You dont have javascript enabled! Please enable it!

বাংলার বাণী
ঢাকাঃ ১৬ই ফেব্রুয়ারী, শনিবার, ৪ঠা ফাল্গুন, ১৩৮০

জীবনে মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম

জীবনে মূল্যবোধের অভাবই সবচাইতে পীড়াদায়ক এবং সবচাইতে বড় সংকট। যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশ সমস্যার অন্ত নেই। আর্থিক অনটন, অভাব, দারিদ্র্য বেশ প্রকট হয়ে উঠেছে। কিন্তু তার চাইতেও জীবনে মূল্যবোধের অভাবেই দুঃসহ ও দুরতিক্রম্য বলে বিবেচিত হচ্ছে। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান গত বৃহস্পতিবার আসন্ন শহীদ দিবস উপলক্ষে বাংলা একাডেমীর উদ্যোগে আয়োজিত স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশের প্রথম জাতীয় সাহিত্য সম্মেলন উদ্বোধন কালে এই আক্ষেপ প্রকাশ করেছেন। তিনি দেশের শিল্পী, সাহিত্যিক, সংস্কৃতিসেবী, শিক্ষাব্রতী ও বুদ্ধিজীবীদের প্রতি সুকুমারবৃত্তির সার্বিক বিকাশের সংগ্রামে তৎপর হয়ে এই সংকট উত্তরণের জন্য চেষ্টা চালাবার আহ্বান জানিয়েছেন। বঙ্গবন্ধু দেশের শিল্পী, সাহিত্যিক, বুদ্ধিজীবীদের প্রতি লক্ষ্য করে বলেন যে, আপনাদের কাছে আমার আবেদন আমাদের সাহিত্য সংস্কৃতি যেন শুধু শহরের পাকা দালানে আবদ্ধ না হয়ে থাকে। বাংলাদেশের গ্রাম-গ্রামান্তরের কোটি কোটি মানুষের প্রাণের স্পন্দন যেন এতে প্রতিফলিত হয়। আজকের সাহিত্য সম্মেলনে যদি এসবের সঠিক মূল্যায়ন হয় তবে আমি সবচাইতে বেশি আনন্দিত হবো।
তিনি বলেন, আমাদের মুক্তি আন্দোলনের প্রতিটি পর্যায়ে রাজনৈতিক কর্মী, মেহনতী মানুষ, কৃষক, শ্রমিক ও ছাত্র তরুণদের পাশাপাশি দেশের শিল্পী-সাহিত্যিক ও সংস্কৃতিসেবীরাও সক্রিয়ভাবে যোগ দিয়েছেন। নির্যাতন সহ্য করেছেন। রক্ত দিয়েছেন। আজকে যখন দেশ স্বাধীন হয়েছে, তখন সাহিত্যিক, শিল্পী ও সংস্কৃতিসেবীদের কাছে আমার প্রত্যাশা আরো অধিক। যারা সাহিত্যসাধনা করছেন, শিল্পচর্চা করছেন, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির সেবা করছেন, তাদেরকে দেশের জনগণের সঙ্গে গভীর যোগসূত্র রক্ষা করে অগ্রসর হতে হবে। দেশের জনগণের চিন্তা ভাবনা, আনন্দ-বেদনা এবং সামগ্রিক অর্থে তাদের জীবন প্রবাহ আমাদের সাহিত্য ও শিল্পে অবশ্যই ফুটিয়ে তুলতে হবে।
জীবনে মূল্যবোধের যে পীড়াদায়ক অভাব জাতির পিতা প্রত্যক্ষ করেছেন, বস্তুতঃ বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনের পর তা নিরসনের পরিবর্তে ক্রমাগত বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হচ্ছে এ কথা সত্য। আর সেই সত্যটিকে যথাযথ ভাবে উপলব্ধি করে তার মূল্যায়নের জন্য সঠিক কর্মপন্থা স্বাধীনতার পরপরই গ্রহণ করা উচিত ছিল। তা করা হয়নি। কোন মহল থেকেই এ ব্যাপারে কোনো বাস্তব ব্যবস্থা নেবার তাগিদও যেন কেউ অনুভব করেননি। কেননা দেশ স্বাধীন হবার পর সমাজের একশ্রেণীর মানুষের ভোগ লালসার লিপ্সা এবং দুর্নীতি পরায়ন মানসিকতা সমাজের আর আর মানুষের সুকুমারবৃত্তি গুলোর প্রকাশ ও বিকাশের পথে যদি বাধা ও সন্ত্রাসের প্রভাব বিস্তার করে জীবনের মূল্যবোধ অর্জন, গ্রহণ ও বিস্তারের স্পৃহা মাথা কুটে কুটে তার অর্গল উন্মোচন করতে পারেনি। কিন্তু এখনো সময় আছে, কেননা দেশ আছে, জাতি আছে, আছে দেশের বিপুল সংখ্যক সচেতন ও সুস্থ চিন্তাশীল মনীষীরা। মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে কেবল আজকে সবচাইতে বড় প্রয়োজন উদ্যোগ নেয়া। এবং সেই উদ্যোগ নিতে হবে জাতীয় কর্মের চিন্তায় মনীষীদের চিন্তাশীল তৎপরতায়। দেশের প্রগতিবাদী মহল সেই উদ্যোগকে আন্দোলনে রূপ দিয়ে ইপ্সিত লক্ষ্যে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারেন এবং তারা সে জন্য প্রস্তুতও। শিল্পী, সাহিত্যিক ও বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায় যেহেতু দেশের প্রগতিশীল মহলের অংশ- শুধু অংশ নয়- নেতৃস্থানীয় সেহেতু এ ক্ষেত্রে তাদের দায়িত্বের হার সিংহভাগ। কিন্তু তার সাথে সাথে রাজনৈতিক নেতৃত্বও প্রয়োজন। কেননা, বাংলাদেশের কোনো আন্দোলনেই অতীতে কোনো দিন বিচ্ছিন্নভাবে পরিচালিত হয়নি- রাজনীতি, রাষ্ট্রনীতি, সমাজনীতি আর অর্থনীতির সাথে হাতে হাত ধরে আন্দোলন সংগ্রাম এগিয়েছে সংস্কৃতি, শিল্প ও সাহিত্য আন্দোলনও। কাজেই আমরা বিশ্বাস করি মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠার সংগ্রামও এই একই ধারায় এগিয়ে গেলে ইপ্সিত লক্ষ্যে পৌছুবেই।

আখ চাষ ও চিনিকলের সমস্যা আর কতদিন থাকবে!

দেশের উত্তরাঞ্চলের যে কয়েকটি শিল্প কারখানা রয়েছে তার মধ্যে অন্যতম প্রধান হলো চিনিকল। উত্তরাঞ্চলে আখ চাষের অনুকূল অবস্থা লক্ষ্য করে চিনিকল স্থাপনের যে মহৎ পরিকল্পনা একদিন নেয়া হয়েছিল তা আজ সমস্যার অন্তরালে পড়ে বিনষ্ট হতে চলেছে। স্বাধীনতা যুদ্ধের কারণে অনিবার্যভাবে আখ চাষীদের জীবনে যে দুরাবস্থা নেমে এসেছিল তার সমাধান দূরে থাক, সমস্যা আরো তীব্র হয়ে উঠেছে। জানা গেছে চিনিকল কতৃপক্ষ আখ চাষীদের ঋণ দানের ব্যাপারে কোনো সহযোগিতা করছে না। এবং বিধ্বস্ত আখ চাষের ও চিনি কলের পুনর্গঠনে কতৃপক্ষের অনীহা বর্তমানে নিদারুণ আকার ধারণ করেছে। এ পর্যন্ত উত্তরবঙ্গের আখ চাষীদের জন্য পর্যাপ্ত পরিমাণ আখ বীজ সরবরাহের কোন ব্যবস্থা গৃহীত হয়নি। সমগ্র উত্তরবঙ্গে বছরে প্রায় পঞ্চাশ লক্ষ মণ আখ বীজের প্রয়োজন রয়েছে অথচ চলতি বছরে মাত্র পঁচিশ লক্ষ মণ আখ বীজ সরবরাহ করা হয়েছে। জানা গেছে, চিনিকলগুলো থেকে যে উৎপাদনের পরিকল্পনা গৃহিত হয়েছে তার পূর্ণ উৎপাদন ক্ষমতার থেকে পঞ্চাশ ভাগ কম। অর্থাৎ পূর্ণ উৎপাদন ক্ষমতা যেখানে আড়াই থেকে তিন কোটি মণ সেখানে এবারের পরিকল্পনায় মাত্র দেড় কোটি মণ উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধার্য করা হয়েছে। এ বছরে সারা উত্তরবঙ্গের প্রায় আট কোটি টাকা মূল্যের আখ বিনষ্ট হয়ে গেছে খরা, বন্যা ও রোগে। এর জন্য দায়ী মূলতঃ কৃষি বিভাগীয় কর্মকর্তাদের অযোগ্যতা ও অদূরদর্শিতা। অন্য একটি সংবাদে প্রকাশ, কৃষি বিভাগীয় আমলাদের অদূরদর্শিতার দরুন, সময় মতো বিনষ্টকারী পোকার বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা না গৃহীত হওয়ায় দিনাজপুর, বগুড়া, রংপুর জেলাতেই শুধু ছয়চল্লিশ হাজার একর জমির আখ পোকার আক্রমণের সম্পূর্ণ বিনষ্ট হয়ে গেছে। উত্তরাঞ্চলের কয়েকটি চিনিকলের সমস্যা ও আখ চাষীদের সমস্যা সম্পর্কে আমাদের প্রতিনিধি কর্তৃক প্রেরিত এক সংবাদে জানা গেছে যে, আখ উৎপাদনে প্রচুর পরিশ্রম ও উল্লেখযোগ্য পরিমাণ অর্থ প্রয়োজন। যানবাহন সমস্যা, বিভাগীয় সহকারী কর্তাব্যক্তিদের সারসাজি, বিক্রয়লব্ধ অর্থ প্রদানে কর্তৃপক্ষের অযথা বিভিন্ন অজুহাত, চিনিকলে আখ বিক্রির চেয়ে গুড় তৈরি করায় লাভ হেতু চিনি ও আখ উৎপাদনে বিভিন্ন সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে। এসকল বাস্তব সমস্যা মোকাবেলায় এসে আখ চাষ আজ বিনষ্টের পথে।
স্বাধীনতার পর থেকে আমাদের কৃষি খাতের বিভিন্ন দিক নানা কারণে বিপর্যস্ত। আখ এর মধ্যে অন্যতম। উত্তরাঞ্চলের জেলাগুলোতে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ উৎপাদিত হতো তা আজ ধবংসের পথে এসে দাঁড়িয়েছে। ফলে দেশের চিনিকলগুলোর উৎপাদন নিদারুণভাবে হ্রাস পেয়েছে। সরকারি পদক্ষেপ এ ব্যাপারে বেশ নিরুৎসাহ জনক। অন্যদিকে আমলাতান্ত্রিক কারসাজিও রয়েছে। সর্বোপরি একটি পরিপূর্ণ ও বাস্তব পরিকল্পনা এ ব্যাপারে কাম্য। আখ চাষের নিশ্চয়তা চিনিকলগুলোর টিকে থাকা নির্ভর করছে। তাছাড়া দেশের এক বৃহৎ অংশ চাষীদের জীবনের বাধা রয়েছে আখ চাষের সঙ্গে। আমরা কর্তৃপক্ষের কাছে সুস্পষ্ট দাবি জানাবো- অনতিবিলম্বে একটি বাস্তব পরিকল্পনা নিয়ে আখ চাষের সমস্যা গুলোর সমাধান করা হোক। চিনিকলগুলোর উৎপাদন নিশ্চিত করাও আজ সরকারের অন্যতম প্রধান কাজ বলে আমরা মনে করি।

লঞ্চের ভাড়া বৃদ্ধি প্রসঙ্গে

গতকাল একটি স্থানীয় দৈনিকে প্রকাশিত লঞ্চ ভাড়া সম্পর্কিত একটি সংবাদের পরিপ্রেক্ষিতে।
খবরে প্রকাশ, মোটর লঞ্চ মালিকরা ১৬ই ফেব্রুয়ারি থেকে লঞ্চ ভাড়া শতকরা দেড়শ’ ভাগ বাড়িয়ে নেওয়ার একপক্ষীয় সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। কেউ কেউ নাকি ইতিমধ্যে শতকরা আড়াইশ’ ভাগ বর্ধিত ভাড়াও আদায় করা শুরু করেছেন।
যেখানে বিভিন্ন রুটে চলাচলকারী লঞ্চ যাত্রীদের কাছ থেকে প্রতি ৩০ মাইলের মধ্যে প্রতি মাইলে ৩ দশমিক ৮ পয়সা হারে ভাড়া আদায়ের এক স্পষ্ট সরকারী নির্দেশ আছে, সেখানে লঞ্চ মালিকরা যাত্রীদের কাছ থেকে প্রতি মাইলে ১৩ পয়সা অর্থাৎ ৯ দশমিক ৯২ পয়সা হারে বেশি পয়সা আদায় করছেন। ওদিকে মালিকদের মনগড়া আচরণের বিরুদ্ধে বাংলাদেশ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষ এক বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে যাত্রীদের বেশি ভাড়া না দেয়ার আহ্বান জানিয়েছেন সত্যি, তবে কি হারে ভাড়া দেওয়া হবে সে কথা স্পষ্ট উল্লেখ করেননি। ফলে, এ ঘটনার মধ্যে যখন তখন লঞ্চে বাক-বিতণ্ডায় নানারকম অপ্রিয় পরিস্থিতির উদ্রেক হচ্ছে।
যাত্রীদের কাছ থেকে প্রতি ৩০ মাইলের প্রতি মাইলে ৩ দশমিক ৮ পয়সা হারে ভাড়া নেবার সরকারি নির্দেশ নাকি ১৯৬৩ সন থেকে এ পর্যন্ত চলে আসছে। অথচ আকস্মিকভাবে এবং এমন অকল্পনীয়ভাবে ভাড়া বৃদ্ধি করাতে মানুষের দুর্গতির নাকি সীমা নেই।
জানা গেছে, আভ্যন্তরীন নৌ-পরিবহন কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান নাকি লঞ্চ মালিকদের এ ভাড়া বৃদ্ধিকরণের সিদ্ধান্ত সম্পর্কে অবহিত নন। বিভিন্ন রুটে চলাচলকারী লঞ্চ সমূহের উপর নৌ-পরিবহন কর্তৃপক্ষের নিয়ন্ত্রণ কতটুকু বা উভয়ের মধ্যে কতখানি নিয়মিত যোগাযোগ থাকে তা তার এ সামান্য কথাতেই স্পষ্ট বোঝা যায়। আবার এদিকে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহন (যাত্রী চলাচল) অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক দৃঢ়তার সঙ্গে জানিয়েছেন যে, বর্তমানে তারা যাত্রীদের কাছ থেকে প্রতি ৩০ মাইলে প্রতি ১৩ পয়সা হারে ভাড়া আদায় করছেন।
এ দেশটা কি মগের মুল্লুক হয়ে গেল নাকি? এদিকে কর্তৃপক্ষের সুদৃষ্টি না পড়লে নৌ-পথে চলাচলকারি মানুষদের দুর্ভোগের আর সীমা থাকবেনা।

কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক

পত্রিকার মূল কপি পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!