You dont have javascript enabled! Please enable it!
মনতলা কমপ্লেক্স -এর লড়াই

১৯৭১ এর মার্চে দ্বিতীয় বেঙ্গল রেজিমেন্ট বিদ্রোহ ঘােষণা করে। পূর্ব পরিকল্পনা মােতাবেক মযমনসিংহ টাংগাইল, জয়দেবপুরে ছড়িয়ে থাকা দ্বিতীয় বেঙ্গলের মুক্তিপাগল সৈনিকেরা বিদ্রোহ ঘােষণার পর ময়মনসিংহ শহরে এসে একত্রিত হয়। বাংলাদেশে কর্মরত অন্যান্য বেঙ্গল রেজিমেন্টের সাথে কোন যােগাযােগ না থাকায় কে কি করছে তা মেজর সফিউল্লাহ (বর্তমানে মেজর জেনারেল) জানতে পারছিলেন না। এ সময় ওয়ারলেসে বহুচেষ্টায় পাকবাহিনীর অভিযানের দুটি গুরুত্বপূর্ণ দিক সম্পর্কে আমরা জানতে পারি। এক, কুষ্টিয়ায় পাকবাহিনীর সম্পূর্ণভাবে পরাস্ত হওয়া বিষয় এবং দুই চট্টগ্রামস্ত বিদ্রোহী অষ্টম বেঙ্গলের হাতে পাকবাহিনীর ক্ষয়ক্ষতির ঘটনা। কুষ্টিয়াসহ অনান্য স্থানে নিয়ােজিত নিরুপায় পাকবাহিনীর আরাে সৈন্য পরিত্রানের জন্য ঢাকা সদর দপ্তরে। ওয়ারলেসে অনুরােধ করতে থাকে। পরিস্থিতি বিবেচনায় মেজর সফিউল্লাহ ঢাকার উপর আক্রমণ চালাবার সিদ্ধান্ত নেন। উদ্দেশ্য ঢাকা সেনানিবাসের উপর চাপ সৃষ্টি করা যাতে সাহায্যের জন্য সেখান থেকে অন্যত্র সৈন্য প্রেরণ করা না যায়। ঢাকার দিকে অগ্রসর হবার দুটো পথ তখন মেজর সফিউল্লাহর জানা ছিল। এক, জয়দেবপুর অথবা সাভার হয়ে ঢাকা, দুই নরসিংদী হয়ে ঢাকা। ঢাকা সেনানিবাসের উপর সরাসরি ও আকস্মিকভাবে আক্রমণ চালাবার কথা বিবেচনা করে মেজর সফিউল্লাহ জানতে পারল যে, মেজর (পরবর্তী মেজর জেনারেল) খালেদ মােশাররফ তার ব্যাটালিয়ান নিয়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় পাক শত্রুর বিরুদ্ধে শক্তিশালী প্রতিরােধ সৃষ্টি করে চলেছেন। তার সাথে আলােচনার জন্য মেজর সফিউল্লাহ ব্রাহ্মণবাড়িয়া যান। ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় মেজর খালেদের সাথে আলােচনার পর মেজর শফিউল্লাহ সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করে ঢাকায় না গিয়ে তখন পর্যন্ত যেসব এলাকা মুক্ত তা নিজের দখলে রেখে পরবর্তী রণকৌশল নির্ধারণের উপর গুরুত্ব আরােপ করেন।

মেজর সফিউল্লাহ দ্বিতীয় বেঙ্গল রেজিমেন্ট নিয়ে তেলিয়াপাড়া এলাকায় মুক্তাঙ্গন রক্ষার দায়িত্ব গ্রহণ করেন। তেলিয়াপাড়ায় সদর দপ্তর স্থাপিত হয়। ঢাকা-সিলেট। মহাসড়ক ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া-আশুগঞ্জ রেল পথের বেশ কিছু অংশ আমাদের নিয়ন্ত্রণে রাখার। জন্য পরবর্তীতে মেজর সফিউল্লাহকে পাকবাহিনীতে প্রবল আক্রমণের মুখােমুখি হতে হয়। তেলিয়াপাড়াকে রক্ষা করার জন্য ঢাকা তেলিয়াপাড়া এসিস-এ তিনটি এবং সিলেট। তেলিয়াপাড়া এসিসে দুটি লড়াইয়ের মুখােমুখি হতে হয়। কিন্তু তা সত্ত্বেও জুনের। মাঝামাঝিতে ২১দিন একটানা প্রাণপণ লড়াই করেও মেজর সফিউল্লাহ তেলিয়াপাড়া ধরে। রাখতে ব্যর্থ হয়। ফলে পাকবাহিনীর ঢাকা-সিলেট মহা সড়কে প্রধান বাধা অপসারিত হয়। আর এ পরাজয় মেজর সফিউল্লাসহ তার সেনাবাহিনীর জন্য বয়ে আনে দুঃখ আর বিষন্নতা। এ অবস্থার পরিপ্রেক্ষিত তেলিয়াপাড়া থেকে মেজর সফিউল্লাহর মূল বাহিনী সরে এসে মনতলা কমপ্লেক্স-এ নতুন ভাবে অবস্থান গ্রহণ করেন। তবে ক্যাপ্টেন (বর্তমানে মেজর জেনারেল) মতিনের অধীনে একটি কোম্পানী তেলিয়াপাড়া সংলগ্ন ভারতীয় এলাকা থেকে শত্রুবাহিনীর গতিবিধির উপর নজর রাখে এবং একই সাথে তাদের অবাধ চলাফেরায় বাধা সৃষ্টি করতে থাকে। হবিগঞ্জ জেলার অধীন মনতলা নির্জন ছােট্ট একটি রেলওয়ে স্টেশন।
মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে এ এলাকাটি হয়ে ওঠে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষ করে জুনে তেলিয়াপাড়া শক্রর দখলে চলে যাবার পর মনতলা ছিল মেজর সফিউল্লাহর শেষ অবস্থান। বাংলাদেশের মাটি থেকে যুদ্ধ পরিচালনা শেষ ভরসা ব্রাহ্মণবাড়িয়া-সিলেট হাইওয়ের পূর্বপাশে ভারতীয় সীমান্তের নিকট উচু টিলার উপর অবস্থিত এ কমল্পেটির উত্তরে স্টেশন। মনতলায় ওরশপুর স্টেশনে মধ্যবর্তী রেলপথ ও তৎসংলগ্ন এলাকাতেই মেজর সফিউল্লাহ অবস্থান নিলেন। এ এলাকা সফিউল্লাহ দখলে রাখতে সর্বশক্তি নিয়ােজিত করার সিদ্ধান্ত নেন। অন্যদিকে শত্রুবাহিনীর কাছে ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে সিলেট যাবার পথে মনতলাই ছিল শেষ বাবা। এ বাধা অপসারণের জন্য তারা উন্মত্ত হয়ে উঠে। বিশেষ করে রেলপথ মেজর সফিউল্লাহ সরাসরি কজায় থাকায় শত্রুপক্ষ না পারছিল রেলযােগে আখাউড়া সিলেট পথে চলাচল করতে, না পারছিল নির্বিঘ্নভাবে ব্রাহ্মণবাড়িয়া সিলেট সড়ক। পথ ব্যবহার করতে। আর মেজর সফিউল্লাহ দৃঢ় প্রতিজ্ঞ হলেন যে, কোন অবস্থাতেই এ এলাকা শত্রুপক্ষের হাতে ছেড়ে দেয়া যাবে না। তেলিয়াপাড়া যুদ্ধে মেজর সফিউল্লাহ দুই কোম্পানী দারুণভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হওয়ায় মনতলা রক্ষার জন্য হাতে ছিল মাত্র তিনটি কোম্পানী। এ তিনটিকে আখাউড়া সিলেট রেলপথের দু’পাশে মােতায়েন করা হয়। ক্যাপ্টেন (বর্তমানে মেজর জেনারেল) নাসিমের কোম্পানী মনতলা স্টেশন এলাকা রক্ষার দায়িত্ব গ্রহণ করে এবং তার দক্ষিণে ক্যাপ্টেন (বর্তমানে ব্রিগেডিয়ার) সুবেদ আলী ভুইয়ার কোম্পানী কাশিমপুর রেলওয়ে স্টেশন এলাকা রক্ষার দায়িত্বে নিয়ােজিত হওয়ায় ক্যাপ্টেন (বর্তমানে মেজর জেনারেল) মঈন প্রথম বেঙ্গল রেজিমেন্টের কমাণ্ডিং অফিসারের দায়িত্ব দিয়ে অন্য সেক্টরে বদলী হয়ে যাওয়ায় লেফটেন্টের (বর্তমানে ব্রিগেডিয়ার) মাের্শেদকে তৃতীয় কোম্পানীর নেতৃত্ব দেওয়া হয়। মাের্শেদের কোম্পানী দক্ষিণে হরশপুর রেলওয়ে স্টেশন এলাকায় অবস্থান গ্রহণ করে। এ তিনটি কোম্পানীর কৌশলগত অবস্থানের কারণে শত্রুর সরবরাহ পথে হুমকির সৃষ্টি করে। এ হুমকির অপসারণের জন্য শত্রুবাহিনী মরিয়া। হয়ে ওঠে। কিন্তু তিন সপ্তাহ ধরে বার বার আক্রমণ করা সত্ত্বেও তাদের চেষ্টা ব্যর্থ হয় এবং শত্রুপক্ষ এসব খণ্ডযুদ্ধে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির সম্মুখীন হয় এবং পিছু হটতে বাধ্য হয়। মনতলা কমপ্লেক্স-এ মেজর সফিউল্লাহর অজ্ঞাতসারে সরাসরি অগ্রসর হতে পারছিলেন।
উপরন্তু প্রথাগত কৌশল অবলম্বন করে আক্রমণ পরিচালনার কারণে তারা বিপুল। ক্ষয়ক্ষতির সম্মুখীন হতে থাকে। তাই তারা যুদ্ধ কৌশলে পরিবর্তন এনে ১৫ই জুন থেকে নতুন ভাবে আক্রমণ চালায়। এবার শত্রুপক্ষ রাতের অন্ধকারে আটিলারী গােলা বর্ষণের সুযােগে নালা অতিক্রম করতে করতে আমাদের অবস্থানের দিকে অগ্রসর হতে থাকে। মেজর সফিউল্লাহ এধরনের আক্রমণের মুখে প্রায় নিরুপায় হয়ে পড়েন। শত্রুর। মােকাবেলার জন্য এ সময় মেজর সফিউল্লাহর হাতে ছিল কয়েকটি মটরি ও হালকা কিছু অস্ত্রশস্ত্র । ফলে অগ্রসরমান শত্রুপক্ষের উপর দূর থেকে কার্যকরী আঘাত হানবার ক্ষমতা ছিল সীমিত। দুর্বলতার সুযােগে শত্রুপক্ষ নিশ্চিন্তে তাদের যুদ্ধ কৌশল বাস্তবায়ন করে চলে। স্বল্প সময়ের জন্য মটারের গােলা বর্ষণের মাধ্যমে দ্রুত অগ্রসরমান শত্রু পক্ষের গতিকে কমাতে সক্ষম হলেও গােলাবারুদের স্বল্পতার কারণে কার্যকরী অর্থে আঘাত। হানতে মেজর সফিউল্লাহ ব্যর্থ হন। এভাবে পাঁচদিনে শত্রুপক্ষ মেজর সফিউল্লাহর বাহিনীর অবস্থানের বেশ নিকটে চলে আসে। সফিউল্লাহর সকল অবস্থানের উপর তাদের আক্রমণের মাত্রাও বেড়ে যেতে থাকে। এ সময় শত্রুপক্ষ জঙ্গী বিমানের সাহায্যে সফিউল্লাহর অবস্থানের ছবিও তুলতে থাকে। সম্ভাব্য আক্রমণের বিষয়টি অনুমান করে সফিউল্লাহ বেশ শংকিত হয়ে পড়েন।
ক্রমাগত পাঁচদিন একরকম বিরতি ছাড়াই নাসিমের কোম্পানী শত্রুপক্ষের আক্রমণের মুখে বেশ নাজুক হয়ে পড়েন। নাসিম বার বার অতিরিক্ত সেনা চেয়ে সফিউল্লাহর হেড কোয়ার্টারে সংবাদ পাঠাতে থাকে। যদিও তার চাহিদা ছিল অত্যন্ত বাস্তব ও ন্যায় সঙ্গত। কিন্তু সফিউল্লাহর পক্ষে তখন। আর কোন অতিরিক্ত সৈন্য না থাকায় তিনি তেলিয়াপড়া এলাকায় নিয়ােজিত মতিনের কোম্পানী থেকে এক প্লাটুন সৈন্য ২০শে জুন নাসিমের কোম্পানীকে সাহায্য করতে পাঠিয়েছেন। রাতের অন্ধকারে তারা যথাস্থানে অবস্থান নেয়।  পরের দিন ২১শে জুন। আকস্মিকভাবে শত্রুপক্ষের চারটি ব্যাটেলিয়ান একযােগ। মনতলা কমপ্লেক্স-এর উপর আক্রমণ হানে। গােলন্দাজ বাহিনীর সহায়তায় ভােরের। দিকে তিনদিক থেকে আক্রমণ হানা হয়। শত্রুপক্ষের যে ব্যাটালিয়ান দুটো নালা অতিক্রম। করতে করতে নাসিমের কোম্পানীর দিকে অগ্রসর হচ্ছিল তারা নাসিমের কোম্পানীর উপর সরাসরি আক্রমণ চালায়। পশ্চিমে চান্দুরার দিক থেকে শত্রুপক্ষের এক ব্যাটালিয়ান ভূঁইয়ার অবস্থানের উপরও হামলা চালায়। অপরদিকে মুকুন্দ অর্থাৎ দক্ষিণ পশ্চিম দিক থেকে শত্রুপক্ষের আর একটি ব্যাটালিয়ান মাের্শেদের অবস্থানের উপর আক্রমণ হানে। চান্দুরার দিক থেকে অগ্রসরমান শত্রুপক্ষ প্রচণ্ড দ্রুততার সাথে ভূইয়ার অবস্থানকে অতিক্রম করে হরশপুর অবস্থানরত মাের্শেদের কোম্পানীর উপরও হামলা চালায়। এই চরম অবস্থায় শত্রুপক্ষ হেলিকপ্টারের সাহায়তায় মাের্শেদের অবস্থানের পেছনে ছাত্রীসেনা নামাতে থাকে। ফলে সফিউল্লাহর অবস্থা আরাে নাজুক হয়ে পড়ে। এ সংকটময় অবস্থায় ভূঁইয়া এবং মাের্শেদের কোম্পানী চারদিক থেকে শত্রু পরিবেষ্টিত অবস্থায় যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছিল।
সফিউল্লাহর কাছে তখন মতিনের দুটো প্লাটুন ছাড়া অন্য কোন সৈন্য ছিল না। নাসিম অতিরিক্ত সৈন্য পাঠাবার জন্য অনুরােধ জানাচ্ছিল। সফিউল্লাহ না পারছিলেন বসে বসে শত্রুপক্ষের হাতে পরাজয় স্বীকার করে নিতে, না পারছিলেন অতিরিক্ত সৈন্য প্রেরণ করতে। এসময় মাের্শেদের কোম্পানীকে শত্রুর মরণথাবা থেকে বের করে আনবার লক্ষ্যে সফিউল্লাহ মতিনের দুটো প্লাটুন নিয়ে শত্রুপক্ষের উপর পাল্টা আক্রমণের সিদ্ধান্ত নেন। নাসিমের নাজুক অবস্থানের কথা বিবেচনা করে সফিউল্লাহ প্রয়ােজনে তাকে তার। অবস্থান থেকে পিছু হটে আসতে নির্দেশ দেন। সিদ্ধান্ত মােতাবেক মাের্শেদের অবস্থানের। দিকে এগিয়ে যাবার পথে সফিউল্লাহ ভুইয়ার কোম্পানীকে পিছু হটে আসতে দেখেন। তাৎক্ষণিক ভাবে তাদেরকে সংঘটিত করে মতিনের দুটো প্লাটুনসহ করকলিয়ার দিক । থেকে শত্রুপক্ষের উপর পাল্টা আক্রমণ হানে। এতে শত্রুপক্ষ বেশ হকচকিয়ে যায় তবু তাদেরকে হরশপুরের একাংশ থেকে পিছু হটিয়ে দিতে সক্ষম হন। সফিউল্লাহর মরনকামড় ফল বয়ে আনে। এ আক্রমণের ফলে সফিউল্লাহ যে কেবল মাের্শেদের। কোম্পানীকেই সাক্ষাৎ মৃত্যুর হাত থেকে ফিরিয়ে আনেন তাই নয় বরং বেশ কিছু এলাকাও সফিউল্লাহ বাহিনীর দখলে আসে। যদিও হরশপুর-মুকুন্দপুরের মধ্যবর্তী প্রায় চল্লিশ বর্গ মাইল এলাকায় পুনরুদ্ধার কৌশলগত দিক দিয়ে তেমন গুরুত্বপূর্ণ ছিল না, তথাপি শত্রুপক্ষের এ প্রচণ্ড আক্রমণের মুখে তাদের কাছ থেকে এ এলাকা কেড়ে নেওয়া গর্বের আনন্দের বিষয়। উল্লেখযােগ্য এ এলাকাটি দেশ স্বাধীন হওয়া পর্যন্ত মুক্তিবাহিনীর দখলেই ছিল।
মুক্তিবাহিনীর সেদিনের গৌরবজ্জ্বল ইতিহাসের পিছনে ছিল সকল সৈনিকের দেশাত্মবােধ ও মাতৃভূমি স্বাধীন করার জন্য জীবন উৎসর্গ করবার মহান অঙ্গীকার। তবে সফিউল্লাহর সেদিনকার যুদ্ধ জয়ের পেছনে সবচেয়ে বেশি অবদান ছিল। মুক্তিযােদ্ধা দৌলামিয়ার। দৌলামিয়ার সেদিনকার বীরােচিত ভূমিকার কথা ভুলবার নয়। তার সম্পর্কে দু’একটা কথা না বললেই নয়। | দৌলামিয়ার আদি নিবাস কুমিল্লার শালদা নদী গ্রামে। লম্বা ও সুঠাম স্বাস্থ্যের অধিকারী দৌলামিয়া স্বাধীনতার যুদ্ধে প্রথম দিকে তেলিয়াপাড়ার সফিউল্লাহ বাহিনীতে এসে যােগ দেয়। গ্রামে তার স্ত্রী ও মেয়েকে নিয়তির হাতে ছেড়ে দিয়ে দেশের ডাকে জীবন বাজী রেখে সে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে। প্রথম অবস্থায় সে তেলিয়াপাড়া কোম্পানীতে ছিল। বিশেষ একটা ঘটনার কারণে দৌলামিয়া মেজর সফিউল্লাহর নজরে পড়ে। দৌলামিয়ার আগে থেকেই মদ্যপানের অভ্যাস ছিল কিনা তা সফিউল্লাহর জানা ছিল না। তবে চা বাগান এলাকায় রাইডের সময় স্থানীয় ভাবে তৈরি মদ তার হাতে আসে। সম্ভবত চা বাগানের শ্রমিকদের কাছে সেই মদ পায়। মদ পান করে সে ভারসাম্যহীন, মাতাল হয়ে পড়ে এবং নিজের মেশিনগান হাতে সঙ্গী মুক্তিযােদ্ধাদের উপর চড়াও হয়। এ আকস্মিক অবস্থায় পরিণতির কথা বিবেচনা করে মতিন শান্তভাবে কৌশলের সাথে তাকে নিরস্ত্র করতে সমর্থ হয়। এরপর তাকে বন্দি করে সফিউল্লাহর কাছে পাঠিয়ে দেন শৃঙখলমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য।
ঘটনা সম্পর্কে জানতে পেরে এবং তাকে সামনে দেখে সফিউল্লাহ বেশ রাগান্বিত হন। এ ধরনের সৈনিক নিজের ও নিজের সহযােগীদের জন্য বিপদ ডেকে আনতে পারে এ বিবেচনায় সফিউল্লাহ তাকে মৃত্যুদণ্ড দেবেন বলে হুমকি দেন। যুদ্ধের সময় সৈনিকদের বড় দায়িত্ব শৃঙ্গলাবােধ ও নিজের উপর নিয়ন্ত্রণ । নিজের উপর নিয়ন্ত্রণহীন একজন সৈনিক দলের জন্য বয়ে আনতে পারে চরম পরাজয় ও ব্যর্থতা। সফিউল্লাহ তাকে মৃত্যুদণ্ডের ভয় দেখাবার পর সে নির্বাক হয়ে চুপ করে থাকে। তার মুখাবয়বে নিজের উপর ঘৃণা ও কৃতকর্মের জন্য অনুতপ্ত হবার ভাব স্পষ্ট হয়ে ওঠে। তথাপিও তাকে বিনা শাস্তিতে ছেড়ে দেয়া অনুচিত বিবেচনায় সফিউল্লাহ তখনই তার সেক্টর এলাকা থেকে চলে যেতে বলে। সফিউল্লাহর এই রায় শুনে সে কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে একটা সুযােগ দেবার জন্য কাকুতি মিনতি করতে থাকে। এবারকার মতাে ক্ষমা প্রার্থনা করে কাঁদতে কাঁদতে বলে, ‘স্যার, আপনার অধীনে আমাকে আর একটা সুযােগ দেন। আমি প্রমাণ করে দেব যে আমি খারাপ নই। আমি আপনাকে কথা দিচ্ছি, আমি কখনও মদ ছোঁব না। ভবিষ্যতে যদি কখনও আপনি আমাকে মদ পান করতে বা অসদাচরণ করতে দেখেন তবে আমাকে কোন প্রশ্ন না করে গুলি করে দেবেন।’ তার মুখের ভাব, তার ব্যবহারে আন্তরিকতা ও সর্বোপরি তার অনুতপ্ত হবার দিকটা বিবেচনা করে সফিউল্লাহ তাকে এবারকার মতাে ক্ষমা করবার সিদ্ধান্ত নেন। যেহেতু মতিন তাকে গ্রহণে অনুচ্ছিক ছিল তাই তাকে মাের্শেদের। কোম্পানীতে যােগ দিতে নির্দেশ দেন। মাের্শেদ তাকে মেশিনগান পােষ্টের দায়িত্বে নিয়ােজিত করে।
২১শে জুন মাের্শেদের কোম্পানী চারদিক থেকে শত্রু পরিবেষ্টিত হয়ে আক্রমণের মুখে চরম অবস্থায়, তখনও মাের্শেদ সাহসিকতার সাথে লড়াই চালিয়ে যেতে থাকে। দুপুর ১২টার দিকে সফিউল্লাহ পিছন দিক থেকে পাল্টা আক্রমণ চালিয়ে শত্রুপক্ষকে হাটিয়ে মাের্শেদের অবস্থানে গিয়ে পৌঁছেন। দৌলামিয়ার মেশিনগান পােষ্টের কাছে পৌঁছতেই সফিউল্লাহ হতবাক হয়ে যান। দৌলামিয়ার সমস্ত শরীর রক্তাক্ত। মরণাপন্ন অবস্থায় সে ডান হাতে মেশিনগান ও বাম হাতে পেটের ক্ষতস্থান চেপে ধরে যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে । শত্রুপক্ষের মেশিনগানের গুলি তার পায়ে ও পেটে লাগে এবং পেট থেকে নাড়িভূড়ি বেরিয়ে আসে। আহত হয়েও সে মেশিনগান পােষ্ট ছেড়ে যায়নি। মৃত্যুকে বাজী রেখে সে ডান হাতে মেশিন গান দিয়ে ক্রমাগতভাবে শত্রুপক্ষের উপর গুলি বর্ষণ করতে থাকে। কোন অবস্থাতেই শত্রু পক্ষের হাতে নিজের অবস্থান ছেড়ে পিছু হটে আসেনি। | সফিউল্লাহকে দেখে দৌলামিয়া ‘জয়বাংলা’ বলে চিৎকার করে বলে ওঠে, ‘স্যার আমি হয়তাে বাঁচব না। হয়ত স্বাধীন বাংলাদেশও দেখব না । দয়া করে আমার রক্তমাখা সার্টটি আপনার কাছে রেখে দিবেন। স্বাধীনতার পর শেখ মুজিবকে দেখাবেন এবং বলবেন আমি তার ডাকে সাড়া দিয়ে স্বাধীনতার জন্য জীবন বলি দিয়েছি। স্যার, আমি আপনার কাছে কৃতজ্ঞ। আপনি সেদিন সুযােগ না দিলে আমার পক্ষে হয়ত আত্মহুতি দেয়া সম্ভব হত না।

তার অবস্থা দেখে এবং তার কথা শুনে আমার পক্ষে চোখের জল ধরে রাখা সম্ভব। হয়নি। তাকে সেখানেই প্রাথমিক চিকিৎসার পর সফিউল্লাহ তার জীপে উঠিয়ে হাসপাতালে নিয়ে যান। হাসপাতালে যাবার পথে সে কাকুতি-মিনতি করে বলতে থাকে, ‘স্যার, যদি মরে যাই তবে বাংলার মাটিতে আমাকে দাফন করবেন। আর আমার মেয়েকে একটু দেখবেন। তার ভার আপনার (সফিউল্লাহর) হাতেই রইল।’ আল্লাহর রহমতে দৌলামিয়া বেঁচে যায়। দীর্ঘ চারমাস পর সে আংশিক সুস্থ হয়ে হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে আসে। যদিও তার আরাে বিশ্রামের প্রয়ােজন ছিল। কেননা তখনও সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে ওঠেনি। হাসপাতাল থেকে সরাসরি ফ্রন্টলাইনে যেতে চাইলেও সফিউল্লাহ তাকে তার সাথে থাকার আদেশ দেন। স্বাধীনতা যুদ্ধের শেষ পর্যন্ত দৌলামিয়া সফিউল্লাহর সাথেই ছিল। দৌলামিয়া এখন কোথায় কিভাবে আছে তা হয়ত জানা নেই। দৌলামিয়ার মতাে হাজারও মুক্তিযােদ্ধা তাদের জীবনবাজী রেখে মুক্তি সংগ্রামে ঝাপিয়ে পড়বার কারণেই আজ আমরা স্বাধীন দেশের নাগরিক হিসেবে পরিচয় দিতে পারছি, প্রাণভরে | নিতে পারছি স্বাধীনতার সুবাতাস।

সূত্রঃ মুক্তিযুদ্ধের দু’শো রণাঙ্গন – মেজর রফিকুল ইসলাম পিএসসি সম্পাদিত

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!