You dont have javascript enabled! Please enable it! সাতক্ষীরা পাওয়ার হাউজে দুর্ধর্ষ আক্রমণ - সংগ্রামের নোটবুক
সাতক্ষীরা পাওয়ার হাউজে দুর্ধর্ষ আক্রমণ

সময়টা নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহ। ঘােনা ক্যাম্পে বসে আছেন আব্দুল মালেক, সােনা। মিয়া, আব্দুল্লাহ, গৌরচন্দ্র, আব্দুল মান্নান, রফিক, হরিপদ, আশরাফ হােসেন আছু, অরুণ। কুমার, কাছেম আলী ও কামরুজ্জামান বাবু। প্রতিদিনই ওদের হাতে কোন না কোন অপারেশনের কর্মসূচী থাকে। কোন দিন তারা পাকসেনাদের ডিউটিরত প্যাট্রোল পার্টির উপর হামলা চালায়, কখনও বা পাকসেনা শিবিরে চালায় গ্রেনেড আক্রমণ, আবার কখনও বা হামলা চালায় পিশাচ রাজাকারদের উপর। কিন্তু সেদিন ওদের হাতে তেমন কোন কাজ ছিল না। তখন পরিশ্রমী নিরলস এই দামাল ছেলেরা আলােচনায় বসেছিল কি করা যায় । ক্যাম্পে বসে শুধু শুধু খাওয়াকে তারা মেনে নিতে পারল না।  এমন সময় সাতক্ষীরা নিবাসী এ্যাডভােকেট কালিপদ রায় চৌধুরীর ছেলে মলয়কে ওদের দিকে আসতে দেখে মৃদু হেসে সবাই তাকে স্বাগত জানাল । প্রাথমিক শুভেচ্ছা বিনিময়ের পর মলয় জানাল, নবম সেক্টরের অধিনায়ক মেজর জলিল সাতক্ষীরা শহর। অপারেশনের কাজে ব্যবহারের জন্য দুটো TIME BOMB দিয়েছেন, সেটা কাজে লাগানাের ব্যবস্থা করার জন্যই তার আগমন। টাইম বােমার কথা শুনে উপস্থিত মুক্তিযােদ্ধারা সবাই বেশ পুলকিত হল এবং একত্রে সিদ্ধান্ত নিল যে ঐ রাতেই তারা  সাতক্ষীরা শহর আক্রমণ করবে। অন্তত একটা কাজ পেয়েছে ভেবে সবাই আশ্বস্ত হল। কিছুক্ষণ পর মলয় দুটো টাইম বােমা নিয়ে এল যা দেখতে প্রায় ২ ব্যান্ডের রেডিও-র। মতাে এবং প্রত্যেকটি বােমা ১২ পাউন্ড ওজন ছিল। ওরা ১১ জন রাত সাড়ে ৯ টায় সাতক্ষীরা শহরে প্রবেশ করে।

শহরে ঢােকার পূর্বেই রফিক, কামরুজ্জামান বাবু এবং অরুণ কুমার পথে থেকে যায় দল ছােট করার উদ্দেশ্যে। শহরের ঝলমল বৈদ্যুতিক আলােয় ওরা ঠিক ঠাহর করতে পারছিল না কি করবে। গােটা শহর মিলিটারী, রাজাকার আর শান্তিবাহিনীর সদস্য দিয়ে ঠাসা, মােড়ে মােড়ে তল্লাশী ও জেরা চলছে। শক্ত একটা প্রতিরক্ষা ব্যুহ রচনা করেছে শত্রুরা। তাদের চোখ ফাকি দিয়ে সাবধানে ওরা সাতক্ষীরা বালিকা বিদ্যালয়ের কাছে এল এবং সাতক্ষীরা খালের ব্রীজ পার হল। হঠাৎ একটা লােককে ওদের দিকে এগিয়ে আসতে দেখে একটা চিপা গলির ভিতর ওরা ঢুকে পড়ে। না লােকটা ওদের দেখতে পায়নি, আপন মনে চলে গেছে। সিদ্ধান্ত হল। সাতক্ষীরা কোর্ট বিল্ডিং উড়িয়ে দিতে হবে। কিন্তু বাধ সাধল সেখানকার বৈদ্যুতিক ঝলমলে আলাে আর নিঃচ্ছিদ্র পাহারা। ঠিক করল সাতক্ষীরা ফুড অফিস আক্রমণ করা হবে না, তেমন গুরুত্বপূর্ণ মনে হল না সেটা, অতএব ফুড অফিস আক্রমণের পরিকল্পনা বাদ। সেদিনের অপারেশনের গ্রুপ কান্ডার সােনা মিয়া প্রস্তাব দিল যে, এই সাতক্ষীরা শহর অপারেশনের অন্যতম বাধা বিদ্যুতের আলাে। অতএব এই আলাের উৎস পাওয়ার হাউজ উড়িয়ে দিতে হবে।
যে কথা সেই কাজ, সবাই তার কথায় একমত হল, কিন্তু কাজটা বড় কঠিন। কারণ একে কড়া প্রতিরােধ রূহ তদুপরি বিদ্যুতের ব্যাপার। সবাই অলি-গলি চোরাপথ মাড়িয়ে শত্রুর হায়েনা চোখ ফাকি দিয়ে রাত সাড়ে দশটা নাগাদ পাওয়ার হাউজের কাঁটা তারের বেড়ার ধারে উপস্থিত হল। সুন্দর করে বেড়া দেয়া, তাই ঢোকা। মুশকিল। ঢােকার জায়গা সাবধানে খুঁজতে খুঁজতে একজনের ঢােকার মতাে একটা। জায়গা পাওয়া গেল। ‘কাঁতারী’ (তার কর্তন করার যন্ত্র বিশেষ) দিয়ে কেটে জায়গা বড় করা হল এবং সােনা মিয়া ও আব্দুল্লাহ সেই জায়গা দিয়ে পাওয়ার হাউজের সীমানার ভেতর প্রবেশ করল অত্যন্ত সাবধানে। তারের বেড়ার পাশে ছিল প্রশস্ত ও গভীর পাকা ড্রেন। বাকীরা ড্রেনের আশ্রয় নিয়ে সােনা মিয়া ও আব্দুল্লাহ ACTION-এর অপেক্ষায় বসে থাকল  সাবধানে, অত্যন্ত সাবধানে এগুচ্ছে সােনা মিয়া আর আব্দুল্লাহ; জীবনে এই প্রথম ওরা পাওয়ার হাউজে ঢুকল, ঢুকেই দেখল কাঁটাতারের রােল করা বড় বড় বান্ডিলের পাশে ওরা লেপ্টে পড়ে। প্রায় নিঃশ্বাস বন্ধ করে একসময় ইঞ্জিন রুমে ঢুকে পড়ে। কাটা তারের বেড়া থেকে ইঞ্জিন রুম প্রায় ২০০ গজ দূরে ছিল, ইঞ্জিন রুমের পাশে শ’খানেক ডিজেলের ব্যারেল ছিল আর ৫০ গজ দূরে টুলে বসে ঝিমােচ্ছিল নিরাপত্তা প্রহরীরা ওরা দেখল লােহার পাতের উপর মােট ৮টা জেনারেটর সেট করা হয়েছে এবং নিচে একটা ফাক ছিল—যা দেখে ওদের মনে হল টাইম বােমাটা বসানাের জন্যই বােধহয় কেউ ফাকাটা আগে থেকেই তৈরি করে রেখেছে।
ওরা দ্রুত কাতারী দিয়ে ডেটোনেটারের মুখ কেটে মাত্র ৪ মিনিটে বােমা দুটো জায়গা মতাে সেট করে ডেটোনেটারে আগুন দিল। বাইরে তখন কেন যেন কুকুরে প্রচন্ড চিৎকার করছিল। কাজ শেষ, দ্রুত নিরাপদ আশ্রয়ে ফেরার পালা, মাত্র আধ ঘন্টার মধ্যে বােমা দুটো বিস্ফোরিত হবে। রাত ১১-২০ মিনিটে বােমা দুটো সেট করে নিরাপদে ওরা স্টেডিয়ামের পাশে এল, প্রাণ ভরে লম্বা নিঃশ্বাস নিল। এ সময় আব্দুল্লাহ প্রস্তাব দিল যেহেতু খায়রুল ক্যাম্পে সেহেতু ওর বাড়িতে সংবাদ দিয়ে। আসা যাক। কারণ স্টেডিয়ামের কাছেই খায়রুলের বাড়ি। আব্দুল্লাহ নিজেই তার বাড়ি গেল। চারদিকে অন্ধকার। শুধু একটা ঘরে মিট মিট করে হারিকেন জ্বলছে। সন্তর্পণে জানালা খুলে দেখল খায়রুলের ছােট ভাই আফজাল ঘুম জড়ানাে চোখে পড়ছে। আস্তে করে তাকে ডাকতেই প্রচন্ড ভয় পেয়ে সে বই, টেবিল, হারিকেন সব উল্টে দিল। আব্দুল্লাহ কোন মতে বলল, ‘আমরা মুক্তিযােদ্ধা। খায়রুল ভাল আছে এবং ক্যাম্পে সুস্থ অবস্থায় আছে।’ এটুকু বলেই সে কেটে পড়ল। ঘড়িতে তখন রাত ১১-৪০ মিনিট অর্থাৎ হিসেব মতাে আর ১০ মিনিটের মধ্যেই বােমা দুটো বিস্ফোরিত হবে। সাবধানে ওরা সাতক্ষীরা শহর পার হচ্ছিল।

হঠাৎ পাহারারত লাঠি হাতে কিছু রাজকার ‘হল্ট’ বলে ওদের থামাল। সােনা মিয়া স্টেনগান ঠেকিয়ে রাজাকারদের হটিয়ে দিল। ঠিক রাত ১১-৫০ মিনিটে আকাশ বাতাস কাঁপিয়ে বিস্ফোরিত হল বােমা দুটিনড়ে উঠল সাতক্ষীরা শহর। একের পর এক ডিজেল ব্যারেলে আগুন লেগে তার লেলিহান শিখায় রক্তবর্ণ ধারণ করল পাওয়ার হাউজ এলাকা, অনেক দূর থেকে তা বােঝা যাচ্ছিল। মিলিটারী ও রাজাকার ক্যাম্প থেকে অনবরত গুলি হচ্ছিল। রাত ১২টায় মুক্তিযােদ্ধারা তেজমহল (তােজাম্মেল হােসেন)-এর বাড়ি গিয়ে পান্তা ভাত খেল। গােলাগুলি কিছুটা থামলে ওরা পরাণদহে রজব আলী ও মােক্তার সরদার প্রমুখের বাড়ি আশ্রয় নেয়। পরদিন জানল ওদের পাতান বােম বিস্ফোরিত হয়ে পাওয়ার হাউজ এমন ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে যে, ২/১ মাসেও তা ঠিক করা যাবে না। এ ঘটনায় জড়িত থাকার সন্দেহে পাওয়ার হাউজের হেড ক্লার্ক ও কিছু কর্মচারীকে মিলিটারীরা পিটিয়ে মেরে ফেলে। নিরীহ। কর্মচারীদের এই নারকীয় হত্যার ঘটনা ওদের আজ পীড়া দেয়। ( সূত্র ও স্বাধীনতার দুর্জয় অভিযান, স, ম, বাবর আলী।)

সূত্রঃ মুক্তিযুদ্ধের দু’শো রণাঙ্গন – মেজর রফিকুল ইসলাম পিএসসি সম্পাদিত