বাংলার বাণী
ঢাকা : ২৯শে নভেম্বর, শুক্রবার, ১৯৭৪, ১৩ই অগ্রহায়ণ, ১৩৮১ বঙ্গাব্দ
হাইলে সেলাসীর প্রাণদন্ডাদেশ
ইথিওপিয়ার সিংহাসনচ্যুত বৃদ্ধ সম্রাট হাইলে সেলাসীকে বর্তমান ক্ষমতাসীন সামরিক কাউন্সিলের তরফ থেকে মৃত্যুদন্ড প্রদান করা হয়েছে এবং চরম দন্ডাদেশ কার্যকরী করার জন্য তাকে রাজধানী থেকে পঁয়ত্রিশ মাইল দূরবর্তী এক শহরে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। বধ্যভূমিতে ইথিওপিয়ার জনগণের এককালীন ভাগ্যনিয়ন্তাকে ঠিক কোন্ মুহূর্তে মৃত্যুদন্ড কার্যকরী হচ্ছে তা বিশদভাবে জানা যায়নি, তবে প্রকাশিত খবরের কোন্ কোনটিতে যে কোনো মুহূর্তে এবং একটিতে খবর প্রকাশের আটচল্লিশ ঘন্টার মধ্যে মৃত্যু দন্ডাদেশ কার্যকরী করার সম্ভাবনার কথা বলা হয়েছে। এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে যে, গত চব্বিশে নভেম্বর আদ্দিস আবাবাতে সামরিক কাউন্সিলের প্রাক্তন চেয়ারম্যান জেনারেল আমান, সম্রাটের পৌত্র নৌবাহিনীর সাবেক ডেপুটি কমান্ডার, দুইজন সাবেক মন্ত্রী সহ মোট ৬০ জনকে সংক্ষিপ্ত সামরিক আদালতে বিচার করে মৃত্যুদন্ডাদেশ এবং সঙ্গে সঙ্গেই তা কার্যকরী করা হয়। ঐদিন গ্রেফতার করা হয়েছিল মোট দুইশত ব্যক্তিকে—যারা বর্তমান ও অতীত শাসক গোষ্ঠীর সাথে কোনো না কোনো দিক দিয়ে জড়িত ছিলেন। ধারণা করা হচ্ছে সাবেক সম্রাট সেলাসীর মতো বাকী এক শত চল্লিশ জনও একই ধরনের ভাগ্যকে বরণ করতে চলেছেন।
গত এগারোই সেপ্টেম্বর বৃদ্ধ সম্রাট সেলাসীকে যখন এক প্রকার বিনা বাধায় ও বিনা রক্তপাতে অপসারণ করা হয়েছিল ‘সামরিক বিপ্লব’ ও ‘কর্মকান্ডের’ সাথে যারা পরিচিত তাদের অনেকেই সেদিন আজকের ঘটনাগুলো ঐ সময়ই ঘটে যাবে বলে প্রত্যাশা করলেও বস্তুতঃপক্ষে সেদিন তাদের সে ধারণা ভ্রান্ত প্রতিপন্ন হওয়ার পর আজকের আদ্রিস আবাবার রাজনৈতিক অঙ্গন রক্তরঞ্জিত হতে দেখে তাদের পক্ষে অবাক হবারই কথা, বিশেষ করে অশীতিপর বৃদ্ধ সম্রাট হাইলে সেলাসীকে সেদিন যদি প্রাণে মারা না হয়; সামরিক বাহিনীর ক্ষমতা দখলের প্রায় আড়াই মাস পর হঠাৎ করে কেনইবা দুইশত লোককে রাতারাতি সামরিক কোর্টে মৃত্যুদন্ডাদেশ দেয়া হচ্ছে এবং কেনই বা পক্ককেশ অর্থব সেলাসীকে বধ্যভূমিতে নেয়া হচ্ছে—রীতিমতো অবাক হবার কথা। সেপ্টেম্বরেই ফিরে যাওয়া যাক। সম্রাট সেলাসীকে অপসারণের পর সুইজারল্যান্ডে রোগগ্রস্ত সেলাসী পুত্রকে রাষ্ট্রপ্রধান করবার কথা আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা করা হয়েছিল প্রধানতঃ দু’টি কারণে। এক : বিশ্বকে দেখানো; সামরিক বাহিনী কর্তৃত্ব দখল করলেও দেশে বেসামরিক প্রশাসন চালু রয়েছে। দুই : ক্ষমতাসীন সামরিক নেতৃবৃন্দের ভিতরকার চরম অন্তর্দ্বন্দ্ব। সম্প্রতি নিহত জেনারেল আমানকে সামরিক কাউন্সিলের চেয়ারম্যান হিসাবে গ্রহণ করা হলেও সেলাসীর সিংহাসনচ্যুতির দিন কয়েক ছাড়া এই আড়াই মাস সময়ে তার ক্ষমতা খর্ব ছাড়া আলাদা কোনো ক্ষমতা দেয়া হয়নি এবং প্রকৃত প্রস্তাবে তার নেতৃত্বেই সেনাবাহিনী ক্ষমতাসীন হয়েছিল, সুতরাং চব্বিশে নভেম্বর যাদেরকে ফায়ারিং স্কোয়াডে নেয়া হয়েছে এবং আরো একশ’ ষাট জনকে নেয়ার কথা হচ্ছে এ সবই ইথিওপিয়ার বর্তমান ক্ষমতাসীন সামরিক চক্রের অন্তর্কলহের স্বাভাবিক পরিণতি এটা কেউ ভাবতে বসলে অবাব হবার কিছু থাকবেনা। তবে প্রশ্ন উঠেছে মণি হারা ফনী বৃদ্ধ অর্থব সেলাসীকে এই আড়াই মাস পর মৃত্যুদন্ড প্রদানের সিদ্ধান্ত নেয়া হলো কেন? পুরনো অভিযোগগুলো ছাড়া তার বিরুদ্ধে কি নতুন কোনো অভিযোগ রয়েছে? জেনারেল আমানের মৃত্যু সেলাসীর বর্তমান পরিণতির সৃষ্ট রহস্যের জটগুলো খুলতে সহায়তা করবে। চব্বিশে নভেম্বর যাদেরকে হত্যা করা হয়েছে—ক্ষমতার অপব্যবহার, সামরিক কর্তাদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টির চেষ্টা ইত্যাদি অভিযোগগুলো তাদের বিরুদ্ধে আনা হয়েছে এবং জেনারেল আমানকে দোষারোপ করে বলা হয়েছে, তিনি হাইলে সেলাসীর মৃত্যুর বিরোধিতা করেছেন।
এখন তথ্যাভিজ্ঞ মহলের প্রশ্ন : যে যে কারণে ইথিওপিয়ার ভাগ্যবিধাতা একনায়ক সেলাসীকে ক্ষমতাচ্যুত করা হয়েছিল; বিগত আড়াই মাস সময়ে খরা ও দুর্ভিক্ষ প্রপীড়িত ইথিওপীয় জনগণের ভাগ্যের সামান্যতম পরিবর্তনের আভাস মাত্র দিতে পেরেছেন কিনা বর্তমান সামরিক কর্মকর্তারা? সহজ উত্তর : পারেননি। আর এই স্বল্প সময়ের মধ্যে তা পারাও সম্ভব নয়। কিন্তু তাই বলে যে সমস্যাকে কেন্দ্র করে এত বড় রাজনৈতিক পটপরিবর্তন, সে সমস্যার গোড়ায় পানি ঢালার উদ্যোগ গ্রহণে অসুবিধা কোথায়? সুতরাং স্বাভাবিক নিয়মেই বর্তমান প্রশাসনে আগেকার কোন্দলের পথ ধরে কিছু লোক সাম্প্রতিক সৃষ্ট নতুন অচলায়তন অপসারণ অথবা ক্ষমতা হস্তান্তরে তৎপর হলে তাদেরকে স্বাভাবিক পরিণতির সম্মুখীনই হয়তো বা হতে হয়েছে এটা চিন্তা করা বিচিত্র কিছু নয়। হাইলে সেলাসীও সৃষ্ট সেই নতুন জটে জড়িয়ে পড়েছেন। আর সামরিক কর্তারা এশিয়া আফ্রিকায় তাদের পূর্বসুরীদের অনুসরণে চলার পথকে নিরুদ্রব ও কন্টকমুক্ত করতে আপন হস্তকে রক্তরঞ্জিত করছেন। কিন্তু মহান আদর্শের বুলি আউড়ে রক্তের হোলি খেলার মধ্য দিয়ে এশিয়া আফ্রিকার দেশগুলোতে সামরিক শক্তির আবির্ভাব যেভাবে ঘটেছে, তথাকথিত প্রতিবিপ্লবের মধ্য দিয়ে নতুন রক্ত স্নানের মাধ্যমে পুরাতনের বিদায় পর্ব ঐভাবেই সমাধা হয়েছে এটা ইথিওপিয়ার সামরিক সরকার অবশ্যই মনে রাখবেন। কারণ জনগণের সমস্যাকে পাশ কাটিয়ে আত্মতোষণের মাধ্যমে ক্ষমতায় টিকে যায় না। এর জন্য চাই জনগণের সহায়তা। সুতরাং যদি কেউ রাষ্ট্রদ্রোহিতার অপরাধ করে থাকে—সংক্ষিপ্ত সামরিক আদালত কেন—গণআদালতের মাধ্যমে তাদের বিচারের ব্যবস্থা করুন। আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ দিন। রাষ্ট্রদ্রোহী অপরাধের বিচার রাষ্ট্রের জনগণ করবে।
পারমাণবিক অস্ত্র সীমিতকরণ সম্পর্কে
দশ বছরের জন্য অস্ত্র প্রতিযোগিতা বন্ধের নীতিমালা সম্পর্কে রুশ-মার্কিন মতৈক্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট জেরাল্ড ফোর্ড এবং সোভিয়েত কম্যুনিস্ট পার্টি প্রধান লিওনিদ ব্রেজনেভের মধ্যে ২৪ ঘন্টাব্যাপী শীর্ষ বৈঠক শেষে এক যুক্ত বিবৃতি প্রকাশ করা হয়েছে। বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ১৯৭৫ সাল থেকে ১৯৮৫ সাল পর্যন্ত এই দশ বছরের জন্য পারমাণবিক অস্ত্র সীমিতকরণের একটি নতুন চুক্তির মৌল নীতিমালা সম্পর্কে তাঁরা ঐক্যমতে পৌঁছেছেন। আশা করা হচ্ছে, এই গুরুত্বপূর্ণ অস্ত্র সীমিতকরণ রুশ-মার্কিন চুক্তিটি আগামী বছর স্বাক্ষরিত হবে। ডঃ হেনরী কিসিঞ্জার সাংবাদিকদের কাছে বলেছেন যে, যুক্ত বিবৃতিতে যে অগ্রগতি সাধিত হয়েছে, তা সাম্প্রতিক বছরগুলোর আলাপ-আলোচনারই প্রত্যক্ষ ফল। আগামী বছর সোভিয়েত নেতা ব্রেজনেভ ওয়াশিংটন সফর করবেন, তখন এই চুক্তি স্বাক্ষরিত হবে বলে ডঃ কিসিঞ্জার অভিমত প্রকাশ করেছেন। প্রশান্ত মহাসাগরের তীরবর্তী সোভিয়েত নগরী ব্লাডিভোস্টকে কাউকে প্রবেশ করতে দেয়া হয়নি। প্রেসিডেন্ট ফোর্ড এবং ডঃ কিসিঞ্জারই প্রথম মার্কিন নাগরিক, যারা এই গুরুত্বপূর্ণ নগরীতে প্রবেশাধিকার পেলেন। ডঃ কিসিঞ্জার ফোর্ড-ব্রেজনেভ বৈঠকে ব্রেজনেভের অতিথি হিসেবে যোগদান করেছিলেন। ডঃ কিসিঞ্জার জানিয়েছেন, ভূখন্ড, সমুদ্র বা অন্তরীক্ষ থেকে ক্ষেপণাস্ত্র ক্ষেপণ, বোমা নিক্ষেপ বা বহুমুখী ক্ষেপণাস্ত্র ইত্যাদি আক্রমণাত্মক পরমাণু অস্ত্র একটা নির্দিষ্ট সীমায় রাখতে মিঃ ফোর্ড এবং মিঃ ব্রেজনেভ সম্মত হয়েছেন। এই চুক্তি অনুযায়ী দু’দেশের সমানসংখ্যক পরমাণু অস্ত্র থাকবে। এই চুক্তির ফলে পরমাণু অস্ত্র সীমিতকরণই সাধিত হবেনা, দু’দেশকে অস্ত্র সংখ্যা হ্রাস করতেও সাহায্য করবে। প্রেসিডেন্ট ফোর্ড নাকি অস্ত্র সীমিতকরণের যে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে তার সঠিক সংখ্যা প্রকাশ না করার জন্য কংগ্রেস নেতাদের প্রতি অনুরোধ জানিয়েছেন। অনুমান করা হচ্ছে, ব্লাডিভোস্টকের বৈঠকে মিঃ ফোর্ড আড়াই হাজারের কম ক্ষেপণাস্ত্র এবং দূরপাল্লার বোমারু বিমান সীমিত রাখার ব্যাপারে সম্মত হয়েছেন। চুক্তিটি যাতে পন্ড না হয়ে যায়, সেজন্যই নাকি মিঃ ফোর্ড ক্ষেপণাস্ত্র রাখার সঠিক সংখ্যাটি আগেভাগে ফাঁস করে দিতে গররাজী। ব্লাডিভোস্টকের সম্মেলনে অস্ত্র প্রতিযোগিতা সীমিত করার প্রশ্নে মতৈক্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, কিন্তু এই সম্মেলনে পারমাণবিক অস্ত্র বর্জনের জন্য কোনো সিদ্ধান্ত নেয়া হয়নি। কাজেই দুর্বল রাষ্ট্রগুলো, যাদের হাতে পারমাণবিক অস্ত্র মওজুত নেই, তারা স্বাভাবিক নিয়মেই আতঙ্কমুক্ত থাকতে পারবে না। এ কথা সত্য যে, অমিত শক্তিশালী পৃথিবীর এই দু’টি বৃহৎ রাষ্ট্র অস্ত্র প্রতিযোগিতা সীমিত করলে, অন্যান্য দেশও তাই করতে বাধ্য হবে। কিন্তু অস্ত্র সীমিত করার চেয়ে যদি অস্ত্র বর্জন করার নীতি গৃহীত হতো, তাহলে ক্ষুদ্র শক্তিসম্পন্ন রাষ্ট্রগুলোকে আতঙ্কিত অবস্থায় কাল কাটাতে হতো না। পারমাণবিক অস্ত্র যাদের হাতে রয়েছে, তারা চোখের পলকেই গোটা পৃথিবীর ধ্বংস ডেকে আনতে পারে। প্রতিযোগিতা তাদের কাছে একেবারেই অনভিপ্রেত। কারণ প্রতিযোগিতার মাধ্যমে কেবল অর্থের যোগানই বাড়ে। তাই পারমাণবিক শক্তিতে অন্য কোনো দেশ যাতে শক্তিশালী না হয়ে উঠে, এটাও রুশ-মার্কিনের ইপ্সিত লক্ষ্য। রুশ-মার্কিন নিজেরা যে পারমাণবিক অস্ত্র একেবারে ছেড়ে দেবে, এমন কোনো চুক্তি কিন্তু সম্পাদিত হয়নি। তবে রুশ-মার্কিন পারমাণবিক অস্ত্রের প্রতিযোগিতায় অবতীর্ণ হবে না। এখানে তারা অস্ত্র সীমিতকরণের পক্ষপাতী। অন্য রাষ্ট্র পারমাণবিক শক্তিতে বলীয়ান হোক, পারমাণবিক অস্ত্র উৎপাদন করুক, প্রকৃত প্রস্তাবে এটা বন্ধ করার জন্যই রুশ-মার্কিন যৌথভাবে পদক্ষেপ নিয়েছেন। প্রেসিডেন্ট ফোর্ড পারমাণবিক অস্ত্রের লড়াই এড়ানোর জন্য বদ্ধপরিকর। মিঃ ব্রেজনেভও পারমাণবিক শক্তি প্রয়োগে উৎসাহী নয়। কিন্তু তবুও অস্ত্র সাহায্যের কোনো রকম বিরতি ঘটেনি। বিশ্বের নানা দেশে অশান্তির আগুন দাউ দাউ করে জ্বলছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র অস্ত্র সীমিতকরণের প্রশ্নে এগিয়ে আসলেও বিভিন্ন সামরিক ঘাঁটিগুলোতে উত্তেজনা জিইয়ে রাখছে। এই অবস্থায় পারমাণবিক অস্ত্র বর্জনের প্রশ্নটিরই পাওয়া উচিত ছিল প্রাধান্য। পারমাণবিক অস্ত্র সীমিত করলেই যে অস্ত্রের ঝনাৎকার বন্ধ হয়ে যাবে এমন মনে করা কঠিন। কারণ পারমাণবিক অস্ত্র চিরদিনই ভয়াবহ। পারমাণবিক অস্ত্র উৎপাদন হ্রাস না করা হলে কিংবা পারমাণবিক অস্ত্র বর্জনের নীতি অনুসৃত না হলে চিরদিনের জন্য দুর্বল রাষ্ট্রগুলোর আতংকিত প্রহরের অবসান হবে না।
কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক