You dont have javascript enabled! Please enable it!

বাংলার বাণী
ঢাকা: ১৪ই অক্টোবর, রোববার, ২৭শে আশ্বিন, ১৩৮০

প্রতিমন্ত্রীদের নিকট একটি আবেদন

যুদ্ধ বিধ্বস্ত বাংলাদেশের সমস্যা ও সংকটের অন্ত নেই। খাদ্য সমস্যা, আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি থেকে আরম্ভ করে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র মূল্য বৃদ্ধি জনিত পরিস্থিতির মোকাবেলা করাটা সহজ সাধ্য কাজ নয়। এছাড়াও রয়েছে অতীতের বস্তাপঁচা আমলাতান্ত্রিক মানসিকতার ভূত। সবকিছু মিলে প্রশাসনযন্ত্রের যে সামগ্রিক চেহারাটি চোখের সামনে ভেসে ওঠে তা খুব একটা আশাব্যঞ্জক নয়। বঙ্গবন্ধুর সরকার যে এ সম্পর্কে অবহিত নন তা নয়। প্রশাসনিক যন্ত্রকে সুষ্ঠু পথে পরিচালিত করার উদ্দেশ্যে বিগত নির্বাচনের পর থেকেই প্রতিমন্ত্রী নিয়োগের ব্যাপারে জল্পনা-কল্পনা চলছিল। অবশেষে মন্ত্রী নিয়োগ এর মধ্য দিয়ে সব জল্পনা-কল্পনার অবসান হয়েছে।
গত ৩রা অক্টোবর চোদ্দ জন প্রতিমন্ত্রী শপথ নিলেন। প্রতিমন্ত্রী নিয়োগ এর উদ্দেশ্য হলো প্রশাসনযন্ত্রে গতির সঞ্চার করা ও আমলাতান্ত্রিক নির্ভরতাকে কাটিয়ে ওঠা। প্রশাসন ব্যবস্থা কেন্দ্রীকরণ, জনগণের অংশগ্রহণ, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক দিক দিয়ে নির্দিষ্ট লক্ষ্য বস্তু অর্থাৎ শোষনহীন সমাজ ব্যবস্থা কায়েমের দিকে ধীরে ধীরে এগিয়ে যাওয়ার কাজকে বাস্তবায়িত করা। বঙ্গবন্ধু সরকার জেনেশুনেই এবং সচেতন চিত্তে এহেন পদক্ষেপ গ্রহণ করেছেন। বাস্তব অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে স্পষ্টতঃ বোঝা যাচ্ছে যে, নতুন প্রতিমন্ত্রীদের দায়িত্ব অনেক। এ দায়িত্ব ও কর্তব্য পালনে বিন্দুমাত্র বিচ্যুতি ঘটলে যে অচলাবস্থা সৃষ্টি হবে তা সহজেই অনুমেয়।
আমরা বিশ্বাস করি নতুন প্রতিমন্ত্রীরা নিজ নিজ দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে পিছপা হবেন না। অন্তত নিষ্ঠার সঙ্গেই তারা তাদের দায়িত্ব পালন করতে সক্ষম হবেন। কিন্তু এক্ষেত্রে একটি বিষয়ের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষন না করে আমরা পারছি না। গত ৩রা অক্টোবর নতুন প্রতিমন্ত্রীর শপথ গ্রহণের পর থেকে কে কার আগে কাকে সমর্থন জানাবে ঠিক এরকম একটি প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে গেছে। সভা-সমিতি, অভিনন্দন, সংবর্ধনা আর মালার জোয়ারে ভেসে যেতে বসেছে প্রতিমন্ত্রীদের মধ্যে অনেকে।
কথায় বলে দশচক্রে নাকি ভগবান ভূত হয়ে যান। অভিনন্দন আর সংবর্ধনার মধ্যে আমরা ঠিক ওই দশ চক্রের সন্ধান পাচ্ছি। অতীতে আমরা দেখেছি যে, সমাজে একদল মানুষ সবসময়ই মালা আর সংবর্ধনার ধান্ধাতেই ব্যস্ত ছিল। যে কোন ব্যক্তি উচ্চপদে বহাল হলেই হলো। অমনি শুরু হয়ে যায় মালা হাতে দৌড়োদৌড়ি আর অভিনন্দন সংবর্ধনার প্রস্তুতি। কে কার আগে মালা দেবে তারই প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে যায়। শুধু তাই নয় শেষ পর্যন্ত তা অন্দর মহল পর্যন্ত পৌঁছে। আর তারই ফলে অঘটন ঘটে অনেক।
বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে রক্তাক্ত সংগ্রামের মাধ্যমে। প্রথম সংগ্রাম পেরিয়ে দ্বিতীয় স্তরের শুরু হয়েছে দেশ গড়ার সংগ্রাম। এই সংগ্রামের যারা সৈনিক তাদের অতীতের বস্তাপঁচা মানসিকতার শিকার হলে চলবে না। তাই আজ যারা প্রতিমন্ত্রী নিযুক্ত হয়েছেন তাদের এ দিকটা ভেবে দেখতে হবে বৈকি! স্মরণ রাখতে হবে সময় কারো জন্য বসে থাকে না। সংবর্ধনা আর মাল্যদানের ভারে সময়ের অপচয় করলে তার খেসারত দিতেই হবে। সুতরাং আমাদের বক্তব্য হলো, আর সময়ের অপচয় না করে কাজে আত্মনিয়োগ করা। যার উপরে যে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে সে দায়িত্বকে সুষ্ঠুভাবে পালন করা। বঙ্গবন্ধু এদেশের দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফুটাতে চান-এই তার জীবনের স্বপ্ন ও সাধনা। বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নকে বাস্তবায়িত করার দায়িত্ব আজ প্রতিমন্ত্রীদের উপরেও অর্পিত সে কথা ভুলে গেলে চলবে না।

পরিবহন ব্যবস্থায় দুর্নীতি রোধ করুন

সারা দেশ আজ অন্যায় আর দুর্নীতিতে ছেয়ে গেছে। স্বাধীনতার পর দেশে এমন সব ঘটনাবলী ঘটে যাচ্ছে যেগুলোতে ন্যায়-নীতির নাম গন্ধ খুঁজে পাওয়া যাবে না। একটি সদ্য স্বাধীনতা প্রাপ্ত দেশের অনাচার ও দুর্নীতির এমন প্লাবন যদি সামনে অব্যাহত থাকে, তাহলে দেশের ভবিষ্যৎ কখনো সুন্দর ও সমৃদ্ধিতে ভরে উঠতে পারে না। রাজধানীর সড়ক পরিবহন ব্যবস্থার কথাই ধরা যাক। গতকাল বাংলার বাণীতে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে যে, রাত সাড়ে নটার পর থেকে বিআরটিসি বাস গুলোর যাত্রীদের কাছ থেকে নাকি দ্বিগুণ ভাড়া আদায় করা হয় এবং যাত্রীদের কোনরকম টিকিট দেয়া হয় না। বাস গুলো যখন যেখানে খুশি রুটের যান চলাচল করে। শুধু তাই নয়, রাতের বেলায় নাকি বিআরটিসি’র চলাচলকারি বাসগুলোতে কোন কন্ডাক্টর থাকে না। বাস ড্রাইভার নিজের লোক দিয়ে যাত্রীদের কাছ থেকে দ্বিগুণ ভাড়া আদায় করে থাকে। যানবাহন সমস্যা বিরাজিত থাকার জন্য তারা বাধ্য হয়েই দ্বিগুণ ভাড়া দিতে বাধ্য হন। অভিযোগটি খুবই গুরুতর। যাত্রীদের ঘাড় ভেঙ্গে ডবল ভাড়া আদায় করা, সন্দেহ নেই, একটি মস্ত বড় অপরাধ। এছাড়া নির্দিষ্ট নিয়ম না মেনে বিআরটিসি বাস চালানোর কোনো যুক্তিসংগত অধিকার বাস ড্রাইভার এর আছে কিনা বিআরটিসি কর্তৃপক্ষের কাছে সেটাও আমাদের জিজ্ঞাসা।
শুধু বি আর টি সি বাস নয় ইতিপূর্বে আমরা অবগত হয়েছি যে, বিভিন্ন রিলিফের কাজে নিয়োজিত গাড়িগুলো রাতেরবেলা পরিবহনের কাজ করে দেদার করে চলেছে। সরকারি কর্মচারীদের গাড়িও নানা ধরনের টিপ দিয়ে বেড়ায় বলে আমাদের কাছে অভিযোগ রয়েছে। তেল সংকটের দিনে এভাবে অবৈধ উপায়ে পরিবহনব্যবস্থা চালিয়ে যাচ্ছে কারা সেটা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কি নজর দেওয়া দরকার নয়? অনেকেই হয়তো যানবাহন সমস্যার দোহাই দেবেন। কিন্তু আমরা জানি, ইতিমধ্যে বিদেশ থেকে প্রচুর গাড়ি এসেছে। গাড়ি আরও দরকার। কিন্তু বিআরটিসি বাস গুলো রাতের বেলা যাত্রীদের কাছ থেকে দ্বিগুণ ভাড়া কেন নেবে, সেটা কি আশ্চর্য ব্যাপার নয়? তাছাড়া নির্দিষ্ট রুটে বাস চলাচল করে যত্রতত্র থামবে এবং ড্রাইভার সাহেবের খেয়াল খুশি মত ট্রিপ দেবে এতে কি দুর্নীতিকে প্রশ্রয় দেয়া হচ্ছে না? রিলিফ সংস্থার গাড়িগুলোই বা কেন ব্যক্তিগত পরিবহন আনানেওয়ার ব্যাপারে চলাচল করবে? সরকারি কর্মচারীদের গাড়িগুলো কেন সন্ধ্যার পর যাত্রী বহন করে পাওয়া পয়সা উপার্জন কাজে ব্যবহৃত হবে, তা আমরা ভেবে পাইনা। এতে করে অযথা তেল অপচয় করা হচ্ছে বলেই আমাদের ধারণা। তেল সংকটের দিনে এইসব অপচয় কঠোর হস্তে দমন না করা হলে ভবিষ্যতে তেল সংকট মারাত্মক আকার ধারণ করবে। সে জন্যই সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের প্রতি আমাদের নিবেদন এ ধরনের ব্যাপার গুলো যাতে আর না ঘটে সেদিকে আপনার একটু দিব্যদৃষ্টি দিন। নইলে অন্যায় আর দুর্নীতিতে দেশ ছেয়ে যাবে। বাংলাদেশ সড়ক পরিবহণ সংস্থাকে আমরা অনুরোধ করি, রাতের বেলা নির্দিষ্ট রুট ছাড়া বাস চলাচল অবিলম্বে বন্ধ করুন। যাত্রীদের কাছ থেকে দ্বিগুণ ভাড়া যারা আদায় করে, তাদের ব্যাপারে শাস্তি মূলক ব্যবস্থা গ্রহন করুন। নইলে যাত্রীদের মনে বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হবে। কোন ব্যাপারেই জনসাধারণ দুর্নীতিকে বেশিদিন সহ্য করবেন না। ধৈর্যের বাঁধ যেদিন ভেঙ্গে যাবে সেদিন দুর্নীতি ও দুর্নীতির প্রদানকারীদের অবস্থান হয়ে উঠবে। রিলিফের ট্রাক যেন রিলিফের কাজে নিয়োজিত থাকে এবং সরকারি কর্মচারীদের গাড়ি কিংবা সরকারি সংস্থার গাড়ি যেন কোন রকম বেসরকারি কাজে লাগানোর না হয়, সেদিকে তীব্র মনোযোগ দেয়ার জন্য আমরা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে সতর্কমূলক কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য অনুরোধ জানাচ্ছি। দয়া করে দেশটাকে আপনারা দুর্নীতির আখড়ায় পরিণত করবেন না, এই আমাদের নিবেদন।

প্রশংসনীয় উদ্যোগ

আরো একশ ছিয়ানব্বই জন মুক্তিযুদ্ধকে সরকারি চাকরিতে প্রথম শ্রেণীর পদের জন্য মনোনীত করা হয়েছে। গত শুক্রবার প্রকাশিত হান্ডু আউটে এ তথ্য জানা যায়। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, ইতিপূর্বে প্রায় পাঁচশ জন মুক্তিযুদ্ধকে সরকারি চাকুরীতে নিয়োগ করা হয়েছে। বঙ্গবন্ধু সরকার সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার নিরিখে প্রশাসন ব্যবস্থাকে মূল পরিবর্তন করে নতুন ধাঁচে গড়ে তুলতে বদ্ধপরিকর। এবং সেই দিকে লক্ষ্য রেখেই প্রশাসন ব্যবস্থা সহ বিভিন্ন সরকারি পদে স্বাধীনতা সংগ্রাম চলাকালে দেশমাতৃকার জন্য আত্ম বলিদান এর উদ্দীপ্ত অকুতোভয় বীর মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়োগের কথা ঘোষণা করা হয়েছিল। সরকারি চাকরির প্রথম শ্রেণীর পদে আরো মুক্তিযোদ্ধা নিয়োগ এর ফলে সরকার ঘোষিত নীতিরই বাস্তবায়ন ঘটলো।
স্বাধীনতা যুদ্ধকালে তরুণ মুক্তিযোদ্ধারা দায়িত্ববোধ ও দেশপ্রেমের যে উজ্জ্বল আদর্শ স্থাপন করেছেন সে কথা নতুন করে উল্লেখের অপেক্ষা রাখে না। যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশের পুনর্গঠনকাজে আবারো দেশ মার প্রতি নিবেদিত সেই সব তরুন আত্মনিয়োগের সুযোগ পাবেন। উপরন্ত তারা তাদের নিজ নিজ দায়িত্বে পুরোপুরিভাবে নিয়োজিত হওয়ার পূর্বে সমাজতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করে প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ গ্রহণ করবেন। কাজেই এরা রাষ্ট্রীয় আদর্শের অন্যতম সমাজতন্ত্র কায়মেরও এক এক নির্ভীক সৈনিক।
আমরা আশা করব অকৃত্রিম দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ এইসব মুক্তিযোদ্ধারা যেমন স্বাধীনতার জন্য জীবনকে বাজি রেখে সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়ে সৃষ্টি করেছেন স্বাধীনতা সংগ্রামের এক অনন্য ইতিহাস। তেমনি তারা নিজ নিজ দায়িত্বে মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় আদর্শ তথা বিশ্বের মতবাদ প্রতিষ্ঠার ভেতর দিয়ে আরেক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করবেন। এবং তাদের সেই কর্তব্যবোধের সাফল্যে দেশ, জাতি ও সমাজও নতুন রূপ লাভ করবে। বর্তমান সমস্যা জর্জরিত ও নানা দুর্নীতিতে ভরা প্রশাসন ও সমাজব্যবস্থা বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে তাদের হাতে সব রকম কুলষতা থেকে মুক্তি পাবে বলে আমার আমরা দৃঢ় আস্থা পোষণ করি।

কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক

পত্রিকার মূল কপি পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!