বাংলার বাণী
ঢাকাঃ ২৯শে আগস্ট, বৃহস্পতিবার, ১২ই ভাদ্র, ১৩৮১
বন্যার পানি সরছে, সমস্যাও বাড়ছে
প্রায় তিন মাস ধরে দেশে চলছে ভয়াবহ বন্যার নির্মম ও দোর্দণ্ড প্রতাপ। দেশের স্থলভাগের প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ গেল ডুবে, প্রায় তিন কোটি লোক হল সহায় সম্বল হারা, অপরিমিত মূল্যমানের খাদ্যশস্য, গবাদিপশু, জীবনযাত্রা নির্বাহী নিত্য ব্যবহার্য দ্রব্যাদি গেল ভেসে। এরই মাঝে আবার নতুন করে শোনা যাচ্ছে বন্যার পদধ্বনি। বর্তমানে বন্যা পরিস্থিতির কুফলগুলো কেবল সহস্ত্র হিংস্র দাত বের মুখব্যাদান শুরু করেছে। এখনকার অবস্থা হল খাদ্য নেই, বস্ত্র নেই, কাজ নেই, নেই বীজ ধান বা হালের বলদ। শুধু ভিটেয় ফিরবার নেই কোনো তাগাদা। হতাশা আর অন্ধকারে চারদিক যেন আচ্ছন্ন। এই বর্তমানকে নিয়ে ভবিষ্যতে টেনে আনতে হবে জীবনের মুখোমুখি।
আমরা জানি প্রায় তিন কোটি ক্ষতিগ্রস্ত জনসাধারণের জীবনের মুখোমুখি যে ভবিষ্যতে হবে তার সহজ কাজ নয়। কারণ সাধারণ হিসেবে ধরতে গেলে ও মাথাপিছু একটাকা সাহায্য দিতে তিন কোটি টাকার প্রয়োজন হয়। এক পোয়া করে দৈনিক চাল বরাদ্দ করলেও প্রতিদিন এক কোটি সোয়া চাল (গড়ে তিন বেলার খাবার হিসেবে) অর্থাৎ এক লক্ষ ৮৭ হাজার ৫শত মণ চাল প্রয়োজন। পুনর্বাসনের জন্য ন্যূনতম ১শত টাকা করে দিলেও প্রয়োজন তিন শত কোটি টাকা। প্রায় ৩৫ লক্ষ প্লাবিত জমিতে চাষাবাদের জন্যও লক্ষ লক্ষ মণ ধান এবং হাজার হাজার জোড়া হালের বলদ দরকার।
অত্যন্ত প্রয়োজনের ওইসব উপকরণসহ একটা সবুজ ভবিষ্যতকে টেনে আনা তাই সহজ কাজ নয়। পর্বত অভিযাত্রী দল যেমন কঠিন অথচ ভঙ্গুর হিমরাশির বুক চিরে চিরে চূড়ায় ওঠে তেমনি কঠোর শ্রম, জীবনের ঝুঁকি, অধ্যাবসায়, নিষ্ঠা ও নিরবচ্ছিন্ন অক্লান্ত সাধনা নিয়ে আমাদেরকে ভবিষ্যতের চূড়াটা ধরতে হবে। অনমনীয় শপথ গ্রহণ করে সমগ্র জাতিকে আজ বন্যা পিষ্ট দেশটির অগণিত মানুষের জন্য কাজ করতে হবে। রাখতে হবে বাস্তব চিন্তার বিন্যাস। আমাদের যা আছে, যেটুকু আছে তাকেই বহুমুখী খাতে ব্যবহার করে তার দ্বারা সর্বোচ্চ ফল লাভের উপায় সৃষ্টি করতে হবে।
প্রসঙ্গক্রমে গ্রামের বিধ্বস্ত রাস্তাঘাটের কথাই বলা যাক। সরকারি তহবিল থেকে বরাদ্দ ধরে ঠিকাদারদের মাধ্যমে সেগুলো মেরামত না করিয়ে গ্রামের বেকারদের দাঁড়াও তা করা যায়। এতে সরকারি ব্যয় অবশ্যই কম হবে, কিছু লোকের বেকারত্ব সাময়িকভাবে হলেও ঘুচবে। এমনিভাবে রিলিফ সামগ্রী ইত্যাদি বন্টন, বীজ ধান, কৃষি সরঞ্জামাদি সরবরাহ ইত্যাদির কাজেও বন্যা ক্ষতিগ্রস্ত লোকদের লাগিয়ে দেওয়া যায়। এতেও ভালো কাজ পাবার আশা বেশি। এমনিভাবে বন্যার ত্রাণ ও পুনর্বাসনের সামগ্রিক কাজে সর্ববিধ বাগাড়ম্বর তথা কমিটি বা সংস্থারূপী মধ্যব্যবস্থার পরিবর্তে সরাসরি কাজের পরিবেশ সৃষ্টি করা আবশ্যক। কারণ দুঃখীর ব্যথা মধ্যস্বত্বাধিকারিরা সহস্ত্র চেষ্টা করলেও বুঝতে পারে না- যার ফলে দুর্নীতির নৈরাজ্য সৃষ্টির পরিবেশ অতি সহজে গড়ে ওঠে। বন্যা পরিস্থিতির মোকাবিলায় আমাদের সামনে এখন পর্যাপ্ত কাজ। সম্ভাব্য সকল প্রকার ত্যাগে উদ্বুদ্ধ হয়ে একটা সুস্থ মানবতা ও নৈতিকতা আজ আমাদের অর্জন করতেই হবে। কারণ বিপদ-আপদ হল দুর্ঘটনার সামিল। একে এড়ানো যায় না। এবং একে অতিক্রম করে টিকে থাকতে হলে করতে হয় মরণপণ সংগ্রাম। আমরা বিশ্বাস করি এই সংগ্রামী মনোভাবেই পারে ভবিষ্যতে চূড়াকে জীবনের মাঝে টেনে সেখানে বিজয় কেতন ওড়াতে। সংগ্রামী জাত হিসেবে আমাদের যে ঐতিহ্য আমরা সৃষ্টি করেছি স্বাধীনতা সংগ্রাম কালে সেই ঐতিহ্যের সম্মানার্থে বন্যা বিধ্বস্ত দেশকে আমাদের আবার গড়ে তোলার শপথ নিতে হবে। বন্যাত্তোর সমস্যা আমাদের কাটিয়ে উঠতে হবে-এই হোক আমাদের ধ্যান-জ্ঞান, কর্ম ও সংগ্রামের মন্ত্র।
জাহাজে স্থান নেইঃ চা বিদেশে যাচ্ছে না
বাণিজ্যমন্ত্রী খন্দকার মোশতাক আহমেদ কাবুল সফরে গেছেন। যাবার আগে তিনি সাংবাদিকদের বলেছেন, কাবুলে চা রপ্তানির বিষয়ে আলাপ-আলোচনা করবেন। কাবুলে হয়তো চা নিয়ে আলোচনা এখন চলছে। কিন্তু এর মধ্যেই সংবাদ বেরিয়েছে, জাহাজে স্থান সংকুলানের অভাবে চট্টগ্রামে প্রায় ৩ কোটি ৬০ লক্ষ পাউন্ড রপ্তানিযোগ্য স্তূপীকৃত হয়ে পড়ে আছে।
প্রসঙ্গতঃ উল্লেখ্য, ১৮ কোটি টাকা বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের জন্য সরকার এ বছর ৬ কোটি পাউন্ড যা রপ্তানি করার লক্ষ্যমাত্রা স্থির করেন। কিন্তু আশঙ্কা করা হচ্ছে যে, আগামী মাসগুলোতে জাহাজের ব্যবস্থা করা না হলে এই রপ্তানি লক্ষ্যে পৌঁছানো সম্ভব নাও হতে পারে।
নানান প্রতিবন্ধকতা সত্ত্বেও চলতি বছরে দেশে চায়ের উৎপাদন বৃদ্ধি পেয়েছে। এপ্রিল হতে জুলাই মাস পর্যন্ত চার মাসে মোট ২ কোটি ৯৯ লাখ ২০ হাজার পাউন্ড চা উৎপাদিত হয়েছে। অথচ গত বছর এ সময়ে চা উৎপাদিত হয় দুই কোটি ৪০ লাখ পাউন্ড।
এটাতো দিবালোকের মতো স্পষ্ট যে, বাংলাদেশের প্রধান রপ্তানি যোগ্য পণ্যের মধ্যে চায়ের একটা বিশেষ স্থান রয়েছে। চা রপ্তানি করে বাংলাদেশ বৈদেশিক মুদ্রা অর্জিত করতে সক্ষম। কিন্তু সবসময়ই দেখা যাচ্ছে যে, চা,পাট, চামড়ার পণ্য রপ্তানি করার জন্য সরকার বিশেষ উদ্যোগ নেয়ার সঙ্গে সঙ্গে একটা-না-একটা প্রতিবন্ধকতা দেখা দেয়। চায়ের কথাই যদি ধরা যায় তাহলে দেখা যাবে, স্বাধীনতা লাভের পর চা শিল্পের উপর দিয়ে ঝড়ঝাপটা চলে গেছে অনেক। এটা থাকে তো ওটা থাকে না-এমন একটা অবস্থা। সে অবস্থার আমূল পরিবর্তন হয়েছে তেমন কথা জোর দিয়ে বলা যায় না। এতদসত্ত্বেও ১৯৭২-৭৩ সালে ৫ কোটি ৩ লক্ষ পাউন্ড এবং ১৯৭৩-৭৪ সালে ৬ কোটি ১ লক্ষ পাউন্ড চা উৎপাদিত হয়েছে। এবং সর্বশেষ মৌসুমে বাংলাদেশ ৫ কোটি এক লক্ষ পাউন্ড বা বিদেশে রপ্তানি করেছে। চলতি বছরে তুলনায় দেড় কোটি পাউন্ড বেশি রপ্তানি করার চেষ্টা করা হয়েছে মাত্র। অথচ এরই মধ্যে দেখা দিয়েছে নতুন ফ্যাকড়া। এ ফ্যাকড়া হল জাহাজের অভাব। আমরা জানিনা কি কারনে বা কার দোষে চট্টগ্রাম বন্দরে ৩ কোটি ৬০ লক্ষ পাউন্ড চা পড়ে রয়েছে। চায়ের অংকটা কিন্তু কম নয়-সার্বিক রপ্তানিযোগ্য চায়ের অর্ধেকেরও বেশি। এ অবস্থাটাকে থাকে তো সহজভাবে মেনে নেয়া যায়না। অনেক কাঠ-খড় কেরোসিন পুড়িয়ে যখন চা বন্দরে এসে পৌঁছাল তখন জাহাজের অভাবে বিদেশে যাবে না-এতো হতে পারে না। হওয়া উচিত নয়। আশা করি সংশ্লিষ্ট দপ্তর ব্যাপারটা গভীরভাবে দেখবেন এবং রপ্তানিযোগ্য যাত্রা শুরু হয় সে ধরনের কার্যকরী ব্যবস্থা নেবেন। আর তা যদি না হয় তাহলে বিদেশে বাংলাদেশের প্রতিনিধিরা যাবেন। চায়ের ব্যবসা নিয়ে আলাপ আলোচনা করবেন ঠিকই তবে শেষ পর্যন্ত তা হবে পর্বতের মূষিক প্রসব।
কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক