চারদিকে যুদ্ধের দামামা বেজে গেছে। অনিবার্য যুদ্ধকে সামনে রেখে বীর বাঙালি। এগিয়ে যায় ধাপে ধাপে। পাইকগাছা, কয়রা, আশাশুনি এলাকা থেকে নির্বাচিত এমএনএ গফুর সাহেব সাতক্ষীরা আসায় সাতক্ষীরার ছাত্র-যুব কর্মীরা প্রাণ ফিরে পায় এবং তাদের আশা উদ্দীপনা বৃদ্ধি পায়। গফুর ভাই বিপ্লবী চিন্তাধারার রাজনীতিক এবং বামপন্থি রাজনীতির উপর তার লেখাপড়া বেশ। সর্বত্রই সংগ্রাম পরিষদ, আওয়ামী সেচ্ছাসেবক বাহিনী ও স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের মাধ্যমে প্রতিরােধ সৃষ্টির লক্ষ্যে ব্যাপক কর্মকান্ড চালিয়ে যাচ্ছেন। জেলা শহর খুলনা যখন খানসেনারা দখল করেছে, তখন। মহকুমা শহর সাতক্ষীরায় শীঘ্রই পাকসেনা আসবে নিশ্চিত, এটা কেবলমাত্র সময়ের ব্যাপার। সুতরাং এই হায়েনার দলকে রুখে দাঁড়ানাের জন্য চাই অস্ত্র । কিন্তু অস্ত্র কোথায় পাওয়া যাবে? সাতক্ষীরা ট্রেজারীতে অস্ত্র আছে। অতএব পুলিশের সাথে যােগাযােগ করে অস্ত্র নেয়া যায় কিনা চিন্তাভাবনা হল। মােটেই দেরি না করে গফুর ভাই, সুবেদার আয়ুব, পুলিশের এসডিপি ওর সাথে আলাপ করলেন। খুলনা জেলার পুলিশ সুপার এআ খন্দকার বাঙালি জাতীয়তাবাদের ধারক ও বাহক ছিলেন। তিনি পূর্বেই আওয়ামী লীগ নেতৃত্বে। গঠিত সংগ্রাম পরিষদের সাথে যােগাযােগ রেখে তাদের কথা মতাে কাজ করার জন্য তার অধীনস্ত পুলিশ বাহিনীকে গােপন নির্দেশ দেন। সুতরাং এসডিপিও (মহকুমা পুলিশ। অফিসার) অস্ত্র দিয়ে দিতে রাজী হলেন।
সাতক্ষীরা ট্রেজারী থেকে ৩৫০ টা ৩০৩ রাইফেল ও ৩০/৪০ বাক্স গুলি পাওয়া গেল। মুস্তাফিজ, কামরুল ইসলাম খান, মাসুদ, এনামুল, হাবলু প্রমুখ অস্ত্র ও গােলাবারুদ গ্রহণ করে। এই সময় পুলিশের ভূমিকা ছিল। প্রশংসার যােগ্য। স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রাথমিক পর্যায়ে এসব অস্ত্র লাভ মুক্তিযুদ্ধের গতিপ্রকৃতিতে নতুন মাত্রা যােগ করে এবং ছাত্র-যুব-তরুণদের মনে প্রচন্ড আশার সঞ্চার করে। তারা আরাে আত্মপ্রত্যয় নিয়ে স্বাধীনতা যুদ্ধে ঝাপিয়ে পড়ে। ছাত্র-যুবকদের এই সময় সশস্ত্র যুদ্ধ সম্পর্কে যেমন কোন ধারণা ছিল না তেমনি। ওদের ছিল না অস্ত্রের কোন প্রশিক্ষণ। কিন্তু দেশকে হানাদার মুক্ত করার জন্য এসব তরুণ। ছাত্র যুবক বুকের তাজা রক্ত অকাতরে ঢেলে দিতে সদা প্রস্তুত। সাহস আর প্রাণপ্রাচুর্য্যে এদের কোন তুলনা হয় না। কাজল নামক একটা ছেলে আসে, সে ছিল পিএন দশম শ্রেণীর ছাত্র। তার আব্বা আশরাফ উদ্দিন খান ভােমরায় এসে স্বীয় পুত্র, কাজলকে বাড়ি নিয়ে যেতে চান। কাজলের বাড়ি ছিল সাতক্ষীরার পলাশপােলে। কাজলে আব্বার। আগমনের খবর পেয়ে অনেক ছাত্র যুবকই তাকে ঘিরে ধরে এবং সাতক্ষীরার মােস্তাফিজ। কাজলের আব্বাকে বলে, “চাচা কাজল আপনার ছেলে একথা ঠিক, কিন্তু আমরা কি আপনার কেউ নই?’ তখন কাজলের আব্বা জবাব দেন যে, কাজলের মা ছেলের জন্য খুবই ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। আর চারদিকে যে অবস্থা তাতে কাজলের মা খুবই কান্নাকাটি করছে। তখন অন্যান্য ছেলেরা বলে, ‘চাচা আমাদের বাড়িতে আমাদের মা-বাবাও তাে কান্নাকাটি করছে।’ তখন কাজলের আব্বা সবাইকে দোয়া করে, কাজল শহীদ হয়।
কাজল ছিল হৃষ্টপুষ্ট চমৎকার চেহারার সুন্দর প্রাণবন্ত একটা ছেলে। সাতক্ষীরা মহকুমায় ঐ সময় এসডিও ছিলেন পাঞ্জাবী, নাম তার খালেদ মাহমুদ, একজন সিএসপি অফিসার। এই পাঞ্জাবী এসডিও নিশ্চিতভাবে ভবিষ্যতে পাকিস্তানীদের পক্ষে এবং বাঙালিদের বিরুদ্ধে কাজ করবে। তাই তাকে ধরে ফেলার সিদ্ধান্ত হয়। এমএনএগফুর সুবেদার আয়ুবসহ ছাত্রনেতৃবৃন্দ এসডিও খালেদ মাহমুদকে গ্রেফতার করে মুসলীম লীগের গফুর সাহেবের বাড়িতে তার জিম্মায় রাখেন। সাতক্ষীরায় এই সময়। দু’জন গফুর ছিলেন। একজন মুসলীম লীগের গফুর যিনি পরবর্তীতে সংগ্রাম পরিষদের কোষাধ্যক্ষ হন। কিন্তু পরে পাকিস্তানীদের সেবাদাস বনে যান এবং অন্যজন সংগ্রামী বীর এমএনএ গফুর, যিনি নবম সেক্টরে মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক। | ২৯শে মার্চ, এসডিও খালেদ মাহমুদকে ভােমরায় আনার জন্য গফুর ভাই সহ কয়েকজন ছাত্রনেতা গফুর সাহেবের বাড়িতে যান। কিন্তু তিনি এসডিও কে হস্তান্তর করতে অস্বীকার করেন। সাথে সাথে ভােমরায় খবর পাঠানাে হয় সুবেদার আয়ূবকে। তিনি খবর পেয়েই এক গাড়ি ইপিআর সহ অতি দ্রুত মুসলীম লীগের গফুর সাহেবের বাড়িতে উপস্থিত হন। কিন্তু গফুর সাহেব এসডিওকে হস্তান্তর করতে একদম নারাজ। বহু কথা কাটাকাটি হয়, কিন্তু কাজ হল না। অতএব তাকে বন্দি করে গাড়িতে তােলা হল। তার বন্দুক নিয়ে নেয়া হল। এমন সময় গফুর সাহেবের পুত্রবধু (সিরাজের স্ত্রী) গফুর সাহেবের প্রাণের বিনিময়ে তাদের বাড়ির এক বাথরুমের ভিতর থেকে এস, ডি, ওকে ভােমরায় আনা হল। ভােমরা কাষ্টম অফিস তখন মুক্তিবাহিনীর ক্যাম্প।
সাতক্ষীরার এসডিও কে বন্দি করে আনা হয়েছে, তাকে দেখতে বহু লােকজন জমা হয়ে গেছে। গফুর ভাই ও সুবেদার আয়ূবের এ ধরনের কাজ ও সাহসিকতার প্রশংসা করছে সবাই এবং জিম্মাদার মুসলীম লীগের গফুর সাহেবের নিন্দা করছে। বিদ্যুৎ বেগে এ খবর রটে গেল চারদিকে, লােকমুখে এ খবর জেনে ছুটে এলেন এমএনএ কামালবখত সাকী। তিনি গফুর ভাইয়ের উপর প্রচন্ডভাবে রেগে গিয়ে তাকে ধমকাতে লাগলেন, কেন এসডিও কে এভাবে আনা হল? সাকী সাহেবের কথায় সাতক্ষীরার ছাত্র-যুবকরা দারুণভাবে আহত হল। পাঞ্জাবী এসডিওর প্রতি তার এই দরদের অর্থ ঠিক বুঝা গেল না। সালাম, মুস্তাফিজ, কামরুল গফুর ভাইয়ের পক্ষ নিয়ে সাকী সাহেবের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ালেন। সাকী সাহেব মনের আগুনে জ্বলতে জ্বলতে স্থান ত্যাগ করতে বাধ্য হলেন। পরে এসডিও। খালেদ মাহমুদকে বন্দি হিসেবে ভারতীয় কর্তৃপক্ষের নিকট হস্তান্তর করা হয়। | সাতক্ষীরা ট্রেজারী থেকে অস্ত্র গ্রহণ এবং পাঞ্জাবী এসডিও খালেদ মাহমুদকে বন্দি করে আনার ঘটনা ছিল অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। এর প্রতিক্রিয়াও ছিল ব্যাপক এবং সুদূর প্রসারী। একদিকে পাকবাহিনী ক্ষিপ্ত হয়ে যায়, পক্ষান্তরে মুক্তিবাহিনীর ছাত্র-যুবকের মধ্যে অভিনব রােমান্টিকতার সৃষ্টি করে। (সূত্রঃ স্বাধীনতার দুর্জয় অভিযান, স, ম, বাবর আলী )
সূত্রঃ মুক্তিযুদ্ধের দু’শো রণাঙ্গন – মেজর রফিকুল ইসলাম পিএসসি সম্পাদিত