You dont have javascript enabled! Please enable it!

বাংলার বাণী
ঢাকাঃ ২২শে আগস্ট, বৃহস্পতিবার, ৫ই ভাদ্র, ১৩৮১

প্রকৃত অপরাধের স্বীকৃতি

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকালে দখলদার সেনাবাহিনীর অধিনায়ক হিসেবে জেনারেল এ,এ,কে নিয়াজী বাংলাদেশ-ভারত যৌথ কমান্ডের কাছে বিনাশর্তে আত্মসমর্পণ করেছিলেন। এরপর দীর্ঘদিন তিনি এবং তাঁর আত্মসমর্পণকারী বাহিনীসহ ভারতে অন্তরীণ ছিলেন। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সীমাহীন অবরাধ সত্ত্বেও পাকিস্তানি বন্দি বাহিনীকে ক্ষমা প্রদর্শন করে মহানুভবতার উদাহরণ সৃষ্টি করেছিলেন। মুক্তিপ্রাপ্ত জেনারেল নিয়াজী এবং তার বন্দী সহকর্মীগণ স্বদেশে প্রত্যাবর্তন করার পর পাকিস্তানের বর্তমান শোষকগোষ্ঠী তাদের অধিকাংশকে চাকরি থেকে বরখাস্ত করেন। বরখাস্ত হওয়ার পর থেকে আজ পর্যন্ত বিভিন্ন সময়ে জেনারেল নিয়াজী মুক্তিযুদ্ধের উপর মন্তব্য করতে গিয়ে বিভিন্ন ভাবে সাবেক প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়া ও সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল টিক্কা বিরুদ্ধে অভিযোগ এনেছেন। গতকাল প্রকাশিত একটি সংবাদে আমরা আরো স্পষ্টভাবে জানতে পেরেছি যে, জেনারেল টিক্কা খানের নির্দেশেই নাকি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় ১৫ লাখ বাঙালিকে হত্যা করা হয়েছে। তৎকালের পূর্ব পাকিস্তানের প্রধান সামরিক কমান্ডার জেনারেল এ,এ,কে নিয়াজী ১৯৭১ সালের যুদ্ধে পরাজয়ের কারণ অনুসন্ধানী হামিদুর রহমান কমিশনের কাছে সাক্ষাত দিতে গিয়ে একথা উল্লেখ করেছেন। জেনারেল নিয়াজী আরো স্বীকার করেছেন যে, পাকিস্তানী সৈন্য গান বিশেষ করে পাঞ্জাবি ও পাঠান সৈন্যরা নির্বিচারে ৯ বছরের বালিকাদের উপরেও পাশবিক অত্যাচার চালিয়েছে। এবং বাংলাদেশের কোটি কোটি টাকার সম্পদ ধ্বংস করা হয়েছে। জেনারেল নিয়াজী আরও দাবি করেছেন, সাবেক প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়া খান এবং তার জেনারেলরা বিশেষ করে পাকিস্তানের বর্তমান সেনাপতি জেনারেল টিক্কা খানকে বাঙালি নিধনের জন্য লেলিয়ে দিয়েছিলেন। তাদের জঘন্যতম অপরাধের লিপ্ত হবার মূলে নাকি জেনারেলদের নির্দেশেই কার্যকরী হয়েছে। বস্তুতঃ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানের সেনাবাহিনী ইতিহাসের জঘন্যতম অপরাধ সংগঠিত করেছিল তার বহু কাহিনী ও ঘটনাই বিশ্বব্যাপী প্রচারিত হয়েছে। বিদেশীরা এই অপরাধের নমুনা প্রত্যক্ষ করেছেন। প্রথমে একপক্ষীয় বা দ্বিপক্ষীয়ভাবে দখলদার সেনাবাহিনীর কার্যকলাপের কথা প্রচারিত হলেও পরে তা বিশ্বের মানুষের কাছে সত্য ঘটনা হিসেবে সম্প্রচারিত হয়ে গিয়েছিল। ক্ষয়ক্ষতি ও জীবননাশের যে সকল চিত্র আমরা বিশ্ববাসীর সামনে তুলে ধরতে চেষ্টা করেছি তা হয়তো অনেকের কাছে উদ্ভট মনে হলেও হতে পারে, কিন্তু জেনারেল নিয়াজির এই স্বীকারোক্তির পর বিশ্বের মানুষের কাছে একটা বিষয় সুস্পষ্ট হলো যে, বাংলাদেশের পক্ষ থেকে যুদ্ধের ক্ষতি সম্পর্কে এতদিন যে সকল করুণ চিত্র তুলে ধরা হতো তার সবই সত্য। দখলদার সেনাবাহিনী এদেশের অসহায় মানুষের উপর যে জঘন্যতম হত্যাকাণ্ড ও নিরপরাধ মা-বোনদের উপর পাশবিক অত্যাচার চালিয়েছিল জেনারেল নিয়াজির স্বীকারোক্তি থেকে তার সত্যতা প্রমাণিত হবে। পাকিস্তানের সঙ্গে আজ ঘটনার পরিক্রমার পরিপ্রেক্ষিতে কোনো বিরোধ আমাদের নেই। তবে যে সকল সমস্যা আজও দু’দেশের মধ্যে বর্তমান রয়েছে তার নিরসনের জন্য একটি সুস্পষ্ট পদক্ষেপ গ্রহণের আবশ্যকতা রয়েছে। এত বড় অপরাধ বাংলাদেশের বুকে সংঘটনের পরও আমরা ক্ষমাসুন্দর মনে সব কিছু পর্যালোচনা করেছি। আজও এদেশের সরকার সকল বিরোধের মীমাংসা চায়। কিন্তু পাকিস্তানি কর্তৃপক্ষের আদৌ সেই সহযোগিতার মনোভাব রয়েছে কিনা সন্দেহ। আমরা আশা করব, পাকিস্তান এতকালের অন্ধ ও ভুল পথ পরিহার করে উপমহাদেশের শান্তি ও নিরাপত্তার প্রয়োজনীয় সহযোগীতামূলক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে অগ্রসর হবেন। বাংলাদেশের জনগণ তাদেরকে সবসময়ই স্বাগতঃ জানাবে।

ইউনিসেফের বদান্যতা

বাংলাদেশের পল্লী এলাকায় পানীয় জলের অসুবিধা দূর করার প্রয়োজনে জাতিসংঘ শিশু তহবিল (ইউনিসেফ) থেকে ১কোটি ৪০ লক্ষ ডলার বরাদ্দ করা হবে। এই অর্থব্যয়ে বাংলাদেশে ১লক্ষ ৫৫ হাজার নলকূপ এবং ৯ হাজার ৫শ’ গভীর নলকূপ বসানো হবে বলে গতকাল পত্রিকান্তরে প্রকাশিত খবরে প্রকাশ। স্থানীয় সরকার দপ্তরের জনৈক কর্মকর্তার উদ্ধৃতি দিয়ে বাংলাদেশ প্রেস ইন্টারন্যাশনাল জানিয়েছেন যে, এক কোটি ৬০ হাজার ডলার ব্যয় বাংলাদেশের নলকূপ বসানোর আরেকটি প্রকল্পের কাজ বর্তমানে ইউনিসেফের হাতে রয়েছে এবং তা চলতি বছরের ডিসেম্বরের মধ্যেই সম্পন্ন হবে। নলকূপ বসানোর জন্য প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম সাহায্যের অন্তর্ভুক্ত এবং ব্যয়ভার ও ইউনিসেফ বহন করবে। বাংলাদেশ সরকারকে শুধুমাত্র নলকূপ বসানোর ও পরিবহন খরচ বহন করতে হবে যাদের কাছে এটা নেশার সর্ববৃহৎ কর্মসূচি এবং আগামী চার বছরের মধ্যে এ কর্মসূচি শেষ হবে। বাংলাদেশের সর্বনাশা বন্যার পর পানীয় জলের অসুবিধে জনিত মানুষের দুর্ভোগের খবরের সংবাদপত্র গুলোর পাতায় ইদানিং ভর্তি থাকছে এবং খাদ্য সমস্যা থেকে কোন অংশেই কম নয় এ সমস্যা। বিশেষত বন্যা দুর্গত এলাকা গুলোতে সংক্রামক ব্যাধি বিস্তারের খবর শোনা যাচ্ছে প্রতিনিয়ত এবং এরও একমাত্র কারণ হল বিশুদ্ধ পানির অভাব। বাংলাদেশের প্রকৃতি এমনই বিচিত্র যে, বন্যার তান্ডব শুরু হলে উপদ্রুত এলাকা গুলোতে পানি বৃদ্ধির ফলে নলকূপ গুলোর অধিকাংশই পানির নীচে তলিয়ে যায় এবং খরার সময় একমাত্র নলকূপ গুলোর উপর ছাড়া খাবার পানির উপর নির্ভর করা চলে না এবং অন্য কিছু অর্থাৎ খোলা নদীর পুষ্করিণী, পানি, খালের পানি পান করে প্রতিবছর এই শত শত লোক পেটের পীড়া ও সংক্রামক ব্যাধির শিকার হয় এবং মৃত্যুর হার বৃদ্ধি পায়। সুতরাং ইউনিসেফের আরও অতিরিক্ত ১ লাখ ৬৫ হাজার নতুন নলকূপ বসানোর খবরে আমরা আনন্দিত।
প্রসঙ্গতঃ উল্লেখযোগ্য যে, বাংলাদেশ ইউনিসেফের পূর্বেকার প্রকল্পের অধীনে নলকূপ বসানো সম্পর্কিত নানা ধরনের রিপোর্ট বারান্তরে বিভিন্ন সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়েছে। ঐ সমস্ত খবরে বলা হয়েছিল যে, জনস্বার্থ বিভাগের কতিপয় কর্মচারীর অযোগ্যতা ও অপরিণামদর্শিতার জন্য নলকূপ বসানোর প্রকল্প নির্দিষ্ট সময়সীমার মধ্যে বাস্তবায়িত হয়নি। তাতে করে দুর্ভোগ পোহাতে হয়েছে এদেশেরই পল্লী এলাকার জনসাধারণকে। ইউনিসেফ বিভিন্ন সময়ে বাংলাদেশের নৌকা বসানোর জন্য যে প্রচুর পরিমাণ অর্থ বরাদ্দ করছে তার একমাত্র উদ্দেশ্য হচ্ছে পল্লী এলাকায় জনগণ যাতে বিশুদ্ধ পানীয় জল সংগ্রহ করতে পারে। আমরা সংশ্লিষ্ট বিভাগের কাছে অনুরোধ জানাব, পূর্বেকার তিক্ত অভিজ্ঞতার পুনরাবৃত্তি না ঘটিয়ে যাতে করে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যেই নলকূপ বসানোর কাজ সম্পাদনের মাধ্যমে পল্লী এলাকার জনগণের পানীয় জলের অভাব দূর করা হয়।

কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক

পত্রিকার মূল কপি পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!