বাংলার বাণী
ঢাকাঃ ১৪ই সেপ্টেম্বর, শনিবার, ২৯শে ভাদ্র, ১৩৮০
এ অধিবেশন জাতিকে নতুন আশ্বাস দিক
আজ জাতীয় সংসদের অধিবেশন শুরু হচ্ছে। এ অধিবেশনকে শরৎকালীন অধিবেশন বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে। জানা গেছে এ অধিবেশনে দশটি বিল ও কয়েকটি হাউস কমিটি গঠনের জন্য প্রস্তাব উত্থাপন করা হবে। আইন ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রী মনোরঞ্জন ধর একটি সংবাদ সংস্থাকে জানিয়েছেন যে, সংসদের সামনে যে পরিমাণ কাজ রয়েছে তাতে পক্ষকালের কম সময় পর্যন্ত অধিবেশন চলতে পারে। শরৎকালীন এ অধিবেশন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বলে আশা করা যাচ্ছে। দেশের সার্বিক অবস্থার দিকে দৃষ্টি রেখে কতগুলো গুরুত্বপূর্ণ বিল সংসদে পাস হবে বলেও আমাদের ধারণা। গত পরশুদিন গণভবনে অনুষ্ঠিত বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যকরী পরিষদের সভায় এ প্রসঙ্গে স্মর্তব্য। জাতীয় সংসদের অধিবেশন কে সামনে রেখে আওয়ামী লীগের এই সভা ও তার প্রস্তাবাবলী অত্যন্ত অর্থবহ। বঙ্গবন্ধুর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এ সভায় যেসকল প্রস্তাব গ্রহণ করা হয়েছে তার মধ্যে অন্যতম হলো দেশের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ প্রসঙ্গ। এবং স্বাধীনতার শত্রু ও প্রতিক্রিয়াশীল শক্তিসমূহকে নস্যাৎ করার প্রস্তাব। আমি লীগের সাংগঠনিক কমিটির এ প্রস্তাবকে আমরা ন্যায়তঃ ও সুদূরপ্রসারী বলে অভিহিত করছি। দেশের সম্মুখে আজ যে নিদারুণ সংকট দেখা দিয়েছে তাহলো – মানুষের জীবনের নিরাপত্তাহীনতা ও সমাজ বিরোধী প্রতিক্রিয়াশীল শক্তির দ্বারা প্রতিনিয়ত আক্রান্ত প্রগতিশীল শক্তির মানুষের জীবনে আসা হতাশা। এই হতাশা কে উত্তোলন করে প্রগতিশীল মানুষের ঐক্য গড়ে তুলে দেশের পুনর্গঠনের কাজে হাত দিতে হবে সবাইকে। এজন্য প্রয়োজন সরকারের সুদুরপ্রসারী পদক্ষেপ। আওয়ামী লীগ তার প্রস্তাবে দেশের শত্রু সাম্রাজ্যবাদী প্রতিক্রিয়াশীল শক্তি ও সমাজবিরোধী শক্তিসমূহের বিরুদ্ধে সেই কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণের কথা উল্লেখ করেছে। আজ যে জাতীয় সংসদের অধিবেশন শুরু হচ্ছে তাতে সেই সকল প্রতিক্রিয়াশীল শক্তির সমূহের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য এই বিল পাস করার আহ্বান জানিয়েছে আওয়ামী লীগ। আমরা আশা করছি জাতীয় সংসদ আওয়ামী লীগের প্রস্তাব অগ্রাধিকার ভিত্তিতে বিবেচনা করবেন। দেশের প্রচলিত শাসনব্যবস্থা ও আইনের দ্বারা সুষ্ঠুভাবে সরকারি নীতি বাস্তবায়িত হতে পারে না বলে আমাদের বিশ্বাস। পুরোনো আইনের দ্বারা নতুন দেশের সমাজতান্ত্রিক নীতি বাস্তবায়িত হতে পারে না। যদি সে প্রচেষ্টা চালানো হয় তাহলে প্রতিনিয়ত তা বাধাপ্রাপ্ত হতে বাধ্য। দেশের বর্তমান প্রতিক্রিয়াশীল চক্রের সীমাহীন তৎপরতা বন্ধ করতে হলে মজুতদার, কালোবাজারিদের অসাধুতা রোধ করতে হলে ও দেশের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ শত্রুদের ষড়যন্ত্র মোকাবিলা করতে হলে নতুন আইনের আবশ্যকতা কেউ যদি অস্বীকার করেন তাহলে তাকে নির্বুদ্ধিতা ছাড়া আর কিছু বলা যাবে না। অনুষ্ঠিতব্য এ অধিবেশন নতুন আইনের আবশ্যকতা সামনে রেখে তাদের কার্য সম্পাদন করবেন বলে আমাদের বিশ্বাস। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ দেশের শত্রুকে পর্যুদস্ত করে সকল প্রকার প্রতিক্রিয়াশীল শক্তির মোকাবেলার জন্য নতুন আইনের আবশ্যকতা অনুধাবন করেন। আর সে কারণেই পেশকৃত তাদের এ প্রস্তাবসমূহ জাতীয় সংসদ শুরু হবার পূর্বে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও অর্থবহ।
কাজের মাধ্যমে জবাব
কাজের মাধ্যমে জবাব দিতে হবে -কাজ করে জবাব দিতে হবে সকল অপপ্রচারের এবং অভিযোগের। শিল্পমন্ত্রী সৈয়দ নজরুল ইসলাম গত বৃহস্পতিবার সেক্টর কর্পোরেশনগুলোর কর্মচারী সমিতির অধিষ্ঠান অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির ভাষণ দানকালে শিল্প-কারখানায় পূর্ণ উদ্যমে কাজ করার জন্য এবং উৎপাদন বাড়িয়ে তোলার জন্য কর্মচারীবৃন্দের উদাত্ত আহ্বান জানিয়ে এ কথা বলেছেন।
শিল্পমন্ত্রী বলেছেন, একশ্রেণীর লোক বলছে জাতীয়করণ নীতি একটি ব্যর্থ হচ্ছে এবং এ নীতি বাদ দিতে হবে। তাই কাজের মাধ্যমে ওদের এসব কথার জবাব দিতে হবে। শিল্পমন্ত্রীর এই আহ্বান এবং অনুধাবন বিলম্বে হলেও আশাপ্রদ। কিন্তু এ প্রসঙ্গে জাতীয়করণ নীতির ব্যর্থতা নিয়ে আজ যারা সোচ্চার তাদের মানসিকতাও ভেবে দেখবার সময় এসেছে। বায়াত্তুরের ২৬শে মার্চ স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে দেশবাসীর উদ্দেশ্যে ভাষণ দানকালে জাতির পিতা এই জাতীয়করণ নীতি ঘোষণা করেন। কিন্তু তার পর থেকে এই নীতি বাস্তবায়নে সরকারি মহলের কিছু লোকের আন্তরিকতা থাকলেও আমলাতন্ত্র আর বৃহৎ পুঁজির চক্রান্তের ফলে সেটা যে সার্বিক কার্যকরী হয়নি -অন্যকথায় ওরা যে হতে দেয়নি, একথা তো আজ আর অস্বীকার করার উপায় নেই।
জাতীয়করণনীতি ঘোষিত হবার পর থেকেই এক শ্রেণীর লোক এটাকে বানচাল করার জন্য উঠে পড়ে লাগে। প্রকাশ্যে এরা রটাতে থাকে যে, এই নীতি ব্যর্থ হয়েছে আর ভেতরে ভেতরে চক্রান্তের কুটিলতায় আবর্তিত হতে থাকে তারা। এই চক্রান্তকারীদের সাথে মিলেছে বৃহৎ পুঁজি বা তাদের লেজুড়ের দল। বিভিন্ন জাতীয়করণকৃত সংস্থার কিছু কিছু কর্মচারীও এদের সাথে হাত মিলিয়ে দাবার ছকটা যেন নতুনভাবে সাজাতে শুরু করে। এরাই ছল-চাতুরি করে বিভিন্ন কর্পোরেশন ও কলকারখানায় কর্মরত সাধারণ কর্মচারী ও শ্রমিকদের বিভ্রান্তির মধ্যে ঠেলে দিয়ে প্রতারণার শিকারে পরিণত করে। আর তারই ফলে জাতীয়করণকৃত শিল্প কারখানায় উৎপাদন ব্যাহত হয় মারাত্মকভাবে। নন্দঘোষের মতো সব দোষ বর্তায় সরকারের ঘাড়ে। অবশ্য সরকারি মহলও তখন কিন্তু পরিস্থিতির সার্বিক মোকাবিলায় যতখানি দৃঢ়তা নিয়ে এগিয়ে আসা উচিত ছিল তা করেননি।
যাহোক আজ যখন সরকার তার বলিষ্ঠতা নিয়ে এগুচ্ছেন তখন আমরা অবশ্যই আশা করবো যে, জাতীয়করণ বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে আজ যেমন সব বাধা দেখা দিয়েছে তা অবশ্যই অবসান ঘটবে।
শিক্ষাঙ্গনে স্বাভাবিক অবস্থা ফিরে আসুক
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গতকাল আবার খুলেছে। গত ৩রা সেপ্টেম্বর বিশ্ববিদ্যালয়ের নির্বাচনকে কেন্দ্র করে যে অপ্রীতিকর ও অবাঞ্ছিত ঘটনা ঘটে গেছে তারই প্রেক্ষিতে বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে স্বাভাবিক অবস্থা ফিরিয়ে আনার প্রয়োজনই বিশ্ববিদ্যালয় ক’দিন বন্ধ রাখা হয়েছিল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এবারকার নির্বাচনকে কেন্দ্র করে যে মর্মান্তিক ও ন্যাক্কারজনক ঘটনা সংঘটিত হয়, তীব্র ভাষায় আমরা তার নিন্দা করেছি। কারণ এই ঘটনা ঐতিহ্যবাহী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ঐতিহ্য এবং সম্মানকেই শুধু ক্ষুন্ন করেনি গোটা জাতি এবং দেশের মর্যাদা ম্লান করেছে। সুতরাং আমরা সেই ঘটনার তীব্র নিন্দা জ্ঞাপন এর সাথে সাথে ভবিষ্যতে যাতে আর কখনো এমন হীন কার্যকলাপের পুনরাবৃত্তি না ঘটে সে বিষয়ে সরকার ও বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে কঠোর কার্যকরী ব্যবস্থা নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছি। বলাবাহুল্য, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীও দৃঢ়তার সঙ্গে ঘোষণা করেছেন ভবিষ্যতে আর কখনো শিক্ষাঙ্গনে অমন ঘটনা ঘটতে দেওয়া হবে না এবং সেজন্য যে কোনো কঠোর ব্যবস্থা নিতে সরকার বদ্ধপরিকর।
দেশের বর্তমান আইনশৃঙ্খলা অবনতির শেষ পর্যন্ত শিক্ষার সর্বোচ্চ পাদপীঠ বিশ্ববিদ্যালয়ের অঙ্গনের যে ভাবে আঘাত হেনেছিল তাতে গোটা দেশ প্রেমিক জনগনই অত্যন্ত মর্মাহত হয়েছিলেন। দশ দিন বন্ধ থাকার পর আবার বিশ্ববিদ্যালয় খোলার খবরে তেমনি সকলের সাথে আমরাও আজ অনেকটা স্বস্তি বোধ করছি। এবং সেই সঙ্গে দৃঢ়ভাবে আশা করছি, সরকার ও বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ শিক্ষাঙ্গনের পবিত্রতা রক্ষায় এতোটুকু কার্পণ্য করবেন না। সঙ্গে সঙ্গে ছাত্র-ছাত্রী, ভাই-বোন, অভিভাবকমহল সহ সবাইকে এ ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আন্তরিক সহযোগিতার হাত প্রসারিত করতে হবে বলে আমরা অভিমত পোষণ করি। শিক্ষাঙ্গনে সুস্থ ও স্বাভাবিক অবস্থা পুরোপুরি ভাবে ফিরে আসুক এবং স্বাভাবিক পরিস্থিতি গোটা সমাজ জীবনে প্রতিফলিত হোউক, এটাই আমাদের আন্তরিক প্রত্যাশা।
কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক