বাংলার বাণী
ঢাকা: ১৬ই এপ্রিল, বুধবার, ৩রা বৈশাখ, ১৩৮১
হিংসার পথ পরিহার করে–
নববর্ষের আহ্বানঃ হিংসার রাজনীতি পরিহার করে মানুষের মঙ্গলের জন্য উদ্বুদ্ধ হয়ে আসুন সবাই একসাথে দেশকে গঠন করি। আহ্বান জানিয়েছেন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সভাপতি জনাব এ, এইচ, এম কামরুজ্জামান এবং বলাই বাহুল্য আহ্বান জানিয়েছেন তিনি বিভিন্ন রাজনৈতিক সংগঠনের কর্মী এবং নেতৃবৃন্দের প্রতি। জানিনা তার আহবানে সাড়া দিয়ে কতজন সত্যিকারের জনগণের মঙ্গলকামনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে এগিয়ে আসবেন, কিন্তু আজ যাদের নিয়ে যাদের জন্য রাজনীতি তারা সেই বিপুল জনগোষ্ঠীর সত্যি মনে প্রানে এই হিংসা হানাহানি পরিহার করতে চায়।
স্বাধীনতা-পূর্ব কালেও হিংসা হানাহানির রাজনীতি ছিল, মনে প্রাণেই কোন কোন বিশেষ গোষ্ঠী সেই রাজনৈতিক আদর্শে উদ্বুদ্ধ ছিলেন। আবার এমন লোকের সংখ্যাও ছিল না যারা গণমুখী রাজনীতির ধারাকে ভিন্নখাতে প্রবাহিত করার জন্য সেই হিংসা হানাহানির রাজনীতিতে ইন্ধন জুগিয়েছেন। তাদের অপচেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে, বিকৃত আদর্শবোধ দ্বারা যারা ছিলেন তাদেরও অনেকে নিজেদের ভ্রান্তি উপলব্ধি করতে পেরেছেন।
স্বাধীনতা-উত্তরকালে আশা করা গিয়েছিল ধ্বংস হত্যা নয় বরং জীবনের সজীবতা ফিরিয়ে এনে নির্মাণ প্রক্রিয়ায় যুক্ত একটা গোটা জনশক্তি জাতীয় অগ্রগতিতে অংশগ্রহণ করবে। নানা প্রতিকূল অবস্থার দরুন সম্ভব হয়নি; সম্ভব হয়নি যেমন সদ্য স্বাধীন একটি দেশের জাতীয় ও আন্তর্জাতিক স্বার্থ পরিচালিত ষড়যন্ত্রের ফলে, তেমনি সম্ভব হয়নি জাতীয় নির্মাণকার্য ব্যাপক জনগোষ্ঠীর মধ্যে তাদের অংশীদারিত্ব সৃষ্টি করতে ব্যর্থ হওয়ায়।
নববর্ষের পবিত্র দিনে ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক সংগঠনের প্রধান যে আহ্বান জানিয়েছেন তাকে অভিনন্দিত করে আমরা বলব অতীতের সকল ব্যর্থতার গ্লানির অবসান ঘটিয়ে নয়া কর্ম প্রবাহ সৃষ্টি করতে হবে। জাতীয় নির্মাণকার্যে বৃহত্তর অংশীদারিত্বের মাধ্যমে সুখী-সমৃদ্ধ ভবিষ্যৎ গড়ার সংগ্রামে সকল দেশপ্রেমিক রাজনৈতিক সংগঠন উদ্বুদ্ধ হতে হবে।
আবার লঞ্চ দুর্ঘটনা
আবার সেই দুঃসংবাদ। লঞ্চ দুর্ঘটনা, প্রাণহানি। মাঝে কিছুদিন থেমেছিল। সম্ভবতঃ পরপর দুর্ঘটনা, বিপুল প্রাণহানি, জনসাধারণের দাবি আর খবরের কাগজের দারুন লেখালেখির ফলে কর্তৃপক্ষের কিছুটা দয়া হয়েছিল। হয়তো কিছু প্রতিরোধ ব্যবস্থা নেয়া হয়েছিল। যার জন্য মাঝে কিছুদিন আমরা এ ব্যাপারে কোন দুঃসংবাদ পাইনি। মানুষ খুশি হয়েছিল, হয়তোবা একটা সুরাহা হলো। হয়তো বা প্রাণের নিশ্চয়তা ফিরে এলো।
কিন্তু সবাইকে আবার দারুন ভাবিয়ে তুলে আবার সেই পুরনো কথা আমাদের কানে এসেছে। এবারের দুর্ঘটনা ঘটেছে খুলনা থেকে ৫ মাইল দূরে কইয়ার ভিটার কাছে দুটো লঞ্চের মুখোমুখি সংঘর্ষের ফলে। একটি “এম এল বিউটি অফ খুলনা” আরেকটি “এম এল মংলা।” প্রত্যক্ষদর্শীদের মতে প্রথমটিতে প্রায় আড়াইশো থেকে তিনশ লোক ছিল, দ্বিতীয়টিতে সাত-আটজন। প্রায় একশ’রও র উপরে লোক প্রাণ হারিয়েছে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। এছাড়া চাল, সরিষার তেল ও আরো খাদ্যদ্রব্য পানিতে ডুবেছে। দুর্ঘটনায় পতিত লঞ্চ থেকে কয়েকজন কর্মচারীকে গ্রেপ্তারও করা হয়েছে।
কিন্তু কথা সেখানে নয়। প্রত্যক্ষ সড়ক-জল বা আকাশ দুর্ঘটনার কয়েকটি স্পষ্ট কারণ আছে. এসব কারণ কে প্রথম থেকেই প্রতিরোধ না করলে দুর্ঘটনা ঘটবেই। এটা খুবই সাধারন কথা। আর এসব কারণের পর্যাপ্ত প্রতিরোধ ব্যবস্থা সত্ত্বেও যদি কোন দূর্ঘটনা ঘটে সেটা অবশ্যই আকস্মিক বা দৈব দুর্ঘটনা। তার ওপর মানুষের কোন হাত নেই। কিন্তু আমাদের দেশের লঞ্চ দুর্ঘটনাকে কোন ক্রমেই দুর্ঘটনা বলা চলে না। অন্ততঃ, আমাদের অতীতের তিক্ত অভিজ্ঞতা থেকে আমরা একথা জোর করেই বলতে পারি।
প্রধানতঃ ক্ষমতার বাইরে যাত্রী বা মাল বহন করলে, বিনা বাতিতে লঞ্চ চালালে, ট্রাফিক নিয়ম ভেঙ্গে লঞ্চ চালালে, পুরনো অচল যন্ত্র মেরামত না করে লঞ্চ চালালে, অনভিজ্ঞ ড্রাইভার বা মেশিনম্যান দিয়ে গাড়ি চালালেই সাধারণতঃ দুর্ঘটনা ঘটে। এমনকি আবহাওয়ার পূর্বাভাস অমান্য করলেও দুর্ঘটনা ঘটতে পারে
আর এসব কারণ এত স্পষ্ট যে, এদের সম্পর্কে পূর্ব ব্যবস্থা নেয়া খুব একটা কঠিন কাজ নয়। শুধুমাত্র যাত্রীসাধারণের প্রাণের প্রতি সদয় হলে এবং অতিরিক্ত লোভ সংবরণ করলেই এসব দুর্ঘটনা সহজেই এড়ানো যায়। কিন্তু আমরা অতীতেও বারবার দেখেছি যে, কি করলে অবশ্যম্ভাবীভ দুর্ঘটনা ঘটে, লঞ্চের মালিক বা কর্মচারী তা তা করে। যেমন, অতিরিক্ত আয়ের লোভে ক্ষমতার বাইরে যাত্রী ও মাল নেবেই, অন্ধকারের হেডলাইট ছাড়া লঞ্চ চালাবেই, সামান্য দু’দিনের অভিজ্ঞ লোক দিয়ে অল্প বেতনে লঞ্চ চালাবেই, ট্রাফিক আইন ভঙ্গ করবেই, দুরন্ত ছেলেদের মত নদীতে আগে যাবার প্রতিযোগিতা চালিয়ে ওভারটেক করবেই, আরো অনেক অনেক কারণ।
আমরা বলি এসব লঞ্চ কোম্পানির লোকেরা রীতিমতো খুনি, ক্রিমিনাল। এদের জন্য কঠোর দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে। পর্যাপ্ত টহলরত জল পুলিশের ব্যবস্থা নেই বলে এরা আরো বেশি সুযোগ পায়। প্রত্যেক ঘাটে ঘাটে স্থায়ী চেকপোস্ট বসিয়ে এদের দমন করতে হবে তা না হলে যাত্রীদের জীবন নিয়ে ছিনিমিনি খেলা চলবেই। এদের জন্য কঠোরতম জল পরিবহন আইন করে স্থায়ীভাবে প্রণয়ন করে দুর্ঘটনা বন্ধ করতে হবে সে ক্ষেত্রে আজও পর্যন্ত কতৃপক্ষ শুধু ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছেন।
ট্রেন চলাচলে অচলাবস্থা
পত্রিকান্তরের খবরে প্রকাশ, কয়লা ও ইঞ্জিনের অভাবে সম্প্রতি তিস্তা চিলমারী এবং লালমনিরহাট-ভুরুঙ্গামারী লাইনে ট্রেন চলাচল দারুণভাবে বিঘ্নিত হয়েছে। এ ব্যাপারে একজন উচ্চপদস্থ রেলওয়ে অফিসার বলেছেন যে, সংশ্লিষ্ট অঞ্চলের অভাব তো আছেই এবং অন্য এলাকার থেকে সংগ্রহ করা সম্ভব হয়নি। এছাড়া ঘন ঘন যান্ত্রিক গোলযোগের দরুন এসব লাইনে চলাচলকারি অধিকাংশ ইঞ্জিনকে ‘অযোগ্য’ ঘোষণা করা হয়েছে। খুচরো যন্ত্রপাতিগুলো মেরামত করা হচ্ছে না। যার ফলে তিস্তা-চিলমারী ইত্যাদি অঞ্চলে রেল যোগাযোগ প্রায় অচল হয়ে পড়েছে।
অভিযোগে আরো প্রকাশ যে, কদিন আগেও ওই অঞ্চলে দিনে রাতে চারটি রেল চলাচল করতো। এখন মাত্র একটি রেল চলছে। এবং অত্যন্ত স্বাভাবিক ভাবেই তার কোন সময় সূচি ঘোষিত হয় না। এছাড়াও জোড়াতালি দেওয়া ইঞ্জিন বিকল হয়ে পড়ে। ফলে যাত্রী সাধারণের কষ্টের অবধি থাকে না।
প্রসঙ্গক্রমে বলা যায়, ওই অঞ্চলে শুধু যে রেলের সংখ্যা কমেছে তাই নয়-রেলের বগি সংখ্যাও কম। বগিগুলোতে রাতের বেলায় আলো থাকে না, বসার ব্যবস্থাও খুব খারাপ, পাখা নেই, শৌচাগার পরিষ্কার করা হয় না ইত্যাকার আনুষঙ্গিক অসুবিধা যাত্রীসাধারণের চূড়ান্ত ভোগান্তি হয়।
একথা অনস্বীকার্য যে, বাংলাদেশের যোগাযোগ ব্যবস্থায় রেলপথের একটি উল্লেখযোগ্য ভূমিকা আছে। আমরা জানি, যে কোন দেশের সমৃদ্ধি উন্নতি ও স্থিতি অনেকটা যোগাযোগ ব্যবস্থার ওপর নির্ভর করে। আর রেল যে শুধু যাত্রী বহন করে তাই নয়, বাংলাদেশের সামগ্রিক পরিবহন কাজের বিরাট অংশ রেলপথে সমাধান হয়। এক্ষেত্রে কোন অঞ্চলে রেল যোগাযোগ বিঘ্নিত হওয়ার সংবাদ এর মধ্যেই সে অঞ্চলের বিশৃঙ্খল পরিস্থিতির চিত্র আমাদের চোখের সামনে ভাসে। এর পরিপ্রেক্ষিতেই বলা যায়, রেল যোগাযোগ ব্যবস্থা চূড়ান্ত অবনতির কারণ গুলো দর্শানো হয় তাও আমাদের কাছে যুক্তিযুক্ত নয়। তাছাড়া যোগাযোগ ব্যবস্থার গুরুত্বের স্বার্থেও যে সময়মতো এবং প্রয়োজনমাফিক সরবরাহ করা হয় না-এই সংবাদ নিঃসন্দেহে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের জন্য সুসমাচরন নয়। আবার ভাঙ্গা ইঞ্জিনগুলো ‘অযোগ্য’ নাম ধারণ করে মেরামতের অভাবে পড়ে আছে তাও তাদের কর্মতৎপরতার স্বাক্ষর বহন করেনা। সর্বোপরি দেশের বৃহত্তর স্বার্থে যোগাযোগ ব্যবস্থার অবনতির জন্য এই কৈফিয়ৎগুলো অনাস্তাজ্ঞাপক। স্বাধীনতার পর বিধ্বস্ত বাংলাদেশে এমনিতেই রেল যোগাযোগ ব্যবস্থা প্রায় অচল ছিল। তখন কিছু নতুন ইঞ্জিন আমদানি করে, কিছু মেরামত করে কাজ চালানো হচ্ছিল। এরই প্রেক্ষিতে দেশ গড়ার তাগিদেই এই ব্যবস্থা করা তাই সংশ্লিষ্ট মহলে পবিত্রতম দায়িত্ব ছিল। অথচ তার পরিবর্তে আজ দুর্ঘটনা, কাল ইঞ্জিন খারাপ, পরশু কয়লা নেই ইত্যাকার ঘটনার রেল ব্যবস্থার ক্রমাবনতি ঘটেই চলেছে। অতএব আমাদের আবেদন-অবিলম্বে সংশ্লিষ্ট অঞ্চলের অসুবিধা ও অভিযোগের কারণগুলি দূর করা হোক। এবং যথারীতি রেল চলাচলের জন্য সম্ভাব্য সকল প্রকার উদ্যোগ নিয়ে উক্ত অঞ্চলের জনজীবনে এবং জাতীয় যোগাযোগ ব্যবস্থায় স্বাভাবিকতা ফিরিয়ে আনা হোক।
কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক