ছাব্বিশে মার্চ স্বাধীনতা ঘােষণা প্রচার হওয়ার পর পুরাে চট্টগ্রাম জেগে ওঠে। এমনিতেই চট্টগ্রামের বীর জনতারা, ১লা মার্চের পর থেকেই স্বাধীনতার প্রশ্নে রাজপথে। তাদের একমাত্র শপথ, চাই স্বাধীনতা। বাংলার অন্যান্য অঞ্চলের মতােই চট্টগ্রামের। স্বাধীনতা প্রত্যাশীরা প্রতিরােধে ব্রত। সেদিন ছিল ৩০শে মার্চ, একাত্তর। লালখান বাজার অঞ্চলের মানুষ সাময়িক মুষড়ে পড়েছে। ইতিমধ্যে পাকবাহিনী দামপাড়া পুলিশ লাইন দখল করে নিয়েছে। অবশ্যই বাঙালি পুলিশ বাহিনী তীব্র প্রতিরােধ সৃষ্টি করেছিল পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে। কিন্তু পাকজান্তাদের উন্নত অস্ত্রের মুখে বাঙালি প্রতিরােধকারী যােদ্ধারা টিকে থাকতে পারেনি। ২৭শে মার্চ থেকে পুরাে লালখান বাজার এলাকায় পানি-বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ ছিল। এলাকাবাসী তাদের হৃদয়ের সমস্ত অনুভূতি দিয়ে প্রতিরােধকারী বাঙালি জোয়ানদের জন্য। খাদ্য জোগার করে পাঠিয়েছেন। বাংলার সাহসী সন্তান পুলিশবাহিনীর জন্য তার জামা, কাপড়, লুঙ্গিসহ বিভিন্ন ধরনের সাধারণ পােষাক সরবরাহ করেছেন। ৩০শে মার্চ সকাল থেকে পুরাে লালখান বাজারসহ আশেপাশের এলাকা পাকবাহিনীর দখলে চলে যায়। ২৮শে মার্চ থেকে পাকবাহিনী ও দামপাড়া পুলিশ লাইনের বাঙালি পুলিশদের সাথে লাগাতার যুদ্ধ শুরু হয়। প্রচুর বাঙালি পুলিশ এ প্রতিরােধে শহীদ হন। অবশেষে বাঙালির পুলিশ এলাকাবাসীর সহযােগিতায় পালিয়ে যায় দামপাড়া পুলিশ লাইন দখলের পর * পাকবাহিনীর নজর পড়ে লালখান বাজার এলাকার দিকে।
তারা সংবাদ সংগ্রহ করে জানতে পেরেছে লালখান বাজার এলাকার জনসাধারণ বাঙালি পুলিশদের সহযােগিতা দিয়েছে। পাকবাহিনী লালখান বাজার এলাকার মানুষের দিকে শুকুনী দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছে। তারা ২৯শে মার্চ থেকেই চালিয়েছে হত্যাকান্ড। ৩০শে মার্চ সকালে লালখান বাজার এলাকায় প্রচারিত হয় হাই লেভেল রােডের মুখে ওয়াটার ওয়ার্কস (ওয়াসা)-এর সামনে কলে পানি দিচ্ছে। এ সংবাদ পাওয়ার পর অনেকেই পানি আনতে রওয়ানা হন। কারণ পানি সমস্যা তখন তীব্র। এক ফোঁটা পানি তখন কোথাও নেই। পানির সংবাদ শুনে অনেকের সাথে কলসি নিয়ে পানি আনতে গেল আলী ইমামের বাসার কাজের ছেলে। রাজু প্রায় আধা ঘন্টা হয়ে গেল ছেলেটি ফিরে এল না। অবশেষে কাজী আলী ইমাম নিজেই বেরিয়ে গেলেন ছেলেটির খোঁজে। তখন সকাল ৭টা। তার সাথে গেলেন ভায়রা ভাই ডাঃ এ এম গােলাম মােস্তফা। কাজী আলী ইমাম ও ডাঃ গােলাম মােস্তফাকে পাকবাহিনী অনেকের সাথে গুলি করে হত্যা করে লাশগুলাে তখন পড়েছিল রাস্তার মাথায়। উন্মাদের মতাে ছুটে গিয়ে মনি ইমাম, রওশন মােস্তফা মিলে মৃতদেহ কোনরকমে ঘরে আঙ্গিনায় তুলে আনেন।
তারপর বৃদ্ধা মায়ের পরণের সাদা ধুতি দিয়ে লাঁশ দু’টিকে ঢেকে দেন। এক সময় দী, ছুরি, খুন্তি, চামচ দিয়ে ঘরের সামনে দেড় হাতের মতাে গর্ত করে দু’জনকে চিরদিনের মতাে শুইয়ে দেন। আলী ইমাম ও ডাঃ গােলাম মােস্তফা ছিলেন স্বাধীনতার অগ্রবর্তী সূর্য সৈনি। সমাজ সেবামূলক কাজ করেই তাঁরা তুপ্তি পেতেন। পবর্তীতে মনি ইমামের সন্তানেরা মুক্তিযুদ্ধে চলে যান। রওশন মােস্তফা তার এক বছরের শিশু কন্যাকে নিয়ে মুখ থুবড়ে পড়েছিলেন। ৪০ দিন পর শহীদদের রুহের জন্য বেলা বিস্কুট দিয়ে ফাতেহা দিয়েছিলেন। এ দুই শহীদের সাথে আরাে মারা যান নাসির, দোকান কর্মচারী, রুস্তম আলী, ডাঃ আলী নুর, প্রফেসর দোহা, সাদেক হাসান বাবুজি, আবুল ফজুল, সরওয়ার, ওয়াহাব, মেম্বার হােসেন ও তার দুই ছেলেইসহাস্হ আরাে অনেক। সাদেক হাসান বাবুজি ছিলেন চট্টগ্রাম মেডিকেল কুলেজের ৩য় বর্ষের ছাত্র। সে ছিল খুব ভাল দাবা খেলােয়াড়। তার সাথে শহীদ হন তার পিতা ও চাচা। অর্থাৎ লালখান বাজার অঞ্চলে সর্বমােট ২০১৭ জন মানুষ পাকবাহিনীর হাতে শহীদ হন। বাবুজির নাম কেউ বলেছেন সাদেক হাসান আবার কেউ বলেছেন সৈয়দ শাহাদাত হােসেন বড় বাবুজি। লালখান বাজার হত্যাকান্ড থেকে অলৌকিক ভাবে বেঁচে যান এ কে এম আনােয়ার হােসেন। তখন তিনি লালখান বাজার ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। পাকবাহিনী অনেকের সাথে তাকে ধরে নিয়ে যায় তাদের ক্যাম্পে।
তারপর সবাইকে হত্যা করে। জনাব আনােয়ার নিজেকে মৃতের মতাে করে অসংখ্য লাশের মধ্যে পড়ে থাকেন। রাত গভীর হলে তিনি কৌশলে চলে আসেন পুলিশের মসজিদে। সেখানে আলমিরার পেছনে লুকিয়ে থাকেন। পরে প্রবেশ করেন একটি বড় ড্রেনে। সেই ড্রেনের পথ ধরে তিনি আসেন নিরাপদ স্থানে। তার মুখ থেকে মৃত্যুর রূপের কথা শুনলে দেহ-মন চঞ্চল হয়ে
ওঠে। তার সাথে আরাে একজন আলৌকিকভাবে বেঁচে যান। তিনি সৈয়দ মােবারক হােসেন। তাকে রক্ষা করে ফাতেমী সাহেব নামক একজন বিহারী। লালখান বাজার হত্যাকান্ডের ইতিহাস লিখতে হলে প্রয়ােজন গবেষণার। তথ্য পেয়েছি শেষ সময়ে। তবে তথ্যের জন্য আরাে আন্তরিক সহযােগিতা পেলে ব্যাপকভাবে লেখা সম্ভব হত। তাই বাধ্য হয়ে খুব সংক্ষেপে এ লেখাটি লিখেছি।
(সূত্র ঃ রণাঙ্গনে সূর্য সৈনিক, সাখাওয়াত হােসেন মজনু ।)
সূত্রঃ মুক্তিযুদ্ধের দু’শো রণাঙ্গন – মেজর রফিকুল ইসলাম পিএসসি সম্পাদিত