You dont have javascript enabled! Please enable it!

বাংলার বাণী
ঢাকা: ১১ই সেপ্টেম্বর, বুধবার, ২৫শে ভাদ্র, ১৩৮১

ঢাকা কর্পোরেশনের দায়িত্ব হবে বিরাট এবং ব্যাপক

ঢাকা করপোরেশনের নির্বাচন আগামী কয়েক মাসের মধ্যে অনুষ্ঠিত হবে বলে গতকাল একটি সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে। স্বায়ত্তশাসন, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় বিভাগের প্রতিমন্ত্রী সাংবাদিকদের কাছে এ তথ্য উদঘাটন করেছেন। জাতীয় সংসদের বিগত অধিবেশনে কর্পোরেশন বিল অনুমোদন লাভ করেছে। এরপর করপোরেশনের নির্বাচন সম্পর্কে দেশের কয়েকটি জাতীয় সংবাদপত্রে কিছু খবরও প্রকাশ পেয়েছিল। বাহাত্তর জন কমিশনার বিশিষ্ট ঢাকা কর্পোরেশন আগামীতে এক বিরাট দায়িত্বভার গ্রহণ করতে চলেছে। প্রথম কর্পোরেশন হিসেবে এর গুরুত্ব অপরিসীম। তাছাড়া ঢাকা যেহেতু আজ একটি দেশের রাজধানী এবং মেট্রোপলিটন শহর হিসেবে যেহেতু ঢাকাকে উন্নত করতে হবে সেহেতু কর্পোরেশন গঠনের প্রয়োজনীয়তা ও গুরুত্ব সুদূরপ্রসারি। ঢাকা মিনিসিপ্যালটিকে কর্পোরেশনে উন্নীত করার প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে আমরা ইতিপূর্বে আমাদের মতামত ব্যক্ত করেছেন। বস্তুতঃ নতুন একটি দেশের রাজধানী হিসেবে ঢাকা সম্প্রসারণ এবং নতুন বৃষ্টিকন্যা ঢাকা শহরকে পুনর্গঠিত করার আবশ্যকতা অত্যন্ত বেশি। এতকালের অবহেলা ও ব্যর্থতার অবসান ঘটিয়ে কর্পোরেশনের দায়িত্ব সম্প্রসারণ করতে হবে গোটা শহরকে একটি দেশের রাজধানী হিসেবে আদর্শ এবং পরিকল্পিত উপায়ে পুর্নগঠিত করতে হবে। এর জন্য যেমন ব্যাপক পরিকল্পনা প্রয়োজন তেমনি কর্পোরেশনের জন্য অত্যন্ত যোগ্য ও সৎ নেতৃত্বও আবশ্যক। আমরা বিশ্বাস করি কোন একটি ব্যবস্থার অবসান ঘটিয়ে অন্য আরেকটি ব্যবস্থার প্রবর্তন করলেই শনৈঃ রবে কোন কিছুর উন্নতি সাধিত হয় না। এর জন্য অবশ্যই প্রয়োজন সুদূর পরিকল্পনা, আন্তরিকতা এবং যোগ্য নেতৃত্ব। বহুকালের ঢাকা মিউনিসিপালিটিকে কর্পোরেশনের উন্নীত করার যে মহাপরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে তাকে কার্যকরী করার সকল দায়িত্ব কর্তৃপক্ষের। নির্বাচনের মাধ্যমে কর্পোরেশন নতুন দায়িত্বভার গ্রহণ করবে। ঢাকা শহরের অধিবাসীদের ভোটে নির্বাচিত হবেন কমিশনারগণ। আমরা আশা করছি একটি সুষ্ঠু নিরপেক্ষ এবং শান্তিপূর্ণ নির্বাচনের মাধ্যমে দেশে প্রথম কর্পোরেশনে যেসকল নেতৃত্তের আগমন ঘটবে তারা নিজেরা যেমন হবেন যোগ্য ও সৎ তেমনি মিউনিসিপ্যালিটির সাফল্য ও ব্যর্থতা সামনে রেখে তারা ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা বাস্তবায়নে পদক্ষেপ গ্রহণ করবেন।
ঢাকা শহরে একটি প্রাচীন ঐতিহাসিক শহর। মোগল সম্রাটের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত শহরের ইতিহাস উপমহাদেশের ইতিহাসে একটি উল্লেখযোগ্য সংযোজন। বহু প্রাচীন নিদর্শন বুকে নিয়ে আজও তাই দাঁড়িয়ে আছে সেই জাহাঙ্গীরনগর। বিংশ শতাব্দীর নতুন সভ্যতার আলোকে বিশ্বের সর্বত্র যেভাবে আলোকিত হয়েছে ঢাকা নগরীও তার থেকে বাদ পড়েনি। তবুও আধুনিক শহর হিসেবে এর পুনর্গঠনের কাজ তেমন উল্লেখের দাবি রাখে না। অবশ্য একথা সত্য যে, পাকিস্তান আমলের উপনিবেশিক শাসনের ভিন্ন কারসাজির ঢাকা শহর উন্নয়নে ব্যাপক কোন পরিকল্পনা কোনদিন অনুমোদন করা হয়নি, যেভাবে উন্নয়ন সাধিত হয়েছিল পশ্চিম পাকিস্তানের করাচি, লাহোর, ইসলামাবাদ শহর। স্বাধীনতা লাভের পর অনিবার্যভাবে তাই আমাদের কর্তৃপক্ষের উপর বর্তেছে ঢাকা শহর পুনর্গঠন এর মহা দায়িত্বভার। শহরের এক উল্লেখযোগ্য পরিমাণ সমস্যা রয়েছে যা বহুকাল ধরেই কর্তৃপক্ষের অবহেলাঃ দরুন সৃষ্ট। ঢাকা বাসীরা এক বাক্যে কতকগুলো সমস্যার ব্যাপারে সম্পূর্ণ একমত পোষণ করে থাকেন। যে সকল সমস্যার কথা বহুকাল ধরেই জাতীয় সংবাদপত্র সমূহ বারবার লেখা হয়েছে কিন্তু তার সুফল মেলেনি। ঢাকা শহরের পুরনো অংশটা সম্পূর্ণ অপরিকল্পিতভাবে বেড়ে উঠেছে। তুলনামূলকভাবে সবচেয়ে নোংরা এলাকাও এটি। শহরের কয়েকটি এলাকার কিছু বড় রাস্তার কথা বাদ দিলে প্রায় প্রত্যেকটি ছোট বড় রাস্তায় অসমতল এবং নোংরা। রাস্তাগুলো এহেন অবস্থা বহুদিন ধরে শহরের মানুষের কাছে এক নিদারুন ক্ষোভের কারণ হলেও মিউনিসিপাল কতৃপক্ষ কোনদিন কাউকে তোয়াক্কা করেননি। অপরিকল্পিতভাবে বাড়িঘর, দোকানপাট ইত্যাদি গড়ে উঠলেও মিউনিসিপালিটি, ডি, আই, টি এবং সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ কোনো ব্যবস্থা অবলম্বন করেন নি। ফলে ঢাকার এলাকায় বিশেষ অত্যন্ত নোংরা ও অগোছালোভাবে বেড়ে উঠেছে। ওয়াসা, টেলিফোন, গ্যাস ও বিদ্যুৎ বিভাগের মধ্যে মূলত আজ পর্যন্ত কোনো সমন্বয় গড়ে ওঠেনি। যার দরুন অসমতল বিপদজনক রাস্তা সমূহ খেয়ালখুশিমতো খনন করে আরো বিপজ্জনক অসমতল করে তোলা হয়েছে। এব্যাপারে বহু লেখালেখি করেও কোনো লাভ হয়নি। জানা গেছে ডি, আই, টি অবলুপ্ত হয়ে মেট্রো পুলিশ ডেভেলপমেন্ট অথরিটি নামে একটি সংস্থা জন্মলাভ করতে চলেছে। ঢাকা শহরের উন্নয়নের ব্যাপারে এ সংস্থার একটি বিরাট দায়িত্ব থাকবে। কর্পোরেশন ও মেট্রোপুলিশ ডেভেলপমেন্ট অথরিটি মধ্যে কাজ বিভাগের একটি সুস্পষ্ট রেখা থাকতে হবে। নইলে এতোকাল ওয়াপদা, ওয়াসা, ডি, আই, টি মিউনিসিপ্যালিটির মধ্যে সমন্বয়ের অভাব পরিলক্ষিত হয়েছে তা ভবিষ্যতেও থেকে যাবে। আমরা পরিকল্পিত ঢাকা শহরের উত্তরোত্তর শ্রীবৃদ্ধি জন্য কর্পোরেশনের গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে কর্তৃপক্ষ সমীপে আমাদের মতামত উত্থাপিত করলাম।

শিক্ষাঙ্গনে অপবিত্রতাঃ ছাত্র নামধারীদের উশৃংখলতা

ধীরে ধীরে এটা একটা রেওয়াজে পরিণত হতে চলেছিল। কোনো না কোনো অজুহাত তুলে পরীক্ষা বন্ধ রাখা অথবা অবাধে নকল চালিয়ে যাবার সুযোগ দাবি। মূলত উশৃংখল এক শ্রেণীর ছাত্রই এর উদ্যোক্তা। এরাই উদ্যোগ গ্রহণ করে শান্তি প্রিয় ছাত্রদের পরীক্ষার দানে বাধা সৃষ্টি করে অথবা পরীক্ষা হলের পরিবেশকে করে তোলে অপবিত্র। অভিভাবকরা দীর্ঘদিন ধরে শংকিত প্রহর গুনে আসছিলেন। ব্যাহত দুষ্কর্মের হোতা ছাত্র-ছাত্রীদের ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র একটা অংশের প্রভাব এত বেশি প্রতীয়মান হচ্ছিল যে ক্ষেত্র বিশেষে স্থানীয় প্রশাসনও অনেক সময় নিজেদের অসহায় বোধ করছিলেন।
স্বাধীনতা-পূর্ব কালে সরকারের পক্ষপুটে আশ্রিত ছাত্রনামধারী একশ্রেণীর গুন্ডা প্রথম আমাদের দেশে শিক্ষায়তন গুলিতে উশৃংখলতা আমদানি করে। তাদের এই উশৃঙ্খলতার বিরুদ্ধে প্রগতিশীল ছাত্র সমাজ বরাবরই সোচ্চার ছিল। কিন্তু স্বাধীনতা পরবর্তীকালে সেই প্রগতিশীল ছাত্র শক্তিকে সংহত ভাবে শিক্ষাঙ্গনে উশৃঙ্খলতার বিরুদ্ধে কোন প্রকার প্রতিরোধ গড়ে তুলতে দেখা যায়নি। বরং তথাকথিত ছাত্র নেতাদের কেউ কেউ শিক্ষাঙ্গনের পরিবেশ কলুষিত করার ব্যাপারে প্রত্যক্ষ অথবা পরোক্ষভাবে ইন্ধন জুগিয়ে এসেছেন।
আমরা এদের নিন্দা করছি, এতে করে কোনো কোনো সময় সেই ছাত্র নামধারী উশৃংখল তরুণরা আমাদের উপর ক্ষুব্ধ হয়েছেন। কিন্তু আমরা বিশ্বাস করি আজকের এই উশৃংখল তরুণদেরও মানসিকতা একদিন পরিবর্তিত হবে। তারা উপলব্ধি করতে পারবেন তাদের বিচ্যুতি সমাজে কি অবাঞ্ছিত এবং অশুভ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করেছে।
সাতই সেপ্টেম্বর মাধ্যমিক স্কুল সার্টিফিকেট পরীক্ষা শুরু হবার পর কোন কোন স্থানে গুটিকতক উশৃংখল ছাত্র অবাঞ্ছিত কিছু ঘটনা ঘটার প্রয়াস পায়। রাজশাহীতে কিছু ছাত্র প্রশ্নপত্র কঠিন হয়েছে এই অজুহাত তুলে পরীক্ষা বর্জন করে এবং অন্যান্য পরীক্ষার্থীদের হল ত্যাগে বাধ্য করে। এরপর তারা অন্যান্য পরীক্ষা কেন্দ্রে গিয়ে সেখানে পরীক্ষারত ছাত্র-ছাত্রীদের হল থেকে বেরিয়ে আসার আহ্বান জানায়। পরীক্ষা বর্জনের ছাত্র-ছাত্রীদের তারা বল প্রয়োগ করতে কসুর করেনি।
প্রশাসন কর্তৃপক্ষ অবশ্য পুলিশ এবং রক্ষী বাহিনীর সহযোগিতায় পরিস্থিতি আয়ত্তে আনতে সক্ষম হন। হলত্যাগী ছাত্রছাত্রীরা বিকেল পাঁচটায় পুনরায় পরীক্ষা দান শুরু করেন। আইন শৃঙ্খলা ভঙ্গের অভিযোগে পরীক্ষার্থীসহ সতের জনকে পুলিশ গ্রেফতার করে।
এমনই অবস্থা যখন রাজশাহীতে তখন সারা দেশে প্রায় সোয়া তিনশ পরীক্ষার্থীকে অসদুপায় অবলম্বনের অভিযোগে বহিষ্কার করা হয়েছে। পরীক্ষা হলের চারিদিকে শুধু ১৪৪ ধারা জারি করেই প্রশাসন কর্তৃপক্ষ নিশ্চিত হতে পারেনি, পুলিশ এবং অন্য স্থানে রক্ষী বাহিনী মোতায়েন করতে হয়েছে।
নিঃসন্দেহে এসব শিক্ষায়তন গুলো তথা শিক্ষার্থীদের পক্ষে খুব একটা গৌরবজনক ব্যাপার নয়। পাকিস্তান আমলের শিক্ষাঙ্গনে পুলিশ অথবা আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী অন্য কোন সংস্থান লোকদের প্রবেশকে অপমানজনক মনে করা হতো। সে আমলে বিশেষ করে প্রগতিশীল ছাত্র আন্দোলন স্তব্ধ করার জন্যই তদানীন্তন গণবিরোধী স্বৈরাচারী সরকার কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় পুলিশ পাঠাতেন। এখন যদি স্বাধীন দেশে পুলিশ এবং রক্ষী বাহিনী নিয়োগই ছাত্র-ছাত্রীদের নিরাপত্তা এবং পবিত্রতা রক্ষার গ্যারান্টি হিসেবে জনসাধারণ তথা অভিভাবকদের কাছে বিবেচিত হতে থাকে তবে তার চাইতে পরিতাপের বিষয় আর কিছু হতে পারে না।
আমরা সাধারণ ছাত্রছাত্রী বিশেষ করে প্রগতিশীল ছাত্র সংগঠনগুলো দৃষ্টি এদিকে আকর্ষণ করছি। গুটিকতক শৃংখল ছাত্রনামধারী তরুণ ইতিমধ্যেই ছাত্র-ছাত্রীদের ভাবমূর্তি নষ্ট করে দিয়েছে। বিগত বত্রিশ মাস ছাত্রসংগঠনগুলোর তরফ থেকে ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধ গড়ে না উঠায় শিক্ষায়তনে উশৃংখলতা বন্ধ করতে প্রশাসনিক কর্তৃপক্ষকে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থাগুলোর সহযোগিতা কামনায় উৎসাহিত করেছে। এ অবস্থার অবশ্যই অবসান ঘটাতে হবে। শিক্ষায়তন গুলিতে যেমন উশৃংখলতা প্রশ্রয় দেয়া যায় না তেমনি তা প্রতিরোধে পুলিশ এবং রক্ষী বাহিনী নিয়োগ দৃষ্টিকটুর। কারণ দুটোই শিক্ষাঙ্গনের পবিত্রতা এবং পরিবেশ বিনষ্ট করে। আমরা বিশ্বাস করি প্রগতিশীল ছাত্র সমাজ এবং ছাত্র সংগঠন যদি এ ব্যাপারে দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করেন তবে আমরা এই অবাঞ্চিত পরিস্থিতি কাটিয়ে উঠতে পারব।

কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক

পত্রিকার মূল কপি পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!