You dont have javascript enabled! Please enable it! চাঁদগাজী হিয়াকু করুইয়ার বাজার অপারেশন - সংগ্রামের নোটবুক
চাঁদগাজী হিয়াকু করুইয়ার বাজার অপারেশন

১লা জুন পাকিস্তান সেনাবাহিনীর শামসুল হুদা ক্যাপ্টেন অলির কাছ থেকে চাঁদগাজী প্রতিরক্ষার দায়িত্ব নেন। এখানে মুক্তিবাহিনীর আর একটি কোম্পানী এসে যােগ দিল। ৬ই জুন পাকিস্তান সেনাবাহিনীর দুটি কোম্পানি সকাল ১০টায় মুক্তিবাহিনীর অবস্থান চাঁদগাজী আক্রমণ করে। এই সময় মেজর জিয়া চাঁদগাজী ঘাটিতেই অবস্থান করছিলেন। উভয়পক্ষে দুঘন্টাব্যাপী ব্যাপক সংঘর্ষ চলে। মুক্তিবাহিনী রাইফেল ছাড়াও মর্টার এবং মেশিনগান ব্যবহার করে। সংঘর্ষে পাকসেনাদের ৭৫ জন নিহত এবং বেশ কিছু আহত হয়। মুক্তিবাহিনীর ব্যাপক আক্রমণের মুখে পাকিস্তানীরা চরম ক্ষতি স্বীকার করে ছাগলনাইয়ার দিকে পালিয়ে যায়। ১৫ই জুন ক্যাপ্টেন মতিউর রহমানকে চাদগাজীতে পাঠানাে হল। ১৬ই জুন। পাকসেনারা সকাল ১০টায় পুনরায় চাদগাজী দখলের জন্য অগ্রসর হলে সংগর্ষের সূত্রপাত হয়। ক্যাপ্টেন মতিউর রহমান তার বাহিনী নিয়ে প্রস্তুত ছিলেন। উভয়পক্ষের সংঘর্ষে পাকিস্তানীদের ৫০ জনের মতো প্রাণ হারায় এবং তারা পিছু সরতে বাধ্য হয়। ১৭ই জুন পাকিস্তান সেনাবাহিনীর একটি ব্যাটালিয়ান সকাল ৭টায় ট্যাঙ্ক, আর্টিলারী। এবং মর্টারসজ্জিত হয়ে পুনরায় চাদগাজী মুক্তিবাহিনীর অবস্থান আক্রমণ করে। এই সংঘর্ষ ১৮ই জুন ভাের পাঁচটা পর্যন্ত স্থায়ী হয়। পাকিস্তানীদের এই ব্যাপক হামলা ক্যাপ্টেন অলি, ক্যাপ্টেন শামসুল হুদা, ক্যাপ্টেন মতিউর রহমান তাদের স্ব স্ব বাহিনী নিয়ে অত্যন্ত সার্থকতার সঙ্গে মােকাবিল করেন। মুক্তিবাহিনীর বেশকিছু ক্ষতি হলেও পাকসেনারা ৪৫ জনের মৃতদেহ ফেলে পিছনে সরে যেতে বাধ্য হয়।

১৯শে জুন সন্ধ্যা সাড়ে ছটায় পাকসেনারা পুনরায় চাদগাজী আক্রমণ করে। পাকসেনারা পাঁচটি হেলিকপ্টারযােগে ২টি পদাতিক বাহিনীর ব্যাটালিয়ন মুক্তিবাহিনীর অবস্থানের পিছনের দিকে নামিয়ে দেয়। স্পীডবােটযােগেও মহুরী নদী দিয়ে একটি কোম্পানি অগ্রসর হতে থাকে। অপরদিকে পাকিস্তানীদের রিয়ার হেড কোয়াটার থেকেও ব্যাপকভাবে আর্টিলারী, মর্টার এবং অন্যান্য স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রের সাহায্যে আক্রমণ করা হয়। মুক্তিবাহিনী ১৯শে জুন ভাের ৪টা পর্যন্ত তাদের অবস্থানে টিকে থাকার চেষ্টা করে, কিন্তু পাকসেনারা চারদিক থেকে মুক্তিবাহিনীর অবস্থান ঘিরে ফেলার চেষ্টা করে। শেষ পর্যন্ত মুক্তিবাহিনী ক্ষয়ক্ষতি স্বীকার করলেও পাকসেনাদের ১৫০ জন নিহত এবং বেশ কিছু আহতের সংবাদ পাওয়া যায়। এই তারিখেই চাদগাজী অবস্থান পাকিস্তানীদের নিয়ন্ত্রণে চলে যায়। এদিকে ক্যাপ্টেন মাহফুজ ১০ই জুন হিয়াকু-রামগড় সড়কে পাকিস্তানীদের এ্যামবুশ করে ৪ জনকে হত্যা করেন। ক্যাপ্টেন মাহফুজ একটি প্লাটুন নিয়ে হিয়াকু-রামগড় সড়কের দু’টি কলামের একটিতে নিজে এবং অপর কলামে নায়েব সুবেদার রহমতুল্লাহকে দিয়ে সড়কের পাশে আখক্ষেতে ওত পেতে বসে রইলেন। দেখা গেল, পাক সৈন্যভর্তি দু’টি মাইক্রোবাস দ্রুতগতিতে হিয়াকু থেকে রামগড়ের দিকে অগ্রসর হচ্ছে। প্রথম মাইক্রোবাসটিতে একজন লেঃ কর্নেল, দু’জন মেজরসহ কয়েকজন গার্ড ছিল। পিছনেরটিতে শুধু জোয়ানরাই ছিল। ঐ তারিখে সকাল ৮টায় পাকসেনারা মুক্তিবাহিনীর রাইফেলের আওতায় আসার সঙ্গে সঙ্গে একসাথে সবগুলাে গান গর্জে ওঠে।
গুলির পরপরই সামনের মাইক্রোবাসটি মুখ থুবড়ে পড়ে যায়। পেছনের গাড়িটিও থেমে যায় এবং পাকসেনারা তাড়াতাড়ি গাড়ি থেকে নেমে পাল্টা গুলি চালায়। ক্যাপ্টেন মাহফুজ বেশ কিছুক্ষণ ক্রমাগত গুলি চালিয়ে তার বাহিনী স্থানত্যাগ করে নিরাপদে নিজ ঘাটিতে ফিরে যান। পরে স্থানীয় লােকজনের কাছ থেকে জানা যায়, শত্রুপক্ষের একজন লেঃ কর্নেল ও দু’জন মেজরসহ ৫ জন নিহত এবং বেশ কয়েকজন আহত হয়। পাকিস্তানীরা আর সামনে অগ্রসর না হয়ে হিয়াকু ফিরে যায়। ২৩শে জুন ক্যাপ্টেন মাহফুজ একটি প্লাটুন নিয়ে করলিয়াটিলা (চিকনছড়া) এবং হিয়াকুব মধ্যস্থল থেকে পাকসেনাদের এ্যামবুশ করেন। ইনফরমার মারফত ক্যাপ্টেন মাহফুজ ২২শে জুন তারিখেই খবর পেলেন, রদিন হিয়াকু থেকে রামগড়ে পাকসেনাদের দু’টি গাড়ি আসবে। মুক্তিবাহিনীর প্লাটুনটি ২৩ শে জুন ভােরবেলা করলিয়াটিলাতে পৌছে সড়কের উপর ৩টি ট্যাঙ্কবিধ্বংসী মাইন বসিয়ে রেখে সড়কের পাশে বসে রইল। ঐ তারিখ সকাল ৬টায় পাকসেনাদের দুটি গাড়ি আসতে দেখা গেল। গাড়িতে ২০ জনের মতাে সৈনিক ছিল। ৬টা বেজে কয়েক মিনিট হয়েছে, পাকিস্তানীদের প্রথম গাড়িটি ঘটনাস্থলে আসার সঙ্গে সঙ্গেই ক্যাপ্টেন মাহফুজ, সুবেদার সাবেদ আলী, হাবিলদার নাফিস আলী একযােগে গােলাবর্ষণ শুরু করেন। উভয়পক্ষে বেশ কিছুক্ষণ গােলগুলি চলে। পাকসেনাদের ১জন অফিসারসহ বেশ কয়েকজন সৈন্য হতাহত হয়। এদিকে ১লা জুলাই ক্যাপ্টেন শামসুল হুদা একটি প্লাটুন নিয়ে রাত ৩টায় পাক। অবস্থান দেবীপুর বি. ও. পি, আক্রমণ করেন। উভয়পক্ষের সংঘর্ষে পাকসেনাদের ১২ জন নিহত এবং ৫ জন আহত হয়। অপরদিকে মুক্তিবাহিনীর পক্ষে সিপাই ফজলুর রহমান। শহীদ হন।
এই সংঘর্ষে হাবিলদার আবুল হােসেন, সিপাই তােহা মিয়া বিশেষ কৃতিত্বের পরিচয় দেন।  ৩রা জুলাই ক্যাপ্টেন মাহফুজ পুনরায় এ্যামবুশ করেন। তিনি সংবাদ পেয়েছিলেন, পাকসেনারা চট্টগ্রাম থেকে বাঙালী সুন্দরী যুবতী মেয়েদেরকে ধরে প্রথমে হিয়াকু এবং সেখান থেকে রামগড়ে নিয়ে যাচ্ছে। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, সাবরুমে নদীর পাড় থেকে শিকলবাধা অবস্থায় মেয়েদের স্নান করতে দেখা গেছে। শিকলের টানাটানিতে প্রায় বিবস্ত্র অবস্থায় রক্তাক্ত দেহে সেই মেয়েদেরকে ঘাটিতে পৌঁছতে হয়েছে। মুক্তিযােদ্ধারা এইসব করুণ দৃশ্য দেখে তখনই আক্রমণের উদ্যোগ নিল। যখন শুনল পাকিস্তানীরা বাঙালি মেয়েদের নিয়ে আসছে, তখন ক্যাপ্টেন মাহফুজ ১০ জনের একটি দল নিয়ে ৩রা জুলাই চিকছড়াতে অপেক্ষা করতে লাগলেন। ঐ তারিখ সকাল থেকে বেলা প্রায় ১২টা পর্যন্ত ঐ সড়ক দিয়ে ৫/৬টি গাড়ি যাতায়াত করল, কিন্তু পাকিস্তানীদের তখনাে কোনাে দেখা পাওয়া গেল না। বেলা ১২টার কয়েক মিনিট পরই একটি মাইক্রোবাসের সামনে একজন অফিসার আর পেছনে ৬ জন মেয়ে এবং তার পেছনে ৪ জন সশস্ত্র গার্ডকে দেখা গেল। মাইক্রোবাসটি ৫০ গজের মধ্যে এলে প্রথমে ড্রাইভারকে লক্ষ্য করে একটি রাইফেল গর্জে উঠ। অব্যর্থ ড্রাইভার চিৎকার করে গাড়ির ব্যালান্স হারিয়ে ফেললে গাড়িটি উল্টে যায়। দ্বিতীয় বারে মুক্তিবাহিনীর সব কটি গানই একসঙ্গে আঘাতের পর আঘাত হানতে থাকে। পাক অফিসারটি ছিল ক্যাপ্টেন। সে গাড়ি থেকে লাফিয়ে পড়ে গুলি চালাতে থাকে। ঐদিন একটি পাকিস্তানীও জীবন নিয়ে ফিরতে পারেনি। মুক্তিবাহিনী নিরাপদে নিজ ঘাঁটিতে ফিরে আসে। শােনা যায় ৪ জন মেয়ে সেদিন বেঁচে গিয়ে পার্শ্ববর্তী গ্রামে আশ্রয় নিয়েছিল। 
১৯শে জুলাই ক্যাপ্টেন মাহফুজ করুইয়াবাজারে পাক অবস্থান আক্রমণ করেন। পাকসেনারা ২ শয়ের মতাে ভারতে গমনরত শরণার্থী ধরে যথেচ্ছ অত্যাচার চালাচ্ছিল। শরণার্থীদের মধ্যে মেয়েদের সংখ্যাই ছিল অধিক। এই মেয়েদের উপর পাকসেনারা দিনের পর দিন পাশবিক অত্যাচার চালিয়ে যাচ্ছিল। পাকিস্তানীদের পাঞ্জাব রেজিমেন্টের একটি কোম্পানি একজন মেজরের কম্যাণ্ডে একটি ‘এল’ প্লাটুনের হাই স্কুলে অবস্থান করছি। ক্যাপ্টেন মাহফুজ মুক্তিবাহিনীর ৪৫ জনের একটি দল নিয়ে ১৯শে জুলাই রাত দেড়টার দিকে ৪টি ২ ইঞ্চি মর্টার, ২টি রকেট লঞ্চার এবং অবশিষ্ট এলএমজি নিয়ে একযোগে পাক অবস্থানের উপর আক্রমণ পরিচালনা করেন। উভয়পক্ষে তুমুল সংঘর্ষ শুরু হয়। এই সময় ক্যাপ্টেন মাহফুজ চিৎকার করে বলতে থাকেন, বাঙালি শরণার্থীরা পালিয়ে আসুন। আধঘন্টা গুলিবিনিময় চলে। এই সময়ের মধ্যে প্রায় ১৫০ জনের মতাে শরণার্থী নিরাপদ স্থানে সরে যেতে পারলেও বেশ কিছুসংখ্যক শরণার্থী গােলাগুলিতে নিহত হয়। পাকসেনাদের ৩০ জন নিহত হয় বলে জানা যায়। মুক্তিবাহিনী কোনাে ক্ষতি স্বীকার না করে নিরাপদে নিজ ঘাঁটিতে ফিরে আসে।
২৭শে জুলাই হিয়াকুতে পাকবাহিনীর হেড কোয়াটারের উপর ক্যাপ্টেন মাহফুজ মাত্র একটি প্লাটুন নিয়ে আক্রমণ করেন। হিয়াকু পাক অবস্থান থেকে মুক্তিবাহিনীর অবস্থান ছিল ১২ মাইল দূরে। বিকেল ৪টায় মুক্তিবাহিনীর দলটি মর্টার এবং রকেট লাঞ্জারসহ একসঙ্গে পাকসেনাদের গাড়ি পার্কের উপর আঘাত হানে। পাকসেনাদের মূল ঘাঁটিতে আক্রমন হতে পারে, এ ছিল তাদের কল্পনাতীত। পাকসেনারা সঙ্গে সঙ্গে তৎপর হয়। মুক্তিবাহিনীর গুলিতে ৪ জন সৈন্যকে ঘটনাস্থলেই নিহত হতে দেখা গেল। মাত্র ১৫ মিনিটের আক্রমণে একটি পার্ক প্রায় বিধ্বস্ত হয়। পাকসেনারা ছােট দলটিকে ঘিরে ফেলার চেষ্টা করে। ক্যাপ্টেন মাহফুজ পাকসেনাদের মতলব বুঝতে পেয়ে পরিস্থিতির গুরুত্ব উপলব্ধি করে তার বাহিনী নিয়ে দ্রুত পেছনে সরে আসেন। নিজেদের অবস্থানে ফেরার পথে। মুক্তিবাহিনী পাকসেনাদের বসানাে বেশকিছু মাইন উদ্ধার করে নিরাপদে নিজ ঘাটিতে। পৌছে সেক্টর কমাণ্ডার মেজর রফিকের কাছে তাদের কর্মতৎপরতার রিপাের্ট পাঠান।  (সূত্রঃ একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ, মেজর রফিকুল ইসলাম, পিএসসি)।

সূত্রঃ মুক্তিযুদ্ধের দু’শো রণাঙ্গন – মেজর রফিকুল ইসলাম পিএসসি সম্পাদিত