You dont have javascript enabled! Please enable it!

বাংলার বাণী
ঢাকা : ২৫শে নভেম্বর, সোমবার, ১৯৭৪, ৯ই অগ্রহায়ণ, ১৩৮১ বঙ্গাব্দ

জাতিসংঘে প্যালেস্টাইনী মুক্তি সংস্থা

এ কথা স্পষ্ট যে, প্যালেস্টাইনীদের মুক্তি সংগ্রাম সমগ্র বিশ্ব বিবেকের সমর্থন অর্জন করেছে। সম্প্রতি জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদ স্বাধীন সার্বভৌম প্যালেস্টাইন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব বিপুলভাবে সমর্থন করেছে এবং জাতিসংঘ প্যালেস্টাইনী মুক্তি সংস্থাকে স্থায়ী পর্যবেক্ষকের মর্যাদা দানের পক্ষে ভোট দিয়েছে। ইসরাইল ও যুক্তরাষ্ট্রের বিরোধিতা সত্ত্বেও জাতিসংঘে প্যালেস্টাইনী মুক্তি সংস্থাকে পর্যবেক্ষকদের মর্যাদা দেয়ার প্রস্তাবটির পক্ষে ৯৫টি ভোট পড়ে। বিপক্ষে ছিল ১৭টি দেশ এবং ভোটদানে বিরত ছিল ১০টি দেশ। আর স্বাধীন সার্বভৌম প্যালেস্টাইন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার প্রস্তাবটির পক্ষে সাধারণ পরিষদে ভোট পড়েছে ৮৯টি, বিপক্ষে ভোট দিয়েছে ৮টি এবং ৩৭টি দেশ ভোট দানে ছিল বিরত।
প্যালেস্টাইনের জন্য আরো শুভ সংকেত বহন করেছে ইউনেস্কোর সিদ্ধান্ত। সম্প্রতি প্যারিসে অনুষ্ঠিত ইউনেস্কোর সাধারণ সম্মেলনে প্যালেস্টাইন ও আফ্রিকান মুক্তি সংগ্রামের জন্য ভবিষ্যত কর্মসূচী বাজেটে বিশেষ অর্থ বরাদ্দের ব্যবস্থা রাখতে বলা হয়েছে। এই প্রস্তাবের পক্ষেও ৭৫টি দেশ ভোট দান করে, বিপক্ষে পড়ে ১৬টি ভোট এবং ভোটদানে বিরত থাকে ১০টি দেশ।
প্রসঙ্গতঃ উল্লেখ্য যে, প্যালেস্টাইনীদের মুক্তি সংগ্রাম তথা মধ্যপ্রাচ্য পরিস্থিতির অশান্তির দিকে চেয়ে এবং সেখানে একটা শান্তিপূর্ণ পরিবেশ গড়ে তোলার সদিচ্ছায় বিশ্বের সকল শান্তিকামী দেশ আজ প্রায় ঐক্যমতে পৌঁছেছে। মানবাধিকারের ভিত্তিতে ও ন্যায্য দাবীর প্রশ্নেই প্যালেস্টাইনীরা একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রের গন্ডি সহ আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার ফিরে পাক—এই শুভ কামনায় বিশ্ববিবেক আজ সোচ্চারও বটে। সম্প্রতি জাতিসংঘে প্যালেস্টাইনের অনুকূলে বহুসংখ্যক রাষ্ট্রের ভোট দান তারই সাক্ষ্য বহন করে।
জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে প্যালেস্টাইনীদের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার স্বীকার করে নেয়ার ব্যাপারে আরব রাষ্ট্রগুলো সহ যে ৩৭টি জোটনিরপেক্ষ দেশ দু’টি প্রস্তাব নেয় (প্রথমটি স্বাধীন সার্বভৌম প্যালেস্টাইন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা, দ্বিতীয়টি জাতিসংঘে প্যালেস্টাইনী মুক্তি সংস্থাকে ভোটাধিকার ছাড়াই স্থায়ী পর্যবেক্ষকের মর্যাদা দান) তার মধ্যে বাংলাদেশও ছিল। শুধু তাই নয়—প্যালেস্টাইনীদের মরণপণ মুক্তি সংগ্রামের নিষ্ঠা ও অবিচল আদর্শের প্রতি বাংলাদেশের জনগণের এবং স্বয়ং বঙ্গবন্ধুর দ্ব্যর্থহীন আন্তরিক সমর্থন বরাবর ছিল এবং এখনো আছে। তারই প্রেক্ষিতে প্যালেস্টাইন মুক্তি সংস্থার চেয়ারম্যান লৌহমানব ইয়াসির আরাফাত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে বিপ্লবী ও সংগ্রামী অভিনন্দনও জানিয়েছেন।
এ কথা সত্য যে, মুক্তিযুদ্ধের অভিজ্ঞতা থেকেই আমরা আত্মনিয়ন্ত্রণের সংগ্রামকে মূল্য দিতে শিখেছি। অনেক ত্যাগ-তিতিক্ষা, কষ্ট সাধনা ও আদর্শবোধের পবিত্র বেদীতে প্রাণ উৎসর্গ করার শপথ গ্রহণের যে কোনো ঝুঁকিই তখন কিভাবে যে দেশপ্রেমের সঙ্গে একাত্ম হয়ে যায় তাও মর্মে মর্মে অনুভব করার অবকাশ বাঙালী জাতি পেয়েছে। তবে প্যালেস্টাইনের স্বাধীনতা সংগ্রামের ঐতিহ্য দীর্ঘদিনের এবং সে দৃষ্টিকোণ থেকে তারা যে কোনো মুক্তিকামী দেশের কাছে অনুপ্রেরণার আদর্শরূপে চিহ্নিত হওয়ার যোগ্যতাও রাখে। এবং সংগ্রামের প্রায় দুই যুগ কালে প্যালেস্টাইন উদ্বান্তু শিবিরে যে ৭ লক্ষ শিশুর জন্ম হয়েছে তাদেরকে মাতৃভূমিতে প্রতিষ্ঠিত করবার দৃঢ় প্রতিজ্ঞায় প্যালেস্টাইনী মু্ক্তি সংস্থার অবিরাম রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম অবশেষে বিশ্ববিবেককে প্রভাবিত করলো—আমাদের আনন্দ সেইখানে।
কূটনীতিক মহল মনে করেন যে, এবার থেকে জাতিসংঘে সকল মুক্তি সংগ্রামের প্রতিনিধিত্বের পথ উন্মুক্ত হলো এজন্য ন্যায্য দাবীর ভিত্তিতে প্যালেস্টাইনী মুক্তি সংস্থার অনমনীয় সংগ্রামকে আমরা জানাই অভিনন্দন। ক্রমে স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্ররূপে প্যালেস্টাইনের প্রতিষ্ঠা সম্পন্ন হোক—আজকের দিনে এইটিই আমাদের একমাত্র ঐকান্তিক শুভকামনা।

বাড়ীভাড়া আইন প্রসঙ্গে

সরকার কয়েকদিনের মধ্যে শহরাঞ্চলের বাড়ী ভাড়া নিয়ন্ত্রণ সম্পর্কিত একটি দীর্ঘ প্রতীক্ষিত আইন প্রণয়ন করতে চলেছেন বলে নির্ভরযোগ্য মহলের বরাত দিয়ে একটি বার্তা সংস্থা এ খবর পরিবেশন করেছে। সংবাদটির মূল বক্তব্য হলো : ১৯৭৩ সালের জুন মাস পর্যন্ত যে বাড়ীর যে ভাড়া ছিল ঐ ভাড়াকে ন্যায্য ভাড়ায় স্থির রেখে সরকার অবিলম্বে একটি আইন প্রণয়ন করবেন। দেশের শহরাঞ্চলগুলোতে বসবাসরত ভাড়াটিয়াদেরকে বাড়ীর মালিকদের জুলুম হতে অব্যাহতি দেয়ার জন্য গঠিত বাড়ীভাড়া কমিটি যে সুপারিশগুলো করেছে গত শনিবার ভূমি প্রশাসন ও রাজস্ব মন্ত্রী শ্রী ফণী ভূষণ মজুমদারের সভাপতিত্বে উক্ত মন্ত্রণালয়ের সংসদীয় উপদেষ্টা কমিটির দুই ঘন্টা স্থায়ী বৈঠকে সুপারিশসমূহ পর্যালোচনার পর এই সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় বলে খবরে উল্লেখ করা হয়েছে। সুতরাং দেখা যাচ্ছে, ঊনিশ শ’ তিয়াত্তর সালের জুন মাসের পর যে সব বাড়ীওয়ালা তাদের বাড়ীর ভাড়াটিয়াদেরকে ভাড়া বৃদ্ধি করতে বাধ্য করেছিলেন—প্রণীত নতুন আইনের আওতায় বাড়ী ভাড়ার সে বর্ধিত হার আপনা আপনি বাতিল হয়ে যাবে।
স্বাধীনতার পর নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির অজুহাতে শহরের অধিকাংশ বাড়ীওয়ালা তাদের ভাড়াটিয়াদের উপর দফায় দফায় বাড়ী ভাড়া বৃদ্ধির নোটিশ প্রদান, মধ্যযুগীয় পন্থায় পানি ও বৈদ্যুতিক লাইন কেটে দেয়া এবং ক্ষেত্র বিশেষে গুন্ডা লাগিয়ে বাড়ীর ভাড়া দ্বিগুণ ত্রিগুণ এমনকি চতুর্গুণ পর্যন্ত করেছেন। অধিকাংশ ক্ষেত্রে চাকুরী নির্ভর এই সব ভাড়াটিয়াদেরকে নীরবে হয় তাদের অত্যাচার সহ্য করতে হয়েছে, নতুবা ছেলে মেয়ে ভাই বোনের পড়া বন্ধ করে সপরিবারে তাদেরকে দেশের বাড়ীতে পাঠিয়ে দিয়ে বাড়ীর কর্তাকে মেসে বেয়ে উঠতে হয়েছে। বলাবাহুল্য, শহরের মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত শ্রেণীকেই এই অসহায় অবস্থার শিকার হতে হচ্ছে। এই অবস্থায় বাড়ীভাড়া নিয়ন্ত্রণের এ খবর নিঃসন্দেহে নির্যাতিত ভাড়াটিয়াদের কাছে নিরতিশয় সুখের ও আনন্দের।
তবে এ প্রসঙ্গে আমাদের কিছু বক্তব্য রয়েছে—জানিনা সংশ্লিষ্ট দপ্তর এ বাস্তব দিকগুলো ভালো করে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছেন কিনা। বলা হয়েছে ১৯৭৩ সালের জুন পর্যন্ত নির্ধারিত বাড়ীর ভাড়া বহাল রাখা হবে। বাড়ীভাড়া কমিটি ও ভূমি প্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সংসদীয় কমিটির মাননীয় সদস্যরা নিশ্চয়ই জানেন যে, শহরাঞ্চলের অধিকাংশ বাড়ীওয়ালা ভাড়া গ্রহণ করে ভাড়াটিয়াদেরকে কোনো প্রকার রশিদ প্রদান করেন না। রশিদ চাইতে গেলে তাদেরকে উচ্ছেদ করার হুমকি দেয়া হয়। একদিকে সরকারকে প্রদত্ত কর ফাঁকি, অপরদিকে ভাড়াটিয়াদেরকে তাদের ন্যায্য অধিকার থেকে সুপরিকল্পিতভাবে বঞ্চিত রেখে যে কোনো মুহূর্তে বিনা নোটিশে উচ্ছেদের ক্ষেত্র উন্মুক্ত রাখার বর্বরোচিত পন্থা তারা অবলম্বন করে চলেছেন। শহরের শতকরা পঁচানব্বইটি বাড়ীর যেখানে এই অবস্থা সেখানে ঊনিশ শ’ তিয়াত্তর সালের জুন মাসের নির্ধারিত বাড়ী ভাড়া নিরূপণ করা যাবে কিভাবে? বাড়ীর মালিক যদি মিথ্যার আশ্রয় নিয়ে বর্তমানের ভাড়াকে তিয়াত্তর সালের জুনের ভাড়া বলে উল্লেখ করেন? যেখানে লিখিত কোনো ডকুমেন্ট নেই, সেই অচলাবস্থা মোকাবেলা কিভাবে করা হবে কমিটির সদস্যদেরকে বিষয়টি অতীব গুরুত্ব দিয়ে ভাবতে অনুরোধ করছি এবং আমরা মনে করছি বিকল্প ব্যবস্থা গ্রহণের কার্যকরী পদ্ধতি আসন্ন আইনটিতে উপস্থিত থাকবে।
বাড়ীভাড়া কমিটির কাছে আরেকটি প্রশ্ন রাখতে চাই। স্বাধীনতার পর পরই অধিকাংশ বাড়ীওয়ালা তাদের বাড়ীর ভাড়া অস্বাভাবিক হারে বৃদ্ধি করেছিলেন। বাড়ী ভাড়া বৃদ্ধির প্রবণতা বাড়ীওয়ালাদের মধ্যে বৃদ্ধি পায় বাহাত্তর সালের মাঝামাঝি সময় থেকে এবং তখন থেকে তিয়াত্তর সালের মাঝামাঝি পর্যন্ত তাদের বেশীর ভাগই বাড়ীর ভাড়া অস্বাভাবিক বৃদ্ধি করে। সুতরাং এই অবস্থায় যদি তিয়াত্তর সালের জুন মাসকে আইনের মাধ্যমে ফ্রিজ করা হয় : গোটা ব্যবস্থাটাই বাড়ীওয়ালাদের পক্ষে চলে যাবে। বিষয়টি আরেকবার চিন্তা করবার জন্য কমিটির সদস্যদেরকে অনুরোধ করছি। কারণ নতুন আইন প্রণয়ন করার উদ্দেশ্য হলো বাড়ীওয়ালাদের জুলুম থেকে ভাড়াটিয়াদেরকে রক্ষা করা। সেক্ষেত্রে আইনটি যেন ভাড়াটিয়াদের পক্ষে বুমেরাং না হয়ে দাঁড়ায়।
সর্বশেষ বক্তব্য হলো : জনগণের সুবিধার প্রতি লক্ষ্য রেখে বছর দেড়েক আগে শহরের রিকশা ও বেবী ট্যাক্সির ভাড়ার রেট বেঁধে দেয়া হয়েছিল। একটা লোকও বলতে পারবেন না যে মিউনিসিপ্যালিটির নির্ধারিত ঐ রেটে কেউ রিকশা বা বেবী ট্যাক্সির পাদানীর কাছেও যেতে পেরেছেন। কর্তৃপক্ষের কাছে অজুহাত সৃষ্টি হয়েছে, জনগণ চেয়েছিল, রেট বেঁধে দিয়েছি, এই ধরনের আরেকটি রেট নির্ধারণ আইনে যদি পরিণত হতে যায় বাড়ীভাড়ার ব্যাপারটি, তাহলে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে আমাদের সবিনয় নিবেদন, দরকার নেই ঐ ধরনের আইন করে। নতুন আইন দেখিয়ে ভাড়াটিয়া তার বাড়ীওয়ালার কাছে হ্রাসকৃত ভাড়া দিতে চাইলে ব্যাপারটিতো এখন লাঠালাঠির পর্যায়ে আছে শেষ পর্যন্ত তা খুনোখুনিতে যেয়ে পৌঁছাবে, কারণ রেন্ট কন্ট্রোল বোর্ড নামক একটা কেতাবী সংস্থার কথা ভাড়াটিয়াদের মুখে মুখে চালু থাকলেও বাড়ীভাড়া সমস্যার একটা কেসেরও তারা সমাধান করতে পেরেছেন এমন একটা ঘটনার কথাও আমরা কেউ শুনিনি। সুতরাং যা কিছু করুন, চারিদিকে আটঘাট বেঁধে করুন। ভাড়াটিয়াদের স্বার্থে যে আইন প্রণীত হতে চলেছে, বিপদের মুখে ভাড়াটিয়াদেরকে রক্ষার যেন উপযুক্ত ব্যবস্থা তাতে থাকে। কেতাবী রেন্ট কন্ট্রোল বোর্ড বা রিকশা বেবী ট্যাক্সির নামকাওয়াস্তে ভাড়া বেঁধে দেয়ার মতো অসার আইনের প্রয়োজন আমাদের কাছে নেই।

কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক

পত্রিকার মূল কপি পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!