You dont have javascript enabled! Please enable it!

বাংলার বাণী
ঢাকা: ৯ই সেপ্টেম্বর, সোমবার, ২৩শে ভাদ্র, ১৩৮১

দেয়ালে পিঠ ঠেকার আগেই

নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি মতোই অপরিহার্য হলো জ্বালানি তেল। তা নিয়েও কতিপয় সমাজবিরোধীদের অবাধ লীলা চলে। পত্রিকান্তরে বিশেষ প্রতিবেদনে জানা গেছে যে, বাংলাদেশের মিনারেল গ্যাস এন্ড অয়েল কর্পোরেশন, পেট্রোবাংলা এবং ইস্টার্ন রিফাইনারির মধ্যে অন্তবিরোধ ঘটার জন্য গত ১৫ই জুলাই থেকে ৩০শে আগস্ট পর্যন্ত তেলবাহী জাহাজের মাল খালাস করা হয়নি। ফলে পর্যাপ্ত তেল পড়ে থাকা সত্ত্বেও দেশের অভ্যন্তরে তেলের তীব্র অভাব দেখা দেয় এবং কতিপয় মুনাফাখোর, দেশীয় ডিলার ও খুচরা বিক্রেতারা এই সুযোগ কৃত্রিমভাবে কেরোসিন তেলের সঙ্কট আরো বাড়িয়ে তুলে দেদার মুনাফা লুটে। উক্ত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে যে, এই দেড়মাসে তেলের কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে কেরোসিন তেল ব্যবসায়ীরা ২ কোটি ৩১ লক্ষ ৫ হাজার ৬৫ টাকা ৫৪ পয়সা মুনাফা আদায় করেছে। অপরদিকে স্বার্থ সংশ্লিষ্ট কোন দলের জন্য বন্দরে মালভর্তি জাহাজ পড়ে থাকায় সরকারকে এই দেড়মাসে ৯ কোটি ১৮ লাখ ৮৩ হাজার ৭৫০ টাকা বৈদেশিক মুদ্রার ডেমারেজ দিতে হয়েছে। এরমধ্যে তেলবাহী বিদেশী জাহাজের ডেমারেজ হচ্ছে ১০ লক্ষ ডলার অর্থাৎ ৮৫ লক্ষ ৬ হাজার ২৫০ টাকা এবং জাহাজ থেকে তেল লাইটারিংয়ে এ বিদেশী ট্যাংকার চার্টার করা বাবদ (প্রতি গ্যালন ৩ ডলারে হারে) ৩০ লাখ ৩৭ হাজার ৫০০ টাকা দিতে হয়েছে। সম্পূর্ণ অবাঞ্ছিত এই ক্ষতি।
গত ৫ই সেপ্টেম্বর বিশেষ দৈনিক সংবাদপত্র প্রতিবেদনে কেরোসিন তেলের কৃত্রিম সংকট সম্বন্ধে কিছু তথ্য পরিবেশন করা হয়েছিল। ওই প্রতিবেদনে কেরোসিনের কৃত্রিম সংকট ও দুর্মূল্যের জন্য কেরোসিন ডিলার ও এজেন্টরাই দায়ী বলে উল্লেখ করা হয়। কেরোসিন তেলের সবরকম এজেন্টরাই নাকি রেশন দোকান সহ সর্বত্র কেরোসিন সরবরাহ আকস্মিকভাবে বন্ধ করে দেয় ফলে স্বাভাবিকভাবেই খোলাবাজারে কেরোসিন তেলের দাম বেড়ে যায় এবং সরকার নির্ধারিত রেটের কেরোসিন (প্রতি গ্যালন ৬.৮৬ পয়সা) ১২ থেকে ১৪ টাকা গ্যালনে প্রকাশ্যে বিক্রি হয়। অনন্যপায় ক্রেতা সাধারণ ক্রেতা কিনতে হয় অগ্যতা। এতে দুষ্কৃতিকারীদের উদ্দেশ্য হাসিল হয় এবং তারা বেশুমার মুনাফা লুটে।
এরই প্রেক্ষিতে স্বভাবতই প্রশ্ন জাগে যে, তেল সংকটের অন্তরালে ঢাকা বন্দর থেকে ডিলার ও এজেন্টদের নিজস্ব সীমায় একই সময় উল্টো দিকে ঘোরে কেমন করে? বন্দরে তেল খালাস হয় না, বিভিন্ন তেল সরবরাহ প্রতিষ্ঠানের মধ্যে অন্তবিরোধ লেগে যায়, স্থানীয়রা ডিলাররা বরাদ্দ সরবরাহ বন্ধ করে তেল মজুদ করে, দাম বাড়ে, জনসাধারণের ভোগান্তি শুরু হয়, সরকারকে প্রচুর ডেমারেজ দিতে হয় এবং তারপর একসময় কেরোসিন সংকট শিথিল হয়। ততক্ষণে সংশ্লিষ্ট মহলের কেল্লাফতে। জনসাধারণের দফারফা প্রায়।
যতটা স্মরণ করা যায় গত বছরের এই একই পদ্ধতিতে বার কয়েক কেরোসিন সংকট সৃষ্টি হয়েছে এবং জনজীবনে দুর্ভোগ নেমে এসেছে। এবারেও মাস দুই আগে থেকেই কেরোসিন সংকটের আলামত পাওয়া যাচ্ছিল। আচমকা কোন সরকারি ঘোষণা ছাড়া কেরোসিনের মূল্য বৃদ্ধি, রেশন সরবরাহ বন্ধ, হকারদের আনাগোনায় স্বল্পতা এবং তারই সাথে কেরোসিনের সম্ভাব্য সংকট নিয়ে জনসংখ্যাকে সংশ্লিষ্ট মহল তখন গুরুত্ব দেননি। ফলে সরকার নির্ধারিত ৬.৮৬ পয়সার ১ গ্যালন কেরোসিন তেল খোলাবাজারে ১২ থেকে ১৪ টাকায় বিক্রি হতে পেরেছে। বিভিন্ন অভিজ্ঞতা থেকে আমরা দেখেছি দেয়ালে পিঠ না ঠেকলে সংশ্লিষ্ট কোনো ব্যাপারে মাথা ঘামাতে চান না। একটা দেশকে গড়ে তোলার সময় সংশ্লিষ্ট মহল গুলো দায়িত্বজ্ঞানহীনতা, ঔদাসীন্য, খামখেয়ালিপনার সত্যিই অমার্জনীয়। অতএব যে কোন ব্যাপারেই দুর্নীতির স্পর্ধিত প্রকাশকে নস্যাৎ করে দিয়ে জনজীবনের সাধারণ স্বস্তি ও জীবনযাত্রার মানের স্থিতিশীলতা আনা হোক এবং সময় থাকাতে এ কাজে নামলে তা করা এখনো সম্ভব নয়।

মোজাম্বিকের স্বাধীনতা

গিনি-বিসাউ এর পর এবার মোজাম্বিক। আফ্রিকায় পর্তুগিজ উপনিবেশগুলি দীর্ঘদিনের পরাধীনতার সম্বল মুক্ত হয়ে স্বাধীন সত্ত্বা নিজেদের প্রকাশ করছে। স্বাধীনতার জন্য মোজাম্বিকের মুক্তিকামী মানুষ সংগ্রাম করে আসছে দীর্ঘদিন ধরে। সশস্ত্র সংগ্রামে অবতীর্ণ হয়েছে তাও দশ বছর আগে। এই দশ বছরের মুক্তি জনসাধারণ বীরত্বপূর্ণ সংগ্রামের ইতিহাস সৃষ্টি করেছিল।
খোদ পর্তুগালের ক্ষমতা মঞ্চের পট পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে আফ্রিকায় পর্তুগিজ উপনিবেশ গুলির প্রসঙ্গের নয়া সরকারের নীতি ঘোষণা করেন তারই আলোকে প্রথম গিনি বিসাউ এবং পরে মোজাম্বিকের স্বাধীনতা চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এই মাসেরই বারো তারিখে স্বাধীনতা উৎসবের তারিখ স্থির করেছে। মোজাম্বিক সার্বিক স্বাধীনতা লাভ করবে আগামী বছরের পঁচিশে জুন।
এই অন্তর্বর্তী সময়ের জন্য অবশ্য ফ্রেলিমোর নেতৃত্বে মোজাম্বিকে একটা সরকার গঠিত হবে। পর্তুগিজ সরকারের সাথে আলোচনায় ফলশ্রুতি হিসেবে সাতই সেপ্টেম্বর মধ্যরাত্রি থেকে মোজাম্বিকে দু’পক্ষের মধ্যে যুদ্ধবিরতি কার্যকরী হবার কথা।
বিগত এপ্রিল মাসের শেষাশেষি পর্তুগালে এক সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে দীর্ঘদিনের স্বৈরাচারী একনায়ক তন্ত্র বাদী শাসনের অবসান ঘটার পরও সরকার ঘোষণা করেছিলেন আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে তারা আফ্রিকায় তাদের উপনিবেশ গুলির স্বাধীনতা প্রদান করবেন। সেই লক্ষ্যকে সামনে রেখে সরকারি এবং বেসরকারি ভাবে বিভিন্ন উপনিবেশের মুক্তিকামী মানুষের প্রতিনিধিত্বশীল নেতৃবৃন্দের সঙ্গে নয়া পর্তুগিজ সরকার বিভিন্ন সমালোচনা বৈঠকের উদ্যোগ গ্রহণ করেন। গত ৬ই সেপ্টেম্বর ফ্রেলিমোর সাথে পর্তুগিজ কর্তৃপক্ষের সর্বশেষ আলোচনার প্রেক্ষিতে মোজাম্বিকের স্বাধীনতা প্রদান চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়।
গিনি-বিসাউ এবং মোজাম্বিকের পর এখন এ্যাঙ্গোলার পালা। এ্যাঙ্গোলার স্বাধীনতাকামী মানুষের দীর্ঘদিন ধরে পর্তুগিজ উপনিবেশ বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে আসছে। এই সংগ্রামকে লক্ষ্যচ্যুত অথবা বিভ্রান্ত করার জন্য পর্তুগালের ঔপনিবেশিক শক্তি বিশেষ করে লুয়ান্ডায় বসবাসকারী শ্বেতাঙ্গরা কম প্রচেষ্টা চালায়নি। উপনিবেশ গুলির স্বাধীনতা প্রদান প্রশ্নের নয়া পর্তুগিজ সরকারের সুস্পষ্ট নীতি ঘোষিত হবার পরও তারা তাদের পুরান অপচেষ্টা থেকে বিরত থাকে নি। বেশ ক’বার দাঙ্গা ঘটিয়েছে এ্যাঙ্গোলার রাজধানী লুয়ান্ডায়। শতাধিক লোক নিহত হয়েছে পর্তুগালের সামরিক অভ্যুত্থানের পর নেতৃস্থানীয় শ্বেতাঙ্গদের অনেকেরই পালিয়ে গিয়েছিল দক্ষিণ আফ্রিকা অথবা রোডেশিয়ায়। সেখান থেকেই তারা এ্যাঙ্গোলার মুক্তিকামী মানুষের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র চালিয়ে যাচ্ছে।
ফ্রেলিমোর সাথে আলোচনাকালে পর্তুগিজ পররাষ্ট্রমন্ত্রী যেমন বুঝতে পেরেছেন শ্বেতাঙ্গ মাত্রই ফ্রেলিমোর শত্রু বলে বিবেচিত হয় না তেমনি এ্যাঙ্গোলার মুক্তিকামী মানুষ শ্বেতাঙ্গদের প্রতি কোন প্রকার বিদ্বেষ পোষণ করেন না। তারা যেটাকে তাদের সাধারণ শত্রু হিসেবে মনে করে তা পর্তুগিজ পররাষ্ট্রমন্ত্রী ভাষায় ‘পর্তুগিজ সাম্রাজ্যবাদ।’ তিনি নিজেই বলেছেন যে, শত্রুরও মৃত্যু হয়েছে। তাই স্বাভাবিকভাবে আশা করা যায় এ্যাঙ্গোলার স্বাধীনতা প্রাপ্তির দিন খুব বেশি দূরে নয়।
আমরা বরাবর এই উপনিবেশ গুলির মুক্তিকামী মানুষের সংগ্রামের সাথে একাত্মতা ঘোষণা করছি। গিনি-বিসাউ এর স্বাধীন সরকারকে পর্তুগাল স্বীকার করে নেয়ার বহু পূর্বেই গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার তাদের স্বীকৃতি প্রদান করেছে। আফ্রিকায় আরেকটা উপনিবেশ মোজাম্বিকের স্বাধীনতা প্রতীকে আমরা স্বাগত জানাই। একই সঙ্গে অধীর প্রতীক্ষায় আমরা সেই দিনটির অপেক্ষা করবো যেদিন পর্তুগালের আর একটি উপনিবেশ এ্যাঙ্গোলা স্বাধীনতা লাভ করে পারস্পরিক সহযোগিতার ভিত্তিতে নব্য স্বাধীনতাপ্রাপ্ত অন্য দুটি রাষ্ট্রের সঙ্গে একযোগে জনগণের কল্যাণ ও সমৃদ্ধিতে সর্বশক্তি নিয়োজিত করবে।

কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক

পত্রিকার মূল কপি পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!