বাংলা বাণী
ঢাকাঃ ২০শে ডিসেম্বর, শুক্রবার, ৪ঠা পৌষ, ১৩৮১
সিমেন্ট আসছে প্রচুর সিমেন্ট
সিমেন্ট নাকি প্রচুর আসছে বাংলাদেশে। টিসিবিই এনেছে প্রায় লক্ষাধিক টন। এছাড়া আসছে ওয়েজ আর্নিং স্কিমে। পত্রিকান্তরে প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুযায়ী ফেব্রুয়ারি মাসের মাঝামাঝি সময়ের মধ্যে সরকারি এবং বেসরকারি খাতে প্রায় সাড়ে ৩ লাখ টন সিমেন্ট বাংলাদেশে এসে পৌঁছাবে। এটা নিঃসন্দেহে আনন্দের খবর। গত তিন বছর যাবত এই সিমেন্টের নিদারুণ অভাব। বেসরকারি তো দূরের কথা সরকারি নির্মাণকাজই বন্ধ রয়েছে অধিকাংশ ক্ষেত্রে সিমেন্টের অভাবে। যোগাযোগব্যবস্থা পুনঃস্থাপনের জন্য প্রয়োজনীয় সিমেন্টের সরবরাহ অব্যাহত রাখতেই সরকারকে ভীষণরকম হিমশিম খেতে হয়েছে। দালানকোঠা নির্মাণ তো বলতে গেলে একেবারে বন্ধ। শহরের লোকের ভিড় বাড়ছে। অথচ তাদের বসবাসের জন্য প্রয়োজনীয় ঘর কোঠা যেমন সরকারি পর্যায়ে তেমনি বেসরকারি পর্যায়েও নির্মাণ করা সম্ভব হয়নি। নির্মাণকাজ বন্ধ থাকায় বেকার বসে আছেন দেশের হাজার হাজার শ্রমিক। সিমেন্টের সরবরাহের ব্যাপারে অনিশ্চয়তা থাকায় তারা নিজেরাও ঠিক হতে পারছেন না কি করবেন। অনেকে আছেন যারা নির্মাণ কাজে বিশেষ অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেছেন। রীতিমতো কৌশলী এইসব শ্রমিকেরা না পারছেন তাদের পেশা ত্যাগ করতে, না পারছেন পুরনো পেশাই আঁকড়ে ধরে জীবনধারণের জন্য নূন্যতম প্রয়োজন পূরণ করতে। তাদের জন্য লাখ-লাখ টন সিমেন্ট আমদানির খবর নতুন করে বাঁচার আশ্বাস যোগাবে।
কিন্তু কথা হলো এই যে লাখ লাখ টন সিমেন্ট আসছে, আগেও এসেছে, সেসব কোন গর্তে গিয়ে জমা হচ্ছে। আমরাও নিজেরাও সিমেন্ট প্রস্তুত করি। চাহিদা পূরণে তা যথেষ্ট নয় ঠিকই হয় কিন্তু বিদেশ থেকে আজ পর্যন্ত যে পরিমাণে সিমেন্ট এসেছে তাও ঠিক ব্যবহৃত হয়েছে সঠিক ভাবে। সরকার ডিলার নিয়োগ করেন। তাদের বিক্রয় মূল্যও বেঁধে দেওয়া হয়। কিন্তু কতজন ডিলার সেই নির্ধারিত মূল্যে সিমেন্ট বিক্রয় কি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ একবার খতিয়ে দেখেছেন। গুদাম থেকে সিমেন্ট নিয়ে যাবার পরে ডিলাররা যে দামে হেঁকে বসেন তাতে বিশেষ প্রয়োজন থাকলেও যে সবাই শেষমেষ কিনতে পারেন না সে খবর তো হরহামেশাই পত্রপত্রিকায় ছাপা হচ্ছে। এবার আরও সিমেন্ট আমদানির খবর কি সে অবস্থার পরিবর্তন করতে সক্ষম হবে?
সিমেন্ট, রড এবং নির্মাণ কাজের প্রয়োজনীয় অন্যান্য উপকরণাদির স্বল্পতা আমাদের উন্নয়ন কার্যক্রমকে দারুণভাবে ব্যাহত করছে। সরকারের কাছে আমাদের আবেদন থাকবে যতটুকু সম্ভব এগুলো আমদানির পর তা বন্টনে যথাযথ সর্তকতা অবলম্বনের। যাতে করে যথা সময়ে তা ব্যবহারের পরিবর্তে কালোবাজারি এবং মজুদদারদের হাতে জমা না হতে পারে। দেশীয় উৎপাদন বৃদ্ধিতেও বিশেষ মনোযোগ দেয়া প্রয়োজন বলে আমরা মনে করি।
বিলম্বিত টেস্ট রিলিফ
অবশেষে দীর্ঘ প্রত্যাশিত টেস্ট রিলিফ কর্মসূচি প্রবর্তিত হতে চলেছে বলে খাদ্য ও ত্রাণ মন্ত্রী জনাব আব্দুল মমিন গতপরশু ঘোষণা করেছেন। গত ১৭ই নভেম্বর আওয়ামী লীগ পার্লামেন্টারি কমিটির বৈঠকে সারা দেশব্যাপী বাধ্যতামূলক ধান-চাল সংগ্রহ এবং টেস্ট রিলিফ কর্মসূচি প্রবর্তনের বিষয় নিয়ে আলাপ আলোচনা চললেও কবে এবং কি পরিমান লোককে এ কর্মসূচির আওতাধীন আনা হবে, বাধ্যতামূলক ধান চাল সংগ্রহের সুস্পষ্ট নির্দেশ মত টেস্ট রিলিফ এর ব্যাপারটিকে ঐ সময় খোলাখুলিভাবে প্রকাশ করা হয়নি। সেজন্য ব্যাপারটি আমাদের কাছে মোটামুটি ভাবে অস্পষ্ট লেগেছিল এবং বাংলার বাণী সম্পাদকীয় নিবন্ধে জরুরী ভিত্তিতে টেস্ট রিলিফ প্রবর্তনের পক্ষে বক্তব্য রাখা হয়েছিল সেই মাসাধিককাল আগেই। প্রধানমন্ত্রী গত পরশু একটি বার্তা সংস্থার কাছে এ সম্পর্কে যে বক্তব্য রেখেছেন তাতে সরকারি নীতির মোটামুটি সুস্পষ্ট ব্যাখ্যা দাঁড় করান হলেও দিন তারিখ সম্পর্কে অস্পষ্টতা এখনো বর্তমান। অর্থাৎ জানুয়ারি থেকে টেস্ট রিলিফ প্রবর্তিত হতে চলেছে নামক ঘোষণায় কেউ যদি মনে করেন জানুয়ারির মাঝামাঝি অথবা শেষাশেষি সময় থেকে শুরু হবে তাহলে তাকে দোষ দেয়া যাবে না। সেজন্য সঠিক দিন তারিখ অবিলম্বে ঘোষণা করা উচিত বলে আমরা মনে করি। সরকারী পক্ষে যারা মনে করবেন যে, টেস্ট রিলিফ কর্মসূচি সঠিক সময়ে গ্রহণ করা হচ্ছে তাদের সাথে আপাততঃ একমত হওয়া যাচ্ছে না প্রধানত দুটি কারণে। প্রথমতঃ বর্তমান মৌসুমে ধান ভালো হয়েছে এ কথাটা মেনে নিলেও সর্বগ্রাসী বন্যায় সর্বহারা মানুষেরা মহাজন বা শহুরেপুরে জোরদারদের খেতে কামলা খেটে তাদের অভাব মোচন করতে পারবে এটা সম্পূর্ণ দুরাশা।
এবং সেজন্যই বেশ আগে থেকেই টেস্ট রিলিফ কর্মসূচি প্রবর্তন করার দরকার ছিল। দ্বিতীয়তঃ ত্রাণমন্ত্রী যে উৎপাদনমুখী টেস্ট রিলিফ কর্মসূচির কথা ঘোষণা করেছেন তা কি আদৌ বাস্তবায়িত হতে পারবে? বাংলাদেশের বর্ষা শেষ হয়ে গেছে প্রায় দু’মাস আগে এবং ভিজে মাঝে শুকনা হতে সময় লেগেছে একটি মাস। সুতরাং এক মাস আগে থেকেই ছোট ছোট সড়ক, বাঁধ বা সেতু নির্মাণে একদিকে সময়ের পুরো সদ্ব্যবহার করা সম্ভব হতো, অপরদিকে রাস্তা বা বাঁধের জন্য কাটা মাটি বসে ভালোভাবে এঁটে যাওয়ার সুযোগ পেত। কিন্তু আগামী জানুয়ারি থেকে মাটির কাজ শুরু হলে ওই সময় থেকে বাংলাদেশে যে বৃষ্টি নামবে না তা কি কোনো নিশ্চয়তা ত্রাণমন্ত্রী দিতে পারবেন? তাহলে অবস্থাটা কি হবে? রাস্তার উপর ফেলা মাটি বৃষ্টিতে ধুয়ে যেতে কয়দিন লাগবে? আর সে সুযোগে টেস্ট রিলিফ তদারকিতে নিয়োজিত স্থানীয় কর্তাব্যক্তিরাও দু’কোদাল মাটি রাস্তায় ফেলে পুরো টাকাটাই গাপ করে দেবে না-অতীত অভিজ্ঞতা যাদের আছে তারা কি এর নিশ্চয়তা দিতে পারবেন? তাছাড়া মাত্র চারদিন সংসদের অধিবেশন বসার পর সদস্যদেরকে যার যার এলাকায় লেভী ধরার জন্য পাঠানো হলো; টেস্ট রিলিফ কর্মসূচির সামগ্রিক তদারকি ভারটা ওই সময় তাদের সাথে জুড়ে দিলে কাজের কি সুবিধা হতো না?
এতসব প্রশ্ন আমরা আগেই রেখেছিলাম। তবুও কাজ হয়নি। ত্রানমন্ত্রী বিলম্বে হলেও শেষ পর্যন্ত টেস্ট রিলিফের কথা বলেছেন। আমরা আশা করব টেস্ট রিলিফের অবস্থার সাথে যেহেতু আমরা সবাই পূর্ব পরিচিত, সেই তিক্ত অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে সার্বিক কর্মসূচির সাফল্য কিভাবে লাভ সম্ভব তা ভালোভাবে খতিয়ে দেখে কাজ শুরু করা হবে।
বিকল বাস সচল হতে কত ধকল পোহাতে হবে?
এমনিতেই রাজধানী ঢাকা নগরীর বাসিন্দাদের সমস্যার অন্ত নেই। তার ওপর দিনানুদৈনিক এই অন্তহীন সমস্যাসঙ্কুল জীবনের সংকট নিরসনের যন্ত্রণাক্ত অভিজ্ঞতাকে আরো তীব্রতর করে তুলেছে। বাস সংকটে শুধু যে নগরবাসীরা জর্জরিত তা নয়, শহর থেকে দূরে শহরতলীতে যারা বসবাস করছে তারাও বাস সংকটার্তের কবলে পড়ে রীতিমতো খাবি খাচ্ছে। রিক্সা কিংবা বেবিট্যাক্সি যোগে যাতায়াত করার সাধ থাকলেও সবার সাধ্যে তা কুলায় না। স্বল্পবিত্ত এবং নির্দিষ্ট আয় ভোগী মানুষের কাছে বাস তাই অফিসে যাওয়ার কিংবা এক স্থান থেকে অন্য স্থানে চলাচলের একটি প্রধান বাহন। নগরীতে চলাচলকারি সরকারি এবং বেসরকারি বাসের সংখ্যা যে একেবারে নগন্য তা নয়, সংখ্যাগত দিক দিয়ে বাসের পরিমাণ মোটামুটি ভালই। অন্ততঃ স্বাধীনতার অব্যবহিত পরবর্তীকালে সংখ্যাল্পতা এখন আর নেই। কিন্তু মূল সমস্যা হলো একমাত্র খুচরা যন্ত্রাংশের অভাবে বেশীরভাগ সরকারী এবং বেসরকারী বাসগুলো মুখ থুবরে স্থবির হয়ে পড়ে আছে। কোনদিন এই বাসগুলো সচল হবে কিনা সে নিশ্চয়তাও কেউ দিতে পারছে না। ফলে যত দুর্ভোগ সব ওই বাস যাত্রীদের কড়ায়-গণ্ডায় পোহাতে হচ্ছে। বাসযাত্রীরা প্রয়োজনীয় সংখ্যক বাসের অভাবে চোখে সর্ষেফুল দেখতে শুরু করেছে। সামান্য খুচরা যন্ত্রাংশের অভাবে নগরীর বাস চলাচল ব্যবস্থা আজ এক বিরাট অচলাবস্থার সৃষ্টি করেছে। এই অচলাবস্থা নির্দিষ্ট আয়ভোগী মানুষের স্বার্থে দীর্ঘদিন জিইয়ে রাখা যায় না। নগরীর বাস চলাচল ব্যবস্থা কে সুগম করতে হলে জরুরি ভিত্তিতে বিদেশ থেকে খুচরা যন্ত্রাংশ আমদানি করা দরকার। বিআরটিসি’র চেয়ারম্যান সাহেব জানিয়েছেন, রাজনৈতিক কারণে স্বাধীনতার পর এ পর্যন্ত বিদেশ থেকে কোনরকম খুচরা যন্ত্রপাতি আমদানি করা হয়নি। তাছাড়া বৈদেশিক মুদ্রা সংকটের কারণে খুচরা যন্ত্রাংশ আমদানি বিঘ্নিত হয়েছে। তবে বিআরটিসি’র চেয়ারম্যান সাহেব আশার বাণী এই টুকুই শুনেছেন যে, ইতালি থেকে নাকি কিছু খুচরা যন্ত্রাংশ আমদানির ব্যবস্থা গৃহীত হয়েছে। এ যন্ত্রাংশগুলো এসে এসে পৌঁছালে সাম্প্রতিক সংকটাপন্ন অবস্থায় হয়তো কিছুটা উন্নতি সাধিত হতে পারে। ইতালি থেকে কবে খুচরা যন্ত্রাংশ এসে পৌঁছাবে এবং কবে নাগাদ বিকল বাসগুলো আবার সচল হবে তা আমাদের অজ্ঞাত। খুচরা যন্ত্রাংশ আমদানির জন্য বৈদেশিক মুদ্রা ভবিষ্যতে কোনদিন পাওয়া যাবে কিনা তাও একটা সমস্যা। এই অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে, সাত মণ তেল না পুড়লে রাধা নাচবে না। সত্যিই তো, প্রয়োজনীয় বৈদেশিক মুদ্রার ব্যবস্থা না হলে খুচরা যন্ত্রাংশ আমদানি হবে কিভাবে? অতএব হে নগরবাসী, ধৈর্য ধরো, প্রতীক্ষা করো, বাস সংকটের ধকল একদিন না একদিন কেটে গেলে যেতেও পারে।
কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক