You dont have javascript enabled! Please enable it! বেলুনিয়া যুদ্ধ - সংগ্রামের নোটবুক
বেলুনিয়া যুদ্ধ

মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে বেলুনিয়া যুদ্ধ বিখ্যাত স্থান অধিকার করে আছে। কে ফোর্সের অন্তর্গত দশম ইস্টবেঙ্গল এখানে যুদ্ধে নিয়ােজিত ছিল। রাজনগরের দশ ইস্টবেঙ্গলের সদর দপ্তর স্থাপিত হয়। বেলুনিয়ায় অবস্থিত পাকিস্তানী অবস্থানের ওপর অতর্কিত আক্রমণ এমবুশ ও গেরিলা তৎপরতা অব্যাহত ছিল। পাকসেনাদের এসব আক্রমণে প্রভুত ক্ষতি সাধিত হয়। মেজর জাফর ইমাম দশম ইস্টবেঙ্গলের অধিনায়ক ছিলেন। তাঁর অধীনে ছিল চারজন অফিসার। ‘এ’ কোম্পানী কমান্ডার ছিলেন লেঃইমামুজ্জামান। ‘বি’ কোম্পানী কমান্ডার ছিলেন ক্যাপ্টেন মােখলেস। বেলুনিয়া অপারেশন যদিও দশম ইস্টবেঙ্গলের দায়িত্বাধীন ছিল, তবুও এই যুদ্ধের জন্য শুধু দশম ইস্টবেঙ্গল যথেষ্ট হবে না ভেবে সিলেট থেকে ক্যাপ্টেন হেলাল মাের্শেদের নেতৃত্বে দ্বিতীয় ইস্টবেঙ্গলের এক কোম্পানী সৈন্য এখানে আনা হয়। এক নাম্বার সেক্টরের ক্যাপ্টেন মাহফুজ বেলুনিয়ার পূর্ব সীমান্ত অবস্থিত এই যুদ্ধে অংশ নেন। সুতরাং দশম ইস্ট বেঙ্গল, দ্বিতীয় ইস্ট বেঙ্গলের এক কোম্পানী সৈন্য ও ক্যাপ্টেন মাহফুজের নেতৃত্বে এক নম্বর সেক্টরের সৈন্যরা বেলুনিয়া যুদ্ধে অংশ গ্রহণ করে। মেজর জাফর ইমাম এই যুদ্ধে সার্বিক নেতৃত্ব দেন।  বাংলাদেশের মানচিত্রের দিকে তাকালে বােঝা যাবে দক্ষিণ পূর্ব সীমান্তে এক বন্য ভূমি ফেনীর উত্তর দিকে ভারতের মধ্যে ঢুকে গেছে। এর সর্বউত্তরে বেলুনিয়া শহর অবস্থিত। বেলুনিয়া উত্তর থেকে দক্ষিণে প্রায় ১৬ মাইল এবং পূর্ব থেকে পশ্চিমে প্রায় ৬ মাইল বিস্তৃত। এলাকাটি পরশুরাম ও ছাগলনাইয়া এই দুটো উপজেলার অন্তর্গত। মহুরী নদী উত্তর থেকে দক্ষিণে প্রবাহিত। দুটি কাঁচা রাস্তা ফেনী ও ছাগলনাইয়া থেকে উত্তরে গিয়ে পরশুরামে মিলেছে এবং সেখান থেকে বেলুনিয়া গেছে। ফেনী থেকে বেলুনিয়া। পর্যন্ত মিটার গেজ ট্রেন চলাচল করে। সমস্ত এলাকা মােটামুটি সমতল, শস্যক্ষেত্র বিস্তৃত। এখানে-সেখানে বিচ্ছিন্ন গ্রাম।

যেহেতু আগে থেকে মুক্তিবাহিনী পাকসেনাদের ব্যতিব্যস্ত করে রেখেছিল, সেহেতু পাকসেনাদের চরম সতর্কতার ছিল। সীমান্তের চারপাশেই ছিল পাকিস্তানীদের সুদৃঢ় অবস্থান। ১৫ বেলুচ প্রতিরক্ষা ব্যুহ রচনা করেছিল। পশ্চিম পাকিস্তান পুলিশ ও রাজাকাররাও এদের সঙ্গে ছিল। পাকিস্তানী সৈন্যদের অবস্থান ছিল নিম্নরূপঃ
(ক) ১৫ বেলুচ রেজিমেন্ট এক কোম্পানী সৈন্য বেলুনিয়ায় অবস্থিত ছিল।
(খ) ১৫ বেলুচের অন্য একটি কোম্পানী পরশুরামে অবস্থিত ছিল।
(গ) বেলুচ রেজিমেন্টের অপর একটি কোম্পানী চন্দনা-সালদার বাজার নিলাফী। এলাকায় অবস্থান নিয়েছিল। 
(ঘ) ইপিসিএফ-এর একটি কোম্পানী গুতুমায় অবস্থিত ছিল।
(ঙ) ইপিসিএফ-এর অন্য একটি কোম্পানী নােয়াপুর-জামুরা সীমান্ত এলাকায় পশ্চিম দিকে মুখ করে প্রতিরক্ষা অবস্থানে ছিল।
(চ) আমজাদঘাটে ১৫ বেলুচ রেজিমেন্টে একটি কোম্পানী অবস্থিত ছিল। (ছ) ফেনীতে ১৫ বেলুচ রেজিমেন্টের সদর দপ্তর স্থাপিত ছিল। (জ) রাস্তার দুই পাশে মর্টার ও গােলন্দাজ কামানের অবস্থান ছিল।
শক্রর অবস্থানের মধ্যবর্তী ফাঁক দিয়ে চন্দনা-সালিয়া-গুতুমা বরাবর অনুপ্রবেশ করে প্রতিরক্ষা অবস্থান নেওয়ার জন্য দশম ইস্টবেঙ্গলকে নির্দেশ দেয়া হয়। এক নম্বর সেক্টরের ক্যাপ্টেন মাহফুজকে পূর্ব সীমান্ত থেকে গুতুমায় প্রবেশ করে দশম ইস্টবেঙ্গলের সঙ্গে মিলিত হতে আদেশ দেয়া হয়। বেলুনিয়ার উত্তরাংশ পূর্ব ও পশ্চিম দিক থেকে ঘিরে শত্রুকে ফাঁদে ফেলাই ছিল আসল উদ্দেশ্য। উক্ত দিকে শত্রু যেন পলায়ন করতে না পারে, দক্ষিণ থেকে শক্রর অন্যদল যেন যােগ দিতে না পারে সেদিকে বিশেষভাবে লক্ষ্য রাখা হয়। মেজর জাফর ইমাম ২৭শে অক্টোরব স্বয়ং রেকি পার্টির নেতৃত্বে দেন। এই রেকি পাটিতে সকল কোম্পানী কমান্ডার থেকে সেকশন কমান্ডার পর্যন্ত অন্তর্ভুক্ত ছিল। শক্রর অবস্থানের মধ্যবর্তী ফাক দিয়ে ছােট ছােট দলে বিভক্ত হয়ে রেকি পার্টি অনুপ্রবেশ করে ও শক্রর অবস্থান সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য সংগ্রহ করে।
এরা সবাই সাধারণ মানুষের সাথে মিশে গেলে শত্রুরা আঁচ করতে পারেনি। তবুও শক্রর অবস্থানের গভীরে প্রবেশ করা সম্ভব ছিল না। রেকি শেষে ফিরে আসার পথে দ্বিতীয় ইস্ট বেঙ্গলের সুবেদার জব্বার মাইন বিস্ফোরণে আহত হয়। তাকে স্ট্রেচারে করে পিছনে সরিয়ে নেয়া হয়। কিন্তু এর ফলে। পাকসেনারা টের পেয়ে যায় এবং দু’পক্ষের মধ্যে গুলিবর্ষণ শুরু হয়। রেকি পার্টি নিরাপদে ফিরে আসে। ২রা নভেম্বর রাজনগরে এই যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী মুক্তিবাহিনী সমবেত হয়। ৩১ শে অক্টোবর থেকে মুষলধারে বৃষ্টি হচ্ছিল। মুক্তিবাহিনীর জন্য এই আবহাওয়া ছিল সুবিধাজনক। ২রা নভেম্বর সন্ধ্যার পরেই মুক্তিবাহিনী চান্দনা ও সুপার বাজারে পাকিস্তানী অবস্থানের ফাঁক দিয়ে ঢুকে মহুরী নদী অতিক্রম করে ছালিয়ার দিকে অগ্রসর হয়। তখনও প্রবল ধারায় বৃষ্টি হচ্ছিল। এবং এই তুমুল বৃষ্টিপাতের জন্য পাকসেনারা বাইরে না আসতে পারার ফলে মুক্তিবাহিনীর গতিবিধি বুঝতে পারেনি। লেঃ মিজানের নেতৃত্বে ‘বি’ কোম্পানী, দ্বিতীয় ইস্ট বেঙ্গলের এক কোম্পানী সৈন্য অভ্যন্তরে প্রবেশ করে। পরিকল্পনা। অনুযায়ী খাদ্যদ্রব্য ও গােলাবারুদসহ সকল দলই শত্রুর অগােচরে অনুপ্রবেশ করে নিজ নিজ অবস্থান গ্রহণ করে। এবং ২রা নভেম্বরের ভােরের আগেই প্রতিরক্ষা ব্যুহ রচনা করে। একই সঙ্গে ক্যাপ্টেন মাহফুজ তার সৈন্যসহ গুতুমীর মধ্য দিয়ে অগ্রসর হয়ে দশম ইস্ট বেঙ্গলের ‘বি’ কোম্পানীর সঙ্গে সালিপাতে মিলিত হয়।
এভাবে মধ্যরাতের আগেই বেলুনিয়ার উত্তরাংশে চন্দনা-সালিয়া-গুতুমা অক্ষরেখা বরাবর শত্রুর পলায়ন পথ রুদ্ধ করে দেয়া হয়। ‘বি’ কোম্পানীর মধ্যস্থলে ব্যাটালিয়ান কমান্ড পােস্ট স্থাপন করা হয়। এ কোম্পানীকে মহুরী নদীর পূর্বস্থান গ্রহণ করতে বলা হয়। মূল মুক্তবাহিনীর অবস্থানের বামপার্শ্ব সুরক্ষিত করাই এর উদ্দেশ্য ছিল।  ৩রা নভেম্বর ভােরের আগেই বাংকার তৈরি করে মুক্তিবাহিনী প্রতিরক্ষা অবস্থান গ্রহণ। করেছিল। পাকিস্তানীরাও নিজ নিজ অবস্থানে নিশ্চিন্তে বসেছিল। এমন সময় সকাল সাড়ে ৬টায় দক্ষিণ দিক থেকে একটি রেলওয়ে ট্রলি আসতে দেখা গেল। এই ট্রলিতে একজন পাকিস্তানী অফিসার ও ৫ জন সৈন্য ছিল। এরা দক্ষিণ দিক থেকে সালিয়ার দিকে যাচ্ছিল। ট্রলিটি পরশুরামের দিকে ৭ গজের মধ্যে আসার সঙ্গে সঙ্গে ‘বি’ কোম্পানীর হাবিলদার ইয়ার আহমেদ হালকা মেশিনগানের গুলিবর্ষণ করেন। পাকিস্তানী আনসার ও সৈন্যরা নিহত হয়। এবং ট্রলিটি সম্পূর্ণভাবে ধ্বংস হয়। পাকিস্তানীদের একটি রকেট লাঞ্চার, একটি চাইনিজ মেশিনগান ও তিনটি রাইফেল ধ্বংস প্রাপ্ত ট্রলির আশে পাশে পড়েছিল। হাবিলদার ইয়ার আহম্মদ উত্তেজনার বশে তার ট্রেঞ্চ থেকে উঠে অস্ত্রগুলাে সংগ্রহের জন্য দৌড়ে ট্রলির কাছে যায়। কিন্তু গুলিবর্ষণের শব্দে ততক্ষণে পাকিস্তানীরা উপস্থিতি উপলব্ধি করতে সক্ষম হয়। পাকিস্তানীদের পাল্টা গুলিবর্ষণের ফলে হাবিলদার ইয়ার আহমদ শহীদ। হন। সালদার দক্ষিণ দিক থেকে পাকবাহিনী অবিরাম গুলিবর্ষনের ব্যুহ ভেঙ্গে ফেলার চেষ্টা করে। মেশিনগানের গুলিবর্ষণ ছাড়াও ভারী কামানের গােলা নিক্ষেপ করতে থাকে। সারাদিন অবিরাম গুলিবর্ষণের পরেও শত্রুসৈন্য মুক্তিবাহিনীর প্রতিরক্ষা অবস্থান ভেদ করতে পারেনি। শক্রসৈন্যের সকল আক্রমণই ব্যর্থ হয়। ৪ঠা নভেম্বর পাকিস্তানীরা আকস্মিকভাবে বিমান হামলা শুরু করে। মুক্তিবাহিনী হালকা মেশিনগান দিয়ে আক্রমণকারী বিমানকে লক্ষ্য করে গুলি করতে থাকে। দ্বিতীয় ইস্ট বেঙ্গলের একটি হেভি মেশিনগান ধ্বংস হয়। এবং যে সুবেদার এই মেশিনগানটি চালাচ্ছিলেন তিনি শহীদ হন। পাকিস্তানী বােমারু বিমানটি গুলিবিদ্ধ হয় ও ক্ষতিগ্রস্থ হয়। এরপর চারটি বিমানই যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পালিয়ে যায়। ৫ই নভেম্বর অপরাহ্নে পুনরায় তিনটি পাকিস্তানী বিমান হামলা শুরু করে। কিন্তু মুক্তিবাহিনীকে ছত্রভঙ্গ করার সকল চেষ্টা ব্যর্থ হয়।
মহুরী নদীর পশ্চিম তীরে ধানীকোন্দার দক্ষিণে সামদার বাজারে পাকিস্তানীদের প্রতিরক্ষা অবস্থান ছিল। লেঃ ইনামুজ্জামানের নেতৃত্বে ‘এ’ কোম্পানী ধানিকোদায় অবস্থান। করছিল। ৫/৬ নভেম্বর রাতে একটি শক্তিশালী পেট্রোল পার্টি শক্রর অবস্থানের দিকে পাঠান হয়। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশতঃ এরা পাকসেনাদের এ্যামবুশে পড়ে। নায়েক তােহিদুল্লাহ হালকা মেশিনগানের গুলিবর্ষণ শুরু করে। ফলে বেশ কয়েকজন শত্রুসৈন্য নিহত হয়। মুক্তিবাহিনীর এই পেট্রোল পার্টি ছত্রভঙ্গ হয়। পেট্রোল পার্টির কমান্ডার নায়ক তৌহিদ পাঁচটি গুলিবিদ্ধ হয় ও আরাে তিনজন আহত হয়। এই দুঃসংবাদ পাওয়ার পর লেঃ ইমান সালদার বাজারের দিকে অগ্রসর হয়। পেট্রোল পার্টিকে নিরাপদে ফিরিয়ে আনা হয় এবং আহতদের চিকিৎসার জন্য পিছনে সরিয়ে নেয়া হয়।  লেঃ ইমাম তার কোম্পানীসহ সালদার বাজার আক্রমণ করেন।
নিজস্ব মর্টারের অব্যাহত গোলা বর্ষণের মধ্যে এই দ্রুত আক্রমণ চালান হয়। নদীর পানি ছিল কোথাও হাঁটু পর্যন্ত বা কোথাও কোমর পর্যন্ত। সুতরাং নদী অতিক্রম করতে কোন অসুবিধা হয়নি। নদীর অপর তীর থেকে হালকা মেশিনগানের সাহায্যে শত্রুকে ব্যাস্ত রেখে সজোরে আঘাত হানার কিছুক্ষণের মধ্যেই প্রচুর গােলা বারুদ অস্ত্রশস্ত্র ফেলে পাকসেনারা পালিয়ে যায়। ৬ই নভেম্বর ভােরে সালদার বাজার দখলে আনা সম্ভব হয়। সকালে পাকিস্তানীরা পাল্টা আক্রমণ করে। কিন্তু তাদের আক্রমণ ব্যর্থ হয়। ভারতীয় বাহিনীর ৮৩ মাউন্টেন ডিভিশন সীমান্তে অবস্থান করছিল। ৬/৭ নভেম্বর মধ্যরাতে বেলুনিয়া আক্রমণের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। ভারতীয় বাহিনীর রেজিমেন্ট এই আক্রমণে অংশগ্রহণ করে। প্রথম গােলন্দাজ বাহিনীর প্রচন্ড গােলা নিক্ষেপ শুরু হয়। শত্রুপক্ষ পর্যদস্ত হলে উত্তর পশ্চিম দিক থেকে ৩ ডােগা রেজিমেন্ট আক্রমণ করে। তুমুল যুদ্ধের পর পাকিস্তানীরা আত্মসমর্পণ করে। এবং সম্পূর্ণ এলাকা শত্রুমুক্ত হয়। দুজন পাকিস্তানী অফিসার ও ৭২জন পাকিস্তানী সৈন্য বন্দি হয়। এ ছাড়াও প্রচুর অস্ত্রশস্ত্র গােলাবারুদ মুক্তিবাহিনীর হস্তগত হয়। বেলুনিয়ার এই বিখ্যাত যুদ্ধ বাংলাদেশ, পাকিস্তান ও ভারতের স্টাফ কলেজে পড়ানাে হয়। ১৯৭৩ সালে পৃথিবীর বিভিন্ন রাষ্ট্রের ২১ জন জেনারেল ও ব্রিগেডিয়ার এই রণাঙ্গণ পরিদর্শন করতে এসেছিলেন।

সূত্রঃ মুক্তিযুদ্ধের দু’শো রণাঙ্গন – মেজর রফিকুল ইসলাম পিএসসি সম্পাদিত