলে। সেদিনের কথা আমার আজো মনে আছে। নতুন গণভবনে পার্লামেন্টারি পার্টি ও আওয়ামী লীগ কার্যনির্বাহী কমিটির যৌথ সভায় আমরা উপস্থিত। বঙ্গবন্ধু তার ভাষণে দেশের রাজনৈতিক, আর্থ-সামাজিক পরিস্থিতির ব্যাখ্যা করে নাতিদীর্ঘ বক্তব্য রাখলেন। সিস্টেম পরিবর্তনের কথা বললেন। বললেন ঃ দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটানাে ও তাদের দুঃখ-দুর্দশা মােচনের জন্য রাষ্ট্রীয় মৌলনীতির অন্যতম সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা ও কার্যকর করার লক্ষ্যে জাতির নিকট প্রদত্ত পূর্ব প্রতিশ্রুতির কথা। বঙ্গবন্ধুর ভাষণের পর জেনারেল ওসমানীকে কিছু বলতে বলা হলে তিনি তার নিজস্ব ভঙ্গীতে বক্তব্য রাখলেন। বললেন ঃ আইয়ুব খান, ইয়াহিয়া খানকে সরিয়ে বাংলাদেশে আমরা মুজিব খানকে দেখতে চাই না। মনে হলাে তিনি ধমকের সাথে কথা বলছেন। তিনি প্রেসিডেন্সিয়াল পদ্ধতির সরকারের ও বঙ্গবন্ধুর পদক্ষেপের সরাসরি বিরােধিতা করে হুঁশিয়ারী উচ্চারণ করে বললেন ঃ এতে কারাে মঙ্গল হবে না। বাকশাল গঠিত হলে সংসদ সদস্য পদ হতে তিনি পদত্যাগ করেন। পদত্যাগ করেন বুর্জোয়া পদ্ধতির একনিষ্ঠ সেবক বলে চিহ্নিত মঈনুল হােসেন।
১১. আজো আমার মনে পড়ে ঐ সভায় প্রবীণ আওয়ামী লীগ নেতা কোরবান আলী বিস্ফোরণােন্মুখ পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করে বললেন : কামানের গােলার সামনে দাঁড়িয়ে জুই ফুলের গান গেয়ে লাভ নেই। নূরে আলম সিদ্দিকী ‘গণ দেবতা’ বঙ্গোপসাগরের উত্তাল তরঙ্গ’ ও ‘বুর্জোয়া গণতন্ত্রের মাহাত্ম্য বর্ণনা করে স্বভাবসুলভ ভঙ্গীতে বক্তব্য রাখলেন। গণতন্ত্রের পূজারী শহীদ সােহরাওয়ার্দীর মানসপুত্র শেখ মুজিবকে তথাকথিত গণতন্ত্রের ধ্বজা আরাে শক্ত করে ধরার দাবী জানালেন।
১২. প্রকাশ বঙ্গবন্ধু কর্তৃক এই মিটিং ডাকার পূর্ব রাতে এবং মিটিং-এর দিনগত রাতে ওবায়দুর রহমান, নূরে আলম সিদ্দিকী, নূরুল ইসলাম মঞ্জুর, তাহেরউদ্দিন ঠাকুর, শাহ মােয়াজ্জেম হােসেন প্রমুখ একমত হন যে, বাকশাল সিস্টেমকে তারা মেনে নেবেন না।২২।
১৩. বাকশাল গঠন হবার পর নতুন করে মন্ত্রীসভা গঠন ও মন্ত্রীদের শপথ নিতে হলাে। পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. কামাল হােসেন মন্ত্রী হিসেবে শপথ গ্রহণ না করে বিদেশে থেকে গেলেন। বাজারে গুজব রটে গেল ড. কামাল হােসেন বাকশাল কর্মসূচি ও পদ্ধতির সঙ্গে একমত হতে পারছেন না। শােনা গেল, বঙ্গবন্ধুর বারবার তাগিদে তিনি দেশে এসে শপথ নিয়ে পুনরায় বিদেশে চলে গেছেন। বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের দিন তিনি দেশে ছিলেন না। বঙ্গবন্ধুর মন্ত্রীসভার প্রায় সকলেই বাকশাল বিরােধী ছিলেন।২৩

১৪, জনাব এ, এইচ এম কামরুজ্জামান হেনা সাহেবের সরকারি বাসভবনে প্রায়ই জলসা বসে। ১৯৭৫ সন। ১৪ই আগস্ট। রাত। সেদিনও তার বাসায় সঙ্গীতের আসর। অনেক রাত হলাে। আসর আরাে জমে উঠল। এমন সময় মেজর (অবঃ) ডালিম ঘরে ঢুকল। বলল জরুরি কথা আছে। কামরুজ্জামান সাহেব তখন গানের সুরে জমে আছেন। বলল রাখ তাের জরুরি কথা! ডালিমের কথায় পাত্তা দিলেন না কামরুজ্জামান সাহেব। বললেন ঃ সকালে আসিস।২৪
১৪.১ লক্ষ্য করেছি বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বচিত হওয়ার কিছু দিনের মধ্যেই তার বিরুদ্ধে ফজলুল হক মনির আক্রমণ পরিচালিত হয়।
১৪.২ স্বভাবতই তিনি ব্ৰিত হন। মুষড়ে পড়েন। তাঁকে তখন হতাশাগ্রস্ত বলে। মনে হতাে। বাকশাল হবার পর বাজেট অধিবেশনে একদিন পার্লামেন্ট ভবনে তার সাথে আমি, বগুড়ার হাসন আলী তালুকদার ও মােজাফফর হােসেন দেখা করি। তিনি পান খাচ্ছিলেন এবং কবিতা লিখছিলেন। কি ধরনের কবিতা লিখছেন আগ্রহ ও আন্তরিকতার সঙ্গে তা জানতে চাইলে তিনি বললেন, মৃত্যুর কবিতা। বললেন, আমি মরব, তুমি মরবে, বঙ্গবন্ধু মরবে… ইত্যাদি।
১৫. সম্প্রতি বঙ্গবন্ধুর মন্ত্রীপরিষদ সদস্য অধ্যাপক ইউসুফ আলী এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন যে, বঙ্গবন্ধুকে সরিয়ে দেবার চক্রান্তের বিষয়টি তদানীন্তন উপরাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম সাহেব ওয়াকিফহাল। ছিলেন।২৫

সূত্রঃ ফ্যাক্টস্ এন্ড ডকুমেন্টস্  বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ড  অধ্যাপক আবু সাইয়িদ