মহানন্দা নদীর দু’পাশে আলীনগর মকরমপুর থেকে শাহপুর গড় পর্যন্ত বিস্তৃত প্রায় ৭ মাইল এলাকাব্যাপী মুক্তিবাহিনীর প্রতিরক্ষা ব্যুহ রচনা করা হয়েছিল। নদীর অপর তীরে শিবরামপুর থেকে রােহনপুর হয়ে বিষ্ণুপুর পর্যন্ত পাকসেনাদের কংক্রিট বাংকারসহ সুদৃঢ় অবস্থান ছিল। ২২শে নভেম্বর পাকবাহিনীর ২৫ পাঞ্জাব রেজিমেন্ট মুক্তিবাহিনীর এই প্রতিরক্ষা বাহিনীর ওপর অতর্কিত আক্রমণ চালায়। প্রতিরক্ষা অবস্থানের সর্ব ডান থেকে শাহপুর গড় এলাকা পাকবাহিনী দখল করে নেয়। মুক্তিযােদ্ধারা ছত্রভংগ হয়ে পড়ে এবং পশ্চাদপসরণ করে নদীর অপর তীরে চলে যেতে শুরু করে। এমন সময় ওযারলেসে ভেসে এল সেক্টর কমাণ্ডার লেঃ কর্নেল জামানের জলদগম্ভীর কণ্ঠ, হােয়াই হ্যাভ এই উইথড্রন? মেক কাউন্টার এটাক এণ্ড রি-ক্যাপচার শাহপুর গড়।’ বেশকিছু মুক্তিযােদ্ধা নদী অতিক্রম করে আলীনগরে চলে গেছে। ছত্রভংগ মুক্তিবাহিনীকে সংগঠিত করে পুনরায় আক্রমণ পরিচালনা করা সহজসাধ্য ছিল না। তবু পরিকল্পনা অনুযায়ী সেদিনই রাত ১-৩০ মিনিটে পাল্টা আক্রমণ শুরু করি। ক্যাপ্টেন জাহাঙ্গীর আমাদের সাহায্যে তার বাহিনী নিয়ে মেহেদীপুর থেকে এসে নৌকাযােগে খাল অতিক্রম করে শাহপুর গড়ের পূর্ব কোণে অবস্থান গ্রহণ করেন। শিবরামপুর, রােহনপুর ও শাহপুর গড়ের ওপরে যুগপৎ কামানের গােলা নিক্ষেপ শুরু হয়। ভারতীয় গােলন্দাজ বাহিনী এই গােলা নিক্ষেপ করে। আলীনগরে আমাদের দুইটি ৮১ মিলিমিটার মর্টার ছিল।
মুক্তিবাহিনীর মর্টারও গর্জে ওঠে। পাকসেনাদের রােহনপুর অবস্থান থাকে। এর কিছুক্ষণ পরে ক্যাপ্টেন জাহাঙ্গীর পূর্বদিক থেকে শাহপুর গড় আক্রমণ করেন এবং আমি, নজরুল, আলতাফ ও নায়েক ওয়াকিল শাহপুরের সম্মুখে ও পশ্চিম দিক থেকে একযােগে আক্রমণ চালাই। প্রায় দেড় ঘন্টা রক্তক্ষয়ী মরণপণ যুদ্ধের পর পাকসেনারা পিছু হটতে শুরু করে। পাকসেনারা বিষ্ণুপুর ও কসবা এলাকায় পলায়ন করে। মুক্তিযােদ্ধা আলতাফ, নজরুল, ওয়াকিল, রায়হান, মর্টার চালক মান্নান-এর অবদান অনস্বীকার্য। শাহপুর গড় পুনর্দখলের পরে দেখলাম জঙ্গলের মধ্যে পড়ে আছে ১১ জন মুক্তিযােদ্ধার লাশ। এদের বাড়ি পাবনায়, সবাই ছাত্র। কয়েকদিন আগেও এদের সঙ্গে গল্প করে গেলাম। আজ ওরা শহীদ। চোখ-কান সাদা সাদা পােকায় খাচ্ছে কোমরে তখন এ্যামুনিশেনের বান্দোলিয়র বাঁধা আছে। নিজের অজান্তেই দীর্ঘশ্বাস বুক চিরে বেরিয়ে এল। ওদেরকে যে যেখানে আছে সেখানেই সমাহিত করা হল। কোন মায়ের আদরের সন্তান স্বাধীনতা যুদ্ধ করতে এসে জীবন দিল এবং এখানে এভাবে জঙ্গলের মধ্যে আত্মীয়স্বজন ব্যাতিরেকেই তাদের কবর হল! (সূত্রঃ একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ, মেজর রফিকুল ইসলাম, পিএসসি)
সূত্রঃ মুক্তিযুদ্ধের দু’শো রণাঙ্গন – মেজর রফিকুল ইসলাম পিএসসি সম্পাদিত