You dont have javascript enabled! Please enable it!
২২-১১-৭২ দৈনিক ইত্তেফাক বাংলাদেশের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘােষণা
 গণহত্যা ও নারী নির্যাতনে দখলদার বাহিনীর সহিত সহযােগিতার অপরাধ : ড. মালিকের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড ঢাকার ১নং বিশেষ ট্রাইব্যুনাল পাকিস্তানী দখলদার বাহিনীর আমলে ইয়াহিয়া শাহীর সর্বশেষ গভর্নর ডা, আবদুল মােত্তালিব মালেককে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘােষণা গণহত্যা নারী নির্যাতন গৃহদাহ লুটতরাজ চালানাে এবং বাংলাদেশে। মুক্তি সংগ্রাম বানচাল করিয়া দেবার ব্যাপারে দখলদার পাকিস্তানী সশস্ত্র বাহিনীর সহিত সরাসরি সহযােগিতার দায়ে অভিযুক্ত এবং বাংলাদেশ দণ্ড বিধির ১২১ ধারা মতে তাকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দণ্ডিত করিয়াছেন। গতকাল বিশেষ ট্রাইব্যুনালের মাননীয় বিচারক জনাব আব্দুল হান্নান চৌধুরী রায়দান প্রসঙ্গে বলেন যে, ডা. এম এ মালেকের বয়স ৭০ বছর। তার এই বার্ধক্য এবং তদুপরি অতীতে তাহার রাজনৈতিক ও সামাজিক কার্যকলাপের পরিপ্রেক্ষিতে তাহাকে বাংলাদেশ দণ্ড বিধির ১২১ ধারা মতে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দণ্ড প্রদান করা হইল। প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখযােগ্য যে মাননীয় বিচারক তাহাকে দোষী সাব্যস্ত এবং যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দান করিয়া রায় ঘােষণার সময় দখলদার আমলে বাংলাদেশে জঙ্গী ইয়াহিয়া শাহীর সর্বশেষ তাবেদার গভর্নর এম, এ, মালেকের মুখে ম্লান হাসি পরিলক্ষিত হয়। কিন্তু তাহার চক্ষু দুইটি সজল হইয়া ওঠে। ইহা ছাড়া মাননীয় বিচারক সুদীর্ঘ সাড়ে ৩ ঘণ্টা ব্যাপী তাহার লিখিত ২১ পৃষ্ঠার রায় পাঠ করিয়া শােনাইবার সময় আসামীর কাঠগড়ায় কড়া পুলিশ পরিবেশিত অবস্থায় উপবিষ্ট ডা, মালেককে সর্বক্ষণই খুবই বিষন্ন দেখাচ্ছিল।
তাহাকে কখনও বুকে দুই হাত রাখিয়া কখনও কাঠগড়ার কাঠে দুইহাত রাখিয়া রায় শুনিতে দেখা যায়। ৭০ বছর বয়সের ডা. মালেকের চোখমুখ আরক্ত হইয়া উঠিয়া ছিল। তাহার ঠোট দুইটি বার বার কাপিয়া উঠিতেছিল। মনে হয় তিনি যেন কি পাঠ করিতেছিলেন। মাননীয় বিচারকের রায় ঘােষণার সঙ্গে সঙ্গেই ডা, মালেক তাহার কৌসুলিগণ নিজ নিজ আসন হতে উঠিয়া দাঁড়াইয়া এই রায়ের জন্য হাইকোর্টে আপিল করার জন্য বিচারকের অনুমতি প্রার্থনা করেন। দালাল আইনে অভিযুক্ত ডা, মালেকের মামলার রায় শ্রবণের জন্য এই দিন ঢাকা জেলা ও দায়রা জর্জের আদালত কক্ষে দর্শকের ভিড়ে তিল ধারণের জায়গা ছিল না। সাংবাদিক গ্যালারিতে ভারতীয় সংবাদিকসহ কয়েকজন বিদেশী সংবাদিকও উপস্থিত ছিলেন। এছাড়া এইদিন আইনজীবীদের স্বাভাবিক ভিড় পরিলক্ষিত হয়। আদালতের আঙ্গিনা ও বাহিরে কড়া পুলিশি নিরাপত্তা জোরদার করা হয়। আদালতের সম্মুখে সদর রাস্তা এবং পিছনে কোট হাউজ স্ট্রীটে পুলিশকে দীর্ঘ বাঁশের লাটির ব্যারিকেড নির্মাণ করিয়া এক বাধভাঙ্গা জনস্রোতকে ঠেকাইয়া রাখিতে হয়। আদালতের পার্শের অফিস ভবনের ছাদে, বারান্দায়, এর দরজা জানালার পাশের সহস্র চক্ষু দৃষ্টি বিস্ফোরিত করিয়া দিয়াছিল আদালতের দিকে। মাননীয় বিচারক তার রায়ে বলেন যে বাংলাদেশ দালাল অর্ডারের (বিশেষ ট্রাইব্যুনাল) ১৯৭২ এর ১২১ এবং ১২৪ (ক) ধারানুযায়ী বর্ণিত সকল অভিযােগে ডা, মালেক দোষী সাব্যস্ত হইয়াছে। তাই তাহাকে ১২১ দণ্ডবিধিতে যাবজ্জীবন দণ্ডিত করা হইল।
১নং তফসিলে বর্ণিত ১২৪(ক) দণ্ড বিধি অথবা দালাল আইনের ৪(খ) ধারা অনুযায়ী তাকে কোন পৃথক সাজা প্রদান করিলাম না। মাননীয় বিচারক বিবাদী পক্ষের কৌসুলিদের উথাপিত যুক্তির উল্লেখ প্রসঙ্গে রায়ে বলেন যে, বিবাদী পক্ষের বিজ্ঞ কৌসুলি বলিয়াছেন যে অভিযুক্ত ডা, মালেক জেনেভা কনভেনশন অনুযায়ী যেহেতু আশ্রয়কারী ব্যক্তি অতএব এই আদালতের তাহার বিচার করার এখতিয়ার নাই । মাননীয় বিচারক তার রায়ে বলেন যে বর্তমান মামলায় ডা, মালেক জন্মগত বাঙ্গালী এবং তিনি বাংলাদেশের নাগরিক নহেন। এ কথা বলা যায় না। ডা, মালেক গত ১৩ নভেম্বর এই আদালতে পেশকৃত এক দরখাস্তে সুস্পষ্টভাবে স্বীকার করিয়াছেন যে তিনি প্রকৃত অর্থে একজন বাঙ্গালী। বিবাদী পক্ষের বিজ্ঞ কৌসুলি জেনেভা কনভেনশনের আরাে কতিপয় বিধির উল্লেখ করিয়াছেন। কিন্তু আমার অভিমত এই যে ডা, মালেক জেনেভা কনভেনশনের বিধান অনুযায়ী একজন আন্তর্জাতিক আশ্রিত ব্যক্তি নহেন। বিবাদী পক্ষের কৌসুলি এই মর্মে আপত্তি উত্থাপন করিয়াছেন যে ১৯৭১ সালের ২৬শে মার্চ বাংলাদেশ যে স্বাধীন হইয়াছে তার কোন প্রামাণ্য সাক্ষী নাই। কিন্তু ১৯৭১ সালের ১০ই এপ্রিলের ঘোষণায় স্পষ্টভাবে বলা হইয়াছে যে ১৯৭১ সালের ২৬শে মার্চ বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘােষণা করা হইয়াছে। অতএব বিবাদী পক্ষের এ যুক্তি ঠিক, নহে। মাননীয় বিচারক তার রায়ে আরাে বলেন মৌখিক প্রামাণ্য সাক্ষ্য হইতে ইহা সুস্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হয় যে ১৯৭১ সালের ২৬শে মার্চ হইতে দখলদার পাকিস্তানী বাহিনী বাংলাদেশের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করিতেছিল এবং ডা, মালেক গভর্নরের পদগ্রহণ করিয়া দখলদার বাহিনীকে সরাসরি সাহায্য করিয়াছেন। অভিযুক্ত ব্যক্তির পক্ষ হইতে মত প্রকাশ করা হইয়াছে যে বাংলাদেশের জনসাধারণের কল্যাণের জন্য তিনি এই পদ গ্রহণ করিয়াছিলেন।
কিন্তু তিনি জনগণের কল্যাণ করিয়াছেন এমন কোন প্রমাণ এই মামলায় উত্থাপন করেন নাই। পক্ষান্তরে প্রাপ্ত সাক্ষ্য প্রমাণে ইহা প্রমাণ হয় যে, তিনি মুক্তিবাহিনীকে ধ্বংস ও দখলদার বাহিনীর হস্ত শক্তিশালী করার জন্য জনসাধারণকে উস্কানি দিয়াছিলেন। তিনি রাজাকারদের সংখ্যা বৃদ্ধি করার চেষ্টা করেছিলেন। এই রাজাকারগণ দখলদার বাহিনীকে গণহত্যা এবং মুক্তিবাহিনী ধ্বংস করার কাজে সাহায্য করিয়াছে । এতদ্ব্যতীত তিনি কয়েকটি ভাষণে বাংলাদেশ সরকারের বিরুদ্ধে ঘৃণা সৃষ্টির প্রয়াস পাইয়াছেন। সাক্ষ্য হইতে ইহা স্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হয় যে বাংলাদেশে বেআইনী দখল অব্যাহত রাখার ব্যাপারে অভিযুক্ত ডা, মালেক দখলদার বাহিনীর শক্তি বৃদ্ধির জন্য সাহায্য এবং সমর্থন জ্ঞাপন করিয়াছেন। তদুপরি এমন কোন আইনের প্রয়ােজনে তিনি গভর্নরের পদ কিম্বা তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের বিশেষ সহকারীর পদ গ্রহণ করেন নাই। ডা, মালেক তদন্তকারী অফিসারের নিকট বলিয়াছেন যে তিনি জনগণকে সাহায্য করার জন্য গভর্নরের পদ গ্রহণ করিয়াছিলেন। কিন্তু তিনি এ ধরনের কোন প্রমাণ দেখাইতে পারেন নাই। বিবাদী পক্ষের কৌঁসুলি বলিয়াছেন যে দালাল অর্ডিন্যান্স একটি খারাপ আইন এবং তাহা সর্বনিম্ন সাজা নির্দিষ্ট করিয়া দিয়া এই আদালতের ক্ষমতা কাড়িয়া লইয়াছে। কোন অপরাধের জন্য সর্বনিম্ন সাজা নিরূপণ সূচক ইহাই কেবল বিশ্বের একমাত্র আইন নহে। এমনকি আমাদের ফৌজদারী। বিধিতেও যাহা বৃটিশ আমলে রচিত হয়েছিল। তাহাতেও সর্বনিম্ন সাজা নির্দিষ্ট রহিয়াছে ।

উদাহরণ স্বরূপ বাংলাদেশ ফৌজদারী বিধির ৩০৩ ধারা উল্লেখ করা যাইতে পারে। এই আইনে সর্বনিম্ন সাজা নির্দিষ্ট রহিয়াছে। সুতরাং যে স্থলে বর্তমান ফৌজদারা বিধিও যুগ যুগ ধরিয়া ভালাে আইন বলে বিবেচিত হইয়াছে। সে স্থলে দালাল অর্ডিন্যান্স সর্বনিম্ন সাজা নির্দিষ্ট করে দেওয়ায় কিভাবে খারাপ আইন হতে পারে তা আমি বুঝি। উল্লেখ যােগ্য যে এই মামলায় সরকার পক্ষের মােট ২৮ জন সাক্ষীর সাক্ষ্য গ্রহণ করা হয়। ইহা ছাড়া মামলায় প্রামাণ্য সাক্ষ্য হিসাবে একশত দলিল পেশ করা হয়। এই মামলায় সরকার পক্ষে ছিলেন বাংলাদেশ সরকারের যুদ্ধপরাধী মামলার প্রধান। কৌসুলী জনাব সিরাজুল হক। সিনিয়র বিশেষ সহকারী কৌসুলি খােন্দকার মাহবুব হােসেন এবং জনাব আবদুর রাজ্জাক। বিবাদীপক্ষে ছিলেন মেসার্স আতাউর রহমান। খান, খান বাহাদুর নাজির উদ্দিন আহমেদ, আমজাদ আলী, মনসুর রহমান, হাবিবুর রহমান এবং কাজী শাহাদত হােসেন। রায় ঘােষণার পর ডা, মালেক আদালত কক্ষের পার্শ্বের অপর একটি কক্ষে প্রবেশ করিয়া তাহার কৌসুলিদের সহিত গোপন সলা। পরামর্শ করেন। তাহাকে যখন প্রিজন ভ্যানে করিয়া কড়া পুলিশ প্রহরাধীন জেলা কারাগারে লইয়া যাইতেছিল তখন বাহিরে অপেক্ষামান বিশাল জনতা টিটকারীসূচক দূর দূর ও হৈ-হুল্লা করিয়া দখলদার আমলে বাংলাদেশী জঙ্গী ইয়াহিয়া শাহীর সর্বশেষ গভর্নর ডা, মালেককে বিদায় অভ্যর্থনা জ্ঞাপন করেন।

সূত্রঃ সাজাপ্রাপ্ত যুদ্ধাপরাধী ১৯৭১ -প্রত্যয় জসীম

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!