You dont have javascript enabled! Please enable it! 1973.09.28 | বাংলার বাণী সম্পাদকীয় | স্বাধীনতাবিরোধী চক্রান্তকে রুখতে হবে | জাতিসংঘে লননল সরকারের বহিষ্কার দাবি | চট্টগ্রাম বন্দর চোরের স্বর্গরাজ্য | শেখ মণি - সংগ্রামের নোটবুক

বাংলার বাণী
ঢাকাঃ ২৮শে সেপ্টেম্বর, রোববার ১৩ই আশ্বিন, ১৩৮০

স্বাধীনতাবিরোধী চক্রান্তকে রুখতে হবে

প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দৃপ্ত কণ্ঠে ঘোষণা করেছেন যে, রক্তের বিনিময়ে অর্জিত আমাদের স্বাধীনতাকে নস্যাৎ করার শক্তি কারো নেই। স্বাধীনতা যুদ্ধে আমাদের নির্বিকার প্রতিরক্ষা বাহিনীর গুলির বীরত্বব্যঞ্জক ত্যাগের কথা স্মরণ করে তিনি বলেন, বাহিনীত্রয়ের সহযোগিতায় আমাদের জনগণ স্বাধীনতার বিরুদ্ধে যেকোন ষড়যন্ত্র ব্যর্থ করে দেবে।
বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর দ্বিতীয় প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে বিমানবাহিনীর ঘাঁটিতে আয়োজিত এক আকর্ষণে অনুষ্ঠানের ভাষণ দানকালে বঙ্গবন্ধু একথা বলেন। তিনি আরো বলেন যে, তিরিশ লক্ষ শহীদের রক্তের বিনিময়ে যারা বাংলাদেশকে স্বাধীন করেছে তারা সেই স্বাধীনতাকে রক্তের বিনিময়ে হলেও রক্ষা করবে।
বিমান বাহিনীর উদ্দেশে বঙ্গবন্ধু বলেন, আপনারা বিগত কয়েক মাসের মধ্যে দেশ গড়ার সাথে সাথে নিজেদের যেভাবে গড়ে তুলেছেন সেজন্য আমি আপনাদের ধন্যবাদ জানাই। অনেক রক্তের বিনিময়ে অর্জিত সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের বয়স দুই বছরেরও কম। এই স্বল্প সময়ের মধ্যে বাংলাদেশকে পর্বত প্রমাণ বাধা-বিপত্তি, সমস্যা ও সংকট অতিক্রম করতে হয়েছে। বলতে গেলে একেবারে শূন্য থেকে যাত্রা করতে হয়েছে বাংলাদেশকে। পাকিস্তানের হানাদার বাহিনী পরাজয় বরণ করার আগে এ দেশের অর্থনীতিকে সম্পূর্ণ পঙ্গু করে দিয়ে গেছে। বিধ্বস্ত বাংলাদেশের অর্থনীতিকে চাঙ্গা করে তোলা সহজসাধ্য ছিল না। আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই এসব সমস্যা ও সংকট মোকাবেলা করতে হয়েছে । অথচ স্বাধীনতার জন্ম লগ্ন থেকেই এদেশের একদল অতিবিপ্লবী নিজেদের হীন স্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য জনসাধারণের সমস্যা ও সংকটের সুযোগ নিয়ে স্বাধীনতাবিরোধী চক্রান্তে মেতে উঠেছে। মিথ্যা আর গুজবের ফানুস উড়িয়ে জনসাধারণকে বিভ্রান্ত করাই হল তাদের আসল উদ্দেশ্য। এরা যে জনসাধারণের দরবারে ঠাই পাচ্ছে তা নয়। তবে আইন ও শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটাবার চেষ্টা করেছেন এরা প্রতিনিয়ত। বিদেশি শক্তির স্বার্থে প্ররোচিত হয়ে এরা বাংলাদেশের স্বাধীনতাকে বিপন্ন করার অপচেষ্টা থেকে এখনো যে হাত-পা গুটিয়ে বসে আছে তা নয়। ওইসব অতিবিপ্লবী আন্তর্জাতিক বিশ্বে বাংলাদেশকে হেয় প্রতিপন্ন করে এরা এ কথাই বলতে চায় যে, বাংলাদেশের স্বাধীনতা টিকবে না। টিকতে পারে না ইত্যাদি ইত্যাদি। মাত্র দুই বছর সময়ের মধ্যে বাংলাদেশে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে সমান অর্জন করেছে এবং বঙ্গবন্ধুর নাম বিশ্বের সর্বত্র প্রচারিত হয়েছে একথা কোনোদিনও ঘুনাক্ষরে এরা উচ্চারণ করে না। অথচ এ কথা কারো অজানা নয় যে, বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পরপরই চরম স্বাস্থ্য সংকটের সম্মুখীন হবার মতো পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছিল। বঙ্গবন্ধুর ব্যক্তিগত প্রচেষ্টায় সে খাদ্য সংকটের মোকাবেলা করা সম্ভব হয়েছে। জাতিসংঘের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারাও স্বীকার করেছেন যে, বাংলাদেশে অন্ততঃ এ পর্যন্ত না খেয়ে কেউ মারা যায়নি।
কথায় বলে চোর না শোনে ধর্মের কাহিনী। এইসব অতিবিপ্লবী স্বাধীনতাবিরোধী গোষ্ঠী কোনদিনই ‘ধর্মের কাহিনী’ শুনবে না। শুনতে পারে না। এরা সুযোগ পেলেই বিষাক্ত সাপের মতো ছোবল দেবে। বিমান বাহিনীর দ্বিতীয় প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে বঙ্গবন্ধু যে বক্তব্য উপস্থাপিত করেছেন তা শুধু তার বক্তব্যই নয় -এ বক্তব্য সমগ্র দেশ প্রেমিক জনসাধারণের। আমরা বিশ্বাস করি দেশের স্থল, নৌ ও বিমান বাহিনীর অতন্ত্র প্রহরীর মতো স্বাধীনতাবিরোধী চক্রান্তকে রুখবার জন্য সদাসতর্ক রয়েছেন। এ মহান দায়িত্ব পালনে সকল দেশ প্রেমিক জনসাধারণ ও তাদের পাশে এসে দাঁড়াবে। বঙ্গবন্ধুর ভাষাতেই বলবো, রক্তের বিনিময়ে অর্জিত আমাদের স্বাধীনতাকে নস্যাৎ করার শক্তি কারো নেই।

জাতিসংঘে লননল সরকারের বহিষ্কার দাবি

কম্বোডিয়ার মুক্তিযুদ্ধ দিনদিন উত্তাল হয়ে উঠেছে। প্রিন্সেস সিহানুক সমর্থক মুক্তিসেনারা সেনারা লননলের সেনাবাহিনীকে পর্যুদস্ত করে রাজধানীর নমপেন দখলের জোর লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে। অপরদিকে উনিশটি জোট নিরপেক্ষ দেশ ঐক্যবদ্ধভাবে জাতিসংঘের মহাসচিব ডক্টর কুর্ড ওয়াইল্ড স্কেমের কাছে একটি লিপি প্রেরণ করেছে। জোট নিরপেক্ষ দেশগুলির পিকিংয়ে নির্বাসিত ক্ষমতাচ্যুত কম্বোডিয়া নেতা প্রিন্স নরোদম সিহানুক কে স্বীকৃতি প্রদানের দাবি উচ্চকিত করেছে। জাতিসংঘ থেকে মার্কিনী তাবেদার কম্বোডিয়া সরকারকে বহিষ্কার করার জন্যও জোট নিরপেক্ষ জাতিগুলো সম্মিলিতভাবে হুমকি প্রদান করেছে। শুধু তাই নয়, উপনিবেশবাদের উপরও বিতর্ক অনুষ্ঠানের মাধ্যমে শর্ত আরোপ করা হয়েছে। এদিকে চলতি মাসের গোড়ার দিকে আলজিয়ার্সে যে জোট নিরপেক্ষ দেশের সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়, সেখানে ও নির্বাসিত সিহানুক এক পত্রের দাবী জানিয়েছেন যে, কম্বোডিয়ায় মার্কিনী তাঁবেদার প্রেসিডেন্ট লননল সরকারকে অপসারণ করে সে স্থলে ক্ষমতাচ্যুত সিহানুক সরকারকে যেন প্রতিষ্ঠা করা হয়।
এখন দেখা যাচ্ছে, প্রেসিডেন্ট লননল মুক্তিবাহিনীর দুর্বার অগ্ৰাভিযানকে যেমন ঠেকাতে পারছেন না ঠিক তেমনি ক্ষমতাচ্যুত প্রিন্স নরোদম সিহানুকের প্রতি ও বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সমর্থন দিন দিন প্রবল হয়ে উঠছে। একদিকে মুক্তিবাহিনী লড়াই করে আত্মপ্রতিষ্ঠার পথ সুগম করে চলেছে, অপরদিকে কূটনৈতিক তৎপরতাও জোরদার হচ্ছে। মার্কিন ছত্রছায়া তাহলে থেকেও প্রেসিডেন্ট লননলের ত্রাহি মধুসূদন অবস্থা। তিনি না পারছেন মুক্তিবাহিনীকে সামলাতে, না পাচ্ছেন তেমন জোরালো সমর্থন। নৈতিক দিক থেকে দেখা যাচ্ছে লননল সরকার বিশ্বের মুক্তিকামী দেশগুলোর কাছে কেবল ধিক্কারেই পেয়ে চলেছে। জাতিসংঘের জোট নিরপেক্ষ দেশগুলো ঐক্যবদ্ধভাবে যে নোটিশ দিয়েছেন, তাতে জাতিসংঘের মহাসচিবকে ভূমিকা গ্রহণ করবেন, তা অবশ্য এই মুহূর্তে বলা মুশকিল। তবে আমরা শুধু এই কথাটুকু উচ্চারণ করতে পারি যে, কম্বোডিয়ার মার্কিনী তাঁবেদার সরকার কে বহিষ্কারের দাবিটি সম্পূর্ণ যৌক্তিক। জোট নিরপেক্ষ দেশ গুলো এব্যাপারে একটি বলিষ্ঠ পদক্ষেপ নিয়েছেন বলে আমাদের বিশ্বাস। আমরা বিশ্বের প্রতিটি মুক্তিসংগ্রামকে সশ্রদ্ধচিত্তে সমর্থন জানাবো। মুক্তি সংগ্রামের মাধ্যমেই স্বাধীনতা অর্জন করেছি। আমরা আশা করি, কম্বোডিয়ার মুক্তিবাহিনীর বিজয় অবশ্যম্ভাবী। কম্বোডিয়ায় প্রতিক্রিয়াশীল শাসকের মৃত্যু ঘন্টা বাজবেই। লননল সরকারের পতনের মুখে আমরা প্রিন্স সিহানুক সমর্থক মুক্তিসেনাদের সার্বিক সাফল্য কামনা করি। সেই সঙ্গে এও প্রত্যাশা করি যে, বিশ্বের বিভিন্ন প্রগতিপন্থি রাষ্ট্র প্রিন্স সিহানুকের প্রতিই সাহায্য ও সহযোগিতার কল্যাণবাহী হাত সম্প্রসারিত করবেন। জাতিসংঘের জোট-নিরপেক্ষ গোষ্ঠীর নোটিশ নির্বাচিত প্রিন্স সিহানুকের কূটনৈতিক তৎপরতারই পরিচয় বহন করছে।

চট্টগ্রাম বন্দর চোরের স্বর্গরাজ্য

সংরক্ষিত এলাকা হওয়া সত্বেও চট্টগ্রাম বন্দর এবং তার পার্শ্বস্থ অদূরবর্তী এলাকা চোরের স্বর্গরাজ্যে পরিণত হয়েছে বলে খবরে প্রকাশ। জাহাজের ক্রুদের সহযোগিতায় জলদস্যুরা নজরে স্থান থেকে বিভিন্ন মালপত্র চুরি করছে এবং এ ধরনের ঘটনা নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রকাশিত খবরে আরও জানা যায়, জলদস্যুরা সাম্পান, স্পিডবোট ইত্যাদির সাহয্যে তাদের হীন কাজ চরিতার্থ করছে। এইসব এলাকায় অধিক সংখ্যক অবৈধ ব্যবসায়ীকেও ঘোরাঘুরি করতে দেখা যায় এবং বন্দর ও জাহাজ থেকে চুরি করা সোনা, বিদেশি সিগারেট, ট্রানজিস্টর, বৈদ্যুতিক জিনিসপত্র ইত্যাদির কিছু কিছু চট্টগ্রামের বাজারেও দেখা যাচ্ছে। ইণ্ডেনটরগণ অভিযোগ করছেন যে, বিদেশি ব্যবসায়ী অংশীদারি রা যে নমুনা প্রেরণ করেন কোন কোন সময় সেসব নমুনার কোন খোঁজ পাওয়া যায় না।
প্রসঙ্গতঃ উল্লেখ্য যে, চট্টগ্রাম বন্দরের এহেন কার্যকলাপ সম্পর্কে এই প্রথম তথ্য পাওয়া গেল না, ইতোপূর্বেও বহুবার এ ধরনের খবর দেশের বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। বলাবাহুল্য, স্বাধীনতা যুদ্ধে পাকহানাদার বাহিনী চট্টগ্রাম বন্দর বিধ্বস্ত করে দিয়ে যায়। ফলে দীর্ঘদিন পর্যন্ত বন্দরে অচলাবস্থা বিরাজ করছিল। কিন্তু বন্ধুদের রাশিয়ার সহযোগিতায় এখন চট্টগ্রাম বন্দর প্রায় স্বধীনতার পূর্বাবস্থা্য মত স্বাভাবিক হয়ে এসেছে। দেশের সর্ববৃহৎ সামুদ্রিক বন্দর চট্টগ্রাম। সুতরাং বিধ্বস্ত দেশের পূনর্গঠনের নিমিত্তে প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র আমদানি এবং নতুন স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রের সঙ্গে ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রেক্ষিতে জলপথে আমদানি-রপ্তানির সুবিধার জন্য পূর্বের চাইতে এক্ষণে চট্টগ্রাম বন্দরের গুরুত্ব অনেক বেড়ে গেছে। কিন্তু যে গুরুত্বপূর্ণ বন্দর এলাকার যদি নিরাপত্তা না থাকে তাহলে তা দেশের পক্ষে যে কতখানি ক্ষতিকর তা বলার অপেক্ষা রাখে না। অথচ সংরক্ষিত এলাকা হওয়া সত্বেও সেখানে দিন দিন জলদস্যু এবং কালোবাজারিদের দৌরাত্ব বেড়ে চলেছে এবং তাতে করে ব্যবসায়ী মহলের উদ্বিগ্নতার ও কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। আরো মজার ব্যাপার, বন্দরের শ্রমিকগণ বসবার আসনের ব্যবস্থা করার জন্যে নাকি জোট সেডে মালপত্র অযত্নে ফেলে রাখে। সুতরাং এমতাবস্থায় সরকারসহ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের প্রতি আমাদের বক্তব্য, যে কোনো মূল্যে বন্দর এলাকায় বিশেষ করে সংরক্ষিত এলাকায় অবৈধ ব্যক্তির আনাগোনা বন্ধ করতে হবে। জলদস্যুদের কার্যকলাপ কঠোর হস্তে দমন করে সত্বর বন্দর এলাকায় নিরাপত্তা বিধানের জন্য কার্যকর ব্যবস্থা নিতে হবে। এজন্য দ্রুত সেখানে পর্যাপ্ত সংখ্যক আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী প্রেরণ করা উচিত বলেও আমরা মনে করি।

কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক

পত্রিকার মূল কপি পড়তে এখানে ক্লিক করুন