You dont have javascript enabled! Please enable it! 1974.03.17 | বাংলার বাণী সম্পাদকীয় | বঙ্গবন্ধুর জন্মদিনে— | আদমজী মিলের সমস্যার বাস্তব সমাধন প্রয়োজন | লাল ফিতার বদৌলতে | শেখ মণি - সংগ্রামের নোটবুক

বাংলার বাণী
ঢাকা : ১৭ই মার্চ, রবিবার, ১৯৭৪, ৩রা চৈত্র, ১৩৮০ বঙ্গাব্দ

বঙ্গবন্ধুর জন্মদিনে—

আজ বাঙালী জাতির জনক প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মদিন। আজকের এই দিনটি সমগ্র দেশব্যাপী পরম শ্রদ্ধায় এবং গভীর আন্তরিকতায় উদযাপিত হবে। সমগ্র জাতি আজ সশ্রদ্ধচিত্তে মহান নেতার জন্ম দিনটিতে তাঁর প্রতি প্রাণঢালা প্রণতি জানাবেন। জাতির জনকের জন্মদিন উপলক্ষে দেশের সর্বত্র সকল সরকারী ও বেসরকারী ভবনে জাতীয় পতাকা উত্তোলন করা হবে। বিদেশে বাংলাদেশের দূতাবাসগুলোতেও আজকের এই পূণ্যদিনটিকে জাতীয় পতাকা উত্তোলন, মহান নেতার সংগ্রামমুখর জীবনাদর্শের উপর আলোকপাত ইত্যাদির মাধ্যমে উদযাপন করা হবে। মসজিদ, মন্দির, মঠ এবং গীর্জায় বিশেষ মোনাজাত ও প্রার্থনা অনুষ্ঠিত হবে। বঙ্গবন্ধুর ঘটনাবহুল সংগ্রামী জীবনের দিক নিয়ে দেশে-বিদেশে ব্যাপক আলোচনা করা হবে। আওয়ামী লীগ, আওয়ামী যুব লীগ সহ বিভিন্ন রাজনৈতিক সাংস্কৃতিক এবং সামাজিক প্রতিষ্ঠানও বঙ্গবন্ধুর জন্মদিন পালনের জন্য বিশেষ কর্মসূচী গ্রহণ করেছেন।
জন্মদিনে বঙ্গবন্ধুকে মাল্যভূষিত করা হবে। সংগ্রামে সমৃদ্ধ বঙ্গবন্ধুর জীবনটি একটি গৌরবদীপ্ত ইতিহাস। স্বাধীনতার পূর্ব থেকে স্বাধীনতা প্রাপ্তির পর আজ পর্যন্ত তাঁর জীবনে এতো অভিজ্ঞতার সমন্বয় ঘটেছে যে, এই সব ঘটনাবলীর পর্যালোচনা জাতিকে নতুন প্রেরণায় উদ্দীপিত করবে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। তাই বাঙালীর প্রতি ঘরে ঘরে মহান নেতার শুভ জন্মদিনটি পালন করা আমাদের জাতীয় কর্তব্যের অন্তর্ভুক্ত হওয়া উচিত। বঙ্গবন্ধুর এবারের জন্মদিনটি যখন পালিত হচ্ছে, তখন তিনি অসুস্থ। ডাক্তারের পরামর্শে তিনি বিশ্রাম নিচ্ছেন। কিন্তু জন্মদিন তো আর বারে বারে আসেনা। বছরের একটি দিনেই পালিত হয় জন্মদিন। জন্মদিনের পূণ্যলগ্নে তাই সমগ্র জাতি তাঁর সুস্থ সমৃদ্ধ কল্যাণময় জীবনের জন্য জানাবেন প্রার্থনা। বঙ্গবন্ধু যেন অচিরেই রোগমুক্ত হয়ে আবার জাতির সেবায় নিজেকের নিয়োজিত করার কাজে মগ্ন হয়ে থাকতে পারেন, সে জন্য তাঁর দীর্ঘ জীবন কামনা করা হবে। নতুন কর্মোদ্দীপনায় বঙ্গবন্ধু তাঁর প্রিয় দেশবাসীকে প্রগতি ও উন্নতির পথে ধাবিত করার জন্য আবার মনোযোগ দেবেন। বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠার ব্যাপারেও তাঁর অনলস কর্ম প্রচেষ্টা অব্যাহত থাকবে। মহান ব্যক্তিদের জীবনাদর্শ পালন করার মধ্যে জাতির একটি মহতী কর্তব্যবোধ ও নিষ্ঠার পরিচয়ও পাওয়া যায়। মহান ব্যক্তিদের দেখানে পথে এগিয়ে যাওয়ার জন্য প্রতিটি মানুষই মহান কর্মযজ্ঞে আত্মনিবেদন করতে উদ্যোগী হয়ে উঠেন। এটাই স্বাভাবিক, এটাই চিরন্তন।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সংগ্রামদীপ্ত জীবনাদর্শ আজ আর কোনো বাঙালীর কাছে অবিদিত নেই। সমগ্র জীবনব্যাপী তিনি বাংলা ও বাঙালী জাতির সেবায় নিয়োজিত রয়েছেন। ঔপনিবেশিক আমলে তাঁকে বার বার কারা নির্যাতন ভোগ করতে হয়েছে। তবু তিনি বাঙালী জাতির স্বার্থ সংরক্ষণের জন্য আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন। ঔপনিবেশিক শাসকগোষ্ঠীর কোনো অত্যাচার, কোনো নির্যাতনই তাঁকে তাঁর গন্তব্য থেকে বিচ্যুত করতে পারেনি। স্বাধিকার আন্দোলন থেকে স্বাধীনতার ডাক পর্যন্ত তিনি তাঁর আপন কর্মনিষ্ঠা থেকে এতোটুকু পিছপা হননি। পঁচিশে মার্চ রাতে হানাদার বাহিনী তাঁকে গ্রেফতার করে সুদূর মিয়ানওয়ালীর জেলে বন্দী করে রেখেছিল। মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়েও তিনি স্বাধীন বাংলার স্বপ্নে ছিলেন বিভোর। অবশেষে রক্তাক্ত মুক্তি সংগ্রাম শেষে, দেশ যখন শত্রুমুক্ত হলো তিনি আবার ফিরে এলেন। দেশে ফিরে এসেই ধ্বংসস্তূপের মাঝে তিনি নব জীবন গড়ার কাজে আত্মনিবেদন করলেন। সুদক্ষ কান্ডারীর মতো তিনি দেশ পুনর্গঠনের হাল ধরলেন। বাংলাদেশকে সোনার বাংলায় পরিণত করার স্বপ্ন দেখলেন। এবং এজন্যে তাঁকে অনেক বন্ধুর পথও অতিক্রম করতে হচ্ছে।
বঙ্গবন্ধুর অক্লান্ত পরিশ্রমের ফলে বাংলাদেশ আজ সমগ্র বিশ্বের মানচিত্রে একটি উজ্জ্বল নাম। যুদ্ধ বিধ্বস্ত একটি দেশকে অর্থনৈতিক মেরুদন্ড সোজা করে দাঁড়াতে অনেক ধকল সইতে হয়। বাংলাদেশকেও এই ধকল সহ্য করতে হচ্ছে এবং এ জন্যে প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ ‍মুজিবুর রহমানকেও নিত্যদিন হরেক রকম সমস্যার সঙ্গে বোঝাপড়া করতে হচ্ছে। দিন নেই, রাত নেই তিনি অবিরাম কাজ করে চলেছেন। কিন্তু দেশের ভেতরে এমন সব বিশৃঙ্খল অবস্থা বিরাজিত রয়েছে যে, বঙ্গবন্ধুর একার পক্ষে সব দিকের টাল সামলানোটাও একটা মহা সমস্যায় পরিণত হয়েছে। এই অবস্থায় তিনি অতিরিক্ত কাজের চাপে মাঝে মাঝেই অসুস্থ হয়ে পড়ছেন।
আজ তাঁর জন্মদিন। কিন্তু তিনি অসুস্থ। বিশ্রাম নিচ্ছেন তাই, আমাদের প্রত্যেকেরই উচিত জন্মদিনে তাঁর আশু রোগমুক্তির জন্যে প্রার্থনা করা। এবং জন্মদিনে যদি আমরা এই মহান নেতার কর্তব্যনিষ্ঠার প্রতি যথাযথ শ্রদ্ধানিবেদন করে বাংলাদেশকে সোনার বাংলায় পরিণত করার শপথ গ্রহণ করি তাহলেই বঙ্গবন্ধুর জন্মদিনটির সার্থকতা খুঁজে পাওয়া যাবে। কারণ, বঙ্গবন্ধু সব সময়ই সমগ্র বাঙালী জাতিকে বিশ্বের একটি সমৃদ্ধ জাতিতে পরিণত করার কথা চিন্তা করেন। বঙ্গবন্ধুর এই চিন্তাধারার বাস্তবায়ন করতে হবে। শুভ জন্মদিনে আসুন সবাই উচ্চারণ করি, জয়তু শেখ মুজিব।

আদমজী মিলের সমস্যার বাস্তব সমাধন প্রয়োজন

কয়েকজন বৃটিশ বিশেষজ্ঞ আমাদের পাটমন্ত্রী জনাব শামসুল হকের সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে দেশের বৃহত্তম আদমজী জুট মিলের পরিচালনা সম্পর্কে একটি জরিপ কাজ শেষ করেছেন। সম্প্রতি বিশেষজ্ঞ দলটি আদমজী জুট মিলের সমস্যাদি নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছেন। তাঁদের মতে, আদমজী মিলে এখন সুষ্ঠু পরিচালনা অভাব ও শৃঙ্খলার অভাব রয়েছে। বৃটিশ পাট বিশেষজ্ঞ দলে রয়েছেন চার জন প্রতিনিধি। তাঁরা আদমজী মিলের সমস্যাদি নিয়ে পর্যালোচনা করেছেন এবং আমাদের পাটমন্ত্রীকে অবহিত করেছেন। আশা করা যাচ্ছে খুব শীঘ্রই তাঁরা একটি রিপোর্ট পেশ করবেন। আমাদের পাটমন্ত্রীকে বিশেষজ্ঞ দলের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে যে, আদমজী জুট মিলের অর্থনৈতিক বা আর্থিক সমস্যাদি, পরিচালনা ও প্রশাসনিক সমস্যাদি, ম্যানেজারিয়েল ও কারিগরি দিক, পরিচালনা ও শ্রমিক সম্পর্ক, খুচরা যন্ত্রাংশ ও কাঁচা পাটের অর্থনৈতিক ব্যবহার সম্পর্কিত সামগ্রিক সমস্যা তাঁরা পর্যালোচনা করে দেখবেন। তাঁরা আরও বলেছেন—আদমজী জুট মিলের সামগ্রিক সমস্যা পর্যালোচনা করে তাঁদের মনে হয়েছে মিল পরিচালনায় সমন্বয়ের অভাব এবং মিলে শৃঙ্খলাহীনতাই সামগ্রিক অযোগ্যতা ও আর্থিক ক্ষতি বাড়িয়েছে। আমাদের পাটমন্ত্রীর মতে, আদমজী জুট মিলের সমস্যা দেশের সার্বিক সমস্যাদির মতোই। তিনি বিশেষজ্ঞদেরকে তাঁদের রিপোর্টে সমস্যার সমাধানের কথা উল্লেখ করতে অনুরোধ করেছেন। দেশের অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে আদমজী মিলের গুরুত্ব যে অপরিসীম সে কথা উল্লেখ করে মন্ত্রী আশা প্রকাশ করেছেন যে, উক্ত রিপোর্ট সমস্যার সমাধানের পক্ষে কার্যকরী হবে।
বাংলাদেশের বৃহত্তম জুট মিল আদমজী। দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের পথে আদমজীর গুরুত্ব নিঃসন্দেহে অপরিসীম। স্বাধীনতার পর আদমজী মিল চালু করার পর থেকেই নানা প্রকার অব্যবস্থার সংবাদ আমরা জানি। বিভিন্ন সময়ে সরকার আদমজীর ব্যাপারে বিভিন্ন পদক্ষেপও নিয়েছেন। আদমজীতে সর্বপ্রথম যে প্রশাসক নিয়োগ করা হয়েছিল তাকে তহবিল তসরুপের দায়ে অপসারণ ও গ্রেফতার করা হয়। পরে যাদের দিয়ে মিলটি পরিচালিত হয়েছে তাদেরকেও বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন অভিযোগে অপসারণ করা হয়েছে। ফলে আদমজীর প্রশাসন ব্যবস্থা আজ পর্যন্ত স্থায়ী গতিশীল রূপ লাভ করতে পারেনি।
এছাড়া যন্ত্রপাতি সংক্রান্ত বিভিন্ন অসুবিধা লেগেই আছে। শ্রমিকদের ব্যাপারেও কিছু কিছু সমস্যা রয়েছে। তাদের অসন্তুষ্টি দূরীকরণেও যথেষ্ট পদক্ষেপ আবশ্যক। আমরা এ ব্যাপারে আমাদের সরকারকে বলেছি আদমজী যেহেতু দেশের সর্ববৃহৎ পাট কল ও দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে এর ভূমিকাও অপরিসীম সেহেতু আদমজীকে সর্বশক্তি নিয়োগ করে চালু রাখতে হবে এবং লাভজনক কারখানায় পরিণত করতে হবে। কিন্তু পূর্বাপর আমরা কর্তৃপক্ষের এ ব্যাপারে শৈথিল্য লক্ষ্য করেছি। বৃটিশ পাট বিশেষজ্ঞরা যে রিপোর্ট প্রদান করবেন আমরা আশা করি কর্তৃপক্ষ সে আলোকে সমস্যার বাস্তব সমাধান করবেন। আদমজী মিলকে যে করেই হোক চালু করা বা রাখা আজ সরকারের নৈতিক কর্তব্য বলে আমরা মনে করি।

লাল ফিতার বদৌলতে

রীতিমতো দুঃসংবাদ। মর্মান্তিকও বলা চলে। নীলফামারীর ছিয়াশিটি প্রাথমিক বিদ্যালয়কে শিক্ষা পরিকল্পনার আওতাধীনে তালিকাভুক্ত করা সত্ত্বেও নাকি বিদ্যালয়গুলোর শিক্ষকরা সরকারী শিক্ষকদের তালিকাভুক্ত হননি। এদের মধ্যে কেউ কেউ তিন চার বছর ধরে বেতন পাচ্ছেন না। দীর্ঘদিন অনিশ্চিত অবস্থায় থেকে এসব শিক্ষকের অনেকেই উৎসাহ হারিয়ে ফেলেছেন। চাকরী ছেড়ে অন্যত্র চলে যাচ্ছেন। তালা পড়ছে এক একটি করে বিদ্যালয়ে। আর এরই ফলশ্রুতিতে সেখানকার দশ হাজার শিশুর লেখাপড়া বন্ধ হবার উপক্রম হয়েছে। এ সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে স্থানীয় একটি দৈনিকে ছোট্ট একটি সংবাদ। তবে এ সংবাদ পড়ে চোখের সামনে ভেসে উঠে অসহায় শিক্ষক আর ছাত্র-ছাত্রীদের ছবি।
প্রাথমিক বিদ্যালয়কে সরকারী তালিকাভুক্ত করার পরও শিক্ষকরা তালিকাভুক্ত হননি এটা শুনতে কেমন যেন লাগে। মনে হয় কোথায় যেন একটা গরমিল রয়েছে। সরকারের পক্ষ থেকে স্পষ্টভাবে জানিয়ে দেয়া হয়েছে যে, সকল প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা সরকারী কর্মচারীর মর্যাদা পাবেন কিন্তু তারপরও এটা হচ্ছে কেন? তার উত্তর বোধ হয় একটাই। আর তা হলো লাল ফিতা নামক বস্তুটি। লাল ফিতার বদৌলতেই নীলফামারীতে এহেন কান্ডটি ঘটেছে। কিন্তু এ তো হতে পারেনা। হওয়া উচিত নয়। সরকার যেখানে গণমুখী শিক্ষা ব্যবস্থা চালু করতে বদ্ধপরিকর, সেখানে যদি গোড়াতেই গলদ থাকে তাহলে তো সামগ্রিকভাবে শিক্ষা সম্প্রসারণের নীতিই লাটে উঠবে। সামান্য লাল ফিতার জন্যে শিক্ষা সম্প্রসারণ লাটে উঠাটা তো খুব ভালো কথা নয়। এতে আর যাই হোক সরকারের কথা ও কাজের সমন্বয় সাধনের ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি হবে। আমরা তাই সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের প্রতি আবেদন জানিয়ে বলবো—লাল ফিতা আর নীল ফিতার জঞ্জাল সাফ করে একটা কিছু করুন যাতে দশ হাজার শিশুর লেখাপড়া চলতে পারে আর শিক্ষকরাও যথাযথ মর্যাদা আর মাসিক সম্মানীটা ঠিকমতো পান।

কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক

পত্রিকার মূল কপি পড়তে এখানে ক্লিক করুন