You dont have javascript enabled! Please enable it! আটগ্রাম সংঘর্ষ - সংগ্রামের নোটবুক
আটগ্রাম সংঘর্ষ

একাত্তরের ৯ই নভেম্বর। সন্ধ্যা প্রায় সমাগত। পশ্চিম দিগন্তে লাল আভা ছড়িয়ে ক্রমশ সূর্যটা ডুবে গেল। ঘনিয়ে এল রাতের অন্ধকার। সুরমা নদীর তীরে অপেক্ষমান লেঃ জহিরের (বর্তমানে অবসরপ্রাপ্ত মেজর) নেতৃত্বে দুই কোম্পানি মুক্তিযােদ্ধা রাতের অন্ধকারে নদী অতিক্রম করে আটগ্রাম অভিমুখে যাত্রা শুরু করল। নিঃশব্দে মুক্তিযােদ্ধারা চারগ্রাম ও দর্পননগর গ্রামের সন্নিকটে সুরমা নদী অতিক্রম করে পাকসেনাদের অগ্রবর্তী ঘাঁটি পাশে রেখে এবং মূল ঘাঁটির সামনে রাস্তার দু’পাশে অবস্থান নিয়ে চরম আঘাত হানার জন্য ওৎ পেতে রইল।  অপরদিকে লেঃ গিয়াস (১৯৮১ সালের রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান হত্যাকান্ডে জড়িত থাকার অপরাধে মৃত্যুদন্ডপ্রাপ্ত) এক কোম্পানি মুক্তিযােদ্ধাসহ শত্রু অধিকৃত আটগ্রামজাকীগঞ্জ সড়ক মুক্ত করার জন্য অগ্রসর হল। ক্যাপ্টেন রব (বর্তমানে ব্রিগেডিয়ার) এক কোম্পানি মুক্তিযােদ্ধা নিয়ে ১০ই নভেম্বর ভােরে গােটাগ্রামে অবস্থান নিলেন। এখানে রাজাকারের একটি ক্যাম্প ছিল। প্রায় ১০/১২ জন রাজাকার তখন ঘুমােচ্ছিল। ক্যাপ্টেন রবের অতর্কিত হামলার মুখে এরা সবাই আত্মসমর্পণ করে। একজন রাজাকার কোন  মতে পালিয়ে গিয়ে আটগ্রামে অবস্তানরত পাকসেনাদের খবর দিতে সক্ষম হয়। ক্যাপ্টেন রবের নির্দেশে রাস্তার দু’পাশে দ্রুত ব্যাংকার খুড়ে প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তােলা হয়।  মুক্তিবাহিনীর অগ্রাভিযানের খবর পেয়ে পাকসেনাদের একটি দল সামনে অগ্রসর হতে থাকে। মুক্তিবাহিনীর সংখ্যা কত হতে পারে তা পাকসেনাদের জানা ছিল না। তারা মুক্তিবাহিনীকে গালাগালি করতে করতে খােলা মাঠের মধ্য দিয়ে অগ্রসর হচ্ছিল। ক্যাপ্টেন রব তার বাহিনী নিয়ে অপেক্ষা করতে লাগলেন।

পাকসেনারা রাইফেল রেঞ্জের মধ্যে আসামাত্র ক্যাপ্টেন রব গুলিবর্ষণের আদেশ দিলেন। এই অপ্রত্যাশিত আক্রমণের ফলে পাকসেনারা দিশেহারা হয়ে পড়ে। আনুমানিক চল্লিশজন পাকসেনা নিহত ও ১১ জন রাজাকার জীবিত আত্মসমর্পণ করে। মুক্তিবাহিনীর ২ জন শহীদ ও ৫ জন আহত হন। বিগ্রেডিয়ার রব এই সংঘর্ষের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে বলেছেন। They were shouting and saying “MUBJIB KA BACHAYHATIAR CHORDAO AGOR NA TO KUEZINDA WAPTES ANTHI AZOGAYE. They were advancing from both sides of the road. They were about a platoon strenght, when they came within hundred yards. I ordered to fire four light machine Guns, two from each side of the road, They got a shock of their jives. Within two minutes 18 of them fell on the ground and the rest of them took shelter of a Nallah and fled away. | প্রসঙ্গত উল্লেখযােগ্য যে, আটগ্রামে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর এক কোম্পানি নিয়মিত। সৈন্য, একটি রাজাকার কোম্পানি ও এক কোম্পানি খাইবার স্কাউটস অবস্থান করছিল। ভৌগোলিক অবস্থানের দিক থেকে আটগ্রাম, জাকীগঞ্জের গুরুত্ব ছিল অপরিসীম। পাকসেনা কর্তৃক রাতের অন্ধকারে আটগ্রাম ও জাকীগঞ্জ থেকে ভারত সীমান্ত অতিক্রম। করে ভারতীয় রেল লাইনের ওপরে মাইন পুঁতে রাখায় যাত্রীরা হতাহত হন।
সেক্টর কমাণ্ডার লেঃ কর্নেল (বর্তমানে অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল) চিত্তরঞ্জন দত্ত আটগ্রাম দখলের পকিল্পনা করলেন এবং দুই কোম্পানিসহ ক্যাপ্টেন এনামকে আটগ্রামের উদ্দেশ্যে অভিযানের নির্দেশ দিলেন। কিন্তু বিশেষ জরুরি প্রয়ােজনে ক্যাপ্টেন এনামকে কামালপুর যুদ্ধে পাঠান হলে লেঃ জহির ও লেঃ গিয়াস তাঁদের বাহিনী নিয়ে আটগ্রাম ও জাকীগঞ্জে অবস্তানরত পাকসেনাদের আক্রমণ করে। প্রথম ইস্টবেঙ্গলের এক কোম্পানি সৈন্য যােগ দিলে সংঘর্ষ তুমুল আকার ধারণ করে। মুক্তিবাহিনী আটগ্রাম ও জাকীগঞ্জ দখলের জন্য মরণপন লড়াইয়ে লিপ্ত থাকে। প্রায় দশ দিন ধরে এই সংঘর্ষ অব্যাহত থাকার পরে। ২০/২১শে নভেম্বরের রাতে আটগ্রাম ও জাকীগঞ্জ মুক্তিবাহিনীর পূর্ণ দখলে আসে।  ২১শে নভেম্বর রাতেই ক্যাপ্টেন রব এক কোম্পানি নিয়ে সালামটিলা এবং লেঃ জহির দুই কোম্পানি নিয়ে রাজটিলা আক্রমণ করেন। ২২শে নভেম্বরের মধ্যেই সালামটিলা ও রাজাটিলা শত্রুমুক্ত হয়। পাকসেনাদের প্রচুর গােলা বারুদ মুক্তিবাহিনীর হস্তগত হয়।
সুরমা নদীর তীর কানাইঘাট থানা সদর দপ্তর অবস্থিত। রণকৌশলগত কারণে এবং মুক্তিবাহিনীর অগ্রাভিযান অব্যাহত রাখার স্বার্থে কানাইঘাট দখলের নির্দেশ দিলেন। ক্যাপ্টেন রবকে কানাইঘাট দরবশত সড়কে প্রতিরােধ গড়ে তােলার জন্য বলা হল। ক্যাপ্টেন রব ২৫/২৬ শে নভেম্বর তার বাহিনীসহ লুকাছড়া চা বাগান এলাকায় অবস্থান নিলেন। উল্লেখযােগ্য যে, কানাইঘাটে পাকসেনাদের শক্তঘাঁটি ছিল। কানাইঘাট দখল করা জেড ফোর্সের দায়িত্ব থাকলেও চার নম্বর সেক্টরের ওপরের শেষ পর্যন্ত এই দায়িত্ব এসে পড়ে। ক্যাপ্টেন রব তার বাহিনী নিয়ে কানাইঘাট-দরবশত সড়কে অবস্থান নেয়ার ফলে পাকসেনাদের গতিবিধি সীমাবদ্ধ হল। পাকসেনারা ১০৫ মিলিমিটার গােলন্দাজ কামানের গােলা নিক্ষেপ করে অগ্রসর হওয়ার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়।  ডিসেম্বর ২/৩ তারিখে রাত ১-৩০ মিনিটে পাকসেনারা মুক্তিবাহিনীর অবস্থানের উপর কামানের গােলা নিক্ষেপ শুরু করে। মুক্তিবাহিনী ৩ ইঞ্চি মর্টারের গােলা নিক্ষেপ করে পাল্টা জবাব দেয়। ৩রা ডিসেম্বর মুক্তিবাহিনীর শত্রুর অবস্থানের ৩০০ গজের মধ্যে আসে। ভাের সাড়ে পাঁচটায় মুক্তিবাহিনীর ওপরে পাকসেনারা ব্যাপক হামলা চালায়। মুক্তিবাহিনী ক্ষিপ্রগতিতে পাকসেনাদের মােকাবিলা করে। পাকসেনাদের তিন দিক থেকে ঘিরে ফেলে ক্যাপ্টেন রবের নেতৃত্বে মুক্তিবাহিনী সকাল ৭-১৫ মিনিটে পাকঅবস্থান চার্জ করলে অধিকাংশ পাকসেনারা নিহত হয়। অনেক পাকসেনা নদীতে ঝাপিয়ে পড়ে প্রাণে বাঁচতে পারেনি। সকাল ৮-৩০ মিনিটের মধ্যেই মুক্তিবাহিনী কানাইঘাট দখল করে নেয়। এই সংঘর্ষে ১১ জন মুক্তিযােদ্ধা শহীদ হন ও ২০জন আহত হন।
লেঃ জাহরের নেতৃত্বে এক কোম্পানি মুক্তিযােদ্ধাকে প্রথম ইস্টবেঙ্গলের সাহায্যে পাঠানাে হল। পাকসেনারা দরবশতে সমবেত হতে লাগল। ৭ই ডিসেম্বর পাকসেনা মুক্তিবাহিনীর প্রচণ্ড আক্রমণের ফলে দরবশত পরিত্যাগ করে হরিপুরে অবস্থান নিল । ১১ই ডিসেম্বর পাকসেনারা নদী অতিক্রম করে অপর তীরে পৌছে মুক্তিবাহিনীর ওপরে আক্রমণ চালায়। মুক্তিবাহিনী এই আকস্মিক আক্রমণে বেশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ১২ই ডিসেম্বর মুক্তিবাহিনী ও মিত্রবাহিনী যৌথভাবে হরিপুর আক্রমণ করে দখল করে নেয়। সিলেট দখলের জন্য নিম্নলিখিত পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয় ? লেঃ কর্নেল জিয়াউর রহমান ১ম বেঙ্গল রেজিমেন্ট এবং ৪ নং সেক্টর ট্রপস-এর। একটি কোম্পানি নিয়ে সালুটিকার বিমান বন্দরের দিকে অগ্রসর হলেন। ভারতীয় সেনাবাহিনীর একটি ব্যাটালিয়ন হেলিকপ্টার যােগে সিলেট শহরের দক্ষিণ দিকে নামবে। এবং লেঃ কর্নেল জিয়া এবং ভারতীয়বাহিনী যৌথভাবে সিলেট আক্রমণ করবে। ৪ নং সেক্টর বাহিনী দরবশত এবং খাদিমনগর হয়ে সিলেট আক্রমণ করবে। ৩য় বেঙ্গল রেজিমেন্ট এবং ৫নং সেক্টর ট্রপস সম্মিলিতভাবে গােয়াঘাটা, ছাতক হয়ে সিলেটের পিছন দিক থেকে আক্রমণ করবে। একটি কোম্পানি নিয়ে ক্যাপ্টেন এনাম ভারতীয় বাহিনীর সহায়তায় মৌলভীবাজার হয়ে সিলেটের দিকে অগ্রসর হবে। লেঃ ওয়াকিউজ্জামান এবং ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট কাদের সেক্টর ট্রপস নিয়ে ভারতীয় বাহিনীর সহায়তায় ফেঞ্চুগঞ্জ হয়ে সিলেট আক্রমণ করবে।
হরিপুর সংঘর্ষের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে মেজর জেনারেল চিত্তরঞ্জন দত্ত বলেন । “আমাকে বলা হল হিমুর (পাকিস্তানীদের ঘাটি) পেছন দিকে থেকে পাকসেনাদের আক্রমণ করতে এবং যেখানেই হােক হিমু শত্রুমুক্ত করে হরিপুরের উপর আক্রমণ চালাতে । খাওয়া-দাওয়া সেরে গ্রাম থেকে দু’জন গাইড নিয়ে চললাম হিমুর উদ্দেশ্যে। সারা রাত নদী, খাল-বিল পার হয়ে পৌছলাম আটগ্রাম নামক এক গ্রামে। এখানে থেকে হিমুর দূরত্ব প্রায় দু’মাইল । আটগ্রামে পৌছলাম ভাের ৪টায়। সঙ্গে সঙ্গে মৌলভীবাজার সাহেবের আযান শােনা গেল। মনটা যেন কেমন করে উঠল। মেজর রব এবং ডাঃ নজরুলকে বললাম এই আযানের কি অর্থ হতে পারে ? তর্ক করার সময় তখন ছিল না।
গ্রামের পাশেই নদী। এই নদী পার হতে হবে। অনেক কষ্টে দুটো নৌকা যােগাড় করা গেল। ওপারে সবাই পৌছলাম। প্রায় ৭০০/৮০০ গজ দূরে খােলা মাঠ এবং মাঠের মধ্যে অনেকগুলাে উঁচু টিলা পুরাে আটগ্রামকে ঘিরে রেখেছে। সকাল হতে চলেছে। দেখলাম হিমু পর্যন্ত খােলা মাঠ। তাই আটগ্রামেই থাকার সিদ্ধান্ত নিলাম। সবাই মিলে আবার নদী পার হয়ে আটগ্রামে ফিরে আসলাম। আমার সৈন্যরা কোথায় থাকবে, কি খাবে ইত্যাদি। চিন্তা ভাবনারও সময় পাওয়া গেল না। সকাল প্রায় ৬টায় পাকিস্তানীরা আমাদের উপর হঠাৎ করেই ওঁ মর্টারের গােলা বর্ষণ শুরু করে। সঙ্গে সঙ্গে আমাদের উপর আরম্ভ হল মেশিনগান ও এলএমজির গুলিবর্ষণ। সৈন্যরা যে পজিশন নেবে তারও সময় নেই। হঠাৎ করে আক্রমণ হওয়ায় আমার সৈন্যরা একেবারে ছত্রভঙ্গ হয়ে গেছে। মৌলভীকে খোঁজে পাঠালাম, কিন্তু পাওয়া গেল না। চারধার থেকে খবর আসছে শুধু মুতের এবং আহতের। তাদের সংখ্যা ক্রমাগতই বেড়ে চলেছে। আটগ্রাম ছােট গ্রাম। বৃষ্টির মতাে গােলাগুলি হচ্ছিল। আমাদের এখন কিছুই করবার নেই। চিন্তা করলাম যদি আটগ্রামেই থাকি। তাহলে সবাই মারা পড়ব। কারণ পাকিস্তানীরা আমাদের অবস্থান জেনে ফেলেছে। তাই সবাইকে যে যেভাবে পারে পেছনে দু’তিন মাইল দূরে আর এক গ্রামে চলে যেতে বললাম। যখন আমরা আটগ্রাম ছেড়ে পেছনে গ্রামের দিকে যাচ্ছিলাম তখন দেখলাম। আমার ১১জন ছেলে শহীদ হয়েছে এবং ৫ জন গুরুতররূপে আহত।
পাকসেনাদের শেষ অগ্রবর্তী ঘাঁটি ছিল খাদিমনগরে। ১৫ই ডিসেম্বরে ডান দিকে মিত্রবাহিনী এবং বাম দিক থেকে মুক্তিবাহিনী অগ্রসর হল। খাদিমনগর সন্নিকটস্থ ঈদগা থেকে পাকসেনাদের অবিরাম গুলিবর্ষণ অব্যাহত ছিল। হাবিলদার গােলাম রসুল বিকেল পাঁচটায় একাই ক্রলিং করে সামনে অগ্রসর হয় এবং পাকঅবস্থানের উপর গ্রেনেড় চার্জ করল। পাকসেনারা ছত্রভঙ্গ হয়ে গেল, কিন্তু গােলাম রসুল জীবন নিয়ে ফিরে আসতে পারল না। স্বাধীনতা যুদ্ধের শেষ লগ্নে গােলাম রসুল জীবন বিসর্জন দিল স্বাধীনতার জন্য। আর অবশিষ্ট মুক্তিযােদ্ধা বীর বিক্রমে খাদিমনগর দখল করে নিল। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সৈন্যরা ১৬ই ডিসেম্বর আত্মসমর্পণ করল এবং সেই সাথে সিলেট শহর বিজয় মিছিলের শহরে পরিণত হল।

সূত্রঃ মুক্তিযুদ্ধের দু’শো রণাঙ্গন – মেজর রফিকুল ইসলাম পিএসসি সম্পাদিত