পাকিস্তানের জন্মব্যাখ্যার তিন তত্ত্ব
কংগ্রেস কিংবা হিন্দু মহাসভা কেউই পাকিস্তানের জন্মকে ঠেকাতে পারলাে না। সাতচল্লিশ সালের চৌদ্দই আগস্ট এই অদ্ভুত রাষ্ট্রটি ভূমিষ্ঠ হলাে।
অদ্ভুত হােক আর বদৃভূত হােক, জন্ম যে হলাে পাকিস্তান নামক একটি রাষ্ট্রের—এইটিই হচ্ছে বাস্তব। বাস্তবকে অস্বীকার করা মােটেই বুদ্ধিমানের কাজ নয়। আর বাস্তবে যা ঘটে, বাস্তবের মধ্যেই তার কার্য-কারণ সম্পর্কটি বিদ্যমান থাকে। সমাজ-বাস্তবের অভ্যন্তরেই পাকিস্তানের জন্মেরও কার্যকারণটি নিহিত ছিল নিশ্চয়। সাতচল্লিশের আগস্টের অনেক আগেই পাকিস্তানের জন্ম হয়েই গিয়েছে বলে ধরে নেয়া হয়েছিল। অন্তত ফেব্রুয়ারি-মার্চ থেকেই এ ব্যাপারে কারাে মনে কোনাে সন্দেহ থাকেনি।
পাকিস্তানের জন্ম কেন সম্ভব হলাে, তা নিয়ে রাজনৈতিক ভাষ্যকারদের মধ্যে যেসব মতবাদ চালু আছে তার মধ্যে, বলতে পারি, তিনটিই প্রধান। অন্য কোনাে মত থাকলেও, আমার মনে হয়, সেগুলাে এ-তিনেরই কোনাে-না-কোনােটির রকমফের মাত্র।
ছেচল্লিশ-সাতচল্লিশে আমার যে-বয়স, সে-বয়সে এসব মতবাদ আমার পক্ষে স্পষ্টভাবে বােঝার কথা নয়, বুঝিওনি। কিন্তু সে-সময়েই আমাদের রামপুর পােস্ট অফিসে সংবাদপত্র সামনে নিয়ে বড়ােরা যে-সব তর্ক-বিতর্ক করতেন, একটু দূরে বসে থেকে সে-সবই আমি অনুধাবন করতে চেষ্টা করেছি। পঁয়তাল্লিশে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সমাপ্তির কিছু আগে ও পরে আমাদের গায়ে নগেন্দ্র দত্তর বৈঠকখানায় কিংবা জগদীশ কবিরাজের কুলন আয়ুর্বেদ ভবনে সংবাদপত্র পাঠের আসরে আমি সক্রিয় বা অক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেছি। এখন, ছেচল্লিশের শেষ ও সাতচল্লিশের গােড়ায়, আমাদের পােস্ট অফিসের আসরটিতেও যােগদানের সুযােগ পেয়ে গেলাম। এ আসরটি ছিল অনেক বড়াে ও সমৃদ্ধ। আশপাশের গ্রাম থেকে গ্রামীণ এলিটরা এসে এখানে জড়াে হতেন। বেখৈরহাটি হাই স্কুলের শিক্ষকরা আসতেন, দলপা গ্রাম থেকে আসতেন যুদ্ধ ফেরত আজিজুর রহমান ফকির। আমাদের রামপুর প্রাইমারি স্কুলের হেড়মাস্টার ও দলপা ইউনিয়ন বাের্ডের প্রেসিডেন্ট সােনাফর উদ্দিন ছিলেন এ-আসরের মধ্যমণি। আর সংবাদপত্রের মূল পাঠক ছিলেন রামপুরের কামিনী কুমার চক্রবর্তী। তাঁকে ঘিরেই পােস্ট অফিসের পাশের কামরাটিতে সকলে গােল হয়ে বসে যেতেন। একেকটা সংবাদ পাঠের পরই শ্রোতাদের নানা জনে নানা মন্তব্য করতেন বা টিপ্পনি কাটতেন। সে-সব মন্তব্য বা টিপ্পনি কখনাে কখনাে আসরে অনাকাক্ষিত উত্তাপেরও সঞ্চার করে ফেলতাে। সে-উত্তাপ দূর করার জন্য অনেক সময়েই এগিয়ে আসতে হতাে গয়ানাথ সরকার মহাশয়কে। সরকার মহাশয়ের বাড়িতেই ছিল রামপুরের ব্রাঞ্চ পােস্ট অফিসটির অবস্থান। তাই, গৃহকর্তা হিসেবে আসরের শান্তি বজায় রাখার দায়িত্ব তাকেই বহন করতে হতাে। আর যােগান দিতে হতাে পান-তামাকের। সে-আসরে এলাকায় বিদগ্ধ ব্যক্তি-বলে-পরিচিত এবং গাঁয়ের প্রতাপশালী তালুকদার মহেন্দ্র চৌধুরীও কোনাে কোনাে দিন উপস্থিত হতেন। কখনাে কখনাে তুখােড় কমিউনিস্ট কর্মী ও ছাত্রনেতা পবিত্র দাশও তার চেলাদের নিয়ে এখানে আসতেন। সােনার মাস্টার, মহেন্দ্র চৌধুরী আর পবিত্র দাশ—এই তিন জন তিন ভিন্ন অবস্থান থেকে আসরে তাঁদের বক্তব্য উপস্থাপন করতেন। প্রথম জন মুসলিম লীগের, দ্বিতীয় জন কংগ্রেসের ও তৃতীয় জন কমিউনিস্ট পার্টির মতের প্রতিধ্বনি করতেন। তিন জনের মধ্যে প্রথম জন প্রায় রােজই
১০০
উপস্থিত থাকতেন, দ্বিতীয় ও তৃতীয় জনের উপস্থিতি অনিয়মিত হলেও তাঁদের প্রতিনিধিস্থানীয় অনেককেই সে-আসরে পাওয়া যেতাে। এঁদের সকলের মন্তব্য-বক্তব্য ও তর্ক-বিতর্কের মধ্য দিয়ে পাকিস্তানের জন্ম সম্পৰ্কীয় তিনটি মতবাদই বেশ স্পষ্ট হয়ে ফুটে উঠতাে।
প্রথম মতটি পাকিস্তানের জন্মদাতা মুসলিম লীগ গােষ্ঠীর। তাদের মতে ব্রিটিশ-শাসিত ভারতবর্ষের মুসলমানরা হচ্ছে একটি জাতি। পাকিস্তানের জনক-বলে-কথিত মােহাম্মদ আলী জিন্নাহ ব্রিটিশ সাংবাদিক বিভার্লি নিকলসের সঙ্গে আলাপচারিতায় এই মুসলিম জাতিত্বের কথাটিই খুব জোর দিয়ে উল্লেখ করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, পাকিস্তানের অন্তঃসার বা মৌলনীতি (‘ভাইটাল প্রিন্সিপল) নিহিত আছে পাঁচটি ইংরেজি শব্দে গ্রথিত একটি বাক্যের মধ্যে। সে-বাক্যটি হচ্ছে—দি মুসলিম আর অ্যা নেশন। মুসলমানরা কী করে একটি জাতি হলাে তা-ও জিন্নাহ সাহেব তাঁর নিজের মতাে করে বর্ণনা করেছেন। শুধু ধর্মেই নয়, আচারেব্যবহারে চিন্তায়-চেতনায় কৃষ্টিতে-সংস্কৃতিতে ব্যক্তির নামে ও নামকরণের রীতিতে—সকল দিক দিয়েই মুসলমানরা হিন্দুদের থেকে স্বতন্ত্র। আধুনিক রাষ্ট্রনীতির বিচারে একটি স্বতন্ত্র জাতির জন্য প্রয়ােজন স্বতন্ত্র একটি রাষ্ট্রের। তাই, মুসলমানদেরও একটি স্বতন্ত্র রাষ্ট্র চাই। হিন্দুদের সঙ্গে মুসলমানদের এক রাষ্ট্রের কাঠামােয় একত্র বাস করা অসম্ভব। হিন্দুরা মুসলমানদের ঘৃণা করে, তাদের ওপর অত্যাচার-নির্যাতন করে, এমন কি তাদের ছোঁয়া বাঁচিয়ে চলে। কাজেই চাই পাকিস্তান। পাকিস্তানই উপমহাদেশের মুসলমানদের তাহজিব তমদ্দুনকে রক্ষা করবে, পাকিস্তানেই মুসলমানরা হিন্দুদের আধিপত্য-মুক্ত হয়ে শির উঁচু করে দাঁড়াতে পারবে। জিন্নাহ্ বললেন: লােকে বলে, ইংরেজরা ভাগ কর ও শাসন কর’ (ডিভাইড এন্ড রুল) নীতির অনুসরণ করে। আমরা ইংরেজদের বলি, তােমরা ভাগ করে দিয়ে চলে যাও (ডিভাইড এন্ড কুইট)। হিন্দুরা দেশ ভাগ করতে দিতে রাজি নয় বলেই মুসলিম লীগ প্রত্যক্ষ সংগ্রামের কর্মসূচি ঘােষণা করলাে, দেশ জুড়ে দাঙ্গা-হাঙ্গামা হলাে, ইংরেজ ও হিন্দু উভয়েই পাকিস্তানের বাস্তবতাকে মেনে নিতে বাধ্য হলাে, পরিশেষে পাকিস্তানের জন্ম হলাে।
পাকিস্তানের জন্ম সম্পর্কে মুসলিম লীগের এই মতবাদে কংগ্রেস বিশ্বাস করে না। কংগ্রেসের মতে ভারতবর্ষ এক ও অবিভাজ্য। ভারতবাসীরা সব মিলে এক জাতি। এক ভারতমাতার সন্তান। এই সন্তানদের ভেতর বিভেদ সৃষ্টি করেছে সাম্রাজ্যবাদী ইংরেজ। ওদের ভাগ করে শাসন করার নীতিই ভারতমাতার দুই সন্তান হিন্দু আর মুসলমানকে পরস্পরের শত্রু বানিয়েছে। ইংরেজ শাসকদের এজেন্ট রূপেই মুসলিম লীগ পাকিস্তানের দাবি তুলেছে, হিন্দুমুসলিম দাঙ্গা বাধিয়েছে, কৃত্রিমভাবে দ্বিজাতিতত্ত্ব নামক একটি ডাহা মিথ্যা মতবাদের বিস্তার ঘটিয়েছে। ইংরেজের কূট কৌশল আর ভেদনীতিই কৃত্রিমভাবে ভারতবর্ষকে বিভক্ত করে পাকিস্তানের জন্ম দিয়েছে।
মার্কসবাদী তথা বামপন্থীদের দৃষ্টি অন্যরকম। পাকিস্তানের জন্মের মূলে তারা দেখেন অর্থনৈতিক কারণ। পবিত্রদা খুব দৃঢ় বিশ্বাসের সঙ্গে সমাজের শ্রেণীবিভাগ ও শ্রেণীসংগ্রামের কথা বলে যেতেন রামপুর পােস্ট অফিসে পত্রিকা-পাঠের আসরে। তিনি আমাদের গ্রাম এলাকার তালুকদার-মহাজন ও কৃষক-খাতকদের দৃষ্টান্তও হাজির করতেন। এদেরই একদল মূলত হিন্দু সম্প্রদায় ও অন্যদল মূলত মুসলমান সম্প্রদায় থেকে এসেছে বলে মুসলিম লিগাররা এই দু’দলের স্বার্থ-সংঘাতকে সাম্প্রদায়িক রূপ দিতে পেরেছে। আসলে এ হচ্ছে শ্রেণী সংগ্রামেরই বিকৃত রূপ। কংগ্রেস আর মুসলিম লীগ দুয়ে মিলেই এই বিকৃত রূপের সৃষ্টি
১০১
করেছে। এই দু’গােষ্ঠীই শোষক, দু’য়ের হাতেই কৃষক-খাতকের মতাে মেহনতি মানুষেরা শােষিত। কংগ্রেস একজাতির কথা বলে আর মুসলিম লীগ দ্বিজাতিতত্ত্বের কথা বলে নিজের নিজের শােষণকেই পােক্ত করতে চায়, ওই শােষিত মানুষগুলােকে ধােকা দিতে চায়। মুসলিম লীগ ইসলামের নাম করে অতি সহজে মুসলমান কৃষক-খাতককে ধােকা দিতে সক্ষম হয়েছে। বলেই পাকিস্তানের জন্ম হয়েছে।
পবিত্ৰদার এ-রকম বক্তব্য তাঁর কিশাের চেলারা ছাড়া আর কাউকেই খুশি করতে পারতাে । কংগ্রেস-সমর্থক ও মুসলিম লীগ-সমর্থক বয়স্ক ব্যক্তিরা এই কলেজ-পড়ুয়া ছোড়ার কথায় খুবই বিরক্ত হতেন। তবে প্রবীণ সােনার মাস্টার বা মহেন্দ্র চৌধুরী কিংবা এমন কাউকেই পবিত্ৰদার সঙ্গে সামনা সামনি কথা কাটাকাটি করতে দেখিনি। পবিত্ৰদাও, নিজের মতে দৃঢ় ও আপােসহীন হয়েও, কখনাে প্রবীণদের সঙ্গে অবিনয় ও ঔদ্ধত্যের পরিচয় দিতেন না। প্রবীণরাও, তাঁর মতকে না মানলেও, এই তীক্ষ্মধী ও নিষ্ঠাবান কর্মী যুবককে সমীহ না-করে পারতেন না।
তবে, পবিত্ৰদার অসাক্ষাতে, প্রবীণ কংগ্রেসী ও মুসলিম লিগারদের সকলেই তাঁর কমিউনিস্ট দৃষ্টিভঙ্গির সমালােচনা করতেন। তাঁদের কথায় কমিউনিস্টদের বিরুদ্ধে ধর্মবিরােধিতা, দেশীয় ঐতিহ্য-বিরােধিতা, রাশিয়ার দালালি এবং এ-রকম সব পুরনাে অভিযােগেরই কেবল পুনরাবৃত্তি থাকতাে—কমিউনিস্টদের যুক্তি খণ্ডন করার মতাে কোনাে সবল যুক্তি থাকতাে না।
পবিত্রদা যে-সব শক্ত শক্ত কথা বলতেন তার অনেক কিছুই বুঝতাম না। তবু অন্যের চেয়ে তার কথাগুলােই আমার বেশি ভালাে লাগতাে। অথচ, মাত্র কিছুদিন আগেই কংগ্রেসের পক্ষে প্রবল উৎসাহে যেসব শ্লোগান দিয়েছি, সেগুলােও ভুলতে পারছিলাম না। পবিত্ৰদার কথার সমর্থন করা মানে কমিউনিস্টদের সমর্থন করা। তা কী করে হয়? আমার বাবা থেকে শুরু করে গুরুজনদের প্রায় সকলেই কংগ্রেসী মতবাদের সমর্থক, তাঁদের কাছ থেকেই তাে আমি কংগ্রেসী শ্লোগানগুলাে শিখেছি, এখন সেগুলােকে ছেড়ে দিই কী করে?
আবার, মুসলিম লীগের সমর্থনে সােনার মাস্টার সাহেব যে-সব কথা বলতেন, সেগুলােরও কিছু কিছু সত্য বলে মনে হতাে। হিন্দুরা মুসলমানদের যেভাবে দূরে সরিয়ে রাখতে তাতে তাে এই দুটি গােষ্ঠীর মানুষকে এক ভাবা খুবই কঠিন ছিল।
অর্থাৎ সােনার মাস্টার, মহেন্দ্র চৌধুরী বা পবিত্র দাশ, যখন যার কথা শুনেছি তখন তার কথাই আমার কাছে সঠিক বলে মনে হয়েছে। প্রত্যেকেই নিজের নিজের কথায় যে-সব যুক্তি হাজির করতেন, সে-সবের কোনােটাকেই অস্বীকার করার ক্ষমতা আমার ছিল না। শুধু সেই বালক বয়সে কেন, পরিণত বয়সেও যখন পাকিস্তানের জন্ম সম্পর্কে মুসলিম লীগ, কংগ্রেস ও কমিউনিস্টদের যুক্তিগুলাে পর্যালােচনা করতে বসেছি, তখন কাউকেই যেমন পুরােপুরি বাতিল করে দিতে পারিনি, তেমনি কারাে প্রতি অকুণ্ঠ সমর্থনও জানাতে পারিনি। অনেক বিশ্বাস ও অনেক সন্দেহের নাগরদোলায় আমি দুলেছি। রাজনীতির বাঘা বাঘা তাত্ত্বিকদের রচনা পাঠ করেও আমার এ-রকম দোলাচল দূর হয়নি।
জীবনের এক পর্যায়ে কমিউনিস্ট মতবাদে দীক্ষিত হলাম। এমতবাদের বৈজ্ঞানিকতা সম্পর্কে আমার মনে বিন্দুমাত্রও সন্দেহ নেই। বিশ শতকের নব্বইয়ের দশকে যখন কমিউনিস্ট শিবিরে ধস নেমেছে, যখন এক কালের অনেক জঁদরেল কমিউনিস্ট নেতাও এ-মতবাদকে অসত্য বলে পরিত্যাগ করে প্রাক্তন কমিউনিস্ট হয়ে গেছেন, এমন কি কেউ কেউ
১০২
কমিউনিজমের ঘাের শত্রু বনে গেছেন, তখনাে আমার চিত্তলােকে কমিউনিস্ট মতবাদের প্রতি আস্থার আসনটি অবিচল রয়ে গেছে। মার্কসীয় ডায়ালেটিকে মিথ্যা প্রমাণ করতে পারে এমন কোনাে মতবাদের উদ্ভব এতাবকালে হয়নি, ভবিষ্যতেও হবে বলে আমার বিশ্বাস নেই। ডায়ালেটিক্সকে অস্বীকার করে কোনাে বিষয়ের অন্তর্নিহিত সত্যকে উদঘাটন করা যায় বলে আমি ধারণা করতে পারি না। পাকিস্তানের জন্মের তাৎপর্য-সন্ধানের জন্যও, তাই, ডায়ালেটিসের শরণ নেয়া অপরিহার্য।
কিন্তু আমার আশেপাশে যাঁরা মার্কসবাদী নামে পরিচিত, তাঁরা অনেকেই মুখে ডায়ালেকটিকসের কথা বলেন অবশ্যই, তবু তাঁদের চিন্তার পদ্ধতিতে ডায়ালেটিসের প্রয়ােগ ঘটে বলে আমার অনেক সময়েই মনে হয় না। দ্বান্দ্বিকতার নাম করে তাঁরা যান্ত্রিকতারই কারবার করেন, সরলীকৃত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে সেটিকেই চূড়ান্ত ও অমােঘ সত্য বলে প্রচার করেন। তারা অর্থনীতিকেই সর্বসাধ্যসার বলে ধরে নন। মার্কসবাদকে তাঁরা অর্থনৈতিক নির্দেশ্যবাদে (ইকনমিক ডিটারমিনিজম) পরিণত করে ফেলেন। অথচ মার্কসবাদ কোনাে মতেই অর্থনৈতিক নির্দেশ্যবাদ নয়, অর্থনীতিই সমাজের একমাত্র নিয়ামক শক্তি’ এমন কথা মার্কস এঙ্গেলস্ বা লেনিন কেউই বলেননি। তবু মার্কস-এঙ্গেলসের জীবৎ কালেই মার্কসবাদের দোহাই দিয়ে অনেকে সমাজ বিশ্লেষণে অর্থনীতি ছাড়া আর সব কিছুর দিক থেকেই মুখ ফিরিয়ে রাখেন। এঁদের সম্পর্কেই এঙ্গেলস লিখেছিলেন—’তরুণরা কিছু কিছু ক্ষেত্রে অর্থনৈতিক দিকটার প্রতি যে প্রয়ােজনাতিরিক্ত গুরুত্ব আরােপ করেছে, তার জন্য আংশিকভাবে মার্কস ও আমিই দায়ী। অর্থনীতি তথা উৎপাদন পদ্ধতি ও উৎপাদন সম্পর্কের ব্যাপারটিকে বিবেচনায় নিতে অমার্কসবাদী তাত্ত্বিকরা মােটেই রাজি ছিলেন না বলেই মার্কসএঙ্গেলস্ এদিকটার ওপর বেশি গুরুত্ব দিতে বাধ্য হয়েছিলেন। তা ছাড়া এঙ্গেলস্ এ-ও জানিয়েছিলেন যে, অর্থনীতির সঙ্গে পারস্পরিক প্রক্রিয়ায় সংশ্লিষ্ট অন্যান্য উপাদানগুলােকে তাদের যথােপযুক্ত স্থানে প্রতিষ্ঠিত করতে পারার মতাে সময় তিনি বা মার্কস কেউই পাননি।
তাদের উত্তরসূরি মার্কসবাদীরা বােধ হয় সেই সময় করে নেয়ার কোনাে গরজই বােধ করেননি। যদি করতেন, তবে পাকিস্তানের জন্ম সম্পর্কেও তারা এ-রকম যান্ত্রিক ও অর্থনৈতিক নির্দেশ্যবাদী তত্ত্ব হাজির করে তৃপ্ত হতে পারতেন না। আবার, এক পর্যায়ে যে ভারতবর্ষের কমিউনিস্টরা সংখ্যালঘুদের আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকারের স্বীকৃতি হিসেবে পাকিস্তানের সমর্থন করে বসেছিলেন, তা-ও তাদের বােধের পরিচ্ছন্নতার পরিচয় দেয়নি।
হ্যা, পবিত্রদা যে শ্রেণীদৃষ্টির কথা বলতেন, যে-কোনাে সামাজিক ঘটনার মতাে পাকিস্তানের অভ্যুদয়ের বিশ্লেষণেও অন্যদের সে-দৃষ্টি থাকার কথা নয়, তাই তাদের বিশ্লেষণও অবশ্যই ভ্রান্ত হবে। কিন্তু তাদের বক্তব্যেও যে সত্যের অনেক উপাদান ছিল, সে কথাও ঠিক। আসল কথা হলাে; সকলেই ছিল খণ্ডিত, কারুরই সামগ্রিক দৃষ্টি ছিল না।
সেই সামগ্রিক দৃষ্টিটিই পেয়েছি রবীন্দ্রনাথের বিশ্লেষণে। পাকিস্তান সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ যদিও কিছুই লেখেননি, পাকিস্তান প্রস্তাব উত্থাপনের এক বছর পরই যদিও তাঁর জীবনাবসান ঘটেছে, তবু রবীন্দ্রনাথের লেখার সঙ্গে আমার নিজের দেখাকে মিলিয়ে আমি নিঃসংশয় হতে পেরেছি: রবীন্দ্রনাথই হিন্দু-মুসলমান সমস্যার আসল রূপটি ধরতে পেরেছিলেন, রবীন্দ্রনাথের সহায়তা নিলেই মার্কসবাদীরাও পাকিস্তানের জন্মের প্রকৃত তাৎপর্যটি উপলব্ধি করতে পারবেন।
১০৩
পাকিস্তানের জন্মদাতাই পাকিস্তানের মৃত্যুবীজ রােপণ করলেন
পাকিস্তানের জন্মের মাস চারেক আগে আমি আমার জন্মগ্রাম চন্দপাড়া ছেড়ে মুক্তাগাছার পারুলতলায় মামার বাড়িতে চলে গিয়েছিলাম। পাকিস্তানের ভূমিষ্ঠ হওয়ার ক্ষণটি আমি মামাবাড়িতে থেকেই প্রত্যক্ষ করেছিলাম। আটচল্লিশের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত পারুলতলা আর হাতিল—মামার বাড়িতে ও মাসির বাড়িতে কাটাই। মামার বাড়িতে অবস্থান করেই আমি ‘পাকিস্তানের জন্মলগ্নে ভদ্র হিন্দুর মানস সংকটের কী রূপ উপলব্ধি করেছিলাম, ব্রাত্যজনের জন্যে পাকিস্তানের কী ধরনের সমস্যার সৃষ্টি করেছিল এবং পল্লী কবি ইউনুস আলীর কবিতা পড়ে আমার কৈশােরিক চৈতন্যে কী রকম সুবাতাস বয়ে গিয়েছিল—সেসব কথা আমি গৌরচন্দ্রিকা সমাপ্ত করার পরপরই বলে নিয়েছি। এরপরই বলেছি, বাংলার লােকজীবনে পাকিস্তানের দুষ্ট হাওয়ার কথা, বর্ণনা দিয়েছি ‘গান্ধী হত্যার অভিনব প্রতিক্রিয়া’র। তারপরই স্মৃতির পাখায় ভর দিয়ে চলে গিয়েছি পাকিস্তানের জন্মের আগের দিনগুলােতে। সে-সময়কার কংগ্রেস, কমিউনিস্ট, মুসলিম লীগ, জাতীয়তাবাদী মুসলমান, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা, হিন্দুর জাতপাত ইত্যাদি নানা ঘাট-আঘাটার পাশ দিয়ে চলতে চলতে আবার চলে এলাম পাকিস্তানের শৈশব কালের তটে। কিন্তু পাকিস্তানের জন্মমৃত্যু দর্শনের জন্যে বারবারই আমাকে পাকিস্তানের জন্মের আগের দিনগুলাের দিকে ফিরে ফিরে তাকাতে হবে। এবং আমার প্রত্যক্ষদর্শন সব কিছুর নাগাল পাবে না বলেই বয়ােজ্যেষ্ঠ জনের শরণ নিতে হবে, অন্যের স্মৃতির এলাকায় অনুপ্রবেশ করতে হবে, বহু বিষয়েই শ্রুতির ওপর নির্ভর করতে হবে। আর এ কথা তাে জানাই আছে যে, শ্রুতি ও স্মৃতিকে অবলম্বন করেই যে কোনাে দর্শন সম্পূর্ণতা পায়।
আটচল্লিশের ফেব্রুয়ারি মাসে বাবা আমাকে মামাবাড়ি থেকে নিয়ে এলেন নেত্রকোনায়। ভর্তি করে দিলেন নেত্রকোনা শহরের চন্দ্রনাথ হাইস্কুলে ক্লাস সিক্স-এ। থাকার জায়গা হলাে শহরের পার্শ্ববর্তী গ্রাম পুখুরিয়া, আমার পিসিমার (বাবার জ্যাঠতুতাে বােনের বাড়িতে। ছেচল্লিশে সেকালের প্রাইমারি স্কুলের শেষ ক্লাসের (ক্লাস ফোর) পরীক্ষা পাস করে এক বছর আমি কোনাে স্কুলে পড়িনি। সাতচল্লিশে মামার বাড়িতে ক্লাস ফাইভের পাঠ্য বিষয়গুলাে পড়ে নিয়েছিলাম গৃহশিক্ষক যতীন চক্রবর্তীর কাছে।
নেত্রকোনা একটি নিতান্ত মফস্বল শহর হলেও শহর তাে বটেই। এই প্রথম আমার শহুরে জীবন সম্পর্কে প্রত্যক্ষ পরিচয়। আর গাঁয়ের প্রাইমারি স্কুলের সঙ্গে শহরের চন্দ্রনাথ হাইস্কুলের তাে তুলনাই চলে না। প্রখ্যাত কংগ্রেস নেতা নলিনীরঞ্জন সরকার, যিনি ছিলেন নেত্রকোনারই কেন্দুয়া থানার সাজিউড়া গ্রামের মানুষ, তারই পিতা চন্দ্রনাথ সরকারের নামাঙ্কিত ছিল এই হাইস্কুল। এই ইস্কুলটির সঙ্গে স্বদেশী আন্দোলনের একটা গভীর সম্পর্ক ছিল। এখানকার শিক্ষক ও ছাত্র উভয়ের প্রতি বক্র দৃষ্টি ছিল ব্রিটিশ সরকারের এবং সদ্য প্রতিষ্ঠিত পাকিস্তান সরকারেরও এর ওপর সুনজর থাকার কথা নয়। নেত্রকোনা শহরে তখন চারটি হাইস্কুল, একটি মেয়েদের ও তিনটি ছেলেদের। আঞ্জুমান হাইস্কুলটি হলাে মূলত মুসলমান ছাত্রদের স্কুল, ছাত্রদের শতকরা আটানব্বই জনই মুসলমান। দত্ত হাইস্কুল (যেটি উনিশ শতকের প্রখ্যাত সিভিলিয়ান ও লেখক রমেশ চন্দ্র দত্তের নামে প্রতিষ্ঠিত) ও চন্দ্রনাথ হাইস্কুলে মুসলমান ছাত্রের সংখ্যা খুবই কম। চন্দ্রনাথ হাইস্কুলে তাে, সেই আটচল্লিশ সালেও, শতকরা পাঁচজনও মুসলমান ছাত্র ছিল কিনা সন্দেহ। শিক্ষকদের মধ্যে একমাত্র আরবীর মৌলবী সাহেব ছাড়া আর সবাই হিন্দু। এ থেকে বােঝা যায় : রাষ্ট্ররূপে পাকিস্তানের জন্মের আগেই এ দেশের সমাজে, অন্তত
১০৪
মধ্যবিত্ত সমাজে, হিন্দুস্থান-পাকিস্তানের ভ্রণ তৈরি হয়ে গিয়েছিল। উনিশ শতকে যে মধ্যবিত্ত সমাজটি আধুনিক শিক্ষা-সংস্কৃতির সংস্পর্শে এসেছিল সেটি ছিল মূলত হিন্দু সমাজ। স্কুল কলেজ সভা সমিতি—এরকম যা কিছু তখন গড়ে উঠেছিল তারও সবই ছিল, তাই, হিন্দু। সে শতকের শেষ দিক থেকেই যখন একটু একটু করে মুসলমান মধ্যবিত্তের উদ্ভব ঘটতে লাগলাে এবং সে মধ্যবিত্তরা যখন আধুনিক শিক্ষার এলাকায় প্রবেশ করতে শুরু করলাে, তখন সে আধুনিকতার ভেতর তারা প্রবলভাবে হিন্দু ও হিন্দুত্বেরই উপস্থিতি দেখতে পেলাে। এই হিন্দু ও হিন্দুত্বের ধাক্কায় তারা তাদের আধুনিকতাকেও মুসলমান বানিয়ে নিলাে, মুসলমানত্বের দুর্গ তৈরি করে তাতেই স্বচ্ছন্দ আশ্রয় খুঁজলাে। অর্থাৎ ইংরেজ আমলে এ দেশে যে আধুনিকতা’টি এসেছিল, এখানকার জল-হাওয়ার ছোঁয়া লেগে সেটি আর খাঁটি আধুনিক হয়ে থাকতে পারলাে না, হয়ে গেলাে—“হিন্দু আধুনিকতা’ ও ‘মুসলিম আধুনিকতা। আধুনিক শিক্ষার সঙ্গে সংযুক্ত মুসলমানের মনেই মুসলিম স্বাতন্ত্রের বােধটি দানা বেঁধে উঠতে লাগলাে। সেই বােধেরই এক ধরনের প্রকাশ দেখা গেলাে মুসলমানদের আঞ্জুমানগুলাের মধ্যে। পাকিস্তান সম্পর্কীয় রাষ্ট্রিক ধারণাটি জন্ম নেয়ার অনেক আগেই একেকটি আঞ্জুমান হয়ে উঠলাে একেকটি সামাজিক পাকিস্তান। নেত্রকোনার আঞ্জুমান হাইস্কুলটিও এরকম একটি পাকিস্তান’ রূপেই দত্ত হাই ও চন্দ্রনাথ হাইস্কুলের ‘হিন্দুস্থান থেকে মুসলমান শিক্ষার্থীদের আলাদা করে নিয়ে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল বিশ শতকের মধ্যপর্বে।
অন্যদিকে, রাষ্ট্রিকভাবে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হয়ে যাওয়ার পরও, আটচল্লিশ সালেও, চন্দ্রনাথ হাইস্কুলের সামাজিক ‘হিন্দুস্থানটি প্রায় অটুটই রয়ে গেলাে। চন্দ্রনাথে প্রতি বছর ঘটা করে সরস্বতী পূজা উদযাপিত হতাে। সরস্বতী পূজাকে কেন্দ্র করেই অনুষ্ঠিত হতাে শিক্ষা সপ্তাহ’। সেই শিক্ষা সপ্তাহ এখনকার সরকারি উদ্যোগে পালিত শিক্ষা সপ্তাহের মতাে যান্ত্রিক ব্যাপার ছিল না মােটেই। চন্দ্রনাথ হাইস্কুলের শিক্ষা সপ্তাহটিতে একদিকে ছিল আনন্দময় শিক্ষার প্রাচুর্য, অন্যদিকে ছিল প্রাণাবেগের চাঞ্চল্য। আবৃত্তি, গান, গল্পবলা, তাৎক্ষণিক বক্তৃতা, বিতর্ক, প্রবন্ধ রচনা—এ সব বিষয়ের প্রতিযােগিতায় সপ্তাহের প্রতিটি দিনই থাকতাে জমজমাট। সেই সঙ্গে বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযােগিতা। সপ্তাহের শেষ দিনে পুরস্কার বিতরণের অনুষ্ঠান। এ অনুষ্ঠানটির আগে স্কুলের বার্ষিক সভা—এ্যানিভার্সারি মিটিং। এ্যানিভার্সারি মিটিং কথাটাই যে কী করে ইউনিভার্সিটি মিটিং-এ পরিণত হয়ে গিয়েছিল তা আজো আমার কাছে দুর্বোধ্য রয়ে গেছে। বাবাই আমাকে শুদ্ধ শব্দটি ও এর অর্থ বলে দিয়েছিলেন। এই এ্যানিভার্সারি মিটিংয়ে স্কুলের রেক্টার (তখন নেত্রকোনার অনেক হাইস্কুলেরই প্রধান শিক্ষককে বলা হতাে ‘রেক্টার) সুখরঞ্জন রায় প্রতি বছর যে বার্ষিক প্রতিবেদন পাঠ করতেন সেগুলাে হয়ে উঠতাে শিক্ষা ও সমাজনীতির ব্যাখ্যাসমৃদ্ধ মৌলিক প্রবন্ধ। এই সুখরঞ্জন রায় যে ছিলেন অনেক বড়াে মাপের মানুষ, সে কথা তখন জানতে পারিনি। পরে জেনেছি: সুখরঞ্জন রায় এক সময় ছিলেন ইংরেজি সাহিত্যের অধ্যাপক, শান্তিনিকেতনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্কে যুক্ত ও রবীন্দ্রনাথের স্নেহধন্য। তিনি কবি ছিলেন, তাঁর কবিতা রবীন্দ্রনাথেরও প্রশংসা লাভ করেছিল। তার মৃত্যুর পর আবিষ্কৃত হয়েছে যে, রবীন্দ্রনাথের গল্প-উপন্যাস বা কথাসাহিত্যের তিনিই ছিলেন প্রথম মূল্যায়নকারী বা সমালােচক। তার সমালােচনা-প্রবন্ধগুলাে বিশের দশকের গােড়ার দিকে বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় ছাপা হয়েছিল। সত্তরের দশকে সেগুলাে সংগ্রহ করে তাঁর পুত্র কলকাতা থেকে রবীন্দ্র কথাকাব্যের মূল সূত্র’ নামে একটি বই প্রকাশ করার পরই কেবল সাহিত্যিক ও সমালােচক মহল সুখরঞ্জন রায়ের অসাধারণ অবদান সম্পর্কে সচেতন হয়ে উঠেছেন।
১০৫
এহেন সুখরঞ্জন রায় যে কেন কলকাতা বা শান্তিনিকেতনের বুধমণ্ডলীর সংস্পর্শ ছেড়ে নেত্রকোনার মতাে মফস্বল শহরে স্বেচ্ছানির্বাসন বরণ করে নিলেন ও স্কুল মাস্টারি করে কাটিয়ে দিলেন শেষ জীবনের প্রায় সবক’টি বছর, কেন তিনি স্কুলের চৌহদ্দির বাইরের আর সব সামাজিক কর্মকাণ্ড থেকে নিজেকে গুটিয়ে নিলেন, কী এক প্রচণ্ড অভিমান বুকে পুষে রেখেছিলেন আমৃত্যু—সে-সব রহস্য কেউই উদঘাটন করতে পারেনি।
আমার সৌভাগ্য, আমি এই অসাধারণ গুণী মানুষটির কাছে সাহিত্যের পাঠ নিতে পেরেছিলাম। আমাদের ক্লাস সিক্স-এ তিনি ইংরেজি গল্প পড়াতেন। এখনকার হেড মাস্টার বা প্রিন্সিপালরা মােটেই শিক্ষক নন, প্রশাসক মাত্র। সে সময় কিন্তু তাঁরা প্রথমে ছিলেন শিক্ষক, পরে প্রশাসক। সুখরঞ্জন রায় ক্লাস ফোর থেকে টেন পর্যন্ত প্রতিটি ক্লাসেই পড়াতেন। স্কুলের সব ছাত্রই তাঁকে তাদের শিক্ষক হিসেবে পেতাে।
চমৎকার নাটিকা রচনা করে তিনি ইস্কুলের ছাত্রদের দিয়ে অভিনয় করাতেন। পুরস্কার বিতরণের অনুষ্ঠানে সেই নাটিকাগুলােরই ছিল সবচেয়ে বেশি আকর্ষণ।
খুবই সুন্দর একটি অ্যাকাডেমিক পরিবেশ ছিল চন্দ্রনাথ হাইস্কুলে। কিন্তু আটচল্লিশের ফেব্রুয়ারি মাসে এই স্কুলে ভর্তি হয়ে সুন্দরের ওপর দিয়ে কুৎসিতের দুষ্ট হাওয়া বয়ে যেতে দেখলাম। সেই হাওয়াটি পাকিস্তান ও সাম্প্রদায়িকতার। না, নগণ্য সংখ্যক মুসলমান ছাত্ররা সেখানে পাকিস্তানী বা সাম্প্রদায়িক হাওয়া ছড়াতে পারেনি। হিন্দু ছাত্ররাই মুসলমানের অনুপস্থিতিতে প্রাণ খুলে সাম্প্রদায়িক কথাবার্তা বলে যেতাে। এ-সব কথাবার্তা অবিশ্যি তাদের বাড়িতে শােনা অভিভাবকদের কথাবার্তারই প্রতিধ্বনি। এবং সেই সঙ্গে যন্ত্রণারও অভিব্যক্তি। পাকিস্তান যে হিন্দু সম্প্রদায়ভুক্ত কিশােরদের মনেও কী রকম নিরাপত্তাহীনতার যন্ত্রণা সঞ্চার করে দিয়েছিল তারই প্রকাশ ঘটতাে তাদের ক্ষুব্ধ আলাপনে। মুসলমানের পাকিস্তানে কোনাে মতেই থাকা যাবে না, আমাদের সবাইকে চলে যেতে হবে হিন্দুস্থানে, অমুকরা অমুক দিন হিন্দুস্থানে রওয়ানা হয়ে যাবে, অমুকের বাবা হিন্দুস্থানে বাড়ি কিনতে গিয়েছেন—এ রকম কথারই বলাবলি চলতাে সারাক্ষণ। সেই সঙ্গে পাকিস্তান ও মুসলমান সম্পর্কে নানা খিস্তি খেউড় আর জিন্নাহর নাম নিয়ে ব্যঙ্গ বিদ্রুপও। তবে পাকিস্তান বা জিন্নাহ সম্পর্কে কোনােরূপ কটু মন্তব্য যে প্রকাশ্যে করা যায় না, এ জ্ঞান যে কোনাে বালক কিশােরেরও ছিল। পাকিস্তান হলাে মুসলমানের রাষ্ট্র আর জিন্নাহ সেই পাকিস্তানের পিতা। পাকিস্তানি কোনাে মুসলমান বালকও যে পিতৃনিন্দা সহ্য করবে না, এতাে জানা কথাই। পাকিস্তান, মুসলমান ও জিন্নাহ তখন প্রায় একার্থবােধক। তাই হিন্দু বালকরা এদের নিয়ে কথা বলতাে খুবই সন্তর্পণে, কোনাে মুসলমান বালক বা বয়স্ক মানুষের উপস্থিতির সঙ্গে সঙ্গে তারা কথা বন্ধ করে দিতে বা কথার মােড় ঘুরিয়ে ফেলতাে।
কিন্তু এরই মধ্যে হঠাৎ একদিন অন্যরকম অভাবিতপূর্ব হাওয়া বয়ে গেলাে ।
বাঘা শিক্ষক উমেশ বাবু ইংরেজির ক্লাস নিচ্ছেন। হঠাৎ ক্লাস নাইন টেনের একদল ছাত্র ‘মে উই কাম ইন স্যার’ বলে স্যারের ‘ইয়েস’ বলার অপেক্ষা না করেই হুড়মুড় করে ক্লাসে ঢুকে পড়লাে। ক্লাস নাইনের একজন নেতাগােছের ছাত্র বক্তৃতার ঢঙে বলতে লাগলাে, “ভাইসব, ঢাকার রাস্তায় পুলিশ ছাত্রমিছিলে হামলা করেছে, টিয়ার গ্যাস ছুঁড়েছে, বহু ছাত্র জখম হয়েছে। ছাত্রদের কোনােই অপরাধ ছিল না। তারা শুধু বলেছিল রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’। আমরা বাঙালি, বাংলাই আমাদের রাষ্ট্রভাষা হবে। কিন্তু পশ্চিমারা তা মানে না, তারা আমাদের ওপর উর্দু ভাষা চাপিয়ে দিতে চায়। আমরা এ-অন্যায় কিছুতেই সহ্য করবাে না।… তােমরা
১০৬
সকলে বেরিয়ে এসাে, আমরা পুলিশের জুলুমের প্রতিবাদে রাস্তায় মিছিল করবাে। বলাে— রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’ ‘পুলিশের জুলুম বন্ধ করাে’…”
গগনবিদারী স্লোগান দিতে দিতে স্যারকে ক্লাসে রেখেই আমরা রাস্তায় বেরিয়ে এলাম। আঞ্জুমান ও দত্ত হাইস্কুলের ছাত্ররাও বেরিয়ে এসেছে। বিশাল ছাত্র মিছিল নেত্রকোনা শহরের রাস্তা কাঁপিয়ে তুললাে। থানার সামনে এসে পুলিশের জুলুম বন্ধ করাে’ স্লোগানটিতে যেন আরাে বেশি জোর লাগলাে। পুলিশরা ভাবলেশহীন চোখে থানার বারান্দায় দাঁড়িয়ে রইলাে।
মিছিল শেষে সভা। তখন নেত্রকোনায় কলেজ ছিল না। ইস্কুলের ক্লাস নাইন টেনের ছাত্ররাই নেতা। আঞ্জুমান, দত্ত হাই ও চন্দ্রনাথ হাইস্কুলের সব নেতাই বক্তৃতা দিলেন। সকলের বক্তৃতাতেই আগুন ঝরলাে। কিছু খবরও বেরিয়ে এলাে তাদের বক্তৃতা থেকে। জিন্নাহ সাহেব ঢাকায় এসে বলেছেন, উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা। ছাত্ররা তার মুখের ওপর প্রতিবাদ করেছে।…জিন্নাহকে আমরা কায়েদে আজম’ বলি, জাতির পিতা বলি। কিন্তু রাষ্ট্রভাষা সম্পর্কে তিনি যা বলেছেন তা কোনাে মতেই জাতির পিতার উপযুক্ত নয়। বাঙালি জাতির মুখের ভাষা কেড়ে নিয়ে তিনি জাতির পিতা থাকতে পারেন না, কায়েদ আজম থাকতে পারেন না।…জিন্নাহই হােন আর যেই হােন, বাংলা ভাষার কোনাে বিরুদ্ধচারীকে বাঙালি ক্ষমা করবে না। বাঙালি বুকের রক্ত দিয়ে বাংলা ভাষার বিরুদ্ধে সকল ষড়যন্ত্রকে রুখে দাঁড়াবে। বাংলা অবশ্যই রাষ্ট্র ভাষা হবে। আবার যদি ছাত্রমিছিলে হামলা চলে তবে সারা দেশে আগুন জ্বলবে।
জিন্নাহর বিরুদ্ধে যে প্রকাশ্যে কেউ মৃদুকণ্ঠে ও মােলায়েম ভাষাতেও কোনাে কথা বলতে পারে, এটা তাে এক ঘণ্টা আগেও আমি ভাবতে পারিনি। জিন্নাহর বিরুদ্ধে কথা বলা আর পাকিস্তানের বিরােধিতা করা তাে একই কথা! জিন্নাহর বিরুদ্ধে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে তাে এতােদিন চুপি চুপি কথা বলেছে হিন্দু ছাত্ররা, তাদের অভিভাবকরা। আর আজ মুসলমান ছাত্ররাও প্রকাশ্যে জিন্নাহর সমালােচনা করছে। তাদের অভিভাবকরাও সে সমালােচনায় গলা মেলাচ্ছেন। সভায় মিছিলে রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’য়ের সঙ্গে পাকিস্তান জিন্দাবাদ’ স্লোগানও দেয়া হচ্ছে বটে, কিন্তু আমরা পাকিস্তানি’ এ কথার চেয়ে বেশি করে বলা হচ্ছে আমরা বাঙালি, বাংলা আমাদের রাষ্ট্রভাষা’। সেদিনের সেই মিছিল আর সভা আমার মনে কী এক ভালাে লাগার অনুভূতি যে সঞ্চার করে দিয়েছিল সেটি আমি কাউকে বর্ণনা করে বােঝাতে পারবাে না। এক বছর আগে গাবতলি বাজারে পল্লী কবি ইউনুস আলীর কবিতা শুনে যে অনুভূতি জেগেছিল, এক বছর পরে সেই অনুভূতিটাই যেন আবার নতুন করে ফিরে পেলাম। না, এ দেশটি শুধু মুসলমানের নয়, এদেশটি আমারও, আমি বাঙালি, বাংলা আমার মাতৃভাষা, রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই। আহ, কী যে আনন্দ!
আটচল্লিশে আমি নিতান্তই অল্পবয়সী এক কিশাের ছাত্র। তবু যে সে-সময়ে মিছিলে ও সভায় রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’ স্লোগানে গলা মেলাতে পেরেছিলাম তার জন্যে আজও আমি প্রবল গর্ব অনুভব করি। এখন মনে হয় : যে জিন্নাহ সাহেব পাকিস্তানের জন্মদাতা, সেই জন্মদাতাই আটচল্লিশের মার্চে ‘উর্দুই পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হবে’ বলে এ রাষ্ট্রটির মৃত্যুবীজও আপন হাতে রােপণ করে গিয়েছিলেন বাংলাদেশের ঢাকায় এসে।
১০৭
পাকিস্তানের জনকের মৃত্যু ও তারপর
ঢাকায় এসে রাষ্ট্রভাষা প্রশ্নের উপলক্ষে পাকিস্তানের মৃত্যুবীজ রােপণ করে করাচিতে ফিরে গিয়ে ছ’মাসের মাথাতেই মৃত্যুবরণ করলেন পাকিস্তানের জাতির পিতা।
খবরটা নেত্রকোনায় এসে পৌঁছেছিল সম্ভবত তাঁর মৃত্যুর পরদিন, অর্থাৎ ১২ সেপ্টেম্বর, ১৯৪৮। আমরা দলবেঁধে স্কুলে যাচ্ছিলাম। আমি একটু পেছনে পড়ে গিয়েছিলাম। আমার পনেরাে/বিশ হাত দূরে ছিল বিমান, প্রাণেশ ও দেব্রত। একজন দাড়িওয়ালা লােককে ওদের সঙ্গে কথা বলতে দেখলাম। হঠাৎ আমার দিকে ফিরে উল্লাসে চিৎকার করে উঠলাে প্রাণেশ, “শুনেছিস, জিন্নাহ্ মরে গেছে!” আমি তাড়াতাড়ি পা চালিয়ে ওদের সামিল হলাম। ওরা এক সঙ্গে কক করে উঠলাে ‘জিন্নাহ্ মরেছে! জিন্নাহ্ মরেছে!’ দাড়িওয়ালা ভদ্রলােকটি মৃদুস্বরে অথচ তিরস্কারের ভঙ্গিতে এ-রকম উল্লাস প্রকাশ করতে কিশাের ছাত্রদের বারণ করে ধীরে ধীরে চলে গেলেন। আমরাও সঙ্গে সঙ্গে সংযত হয়ে গেলাম। বিষয়টির গুরুত্ব ও গাম্ভীর্য উপলব্ধি করতে আমাদের একটুও দেরি হলাে না। সারা রাস্তায় আমরা আর একটিও কথা বলিনি।
স্কুলে গিয়েও দেখলাম সবাই গম্ভীর। ছাত্র ও শিক্ষকদের কেউই কোনাে কথা বলছেন না। একটু পরেই স্কুলের বারান্দায় খুবই সংক্ষিপ্ত একটি শােকসভার অনুষ্ঠান হলাে। রেক্টার সুখরজ্জন রায় ছােট্ট একটি বক্তৃতায় সদ্য প্রয়াত জিন্নাহর প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করলেন। তার বক্তৃতার একটি শব্দ ব্যবহার আমার কাছে খুব চমৎকার লাগলাে। কর্ণধার। শব্দটির অর্থ জানতাম—‘নৌকার মাঝি’ । কিন্তু জিন্নাহকে যখন স্যার ‘পাকিস্তান রাষ্ট্রের কর্ণধার’ বলে উল্লেখ করলেন, তখন সেই বয়সে আমার কাছে এটি একান্তই অভিনব বলে মনে হয়েছিল। ‘পাকিস্তান’ হচ্ছে একটি নৌকা, আর জিন্নাহ ছিলেন তার মাঝি, এখন সেই মাঝিটি মারা গেলেন, নৌকাটি মাঝ গাঙে—এ-রকম একটি দৃশ্য আমার চোখে ভেসে উঠেছিল।
কর্ণধারের মৃত্যুতে পাকিস্তান নামক রাষ্ট্র তরণীর যাত্রীদের মধ্যে প্রবল শােকাবেগ দেখা দিয়েছিল। শােকাবেগের সঙ্গে সাম্প্রদায়িক আবেগও নতুন করে জেগে উঠেছিল। কিংবা বলা যায়, সুপরিকল্পিতভাবে তা জাগিয়ে তােলা হয়েছিল। বলা হচ্ছিল: জিন্নাহর মৃত্যুতে শিশু রাষ্ট্র পাকিস্তান অসহায় হয়ে গেছে মনে করে হিন্দুস্থান এ-রাষ্ট্রটির ক্ষতি করার জন্যে এই মুহূর্তেই উঠে পড়ে লেগে যাবে। আর হিন্দুস্থানের বর্ণচোরা এজেন্ট যে বিধর্মীরা, তারা তাে পাকিস্তানের শহর-গ্রামের সর্বত্রই ছড়িয়ে রয়েছে। এদের সম্পর্কে সকল মুসলমানকেই সজাগ থাকতে হবে, নিজেদের ভেতরকার কলহ-বিবাদ দূর করে ফেলতে হবে। আল্লাহর রহমতে আমরা পাকিস্তান পেয়েছি, আল্লাহর রহমতেই সেই পাকিস্তান টিকেও থাকবে। আমাদের জাতির পিতা কায়েদে আজম তাে বলেই গিয়েছেন পাকিস্তান টিকে থাকার জন্যে এসেছে। কায়েদে আজমের কথা মিথ্যা হতে পারে না। তার ওয়ারিস আমরা রক্ষা করবােই।
আনুষ্ঠানিক স্মরণ সভায় কিংবা চায়ের দোকানের আড্ডায় সর্বত্রই এ-ধরনের কথা শােনা যেতাে।
হিন্দুরা এ-সময়ে কথাবার্তায় আগের চেয়ে আরাে বেশি সতর্ক হয়ে উঠলাে। কারণ, জিন্নাহর পাকিস্তানে দেশপ্রেমের মনােপলি দাবি করতাে যারা তারা সময়ে-অসময়ে প্রাসঙ্গিক বা অপ্রাসঙ্গিকভাবে হিন্দুদের দেশপ্রেম সম্পর্কে কটাক্ষ করে বসতাে। সাধারণ হিন্দুরা এর কোনাে প্রতিবাদ করতাে না। তারা বরং কচ্ছপের মতােই নিজের ভেতরে নিজেকে গুটিয়ে নিলাে।
১০৮
যদিও দেশপ্রেমের অনির্বাণ অগ্নিশিখা বুকের গভীরে তারা জ্বালিয়ে রেখেছিল, তবু সেঅগ্নিশিখাকে সঙ্গে নিয়েই দেশত্যাগের প্রস্তুতি নিতে লাগলাে, দেশপ্রেমের ব্যাপারে প্রতিপক্ষকে চ্যালেঞ্জ জানাবার কোনাে গরজই বােধ করলাে না। এর একটা বড়াে কারণ এই যে, দেশের প্রতি ভালােবাসা থাকলেও পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রটিকে ভালােবাসা কোনাে হিন্দু কিংবা যেকোনাে অমুসলমানের পক্ষেই ছিল অসম্ভব। মুসলমানের রাষ্ট্র বলে যা ঘঘাষিত, মুসলমানের তাহজিব তমদ্দুন রক্ষার উদ্দেশ্যে সাম্প্রদায়িক ঘৃণা ও রক্তপাতের মধ্য দিয়ে জন্ম যে-রাষ্ট্রের, সে-রাষ্ট্রকে কোনাে অমুসলমান নিজের বলে ভাববে কোন্ যুক্তিতে? অমুসলমান এ-রাষ্ট্রে বাস করতে পারে মুসলমানের করুণার ওপর নির্ভর করে,—নিজের অধিকারের বলে নয়। সংখ্যালঘু অমুসলমানরা পাকিস্তানে সংখ্যাগুরু মুসলমানের পবিত্র আমানত’—নেতারা তাে এমন কথা প্রকাশ্যেই বলতেন। এবং এ-রকম বলে উদারতার পরাকাষ্ঠা প্রদর্শন করছেন ভেবে আত্মপ্রসাদে স্ফীত হতেন। কিন্তু এর দ্বারা তারা যে একটি জনগােষ্ঠীকে মর্মান্তিক অপমান করছেন তা বুঝতেও চেষ্টা করতেন না। পবিত্র আর অপবিত্র যাই হােক না কেন, কারাে ‘আমানত হওয়া যে সম্মানের পরিচায়ক নয়,—এ-কথা বােঝার জন্যে খুব বেশি বুদ্ধির প্রয়ােজন নিশ্চয়ই পড়ে না। যে রাষ্ট্রের জন্মের ফলে নিজের জন্মভূমিতে অন্যের আমানত হয়ে যেতে হয় একটি গােটা সম্প্রদায়কে, সেই সম্প্রদায়ের মানুষগুলাে সেই অধিকারহরণকারী রাষ্ট্রটিকে প্রাণ ভরে ভালােবাসতে থাকবে—এ-রকম আশা করাই বাতুলতা মাত্র । হিন্দুরা তাে, সে কারণে, অত্যন্ত স্বাভাবিকভাবেই পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার বিরােধিতা করে এসেছে। প্রতিষ্ঠিত পাকিস্তান তাদের যন্ত্রণাবিদ্ধ করেছে। যন্ত্রণাবিদ্ধ হয়ে এ-রাষ্ট্রটির প্রতি তাদের বিরূপতা ক্রমাগত বেড়েই গিয়েছে। তাই, পাকিস্তানের হিন্দুদের বিরুদ্ধে উত্থাপিত রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযােগকে আমি সত্য বলেই বিশ্বাস করি। তবে তাদের রাষ্ট্রদ্রোহিতা মােটেই সকর্মক ছিল না। তবু, একান্ত অকর্মক হলেও পাকিস্তানে এদের অবস্থানকে কেউ রাষ্ট্রবিরােধী বলে চিহ্নিত করলেও করতে পারেন। কিন্তু যারা তাদের দেশপ্রেম সম্পর্কে প্রশ্ন তােলে, তারা হয় মতলববাজ, নয় আহাম্মক। যে-কোনাে সম্প্রদায়ের যে-কোনাে মানুষই দেশপ্রেমিক বা দেশবিদ্রোহী হতে পারে। এ-দেশেও সে-রকমই হয়েছে। অথচ, এ-বিবেচনাকে আড়াল করে একটি গােটা সম্প্রদায়কে যারা দেশপ্রেমহীনতার অপবাদ দেয়, তারা কিছুতেই স্বদেশের কল্যাণকামী হতে পারে না। তারাই তাে আসল দেশদ্রোহী। রাষ্ট্রদ্রোহিতা আর দেশদ্রোহিতা সব সময় সমার্থক নয়। অন্তত পাকিস্তান নামক একটি অমানবিক ও কৃত্রিম রাষ্ট্রে রাষ্ট্রদ্রোহী না হয়ে দেশপ্রেমিক হওয়ার কোনাে উপায়ই ছিল না।
দেশপ্রেমিক ও স্বাধীনতা-সংগ্রামী বেশ কিছু কংগ্রেস নেতা পাকিস্তানে থেকে গিয়েছিলেন। এই রাষ্ট্রটি একটি আধুনিক রাষ্ট্রে পরিণত হােক—এমনটিই তাঁরা কামনা করেছিলেন। এঁদের মধ্যে কুমিল্লার ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত আর ময়মনসিংহের মনােরঞ্জন ধরের নাম বারবারই মনে পড়ে। জিন্নাহ সাহেব পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার তিন দিন আগেই (১১ আগস্ট, ১৯৪৭) ধর্মকে নিতান্ত ব্যক্তিগত বিশ্বাসের ব্যাপার বলে ঘােষণা করেছিলেন, এবং সকল সম্প্রদায়ের মানুষের জন্যে সমান নাগরিক অধিকারের নিশ্চয়তার কথা বলেছিলেন। ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত বা মনােরঞ্জন ধরের মতাে প্রকৃত স্বদেশপ্রেমিক নেতৃবৃন্দ জিন্নাহ সাহেবের বক্তব্যে আস্থা স্থাপন করতে চেয়েছিলেন। সেই আস্থা থেকেই তারা চেয়েছিলেন যে পাকিস্তানে সাম্প্রদায়িকতার অবসান ঘটুক, এখানে মানবিকতার প্রতিষ্ঠা হােক, মধ্যযুগীয় থিয়ােক্রেটিক রাষ্ট্রের বদলে দেশের রাষ্ট্রব্যবস্থাটি
১০৯
সেকুলার ও আধুনিক হয়ে উঠুক। কিন্তু তাঁদের সদিচ্ছা ব্যর্থ ও প্রত্যাখ্যাত হলাে। পাকিস্তানের জন্মের পর এ-রাষ্ট্রটির জনক-বলে-কথিত জিন্নাহ সাহেব মাত্র এক বছর জীবিত ছিলেন। কিন্তু এই এক বছরের মধ্যেই অনেক রকম স্ববিরােধিতার পরিচয় দিয়ে তিনি তাঁর বিশ্বাসযােগ্যতা নষ্ট করে ফেলেছিলেন। তিনি এবং তাঁর সরকার সৎ নাগরিকদের সত্যনিষ্ঠা ও দেশপ্রেমের কানাকড়িও মূল্য দেননি। বিশেষ করে হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষদের জন্যে দেশকে ভালােবাসার কথা বলাও যেন পাকিস্তানে নিষিদ্ধ হয়ে গিয়েছিল। তাই দেখি, পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষদের মুখের ভাষা বাংলাভাষার মর্যাদা দানের কথা বলায় ধীরেন দত্ত পান ‘পাকিস্তানের দুশমন’ আখ্যা। পাকিস্তানের গণপরিষদের সদস্যদের হয় উর্দুতে নয় ইংরেজিতে বক্তৃতা করতে হবে—এমন একটি বিধান ছিল। ১৯৪৮ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি ধীরেন দত্ত এর সঙ্গে বাংলাকেও সরকারি ভাষা করার প্রস্তাব করে একটি সংশােধনী আনেন। সংশােধনীটির বিরােধিতা করে পরিষদের নেতা লিয়াকত আলী খান বলেছিলেন, “পাকিস্তান মুসলিম রাষ্ট্র। তাই পাকিস্তানের ভাষা মুসলিম রাষ্ট্রের ভাষাই হওয়া উচিত। প্রথমে সংশােধন-প্রস্তাবের উদ্দেশ্য নির্দোষ বলে আমি মনে করেছিলাম। প্রস্তাবে বাংলাকে পরিষদের ভাষার অন্তর্ভুক্ত করার ইচ্ছা প্রকাশ করা হয়েছিল। কিন্তু এখন মনে হয় পাকিস্তানের মানুষদের মধ্যে বিরােধ সৃষ্টি করা, একটা সাধারণ ভাষার দ্বারা ঐক্যসূত্র স্থাপনের প্রচেষ্টা থেকে মুসলমানদের বিচ্ছিন্ন করাই প্রস্তাবের উদ্দেশ্য।”
বাংলার অধিবাসী খাজা নাজিমুদ্দিন সহ পাকিস্তান গণ-পরিষদের অনেক সদস্যই ধীরেন দত্তের একান্ত সঙ্গত ও দেশপ্রেম মূলক প্রস্তাবটি সম্পর্কে অনেক ইতরতা-দুষ্ট সাম্প্রদায়িক ইঙ্গিত করেন। এরপর জিন্নাহ সাহেবও ঢাকায় এসে বাংলাকে সরকারি ভাষা করার দাবিদারদের সম্পর্কে এ-রকম ইঙ্গিতই করেছিলেন। তাঁর ভাষায় (তৎকালীন ‘আজাদ পত্রিকার বয়ান অনুসারে) “অতীতে যাহারা মুসলমানদের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা করিয়াছে অথবা পাকিস্তানের বিরুদ্ধে বিশ্বাসঘাতকতা করিয়াছে অথবা পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ভােট দিয়াছে, তাহারাই আজ হঠাৎ আপনাদের ন্যায়সঙ্গত অধিকারের ত্রাণকর্তা হইয়া উঠিয়াছে এবং ভাষার প্রশ্ন লইয়া গবর্নমেন্টকে অমান্য করার জন্যে উস্কানি দিতেছে। অথচ এই পাকিস্তানই হইতেছে আপনাদের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকারের মূল ভিত্তি।…এসব পঞ্চম বাহিনী সম্পর্কে আপনাদের সাবধান করিয়া দিতেছি।”
জিন্নাহর বক্তব্যে সেকালের পূর্ববাংলায় ছাত্র ও বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে প্রচণ্ড অসন্তোষ সৃষ্টি হয়েছিল যদিও, তবু তাঁর মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে, সাময়িকভাবে হলেও, সে-অসন্তোষ থিতিয়ে যায়। তাঁর শােকসভাগুলােতে বরং বিপরীত ধরনের আবেগেরই প্রবল প্রকাশ ঘটে।
ময়মনসিংহের বিপিন পার্কে অনুষ্ঠিত এ-রকম একটি শােকসভারই কৌতুককর বিবরণ শুনেছিলাম প্রবীণ আইনজীবী ও বিশিষ্ট বিদ্বান সুরেন ভৌমিকের মুখে। ময়মনসিংহ বারেরই একজন হিন্দু উকিল’ সে-সভায় বক্তৃতা দিতে গিয়েছিলেন। ওই ভদ্রলােকের যে-কোনাে বক্তৃতায় উচ্ছ্বাসের প্রাবল্য থাকতাে। ইংরেজিতে বক্তৃতা দিতেই তিনি বিশেষ স্বাচ্ছন্দ্য বােধ করতেন। বাংলায় বক্তৃতা দিতে গেলেও তিনি অনেক ইংরেজি ইডিয়মের এমন অনুবাদ করতেন যা শ্রোতাদের মধ্যে বেশ হাস্যরসের সঞ্চার ঘটাতাে। কিন্তু জিন্নাহর শােকসভায় বক্তৃতা তার জন্যে হাস্যরসের বদলে করুণ পরিণতি নিয়ে এলাে। গীতার একটি শ্লোক দিয়ে বক্তৃতা শুরু করে জিন্নাহ সম্পর্কে দুয়েকটি উচ্ছাসপূর্ণ বাক্য উচ্চারণের পরই তিনি বলতে
১১০
লাগলেন, ‘জিন্নাহ ছিলেন একজন… জিন্নাহ ছিলেন একজন…। বােঝা যাচ্ছিল; জুৎসই বাংলা শব্দটি তিনি খুঁজে পাচ্ছেন না। শব্দ হাতড়াতে হাতড়াতে হঠাৎ বলে উঠলেন ‘জিন্নাহ ছিলেন একজন দৈত্য’। আর যায় কোথায়! শ্রোতাদের কে একজন চিৎকার করে উঠলাে কী, জিন্নাহকে দৈত্য বললাে? এতাে বড়াে অপমান। ব্যাটার সাহস তাে কম নয়। ধর ব্যাটা মালাউনকে।
মরহুম জাতির পিতার অপমানে বহু শ্ৰোতাই ক্ষিপ্ত হয়ে উঠে বক্তাকে ধাওয়া করলাে। তখন জেলা জজ না আর কে একজন কোন রকমে নিজের গাড়িতে তুলে নিয়ে তাকে বাড়িতে পৌছিয়ে দেন, এবং এভাবেই জনতার ক্রোধ থেকে সেদিন তিনি রক্ষা পান।
উনিশ শাে পঁয়ষট্টি সালের দিকে সুরেন বাবু ওই ঘটনাটি রসিয়ে রসিয়ে বর্ণনা করে বলছিলেন, “আসলে ইংরেজি জায়েন্ট’ শব্দটারই বাংলা করে ওই উকিল বক্তা জিন্নাহকে। দৈত্য’ আখ্যা দিয়ে সম্মান জানাতে চেয়েছিলেন। কিন্তু ফল হলাে উল্টো। এতে সম্মানের বদলে অপমান করা হয়েছে ভেবেই সে-সভার জিন্নাহ ভক্ত শ্রোতারা উত্তেজিত হয়ে উঠে বক্তাকে আক্রমণ করতে গিয়েছিল।”
আমার মনে পড়লাে: ব্রিটিশ সাংবাদিক বিভার্লি নিকলসের ‘ভার্ডিক্ট অন ইন্ডিয়া’ বইয়ের একটি অধ্যায়েরই শিরােনামই ছিল ‘ডায়ালােগ উইথ এ্যা জায়েন্ট’। জিন্নাহকেই সেখানে নিকস্ সাহেব বিমুগ্ধ চিত্তে জায়েন্ট’ আখ্যা দিয়েছিলেন। অথচ সেই জায়েন্টকেই বাংলায় দৈত্য’ বলে ময়মনসিংহের এক ‘হিন্দু উকিল’-এর ঘটলাে মারাত্মক বিপত্তি।
তবে ওই উকিল বাবুর জন্যে যতাে বিপত্তিকরই হােক না কেন, পাকিস্তানের জনকের মৃত্যু-পরবর্তী বছর খানেক, কিংবা তার চেয়ে কিছু বেশি সময়, রাষ্ট্রটি ছিল বিপদমুক্ত। পর্দার অন্তরালে প্রাসাদ ষড়যন্ত্র চললেও সাধারণ জনতা ছিল প্রায় প্রশান্ত। জাতির পিতার বিয়ােগজনিত শােকাবেগকে অত্যন্ত নিপুণতার সঙ্গে কাজে লাগিয়েই পাক শাসকরা গণঅসন্তোষকে বেশ কিছু দিনের জন্যে ধামাচাপা দিয়ে রাখতে পেরেছিল।
হিন্দুদের দেশত্যাগ ও মানসিক যন্ত্রণা
নেত্রকোনার চন্দ্রনাথ হাইস্কুলটি আমার খুবই ভালাে লেগে গিয়েছিলাে। এ-স্কুলের ‘ডিসিপ্লিন’ যেমন কড়া, গানে-গল্পে-অভিনয়ে-খেলাধুলায় এখানকার প্রতিটি দিন ছিল তেমনি মিঠে। খবর নিয়ে জেনেছি: এ-রকম মিঠেকড়া পরিবেশ আশপাশের কোনাে স্কুলেই ছিল না। চন্দ্রনাথ স্কুলে কোনাে ছাত্র ইচ্ছেমতাে ক্লাস কামাই করতে পারতাে না। একদিন ক্লাসে না গেলেই এক আনা (এখনকার ছয় পয়সা) জরিমানা। উপযুক্ত কারণ দেখিয়ে দরখাস্ত করলে অবিশ্যি জরিমানা থেকে রেহাই পাওয়া যায়, তবে সে-দরখাস্তের এক পাশে অভিভাবককে ‘বিবরণ সত্য’ লিখে দস্তখত দিতে হতাে। কোনাে ছাত্র অভিভাবকের দস্তখত নকল করে ধরা পড়ে গেলে তার জন্য ছিল কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা। তবে, সাধারণত কোনাে ছাত্রই বিনা কারণে ক্লাস কামাই করতে চাইতাে না। অনেক ছাত্র বরং সারা বছরের প্রতিটি ক্লাসে হাজির থাকতে চেষ্টা করতাে, কারণ এ-রকম উপস্থিতির জন্য বছর শেষে পাওয়া যেতাে লােভনীয় পুরস্কার। চন্দ্রনাথ হাইস্কুলের মতাে এতাে বেশি পুরস্কারের ব্যবস্থা বােধ হয় আর কোনাে স্কুলেই ছিল না। খেলাধুলা, গান আবৃত্তি, বক্তৃতা, অভিনয়, গল্পবলা ইত্যাদি বিষয়ে কৃতিত্বের জন্য যেমন পুরষ্কার মিলতাে,
১১১
তেমনি পরীক্ষায় ভালাে ফলের জন্যও ছিল অনেকগুলাে পুরস্কার। বার্ষিক পরীক্ষায় প্রথম থেকে পঞ্চম স্থান অধিকারী পর্যন্ত সবাই পুরস্কার পেতাে। প্রত্যেক বিষয়ে সর্বোচ্চ নম্বরপ্রাপ্ত ছাত্রের জন্যও ছিল পুরস্কার পাওয়ার সুযােগ। এর পরও ছিল ক্লাসে ভালাে হাজিরা আর গুড কন্ডাক্ট বা সদাচরণের জন্য পুরস্কার। এতাে সব পুরস্কার যে-স্কুলে হাতছানি দিয়ে ডাকে, সে-স্কুলে ক্লাস কামাই করবে কোন বােকা ছাত্র?
তাছাড়া স্কুলের ক্লাসগুলাে এমনিতেই ছিল দারুণ আকর্ষণীয়। রুটিনে অঙ্ক, বাংলা, ইংরেজি বা এ-রকম অন্যান্য বিষয়ের মতাে খেলাধুলা ও গল্প বলার জন্যও ‘পিরিয়ড’ (ঘন্টা) নির্দিষ্ট করা থাকতাে। আমাদের ক্লাস সিক্স-এ মঙ্গলবারে পঞ্চম ও বুধবারে ষষ্ঠ—এই দুটো পিরিয়ড ছিল খেলাধুলার। এর শিক্ষক ছিলেন উপেন্দ্র সরকার। দৌড় ঝাপের নানা রকম খেলা তিনি শেখাতেন। গল্প বলার ক্লাস হতাে বৃহস্পতিবার দ্বিতীয় পিরিয়ডে । আমাদের ক্লাস টিচার’ রামশঙ্কর সরকারই ওই গল্পের ক্লাসটি নিতেন। (এখানে বলে নিই, যিনি যে-ক্লাশে প্রথম পিরিয়ডে পড়াতেন, তাঁকেই সে-ক্লাসের ক্লাস টিচার’ বলা হতাে। তিনি রােল কল করতেন, ক্লাসের ছাত্রদের ছুটি মঞ্জুর করতেন, অনুপস্থিতি বা অসদাচরণের জন্য তাদের জরিমানা করতেন বা অন্য কোনাে শাস্তি দিতেন। অর্থাৎ প্রতিটি ছাত্রকে নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব বহন করতে হতাে সেই ক্লাসের ক্লাস টিচারকে। চন্দ্রনাথ ইস্কুলে ক্লাস টিচার’-এর ভূমিকা অন্য অনেক স্কুলের চেয়ে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ ছিল।) রামশঙ্কর বাবু ছিলেন সায়েন্স গ্রাজুয়েট । সায়েন্সের শিক্ষা যে তাকে রসকষহীন করে ফেলেনি, তাঁর কাছে পাঠ নিতে গিয়ে আমরা সবাই তা অনুভব করতাম। সাহিত্য ও সঙ্গীতরসেও তার চিত্ত ছিল ভরপুর। বার্ষিক পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে পরিবেশনের জন্য ছাত্রদের সঙ্গীতে তালিম দেয়ার দায়িত্ব তার ওপরই পড়তাে। আমাদের তিনি পড়াতেন অঙ্ক ও ভূগােল। অঙ্কের প্রতি আমর প্রচণ্ড বিরূপতা সত্ত্বেও কী করে যে আমি তার মাত্রাতিরিক্ত স্নেহ আকর্ষণ করে ফেলেছিলাম জানি না। সম্ভবত গল্প বলার ক্লাসে আমার পারফরমেন্স’ তাঁর ভালাে লেগে গিয়েছিল। তবে যে-কারণেই হােক, তার স্নেহের ছায়া আজও আমাকে ঘিরে রেখেছে, এবং এই বুড়াে বয়সেও আমি তার সান্নিধ্যে তেরাে বছরের সেই কিশােরটি হয়ে যাই।
রাম শঙ্কর বাবু ছাড়া, এই নব্বইয়ের দশকে, চন্দ্রনাথ স্কুলে আমার শিক্ষকদের মধ্যে বােধ হয় একমাত্র হরেন্দ্র পাল মহাশয়ই জীবিত আছেন। তিনি আমাদের বাংলা পড়াতেন। ব্যাকরণের মতাে নিতান্ত শুষ্ক বিষয়ের ভেতরেও যে বয়ে চলেছে রসের অন্তহীন প্রস্রবণ, তার সন্ধান আমি প্রথম হরেন্দ্র বাবুর কাছেই পাই। বাংলা ভাষার খুঁটিনাটি দিকের প্রতি তিনিই আমাকে মনােযােগী করে তােলেন। তাঁর পাঠদান-রীতিটি ছিল অত্যন্ত চমৎকার।
আর উমেশচন্দ্র ভদ্র মহাশয় তাে ইংরেজি পড়ানাের বেলায় একটি অভিনব পদ্ধতি অনুসরণ করতেন। একটি পাঠের (লেসন) জন্য তিনি দু’দিন সময় নিতেন। প্রথম দিন পাঠটির ভেতরকার সব বিষয় প্রাঞ্জলভাবে বােঝাতেন। প্রতিটি ইংরেজি শব্দের বাংলা অর্থ ও ইংরেজি প্রতিশব্দ ব্ল্যাক বাের্ডে লিখে দিতেন, সেই সঙ্গে করতেন ব্যাকরণগত আলােচনা। পরের দিন হতাে পূর্ব দিনের পাঠের পরীক্ষা। এই পরীক্ষাটি হয়ে উঠতাে প্রচণ্ড প্রতিযােগিতাপূর্ণ। প্রতিযােগিতায় জিতে পুরস্কার পাওয়া যেতাে হাতে হাতে। পুরস্কারটি আর কিছু নয়—পেছন থেকে সামনে ও বাঁ থেকে ডানে চলে আসা। ক্লাসের সামনের সারির বেঞ্চটির একেবারে ডান দিকের আসনটিতে বসতাে ক্লাসের ফার্স্ট বয়। এর পর ক্রমান্বয়ে সেকেণ্ড থেকে ফিলথ বয়।
১১২
তারপরের বেঞ্চগুলােতে অন্য সবাই নিজেদের ইচ্ছেমতাে। এ-রকমই ছিল উমেশ বাবুর ক্লাসের সমস্ত ছাত্রদের আসন-বিন্যাস। ইংরেজি পাঠের পরীক্ষায় উমেশ বাবু ক্লাসের সমস্ত ছাত্রদের উদ্দেশে একটি প্রশ্ন ছুঁড়ে মারতেন। উত্তরদানে সমর্থ ছাত্ররা হাত তুলতাে। ডান দিকের আসনে বসা ছাত্র যদি উত্তর দিতে না পারতাে, তবে তাকে বয়ে চলে যেতে হতাে, সঠিক উত্তরদাতা বাঁয়ের ছাত্র চলে আসতাে ডানে, পেছনের ছাত্র সামনে। প্রতিযােগিতায় হারজিতের উত্তেজনায় উমেশ বাবুর ক্লাসটি টানটান হয়ে থাকতাে।
পুখুরিয়া গ্রাম থেকে দেড় মাইল রাস্তা হেঁটে গিয়ে আমাকে ক্লাস করতে হতাে। তাই সামনের দিকের বেঞ্চে বসার সুযােগ আমার হতাে না, বসতে হতাে পেছনে। একদিন উমেশ বাবু পাঠ দিচ্ছিলেন PAPER (কাগজ) সম্পর্কে। হঠাৎ প্রশ্ন করে বসলেন, বল তাে, পিইপিপিইআর-PEPPER অর্থ কী?’ ক্লাসের চৌষট্টি জন ছাত্রের সবাই চুপ। কারাে হাত উঠলাে না। একেবারে শেষ বেঞ্চে ছিলাম আমি সামনের বেঞ্চের কাউকে হাত ওঠাতে না দেখে আমি আস্তে আস্তে ডান হাতটা উঁচু করে তুলে ধরলাম। স্যার আমার পাশে চলে এলেন। আমাকে আপাদমস্তক দেখে নিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, তুমি Pepper-এর অর্থ জান?’ আমি বললাম, জানি স্যার,মরিচ। সঙ্গে সঙ্গে স্যার আমার হাত ধরে সামনে নিয়ে এসে প্রথম বেঞ্চের প্রথম আসনটি থেকে ফার্স্ট বয় সুকুমারকে সরিয়ে আমাকে বসিয়ে দিলেন। আরাে কয়েকটি প্রশ্ন করে সন্তোষজনক উত্তর পেয়ে খুব খুশি হলেন। অনেক উপদেশ ও উৎসাহ দিয়ে আমাকে উদ্দীপ্ত করে তুললেন। আর ফার্স্ট বয় সুকুমারকে বললেন, “দেখাে, তােমার প্রতিদ্বন্দ্বী এসে গেছে। শুরু থেকেই হুঁশিয়ার না হলে ফার্স্ট বয়ের আসনটি তােমাকে হারাতে হবে। সারা ক্লাসের ছাত্রদের নজর পড়ে গেলাে আমার ওপর।
আমি গ্রামের প্রাইমারি স্কুল থেকে ক্লাস ফোরের পরীক্ষা পাস করে, এবং ক্লাস ফাইভে কোনাে স্কুলে না পড়েই, শহরের চন্দ্রনাথ হাইস্কুলে ক্লাস সিক্স-এ ভর্তি হয়েছিলাম। আমার মতাে নতুন ছাত্রকে স্কুলের পুরনাে ছাত্ররা মােটেই পাত্তা দিতে চাইতাে না। আমিও এক ধরনের হীনমন্যতা নিয়ে শহুরে ছাত্রদের থেকে দূরে দূরেই থাকতাম। উমেশ বাবুই সেদিন আমার হীনমন্যতা ঘুচিয়ে দিয়েছিলেন। এরপর থেকে ক্লাসে আর আমাকে পেছনের সারিতে বসতে হয়নি, কিংবা কেউ আমাকে হারিয়ে দিয়ে আসনচ্যুত করতে পারেনি। রােজ রােজ ঠিক ঠিক মতাে পড়া শিখে এসে নিজের আসনটি বজায় রাখার জেদ আমার ভেতর চেপে বসেছিল উমেশ বাবুর কাছ থেকে উৎসাহ পেয়েই।
ভীম নাথ (এই নামটি নিয়ে আমরা খুবই কৌতুক করতাম) পড়াতেন ইতিহাস। দারুণ আকর্ষণীয় ভঙ্গিতে তিনি ইতিহাসের গল্প বলে যেতেন। প্রাক্ মুঘল যুগের দিল্লীর সিংহাসনে আসীন ছিলেন যে রাজবংশগুলাে তাদের নামগুলাে মনে রাখার জন্য তিনি আমাদের একটি ইংরেজি বাক্য শিখিয়ে দিয়েছিলেন—Slaves kindly treated serve long. এই বাক্যের পাঁচটি শব্দের প্রত্যেকটি প্রথম অক্ষর মনে করলেই পাঁচটি রাজবংশের পর্যায়ক্রমিক নামগুলাে মনে পড়ে যাবে—স্লেস্ (অর্থাৎ দাস রাজবংশ), খিলজি, তুঘলক, সৈয়দ, লােদি। মুঘল বাদশাহদের নামগুলাের জন্য শিখিয়েছিলেন একটি বাংলা বাক্য—বাবার হইল আবার জ্বর, সারিল ঔষধে। প্রত্যেকটি শব্দের প্রথম অক্ষর অনুযায়ী নামগুলাে—বাবর, হুমায়ুন, আকবর, জাহাঙ্গির, সাজাহান, ঔরঙ্গজীব।
রামশঙ্কর সরকার, হরেন্দ্রচন্দ্র পাল, উমেশচন্দ্র ভদ্র, ভীম নাথ—এ-রকম সব শিক্ষকের চমৎকার পাঠদান পদ্ধতি আমার পাঠ্যপুস্তক-বিরূপতা অনেক পরিমাণে দূর করে দিয়েছিল।
১১৩
মেধার ঘাটতি সত্ত্বেও ক্রমে ক্রমে মনােযােগী ছাত্র হয়ে উঠছিলাম। চন্দ্রনাথ হাইস্কুলেই ক্লাস। টেন পর্যন্ত পড়বাে, মনােযােগের সঙ্গে পড়াশােনা করে ক্লাসের সেরা ছাত্রটি হয়ে উঠবাে, ম্যাট্রিক পরীক্ষাতেও খুব ভালাে রেজাল্ট করবাে—এ-রকম সংকল্পও আমার ভেতর দানা বেঁধে উঠছিল।
কিন্তু আটচল্লিশের অক্টোবর-নবেম্বর মাসেই স্পষ্ট হয়ে উঠলাে যে, চন্দ্রনাথ হাইস্কুলে পড়া আর আমার পক্ষে সম্ভব হচ্ছে না। কারণ, পুখুরিয়া গ্রামে যে-পিসিমার বাড়িতে আমি থাকতাম, সেই পিসিমার ছেলেরা দেশ ছেড়ে চলে যাচ্ছেন। তারা ভারতের কুচবিহারে গিয়ে জায়গা জমির ব্যবস্থা করে এসেছেন। তারা চলে গেলে সঙ্গে সঙ্গেই আমি আশ্রয়চ্যুত হয়ে যাবাে। আশপাশে আমাদের কোনাে আত্মীয়-স্বজনও নেই। স্কুলের হােস্টেলে যে উঠবাে তাও সম্ভব নয়। হােস্টেলের খরচ জোগানাের মতাে আর্থিক সঙ্গতি আমার বাবার নেই।
শুধু চন্দ্রনাথ স্কুলের কথাই-বা বলি কেন, আদৌ কোনাে স্কুলে পড়াই আমার পক্ষে সম্ভব হবে কিনা তাতেও সন্দেহ দেখা দিয়েছে। আমাদের সকল আত্মীয়-স্বজন যখন দেশত্যাগ করছে, তখন আমরাই-বা দেশে থাকবাে কী করে? পাড়া-প্রতিবেশীদের সকলে দেশত্যাগের উদ্যোগ নেবার জন্য বাবাকে প্রতিনিয়ত প্ররােচিত করছে। দেশান্তরে যাবার ইচ্ছে বাবার একদম নেই, কিন্তু নানা জনের নানা কথায় দুর্বল হয়ে পড়ছেন। এমন কি আমার মা আর ঠাকুরমাও বাবার এ দুর্বলতা বাড়িয়ে দিচ্ছেন। তাদের মতে ছেলেমেয়ে তিনটিকে (অর্থাৎ আমি এবং আমার ছােট ভাই ও বােনকে বাঁচাতে হলে, বংশের ধারা রক্ষা করতে হলে, এখনই আমাদের হিন্দুস্থানে চলে যাওয়া উচিত। বিশেষ করে মেয়ে বড়াে হলে এদেশে তার ইজ্জত রক্ষা তাে কিছুতেই হবে না। তা যদি হয়ও, তার বিয়ের পাত্র পাওয়া যাবে কোথায়? কোনাে ভদ্র হিন্দু তাে পাকিস্তানে থাকবেই না। আর ছেলেরাই-বা এখানে থেকে কী করবে? তাদের কি ভবিষ্যৎ আছে কোনাে? হিন্দুর ছেলে কি পাকিস্তানে কোনাে চাকরি পাবে?
বাবা এ-সব যুক্তি পুরােপুরি অগ্রাহ্য করতে পারতেন না। কিন্তু তার বাস্তব বােধ তাঁকে অন্য রকম যুক্তিরও জোগান দিতাে। ছেলের চাকরি বা মেয়ের বিয়ের ভাবনা তাে পরে, আগে তাে ওদের বেঁচে থাকার কথা ভাবতে হবে। হিন্দুস্থানে গিয়ে প্রাণে বাঁচার ব্যবস্থাই কি করা যাবে? যারা নগদ টাকা-পয়সা নিয়ে যেতে পারবে, তারা না হয় বেঁচে থাকার বা টিকে থাকার জন্য একটা কিছু করে নেবে। কিন্তু আমাদের মতাে সঙ্গতিহীন লােকেরা তাে সেখানে পেটের ভাত বা মাথা গোঁজার ঠাই—কোনােটাই জোগাড় করতে পারবে না। আর কোনাে রকম যদি তার ব্যবস্থা হয়েও যায়, তবে ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া করানাের মতাে অর্থের সংস্থান কী করে হবে? লেখাপড়া শিখলে পরে তাে চাকরি। লেখাপড়া না শেখাতে পারলে ওরা তাে মুটে মজুরি করেও পেটের ভাত জোগাতে পারবে না।
মা-ঠাকুরমা তখন যুক্তির বদলে দৈবের আশ্রয় গ্রহণ করেন। তা ওখানে গেলে যা হবার হবে। এতাে লােক দেশ ছেড়ে সেখানে যাচ্ছে, তাদের যদি কোনাে ব্যবস্থা হয় তাে আমাদের কেন হবে না? জীব দিয়েছেন যিনি, আহার দেবেন তিনি। হিন্দুর দেশে গেলে ভগবান হিন্দুকে কি না খাইয়ে মেরে ফেলবেন? আর ভগবানের যদি ও-রকম ইচ্ছে থেকেই থাকে, তবে আমরা সেটা খণ্ডাবাে কী করে? কিন্তু তাই বলে কি পাকিস্তানে জাতিধর্ম খুঁইয়ে বেঁচে থাকতে হবে?
এ-সব যুক্তি, পাল্টা যুক্তি আর দৈবের দোহাই চলতেই থাকে। আমরা দেশত্যাগ করি না বটে, কিন্তু তা না করে কিংবা করার উদ্যোগ না নিয়ে যে মােটেই বুদ্ধিমানের কাজ করিনি,
১১৪
এমন কথা আমার বাবাকে সময়ে-অসময়ে শুনিয়ে যেতেন শুভানুধ্যায়ী হিন্দু প্রতিবেশীরা। অনেক হিন্দু যেমন দেশ ছেড়ে চলে যায়, অনেকেই বাধ্য হয়ে হলেও দেশেই থেকে যায়। কেউ কেউ হিন্দুস্থানে চলে গিয়েও আবার দেশে ফিরে আসে। কেউ আসে অর্থবিত্ত হারিয়ে, কেউ আসে বউ ছেলেমেয়ে বা অন্য পরিজন হারানাের ব্যথা বুকে নিয়ে। এ-রকম অনেকেই বাবার কাছে এসে বলে, ‘ডাক্তার বাবু, দেশ ছেড়ে না গিয়ে ভালােই করেছেন। কী যে কষ্ট ওদেশে তা বর্ণনা করে বােঝানাে যায় না। রিফিউজি ক্যাম্পে যা খাবার দেয় তাকে খাবার না বলে অখাদ্য বলাই ভালাে। এ-রকম অখাদ্য কুখাদ্য খেয়ে লাগলাে কলেরা। কতাে লােক মারা গেলাে। অনেকেই সেই কলেরায় নিজের প্রিয় পরিজনের মৃত্যুর কথা বলতে বলতে হাউমাউ করে কেঁদে ফেলে। কেউ পরদেশে গিয়ে সর্বস্ত হবার বিবরণ দিয়ে শপথ করে বলে, মরে গেলেও আর দেশ ছেড়ে যাবাে না। দেশের মাটি কামড়ে পড়ে থাকবাে। কপালে যা লেখা আছে তাই হবে।
এদের দৃষ্টান্ত থেকে আমার বাবা দেশত্যাগ না-করার পক্ষে নতুন যুক্তি আহরণ করে মনে শক্তি সঞ্চার করার চেষ্টা করেন।
তবে দেশ ছাড়ি আর না-ই ছাড়ি, আমাকে যে চন্দ্রনাথ হাইস্কুল ছাড়তেই হবে—এ বিষয়ে আর কোনাে সন্দেহ রইলাে না। মনটা এতাে খারাপ হয়ে গেলাে যে, সেই কিশাের বয়সেই জীবনটাকে মনে হলাে অর্থহীন। পাকিস্তানের জন্মই আমাকে এমন অর্থহীনতার বােধে আক্রান্ত করলাে। আমার মতাে এ-রকম অনেককেই।
Reference: পাকিস্তানের জন্মমৃত্যু-দর্শন – যতীন সরকার