You dont have javascript enabled! Please enable it! চিলমারী রেইড - সংগ্রামের নোটবুক
চিলমারী রেইড

বিশাল ব্রহ্মপুত্রের অপর তীরে অবস্থিত চিলমারীর দুর্ভেদ্য শত্রু বহ এক প্রচণ্ড হানা দিয়ে লেঃ কর্নেল তাহের ও তার দলবল শক্রর বিপুল ক্ষতিসাধন করে। এই আক্রমণকে মুক্তিবাহিনীর মূল আক্রমণ ভেবে সে এলাকায় বৃহৎ আকারের শক্ত সমাবেশ ঘটে। এ ধরনের আক্রমণ শুধুমাত্র দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ চলাকালীন মিত্রবাহিনীর ইংলিশ চ্যালেন আক্রমণের কয়েকটি ঘটনার সঙ্গে তুলনীয়। এক্ষেত্রে সুশিক্ষিত কয়েক ডিভিশন ছত্রীসেনা।  এবং স্পেশাল ফোস অংশ গ্রহণ করেছিল। সে যুদ্ধের পরিকল্পনা প্রণয়ন ও তা বাস্তবায়নে কয়েক ডজন জেনারেল অংশ গ্রহণ করেছিলেন। যুদ্ধের ইতিহাসে চিলমারী আক্রমণ একটি উজ্জ্বল ঘটনা। এই যুদ্ধে বাংলার সােনার ছেলেদের নিয়ে গঠিত সেক্টর প্রাইভেট আর্মি দ্বারা সংঘটিত হয়। রৌমারীর মুক্তাঞ্চলে মাত্র ১৫ দিনের অনুশীলনপ্রাপ্ত এ সমস্ত ছেলেদের নিয়মিত খাবারের সরবরাহ ছিল না, হাত খরচা ব্যবস্থা ছিল না। এবং শুধুমাত্র দখলীকৃত জিনিসপত্রের উপরই তাদের নির্ভর করতে হত। কোন অনুমােদিত ট্রেনিং ক্যাম্পে অনুশীলন প্রাপ্ত না হওয়ায় এ সমস্ত মুক্তিযােদ্ধারা সেক্টর কমাণ্ডারের প্রাইভেট আর্মি হিসেবে পরিচিত ছিল। তাদের চিলমারী আক্রমণ পরিকল্পনায় দক্ষতা, সাহস ও নৈপুণ্যের সাথে তার বাস্তবায়নের বিষয় যুদ্ধবিদ্যায় ছাত্রদের কাছে অনুপ্রেরণার উৎস হয়ে থাকবে। ১১ নং সেক্টরের কমাণ্ডার হিসেবে যখন তাহের গ্রহণ করে তখন বেশ অনেকগুলাে চরের সমন্বয়ে গঠিত বিশাল রৌমারী এলাকা মুক্ত ছিল। এর প্রতিরক্ষা মুক্তিযােদ্ধাদের জন্য একটা চ্যালেঞ্জ হয়ে দাড়িয়েছিল, মুজিব নগর থেকে অস্থায়ী বাংলাদেশ সরকারকে মুক্তিযােদ্ধারা সেখানে প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলেন। মেজর জিয়া (পরবর্তীতে মেজর জেনারেল) ব্রিগেডের দুটো বেঙ্গল রেজিমেন্ট এই মুক্তাঞ্চল প্রতিরক্ষার কাজে নিয়ােজিত ছিল।

শুধুমাত্র কোদালকাঠিচর ছাড়া ব্রহ্মপুত্রের পূর্ব পারের সকল এলাকা মুক্ত ছিল। কোদালকাঠিতে শত্রুসৈন্যের অবস্থান স্থানীয় গ্রামবাসীদের জন্য ত্রাসের কারণ হয়ে দাড়িয়েছিল। এসময় শত্রুসৈন্য প্রায়ই পাশের গ্রামগুলােতে ঢুকে পড়ে গ্রামবাসীদের উপর অত্যাচার চালাত। ব্রহ্মপুত্রের পূর্বাঞ্চল সম্পূর্ণ শত্রুমুক্ত করার জন্য সুবেদার আখতারের নেতৃত্বে দুই। কোম্পানী মুক্তিযােদ্ধা সেপটেম্বরের প্রথম দিকের এক রাতে গােপনে কোদালকাঠিতে অনুপ্রবেশ করে এবং শক্র ব্যুহের মাত্র কয়েকশত গজ দূরবর্তী ঝাউবনে ট্রেঞ্চ খনন করে তাতে অবস্থান করতে থাকে। মুক্তিযােদ্ধাদের পরিখাগুলাে সামনেই শক্রনিধনের উপযােগী বিস্তৃত খােলা জায়গা ছিল। তাহের ও তার বাহিনীর কৌশলের মূল উদ্দেশ্য ছিল, এই মুক্তিযােদ্ধাদের পরিখার উপস্তিতি টের পেয়ে যখন শত্রুসেনা তাদেরকে উৎখাত করার জন্য আক্রমণ চালাবে, তখন আক্রমণােদ্যত শত্রুসেনাদের খােলা জায়গায় পেয়ে তাহের তার বাহিনী নিয়ে শত্রুসেনাদের নিশ্চিহ্ন করে।  পরের দিন ভােরে মুক্তিযোেদ্ধাদের প্রত্যাশা অনুযায়ী শক্রর প্রচণ্ড আক্রমণ ঘটে এবং তা তড়িত গতিতে প্রতিহত করা হয়। শীঘ্রই সেনাবাহিনীর দ্বিতীয় এবং তারপর তৃতীয় আক্রমণ ঘটে। সেগুলাের সাথেও মােকাবেলা করে মুক্তিযােদ্ধারা। নিধন এলাকা শত্রুসৈন্যদের মৃত্যদেহে ভরে ওঠে। যে ক’জন শত্রুসেনা পরিখা পর্যন্ত এগুতে পেরেছিল তাদের বেয়নেট চার্জ করে হত্যা করা হয়। তাহেরের বাহিনীর অবস্থানের দু’প্রান্তে স্থাপিত মেশিনগান দুটো সেদিন মুক্তিসেনাদের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেনি। মেশিনগান দু’টির আড়াআড়ি গুলিবর্ষনে বেশির ভাগ শত্রুসৈন্য মারা পড়েছিল। তৃতীয় আক্রমণ প্রতিহত করার পর মুক্তিযােদ্ধারা তাদের পরিখা থেকে বেরিয়ে আসে এবং শত্রুদের উপর মরন আঘাত হানার জন্য এগিয়ে যায়।

খুব অল্প সংখ্যক শত্রুসৈন্যই অপেক্ষমান গানবােটে পালিয়ে যেতে সমর্থ হয়।  কোদালকাঠি তাহের বাহিনীর হস্তগত হল। গ্রামবাসীদের মধ্যে দারুণ উল্লাসের সৃষ্টি হয় এবং মুক্তিযােদ্ধাদের বীরত্ব এবং দক্ষতার উপর তাদের আস্থা বহুলাংশে বেড়ে যায় ।

যদিও তাদের সামর্থ ছিল সামান্য তবুও মুক্তিযােদ্ধাদের জন্য তারা রান্না করা খাবার এবং মিষ্টান্ন নিয়ে আসেন। সেপটেম্বরের মাঝামাঝি মেজর জিয়া তার বিগ্রেড নিয়ে ১১ নং সেক্টর ত্যাগ করেন। সেদিন মুক্তিযােদ্ধারা বিষন্ন বােধ করেছিলেন। সে সময় তাহের ও তার বাহিনী জামালপুর টাঙ্গাইল হয়ে ঢাকার পথে এগিয়ে যাবার প্রস্তুতি নিচ্ছিল । শুধু যে তাহের ও তার বাহিনীর রাজনীতি পাল্টাতে হল তা নয়। রৌমারীর বিরাট মুক্তাঞ্চল রক্ষার দায়িত্ব তাহেরকে বিচলিত করে তুলল। তাহেরের রৌমারীতে ১৫ দিনের শিক্ষাপ্রাপ্ত ছেলেদের উপর নির্ভর করতে হয়। এদের মধ্যে শতকরা মাত্র ২৫ জন অস্ত্রে সজ্জিত ছিল। রৌমারীর প্রতিরক্ষার কাজে ভারতীয় বাহিনী পাঠাবার প্রস্তাব করেছিলেন ভারতীয় কমাণ্ডার। তার সে প্রস্তাব। তাহের প্রত্যাখান করেন। বাংলার মাটি রক্ষা করবে বাংলার বীর ছেলেরাই। রৌমারীর প্রতিরক্ষা ব্যুহ আবার ঢেলে সাজাতে হবে। নেতৃত্বের পুরােভার পড়ল সুবেদার আফতাবের উপর। চওড়া কাঁধ আর লম্বা কোকড়ানাে চুলের অধিকারী এই নিউকি জেসিও সব সময়ই বীরত্ব এবং দৃঢ়তার প্রতীক ছিল। তাহের যখন পুরাে পরিস্থিতি তাকে বুঝিয়ে বললেন সে উঠে দাড়িয়ে তাহেরকে স্যালুট করল এবং বলল, ‘স্যার, পাকিস্তানীরা শুধুমাত্র সুবেদার আখতারের মরদেহের উপর দিয়েই রৌমারীতে প্রবেশ করতে পারে।
কিন্তু জেনে রাখবেন সুবেদার আফতাব মরবে না।’ এই বিপ্লবী নেতার মানােবল  কত উপরে ছিল তা এই উক্তি থেকে বােঝা যায়। তখন থেকেই পরবর্তী কালের বিভিন্ন সময়ে দক্ষ সৈনিক, অস্ত্র এবং গােলাবারুদের অভাব পূরণের জন্য তাহেরকে কৌশলের আশ্রয় নিতে হয়েছে। ইতিমধ্যে পাকিস্তানীরা চিলমারী বন্দর থেকে গানবােটের সাহায্যে রৌমারীর মুক্ত অঞ্চলে প্রায়ই থাবা দিতে শুরু করেছে। কিন্তু শত্রুরা কোন সময়ই সদাজাগ্রত মুক্তিযােদ্ধাদের প্রতিরক্ষা ব্যুহ ভেদ করতে সক্ষম হয়নি। রৌমারীর মুক্তিযােদ্ধাদের অস্ত্রে সজ্জিত করাটা তাহেরের আশু কর্তব্য হয়ে দাড়াল এবং তাহের সব সময়ই অস্ত্রে সজ্জিত থাকত এবং অস্ত্র দখলের জন্য তাহের ও তার বাহিনী চিলমারী বন্দরকে বেছে নেন।  চিলমারী আক্রমণের পিছনে আরাে কারণ ছিল। কুখ্যাত মুসলিম লীগ নেতা আবুল কাশেম এবং তার সহযােগীদের নেতৃত্বে সেখানে বাংলাদেশ, বিরােধী কার্যকলাপ বৃদ্ধি পেয়েছিল । চিলমারীতে অবস্থানরত পাকবাহিনীর উপর আঘাত হানাটা অপরিহার্য হয়ে দাড়াল তা যতই বিপদজনক হােক না কেন। এভাবেই চিলমারী আক্রমণের পরিকল্পনা রূপ পেল।  ব্রহ্মপুত্রের পশ্চিম তীরে অবস্থিত চিলমারী একটি নদীবন্দর। চিলমারীর কয়েক মাইল দক্ষিণে তিস্তা নদী ব্রহ্মপুত্রের সাথে মিলিত হয়েছে। নদী পথ ছাড়াও চিলমারী রেল ও সড়ক দ্বারা যুক্ত।
চিলমারীতে পাকবাহিনীর যাতায়তের জন্য রেল সড়ক এবং নদী পথ উম্মুক্ত ছিল। তাহেরের অক্লান্ত গােয়েন্দা অফিসার ওয়ারেন্ট অফিসার শফিউল্লা শত্রু সম্পকীয় খবরাখবর সংগ্রহে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। কয়েকদিনের মধ্যেই তিনি শত্রুসৈন্যের সঠিক অবস্থানসহ চিলমারীর বিস্তারিত এবং হুবহু মাটির নক্সা তৈরি করে ফেললেন। চিলমারীতে তখন পাকবাহিনীর দুই কোম্পানী নিয়মিত সৈন্য এবং দুই কোম্পানী মিলিশিয়া অবস্থান করছিল। তারা চিলমারীর ওয়াপদা ভবন, রােজগাছ, রাজভিটা, থানাহাটম পুলিশ স্টেশন, বলবাড়ি রেলওয়ে স্টেশন এবং পুলিশ স্টেশন সংলগ্ন রেলওয়ে ব্রীজে মােতায়েন ছিল। তাদের সাথে ছিল কুখ্যাত ওয়ালী মাহমুদ ও পানু মিয়ার নেতৃত্বে গড়ে ওঠা বড় আকারের এক রাজাকার বাহিনী। শত্রুকে প্রচণ্ড আঘাত হানার জন্য তাহের ও তাঁর সঙ্গীদের দরকার ছিল। একই সময়ে বিভিন্ন শত্রুদের আক্রমণ করা এবং স্ব স্ব অবস্থানে তাদের আটকে রাখা যাতে করে তারা একে অপরের সাহায্যে বিশেষ করে চিলমারীতে সাহায্যকারী শত্রুসেনা এগিয়ে আসতে না পারে। সেজন্য চিলমারীর বেশ পেছনে রেল এবং সড়ক যােগাযােগ বিচ্ছিন্ন করে দেয়ার জন্য একটি দল পাঠানাের প্রয়ােজন ছিল। এ অভিযানে সাফল্যের চাবিকাঠি। নিহিত ছিল শত্রুর অজ্ঞাতে অতর্কিত আক্রমণের উপর। এক বিরাট বাহিনীর পক্ষে সকলের অগােচরে প্রায় ৩ মাইল প্রশস্ত ব্রহ্মপুত্র পাড়ি দেয়া সহজ ব্যাপার ছিল না। এ ছাড়া মূল আক্রমণকে সমর্থন দেয়ার জন্য যে চারটি দূরপাল্লার কামান তাহেরবাহিনীর কাছে। ছিল সেগুলের নিকটবর্তী এক চরে নিয়ে যাওয়ার প্রয়ােজন ছিল। শত্রু সম্পর্কে বিভিন্ন খবর সংগৃহীত হল। প্রস্তুতি পর্ব সম্পন্ন হল। শত্রুদের অবস্থানের উপর একই সাথে আঘাত। হানার জন্য বিভিন্ন সময়সূচি পুঙ্খানুপুঙ্খ ভাবে পরীক্ষা করে দেখা হল। এই অভিযান। বিফলে যাওয়ার একটি মাত্র সম্ভাবনা ছিল, সেটি হচ্ছে যদি কোন অতি উৎসাহী মুক্তিযােদ্ধা মুহূর্তের পূর্বেই উত্তেজনাবশত কিছু করে বসে।
অক্টোবরে ৯ তারিখে সড়ক এবং রেল যােগাযােগ বিচ্ছিন্নকারী দলটি প্রত্যেকের নির্দিষ্ট কাজের নির্দেশ নিয়ে সন্ধ্যার পর রওনা হল। গােপনে ও অতিসন্তর্পণে এই দলটিকে উলিপুর এবং চিলমারীর মাঝামাঝি স্থানে ঘাঁটি স্থাপন করে মূল আক্রমণ শুরু না হওয়া পর্যন্ত আত্মগােপন করে থাকতে হবে। ১১ই অক্টোবর মূল বাহিনী চিলমারীর উদ্দেশ্যে রওনা হল। অনেকগুলাে দেশি নৌকা তাদের বহন করে এগিয়ে চলল। একসাথে এতগুলাে দেশি নৌকার ব্যবস্থা করা ও তাদের বিভিন্ন অবস্থান থেকে গােপনে একই সময়ে শত্রু ঘাটির কাছাকাছি নিয়ে যাওয়া সেই সময়ে বড় কঠিন ব্যাপার ছিল। কমাণ্ডার। আবুল কাসেম চাঁদ, ঢাকা প্রকৌশলী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র এ ব্যাপারে এগিয়ে এসে অপর সমস্ত ব্যবস্থা সুষ্ঠভাবে সম্পন্ন করল। রাতের অন্ধকারে দূরপাল্লার কামানগুলাে স্থাপন করা হল। এই ভারী অস্ত্রগুলােকে নৌকা থেকে নামিয়ে বালুচরের উপর দিয়ে টেনে নিয়ে নির্ধারিত স্থানে স্থাপন করা যে কি বিপদজনক এবং কঠিন ছিল তা লিখে বুঝানাে যায় না। স্বাধীনতা যুদ্ধের আর এক অসমসাহসী সৈনিক নায়েক সুবেদার মান্নান। তার উপরে ন্যস্ত ছিল ওয়াপদা ভবন ধ্বংস করার দায়িত্ব। ওখানে পাকিস্তানী অফিসাররা প্রমোেদ বিলাসে মত্ত ছিল। তাহেরের সঙ্গী মুক্তিবাহিনীর মাত্র দুটি রকেট লাঞ্চ তাদের সঙ্গে ছিল। কমাণ্ডার চাদের নেতৃত্বে বিভিন্ন দল গােরগাছা, রাজভিটা, থানাহাট পুলিশ স্টেশন এবং ব্রীজ অবস্থান আক্রমণের জন্য নির্দিষ্ট হল। এদের অর্ধেকের সাথে ছিল ৩০৩ রাইফেল, কিছু পুরনাে। স্টেনগান আর বাকিদের কাছে শুধুমাত্র গ্রেনেড। মূল বাহিনীর এই ছােট ছােট দলগুলাের নেতৃত্ব দিচ্ছিল খালেদুল, সুলতান, নূর আহমেদ আলাে আর নজরুল। বলবাড়ি পুলিশ স্টেশনের জন্য কোন দল পাঠানাে হয়নি।
কারণ তাহের ও তার সঙ্গী মুক্তিবাহিনীর জানা ছিল শত্রুসেনারা রাতে সেই অবস্থান ছেড়ে চলে এসেছে। আক্রমণ পরিচালনার জন্য চালিয়া পাড়ায় তাহের ও তার সঙ্গী মুক্তিযােদ্ধারা হেড কোয়টিার স্থাপন করলেন। চিলমারীর দুই মাইল দক্ষিণে গাজীর চরকে আক্রমণকারী বাহিনীর আক্রমণের পূর্ব মুহূর্তের ঘাঁটি হিসেবে বেছে নেয়া হল রাত গভীর। ১টার সময় খবর এল তাহেরের নেতৃত্বে মুক্তিবাহিনী আক্রমণ স্থলের নিকটবর্তী ঘাঁটিতে পৌঁছে গেছে এবং যার যার নির্দিষ্ট আক্রমণ স্থলের উদ্দেশ্য যাত্রার প্রস্তুতি নিচ্ছে। গ্রাউণ্ড সিট বিছিয়ে কর্নেল তাহের ঘুমিয়ে পড়লেন। রাত সাড়ে তিনটায় তাহেরকে জানান হল কিছুক্ষণের মধ্যেই তাহেরের নেতৃত্বাধীন মুক্তিসেনা ঝাপিয়ে পড়বে। রাত চারটা। খুব কাছে থেকে রকেট লাঞ্চার দিয়ে ওয়াপদা ভবনের আঘাত হানার সাথে সাথে সবত্মিক আক্রমণ শুরু হল। সমস্ত শত্রু ধ্বংসযজ্ঞ নেমে এল। দূরপাল্লার কামানগুলাে শক্রসেনাদের গান বােটগুলাের সম্ভাব্য অবস্থানের উপর গোলাবর্ষন করে চলেছে। কামানের গােলা, গ্রেনেড, মেশিনগান আর ছােট অস্ত্রের আওয়াজে রাতের নিস্তদ্ধতা ভেঙ্গে যেতে লাগল। সকাল ৬ টার মধ্যে গােরগাছা, রাজভিটা, পুলিশ স্টেশন ও ব্রীজের অবস্থানগুলাে তাহেরের বাহিনীর আয়ত্বে এল । কিন্তু ওয়াপদা ভবনের আশপাশের কংক্রীট বাংকারে শত্রুসেনাদের অবস্থান নজরে পড়ল। তাহেরের সঙ্গী মুক্তিযােদ্ধাদের একমাত্র নির্ভর রকেট লাঞ্চার দুটি শক্র বাংকার গুলিকে নির্মূল করতে পারল না বটে, তবে ওয়াপদা ভবনে অবস্থানরত প্রচুর শত্রুসেনা খতম করতে সক্ষম হন। শুধুমাত্র দুটি অস্ত্রের উপর নির্ভর করায় তাহেরের সঙ্গী মুক্তিসেনারা শত্রুর এই অবস্থানটি দখল করতে সক্ষম।
হলেন না। যেহেতু সম্পূর্ণভাবে শক্রকে ধ্বংস করা গেল না, তাই শক্রকে তাদের ঘাঁটিতে আটক রাখার জন্য তাহেরের বাহিনীকে তাদের অবস্থান আঁকড়ে থাকতে হল। কারণ একমাত্র রাতের অন্ধকারেই সফল পশ্চাদপসরণ সম্ভব। সকাল ৮টা। তাহেরের কাছে খবর এল চাঁদ আরাে সাহায্য চাচ্ছে। মনে হল অবস্থা সংকটজনক। সে লক্ষ্য করেছে। বলবাড়ি রেল স্টেশন থেকে শক্রসেনার নতুন আক্রমণের প্রস্তুতি নিচ্ছে। তাহের ছােট্ট স্পীডবােডটি নিয়ে নদী পার হয়ে চালিয়াপাড়া থেকে গাভীর চরে গিয়ে পৌঁছলেন। সেখানে গিয়ে তাহের দেখলেন স্কোয়াড্রন লিডার হামিদুল্লাহ বন্দিদের কাছ থেকে খবর বার করার চেষ্টা করছেন। তার ব্যবস্থাপনা মন্দ ছিল না। যাওয়ার সাথে সাথে তাহেরকে এককাপ গরম চা দেওয়া হল। তাহের জানতে পারলেন চাঁদকে সাহায্য পাঠানাের মতাে কোন বাড়তি দল রাখা হয়নি। তৎক্ষণাৎ তাহের তার ছােট্ট রক্ষাকারী বাহিনী নিয়ে থানা অভিমুখে এগিয়ে গেল। ভাগ্যক্রমে তাহেরের একটি এলএমজি ছিল। এই অস্ত্রটি সেদিন তাহের ও তার সঙ্গী মুক্তিবাহিনীর ভীষণ উপকারে আসে। নানাদিক থেকে মাঝে মধ্যেই গােলাগুলি চলছিল। গ্রামবাসীরা যে যেদিকে পারছিল দৌড়াচ্ছিল। কেউ কেউ ‘জয় বাংলা ‘জয় বাংলা’ বলে চিৎকার করছিল। থানার এক মাইলের মধ্যে চলে এসে রাস্তায় ফেলে যাওয়া একটি গরুর গাড়ি রাস্তার মাঝখানে পেলেন তাহের। গাড়িতে শুয়েছিল একজন মেয়েলােক। একটা হাত ভাঙ্গা, বুকের স্তন নেই। পাকিস্তানী মর্টার শেলের শিকার। তার বাচ্চা ছেলেটি মায়ের রক্তে মাখা, বসে বসে কাঁদছে। এই নিস্পাপ শিশুটি তার মাকে ছেড়ে যেতে পারেনি। একজন গ্রামবাসীকে ডেকে জানা গেল মেয়েটিকে হাসপাতালে নেয়া হচ্ছিল।
থানার পাশেই হাসপাতাল। আর ঐ দিক থেকেই গুলি আসছে। তাই তাকে | ছেড়ে সবাই পালিয়েছে। তাহের ঐ লােকটাকে গাড়ি চালিয়ে তাদের সাথে আসতে বললেন। তাহের ও তার সঙ্গী মুক্তিযােদ্ধারা থাকায় লােকটি আসতে সাহস পেল। হাসপাতালে যখন পৌছালাম গুলিবর্ষণ তখন আরাে তীব্রতর হয়েছে। ঝাকে ঝাকে। মেশিনগানের গুলি হাসপাতালের ভেতরে। ভীতসন্ত্রস্ত অবস্থায় ডাক্তারকে পেলাম । তাহের সেই হতভাগ্য মেয়েলােকটির ভার ডাক্তারের উপর ছেড়ে দিলেন। হতভাগ্য মেয়েটি বেঁচে আছে কিনা কে জানে! হাসপাতাল থেকে বের হয়েই তাহের দেখতে পেলেন চাঁদ দৌড়ে আসছে তার দিকে। সে কাঁদছিল। তাহেরকে জানাল, তার দল ৭৬টি দখল করা অস্ত্র, প্রচুর গােলাবারুদ ফেলে থানার অবস্থান ছেড়ে চলে এসেছে। তাকে উৎসাহ দিয়ে তাহের এগিয়ে গেলেন পূর্ব অবস্থান পুনর্দখলের জন্য। মেশিনগানের একঝাঁক গুলি। তাহের ও তার সঙ্গী মুক্তিযােদ্ধাদের মাথার উপর দিয়ে চলে গেল। তাহের দেখতে পেলেন পাকিস্তানী সৈন্যরা প্রায় ১০০ গজ দূরে রেললাইনের উপর অবস্থান নিয়েছে। বাঁশঝাড়ের আড়ালে আড়ালে তাহের ও সঙ্গী মুক্তিযােদ্ধারা এগিয়ে গেলেন এবং শত্রুবাহিনীর এক পাশে তাহেরকে রক্ষাকারী মুক্তিসেনারা এলএম জিটি স্থাপন করলেন। এক নাগাড়ে গুলি করার পর কিছু পাকিস্তানী সেনা পড়ে গেল।
বাকিরা তাদের অবস্থান ছেড়ে রেললাইনের উপরে চলে গেল। তড়িৎ গতিতে তাহের ও তার সঙ্গী মুক্তিযােদ্ধারা রেললাইন দখল করলেন। গুলি চালিয়ে আরাে কিছু পাকিস্তানী বাহিনীকে খতম করা হল। কিছুক্ষণ পরই বলবাড়ি স্টেশনের অবস্থান থেকে শত্রুসেনারা তাহেরের বাহিনীর উপর গুলি। চালাল। তাহের ও তার সঙ্গী মুক্তিযােদ্ধারা পিছু হটে ষ্টেশনে অবস্থান নিলেন। সেখানে পাকিস্তানীদের তৈরি পরিখার অভাব ছিল না। বেশ কিছুক্ষণ পর তাহের একজন বৃদ্ধ লােককে পেলেন। তাহের তাকে দরকার থাকলে কিছু চাউল নিয়ে যেতে বললেন। কিছুক্ষণের মধ্যে চারদিক থেকে লােকজন আসতে লাগল। হট্টগােল শুরু হয়ে গেল । ছেলে, বুড়াে, পুরুষ, মেয়েলােক সবাই কাড়াকড়ি করছে চাল তুলে নেয়ার জন্য। কয়েক মিনিটের মধ্যেই থানা ও থানার পাশের বাসাগুলাে খালি হয়ে গেল। এদৃশ্য ভােলার নয়।
রাতের অন্ধকার নেমে আসছে। সাথে সাথে তাহের কিছু সংখ্যক মুক্তিযােদ্ধা রেখে। প্রধান দলটি নিয়ে পাড়ির চরে চলে গেলেন। কিছু সংখ্যক মুক্তিযােদ্ধা রেখে আসার উদ্দেশ্য ছিল যাতে পাকিস্তানীরা তাহেরের পিছু নিতে না পারে। যদিও তাহের ও তার সঙ্গীরা ভবনের বাংকারগুলাে এবং বলবাড়ি রেলওয়ে স্টেশনের অবস্থান সম্পূর্ণ ধ্বংস করতে পারেননি, তবুও পাকিস্তানী সেনাবাহিনী দারুণ ভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছিল। অতি । নিকট থেকে সম্পূর্ণভাবে ঘেরাও হয়েও শত্রুসৈন্যরা আত্মসমর্পন করেনি। সত্যিই তারা । বীরত্বের সঙ্গে যুদ্ধ করেছিল। তাহের ও তার সঙ্গী মুক্তিযােদ্ধারা জানতেন তারা চলে আসার পর ঐ এলাকার জনসাধারণের উপর পাকিস্তানীরা কি ভয়াবহ অত্যাচার চালাবে। কিন্তু পেছনে ব্রহ্মপুত্র নদীর বাধা নিয়ে তাহের ও তার সঙ্গীদের পক্ষে দখল করা অবস্থান আঁকড়ে থাকা সম্ভব ছিল না। এই আক্রমণ এর উদ্দেশ্যেই ছিল শত্রুকে অকস্মাৎ আঘাত হানী, যত বেশি সম্ভব শক্রসেনা খতম করা, তাদের মনােবল ভেঙ্গে দেওয়া, অস্ত্র ও গােলা বারুদ দখল করা। তাহের ও তার সঙ্গী মুক্তি সেনারা সম্পূর্ণ সফল হয়েছিলেন। তাহের ও তার সঙ্গী মুক্তিযােদ্ধারা চলে আসার পর পাকিস্তানীরা ঐ এলাকায় নিরীহ, নিরস্ত্র গ্রামবাসীদের উপর নির্মম অত্যাচার চালায়। নিরস্ত্র জাতি এমনিভাবে অত্যাচার সহ্য। করেই বাংলার স্বাধীনতা এনেছে।
ওয়ারেন্ট অফিসার সফিউল্লার নেতৃত্বে যােগাযােগ বিচ্ছিন্নকারী দলটি অভূতপূর্ব। সাফল্যের সাথে তাদের কাজ সম্পন্ন করে। তারা শুধু সড়ক এবং রেলপথের ব্রীজগুলাে ভেঙ্গে দিয়েই শান্ত হয়নি, জায়গায় জায়গায় রেলওয়ে লাইন এবং রাস্তা কেটে তারা সমান করে দেয়। বেশ কিছুদিনের জন্য এই যােগাযােগ ব্যবস্থা পাকিস্তানীরা ব্যবহার করতে। পারেনি।  ১৩ই অক্টোরব। বিপুল সংখ্যক যুদ্ধবন্দি এবং প্রচুর অস্ত্র গােলাবারুদ নিয়ে তাহের ও তার সঙ্গী মুক্তিবাহিনীরা রৌমারী ফিরে যান। জনগণের আদালতে ওয়ালী মাহমুদ ও পাচু মিয়ার বিচার হল। দেশ প্রেমিক হত্যা, রাজাকার বাহিনীর সংগঠন এবং লুণ্ঠনের অপরাধে। তারা দোষী সাব্যস্ত হয় এবং তাদের মৃত্যুদণ্ড দেয়া হল। বহু সংখ্যক বাঙ্গালি রাজাকার মুক্তিযুদ্ধে যােগদান করে। ওয়ারেন্ট অফিসার সফিকউল্লাহ, নায়েব সুবেদার মান্নান, চাঁদ, দুলু, আলাে, নায়েক সুবেদার এবং আরাে অনেকের বীরত্ব এবং ত্যাগের কথা কোনদিনই ভােলা যাবে না। এরাই বাংলার সােনার ছেলে।

সূত্রঃ মুক্তিযুদ্ধের দু’শো রণাঙ্গন – মেজর রফিকুল ইসলাম পিএসসি সম্পাদিত